কোটা সংস্কারের আন্দোলন থেকে গণপ্রতিরোধ: ঘটনাপ্রবাহ এবং কারণ অনুসন্ধান
সালমান সিদ্দিকী
আজি কারার সারাদেহে মুক্তি–ক্রন্দন
ধ্বনিছে হা হা– স্বরে ছিঁড়িতে বন্ধন
—নজরুল
কোটা সংস্কারের আন্দোলন এখন আর শুধু নির্দিষ্ট গণ্ডিতে আবদ্ধ নেই। বন্দী মানুষ মুক্তির আশায় রাস্তায় নেমে পড়েছে। কে নেই এই মিছিলে? ছাত্র, অভিভাবক, শিক্ষক, কারখানার শ্রমিক, হোটেল বয়, রিকশা চালক সবাই আজ রাস্তায়। ছাত্ররা জানে তারা ভালো নেই। ক্যাম্পাসগুলোতে ক্ষমতাসীনদের কাছে প্রতিদিনকার পরাজিত জীবন! পড়াশোনা শেষ করলেও চাকরি নেই,ভবিষ্যত নেই। মানুষ জানে, তারা দু’ মুঠো খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। বাজারে জিনিসপত্রের দাম আকাশ ছোঁয়া। ভোটাধিকার তো আগেই হরণ করা হয়েছে। কথা বলার অধিকার নেই। বিরোধী দল-মতকে দমন করা হচ্ছে। চলছে গুম-খুন, নির্যাতন। সরকার উন্নয়নের বাণী প্রচার করছে কিন্তু সাধারণ মানুষের জীবনে উন্নতির বিন্দুমাত্র ছাপ নেই। মানুষ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, শাসক আওয়ামীলীগ দেশটাকে লুটপাট আর জুলুমের রাজত্বে পরিণত করেছে। মানুষ মুক্তি পিয়াসায় ছটফট করছে! এই প্রেক্ষাপট বিবেচনায় রেখে কোটা সংস্কার আন্দোলনের বিষয়টি বোঝার চেষ্টায় এই লেখায় এই আন্দোলনের ঘটনাপ্রবাহ ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরে এই আন্দোলনের ঐতিহাসিক গণ আন্দোলনে পরিণত হবার কারণ অনুসন্ধান করা হয়েছে।
সর্বজনকথা ১০ম বর্ষ: ৪র্থ সংখ্যা (আগস্ট- অক্টোবর ২০২৪)
কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে গণঅভ্যুত্থান- ঘটনার ধারাক্রম, মতামত, বিশ্লেষণ
জুলাই হত্যাকান্ড: ইন্টারনেটবিহীন প্রপাগান্ডা-ভিশন- মোশাহিদা সুলতানা
কোটা সংস্কার আন্দোলন, কর্তৃত্ববাদ ও নৃশংসতা- কল্লোল মোস্তফা
কোটা সংস্কার আন্দোলন, সরকারের নিপীড়ন ও নৃশংসতার টাইমলাইন
কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে গণঅভ্যুত্থান
২০১৮-র পরে বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণে দ্বিতীয় পর্বে কোটা সংস্কার আন্দোলন খুবই শান্তিপূর্ণভাবে অগ্রসর হচ্ছিল। কিন্তু সরকারের দিক থেকে ছিল উপেক্ষা, কালক্ষেপন এবং হাইকোর্ট দেখানোর খেলা। গত ১৪ই জুলাই প্রধানমন্ত্রী এই আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্যে খুবই আপত্তিকর বক্তব্য দেবার পর ঘটে বিস্ফোরণ। সেদিন রাতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে আরও বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থী রাস্তায় বের হন। পরের দিন ওবায়দুল কাদেরের ঘোষণা অনুযায়ী ছাত্রলীগ যুবলীগ যখন হামলা শুরু করে তখন এই প্রতিরোধ দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। তাদের হামলার সাথে সাথে শুরু হয় পুলিশ র্যাব বিজিবির অভিযান।
এরপর অবিশ্বাস্য সব ঘটনা ঘটতে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে মহাপরাক্রমশালী সার্বক্ষনিক অত্যাচারী ছাত্রলীগ নেতাদের বের করে দেয়া, পঞ্চাশের অধিক ছাত্রলীগ নেতার সংগঠন থেকে পদত্যাগ, স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা ও কয়েক ঘন্টার মধ্যে হল ত্যাগের নির্দেশ, শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়নের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে লীগ সন্ত্রাসী সহযোগে পুলিশ র্যাব বিজিবির আক্রমণ। মনে হচ্ছিল সরকার জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। এরপরের কয়দিন নির্বিচার হত্যাকান্ডে ছাত্রলীগ-যুবলীগ-পুলিশ-বিজিবির সম্মিলিত ভূমিকা দেখা যায়।
অনেক রক্ষণশীল হিসাবেও নিহতের সংখ্যা দুই শ অতিক্রম করেছে, এখনও অনেকে নিখোঁজ, যাদের অধিকাংশই তরুণ, এদের মধ্যে শিশু কিশোরও আছে। আন্দোলনকারীদের প্রহারে পুলিশ মৃত্যুর ঘটনাও আছে। গুলি হামলা বৃদ্ধির সাথে সাথে প্রতিবাদী শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াতে থাকে শ্রমজীবীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ, বাংলাদেশের ইতিহাসে সৃষ্টি হয় আরেক গণঅভ্যুত্থান। টিকে থাকার উন্মাদনায় সরকার কার্ফু দিয়ে সেনাবাহিনী নামায়, হেলিকপ্টার থেকে নিরস্ত্র মানুষের ওপর আক্রমণও চলে।
বস্তুত অনেকরকম ক্ষোভ একসাথে হয়ে এই সর্বব্যাপী প্রতিরোধের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। একদিকে প্রাপ্য কর্মসংস্থানের সংকট, তার পাশে নিয়োগ বাণিজ্য, প্রশ্নফাঁস সর্বোপরি কোটা তরুণদের বড় হতাশা আর অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে। এর বাইরে একদিকে লাগামহীন একটানা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে নাজেহাল মানুষ অন্যদিকে অবিশ্বাস্য দুর্নীতিতে ফুলে ফেঁপে সরকার ঘনিষ্ঠ ক্ষমতাবান কতিপয় গোষ্ঠীর দেশ বিদেশে ক্ষমতার বিস্তার। একদিকে নির্বাচন নির্বাসনে পাঠিয়ে জবরদস্তিমূলক সরকার বসে আছে, অন্যদিকে সকল ক্ষেত্রে তাদের জুলুমের শিকার হতে হচ্ছে মানুষকে।
মুক্তিযুদ্ধের আগে পরে আর কোনো আন্দোলনে এত প্রাণহানি হয়নি, নিষ্ঠুরতায় এই সরকার আগের সব সরকারকে অতিক্রম করেছে। পুরো দেশকে ক্ষতবিক্ষত ও রক্তাক্ত করার পর সরকার কোটা সংস্কারের দাবি মেনে নিচ্ছে, তাও একতরফাভাবে। কিন্তু এই হত্যাকান্ড আর জুলুম সেই সাথে দেশের সম্পদ ধ্বংসের মূল দায় সরকারের ওপরই বর্তায়।
এই সংখ্যায় ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে গণঅভ্যুত্থান’ এই শিরোনামে সংবাদপত্রের খবর ধরে ঘটনার ধারাক্রম ছাড়াও এই বিষয়ে একাধিক ব্যক্তিগত মতামত, বিশ্লেষণ, ছবি, কার্টুনসহ বিভিন্ন বক্তব্য সংকলিত করা হচ্ছে। এর কয়েকটি অনলাইনে আগাম প্রকাশ করা হচ্ছে।
জুলাই হত্যাকান্ড: ইন্টারনেটবিহীন প্রপাগান্ডা-ভিশন- মোশাহিদা সুলতানা