কৃষিপণ্যের দাম, কৃষকের আত্মহত্যা এবং জরুরী প্রস্তাব

গত ২৬শে মার্চ মেহেরপুরের মুজিবনগরের কৃষক সাইফুল শেখ পেঁয়াজচাষে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। তার মৃত্যুর পেছনের কারণ ও বাংলাদেশের কৃষকদের দুরবস্থার মাঠপর্যায়ের চিত্র তুলে আনতে একটি তথ্যানুসন্ধ্যান চালায় ‘বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তা নেটওয়ার্ক’- খানি। এই অনুসন্ধান থেকে প্রাপ্ত তথ্য জাতীয় পর্যায়ে তুলে ধরতে তারা গত ২৩ এপ্রিল ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন। আত্মহত্যার শিকার কৃষক সাইফুল শেখের মেয়ে রোজেফা খাতুন ও তার মা রমেসা বেগমও এই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। এখানে সংবাদ সম্মেলনে উপস্থাপিত মূল বক্তব্য উপস্থিত করা হলো।
ফসলের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া বাংলাদেশের প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকের জন্য দীর্ঘদিনের একটি অলিখিত শোষণ-বঞ্চনার বাস্তবতা। কৃষি নির্ভরশীল দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশে সবচেয়ে অবহেলিত গোষ্ঠী আমাদের কৃষক। পৃথিবীর কৃষিপ্রধান দেশগুলোতে কৃষকের জন্য বিভিন্ন সেইফ গার্ডিং বা সুরক্ষা স্কিম থাকলেও বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো কর্মসূচি নেই। চাষাবাদের প্রাথমিক পর্যায় থেকে শুরু করে উচ্চমুল্যে বীজ, সার, শ্রমিকের মজুরি, সেচ, কীটনাশক, ফসল তোলা এবং বিক্রির প্রতিটি পর্যায়ে প্রাকৃতিক নানা বৈরিতা, দুর্যোগ পেরিয়ে এসে ফড়িয়াবাজি আর ফসলের দাম নিয়ে সিন্ডিকেট এর কারসাজিতে ভুগতে হয় তাদের। অর্থনৈতিক নানা টানাপোড়ন, মূল্যস্ফীতি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারি- সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে উল্লেখযোগ্য কোনো বিপর্যয় ছাড়াই এ দেশের মানুষের টিকে থাকার মূলে সবচেয়ে বড় অবদান কৃষকের। অথচ নীতিনির্ধারকদের অবহেলার শিকার হয়ে এই কৃষককেই সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
উৎপাদন যত ভালোই হোক না কেন, ফসলের ন্যায্যমূল্য না পেলে কৃষকের জন্য তা সোনার ফসল হয় না, বরং গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। আপনারা সকলে এ বছরের উদ্বৃত্ত ফসল সম্পর্কে অবগত আছেন। এবারের মৌসুমে চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে; আলুর বাম্পার ফলন হয়েছে। এক কেজি আলুর উৎপাদন খরচ ২২-২৫ টাকা হলেও কৃষকদের তা মাত্র ১৪ টাকায় বিক্রি করতে হয়েছে। ন্যায্য মূল্য না পেয়ে কৃষক ফসল আড়তে ফেলে আসছেন, গরুকে খাওয়াচ্ছেন- এমন নানা খবর গণমাধ্যমে বারবার আমাদের সামনে এসেছে।
কৃষকের প্রয়োজন ন্যায্য মূল্য, ভোক্তা চায় কম মূল্য, ব্যবসায়ী চায় বেশি লাভ। কৃষকের উৎপাদিত পণ্য ভোক্তার হাতে যেতে বেশ কয়েকদফা হাতবদলের প্রক্রিয়ায় স্থানীয় ব্যবসায়ী, পাইকারি ব্যবসায়ী ও খুচরা ব্যবসায়ীরা লাভ পেলেও সবচেয়ে কম মূল্য পান কৃষক, এমনকি উৎপাদনের খরচ ও উঠে আসেনা।
এবারে শীতকালে এবং রমজান মাসে সবজির দাম অন্যান্য সাম্প্রতিক বছরের চেয়ে তুলনামূলক কম থাকায় ভোক্তারা স্বস্তি পেলেও উৎপাদন খরচ বেশি থাকায় এর মাশুল দিতে হয়েছে কৃষককে। বাংলাদেশের অধিকাংশ ক্ষুদ্র কৃষক ফসল উৎপাদনের ব্যয়ভার বহনে নানাভাবে ঋণ নিয়ে ফসল ফলান। ঋণ শোধ করতে অনেকটা তড়িঘড়ি করেই কৃষক ফসল বিক্রি করে দেন। আবার, বাজারে দাম উঠা পর্যন্ত ফসল ধরে রাখার ক্ষেত্রেও পর্যাপ্ত সংরক্ষণাগার নেই, ফলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দ্রুত পচনশীল কৃষি পণ্য বেশিদিন ধরে রাখা যায় না। আলু সংরক্ষণে সরকারি-বেসরকারি ৩৬৬টি হিমাগার থাকলেও সবজির জন্য কোনো বিশেষায়িত হিমাগার নেই। কৃষিপণ্য বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী মানসম্মত সংরক্ষণ ব্যবস্থার অভাবে দেশে প্রতিবছর ২০-৪৪ শতাংশ সবজি ও ফলমূল নষ্ট হয়ে যার আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২৮ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। এবার কোল্ড স্টোরেজে আলু সংরক্ষণের সংকট নিয়ে দেশের গণমাধ্যমগুলোতে একাধিকবার সংবাদ হয়েছে- একদিকে হিমাগারের সংখ্যা অপ্রতুল, অন্যদিকে হিমাগারের ভাড়া বাড়িয়েছেন মালিকেরা।
এবারে শীতকালে এবং রমজান মাসে সবজির দাম অন্যান্য সাম্প্রতিক বছরের চেয়ে তুলনামূলক কম থাকায় ভোক্তারা স্বস্তি পেলেও উৎপাদন খরচ বেশি থাকায় এর মাশুল দিতে হয়েছে কৃষককে।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এ বছর টমেটোর বাম্পার ফলন হলেও একইভাবে ফসলের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া, বাজারজাতকরণের অত্যাধিক ব্যয় এবং হিমাগার না থাকার কারণে অনেক কৃষক ক্ষেত থেকেই টমেটো তোলেননি। ফলে ক্ষেতেই পচে নষ্ট হয়েছে বিপুল পরিমাণ টমেটো। ভালো ফলন হবার পরেও সবজি সংরক্ষণ ও মূল্য সংকটের এই দীর্ঘ চলমান প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই কৃষক ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হন। দুর্গম উৎপাদনস্থল, ক্রেতা কম বিক্রেতা বেশি, বিশেষ করে পাহাড়ি ও হাওড় এলাকায় পরিবহন সংকট, ভঙ্গুর সড়ক অবকাঠামো এবং পণ্যের গুণমানজনিত সমস্যাসহ বিবিধ প্রতিবন্ধকতা ক্ষুদ্র কৃষকের ফসলের মূল্য বঞ্চনায় নিয়ামক হয়ে ওঠে।
আলু সংরক্ষণে সরকারি-বেসরকারি ৩৬৬টি হিমাগার থাকলেও সবজির জন্য কোনো বিশেষায়িত হিমাগার নেই। কৃষিপণ্য বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী মানসম্মত সংরক্ষণ ব্যবস্থার অভাবে দেশে প্রতিবছর ২০-৪৪ শতাংশ সবজি ও ফলমূল নষ্ট হয়ে যার আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২৮ হাজার ৮০০ কোটি টাকা।
২০১৮ সালে ‘কৃষিপণ্য বিপণন আইন’ প্রণয়নের তিন বছরের মাথায় ‘কৃষিপণ্য বিপণন বিধিমালা’ তৈরি হয়, যেখানে চাল, ডাল, শাকসবজি, মাছ, ডিম, দুধ এবং প্রক্রিয়াজাত খাবারের জন্য সর্বোচ্চ মুনাফার হার নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। বিধিমালা অনুযায়ী কৃষক, পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে যৌক্তিক মুনাফার একটি কাঠামো ঠিক করা আছে। এছাড়া বাজারভিত্তিক আলাদা কমিটি গঠন এবং জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে এই মুনাফার হার নিরীক্ষা ও বাস্তবায়নের ব্যবস্থাও থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবে এই বিধিমালার কার্যকর কোনো প্রয়োগ দেখা যায় না।
