পরিবেশবিনাশী জনস্বার্থবিরোধী বৈষম্যমূলক প্রকল্প

ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র‌্যাম্প

পরিবেশবিনাশী জনস্বার্থবিরোধী বৈষম্যমূলক প্রকল্প

হাতিরঝিল ও পান্থকুঞ্জ পার্ক বিধ্বংসী জনবিরোধী এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র‌্যাম্প (সংযোগ সড়ক) প্রকল্প বাতিলের দাবিতে ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪ থেকে পান্থকুঞ্জ পার্কে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন ‘গাছ রক্ষা আন্দোলন’-এর কর্মীরা। অবস্থান কর্মসূচির শততম দিনে ২৩ মার্চ ২০২৫ তারিখে বাংলাদেশ প্ল্যানার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এই প্রকল্পের বিস্তারিত তথ্য-সংবলিত এই লিখিত বক্তব্যটি উপস্থাপন করেন গাছ রক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক আমিরুল রাজীব। বক্তব্যটি যৌথভাবে লিখেছেন নাঈম উল হাসান, ড. আদিল মুহম্মদ খান, সৈয়দ মাহবুবুল আলম, পাভেল পার্থ ও আমিরুল রাজিব।

বিগত ১০০ দিন ধরে, পান্থকুঞ্জ ও হাতিরঝিল ধ্বংসকারী ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের এফডিসি থেকে পলাশী পর্যন্ত সংযোগ সড়কের নির্মাণকাজ বাতিল এবং পান্থকুঞ্জ পার্ক ও হাতিরঝিলের পরিবেশ পুনরুদ্ধারের দাবিতে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া, বায়ু ও শব্দদূষণকে উপেক্ষা করে ‘বাংলাদেশ গাছ রক্ষা আন্দোলন’-এর তরুণ পরিবেশকর্মীরা পান্থকুঞ্জ পার্কে ২৪ ঘণ্টা লাগাতার অবস্থানের মাধ্যমে ২০২৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর থেকে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। এর মাঝে ২০২৪ শেষ হয়ে ২০২৫ সাল শুরু হয়েছে। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে দাবি আদায়ে আয়োজিত হয়েছে বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও সমাবেশ। এই আন্দোলনে সংহতি জানিয়েছে বিভিন্ন সামাজিক-পরিবেশ-পরিকল্পনা-পেশাজীবী-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন। এই আন্দোলনে ইতোমধ্যেই সংহতি জানিয়েছেন ও যুক্ত হয়েছেন পরিবেশকর্মী, নগর পরিকল্পনাবিদ, সমাজকর্মী, গবেষক, এলাকাবাসী, স্থপতি, প্রকৌশলী, সংস্কৃতিকর্মী, ছাত্র-তরুণ-জনতাসহ নানান শ্রেণি-পেশার মানুষ।

গত বছর ২০২৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর সড়ক পরিবহণ ও সেতু মন্ত্রণালয়, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের তিন উপদেষ্টা পান্থকুঞ্জ পার্কে এসে আন্দোলনকারীদের সাথে কথা বলেন এবং এই বিষয়ে অধিকতর আলোচনার জন্য দ্রুততম সময়ে আন্দোলনকারীদের সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে মতবিনিময় করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। এই মতবিনিময় আলোচনা অদ্যাবধি হয়নি। আন্দোলনকারীরা এখনো সব ধরনের আবহাওয়াগত সংকট, বায়ু ও শব্দদূষণে বিপর্যস্ত হয়েও পান্থকুঞ্জে তাদের অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন।

 এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কি এবং কাদের জন্য?

ঢাকা শহরের অধিকাংশ মানুষই নিম্ন, নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারকারীর সংখ্যা এই শহরে অতি অল্প। উপর্যুক্ত আর্থসামাজিক ও পরিকল্পনাগত বাস্তবতাকে আমলে নিয়েই ২০০৫ সালে প্রণীত ঢাকার ‘কৌশলগত পরিবহণ পরিকল্পনা বা স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান (এসটিপি)’-এ ঢাকার টেকসই যোগাযোগ পরিকল্পনার জন্য বিভিন্ন প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছিল। এসটিপি অনুসারে, ঢাকা ও এর আশপাশে গণপরিবহণের যাত্রীদের ৫৮ শতাংশ বাসে যাতায়াত করেন। বাস-মিনিবাস, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও কার–এই তিন শ্রেণির যানের মধ্যে বাস-মিনিবাসে ৭২ শতাংশ ট্রিপ (যাত্রা) হয়। যত ধরনের গণপরিবহণ আছে, এর মধ্যে বাস-মিনিবাসের ভাড়া সবচেয়ে কম। বাস্তবায়নের প্রাধিকারে ঢাকার জন্য গণপরিবহণভিত্তিক সমাধানকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল, পেছনের সারিতেই ছিল ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প। এতৎসত্ত্বেও ঢাকার টেকসই পরিবহণ পরিকল্পনার জন্য অল্প ব্যয়ে অধিক উপযোগী প্রস্তাবনাসমূহকে পেছনে রেখে ২০১১ সালে গৃহীত হয় এই প্রকল্প।

ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে মূলত একটি উড়াল-সেতু, ধনীদের প্রাইভেট গাড়ি যাতে সব ধরনের যানজট এড়িয়ে নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারে এরকম দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই এর নির্মাণ শুরু হয়েছে। ঢাকার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছিল, দেশের উত্তরাঞ্চল থেকে আসা যানবাহনগুলো ঢাকাকে বাইপাস করে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সরাসরি যাতায়াত করতে পারবে, এতে যানবাহনের গতি হবে ঘণ্টায় ৮০ কিমি। চট্টগ্রাম, সিলেটসহ পূর্বাঞ্চল এবং পদ্মা সেতু হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যানবাহন ঢাকায় প্রবেশ না করে সরাসরি উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে প্রবেশ করতে সহায়তা করবে। প্রতিদিন এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে ঢাকা নগরীতে না ঢুকেই বিভিন্ন অঞ্চলের ৮০ হাজার যানবাহন চলাচল করবে। উপরন্তু উড়াল সড়ক বাস্তবায়নের পর ঢাকার উত্তর-দক্ষিণে বিকল্প সড়ক সৃষ্টি হবে; এতে ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী অংশে নিরসন হবে যানজট। কিন্তু বাস্তবতা হয়েছে উল্টো।

ছবি: প্রাথমিকভাবে যে ৫টি পথে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে তৈরির প্রস্তাবনা ছিল সেখানে পান্থকুঞ্জের ভেতরে কোনো র‍্যাম্প নামার কথা ছিল না।

প্রাথমিকভাবে ঢাকাকে বাইপাস করে নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হলেও বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে, ঢাকার লোকাল যানবাহন থেকে অতিরিক্ত টোল আদায়ের লক্ষ্যে ঢাকার ট্রাফিক ও সামগ্রিক পরিবেশকে যথাযথ বিবেচনায় না নিয়েই ঢাকার ভেতর দিয়ে র‌্যাম্প নির্মাণের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়। ফলে ঢাকাকে বাইপাস না করে, বরং ঢাকার একেবারে মধ্য দিয়ে গিয়ে ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচলের সুযোগ করে দিতে ঢাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জংশন বা মোড়ে জালের মতো নতুন নতুন র‍্যাম্প যুক্ত করে দিয়ে ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে আরও যানজট বাড়ানোর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এই প্রকল্প, যা অধিকাংশ ঢাকাবাসীর ভোগান্তি বৃদ্ধি করেছে।

প্রাথমিকভাবে ঢাকাকে বাইপাস করে নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হলেও বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে, ঢাকার লোকাল যানবাহন থেকে অতিরিক্ত টোল আদায়ের লক্ষ্যে ঢাকার ট্রাফিক ও সামগ্রিক পরিবেশকে যথাযথ বিবেচনায় না নিয়েই ঢাকার ভেতর দিয়ে র‌্যাম্প নির্মাণের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়।

বিমানবন্দর থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মূল করিডোরের দৈর্ঘ্য ১৯.৭৩ কিলোমিটার, ৩১টি র‍্যাম্পসহ প্রকল্পের দৈর্ঘ্য ৪৬.৭৩ কিলোমিটার। এই প্রকল্পের একটি বেমানান দিক হচ্ছে মূল প্রকল্পের চেয়ে র‌্যাম্পের দৈর্ঘ্য বেশি। দ্রুতগতির এই উড়াল সড়ক হয়ে ঢাকা শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাবে যেসব গাড়ি সেগুলো যাতে শহরের ভেতর ঢুকতে না হয়–এমন ব্যবস্থাই করার কথা ছিল। অথচ ৩১টি র‌্যাম্প (ওঠানামার পথ) করে দিয়ে উড়াল সড়কটিকে শহরের সাধারণ সড়কে পরিণত করা হয়েছে। এই র‌্যাম্পগুলোর দৈর্ঘ্য ২৭ কিলোমিটারের বেশি; যা এক্সপ্রেসওয়ের চেয়েও সাত কিলোমিটার বেশি দীর্ঘ। অথচ আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ২৪ কিলোমিটারে র‌্যাম্প রেখেছে সাতটি। ঢাকা এক্সপ্রেসওয়ের চালু হওয়া প্রতিটি র‍্যাম্পের আশপাশের সড়কে অতিরিক্ত যানজট নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

জনদুর্ভোগের কারণ হবে এই এক্সপ্রেসওয়ে, নষ্ট হবে পরিবহণ ব্যবস্থা

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের এফডিসি থেকে পলাশী পর্যন্ত সংযোগ সড়ক নির্মাণের উদ্যোগের কারণে হাতিরঝিল জলাধার ও পান্থকুঞ্জ পার্কের পরিবেশ ইতোমধ্যেই ধ্বংসের পাশাপাশি কাঁঠালবাগান-কাঁটাবন-নীলক্ষেত-পলাশীসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এর সামগ্রিক পরিবেশ ও পরিবহণ ব্যবস্থা সীমাহীন সংকটে পড়বে।

মেগা প্রজেক্টের বিনিয়োগ ফেরত আনা ও ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচলের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য এই সংযোগ সড়কটি প্রস্তাব করা হয়েছে, যা এই এলাকায় বিদ্যমান অতিব্যস্ত রাস্তাসমূহের উপযোগিতা নষ্ট করবে। একইসাথে এই এলাকায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র‍্যাম্প ওঠানামার কারণে বিভিন্ন মোড়ে ট্রাফিক জ্যাম আরও অনেক বেড়ে যাবে।

ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ২০২৪ সালের জানুয়ারির টোল ও ট্রাফিক রিপোর্টের তথ্যানুযায়ী, এক্সপ্রেসওয়েতে ব্যবহারকারী যানবাহনের শতকরা ৯৮.৩ ভাগ ব্যক্তিগত গাড়ি। ফলে বিত্তশালীদের ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচলের জন্য এফডিসি থেকে পলাশী পর্যন্ত প্রস্তাবিত সংযোগ সড়কটি এই এলাকার সাধারণ মানুষের কোনো কাজে আসবে না, বরং এই এলাকার যানজট বাড়ানোর মাধ্যমে জনদুর্ভোগের কারণ হবে এই সড়ক।

এই সংযোগ সড়ক বাতিল করা না হলে ট্রাফিক জ্যাম মারাত্মকভাবে বেড়ে যাবে সার্ক ফোয়ারা, বাংলামোটর, কাঁটাবন, এলিফ্যান্ট রোড, নীলক্ষেত ও পলাশী মোড়সমূহে। গাড়ির চাপ অনেক বেড়ে যাওয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এর সামগ্রিক একাডেমিক পরিবেশ ও পরিবহণ ব্যবস্থা সংকটে পড়বে।

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের এফডিসি থেকে পলাশী পর্যন্ত সংযোগ সড়কের ব্যাপারে রাজউক, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনসহ নগর পরিকল্পনাবিদ, পরিবেশবিদসহ অনেক বিশেষজ্ঞ ও এলাকাবাসী তীব্র আপত্তি জানানো সত্ত্বেও এই সংযোগ সড়ক বিগত সরকার বাতিল করেনি।

বিশদ ও যথাযথ সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই হাতিরঝিলের জলাধার ভরাট ও পান্থকুঞ্জ পার্কের মধ্য দিয়ে এক্সপ্রেসওয়ে সম্প্রসারণ আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। এই সংযোগ সড়কের ব্যাপারে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এবং রাজউকের পক্ষ থেকে বিগত বছরগুলোতেই আপত্তি জানানো হয়েছিল। ১৯৫৩ সালের টাউন ইম্প্রুভমেন্ট আইন অনুসারে বিশদ পরিকল্পনাগত প্রভাব বিশ্লেষণ সাপেক্ষে রাজউকের যথাযথ অনুমতি ছাড়া কিংবা সিটি করপোরেশনসহ অন্যান্য সংস্থার কার্যকর সমন্বয় ছাড়াই এ ধরনের প্রকল্প কীভাবে বাস্তবায়ন করা হয়, সেই আলোচনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরিবেশ ও নগর এলাকায় নেতিবাচক প্রভাবের কারণ হতে পারে, এ ধরনের প্রকল্পের সাথে যেসব পেশাজীবী ও কর্মকর্তা যুক্ত থাকেন, তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা প্রয়োজন।

বিশদ ও যথাযথ সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই হাতিরঝিলের জলাধার ভরাট ও পান্থকুঞ্জ পার্কের মধ্য দিয়ে এক্সপ্রেসওয়ে সম্প্রসারণ আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। এই সংযোগ সড়কের ব্যাপারে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এবং রাজউকের পক্ষ থেকে বিগত বছরগুলোতেই আপত্তি জানানো হয়েছিল।

পৃথিবীর উন্নত ও আধুনিক শহরগুলো নগর এলাকায় ব্যক্তিগত গাড়িকে প্রাধান্য দিয়ে ফ্লাইওভারকেন্দ্রিক পরিবহণ সমস্যা সমাধানের কৌশল থেকে সরে এসেছে। অথচ আমরা এখনো পরিবহণ সমস্যার সমাধান কৌশল হিসেবে ফ্লাইওভারকেন্দ্রিক পরিবহণ সমাধান পরিকল্পনা করে যাচ্ছি, যা ব্যক্তিগত গাড়িকে উৎসাহিত করে। পরিবহণ-ভূমি ব্যবহার-পরিবেশ-জনজীবনের পারস্পরিক সম্পর্কজনিত প্রভাব বিশ্লেষণ না করেই ব্যক্তিগত গাড়িকেন্দ্রিক নেওয়া এই সংযোগ সড়কটি সার্বিক জনস্বার্থ রক্ষায় অবিলম্বে বাতিল করা প্রয়োজন।

আমাদের দেশে যোগাযোগ ও পরিবহণ অবকাঠামোর ক্ষেত্রে প্রকল্প গ্রহণের সিদ্ধান্ত আগে নেওয়া হয়, তারপর সেটাকে বৈধ করার জন্য সমীক্ষা বা সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। ব্যক্তিগত গাড়িতে যেই ৫ শতাংশ লোক চলাচল করেন, তাদের জন্য মেগা প্রজেক্ট নেওয়া হয়; অথচ তার কুফল ভোগ করেন বাকি ৯৫ শতাংশ মানুষ। এ প্রবণতা থেকে বের হয়ে কম ব্যয়ে ও সহজে বাস্তবায়নযোগ্য অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিবহণ অবকাঠামো গড়ে তোলার জন্য পরিবহণ ও নগর পরিকল্পনার কর্মকৌশল তৈরি করা প্রয়োজন।

আমাদের দেশে যোগাযোগ ও পরিবহণ অবকাঠামোর ক্ষেত্রে প্রকল্প গ্রহণের সিদ্ধান্ত আগে নেওয়া হয়, তারপর সেটাকে বৈধ করার জন্য সমীক্ষা বা সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। ব্যক্তিগত গাড়িতে যেই ৫ শতাংশ লোক চলাচল করেন, তাদের জন্য মেগা প্রজেক্ট নেওয়া হয়; অথচ তার কুফল ভোগ করেন বাকি ৯৫ শতাংশ মানুষ।

বিগত সরকারের আমলে পরিবহণ অবকাঠামো সংশ্লিষ্ট প্রকল্পে জনগণের মতামত গ্রহণ ও গণশুনানির আয়োজন ছাড়াই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। টপ ডাউন প্ল্যানিং বা ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া এ ধরনের পরিকল্পনা জনগণের প্রকৃত চাহিদাভিত্তিক সমাধানের সাথে সম্পৃক্ততাবিহীন। একইসাথে বিগত সরকারের আমলে দেশীয় স্বার্থান্বেষী মহলের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগকারী রাষ্ট্র ও ঠিকাদারদের প্রভাবে ব্যয়সাশ্রয়ী পরিবহণ পরিকল্পনা বাদ দিয়ে অতি ব্যয়বহুল এবং কম উপযোগী পরিবহণ অবকাঠামো প্রকল্প গ্রহণের যে প্রবণতা ছিল, সেটা থেকে অন্তর্বর্তী সরকারকে সরে আসতে আমরা আন্তরিক অনুরোধ করছি।

প্রকল্পের অর্থনৈতিক চাতুরীর প্রমাণ ও বৈষম্যমূলক চুক্তির বিবরণ

পরিবেশ ধ্বংসের পাশাপাশি এই প্রকল্পটি নাগরিক অধিকার হরণ করেছে, অন্যায্য ‍চুক্তির মাধ্যমে দেশীয় বিনিয়োগ ও অর্থ খাতকে পাশ কাটিয়ে বিদেশি মুনাফাকে প্রাধান্য দিয়েছে এবং রাষ্ট্রীয় অর্থ, শ্রম ও পরিকল্পনা অপচয়ের প্রকৃত উদাহরণ এই এক্সপ্রেসওয়ে। ঢাকা এক্সপ্রেসওয়ের মূল প্রকল্পটি ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১১ সালের জুলাই থেকে ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য একনেকে অনুমোদন পেলেও অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, স্বেচ্ছাচারিতা ও দুর্নীতির কারণে তিন বছরের এই প্রকল্প এক যুগ পার হলেও সম্পন্ন করা যায়নি এবং এই প্রকল্প ঢাকাবাসীর জন্য অবিরাম জনদুর্ভোগের কারণ সৃষ্টি করছে।

এর বাইরে উড়াল সড়কের জন্য জমি অধিগ্রহণ, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসন, বিভিন্ন সেবা সংস্থার লাইন সরানো ও পরামর্শকদের ব্যয় মেটানোর জন্য ‘সাপোর্ট টু ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে পিপিপি প্রজেক্ট’ নামে আরেকটি প্রকল্প নেয় সেতু বিভাগ। শুরুতে ২০১১ সালে এই প্রকল্পের ব্যয় ৩ হাজার ২১৬ কোটি টাকা ধরা হলেও এই ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার ৯১৭ কোটি টাকায়, যার পুরোটাই বহন করতে হবে দেশের জনগণকে।

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের সম্পূর্ণ খরচের খতিয়ান

প্রকল্পের নাম: ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে পিপিপি প্রকল্প

প্রাক্কলিত ব্যয়

বিদেশি কোম্পানির ব্যয়

সরকারের ব্যয়

মন্তব্য

৮,৯৪০ কোটি টাকা

৬,৫২৭ কোটি টাকা (প্রাক্কলিত ব্যয়ের ৭৩%)

২,৪১৩ কোটি টাকা (প্রাক্কলিত ব্যয়ের ২৭%)

 

প্রকল্পের নাম: সাপোর্ট টু ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে পিপিপি প্রজেক্ট

প্রাক্কলিত ব্যয়

বিদেশি কোম্পানির ব্যয়

সরকারের ব্যয়

মন্তব্য

৪৯১৭.৫৭ কোটি টাকা

কোনো অংশীদারত্ব নেই।

৪৯১৭.৫৭ কোটি টাকা

এ প্রকল্পের আওতায় উল্লেখযোগ্য কার্যক্রমসমূহ হলো: ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে পিপিপি প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন, ইউটিলিটিস স্থানান্তর এবং পরামর্শক সেবা যেটা সম্পূর্ণ বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে হচ্ছে।

সর্বমোট প্রাক্কলিত ব্যয়

বিদেশি কোম্পানির সর্বমোট ব্যয়

সরকারের সর্বমোট ব্যয়

মন্তব্য

১৩,৮৫৭.৫৭ কোটি টাকা

৬,৫২৭ কোটি টাকা (৪৭.১%)

৭৩৩০.৫৭ কোটি টাকা (৫২.৯%)

মূল প্রকল্প থেকে অনেকগুলো ব্যয়বহুল খাত সরকারি প্রকল্পে সরিয়ে নিয়ে পিপিপি প্রকল্পটিকে লাভজনক দেখানো হয়েছে।

এ ছাড়াও রেলওয়ে থেকে নেওয়া ১২৮ একর জমির মূল্যমান ৬০০০ কোটি টাকা যুক্ত করলে এই প্রকল্পের নির্মাণব্যয় বহুগুণ বেড়ে যায় এবং সেখানে প্রকল্পের প্রকৃত ব্যয় আনুমানিক ১৯,৮৫৭.৫৭ কোটি টাকায় এসে দাঁড়ায় যেখানে জনগণের ব্যয় হবে আনুমানিক ১৩,৩৩০.৫৭ কোটি টাকা।

তথ্যসূত্র: বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইট ও নিজস্ব ক্যালকুলেশন

ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প চুক্তিটি অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, স্বেচ্ছাচারিতা ও দুর্নীতির প্রকৃষ্ট উদাহরণ এবং এই চুক্তিটি বৈষম্যমূলক। দেশের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এই অসম চুক্তির মাধ্যমে। পিপিপি চুক্তির নিয়মানুযায়ী মূল কাঠামো নির্মাণ ব্যয়ের ৭৩ শতাংশ জোগান দেবে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান, আর ২৭ শতাংশ দেবে বাংলাদেশ সরকার। কিন্তু ‘সাপোর্ট টু ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে পিপিপি প্রজেক্ট’ নামক লিংক প্রকল্পের ব্যয় যুক্ত করলে দেখা যায় যে সর্বমোট প্রাক্কলিত ১৩,৮৫৭.৫৭ কোটি টাকার মধ্যে ৭৩৩০.৫৭ কোটি টাকা বা ৫২.৯ শতাংশ বহন করবে বাংলাদেশের জনগণ।

প্রকল্পের ব্যয়বহুল খাতসমূহ আলাদা লিংক প্রকল্পের আওতায় এনে পিপিপি প্রকল্পকে লাভজনক করে দেখানোর এই চেষ্টা জনগণের সাথে স্রেফ প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়। এ ছাড়াও বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ২৫ বছর ধরে এই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে থেকে টোল আদায়ের সুযোগ পাবে। বিনিয়োগকারীদের অধীন থাকা অবস্থায় উড়াল সড়ক থেকে ২৫ বছরে বাংলাদেশ ফি হিসেবে পাবে মাত্র ২৭২ কোটি টাকা। উড়াল সড়ক দিয়ে দিনে ৮০ হাজারের বেশি যানবাহন চলাচল করলে বাড়তি যে টোল আদায় হবে, তার মাত্র ২৫ শতাংশ বাংলাদেশ পাবে। অন্যদিকে সাড়ে ১৩ হাজারের চেয়ে কম যানবাহন চলাচল করলে বিনিয়োগকারীকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে সরকারের। চুক্তিতে বলা আছে, একটানা ১৫ দিন দৈনিক গড়ে সাড়ে ১৩ হাজারের কম যানবাহন চলাচল করলে ক্ষতিপূরণ হিসেবে বিনিয়োগকারীকে চুক্তি অনুযায়ী ২৫ বছরের চেয়ে বাড়তি সময় টোল আদায় করার সুযোগ দিতে হবে।

 

এ চুক্তিতে বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার, পরিবেশ ধ্বংসের যে ক্ষতি তার কোনো হিসাব নেই। চুক্তিতে বাংলাদেশ রেলওয়ের দেওয়া ১২৮ একর জমির মূল্যমান আনুমানিক ছয় হাজার কোটি টাকাও বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। বাংলাদেশ রেলওয়ে টোলের কোনো অংশও সেভাবে পাবে না। এই প্রকল্পের কারণে ঢাকা-টঙ্গী তৃতীয় ও চতুর্থ লাইন রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প আটকে আছে।

এই প্রকল্পের পাশাপাশি সাপোর্ট টু এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের নাম দিয়ে সরকারের বড় একটা খরচ আলাদা করে ফেলা হয়েছে। প্রকৃত বিচারে এই প্রকল্পে বিদেশি ঋণের বাইরে সরকারের বিনিয়োগ শতকরা পঞ্চাশ ভাগেরও বেশি। এই প্রকল্পের প্রতি কিমি ব্যয় অত্যন্ত বেশি, যা প্রায় ৩০০ কোটি টাকারও বেশি হওয়ার কথা। এই প্রকল্পের চুক্তি সার্বিকভাবে দেশের জন্য ক্ষতিকর।

 

মেয়াদোত্তীর্ণ পরিবেশ ছাড়পত্র ও শর্তাবলির লঙ্ঘন

বাংলাদেশ গাছ রক্ষা আন্দোলনের পক্ষ থেকে গত ৯ জানুয়ারি ২০২৫ তারিখে পরিবেশ অধিদপ্তরে তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯ অনুযায়ী হাতিরঝিল ও পান্থকুঞ্জে চলমান এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের পরিবেশ ছাড়পত্র বিষয়ক তথ্য প্রাপ্তির আবেদন করা হয়। এর নিমিত্ত পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে প্রাপ্ত চিঠির তথ্যানুযায়ী পান্থকুঞ্জ পার্কে সহস্রাধিক গাছ কেটে এবং হাতিরঝিল জলাধারে মাটি ফেলে ভরাট করে নির্মাণকাজ পরিচালনা করার জন্য পরিবেশ ছাড়পত্রের কোনো আবেদন পাওয়া যায়নি। এ ছাড়াও পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের অনুকূলে ০৩/০৪/২০২২ তারিখে প্রদানকৃত ছাড়পত্র ও সর্বশেষ ০৯/০২/২০২৩ তারিখে প্রদানকৃত নবায়নকৃত ছাড়পত্রের কপি বাংলাদেশ গাছ রক্ষা আন্দোলনের কাছে পেশ করা হয়। উক্ত নথিসমূহ পর্যালোচনা করে দেখা যায়:

১। সর্বশেষ ০৯/০২/২০২৩ তারিখে প্রদানকৃত পরিবেশ ছাড়পত্রের মেয়াদ ০৮/১২/২০২৩ তারিখে উত্তীর্ণ হয়ে গেছে এবং পরবর্তী সময়ে এই ছাড়পত্র নবায়ন করা হয়নি। অর্থাৎ ০৮/১২/২০২৩ তারিখের পর থেকে এই প্রকল্পের কাজ পরিবেশ ছাড়পত্র ছাড়াই চলমান রয়েছে।

২। DOE/ clearance/5081/2011 স্মারকে ০৩/০৪/২০২২ তারিখে ইস্যু করা পরিবেশ ছাড়পত্রের C. Premises to Which this Clearance Certificate Applies অংশটি পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে ছাড়পত্রটি প্রদান করা হয়েছে মগবাজার লেভেল ক্রসিং থেকে সোনারগাঁও হোটেলের পেছন দিক থেকে হাতিরপুল, কাঁটাবন ও পলাশী পর্যন্ত নির্মাণকাজ পরিচালনা করার জন্য। কিন্তু প্রকল্পের পরামর্শক ইকবাল হাবীবের প্রতিষ্ঠান ‘ভিত্তি’র ওয়েবসাইটে প্রকল্প বিষয়ক ড্রয়িং থেকে দেখা যায় যে প্রকল্পের নির্মাণকাজ পাঁচতারকা সোনারগাঁও হোটেলের পেছন থেকে সরিয়ে বিয়াম স্কুল ও কলেজের পাশে নিয়ে আসা হয়েছে। নবায়নকৃত পরিবেশ ছাড়পত্রের ১ নম্বর শর্তে বলা হয়েছে: ‘প্রকল্প কর্তৃপক্ষ কর্তৃক এ প্রকল্পের দেওয়া তথ্যের বাইরে প্রকল্পের কার্যক্রমের কোনোরূপ পরিবর্তন করা হলে অবশ্যই পরিবেশ অধিদপ্তরের পূর্বানুমতি গ্রহণ করতে হবে।’ প্রকল্পের নকশায় এই ধরনের পরিবর্তন ঘটানো সত্ত্বেও পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে সেটার অনুমোদন নেওয়া হয়নি।

৩। পরিবেশ ছাড়পত্রের E. Terms and Conditions for Environmental Clearance Certificate শীর্ষক অংশের 3. Operating Conditions-এর বিভিন্ন অংশ পর্যালোচনা করলে নিম্নোক্ত শর্তগুলো দেখা যায়:

  • 4 Environmentally friendly construction and development practices shall be followed that minimize the loss of habitats and biodiversity.
  • 16 Any heritage site, ecological critical area, and other environmentally and /or religious sensitive places shall be avoided during the construction phase.

পান্থকুঞ্জ ও হাতিরঝিল জলাধারে নির্মাণকাজ চালানোর মাধ্যমে এই দুটি শর্ত ভঙ্গ করা হয়েছে। উক্ত ছাড়পত্রের শেষ অংশে বলা আছে: ‘Violation of any of the above conditions shall render this clearance void’ অর্থাৎ উক্ত শর্তসমূহ ভঙ্গের দায়ে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে প্রদানকৃত উক্ত পরিবেশ ছাড়পত্র বাতিল করা যেতে পারে।

৪। একইসাথে ছাড়পত্রের অনুচ্ছেদ 4.2 এবং 5 অনুযায়ী প্রকল্প চলাকালীন বায়ু, পানি ও শব্দদূষণ সংক্রান্ত রিপোর্ট তিন মাস অন্তর অন্তর পরিবেশ অধিদপ্তর বরাবর দাখিলের বিধান রয়েছে। আমরা চাই ঢাকা যখন বিগত কয়েক বছর ধরে দূষিত নগরের তালিকায় শীর্ষস্থানে রয়েছে, তখন উক্ত প্রকল্পের দূষণ সংক্রান্ত এই সকল রিপোর্ট জনগণের সামনে উন্মুক্ত করা হোক। এবং এই রিপোর্টসমূহ যদি পরিবেশ অধিদপ্তর বরাবর দাখিল করা না হয়, তাহলে প্রকল্পের পরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের আইনের আওতায় আনা হোক।

৫। পরিবেশ ছাড়পত্রের 6 Notification of environmental harm সেকশনে বলা আছে যে, ‘The Clearance Certificate holder or its employees must notify the Department of Environment of incidents causing or threatening material harm to the environment as soon as practicable after the person becomes aware of the incident.’ আমরা জানতে চাই: এই প্রকল্পের জন্য হাতিরঝিল জলাধার ভরাট এবং পান্থকুঞ্জ পার্কের সহস্রাধিক গাছ কেটে মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয় ডেকে আনলেও এই বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরকে জানানো হয়েছে কি না। যদি জানানো না হয়ে থাকে, তাহলে তার ভিত্তিতে এই ছাড়পত্র বাতিল করে নির্মাণকাজ বন্ধের নির্দেশনা দেওয়া হয়নি কেন? আর যদি জানানো হয়ে থাকে, তাহলে এই বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর কী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে? আমরা মনে করি, পরিবেশ মন্ত্রণালয় এর দায় এড়াতে পারে না।

আইন, আদালত, সংবিধান ও নীতিমালার ব্যত্যয়

এই প্রকল্পের কারণে ইতোমধ্যে হাতিরঝিল এলাকায় জলাধার ভরাট এবং পান্থকুঞ্জ উদ্যানের সহস্রাধিক গাছ কাটা হয়েছে। হাতিরঝিল ও পান্থকুঞ্জ সংলগ্ন এলাকায় প্রস্তাবিত পিলারসমূহ এলাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, জলাধারের পানিপ্রবাহ ও সার্বিক উপযোগিতা ধ্বংস করবে। সংযোগ সড়ক প্রকল্পটি ইতোমধ্যেই মাঠ, পার্ক ও জলাধার সংরক্ষণ আইন, পরিবেশ সংক্রান্ত আইন ও বিভিন্ন পরিকল্পনার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করেছে।

উক্ত উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে পান্থকুঞ্জের মতো পরিবেশগত এবং জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় অবদান রাখা এক পাবলিক উদ্যানের পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, যা সংবিধানের ১৮ক অনুচ্ছেদের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। যেখানে বলা হয়েছে: ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন।’

পান্থকুঞ্জের মতো পরিবেশগত এবং জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় অবদান রাখা এক পাবলিক উদ্যানের পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, যা সংবিধানের ১৮ক অনুচ্ছেদের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। যেখানে বলা হয়েছে: ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন।’

মাঠ, পার্ক আমাদের নাগরিক অধিকারের একটি অন্যতম অংশ। গিয়াসউদ্দিন বনাম ঢাকা সিটি করপোরেশন মামলায় আদালত বলেন:

Gaisuddin Vs Dhaka Municipal Corporation (1997 BLD 577) observed as follows

A public park is necessary for protecting health and hygiene of inhabiatns of the area priding open spece with garde. The structure cannot be allowed to occupy the same on the plea of their incispensable accommondation to proect their life to the detriment of health and hygine of the inhabinats of the area.

পান্থকুঞ্জ নিয়ে রিট পিটিশন নম্বর: ১০৯৮৫/২০১৪-এ মহামান্য আদালত পান্থকুঞ্জকে মাস্টারপ্ল্যান অনুসারে উন্মুক্ত রাখার নির্দেশনা প্রদান করেন। কিন্তু এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের ক্ষেত্রে আদালতের নির্দেশনা অমান্য করে, পরিবেশ ছাড়পত্র না নিয়ে অবকাঠামো নির্মাণ শুরু করা হয়।

২০১১ সালের ৩ এপ্রিল হাইকোর্ট এক রায়ে বিজিএমইএর তৎকালীন ভবনটিকে ‘হাতিরঝিল প্রকল্পে একটি ক্যানসারের মতো’ উল্লেখ করে রায় প্রকাশের ৯০ দিনের মধ্যে ভেঙে ফেলতে নির্দেশ দেন। এর বিরুদ্ধে বিজিএমইএ লিভ টু আপিল করে, যা ২০১৬ সালের ২ জুন আপিল বিভাগে খারিজ হয়। রায়ে বলা হয়, ভবনটি নিজ খরচে অবিলম্বে ভাঙতে আবেদনকারীকে (বিজিএমইএ) নির্দেশ দেওয়া যাচ্ছে। এতে ব্যর্থ হলে রায়ের কপি হাতে পাওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে রাজউককে ভবনটি ভেঙে ফেলতে নির্দেশ দেওয়া হলো। পরে ভবন ছাড়তে উচ্চ আদালতের কাছে সময় চায় বিজিএমইএ। প্রথমে ছয় মাস এবং পরে সাত মাস সময়ও পায় তারা। কারওয়ান বাজারে বিজিএমইএর বর্তমান ভবনটি দুটি বেজমেন্টসহ ১৬তলা ছিল। বিজিএমইএ ব্যবহার করে চারটি তলা। বাকি জায়গা দুটি ব্যাংকসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করা হয়েছিল। ভবনের উপরের দুই তলা নিয়ে বিলাসবহুল ‘অ্যাপারেল ক্লাব’ করা হয়েছিল। সেখানে সংগঠনের সদস্যদের জন্য সুইমিং পুল, ব্যায়ামাগার, রেস্টুরেন্ট ও সভাকক্ষ ছিল। বড় আকারের একটি মিলনায়তনও ছিল। পরিবেশ প্রকৃতি রক্ষায় আদালতের নির্দেশে সেই সকল স্থাপনা ভাঙা হয়। কিন্তু আদালতের নির্দেশ অমান্য করে, সেই একই স্থানে আবার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের পিলার স্থাপন করা হচ্ছে, যা সম্পূর্ণ বেআইনি এবং অসাংবিধানিক।

 

নাগরিক হত্যা ও অধিকার হরণ: শাস্তি হয়নি

এই অবকাঠামো নির্মাণের দায়িত্বে থাকা কোম্পানির দায়িত্বহীনতায় একাধিক ব্যক্তির মৃত্যু হলেও, কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি, শাস্তি হয়নি কোম্পানি বা কোম্পানির কোনো প্রতিনিধির। দায় চাপানো হয়েছে সাধারণ নাগরিকদের ওপর বা কর্মীদের ওপর, যা সত্যিই বিস্ময়ের।

তারিখ

ঘটনা ও স্থান

‍মৃত ব্যক্তির নাম

মামলা

৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

রাজধানী ঢাকার মগবাজারে নির্মাণাধীন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে থেকে লোহার মই পড়ে এক পথচারীর মৃত্যু

বুধবার (৭ ফেব্রুয়ারি) সকালে মগবাজার লেভেল ক্রসিংয়ের পাশে দিলু রোড এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে

নাম: মতিউর রহমান (৫০)।

বাড়ি: ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে।

অবহেলাজনিত মৃত্যুর কারণ দেখিয়ে নিহতের বোন বাদী হয়ে হাতিরঝিল থানায় একটি মামলা করেন।

৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ 

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ক্রেন থেকে কনটেইনার পড়ে শ্রমিক নিহত

তেজগাঁওয়ে তেজকুনীপাড়া রেল কলোনি সংলগ্ন বিজয় সরণি ফ্লাইওভারের নিচে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ৩৪৮ ও ৩৪৯ নম্বর পিলারের মাঝ ক্রেন দিয়ে কনটেইনার সরানোর সময় ক্রেন থেকে সেটি নিচে পড়ে যায়।

নাম: শামীম মিয়া (৩৯)

বাড়ি: নরসিংদীর রায়পুরার সাদাঘর কান্দিতে।

ক্রেন অপারেটর আজহারুল ইসলাম সোহাগ (২৯)-কে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

 ২৯ মে ২০২৩

মহাখালীতে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে থেকে পড়া রড মাথায় ঢুকে কিশোরের মৃত্যু

সকালে মহাখালীর নির্মাণাধীন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নিচ দিয়ে যাওয়ার সময় শিশুটির মাথায় ওপর থেকে রড পড়ে। রডের টুকরাটি শিশুটির মাথায় ঢুকে যায়

নাম: এক অজ্ঞাত কিশোর (১২)

ঢামেক পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক মো. বাচ্চু মিয়া ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, ‘চিকিৎসাধীন অবস্থায় অজ্ঞাতপরিচয় কিশোরের মৃত্যু হয়েছে। মরদেহ ঢামেক হাসপাতাল মর্গে রাখা হয়েছে।’

রাজধানীর মহাখালী এলাকায় গতকাল সোমবার এক্সপ্রেসওয়ে থেকে মাথায় রড পড়ে শিশু মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় শ্রমিক মো. হাসানের (৩২) বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ এনে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের বনানী-মহাখালীর সাইট ম্যানেজার হাসিব হাসান মামলা করেন।

৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২

তেজগাঁওয়ে এলিভেটেড এক্সপ্রেসে স্লিপারের আঘাতে অপারেটর নিহত

রাজধানীতে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে কাজ করার সময় স্লিপারের আঘাতে এক গার্ডার অপারেটর নিহত হয়েছেন।

নাম: মো. হাসান মিঝি (৩০)।

বাড়ি: চাঁদপুর সদরের বড় সুন্দর গ্রামে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির পুলিশ পরিদর্শক মো. বাচ্চু মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, হাসানকে রাত পৌনে ৮টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আনা হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। 

২২ জানুয়ারি ২০২২

রাজধানীর ভাটারা থানা এলাকায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ করতে গিয়ে মো. রাহিদুল ইসলাম (৫০) নামে এক নির্মাণশ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে।

নাম: মো. রাহিদুল ইসলাম স্বপন (৫০)

বাড়ি: লালমনিরহাট

স্বপনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া সহকর্মী মিজানুর রহমান জানান, দীর্ঘ এক বছর ধরে স্বপন এই নির্মাণ প্রকল্পে কাজ করে আসছিল। আজ উঁচু একটি মাচানে দাঁড়িয়ে কাজ করার সময় সেখান থেকে নিচে পড়ে মাথায় গুরুতর আঘাত পায়। সঙ্গে সঙ্গে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে সেখানে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

 

পরিবেশ ধ্বংসের খতিয়ান

ঢাকা বিশ্বের অন্যতম যানজট ও বায়ুদূষণের শহর। বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ এই শহরে বৃক্ষ আচ্ছাদিত রয়েছে মাত্র ৮.৫ শতাংশ, যেখানে প্রয়োজন প্রায় ২৫ শতাংশ। বায়ুদূষণ রোধ করা গেলে বাংলাদেশে প্রতিবছর লক্ষাধিক মানুষের অকালমৃত্যু ঠেকানো সম্ভব। বায়ুদূষণের কারণে যাদের মৃত্যু হয়, তাদের অধিকাংশই ঢাকা ও চট্টগ্রাম নগরীতে বসবাস করেন। অথচ ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্রে বসবাসকারী কয়েক লাখ লোকের ব্যবহারযোগ্য একমাত্র পার্ক পান্থকুঞ্জ এবং হাতিরঝিল জলাধার ভরাট করে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের পিলার স্থাপন করা হচ্ছে, যা এলাকার পরিবেশ-প্রতিবেশ ধ্বংস করছে। অথচ এই প্রকল্পের মাধ্যমে বিদেশি কোম্পানির ব্যবসায়িক মুনাফা নিশ্চিত করা হচ্ছে এবং যার সুফল পাবে কেবল স্বল্পসংখ্যক ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারকারী।

চিত্র: হাতিরঝিল ও পান্থকুঞ্জ ধ্বংস করে প্রস্তাবিত পলাশী পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ম্যাপ।

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের পরিবেশগত সমীক্ষা প্রতিবেদনে (ইআইএ রিপোর্ট) এই উড়াল সড়কের কারণে পলাশী, কাঁটাবন এলাকায় ট্রাফিকের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে এবং নিচের রাস্তার উপযোগিতা কমে যাবে বলা হয়েছে। পান্থকুঞ্জ পার্কে বৃক্ষনিধন ও পরিবেশ-প্রতিবেশ বিনষ্ট হওয়ার বিষয়টাকে পরিবেশগত সমীক্ষা প্রতিবেদনে উপেক্ষা করা হয়েছে। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে নগর পরিকল্পনাবিদকে সম্পৃক্ত করা হয়নি। এলাকাবাসীর মতামত ও যথাযথভাবে নেওয়া হয়নি এই প্রকল্পে। অর্থনৈতিকভাবে অলাভজনক একটি প্রকল্পকে লাভজনক করার উদ্দেশ্যে পরিবেশ-প্রতিবেশ ধ্বংস করে নতুন এই লিংক যুক্ত করা হয়েছে।

চিত্র: হাতিরঝিল ও পান্থকুঞ্জ ধ্বংস করে প্রস্তাবিত পলাশী পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ম্যাপের ডিটেইল।

ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র‌্যাম্প নির্মাণের মাধ্যমে পান্থকুঞ্জ ও হাতিরঝিলের প্রাণ-প্রকৃতি-প্রাণবৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে ধ্বংসের সম্মুখীন। ইতোমধ্যেই পান্থকুঞ্জ পার্কের প্রায় ৪০ প্রজাতির সহস্রাধিক বৃক্ষ ধ্বংস করা হয়েছে। বিদ্যমান পরিবেশ, জলাধার কিংবা প্রাণবৈচিত্র্য সুরক্ষা নীতি ও আইন লঙ্ঘন করে এই প্রকল্পের মাধ্যমে হাতিরঝিলের জলাধার ভরাটের মাধ্যমে এর শ্রেণি পরিবর্তন করা হচ্ছে। উক্ত প্রকল্পের অধীন কারওয়ান বাজার থেকে পলাশী পর্যন্ত সংযোগ সড়ক নির্মাণের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তা হাতিরঝিলের মতো এই অঞ্চলের টিকে থাকা সংবেদনশীল এই জলাশয়ের মারাত্মক ক্ষতি করবে। প্রকল্পের প্রস্তাবিত শতাধিক পিলার হাতিরঝিল জলাধার ও পান্থকুঞ্জ উদ্যানে বসানো হবে। ইতোমধ্যে বেশকিছু পিলার বসানোর জন্য বালি-মাটি দিয়ে জলাশয় ভরাট করায় এর সৌন্দর্য, প্রাণবৈচিত্র্য এবং পরিবেশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

এ ছাড়াও নকশা পরিবর্তনের মাধ্যমে এক্সপ্রেসওয়ের রাস্তা বাণিজ্যিক এলাকা (সোনারগাঁও হোটেল) থেকে সরিয়ে আবাসিক এলাকার মতো সংবেদনশীল এলাকায় নিয়ে আসা হয়েছে যেখানে বাচ্চাদের স্কুল পর্যন্ত রয়েছে। এ ধরনের জনবিরোধী নকশাকারদের শাস্তির আওতায় আনা উচিত।

শুধু পিলখানার ভেতর দিয়ে জনসাধারণের জন্য একটি রাস্তা উন্মুক্ত করে দিলেই পুরান ঢাকার সাথে যোগাযোগ অনেক সহজ হয়ে যাবে এবং একইসাথে ট্রাফিক জ্যামে জর্জরিত সায়েন্সল্যাব ও নীলক্ষেত মোড় কিছুটা হলেও স্বস্তি লাভ করবে।

পুরান ঢাকার সাথে যোগাযোগের বিকল্প প্রস্তাবনা

প্রকল্পের নানা পর্যায়ে প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা ‘এই এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প পুরান ঢাকার সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটাবে’–এ ধরনের যুক্তি দিয়েছেন। আমরা বাংলাদেশ গাছ রক্ষা আন্দোলনের পক্ষ থেকে, পুরান ঢাকার সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধনের জন্য একটি বিকল্প প্রস্তাব রাখতে চাই। ধানমন্ডি সাতমসজিদ সড়ক থেকে পিলখানার ভেতর দিয়ে আজিমপুর গোরস্তান পর্যন্ত রাস্তাটি ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত ছিল। পরবর্তী সময়ে এই রাস্তাটিতে জনসাধারণের চলাফেরা সীমিত করে ফেলা হয়। প্রতিদিন পুরান ঢাকা থেকে এবং পুরান ঢাকাগামী লাখ লাখ মানুষের চলাচলের একমাত্র পথ সায়েন্সল্যাব ও নীলক্ষেত মোড়ে অসহনীয় জ্যামের কারণ এই যাত্রাপথের কোনো বিকল্প তৈরি হয়নি। শুধু পিলখানার ভেতর দিয়ে জনসাধারণের জন্য একটি রাস্তা উন্মুক্ত করে দিলেই পুরান ঢাকার সাথে যোগাযোগ অনেক সহজ হয়ে যাবে এবং একইসাথে ট্রাফিক জ্যামে জর্জরিত সায়েন্সল্যাব ও নীলক্ষেত মোড় কিছুটা হলেও স্বস্তি লাভ করবে।

উপসংহার

বিগত সরকারের সময়ে যথাযথ পরিবেশগত, পরিকল্পনাগত প্রভাব বিশ্লেষণ এবং জনগণের মতামত ছাড়াই যেসব মেগা প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল, সেগুলোর অন্যতম হলো ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। এই প্রকল্পের প্রথম দিককার প্রস্তাবনায়ও এই সংযোগ সড়ক ছিল না। অন্তর্বর্তী সরকার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ সড়ক অবকাঠামো প্রকল্পসমূহের পুনর্মূল্যায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করে যথাযথ সংশোধনসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে–এটাই ছিল জনগণের প্রত্যাশা। অথচ এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে, হাতিরঝিল জলাধার ও পান্থকুঞ্জ পার্কের পরিবেশ ধ্বংস করে এফডিসি থেকে পলাশী পর্যন্ত চলমান এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের সংযোগ সড়ক প্রকল্প নির্মাণ বাতিলের দাবিতে পান্থকুঞ্জ পার্ক সংলগ্ন এলাকাবাসী, বাংলাদেশ গাছ রক্ষা আন্দোলনসহ বিভিন্ন পরিবেশ, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থা, সংগঠন ও বিশেষজ্ঞদের সম্মিলিত আন্দোলন ১০০ দিন পার হয়ে গেলেও এ বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল থেকে এখন পর্যন্ত কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

উন্নয়নের নামে দেশব্যাপী প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল বিগত সরকারের আমলে নেওয়া বিভিন্ন অবকাঠামোগত প্রকল্প। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত নতুন বাংলাদেশে উন্নয়নের নামে পরিবেশ, জনস্বাস্থ্য ও জনস্বার্থবিনাশী কোনো কর্মকাণ্ড চলতে পারে না। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে রাষ্ট্র সংস্কারের কর্মসূচি হিসেবে সকল উন্নয়ন প্রকল্পকে পরিবেশগত, জনস্বাস্থ্য ও জনস্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে জবাবদিহির আওতায় আনার জোর দাবি জানাচ্ছি আমরা।

অতি ব্যয়বহুল ও বিদেশি ঋণনির্ভর প্রকল্প নেওয়ার প্রবণতা থেকে রাষ্ট্রকে বেরিয়ে আসতে হবে। সড়ক পরিবহণ পরিকল্পনায় ব্যয়সাশ্রয়ী, টেকসই, গণপরিবহণকেন্দ্রিক, জনবান্ধব ও পরিবেশ-প্রতিবেশ সহনশীল সমাধানকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে।

বিদ্যমান প্রেক্ষিতে আমাদের সম্মিলিত দাবিসমূহ

১. এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের এফডিসি থেকে পলাশী পর্যন্ত সংযোগ সড়ক নির্মাণের উদ্যোগের কারণে হাতিরঝিল জলাধার ও পান্থকুঞ্জ পার্কের পরিবেশ ইতোমধ্যেই ধ্বংসের পাশাপাশি কাঁঠালবাগান-কাঁটাবন-নীলক্ষেতসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সামগ্রিক পরিবেশ ও পরিবহণ ব্যবস্থা সীমাহীন সংকটে পড়বে। ফলে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের এফডিসি থেকে পলাশী পর্যন্ত সংযোগ সড়ক অবিলম্বে বাতিল করতে হবে।

২. ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, জনভোগান্তি, হতাহতের ঘটনা ও দুর্নীতি উদ্ঘাটনে অবিলম্বে তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে। পাশাপাশি এই প্রকল্পের চুক্তি পুনর্মূল্যায়নের মাধ্যমে এই প্রকল্পে দেশের স্বার্থ নিশ্চিত করতে হবে।

৩. এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের কারণে হাতিরঝিল ভরাট করে স্থাপিত পিলারগুলো সরিয়ে নিয়ে জলাধারের পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য পুনরুদ্ধার করে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। পান্থকুঞ্জ পার্কে চলমান প্রকল্পের কাজ অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে এবং পার্কের আয়তন, সীমানা অনুযায়ী ও ঋতুগত ভিন্নতাকে বিবেচনায় রেখে দেশি প্রজাতির বৃক্ষরোপণ করে কার্যকর পরিকল্পনার মাধ্যমে পার্কটিকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে।

৪. মেয়াদোত্তীর্ণ ছাড়পত্র দিয়ে চলমান এই প্রকল্প অবিলম্বে বন্ধের নির্দেশনা দিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে নোটিশ জারি করতে হবে এবং পরবর্তী সময়ে প্রকল্পের পক্ষ থেকে ছাড়পত্রের মেয়াদ নবায়ন করার আবেদন করা হলে উপরোল্লিখিত কারণ প্রদর্শনপূর্বক তাদের পরিবেশ ছাড়পত্র চূড়ান্তভাবে বাতিল ঘোষণা করতে হবে।

৫. রাষ্ট্রীয় আইন ও পরিকল্পনার ব্যত্যয় করে পরিবেশ ও জলাশয় ধ্বংসকারী এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের এফডিসি থেকে পলাশী পর্যন্ত সংযোগ সড়কের পূর্ণাঙ্গ কারিগরি নকশা, অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতা প্রতিবেদন ও সামগ্রিক লাভক্ষতির উপযোগিতা বিশ্লেষণ, পরিবেশগত সমীক্ষা প্রতিবেদন, পরিবহণগত সমীক্ষা প্রতিবেদন ও সামাজিক প্রভাবগত বিশ্লেষণ জনসম্মুখে প্রকাশ করতে হবে। জনগণ এবং বিশেষজ্ঞদের মতামত সাপেক্ষে পুরো প্রকল্পের পুনর্মূল্যায়ন করে যথাযথ পরিমার্জনা সাপেক্ষে প্রকল্পের অসমাপ্ত কাজ দ্রুত শেষ করতে হবে।

৬. এই সংযোগ সড়ক নকশা প্রণয়নকারী, পরামর্শক ও বাস্তবায়নকারী সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় এনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, যেন আগামী দিনগুলোতে এ ধরনের পরিবেশ ও জনজীবনবিনাশী প্রকল্পের পুনরাবৃত্তি না হয়।

৭. বাংলাদেশের সড়ক অবকাঠামো সংক্রান্ত চলমান বিভিন্ন প্রকল্পের পরিবেশ সংবেদনশীল পুনর্মূল্যায়ন করে জনগণ ও বিশেষজ্ঞদের যথাযথ মতামত নেওয়ার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে হবে।

৮. মাঠ, পার্ক, জলাধার রক্ষায় বিদ্যমান আইন সংশোধনের মাধ্যমে কঠোর বিধান প্রণয়ন করতে হবে। বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ)সহ সকল মাস্টারপ্ল্যানের যথাযথ বাস্তবায়ন ও মাস্টারপ্ল্যানে নির্ধারিত শ্রেণি পরিবর্তনের ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রাখতে হবে।

৯. অতি ব্যয়বহুল ও বিদেশি ঋণনির্ভর প্রকল্প নেওয়ার প্রবণতা থেকে রাষ্ট্রকে বেরিয়ে আসতে হবে। সড়ক পরিবহণ পরিকল্পনায় ব্যয়সাশ্রয়ী, টেকসই, গণপরিবহণকেন্দ্রিক, জনবান্ধব ও পরিবেশ-প্রতিবেশ সহনশীল সমাধানকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে।

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •