বৈষম্যের সমাজে শিশু স্বাস্থ্য

১১তম বর্ষ Hide

বৈষম্যের সমাজে শিশু স্বাস্থ্য

বনানী চক্রবর্তী

বহুমাত্রিক বৈষম্যের সমাজে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ শিশুরা আরও বহুবিধ বৈষম্যের শিকার হয়ে বড় হতে থাকে। শৈশব থেকে যে জীবন তাকে দেয়া হয় তা নিয়ে কীভাবে একটি সুস্থ সমাজ গড়ে উঠতে পারে? এই লেখায় একজন সংবেদনশীল শিশু চিকিৎসক নিজের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান দিয়ে সেই বিষয়েরই কিছু চিত্র তুলে ধরেছেন।  

সকাল সাড়ে সাতটা। রিকশাচালক কোলে একটা বাচ্চা নিয়ে বসে আছেন অপেক্ষায়। পাশে বয়সে বড় আর একজন বাচ্চা। রিক্সায় উঠার পর বড় বাচ্চাটা চালাতে শুরু করল। অনভ্যস্ত আশঙ্কার জায়গা থেকে প্রশ্ন করলে উত্তর পাওয়া গেল… কি করবো, গরীব মানুষ পড়ালেখাও শিখাতে পারিনা, খাওয়াতেও পারিনা, শিখুক চালানো। পেট চালাতে তো হবে। জানা গেলো দুই ছেলে, বড়জনের বয়স ১২ বছর আর ছোটোজন ১৬ মাস বয়সী। মা অসুস্থ থাকায় ছোট জনকে প্রায় সাথে রাখতে হয়। সকালে বাচ্চাকে কী খাইয়েছেন জানতে চাইলে বললেন, দুজনেই একটা করে ১৫ টাকা দামের প্যাকেট জুস খেয়ে এসেছে। বড়ছেলে কিছুদূর চালিয়ে এসে রেস্টুরেন্ট এর সামনে নেমে গেলো। ওখানে কাজ করে যখন ডাকে। দুপুরের খাবার আর দিন কাবারি ১০০ টাকা পায়।

এ দুটি শিশুর প্রতিদিন কিভাবে চলবে, ভবিষ্যৎ কোনদিকে এগিয়ে যাবে মোটামুটি একটা ধারণা করা যায়। যুক্তি দিয়ে চিন্তা করলে বলা যায় যে, কিছু কিছু শর্ত পূরণ হলে গল্পটা অন্যরকমও হতে পারে। তাই মাঝে মাঝে অত্যাশ্চর্য কিছু খবর সংবাদপত্রের পাতায় পাওয়া যায়, যেমন: রিকশাচালকের সন্তান বিসিএস ক্যাডার কিংবা মেডিকেলে, বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে ইত্যাদি। অর্থাৎ যা হবার সম্ভাবনা ছিল না তাই হয়েছে। মধ্যপথের যুদ্ধগুলো জানা হয়না বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। সমাজের তথাকথিত “সফলতা”গুলো রিকশাচালক বা শ্রমিক পরিবারের জন্য নয় তাই এগুলো বিশেষ খবর। কিন্তু প্রাকৃতিক একজন মানুষের জীবনকালের পূর্ণ সম্ভাবনা অসীম, যদিও যখন সে সমাজের মানুষ তখন সামাজিক  অর্থনৈতিক অবস্থা তার সম্ভাবনার জায়গায় সাধারণভাবে একটা সীমা নির্ধারণ করে দিতে চায়। এ দুটি শিশু এদেশের ভবিষ্যৎ নাগরিক। এরা জন্মেছে পূর্ণ সম্ভাবনাসহ স্বাস্থ্যবান জীবন যাপনের অধিকার নিয়ে কিন্তু বাস্তবতা আলাদা। তাদের জীবন শুরু হয়েছে টিকে থাকার সংগ্রাম দিয়ে যেখানে স্বাস্থ্য এবং সম্ভাবনা অনিশ্চিত।

শিশু শুধু পরিবারের দায়িত্ব নয়

জীবজগতে যেসব সুস্থ সবল শিশু পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে টিকে যেতে পারে তারাই প্রজাতি রক্ষা করে। মানুষের বেলায় আলাদা কিছু নয়। পার্থক্য হলো মানুষ জীবনের সাথে পরিবেশ প্রতিবেশের সম্পর্ক প্রভাব জেনে চলেছে আর জীবনকে আরো কার্যকরী করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। সভ্যতার বিভিন্ন পর্যায়ে শিশুর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তিত হয়েছে সমাজে তার প্রয়োজনের ধরণমত। কৃষিভিত্তিক সমাজে শিশু ছিল জনশক্তি। একটু বড় হতে না হতেই কৃষিকাজে, ঘরের কাজে, বয়স্ক সদস্যদের দেখাশোনার কাজে লাগানো হতো। শিল্পযুগের শুরুতেও কারখানায় শ্রমিক হিসেবে শিশুদের ব্যবহার ছিল। শিশুর স্বাস্থ্য, শিক্ষা, শিশু বিকাশ এসব বিষয়ে জ্ঞান ছিল সীমিত। পরবর্তীতে প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে দক্ষ জনশক্তির প্রয়োজন দেখা দেওয়ার পাশাপাশি সমাজ পরিবার, অর্থনীতির ধরণ পাল্টে গেলো। শিশুর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গীতেও পরিবর্তন এল। সময়ের সাথে সাথে পারিবারিক সামাজিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে শিশুর সরাসরি ভূমিকা আশা করা না হলেও বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বৈষম্যমূলক আর্থ-সামাজিক অবস্থার কারণে অনেক শিশু তার শৈশব হারিয়ে ফেলে অভাবে, অপুষ্টিতে, অশিক্ষায়। একজন সুস্থ পূর্ণবয়স্ক মানুষ হিসেবে অনেক শিশুর সম্ভাবনা প্রকাশিত হতে পারেনা। প্রজাতি এগিয়ে নিতে বা সমাজে ভূমিকা রাখতে পারেনা।

গত কয়েক শতক ধরে শিশুস্বাস্থ্য বিষয়ে আলাদা গুরুত্ব দিতে গিয়ে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো গেছে যে, শিশুর ভালোমন্দের দেখাশোনা পুরোপুরি পরিবারের দায়িত্ব নয় আর সম্ভবও নয়। শিশুকে পরিপূর্ণ এবং সুস্থ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার যে প্রক্রিয়া তা পরিবার থেকে শুরু হলেও এতে পরিবারের পাশাপাশি সামাজিক অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেরও ভূমিকা রয়েছে। যেমন: শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান এগুলো। শিশুর বিকাশ শুধু পরিবারের স্বার্থও নয় কারণ এই শিশুটি বড় হয়ে সমাজের একজন সদস্য বা দেশেরই একজন নাগরিক হবে। অন্যকথায় বলা যায় শিশুর বৃদ্ধি বিকাশ শুধুমাত্র শিশুর জন্য নয় আর তাই শিশুকে পৃথিবীর, দেশের, রাষ্ট্রের মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তোলার উপর জোর দেয়া হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবে সেখানেই আসছে রাষ্ট্রের দায়িত্ব, নীতিমালা, উদ্যোগ।

শিশুর বিকাশ শুধু পরিবারের স্বার্থও নয় কারণ এই শিশুটি বড় হয়ে সমাজের একজন সদস্য বা দেশেরই একজন নাগরিক হবে।

শিশু স্বাস্থ্যের ধারণা

শিশু স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবনার প্রাথমিক অবস্থায় দেখা গেলো স্বাস্থ্যের যে সংজ্ঞা তা শিশুস্বাস্থ্য পুরোপুরি সংজ্ঞায়িত করে না। ১৯৪৮ সালে WHO-র প্রকাশিত সংজ্ঞা অনুযায়ী বলা যায়, .. Health is a state of complete physical mental social well being not merely an absence of disease.এরপর Ottawa convention এ সংজ্ঞাকে আরো পরিশীলিত করে বলা হলো… the extent to which a group or individual can fulfil their ambitions and needs, on the one hand and evolve with or adapt to the environment on the other.  স্বাস্থ্যের এই সংজ্ঞায় পরিবেশের সাথে মানিয়ে নেবার বা  বিবর্তনের কথা থাকলেও বিকাশের প্রসঙ্গ নেই, ভবিষ্যৎ স্বাস্থ্যের প্রসঙ্গ নেই। যে শিশুটির শরীরে রোগ নেই কিন্তু বয়সের সাথে ওজন বাড়েনি, শারীরিক, মানসিক, বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ হয়নি, অবহেলিত একটা পরিবেশে যে বাস করে পূর্ণবয়স্ক মানুষ হিসেবে তার স্বাস্থ্যের কী অবস্থা হতে পারে এই সংজ্ঞায় এসব বিষয়ে উল্লেখ নেই।

