বাংলাদেশে অর্থনৈতিক বৈষম্য: স্বরূপ ও করণীয়
কল্লোল মোস্তফা

গত ২০শে জানুয়ারি ২০২৫ সর্বজনকথার আয়োজনে “স্বৈরতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রের পথ: বৈষম্যহীন বাংলাদেশের সন্ধানে” শিরোনামে দিনব্যাপী সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বৈষম্য, কৃষকের ন্যায্য মূল্য ও খাদ্যপণ্যের সিন্ডিকেট, পাঁচ দশকে শিল্পায়নের সমস্যা, বৈষম্য নিরসনে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের ভূমিকা, উচ্চশিক্ষার সংকট, জনস্বাস্থ্যের সংকট, লিঙ্গীয় বৈষম্যের নানান রূপ, জাতিগত সংকট নিরসনে করণীয় এবং বাংলাদেশে ধর্মীয় সম্প্রীতির পথে বাধা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এই লেখা সর্বজনকথা সেমিনারে উপরোক্ত বিষয়ে উপস্থাপিত বক্তব্যের লিখিত ও পরিমার্জিত রূপ।
একটা রক্তাক্ত গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ স্বৈরশাসনের পতন ঘটেছে। সরকারি চাকরিতে কোটা বৈষম্যের কারণে শুরু হওয়া আন্দোলন এক পর্যায়ে গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। এ অভ্যুত্থানের এক পর্যায়ে বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষ যুক্ত হয়ে যান যাদের এক বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ছিলেন শ্রমজীবী মানুষ। তারা যখন এতে যুক্ত হন, তাদের এই আকাঙ্ক্ষা কিন্তু শুধু সরকারি চাকরিতে বৈষম্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, সার্বিক বৈষম্য মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় পরিণত হয়।
গণঅভ্যুত্থানে কোন লিখিত ম্যানুফেস্টো ছিল না। গ্রাফিতি বা দেয়ালচিত্রগুলোই গণঅভ্যুত্থানের ম্যানুফেস্টো হয়ে ওঠে। আমরা যদি সেই দেয়ালচিত্রগুলো দেখি, তাহলে দেখব কীভাবে সেখানে বৈষম্যহীন বাংলাদেশের কথা বারবার উঠে এসেছে। সেইসব দেয়ালচিত্রে লেখা ছিল বৈষম্যহীন বাংলাদেশ, বৈষম্যহীন সরকার গঠনের কথা। শুধু তা-ই না, আমার খুব প্রিয় একটা দেয়ালচিত্র আছে যেখানে বলা হচ্ছে যে, “একজন রিকশাচালকের সন্তানও প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখবে”।
শ্রেণীগত জায়গা থেকে চিন্তা করলে এটা বেশ র্যাডিক্যাল একটা আকাঙ্ক্ষা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই যে “একজন রিকশাচালকের সন্তানও প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখবে” এরকম একটা আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের জন্য যে ধরণের শিক্ষাব্যবস্থা কিংবা রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-প্রশাসনিক ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন সেটা কি আসলে দেশে আছে? বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ৫৩ বছরেরও বেশি সময় পার হয়ে গেছে। এখন বাংলাদেশে যে ধরণের রূপান্তরের কথা হচ্ছে, রাষ্ট্র সংস্কারের কথা হচ্ছে, সেখানে কি এই আকাঙ্ক্ষার স্বীকৃতি আছে? বাংলাদেশ কি আসলে ঐ পথে হাঁটছে? কিংবা যদি আমরা ঐ পথে হাঁটতে চাই তাহলে কী করতে হবে?
গণঅভ্যুত্থানে কোন লিখিত ম্যানুফেস্টো ছিল না। গ্রাফিতি বা দেয়ালচিত্রগুলোই গণঅভ্যুত্থানের ম্যানুফেস্টো হয়ে ওঠে। আমরা যদি সেই দেয়ালচিত্রগুলো দেখি, তাহলে দেখব কীভাবে সেখানে বৈষম্যহীন বাংলাদেশের কথা বারবার উঠে এসেছে।
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের কিন্তু প্রথমে দেখতে হবে দেশের বর্তমান অবস্থাটা কী। আমাদের বর্তমানে যে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, যে অর্থনৈতিক বৈষম্য, তার স্বরূপটা কী, ধরণটা কী। সেই সাথে তার কারণটা বুঝতে হবে। যদি আমরা বিদ্যমান অর্থনৈতিক ধরণ ও তার কার্যকারণ স্পষ্ট বুঝতে পারি, উপলব্ধি করতে পারি তাহলেই আমরা বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়বার রাস্তা পাব। যে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়বার আকাঙ্ক্ষা ছিল ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে এই ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের জীবন্ত আকাঙ্ক্ষা।
বিদ্যমান অর্থনৈতিক বৈষম্য
বাংলাদেশে এমন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে যেখানে ১০ শতাংশ ধনীর হাতে যায় ৪১ শতাংশ আয়। এই পরিস্থিতি যে শুধু সাম্প্রতিক সময়ে হয়েছে তা না। গত দেড় দশকে এটা অনেক বেশি তীব্র হয়েছে। কিন্তু এর একটা ধারাবাহিক যাত্রা বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই আছে। ১৯৭৩-৭৪ সনে যেখানে ১০ শতাংশ ধনীর হাতে ২৮ শতাংশ আয় ছিল, সেখানে এখন দাঁড়িয়েছে ৪১ শতাংশ। এটা নিয়মিতই বেড়েছে। আয় বৈষম্য পরিমাপের গিনি সহগ দেখলেও বৈষম্য বৃদ্ধির পরিস্থিতি বোঝা যায়। ১৯৭৩-৭৪ সালে যে গিনি সহগ ছিল দশমিক ৩৬, এখন সেটা প্রায় দশমিক ৫০। এটা খুবই উচ্চ আয় বৈষম্যের নির্দেশক।

আমরা যদি আরেকটু খেয়াল করে দেখি, দেখব ৫ শতাংশ ধনীর হাতে ২০১০ সালে ২৪.৬১ শতাংশ আয় ছিল। অর্থাৎ ২০১০ সালে ১০০ টাকা জাতীয় আয়ের ২৪.৬১ টাকা বা প্রায় ২৫ টাকা ৫ শতাংশ ধনীর হাতে যেত এবং সে সময়ে ৫ শতাংশ দরিদ্রের হাতে যেতো ১ শতাংশেরও কম, দশমিক ৭৮ শতাংশ আয়। এর পরবর্তী এক যুগে আমরা ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা শুনেছি, জিডিপি প্রবৃদ্ধির কথা শুনেছি, কিন্তু তার ফলাফলটা কী হল? আমরা দেখছি যে সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশের আয় ২৫ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৩০ শতাংশ হয়েছে এবং সবচেয়ে দরিদ্র ৫ শতাংশ যাদের হাতে দশমিক ৭৮ শতাংশ ছিল, সেটা আরো কমে এখন দশমিক ৩৭ শতাংশে নেমেছে। অর্থাৎ আগে যা ছিল সেটাই ছিলো খুদকুড়ো, এটা আরো কমে অর্ধেক হয়েছে। মানে দরিদ্রের কাছ থেকে আয় আরো বেশি কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এই হচ্ছে গত একযুগের উন্নয়নের ফলাফল।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক রিপোর্ট থেকেও একই চিত্র পাওয়া যায়। যেমন: দেশের সম্পদ যে কিছু বিশেষ গোষ্ঠীর হাতে পুঞ্জীভূত হচ্ছে তা ক্রেডিট সুইস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের দেওয়া এই তথ্য থেকে বোঝা যায়। আমরা পাকিস্তান আমলে ২২ পরিবারের হাতে সম্পদ পুঞ্জীভবনের কথা শুনেছি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের একটি অন্যতম আকাঙ্ক্ষা ছিল ২২ পরিবারের শোষণ থেকে মুক্তি, ২২ পরিবারের আধিপত্য থেকে মুক্তি। এখন কিন্তু ক্রেডিট সুইস বলছে যে, দেশে এখন ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি সম্পদ আছে এরকম ব্যক্তির সংখ্যা ২১ জন। দেখা যাচ্ছে, ২২ পরিবারের হাত থেকে আমরা ২১ পরিবারের খপ্পরে আছি। শুধু তাই না, একই রিপোর্ট অনুসারে, ১০০ কোটি টাকার বেশি সম্পদ আছে এরকম ব্যক্তির সংখ্যা এখন ৫০০।

আমরা পাকিস্তান আমলে ২২ পরিবারের হাতে সম্পদ পুঞ্জীভবনের কথা শুনেছি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের একটি অন্যতম আকাঙ্ক্ষা ছিল ২২ পরিবারের শোষণ থেকে মুক্তি, ২২ পরিবারের আধিপত্য থেকে মুক্তি। এখন কিন্তু ক্রেডিট সুইস বলছে যে, দেশে এখন ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি সম্পদ আছে এরকম ব্যক্তির সংখ্যা ২১ জন।
তার মানে বাংলাদেশের যে বর্তমান পরিস্থিতি আমরা দেখছি, এখানে যেসব অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, আইন করা হচ্ছে, বিভিন্ন ধরণের নীতিমালা তৈরি করা হচ্ছে, এখানকার গণমাধ্যম, এখানকার ব্যবসাবাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানি ইত্যাদি সবকিছু এই অল্পকিছু মানুষের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে। তারই বহিঃপ্রকাশ ধারাবাহিক ভাবে আয় বৈষম্য বৃদ্ধি। এই যে বিপুল পরিমাণ সম্পদ অল্পকিছু মানুষের হাতে পুঞ্জিভূত হয়ে আছে, এইটাই কিন্তু অনেককিছু নির্ধারণ করে দেয়। এই রাষ্ট্রটা আসলে কে চালায়, রাষ্ট্র আসলে কার দখলে? আমাদের জাতীয় সংসদের চিত্রটা দেখলে এর একটা ধারণা পাওয়া যায়। নির্বাচিত, অনির্বাচিত, নির্বাচনের নামে নাটক ইত্যাদি নানাকিছুর মধ্য দিয়ে দেশে নানা ধরনের সংসদ বাংলাদেশে হয়েছে কিন্তু একটা সাধারণ চিত্র হচ্ছে যে, প্রতিবারই আগের চেয়ে বেশি করে ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর হাতে, ধনীক গোষ্ঠীর হাতে সংসদের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা পুঞ্জিভূত হয়েছে।

যেখানে ১৯৭৩ সালের সংসদে আইনজীবী ছিল ৩১ শতাংশ এবং ব্যবসায়ী ছিল ১৮ শতাংশ, সেখানে এখন আইনজীবীর সংখ্যা হচ্ছে ৮ শতাংশ এবং ব্যবসায়ী ৬৭ শতাংশ। এটা যে একবারে হঠাৎ করে হয়েছে এমন না, ধারাবাহিক ভাবে ঘটছে। আর এর তাৎপর্য হলো, ব্যবসায়ীরা যখন সংসদে যান, যখন তারা আইন প্রণয়ন করেন, তখন রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণ তাদের কব্জায় চলে যায়। এর ফলে তারা তাদের স্বার্থের পক্ষে আইন কানুন নীতিমালা তৈরী করে জনগণের সম্পদ লুন্ঠন করেন যার উদাহরণ হলো ব্যাংক কোম্পানি আইন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি দ্রুত সরবরাহ আইন ইত্যাদি। এখানে আমি দুর্নীতির কথা বলছিনা, দুর্নীতির ব্যাপারে পরে আসছি। এই যে বিভিন্ন নীতিমালার মাধ্যমে জনগণের সম্পদ লুণ্ঠন করে প্রতিবছর অল্প কিছু দেশীবিদেশী গোষ্ঠী উপকৃত হয়েছে, তার সাথে অর্থনৈতিক বৈষম্য ও অর্থনীতির বৈষম্যমূলক কাঠামোর সম্পর্ক রয়েছে।
তারই একটা প্রতিফলন হলো, একটা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর দখলে রাষ্ট্রের চলে যাওয়া। সরকার যে দলেরই থাকুক, রাষ্ট্রের দখল একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠির হাতেই থাকছে। এই যে দেশে নির্দিষ্ট একটি ধরনের অর্থনীতি গড়ে উঠেছে এবং তার যে একটা বৈষম্যমূলক চেহারা রয়েছে, এটা কি প্রাকৃতিক ভাবে ঘটছে? এমনিই ঘটছে? অনেক সময় বলা হয় যে, উন্নয়নের প্রাথমিক স্তরে অর্থনীতির চেহারা এরকমই হয়। আসলে এর পেছনে কতগুলো সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া আছে, কিছু সুনির্দিষ্ট কারণ আছে। এগুলো আমাদের খতিয়ে দেখা দরকার। এরকম কিছু কার্যকারণ হলো: বৈষম্যমূলক কর ব্যবস্থা, কৃষিখাতে অবহেলা, কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের ব্যাপক প্রাধান্য ও অতি নিম্ন মজুরী, ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে অপ্রতুল বরাদ্দ, শিক্ষা এবং চিকিৎসার বাণিজ্যিকীকরণ ইত্যাদি।
কর ব্যবস্থায় বৈষম্য
আমরা শুনি যে বাংলাদেশের কর-জিডিপির অনুপাত খুবই কম। মানে জিডিপির তুলনায় এখান থেকে কর খুবই কম সংগ্রহ করা হয়। বাংলাদেশের কর-জিডিপির অনুপাত সাড়ে সাত শতাংশের মতো যা আসলেই বেশ কম। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এটা কেন কম? ব্যাপারটা কি এরকম যে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছ থেকে কর কম নেওয়া হচ্ছে, এইজন্য কম? না। এর একটা কারণ হলো, জিডিপি নিয়ে জালিয়াতি, উন্নয়ন দেখানোর জন্য জিডিপি বাস্তবের চেয়ে বাড়িয়ে দেখানো। আরেকটা কারণ হলো, ধনীক গোষ্ঠির কাছ থেকে কর আহরণ কম করা।
বাংলাদেশে কর আহরণের ধরণটা যদি আমরা খেয়াল করি, দেখব যে প্রত্যক্ষ আয়কর অর্থাৎ ধনিক গোষ্ঠীর কাছ থেকে, তাদের মুনাফা থেকে যে আয়করটা নেওয়া হয়, এটা দুনিয়ার অন্যান্য যেকোন অঞ্চলের তুলনায় বাংলাদেশের অনেক কম। অন্যান্য দেশে কিন্তু প্রত্যক্ষ করের অনুপাতটা অনেক বেশি। বাংলাদেশে যে ব্যক্তি মাসে দশ হাজার টাকা আয় করে আর যে ব্যক্তি মাসে এক লাখ টাকা আয় করে সবার কাছ থেকেই এক ধরণের কর নেওয়া হয়। এটা হলো পরোক্ষ কর। আপনি চিনি কেনেন, তেল কেনেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় এরকম বহু পণ্যের ওপরে কর বসানো আছে। এই কর বৈষম্যমূলক। অন্যদিকে যদি সামর্থ্য অনুযায়ী কর আদায় করা হয় তাহলে সেই কর বৈষম্য নিরসনের একটা গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে কাজ করতে পারে। বৈষম্য নিরসন করতে হলে সামর্থ্যবানের কাছ থেকে তুলনামূলক বেশি কর আদায় করতে হবে এবং তার ব্যবসাবাণিজ্য, আয়-উন্নতির সাথে করের সম্পর্ক থাকবে। কিন্তু বাংলাদেশে এর উল্টোটাই ঘটে, এখানে সাধারণ মানুষের কাছ থেকেই বেশি কর আদায় করা হয়। সরকার যে ধনীদের কাছ থেকে পর্যাপ্ত কর আহরণ করে না তার প্রমাণ হল, সরকারের রাজস্ব আয়ের ৬৫-৬৭ শতাংশ আসে পরোক্ষ কর থেকে। মানে করের বেশিরিভাগটাই আসে সাধারণ মানুষের পকেট থেকে।
অন্যদিকে ধনীক গোষ্ঠীর কাছ থেকে কর আহরণের বেলায় নানা ধরণের ছাড় দেওয়া হয়। দেশে বছরে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার আয়কর ছাড় দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে ৬৮ শতাংশ বা ৮৫ হাজার ৩১৫ কোটি টাকার করপোরেট করছাড় দেওয়া হয়। বাকি প্রায় সাড়ে ৪০ হাজার কোটি টাকার ছাড় দেওয়া হয় ব্যক্তি পর্যায়ের করদাতাদের। ছাড় দেওয়া আয়করের পরিমাণ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩ দশমিক ৫৬ শতাংশের সমান।
আবার নানা ধরণের ছাড় দেওয়ার পর যতটুকুই বা কর ধার্য করা হচ্ছে, সেখানে আবার বিপুল পরিমাণে কর ফাঁকি দেওয়া হয় এবং সেটা উদ্ধারের ব্যাপারে আমরা আগেও যেমন সরকারের কোন তাগিদ দেখিনি, এখনো কিন্তু দেখছি না। দেশে করযোগ্য আয় করেও ৬৮ শতাংশ মানুষ আয়কর দেন না। জয়েন্ট স্টক কোম্পানিতে ২ লাখ ১৩ হাজার কোম্পানি রেজিস্টার্ড হলেও রিটার্ন দাখিল করে মাত্র ৪৫ হাজার কোম্পানি। বিভিন্ন খাতে কর ফাঁকি ও কর এড়িয়ে যাওয়ার কারণে বছরে ৫৫ হাজার ৮০০ কোটি থেকে ২ লাখ ৯২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা পর্যন্ত রাজস্ব আয় কম হয়।
এটা পরিস্কার যে, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়তে হলে পরোক্ষ করের বদলে প্রত্যক্ষ করের ওপর জোর দিতে হবে। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু আমরা দেখছি যে, এই সরকার এসেও সেই পরোক্ষ করের ওপর জোর দিচ্ছে এবং আইএমএফ-এর শর্ত মেনে বারো হাজার কোটি টাকা সাধারণ মানুষের পকেট থেকে নেওয়ার জন্য শতাধিক পণ্যের ওপরে ভ্যাট এবং শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। এটা কিন্তু বৈষম্যমুক্ত হওয়ার রাস্তা না।
কৃষি খাতে অবহেলা
দেশের মোট শ্রমশক্তির ৪৫ শতাংশ বা ৩ কোটি ২০ লাখ মানুষ কৃষি খাতে নিয়োজিত। জিডিপিতে কৃষির সরাসরি অবদান ১১ শতাংশ হলেও প্রকৃয়াকরণ, পরিবহণ ও বাণিজ্য মিলে কৃষি অর্থনীতির অবদান ২৩ শতাংশ। নগরকেন্দ্রিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতি অবহেলিত। রপ্তানিমুখী শিল্পে যেরকম গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, গ্রামীণ কৃষি ও কৃষি ভিত্তিক শিল্পে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।
সার, বীজ, কীটনাশক, কৃষি যন্ত্রপাতি, গবাদিপশু-মাছ-পোল্ট্রি খাদ্য সহ সমস্ত কৃষি উপকরণের উপর বিভিন্ন ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, ফলে এসব উপকরণ কৃষককে চড়া দামে ক্রয় করতে হয়। অন্যদিকে উৎপাদিত ফসলের এমন একটি বিপনন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে যার উপরেও কৃষকের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই, ফলে উৎপাদিত ফসল তাকে বিক্রি করতে হয় সবচেয়ে কম দামে।
ভারত সরকার ২৩টি কৃষিপণ্যের ‘মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস’ ঘোষণা করে, যেখানে উৎপাদন খরচের দেড় গুণ দাম ধরা হয়। বাংলাদেশে এরকম কোন ব্যবস্থা নেই। কৃষিপণ্য সংরক্ষণ ব্যবস্থা কৃষক বান্ধব নয়, গড়ে উঠেনি পর্যাপ্ত কৃষিভিত্তিক শিল্প। ফলে কৃষকের উৎপাদিত পণ্য যতদিন কৃষকের হাতে থাকে ততদিন তার দাম থাকে কম আর যখন কৃষকের হাত থেকে ব্যবসায়ী ও মজুতদারদের হাতে যায়, তখন তার দাম হয় চড়া। কৃষিখাতে যতটুকু প্রণোদনা ও ভর্তুকী দেওয়া হয়, সেটাও প্রকৃত কৃষকের ভাগ্যে জোটে না।
গ্রামে ভূমিহীন মানুষের হার গড়ে ৫৬%। ০.৫ একরের কম জমির মালিক প্রান্তিক চাষি ৪১% যারা ১১% ভূমির মালিক। ২.৫ একরের বেশি জমির মালিক কৃষকের হার ৬% যার চার ভাগের এক ভাগ জমির মালিক। ৪০% চাষীর কোন জমি নেই, তারা জমি বর্গা নিয়ে বা ভাড়া নিয়ে চাষাবাদ করেন। যেসব পরিবারের কৃষি জমির মালিকানা আছে, তার মধ্যে নারীর মালিকানার হার ১৩ শতাংশ যার মধ্যে ৪-৫ শতাংশের জমির উপর প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ আছে।
অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের প্রাধান্য ও অতি নিম্ন মজুরী
সাধারণভাবে ধরে নেওয়া হয় যে, মানুষের যদি একটা কর্মসংস্থান থাকে, মানুষ যদি নিয়মিত কোন অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত থাকে, তাহলে তার খেয়ে পরে মোটামুটি ভালভাবে বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে কোন সমস্যা হওয়ার কথা না। কিন্তু বাংলাদেশে এমন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে যে এখানে কাজ করেও মানুষ দারিদ্র থেকে মুক্তি পাচ্ছে না। এখানে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের প্রাধান্য বেশি। এর মানে হলো, যে খাতগুলোতে শ্রম আইনের কোন এনফোর্সমেন্ট নাই, শ্রমিকদের কোন অধিকার নাই, কোন ন্যূনতম মজুরি নাই, তার সবেতন ছুটি, স্বাস্থ্যবীমা ইত্যাদি যেসব ন্যূনতম অধিকার বিশ্বজুড়ে শ্রমিকদের প্রাপ্য, সেই অধিকারগুলোর কোন বালাই নাই এরকম খাতে বাংলাদেশের শ্রমিকদের ৮৫ শতাংশ বা ৬ কোটি শ্রমিক কাজ করেন। এর ফলাফল হলো, তাদেরকে অতি নিম্ন মজুরিতে কাজ করতে হয়। যারা প্রাতিষ্ঠানিক খাতে আছে তাদের ক্ষেত্রেও নিম্ন মজুরির সংকট আছে কিন্তু যারা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে, তাদের ক্ষেত্রে সংকটটা আরো অনেক বেশি।

আইএলও-র ২০২০-২১ সালের এক রিপোর্ট থেকে দেখা যায়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মাসিক মজুরী ৪৮ ডলার থেকে ২১৬৬ ডলার। এর মধ্যে সবচেয়ে কম মজুরি দেওয়া হয় বাংলাদেশে, গড়ে ৪৮ ডলার। আইএলও-র ঐ প্রতিবেদনে লেখা হয়, বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যেখানে ন্যূন্যতম মজুরি আন্তর্জাতিক দারিদ্রসীমার নিচে। বর্তমানে এই পরিস্থিতির তেমন কোন পরিবর্তন ঘটেনি।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মাসিক মজুরী ৪৮ ডলার থেকে ২১৬৬ ডলার। এর মধ্যে সবচেয়ে কম মজুরি দেওয়া হয় বাংলাদেশে, গড়ে ৪৮ ডলার। আইএলও-র ঐ প্রতিবেদনে লেখা হয়, বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যেখানে ন্যূন্যতম মজুরি আন্তর্জাতিক দারিদ্রসীমার নিচে।
দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ এমন একটা দেশ যেখানে কাজ করেও দারিদ্রমুক্ত হওয়া যায় না! সিপিডির একটা স্টাডি থেকে দেখা গেছে, ২০২২ সালের ডিসেম্বর নাগাদ মাছ, মাংস, ডিম, দুধ বাদ দিয়ে শুধুমাত্র ক্যালরি চাহিদা মেটানোর জন্য যতটুকু ন্যূনতম খাদ্য মানুষের প্রয়োজন, সেই খাদ্য কেনার জন্য চার সদস্যের একটা পরিবারের যে ৯ হাজার ৫৫৭ টাকা লাগে, সেই টাকাটাও ন্যূনতম মজুরি হিসেবে দেওয়া হয় না প্রাতিষ্ঠানিক খাতের অনেক প্রতিষ্ঠানে।
দেশের শ্রমিকরা সব মিলিয়ে ১৪২টি খাত ও উপখাতে কাজ করেন। এর মধ্যে মাত্র চল্লিশটা খাতে ন্যূনতম মজুরি আছে। এই ন্যূনতম মজুরির কি অবস্থা সেটা তো আপনারা দেখলেন, এই ন্যূনতম মজুরি আসলে মানবেতর জীবনযাপন করার জন্যও যথেষ্ট না। অন্যদিকে ন্যূনতম মজুরির আওতার বাইরে রয়ে গেছে একশোরও বেশি উপখাত।
লুণ্ঠন, দুর্নীতি ও পাচার:
অর্থনৈতিক বৈষম্যের আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে কতিপয় গোষ্ঠীর লুণ্ঠন, দুর্নীতি ও পাচার। দেশে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড থেকে যতটুকু সম্পদ সৃষ্টি হচ্ছে, তা আবার দেশে থাকছে না। তা দেশের মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে যুক্ত হচ্ছে না, কর্মসংস্থানের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে না। লুটপাট হয়ে বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত অর্থনীতি সংক্রান্ত শ্বেতপত্র কমিটির রিপোর্ট থেকে দেখা যাচ্ছে যে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের পনেরো বছরে আটাশ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। চলতি অর্থ বছরের বাজেট প্রায় আট লক্ষ কোটি টাকা। তার মানে পনেরো বছরে সাড়ে তিন বছরের বাজেটের সমপরিমাণ অর্থ স্রেফ বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। প্রতি বছর পাচার হয়েছে এক লক্ষ আশি হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ঘুষ দুর্নীতির চিত্র হলো- রাজনৈতিক নেতারা নিয়েছেন এক লাখ চল্লিশ হাজার কোটি টাকা, আমলারা নিয়েছেন আটানব্বই হাজার কোটি টাকা। এদের বেশীরভাগই বহাল তবিয়তেই আছেন। আমরা যে সিন্ডিকেটের কথা বলি, ব্যাংক খাতে লুটপাটের কথা বলি, ব্যবসায়ীদের আধিপত্যের কথা বলি, তাদের কাঠামোগত পরিবর্তন যে খুব হয়েছে তা নয়। অল্পকিছু মানুষ হয়তো জেলে আছে বা পলাতক আছে কিন্তু সাধারণভাবে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও নীতিমালার মধ্যে ব্যবসায়ী ও ধনিক গোষ্ঠির আধিপত্যের জায়গাগুলোর কোনো পরিবর্তন হয়নি। কিছু লোক বদল হয়েছে হয়তো।

সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বৈষম্য
সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা হচ্ছে এমন একটি খাত যেটি বৈষম্যমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যেও মানুষকে কিছুটা স্বস্তি দেওয়ার কাজে লাগতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ খুবই অপ্রতুল এবং যতটুকু বরাদ্দ হয় তারও একটা বড় অংশ প্রকৃতপক্ষে দরিদ্র জনগোষ্ঠির কাছে পৌছায় না। সরকারি জরিপেই দেখা গেছে তালিকাভুক্ত ভাতাভোগীদের ৪৬ শতাংশের বেশি ভাতা পাওয়ার যোগ্য নয়।


নানা ধরনের রাজনৈতিক কারণে, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে তাদেরকে এগুলো দেওয়া হচ্ছে। এবং যতটুকু ভাতা দেওয়া হচ্ছে দেখলে মনে হবে যে ভিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। আট লক্ষ কোটি টাকার বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা বাজেট দেখানো হয়েছে এক লক্ষ ছত্রিশ হাজার কোটি টাকা। মোট বরাদ্দ বেশি দেখানোর কৌশল হিসেবে এই খাতে এমন কিছু কর্মসূচি দেখানো হয়, যা বাস্তবে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিই নয়। এরকম কতগুলো কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- সরকারি কর্মচারীদের পেনশন, কৃষিখাতে ভর্তুকি, সঞ্চয়পত্রের সুদ, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের দেয়া প্রণোদনা ইত্যাদি। ফলে প্রয়োজনের তুলনায় খুব কম সংখ্যক দরিদ্রই সামাজিক নিরাপত্তা ভাতা পায়, আর যাও বা পায় তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য। এই কারণেই দেশের অর্থনীতির আকার যত বড় হচ্ছে, বৈষম্য তত বাড়ছে।
শিক্ষা ব্যবস্থায় বৈষম্য
বাজার অর্থনীতির দেশগুলোর ক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, একটা মানুষ যদি দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেয় তাহলে তার শ্রেণী উত্তরণ ঘটবে কীভাবে? সে কীভাবে একটু খেয়েপরে ভাল জীবনযাপন করবে? এর একটা গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হতে পারে শিক্ষা। কোন দেশে যদি ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে শিক্ষা অর্জনে সুযোগের সমতা থাকে তাহলে কিন্তু একেবারে দরিদ্র পরিবারে জন্ম নিয়েও শ্রেণী উত্তরণের ন্যূনতম একটা সুযোগ থাকে। এই বিষয়টাকে বলা হয় সোশ্যাল মোবিলিটি বা সামাজিক চলনশীলতা। বাংলাদেশে এই সোশ্যাল মোবিলিটির কী পরিস্থিতি? এই যে আমরা শুরুতে গণঅভ্যুত্থানের গ্রাফিতিতে একজন রিকশা চালকের সন্তানেরও প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখার সুযোগের আকাঙ্ক্ষা দেখলাম, বর্তমান ব্যবস্থায় সেটা কতটুকু সম্ভব? সে তো স্কুলেই যেতে পারে না।

শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যখাতের যে অবস্থা আমরা দেখছি, জিডিপির ২ শতাংশেরও কম শিক্ষাখাতে বরাদ্দ করা হয় আর স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ ১ শতাংশের কম। বাংলাদেশে বরাদ্দের এই হার সারা দুনিয়ার মধ্যে সবচেয়ে নীচের দিকে। এর ফলে যা ঘটছে তা হলো শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যখাতের ক্রমাগত বাণিজ্যিকিকীরণের কারণে একদিকে সমাজের তলায় পড়ে আছে যে মানুষ, তাদের আর উপরে ওঠার কোন সুযোগই থাকে না। শুধু তাই না, যারা কোনরকমে উঠে আসতে চান, তারা এই শিক্ষা এবং চিকিৎসার ব্যয় বহন করতে করতে আবার নিঃস্ব হয়ে যান। ইউনেস্কোর সাজেশন হচ্ছে, “জিডিপির ৪ থেকে ৬ শতাংশ শিক্ষাখাতে ব্যয় করা উচিৎ” কিন্তু আমরা ব্যয় করছি ২ শতাংশের কম। শিক্ষাখাতে পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তু, কারিকুলাম অবশ্যই প্রয়োজনীয় বিষয়। কিন্তু এগুলো নিয়ে যতটা আলোচনা হয়, তার তুলনায় খুবই কম আলোচনা হয় মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রাপ্তিতে যে বৈষম্য আছে সেটা নিয়ে। এটা কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কিন্তু ততটা মনোযোগ আমরা দেখছি না।
ইউনেস্কোর তথ্য অনুসারে, শিক্ষাখাতে যতটা ব্যয় হয় তার ৭১ শতাংশই পরিবারগুলোকে বহন করতে হয়। এখন শিক্ষাখাতে ১০০ টাকা খরচের মধ্যে ৭১ টাকাই যদি একটা পরিবারকে বহন করতে হয়, তাহলে দরিদ্র পরিবারের সন্তানরা শিক্ষা লাভ করবে কীভাবে? আমরা জানি যে, সরকারি প্রাথমিক শিক্ষা বিনামূল্যে পাওয়ার সুযোগ থাকলেও শিক্ষার মান, শিক্ষকের মান ও সংখ্যা, শিক্ষার উপকরণ ইত্যাদির ক্ষেত্রে গ্রাম-শহরে ব্যাপক বৈষম্য আছে। ব্যানবেইজের বাংলাদেশ এডুকেশন স্ট্যাটিস্টিকস ২০২৩ অনুসারে, প্রাথমিকে ভর্তির হার ৯৮ শতাংশ। কিন্তু মাধ্যমিকে ঝরে পরে ৩২.৮৫ শতাংশ। ১০০ জন যদি প্রাথমিকে ভর্তি হয় ৩২-৩৩ জন মাধ্যমিকেই ঝরে পরে। তারপর উচ্চ মাধ্যমিক থেকে ঝরে পরে আরো ২১ শতাংশ। উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পায় মাত্র ২০ শতাংশ। বলতে পারেন যে, ১০০ শতাংশেরই কি উচ্চ শিক্ষা পাওয়ার প্রয়োজন আছে? আমি ঐ তর্কে যাব না। আমি শুধু বলব, উচ্চশিক্ষা কে পাবে, কে পাবে না এটা কী দিয়ে নির্ধারণ হয়? এটা কি মেধা দিয়ে নির্ধারণ হয়? যোগ্যতা দিয়ে নির্ধারণ হয়? নাকি পিতামাতার আর্থিক সামর্থ্য দিয়ে নির্ধারিত হয়? তাহলে কীভাবে আমরা বৈষম্য থেকে বের হয়ে আসব?
২১ হাজার ৮৬টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে মাধ্যমিক পর্যায়ে, তার মধ্যে ১৯ হাজার ৭৫৭টি-ই হচ্ছে বেসরকারি। কলেজ আছে ৩ হাজার ৪১১টি যার মধ্যে ২ হাজার ৭১১টি-ই বেসরকারি। ১৭১টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ১১৪টি-ই বেসরকারি। এখন এই যদি অবস্থা হয়, তাহলে শিক্ষার মাধ্যমে বৈষম্য কমা তো পরের কথা, শিক্ষা নিজেই বৈষম্যের একটা উৎস হয়ে গেছে, একটা প্রক্রিয়া হয়ে গেছে যা বৈষম্যকে চিরস্থায়ী করে। এই ধরণের শিক্ষাব্যবস্থা থাকলে বৈষম্য থেকে দেশ কখনোই বেরিয়ে আসতে পারবে না।
২১ হাজার ৮৬টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে মাধ্যমিক পর্যায়ে, তার মধ্যে ১৯ হাজার ৭৫৭টি-ই হচ্ছে বেসরকারি। কলেজ আছে ৩ হাজার ৪১১টি যার মধ্যে ২ হাজার ৭১১টি-ই বেসরকারি। ১৭১টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ১১৪টি-ই বেসরকারি। এখন এই যদি অবস্থা হয়, তাহলে শিক্ষার মাধ্যমে বৈষম্য কমা তো পরের কথা, শিক্ষা নিজেই বৈষম্যের একটা উৎস হয়ে গেছে।
স্বাস্থ্য খাতে বৈষম্য
এবার দেখা যাক স্বাস্থ্যখাতের পরিস্থিতি। স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ জিডিপির মাত্র ১ শতাংশ। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বলছে যে, সার্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির ৪ থেকে ৫ শতাংশ ব্যয় করা উচিৎ। কিন্তু আমাদের দেশে বরাদ্দ করা হচ্ছে প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। আবার যে বরাদ্দটুকু করা হচ্ছে সেটার কোয়ালিটিও নিয়ে প্রশ্ন আছে। আছে চুরি, দুর্নীতি, অনিয়ম। এর ফলাফল কী? ফলাফল হচ্ছে যে, প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য চিকিৎসক-নার্স-ধাত্রীর সংখ্যা ৯ দশমিক ৯, যা বৈশ্বিক গড়ের তুলনায় অনেক কম। বৈশ্বিক গড় হচ্ছে ৪৮ দশমিক ৬। প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য হাসপাতালের বেড থাকা দরকার ১৮, বাংলাদেশে আছে মাত্র ৯ দশমিক ৫। কিন্তু যা আছে তা-ও আবার শহরকেন্দ্রিক এবং বেসরকারি হাসপাতাল কেন্দ্রিক, ফলে ব্যয়বহুল। বাংলাদেশ হেলথ ওয়ার্কফোর্স স্ট্র্যাটেজি ২০২৩ অনুসারে, চিকিৎসক ও নার্সদের দুই-তৃতীয়াংশ এবং দন্ত চিকিৎসক ও মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের অর্ধেকেরও বেশি শহর এলাকায় থাকেন। এদের বেশিরভাগই আবার চিকিৎসা প্রদান করেন বেসরকারিভাবে।

তাহলে এই যে চিকিৎসা ব্যবস্থা, যেখানে বরাদ্দ কম, প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল, চিকিৎসক, নার্সসহ, হাসপাতালের বিছানা সবকিছুই আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের তুলনায় অনেক কম, এর ফলাফল কী? শিক্ষার ক্ষেত্রে যেমন ৭১ শতাংশ ব্যয় পরিবারের পকেট থেকে যায়, চিকিৎসারও একই অবস্থা, ৭৩ শতাংশ ব্যয় সাধারণ মানুষের পকেট থেকে বহন করতে হয়। যা দিনে দিনে আরো বাড়ছে। এর ফলে চিকিৎসার খরচ জোগাতে গিয়ে প্রতি বছর প্রায় ৮৬ লক্ষ মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে চলে যাচ্ছে। কোনো ব্যক্তি সারাজীবন বহু পরিশ্রম লড়াই করে করে হয়তো কিছু সঞ্চয় করছে, কিন্তু পরিবারের কারো যদি একটা কিডনীর অসুখ হয়, কারো যদি ক্যান্সার হয়, হার্টের অসুখ, ডায়াবেটিকস সহ জটিল কোন অসুখ হয় যার জন্য দীর্ঘমেয়াদী ও ব্যয়বহুল চিকিৎসার প্রয়োজন, সেক্ষেত্রে ঐ পুরো পরিবারই ডুবে যায়। এইরকম একটা অবস্থা যা বিদ্যমান অর্থনৈতিক বৈষম্যকে আরো তীব্র করছে।
চিকিৎসারও একই অবস্থা, ৭৩ শতাংশ ব্যয় সাধারণ মানুষের পকেট থেকে বহন করতে হয়। যা দিনে দিনে আরো বাড়ছে। এর ফলে চিকিৎসার খরচ জোগাতে গিয়ে প্রতি বছর প্রায় ৮৬ লক্ষ মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে চলে যাচ্ছে।
বৈষম্য হৃাসে করণীয়
এতক্ষণ আমরা কী কারণে একটা ভয়াবহ অর্থনৈতিক বৈষম্যের মধ্যে আছি তা দেখলাম, আলোচনা থেকে এটাও বোঝা যাবার কথা যে, এই বৈষম্য দূর করতে কী কী করতে হবে। বিদ্যমান রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা মাথায় রেখেই বলছি, বৈষম্য কমাতে হলে ধনিক গোষ্ঠীর কাছ থেকে প্রত্যক্ষ কর আহরণ বৃদ্ধি করতে হবে, শুল্ক ও ভ্যাটের নামে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে পরোক্ষ কর আহরণ কমাতে হবে। ভূমি সংস্কার করে বাড়তি জমি ভূমিহীন কৃষকের মাঝে বন্টন করতে হবে। কৃষি উপকরণের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, উৎপাদিত ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বেধে দিতে হবে, রাষ্ট্রীয় ভাবে সরাসরি ক্রয় করতে হবে।
এছাড়া শ্রমজীবী মানুষের বেঁচে থাকার জন্য জাতীয় ন্যূন্যতম মজুরি বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক খাতে মানসম্মত কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতকে শ্রম আইনের আওতায় এনে শ্রমিকের বেঁচে থাকার মতো ন্যূনতম মজুরি ও নিরাপদ কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে হবে। ধনিক গোষ্ঠীর লুণ্ঠন ও দুর্নীতি কঠোরভাবে দমন করতে হবে, দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে বিচার করে শাস্তি দিতে হবে।
শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে। শিক্ষার সব স্তরে সুযোগের সমতা নিশ্চিত করা জরুরি, যেন মা-বাবার অর্থনৈতিক অবস্থা সন্তানের শিক্ষাপ্রাপ্তির পথে বাধা হতে না পারে। চিকিৎসা খাতে সরকারের ব্যয় বৃদ্ধি করতে হবে, চিকিৎসা ব্যয়ে দুর্নীতি দূর করতে হবে, সর্বজনের চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে, চিকিৎসাসুবিধা প্রাপ্তিতে গ্রাম–শহরের ভেদ দূর করতে হবে, সরকারি খাতে চিকিৎসক-নার্স-হাসপাতালের বিছানা ইত্যাদি বৃদ্ধি করতে হবে, যেন বেসরকারি খাতে চিকিৎসা নিতে গিয়ে প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষকে নিঃস্ব হতে না হয়।
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা ও বরাদ্দ বাড়াতে হবে, প্রকৃতপক্ষে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে ভাতা পৌঁছানো নিশ্চিত করতে হবে। নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক ও ডিজিটাইজেশনের মাধ্যমে দুর্নীতিমুক্ত রেশনব্যবস্থা চালু করতে হবে, যাতে কৃষকের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি এবং দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা দুটোই নিশ্চিত হয়, সেই সঙ্গে বাজারে এসব পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
একটি সতর্কবার্তা
আলোচনার শেষে একটা সতর্কবার্তা। বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থানের পরে আমরা দেখছি যে নানা ধরণের সংস্কারের কথা হচ্ছে। রাজনৈতিক সংস্কার, বিভিন্ন ধরণের প্রশাসনিক বা প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে কিন্তু যে বৈষম্যমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হাসিনা শাসনের বিরুদ্ধে মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলো, সেই অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অর্থপূর্ণ সংস্কারের কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এটা না হলে কোনো রাজনৈতিক সংস্কার, কোনো গণতান্ত্রিক সংস্কার টিকবেনা। অর্থনীতি হচ্ছে ভিত্তি, তা যদি দুর্বল থাকে, এই দুর্বল ভিত্তির ওপরে যতই সংস্কারের ইমারত তৈরি করা হোক তা ধ্বসে যাবে।
এটা বাংলাদেশের জন্য আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে, একটা দীর্ঘ স্বৈরশাসনের অবসান ঘটেছে। পাঁচ বছর পর পর সরকার পরিবর্তনের কোন ঘটনা এটা না। সাধারণত দীর্ঘ স্বৈরশাসনের পরে যখন একটা শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন হয়, তখন নানা ধরণের শূণ্যতা ও সংকট তৈরী হয়। দীর্ঘ স্বৈরশাসনে দেশের রাজনীতি-অর্থনীতির মধ্যে এমন ক্ষত তৈরী হয় যা শুধু উপরে উপরে মলম দিয়ে সারিয়ে তোলা যায় না। অর্থনীতির কাঠামো যদি সংস্কার করা না হয়, তাহলে এই সংস্কারকে মানুষ গ্রহণ করবে না, নিজের মনে করবে না। বিশ্বের ইতিহাসে এরকম অনেক ঘটনা দেখা গেছে যে, সংস্কার করে খুব সুন্দর একটা সংবিধান তৈরী করা হলো, কিন্তু সেই সংবিধান মানুষের খাওয়া-পরার নিশ্চয়তা দিতে পারছে না, অর্থনৈতিক বৈষম্যকে হ্রাস করতে পারছে না। সেই সংবিধান কিন্তু মানুষ গ্রহণ করে না। দেখা যায়, একটা স্বৈরাচারী শক্তি খুব সহজেই সেটাকে উল্টে দিতে পারে।
গণঅভ্যুত্থানের দেয়ালচিত্রেও আমরা রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা দেখি, “এলিটদের রাষ্ট্রব্যবস্থা না, গণমানুষের রাষ্ট্রব্যবস্থা”। এখানে খেয়াল করবার বিষয় হলো, অভ্যুত্থানকারী ছাত্র-জনতা কিন্তু একটা সরকার পতনের মধ্যেই সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাঁরা একটা রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিবর্তন চেয়েছেন। সেই রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজনীয় রাজনীতি আমাদের গড়ে তুলতে হবে, তাহলেই আমরা একটা বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারব।
কল্লোল মোস্তফা: লেখক, গবেষক। ইমেইল: kallol_mustafa@yahoo.com