অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত
মোশাহিদা সুলতানা

গত ২০শে জানুয়ারি ২০২৫ সর্বজনকথার আয়োজনে “স্বৈরতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রের পথ: বৈষম্যহীন বাংলাদেশের সন্ধানে” শিরোনামে দিনব্যাপী সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বৈষম্য, কৃষকের ন্যায্য মূল্য ও খাদ্যপণ্যের সিন্ডিকেট, পাঁচ দশকে শিল্পায়নের সমস্যা, বৈষম্য নিরসনে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের ভূমিকা, উচ্চশিক্ষার সংকট, জনস্বাস্থ্যের সংকট, লিঙ্গীয় বৈষম্যের নানান রূপ, জাতিগত সংকট নিরসনে করণীয় এবং বাংলাদেশে ধর্মীয় সম্প্রীতির পথে বাধা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এই লেখা সর্বজনকথা সেমিনারে উপরোক্ত বিষয়ে উপস্থাপিত বক্তব্যের লিখিত ও পরিমার্জিত রূপ।
অর্থনৈতিক বৈষম্য নিরসনের প্রসঙ্গ এলেই দারিদ্র্য বিমোচনে করণীয় নিয়ে আলোচনা হয়। গতানুগতিক চিন্তাধারায় বৈষম্য নিরসনকে দেখা হয় একরৈখিক দৃষ্টিকোণ থেকে। ধরে নেওয়া হয় যে, দেশে বিদেশি বিনিয়োগ হলেই নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হবে, মানুষের জীবিকার পথ তৈরি হবে। অথবা অবকাঠামো নির্মাণ হলে তা থেকে সকল শ্রেণির মানুষ উপকৃত হবে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়বে, বৈষম্য দূর হবে। আরেকটি ধারণাও গত কয়েক দশকে প্রাধান্য পেয়েছে, তা হলো ক্ষুদ্রঋণ। এই ধারণা অনুযায়ী ক্ষুদ্রঋণ দিয়ে মানুষকে উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ দিলে আয়বৈষম্য দূর হবে। জাতিসংঘের উন্নয়ন দর্শন অনুসরণ করে সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল ও পরে মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল পূরণ করার প্রতিও আগের সরকারগুলো জোর দিয়েছিল। কিন্তু এই সবকিছুই বৈষম্য দূর করতে পারেনি। কারণ, কাঠামোগতভাবে যে বৈষম্য তৈরি করা হয়েছে তার উৎস সন্ধান করতে না পারলে ও তা দূরীকরণে নীতি বাস্তবায়ন না করলে আসলে বৈষম্য নিরসন রয়ে যাবে একটি দূরবর্তী বিষয়।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের ভূমিকা: বৈষম্যের স্বরূপ
অর্থনৈতিক বৈষম্য নিরসনে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত কী ভূমিকা রাখতে পারে তা নিয়ে আমি আলোচনা করব। তার আগে জানা প্রয়োজন বৈষম্যের স্বরূপটি কেমন। বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি এবং গ্যাস ও তেলের দাম বৃদ্ধি সবকিছুই আমাদের জনজীবনে বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। মূল্যস্ফীতি বাড়ার প্রাথমিক কারণ ছিল জ্বালানি ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি। সংকট মোকাবিলার জন্য অপ্রস্তুত ছিল বাংলাদেশ। কারণ, দীর্ঘদিনের জ্বালানি নীতি বাংলাদেশকে করে তুলেছে আমদানিনির্ভর। উপরন্তু বাংলাদেশ ক্রমান্বয়ে দেশি-বিদেশি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর কাছে আরও বেশি জিম্মি হয়েছে গত দুই দশকে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়ার কারণে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পায় এবং এ থেকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শ্রমজীবী মানুষ। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি হলে কৃষির উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পায়, পরিবহণ খরচ বাড়ে। ফলে খাদ্যদ্রব্যের মূল্যও বাড়ে। কাজেই সবকিছুর মূলে রয়েছে জ্বালানির দাম। শ্রমজীবী মানুষের আয়ের একটা বড় অংশ ব্যয় হয় প্রতিমাসে রান্নার জন্য এলপিজি কিনতে। আমরা এলপি গ্যাস ২০০০-এর দশক থেকে ব্যবহার করা শুরু করেছি। এলপি গ্যাসের দাম বাড়লে খাদ্যের খরচ বাড়ে। এলপি গ্যাসও বৈষম্য সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। গ্রামে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের অভাব রয়েছে। কিন্তু শহরে আবার সরবরাহ বেশি। এখানেও রয়েছে বৈষম্য। অন্যদিকে শহরের অভিজাত এলাকাগুলোতে বিদ্যুৎ সরবরাহ যেখানে নিরবচ্ছিন্ন থাকে, সেখানে দেখা যায় নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের এলাকায় লোডশেডিং হয় বেশি।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়ার কারণে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পায় এবং এ থেকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শ্রমজীবী মানুষ। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি হলে কৃষির উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পায়, পরিবহণ খরচ বাড়ে। ফলে খাদ্যদ্রব্যের মূল্যও বাড়ে। কাজেই সবকিছুর মূলে রয়েছে জ্বালানির দাম।
সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে গ্যাস সরবরাহ না দিয়ে, কুইক রেন্টাল বা বিদেশি বিনিয়োগে নির্মিত বিদ্যুৎ প্রকল্পে গ্যাস সরবরাহ দিয়ে আসছে সরকার। এ কারণে আমাদের রাষ্ট্রায়ত্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলো নানাভাবে বঞ্চিত হচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। এখানে বিদেশি বা রেন্টাল, কুইক রেন্টালগুলোকে বেশি সুবিধা দেওয়া হয়। আবার আমরা আরেকটা বৈষম্য এখানে দেখছি। সেটা হচ্ছে বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি বাপেক্সকে বাদ দিয়ে বিদেশি কোম্পানি যেমন: গ্যাজপ্রমকে বেশি খরচে গ্যাস উত্তোলন করতে দেওয়া হয়। এটা শুধু গ্যাজপ্রমের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়; আরও যেসব বিদেশি কোম্পানি বাংলাদেশে কাজ করছে তারাও কিন্তু অনেক বেশি কনসালটেন্সি ফি এবং বেশি খরচে উৎপাদন করছে।
সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে গ্যাস সরবরাহ না দিয়ে, কুইক রেন্টাল বা বিদেশি বিনিয়োগে নির্মিত বিদ্যুৎ প্রকল্পে গ্যাস সরবরাহ দিয়ে আসছে সরকার। এ কারণে আমাদের রাষ্ট্রায়ত্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলো নানাভাবে বঞ্চিত হচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। এখানে বিদেশি বা রেন্টাল, কুইক রেন্টালগুলোকে বেশি সুবিধা দেওয়া হয়।
এখন নতুন সংযোগ যাদের দেওয়া হচ্ছে তাদের কাছ থেকে বেশি দাম নেওয়া হচ্ছে। আবার একদিকে রাজস্ব আয়ের বড় একটা অংশ যখন অলস বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধে ব্যয় হয়, তখন অন্যদিকে জনগণ বেশি দাম দিয়ে বিদ্যুৎ কিনছে। অর্থাৎ এখানে সিস্টেমের মধ্যে লিকেজ তৈরি করা হয়েছে। অনেকেই বলেন, বাজার অর্থনীতি প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করে এবং বৈষম্য নিরসন করতে সাহায্য করে। প্রকৃত অর্থে যদি প্রতিযোগিতা থাকত তাহলে দাম কমত। কিন্তু এখানে তো আসলে ঠিক প্রতিযোগিতা নেই। এখানে রয়েছে অসম প্রতিযোগিতা। এবং সেই অসম প্রতিযোগিতার সুযোগ নিয়ে গোষ্ঠীবদ্ধ শাসক শ্রেণি বিভিন্নভাবে ব্যবসায়ী শ্রেণির সঙ্গে আঁতাত করার মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের লুটপাটের অংশীদার হয়েছে। এবং সেটার আবার একটা বড় কারণ এখানে বৈষম্য থাকার।
পরিবেশবিধ্বংসী বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো আমাদের এখানে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াচ্ছে। এবং নিম্ন আয়ের মানুষ স্বাস্থ্য বিপর্যয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের চিকিৎসার অভাব, আয়ের অভাব–খরচ করতে পারছে না স্বাস্থ্যের পেছনে, পুষ্টিকর খাবার খেতে পারছে না তারা। কয়লার ব্যবহার বায়ু ও নদীদূষণ বাড়াচ্ছে। পায়রা, মাতারবাড়ি, রূপপুর, রামপাল প্রকল্প এবং বিভিন্ন সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণকৃত জমি থেকে সরিয়ে দেওয়া জনগোষ্ঠী আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টিতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বড় ভূমিকা রয়েছে ।
পরিবেশবিধ্বংসী বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো আমাদের এখানে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াচ্ছে। এবং নিম্ন আয়ের মানুষ স্বাস্থ্য বিপর্যয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের চিকিৎসার অভাব, আয়ের অভাব–খরচ করতে পারছে না স্বাস্থ্যের পেছনে, পুষ্টিকর খাবার খেতে পারছে না তারা।
গত ১৫ বছরে কী হয়েছে? অন্তর্বর্তী সরকার কী করেছে?
মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে আমরা দেখছি যে গ্যাসের পরিবর্তে আমদানিকৃত এলপিজির ব্যবহার বেড়েছে। নিম্নবিত্ত পরিবারগুলো বেশি দামে সিলিন্ডার ও এলপিজি কিনতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। এদিকে ১৫ বছরে বিদ্যুতের দাম ১৪ বার বেড়েছে এবং বিদ্যুতের গড় উৎপাদন ব্যয় চার গুণ ছাড়িয়েছে। আবার বাল্ক বিদ্যুতের দাম বেড়েছে প্রায় ১৮৩ শতাংশ ও গ্রাহক পর্যায়ে প্রায় ১৮১ শতাংশ। এভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমে গেলেও সরকার তেলের দাম বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি করার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। অথচ সিপিডির এক গবেষণায় দেখা গেছে, এখন বাংলাদেশে যে তেলের মূল্য সেটা এখনো ১৫ টাকা করে কমানো সম্ভব। এই সমস্ত দিক থেকে আমরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছি। আবার অন্যদিক থেকে উৎপাদন না করেও অলস বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়ে যাচ্ছে।
গ্যাসের পরিবর্তে আমদানিকৃত এলপিজির ব্যবহার বেড়েছে। নিম্নবিত্ত পরিবারগুলো বেশি দামে সিলিন্ডার ও এলপিজি কিনতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। এদিকে ১৫ বছরে বিদ্যুতের দাম ১৪ বার বেড়েছে এবং বিদ্যুতের গড় উৎপাদন ব্যয় চার গুণ ছাড়িয়েছে। আবার বাল্ক বিদ্যুতের দাম বেড়েছে প্রায় ১৮৩ শতাংশ ও গ্রাহক পর্যায়ে প্রায় ১৮১ শতাংশ।
ব্যয়বহুল রান্নায় এলপি গ্যাস – শ্রমজীবী মানুষের জন্য বৈষম্য তৈরি করে। মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ১১ শতাংশের বেশি মানুষ এখন এলপি গ্যাস ব্যবহার করছে এবং বর্তমানে ১২ কেজি সিলিন্ডার বিক্রি হয় ১ হাজার ৪৫৫ টাকায়। একজন গার্ডেনার বা টি-বয়ের ন্যূনতম মজুরি যদি আমরা দেখি সেটা যদি ১২ হাজার ৮০০ টাকা হয়, তাহলে ১২ কেজি এলপিজি সিলিন্ডারের দাম তার মাসিক আয়ের ১১ শতাংশ। এবং সদস্য কতজন সেটা ভেদে এই ১২ কেজির সিলিন্ডার কতদিন চলবে সেটা নির্ধারণ করা হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, অনেক পরিবারে এক মাসের আগেই ১২ কেজি সিলিন্ডার শেষ হয়ে যায়। কাজেই এটা একটা বড় ধরনের খরচ, যেটা মানুষের ওপর আর্থিকভাবে চাপ সৃষ্টি করছে। অন্যদিকে একজন সরকারি কর্মকর্তার মাসিক বেতন যদি হয় ১ লাখ টাকা, তাহলে এই খরচ তার মাসিক আয়ের ১.৪ শতাংশ। শুধু সরকারি চাকরিজীবী নন, বরং সব ধরনের মানুষের জন্যই এলপিজির দাম কমানো উচিত।
গ্রাম ও শহরে অনেক মানুষ তাই এখনো গোবর ও গাছের ডাল পুড়িয়ে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে রান্না করে এবং এর অনুপাত প্রায় ৭০ শতাংশ। কাজেই বাংলাদেশে এখনো ৭০ শতাংশ মানুষ আসলে এ ধরনের কমার্শিয়াল জ্বালানির আওতার বাইরে রয়েছে। তারা বিভিন্ন ধরনের অসুখ-বিসুখে ভুগছেন। এলপি গ্যাস বাজারে অসম প্রতিযোগিতা বিরাজ করছে। ২৫টি কোম্পানি সক্রিয় রয়েছে আমদানিতে, প্রতিযোগিতার কথা থাকলেও দাম নিয়ন্ত্রণ করে এই কোম্পানিগুলো। এবং রিজার্ভ সংকটের সময় যখন এলসি খোলা যায় না তখন এই সংকটকে কাজে লাগিয়ে বাজারে তারা একটা অস্থিরতা তৈরি করে। বেশিরভাগ সময় দেখা যায়, সরকার তখন দাম নির্ধারণ করে দিলেও বেশি দামে বিক্রি হয় বাজারে। আমরা এরকম উদাহরণও দেখেছি যে এলপিজি আমদানি করতে গিয়ে প্রায় আট মাসে ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। আমদানি নির্ভরতার আরেকটা দিক হলো, এর সঙ্গে অর্থ পাচারও যুক্ত হচ্ছে।
বিদ্যুৎ সরবরাহেও বৈষম্য রয়েছে। আমরা যদি দেখি দাবদাহের মধ্যে লোডশেডিংয়ের চিত্র এক দেশে দুই রকম। গ্রামে আর শহরের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। লোডশেডিং গ্রামে বেশি হচ্ছে – মাঝে মাঝে ৫-৬ ঘণ্টাও গ্রামে বিদ্যুৎ থাকে না। অথচ আমরা নাকি শতভাগ বিদ্যুৎ সক্ষমতা অর্জন করেছি। আবার এদিকে দেখা যায়, রেকর্ড বিদ্যুৎ উৎপাদনেও গ্রামে যে লোডশেডিং সেটা দিন দিন বাড়ছে। শতভাগ বিদ্যুতায়নের পরও আমরা তাহলে প্রশ্ন করতে পারি: গ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহে বিঘ্ন ঘটে কেন? এখন মনে হতে পারে যে এই বিঘ্ন ঘটার কারণ আমাদের জ্বালানির অভাব আর সে কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। হ্যাঁ, সেটা এখন হচ্ছে। কিন্তু তার আগে যখন ২০২০ সালে শতভাগ বিদ্যুতের ঘোষণা সরকার দিয়েছিল তখন কেন বিদ্যুৎ সরবরাহে বিঘ্ন ঘটেছিল? আমরা দেখেছি ৮০ শতাংশ বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকে কেবল নিম্নমানের যন্ত্রাংশ ও অবকাঠামোর জন্য। এটার সঙ্গে লোডশেডিংয়ের কোনো সম্পর্ক নেই। লোডশেডিং কিন্তু আরেকটা বিষয়। সেটা আবার দেখা গেছে যে কোনো কোনো জায়গায় – যেমন: ময়মনসিংহে ৫০ শতাংশ লোডশেডিং হচ্ছে, আবার অন্য এলাকায় ৩৫ শতাংশ। এরকম গ্রামের মানুষ কিন্তু নানাভাবে এখানে বিদ্যুৎ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
লোডশেডিং গ্রামে বেশি হচ্ছে – মাঝে মাঝে ৫-৬ ঘণ্টাও গ্রামে বিদ্যুৎ থাকে না। অথচ আমরা নাকি শতভাগ বিদ্যুৎ সক্ষমতা অর্জন করেছি। আবার এদিকে দেখা যায়, রেকর্ড বিদ্যুৎ উৎপাদনেও গ্রামে যে লোডশেডিং সেটা দিন দিন বাড়ছে।
বস্তুত পল্লী বিদ্যুতের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় দ্বৈত ব্যবস্থাপনার কারণে এই বৈষম্য বিরাজ করছে। আমরা অনেক সময় মনে করি এটা শুধুই অর্থনৈতিক নীতি। এটা শুধুই দাম নিয়ন্ত্রণের বিষয় না। এখানে প্রাতিষ্ঠানিক বিষয়গুলোও আছে যেগুলো আসলে শোষণ এবং বৈষম্যের জন্ম দিয়ে থাকে। যেমন: পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড পল্লী বিদ্যুৎ এলাকায় বিতরণের অবকাঠামো নির্মাণ করে। কিন্তু কোনো সমস্যা হলে গ্রাহক পর্যায়ে অভিযোগ শুনতে হয় পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিকে। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মচারীরা পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের কারণে মাঝে মাঝে মারধরেরও শিকার হন। আবার পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড নিম্নমানের যন্ত্রপাতি ক্রয় করায় বিদ্যুৎ বিতরণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কিন্তু এর দায় নিতে হয় সমিতিগুলোকে। কাজেই শোষণ ও বৈষম্যের শিকার যে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি তাদেরকে বৈষম্যমুক্ত না করে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো পুনর্মূল্যায়ন না করে এমন দ্বৈত ব্যবস্থার যে কাঠামো বিরাজ করছে তার যদি পরিবর্তন না করি, সংস্কার না করি; তাহলে এই পল্লী বিদ্যুতের উন্নয়ন সম্ভব হবে না। এটা একটা বড় বাধা হিসেবে রয়েছে। অনিয়মিত শ্রমিক নিয়োগ হয়, তাদের চিকিৎসাসেবা ও ছুটি থেকে বঞ্চিত করা হয়, কাজ নাই মজুরি নাই শর্তে নিয়োগ দেওয়া হয়। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য এটাও বড় ধরনের অন্তরায়। লাইনম্যানরা দুর্ঘটনার শিকার হলে তাদেরকে ক্ষতিপূরণও দেওয়া হয় না। অনিয়মিত নারী কর্মীরা গর্ভকালীন বিনা বেতনে ছুটি নিতে বাধ্য হন। কারণ, তারা ছুটি পান না। এগুলোর সমাধান চাইলে, সংস্কার চাইলে নির্বিচারে বদলি, চাকরিচ্যুতি, মামলা, স্ট্যান্ড রিলিজ ইত্যাদি করা হয়।
পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মচারীরা পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের কারণে মাঝে মাঝে মারধরেরও শিকার হন। আবার পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড নিম্নমানের যন্ত্রপাতি ক্রয় করায় বিদ্যুৎ বিতরণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কিন্তু এর দায় নিতে হয় সমিতিগুলোকে।
অক্টোবর মাসে আমরা দেখেছি যে কীভাবে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিগুলো থেকে প্রায় ২৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল তারা এগুলো নিয়ে আন্দোলন করেছিল এবং তাদের অধিকার নিয়ে কথা বলেছিল বলে। এ সকল বৈষম্য নিয়ে সরব হয়ে গেলে আওয়ামী লীগ আমলে আমরা দেখেছি দুজনকে বিএনপি-জামায়াত সংশ্লিষ্টতা দেখিয়ে বরখাস্ত করা হয়েছে। ২০২৪ সালে আবার আমরা দেখেছি আওয়ামী সম্পৃক্ততা দেখিয়ে ২৪ জনকে বরখাস্ত করা হয়েছে। কাজেই এখানে যে দুঃশাসন বিরাজ করছে, বৈষম্য শোষণের যে কাঠামো বিরাজ করছে এটাকে পরিবর্তন করতে হবে। একটা জাতীয় কমিটি করা হয়েছে। কিন্তু তারাও কতটুকু নিরপেক্ষ প্রতিবেদন দেবে, সেটা নিয়েও আমাদের সন্দেহ রয়েছে। কাজেই এই জায়গাগুলো আমাদের দেখতে হবে। আরও লক্ষণীয় যে দুই মাস জেল খেটে যারা ছাড়া পেয়েছে তারা এখনো চাকরিই ফেরত পায়নি। এটা তাদের জন্য একটা বড় ধরনের বৈষম্য। এই বৈষম্যগুলো নিরসন না করে অর্থনৈতিক বৈষম্যের আলাপ অসম্পূর্ণ।
বৈষম্য নিয়ে সরব হয়ে গেলে আওয়ামী লীগ আমলে আমরা দেখেছি দুজনকে বিএনপি-জামায়াত সংশ্লিষ্টতা দেখিয়ে বরখাস্ত করা হয়েছে। ২০২৪ সালে আবার আমরা দেখেছি আওয়ামী সম্পৃক্ততা দেখিয়ে ২৪ জনকে বরখাস্ত করা হয়েছে।
আগেও বলেছি যে, সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে না দিয়ে বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে গ্যাস দেওয়া হচ্ছে। একটা উদাহরণ দেওয়া যায়, আশুগঞ্জের ১ হাজার ৩১৫ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসিয়ে রেখে রিলায়েন্সকে গ্যাস সরবরাহ দেওয়া হচ্ছে। এটা শুধু একটা দৃষ্টান্ত মাত্র। এরকম বহু দৃষ্টান্ত আমরা দেখে এসেছি। তারা আবার ক্যাপাসিটি চার্জও নিচ্ছে। বেসরকারি খাতে ভর্তুকি দিয়ে উৎসাহিত করা হয়েছে। রেন্টাল এবং কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো উৎপাদন না করেও বিপুল পরিমাণ ক্যাপাসিটি চার্জ আদায় করে নিয়েছে। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত আমদানি নির্ভর হয়ে গিয়েছে। বিদেশি ঋণনির্ভর কয়লা, এলএনজি ও পারমাণবিক প্রকল্প নির্মাণ শুরু হয়েছে। এবং দেশীয় গ্যাস উত্তোলনকে একেবারেই অবহেলা করা হয়েছে। যে কারণে এখন গ্যাসের সংকট বিদ্যমান।