২০০১ সালে united states department of health and human services এর অধীনে শিশুস্বাস্থ্য পর্যালোচনার জন্য একটা কমিটি হলো যা শিশু স্বাস্থ্যের একটা সংজ্ঞা প্রকাশ করল…as the extent to which individual children or groups of children are able or enabled to a) develop and realize their potential, b) satisfy their needs, c) develop capacities that allow them to interact successfully with their physical biological and social environment. এই সংজ্ঞা শিশু স্বাস্থ্যকে অনেকটা স্পষ্ট করলো। শিশুর স্বাস্থ্য একটা নির্মাণ। পরিপূর্ণভাবে বাঁচার সম্ভাবনা তৈরি করাই স্বাস্থ্য গঠনের উদ্দেশ্য।

শিশুর স্বাস্থ্য নির্মাণ

শিশুর বৃদ্ধি এবং বিকাশ একটি গতিশীল প্রক্রিয়া—এটাই শিশু স্বাস্থ্যের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। তাই শারীরবৃত্তীয় দিক থেকে শিশু পরিবেশের প্রতি তুলনামূলকভাবে বেশি সংবেদনশীল সেটা শারীরিক বা মানসিক যাই হোক। মায়ের পেটে থাকার সময় থেকে শুরু করে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত কতগুলো ধাপ পার হয়ে একজন শিশু পূর্ণবয়স্ক মানুষ হয়। প্রতিটা ধাপে বংশগতির সাথে পরিবেশের মিথস্ক্রিয়া ভিন্নরকম এবং প্রতিটা ধাপ আলাদা মনোযোগ দাবি করে। একজন মানুষ কিভাবে বাঁচবে, পরিবেশের সাথে তার শারীরিক মানসিক ক্রিয়া বিক্রিয়া কী হবে শৈশব থেকেই তা নির্ধারিত হতে থাকে। অর্থাৎ শিশুর স্বাস্থ্য প্রতিদিন গঠিত হয় আর তৈরি হয় ভবিষ্যৎ নাগরিকের স্বাস্থ্যের ভিত্তি।

মায়ের পেটে থাকার সময় থেকে শুরু করে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত কতগুলো ধাপ পার হয়ে একজন শিশু পূর্ণবয়স্ক মানুষ হয়। প্রতিটা ধাপে বংশগতির সাথে পরিবেশের মিথস্ক্রিয়া ভিন্নরকম এবং প্রতিটা ধাপ আলাদা মনোযোগ দাবি করে।

২০০৮ সালে Lancet এ প্রকাশিত গবেষণাপত্রের মাধ্যমে শিশুর স্বাস্থ্য গঠন বিষয়ে একটি ধারণা গ্রহণযোগ্যতা পায় যা First 1000 days of a child’s life হিসেবে পরিচিত। মায়ের পেটে ভ্রূণের আভাস থেকে শুরু করে শিশুর জন্মের দুই বছর বয়স পর্যন্ত এই সময়টা হিসাব করলে ১০০০ দিন হয়। এই সময়কে আরো একটু প্রসারিত করে বলা হচ্ছে পরবর্তী ১০০০ দিন যা ২ বছর থেকে ৫ বছর বয়স পর্যন্ত অর্থাৎ শিশুর প্রথম স্কুলে যাওয়া পর্যন্ত সময়কে বোঝায়। এই পুরো সময়টাকে বলা হচ্ছে early childhood যা একই সাথে সংবেদনশীল এবং ঝুঁকি পূর্ণ।৪,৫ এই সময়ে পুষ্টির ঘাটতি, সংক্রমণ, পরিবেশের ক্ষতিকর প্রভাব শিশুর মৃত্যু থেকে শুরু করে দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণ হতে পারে। অন্যদিকে এই সময়েই পারিবারিক সামাজিক সুযোগ সুবিধা, যত্ন শিশুকে স্বাস্থ্যবান জীবন দিতে পারে। সুস্বাস্থ্য গঠনে পূর্ণ সম্ভাবনার দিকে নিয়ে যেতে পারে।  এই সময়ের গুণগত মানের উপর নির্ভর করবে সে কতটা সম্ভাবনা নিয়ে বাঁচতে যাচ্ছে।

গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাস সময়ে মায়ের শরীরে পুষ্টির ঘাটতি, মায়ের যেকোনো ধরনের অসুস্থতা, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, পরিবেশ দূষণের প্রভাব, বিশেষ জীবাণু সংক্রমণ ভ্রূণের বৃদ্ধি বিকাশে বাধা দেয়। এতে জন্মগত বিভিন্ন ত্রুটি নিয়ে শিশু জন্ম হতে পারে। তাই গর্ভবতী হবার আগেই মায়ের স্বাস্থ্য পুষ্টির কী অবস্থা সেটা বিবেচ্য। পুরো গর্ভাবস্থা জুড়ে স্বাভাবিক বৃদ্ধি বিকাশের বাধা হলে শিশুর ওজন কম হওয়া বা পরিপূর্ণ হবার আগেই জন্ম নেবার ঝুঁকি বেড়ে যায়। এই সময়কার পুষ্টির ঘাটতি তাকে টেনে নিয়ে যেতে হয় জন্মের পরও। মায়ের মানসিক অবস্থা, তার পরিবেশের সামগ্রিক প্রভাব গর্ভস্থ শিশুর অভিজ্ঞতায় যুক্ত হয়।

তারপর আসে জন্মকালীন সময়। জন্মকালীন জটিলতা মস্তিষ্কের বৃদ্ধিবিকাশ, ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এর ফলে পরিবারের উপর দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক মানসিক চাপ যুক্ত হয়। জন্ম পরবর্তী সময়ও ঝুঁকিপূর্ণ। এই সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মায়ের দুধ খাওয়ানো শুরু করা। মায়ের দুধ শিশুর সার্বিক পুষ্টি নিশ্চিত করে, জীবাণু সংক্রমণ কমায়, তাপমাত্রা স্থিতিশীল রাখে আর এর মাধ্যমে মায়ের সাথে তার যোগাযোগ তৈরি হয়। দীর্ঘমেয়াদে শিশুর সুস্বাস্থ্যের ভিত্তি তৈরি করে মায়ের দুধ।

জন্মের পর শিশু খুব দ্রুত বাড়ে। প্রথম ৫ থেকে ৬ মাসের মধ্যে শিশুর ওজন জন্মের ওজনের প্রায়  দ্বিগুণ হয়ে যায় এবং এক বছরে গিয়ে ৩ গুণ হয়। ধীরে ধীরে বৃদ্ধির হার কমতে থাকে। মস্তিষ্কের বৃদ্ধির প্রায় ৮৫ থেকে ৯০ ভাগ প্রথম তিন বছর বয়সেই হয়ে যায়। এই সময় পুষ্টির ঘাটতি পরিবেশের ক্ষতিকর প্রভাব তার বৃদ্ধি ব্যাহত করে বিভিন্ন রকম দীর্ঘমেয়াদী রোগ সৃষ্টি করতে পারে। পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত চারপাশের পরিবেশ থেকে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে মস্তিষ্কে সর্বোচ্চ স্নায়বিক যোগ তৈরি হয়। এর পর এই হার কমতে থাকে। এই সময়কার অভিজ্ঞতা পরবর্তী জীবন ধারণায়, জীবনচর্চায় প্রভাব ফেলে অর্থাৎ একটা ছাঁচ তৈরি হয়।  তাই শিশুর শারীরিক বৃদ্ধির জন্য পুষ্টি নিশ্চিত করা যেমন জরুরি তেমনি এই সময় বিকাশের উপযুক্ত সংবেদনশীল সহযোগিতাপূর্ণ পরিবেশও খুব গুরুত্বপূর্ণ।

জন্মের পর শিশু খুব দ্রুত বাড়ে। প্রথম ৫ থেকে ৬ মাসের মধ্যে শিশুর ওজন জন্মের ওজনের প্রায়  দ্বিগুণ হয়ে যায় এবং এক বছরে গিয়ে ৩ গুণ হয়। ধীরে ধীরে বৃদ্ধির হার কমতে থাকে। মস্তিষ্কের বৃদ্ধির প্রায় ৮৫ থেকে ৯০ ভাগ প্রথম তিন বছর বয়সেই হয়ে যায়। এই সময় পুষ্টির ঘাটতি পরিবেশের ক্ষতিকর প্রভাব তার বৃদ্ধি ব্যাহত করে বিভিন্ন রকম দীর্ঘমেয়াদী রোগ সৃষ্টি করতে পারে।

এই সময়েই শিশু মায়ের দুধের পাশাপাশি বাড়ির খাবার খেতে শেখে, তার খাদ্যাভ্যাস তৈরি হয়, কথা বলতে শেখে, মা বাবার সাথে, পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে পারস্পরিক সম্পর্কের ভেতর দিয়ে শিশু সামাজিক সম্পর্কগুলোর ধারণা পায়। তার বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ হয়। সে স্কুলে যাওয়া শুরু করে অর্থাৎ করার কথা। কী ধরনের পরিবেশে  সে বড় হচ্ছে তার উপর ভিত্তি করে তার শারীরিক বৃদ্ধি, তার মধ্যে নিরাপত্তা বোধ, আত্মবিশ্বাস, স্বনির্ভরতা, অন্যের প্রতি বিবেচনা বোধ, অন্যান্য সামাজিক গুণাবলীর বিকাশ হয়। বলা যায় এভাবে শিশু তার শারীরিক এবং মানসিক আকার পায়।

শিশুর লালন পালনের ( nurturing care) জন্য সংবেদনশীল এবং ঝুঁকিমুক্ত স্থিতিশীল পরিবেশ প্রয়োজন যা তার শারীরিক বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রাথমিক মানসিক বিকাশের জন্য সহায়ক। এজন্য কতগুলো শর্ত বা উপাদান খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেগুলো হলো পুষ্টি, শিক্ষা, পারিবারিক এবং সামাজিক পারস্পরিক সম্পর্ক, সামাজিক নিরাপত্তা। শিশু পালনের মূল কেন্দ্রবিন্দু পরিবার এবং তার সহায়ক হিসেবে কাজ করে সমাজ রাষ্ট্র। বর্তমান সমাজে বা রাষ্ট্রব্যবস্থায় এগুলো নিশ্চিত হবে কী হবে না তার সাথে আর্থ-সামাজিক অবস্থা জোরালোভাবে জড়িত। বিশ্বে নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোর ২৫ কোটি (৪৩% ) শিশু পূর্ণ স্বাস্থ্য সম্ভাবনা থেকে বঞ্চিত হবার ঝুঁকিতে আছে।৭,৮ অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীতে গর্ভকালীন সময় থেকে শিশু যে স্বাস্থ্য ঝুঁকির শিকার হয় বলা চলে শৈশব পার হয়ে একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ হিসেবে সে প্রজন্মান্তরে বয়ে বেড়ায়। বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ৩৫.৬% শিশু কিশোর অর্থাৎ শূন্য থেকে ১৭ বছর বয়সী। এই ভবিষ্যৎ নাগরিকদের স্বাস্থ্য কিভাবে গঠিত হচ্ছে? ২০১৭-১৮ এবং ২০২২ এর মধ্যে অনূর্ধ্ব ৫ বছর বয়সী শিশু মৃত্যুর হার হাজারে ৪৩ থেকে ৩১ এ নেমে এসেছে। নিঃসন্দেহে এটি একটি অর্জন। কিন্তু যারা বেঁচে যাচ্ছে তারা কি পূর্ণ সম্ভাবনা নিয়ে বাঁচতে পারছে?

বৈষম্যের সমাজে শিশুর জীবনের প্রথম ১০০০ দিন

অর্থনৈতিক অগ্রগতির সূচক হিসেবে গত দশ বছরে বাংলাদেশে জিডিপি বৃদ্ধির হার দ্রুততম। ২০১৯ সালে জিডিপি ১৯০৬ মার্কিন ডলার। শিশু এবং বৃদ্ধ বাদে প্রতিটি উৎপাদনক্ষম বা উপার্জনক্ষম মানুষকে এই হিসাবে ধরা হয়েছে যাদের উপর শিশুরা নির্ভরশীল। এদিকে ২০১৮-১৯ সালে বিবিএস পরিসংখ্যান মত দরিদ্র ২০.৫% এবং অতিদরিদ্র ১০.৫%।১০ পরিসংখ্যান হিসেবে করে দেখলেও এই উন্নতি পুরো জনসংখ্যার জন্য হয়নি যদিও মাথাপিছু বার্ষিক গড় আয় হিসাব করা হয়েছে ২,৬৮৮ মার্কিন ডলার। বলা হচ্ছে, ১৫-২৪ বছর বয়সী কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর মধ্যে বেকারত্বের হার ৫.২% (২০২৩) আবার ২০১৭ সালে গ্রাজুয়েট হওয়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৬৬% কোনো নির্দিষ্ট জীবিকায় যুক্ত নেই।১১ যেসব চাকুরীজীবী বা শ্রমিক নিয়মিত বেতন পাননা, দিনমজুর হকার, গৃহকর্মী, কৃষি শ্রমিক, চা শ্রমিক, হাওর অঞ্চল এবং পার্বত্য অঞ্চলের জনগোষ্ঠী, বিভিন্ন অপ্রাতিষ্ঠানিক জীবিকায় যুক্ত মানুষ যাদের নিয়মিত কাজ থাকেনা এরকম আরো অনেকের হিসাব এতে নেই মনে হয়। তাদের শিশুদের দৈনন্দিন স্বাস্থ্যের কী অবস্থা? মানব সম্পদ উন্নয়ন সূচকে (UN human development index) ১৮৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৫।১২ বাংলাদেশ এগিয়েছে। প্রশ্ন কিভাবে? কোথায়? কার জন্য?

একজন স্বাস্থ্যবান মা একটি সুস্থ শিশু জন্ম দেবে। মায়ের স্বাস্থ্য অর্থনৈতিক অবস্থার সাথে সম্পর্কিত। এমনিতেই দুর্মূল্যের বাজারে, বৈষম্যের সমাজে নারীদের পুষ্টি অগ্রাধিকার পায়না। তার মধ্যে একজন মেয়ে শিশু শারীরিক পুষ্টি, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, শিক্ষা, মানসিক বিকাশ, শিশুপালনের ধারণা; এসব কিছু পাবার আগেই মা হয়ে যায়। বাল্য বিবাহে বাংলাদেশ বিশ্বে অষ্টম। ১৮তে পৌঁছানোর আগেই ৫০% মেয়েদের বিয়ে হয়। ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী কিশোরীদের মা হবার হার ২০২৩ সালে ছিল ২৫.৯%।১৩ এই হার আসলে গ্রাম অঞ্চলে, শহর নগরের সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীতে ভিন্নরকম হবার সম্ভাবনা। নাজুক অর্থনৈতিক অবস্থায় অপুষ্টি, অশিক্ষা আর বাল্যবিবাহের শিকার মা যে শিশুর জন্ম দেয় সে যেমন জন্মকালীন বিভিন্ন জটিলতার ঝুঁকিতে থাকে আবার দীর্ঘমেয়াদে শারীরিক এবং মানসিকভাবে পিছিয়ে থাকার সম্ভাবনা নিয়েই জন্মায়। মায়ের অপুষ্টি, আয়রনের ঘাটতি, রক্তস্বল্পতা এসব কারণে জন্মের আগেই শিশুর বঞ্চনা শুরু হয়। এর ফলে অপরিণত, কম ওজনের শিশুর জন্ম নেয়ার হার বেড়ে যায়। বর্তমানে বাংলাদেশে ১৬.১% শিশু ৩৭ সপ্তাহের আগে জন্ম নেয় যা বিশ্বে সর্বোচ্চ।১৪ বাল্যবিবাহ, গর্ভকালীন চেকআপ এর অভাব এর বড় কারণ। বাংলাদেশে নবজাতকের মৃত্যু হার কমে বর্তমানে হাজারে ২০।১৫ বেঁচে যাওয়ার পর তাদের তাদের স্বাস্থ্য নির্মাণের কী অবস্থা?

মায়ের স্বাস্থ্য এবং গর্ভস্থ শিশুর বৃদ্ধি বিকাশ এবং কোনো ধরনের জটিলতার পূর্বাভাস পর্যালোচনার জন্য WHO কমপক্ষে চারবার এন্টিনেটাল চেকআপের সুপারিশ করে । ২০২২ সালে বিডিএইচএস এর হিসাবে ৪২% গর্ভবতী নারী ৪ বার চেকআপ করিয়েছেন। তবে মানসম্পন্ন চেকআপ পেয়েছেন অর্থাৎ প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী বা চিকিৎসকের মাধ্যমে পরীক্ষা করাতে পেরেছেন ২১% নারী। এর মধ্যে অর্থনৈতিক অবস্থা (মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত যথাক্রমে ৩৯%, ৮%) এবং শহর গ্রাম (শহর এবং গ্রামে যথাক্রমে ৩৩%, ১৭%) হিসেবে পার্থক্য আছে।১৬ হাতের কাছে ক্লিনিক হাসপাতাল আছে এরকম ক্ষেত্রে একটা “আল্ট্রা” করে অনেক পরিবার মনে করে চেকআপ হয়ে গেছে যদিও এতে শুধু হাসপাতালের আয় বৃদ্ধি হয়। সরকারি স্বাস্থ্য সুবিধা নাগালের কাছে না থাকা আর বেসরকারি হাসপাতালগুলো অতিরিক্ত খরচ; এগুলো কারণ হিসেবে দেখা যায়। এছাড়া সচেতনতার অভাব, কুসংস্কার, ভয়, যোগাযোগ ব্যবস্থাব অসুবিধা এগুলোতো আছেই। উপজেলা গ্রাম পর্যায়ে সরকারি কমিউনিটি ক্লিনিক বা ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার ক্লিনিকগুলোর কার্যক্রম বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভিটামিন আয়রন ক্যালসিয়াম জাতীয় ওষুধ দেয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব, যন্ত্রপাতি, পরিবহন সুবিধাসহ ব্যবস্থাপনার সীমাবদ্ধতার কারণে এসব কেন্দ্র পর্যাপ্ত সেবা দিতে পারেনা এবং এখান থেকে উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়মিত কোনো রেফারেল সুবিধা গড়ে উঠেনি।

২০২২ সালের হিসাব অনুযায়ী ৬৫% মা হাসপাতালে শিশু জন্ম দিয়েছেন। অর্থনৈতিক শ্রেণী হিসেবে এই পরিসংখ্যানের পার্থক্য খুব ব্যাপক (মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের মধ্যে যথাক্রমে ৮৭%, ৪২%)। এছাড়া গ্রাম শহর, জেলা, হিসেবেও চোখে পড়ার মতো পার্থক্য আছে।  লক্ষণীয় যে, ৪৫% ডেলিভারি বেসরকারি হাসপাতালে, ১৮% সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে এবং ২% এনজিও স্বাস্থ্য কেন্দ্রে হয়েছে। বাড়িতে সন্তান জন্ম দেবার ক্ষেত্রে ৫৩% নারী প্রশিক্ষিত দাই এর সহায়তা নিয়েছেন।১৭ বাংলাদেশে জন্মকালীন অক্সিজেনের ঘাটতি বা birth asphyxia নবজাতক মৃত্যুর অন্যতম মূল কারণ (৩৬.৬%) হিসেবে দেখা যায়। এছাড়া নবজাতকের সংক্রমণ (২১%) এবং কম ওজনজনিত জটিলতার কারণে (২০%) মারা যায়। যেসব নবজাতক মারা যায় তাদের মধ্যে ৩৮.৪% (২০২০) এর মৃত্যু বাড়িতেই হয়।১৮ বাড়িতে বা হাসপাতালে ডেলিভারির সময় জটিলতা দেখা গেলে বিশেষায়িত চিকিৎসা প্রয়োজন হয়। ডেলিভারি খরচ মেটানোর পর মা এবং শিশুর পরবর্তী চিকিৎসা নিম্ন আয়ের পরিবার গুলোর জন্য অসম্ভব হয়ে পড়ে। মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জেলা হাসপাতালে বেড সংকট, বেসরকারি হাসপাতালে দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা খরচ তাদের সাধ্যের বাইরে। অনেক পরিবার ঋণগ্রস্ত হয় পড়েন, পুরো চিকিৎসা না নিয়েই বাড়ি যান।

বাংলাদেশে জন্মকালীন অক্সিজেনের ঘাটতি বা birth asphyxia নবজাতক মৃত্যুর অন্যতম মূল কারণ (৫৭.২%) হিসেবে দেখা যায়। এছাড়া নবজাতকের সংক্রমণ (২১%) এবং কম ওজনজনিত জটিলতার কারণে (২০%) মারা যায়। যেসব নবজাতক মারা যায় তাদের মধ্যে ৩৮.৪% (২০২০) এর মৃত্যু বাড়িতেই হয়।

জন্মের প্রথম ঘণ্টার মধ্যে শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়ানোর হার ৪০% এবং ৫৫% শিশু ৬ মাস বয়স পর্যন্ত শুধুমাত্র মায়ের দুধ খায়।১৯ আবারো এই হার গ্রাম, শহর, পেশা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, অর্থনৈতিক অবস্থা ভেদে আলাদা। সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে মায়ের দুধ খাওয়ানো নিয়ে অনেক কার্যক্রম থাকলেও সব জনগোষ্ঠীতে সমানভাবে পৌঁছায় না। মায়ের দুধের বিকল্প খাদ্যের বাজার যদিও গ্রাম শহর নির্বিশেষে বেশ ভালো। গর্ভকালীন সময়ে বা তার আগে পরে মায়ের দুধ বিষয়ক জ্ঞান যেহেতু পৌঁছানো যাচ্ছেনা, পৌঁছানো গেলেও মায়েদের বয়স, শিক্ষা, মাতৃকালীন ছুটি এধরনের বিভিন্ন দুর্বলতার কারণে বাজারের শক্তিবৃদ্ধি হচ্ছে। কাজেই এখনো পর্যন্ত মায়ের দুধের প্রাকৃতিক সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত বড় অংশের শিশুরা। এর মাশুল বেশি করে দিতে হয় নিম্নবিত্ত পরিবারের শিশুদের।

ছয় মাস থেকে দুই বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে  IYCF(Infant and Young Child Feeding) সুপারিশকৃত বিধিমালা মেনে মায়ের দুধের পাশাপাশি আয়রন ভিটামিন প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার (minimum acceptable diet) খায় খুব কম শিশু। যারা মায়ের দুধ খায় তাদের ক্ষেত্রে এই হার ২৮.৯% আর যারা মায়ের দুধ খায়না তাদের ক্ষেত্রে ১৭%।২০ এটা সারা দেশের হিসাব। ধারণা করে নেয়া যায় নিম্নআয়ের পরিবারগুলোয় শিশুদের অবস্থা। শিশুপালন বিষয়ে প্রাচীন ধ্যানধারণা, অজ্ঞতা, নিয়ন্ত্রণহীন শিশুখাদ্য বিপণন, দুর্মূল্যের বাজার, মায়ের পেশা সব মিলিয়ে ৬ মাস বয়সের পর থেকে এদের কপালে জোটে চালের গুড়া, সুজি, গরুর দুধ, পাতলা করে মেশানো সেরেলাক, কৌটার দুধ। আপাত দৃষ্টিতে অনেক শিশুর ওজন ঠিক থাকলেও এরা রক্তস্বল্পতাসহ আয়রন ভিটামিনসহ অন্যান্য খনিজের ঘাটতিতে ভোগে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হবার ফলে কারণে ঘন ঘন অসুস্থ হয়, শারীরিক বৃদ্ধি মানসিক বিকাশ ব্যাহত হয়, পরবর্তীতে পূর্ণবয়স্ক মানুষ হিসেবেও দীর্ঘমেয়াদী রোগের ঝুঁকিতে থাকে। শিশুর পুষ্টির সূচকগুলো গত ২০ বছরে অনেক কমে এলেও এখনো পর্যন্ত ২২% শিশুর ওজন বয়স অনুপাতে কম (underweight) এবং ২৪% শিশু খর্বাকৃতি (stunted) অর্থাৎ তারা দীর্ঘদিন অপুষ্টিতে ভুগছে।২১ নিম্নবিত্ত সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীতে একটি শিশুর স্বাস্থ্য নির্মাণের প্রথম ১০০০ দিন প্রায়ই অপচয়ের ঝুঁকিতে থাকে।

৬ মাস বয়সের পর থেকে এদের কপালে জোটে চালের গুড়া, সুজি, গরুর দুধ, পাতলা করে মেশানো সেরেলাক, কৌটার দুধ। আপাত দৃষ্টিতে অনেক শিশুর ওজন ঠিক থাকলেও এরা রক্তস্বল্পতাসহ আয়রন ভিটামিনসহ অন্যান্য খনিজের ঘাটতিতে ভোগে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হবার ফলে কারণে ঘন ঘন অসুস্থ হয়, শারীরিক বৃদ্ধি মানসিক বিকাশ ব্যাহত হয়, পরবর্তীতে পূর্ণবয়স্ক মানুষ হিসেবেও দীর্ঘমেয়াদী রোগের ঝুঁকিতে থাকে।

শিশুর সামাজিক নিরাপত্তা

নিরাপদ পানি, বাসস্থান স্বাস্থ্যের পূর্বশর্ত। বায়ু দূষণ আর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের কারণে শিশুবা নিউমোনিয়াসহ শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ, ডায়রিয়া, চামড়ার রোগসহ বিভিন্ন সংক্রামক রোগের ঝুঁকিতে থাকে (অনূর্ধ্ব ৫ বছর বয়সী শিশুমৃত্যুর ৩৪.৯১% ক্ষেত্রে কারণ হিসেবে নিউমোনিয়া পাওয়া যায়)। দৈনন্দিন ব্যবহার্য পানির মান উন্নত হয়েছে, যদিও বলা হচ্ছে অনেক ক্ষেত্রেই তা E. coli মুক্ত নয়। বিবিএস জরিপ মতো ৭০.৫৩% গৃহস্থ নিরাপদ খাবার পানি পায়।২২ আসলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে, শহর ও গ্রাম, আবার শহরেও বিভিন্ন এলাকার মধ্যে পানির মানের অনেক পার্থক্য রয়েছে। মূলত নিরাপদ পানি, পরিচ্ছন্নতা এবং পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা অর্থাৎ স্বাস্থ্যকর বাসস্থান আর্থ-সামাজিক অবস্থার সাথে সম্পর্কিত। শ্রমজীবী পরিবারগুলো যেভাবে বাস করে – একটি কামরায় শিশুসহ চার পাঁচ জনের বসবাস, চার পাঁচটি পরিবারের একই স্নানের ঘর, ল্যাট্রিন সুস্থ বসবাসের পরিবেশ হতে পারে না। এছাড়া বস্তির পরিবেশের কথা বলাই বাহুল্য; যদিও সেখানেও শিশুরা বড় হচ্ছে। দারিদ্র্য, বৈষম্য এবং স্বাস্থ্যসেবার অভাবে যেখানে হাজারে ৪৯ জন (২০১৯)দরিদ্র পরিবারের শিশু মারা যায় সেখানে ধনী পরিবারের শিশু মারা যায় হাজারে ২৮ জন।২৩

প্রাথমিক স্কুলে ৮৫.৯% শিশু ভর্তি হলেও অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত যেতে পারে ৫৭.৮%। মেয়েদের চেয়ে ছেলেরা তাড়াতাড়ি ঝরে পড়ে।২৪ অন্যদিকে একটু বড় হলেই মেয়েকে স্কুল পাঠাতে অভিভাবক নিরাপত্তার চিন্তা করেন। দিনের একটা বড় অংশ শিশুরা স্কুলে থাকে। কাজেই স্কুলে পরিবেশ স্বাস্থ্যকর হওয়া জরুরী। ২০% স্কুলে কোনো খাবার পানির ব্যবস্থা নেই এবং ৪৪% স্কুলে হাতধোয়ার ব্যবস্থা নেই।২৫ কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা  গেছে একটি টয়লেটের জন্য ছাত্রের অনুপাত ১:১১৫।২৬ স্কুলে থাকাকালীন শিশুদের খাবার প্রয়োজন হয়। সকালে অনেক শিশুই পেট ভরে খেয়ে আসতে পারেনা, বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে আসতেও পারেনা। স্কুলের গেটে অস্বাস্থ্যকর খাবারই ভরসা যেগুলো দিন শেষে শারীরিক অসুস্থতা বাড়ায়। সেটাও সব জায়গায় পাওয়া যাবার কথা নয় আবার খরচ সাপেক্ষ যা সব শিশুর পক্ষে সম্ভবও নয়। ২০২২ সাল পর্যন্ত চলতে থাকা ন্যাশনাল স্কুল ফিডিং প্রকল্পের মাধ্যমে ১,৩৩,০০০ স্কুলের মধ্যে দরিদ্র অঞ্চলের ১৫,২৮৯ স্কুলের ৩০ লক্ষ শিশুকে খাবার দেবার কথা জানা যায়।২৭ পরবর্তী প্রকল্প শুরু হবার কথা থাকলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে তার অবস্থা জানা নেই। প্রাথমিক স্কুলের শিশুদের উপবৃত্তি পাবার কথা যার জন্য বিকাশ একাউন্ট, জন্ম নিবন্ধন, এরকম বিভিন্ন শর্ত আছে। সরকারি প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি হতে জন্ম নিবন্ধন প্রয়োজন হয় যা জোগাড় করা খুব কঠিন। বেসরকারি স্কুলের বেতন কমপক্ষেও ৫০০/১০০০ টাকা। আবার বর্তমানে স্কুলে যাবার পরও প্রাইভেট পড়তে হয়। এতো ধরণের আনুষঙ্গিক বাধা পার করে শিশুর শিক্ষা নিশ্চিত করা নিম্নবিত্ত পরিবারের ব্যক্তিগত উদ্যোগে অসম্ভব। অধিকারের সাথে ইচ্ছার সাথে, সামর্থ্যরে মিল হয়না তাদের। শিশু যদি পড়তে না পারে, পড়তে পারলেও বুঝতে না পারে তাহলে তার বিকাশের একটা দিক বন্ধই থাকে। পূর্ণবয়স্ক মানুষ হিসেবে দৈনন্দিন জীবনের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিষয়সহ অন্যান্য বিভিন্ন তথ্য খবরাখবর জানতে বুঝতে তাকে অন্যের উপর নির্ভর করতে হয়। তার জীবন নিয়ন্ত্রণ করে অন্য কেউ।

শিশুকে স্পর্শ করা, আদর করে জড়িয়ে ধরা, তার সাথে কথা বলা, খেলা করা, প্রতিবেশীদের সাথে যোগাযোগ করানো এগুলো একজন সংবেদনশীল সামাজিক মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার পথে তাকে চারপাশের পরিবেশের সাথে যুক্ত করে। পরিবারের ভেতরে, বাইরে কী ধরনের পরিবেশ সে পাচ্ছে সেভাবেই তার ধারণা তৈরি হয়। ইউনিসেফের একটা হিসাবে দেখা যায় ০-১৭ বছর বয়সী শিশুদের ৪.১% মা বাবার সাথে থাকেনা, ৪% এর মা বাবা দুজনেই মৃত, ৭.৬% এর মা বা বাবা বিদেশে থাকেন, ১২% এর ক্ষেত্রে মা একাই লালন পালন করেন।২৮ আরো অনেক মা কাগজ কলমে বিবাহিত হলেও কার্যত একাই সন্তান নিয়ে বাঁচেন। এর সাথে আছে শ্রমজীবী, চাকুরীজীবী মা বাবার শিশুরা যারা দিনের বড় অংশ টাকার বিনিময়ে প্রতিবেশীর কাছে থাকে, সুযোগ থাকলে ডে কেয়ার, কখনও বা বয়সে বড় কিন্তু শিশু ভাইবোনের তত্ত্বাবধানে থাকে, আবার একাও থাকে। কেউ কেউ আবাসিক মাদ্রাসায়, এতিম খানায় থাকে যেখানে শিশুবিকাশের পরিবেশ প্রশ্নসাপেক্ষ। এসব ক্ষেত্রে মানবিক আদান প্রদান খুব সীমিত হয়। ব্যক্তি হিসেবে শিশুর ইচ্ছা-অনিচ্ছা ভালো লাগা, মন্দ লাগা, তার চিন্তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আড়ালে পড়ে থাকে।

শিশুকে স্পর্শ করা, আদর করে জড়িয়ে ধরা, তার সাথে কথা বলা, খেলা করা, প্রতিবেশীদের সাথে যোগাযোগ করানো এগুলো একজন সংবেদনশীল সামাজিক মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার পথে তাকে চারপাশের পরিবেশের সাথে যুক্ত করে।

এমন নয় যে মা বাবার সাথে না থাকলেই আদর ভালোবাসার অভাব হবার কথা কিন্তু এই সমাজ ব্যবস্থায় এখনও পর্যন্ত মা বাবাই শিশুর প্রাথমিক দায়িত্বে। শিশুর মধ্যে এই বঞ্চনার জায়গাটা সমাজের মনস্তত্ত্ব থেকেই ঢুকে পড়ার সম্ভাবনা। আবার যেখানে প্রতিদিন টিকে থাকার যুদ্ধ সেখানে আত্মীয়-স্বজন বাবা মায়ের সাংস্কৃতিক, মানসিক বিকাশ কতটুকু আশা করা যায় যে তাঁরা সন্তানের মানস গঠন করবেন? অভাব অনটন, অস্থিরতা আর তার অনুষঙ্গ হিসেবে কলহ, সহিংসতা, তিক্ততা দেখেই শিশু জীবনের ধারণা পায়। শারীরিক নির্যাতন থেকে সেও বাদ যায় না। যে শিশুটি এভাবে বড় হয় তার মধ্যে বিভিন্ন মানসিক সমস্যা দেখা যেতে পারে। জীবন সম্পর্কে তার ধারণায় ভয়, আশঙ্কা, হতাশা, অনিরাপত্তাবোধ, আত্মবিশ্বাসের অভাব এগুলো যোগ হতে পারে। পরোক্ষভাবে বিদ্বেষ, সহিংসতাও তার ভেতর জন্ম নিতে পারে।

এদিকে শপিং মল, রেস্টুরেন্ট, গার্মেন্টস দখল করে নিচ্ছে খেলার মাঠ। এমনকি গ্রামেও খোলা জায়গা ঘেরা পড়ে যাচ্ছে, ঢুকে যাচ্ছে আবাসন প্রকল্পের পেটে। খেলাধুলার শারীরিক সামাজিক দিক থেকে শ্রেনী নির্বিশেষে শিশুরা বঞ্চিত। বন্ধ ঘরে, গলির ভেতর, পথের ধারে, নালার পারে তো আর মাঠের খেলা চলেনা। নিম্নবিত্ত পরিবারে শিশুর বিনোদনের ব্যবস্থাও সীমিত। কোনো কোনো সময় টেলিভিশন আর মোবাইলই বিনোদন, বাবা মায়ের অনুপস্থিতিতে সঙ্গী। এছাড়া ভিডিও গেম, পর্ণ, মাদকের হাতছানি কম নয়। চারপাশের পরিবেশে অভাবের সাথেই এসে পড়ে বিভিন্ন অপরাধ জগতের ছায়া। ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে শিশুরা যৌন সহিংসতার ঝুঁকিতে থাকলেও আর্থ-সামাজিক নিচের স্তরের শিশুরা বিভিন্ন কারণে অনেক বেশি অরক্ষিত থাকে।

বাংলাদেশে জনসংখ্যার এক পঞ্চমাংশ কিশোর কিশোরী। দশ এগারো বছর বয়সের পর থেকে শিশুরা বয়োসন্ধিজনিত শারীরিক মানসিক বিভিন্ন পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যেতে থাকে যার সাথে তার নতুন করে খাপ খাওয়াতে হয়। শারীরিক বৃদ্ধি এইসময় আবারো দ্রুত হয়। তাই পুষ্টির চাহিদা বাড়ে। সামাজিক সাংস্কৃতিক পরিবেশ তাকে প্রভাবিত করে নতুন ভাবে। জীবন জগৎ সম্পর্কে তার চিন্তা ভাবনায় একটা বিচার বিশ্লেষণ শুরু হয়,পরিবেশের ধরণ অনুযায়ী বিভিন্ন বিষয়ে সে অনুসন্ধিৎসু হয় কিন্তু শিক্ষা সুযোগের অভাব, আর্থসামাজিক বৈষম্যের কারণে তার জানাশোনার পথ খুব সহজ হয় না। সমাজে সুযোগ সন্ধানীদের হাতে সে ব্যবহৃত হয় বিভিন্ন ভাবে। বয়ঃসন্ধিকালীন আলাদা যত্ন, সাহচর্য প্রয়োজন। কিন্তু বৈষম্যের সমাজে এই চিন্তা বিলাসিতা। এই সময় রক্ত স্বল্পতা, আয়রনের ঘাটতি এসব কারণে মেয়ে শিশুদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বেশি থাকে, তার সাথে যুক্ত হয় সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বাল্য বিবাহ। শারীরিক মানসিক গঠন তৈরি না হতেই দুষ্টচক্রে ঢুকে পড়তে হয় তাকে। শৈশব কৈশোরে এভাবেই তার পরবর্তী জীবন যাপনের প্রস্তুতি শুরু হয়।

বয়ঃসন্ধিকালীন আলাদা যত্ন, সাহচর্য প্রয়োজন। কিন্তু বৈষম্যের সমাজে এই চিন্তা বিলাসিতা। এই সময় রক্ত স্বল্পতা, আয়রনের ঘাটতি এসব কারণে মেয়ে শিশুদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বেশি থাকে, তার সাথে যুক্ত হয় সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বাল্য বিবাহ।

বলা হচ্ছে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সীদের মধ্যে ৬.৮% শিশু কোনো না কোনো ধরনের শ্রমে নিযুক্ত।২৯ বাস্তবে এই হারের হের ফের হতে পারে। সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীতে শিশু খুব বেশিদিন শিশু থাকতে পারেনা। টেনে হিঁচড়ে বড় করে ফেলা হয়। শৈশব ফেলে, খেলা ছেড়ে, স্কুল ছেড়ে জীবিকার খোঁজে যেতে হয় অনেক শিশুকে। বাসাবাড়িতে, হোটেলে, চা দোকানে, অলিগলির ওয়ার্কশপ, কারখানার অন্ধকার ঘরে, বয়স লুকিয়ে গার্মেন্টসে তার আর এক জীবন শুরু হয়। সেখানে তার জন্য কোনো সুখকর পরিবেশ অপেক্ষা করে থাকেনা বলা বাহুল্য।

শিশুর চিকিৎসার কী অবস্থা?