বাংলাদেশে ধান ও চাল ছাড়া অন্য কোনো কৃষিপণ্য সরকারিভাবে সংগ্রহ করা হয় না। খাদ্যশস্যের নিরাপত্তা এবং চালের বাজার স্থিতিশীল রাখতে সরকার চাল সংগ্রহ করে ঠিকই, কিন্তু বিগত দুই বছরে জ্বালানি, সার, কৃষিশ্রমিকের মজুরি — সবকিছুর খরচ একের পর এক বাড়লেও কৃষক সেই অনুযায়ী ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না।
ধান-চাল সংগ্রহে সরকারি উদ্যোগ বরাবরই সীমিত। উপরন্তু, এই সংগ্রহ প্রক্রিয়ায় মূল লাভ চলে যায় মিলারদের হাতে। চলতি বছরে খাদ্য মন্ত্রণালয় বোরো মৌসুমে ধান সংগ্রহের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, তা গত বছরের তুলনায় অর্ধেক — এবার তিন লাখ মেট্রিক টন, যেখানে গত বছর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ছয় লাখ।
বাংলাদেশে ধান ও চাল ছাড়া অন্য কোনো কৃষিপণ্য সরকারিভাবে সংগ্রহ করা হয় না। খাদ্যশস্যের নিরাপত্তা এবং চালের বাজার স্থিতিশীল রাখতে সরকার চাল সংগ্রহ করে ঠিকই, কিন্তু বিগত দুই বছরে জ্বালানি, সার, কৃষিশ্রমিকের মজুরি — সবকিছুর খরচ একের পর এক বাড়লেও কৃষক সেই অনুযায়ী ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না।
অন্যদিকে কৃষকের কাছ থেকে পণ্য সংগ্রহের যে প্রক্রিয়া রয়েছে, তা এখনও অস্বচ্ছ, দুর্বল এবং নানা অনিয়মে ভরা। ফলে বছরের পর বছর কৃষক প্রতারণার শিকার হচ্ছেন।
এতসব সমস্যা নানাভাবে আলোচনায় আসা সত্ত্বেও কৃষকের সার্বিক এই অসহায়ত্ব নিরসনে কোনো সমাধান আসেনি। কৃষকের জন্য বাজার থাকে পুরোপুরি মুক্ত — পণ্য বিক্রির সময় তিনি দাম নির্ধারণে কোনো নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেন না। কিন্তু ফড়িয়া, পাইকার ও খুচরা বিক্রেতাদের হাতে সেই একই পণ্য পৌঁছানোর পর বাজারের খোলামেলা চরিত্র বদলে যায়; তখন সেটি হয়ে ওঠে নিয়ন্ত্রিত ও সীমাবদ্ধ, যেখানে মূল্য নির্ধারণের ক্ষমতা তাদের হাতে।
এ বছর কৃষকের হাতে পেঁয়াজ শেষ হবার পরেই, ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট এর গুদামজাত এর দৌরাত্মে ভরা মৌসুমেও এই দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। ৩০-৩৫ টাকার পেঁয়াজ খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকায়। আর গত ২৬শে মার্চ, ২০২৫ তারিখে মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার ভবরপাড়া গ্রামে ৫৫ বছর বয়সী কৃষক সাইফুল শেখ পেঁয়াজ চাষে আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়ে ঋণ পরিশোধের চাপে মর্মান্তিকভাবে আত্মহত্যা করেছেন। দুই বিঘা জমিতে পেঁয়াজ চাষে তার দেড় লাখ টাকা খরচ হলেও পেঁয়াজ বিক্রিতে পাওয়া গেছে ৫৮ হাজার টাকা। গত ২৬ মার্চ নিজের পেঁয়াজক্ষেতে বিষপান করে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে প্রথমে মেহেরপুর সদর হাসপাতাল এবং পরে অবস্থার অবনতি হওয়ায় কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালে নেয়া হয়। ২৮ মার্চ বৃহস্পতিবার চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। এর ঠিক ১৮ দিন পর ১৪ এপ্রিল, ২০২৫ রাজশাহীর বাঘা উপজেলার মাঝপাড়া বাউসা গ্রামের আরো এক কৃষক মীর রুহুল আমিন পেঁয়াজ চাষের লোকসান এবং ঋণ এর ভারে ট্রেনের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন।
দুই বিঘা জমিতে পেঁয়াজ চাষে তার দেড় লাখ টাকা খরচ হলেও পেঁয়াজ বিক্রিতে পাওয়া গেছে ৫৮ হাজার টাকা। গত ২৬ মার্চ নিজের পেঁয়াজক্ষেতে বিষপান করে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে প্রথমে মেহেরপুর সদর হাসপাতাল এবং পরে অবস্থার অবনতি হওয়ায় কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালে নেয়া হয়।
কৃষকরা জানিয়েছেন, মার্চের শেষের দিকে পেঁয়াজের মূল্য চাষের খরচ মেটানোর জন্যও যথেষ্ট ছিলো না। প্রতি বিঘায় খরচ ৪০-৫০ হাজার টাকা হলেও পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১১শ’ থেকে ১২শ’ টাকা মণ, এবং হাইব্রিড সুখসাগর পেঁয়াজ ৭শ’ থেকে ৮শ’ টাকা মণ। গড়ে বিঘাপ্রতি উৎপাদন ২০-৩০ মণ হওয়ায় বিক্রির পর খরচ উঠে আসেনি। একইসাথে ভেজাল পেঁয়াজ বীজ চাষ করে এবং পেঁয়াজের জমিতে ভেজাল কীটনাশক প্রয়োগ করে দেশব্যাপী কৃষক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন এবং পেঁয়াজের ফলন বিনষ্ট হয়েছে। অথচ সাইফুল শেখের মৃত্যুর দু’সপ্তাহের মাথায় বাজারে পেঁয়াজের মূল্য বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। মেহেরপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার পলাশ মন্ডল খানি তথ্যানুসন্ধান দলকে জানান, সাইফুল শেখের মৃত্যুর মাসখানেক আগেও এলাকার পেঁয়াজ চাষীরা ভরা মৌসুমে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধে এবং ন্যায্যমূল্যের দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মানববন্ধন করেন।
মার্চের শেষের দিকে পেঁয়াজের মূল্য চাষের খরচ মেটানোর জন্যও যথেষ্ট ছিলো না। প্রতি বিঘায় খরচ ৪০-৫০ হাজার টাকা হলেও পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১১শ’ থেকে ১২শ’ টাকা মণ, এবং হাইব্রিড সুখসাগর পেঁয়াজ ৭শ’ থেকে ৮শ’ টাকা মণ। গড়ে বিঘাপ্রতি উৎপাদন ২০-৩০ মণ হওয়ায় বিক্রির পর খরচ উঠে আসেনি।
কৃষির দেশে কৃষকের আত্মহত্যা- এই হৃদয়বিদারক ঘটনাটি শুধু একটি বিচ্ছিন্ন ট্র্যাজেডি নয়, বরং এটি লজ্জাজনক এবং আমাদের কৃষি খাতের চাষীদের গভীর সংকট ও অসহায় অবস্থার প্রতি আমাদের সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
এই ঘটনার প্রেক্ষিতে গত ১৬ ও ১৭ এপ্রিল, ২০২৫ খাদ্য নিরাপত্তা নেটওয়ার্ক- খানি বাংলাদেশ এর পক্ষ হতে একটি তথ্যানুসন্ধান দল কৃষকের চলমান সংকট, এর তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের বিষয়ে ভুক্তভোগী কৃষকের পরিবার, প্রতিবেশী কৃষক, স্থানীয় কীটনাশক ব্যবসায়ী এবং স্থানীয় প্রশাসনের সাথে বিস্তারিত আলোচনা করেছে। এই অনুসন্ধানের মাধ্যমে আমরা পেঁয়াজ চাষীদের তথা কৃষকের মুখোমুখি হওয়া ভয়াবহ বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জগুলো সম্পর্কে জানতে পেরেছি।
আমাদের অনুসন্ধানে উঠে আসা প্রধান বিষয়গুলো হলো:
- আর্থিক ক্ষতির তীব্রতা: সাইফুল শেখ পেঁয়াজ চাষে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করে চরম আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়েছিলেন। তার বিনিয়োগের বিপরীতে আয় ছিল অত্যন্ত নগণ্য, যা তাকে গভীর মানসিক হতাশায় ফেলে দিয়েছিলো।
- ফসলের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় হতাশা: এই অনুসন্ধানে শুধু সাইফুল শেখ নন, স্থানীয় অন্যান্য পেঁয়াজ চাষীদের মধ্যেও ব্যাপক হতাশার চিত্র দেখা গেছে। উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি, ন্যায্য দামের অভাব, নিজের ফসল বিক্রিতে নিয়ন্ত্রণ না থাকা এবং অন্যান্য প্রতিকূলতার কারণে অনেক কৃষকই অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হয়েছেন।
- কৃষি ঋণ-সম্পর্কিত তথ্যের অভাব: সরেজমিনে কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বেশিরভাগই সরকারের দেওয়া কৃষি-ঋণ এবং অন্যান্য সরকারি সেবা-সুবিধা সম্পর্কে অবগত নন।
- ঋণের বোঝাঃ ব্যাংক ঋণের কাগজপত্রের জটিলতা এড়াতে তারা বিভিন্ন ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেন। পাশাপাশি সার, কীটনাশকের দোকান থেকে বাকিতে পণ্য নিয়ে কৃষিকাজ চালিয়ে যান। কিন্তু এইসব ক্ষেত্রে ঋণ পরিশোধের সময়সীমার সাথে ফসল ঘরে উঠার সময়ের কোনো সামঞ্জস্য না থাকায় তারা ক্রমেই হয় সুদের হারে জড়িয়ে পড়েন, কিংবা পাওনাদারের তাড়ায় মানসিক চাপের শিকার হন, যেমনটি ঘটেছে সাইফুল শেখের ক্ষেত্রে। তিনি স্থানীয় একটি ক্ষুদ্র ঋণদাতা সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে চাষাবাদ করেন এবং ফসলের অর্থ দিয়ে তা পরিশোধ করার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত ফসল ও দাম না পেয়ে পরবর্তীতে তিনি হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়েন।
- অনিয়ন্ত্রিত বীজের বাজার: বেশিরভাগ কৃষক ভারতীয় কালোবাজার এবং স্থানীয়ভাবে সংরক্ষিত বীজ থেকে থেকে ভেজাল বা নিম্নমানের বীজ কিনতে বাধ্য হন, যা তাদের উৎপাদনকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে এবং আর্থিক ক্ষতির ঝুঁকি বাড়ায়। বীজের চড়া দামও তাদের জন্য একটি বড় বোঝা। মুজিবনগরে সরকারিভাবে নাসিকা জাতের পেঁয়াজের বীজ সরবরাহ করা হলেও ভৌগলিকভাবে সুখসাগর পেঁয়াজের ফলন বেশি হয়। কৃষক সাইফুলও স্থানীয়ভাবে নিজের কেনা দুই কেজি সুখসাগর বীজ দিয়ে পেঁয়াজ চাষ করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে বীজের খরচ, কৃষিমজুরের খরচসহ অন্যান্য খরচ মিলে যেটুকু ব্যয় হয়েছে, তা পেঁয়াজ বিক্রি করে উঠে আসেনি।
- সংরক্ষণাগারের অভাব: মেহেরপুর উপজেলায় পেঁয়াজ সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় কৃষকরা ফসল উত্তলনের পরপরই একরকমে বাধ্য হয়ে পেঁয়াজ বিক্রি করে দেন। সামান্য সময় ধরে পেঁয়াজ ধরে রাখার সুযোগ না থাকায় তারা বাজারের সুবিধা নিতে পারেন না এবং আর্থিক ক্ষতি এড়াতে মাঠ থেকেই কম মূল্যে পেঁয়াজ বিক্রি করতে বাধ্য হন।
- নির্দেশনার অভাব: কৃষকদের প্রায়শই কোন ফসল চাষ করবেন, কী পরিমাণে চাষ করবেন সেই বিষয়ে নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ এবং সক্ষমতা থাকে না। বাজারের প্রবণতা, স্থানীয় কৃষক এবং ডিলারদের পরামর্শ অনুসরণ করতে গিয়ে অনেক সময় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অতিরিক্ত উৎপাদনের ফলে দাম কমে যায় এবং কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। কোনো কোনো ফসল চাষে উৎসাহিত করতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কাজ করলেও নিরুৎসাহিত করার ক্ষেত্রে কোন পদক্ষেপ নেই। আবার কৃষকরা অনেকসময় বিগত সময়ের লাভের হিসাব, বা সার্বিকভাবে লাভের প্রবণতা লক্ষ্য করে চাষের সিদ্ধান্ত নেন, অভিজ্ঞদের পরামর্শ তেমন শোনেন না। কৃষকরা সরকারের কাছ থেকে সময়োপযোগী ও পর্যাপ্ত বীজ, সার এবং অন্যান্য কৃষি উপকরণ পাননি বলে অভিযোগ করেছেন।
আমরা এই মর্মান্তিক ঘটনার প্রেক্ষিতে নিম্নলিখিত জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি:
তাৎক্ষণিক সুপারিশসমূহ
- কৃষকের উৎপাদিত ফসলের জন্য নূন্যতম সহায়ক মূল্য নির্ধারণ করতে হবে, যেখানে সরকার নির্ধারিত ন্যুনতম দামে কৃষক থেকে ফসল কিনবে সরকার। এর ফলে বাজার ওঠানামা করলেও কৃষকের লোকসান এড়ানো যাবে। এই কার্যক্রম সুচারুরূপে পরিচালনার জন্য কৃষি মূল্য কমিশন গঠনে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
- কৃষকের লোকসান ঠেকাতে সরকারিভাবে সরসরি কৃষককের কাছ থেকে ধান এবং চালের মতো অন্যান্য ফসল ক্রয়ের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। কৃষকের ফসল বিক্রির সুবিধার্থে ইউনিয়নভিত্তিক সরকারি ক্রয় কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে।
- কৃষকের উৎপাদিত ফসল সংরক্ষণে জন্য কৃষি জোনভিত্তিক কমিউনিটি সংরক্ষণাগার এবং হিমাগার তৈরির ব্যবস্থাগ্রহণ করতে হবে।
সেই সাথে আগামীতে এই ধরণের আত্মহত্যার ঘটনা প্রতিরোধে কৃষকদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করা তথা দেশের মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দীর্ঘমেয়াদে সুপারিশসমূহঃ
- প্রাকৃতিক বা যে কোনো দুর্যোগে ফসলহানির ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সুরক্ষার জন্য শস্য বীমা চালু করতে হবে।
- প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বীজ সার কীটনাশক সংক্রান্ত ফসলহানির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ঋণের সুদ মওকুফ, এককালীন সাহায্যের তহবিল গঠন এবং ঋণের কিস্তি পরিশোধের মেয়াদ বৃদ্ধির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
- ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের জন্য সরকার প্রদত্ত কৃষি ভর্তুকি সরাসরি প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে।
- কৃষকের জন্য মৌসূমভিত্তিক কৃষি ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। স্বল্পমূল্যে ও সহজ কিস্তিতে প্রকৃত কৃষকদের কৃষি যন্ত্রপাতি প্রাপ্তি নিশ্চিতকরণ এবং কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড প্রদান ও এর আওতা বৃদ্ধি করতে হবে।
- কৃষি পণ্য উৎপাদনের পূর্বাভাস, লক্ষ্যমাত্রা, বাজারজাতকরণের ধরণ, কোন মৌসুমে কোন ফসল কী পরিমাণে উৎপাদন করলে কৃষক লাভবান হবেন সেই বিষয়ে কৃষককে আগাম অবহিত করার ব্যবস্থা করতে হবে।
- আত্মহত্যাকারী কৃষক পরিবারকে সকল ধরনের সহায়তা রাষ্ট্রের পক্ষ হতে করতে হবে।
- কৃষকদের আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি এবং বাজার সম্পর্কে সচেতন করার জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও কর্মশালার আয়োজন করতে হবে।
আমরা বিশ্বাস করি, জরুরি ভিত্তিতে এই পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা হলে কেবল সাইফুল শেখের পরিবারের মতো ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক পরিবারগুলোই উপকৃত হবে না, বরং সমগ্র কৃষি খাত একটি স্থিতিশীল ও টেকসই ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর হতে পারবে।