ডলারের দাম এবং একইসঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ পড়ছে। সে কারণে জ্বালানির অভাবে সব বিদ্যুৎ কেন্দ্র চলছে না। ১৫ বছরে মেগা প্রকল্পে বাংলাদেশ প্রচুর ঋণ নিয়েছে। এই ঋণ বৈষম্য সৃষ্টির আরেকটি উৎস। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য রাশিয়া থেকে ঋণ নেওয়া হয়েছে ১১.৩৮ বিলিয়ন ডলার। মাতারবাড়ি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য জাপানের কাছ থেকে ঋণ নেওয়া হয়েছে ৪.৪ বিলিয়ন ডলার। পায়রা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ১.৯৮ বিলিয়ন ডলার এবং রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ১.৬ বিলিয়ন ডলার। এই বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার – এগুলো কিন্তু পরিশোধ করতে হবে জনগণকেই। আবার বেশি দামে একইসঙ্গে বিদ্যুৎও কিনতে হবে। কাজেই দুদিক থেকেই বাংলাদেশের মানুষ আসলে বড় ধরনের নিষ্পেষণের শিকার।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য রাশিয়া থেকে ঋণ নেওয়া হয়েছে ১১.৩৮ বিলিয়ন ডলার। মাতারবাড়ি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য জাপানের কাছ থেকে ঋণ নেওয়া হয়েছে ৪.৪ বিলিয়ন ডলার। পায়রা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ১.৯৮ বিলিয়ন ডলার এবং রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ১.৬ বিলিয়ন ডলার।
গত সরকারের আমলে কতগুলো জনস্বার্থবিরোধী আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। যেমন: বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের কাছ থেকে মূল্য নির্ধারণের ক্ষমতা সরিয়ে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। দ্রুত জ্বালানি আইন ২০১০-এর অধীন প্রতিযোগিতামূলক বিডিং বাদ দিয়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় কুইক রেন্টালকে বেশি দামে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে দেওয়া হয়েছে। এটমিক এনার্জি অ্যাক্ট ২০১৫ অনুযায়ী, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরামর্শক ও কর্মকর্তাদের দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। এগুলোয় কোনো দুর্ঘটনা হলে তারা সবাই দায়মুক্ত। দায় কারা নেবেন? দেশের মানুষ।
গত দেড় দশকে বহিঃশক্তির প্রভাব এখানে বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারত থেকে তেল আমদানির জন্য এখানে পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি ইস্টার্ন রিফাইনারিকে বাদ দিয়ে এস আলম গ্রুপের সঙ্গে রিফাইনারি নির্মাণের চুক্তি করা হয়েছিল। এটি বাতিল করার পর এখন আবার চেষ্টা করা হচ্ছে সৌদি আরবের একটা কোম্পানিকে দিয়ে দেওয়ার। আবার বাপেক্সকে বাদ দিয়ে গ্যাজপ্রমকে কূপ খননের কাজ দেওয়া হয়েছে। রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের জন্য রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। অফশোর বিডিং রাউন্ড ঘোষণা করা হয়েছিল। এবং জাপানিজ ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি জাইকাকে ২০১০, ২০১৬, ২০২৩ সালের বিদ্যুৎ মাস্টারপ্ল্যান করতে দেওয়া হয়েছে। শুধু ব্যবসা দিয়েই আসলে শেষ হয়নি, দেশের নীতিমালা ঠিক করার দায়িত্বও বিদেশি সংস্থার হাতে তুলে দেয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভারত নির্ভরতা
বিদ্যুৎ খাতে ভারতের ওপর নির্ভরতার চিত্র খেয়াল করা দরকার। বাংলাদেশে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার ১৭.৩ শতাংশই ভারতের ওপর নির্ভরশীল। আদানির ঝাড়খণ্ড বিদ্যুৎ কেন্দ্র একটা উদাহরণ, ২০২২-২৩ অর্থবছরে আদানি প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ধরেছে ১৪ টাকা। সেখানে দেশের বিদ্যুতের গড় দাম ছিল ৮ টাকা ৭৭ পয়সা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আদানি পাওয়ার সমালোচনার মুখে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ধরেছে ১২ টাকা। এরকম ক্রয়কৃত বিদ্যুৎ বাংলাদেশ যখন বিক্রি করে ৮.৯৫ টাকায় তখন বাংলাদেশকে আসলে ভর্তুকি দিতে হয়। আবার এদিকে ক্যাপাসিটি চার্জের ৬২ শতাংশ ব্যবহার করা হয়েছে গত অর্থবছরে। এদিকে সক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার না হওয়ায় ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়েছে প্রায় ৫ হাজার ৮২৩ কোটি টাকা, যা প্রায় ২০ শতাংশ। ১৫ বছরে আমাদের ক্যাপাসিটি চার্জের চিত্রও আমরা জানি। গত শাসনামলে মোট ক্যাপাসিটি চার্জ দেড় লাখ কোটি টাকা হয়েছে আর দেশীয় ২৩টি কোম্পানি নিয়েছে ৯৫ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা। আদানিকে সবচেয়ে বেশি ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা দেখছি ২০১৬ সালেও ২৫০ মেগাওয়াটের মতো ছিল এখন সেটা ৪ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট হয়েছে। এলএনজি আমদানি বেড়েছে। এখন ২০২৪ সালে এলএনজি মোট ব্যবহৃত গ্যাসের ২৫ শতাংশ হয়েছে। ২০২১-২২ সালে আমদানিকৃত এলএনজির দাম দেশীয় গ্যাসের ২৪ গুণ ছিল। এদিকে সৌরবিদ্যুতের বিভিন্ন প্রযুক্তির উৎপাদন ক্ষমতা সেই হারে বাড়েনি। মাত্র ১ হাজার ৮৫ মেগাওয়াটের মতো। আমরা যদি দেখি যে প্রকৃত সৌরবিদ্যুৎ সরবরাহ এখনো ১ শতাংশের নিচে রয়েছে। বাংলাদেশে এখনো সৌরবিদ্যুতের দাম অনেক বেশি। সরকারকে এই জায়গাগুলোতে কাজ করতে হবে।
২০২২-২৩ অর্থবছরে আদানি প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ধরেছে ১৪ টাকা। সেখানে দেশের বিদ্যুতের গড় দাম ছিল ৮ টাকা ৭৭ পয়সা।
অন্তর্বর্তী সরকার কিছু কাজ করেছে। যেমন: বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন সংশোধন করে অধ্যাদেশ জারি করে কার্যক্রম সক্রিয় করেছে। দ্রুত জ্বালানি আইন ২০১০ স্থগিত করেছে। দ্রুত জ্বালানি আইনের আওতায় যেসব প্রকল্প হয়েছে সেগুলোর রিভিউ করার জন্য একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে। আবার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশে কমিটি গঠন করা হয়েছে। এস আলম গ্রুপের সঙ্গে প্রাইভেট রিফাইনারি করার চুক্তিও বাতিল করেছে। পল্লী বিদ্যুৎ বোর্ড ও সমিতির কাঠামো পুনর্মূল্যায়নে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়েছে। এগুলো কি সত্যি সত্যি কাজে দেবে, তা এখন নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। এই পর্যালোচনার জন্য আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু কিছু কিছু আলামত ভালো নয়। যেমন, আমরা যদি দেখি ‘দ্রুত জ্বালানি আইন ২০১০’ স্থগিত করেছে, কিন্তু এটার অধীন যেসব বিদ্যুৎ প্রকল্প হয়েছে সেগুলো বন্ধ করা বা সেগুলোকে স্থগিত করার ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এবিষয়ক শ্বেতপত্র কমিটি এখনো প্রতিবেদন দেয়নি। কিন্তু আমরা যতটুকু আভাস পেয়েছি যে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র বা নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করার ব্যাপারে এখন পর্যন্ত সরকারের অবস্থান এটাই যে এগুলো বন্ধ করা যাবে না।
বৈষম্য নিরসনে করণীয় কী?
প্রথমত, তেল গ্যাস বিদ্যুতের দাম কমাতে হবে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো হয়তো আমাদের মতোই একটা কঠিন পরিস্থিতিতে আছে যেখানে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে গেছে। কিন্তু তারা জ্বালানির দাম কমিয়েছে। শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান তা করেছে। বাংলাদেশে জ্বালানির দাম কমালেই মূল্যস্ফীতি অনেকখানি কমে যাবে, কিন্তু সেটাই হচ্ছে না। সুদের হার বাড়াচ্ছে, সুদ বাড়ালে বিনিয়োগ কমে যায়, বিনিয়োগ কমলে কর্মসংস্থান কমে যায়। নতুন শিল্পে গ্যাসের দাম ও ক্যাপটিভে গ্যাসের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে আইএমএফের শর্ত পূরণ করতে। ভ্যাট বাড়াচ্ছে, শুল্ক বাড়াচ্ছে। যা কিছু করলে উৎপাদন খরচ আরও বৃদ্ধি পায় সেই নীতিগুলোই একটা একটা করে নেয়া হচ্ছে। উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেলে মূল্যস্ফীতি বাড়বে। কাজেই আমরা যে সংস্কারের নমুনা দেখতে পাচ্ছি এখন পর্যন্ত তা খুব আশাব্যঞ্জক নয়।
দ্বিতীয়ত, ভারতের ওপর নির্ভরতা কমাতে হবে। রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং আদানির চুক্তি বাতিল করতে হবে। এলপিজি-তে ভর্তুকি দিতে হবে। কারণ, এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি জ্বালানি, যা মানুষের প্রতিদিনের জীবনযাপনের খরচ বাড়িয়ে চলেছে। বেসরকারি অপ্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বাতিল করতে হবে। এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে ভর্তুকি দিতে হবে। কৃষিজমি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ প্রকল্প বা কয়লা উত্তোলন করা যাবে না। কারণ, এগুলো আরেকটা বৈষম্যের ক্ষেত্র তৈরি করে। ব্যয়বহুল পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করতে হবে। এ ছাড়াও অপ্রয়োজনীয় মেগা প্রকল্পের জন্য নেওয়া ঋণ মওকুফের জন্য কূটনৈতিক পর্যায়ে তৎপর হতে হবে। আমরা যেসব মেগা প্রকল্পের জন্য ঋণ নিয়েছি সেগুলো যদি জনগণের মতের বিরুদ্ধে হয়ে থাকে তাহলে এই ঋণগুলো মওকুফ করার সুযোগ আছে। সেগুলোকে আমাদেরকে কাজে লাগাতে হবে।
কোনো কিছু অসম্ভব ধরে নিয়ে বসে থাকলে চলবে না। আমাদেরকে যদি আসলেই সংস্কার করতে হয়, কিছু বৈপ্লবিক পরিবর্তন যদি দেখতে হয়, তাহলে তা জন্য জোর দিতে হবে। এবং বারবার একই কথা বলতে হবে।
মোশাহিদা সুলতানা: সহযোগী অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ইমেইল: moshahida@du.ac.bd