তারপর আসে চিকিৎসার প্রসঙ্গ। সরকারি হাসপাতাল গুলো বেড সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় কম। জেলা হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে এক মুহুর্ত থাকলেই সেটা বোঝা যাবে। বারান্দায়, বাথরুমের সামনে কোথায় শিশুর বিছানা নেই? বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে এলে সারাদিন সময় হাতে নিয়ে আসতে হবে। চাকুরীজীবী অভিভাবকের পক্ষে প্রায়ই খুব কঠিন হয়ে পড়ে। তাও আশেপাশে যারা থাকেন তাদের শিশুরা এই সুবিধা কিছু পেয়ে থাকে। রোগীর তুলনায় চিকিৎসা জনবলে প্রচুর ঘাটতি আছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, জনবল ঘাটতির কারণে শিশুদের চিকিৎসা সব জায়গায় হয় না। এসব কারণে খরচ সাপেক্ষ বেসরকারি হাসপাতাল ক্লিনিকের শরণাপন্ন হতে হয়। আবার বেসরকারি সুবিধাগুলো সব এলাকায় সমানভাবে নেই। তার ফলে ওষুধের দোকানগুলো বেশ ভালোভাবে হাসপাতাল আর চিকিৎসকের বিকল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে জনমানসে। বড়দের পাশাপাশি শিশুদের চিকিৎসাও এখানেই হয়। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে এন্টিবায়োটিকসহ বিভিন্ন ধরনের ওষুধ দিয়ে শিশুর চিকিৎসা চলে। এছাড়া স্বল্প প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্য সহকারী, যারা প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে চিকিৎসকের কাছে পাঠানোর কথা তারাই শিশুকে চিকিৎসা দেন। তাছাড়া সবজায়গায় চিকিৎসকের কাছে পাঠানোর সুবিধা নেই। অনেক ক্ষেত্রে আসলেই চিকিৎসা নিতে আসাটা একটা মহা প্রস্তুতির বিষয় হয়ে পড়ে খরচ, যোগাযোগ, পরিবারের জনবল সব মিলে। তাই নিরুপায় হয়ে বাড়ির কাছেই কাজ চালিয়ে নিতে চান অভিভাবক। না পারতে হাসপাতালে আসেন। শিশু যেহেতু নিজে তার অসুস্থতার কথা বোঝাতে পারে না, খুব খারাপ না হলে অভিভাবকও অনেক সময়ই বুঝতে পারেন না, রোগ জটিল পর্যায়ে চলে যায়। দেখা গেছে, অনুর্দ্ধ ৫ বছর বয়সী যাদের শ্বাসনালীর সংক্রমণ ছিল তাদের মধ্যে ৫৫% শিশু চিকিৎসা নিয়েছে। এছাড়া যাদের জ্বর ছিল তাদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ চিকিৎসা নিয়েছে।৩০

শ্রমজীবী পরিবারের শিশু স্বাস্থ্যের কিছু নমুনা

১। মীম এর বয়স ৭ মাস। ডায়রিয়া নিয়ে ভর্তি হয়েছে। গার্মেন্টস শ্রমিক মায়ের বয়স ১৭ বছর যদিও অপুষ্ট শরীর স্বাস্থ্যের কারণে আরো কম দেখাচ্ছিল। বাচ্চার জন্ম হয়েছে কাছেই একটা বেসরকারি হাসপাতালে। মেয়েকে দুই মাসের রেখে কাজ করছেন। দিনে সুজি কৌটার দুধ খাওয়ান। নানির কাছে থাকে। রাত দশটার পর বুকের দুধ দিতে চেষ্টা করেন। মায়ের কথামত বাচ্চা বুকের দুধ তেমন পায়না।

২। আবু বকর এর বয়স ৫ বছর। পেটে ব্যথা নিয়ে এসেছে। তার খুব ঘন ঘন কৃমি হয়। ছয় মাস পর পর সরকারি কৃমির ওষুধ খাওয়ানো হয় কিন্তু কমে না। শিশুটির বাবা বিদেশে থাকেন। মা নানিসহ এক রুমে ভাড়া থাকেন। ৫টা পরিবার মিলে একটা গোসলখানা আর টয়লেট। খুব পরিষ্কার রাখা সম্ভব হয় না। মায়ের কথামত চারপাশের পরিবেশ নোংরা। শিশুটি সেখানে খেলাধুলা করে। তাঁরা সাপ্লাই এর পানিই খান। পানির লাইনের পাশেই ড্রেইন। গ্যাস খরচ বাঁচাতে গিয়ে সবসময় পানি ফুটিয়ে নিতে পারেন না।

৩। আবরার এর বয়স ৪  মাস। ঘন ঘন ঠাণ্ডা লাগে। মা নতুন চাকরিতে যোগ দিয়েছেন। বাবা ১৫০০০ পেতেন। একজনের আয়ে চলছে না। দুই জায়গায় ঋণ আছে। মেয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ত। বাচ্চা দেখার লোক নেই তাই স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নিয়েছেন। এখন সে ই ছেলের দেখাশোনা করে। মা বললেন, মেয়েকে তো কদিন পর বিয়েই দিয়ে দেবেন আর পড়ে কি হবে। খরচও বেশি। সাথে এটাও বললেন যে, তাঁর নিজেরও ক্লাস সেভেন পড়ার সময় বিয়ে হয়ে গিয়েছিল।

৪। দুই মাসের রোজামনি জন্মের পর থেকে নিয়মিত পায়খানা করে না। মা প্রতিবেশীর কাছে শুনেছেন একটা হরমোনের সমস্যার কারণে এরকম হয়, এতে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী হতে পারে। গার্মেন্টস শ্রমিক মা টাকা জমিয়ে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে এসেছেন। বড় বাচ্চার বয়স ৫ বছর। বয়স্ক মা সাথে থাকেন বাচ্চা দেখার জন্য। চারজন একটা রুমে থাকেন মাসিক ৩,০০০ টাকা ভাড়ায়। আলাদা রান্নাঘর নেই। গ্যাস সিলিন্ডার দিয়ে ভিতরে রাধা বিপদ মনে করেন তাই বাইরে এনে রাঁধেন। বাবা হঠাৎ আসে। টাকা নিয়ে চলে যায়। মা এটা স্বাভাবিক মনে করেন।

৫। আবদুর রহমানের বয়স ১৫ বছর। ঘাড়ে পিঠে ব্যাথা নিয়ে এসেছে। পরীক্ষা করে কোনো অসুবিধা পাওয়া গেল না। বাবা এক্স রে করে দেখতে চান। এক্স রে-ও ভালো। জানা গেলো গত এক বছর বাসার কাছে একটা গার্মেন্টস এক্সেসরিজের কারখানায় কাজ করে সে। ওখানে ফ্লোরে বসে ঘাড় নিচু করে কাজ করতে হয়। বাবা বললেন পড়াশোনা হচ্ছেনা তাই কাজে দিয়েছেন, সংসারে কিছু সাশ্রয় হয়।

৬। দশমাস বয়সী শিশুকে নিয়ে আসা হয়েছে জ্বর ডায়রিয়ার জন্য। জানা গেলো তার খিঁচুনিও হয়েছে। চিকিৎসক জরুরি ভর্তির পরামর্শ দেয়াতে বাবা ভীষণ উত্তেজিত হয়ে গেলেন। তাঁর লোকজন নেই, ছুটি নেই। তিনি চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি যাবেন। কদিন আগে মায়ের চিকিৎসা করতে গিয়ে একটা চাকরি হারিয়েছেন এখন আর একটা চাকরি হারাতে পারবেন না।

শেষ কথা

বাংলাদেশে স্বাস্থ্যখাতে ব্যক্তিগত খরচ (Out of pocket expenditure) বেশি (৬৭%) যা WHO সুপারিশের (২০%) প্রায় তিন গুণ।৩১ দেখা গেছে, বস্তি এলাকায় এই খরচের সিংহভাগ ওষুধের পিছনে চলে যায়, আসল চিকিৎসা বহু দূরে থাকে। চিকিৎসা সেবা বঞ্চিত জনগোষ্ঠীতে চিকিৎসা আর ওষুধ মোটামুটি সমার্থক। এতে ওষুধের ব্যবসার উন্নতি হলেও এই জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যের অবস্থা খারাপের দিকেই যাবার কথা। বলা হয় মানুষের স্বাস্থ্য সচেতনতা বেড়েছে, স্বাস্থ্য সেবা নেবার সক্ষমতাও বেড়েছে। নিজের রিক্সা বিক্রি করে কেউ যখন শিশুর চিকিৎসা খরচ পরিশোধ করেন তখন পরবর্তীতে শিশুর খাবার নিশ্চিত কিভাবে করবেন সেই হিসেবে না গিয়ে ওই মুহূর্তে আমরা তাকে সক্ষমতার পরিসংখ্যানে নিতে পারি হয়ত। একজন শ্রমিক নারী শিশু পালনের জন্য ছুটি না পেলেও, শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াতে না পারলেও, দিনভর শিশুর সংস্পর্শে না থাকলেও কৌটার দুধ কিনতে পারেন আর ওষুধ কিনে খাওয়াতে পারেন। কাজেই তাকেও একই ভাবে স্বাস্থ্য সেবা নিতে  সক্ষম বলতে পারি। সন্তানের জন্য স্বাস্থ্যকর বাসস্থান, পুষ্টির ব্যবস্থা করতে না পারলেও দশ পনেরো টাকা দামে “ফলের জুস” কিনে দিতে পারেন। শিক্ষার ব্যবস্থা করতে না পারলেও বিনোদন এর মাধ্যম হিসেবে কখনওবা টেলিভিশন, মোবাইল কিনে দিতে পারেন। পরিসংখ্যানের হিসাব নিকাশের সাথে চারপাশের জীবন মিলাতে গেলে তাই বিভ্রান্ত হতে হয়। সমাজে যখন বৈষম্য বেশি থাকে সেখানে পরিসংখ্যান নিয়ে সন্তুষ্ট হবার উপায় নেই। শ্রেণী নির্বিশেষে পুষ্টি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যকর বাসস্থান, সামাজিক নিরাপত্তা, মানসিক বিকাশ এক কথায় পূর্ণ সম্ভাবনা নিয়ে সুস্থ জীবন যাপনের অধিকার দেশের সব শিশুর। কাজেই চিকিৎসার প্রাপ্যতা শুধু নয়, সব শিশুর স্বাস্থ্য নির্মাণের শর্তগুলো নিশ্চিত করতে হবে।

বনানী চক্রবর্তী: চিকিৎসক। ই-মেইল: cbanani24@gmail.com

তথ্যসূত্র:

WHO, https://www.who.int/about/governance/constitution

Ruth E. K. Stein, Defining child health in the 21st century, Pediatric Research.2024; vol 96:1438–1444, https://www.nature.com/articles/s41390-024-03423-w#auth-Ruth_E__K_-Stein-Aff1 

—Ibid— 

Z.A. Bhutta et al., What works? Interventions for maternal and child undernutrition and survival, Lancet, 371 (2008), pp. 417-440, Feb 2;371(9610):417-40. doi: 10.1016/S0140-6736(07)61693-6, https://pubmed.ncbi.nlm.nih.gov/18206226/

Catherine ED et al. The next 1000 days: building on early investments for the health and development of young children. Volume 404, Issue 10467 p2094-2116November 23, https://www.thelancet.com/journals/lancet/article/PIIS0140-6736(24)01389-8/fulltext

Pia R Britto et al. Nurturing care: promoting early childhood development: Advancing Early Childhood Development: from Science to Scale2,  october 4 2016, https://www.thelancet.com/journals/lancet/article/PIIS0140-6736(16)31390-3/abstract 

Victor M Aguayoa vaguayo et al, The first and next 1000 days: a continuum for child development in early life, Volume 404, Issue 10467p2028-2030, November 23, 2024 https://www.thelancet.com/journals/lancet/article/PIIS0140-6736(24)02439-5/abstract#:~:text=The%20centrality%20of%20the%20first,and%20brain%20development%20in%20children. 

Cesar G Victora et al. Effects of eartly life poverty on health and human capital in children and adolescent; analysis of national serveys and birth cohort studies in LMICs.:Optimizing Child and Adolecsent Health and Development2. vol.339, april 30 2022, https://ipa-world.org/uploadedbyfck/TL-Optimising-Healthseries-BOOKLET-passed-28042022.pdf

Bangladesh Demographic and Health Survey 2022,  https://niport.portal.gov.bd/sites/default/files/files/niport.portal.gov.bd/miscellaneous_info/5585841a_d4fe_405c_b235_fbc4873ae742/2023-04-17-03-16-9833e31b63e1944d5796a1e4ec40d708.pdf

১০The situation of children in Bangladesh,  Bangladesh planning commission (GED), Government of the People’s Republic of Bangladesh and Unicef, www.gedkp.gov.bd, www.unicef.org/bangladesh

১১শিরোনাম: Graduate unemployment: Who’s to blame? jan 13 2023, https://www.thedailystar.net/opinion/views/news/graduate-unemployment-whos-blame-3219261

১২Bangladesh planning commission (GED), Government of the People’s Republic of Bangladesh and Unicef, The situation of children in Bangladesh, www.gedkp.gov.bd, www.unicef.org/bangladesh

১৩Bangladesh Demographic and Health Survey 2022,  https://niport.portal.gov.bd/sites/default/files/files/niport.portal.gov.bd/miscellaneous_info/5585841a_d4fe_405c_b235_fbc4873ae742/2023-04-17-03-16-9833e31b63e1944d5796a1e4ec40d708.pdf

১৪Eric O Ohuma et al, National, regional, and global estimates of preterm birth in 2020, with trends from 2010: a systematic analysis, Lancet 2023; 402: 1261–71,  https://www.thelancet.com/pdfs/journals/lancet/PIIS0140-6736(23)00878-4.pdf

১৫Bangladesh Demographic and Health Survey 2022,  https://niport.portal.gov.bd/sites/default/files/files/niport.portal.gov.bd/miscellaneous_info/5585841a_d4fe_405c_b235_fbc4873ae742/2023-04-17-03-16-9833e31b63e1944d5796a1e4ec40d708.pdf

১৬—Ibid—

১৭—Ibid—

১৮Maternal and Perinatal Death Surveillance and Response (MPDSR) in Bangladesh Progress and Highlights in 2020, https://bangladesh.unfpa.org/sites/default/files/pub-pdf/mpdsr_annual_report_2020_final.pdf

১৯Bangladesh Demographic and Health Survey 2022,  https://niport.portal.gov.bd/sites/default/files/files/niport.portal.gov.bd/miscellaneous_info/5585841a_d4fe_405c_b235_fbc4873ae742/2023-04-17-03-16-9833e31b63e1944d5796a1e4ec40d708.pdf

২০The situation of children in Bangladesh,  Bangladesh planning commission (GED), Government of the People’s Republic of Bangladesh and Unicef, www.gedkp.gov.bd, www.unicef.org/bangladesh

২১Bangladesh Demographic and Health Survey 2022,  https://niport.portal.gov.bd/sites/default/files/files/niport.portal.gov.bd/miscellaneous_info/5585841a_d4fe_405c_b235_fbc4873ae742/2023-04-17-03-16-9833e31b63e1944d5796a1e4ec40d708.pdf

২২The situation of children in Bangladesh,  Bangladesh planning commission (GED), Government of the People’s Republic of Bangladesh and Unicef, www.gedkp.gov.bd, www.unicef.org/bangladesh

২৩One child dies of pneumonia every 39 seconds, agencies warn, https://www.unicef.org/bangladesh/en/press-releases/one-child-dies-pneumonia-every-39-seconds-agencies-warn

২৪The situation of children in Bangladesh,  Bangladesh planning commission (GED), Government of the People’s Republic of Bangladesh and Unicef, www.gedkp.gov.bd, www.unicef.org/bangladesh

২৫Schools ill-equipped to provide healthy and inclusive learning environments for all children – UNICEF, WHO, 23 June 2022, https://www.unicef.org/bangladesh/en/press-releases/schools-ill-equipped-provide-healthy-and-inclusive-learning-environments-all

২৬The situation of children in Bangladesh,  Bangladesh planning commission (GED), Government of the People’s Republic of Bangladesh and Unicef, www.gedkp.gov.bd, www.unicef.org/bangladesh

২৭Sustainable Financing Initiative for School Health and Nutrition (SFI) School Meals Financing Rapid Assessment. Bangladesh. https://educationcommission.org/wp-content/uploads/2022/12/SFI-Country-Case-Study-Bangladesh-April-2022.pdf

২৮The situation of children in Bangladesh,  Bangladesh planning commission (GED), Government of the People’s Republic of Bangladesh and Unicef, www.gedkp.gov.bd, www.unicef.org/bangladesh

২৯—Ibid—

৩০Bangladesh Demographic and Health Survey 2022,  https://niport.portal.gov.bd/sites/default/files/files/niport.portal.gov.bd/miscellaneous_info/5585841a_d4fe_405c_b235_fbc4873ae742/2023-04-17-03-16-9833e31b63e1944d5796a1e4ec40d708.pdf
 
৩১The situation of children in Bangladesh,  Bangladesh planning commission (GED), Government of the People’s Republic of Bangladesh and Unicef, www.gedkp.gov.bd, www.unicef.org/bangladesh

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •