কেমন আছেন?
মওদুদ রহমান

পরিচিত কিংবা অপরিচিত যে কারো সঙ্গেই আমাদের কথা হোক-না কেন, আলাপ শুরুর দিকে আমরা অজান্তেই যা জানতে চাই তা হলো: কেমন আছেন? এই প্রশ্নটা যেমন অবধারিত, ঠিক তেমনি অপর পাশ থেকে আসা এর উত্তরটাও প্রায় প্রতিটি সময়ই সুনির্দিষ্ট: ভালো আছি। মাসের শেষে এসে কেউ হয়তো ভাবছেন, বেতনের টাকাটা পাওয়ার আগ পর্যন্ত বাকি দিনগুলো কীভাবে চলবেন, সে-ও বলে ভালো আছি। কারো হয়তো কিস্তির টাকাটা বাকি পড়ে আছে গত দু-সপ্তাহ ধরে, সে-ও বলে ভালো আছি। আবার যে কিনা সারা দিন বাসায় বাসায় বুয়ার কাজ করে গভীর রাত পর্যন্ত জেগে অপেক্ষা করেন, কখন গ্যাসের চাপটা বাড়বে, আর কখন নিজের জন্য, পরিবারের জন্য রান্না করবেন, পরের দিন গার্মেন্টসে যাওয়া স্বামীর টিফিন ক্যারিয়ারটা গুছিয়ে রাখবেন, তাকেও যখন কেউ জিজ্ঞেস করে এই প্রশ্ন, সে-ও জবাবে দেয়: ভালো আছি। এই ভালো থাকাটা আসলে কতটা ভালো থাকা? এই ভালো থাকাটা কি শুধুই বেঁচে থাকা? এই ভালো থাকাটা কি ছুটতে থাকা, ধুঁকতে থাকা সাদাকালো জীবনে ভবিষ্যতের রঙিন আশা? নাকি এই ভালো আছি বলাটা কেবলই রূপক? নাকি এই ভালো থাকাটা শুধুই রক্তমাংসের শরীরী জীবনের মেনে নেওয়া ক্রমেই ছোট হয়ে আসতে থাকা ছায়া? বিভিন্নজনের সাথে আলাপ করে উত্তর পাবার চেষ্টা করা হয়েছে এই লেখায়।
যে কৃষক লাঙল টানে, সেই কৃষকই হয়তো আকালের সময় শহরে আসে রিকশা টানতে, হয়তো সে কৃষকের সঙ্গে হাত ধরে চলে আসে পাশের বাড়ির কোনো এক এতিম ছেলে যে কিনা কেবলই উঠেছিল ক্লাস সেভেনে, অথচ তার আর পড়া হবে না। কারণ, বড় বোনের বিয়ে হচ্ছে না যৌতুকের বিশ হাজার টাকার হিসাব মেলানো যাচ্ছে না বলে। সেই ছেলে হয়তো শুনেছে শহরে কম পুঁজিতে ভেলপুরি, ফুচকার ব্যবসা করা যায়, তাই মায়ের রুপার বালাজোড়া বন্ধক রেখে ভেলপুরি ফেরি করে বিক্রির পুঁজি নিয়ে সে হয়তো রাতের বাসে ঢুলতে ঢুলতে এসে পড়ে এক মস্তবড় শহরে। আমরা হয়তো সেই কৃষকের পায়ে টানা রিকশায় উঠে বলছি: মামা, আরেকটু জোরে চালান, অফিসের দেরি হইয়া যাইতেছে। আমরা হয়তো সেই ছেলেটার বানাতে থাকা ভেলপুরি চিবোতে চিবোতে বলছি: ঝাল এত কম কেন? আরেকটু টক দাও।
এই রিকশাচালক, পুরিওয়ালা, ভ্যানগাড়িতে করে সবজিবিক্রেতা, ম্যানহোলে নামা সুইপার, বাসায় কাজ করতে যাওয়া বুয়া – আমার আলাপ তাদের সঙ্গেই। তাদেরকে আমি জিজ্ঞাসা করি: কেমন আছেন? তাদের এই বেঁচে থাকারূপী ভালো থাকা জীবনের অন্দরমহলে আমি ঢুকতে চাই কোনো অনুপ্রবেশকারী হিসেবে নয়, বরং তাদের সঙ্গী হিসেবে। আমাদের কথার নৌকা চলে তাদের ইচ্ছার নদীতে। আমি তাদের চোখে তাদের জীবন বোঝার চেষ্টা চালিয়ে যাই আমার মাথায় আসতে থাকা অসংখ্য প্রশ্নের চাপ উপেক্ষা করে। আমার এই চেষ্টা হয়তো কখনোই সার্থক হওয়ার নয়। যে বর্গে আমার বসবাস, সেই জমিনের বর্গাচারী জীবন বোঝা যতটা সহজ, অপর বর্গীয় জীবন বোঝা ঠিক ততটাই কঠিন। এ জন্য প্রয়োজন একনিষ্ঠ সাধনা, আর কথা শুনতে পারার অপরিসীম ধৈর্য, যার কোনোটাই আমার মধ্যে পরিপূর্ণভাবে আছে বলে মনে করি না। কিন্তু এরপরও আমি আমার চেষ্টা চালিয়ে যাই, জীবনের সঙ্গে কথা বলি, আর টুকরো টুকরো গল্প শুনি। আমার এই অভ্যাসে অভ্যস্ত জীবনে টুকে রাখা নোট থেকে ‘কেমন আছেন?’ শিরোনামে সর্বজনকথার জন্য এই লেখা। এই লেখার প্রতিটি জীবন বাস্তব, প্রতিটি চরিত্রের কাছ থেকে শোনা জবানীগুলো প্রায় হুবহু তুলে দেওয়া, কেবল নামগুলো কাল্পনিক।
এই লেখার শেষে গত কয়েক মাসে প্রায় প্রতি পনেরো দিন অন্তর অন্তর বাজার ঘুরে ঘুরে সংগৃহীত কিছু কাঁচাবাজারি পণ্যের মূল্যতালিকা দেওয়া হলো, সেইসঙ্গে ওই মাসগুলোতে চলতি দামে প্রাপ্ত কাঁচা তরকারি, সবজি, মাছ, মাংস ইত্যাদি কিনে একটা ৪ থেকে ৫ সদস্যের পরিবারের কেবল খাবার খরচ এক মাসে কত হতে পারে সেটার একটা ধারণামূলক হিসাব যুক্ত করা হলো।
খাবারের চেয়ে ওষুধের খরচ বেশি
রাহেলা আপার সঙ্গে যেই বিকেলে আলাপ হচ্ছিল তার আগে দিনের পুরোটা সময় উনি তার স্বামীর সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি করেই কাটিয়েছেন। সেই ঝগড়া একপর্যায়ে পরিণত হয় হাতাহাতিতে। আর শেষ হয় রাহেলা যখন রান্নাঘরের বঁটি বের করে তার স্বামীকে কোপ দিতে উদ্যত হন তখন। এরপরই তার স্বামী ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। এরপর অবশ্য রাহেলা আপাও আর ঘরে থাকেননি। তিনিও রাগে-দুঃখে-অপমানে কাপড়-চোপড় একটা পুঁটলিতে ভরে বের হয়ে এসেছেন। জানতে চাই: এখন থাকবেন কোথায়? রাহেলা জানান, তিনি যে বাসায় বুয়ার কাজ করেন সেখানকার আপা খুব ভালো। তার বাসাতেই কাপড়-চোপড় সমেত উঠেছেন।
–আপনার বাসায় আর কে কে আছে?
রাহেলা জানান তার তিন মেয়ে। এক মেয়ের বিয়ে হয়েছে অনেক বছর আগেই। আরেক মেয়ের বিয়ে হলেও জামাই তাকে এখনো ঘরে উঠিয়ে নেয়নি যৌতুকের পুরো টাকা পায়নি বলে। আর ছোট মেয়ে গত বছর ক্লাস ফাইভ শেষ করেছে। এখন বাসাতেই আছে।
–ছোট মেয়ে এখন কোন স্কুলে পড়ে?
–এখন আর পড়ে না। ভর্তি করতে দেড় হাজার টেকা লাগবে। মাসে দুইশ টেকা বেতন। এই টেকা মেয়ের বাপ দিতে পারবে না বলছে। তাই মেয়েরে এই বছর আর ভর্তি করাই নাই।
–সরকারি স্কুলে ভর্তি করান। সেখানে তো খরচ কম।
–কই খরচ কম! ফাইভ পর্যন্ত ফ্রি। এরপর আর ফ্রি স্কুল নাই।
রাহেলার স্বামী কক্সবাজার শহরে টমটম চালায়। অবশ্য রাহেলার ভাষায় চালায় না বলে এটা বলা সঠিক হবে যে, আগে নিয়মিত চালাতো, আর এখন মাঝেসাঝে গাড়ি নিয়ে রোডে বের হয়।
–তাহলে বাকি সময় আপনার স্বামী কী করে?
–মোবাইলে জুয়া খেলে।
–সেইটা কীভাবে?
–ওই-যে মোবাইলের জুয়া আছে না। যেইখানে বিকাশে টেকা পাঠায়। এরপর বাজি ধরে। স্মাটফোনে খেলে।
বুঝলাম রাহেলার স্বামী অনলাইনের নিষিদ্ধ বেটিং সাইটগুলোতে আসক্ত। বাংলাদেশে ক্রিকেটকেন্দ্রিক এরকম কিছু বেটিং সাইট খুবই জনপ্রিয়, যেখানে নানানভাবে বাজি ধরা যায়। নিজের পছন্দের প্রোফাইলের খেলোয়াড় দিয়ে ভার্চুয়াল দল তৈরি করা যায়। কোন দল কোন ম্যাচে জিতবে, প্রথম দশ ওভারে কত রান হবে, কত উইকেট পড়বে ইত্যাদি নানান ফরম্যাটে নানান রেটের বাজি ধরা যায়। মনে পড়ল আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি, তারকা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান নিয়মিতই বেটিং কোম্পানির ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হন, বিজ্ঞাপনে কাজ করেন, যেটা নিয়ে সময়ে সময়ে বেশ আলোচনা-সমালোচনা হয়।
–জুয়াতে তো হারজিত আছে। আপনার স্বামী কি শুধুই হারে? কখনো জেতে না?
–কে বলছে হারজিত আছে। উনি কখনো জিতে না। খালি টেকা ঢালে। টমটম নিয়ে একবেলা বাইর হইলে ছয়-সাতশ টেকার ভাড়া মারে। ওই টেকা এক বেলাতেই শ্যাষ। এরপর টেকা ধার করে। আবার খেলে। আর পাওনাদাররা আইসা ধরে আমারে।
–কেন? আপনারে ধরে কেন?
–ওর বাপ বাসায় থাকে নাতো। সারা দিন ওই গ্যারেজ এই গ্যারেজ, এই জায়গা ওই জায়গায় পলায় থাকে। আমার তো বাসায় মেয়ে আছে। আমার তো আর লুকানোর জায়গা নাই। আমিই ধরা খাই।
–তখন আপনি কী করেন?
–কী করব আর! মানুষের টেকা মানুষ ছাইড়া দিবে নাকি! আমি ধারদেনা কইরা শোধ দেই। ছয় মাস আগে কিস্তিতে চল্লিশ হাজার টেকা তুলছি। ত্রিশ হাজার টেকা এই সবেই শ্যাষ। অহন সপ্তাহে সপ্তাহে কিস্তির টেকা টানা লাগে।
–কিস্তি কত দেন?
–সপ্তাহে দেই আটশ টেকা। চল্লিশ হাজারে দিতে হবে চুয়াল্লিশ হাজার টেকা।
–এই টাকা কীভাবে ম্যানেজ করেন?
–বাসাবাড়িতে কাজ করি। এক বাসায় পাই মাসে চাইর হাজার। আর এই বাড়ি ওই বাড়িতে কাজের জন্য লাগলে ডাক দেয়। তহন কাজ করি। টেকা দেয়।
–আপনার স্বামী বাজার করে না?
–ওর আবার বাজার! রাতে বাসায় আসবার সময় মাঝেমইদ্যে বেগুন আনে, আলু আনে, চাইল আনে। এইগুলারে কি বাজার বলে? সংসার কি এক কেজি আলু, বেগুন আর চাইলে চলে?
–আপনি তাহলে কি রান্না করেন প্রতিদিন?
–ধরেন, এইটা-সেইটা কইরা চলতে হয়। বাসার পাশে শাকপাতা হয়। কলমিশাক, কচুশাক এইগুলা টোকাই। এইগুলা দিয়া বেশিরভাগ সময় ভাজি করি। খাই। যেইসব বাসায় কাজ করি, সেইখানে থিকাও চাইয়া আনি।
কী করব আর! মানুষের টেকা মানুষ ছাইড়া দিবে নাকি! আমি ধারদেনা কইরা শোধ দেই। ছয় মাস আগে কিস্তিতে চল্লিশ হাজার টেকা তুলছি। ত্রিশ হাজার টেকা এই সবেই শ্যাষ। অহন সপ্তাহে সপ্তাহে কিস্তির টেকা টানা লাগে।
–আপনার স্বামী কি আগেও জুয়া খেলত?
–না। আগে ব্যাটারি রিকশা চালাইতো। এরও আগে চালাইতো পায়ের রিকশা। তহন নিয়ম কইরা টেকা আনতো ঘরে।
–বিয়ের পর থেকেই রিকশা চালাতো? নাকি অন্য কাজও করত?
–না। বিয়ার পর শুরুর দিকে মাছ ধরতে সাগরে যাইতো। একবার সাগরে গেলে সাত দিন দশ দিন পরে আসতো।
–ছাড়ল কেন?
–সাগরে মাছ ধরার শ্রমিকদের মহাজনেরা আগে থেকেই টাকা দিয়ে রাখে যাতে মৌসুমের সময় অন্য মহাজনের নৌকায় সেই শ্রমিক না যায়। স্বাভাবিকভাবেই অভাবের সংসারের নানান টানাটানিতে মহাজনের দেওয়া অগ্রিম সামান্য টাকা অল্প দিনেই শেষ হয়ে যায়। ফলে শ্রমিকরা আরও টাকা চায়। আর মহাজনও অল্প অল্প করে টাকা দিয়ে সামনের মৌসুমের শ্রমিক সস্তা দামে ধরে রাখে। এতে মৌসুমের সময় যখন বাজারে শ্রমিকের চাহিদা বাড়ার কারণে মজুরি চড়া হয়ে যায় তখন অগ্রিম নেওয়া টাকা শোধ করতে মহাজনের ইচ্ছামতো ঠিক করা কম মজুরিতে শ্রমিকের গতর খাটানো ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।
জানলাম, এমন করে মহাজনী ঋণের জালে জড়িয়ে শেষমেশ নিরূপায় হয়েই রাহেলার স্বামী বউ-বাচ্চা নিয়ে অনেক বছর আগে যে এলাকায় আগে থাকত সেখান থেকে এক প্রকার পালিয়েই চলে এসেছে।
–এখন যেখানে থাকেন সেখানে ঘরভাড়া কত?
–ঘরভাড়া মাসে আড়াই হাজার। পনরো হাজার টেকা ঘরভাড়া বাকি পড়ছে। বাড়িওয়ালা রোজ আসে। বকাঝকা করে।
–ঘরভাড়া শোধ দেবেন কীভাবে? কিছু চিন্তা করছেন?
–এই জন্যই তো আজকে মারামারি হইলো। আমি বলছি যে, ঘরে কি শুধু আমি থাকি? সংসার কি খালি আমার? মেয়েগুলি কি শুধু আমার? তাইলে সে কিছু করবে না কেন?
কথাগুলো শোনার সময় টের পাচ্ছিলাম গরিবি সংসারের যন্ত্রণাদায়ী রাহু রাহেলাকে সবদিক দিয়ে ঘিরে ধরেছে। রাহেলার লিকলিকে শরীরে চল্লিশ না পেরোতেই বাসা বেঁধেছে ডায়াবেটিস, হাই ব্লাড প্রেশার, চর্মরোগ আর ইউরিন ইনফেকশন। ওনার নিজের জন্য ওষুধ কিনতেই মাসে খরচ হয় সাড়ে চার হাজার টাকা। প্রতিদিনের দশ টাকার খরচ বাঁচাতে শরীরে ইনসুলিন ঢোকায় একই সিরিঞ্জের সুঁই বারবার ব্যবহার করে, যেটা কিনা মারাত্মক ইনফেকশনের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে যে কোনো সময়। রাহেলার মাসে যত টাকার ওষুধ লাগে, তত টাকার বাজার সে করতে পারে না। মেজো মেয়েকে স্বামীর বাড়ি পাঠাতে পারছে না। কারণ, মেয়ের জামাইয়ের দাবি কিছু নগদ টাকা যাতে সে একটা টমটম কিনতে পারে। অথচ রাহেলার ঘরভাড়া বাকি পড়ে আছে গত ছয় মাসের। বিয়ের পরও বাপের বাড়িতে থেকে নানান জনের নানান কথা শুনতে শুনতে ক্ষোভে, দুঃখে, হতাশায় কয়েক মাস আগে সেই মেয়ে এক পাতা ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। ফলে তার গর্ভের সন্তান গর্ভেই মারা যায়।
রাহেলা আপা খুব ভালো করেই জানেন, তার স্বামীকে ঘর থেকে বের করে দেওয়ার মাঝে কোনো সমাধান নাই। রাহেলাদের সমাধান আছে কেবল আশার কুয়াশায়, যা কিনা বারবারই শূন্যে মিলিয়ে যায়। আর এই কুয়াশার প্রতারণা বুঝতে বুঝতেই রাহেলাদের জীবন ক্ষয় হতে থাকে। আর এদের শ্রমের, ঘামের দাম লুট হয়ে যেতে থাকে কখনো মহাজনের পাতা ফাঁদে, আবার কখনো তারকা ক্রিকেটার সাকিবের নিষিদ্ধ জুয়ার বিজ্ঞাপনী জালে।
প্রতিদিনের দশ টাকার খরচ বাঁচাতে শরীরে ইনসুলিন ঢোকায় একই সিরিঞ্জের সুঁই বারবার ব্যবহার করে, যেটা কিনা মারাত্মক ইনফেকশনের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে যে কোনো সময়। রাহেলার মাসে যত টাকার ওষুধ লাগে, তত টাকার বাজার সে করতে পারে না। মেজো মেয়েকে স্বামীর বাড়ি পাঠাতে পারছে না। কারণ, মেয়ের জামাইয়ের দাবি কিছু নগদ টাকা যাতে সে একটা টমটম কিনতে পারে। অথচ রাহেলার ঘরভাড়া বাকি পড়ে আছে গত ছয় মাসের।
প্রতিদিন খাই গ্যাসের বড়ি আর ক্যালসিয়াম
জলিল শেখের প্রায় সব পেকে-যাওয়া দাড়ির ফেনিয়ে তোলা সাদা রঙের মাঝে মাঝে কালো দাড়ি এখনো দেখা যায়। তবে চুল আর দাড়িতে সাদার এই বাড়বাড়ন্ত দেখে ওনার ছোটখাটো শরীরের বয়স আন্দাজ করার উপায় নেই। কারণ, উনি রিকশা চালান নিখুঁত দক্ষতায়। সময়মতো ব্রেক কষা আর ফাঁকা রাস্তায় ওনার প্যাডেল চালানো অনুভব করলে যাত্রীর বোঝার কোনো উপায় থাকে না যে জলিল শেখের বয়স ষাট পার হয়েছে বহু আগেই, যা আমি জানতে পেরেছিলাম ওনার সঙ্গে আলাপ শুরু করার বেশ পরে।
জলিল শেখের বাড়ি কুষ্টিয়া, রিকশা চালান প্রায় ত্রিশ বছর ধরে। প্রথম দশ বছর চালিয়েছেন কুষ্টিয়ায়, এরপর কিছুদিন প্যাডেল মেরেছেন দোহার আর এরপর থেকে ঢাকায়।
–কুষ্টিয়া থেকে চলে এলেন কেন?
জলিল শেখ জবাব দেন: ‘আগে করতাম তামাকের কাজ, বিড়ি বানাইতাম। কামে অনেক কষ্ট, বিড়ির গ্যাস বেশি। মজুরিও কম। তাই ওই কাজ ছেড়ে রিকশা ধরলাম।’
–তখন রিকশার জমাখরচ কত দিতেন?
–দশ টাকা।
–আর এখন?
–একশ বিশ টাকা।
–তখন কামাই বেশি হতো, নাকি এখন?
জলিল শেখ প্রায় চেঁচানো সুরে বললেন: ‘ওরে বাবা! তখন তো পকেটে সারা দিনে একশ টেকা আসলে আমি মেলা বড়লোক। সারা দিনে কামাই হইতো ষাইট, সত্তুর, পঁচাত্তুর। তখন চাইল কত খাইছি? ২ টেকা, ৩ টেকা, ৪ টেকা কেজি। সবচেয়ে ভালো চাউলের দাম ধরেন যে ৫ টেকা কেজি।’
–এখন কত টাকা কেজির চাল খান?
–এখন তো চাইল খাই ষাট টাকা দামের।
–এখন দিনে কামাই কেমন হয়? আগের থেকে বেশি নাকি কম?
–অবশ্যই কম। এখন তো কামাই করি এক হাজার, বারোশ। কিন্তু টেকা তো থাকে না পকেটে।
কী কারণে পকেটে টাকা থাকে না, সেটা আর আমি জানতে চাইলাম না। বোধকরি কারোরই এই কারণটা অজানা থাকবার কথা না। জলিল শেখের আয়-রোজগারের সংখ্যা থেকেও কারণটা বোঝা যায়। যখন ওনার দিনে ষাট টাকা আয় হতো তখন উনি সেই আয় দিয়ে ২ টাকা কেজি দামের ৩০ কেজি চাল কিনতে পারতেন। আর এখন যখন ওনার আয় দৈনিক এক হাজার টাকা হয়, তখন ১৬ কিংবা ১৭ কেজির বেশি চাল কেনা ওই আয় দিয়ে সম্ভব নয়। কাজেই এটা পরিষ্কার যে, জলিল শেখ এবং ওনার মতো উপার্জনের চেষ্টায় থাকা সবার ক্রয়ক্ষমতা কেবলই কমেছে। অথচ আমাদেরকে জানানো হয়, জিডিপি নাকি কেবলই বাড়ছে। আমাদের বলা হয়, আর কটা দিন সবুর করলেই নাকি আমরা হয়ে যাব সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া। যে জিডিপির অঙ্ক জলিল শেখদের রক্ত পানি করা কামাই দিয়ে ফুলে-ফেঁপে ওঠে সেই জিডিপির লাভের ভাগের ছিটেফোঁটাও যে জলিল শেখের কপালে জোটে না, সেটা বোঝাবে কোন বিশ্লেষক? সেটা বলবে কোন মিডিয়া?
জানতে চাই তিনি প্রতিদিনই রিকশা চালান কি না? জলিল শেখ জবাব দেন যে উনি রিকশা চালান প্রতিদিনই, কিন্তু একদিন ফুলটাইম আর পরের দিন হাফ টাইম। বিষয়টা প্রথমে না বোঝায় উনি ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘প্রতিদিন রিকশা টানা যায় না, আবার একদিন পুরা বইসে থাকলে শরীর ডাউন হয়ে যায়। তাই মনে করো গতকাল বাইর হইছি সকাল সাতটা বাজে, আর গ্যারেজে গেছি রাত ১১টা বাজে। আবার আজকে যেমন বাইর হইছি সকাল ১১টায়, গ্যারেজে যাব ৬টার মইদ্যে।’
–খাওয়া-দাওয়া করেন কই?
–রোডেই খাই।
আরও জানতে প্রশ্ন করি যে রোডের খাওয়া কেমন? হাসতে হাসতে জবাব আসে, ‘আর কী বলব! রং দেখলেই তো ডর লাগে। কেমুন টকটকা। আমি ওইসব খাই না।’
–তাহলে কী খান?
–আমি খাই এক প্লেট ভাত, ভাজি, আর ডাউল। আর চপ থাকলে চপ খাই। রাইতে খাই ভাজা মাছ। কোনো তেলমসলা না। কড়কড়া ভাজা মাছ। দুপুরে খাই ধরো আশি টেকার, রাইতে ধরো একশ টেকার মতো লাগে।
–চাচা, আপনে থাকেন কই?
জলিল শেখ জানান উনি রিকশার গ্যারেজেই থাকেন। আলাদা কোনো ভাড়া দেওয়া লাগে না। যে মালিকের রিকশা টানেন তার গ্যারেজের ওপর মাচা করে দেওয়া আছে, সব ড্রাইভার সেখানেই ঘুমান।
–চাচা আপনে ঘুমান কখন?
–ঘুমাইতে ঘুমাইতে ধরো ১২টা-১টা বাজে।
জানতে পারি ওনার আরও আগেই ঘুমের অভ্যাস, কিন্তু গ্যারেজের আলো আর শব্দে ঘুম আসতে আসতে ১২টা- ১টা বেজে যায়। সকালে ওঠেন ৬-৭টায়।
–সকালে নাশতা খান কোথায়?
–নাশতা খাই হোটেলে। তিনটা রুটি আর ২০ টেকার বুন্দিয়া। ৫০ টেকায় নাশতা শেষ।
খুব সংকোচে জানতে চাই: চাচা, আপনি কি সিগারেট খান? জলিল শেখ মুচকি হেসে জানান, উনি সিগারেট খান। –আমার সিগেরেট খাবার ধরনডা আবার ভিন্ন বাবা বুঝলা। আমি সিগারেট খাই দুইটা। সকালে ঘুম থিইক্যা উইঠা একটা খাই, এরপর মুখ ধুইয়া ফালাই। সারা দিনে আর খাই না। সিগারেটে মুখে গন্ধ আসে। যাত্রীগো অসুবিধা হয়। এরপর আরেকটা খাই ঘুমানোর আগে, রাইতের বেলা।
এবার জানতে চাই ওনার কামাই রোজগারের ব্যাপারে। বলেন, ‘যেদিন ফুলটাইম ভাড়া মারি সেদিন দিনে পনেরশো টেকা পর্যন্ত মারতে পারি। রিকশার জমা একশ বিশ টেকা, রোডে খানা খরচ, চা-বিস্কুট, মোবাইলের খরচ আছে দুইশ টেকা। দুপুরের ভাত, রাইতের ভাত লাগে দেড়-দুইশো টেকা। দিনে ধরো এমনেই খরচ হইয়া যায় পাঁচশ টেকা। যেইদিন ফুল টাইম রোডে থাকি, আয় থাকে এক হাজার, হাফ টাইমে আয় থাকে পাঁচ থিইকা ছয়শ টেকা।’
–টাকা কই রাখেন?
–দিনের টেকা দিনেই পাঠায় দেই। ছোট পোলার বিকাশে। থাকি গ্যারেজে। সঙ্গে রাখলে চুরি হইতে পারে, হারাইতে পারে। রিস্ক আছে।
এবার জানতে চাই, বাড়ির খবর। জলিল শেখ জানান, ওনার স্ত্রী, দুই মেয়ে, দুই ছেলে কুষ্টিয়ায় থাকেন। বড় ছেলে বিয়ে করে আলাদা থাকেন। সেখানেই দিনমজুরির কাজ করেন। ছোট ছেলে ডিগ্রি পাস করেছে, দুই মেয়ে পড়ে কলেজে।
–ছোট ছেলে কী করবে বলে ভাবছে?
–আমি তো চাইছিলাম পুলিশের পরীক্ষাডায় জানি ঢোকে। একবার চান্স পাইছিলো। এত কইলাম, ঢুকলো না, কয় ওই কামে নাকি সম্মান নাই। দেহি, সামনে আর কোন পরীক্ষায় টেকে!
বসতবাড়ি, জায়গাজমি আছে কি না জানতে চাইলাম। জানালেন, বসতবাড়ি আছে। কিন্তু জমি নাই। ওনার বাবার জমি ছিল তেরো বিঘা। কিন্তু দেনার দায়ে সব বিক্রি করে দিতে হয়েছে। জানতে চাইলাম, ওনার বাবা কী করতেন? জানালেন, ‘বাবায় গরু সাপ্লাই দিতো ঢাকায় কসাইয়ের দোকানে। এখন গরু দিছে, টেকা দেয় নাই, বলছে, এখন দিবে, তখন দিবে। বাবায়ও বিশ্বাস করছে। ধারে গরু কিনছে যাদের থেকে তারা তো আর কসাইগোরে চেনে না। তারা ধরছে আমার বাপেরে। আমার বাপে তহন জমি বেচা শুরু করল, হেই যে শুরু হইলো, এক বিঘা, দুই বিঘা করতে করতে সব শেষ।’
হঠাৎ করেই ওনাকে প্রশ্ন করে বসি: ‘চাচা, আপনের কি ডায়বেটিস আছে?’ তাচ্ছিল্যভরা হাসিতে জবাব আসে: ‘দূর, কয় কী! রিকশা যারা চালায় হেগোর আবার ডায়বেটিস হয়নি!’ তাইলে তো চাচা, মাশাল্লাহ, আপনার কোনো ওষুধ খাইতে হয় না। আমিও ফিরতি জবাবে হাসতে হাসতেই বলি। জবাবে তিনি বলেন, ওনার অসুখ নাই ঠিকই। কিন্তু দিনে তিনটা ট্যাবলেট খান। একটা নাপা, একটা ক্যালসিলাম আর একটা গ্যাসের বড়ি খান।
–গ্যাসের বড়ি কোনটা খান? সারজেল?
–অতো নাম তো জানি না, দোকানে গিয়ে কই গ্যাসের বড়ি দেন। হেরা দিয়ে দেয়।
–গ্যাসের বড়ি কেন খান?
–আরেহ! যেই খাবার খাই, গ্যাসের বড়ি না খাইলে তো প্যাট জ্বলে। আর নাপাডা খাই মনে করেন যে, শরীরে যে ব্যথা-বিষ আছে, সব নাইমা যায়, আর ক্যালসিয়ামে পায়ে জোর আসে, বুঝলেন না? ক্যালসিয়াম কিন্তু পায়ের জন্য ভালো।
–এসব ওষুধ কে বলছে আপনাকে খেতে? ডাক্তার দেখাইছিলেন?
–নাহ্! ডাক্তার না। এই ওষুধ দিয়া গেছে আমার শ্বশুর। হেয় রিকশা চালাইতো, খাইতো। আমিও খাই। কোনো অসুবিধা নাই।
আরেহ! যেই খাবার খাই, গ্যাসের বড়ি না খাইলে তো প্যাট জ্বলে। আর নাপাডা খাই মনে করেন যে, শরীরে যে ব্যথা-বিষ আছে, সব নাইমা যায়, আর ক্যালসিয়ামে পায়ে জোর আসে, বুঝলেন না? ক্যালসিয়াম কিন্তু পায়ের জন্য ভালো।
জানলাম জলিল শেখ বাড়ি যান এক-দেড় মাস পরপর। বাড়িতে গিয়ে ওনার স্ত্রীর লাগানো সবজি আর বাজার থেকে কিনে আনা পুকুর আর নয়তো নদীর মাছ খান। বাড়িতে গিয়ে থাকেন প্রায় এক-দেড় সপ্তাহ। তখন ওনার গ্যাসের ওষুধ খাওয়ার প্রয়োজন হয় না।
এই টুকরো টুকরো নোটের হিসাব যখন আমি মেলাতে বসি তখন দেখি জলিল শেখ তার প্রায় পুরো জীবনটাই খরচ করে ফেলছেন এই শহরকে সার্ভিস দিতে দিতে। ওনার বাবা যেমন করে তার সহায়-সম্পদ খরচ করেছেন এই শহরের মানুষদের পাতে গরুর ভুনা গোশতের জোগান দিতে দিতে। এই যে, জলিল শেখরা থাকেন আমাদের শহরে, আমাদের সঙ্গে সঙ্গে, আমাদের প্রতিদিনকার সেবা দিতে, তারা কতটা খান, কতটা ঘুমান, কতটা বিশ্রাম নেন, কতটা পরিবারকে কাছে পান, কতটা ভালো থাকেন আর কতটা খারাপ থাকেন–সেই হিসাব কে রাখছে? আমরা তো ব্যস্ত আছি কেবল উন্নয়ন আর জিডিপির হিসাব মেলাতে, বাজেটের স্বাস্থ্য মোটাতাজা করাতে। মনে রাখা দরকার, জলিল শেখ প্রতিদিন যেই গ্যাসের বড়ি আর ক্যালসিয়াম খান সেই গ্যাসের বড়ি আর ট্যাবলেট বিক্রির টাকাও কিন্তু আমাদের জিডিপির আকার বাড়ায়। এই জীবন নিংড়ানো ঘানিতে এই শহর গতি পায়, বেঁচে থাকে। আর সেই ঘানির চতুর্পাশে টলতে টলতে ঘুরতে থাকে জলিল শেখদের জীবন।
সারা দিনে বসার সময় কই?
শোয়েবের সঙ্গে আমার পরিচয় মিরপুর-১ নম্বর থেকে মুক্তিযোদ্ধা মার্কেটের দিকে যে মোড়টা আছে সেখানে। ব্যস্ত বড় রাস্তার ওপর একটা ভ্যানগাড়িতে শোয়েবের দোকান। সেখানে ভিন্ন ভিন্ন পলিথিনের প্যাকেটে আছে ভেলপুরি আর ছোট-বড় সাইজের ফুচকা, অ্যালুমিনিয়ামের গামলায় আছে ঘুগনি। দুইটা আলাদা আলাদা প্লাস্টিকের এক বোতলে আছে মিষ্টি টক, আরেক বোতলে আছে মিষ্টি ছাড়া টক। জানলাম মিষ্টি টকের থেকে মিষ্টিবিহীন টকের ডিমান্ড বেশি। প্রতি প্লেটে আটটা ফুচকা, দাম ৩০ টাকা। ভেলপুরি পাঁচটাতে এক প্লেট, দাম ২০ টাকা। শোয়েবের চেহারায় এখনো শৈশবের ছাপ, কথায় শহরের রুক্ষতা আসেনি। কিন্তু এই বয়সেই সে সামলাচ্ছে বড় ভাইয়ের ব্যবসা।
শোয়েবের বড় ভাইয়ের মূলত দুইটা দোকান। দুই দোকানে একই আইটেম বিক্রি হয়। অপর দোকানটা একই এলাকায় আরেক মার্কেটের সামনে বসানো। সকালে দুই ভাই একসঙ্গেই ভ্যানগাড়ি ঠেলে বের হয়, শোয়েবের দায়িত্বে থাকে একটা আর অপরটা দেখে তার ভাই। কিন্তু শোয়েবের বড় ভাই সৌদি আরব যাওয়ার জন্য চেষ্টা করছে, তখন একটা দোকান নিশ্চিতভাবেই ছেড়ে দিতে হবে। আর বাকিটা একা একা কীভাবে চালাবে সেই চিন্তার ছাপ শোয়েবের কথায় একটু পরপরই টের পাওয়া যায়।
শোয়েবকে জিজ্ঞেস করি: কত বছর ধরে আছে সে এই শহরে।
–দেড় বছর।
–কোথায় বাড়ি তোমার? এই প্রশ্নের জবাবে জানায় যে তার বাড়ি চাঁদপুর। সে ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়েছে। এরপরই চলে আসে ঢাকায়।
–হঠাৎ পড়া ছাইড়া ঢাকায় আসলা কেন?
শোয়েব জানায়, তার বাবা দুবাই গিয়েছিল। কিন্তু এগারো দিনের মাথায় তাকে সেখানকার পুলিশ ধরে দেশে পাঠিয়ে দেয়।
–কী কারণে পাঠায় দিলো? কাগজপত্র ঠিক ছিল না?
–কাগজপত্র কি আছিলো বাপে তো দেহে নাই। টেকা নিসে সাড়ে তিন লাখ। বাপেরে কইছে সব ঠিক আছে। সমস্যা নাই। বিদেশ গ্যালে কাম রেডি। এইসব কইয়া টেকা নিছে। ভিসা লাগাইছে।
–দেশে আইসা দালালরে ধরে নাই?
সে জানায়, সেই দালালের আর কোনো খোঁজ-খবর তারা বের করতে পারেনি।
–ও, তাইলে তোমার বাবা বিদেশে ধরা খাইয়া আইসা পড়ার পরেই ঢাকায় আসলা?
–হ, বাড়িতে কিস্তি নিছিলো। বাপে মাসে মাসে টেকা পাঠাইলে হেই কিস্তি শোধ দিবো, এইডা চিন্তা কইরাই মনে করেন যে কিস্তি লইয়া, জমানি যা কিছু আছিলো সব দিয়া বিদেশ গেছিলো। এহন তো মনে করেন, হেই টেকা শোধ দিতে হইবো। হেইডা করতেই মনে করেন যে আমি ঢাকা আহি। বড় ভাইয়ের লগে ব্যবসা দেখতে।
–প্রতিদিন কত টেকার ব্যবসা হয়?
–ব্যবসা আল্লায় দিলে ভালোই, মনে করেন যে, ডেইলি দেড়-দুই হাজার টেকার বেচি। শুক্রবারে বেচাডা হয় একটু বেশি, মনে করেন যে তিন-সাড়ে তিন হাজার।
কেবলই লাভ-লসের হিসাব করতে চাওয়া আমার শহুরে মন জানতে চায় যে, প্রতিদিন কত টাকা লাভ থাকে। কিন্তু শোয়েব তা জানাতে পারে না। কারণ, তার বড় ভাই কত টাকার ফুচকা কেনে আর কত টাকার অন্য মসলাপাতি কেনে সেটা সে জানে না। তখন ভাবলাম, যাক, অন্তত শোয়েবের শৈশবে এখনো অতটা বৈষয়িকতা ভর করেনি যতটা করলে মানুষ কেবলই লাভ-লোকসানের চক্করে ঘুরপাক খায়।
শোয়েবের বসার কোনো ব্যবস্থা নেই। আমরা শোয়েবের খোলা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কথা বলছি। চার-পাঁচজন এলেই গাড়ির চারপাশটা ভরে যায়, তখন আমি পেছনে সরে যাই, আবার যখন তা কমে একজন-দুজনে নেমে আসে, তখন শোয়েবই আমাকে বলে: ‘আমার কাম করতে করতে কথা কইতে সমস্যা নাই। এই যে, মনে করেন যে হাত চালাইতাছি, এইডা তো কোনো ব্যাপারই না। চাইলে আরও জোরে বানাইতে পারি। তখন মনে করেন যে কাস্টমারও কূল পায় না। হেই কারণে মনে করেন যে, বেশি স্পিডে বানাই না। আপনে কথা কন, সমস্যা নাই।’
শোয়েবের আশকারা পেয়ে আমি আবারও গল্পের ছেঁড়া সুতোগুলো জোড়া দেওয়ার চেষ্টা শুরু করি। আরও কিছু জানতে চাই।
–তুমি বসো কোথায়? ভ্যানের নিচের দিকে থাকা লকারের মতো জায়গাটা দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করি: ‘এর ভেতরে কি টুল আছে?
–না, টুল নাই, এর ভিতরে মালসামান আছে। আর সারা দিনে বসার সময় কই, কন। আর বইলে এইসব বানান যায় না। হাত ব্যথা করে।
–তাহলে সারা দিন এই-যে দাঁড়ায় থাকো, পা ব্যথা করে না?
–না, করে না।
শোয়েব বসে বসে ভেলপুরির মসলা মাখায় না, ফুচকার ওপর টক ছড়িয়ে দেয় না, এতে নাকি শোয়েবের হাত ব্যথা করে, কাজের স্পিড কমে যায়। আর এই কাজের স্পিড ধরে রাখতে সে দুপুর ১২টা থেকে রাত ৯টা-১০টা পর্যন্ত দাঁড়িয়েই থাকে, এতে নাকি তার পা ব্যথা করে না! আসলেই কি ব্যথা করে না? নাকি শোয়েবরা এই শহরে তাদের বোবা ব্যথা বিক্রি করে?
–ঘুমাও কখন?
–১২টা-১টা বাইজা যায়।
–খাও কোথায়?
–অডারের খাওনা খাই। দুই ভাইয়ের মাসে ৬ হাজার টেকা। দুপুরে আর রাইতে।
–সকালের নাশতা কর কোথায়?
–সকালের ঘুম থিইক্যা উঠতে উঠতেই তো মনে করেন ১০টা-১১টা বাইজা যায়। একবারে মনে করেন দোকানের মাল রেডি করতে করতে, পুরি ভাজতে ভাজতে দুপুরের খাওনের টাইম হইয়া যায়। খাইয়া দোকান লইয়া বাইর হই।
এই কাজের স্পিড ধরে রাখতে সে দুপুর ১২টা থেকে রাত ৯টা-১০টা পর্যন্ত দাঁড়িয়েই থাকে, এতে নাকি তার পা ব্যথা করে না! আসলেই কি ব্যথা করে না? নাকি শোয়েবরা এই শহরে তাদের বোবা ব্যথা বিক্রি করে?
–ঘরভাড়া কত দাও?
–চাইর হাজার টেকা।
–ফুচকা, পুরি কি সব নিজেরাই ভাজ?
–না, ফুচকা ভাই কিইন্যা আনে। পুরি ভাজে নিজে। ভাই নিজেই গাড়ি রেডি করে।
কথা শুনছি আর ভাবছি জীবনের সূত্রগুলো শোয়েব আর তার ভাই কীভাবে কীভাবে মিলিয়ে নিচ্ছে। সকালের নাশতা খাওয়া এড়াতে গভীর রাতে ঘুমাতে যাওয়ার উছিলায় বেলা করে ঘুম থেকে ওঠা যাতে ক্ষুধা লাগতে লাগতেই দুপুরের টাইম হয়ে যায়, ফলে সকালের নাশতার ৫০ কিংবা ৬০ টাকা বাঁচিয়ে ফেলা যায়। অর্থনীতিবিদরা কী নাম দেবেন এই কৌশলী রুটিনের? এটা কি পুরিওয়ালার পয়সা বাঁচিয়ে বড়লোক হওয়ার ধান্দা? নাকি এই শহরে বেঁচে থাকার গরিবি কৌশল?
–রাস্তার ওপর বসো, ভাড়া দাও কারে?
–আগে দিতাম দিনে আড়াইশ। আগস্টের পর থিইক্যা কেউ টেকা উডায় না। খালি ময়লা পরিষ্কারের ৩০ টেকা দেই দিনে।
–তাইলে তো অনেক শান্তি। উৎপাত করার কেউ নাই আর?
–নাই, আবার আছেও। ধরেন, আগে তো টেকা নিতো, একটা গ্যারান্টি আছিলো। অহন তো কোনো গ্যারান্টি নাই। মনে করেন যে, কাইলকা পুলিশ আইয়া গেঞ্জাম করছে। এক ঘণ্টা দোকান করতে পারি নাই। খালি দৌড়াদৌড়ি করছি।
এই যে চাঁদা দিয়ে হলেও এক টুকরো জায়গায় শান্তিমতো দাঁড়িয়ে ভেলপুরি আর ফুচকা বেচতে চাওয়ার মরিয়া চেষ্টা সেটা কী রাষ্ট্রের আইনে অবৈধ ঘোষণা করে দিলেই বন্ধ হয়ে যায়? নাকি এই আইন এক শ্রেণির ওপর আরেক শ্রেণির শোষণের নতুন ময়দান তৈরি করে দেয়? তো এমন অসমতার ময়দানে সমতার মিনার কী করে তৈরি করবেন আমাদের আইন প্রণেতারা?
সকালের নাশতা খাওয়া এড়াতে গভীর রাতে ঘুমাতে যাওয়ার উছিলায় বেলা করে ঘুম থেকে ওঠা যাতে ক্ষুধা লাগতে লাগতেই দুপুরের টাইম হয়ে যায়, ফলে সকালের নাশতার ৫০ কিংবা ৬০ টাকা বাঁচিয়ে ফেলা যায়। অর্থনীতিবিদরা কী নাম দেবেন এই কৌশলী রুটিনের?
শোয়েবরা চার ভাই বোন। শোয়েবের ছোট দুই বোনের একজন পড়ে ক্লাস থ্রি-তে আর অপরজন পড়ে ক্লাস ফাইভে। সামনের রমজানে সে বাড়ি যাবে। অনেক দিন পর মা-বাবা, বোনদের সঙ্গে শোয়েবের দেখা হবে। সেই কথা যখন বলছিল তখন শোয়েবের চোখদুটো মনে হয় খুশিতে জ্বলজ্বল করছিল। আবার এমনও হতে পারে যে আমার দেখার ভুল। আমরা যখন কথা বলছিলাম তখন শোয়েবের দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফুচকা বিক্রি করার সময় অলরেডি সাত ঘণ্টা অতিক্রম করেছে। চারদিকে গাড়ির হর্ন, দোকানে কাস্টমারের চাপ, ফুচকা থেকে পুরির প্যাকেট, সেখান থেকে টকের বোতল, সেখান থেকে আবার প্লেট ধোয়ামোছার বালতি গামছার বেড়াবেড়ি এমনসব কিছুর মাঝেও কি জীবনের কোনো সুখ থাকে, এমন জীবনেও কি কোনো আনন্দ আসে? নাকি গরিবি জীবনে সুখ এরই মাঝে খুঁজে নিতে হয়? সুখের সঙ্গে কি আর্থিক নিরাপত্তার সম্পর্ক আছে? নাকি নাই? যদি কোনো সম্পর্ক থেকেই থাকে তবে এমন আর্থিক নিরাপত্তাহীন হয়ে কত লাখ শোয়েব আমাদের চারপাশে আনন্দহীন জীবন পার করছে?
শোয়েবের সঙ্গে কথা বলার সময় নেওয়া নোটের পাতা উল্টাই আর ভাবি, আশাহীন জীবনের কী এমন ছলনা যার জাদুর টানে এরা সবাই ছুটতে থাকে! শোয়েবের বাবা বিদেশ যেতে চেয়ে প্রতারিত হয়েও আশা ছাড়েনি। শোয়েব চলে এসেছে শহরে কিস্তির টাকার দেনা শোধ করবে বলে। শোয়েবের বড় ভাই এখনো যেতে চায় বিদেশে। হয়তো শোয়েবও একদিন নাম লিখিয়ে ফেলবে অজানা জীবনের সওয়ারি হতে। হয়তো শোয়েব পারবে, হয়তো পারবে না। অবশ্য কার কী এসে যায়, কোথাকার কোন শোয়েবের এমন হারিয়ে যাওয়ায়! একজন শোয়েব চলে গেলে সেই জায়গা ভরে দেয় আরেক শোয়েব। আমাদের তো ভেলপুরির টকে ঝালটা ঠিকমতো হলেই হলো। সেটা কে তৈরি করছে তা জেনে আমাদের কী লাভ!
ছক-১: সময়ে সময়ে বাজার ঘুরে প্রাপ্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু পণ্যের মূল্যতালিকা (টাকায়)
পণ্যতালিকা | ১৫ জানুয়ারি ২০২৫ | ৩০ জানুয়ারি ২০২৫ | ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ | ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ | ১০ মার্চ ২০২৫ (নবম রোজা) | ২৩ মার্চ ২০২৫ (বাইশতম রোজা) |
জরিপের স্থান | মিরপুর-১ নম্বর কাঁচাবাজার, ঢাকা | বড়বাজার, কক্সবাজার | বড়বাজার, কক্সবাজার | উপজেলা বাজার, কক্সবাজার | বিডিআর ক্যাম্প বাজার, কক্সবাজার | উপজেলা বাজার, কক্সবাজার |
১। চাল (নাজিরশাইল) প্রতি কেজি | ৮৫ | ৭৫ | ৮৫ | ৮৫ | ৯০ | ৮৫ |
২। চাল (মিনিকেট) প্রতি কেজি | ৮০ | ৭০ | ৭০ | ৭০ | ৭০ | ৭০ |
৩। চাল (বাজারে প্রাপ্ত সর্বনিম্ন দাম) প্রতি কেজি | ৬৫ | ৭০ | ৭০ | ৭০ | ৭০ | ৭০ |
৪। ডিম (সাদা) প্রতি ডজন | ১৩৫ | ১৪০ | ১৩০ | ১২০ | ১১৫ | ১২০ |
৫। আটা (২ কেজির প্যাকেট; বাজারে প্রাপ্ত সর্বনিম্ন দাম) প্রতিটি | ১০০ | ১১০ | ১২০ | ১০০ | ১১০ | ১১০ |
৬। ময়দা (২ কেজির প্যাকেট; বাজারে প্রাপ্ত সর্বনিম্ন দাম) প্রতিটি | ১৩০ | ১৩০ | ১৩০ | ১৪০ | ১৪০ | ১৪০ |
৭। লবণ প্রতি কেজি | ৪০ | ৪০ | ৪০ | ৩৫ | ৪০ | ৪০ |
৮। সাদা চিনি প্রতি কেজি | ১২৫ | ১৩০ | ১২৫ | ১২০ | ১২০ | ১২৫ |
৯। মসুর ডাল (মোটা) প্রতি কেজি | ১০৫ | ১১০ | ১১০ | ১০৫ | ১১০ | ১২০ |
১০। মসুর ডাল (চিকন) প্রতি কেজি | ১৩০ | ১৫০ | ১৪০ | ১৪৫ | ১৪৫ | ১৬০ |
১১। বুটের ডাল প্রতি কেজি | ১৩৫ | ১৪০ | ১২৫ | ৭৫ | ৮০ | |
১২। খেসারির ডাল প্রতি কেজি | ৮০ | ১২০ | ১২০ | ১১৫ | ||
১৩। ছোলা | ১২০ | ১১৮ | ১৩০ | ১১৫ | ||
১৪। সয়াবিন তেল (বাজারে প্রাপ্ত সর্বনিম্ন দামের বোতলজাত) প্রতি লিটার | ১৯০ | ১৭৫ | ১৭৫ | ১৮৫ | বাজারে ছিল না | ১৭৫ |
১৫। সরিষার তেল (বাজারে প্রাপ্ত সর্বনিম্ন দামের বোতলজাত) প্রতি লিটার | ৩১০ | ৩০০ | ৩০০ | ২৮০ | ২৮০ | |
১৬। আলু প্রতি কেজি | ৩০ | ৩০; নতুন আলু ৪০ | নতুন আলু ৩০ | নতুন আলু ৩০ | ৩০ | ৩০ |
১৭। পেঁয়াজ প্রতি কেজি | ৫৫ | ৫০ | ৫০ | ৫০ | ৫০ | ৪০ |
১৮। রসুন প্রতি কেজি | ২৪০ | ২২০ | ২২০ | ২৪০ | ২৪০ | ২৪০ |
১৯। আদা | ১০০ | ১১০ | ১৩০ | ১৮০ | ১৪০ | ১৬০ |
২০। কাঁচা মরিচ প্রতি কেজি | ৬০ | ৩৫ | ৪০ | ৪০ | ৫০ | ৬০ |
২১। বেগুন | ৪০ | ২০ | ২৫ | ৪০ | ৪০ | ৫০ |
২২। ঢ্যাঁড়শ | ৬০ | ৭০ | ৭০ | |||
২৩। মুলা | ২০ | ২০ | ||||
২৪। করলা | ৭০ | ৯০ | ৮০ | |||
২৫। চিচিঙ্গা | ৪০ | |||||
২৬। বরবটি | ৭০ | ৬০ | ৬০ | |||
২৭। টমেটো প্রতি কেজি | ৬০ | ৩০ | ২০ | ২৫ | ১০ | ২০ |
২৮। শসা | ৪০ | ৩০ | ৪০ | ৫০ | ||
২৯। ফুলকপি প্রতি কেজি | ৩০ | ২০ | ২০ | ৩০ | ৫০ | ৮০ |
৩০। বাঁধাকপি প্রতি কেজি | ৩০ | ১৫ | ২০ | ৩০ | ২০ | |
৩১। পালংশাক এক আঁটি | ১০ | ১০ | ১০ | ২০ | ||
৩২। কলমিশাক | ১০ | ১০ | ||||
৩৩। লালশাক এক আঁটি | ১০ | ১০ | ১০ | ২০ | ২০ | ২০ |
৩৪। লাউশাক এক আঁটি | ২০ | ৩০ | ৩৫ | ৪০ | ৩০ | ৩০ |
৩৫। কচুশাক এক আঁটি | ১০ | |||||
৩৬। আনারস (মাঝারি সাইজ) প্রতি পিস | ২৫ | ৪০ | ৪০ | ৩৫ | ২০ | |
৩৭। চাঁপাকলা (প্রতি ডজন) | ৪০ | ৪০ | ৪০ | ৬০ | ৪০ | ৫০ |
৩৮। বাংলা কলা (প্রতি ডজন) | ৫০ | ৯০ | ৯০ | ১৪৪ | ১১০ | ১২০ |
৩৯। পেয়ারা প্রতি কেজি | ৬০ | ৯০ | ৯০ | ৭০ | ৮০ | |
৪০। কমলা প্রতি কেজি | ২২০ | ২৪০ | ২৬০ | ৩২০ | ৩২০ | |
৪১। আনার প্রতি কেজি | ৪০০ | ৩৮০ | ৪০০ | |||
৪২। শিম প্রতি কেজি | ৪০ | ৪০ | ৩০ | ৫০ | ৫০ | ৪০ |
৪৩। লেবু প্রতি হালি | ১৫ | ৪০ | ৪০ | ৪০ | ৪০ | |
৪৪। কাঁচা পেঁপে প্রতি কেজি | ৪০ | ৫০ | ||||
৪৫। গাজর প্রতি কেজি | ৩০ | ৩০ | ৩০ | ৪০ | ৪০ | ৩০ |
৪৬। তেলাপিয়া (ছোট সাইজ; ৪ থেকে ৫টায় ১ কেজি) প্রতি কেজি | ১৫০ | ২০০ | ২০০ | ২৩০ | ২৪০ | ২৪০ |
৪৭। তেলাপিয়া (বড় সাইজ; ১টা প্রায় ৭০০-৮০০ গ্রাম ওজনের) প্রতি কেজি | ২০০ | ২৪০ | ২৪০ | ২৩০ | ২৪০ | ২৬০ |
৪৮। পাঙাশ (দেড় থেকে ২ কেজি ওজনের) প্রতি কেজি | ১৬০ | ১৭০ | ১৭০ | ১৬০ | ১৭০ | ১৮০ |
৪৯। রুই (বড় সাইজের; প্রায় ২ কেজি ওজনের) প্রতি কেজি | ৩৬০ | ৩২০ | ৩০০ | ৩০০ | ||
৫০। রুই (ছোট সাইজের) প্রতি কেজি | ৩২০ | ২৩০ | ২৫০ | |||
৫১। ব্রয়লার মুরগি প্রতি কেজি | ১৯০ | ১৮০ | ২০০ | ২০০ | ২০০ | ২১০ |
৫২। সোনালি মুরগি প্রতি কেজি | ৩২০ | ৩২০ | ৩০০ | ৩২০ | ৩২০ | ৩১০ |
৫৩। গরুর মাংস | ৭৫০ | ৭৬০ | ৭৬০ | ৭৬০ | ৭৬৫ | ৭৬৫ |
৫৪। খাসির মাংস | ১১৫০ | ১১৫০ | ১১৫০ | ১২০০ | ১১৫০ | ১১৫০ |
৫৫। এলপিজি সিলিন্ডার (১২ কেজি); বাসায় পৌঁছে দেওয়ার খরচসহ | ১৫৫০ | ১৫৫০ | ১৫৫০ | ১৫৫০ | ১৫৫০ | ১৫৫০ |
ছক-২: উপরে প্রাপ্ত (ছক-১ দ্রষ্টব্য) কিছু নির্দিষ্ট দিনের বাজারদর অনুসারে একটি ৪ থেকে ৫ সদস্যের পরিবারের মাসিক কাঁচাবাজার খরচ (টাকায়)
পণ্যতালিকা | ১৫ জানুয়ারি ২০২৫ | ৩০ জানুয়ারি ২০২৫ | ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ | ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ | ১০ মার্চ ২০২৫ (নবম রোজা) | ২৩ মার্চ ২০২৫ (বাইশতম রোজা) |
আটা (২৫০ গ্রাম) | ১৩ | ১৪ | ১৫ | ১৩ | ১৪ | ১৪ |
আলু (৫০০ গ্রাম) | ১৫ | ১৫ | ১৫ | ১৫ | ১৫ | ১৫ |
সবজি (শাক/সবজি); (৩১+৪২/২) | ৩০ | ৩০ | ২৫ | ৪৫ | ৩৫ | ৩০ |
মাছ (৫০০ গ্রাম পাঙাশ) এক বেলা | ৮০ | ৮৫ | ৮৫ | ৮০ | ৮৫ | ৯০ |
মাংস (৫০০ গ্রাম ব্রয়লার) এক বেলা | ৯৫ | ৯০ | ১০০ | ১০০ | ১০০ | ১০৫ |
সয়াবিন তেল (১৩০ মিলিলিটার) | ২৫ | ২৩ | ২৩ | ২৪ | ২৪ | ২৩ |
চাল (১ কেজি) | ৬৫ | ৭০ | ৭০ | ৭০ | ৭০ | ৭০ |
ডাল (১০০ গ্রাম) | ১১ | ১১ | ১১ | ১১ | ১১ | ১২ |
কলা (৫টি) | ১৭ | ১৭ | ১৭ | ২৫ | ১৭ | ২১ |
ডিম (৫টি) | ৫৬ | ৫৮ | ৫৪ | ৫০ | ৪৮ | ৫০ |
পেঁয়াজ (২০০ গ্রাম) | ১১ | ১০ | ১০ | ১০ | ১০ | ৮ |
রসুন (৫০ গ্রাম) | ১২ | ১১ | ১১ | ১২ | ১২ | ১২ |
অন্যান্য (হলুদ, আদা, মরিচ, অন্যান্য মসলা, লবণ ইত্যাদি), উপরের খরচগুলোর ১৫ শতাংশ ধরে | ৬৪ | ৬৫ | ৬৫ | ৬৮ | ৬৬ | ৬৭ |
রান্নার গ্যাস; (৫৫/৩০) | ৫২ | ৫২ | ৫২ | ৫২ | ৫২ | ৫২ |
দৈনিক মোট খরচ | ৫৪৫ | ৫৫০ | ৫৫৩ | ৫৭৪ | ৫৫৮ | ৫৬৮ |
উপরের হিসাবে মাসিক খাবারের খরচ (৪ থেকে ৫ জনের পরিবার বিবেচনায়) | ১৬,৩৩৭ | ১৬,৫০৬ | ১৬,৫৭৮ | ১৭,২১৫ | ১৬,৭৪২ | ১৭,০৫২ |
বিশেষভাবে দ্রষ্টব্য: একটি পরিবার এক বেলা মাছ খাবে আর অপর বেলা মাংস খাবে ধরে নিয়ে হিসাবটি করা হয়েছে। কারণ, একজন গার্মেন্টস কর্মী কিংবা একজন ঝালমুড়িওয়ালা প্রতিদিন ভর্তাভাজি খাবে আর সপ্তাহে কেবল একদিন ডিম কিংবা ব্রয়লার মুরগির ঝোল খাবে এমন বেরহমি পূর্বানুমান করে নিয়ে তাদের জন্য ন্যূনতম আয়ের সীমা নির্ধারণ করার যে চর্চা আমরা প্রায় সময়ই দেখি তা একেবারেই অনুচিত। যদিও চাল, ডাল, আটা, তেল, মসলা ইত্যাদির ক্ষেত্রে বাজারে প্রাপ্ত সবচেয়ে কমদামি পণ্যটির দাম বিবেচনা করা হয়েছে। সেইসঙ্গে বাদ রাখা হয়েছে বিকেলের চা-নাশতা, দুধ, চিনি, মৌসুমি ফল ইত্যাদির খরচ এবং দেশি বা সোনালি মুরগি কিংবা গরুর মাংস হিসাবে না ধরে বাজারের অন্যতম সস্তা পাঙাশ মাছ আর ব্রয়লার মুরগি বিবেচনা করা হয়েছে।
চাল, ডাল, আটা, তেল, মসলা ইত্যাদির ক্ষেত্রে বাজারে প্রাপ্ত সবচেয়ে কমদামি পণ্যটির দাম বিবেচনা করা হয়েছে। সেইসঙ্গে বাদ রাখা হয়েছে বিকেলের চা-নাশতা, দুধ, চিনি, মৌসুমি ফল ইত্যাদির খরচ এবং দেশি বা সোনালি মুরগি কিংবা গরুর মাংস হিসাবে না ধরে বাজারের অন্যতম সস্তা পাঙাশ মাছ আর ব্রয়লার মুরগি বিবেচনা করা হয়েছে।
অবশ্য একটা পরিবার চালাতে সংসারের উপার্জনকারী ব্যক্তিকে তো শুধু খাবার খরচ জোগাড় করলেই হয় না। প্রতিদিন বাজার খরচের পাশাপাশি আছে বাসাভাড়া, সন্তানের শিক্ষা ব্যয়, চিকিৎসা খরচ, প্রতিদিনকার যাতায়াত ভাড়া, সাবান, টুথপেস্ট, জুতা, স্যান্ডেল, মোবাইল বিল, ইন্টারনেট খরচসহ যাবতীয় খরচ। আবার অতিথি আপ্যায়ন এবং বিনোদনেও মাসের খরচের একটা অংশ বরাদ্দ রাখতে হয়। এত কিছুর পর প্রতি মাসের ইনকাম থেকে কিছুটা সঞ্চয় করার চেষ্টাটাও কিন্তু অবাস্তব কিছু না। অথচ ২০২৩ সালে গার্মেন্টস শিল্প শ্রমিকদের জন্য জারিকৃত প্রজ্ঞাপন অনুসারে গ্রেড-৪ ক্যাটাগরির একজন শ্রমিক মূল মজুরি, বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতা, যাতায়াত ভাতা, খাদ্য ভাতাসহ সব মিলিয়ে সাকুল্যে পান ১২ হাজার ৫০০ টাকা, আর সর্বোচ্চ গ্রেড-১ ক্যাটাগরিতে নিয়োজিত শ্রমিক পান ১৫ হাজার ৩৫ টাকা। যে সেক্টরে প্রায় ৩০ লাখ শ্রমিক কাজ করছে, যে সেক্টরের জন্য সরকারের ঘোষিত নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ করে দেওয়া আছে, সেই সেক্টরে কর্মরত শ্রমিকদের কারো পক্ষেই সারা দিন হাড়ভাঙা খাটুনির পরও মাসের শেষে সম্মানজনক মজুরি পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। আর এই সেক্টরের বাইরে যারা আছেন, যারা রিকশা চালান, লেগুনার হেলপারি করেন, হোটেল বয়ের কাজ করেন, উবার চালান, হোম ডেলিভারির কাজ করেন, বাসাবাড়িতে ঝিয়ের কাজ করেন, রাস্তার পাশে পান-সিগারেট বিক্রি করেন কিংবা যারা গড়পড়তা মানের প্রাইভেট অফিসে চাকরি শুরু করেছেন কিংবা কয়েক বছর ধরে করছেন তাদের অবস্থা বোঝার জন্য কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও কাণ্ডজ্ঞানই যথেষ্ট। কাজেই শেষ কথা হিসেবে বলা হয়তো অনুচিত হবে না যে, মোট জনসংখ্যার খুব সামান্য অংশই হয়তো মোটামুটি আদর্শ একটা ব্যক্তিগত, পারিবারিক আর সামাজিক জীবন উপভোগ করতে পারছেন।
কিন্তু যারা পারছেন না, তারা আসলে কেমন আছেন?
মওদুদ রহমান: লেখক, গবেষক। ইমেইল: mowdudur@gmail.com