তিস্তা মহাপরিকল্পনা নদীর জন্য কী ফল আনবে?

আগাম প্রকাশ

‘তিস্তা নদী সমন্বিত ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা’র চূড়ান্ত সম্ভাব্যতা প্রতিবেদন বিশ্লেষণ

মো. খালেকুজ্জামান

বাংলাদেশে নদী ও পানি সম্পদ নিয়ে পাকিস্তান আমল থেকে বহু ব্যয়বহুল প্রকল্প নেয়া হয়েছে। এসব প্রকল্পের পেছনে বহু টাকা খরচ হয়েছে, বিশাল ঋণ নেয়া হয়েছে, দেশি বিদেশি কোম্পানি-কনসালট্যান্ট-ব্যবসায়ীরাই সব সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তারাই লাভবান হয়েছে, কিন্তু জনগণের কাছে এসব প্রকল্পের অনেক কিছুই গোপন রাখা হয়েছে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ, সেচ ও উন্নয়নের কথা বলে নেয়া হলেও এরকম বহু প্রকল্পের কারণে বহু নদী এখন মৃত, নদী ভাঙনবৃদ্ধিতে বহু অঞ্চলের মানুষ সর্বশান্ত, বহু অঞ্চল জলাবদ্ধতার শিকার, প্রাণ প্রকৃতি প্রতিবেশ বিপর্যস্ত। একইধারায় গত সরকারের সময়ে নেয়া হয়েছে ‘ডেল্টা প্রকল্প’ ও ‘তিস্তা মহাপরিকল্পনা’। এ নিয়ে স্বাধীন বিশেষজ্ঞদের মতামত গ্রাহ্যও করা হয়নি। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার একই পথে অগ্রসর হচ্ছে। এই বিশেষজ্ঞ লেখায় তিস্তা মহাপরিকল্পনা সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট চীনা কোম্পানির আনুষ্ঠানিক বক্তব্য ও প্রচারণা বিশ্লেষণ করে গুরুতর সমস্যা চিহ্নিত ও করণীয় নির্দেশ করা হয়েছে।     

বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি `পাওয়ার চায়না’ নামক একটি চীনা সংস্থার সঙ্গে ৮৫৩ মিলিয়ন ডলার ঋণ নেওয়ার জন্য চুক্তি সই করেছে (তথ্যের উৎসের ওপর নির্ভর করে এই পরিমাণের পরিবর্তন দেখা যায়), এবং তাদের কারিগরি সহায়তায় ‘তিস্তা নদী সমন্বিত ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার প্রকল্প’, টিআরসিএমআরপি কিংবা TRCMRP,  (BWDB, 2019) গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। `পাওয়ার চায়না’ কর্তৃক প্রস্তুতকৃত একটি প্রচারমূলক ভিডিও ক্লিপের মাধ্যমে এবং গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের মাধ্যমে এর প্রাথমিক বিবরণ জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, টিআরসিএমআরপি-টি বাংলাদেশে ‘তিস্তা মহাপরিকল্পনা’ নামেই বেশি পরিচিত।

সংবাদ প্রতিবেদন অনুসারে, তিস্তা মহাপরিকল্পনার সাতটি উদ্দেশ্য রয়েছে যার মধ্যে রয়েছে- নদীর তলদেশের প্রস্থ সংকুচিত এবং গভীর করার মাধ্যমে নদীর আকার নিয়ন্ত্রণ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নদীর ভাঙন নিয়ন্ত্রণ, নৌচলাচল বৃদ্ধি, সেচ, ভূমি পুনরুদ্ধার এবং পানি সংরক্ষণ (আচার্য, ২০২০; এশিয়ানওয়াটার, ২০২০; আজাজ, ২০২০; ভট্টাচার্য, ২০২০; চাকমা, ২০২০; মোহন, ২০২০)। এই প্রকল্পের অংশ হিসেবে, দোয়ানি-ডালিয়ায় তিস্তা ব্যারাজ থেকে চিলমারী পর্যন্ত নদীর উভয় তীরে মোট ১১২ কিলোমিটার দীর্ঘ বাঁধ বা লেভি নির্মাণ করা হবে। এই প্রকল্পের আওতায়, দোয়ানি-ডালিয়া ব্যারাজ থেকে কাউনিয়া পর্যন্ত তিস্তা নদীর প্রাকৃতিক প্রস্থ ৭০০ মিটার এবং কাউনিয়া থেকে চিলামারী পর্যন্ত ১,০০০ মিটারে নামিয়ে আনা হবে। পাওয়ার চায়নার ভিডিও অনুসারে, নদীর পুরো দৈর্ঘ্য ১০ মিটার গভীরে খনন করা হবে যাতে নতুনভাবে নির্মিত ১১২ কিলোমিটার বাঁধ এবং বিদ্যমান বাঁধের মধ্যে মূল নদীটি সীমাবদ্ধ থাকে। তবে টিআরসিএমআরপি (বিডব্লিউডিবি এবং পাওয়ার চায়না, ২০২৩) এর সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় খননের গভীরতা সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য দেওয়া হয়নি। শিল্প, আবাসিক, ৫০০ মেগাওয়াট সৌর ফটোভোলটাইক এবং কৃষি কমপ্লেক্সের সুবিধার্থে নদীর উভয় পাশে মোট ১৭০ বর্গকিলোমিটার জমি পুনরুদ্ধার করা হবে (Roy, 2020)। এ ছাড়াও মোট ৩টি যাত্রী টার্মিনাল, ১১টি লোডিং টার্মিনাল, শুকনো মৌসুমে (লিন সিজন) পানি সংরক্ষণ রিজার্ভার, নতুনভাবে পুনরুদ্ধারকৃত জমিগুলোকে সংযুক্ত করার জন্য একটি সড়ক নেটওয়ার্ক, নদীর তীরের ভাঙন কমাতে ৫০টি নতুন গ্রোইন বা গ্রোইন বা ক্রসবার এবং নদীর তীর বরাবর বাঁধ বা লেভি তৈরি করা হবে। গ্রোইন হচ্ছে নদীর তীর থেকে নদীর মধ্যখানে নির্মিত ঋজু বাঁধ যার মাধ্যমে নদীর তীরবর্তী পানি ও পলিপ্রবাহের বেগ হ্রাস করা হয়। ক্রসবার হচ্ছে গ্রোইনেরই আরেকটি ধরন। সংবাদ প্রতিবেদন অনুসারে, ‘পাওয়ার চায়না’ একটি পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন (EIA) সম্পন্ন করেছে, যা পাবলিক ডোমেইনে পাওয়া যায়নি (BWDB, 2019; Azaz, 2020; Roy, 2020)।

পাবলিক ডোমেইনে প্রাপ্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে, খালেকুজ্জামান (2023, এবং 2024), এবং ইসলাম (2022, 2023, এবং 2025) ‘প্রস্তাবিত তিস্তা মহাপরিকল্পনার মূল্যায়ন’–এই লেখাটি আগেই প্রকাশ করেছেন।

সম্প্রতি (২০২৫ সালের জুলাই মাসে), তিস্তা মহাপরিকল্পনা (BWDB এবং পাওয়ার চায়না, 2023)-এর সম্ভাব্যতা অধ্যয়নের চূড়ান্ত প্রতিবেদন জনসমক্ষে আনা হয়েছে। একই শিরোনামের চূড়ান্ত প্রতিবেদনের একটি পূর্ববর্তী সংস্করণও রয়েছে (BWDB এবং পাওয়ার চায়না, 2019)। যেহেতু দুটি চূড়ান্ত প্রতিবেদন একই প্রকল্পের সঙ্গে সম্পর্কিত, এবং যেহেতু 2023 সংস্করণটি আপডেট করা তথ্য প্রদান করে, তাই এই বিশ্লেষণটি চূড়ান্ত সম্ভাব্যতা অধ্যয়নের 2023 সংস্করণের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে এবং নিম্নলিখিত বিশ্লেষণ পত্রটিতে সম্ভাব্যতা অধ্যয়নের চূড়ান্ত প্রতিবেদনটিকে FSFR (Feasibility Study- Final report)  হিসেবে উল্লেখ করা হবে।

এই বিশ্লেষণটি চূড়ান্ত সম্ভাব্যতা অধ্যয়নের 2023 সংস্করণের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে এবং নিম্নলিখিত বিশ্লেষণ পত্রটিতে সম্ভাব্যতা অধ্যয়নের চূড়ান্ত প্রতিবেদনটিকে FSFR (Feasibility Study- Final report)  হিসেবে উল্লেখ করা হবে।

এই বিশ্লেষণটি BWDB এবং পাওয়ার চায়না (2023) দ্বারা FSFR-এ প্রস্তাবিত তিস্তা মহাপরিকল্পনার বিভিন্ন উপাদানের মূল্যায়ন প্রদান করবে। নিচের প্রতিটি বিভাগে FSFR-এ প্রস্তাবিত প্রকল্পের লক্ষ্যগুলোর সংক্ষিপ্তসার থাকবে এবং তারপর এই লেখকের দ্বারা উপস্থাপিত সুপারিশসহ একটি বিশ্লেষণ প্রদান করা হবে।

(১) তিস্তা নদীর ভৌগোলিক অবস্থান:

তিস্তা ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে অবস্থিত চতুর্থ বৃহত্তম আন্তঃসীমান্ত নদী। তিস্তা ব্রহ্মপুত্র নদীর বৃহত্তম উপনদী। অতীতে তিস্তা নদী প্রায় ৬০ বিলিয়ন ঘনমিটার (bcm) পানি এবং ৪৯ মিলিয়ন টন (Mt) পলি বহন করত, যা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যথাক্রমে প্রায় ২৫.২ bcm এবং ৩.৪ Mt-এ নেমে এসেছে (Azaz, 2020; BWDB, 2019; Shi, et al., 2019)। নদীর প্রবাহ এবং পলি সরবরাহের পরিমাণ হ্রাসের কারণ হলো সিকিমে একাধিক পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ এবং পশ্চিমবঙ্গের গজলডোবায় একটি বাঁধ নির্মাণ, যা বাংলাদেশের দোয়ানি-ডালিয়া বাঁধের প্রায় ১০০ কিলোমিটার উজানে অবস্থিত, যাতে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পাঁচটি জেলায় অবস্থিত তিস্তা অববাহিকার বাইরের বারিপাত অঞ্চলে পানি প্রবাহিত করা হয় (রুদ্র, ২০০৩; ইসলাম এবং হিগানো, ২০১২; মল্লিক এবং অন্যরা, ২০১০; রাহমান এবং মামুন, ২০২০; গিরি, ২০২১)। তিস্তা নদীর মোট বারিপাত এলাকা ১২ হাজার ৩৭০ বর্গকিলোমিটার, যার মধ্যে প্রায় ২০০০ বর্গকিলোমিটার (১৭ শতাংশ) বাংলাদেশের মধ্যে অবস্থিত। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নদীর প্রস্থ ০.৭ থেকে ৫.৫ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে ওঠানামা করে এবং নদীটির গড় প্রস্থ হচ্ছে ৩ কিলোমিটার (বিডব্লিউডিবি, ২০১৯)। তিস্তা বারিপাত অঞ্চলের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫০ শতাংশ বাংলাদেশের তিস্তা-নির্ভর এবং বারিপাত অঞ্চলে বাস করে। বাংলাদেশের প্রায় ১৪ শতাংশ ফসল তিস্তা-নির্ভর অঞ্চলে উৎপাদিত হয় (হক এট আল., ২০১৭; মন্ডল এবং ইসলাম, ২০১৭)। ২ কোটি ২০ লাখ মানুষের জীবন ও জীবিকা নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহের ওপর নির্ভরশীল, যা কিনা বর্তমানে একতরফাভাবে উজানের ভারত দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। বাংলাদেশে ১৯৯০ সালে দোয়ানি-ডালিয়ায় একটি বাঁধ নির্মাণ করে তিস্তা সেচ প্রকল্প (টিআইপি) করা হয় যার লক্ষ্য ছিল ৭৫০,০০০ হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়া। তবে টিআইপি সর্বোচ্চ ১,১০,০০০ হেক্টর জমিতে সেচ দিতে পারে। টিআইপির স্বল্পস্থায়ী সাফল্যের পর, ভারত পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলের পাঁচটি জেলার ৯,২০,০০০ হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়ার লক্ষ্যে তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্প (টিবিপি) পরিচালনা করার জন্য গজলডোবায় একটি বাঁধ নির্মাণ করে তিস্তা থেকে পানি সরিয়ে নেওয়া শুরু করে (চিত্র: ১)। তিস্তা-মহানন্দা সংযোগ খাল এবং তিস্তা-পানিঢাকা মূল খাল দিয়ে পানি সরানো হয় (রুদ্র, ২০০৩)। ভারত যখন মহানন্দা-পুনর্ভবা-মেচি বারিপাত অঞ্চলে তিস্তার পানি সরিয়ে নিতে শুরু করে, তখন ১৯৯৬ সালের মধ্যে নদীর গড় প্রবাহ ৮৫ শতাংশ হ্রাস পায়। বাংলাদেশের দোয়ানি-ডালিয়ায় তিস্তা নদীর মাসিক গড় প্রবাহ ১৯৯০-১৯৯৬ সালে ১০,০০০ কিউসেক থেকে কমে ১৯৯৬-২০০৬ সালে ২,০০০ কিউসেক-এরও কমে নেমে আসে (মুলিক এট আল, ২০১০; এজাজ, ২০২০; ইসলাম, ২০২০)। ২০০৬ সালে বর্ষা মৌসুমে নদীর প্রবাহ ২০ কিউমেক (৭০০ কিউসেক)-এর নিচে নেমে যায় (মুলিক এট আল, ২০১০)। বাংলাদেশ বেশ কয়েকবার ভারতের সঙ্গে পানিবণ্টন চুক্তি করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। তিস্তা নদীর পানিবণ্টন নিয়ে ব্যর্থ আলোচনার বিষয়টি বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিরোধের একটি প্রধান কারণ হিসেবে বিদ্যমান (আহমেদ, ২০১২)।

১৯৯০ সালে দোয়ানি-ডালিয়ায় একটি বাঁধ নির্মাণ করে তিস্তা সেচ প্রকল্প (টিআইপি) করা হয় যার লক্ষ্য ছিল ৭৫০,০০০ হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়া। তবে টিআইপি সর্বোচ্চ ১,১০,০০০ হেক্টর জমিতে সেচ দিতে পারে।

চিত্র-১: উপরোক্ত মানচিত্রে পশ্চিমবঙ্গে তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্প (TBP) এবং বাংলাদেশে তিস্তা সেচ প্রকল্প (TIP)-এর বিস্তৃতি দেখানো হয়েছে।

বিশ্লেষণ এবং সুপারিশ:

যে কোনো নদীর পানি ব্যবস্থাপনা সেই নদীর বারিপাত অঞ্চল অনুযায়ী করা উচিত। কারণ উজানে সংঘটিত যে কোনো কার্যক্রম ভাটির প্রবাহকে প্রভাবিত করে। তিস্তা নদীর নিম্ন বারিপাত অঞ্চলের মাত্র ১৭ শতাংশ বাংলাদেশের মধ্যে অবস্থিত। তিস্তা অঞ্চলে বাংলাদেশের জনগণের বেশিরভাগ সমস্যার মূলে রয়েছে উজানের দিকে ভারতের তিস্তা প্রবাহের একতরফা নিয়ন্ত্রণ। শুষ্ক মৌসুমে নদীতে পর্যাপ্ত পানি থাকে না এবং বর্ষাকালে অতিরিক্ত পানি থাকে। বর্ষাকালে উচ্চ প্রবাহ বন্যা, নদীতীর ভাঙন এবং জীবন ও জীবিকার ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শুষ্ক মৌসুমে খুব কম পানি প্রাপ্যতা বাংলাদেশের বারিপাত অঞ্চল এবং তিস্তা-নির্ভর অঞ্চলের কৃষি, মৎস্য, পানি সরবরাহ, সেচ প্রকল্প এবং বাস্তুতন্ত্রকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবান্বিত করে। যদি বাংলাদেশ তিস্তা নদীর প্রবাহের ওপর তার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে না পারে, তাহলে ভাটির দিকে কোনো প্রকল্পই সম্পূর্ণরূপে সফল হবে না। FSFR এই বাস্তবতা আমলে নেয়নি এবং তিস্তা প্রবাহে বাংলাদেশের ন্যায্য অংশ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে না। FSFR ভারত কর্তৃক তিস্তা নদীর উজানের নিয়ন্ত্রণের প্রভাব নিয়েও কোনো আলোচনা করা হয়নি। এ বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার ফলে কিন্তু তিস্তা অঞ্চলের বাস্তবতা পরিবর্তন হবে না। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি সঠিক চুক্তি স্বাক্ষরিত না হলে এবং সঠিকভাবে বাস্তবায়ন না করা হলে, তিস্তা মহাপরিকল্পনা উজানে ভারতের দ্বারা তিস্তা নদীর অপ্রত্যাশিত প্রবাহের পরিণতিতে সৃষ্ট সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম হবে না। উপরন্তু তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হলে উজানে ভারতের দ্বারা তিস্তা নদীর প্রবাহের অন্যায্য এবং একতরফা নিয়ন্ত্রণকে পরোক্ষভাবে বরং বৈধতাই দেবে। এটি ভারতকে একটি ভুল সংকেত দেবে যে বাংলাদেশ তাদের নিজস্ব ভূখণ্ডের মধ্যে শুকনো মৌসুমে পানির ঘাটতি এবং বর্ষায় অতিরিক্ত প্রবাহের সমস্যা সমাধান করতে পারে এবং আন্তঃসীমান্ত নদীগুলোতে পানিবণ্টন চুক্তিতে পৌঁছানোর আর কোনো প্রয়োজন নেই। FSFR-কে বাংলাদেশে তিস্তা-নির্ভর এলাকার মানুষ যে সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে তার অন্তর্নিহিত কারণগুলো অনুধাবন করতে হবে। FSFR-কে আন্তঃসীমান্ত নদীর ওপর বাংলাদেশের বৈধ অধিকারের ওপর জোর দিতে হবে। কোনো অভ্যন্তরীণ প্রকল্প প্রণয়নের আগে বাংলাদেশের উজানে ভারতের সঙ্গে তিস্তা নদীর প্রবাহের ওপর একটি বছরব্যাপী, দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে কাজ করতে হবে। যদি ভারতের সঙ্গে এ ধরনের চুক্তি অর্জন করা না যায়, তাহলে বাংলাদেশের বিষয়টি আন্তর্জাতিক ফোরামে নিয়ে যাওয়া উচিত হবে।

ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি সঠিক চুক্তি স্বাক্ষরিত না হলে এবং সঠিকভাবে বাস্তবায়ন না করা হলে, তিস্তা মহাপরিকল্পনা উজানে ভারতের দ্বারা তিস্তা নদীর অপ্রত্যাশিত প্রবাহের পরিণতিতে সৃষ্ট সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম হবে না। উপরন্তু তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হলে উজানে ভারতের দ্বারা তিস্তা নদীর প্রবাহের অন্যায্য এবং একতরফা নিয়ন্ত্রণকে পরোক্ষভাবে বরং বৈধতাই দেবে।

FSFR নদীর প্রাকৃতিক বিনুনিযুক্ত বৈশিষ্ট্য পরিবর্তনের প্রস্তাব করেছে এবং এই নদীটিকে একটি সরল নিষ্কাশন খালে রূপান্তর করার প্রস্তাব করছে। তিস্তা মহাপরিকল্পনা ধরে নেয় যে একটি নদী শুধুই পানি পরিবহনের একটি নিষ্কাশন খাল এবং একটি বিনুনিযুক্ত নদী যে আসলে একটি সূক্ষ্ম ও জঠিল বাস্তুতন্ত্রকে ধারণ করে সেই বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে । এক অর্থে, একটি প্রাকৃতিক নদী ব্যবস্থার এ ধরনের পরিবর্তন সুপ্রিম কোর্টের নদীকে একটি জীবন্ত সত্তা হিসেবে বিবেচনা করার রায়েরও লঙ্ঘন (মার্জিল, ২০২০)।

তিস্তা মহাপরিকল্পনা ধরে নেয় যে একটি নদী শুধুই পানি পরিবহনের একটি নিষ্কাশন খাল এবং একটি বিনুনিযুক্ত নদী যে আসলে একটি সূক্ষ্ম ও জঠিল বাস্তুতন্ত্রকে ধারণ করে সেই বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে ।

(২) তিস্তা নদীর প্রবহমানতা এবং পানিতাত্ত্বিক কাঠামো:

তিস্তা একটি বিনুনিযুক্ত নদী যা পানি এবং পলিপ্রবাহের ক্ষেত্রে খুবই পরিবর্তনশীল। যে নদীর প্রবাহ একাধিক প্রবাহে বিভক্ত হয়ে আবার সংযুক্ত হয় তাকে বিনুনিযুক্ত নদী বলা হয়। বিনুনিযুক্ত নদীগুলো ভূতাত্ত্বিকভাবে সাধারণত সক্রিয় পর্বতমালার পাদদেশে অবস্থিত হয় যা কিনা টেকটোনিক কার্যকলাপের কারণে প্রচুর পরিমাণে পলি বয়ে নিয়ে আসে (চারকভ, ২০১৩; চার্চ, ২০১৫; ফিশার এট আল., ২০১৭; গ্রে এট আল., ২০১৮)। পূর্ব হিমালয়ে উচ্চ বৃষ্টিপাতের সঙ্গে টেকটোনিক কার্যকলাপের কারণে উৎপাদিত প্রচুর পরিমাণে পলিমাটি বয়ে আসার কারণেই ব্রহ্মপুত্র, কোশী এবং তিস্তা নদীর মতো বড় বড় পলিমাটির পাখা এবং বিনুনিযুক্ত নদীগুলোর সৃষ্টি হয়। প্রাকৃতিক ভূমিরূপ এবং অন্তর্নিহিত ভূতাত্ত্বিক নিয়ন্ত্রণের কারণে তিস্তা একটি বিনুনিযুক্ত নদী হিসেবে সৃষ্টি হয়েছে। মানুষ তাদের প্রয়োজন অনুসারে প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করতে পারে না এবং করা উচিতও নয়। কারণ, তাতে হিতে বিপরীত হয়।

FSFR এই বাস্তবতাকে এভাবে স্বীকার করে নিয়েছে,

‘তিস্তা নদী একটি বিচরণশীল নদী, এবং বন্যার সময়ে পানি প্রবাহ প্রচুর। প্রয়োজনীয় সুরক্ষা ব্যবস্থার অভাবে, এটি নদীর তীব্র ক্ষয় এবং ক্ষয়ক্ষতির দিকে পরিচালিত করে এবং উভয় তীরের বিশাল জমি এবং বসতি এলাকা ডুবে যায় (FSFR এর পৃষ্ঠা ১)।’

FSFR আরও উল্লেখ করে যে,

‘…নদীটি প্রশস্ত এবং অগভীর, যেখানে প্রস্থ সাধারণত ০.৭ কিমি – ৫.৫ কিমি এবং গড়ে প্রায় ৩.০ কিমি (পৃ. ১৭)।’

যেহেতু FSFR নদীর বিনুনি প্রকৃতিকে একটি সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, তাই তিস্তা মহাপরিকল্পনা প্রস্তাব করে যে,

‘তিস্তা ব্যারাজ থেকে তিস্তা নদী এবং ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীর সংযোগস্থল পর্যন্ত ১০২ কিমি দীর্ঘ নদীপথ পরিচালনার জন্য বাঁধ এবং গ্রোইনের মতো নদী নিয়ন্ত্রণ কাজগুলো ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হবে, যা নদীর বিস্তৃতির পরিসর নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে এবং নদীর প্রবাহ পথ স্থিতিশীল করতে পারবে (পৃ. ১৭)।’

FSFR-এর ৩০ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে যে,

‘নদী ঘনঘন সরে যাচ্ছে এবং উভয় তীরের প্রবাহের বেগ কম এবং যার ফলে নদীতীরের সূক্ষ্ম বালুকণা আলগা হয়ে নদীতীর ক্ষয় করে। প্রাকৃতিক নদীর উভয় পাশে তীর ধসের ঘটনাটি স্পষ্টতই পার্শ্বীয় ক্ষয় (lateral erosion) এবং স্কাউয়ারিং (scouring) প্রভাব দ্বারা প্রভাবিত।’

FSFR নদীর প্রস্থ গড়ে ৩ কিমি থেকে ৭০০ মিটার (কাউনিয়ার উজানে) থেকে ১০০০ মিটার (কাউনিয়ার ভাটিতে) পর্যন্ত সীমাবদ্ধ করার প্রস্তাব করেছে। FSFR প্রস্তাব অনুসারে, নদীর উভয় তীর ডালিয়া থেকে চিলমারী পর্যন্ত বাঁধ তৈরি করা হবে এবং ১৭০ বর্গকিমি জমি পুনরুদ্ধার করা হবে। যদিও পাওয়ার চায়নার ভিডিওতে দাবি করা হয়েছে যে সংকীর্ণ প্রধান চ্যানেলের গভীরতা ১০ মিটার হবে, FSFR নির্দেশ করে যে মূল চ্যানেলের উজান থেকে ভাটিতে গড় গভীরতা যথাক্রমে প্রায় ২.৮ মিটার এবং ৩.৩ মিটার (পৃষ্ঠা: ৯৯)। FSFR প্রস্তাব করে যে,

মূল চ্যানেলের অভ্যন্তরে ৩০০ মিটার প্রস্থ এবং ১.৯ মিটার গভীরতার একটি ‘ছোট স্কাউয়ারিং চ্যানেল’ খনন করা হবে, যা একটি প্রবাহ স্কাউয়ার (গর্তসৃষ্টিকারী) চ্যানেল হিসেবে কাজ করবে (পৃষ্ঠা: ১০৩)। কাউনিয়ার উজানে এবং ভাটিতে পরিবর্তিত চ্যানেলের মোট গভীরতা হবে যথাক্রমে ৪.৭ মিটার (২.৮ মিটার প্রধান চ্যানেল + ১.৯ মিটার স্কাউয়ারিং চ্যানেলের জন্য) এবং ৫.২ মিটার (৩.৩ মিটার + ১.৯ মিটার)। FSFR প্রস্তাব করেছে ‘তিস্তা নদীকে একটি স্থিতিশীল প্রধান চ্যানেলে রূপান্তরিত করে পুনরুদ্ধার করা হবে (পৃষ্ঠা: ৪৬)।’

নদীশাসনের সাধারণ ধারণা হলো

‘প্রধান প্রবাহের বিচরণ পরিসর সীমিত করা, এবং প্রবাহ পথটি নদী নিয়ন্ত্রণকারী কাঠামোর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা, যার মধ্যে থাকবে গ্রোইন, ট্রেনিং ডাইক, রিভেটমেন্ট এবং রিপ্র্যাপ ব্যাকফিল ইত্যাদি যাতে একটি স্থিতিশীল প্রধান চ্যানেল তৈরি হয় এবং নদীর ভাঙন কমানো যায় (পৃষ্ঠা: ৪৬)।’

বিশ্লেষণ এবং সুপারিশ:

তিস্তা নদীর বর্তমান গড় গভীরতা প্রায় ৫ মিটার এবং গড় প্রস্থ প্রায় ৩ কিমি (অথবা ৩,০০০ মিটার), যার ফলে ১৫,০০০ বর্গমিটার (৫ মিটার x ৩,০০০ মিটার) ক্রস-সেকশনাল এলাকা বন্যার পানি বহন করার জন্য বিদ্যমান। কাউনিয়ার উজানে এবং ভাটিতে নদীর প্রস্তাবিত প্রস্থ যথাক্রমে ৭০০ মিটার এবং ১,০০০ মিটার হবে। নদীর প্রস্তাবিত গভীরতায় মূল চ্যানেলের জন্য দুটি উপাদান থাকবে (কাউনিয়ার উজানে ২.৮ মিটার এবং ভাটিতে ৩.৩ মিটার) এবং স্কাউয়ারিং চ্যানেলের জন্য (কাউনিয়ার উজানে এবং ভাটিতে ১.৯ মিটার)। ফলস্বরূপ, কাউনিয়ার উজানে এবং ভাটিতে নদীর ক্রস-সেকশনাল আয়তন হবে যথাক্রমে প্রায় ৩,৮৬০ বর্গমিটার এবং ৫,৭৭০ বর্গমিটার। এই ক্রস-সেকশনাল আয়তনগুলো মূল নদীর মাত্র ২৫ শতাংশ (কাউনিয়ার উজানে) এবং ৩৮ শতাংশ (কাউনিয়ার ভাটিতে), যার অর্থ হলো নদীর প্রাকৃতিক পরিবেশের তুলনায় প্রস্থচ্ছেদ-আয়তন কমে যাওয়ার কারণে পানিবহন ক্ষমতা হ্রাস পাবে, ফলশ্রুতিতে এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বন্যার পরিমাণ এবং তীব্রতা আরও বৃদ্ধি পাবে।

নদীর প্রাকৃতিক পরিবেশের তুলনায় প্রস্থচ্ছেদ-আয়তন কমে যাওয়ার কারণে পানিবহন ক্ষমতা হ্রাস পাবে, ফলশ্রুতিতে এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বন্যার পরিমাণ এবং তীব্রতা আরও বৃদ্ধি পাবে।

মূল চ্যানেল থেকে ড্রেজিং করা পলির মোট পরিমাণ হবে ১৩১ মিলিয়ন ঘনমিটার এবং স্কাউয়ারিং চ্যানেলের পরিমাণ ৫৮ মিলিয়ন ঘনমিটার (পৃষ্ঠা: ৫০)। অন্য কথায়, ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে তৈরি পরিবর্তিত চ্যানেলের বহন ক্ষমতা হবে ১৯১ মিলিয়ন বর্গমিটার। FSFR নির্দেশ করে যে ৫০ বছরকালীন এবং ১০০ বছরকালীন বন্যার সময় গড় পানি নিষ্কাশন ক্ষমতা হবে যথাক্রমে ১০,৬৮০ ঘনমিটার/সেকেন্ড এবং ১১,৯৮২ ঘনমিটার/সেকেন্ড (পৃষ্ঠা: ১৫)। যদিও, ১৯৬৮ সালের বন্যা ১৯,৬০০ ঘনমিটার/সেকেন্ড বহন করেছিল (রুদ্র, ২০০৩)। ৫০ বছরকালীন বন্যার সময় (১০,৬৮০ ঘনমিটার/সেকেন্ড), নদীর খননকৃত পরিমাণ (১৯১ মিলিয়ন ঘনমিটার) ৫ ঘণ্টারও কম সময়ে পূর্ণ হয়ে যাবে। অন্য কথায়, সরু এবং অগভীর খালটি কোনো বড় বন্যার ঘটনা সামাল দিতে সক্ষম হবে না।

FSFR যে কোনো বিনুনিযুক্ত নদীর প্রাকৃতিক প্রবণতা স্বীকার করে। সমস্ত বিনুনিযুক্ত নদীগুলো গভীরের চেয়ে প্রশস্ত হয়। কারণ, নদীর তলদেশে প্রচুর পলি জমা হয় যা বালির ছোট ছোট দ্বীপ তৈরি করে (স্থানীয়ভাবে চর নামে পরিচিত)। যদি এ ধরনের পলি-বোঝাই করা নদী একটি সরু এবং অগভীর খালে সীমাবদ্ধ থাকে, তাহলে বেশিরভাগ পলি নদীর তলদেশে জমা হবে, যা নদীর পানি বহন ক্ষমতা হ্রাস করবে, যার ফলে নদীটিকে সংকীর্ণ এবং অগভীর করায় আগের তুলনায় বেশি বন্যা হবে। সমস্ত বিনুনিযুক্ত নদী অস্থির কারণ তাদের প্রচুর পরিমাণে পানি এবং পলি ধারণ করতে হয় যা একাধিক খালে বিভক্ত হয়ে সম্পন্ন করে। তিস্তা নদীর মতো বিনুনিযুক্ত নদীতে যখন বন্যার পানি একাধিক খালে বিভক্ত হয়, তখন সমগ্র বিনুনিযুক্ত সমভূমি পানি ধারণকারী জলাধার হিসেবে কাজ করে, যার ফলে পুরো বারিপাত অঞ্চলে বন্যার প্রবণতা হ্রাস পায়। এ ছাড়াও বিনুনিযুক্ত নদীর উপনদী এবং শাখা নদীগুলোও বন্যার পানি ধারণ করতে পারে, যতক্ষণ সেগুলো মূল নদীর সঙ্গে সংযুক্ত থাকে। প্রস্তাবিত FSFR-এ, উপনদী এবং শাখা নদীগুলোর অস্তিত্বকে সমগ্র নদী ব্যবস্থার একটি অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, তবে এই উপনদী এবং শাখা নদীগুলো মূল চ্যানেলের সঙ্গে মুক্তভাবে প্রবহমান নদী হিসেবে থাকবে কি না, তা স্পষ্ট নয়। FSFR তিস্তা নদীর ১২টি উপনদীর বর্ণনা দিয়েছে, তবে এই ছোট নদীগুলো কীভাবে মূল তিস্তা নদীর প্রবাহের সঙ্গে সংযুক্ত হবে (অথবা সেগুলোকে তিস্তা মহাপরিকল্পনায় আদৌ অন্তর্ভুক্ত করা হবে কি না), তা নির্দিষ্টভাবে বর্ণনা করেনি।

যদি এ ধরনের পলি-বোঝাই করা নদী একটি সরু এবং অগভীর খালে সীমাবদ্ধ থাকে, তাহলে বেশিরভাগ পলি নদীর তলদেশে জমা হবে, যা নদীর পানি বহন ক্ষমতা হ্রাস করবে, যার ফলে নদীটিকে সংকীর্ণ এবং অগভীর করায় আগের তুলনায় বেশি বন্যা হবে। সমস্ত বিনুনিযুক্ত নদী অস্থির কারণ তাদের প্রচুর পরিমাণে পানি এবং পলি ধারণ করতে হয় যা একাধিক খালে বিভক্ত হয়ে সম্পন্ন করে।

ভৌগোলিক এবং ভূতাত্ত্বিক পরিবেশই নির্ধারণ করে যে কোন স্থানে কোন ধরনের ভূমিরূপ এবং নদী ব্যবস্থা বিদ্যমান থাকবে। ভূতাত্ত্বিক এবং ভৌগোলিক বাস্তবতার ওপর ভিত্তি করে, তিস্তা, ধরলা, ব্রহ্মপুত্র হলো বিনুনি নদী – বাঁকানো সর্পিল নদী নয়। সর্পিল নদীগুলো এমন অঞ্চলে পাওয়া যায় যেখানে সূক্ষ্ম পলি দ্বারা সমতল ভূ-প্রকৃতি গঠিত হয়, যেমন: উপকূলীয় অঞ্চল। FSFR এই প্রাকৃতিক অবস্থাগুলোকে উপেক্ষা করে এবং কৃত্রিমভাবে বিনুনি নদীকে জোরপূর্বক সর্পিল কিংবা সরল নদীতে রূপান্তর করে প্রকৃতিকে ‘নিয়ন্ত্রণ’ করতে চায়। উল্লেখ্য, তিস্তা নদীর প্রস্তাবিত প্রধান প্রবাহের সাইনোসিটি সূচক প্রায় ১.২। একটি সর্পিল নদীর বাঁকানো সূচক ১.৫-এর বেশি হতে হয়। যদি তিস্তা নদীকে কৃত্রিমভাবে একটি সর্পিল নদীতে রূপান্তরিত করা হয়, তাহলে প্রকৃতির অন্তর্নিহিত শক্তি ধীরে ধীরে নদীটিকে আবার একটি বিনুনি নদীতে রূপান্তরিত করবে, যার ফলে নদীর তীর প্রশস্ত হবে এবং নদীর পাড় ক্ষয় হয়ে এবং ভারতের অংশের নদীর উজান থেকে প্রচুর পরিমাণে পলি বয়ে বিয়ে আসবে, যা কিনা আবার নদীটিকে বিনুনি নদীতে পরিণত করবে।

নদীতীরের ভাঙন যে কোনো বিনুনিযুক্ত নদীর স্বাভাবিক প্রবণতা। তবে যেহেতু তিস্তা নদীর উভয় পাশে জনবহুল বসতি অঞ্চল এবং উৎপাদনশীল ভূমি রয়েছে, তাই নদীপাড় ক্ষয়ের ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলো চিহ্নিত করা অত্যন্ত জরুরি এবং ক্ষয়প্রাপ্ত নদীর তীর স্থিতিশীল করার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। বিনুনিযুক্ত নদীর প্রাকৃতিক পরিবেশ ঠিক রেখেই নদীর তীরের ভাঙন কমিয়ে আনা প্রয়োজন। তিস্তার মতো একটি প্রশস্ত এবং অগভীর বিনুনিযুক্ত নদী বন্যার সময় নদীর প্রবাহ তলদেশের বালি-নুড়ির সঙ্গে ঘর্ষণের ফলে প্রবাহের গতি কমে আসে, যার ফলে নদীর তীরের ভাঙন তুলনামূলকভাবে কম হয়। একটি প্রশস্ত নদীর পানি বহন ক্ষমতাও বেশি থাকে যা বন্যার সময় বাড়তি পানি ধরে রাখার জন্য জলাধার হিসেবে কাজ করে। প্রস্তাবিত সংকীর্ণ প্রধান খাল এবং এর মধ্যে অবস্থিত স্কাউয়ারিং খালের পানি বহন ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে কম হবে, যার ফলে পুনরুদ্ধারকৃত জমিতে এবং নদীতীরে প্রবাহের বেগ বেশি হবে এবং বন্যার গভীরতাও বেশি হবে। এই বিষয়গুলোর কিছু কিছু পরবর্তী অনুচ্ছেদগুলোতে আরও বিশদ আলোচনা করা হবে। 

(৩) তিস্তা মহাপরিকল্পনার বিভিন্ন উপাদানের সম্ভাব্যতা:

তিস্তা মহাপরিকল্পনা প্রকল্পে নিম্নলিখিত লক্ষ্যগুলো অর্জনের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে: (ক) নদীশাসন নিয়ন্ত্রণ এবং পানি স্বল্পতার সমাধান, (খ) বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং দুর্যোগ প্রশমন, (গ) নদীর তীর ভাঙন হ্রাস, (ঘ) পানি সংরক্ষণ, সেচ এবং নাব্যতা বৃদ্ধি, (ঙ) শিল্প ও নগর কমপ্লেক্স স্থাপনের জন্য জমি পুনরুদ্ধার, (চ) স্থানীয় জনগণের জন্য অর্থনৈতিক সুবিধা সম্প্রসারণ এবং (ছ) পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রের মান উন্নয়ন করা।

নিম্নলিখিত অনুচ্ছেদগুলোতে পানিবিদ্যা, ভূতত্ত্ব, বাস্তুতন্ত্র, পরিবেশ বিজ্ঞান এবং অর্থনৈতিক কার্যকারিতার আলোকে উপরোক্ত প্রতিটি বিষয় বিশ্লেষণ করা হবে। প্রস্তাবিত লক্ষ্যগুলোর সম্ভাব্যতা বিশ্লেষণের পাশাপাশি, সুনির্দিষ্ট পরামর্শ এবং সুপারিশও প্রদান করা হবে।

(ক) শুষ্ক মৌসুমে নদীশাসন নিয়ন্ত্রণ এবং জলাবদ্ধতার সমাধান:

তিস্তার প্রবাহের ওপর বাংলাদেশে তিস্তা বারিপাত অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বৈধ অধিকার ভারত কয়েক দশক ধরে অস্বীকার করে আসছে। ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গে নির্মিত গজলডোবা ব্যারাজ এবং একাধিক পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্রে পানি সরিয়ে নেওয়ার ফলে মানুষের জীবন ও জীবিকা এবং নদী বাস্তুতন্ত্র, পানি, পলি এবং পুষ্টির কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এই অর্থে ভারতের তিস্তা অববাহিকার জনগণ কয়েক দশক ধরে যে অর্থনৈতিকভাবে লাভ এবং সমৃদ্ধি উপভোগ করছে তা অংশত তিস্তা নদীর সম্পদের ওপর বাংলাদেশের অধিকারের বিনিময়ে হয়েছে। বাংলাদেশের সকল স্তরে তিস্তা প্রবাহের ওপর তাদের অধিকারের দাবি বজায় রাখা প্রয়োজন। তিস্তা নদীতে শুকনো মৌসুমে অতিরিক্ত প্রবাহ নিশ্চিত না করে, প্রস্তাবিত টিআরসিএমআরপি তিস্তা নদীর পানি ঘাটতি সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। নদীর তল গভীর করার পর প্রস্তাবিত মূল চ্যানেলে যে পানি পাওয়া যেতে পারে তা তিস্তা নদীর উভয় পাশে ভূগর্ভস্থ পানিরই অংশ। গজলডোবা ব্যারাজে পানি ছেড়ে দেওয়ার মাধ্যমে উজানে ভারত কর্তৃক পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি না করা হলে, নদীটিকে আরও গভীরভাবে খনন করে অতিরিক্ত পানির সরবরাহ করা যাবে না। তবে এ ধরনের ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে ভাটির দিকে একটি বাঁধ বা ব্যারাজ তৈরি করা হলে, তিস্তার নিম্নাঞ্চলে কিছু পানি সংরক্ষণ করা হয়তো সম্ভব হবে। যদিও FSFR-এ উল্লেখ নেই যে, এ ধরনের বাঁধ বা রিজার্ভার প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করা হবে কি না। তবে এ ধরনের বাঁধ বা ব্যারাজ নির্মাণ করা হলে অন্যান্য চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে, যা নিম্নলিখিত অনুচ্ছেদগুলোতে আলোচনা করা হয়েছে।

(খ) বন্যা নিয়ন্ত্রণ:

FSFR তিস্তা অববাহিকায় বন্যাকে একটি বড় দুর্যোগ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। FSFR অনুসারে, সাম্প্রতিক রেকর্ডকৃত বড় বন্যাগুলো হলো: ১৯৪৪, ১৯৮০, ১৯৮৭, ১৯৮৮, ১৯৮৯, ১৯৯৩, ১৯৯৫, ১৯৯৮, ২০০৪, ২০০৭, ২০০৯ এবং ২০১০ সালের বন্যা (পৃষ্ঠা: ৩৮)। তবে FSFR গত কয়েক দশক ধরে তিস্তা অববাহিকায় বন্যা এবং আকস্মিক বন্যার সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করতে ব্যর্থ হয়েছে। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসারে, ১৯৫০ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে ১০টি বড় বন্যা সংঘটিত হয়েছিল (১৯৫০, ১৯৬৮, ১৯৭৩, ১৯৬৮, ১৯৭৮, ১৯৯৩, ১৯৯৬, ২০০০ ও ২০০৩)। অন্যদিকে গত ৫ বছরে ১০টি বন্যা সংঘটিত হয়েছে (২০১৬ সালে দুবার, ২০১৭ সালে দুবার, ২০১৯ সালে তিনবার, ২০২০ সালে তিনবার ও ২০২১ সালে তিনবার)। তিস্তা অববাহিকায় জীবন ও সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি কমাতে ব্যবস্থা নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। প্রস্তাবিত FSFR টিআরসিএমআরপিতে বন্যার সমস্যাটি কীভাবে সমাধান করা সম্ভব হবে অথবা হ্রাস করা যাবে সে বিষয়ে পর্যাপ্তভাবে আলোচনা করেনি।

বিশ্লেষণ:

গড়ে তিস্তা নদী প্রতিবছর ২৫ থেকে ৬০ বিলিয়ন ঘনমিটার (বিসিএম) পানি বহন করে। ১৯৬৮ সালের ঐতিহাসিক বড় বন্যায় ১৯,০০০ ঘনমিটার/সেকেন্ড পানি বহন করা হয়েছিল। এই হারে ১৯৬৮ সালের বন্যা মাত্র এক দিনে মোট ১,৬৩৪,০০০,০০০ ঘনমিটার (১.৬ বিসিএম) পানি বহন করত। টিআরসিএমআরপির অধীন খনন করা তিস্তা নদীর মোট পানি বহন ক্ষমতা হবে প্রায় ৩১৩ মিলিয়ন ঘনমিটার (কাউনিয়ার উজানে ৬০ কিমি *৭০০ মিটার* ২.৮ মিটার এবং কাউনিয়া থেকে নিম্ন অংশে ৪২ কিমি *১,০০০ মিটার* ৩.৩ মিটার; উপরন্তু নদীর পুরো দৈর্ঘ্যের স্কাউয়ারিং চ্যানেলের আয়তন ১০২ কিমি দৈর্ঘ *৩০০ মিটার প্রস্থ* ১.৯ মিটার গভীর)। খননকৃত খালের ধারণক্ষমতা ১৯৬৮ সালে এক দিনের বন্যার প্রবাহে যে পরিমাণ পানি বহন করা হয়েছিল তার মাত্র ২০ শতাংশ। ৫০ বছরের বন্যা প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ১০,৬৮০ ঘনমিটার/সেকেন্ড বা ৩৮,৪৪৮,০০০ ঘনমিটার পানি বহন করে, যার অর্থ হলো খননকৃত খালটি তীরবর্তী পর্যায়ে পৌঁছানোর আগে প্রায় ৮ ঘণ্টা বন্যার পানি ধরে রাখার ক্ষমতা রাখে। তিস্তার মতো বৃহৎ অববাহিকায় বন্যা সাধারণত এক দিনের বেশি স্থায়ী হয়। ১৯৬৮ সালের ধরনের বন্যার কয়েক ঘণ্টা পর খননকৃত খালটি ডুবে যাবে এবং নদীটি পুনরুদ্ধারকৃত এলাকার প্লাবনভূমিতে ছড়িয়ে পড়বে। অন্য কথায়, ১৯৬৮ সালের তীব্র বন্যা বা ৫০ বছরকালীন বন্যার সময় খননকৃত খালটি এক দিনের জন্যও বন্যার পানি ধারণ করতে সক্ষম হবে না।

FSFR-তে দেখানো মডেল সিমুলেশন ফলাফল অনুসারে, ২ বছরের বন্যা এবং ৫০ বছরের বন্যার জন্য নকশা প্রকল্পে গ্রোইনের উজানে বন্যার সময় পানিপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে (পৃষ্ঠা: ১০৯-১১৮)। FSFR-এর বিকল্প ২ (গৃহীত বিকল্প) অনুসারে,

‘প্রকল্পের পরে মহিপুর ঘাট সেতুর উজানে পৌঁছানো পানির স্তর কিছু এলাকায় বৃদ্ধি পাবে এবং অন্যান্য এলাকায় হ্রাস পাবে এবং পানির স্তরের সর্বাধিক বৃদ্ধি ০.৫ মিটার। মহিপুর ঘাট সেতু এবং কাউনিয়া সেতুর মধ্যে সমস্ত ক্রস-সেকশনে পানিস্তর বৃদ্ধি পাবে এবং সর্বাধিক বৃদ্ধির পরিমাণ হবে ১.০৬ মিটার (পৃষ্ঠা: ৮১)।’

চরবাসী এবং পুনরুদ্ধারকৃত জমিতে বসবাসকারী মানুষের জন্য ১.০৬ মিটার পর্যন্ত পানির স্তর বৃদ্ধি যথেষ্ট পরিমাণে বেশি এবং আশঙ্কাজনক। অন্য কথায়, যদিও প্রস্তাবিত লক্ষ্যগুলোর মধ্যে একটি হলো তিস্তা মহাপরিকল্পনায় বন্যার বিপর্যয় হ্রাস করা, এটি স্পষ্ট যে প্রকল্প বাস্তবায়নের পর বন্যা পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।

গ্রোইন নির্মাণের পাশাপাশি, FSFR তিস্তা নদীর উভয় তীরে বাঁধ বা লেভি নির্মাণেরও প্রস্তাব করেছে। বিদ্যমান ৭৯.৬ কিলোমিটার (বাম ও ডান তীরে যথাক্রমে ৫৬.৮ কিলোমিটার এবং ২২.৮ কিলোমিটার) বাঁধ ছাড়াও মোট ১২৪.২ কিলোমিটার (বাম তীরে ৪৬.৪ কিলোমিটার এবং ডান তীরে ৭৭.৮ কিলোমিটার) নতুন বাঁধ নির্মাণ করা হবে। গৃহীত বিকল্প ২ অনুযায়ী বাম ও ডান তীরের বাঁধের মধ্যে দূরত্ব হবে প্রায় ২.২ কিলোমিটার থেকে ৪.৬ কিলোমিটার এবং গড় দূরত্ব হবে প্রায় ২.৮ কিলোমিটার (পৃষ্ঠা: ৭৯)। প্রস্তাবিত পুনরুদ্ধারকৃত জমির বেশিরভাগই ২ বছরের বন্যার স্তরের নিচে থাকবে (চিত্র: ২)। অন্যকথায়, পুনরুদ্ধারকৃত জমির বেশিরভাগই বড় বন্যার কবলে পড়বে। এটা ভালো যে বাঁধগুলোর মধ্যে দূরত্ব তুলনামূলকভাবে বেশি (২.৮ কিমি), যা বন্যার সময় নদীর পানি দুটি বাঁধের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে সাহায্য করবে এবং এর ফলে পরিকল্পিত চ্যানেলের মধ্যে বন্যার তীব্রতা হ্রাস পাবে; তবে প্রকল্পের প্রাথমিক দাবি অনুসারে, পুনরুদ্ধারকৃত জমির বেশিরভাগ এবং বাঁধের ভেতরের এলাকা (বাঁধ এবং নদীপাড়ের মধ্যের এলাকা) বন্যার হাত থেকে সুরক্ষিত থাকবে না। FSFR দাবি করে যে ‘প্রস্তাবিত প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে, বন্যা নিয়ন্ত্রণে আসবে এবং বন্যার দুর্যোগ প্রশমিত হবে (পৃষ্ঠা: ১৫২)।’ উপরের বিশ্লেষণে যেমন দেখানো হয়েছে, এই দাবিটি তথ্য এবং পানিবিদ্যুৎ ধারণা দ্বারা প্রমাণিত নয়।

FSFR দাবি করে যে ‘প্রস্তাবিত প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে, বন্যা নিয়ন্ত্রণে আসবে এবং বন্যার দুর্যোগ প্রশমিত হবে (পৃষ্ঠা: ১৫২)।’ উপরের বিশ্লেষণে যেমন দেখানো হয়েছে, এই দাবিটি তথ্য এবং পানিবিদ্যুৎ ধারণা দ্বারা প্রমাণিত নয়।

চিত্র-২: তিস্তার এপাড়-ওপাড় বরাবর সাধারণ প্রস্থচ্ছেদ (FSFR-এর পৃষ্ঠা ১০০)

(গ) নদীতীর ভাঙন কমানো:

তিস্তা মহাপরিকল্পনার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হলো নদীর তীর ভাঙন কমানো। FSFR ৫০টি নতুন গ্রোইন নির্মাণ এবং সংকীর্ণ চ্যানেলের উভয় পাশে ১৫টি বিদ্যমান গ্রোইন বজায় রাখার প্রস্তাব করেছে (পৃষ্ঠা: ২ ও ১০৮)। তিস্তা মহাপরিকল্পনা প্রকল্প অনুযায়ী নদীর তীর থেকে আড়াআড়িভাবে নদীর ভেতর গ্রোইন নির্মাণ করে নদীর তীর ভাঙন কমানোর পরিকল্পনা করছে। ১০২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যে মোট ৬৫টি গ্রোইন থাকবে। FSFR (পৃষ্ঠা: ৯৫) অনুসারে, ‘এই গ্রোইনগুলোর দৈর্ঘ্য সাধারণত নদীর প্রস্থের এক-পঞ্চমাংশের বেশি হয় না।’ যেহেতু নদীর প্রস্থ ৭০০ মিটার থেকে ১,০০০ মিটারে কমিয়ে আনা হবে, তাই গ্রোইনগুলোর দৈর্ঘ্য ১৪০ মিটার থেকে ২০০ মিটারের মধ্যে হওয়া উচিত। সেই মোতাবেক, ‘গ্রোইনগুলোর মধ্যের দূরত্ব তার দৈর্ঘ্যের ২-৩ গুণ (পৃষ্ঠা: ৯৫)।’ এই হারে নদীর উভয় তীরে প্রতি ২৮০-৪০০ মিটার অন্তর গ্রোইন তৈরি করা উচিত। তবে FSFR প্রতি ৩-৩.৫ কিমি বা ৩,০০০-৩,৫০০ মিটার অন্তর গ্রোইন তৈরির প্রস্তাব করেছে (পৃষ্ঠা: ৯৫)। এত বড় ব্যবধানে নির্মিত এই গ্রোইনগুলো অকার্যকর প্রমাণিত হবে।

FSFR এই সত্যটি তুলে ধরেছে যে তিস্তা ব্যারাজ, মহিপুর ঘাট সেতু, কাউনিয়া সেতুতে তিস্তা নদীর প্রস্থ ৭০০ মিটারের কাছাকাছি। যেহেতু ‘প্রকৌশলগত অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে কয়েক দশক ধরে প্রকল্পের এলাকাধীন নদীটি সর্বদা স্থিতিশীল থাকে, তাই কাউনিয়া সেতুর উজানের মূল চ্যানেলের প্রস্থ প্রায় ৭০০ মিটার (পৃষ্ঠা: ৭০)’ হিসাবে নির্ধারিত করা হয়েছে।

বিশ্লেষণ:

গ্রোইনগুলো সাধারণত তীরবর্তী স্রোতের কারণে সৃষ্ট সমুদ্রের উপকূলীয় ক্ষয়কে প্রতিরোধ করতে ব্যবহৃত হয়। উপকূলের দীর্ঘ তীরবর্তী স্রোতের প্রবাহ বড় বড় নদীর তুলনায় কম। গ্রোইনের ভাটির প্রান্তে পলির ক্ষয় খুবই সাধারণ (চিত্র: ৩)। বৃহৎ নদীগুলোর জন্য নদীর তীরবর্তী ক্ষয় কমাতে গ্রোইন ব্যবহার করা খুব একটা দেখা যায় না। কারণ, তাদের প্রবাহ বেগ তুলনামূলকভাবে বেশি। উদাহরণস্বরূপ, FSFR-এ ব্যবহৃত কম্পিউটার মডেলিং নির্দেশ করে যে নদীর প্রবাহ ২ মিটার/সেকেন্ডের মধ্যে থাকবে (পৃষ্ঠা: ১১৬), যা প্রতিটি গ্রোইনের ভাটির দিকে বালি এবং নুড়িজাতীয় পলির তীব্র ক্ষয় ঘটাতে যথেষ্টভাবে সক্ষম।

প্রতিটি গ্রোইনের উজানে নদীর প্রবাহের বেগ হ্রাস পাবে, তবে প্রতিটি গ্রোইনের তাৎক্ষণিকভাবে ভাটির দিকে প্রবাহের বেগ বৃদ্ধি পাবে, যার ফলে দুটি গ্রোইনের মধ্যবর্তী স্থানে নদীর তীর ক্ষয় হবে। FSFR নির্দেশ করে যে মূল চ্যানেলের মাঝখানে এবং স্কাউয়ারিং চ্যানেলগুলোতে প্রবাহের বেগ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে (চিত্র: ৩)। বেগের এই বৃদ্ধির ফলে নদীর তীর বরাবর ক্ষয় বৃদ্ধি পাবে, যার ফলে নিচের চিত্র: ৩-এ দেখানো হয়েছে যে গ্রোইনের মধ্যে প্রধান চ্যানেলটি ক্ষয়ীভূত হয়ে প্রশস্ত হবে। FSFR আরও নির্দেশ করে যে

‘গ্রোইন নির্মাণের কারণে, নদীর চ্যানেলের বন্যা নিষ্কাশন ক্ষমতা হ্রাস পাবে, তবে অন্যদিকে, সংকুচিত অংশের কারণে বেগ বৃদ্ধি পাবে, যা নদীর তলদেশের ক্ষয়কে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে এবং প্রধান চ্যানেলের গভীরতা বৃদ্ধি করতে পারে (পৃষ্ঠা: ১৬৬)।’

যেহেতু এই রিপোর্টের ভাষামতে নদীর ক্ষয়, প্রবাহের বেগ বৃদ্ধি পাবে যা কিনা নদীর তীর ক্ষয় করবে এবং বাড়তি বন্যার সৃষ্টি করবে, তাহলে তারা কোন যুক্তি ব্যবহার করে গ্রোইন তৈরি করছে তা স্পষ্ট নয়।

চিত্র-৩: রাইন নদীর গ্রোইন দেখানো ছবি। প্রতিটি গ্রোইনের নিচের দিকে গ্রোইনের মধ্যে ব্যবধান এবং ক্ষয়ের অবস্থান লক্ষ করুন। এই ছবিতে, ছবির নিচ থেকে উপরে প্রবাহিত (উৎস: উইকিপিডিয়া)।
চিত্র-৪: ৫০ বছরের বন্যার জন্য তিস্তা ব্যারাজ এবং মহিপুর ঘাটের মধ্যবর্তী উপরের অংশের জন্য পরিকল্পিত চ্যানেলে সিমুলেটেড বেগের ফলাফল (পৃষ্ঠা: ১১৬)। উল্লেখ্য, নদীর মধ্য এবং নিম্নাংশের জন্যও বেগের একই রকম বৃদ্ধি লক্ষ করা যায় (পৃষ্ঠা: ১১৭)।

এটা ঠিক যে তিস্তা ব্যারাজ, মহিপুর ঘাট সেতু এবং কাউনিয়া সেতুতে নদীর প্রস্থ প্রায় ৭০০ মিটারের মধ্যে সীমাবদ্ধ। নদীর ওপর বেশিরভাগ সেতুই নদীর সংকীর্ণ অংশে নির্মিত হয় যাতে খরচ কমানো যায়। তবে এই স্থানগুলোতে প্রস্থ সংকীর্ণ হওয়ার ফলে তীব্র প্রবাহের সৃষ্টি হয়, যার ফলে প্রবাহের বেগ বৃদ্ধি পায় এবং সেতুর উজানে নদীর উভয় তীরে ভাঙন দেখা দেয়। নদীর তীরে ভাঙন কমাতে এই সেতুগুলোর চারপাশে বেশ কয়েকটি প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। চিত্র: ৫-এ দেখা যাচ্ছে, তিস্তা ব্যারাজ, মহিপুর ঘাট সেতু এবং কাউনিয়া সেতুর ভাটিতে প্রবাহের বেগ উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। যেহেতু বর্তমানে এই সেতুগুলোর উজানে নদীর প্রস্থ ৭০০ মিটারেরও বেশি, তাই বৃহত্তর ভেজা-পরিধি (wetted perimeter) এবং নদীর তলদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত পানির ঘর্ষণের কারণে প্রবাহের বেগ কিছুটা হ্রাস পায়। কাউনিয়া সেতুর উজানে নদীর পুরো দৈর্ঘ্যের জন্য যদি নদীর প্রস্থ ৭০০ মিটারে কমানো হয়, তাহলে উভয় পাশের নদীর তীরে প্রবাহের বেগ বৃদ্ধি পাবে এবং বিশেষ করে গ্রোইনগুলো মধ্যবর্তী এলাকায় নদীর তীরে ভাঙন দেখা দেবে।

এই বিশ্লেষণের আলোকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, নদীর গড় প্রস্থ ৩ কিলোমিটার থেকে ৭০০ মিটারে সংকুচিত করার ফলে প্রবাহের বেগ বৃদ্ধি পাবে, নদীর তীর ভাঙন বৃদ্ধি পাবে এবং এই সেতুগুলোর উজানে পানি জমার কারণে বন্যার তীব্রতা ও জলাবদ্ধতা বৃদ্ধি পাবে।

চিত্র-৫: প্রাকৃতিক পরিস্থিতিতে তিস্তা নদীর তীরে ৫০ বছরের বন্যার (P=২%) বেগের ফলাফল। তিস্তা ব্যারাজ, মহিপুর ঘাট সেতু এবং কাউনিয়া সেতুর ভাটিতে উচ্চতর বেগ (১.৮-২.০ মি/সেকেন্ড) লক্ষ্য করুন (সূত্র: FSFR, ২০২৩, পৃষ্ঠা: ১১০)।

তিস্তা মহাপরিকল্পনা হলো একটি মানব-কেন্দ্রিক নদী ব্যবস্থাপনার বাণিজ্যিক পন্থা যার মাধ্যমে ধরে নেওয়া হয় যে নদীকে একটি সংকীর্ণ খালের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা উচিত যাতে বন্যা এবং নদীর তীর ভাঙনের ফলে মানুষের কোনো ক্ষতি না হয়। এই পন্থাটি নদীর সক্রিয় প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া এবং নদীর পরিবেশগত পরিষেবাকে অস্বীকার করে (ইসলাম, ২০২০)। তবে মানুষের এ ধরনের অস্বীকৃতি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার শক্তি এবং প্রয়োজনীয়তাকে বাতিল করতে পারে না। একটি নদী, বিশেষ করে একটি বিনুনিযুক্ত নদী, যা পলিতে ভরা থাকে এবং প্রবাহিত পানির জন্য নদীর তীরের উভয় পাশে ছড়িয়ে পড়ার স্থান প্রয়োজন হয়, যেই স্থানকে বিনুনি সমভূমি বা প্লাবনভূমি বলা হয়। একটি বিনুনিযুক্ত নদী এবং দুই পাড়ের প্লাবনভূমি একে অপরের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য এবং দুইয়ের মধ্যে সহস্রাব্দ ধরে মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে একটি প্রাকৃতিক ভারসাম্য স্থাপিত হয়। নদীতে মানুষের হস্তক্ষেপ এবং দখল সেই সূক্ষ্ম ভারসাম্যকে নষ্ট করতে পারে। তিস্তা মহাপরিকল্পনার মতো যে কোনো নদী ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত প্রকল্প গ্রহণের সময় মানুষকে নদীতে ক্রিয়াশীল প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া এবং নদী দুই পাড়ের প্লাবনভূমির সঙ্গে যে প্রাকৃতিক ভারসাম্য স্থাপন করেছে সে সম্পর্কে ব্যবহারিক জ্ঞান থাকতে হবে। মানুষকে নদীর চাহিদা বুঝতে হবে এবং তাদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে বসবাস করতে শিখতে হবে।

তিস্তা মহাপরিকল্পনা হলো একটি মানব-কেন্দ্রিক নদী ব্যবস্থাপনার বাণিজ্যিক পন্থা যার মাধ্যমে ধরে নেওয়া হয় যে নদীকে একটি সংকীর্ণ খালের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা উচিত যাতে বন্যা এবং নদীর তীর ভাঙনের ফলে মানুষের কোনো ক্ষতি না হয়। এই পন্থাটি নদীর সক্রিয় প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া এবং নদীর পরিবেশগত পরিষেবাকে অস্বীকার করে।

যে কোনো কাঠামোগত প্রকল্প সফল হওয়ার জন্য মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির একটি আদর্শ পরিবর্তন প্রয়োজন। নদীর প্রাকৃতিক আচরণ নিয়ন্ত্রণ করার পরিবর্তে, মানুষের নদীর জন্য জায়গা ছেড়ে দেওয়া দরকার এবং নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহজনিত প্রক্রিয়ার সঙ্গে সাংঘর্ষিক জীবনযাত্রার পরিবর্তন করা গুরুত্বপূর্ণ। আখতার প্রমুখের একটি গবেষণা (২০১৯) এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, নদী পরিবর্তনের প্রবাহ পথে চ্যানেলে উচ্চ পলি জমার ফলে চ্যানেল স্থানান্তরের হারে সাময়িক পরিবর্তনগুলো বেশিরভাগই প্রভাবিত হয়েছিল; পক্ষান্তরে চ্যানেলের কিনারার স্থানিক পরিবর্তনগুলো মূলত নদীর তীরের পার্থক্য দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েছিল, যেমনটি বিভিন্ন গঠন দ্বারা প্রদর্শিত হয়েছিল। ১৯৭২-২০২০ সালে নদীর মধ্যে সাইনুসিটি (sinuosity), চর এলাকা এবং ব্রেডিং সূচক বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ব্যারাজ এবং পানি বাঁধ দ্বারা উজানে নিয়ন্ত্রণের কারণে প্রবাহের অনিশ্চয়তা বৃদ্ধির সঙ্গে সম্পর্কিত (বসু, ২০১৭)।

অটোরিগ্রেসিভ ইন্টিগ্রেটেড মুভিং এভারেজ (ARIMA) মডেলের ফলাফল ইঙ্গিত দেয় যে ২০১৭ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে সর্বাধিক মধ্য-রেখা চ্যানেল স্থানান্তর ডানদিকে (পশ্চিম দিকে) এবং ২০২৪ থেকে ২০৩১ সালের মধ্যে বাঁদিকে (পূর্ব দিকে) মধ্য-রেখা চ্যানেল স্থানান্তর ঘটবে (আখতার এবং অন্যরা, ২০১৯)। সাধারণভাবে তিস্তা নদী ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে পশ্চিমে দোয়ানি-ডিমলা, পূর্বে দোয়ানি-ডিমলা থেকে হাতিবান্ধা উপজেলা, পশ্চিমে হাতিবান্ধা থেকে গঙ্গাচড়া, পূর্বে গঙ্গাচড়া থেকে রাজারহাট-উলিপুর, উলিপুর থেকে পশ্চিমে পীরগাছা এবং পূর্বে পীরগাছা থেকে সুন্দরগঞ্জ পর্যন্ত সরে গেছে। মনে হচ্ছে নদীটি প্রবাহের পথে একটি বিস্তৃত সাইনুসিটি বজায় রেখেছে যার তরঙ্গদৈর্ঘ্য প্রায় ৫৫ থেকে ৬০ কিলোমিটার (ভিত্তিরেখা বা ঐতিহাসিক মধ্য-প্রবাহের অবস্থান থেকে নদীর তীরের পূর্ব বা পশ্চিম দিকে দুটি স্থানচ্যুতির মধ্যে দূরত্ব)। সহজাত বৃহৎ আকারের সাইনুসিটি নদীর অন্তর্নিহিত বল এবং প্রবণতার ইঙ্গিত দেয় যার জন্য বন্যার পর্যায়ে সর্বাধিক প্রবাহ এবং পলিপ্রবাহকে সামঞ্জস্য করার জন্য ব্রেইডপ্লেনের (বিনুনি-সমভূমি) যথেষ্ট প্রস্থের প্রয়োজন হয়। নদীর পানিতাত্ত্বিক প্রকৃতির জন্য প্রয়োজনীয় আকৃতি এবং প্রস্থকে সামঞ্জস্য করার জন্য নদীকে নিজের মতো চলতে দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ, যা আখেরে একটি সূক্ষ্ম ভারসাম্য স্থাপন করতে সাহায্য করে। নদীর তলদেশে পলি ক্ষয় এবং জমার ক্ষেত্রগুলো নির্ধারণ করার জন্য, বিভিন্ন সময় নির্দিষ্ট স্থানে নদীর প্রোফাইলের ক্রস-সেকশন (প্রস্থচ্ছেদ) জরিপের মাধ্যমে আরও হাইড্রোলজিক গবেষণা করা প্রয়োজন। নদীর তীর ক্ষয়ের অন্তর্নিহিত কারণগুলো নির্ধারণ না করা পর্যন্ত প্রকৌশল কাঠামো নির্মাণের মাধ্যমে নদীর প্রকৃতিগত কাঠামো পরিবর্তনে মানুষের হস্তক্ষেপ সফল হবে না।

নদীর তীরের উপকরণগুলো (বালু, নুড়ি) ক্ষয়প্রাপ্ত হয় যখন নদীর প্রবাহের বেগ সেই উপকরণগুলোকে ক্ষয় করার জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণের চেয়ে বেশি হয়। নদীর বেগ (V) নির্ভর করে নদীর প্রবাহের পরিমাণ (Q) (যা কিনা m3/সেকেন্ডে পরিমাপ করা হয়) এবং ক্রস-সেকশনাল এরিয়া (A) (যা m2 দ্বারা পরিমাপিত হয় যা কিনা নদীর গড় প্রস্থ এবং গভীরতার ওপর নির্ভর করে) এর ওপর। এগুলোর মধ্যেকার সম্পর্ক যে সমীকরণ অনুসরণ করে তা হলো: V = Q/A

বর্তমানে, তিস্তা নদীর গড় পানির গভীরতা প্রায় ৫ মিটার এবং গড় প্রস্থ প্রায় ৩ কিমি, যার ফলে ক্রস-সেকশনাল এরিয়া (A) 15,000 বর্গমিটার। অন্যদিকে নদীর উজানের (কাউনিয়ার উপরের) অংশ এবং নিচের অংশে তিস্তা মহাপরিকল্পনার অধীন খনন করা খালের ক্রস-সেকশনাল এরিয়া বা প্রস্থচ্ছেদ যথাক্রমে 3,860 বর্গমিটার এবং 5,770 বর্গমিটার হবে। তিস্তা নদীর গড় বার্ষিক প্রবাহ (Q) 4,083 ঘনমিটার/সেকেন্ডে পরিমাপ করা হয় (পৃষ্ঠা: 108)। উপরে বর্ণিত বেগ (V)-এর সমীকরণ অনুসারে, প্রাকৃতিক নদীর একটি ক্রস-সেকশনাল এরিয়া বা প্রস্থচ্ছেদ (A) দিয়ে প্রবাহিত পানিপ্রবাহের পরিমাণ (Q) হবে ২৬ সেমি/সেকেন্ড, যা তিস্তা নদীর তলদেশে বিদ্যমান বালি এবং নুড়ির ক্ষয়-বেগের চেয়ে সামান্য কম। অন্যদিকে তিস্তা মহাপরিকল্পনার অধীন খনন করা খালের প্রস্থচ্ছেদের এলাকা (৩,৮৬০ বর্গমিটার থেকে ৫,৭৭০ বর্গমিটার) দিয়ে প্রবাহিত পানিপ্রবাহের বেগ হবে ১০০ সেমি/সেকেন্ড (উপরের অংশের জন্য) থেকে ৭০ সেমি/সেকেন্ড (নিচের অংশের জন্য), যা প্রাকৃতিক নদীর বেগের চেয়ে অনেক বেশি। তিস্তা নদীর এই সর্বোচ্চ ঐতিহাসিক বন্যাপ্রবাহ রেকর্ড করা হয়েছে ১৯,০০০ বর্গমিটার/সেকেন্ড (রুদ্র, ২০০৩)। এ ধরনের প্রবাহের জন্য, ৫,৭৭০ বর্গমিটার (দোয়ানি-ডালিয়া থেকে কাউনিয়া পর্যন্ত নিম্নাংশের জন্য) ক্রস-সেকশনাল এলাকাসহ খননকৃত খালের বেগ ৩২০ সেমি/সেকেন্ডের বেশি হবে, যা প্রকৃতিগতভাবে ক্ষয়কারক হবে (চিত্র: ৬)। অন্য কথায়, তিস্তা মহাপরিকল্পনার অধীন সংকুচিত নকশাকৃত চ্যানেলের বেগ প্রাকৃতিক তিস্তা নদীর বর্তমান গড় প্রস্থের তুলনায় বৃদ্ধি পাবে। খননকৃত চ্যানেলে বেগের এই বৃদ্ধি বার্ষিক গড় প্রবাহ এবং ঐতিহাসিক বন্যাপ্রবাহের ঘটনা উভয় সময়েই নদীতে অবস্থিত বালু এবং নুড়ির জন্য ক্ষয়কারক বেগ অর্জন করবে।

হিউলস্ট্রম চিত্র (চিত্র: ৬) নদীতলের পদার্থের ক্ষয়ক্ষতির জন্য প্রয়োজনীয় বেগ এবং কণার আকারের মধ্যে সম্পর্ক দেখায়। উদাহরণস্বরূপ, তিস্তা নদীর তলদেশের উপকরণগুলোতে বালি এবং নুড়ি রয়েছে যার কণার আকার ০.১ থেকে ৩ মিমি পর্যন্ত। চিত্র থেকে এটি স্পষ্ট যে ২৬ সেমি/সেকেন্ডের বেশি বেগের ফলে তিস্তা নদীর তলদেশের উপাদানগুলোর ক্ষয় হবে। প্রাকৃতিক তিস্তা নদীতে গড় বার্ষিক প্রবাহের বেগ বালি এবং নুড়ির ক্ষয়ক্ষতির বেগের চেয়ে কম, তবে খনন করা খালের বেগ তিস্তা নদীর তলদেশের উপাদানগুলোর জন্য ক্ষয়ক্ষতির বেগ হবে। অন্য কথায়, ১৯৬৮ সালের মতো গড় এবং ঐতিহাসিক বন্যাপ্রবাহের ঘটনাগুলোর সময় খনন করা খালের ফলে প্রাকৃতিক নদীর তুলনায় উচ্চ প্রবাহ-বেগ হবে এবং নদীর তীর ভাঙনের কারণ হবে। গঙ্গা (৮০০ টন/বর্গকিমি) এবং যমুনা (১,০০০ টন/বর্গকিমি) নদীর তুলনায়, তিস্তা বারিপাত অঞ্চলে প্রতি একক এলাকায় প্রতিবছর সর্বোচ্চ পরিমাণে পলি (৩,২০০ টন/বর্গকিমি) উৎপন্ন করে (শি এট আল., ২০১৯; রহমান এট আল., ২০১৮; ফিশার এট আল., ২০১৭)। এই পলি উচ্চ প্রবাহের সময় নদীর তীরে ‘বালির শিরিশ কাগজ’ হিসেবে কাজ করে, যার ফলে নদীর তীর ভাঙন এবং প্রশস্ততা বৃদ্ধি পায়।

লক্ষণীয় যে বিশ্বের অন্যান্য নদীর মতো নয়, তিস্তা নদীতে প্রবাহে উচ্চমাত্রার তারতম্য দেখা যায়। শেখ এবং অন্যান্য (২০১৫) এর দ্বারা পরিচালিত গবেষণার মতে, তিস্তা নদীর প্রায় ৭০ শতাংশ বৃষ্টিপাত এবং প্রবাহ বর্ষা মৌসুমে (জুন-আগস্ট) ঘটে। তিস্তা নদীর গড় প্রস্থ ৩ কিমি এবং বিনুনি প্রকৃতি সর্বোচ্চ প্রবাহের ওপর নির্ভর করে; গড় প্রবাহ, নদীতে বিদ্যমান শক্তি ব্যবস্থা এবং নদী দ্বারা বাহিত পলিপ্রবাহের পরিমাণের ওপর নয়। যেহেতু তিস্তা নদী তার আকারের তুলনায় অস্বাভাবিকভাবে বেশি পরিমাণে পলি বহন করে, তাই সম্ভবত সংকীর্ণ পরিকল্পিত চ্যানেলটি পলির পরিমাণ দ্বারা পরিপূর্ণ হয়ে যাবে এবং চ্যানেলের মধ্যে বালির চর তৈরি করবে, যার ফলে পানি বহন ক্ষমতা হ্রাস পাবে। পরিকল্পিত চ্যানেলটি নাব্যতা বজায় রাখার জন্য ক্রমাগত খনন করতে হবে।

FSFR ইঙ্গিত দেয় যে প্রকল্পটি সম্পন্ন হওয়ার পর রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিং করতে হবে; তবে এটি পলি ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা সম্পর্কে বিশদ বিবরণ দেয় না। তিস্তা নদী প্রতিবছর প্রায় ৪৯ মিলিয়ন টন পলি বহন করে, যার পরিমাণ প্রায় ২৭ মিলিয়ন ঘনমিটারের সমান (পলির ঘনত্ব ১৮০০ কেজি/ঘনমিটার বিবেচনা করে)। পলির এই পরিমাণ প্রকল্পের জন্য মোট খনন করা পলির (১৯১ মিলিয়ন ঘনমিটার) ১৪ শতাংশ। অন্যভাবে বলা যায়, যদি সমস্ত পলি নদীর তলদেশে জমা করা হয়, তাহলে খনন করা চ্যানেলটি ভরাট হয়ে যেতে মাত্র সাত বছর সময় লাগবে। যেহেতু সব পলিই বেডলোড (তলদেশে গড়িয়ে চলা বালু-নুড়ি) হিসেবে আসে না এবং যেহেতু সব পলি নদীর তলদেশে জমাও হবে না, তাই খনন করা চ্যানেলটি ভরাট করতে তার চেয়ে বেশি সময় লাগবে, তবে স্কাউয়ারিং চ্যানেল এবং প্রধান চ্যানেলের নাব্যতা বজায় রাখার জন্য প্রতিবছর ব্যয়বহুল ড্রেজিং করতে হবে।

FSFR আরও ইঙ্গিত করে যে ‘প্রয়োজনীয় হিসেবে প্রধান চ্যানেলটি ড্রেজিং করা উচিত (পৃষ্ঠা: ১৬৭)।’ এটি জেনে খুব স্বস্তিদায়ক হতে পারে না যে ভবিষ্যতে ক্রমাগত ড্রেজিং প্রকল্পের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হবে। যদি এটি হয়, তাহলে প্রকৃতি যেমনটি চেয়েছিল তেমনভাবে নদীর বিনুনিযুক্ত প্রকৃতি বজায় রাখা এবং তীব্র নদীতীর ভাঙনের জায়গাগুলো খুঁজে বের করা এবং দেশীয় পদ্ধতি এবং জিও-ব্যাগ প্রযুক্তি ব্যবহার করে এ ধরনের ভাঙন কমানোর চেষ্টা করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

চিত্র-৬: হিউলস্ট্রম চিত্রটি নদীতে বিদ্যমান বালু/নুড়ি কণার আকার এবং এ-জাতীয় পদার্থের ক্ষয়-বেগের মধ্যে সম্পর্ক প্রদর্শন করে। লক্ষ্য করুন যে, তিস্তা নদীর তলদেশে বালি এবং নুড়ি ক্ষয়ের জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষয়-বেগ ২৬ সেমি/সেকেন্ডের (সবুজ বিন্দুযুক্ত রেখা) বেশি, যা টিআরসিএমআরপি প্রকল্পের অধীন ড্রেজ করা খালে গড় বার্ষিক প্রবাহ (৭০ এবং ১০০ সেমি/সেকেন্ড) এবং ঐতিহাসিক বন্যাপ্রবাহ (২৮২ সেমি/সেকেন্ড) সময় লাল বিন্দুযুক্ত রেখা দিয়ে দেখানো হয়েছে। হিউলস্ট্রম চিত্রটি কুনাকা (২০২০) থেকে পরিবর্তিত।

তিস্তা নদীর তলদেশীয় উপাদানগুলো বালি ও নুড়ি দিয়ে তৈরি যার প্রাকৃতিক স্থিতি-কোণ (angle of repose) ২৫ থেকে ৩০ ডিগ্রি (বোব্রোস্কি এবং মার্কার, ২০১৮)। যদি নদীর প্রস্থ ৫ কিমি থেকে ১ কিমি বা তার কম হয়, তাহলে নদীর তীরের ঢাল অনেক বেশি খাড়া হবে, সম্ভবত ৬০ ডিগ্রি হতে পারে। এ ছাড়াও মূল চ্যানেলের মধ্যে থাকা স্কাউয়ারিং চ্যানেলগুলোর উল্লম্ব দেয়াল (৯০-ডিগ্রি ঢাল) থাকবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নদীর তীরের উপাদানগুলো তাদের প্রাকৃতিক ঢাল ২৫ থেকে ৩০ ডিগ্রির স্থিতি-কোণ এর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেবে। এটি করার ফলে নদীর তীর ক্ষয় এবং প্রশস্তকরণের মধ্য দিয়ে প্রাকৃতিক বিশ্রাম কোণে পৌঁছাবে। ফলস্বরূপ, নদীর তীরের ক্ষয় এবং প্রশস্তকরণ সম্ভবত ত্বরান্বিত হবে এবং কিছু সময় পর নদীর তীরে নির্মিত বাঁধগুলোকে হুমকির মুখে ফেলবে।

FSFR উল্লেখ করেছে যে নদীর তীরের ভাঙন কমাতে তিস্তা নদীর তীরে অনেক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, যার বেশিরভাগই ইতঃপূর্বে অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছে (পৃষ্ঠা: ১৬৬)। যদি অতীতে একই ধরনের কাঠামোগত ব্যবস্থা (বাঁধ, গ্রোইন, গ্রসবার, লেভি ইত্যাদি) নদীর তীরের ভাঙন এবং বন্যা কমাতে ব্যর্থ হয়, তাহলে এই প্রকল্পের জন্য একই ধরনের কাঠামো কার্যকর হওয়ার কী নিশ্চয়তা আছে?

() পানি সংরক্ষণ, সেচ এবং নাব্যতা বৃদ্ধি:

FSFR খননকৃত চ্যানেলে বেশ কয়েকটি যাত্রী এবং মালবাহী টার্মিনাল নির্মাণের প্রস্তাব করেছে। তিস্তা মহাপরিকল্পনার একটি প্রধান লক্ষ্য হলো তিস্তা নদীর ভূপৃষ্ঠের পানি ব্যবহার করে সেচের পরিধি সম্প্রসারণ করা। এ ছাড়াও FSFR দাবি করে যে ‘প্রস্তাবিত প্রকল্পটি সেচের জন্য ভূপৃষ্ঠের জলের প্রাপ্যতা বৃদ্ধি করবে বলে আশা করা হচ্ছে; সেচ এলাকাও সম্প্রসারিত হবে (পৃষ্ঠা: ১৫৩)।’

জলাধার এবং নাব্যতা বৃদ্ধির বিশ্লেষণ:

চিলমারীতে বাঁধের মতো পানি ধারণ কাঠামো নির্মাণ ছাড়া, মূল চ্যানেলের পানি সম্ভবত শুষ্ক মৌসুমে ব্রহ্মপুত্র নদে প্রবাহিত হয়ে যাবে। FSFR-তে এ ধরনের কাঠামো নির্মাণের বিষয়ে কোনো আলোচনা নেই। তবে যদি এ ধরনের কাঠামো তৈরি করা হয়, তাহলে ব্রহ্মপুত্র নদে যাতায়াত এবং নদীপথে অবাধ যাতায়াতের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করবে। উপরন্তু নদী দ্বারা বাহিত কিছু পলি এ ধরনের বাঁধের পেছনে জমা হবে, যা বাঁধের পেছনের জলাধারটি পূরণ করবে। অভ্যন্তরীণ নদীগুলোর ওপর বেশিরভাগ বাঁধ পলি জমা করে। যদি মোট পলির ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ (৪৯ মেগাটন বা ৪৯ বিলিয়ন কেজি ১৮০০ কেজি/ঘনমিটার ঘনত্ব = ২৭ মিলিয়ন ঘনমিটার) বাঁধের পেছনে জমা হয়, তাহলে চিলমারী থেকে কাউনিয়া (৪০ কিমি *১,০০০ মি* ৫.২ মি = ২০৮ মিলিয়ন ঘনমিটার) পর্যন্ত খনন করা খালটি পূরণ করতে প্রায় ১৫ থেকে ৩০ বছর সময় লাগবে। এ ছাড়াও চিলমারীতে একটি বাঁধ তৈরি হলে উজানের স্থানে বন্যা পরিস্থিতি এবং জলাবদ্ধতা আরও খারাপ হতে পারে।

পূর্ববর্তী অংশে আলোচনা করা সংকুচিত খালে নদীর তীর ভাঙনের কারণে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের পর নদীতে পলির পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পলিপ্রবাহের এই বৃদ্ধি বাঁধের পেছনে পলি জমা ত্বরান্বিত করবে, যার ফলে খনন করা খালটি ক্রমাগত খনন করা না হলে ১৫ থেকে ৩০ বছরের আগেই ভরাট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

প্রস্তাবিত স্কাউয়ারিং চ্যানেলের গভীরতা প্রায় ৫.২ মিটার, যা প্রাকৃতিক নদীর গড় গভীরতার চেয়ে মাত্র ২০ সেমি গভীর। প্রস্তাবিত টার্মিনাল এবং নৌচলাচলকে এত অগভীর গভীরতা কীভাবে সমর্থন করতে সক্ষম হবে তা স্পষ্ট নয়।

সেচ বৃদ্ধির সম্ভাবনার বিশ্লেষণ:

বাংলাদেশে গড়ে ১২০ দিনের চাষের মৌসুমে এক কেজি ধান উৎপাদনের জন্য ৩,০০০ লিটার পানি প্রয়োজন হয় (শহিদ, ২০০৭)। প্রতি হেক্টরে গড়ে ধান উৎপাদন হয় ৫.৫ টন বা ৫,৫০০ কিলোগ্রাম (স্যাটার, ১৯৯৮)। এই হারে ধান চাষের মৌসুমে ১.৬৭ মিটার গভীর পানি প্রয়োগ করতে হবে, যা প্রতি হেক্টরে ১৬,৭০০ ঘনমিটার পানির সমান। তিস্তা নদীতে শুকনো মৌসুমে গড় প্রবাহ ৫০০ কিউসেক বা ১৫ ঘনমিটার/সেকেন্ডের কম। বোরো ফসল চাষের মৌসুমে ১২০ দিন (১০,৩৬৮,০০০ সেকেন্ড) ধরে, তিস্তা নদী ১৫,৫০০,০০,০০০ ঘনমিটার পানি বহন করে, যা ১৬,৭০০ ঘনমিটার/হেক্টর হারে প্রায় ৯,৩১২ হেক্টর জমির জন্য উপযুক্ত।

যদি বাংলাদেশ সরকার ভারতের সঙ্গে একটি চুক্তির মাধ্যমে প্রায় ১০০ কিউমেক (৩,৫০০ কিউসেক) পানির নিশ্চয়তা পায়, তাহলে ১২০ দিনের শুষ্ক মৌসুমে উজান থেকে মোট ১,০৩৬,৮০০,০০০ ঘনমিটার (প্রায় ১ বিসিএম) পানি বাংলাদেশে প্রবাহিত হবে, যা ৬২,০০০ হেক্টর বোরো ফসল সেচের জন্য পর্যাপ্ত হবে; কিন্তু সেই ক্ষেত্রে পরিবেশগত প্রবাহ হিসাবে নদীতে কোনো পানি অবশিষ্ট থাকবে না। তা ছাড়া যদি ভারতের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে যুক্তিসংগত পরিমাণে পানি নিশ্চিত করা যায়, তাহলে তিস্তা সেচ প্রকল্পের (টিআইপি) জন্য দোয়ানি-ডালিয়া ব্যারাজেই সেই পানি ধরে রাখা হবে এবং টিআরসিএমআরপির অধীন পরিকল্পিত মূল চ্যানেলে কোনো বাড়তি পানি পৌঁছানোর সম্ভাবনা নেই।

একটি সংবাদ প্রতিবেদন অনুসারে, টিআরসিএমআরপি বাস্তবায়িত হলে প্রায় ৬০০,০০০ হেক্টর জমি সেচের আওতায় আসবে (ইসলাম, ২০২১)। উপরে প্রদত্ত হিসাব অনুযায়ী, ৬০০,০০০ হেক্টর জমি সেচের জন্য ১০,০০০,০০০,০০০ ঘনমিটারেরও (১০ বিসিএম) বেশি পানির প্রয়োজন হবে, যার অর্থ হলো এই পরিমাণ সেচ এলাকার জন্য বোরো ফসল উৎপাদনের মৌসুমে ভারত থেকে প্রায় ১,০০০ কিউমেক (৩৫০,০০০ কিউসেক) পানি বাংলাদেশে প্রবাহিত হতে হবে। এই পরিমাণ পানি কেবল বর্ষাকালে (জুন-আগস্ট) তিস্তায় প্রবাহিত হয়। উল্লেখ্য, ১৯৯৬-১৯৯৯ সালে তিস্তা নদীতে সর্বনিম্ন গড় প্রবাহ ছিল প্রায় ৪০ কিউমেক (ইসলাম, ২০২০)। ২০১৬ সালে, শুষ্ক মৌসুমে প্রবাহ কমে ৮.৫ কিউমেকে দাঁড়িয়েছিল। ভারত ৯,২০,০০০ হেক্টর জমিতে সেচের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, কিন্তু রুদ্র (২০০৩) অনুসারে, ২০০১ সালে মাত্র ১২৬,১১০ হেক্টর জমিতে সেচের ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

একইভাবে যদিও টিআইপির অধীন সেচের প্রাথমিক লক্ষ্যমাত্রা ৭৫০,০০০ হেক্টর নির্ধারণ করা হয়েছিল, তবুও সর্বোচ্চ অর্জন হয়েছে মাত্র ১১১,০০০ হেক্টর। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, বাংলাদেশের টিআইপিতে ১,১১,০০০ হেক্টর সেচযোগ্য জমির বেশিরভাগই পানির অভাবে বর্ষা মৌসুমে চাষের অযোগ্য থাকে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৩-১৪ সালে মোট সেচযোগ্য এলাকার মাত্র ৩৫ শতাংশ চাষ করা হয়েছিল (রয়, ২০২০)। টিআইপি (বাংলাদেশ তিস্তা সেচ প্রকল্প) প্রায় ২৮৩ কিউমেক (১০,০০০ কিউসেক) সর্বোচ্চ জলের প্রাপ্যতার ওপর ভিত্তি করে ডিজাইন করা হয়েছিল। টিআইপি এবং টিবিপি (ভারতের তিস্তা সেচ প্রকল্প) উভয়ই অতি উচ্চাকাঙ্ক্ষী সেচ প্রকল্প (দিলশাদ ও অন্যান্য, ২০১৭)। বসু (২০১৭) রিপোর্ট করেছেন যে এই দুটি প্রকল্পের লক্ষ্যমাত্রা ১,৬৭০,০০০ হেক্টর সেচ এলাকা, যার জন্য শুষ্ক মৌসুমে (জানুয়ারি-এপ্রিল) তিস্তা নদীতে কমপক্ষে ১,৬০০ কিউমেক (৫৬,৫০০ কিউসেক) প্রবাহের প্রয়োজন হবে। গজলডোবা ব্যারাজে ডাইভারশনের আগে, দোয়ানি-ডালিয়ায় শুষ্ক মৌসুমে গড় প্রবাহ ১০০ থেকে ৩৫০ কিউমেকের মধ্যে ছিল (মুলিক ও অন্যরা, ২০১০)। বসু (২০১৭) অনুসারে, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের একটি অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে শুষ্ক মৌসুমে, তিস্তা নদীতে প্রয়োজনীয় পানির প্রায় এক-ষোড়শ (১,৬০০ কিউমেক) (পশ্চিমবঙ্গের এই অংশে বসবাসকারী বেশিরভাগ মানুষের প্রধান জীবিকা) ধান চাষের জন্য প্রয়োজনীয় পানি থাকে। তবে ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা কী এবং এই লক্ষ্যমাত্রাযুক্ত অঞ্চলগুলো কোন বারিপাত অঞ্চলে অবস্থিত তা স্পষ্ট নয়। পশ্চিমবঙ্গের তিস্তা নদীর পানি অন্যান্য বারিপাত অঞ্চলে (মহানন্দা-পুনর্ভবা-মেচি) স্থানান্তর করা ভূপৃষ্ঠের অববাহিকা কিংবা বারিপাত-ভিত্তিক পানি ব্যবস্থাপনার আন্তর্জাতিক নিয়ম লঙ্ঘন। এটি উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ভালো বাস্তুতন্ত্র বজায় রাখার জন্য তিস্তা নদীর ন্যূনতম পরিবেশগত প্রবাহ কমপক্ষে ৯০ কিউমেক হওয়া উচিত (মুলিক ও অন্যরা, ২০১০)। যদি পরিবেশগত প্রবাহ প্রস্তাবিত পদ্ধতি অনুসারে বজায় রাখা হয়, তাহলে সেচের উদ্দেশ্যে উত্তোলনের জন্য নদীতে খুব কমই পানি থাকবে, এমনকি যদি শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশের জন্য ১০০ কিউমেক (৩,৫০০ কিউসেক) জলের নিশ্চয়তা দেওয়ার জন্য পানিবণ্টন চুক্তিও হয়।

এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ভূ-উপরিস্থ পানির প্রাপ্যতা বৃদ্ধি পাবে এবং সেচ এলাকা বৃদ্ধি পাবে–এই ধারণাকে সমর্থন করে এমন কোনো উল্লেখযোগ্য তথ্য বা প্রমাণ FSFR-তে নেই। যদি ভারত শুকনো মৌসুমে অতিরিক্ত পানি না ছাড়ে, তাহলে মূল খাল খনন বা খনন করে অতিরিক্ত পানি উৎপন্ন করা যাবে না। খননকৃত খালের তলায় যে পানি দেখা যাবে তা আসলে নদীর উভয় পাশের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর থেকে আসবে। ভূগর্ভস্থ পানি অতিরিক্ত কোনো ভূ-উপরিস্থ পানির জোগান দেবে না। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কারণে এমন কোনো অতিরিক্ত এলাকা সেচ করা যাবে না যেখানে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার না করে সেচ করা অসম্ভব।

(ঙ) শিল্প ও নগর কমপ্লেক্স স্থাপনের জন্য জমি পুনরুদ্ধার করা:

তিস্তা একটি জটিল বিনুনিযুক্ত নদী ব্যবস্থা যার বেশ কয়েকটি উপনদী এবং শাখা নদী রয়েছে (চক্রবর্তী এবং ঘোষ, ২০১০)। ওয়াদুদ (২০২১)-এর একটি ক্ষেত্র-ভিত্তিক সমীক্ষা তিস্তা নদীর অসংখ্য উপনদী এবং শাখার অস্তিত্বের কথা জানায় যেগুলোর মধ্যে রয়েছে শানিয়াজান, পানাকুরা, নাউতারা, কুমলাল, ধুম, বুড়ি তিস্তা, আউলিয়াখান, কালিবাড়ি, সতী, স্বর্ণমতী, ভেটেশ্বর, কোটেশ্বর, আলমায়ারা, মরা তিস্তা, শ্যামা সুন্দরী, শালমারা, আলাই, মানস, বুড়িয়াল ও বৈশাদরা (চিত্র: ৭)। তিস্তা মহাপরিকল্পনার অধীন এই উপনদী এবং শাখা নদীগুলোর ভাগ্য অনিশ্চিত৷ চায়না পাওয়ার (২০২০), পিপিডিপি (বিডব্লিউডিবি, ২০১৯) এবং FSFR কর্তৃক প্রদত্ত প্রচারণামূলক উপকরণ থেকে দেখা যাচ্ছে যে, এই উপনদী এবং শাখা নদীগুলোর বেশিরভাগই সম্ভবত বাঁধ এবং নিয়ন্ত্রকদের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হবে এবং মূল তিস্তা নদী ব্যবস্থার একটি সমন্বিত অংশ হবে না। বন্যার সময় নদীর প্রবাহ তার উপশাখা নদী এবং শাখা নদীগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে, যার ফলে মূল নদীতে বন্যার প্রবণতা হ্রাস পায়। তিস্তা মহাপরিকল্পনার অধীনে মূল নদী এবং এর মধ্যে সংযোগ হ্রাস পাওয়ার কারণে বন্যা তীব্র হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পুনরুদ্ধারকৃত জমি তিস্তা নদীর সক্রিয় বন্যাপ্রবাহ অঞ্চলে থাকবে এবং সম্ভবত বন্যার ক্ষতির ঝুঁকিতে থাকবে। পূর্ববর্তী বিভাগে আলোচনা করা ক্রমবর্ধমান ভাঙন শক্তির কারণে পুনরুদ্ধারকৃত অঞ্চলগুলো ক্রমাগত সংকুচিত খাল দ্বারা গ্রাস হওয়ার ঝুঁকিতে থাকবে।

তিস্তা মহাপরিকল্পনার অধীন তিস্তা নদী তার প্রাকৃতিক প্রবাহ বৈশিষ্ট্য হারাবে। নদী বাস্তুতন্ত্র এবং চরবাসীর জীবন ও জীবিকা হুমকির মুখে পড়বে। প্রাকৃতিক নদীটিকে ‘নিষ্কাশন নালী’তে রূপান্তরিত করা হবে। পুনরুদ্ধারকৃত জমিটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী এবং ভূমিদস্যুদের দ্বারা দখলকৃত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকবে। প্রকৃতপক্ষে FSFR কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসনের জন্য পুনরুদ্ধারকৃত জমি ব্যবহারের জন্য একটি কাঠামো রূপরেখা তৈরি করেছে (পৃষ্ঠা: ১৩৬)। নদীভাঙনে তাদের জমি হারিয়েছেন এমন স্থানীয় জনগণকে পুনরুদ্ধারকৃত জমিতে পুনর্বাসিত করা হবে কি না, তা স্পষ্ট নয়।

এ ছাড়াও তিস্তা মহাপরিকল্পনা হলো বাংলাদেশে পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় অপ্রচলিত ‘কর্ডন’ বা বেষ্টনী পন্থাভিত্তিক আরেকটি আয়োজন (ইসলাম, ২০২০)। তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে, বাংলাদেশ একটি আন্তঃসীমান্ত নদীতে ভারতের অবৈধভাবে পানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণকে বৈধতা দেবে।

চিত্র: ৭। তিস্তা নদী এবং এর প্রধান উপনদী/প্রশাখার মানচিত্র।

(চ) স্থানীয় জনগণের জন্য অর্থনৈতিক সুবিধা সম্প্রসারণ:

FSFR বিস্তৃত সুবিধার তালিকা প্রণয়ন করেছে যার মধ্যে রয়েছে নতুন জমির সুবিধা, পরোক্ষ বন্যা নিয়ন্ত্রণ সুবিধা, শিল্প ও কৃষি সুবিধা এবং স্থানীয় জনগণের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ (পৃষ্ঠা: ১৭৩)। নতুন পুনরুদ্ধারকৃত জমির মূল্য ধরা হয়েছে $১৫৭০.৮৫ মিলিয়ন। FSFR প্রকল্পের জন্য সুবিধা-ব্যয় অনুপাতও ২.১৩ নির্ধারণ করেছে, যা ১ বা ব্রেক-ইভেন খরচের চেয়ে বেশি।

বিশ্লেষণ:

দাবি করা সুবিধাগুলো অনুমানের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে, যার বেশিরভাগই এখনো বাস্তবায়িত না হওয়ার কারণে সত্য প্রমাণিত হয়নি। পূর্ববর্তী অনুচ্ছেদগুলোতে আলোচনা করা হয়েছে, দাবি করা বেশিরভাগ সুবিধার দাবিগুলো প্রমাণ করার জন্য খুব বেশি বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত কিংবা যুক্তি নেই। প্রকল্পটি সম্পন্ন হওয়ার পর রক্ষণাবেক্ষণের খরচ এই সুবিধাগুলোতে বিবেচনা করা হয়নি। প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে সম্পত্তি এবং বাস্তুতন্ত্রের সম্ভাব্য ক্ষতি নিয়ে আলোচনা করা হয়নি।

দাবি করা বেশিরভাগ সুবিধার দাবিগুলো প্রমাণ করার জন্য খুব বেশি বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত কিংবা যুক্তি নেই। প্রকল্পটি সম্পন্ন হওয়ার পর রক্ষণাবেক্ষণের খরচ এই সুবিধাগুলোতে বিবেচনা করা হয়নি। প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে সম্পত্তি এবং বাস্তুতন্ত্রের সম্ভাব্য ক্ষতি নিয়ে আলোচনা করা হয়নি।

(ছ) বাস্তুতন্ত্র এবং পরিবেশের মান উন্নত করা:

উপরে আলোচনা করা হয়েছে যে, ১৯৯৬ সালে গজলডোবা ব্যারাজে প্রবাহ পরিবর্তন এবং সিকিমে একাধিক পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্রের সম্পূর্ণ কার্যক্রমের পর শুষ্ক মৌসুমে নদীর গড় প্রবাহ ক্রমাগত হ্রাস পেয়েছে। সিকিমে পাঁচটি পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্র সম্পূর্ণরূপে চালু রয়েছে। এ ছাড়াও সিকিম এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে জলাশয়ের বিভিন্ন অংশে ১৬টি চলমান এবং ২২টি আসন্ন পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে (ইসলাম, ২০২০)। রুদ্র (২০০৩)-এর একটি গবেষণা অনুসারে, প্রতিটি কার্যকর পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্র বাষ্পীভবন এবং ভোগ্যপণ্য ব্যবহারের মাধ্যমে প্রবাহের কমপক্ষে ৫ শতাংশ ব্যবহার করে। স্পষ্টতই পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে বাঁধের পেছনে আটকানোর সময়, সাধারণত নদীর বাস্তুতন্ত্র বজায় রাখার জন্য ১ থেকে ২ শতাংশ পানি ভাটিতে ছেড়ে দেওয়া হয় (বাসু, ২০১৭)। তিস্তা নদীতে এই ধরনের একতরফা এবং অনিয়ন্ত্রিত প্রবাহ এবং পানির ব্যবহার ভাটিতে অবস্থিত বাস্তুতন্ত্রগুলোকে ধ্বংস করছে। গজলডোবায় তিস্তা বাঁধ বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষি, নৌচলাচল, মৎস্য, বনায়ন ইত্যাদির ওপর বিরাট নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে (ইসলাম ও হিগানো, ২০১২; ১৯৯৯)। সিকিমে মোট ২৯টি পানিবিদ্যুৎ প্রকল্পের পরিকল্পনা করা হয়েছে, যার প্রতিটি ৩০ থেকে ১,২০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত, যার মোট পরিমাণ প্রায় ৪,৪০০ মেগাওয়াট। সঠিক বৈজ্ঞানিক গবেষণা ছাড়া সিকিমে পানিবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশ উভয় ক্ষেত্রেই তিস্তার বাস্তুতন্ত্র এবং বাস্তুতন্ত্রের ওপর প্রভাব ফেলবে। সিকিমের বেশিরভাগ পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প হলো Run of the River বা ‘চলমান নদীর প্রবাহ’ প্রকল্প। এর ফলে নদীগুলো উচু বাঁধের পেছনে আটকে থাকা নদী হিসেবে কাজ করে। (বাসু, ২০১৭)। উজানের দিকে প্রবাহ এই প্রকল্পগুলোর কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তিস্তা নদীর গড় বার্ষিক প্রবাহ ৬০ বিলিয়ন ঘনমিটার থেকে কমে ২৫.২ বিলিয়ন ঘনমিটারে নেমে এসেছে (শি ও অন্যান্য, ২০১৯)। দোয়ানি-ডালিয়া ব্যারাজের ভাটিতে নদীর প্রবাহ ৩০০ থেকে ৪০০ কিউসেক (৮.৫-১১.৩৩ কিউমেক)-এর মধ্যে নেমে এসেছে, যা জলজ প্রাণীর জন্য যথেষ্ট নয় (হোসেন, ২০১৮)। গত কয়েক দশক ধরে তিস্তা নদীর অববাহিকা অঞ্চলে বসবাসকারী লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন ও জীবিকা মানে অবনতি হয়েছে। পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর কার্যক্রমের যথাযথ তদারকি ছাড়া এবং যৌথ নদীর অববাহিকার দেশগুলোর মধ্যে একটি অববাহিকা-ভিত্তিক সমন্বিত পানি-পলি চুক্তি ছাড়া, অববাহিকার হারানো বাস্তুতন্ত্র পরিষেবা পুনরুদ্ধার করা অসম্ভব হবে।

নদী ব্যবস্থাপনায় চীনের অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে:

প্রস্তাবিত তিস্তা মহাপরিকল্পনার সমর্থকদের অভিমত, তিস্তা নদীতে বন্যা এবং নদীভাঙনের সমস্যা সমাধানে ‘চায়না পাওয়ার’ হুয়াং হে নদীর সফল ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে তাদের জ্ঞান ব্যবহার করবে (ইসলাম, ২০২১)। বিভিন্ন কারণে এই লেখকের ভিন্ন মতামত রয়েছে। প্রথমত, হুয়াং হে এবং তিস্তা নদীর প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য ভিন্ন। হুয়াং হে একটি সর্পিল নদী যা চীনের ভূখণ্ডের মধ্যে অবস্থিত বিভিন্ন ভূ-প্রাকৃতিক প্রদেশের মধ্যদিয়ে প্রবাহিত হয়। তিস্তা একটি বিনুনি নদী যা সিকিমের হিমবাহ হ্রদে উৎপন্ন হয় এবং বাংলাদেশে প্রবেশের আগে পশ্চিমবঙ্গের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। তিস্তা অববাহিকার মাত্র ১৭ শতাংশ ভাটির অংশ বাংলাদেশের ভূখণ্ডের অন্তর্গত।

চীন উজানের অঞ্চলে বনায়ন এবং উজানের প্রবাহ-নালা নির্মাণের মাধ্যমে নদীর তীরের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ এবং নদীতে পলিপ্রবাহ কমাতে অসংখ্য ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। ভারতের সিকিমে অবস্থিত অববাহিকার উজানের অংশে ভূমি ব্যবহার পরিবর্তন করার কোনো অধিকার বাংলাদেশের নেই। তিস্তা নদীর অববাহিকার ভাটির দিকের অংশে, যা বাংলাদেশে অবস্থিত, কোনো পানি ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণরূপে সফল হবে না, যদি-না সমগ্র অববাহিকার ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনায় সহযোগিতা এবং সমন্বয় সাধন করা হয়, যার বেশিরভাগই ভারতে অবস্থিত। এ ছাড়াও টিআরসিএমআরপি হলো একটি প্রকৌশল ব্যবস্থা যা একটি জটিল গতিশীল ব্যবস্থা সমাধানের জন্য কাজ করে; যার জন্য নদী প্রকৌশল, বিজ্ঞান, পানিবিদ, পানিজ জীববিজ্ঞানী, ভূমি ব্যবস্থাপনা, অর্থনীতিবিদ, পরিকল্পনা গোষ্ঠী এবং বৃহত্তর সম্প্রদায়ের কাছ থেকে ইনপুট প্রয়োজন। বর্তমানে টিআরসিএমআরপি হলো নদী ব্যবস্থাপনার জন্য কর্ডন বা বেষ্টনী পদ্ধতির আরেকটি প্রকল্প, যা গত কয়েক দশক ধরে নদীভাঙন এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশে সফল প্রমাণিত হয়নি (ইসলাম, ২০২০)।

বর্তমানে টিআরসিএমআরপি হলো নদী ব্যবস্থাপনার জন্য কর্ডন বা বেষ্টনী পদ্ধতির আরেকটি প্রকল্প, যা গত কয়েক দশক ধরে নদীভাঙন এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশে সফল প্রমাণিত হয়নি।

তিস্তা মহাপরিকল্পনার বিকল্প:

উপরে উপস্থাপিত FSFR-এর বিশ্লেষণের ভিত্তিতে এই লেখকের মতামত হলো, তিস্তা মহাপরিকল্পনা কোনো টেকসই পরিকল্পনা নয়। প্রস্তাবিত মাস্টার প্ল্যানের অন্য কোনো টেকসই এবং বৈজ্ঞানিক সমাধান আছে কি না, এই প্রশ্নের উত্তরে জনগণ এবং সরকারের বিবেচনার জন্য নিম্নরূপ একটি ১০ দফা প্রস্তাব উপস্থাপন করা হলো।

(১) বাংলাদেশ সরকার ভারতের তিস্তা নদীর সিকিম অংশে গজলডোবা এবং অন্যান্য প্রবাহ-নিয়ন্ত্রণ কাঠামো নির্মাণের পূর্বে ঐতিহাসিক প্রবাহের ভিত্তিতে জলের ন্যায্য বণ্টনের বিষয়ে দীর্ঘমেয়াদি এবং ১২ মাস-প্রতিবছর চুক্তি করার উদ্যোগ নেবে, যাতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বজায় রাখা এবং পানিজ পরিবেশ রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ন্যায্য পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা যায়। প্রয়োজনে বিদ্যমান আন্তর্জাতিক আইনের অধীন স্থায়ী সমাধান খুঁজে বের করার জন্য সময় নষ্ট না করে সরকার এখনই উদ্যোগ নেবে।

(২) গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকায় অবস্থিত ভারতসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে সমস্ত কূটনীতির কেন্দ্রে পানি কূটনীতি রাখা উচিত। প্রয়োজনে অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য অংশের বিনিময়ে ট্রানজিট এবং অন্যান্য বাণিজ্যিক সুবিধার জন্য শর্ত আরোপ করা হবে।

(৩) তিস্তা নদীর পানি ও পলি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য খনন কাজ চালানো উচিত এবং বিনুনিযুক্ত নদীর প্রাকৃতিক ভূ-রূপগত বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণরূপে বজায় রাখা উচিত। খননকৃত পলি ও বালির ব্যবহারযোগ্যতা যাচাই করার পর, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের মাধ্যমে নদীর তীরে শিল্প স্থাপন করা উচিত। পলি ও বালির খনিজ পদার্থ পরীক্ষা করে নির্মাণসামগ্রী হিসেবে ব্যবহার করা উচিত এবং বিভিন্ন কণার আকার অনুসারে নদীর তীরে ক্ষয় রোধে ব্যবহৃত জিও-ব্যাগ দিয়ে ভরাট করে নদীপাড় ভাঙন রোধ প্রকল্প গ্রহণ করা জরুরি।

(৪) জিও-ব্যাগের ব্যবহার অনেক বেশি পরিবেশবান্ধব এবং কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। অতএব, একেবারে প্রয়োজনীয় না হলে, ভাঙন রোধে নদীর তীরে বাঁধ এবং গ্রোইন নির্মাণকে কর্ডন বা অকার্যকর প্রমাণিত হওয়া বেষ্টনী পদ্ধতি থেকে সরিয়ে নেওয়া উচিত এবং জিও-ব্যাগ ব্যবস্থাকে নদীপাড় ক্ষয় নিয়ন্ত্রণের একটি ব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করা উচিত।

(৫) তিস্তা সেচ প্রকল্প এলাকার সকল পরিত্যক্ত খাল পুনরুদ্ধার ও খনন করে বর্ষাকালে পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।

(৬) তিস্তা নদীর তলদেশের চরাঞ্চলে বসবাসকারী এবং কৃষিকাজে নিয়োজিত মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করার জন্য কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

(৭) চিলমারীতে তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্রের সংযোগস্থলে পলি জমে নদীর প্রস্থ মাত্র ৭০০ মিটারে নেমে এসেছে। তবে উজানের সমস্ত পানি এই এলাকা দিয়ে প্রবাহিত হয়। নদীর প্রস্থ বাড়ানোর জন্য এই এলাকায় ড্রেজিং করতে হবে।

(৮) তিস্তা অববাহিকার সেচকৃত এলাকার আকার বাস্তবসম্মত রাখতে হবে। প্রস্তাবিত সেচ প্রকল্পের আকার বর্তমান এবং সাম্প্রতিক অতীতে প্রাপ্ত পানির তুলনায় সম্ভাব্য সেচ প্রকল্পের আকারের চেয়ে অনেক বড়। যদি পানির প্রাপ্যতা বৃদ্ধি করা না যায়, তাহলে প্রস্তাবিত সেচ এলাকায় সেচ কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া বাস্তবসম্মত হবে না। প্রয়োজনে কৃষি উৎপাদনের ধরনে পরিবর্তন আনতে হবে।

(৯) বুড়ি তিস্তাসহ তিস্তার সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য উপনদী ও শাখা নদীগুলোর পানি ধারণক্ষমতাও প্রয়োজনীয় খননের মাধ্যমে বৃদ্ধি করতে হবে এবং নদীগুলোকে আন্তঃসংযুক্ত এবং পরস্পর নির্ভরশীল করতে হবে, যাতে আকস্মিক বন্যা বা অন্যান্য বন্যার সময় বন্যার পানি সমগ্র অববাহিকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং বন্যার ক্ষয়ক্ষতি কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলে সীমাবদ্ধ না থাকে।

(১০) তিস্তা অববাহিকা অঞ্চলে, জমির ধরন অনুসারে কৃষি-শিল্প এবং নির্মাণসামগ্রী তৈরির শিল্প গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া উচিত এবং স্থানীয় জনগণের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা উচিত, যাতে তিস্তা অববাহিকার মানুষও দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষের শিক্ষার হার এবং গড় আয়ের তুলনায় জীবনের সকল ক্ষেত্রে সমান সুযোগ পায়। অর্থনৈতিক এবং শিক্ষার উন্নয়নের ক্ষেত্রে, সারা দেশে সমতার ভিত্তিতে সমতা ও ন্যায্যতা-ভিত্তিক বৈষম্যহীন সমাজ গড়ে তোলার ওপর জোর দেওয়া উচিত।

ডক্টর মো. খালেকুজ্জামান: ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক, কমনওয়েলথ বিশ্ববিদ্যালয়, পেনসিলভেনিয়া, লক হ্যাভেন, PA 17745, যুক্তরাষ্ট্র। ই-মেইল: mkhalequ@commonwealthu.edu

তথ্যসূত্র:

আচার্য্য, ডি., ২০২০, তিস্তার প্রবাহ পুনরুদ্ধারের জন্য ৮৫০০ কোটি টাকা,

http://www.theindependentbd.com/post/244804 (২৪ জুলাই ২০২৫ তারিখে অ্যাক্সেস করা হয়েছে)

আহমেদ, আই., ২০১২, তিস্তা, টিপাইমুখ এবং নদী সংযোগ: ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের বিপদ। EPW, খণ্ড: ৪৭, সংখ্যা: ১৬, ২১ এপ্রিল। https://www.epw.in/journal/2012/16/river-interlinking-uncategorised/teesta-tipaimukh-and-river-linking-danger (অ্যাক্সেস করা হয়েছে ২০ ডিসেম্বর ২০২১)

আখতার, এস., এইবেক, কে.ইউ., ইসলাম, এস., ইসলাম, এস. আর. এম. টি., শেন, এস., এবং চু, আর., ২০১৯, জিআইএস এবং এআরআইএমএ মডেলিং ব্যবহার করে বাংলাদেশের তিস্তা নদীর নাগালে চ্যানেল আকারবিদ্যায় স্থানিক-সময়গত পরিবর্তনের পূর্বাভাস। কোয়াটারনারি ইন্টারন্যাশনাল, ৫১৩(১): ৮০-৯৪। Doi: ১০.১০১৬/j.quaint.২০১৯.০১.০২২

এশিয়ানওয়াটার, ২০২০, বাংলাদেশ তিস্তা নদী পুনরুদ্ধার প্রকল্পের জন্য চীনা সহায়তা চাইবে।

https://asianwater.com.my/bangladesh-to-seek-chinese-support-for-teesta-river-restoration-project/ (২৪ জুলাই ২০২৫ তারিখে অ্যাক্সেস করা হয়েছে)

এজাজ, এম., ২০২০, তিস্তা নদী ব্যবস্থাপনা প্রকল্প: এটি কতটা ব্যাপক হবে? দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ১৯ নভেম্বর ২০২০।

https://tbsnews.net/feature/panorama/teesta-river-comprehensive-management-project-how-comprehensive-will-it-be-160042 (২৪ জুলাই ২০২৫ তারিখে অ্যাক্সেস করা হয়েছে)

বাসু, জে., ২০১৭, তিস্তার পানি কোথায়? তৃতীয় মেরু, ১৯ জুন ২০১৭।

https://www.thethirdpole.net/en/regional-cooperation/where-are-the-teesta-waters/ (২৪ জুলাই ২০২৫ তারিখে অ্যাক্সেস করা হয়েছে)

ভট্টাচার্য, কে., ২০২০, তিস্তায় চীনা আগ্রহ ভারতের জন্য কী বোঝায়?

https://www.thehindu.com/news/international/the-hindu-explains-what-does-chinese-interest-in-the-teesta-mean-for-india/article32420205.ece (২৪ জুলাই ২০২৫ তারিখে অ্যাক্সেস করা হয়েছে)

বব্রোস্কি, পি. টি., এবং মার্কার, বি., ২০১৮, এনসাইক্লোপিডিয়া অব ইঞ্জিনিয়ারিং জিওলজি, স্প্রিংগার পাবলিশার্স, ১২০০ পৃষ্ঠা। https://pdfs.semanticscholar.org/ed27/b538b6bf5536bb76d65e91b448bbdc58638a.pdf

বিডব্লিউডিবি, ২০১৯, তিস্তা নদী ব্যাপক ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার প্রকল্পের জন্য প্রাথমিক উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (পিডিপিপি)। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা শাখা-১, ১২ পৃষ্ঠা।

বিডব্লিউডিবি এবং পাওয়ার চায়না, ২০২৩, তিস্তা নদীর ব্যাপক ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার প্রকল্পের সম্ভাব্যতা অধ্যয়ন – চূড়ান্ত প্রতিবেদন, ২১৬ পৃষ্ঠা।

চাকমা, জে, ২০২০, ভারতীয় অবহেলার মধ্যে বাংলাদেশ তিস্তার জন্য চীনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে।

https://www.thedailystar.net/business/news/bangladesh-leans-china-teesta-management-amidst-indian-neglect-1942561 (২৪ জুলাই ২০২৫ তারিখে অ্যাক্সেস করা হয়েছে)

চক্রবর্তী, টি., এবং ঘোষ, পি., ২০১০, তিস্তা মেগাফ্যানের ভূ-রূপবিদ্যা এবং পললবিদ্যা, দার্জিলিং হিমালয়: মেগাফ্যান নির্মাণ প্রক্রিয়ার জন্য প্রভাব: ভূ-রূপবিদ্যা, খণ্ড ১১৫, সংখ্যা ৩-৪, পি. ২৫২-২৬৬

চারলভ, এস., আলেক্সিভস্কি, এন. আই., ২০১৩, বিনুনিযুক্ত নদী: গঠন, প্রকার এবং পানিবিদ্যাগত প্রভাব। পানিবিদ্যা গবেষণা, ৪৬(২): ২৫৮-২৭৫। https://doi.org/10.2166/nh.2013.023. (২৪ জুলাই ২০২৫ তারিখে অ্যাক্সেস করা হয়েছে)

চার্চ, এম., ২০১৫, চ্যানেল স্থিতিশীলতা: নদীসমূহের ভূমিরূপ এবং ভূমিবিন্যাস।

রোইনস্কি, পি., এবং রাডেকি-পাওলিক (সম্পাদক), নদী – ভৌত, প্রবাহিত এবং পরিবেশগত প্রক্রিয়া, ভূ-গ্রহ, পৃথিবী এবং গ্রহ বিজ্ঞান, স্প্রিংগার আন্তর্জাতিক প্রকাশনা, সুইজারল্যান্ড। doi: 10.1007/978-3-319-17719-9_12

ফিশার, এস., পিট্রন, জে., ব্রিং, এ., থ্রোসলুন্ড, জে., এবং জারজো, জে., ২০১৭, ব্রহ্মপুত্র নদীর বর্তমান এবং ভবিষ্যতের পলি পরিবহন: পূর্বাভাস এবং ব্যবস্থাপনায় অনিশ্চয়তা হ্রাস করা। আঞ্চলিক পরিবেশগত পরিবর্তন, ২০, ৫১৫-৫২৬। https://doi.org/10.1007/s10113-016-1039-7 (২৪ জুলাই ২০২৫ তারিখে অ্যাক্সেস করা হয়েছে)

গিরি, পি., ২০২১, তিস্তা ব্যারাজ: প্রাক্তন জমির মালিকরা চাকরির দাবিতে, উত্তরবঙ্গে আন্দোলন শুরু করেছেন। হিন্দুস্তান টাইমস, https://www.hindustantimes.com/cities/kolkata-news/teesta-barrage-former-land-owners-demand-jobs-start-agitation-in-north-bengal-101611905896231.html (২৪ জুলাই ২০২৫ তারিখে অ্যাক্সেস করা হয়েছে)

গ্রে, ডি. পি., গ্রোভ, পি., সুরমান, এম. আর., এবং কিলিং, সি., ২০১৮, ব্রেইডেড নদী: প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য, হুমকি এবং আরও কার্যকর ব্যবস্থাপনার পদ্ধতি। পরিবেশগত ক্যান্টারবেরি আঞ্চলিক পরিষদ, টেকনিক্যাল রিপোর্ট (ক্যান্টারবেরি, নিউজিল্যান্ড), বিজ্ঞান গ্রুপ।

হক, এস. এ., এ., উজ্জামান, এ., গুডরিচ, সি. জি., মল্লিক, ডি., মিনি, জি., শর্মা, জি., নাইমা, কে., মামনুন, এন., ভার্মা, এন., সিং, পি., ঘাটে, আর., ত্রিবেদী, এস., সেন, এস., ভাদওয়াল, এস., হাসান, টি.,

দিলশাদ, টি., গুলাটি, ভি., নাজনীন, জেড., (২০১৭) তিস্তা অববাহিকা: সকলের জন্য বিদ্যুৎ এবং কৃষির জন্য পর্যাপ্ত পানি?। হাই-আওয়ার ওয়ার্কিং পেপার ১২। কাঠমান্ডু: হাই-আওয়ার।

হোসেন, এম., ২০১৮, তিস্তা নদী শুকিয়ে যাচ্ছে, বাস্তুতন্ত্র হুমকির মুখে। ঢাকা ট্রিবিউন, মার্চ ২৬, ২০১৮। https://www.dhakatribune.com/bangladesh/nation/2018/03/26/teesta-river-dry-ecosystem-threatened (২৪ জুলাই ২০২৫-এ অ্যাক্সেস করা হয়েছে)

ইসলাম, নজরুল (২০২৫) (ইসলাম, ২০২৫), ‘বাংলাদেশের নদী নিয়ন্ত্রণে সহায়তার ভালোমন্দ,’ প্রথম আলো, ৮ এপ্রিল ২০২৫

ইসলাম, নজরুল ( ২০২৩), সংবিধান উন্নয়ন – বর্তমান ধারার অভিযোগ এবং বিকল্পধারার প্রশ্ন, প্রাচ্য প্রজ্ঞা, ঢাকা

ইসলাম, নজরুল এস. (২০২২), বাংলাদেশে পানি উন্নয়ন: অতীত, বর্তমান, এবং ভবিষ্যৎ, ঢাকা: পূর্ব একাডেমিক

Islam, M., 2021, Op-Ed on তিস্তা মহাপরিকল্পনা (বাংলায়), দৈনিক বণিক বার্তা, ৩ নভেম্বর, ২০২১। https://bonikbarta.net/home/news_description/279061/ (২৪ জুলাই ২০২৫-এ অ্যাক্সেস করা হয়েছে)

ইসলাম, এস. এন., ২০২০, নদী ও টেকসই উন্নয়ন – বিকল্প পদ্ধতি এবং তাদের প্রভাব। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ৪৪৮ পৃষ্ঠা।

ইসলাম, এম. এফ., এবং হিগানো, ওয়াই., ২০১২, ন্যায়সঙ্গত দ্বিপাক্ষিক ভাগাভাগি আন্তর্জাতিক: তিস্তা নদীর সর্বোত্তম ব্যবহারের একটি নীতি পরিমাপ। https://pdfs.semanticscholar.org/ed27/b538b6bf5536bb76d65e91b448bbdc58638a.pdf (২৪ জুলাই ২০২৫ তারিখে অ্যাক্সেস করা হয়েছে)

ইসলাম, এম. এফ., এবং হিগানো, ওয়াই., ১৯৯৯, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে আন্তর্জাতিক পরিবেশগত সমস্যা: তিস্তা নদী এলাকার পরিবেশগত এবং আর্থ-সামাজিক প্রভাব। ইউরোপীয় আঞ্চলিক বিজ্ঞান সমিতির ৩৯তম কংগ্রেস: ‘একবিংশ শতাব্দীর ইউরোপে আঞ্চলিক সংহতি এবং প্রতিযোগিতামূলকতা’, ২৩–২৭ আগস্ট, ১৯৯৯, ডাবলিন, আয়ারল্যান্ড, ইউরোপীয় আঞ্চলিক বিজ্ঞান সমিতি (ERSA), লুভেন-লা-নিউভ।

খালেকুজ্জামান, মো. (2024), সাসটেইনেবিলিটি অব বাংলাদেশ ডেল্টা, ঢাকা: ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ১৮০ পৃ.

খালেকুজ্জামান, মো. ( ২০২৩), ‘তিস্তা সমন্বিত উন্নয়ন ও পুনরুদ্ধার প্রকল্প,’ সর্বোত্তম, ২১ জুন, https://sarbojonkotha.info/teesta-river-comprehensive-management-and-restoration-project/ এ উপলব্ধ (অ্যাক্সেস করা হয়েছে জুলাই ২৪, ২০২৫)

কুনাকা, ডি., 2020, নদী ক্ষয়, পরিবহন এবং জমার Hjulstrom কার্ভ। https://thegeoroom.co.zw/hydrology/the-hjulstrom-curve-of-river-erosion-transportation-and-deposition/ (২৪ জুলাই ২০২৫ তারিখে অ্যাক্সেস করা হয়েছে)

মার্জিল, এম., ২০২০, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট নদীর অধিকার সমুন্নত রাখে। সেন্টার ফর ডেমোক্রেটিক অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল রাইটস, স্পোকেন, ওয়াশিংটন। https://mari-margil.medium.com/bangladesh-supreme-court-upholds-rights-of-rivers-ede78568d8aa (২৪ জুলাই ২০২৫ তারিখে অ্যাক্সেস করা হয়েছে)

মোহন, জি., ২০২০, তিস্তা নদী প্রকল্পের জন্য চীন বাংলাদেশকে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেবে, বাংলাদেশি মিডিয়া জানিয়েছে,

https://www.indiatoday.in/world/story/china-to-lend-bangladesh-almost-1-billion-for-teesta-river-project-reports-bangladeshi-media-1712284-2020-08-17 (২৪ জুলাই ২০২৫ তারিখে অ্যাক্সেস করা হয়েছে)

মণ্ডল, এম. এস. এইচ., এবং ইসলাম, এম. এ., ২০১৭, বাংলাদেশে তিস্তা নদীতে সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন পানিপ্রবাহের কালানুক্রমিক প্রবণতা এবং এর প্রভাব। জাম্বা, জার্নাল অব ডিজাস্টার অ্যান্ড রিস্ক স্টাডিজ, 9(1), 373, doi: 10.4102/jamba.v9i1.373. (২৪ জুলাই ২০২৫ তারিখে অ্যাক্সেস করা হয়েছে)

মুলিক, আর., বাবেল, এম., এবং পেরেট, এস., ২০১০, তিস্তা নদীর জন্য প্রবাহ বৈশিষ্ট্য এবং পরিবেশগত প্রবাহের প্রয়োজনীয়তা, বাংলাদেশ: বাংলাদেশের পরিবেশগত দিক সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনের কার্যপ্রণালী (ICEAB 10), জাপান। http://benjapan.org/iceab10/42.pdf

পাওয়ার চায়না, ২০২০, তিস্তা মহাপরিকল্পনার সমর্থনে প্রচারমূলক ভিডিও

https://m.facebook.com/watch/?v=3618953924829172&_rdr (২৪ জুলাই ২০২৫ তারিখে অ্যাক্সেস করা হয়েছে)

রহমান, এম. এম., এবং মামুন, এ. এ., ২০২০, তিস্তা নদীর অববাহিকা বরাবর পানিবিদ্যুৎ উন্নয়ন: সুযোগ এবং সহযোগিতা। পানি নীতি, ২২(৪), ৬৪১-৬৫৭। https://doi.org/10.2166/wp.2020.136 (২৪ জুলাই ২০২৫ তারিখে অ্যাক্সেস করা হয়েছে)

রহমান, এম., দুস্তেগির, এম., করিম, আর., হক, এ., নিকোলস, আর., ডার্বি, এস. ই., নাকাগাওয়া, এইচ., হোসেন, এম., ডান, এফ. ই., এবং আক্তার, এম., ২০১৮, গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা ব-দ্বীপ ব্যবস্থায় সাম্প্রতিক পলিপ্রবাহ। মোট পরিবেশ বিজ্ঞান, ৬৪৩, ১০৫৪-১০৬৪। DOI: 10.1016/j.scitotenv.2018.06.147 (২৪ জুলাই ২০২৫ তারিখে অ্যাক্সেস করা হয়েছে)

রুদ্র, কে., ২০০৩. তিস্তাকে নিয়ন্ত্রণ করা। দ্য ইকোলজিস্টস এশিয়া, খণ্ড ১১, নং ১। http://www.actsikkim.com/docs/Rudra_Taming_the_Teesta.pdf (২৪ জুলাই ২০২৫ তারিখে অ্যাক্সেস করা হয়েছে)

রয়, পি. কে., ২০২০, তিস্তা নদী ব্যাপক ব্যবস্থাপনা এবং পুনরুদ্ধার প্রকল্প। https://prodip.wordpress.com/2020/09/12/teesta-river-comprehensive-management-and-restoration-project/

রয়, পি., ২০২০, ভারতের হতাশার জন্য, বাংলাদেশ তিস্তা নদীকে রূপান্তরিত করার জন্য চীনের দিকে ঝুঁকছে। তৃতীয় মেরু, ২৮ সেপ্টেম্বর। https://www.thethirdpole.net/en/regional-cooperation/bangladesh-teesta-river/ (২৪ জুলাই ২০২৫ তারিখে অ্যাক্সেস করা হয়েছে)।

স্যাটার, এস. এ., ১৯৯৮, বাংলাদেশে ধানের উৎপাদনের ব্যবধান পূরণ করা। কৃষিবিদ্যা বিভাগ, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর, বাংলাদেশ।

শহীদ, এস., ২০০৭, রিমোট সেন্সিং এবং জিআইএস ব্যবহার করে উত্তর-পশ্চিম বাংলাদেশের ধানক্ষেতে সেচের পানির চাহিদার অনুমান। ভূগোল বিভাগ, ফ্রেডরিক-শিলার বিশ্ববিদ্যালয়, জেনা, জার্মানি, ৩৫ পৃষ্ঠা।

শেখ, এম., রেজা, এ., এবং ইসলাম, এম. টি., ২০১৫, উত্তর বাংলাদেশের তিস্তা নদীর রূপবিদ্যার ওপর নৃতাত্ত্বিক প্রভাব: একটি অনুসন্ধানমূলক গবেষণা। জার্নাল অব জিওসায়েন্স অ্যান্ড জিওমেটিক্স, খণ্ড ৩, নং ৩, পৃষ্ঠা: ৫০-৫৫। http://pubs.sciepub.com/jgg/3/3/1 (অ্যাক্সেস করা হয়েছে ৪ জানুয়ারি ২০২২)

শি, এইচ., জি, ডব্লিউ., এবং ওয়াং, ডি., (২০১৯), বাংলাদেশের তিস্তা নদীর প্রবাহ প্রক্রিয়া এবং পলি পরিবহন ক্ষমতার ওপর গবেষণা।

বিশ্ব পরিবেশ ও পানি সম্পদ কংগ্রেস, ASCE, রেস্টন ভিএ। https://ascelibrary.org/doi/10.1061/9780784482353.038 (২৪ জুলাই ২০২৫-এ অ্যাক্সেস করা হয়েছে)

Wadud, T., 2021, তিস্তা নদীর উপনদী ও শাখানদী (বাংলায়), প্রথম আলো, ২৭ ডিসেম্বর ২০২১। https://www.prothomalo.com/opinion/column (২৮ ডিসেম্বর ২০২১-এ অ্যাক্সেস করা হয়েছে)।

উইকিপিডিয়া, 2025, https://en.wikipedia.org/wiki/Groyne (জুলাই ২৪, ২০২৫-এ অ্যাক্সেস করা হয়েছে)

 

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *