গাজার বিশ লাখ অধিবাসীকে বন্দি করে রাখার চরম খেসারত ইসরায়েল এড়াবে কী করে

আগাম প্রকাশ
ছবি: সংগৃহীত

[লেখাটি ইসরায়েলি সংবাদপত্র দ্য হারেৎজ-এ প্রকাশিত সাংবাদিক ও লেখক Gideon Levy-এর ‘Israel Can’t Imprison Two Million Gazans Without Paying a Cruel Price’ শীর্ষক লেখার অনুবাদ। অনুবাদ করেছেন কল্লোল মোস্তফা।]

এই সবকিছুর জন্য দায়ী ইসরায়েলি ঔদ্ধত্য;  এরকম একটা ধারণা যে আমরা যা খুশি তা করতে পারি, এ জন্য আমাদের কোনো মূল্য দিতে হবে না এবং কোনো শাস্তি পেতে হবে না। আমরা নির্বিঘ্নে এসব চালিয়ে যাব।

আমরা ফিলিস্তিনিদের গ্রেফতার করব, হত্যা করব, হয়রানি করব, উচ্ছেদ করব আর তাদের ওপর গণহত্যা কার্যক্রম চালানো সেটেলার বা দখলদারদের রক্ষা করব।

আমরা নিরপরাধ মানুষের ওপর গুলি চালাব, তাদের চোখ তুলে ফেলব, মুখ ভেঙে ফেলব, তাদের বহিষ্কার করব, তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করব, তাদের বিছানা থেকে তুলে নিয়ে আসব এবং অবশ্যই গাজা উপত্যকায় অবিশ্বাস্য অবরোধ চালিয়ে যাব আর ধরে নেব সবকিছু ঠিকমতো চলবে।

আমরা গাজার চারপাশে ভয়ংকর দেয়াল তৈরি করব–শুধু ভূগর্ভস্থ এই দেয়ালের পেছনে ৩০০ কোটি শেকেল বা ৭৬৫ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছে–এবং আমরা নিরাপদ থাকব। আমরা সেনাবাহিনীর সাইবার-গোয়েন্দা ইউনিটের প্রতিভা আর শিন বেটের নিরাপত্তারক্ষীদের ওপর নির্ভর করব, যারা সবকিছু সম্পর্কে জানে। তারা সময়মতো আমাদের সতর্ক করবে।

শুধু ডানপন্থি আইনপ্রণেতা জেভি সুকোট এবং দখলদার সেটেলারদের রক্ষা করার জন্য আমরা গাজা সীমান্ত থেকে পশ্চিম তীরের হাওয়ারা সীমান্তে অর্ধেক সেনাবাহিনী স্থানান্তর করব। আর হাওয়ারা এবং গাজার ইরেজ ক্রসিং উভয় এলাকাতেই সবকিছু স্বাভাবিক থাকবে।

কিন্তু দেখা গেল দুর্দান্ত প্রেরণা থাকলে বিশ্বের সবচেয়ে অত্যাধুনিক এবং ব্যয়বহুল প্রতিবন্ধকতাও উড়িয়ে দেওয়া যায় স্রেফ পুরাতন জীর্ণ একটি বুলডোজার দিয়ে। নামিদামি বিশেষজ্ঞ আর কন্ট্রাক্টরদের শত শত কোটি টাকা দিয়ে নির্মিত এই অহংকারী প্রতিবন্ধকতা স্রেফ সাইকেল এবং মোপেড দিয়েই অতিক্রম করা যায়।

আমরা ভেবেছিলাম আমরা গাজায় যেতে থাকব, কয়েক হাজার ইসরায়েলি ওয়ার্ক পারমিট ছড়িয়ে দেওয়ার বিনিময়ে তাদের কারাগারেই রেখে দেব। আমরা সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে শান্তি স্থাপন করব আর মানুষ ফিলিস্তিনিদের ভুলে থাকবে যতদিন-না তাদের একেবারে নির্মূল করে দেওয়া যায়, যেমনটি বেশ কিছু ইসরায়েলির চাওয়া।

আমরা হাজার হাজার ফিলিস্তিনি বন্দিকে আটকে রাখব, কখনো কখনো বিনা বিচারে, যাদের অধিকাংশই রাজনৈতিক বন্দি। এবং কয়েক দশক ধরে কারাগারে থাকার পরও তাদের মুক্তির বিষয়ে আমরা আলোচনা করতে রাজি থাকব না।

আমরা তাদের বলব যে শুধু শক্তির জোরেই বন্দিরা স্বাধীনতা পেতে পারে। আমরা ভেবেছিলাম যে আমরা কূটনৈতিক সমাধানের যে কোনো প্রচেষ্টাকে অহংকারের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করতে থাকব, শুধু এই কারণে যে আমরা এই সবকিছুকে মোকাবিলা করতে চাই না, এবং সবকিছু চিরকাল এভাবেই চলতে থাকবে।

আবারও প্রমাণিত হলো যে এভাবে সবকিছু চলে না। কয়েকশ সশস্ত্র ফিলিস্তিনি প্রতিরক্ষা ব্যূহ ভেদ করে ইসরায়েলে এমনভাবে আক্রমণ করল যা কোনো ইসরায়েলি কল্পনাও করতে পারেনি। মাত্র কয়েকশ মানুষ প্রমাণ করে দিল যে, চরম নিষ্ঠুর মূল্য না দিয়ে বিশ লাখ মানুষকে চিরতরে বন্দি করে রাখা অসম্ভব।

এই শনিবারে জীর্ণ পুরাতন ফিলিস্তিনি বুলডোজারটি যেভাবে বিশ্বের সবচেয়ে স্মার্ট প্রতিবন্ধকতার দেয়াল ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে, তেমনিভাবে ধসিয়ে দিয়েছে ইসরায়েলের সমস্ত অহংকার আর আত্মতুষ্টি। গাজায় মাঝে মাঝে আত্মঘাতী ড্রোন হামলা চালানো এবং অর্ধেক দুনিয়ার কাছে সেই ড্রোন বিক্রি করাই ইসরায়েলের নিরাপত্তার জন্য যথেষ্ট–এই ধারণাটিও একইভাবে ভেঙে গেছে।

এই শনিবার ইসরায়েল এমন ছবি দেখেছে যা আগে কখনো দেখেনি। ফিলিস্তিনি যানবাহন ইসরায়েলি শহরে টহল দিচ্ছে, মোটরবাইক আরোহীরা গাজার গেট দিয়ে ইসরায়েলে প্রবেশ করছে। এই ছবিগুলো সেই ঔদ্ধত্যকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলে। গাজার ফিলিস্তিনিরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে তারা স্বাধীনতার একটা মুহূর্তের জন্য যে কোনো মূল্য দিতে রাজি। তাতে কি কোনো আশা আছে? না। ইসরায়েল কি এর থেকে শিক্ষা নেবে? না।

এই শনিবার থেকেই তারা আলাপ শুরু করে দিয়েছে গাজার সমস্ত পাড়া-মহল্লাকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া, গাজা স্ট্রিপ দখল করে নেওয়া এবং গাজাকে এমন ভয়ংকর শাস্তি দেওয়ার বিষয়ে, “যে শাস্তি আগে কখনো দেওয়া হয়নি।” কিন্তু ইসরায়েল তো সেই ১৯৪৮ সাল থেকেই গাজাকে শাস্তি দিয়ে আসছে, এক মুহূর্তের জন্যও থামেনি।

৭৫ বছর ধরে নিপীড়িত হওয়ার পর, গাজার জন্য আবারও একটা খারাপ পরিণতি অপেক্ষা করছে। “গাজাকে সমতল করার” হুমকি থেকে শুধু এটাই প্রমাণিত হয় যে আমরা কিছুই শিখিনি। দাম্ভিকতা থেকেই যাচ্ছে, যদিও ইসরায়েলকে এর জন্য আবারও চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে।

যা ঘটেছে তার জন্য প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর দায় অনেক বেশি, এবং এর মূল্য তাকে দিতে হবে। কিন্তু এই পরিস্থিতির সূত্রপাত তার আমলে ঘটেনি এবং তার আমল শেষ হওয়ার পরও তা চলতে থাকবে। আমাদেরকে এখন ইসরায়েলি ভিকটিমদের জন্য কাঁদতে হবে, কিন্তু গাজার ভিকটিমদের জন্যও আমাদের কাঁদা উচিত।

গাজা, যার অধিকাংশ বাসিন্দা ইসরায়েলের তৈরি উদ্বাস্তু। গাজা, যে একদিনের জন্যও স্বাধীনতার স্বাদ পায়নি।

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *