সম্পাদকীয়

সম্পাদকীয়

সর্বজনকথা দশম বর্ষের শেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয় গত ১লা আগস্ট। পুরো জুলাই মাস জুড়ে বাংলাদেশ অস্থির ছিল এবং দ্রুত গণঅভ্যুত্থানের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। ১৫ই জুলাই থেকে শিক্ষার্থী-শ্রমিক-জনতার ওপর সরকার এবং সরকারি বিভিন্ন বাহিনীর হামলা, জখম, তান্ডব, নৃশংসতা, নির্বিচার হত্যাকান্ড সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষকে প্রতিরোধে টেনে এনেছিল শিক্ষার্থীদের পাশে রাস্তায়, গুলির মুখোমুখি। সর্বজনকথার সকলে এই সময়ে নানাভাবে জনগণের উত্থানের সাথে যুক্ত ছিলেন আবার সেই সাথে পত্রিকার লেখা, সম্পাদনা ও প্রকাশনার কাজও করেছেন। ঐ সংখ্যায় এ বিষয় নিয়ে একাধিক লেখা প্রকাশিত হয়েছে। পত্রিকা প্রকাশের চারদিনের মাথায় মহাপরাক্রমশালী সরকারের পতন হয় শেখ হাসিনার পলায়নের মধ্য দিয়ে।

গত বছরগুলোতে দেশের ভেতরে অনেক অর্থনীতিবিদ, বড় ব্যবসায়ী, বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশে ‘উন্নয়নের বিপুল অগ্রযাত্রা’ এবং তার নেতৃত্ব দেবার জন্য শেখ হাসিনার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার দলিলপত্রে, ইকনমিস্টসহ বিভিন্ন বিশ্ব কর্পোরেট জগতের পত্রিকাতে বাংলাদেশের উচ্চ প্রবৃদ্ধি আর বিপুল নির্মাণকাজ নিয়ে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা দেখা গেছে। এর অনেকগুলোই ভাড়াটে রিপোর্ট হলেও পুঁজিবাদী উন্নয়ন দর্শনে এগুলো আসলেই বিরাট সাফল্য ছিল। সেকারণে বিশ্বজুড়ে অনেকেই অবাক যে এত সফল এবং জনপ্রিয় একজন প্রধানমন্ত্রী কীভাবে এরকম জনবিদ্রোহে পতিত হলেন! এই প্রশ্নের বিস্তৃত উত্তর আছে এই সংখ্যার ‘শেখ হাসিনা সরকার: দুর্নীতি ও নিপীড়নের খতিয়ান’ শীর্ষক লেখায়।

প্রকৃতপক্ষে শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনামল জুড়ে ভোটাধিকার ও বাকস্বাধীনতা হরণ, বিরোধী দল ও ভিন্নমতাবলম্বীদের গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও পুলিশি নিপীড়ন, ব্যাংক লুণ্ঠন, ব্যাপক দুর্নীতি ও অর্থপাচার, বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ধ্বস, দ্রব্যমূল্যের ব্যাপক ঊর্ধ্বগতি, ভারতের অন্যায়ের কাছে নতজানু অবস্থান ইত্যাদি কারণে জনক্ষোভ বিস্তৃত হচ্ছিলো। ন্যায্য দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী-জনতার নির্বিচার হত্যাকান্ডের কারণে সেই পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে।

কোটা সংস্কারের আন্দোলন থেকে গণঅভ্যুত্থান তৈরির পথে শিক্ষার্থীসহ দেশের বিভিন্ন স্তরের  মানুষেরা যুক্ত হয়েছেন। প্রায় তিন সপ্তাহে এই মানুষেরা অসম্ভব, অভাবনীয় অভিজ্ঞতার মধ্যে গেছেন। তাদের ভেতরে পরিবর্তন এবং ভাংচুরও হয়েছে নানা মাত্রায়। সেইসব অমূল্য অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন ক্রমে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারী হয়ে ওঠা একজন শিক্ষার্থী। এই আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরাও অভূতপূর্ব ভূমিকা পালন করেছেন। ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক’ লেখায় ১৬ই জুলাই থেকে ১০ই আগস্ট ২০২৪ শিক্ষকদের ভূমিকার সংকলিত দলিলপত্র এই সংখ্যায় প্রকাশ করা হলো। ‘গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও শ্রমজীবীদের হিস্যা’ লেখায় এই গণঅভ্যুত্থানের আগে পরে শ্রমিক জনগোষ্ঠীর জীবন জীবিকার অবস্থা আলোচনা করা হয়েছে। গণঅভ্যুত্থান বড় এক সৃজনশীল ঘটনা, তার প্রমাণ দেয়ালে, শ্লোগানে, গানে, নাটকে, চিত্রশিল্পে, কার্টুনে, কবিতায় জমা হয়েছে। ‘২৪ এর গণআন্দোলনের গান’-এ এই সময়ে রচিত, গীত ও তুমুল জনপ্রিয় গানের সংকলনের প্রথম কিস্তি প্রকাশ করা হলো।

গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারের পতন বৈষম্যহীন বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছে। কিন্তু এর বাস্তবায়ন যে জটিল যাত্রা, তার পথে বাধাগুলো কেমন, তার পর্যালোচনা করে একটি লেখা আছে এই সংখ্যায়।  ‘বাংলাদেশ, খোলা কবরের গল্পজমিন’-এর লেখক আজকের বাংলাদেশকে দেখেছেন দিনবদলের গ্রাফিতি হিসেবে। তবে একইসঙ্গে দেখেছেন, ‘মরতে মরতে বাঁচতে চাওয়া মানুষের জিতে যাওয়ার কেচ্ছার। কিন্তু এই কেচ্ছা নিদারুণ করুণ, খোলা কবরের গল্পনামা।… নতুন ভোর একটা পূর্ণ দিন হয়ে ওঠার আগেই এক অনিশ্চিত আগামীকাল তাকে গ্রাস করতে থাকে।’ গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরশাসনের পতন হলেও পাহাড়ে আগের ব্যবস্থাই অব্যাহত আছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে হত্যাযজ্ঞের ন্যায়বিচার ও সেনাশাসন অবসানের দাবি জানিয়ে প্রকাশিত বিবৃতিতে এবিষয়ে বলা হয়েছে।    

সুন্দরবন বিনাশী রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র সুন্দরবনের ওপর ছোবল মারতে শুরু করেছে। এই কেন্দ্র ছাড়াও আরও অনেক দিক থেকে সুন্দরবন বিপদগ্রস্ত হচ্ছে। দুর্নীতি, লোভ আর দায়িত্বহীনতার কারণে ক্ষতি হচ্ছে অপূরণীয়। এবিষয়ে এই সংখ্যায় আমাদের বিশদভাবে জানিয়েছেন একজন বনজীবী। পাশাপাশি সুন্দরবনের বনজীবীদের নিয়েই আরেকটি লেখা আছে।

শ্রীলঙ্কায় বামপন্থি দিশানায়েকের জয় বর্তমান সময়ের একটি বিশেষ ঘটনা। প্রবল দুই রাজনৈতিক দলের দীর্ঘদিনের আধিপত্য ভেঙে প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনে জয়লাভ করেছেন বামদলের নেতা। কীভাবে হলো তার সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ আছে এই সংখ্যায়। দুর্নীতিবাজ সরকারের বিরুদ্ধে জনবিদ্রোহের পর নতুন ব্যবস্থায় সম্প্রতি সেখানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে দুই দলের আধিপত্যের বাইরে এই বামপন্থী নেতার বিজয় হয়। এতে দক্ষিণ এশিয়ায় ক্ষমতার পালাবদলে আরেকটি অধ্যায় তৈরি হয়েছে যা বাংলাদেশের মানুষের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। সে বিষয়টিও এই লেখায় আলোচনা করা হয়েছে।

এছাড়া ধারাবাহিক লেখা ‘বাংলাদেশের ৫০ বছর ও তারপর’ এবং চলচ্চিত্র আলোচনা ‘দিল্লীর দিল! শহরের নির্ঘুম মানুষ ও অসুস্থ পাখিদের বয়ান’ প্রকাশিত হলো এই সংখ্যায়। স্থানাভাবে নিয়মিত ধারাবাহিক ‘২২ পরিবার’ এবং ‘মৌলবাদের সংঘাত’ এর পর্ব গুলো এই সংখ্যায় প্রকাশ করা গেল না বলে আমরা দু:খিত। 

আনু মুহাম্মদ

৩১শে অক্টোবর ২০২৪

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •