২২ পরিবারের অতীত ও বর্তমান-৫

২২ পরিবারের অতীত ও বর্তমান-৫

সদ্যজাত বাংলাদেশ: পুরানো ভিত, নতুন ইমারত

মেহেদী হাসান

বাংলাদেশে পুঁজিবাদের বিকাশ উল্লেখযোগ্য আকার নিয়েছে। এই বিকাশ ধারায় একদিকে তৈরি হয়েছে পাকিস্তানের ২২ পরিবারের চাইতেও সম্পদশালী বেশ কিছু গোষ্ঠী, অন্যদিকে বৈষম্য ও পরিবেশ বিধ্বংসী তৎপরতাও অভূতপূর্ব মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে ‘উন্নয়ন’ ধারার স্বরূপ বিশ্লেষণ, পুঁজির কেন্দ্রীভবনের ধরন, শ্রেণি বিন্যাস, এই ধারার পুঁজিবাদ বিকাশে রাষ্ট্রের ভূমিকা ইত্যাদি পরীক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান প্রবন্ধ কয়েক কিস্তিতে এই অনুসন্ধান বিশ্লেষণ হাজির করবে। পঞ্চম কিস্তিতে যুদ্ধোত্তর সদ্যজাত রাষ্ট্রে পুরাতন ব্যবস্থার ধারাবাহিকতা এবং সরকার ও লুম্পেন ধনিক শ্রেণির পারস্পরিক সম্পর্ক আলোচনা করা হয়েছে।

স্বাধীনতাত্তোর সমাজতন্ত্র’: ধরন, প্রক্রিয়া এবং প্রতিক্রিয়া

পুরাতন সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন এবং ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিক’ অর্থনীতি প্রবর্তনের ঘোষণা দিয়ে সদ্যজাত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শিল্প-প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রীয়করণের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।[1] বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ধরন-কাঠামো কেমন হবে সে বিষয়ে পরিষ্কার কোন বক্তব্য দলের মুখপাত্র পর্যায়ের কারো কাছ থেকে পাওয়া যায়নি।[2] ১৯৭০ সালের আওয়ামী লীগের নির্বাচনী মেন্যুফেস্টোতে ইসলামী নীতি-নৈতিকতাকে প্রাধান্য দিয়ে ‘সমাজতান্ত্রিক’ কর্মসূচি হিসেবে ব্যাংক, বীমা, বড় শিল্প-কারখানার রাষ্ট্রীয়করণ এবং ভূমিসংস্কারের বিষয়গুলোর উল্লেখ ছিল।[3] উপস্থাপিত সেসব প্রতিশ্রুতির সামগ্রিক কাঠামোগত কোন চেহারা ছিল না। বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে লীগ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী এবং দলের বিভিন্ন নেতা বিভিন্ন সময়ে ‘সমাজতন্ত্র’ সম্পর্কে নানাবিধ বক্তব্য পেশ করে। যেমন, তৎকালীন আইনমন্ত্রী ড. কামাল সংসদে এক বক্তৃতায় বাংলাদেশে ‘সমাজতন্ত্রে’র ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে অর্থনৈতিক শোষণ থেকে মুক্তির কথা বলেছিলেন।[4] কীভাবে? তার ধরন কেমন? তার উত্তরে, ‘সমাজতান্ত্রিক গঠন প্রক্রিয়া’ সম্পর্কে তিনি ‘জাতি এবং অর্থনৈতিক গঠনে’র জন্য প্রত্যেকের সমান অংশগ্রহণের উপর জোর দিয়েছিলেন। অর্থনৈতিক গঠনে কোন কোন দিকগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে? বণ্টনের প্রক্রিয়াগুলো কেমন হবে? এ বিষয়ে সামগ্রিকভাবে কোন বক্তব্য সরকারি দলের কোন পক্ষ থেকে উপস্থাপন করা হয়নি। কেন? কারণ, বলা হয়েছিল; আওয়ামী লীগ ‘আদর্শগত’[5] কোন রাজনৈতিক দল নয়। সুতরাং, যখন যা নীতি-পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে তাই হবে ‘সমাজতন্ত্র’।

সদ্যজাত বাংলাদেশে ‘সমাজতন্ত্র’ চর্চার ধরন নিয়ে সে সময় বিভিন্ন মহল থেকে নানাবিধ প্রশ্ন উঠতে থাকে। মওলানা ভাসানীর পৃষ্ঠপোষকতায় প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘হক কথা’য় বলা হয়, ‘‘বাংলাদেশে যারা দাবী করছেন, সমাজতন্ত্র কায়েম করবেন, তাদের শ্রেণি চরিত্র কী? এমন কিছু কি তারা করতে যাবেন, যা তাদের বৈষয়িক লোকসান ডেকে আনবে? তাদের সঞ্চয় অঢেল। তাদের আয়াস অপরিসীম। ..ব্যাংক-বীমায় সরকারি প্রশাসক নিয়োগে সমাজতন্ত্রের আদর্শ কতটুকু ফুটে উঠেছে? এতে কি গ্রামের কৃষক, যারা জনসংখ্যার শতকরা ৮০ জন; লাভবান হবেন? ভূমি ব্যবস্থার কী হবে? জোতদার-মহাজনদের দাপট খতম হবে কি?’’[6] কোন কোন সংসদ সদস্যের মধ্যে সমাজতন্ত্রের ঘোষণা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। একজন জ্যেষ্ঠ সংসদ সদস্য বলেছিলেন যে, এই ধরনের রাষ্ট্রীয়করণ মানে সমাজতন্ত্র নয় এবং একে সমাজতন্ত্রের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবেও বলা যাবে না। এটি ‘রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ’ এবং যেটি সমাজতন্ত্রের বিকাশের স্বার্থে না।[7] একজন শ্রমিক নেতার বক্তব্য ছিল এরকম যে, রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করা হয়েছিল নতুন করে আবার একটি বাঙ্গালী পুঁজিপতি শ্রেণিকে তৈরী করার উদ্দেশ্যে না বরং একটি শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করার জন্য।[8]

পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থা যে শোষণমূলক ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে – ব্যক্তিগত সম্পত্তির পুঁজিবাদী ধরন; উৎপাদনী উপায়, বণ্টন ব্যবস্থার ব্যক্তিগত মালিকানা ব্যবস্থা এবং এই ব্যবস্থার ভিত্তিসাপেক্ষ চিন্তা-ধারণা-মনোজগৎ-সংস্কৃতি প্রভৃতির আমূল পরিবর্তনসাপেক্ষ দীর্ঘমেয়াদী কোন প্রক্রিয়া-পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে না গিয়ে কি ‘সমাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব? শোষণ-বৈষম্যমূলক পুরাতন ব্যবস্থার ভিত্তিমূল উচ্ছেদ এবং তার স্থলে নতুন সামাজিক উৎপাদনের উপায়-পদ্ধতি, বণ্টন, ভোগ, নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান, আইন-কানুন, বিধি-বিধান, বাজার ব্যবস্থা, সামাজিক মনস্তত্ব অর্থাৎ সামগ্রিক মৌলিক পরিবর্তন-প্রতিস্থাপন ছাড়া কি সম্ভব? সমাজতান্ত্রিক বিশ্লেষকগণ বলেন যে, সমাজতান্ত্রিক নির্মাণ একটি সামগ্রিক প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়া রাতারাতি বাস্তবায়ন সম্ভব নয় কিন্তু সামগ্রিকভাবে (উৎপাদন-বণ্টন-বিতরণ-ভোগ) প্রতিটি প্রেক্ষিতকে গুরুত্ব দিয়ে তবেই এই প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব। 

তাহলে, সামগ্রিক সমাজের অন্যান্য দিককে উপেক্ষা করে কেবলমাত্র উৎপাদন; অর্থনৈতিক কিছু খাতের রাষ্ট্রীয়করণের মাধ্যমে বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হওয়া সম্ভব কি? পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন এবং বাজার ব্যবস্থাকে অক্ষুণ্ন রেখে, পুঁজির সম্পর্কের কোনরূপ মৌলিক পরিবর্তন না ঘটিয়ে কিংবা সামগ্রিক সম্পদের সামাজিক মালিকানা, কর্তৃত্ব এবং নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার আয়োজন না করে কিছু ঘোষণাকে সমাজতন্ত্র বলা যায় কি? বরং তা কি পুঁজিতান্ত্রিক বুর্জোয়া মালিকানা ব্যবস্থাকেই পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেনি? সেই প্রক্রিয়ার ফলে কি সিংহভাগ জনসাধারণের সম্পদ ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত, পুঁঞ্জীভূত হয়নি? ঐতিহাসিক নানা কারণে স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব লীগের হাতে চলে যায়। তাই যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী হয় দলটি। প্রধান নেতৃত্বের হাতে দলের সামগ্রিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়। ব্যক্তির হাতে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়ার কারণে নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব এবং নিরঙ্কুশ স্বেচ্ছাচারিতার শর্ত তৈরী করে। ফলে, একদিকে নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ববাদী শাসন এবং অন্যদিকে ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠীর হাতে সম্পদ কেন্দ্রীভূত করার সুযোগ তৈরী করে দেওয়ার ফলে কি সামগ্রিকভাবে সমাজে নৈরাজ্য দেখা দেয়নি?  

১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লবের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের নতুন ধরনের সমাজতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণ প্রচেষ্টার প্রভাব সারা বিশ্বেই অনুভূত হয়। বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তার প্রভাব যেমন দেখতে পাওয়া যায় তেমনি পাকিস্তান আমলে পুঁজিপতি শ্রেণি এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ‘সমাজতন্ত্র’ একটি মর্যাদাপূর্ণ এবং জনপ্রিয় শ্লোগানে পরিণত হয় শ্রমিক-কৃষক-মধ্যবিত্ত জনগণের মধ্যে। তারই ধারাবাহিকতায় স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শ্রমিক শ্রেণি এবং কৃষকদের শ্রেণি চেতনা উচ্চ মাত্রায় উন্নীত হয়। কিন্তু চৈতন্যগত উন্নয়ন মানে বৃহৎ লুম্পেন পুঁজিপতি, সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ পুনরুৎপাদনকে সমূলে উৎপাটন করার একমাত্র গ্যারান্টি না। পুঁজির প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক শক্তি শ্রমিক শ্রেণিকে যখন তাদের পতাকাধীনে শামিল করে তখন প্রমাণ হয় যে, শ্রমিক শ্রেণির চেতনার বিকাশ হওয়াই কেবল যথেষ্ট নয়; চৈতন্যের বিকাশ আমূল পরিবর্তনের একটি শর্ত মাত্র। ‘‘শ্রমিক শ্রেণি এবং কৃষকদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব অধিকাংশ ক্ষেত্রে মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের হাতে রয়ে যাওয়ার’’[9] কারণে পাকিস্তান আমলে এবং তার পরবর্তী সময়েও তারা (মধ্যবিত্ত) তাদের নিজেদের শক্তি বৃদ্ধির স্বার্থে উক্ত শ্রেণিকে ব্যবহার করেছে। তারই ধারাবাহিকতায়, একদিকে শ্রমিক শ্রেণিকে নিজেদের তাঁবে রাখা, অন্যদিকে মূলধারার রাজনীতিতে টিকে থাকা এবং জনপ্রিয়তা রক্ষার প্রয়োজনে আওয়ামী লীগ ‘সমাজতন্ত্রের’ শ্লোগানটি গ্রহণ করেছে ’৭০-এর নির্বাচনের পূর্বে।

লীগের শ্রেণি চরিত্র এবং সমাজতন্ত্র ঘোষণার পরস্পরবিরোধী সম্পর্ক তুলে ধরতে গিয়ে বদরুদ্দীন উমর লিখেছেন যে, ‘‘…সমাজতন্ত্র কায়েমের কোন উদ্দেশ্য আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের মধ্যে নেই। আওয়ামী লীগ না কোন সমাজতান্ত্রিক দল এবং তাদের নেতারাও না কোন সমাজতন্ত্রী।…(সমাজতান্ত্রিক) কোন শ্লোগান গ্রহণ করলেই আওয়ামী লীগ সমাজতান্ত্রিক দল হয়ে যায় না। বিশেষ করে, শ্রেণি সংগ্রাম বিদ্বেষী ঘোষণা এবং সংগঠিত রাজনীতির শ্রেণিভিত্তিক অবস্থান অস্বীকার করার মধ্য দিয়ে’’[10] তাদের পরষ্পরবিরোধী অবস্থান সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায়। পূর্ব পাকিস্তানে ভূট্টো-ইয়াহিয়ার দমন-পীড়ন-ষড়যন্ত্র এবং উদ্দেশ্যমূলকভাবে শাসনতান্ত্রিক সঙ্কট তৈরীর এক পর্যায়ে দলের প্রধান নেতৃত্বের এজেন্সি ফ্রান্স প্রেস (Agence France Press)-এর রিপোর্টারের কাছে দেওয়া এক সাক্ষাৎকার থেকে এই ধারণা সম্পর্কে প্রমাণ পাওয়া যায়।[11]

শিল্প-কারখানা রাষ্ট্রীয়করণের পাশাপাশি কৃষিতে ভূমিসংস্কার বিষয়ক লীগের ঘোষণা নিয়েও শুরু থেকেই প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। ছয় দফা প্রণয়নের পরবর্তী এক পর্যায়ে দলটি তাদের ঘোষণায় বলে, ‘২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করা হবে’। ইন্দু সাহা’র ভাষ্য অনুযায়ী, ‘‘…যেখানে পূর্ব বাঙলার ৬৪ শতাংশ কৃষকের জমির মালিকানা শোষক জোতদার-মহাজন প্রভৃতি শতকরা আটজনের হাতে কুক্ষিগত, যেখানে শতকরা পঁচাশি জন কৃষকের মধ্যে শতকরা সত্তর জন কৃষকের হাতে কিছু (দুই তিন বিঘা) জমি আছে, এবং অধিকাংশই হচ্ছে সর্বহারা ক্ষেতমজুর, সেই ক্ষেত্রে পঁচিশ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করার ঘোষণা ও তহশীলদারী সীমিতকরণ– কাদের স্বার্থ রক্ষা করে? কৃষকের? নাকি জোতদার, মহাজন, ইজারাদার প্রভৃতি সামন্তবাদী শ্রেণির স্বার্থ রক্ষা করে? কৃষকের হাতে জমি থাকলে তবেই তো এই ঘোষণা (সমাজতন্ত্রের) তাদের স্বার্থে লাগবে?[12]

বিপ্লবোত্তর সোভিয়েত ইউনিয়ন কিংবা চীনের রাষ্ট্রীয়করণ প্রক্রিয়ার সাথে বিশ্বের অন্যান্য বুর্জোয়া রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয়করণ প্রক্রিয়ার মৌলিক পার্থক্য ছিল। বুর্জোয়া রাষ্ট্রে শিল্প প্রতিষ্ঠানের রাষ্ট্রীয়করণ ব্যক্তি পুঁজির উচ্ছেদের স্বার্থে নয় বরং তার বিপরীতে, পুঁজির প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করার স্বার্থে। চীন কিংবা সোভিয়েত ইউনিয়নে রাষ্ট্র ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ এবং শিল্পায়ন প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের দায়িত্ব ছিল শ্রমিক-কৃষকের প্রতিনিধিত্বকারী শক্তির হাতে। অপরদিকে, আওয়ামী লীগ নির্দিষ্ট কোন শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করেনি এবং ‘দলটি প্রকাশ্যে শ্রেণি সংগ্রামের সাথে তাদের সম্পর্কের কথা অস্বীকার করতো।’[13] এবং পরবর্তীকালে গৃহীত বিভিন্ন পরিকল্পনা থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, ব্যক্তি মালিকানার পুঁজিবাদী ধরনের উচ্ছেদ নয় বরং তার পুনঃপ্রতিষ্ঠাই ছিল তাদের মূলনীতি।

বস্তুত, ৬ দফা, বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিলেও ‘‘এই দলের কোন সুদূরপ্রসারী(সমাজতান্ত্রিক)কর্মসূচি বা সেই কর্মসূচিকে রূপদানের জন্য কোন বিপ্লবী কর্মীবাহিনী ছিল না’’ দাবী করে একজন বিশ্লেষক বলেন, ‘‘আইয়ুব খানের স্বৈরাচার ও পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শোষণের বিরুদ্ধে জনগণের মুক্তির সার্বিক আকাঙ্ক্ষাকে মূর্ত করে ষাট দশকের মধ্যভাগ থেকে শেখ মুজিবুর রহমান(সোহরাওয়ার্দীর ‘অশুভ’ প্রভাব অপসৃত হলে)যে নির্ভীক নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তার ফলে গণচিত্তে তাঁর একটি অভূতপূর্ব স্থান বা charisma সৃষ্টি হয়েছিল কিন্তু ‘‘লীগের বৃহদাংশের শ্রেণিচরিত্র ও আদর্শগত ধ্যানধারণা সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির পরিপন্থী ছিল’’।[14] গোড়ার দিকে মূলত পাকিস্তানী প্রকল্পের সীমার মধ্যে থেকে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং মওলানা ভাসানীর রাজনীতি পূর্ব পাকিস্তানের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে ঘিরে আবর্তিত হয়। সে সময় শেখ মুজিবের রাজনৈতিক উত্থানও একই সীমার মধ্যে থেকেই হয়। কর্মী সমর্থকগোষ্ঠীর অবস্থান থেকে বিবেচনা করা হলে, ভিত্তি হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানের উদীয়মান মুসলমান মধ্যবিত্ত সমাজের মধ্যে শেখ মুজিবর রহমান একটি শক্ত অবস্থান তৈরী করতে সমর্থ হন। কারণ? ‘পাকিস্তান কাঠামোর মধ্যে ক্রমবর্ধমান এই মধ্যবিত্তদের অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা বিরোধপূর্ণ হয়ে উঠেছিল এবং পাকিস্তানের অস্তিত্বকে অস্বীকার করার একটি শর্ত তৈরী হয়েছিল।’[15] দলের প্রধান নেতৃত্ব মুসলমান মধ্যবিত্তীয় এই আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে শামিল করতে পেরেছিলেন।  

একটি পরিসংখ্যানের দিকে নজর দিলে লীগের মধ্যে মধ্যবিত্তীয় প্রভাব এবং এই সম্প্রদায়ের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের দলীয় প্রচেষ্টা সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায়। যেমন, ১৯৬৯-৭০ সালের পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের শ্রেণি বিন্যাসের দিকে নজর দিলে দেখা যায়; দলের উচ্চ পর্যায়ের নেতৃত্বের মধ্যে ২১ জন অর্থাৎ প্রায় ৫৭ শতাংশ পেশায় ছিলেন আইনজীবী, ২১ জন (প্রায় ২৯ শতাংশ) ছিলেন ব্যবসায়ী (ঠিকাদার এবং বীমা কোম্পানির লোকজন), ট্রেড ইউনিয়ন নেতা ১ জন (প্রায় ৩ শতাংশ), বড় ভূমির মালিক ২ জন (প্রায় ৬ শতাংশ), প্রাক্তন স্কুল এবং কলেজ শিক্ষক ২ জন (প্রায় ৬ শতাংশ)।[16]

’৭০ সালের সাধারণ জাতীয় পরিষদ নির্বাচনের সময় ১৬২ জন নমিনেশনপ্রাপ্ত প্রার্থীদের মধ্যে শতকরা প্রায় ৭ শতাংশ ছিলেন বৃহৎ ভূমির মালিক। এছাড়া বাকীদের মধ্যে ৭৭ জন ছিলেন আইনজীবী (প্রায় ৪৭%। এদের মধ্যে ৩ জন ছিলেন ব্যবসায়ের সাথে যুক্ত এবং একজন বৃহৎ ভূমির মালিক এবং অনেকে ছিলেন ‘পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত’), ৭ জন ডাক্তার (প্রায় ৪%), ব্যবসায়ী ৩১ জন (প্রায় ১৯%), প্রাক্তন সরকারি চাকুরিজীবী, ৩ জন (প্রায় ২%), স্কুল শিক্ষক ৬ জন (প্রায় ৪%), বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজ শিক্ষক ১০ জন (প্রায় ৬%), ট্রেড ইউনিয়ন নেতা ১ জন (প্রায় ১%। জাতীয় শ্রমিক লীগের নেতা।), ছাত্রনেতা ৩ জন (প্রায় ২%), সাংবাদিক ৫ জন (প্রায় ৩%), প্রাক্তন মিলিটারি কর্মকর্তা ৩ জন (প্রায় ২%), অন্যান্য ৯ জন (প্রায় ৬%)। মোট প্রার্থীদের মধ্যে ১৬০ জন ছিলেন মুসলমান (প্রায় ৯৮.৮%), ১ জন হিন্দু (প্রায় ০.০৬%), ১ জন বৌদ্ধ (প্রায় ০.০৬%)।[17]  উল্লেখযোগ্য যে, ১৯৭৩ সালের নির্বাচনের সময়ও এই শ্রেণিবিন্যাসের খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। বাংলাদেশের নতুন সংসদের শতকরা প্রায় ৬০ ভাগ সংসদ সদস্য ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান সংসদের সদস্য। নতুন সদস্যদের সাথে ’৭৩ সালে তারা পুনরায় নির্বাচিত হন।[18] 

আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায়সমাজতান্ত্রিকউৎপাদন, বণ্টনে পুঁজিবাদ

২৬ মার্চ, ১৯৭২ সালে ‘বাংলাদেশ শিল্প কারখানা জাতীয়করণ অধ্যাদেশ’ প্রণীত হয়। এই অধ্যাদেশের বলে প্রায় ৮৫ শতাংশ শিল্প-কারখানা জাতীয়করণ করা হয়। দেশীয় ব্যাংক-বীমাসহ বৃহৎ কলকারখানা রাষ্ট্রীয়করণের দাবী ছিল ১৯৬৯ সালে ১১ দফাতে। ‘‘১৯৭২ সালে কেবলমাত্র বৃহৎ কলকারখানাই রাষ্ট্রীয়করণ করা হয়নি, অনেকটা প্রায় অনন্যোপায় হয়ে পাকিস্তানি মালিকদের পরিত্যক্ত ৪০০টি ক্ষুদ্র শিল্পও রাষ্ট্র-মালিকানায় নিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিল সরকার। প্রাক্তন ই.পি.আই.ডি.সি (East Pakistan Industrial Development Corporation)পরিচালনাধীন ৫৩টি শিল্প-কারখানা ও বাঙ্গালী ব্যক্তি মালিকানাধীন ৭৫টি বস্ত্র ও পাটকলও রাষ্ট্রস্বত্বের অন্তর্ভুক্ত হয়। ‘বাঙ্গালী ব্যক্তিমালিকানাধীন’ বলা অবশ্য আক্ষরিক অর্থে সত্যি নয়, কারণ এই সব বস্ত্র ও পাট কলে বাঙ্গালী মালিকদের নিজস্ব বিনিয়োগ ২৪ শতাংশের বেশী ছিল না। অবশিষ্ট ৭৬ শতাংশ মূলধন এসেছিল সরকারি ঋণ ও জনগণের বিনিয়োগ থেকে।’’[19] 

পশ্চিম পাকিস্তানী মালিকশ্রেণির তুলনায় বাঙ্গালী পুঁজির মালিক, শিল্পপতি এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মালিকরা ছিল খুবই অল্প এবং শ্রেণি হিসেবে যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল না। এ অঞ্চলের বেশীরভাগ পুঁজির মালিকরা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানী বড় পুঁজির মালিকদের অংশীদার। তাছাড়া, ‘পূর্ব পাকিস্তানের নবজাতক বুর্জোয়াদের তুলনায় লীগ নেতৃত্বের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের বৃহৎ বুর্জোয়াদের সাথে।[20] যার ফলে, পূর্বাংশের মালিকদের পক্ষে লীগের অভ্যন্তরে একটি শক্ত অবস্থান তৈরী করা সম্ভব হয়নি। অনুপস্থিত পশ্চিম পাকিস্তানী বৃহৎ মালিকদের সাথে যখন এ অঞ্চলের মালিকদের শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রের আওতায় আনা হয় তখন স্থানীয় পুঁজিপতিদের সেটি মেনে নেওয়া ছাড়া কোন উপায় ছিল না। ফলে, ১৯৬০ সালের দিকে আইয়ুব শাসনের আমলে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা বাঙ্গালী এই উদ্যোক্তা শ্রেণি ‘সমাজতান্ত্রিক’ রাষ্ট্রীয়করণের ফলে কিছুটা ঝামেলায় পড়ে যায়। রেহমান সোবহানের ভাষ্যমতে, তারা ‘felt diminished and vulnerable’[21]

রাষ্ট্রীয়করণের ফলে যদিও শিল্পীয় শাখার পূর্বতন উদ্যোক্তা শ্রেণির মধ্যে সাময়িক পশ্চাদপসরণ দেখা দেয় কিন্তু বুর্জোয়াদের অপরাপর শ্রেণির ব্যবসায়ীদের আনাগোনা তাতে থেমে থাকেনি। ব্যবসা-বাণিজ্যের সাথে যারা যুক্ত ছিল কিংবা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা প্রাপ্তির মাধ্যমে যারা ব্যবসায় নতুনভাবে প্রবেশ করতে চেয়েছে তাদের সম্পদ ভাগ্য উত্তোরোত্তর বৃদ্ধির অসামান্য সুযোগ তৈরী হয় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার কারণে। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে লীগ এ সমস্ত সুবিধাভোগীদের প্রতিরোধ করতে পারেনি। মন্ত্রণালয়ের ভেতর এবং দলের উচ্চপর্যায়ের কোন কোন নেতার নেতৃত্বে ব্যবসায়িক এই গোষ্ঠীটি তাদের স্বার্থে ব্যবসায়ীবান্ধব নীতি-পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পক্ষে কাজ করেছিল।[22]

একটি হিসেবে দেখা যায় যে, শিল্প-কারখানার শতকরা ২১ শতাংশ, শতকরা ২৭ ভাগ ট্রেডিং কোম্পানি এবং শতকরা ৭৫ ভাগ ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান ‘পরিত্যক্ত’ অবস্থায় পাওয়া যায় যেসবের নিয়ন্ত্রণ এবং মালিকানা ছিল অবাঙ্গালী পুঁজিপতিদের হাতে যারা মোট জনসংখ্যার শতকরা ১ ভাগেরও কম ছিল। যুদ্ধোত্তর পরবর্তী বাংলাদেশে ৩,৭০৪টি নিবন্ধিত ম্যানুফ্যাকচারিং প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৭৮৬টি ইউনিট পাওয়া যায় যেগুলোর মালিকরা প্রতিষ্ঠান রেখে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যায়। ৯,২৯৩টি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২,১৮৭টি এবং ১২টি ব্যাংকের ১১৭৫টি শাখার অবাঙ্গালী ব্যবস্থাপক/কর্মকর্তাদের একটি বড় অংশ প্রতিষ্ঠান ছেড়ে চলে যাওয়ার কারণে সেসবের ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের শূণ্যতা দেখা দেয়।[23] ‘পরিত্যক্ত’ এই শিল্প-কারখানা, ব্যাংক-বীমা, আর্থিক-বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনার ভার দেয়া হয় আওয়ামী লীগের সাথে সম্পর্কিত দলীয় লোকজনের হাতে অথবা সম্পর্কিত আমলাদের হাতে।      

‘পরিত্যক্ত’ প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনাগত সমস্যা দেখা দিলে পুরাতন সংস্থাগুলোর পাশাপাশি নতুন সরকারি সংস্থা গড়ে তোলা হয়। বাঙ্গালী এবং পাকিস্তানি অংশিদারীত্বের যাবতীয় সম্পত্তিসমেত ১২টি বাণিজ্যিক ব্যাংককে রাষ্ট্রীয় আওতায় আনা হয় এবং নতুন ছয়টি ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। বাংলাদেশে পাকিস্তান স্টেট ব্যাংকের সম্পত্তি এবং পাবলিক অংশিদারিত্বের অর্থসমেত বাংলাদেশ ব্যাংক স্থাপন করা হয়। পাকিস্তান হাউজ বিল্ডিং ফিন্যান্স কর্পোরেশনের পরিবর্তে অবশিষ্ট পুঁজি নিয়ে বাংলাদেশ হাউজ বিল্ডিং ফিন্যান্স কর্পোরেশন স্থাপন করা হয়। বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক, বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা একইভাবে স্থাপন করা হয়। জীবন বীমা ও সাধারণ বীমা ব্যবসার পরিচালনার জন্য দু’টো সংস্থা গড়ে তোলা হয়। কৃষি উন্নয়ন সংস্থা, কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, পাট সংস্থা, চা সংস্থা, বন্দর ট্রাস্ট, বিভিন্ন নগর উন্নয়ন ট্রাস্ট, পানি এবং পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ, অভ্যন্তরীণ নদী এবং পরিবহণ কর্তৃপক্ষ প্রভৃতি পূর্ববর্তী কাঠামোর ধারাবাহিকতায় চলতে থাকে। পানি এবং জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে ভাগ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং জ্বালানি উন্নয়ন বোর্ড-এ রূপান্তরিত করা হয়। পাশাপাশি তুলা, তামাক, হর্টিকালচার বোর্ড স্থাপন করা হয়। বৈদেশিক বাণিজ্য পরিচালনার জন্য ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) স্থাপন করা হয়। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখার জন্য কনজ্যুমার্স সাপ্লাই কর্পোরেশন স্থাপন করা হয়। রপ্তানী শিল্প পাটকে রাষ্ট্রীয়করণ করা হয় এবং বাংলাদেশ জুট এক্সপোর্ট কর্পোরেশন তৈরী করা হয়। অবাঙ্গালী ব্যক্তি মালিকানাধীন ৬টি নদী পরিবহণ কোম্পানিসমেত পূর্ব পাকিস্তান শিপিং কর্পোরেশনকে একীভূত করে গঠন করা হয় ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশন। বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন একইসময়ে যাত্রা শুরু করে।

পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (পিআইডিসি)-কে স্থগিত করে পরিত্যক্ত ২৫ লক্ষ টাকার (তৎকালীন টাকার দাম হিসেবে) সমদামের স্থায়ী সম্পত্তির শিল্প-প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য ১০টি কর্পোরেশন তৈরী করে। এ সমস্ত পরিত্যক্ত শিল্প-কারখানার একটি অংশ মুক্তিযুদ্ধ কল্যাণ ট্রাস্ট এবং সেনা কল্যাণ সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া হয়। বাদবাকীগুলো বেসরকারি খাতে তুলে দেওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সরকারের হাতে রেখে দেওয়া হয়।[24] খেয়াল করলে দেখা যাবে, এসব সংস্থা হয় পূর্বতন কাঠামোর ধারাবাহিকতা; অথবা পূর্বতন কাঠামোর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে গড়ে তোলা। পাকিস্তান আমলে যেসব ছিল প্রাদেশিক কাঠামোর (সচিবালয়, বিভাগ, অধিদপ্তর, কর্পোরেশন) সেসবই ‘জাতীয়’ হিসেবে কেন্দ্রীয় জায়গায় প্রতিস্থাপিত হয়। 

প্রশাসকদের অধিকাংশের শিল্প-প্রতিষ্ঠান পরিচালনার পূর্ব অভিজ্ঞতা কিংবা দক্ষতা কোনটিই ছিল না এবং বেশীরভাগ নিয়োগ দেওয়া হয় দলীয় সম্পর্কিত ব্যক্তিবর্গকে। এ ধরনের পৃষ্ঠপোষকতার বিষয়টি বরাবরই ছিল; একীভূত পাকিস্তান রাষ্ট্রে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকদের মধ্যে যেমন তেমনি পূর্ব পাকিস্তানেও।[25] এছাড়া বড় শিল্প-প্রতিষ্ঠানগুলোর রাষ্ট্রীয়করণের ফলে দুই ধরনের ঘটনা ঘটে। প্রথমত: এই প্রক্রিয়ার ফলে শিল্প-কারখানার একটা বড় অংশ এবং সেসবের কর্মকর্তা/কর্মচারী কিংবা শ্রমিক সরাসরি সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন ব্যবস্থাপনার অধীনে চলে আসে। দ্বিতীয়ত: এর ফলে সরকার এককভাবে সবচেয়ে বড় কর্মসংস্থানের এজেন্সি হিসেবে জায়গা করে নেয়। কিন্তু বড় মাপের নিয়োগ মোকাবিলার জন্য সাংগঠনিক এবং সরকারি কর্মী ব্যবস্থাপনার অপ্রতুলতা ও অদক্ষতার কারণে সমস্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। [26]

অন্যদিকে, বিভিন্ন ধরনের জটিলতা প্রশাসকদের জন্য বড় একটি সুযোগ তৈরী করে দেয়। অনেকটা, ‘এলোমেলো করে দে মা, লুটেপুটে খাই’ গোছের। দেখা গেছে, প্রশাসকদের একটি বড় অংশ ‘পরিত্যক্ত’ প্রতিষ্ঠানগুলোর বিভিন্ন ধরনের অস্থায়ী সম্পদ নিজেরা সরাসরি অথবা ট্রেডইউনিয়ন নেতা অথবা কতিপয় শ্রমিকের যোগসাজশে হাতিয়ে নিয়ে বাইরে চালান করে দিয়েছে। উৎপাদনী ক্ষমতাসম্পন্ন ‘পরিত্যক্ত’ প্রতিষ্ঠানগুলো এই প্রক্রিয়ায় লোকসানী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় অন্যদিকে ফুলে ফেঁপে ওঠে প্রশাসকরা। তাতে কেবল দেশের অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছে এমনটি নয় উপরন্তু জনগণের ভোগ যোগানকে প্রভাবিত করেছে এবং বৈদেশিক বিনিময়ের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় আয় থেকেও বঞ্চিত হয়েছে রাষ্ট্র।[27]

আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনিক ব্যবস্থার যাত্রারম্ভ হয় ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালের পরপরই। রাষ্ট্রের প্রাদেশিক প্রশাসনকে রাতারাতি কেন্দ্রীয় স্তরে উন্নীত করে দেওয়া হয়। পূর্বতন প্রাদেশিক সচিবালয় জাতীয় সরকারের কেন্দ্রীয় সচিবালয়ে রূপান্তর ঘটলেও সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর থেকে শুরু করে অধীনস্ত অফিস-আদালত এবং মাঠ পর্যায়ের সমস্ত প্রশাসনিক ব্যবস্থা পাকিস্তান আমলের কাঠামো-পদ্ধতি-প্রক্রিয়া অনুযায়ী চলতে শুরু করে।[28] ফলে, একদিকে পুরাতন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের পূর্ব পাকিস্তান ভিত্তিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাবেক বহাল এবং বাংলাদেশ সরকারের সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারিদের মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রকট আকার ধারণ করে। এ সমস্যা সমাধানের জন্য ২৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে সরকার ‘Civil Administration Restoration Committee‘ নামে একটি কমিটি করে। তার কাজ ছিল এক; প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের পুনঃপ্রতিষ্ঠা, দুই; সাবেক পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বিদ্যমান প্রশাসনে অন্তর্ভুক্তিকরণ, তিন; পূর্বতন কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাদেশিক পূর্ব পাকিস্তানের মন্ত্রণালয়/বিভাগের বিভিন্ন অংশের কাঠামোর মধ্যে নতুন সরকারি প্রশাসনিক কাঠামো একীভূতকরণের উপায় এবং পদ্ধতি বের করা। অন্যভাবে বলা যায়; যা কিছু পুরাতন প্রশাসনিক আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু ছিল, সেসব রেখে দিয়ে নাম, ব্যক্তি, পদ পরিবর্তন করে আমলাতন্ত্রের রথে যাত্রা শুরু করে সরকার।

আমলাতন্ত্রের একীভূতকরণ প্রচেষ্টাটি খেয়াল করলে দেখা যাবে, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোগুলো মূলত বৃটিশ ভারত এবং পাকিস্তান আমলাতন্ত্রের সংযোজন-বিয়োজন অর্থাৎ ধারাবাহিকতা ছাড়া এসবের মধ্যে মৌলিক তেমন কোন পার্থক্য নেই। ইন্ডিয়ান প্ল্যানিং কমিশন (আইপিসি)-র বৈদেশিক ঋণ বিষয়ক যা কিছু সমঝোতা তার যাবতীয় দায়-দায়িত্ব বহন করতো অর্থ মন্ত্রণালয় বিভাগ। অন্যদিকে, পাকিস্তান প্ল্যানিং কমিশন (পিপিসি)-র সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বৈদেশিক ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের ছিল নিরঙ্কুশ ক্ষমতা। ঋণ সম্পর্কিত যাবতীয় সমঝোতার ক্ষেত্রে বিদেশী ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের ছিল সার্বভৌম নিয়ন্ত্রণ এবং পিপিসি-র ডেপুটি চেয়ারম্যান রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের কোন ধার ধারতেন না।[29] তারই ধারাবাহিকতায় সদ্যজাত বাংলাদেশে ইন্ডিয়ান প্ল্যানিং কমিশন (আইপিসি) এবং পাকিস্তান প্ল্যানিং কমিশন (পিপিসি)-র প্রণীত পরিকল্পনার মিশ্রণে বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস (বিপিসি)-র পরিকল্পনা গৃহীত হয়।[30] এই কমিশনের যাবতীয় পরিকল্পনা যাচাই-বাছাই করা হতো লীগ নেতৃত্বাধীন মন্ত্রণালয়ের অধীনে। ‘‘এসব মন্ত্রণালয়ের একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক মন্ত্রীদের ‘সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি’ সম্পর্কে যথেষ্ট ‘ভুল ধারণা’ ছিল।[31]’’ এছাড়া পাকিস্তানের প্রশাসনিক ব্যবস্থাই বহাল থাকে বাংলাদেশের সিংহভাগ মন্ত্রণালয়ে যেখানে সিনিয়র আমলাদের নিয়ন্ত্রণ এবং আধিপত্য বজায় থাকে আগের মতো। উল্লেখ্য যে, সিনিয়র আমলাদের বেশীরভাগের সাথে বাংলাদেশ আন্দোলনের কোন সম্পৃক্ততা ছিল না। তাদের অধিকাংশ যে বাংলাদেশপন্থী ছিল এমন কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বরং, ’৭১ সালের শেষ অব্দি পাকিস্তানের প্রশাসনের সাথে এই আমলাদের অধিকাংশ জনেরই সম্পৃক্ততা ছিল। 

উল্লেখ্য যে, ঔপনিবেশিক প্রত্যক্ষ শাসন থেকে বের হওয়া ‘তৃতীয় বিশ্বে’র বিভিন্ন রাষ্ট্রের আমলাতন্ত্র (সামরিক ও বেসামরিক) কখনও বিদেশী রাষ্ট্রের প্রভাবমুক্ত হয়ে বিকশিত হতে পারেনি। স্থানীয় পুঁজি এবং বুর্জোয়া শ্রেণির বিকলাঙ্গ বিকাশ; পাশাপাশি ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের বাহ্যিক প্রভাবের কারণে পূর্ব ধরন-কাঠামোর সাথে মিশ্র আমলাতান্ত্রিক কাঠামো গঠন স্বাধীনতা উত্তর বিভিন্ন দেশের প্রত্যক্ষ বাস্তবতা। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও প্রশাসনিক কাঠামো এবং শ্রেণিবিন্যাসে পরিবর্তন আনতে না পারার ফলে ধীরে ধীরে পাকিস্তান আমলের মতো আমলাতান্ত্রিক প্রভাব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। উদাহরণ হিসেবে Laws Enforcement Continuance Enforcement Order (ইস্যুর তারিখ এপ্রিল ১০, ১৯৭১) এর কথা উল্লেখ করা যায়। এই আইন মোতাবেক ২৫ মার্চ, ১৯৭১-এর পূর্বের জারীকৃত যত আইন সেসব ‘পূর্বেকার মতোই বলবৎ থাকবে’ মর্মে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এছাড়া আইন জারী করা হয় যে, ‘যারা নতুন সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করবেন এমন পূর্বতন সরকারি কর্মকর্তা/কর্মচারীরা পূর্বেকার নিয়ম এবং শর্তাবলী অনুযায়ী তাদের চাকুরীতে বহাল থাকতে পারবেন’। মোটকথা, পাকিস্তান আমলের কেন্দ্রীয় Central Public Service Commission (CPSC)এবং প্রাদেশিক East Pakistan Public Service Commission (EPPSC) সরকারের সব ধরনের কাঠামো-প্রক্রিয়া-ধরনকে মৌলিকভাবে অপরিবর্তিত রেখে নতুন সরকারের যাত্রারম্ভ হয় ‘স্বাধীন’, ‘সার্বভৌম’ বাংলাদেশে।[32]

আমলাতান্ত্রিক গঠন/পুনর্গঠনের পাশাপাশি ক্ষুদ্র শিল্প ইউনিটগুলোর জন্য ব্যক্তিগত পুঁজির সীমা ১৫ লাখ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ৩৫ লাখ টাকা করা হয়। কাগজে কলমে এই সীমা থাকলেও ‘বাস্তবে এর পরিমাণ অনেক বেশী’[33] ছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। পরবর্তীতে এর পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পায়। একদিকে সিলিং বৃদ্ধি এবং অন্যদিকে পাট, চিনি এবং অন্যান্য শিল্পকে ‘অলাভজনক’, ‘উৎপাদনের অযোগ্য’, ‘ব্যয়বহুল’ প্রভৃতির কারণ দেখিয়ে সরকারি বিনিয়োগ থেকে বঞ্চিত করে ব্যক্তিখাতে তুলে দেওয়ার প্রক্রিয়াটিও ছিল আলোচনা-সমালোচনার বিষয়। প্রগতিশীল মহল থেকে এর প্রচুর সমালোচনা করা হয়। যারা শিল্প ইউনিটগুলো ‘মূল্যায়ন’ প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত ছিলেন তাদের বৈধতা সম্পর্কেই বদরুদ্দীন উমর প্রশ্ন তুলে বলেছেন, মূল্য নির্ধারণের জন্য সরকার যাদের দায়িত্ব দিয়েছে ‘‘তারা কারা? হয় তারা বিদ্যমান ম্যানেজার অথবা উক্ত কাজের ‘উপযুক্ত’ আমলা। যারা শিল্প ইউনিটগুলোর অবচয় এবং অন্যান্য হিসাব-নিকাশ করে ব্যক্তিগত বিনিয়োগের সর্বোচ্চ সীমার মধ্যেই রাখবে। অন্যভাবে বললে, যাতে ৩৫ লাখ টাকার উর্দ্ধে না যায় এমনভাবে (শিল্প ইউনিটগুলোর) তারা মূল্যায়ন করবে।’’[34]  পরবর্তীতে এ ধরনের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ব্যক্তি মালিকদের হাতে তুলে দেয় রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প ইউনিটগুলোকে।

১৬ জুলাই, ১৯৭৪ সালে নতুন বিনিয়োগ পলিসি করা হয় বৈদেশিক বিনিয়োগ এবং ব্যক্তি পুঁজিকে আকৃষ্ট করার জন্য। ‘নয়া বিনিয়োগ পলিসি’তে পূর্বের প্রথম পলিসির বিনিয়োগ সীমা পরিবর্তন করে ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়।[35] সরকারি এবং বেসরকারি ব্যক্তি মালিকানা উভয় ক্ষেত্রের সাথে বৈদেশিক বিনিয়োগের অনুমোদন দেওয়া হয়। বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সিলিং পুরোপুরি তুলে দেওয়া হয়।[36] রাষ্ট্রীয়করণ স্থগিতকরণের[37] ঘোষণা দেওয়া হয় এবং পরবর্তীতে ব্যক্তি মালিকানাধীন শিল্প প্রতিষ্ঠান অধিগ্রহণ করা হলে ‘উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ’ প্রদানসাপেক্ষে তা করা হবে এই মর্মে ঘোষণা দেওয়া হয়। ব্যক্তি মালিকানাধীন পুঁজির ক্ষেত্রে ৭ বছরের জন্য কর অবকাশ এবং নানা ধরনের প্রণোদনার ঘোষণা দেওয়া হয়।[38] ‘স্থগিতাদেশ’-এর মেয়াদ সম্পর্কে প্রগতিশীল রাজনৈতিক মহলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরী হয়।[39]

‘সমাজতন্ত্রে’র উল্টো পথে ছোটার গতির এই ‍সুযোগে রাতারাতি অল্প কিছু ব্যক্তির বিত্তশালী হওয়ার পথ পরিষ্কার হয়ে যায়।[40] এছাড়াও বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় অবৈধভাবে অর্থ-সম্পদ আত্মসাৎকারীদের বিদেশে পাচারের অভিযোগ সম্পর্কে সংবাদ এবং গবেষণা থেকে জানা যায়, ‘জানুয়ারি ১৯৭২ সাল থেকে আগস্ট ১৯৭৫ পর্যন্ত বিদেশে পাচারকৃত এই অর্থ সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ৬,০০০ কোটি টাকা’।[41] অথচ ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ এবং ভয়াবহ বন্যায় সরকারি হিসাবে ২৭,০০০; বেসরকারি হিসাবে ১,০০,০০০ থেকে ৪,৫০,০০০ মানুষের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে মৃত্যু ঘটে।[42] এর আশু কারণ ছিল, ফসল উৎপাদনকারী এবং খাদ্যশস্য ব্যবসায়ীদের মজুদ ও ফাটকাবাজি। অবশ্য এর স্থানীয়ভাবে তীব্রতার মূলে ছিল খাদ্য মন্ত্রণালয়ের রক্ষণশীলতা।[43] খাদ্যশস্যের বিতরণ ব্যবস্থা এবং সেক্ষেত্রে একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর হাতে অর্থাৎ ব্যবসায়ী ও বড় কৃষকের হাতে উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য কেন্দ্রীভূত হওয়ার বিপদ সম্পর্কে সচেতন করে রেহমান সোবহান বলছেন, ‘বিশ্বব্যাংকের নীতি হচ্ছে খাদ্য ঘাটতির এ মোক্ষম হাতিয়ারকে ব্যবহার করে ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষা ও তাদের গড়ে তোলার জন্য সরকারকে চাপ দেয়া এবং অবশেষে আমদানীকৃত খাদ্যশস্যের পুরো ব্যবসাটাই এসব ব্যবসায়ীর হাতে তুলে দেয়া।’’[44] প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, যুদ্ধের পর সরকারের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্বব্যাংকের নিকট অতীতের ফাটলধরা সম্পর্কে জোড়া লাগে এবং ঘনিষ্ঠ হতে থাকে।

অন্যদিকে, রাষ্ট্রীয়করণ উদ্যোগকে সমাজতান্ত্রিক পদক্ষেপের সাথে এক করে দেখার ক্ষেত্রে সরকারের সাথে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক পুঁজিপতি শ্রেণির পারস্পরিক সম্পর্ক কী ধরনের সেটি খেয়াল রাখা দরকার। সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ বজায় রেখে রাষ্ট্রীয়করণ কর্মসূচির বাস্তবায়ন এবং তার সুফল ভোগ যে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে সম্ভব হবে না প্রথম থেকেই তার ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল। পাকিস্তান আমলে ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র’[45] এবং বৃটিশ ব্যাংক, বীমা, চা শিল্প প্রভৃতিকে নজরদারির বাইরে রেখে সংরক্ষণের নীতি গ্রহণ করেছিল। স্বাধীন বাংলাদেশেও সেসব শিল্প-প্রতিষ্ঠানকে ধরাছোঁয়ার বাইরে রেখে দেওয়া হয়েছিল।[46] তাছাড়া, ব্যাংক, বীমা কোম্পানি প্রভৃতির রাষ্ট্রীয়করণ কিংবা ঋণ এবং বিনিয়োগ পলিসির মধ্যে কোন মৌলিক পরিবর্তন করা হলেই যে তা সমাজতান্ত্রিক উদ্যোগকে ত্বরান্বিত করবে এর যথার্থ কোন ভিত্তি নেই। বিশ্বের বহু ধনতান্ত্রিক দেশ আছে যাদের সরকার সুক্ষতর উপায়ে ঋণ পলিসির মৌলিক পরিবর্তন ঘটিয়েছে ব্যক্তি পুঁজির শিল্প-ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থে। তাই, বিদেশী পুঁজির স্বার্থকে রাষ্ট্রের আওতায় নিয়ে আসা যত না অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত; তার চাইতে এটি অনেক বেশী ‘রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত’[47]; যা পুঁজির মালিকানার রাজনীতির চাইতে মৌলিকভাবে পৃথক।

সাংগঠনিক কাঠামোগত দুর্বলতা, মতাদর্শিক অবস্থান, পুঁজিপতি শ্রেণির অসংগঠিত বিকাশ, আমলাতান্ত্রিক ঐতিহ্যগত নির্ভরতা ইত্যাদি নানাবিধ কারণে আওয়ামী লীগ সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য সাবেক পুঁজিপতি এবং আমলাতন্ত্রের হাতে তুলে দেয়। অর্থাৎ, রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প প্রতিষ্ঠান তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয় যারা সমাজতন্ত্রের বিরোধী একটি শক্তিশালী পক্ষ; শ্রমিকশ্রেণির স্বার্থ বিরোধী ব্যক্তি মালিকানাধীন পুঁজির প্রতিনিধিত্বকারী শ্রেণি। এর ফলে একদিকে, রাষ্ট্রীয়করণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মূলত ব্যক্তি মালিকানাধীন পুঁজির বিকাশের রাস্তাকে পরিষ্কার করা হয়। অন্যদিকে, রাষ্ট্র পরিচালনায় আমলাতন্ত্র নির্ভর একটি ব্যবস্থার বীজ রোপণ করা হয়। সাবেক ব্যক্তি পুঁজিপতি এবং আমলাতন্ত্রের এই পারস্পরিক স্বার্থগত ঐকতানের মধ্য দিয়ে যে কাঠামো বিন্যাস দাঁড়ায় তা রাষ্ট্রীয়করণ এবং সরকারি খাতের জন্য কোন সুফল বয়ে আনেনি। বরং বিপরীতে, নতুন নতুন যত ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রায়ত্ত খাতে আনা হয়েছে তত বেশী সাবেক এই ‘শিল্পীয় আমলাতন্ত্র’[48] শক্তিশালী হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প খাত পরিচালনাকারী এইসব ব্যক্তিবর্গ পরবর্তীতে শিল্পক্ষেত্রে ব্যক্তি পুঁজির বিকাশে নেতৃত্ব প্রদান করে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ১৯১৭ সালের সোভিয়েত রাশিয়ার কমিউনিস্ট বিপ্লবের পর শুরুতে ব্যক্তিগত বৃহৎ ভূমি সম্পত্তি এবং উৎপাদনের ব্যক্তিগত মালিকানা বিলোপ সাধনের উদ্দেশ্যে উৎপাদনী উপকরণ রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব এবং নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। বুলগেরিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরী, পোল্যান্ড, রুমানিয়া, ইয়োগোশ্লাভিয়া একই পথ অনুসরণ করে। এই নীতি অনুসরণের পেছনে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সাম্যের দর্শন ছিল। পরিকল্পিত অর্থনীতি এবং পূর্ববর্তী পুঁজিবাদী ব্যবস্থা উচ্ছেদের উদ্দেশ্য ছিল এই পথ অনুসরণের নেপথ্যে। বিপরীতদিকে, ১৯২৯-এর মহামন্দার পর পুঁজিবাদী অর্থনীতির সঙ্কট দেখা দিলে বিশ্বজুড়ে এর প্রভাব পড়ে। সঙ্কটের প্রভাব এড়াতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পুঁজিবাদী বিশ্বের কেন্দ্রস্থ বহু দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাবে শিল্প-কারখানা রাষ্ট্রীয়করণের নীতি গ্রহণ করে। ব্যক্তিগত সম্পত্তির ভিত্তিমূলক পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক কাঠামো, ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান এবং প্রতিযোগিতার কোন ‍উচ্ছেদ সাধন না করে এ দেশগুলোতে বড় বড় বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেওয়া হয়। বিশেষ করে বৃটেন, ফ্রান্স, ইটালি, অস্ট্রিয়া, জার্মানির মতো দেশগুলোতে। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোন কোন রাজ্যে এই ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। ১৯৫৬-’৭২ সালের মধ্যে এশিয়া, আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকার ৪০টিরও বেশী দেশে প্রায় ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমূল্যের সম্পত্তি রাষ্ট্রীয়করণের আওতায় আনা হয়। এর মধ্যে ছিল কৃষি, ভূমি, খনিজ সম্পদ, শিল্প-কারখানা, বাণিজ্য, সেবা-পরিষেবা, ব্যাংক, বীমা কোম্পানি, পরিবহণ, জ্বালানি, বিদ্যুৎ, নির্মাণ ইত্যাদি। অন্য আরেকটি হিসাবে দেখা যায় যে, ১৯৬০-’৭৪ সালের মধ্যে বিশ্বের প্রায় ৬২টি দেশে প্রায় ৮৭৫টি রাষ্ট্রীয়করণের ঘটনা ঘটে যার মধ্যে ৩৪০টি উদ্যোগ নেওয়া হয় আফ্রিকাতে।[49]

পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোর সাথে ‘সমাজতান্ত্রিক’ রাষ্ট্রীয় এই উদ্যোগগুলোর বেশকিছু গুণগত পার্থক্য ছিল। যেমন; এক, ‘সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ছিল কমিউনিস্ট পার্টির হাতে যারা শ্রমিক শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করতো (বিপরীতে এই ক্ষেত্রে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোর ক্ষমতা ছিল বুর্জোয়াদের হাতে যারা পুঁজিবাদী শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করতো), দুই; উৎপাদনের উপকরণের সামাজিক মালিকানা, তিন; কেন্দ্রীয় অর্থনৈতিক পরিকল্পনা, চার; জাতীয় আয়ের সামাজিক সমবণ্টন প্রক্রিয়া।[50] ইউরোপ, আফ্রিকা, ল্যাতিন আমেরিকা, এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এই চার ক্ষেত্রেই সমাজতান্ত্রিক নির্মাণ প্রক্রিয়ার জন্য যে সমস্ত পরিমাপককে ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয় তার সকল কিছুর কেন্দ্রীয় উদ্দেশ্য ছিল ব্যক্তিগত মালিকানার পুঁজির পুরাতন সম্পর্কের বিলোপ সাধন। বিপরীতে, বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে পুরাতন সামন্ততান্ত্রিক কিংবা পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্কের মৌলিক দিকগুলোর বিলোপ সাধনের কোন উদ্দেশ্য রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচিতে ছিল না।

সমাজতান্ত্রিক বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্যক্তিগত সম্পত্তির পুঁজিবাদী কাঠামোর বিলোপ সাধনকে এড়িয়ে কতিপয় উৎপাদনের উপায়গুলোকে রাষ্ট্রের আওতায় নেওয়ার পরিকল্পনা মানেই সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি নয়। সমাজ বিবর্তনের ধারায় উৎপাদন সম্পর্কের ব্যক্তিগত মালিকানার পুঁজিবাদী ধরন বিলোপের সামগ্রিক প্রক্রিয়ার একটি স্তর হলো সমাজতন্ত্র। এই স্তর নির্মাণের নিয়ন্ত্রণ, দায়িত্ব এবং কর্তৃত্বে কোন শ্রেণি ক্ষমতায় আছে সেটি প্রধান বিবেচ্য বিষয়। শিল্প-কারখানা রাষ্ট্রের আওতায় আনার পাশাপাশি সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানার পুঁজিবাদী সম্পর্ক যদি একইসাথে জারী রাখা হয় সেটি শেষ পর্যন্ত পুঁজিবাদী সম্পর্কেরই প্রতিনিধিত্ব করে। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল পুঁজির মালিকদের স্বার্থেরই প্রতিনিধিত্ব করে বলে সে সম্পর্ক বহাল রাখতে যাবতীয় আইন-পরিকল্পনা-নীতির প্রচলন ঘটিয়ে থাকে। ফলে পুঁজিবাদী সম্পর্কই পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।

যে সমস্ত দেশগুলোর অর্থনীতিতে ব্যক্তিগত মালিকানার পুঁজিবাদী প্রক্রিয়াকে অক্ষুন্ন রেখে কিছু উপায়ের সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল সে সমস্ত দেশগুলোতে শেষ পর্যন্ত ‘উদার বাজার নীতি’র আওতায় ব্যক্তিগত মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোকেই পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুঁজিপতিদের হাতে ন্যস্ত করা হয়। প্রথমাবস্থায় যাবতীয় ঝুঁকি রাষ্ট্রের কাঁধে দিয়ে জনগণের সামাজিক পুঁজি ব্যবহৃত হয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কাজে এবং ধীরে ধীরে সেসব প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যক্তিগত মালিকানায় দিয়ে দেওয়ার বন্দোবস্ত করা হয়। পরবর্তীতে ব্যক্তিগত পুঁজির একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পথ পরিষ্কার করা হয়। পাকিস্তান আমলের সাথে সদ্যজাত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পার্থক্য ছিল এই যে, পাকিস্তানে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে প্রথম থেকে বেশ কিছু শিল্প-কারখানা স্থাপনের মধ্য দিয়ে ব্যক্তি মালিকদের আকর্ষণ করে পুঁজি বিনিয়োগের। ব্যক্তি মালিকানাধীন শিল্প-প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যেই রাষ্ট্রীয় নীতি-পরিকল্পনা গৃহীত হয়। অন্যদিকে, বাংলাদেশে নিরুপায় হয়ে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় নিয়ে নেওয়ার বন্দোবস্ত হয়; পরিকল্পিতভাবে নতুন আকারে তেমন কিছুই গড়ে তোলা হয়নি। ‘সমাজতন্ত্রের’ শ্লোগানে কর্মসূচি ছিল ব্যক্তি পুঁজির প্রক্রিয়ার। কৃষি-শিল্প-বাণিজ্যের নানা খাতে ব্যক্তি পুঁজির উদ্যোগকে সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করতে দেখা যায় সদ্যজাত বাংলাদেশের ‘মিশ্র অর্থনীতি’র পরিকল্পনায়।

উৎপাদনের উপায়ের পুঁজিবাদী মালিকানার বিলোপ এবং জনগণের সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা, বণ্টনের কর্তৃত্ব-নিয়ন্ত্রণে ব্যক্তি মালিকানার বদলে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা; পুঁজিতন্ত্র থেকে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের উপায়গুলোর মধ্যে মৌলিক হিসেবে ধরা হয়। সমাজতন্ত্র অনুসরণকারী দেশগুলো সে পথেই তাদের যাত্রারম্ভ করে। কিন্তু বাংলাদেশের ‘উন্নয়ন’ ঘটাতে ‘সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয়করণ’ ছিল মূলত ‘‘পশ্চিমা ধাঁচের’ মিশেল সংসদীয় ‘গণতন্ত্র’; যেখানে ‘সমাজতন্ত্রী’ এবং ‘অ-সমাজতন্ত্রী’, শোষক এবং শোষিতের সমান অধিকার কিন্তু নির্বাচন ও ক্ষমতায় যাওয়ার ‘অসমান’ অধিকারসম্পন্ন’’।[51] যদিও পরিকল্পনা কমিশনের পক্ষ থেকে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা যেটি করা হয়েছিল সেখানে ঘোষিত ‘সমাজতান্ত্রিক’ কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য নানাবিধ উদ্যোগ গ্রহণের কথা বলা হয়। কিন্তু পরিকল্পনা কমিশনের পরামর্শ সম্পূর্ণত নির্ভরশীল ছিল লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের উপর বিশেষ করে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর উপর। রাজনৈতিক বিবেচনায় কমিশনের প্রস্তাবিত পরামর্শ অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাস্তবায়িত হতে পারেনি। যদিও কমিশনের পক্ষ থেকে সতর্ক করে দেওয়া হয় যে; উৎপাদিকা শক্তির যথাযথ বিকাশ না হলে কিংবা অনুৎপাদনশীল তৎপরতার ‍বৃদ্ধি হলে কিংবা অপ্রয়োজনীয় ভোগ-বিলাস হলে তা ‘সমাজতান্ত্রিক’ কর্মসূচিকে বাধাগ্রস্থ করবে। ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত যে, পরম্পরাগতভাবে যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে এই ঘটনাগুলোই বেশী পরিমাণে ঘটেছে।     

কোন কোন গবেষক যদিও বলেছেন, সমাজতন্ত্রের নামে আসলে ‘রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ’-এর প্রচেষ্টা হয়েছিল কিন্তু প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশ নির্মাণকালের নির্দিষ্ট এই সময়টিতে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের মাধ্যমে লুম্পেন পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটানো হয়েছিল। বাংলাদেশে পুঁজির আদি সঞ্চয়নের প্রধান ধরন হিসেবে লুম্পেনাইজেশন প্রক্রিয়াই ছিল প্রধান। সামাজিক উৎপাদনের লুণ্ঠন, ঘুষ, দুর্নীতি, চোরাই কারবার, দখল ইত্যাদির মধ্য দিয়ে যে পুঁজির প্রসার এবং বিকাশ সেটি কোনভাবে ভিত্তিমূলক উৎপাদনী শিল্প পুঁজির বিকাশকে ত্বরান্বিত করেনি। একসময় বাংলার সম্পদ লুট করে নিয়ে ইউরোপে শিল্পায়ন করেছে ইংল্যান্ডিয় বণিকরা। পাকিস্তান আমলে সেই ধারা অব্যাহত থাকে। এই দুই লুটেরাদের মধ্যে বাংলাদেশ আমলের পার্থক্য হলো; পূর্বেকার লুটেরা ধনী শাসক শ্রেণি ছিল ভিন্ন জাতির, ভিন্ন ভাষার, ভিন্ন সংস্কৃতির কিন্তু সদ্যজাত বাংলাদেশে তারা ছিল বাংলা ভাষা-ভাষী জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ। ‘বাঙ্গালী’ জাতীয়তাবাদের আড়ালে সর্বজনের সাথে মিশে থাকার কারণে তাদের আলাদা করে চেনা যায়নি। আরও বুঝা যায়নি কারণ, সরকারের অভ্যন্তরে থাকা ‘চেনা মানুষগুলো’র মাধ্যমে এই লুটপাটগুলো হয়েছে; রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে লুম্পেন এই পুঁজিপতিদের শক্তভাবে দাঁড়ানো এবং আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।

একটি গবেষণায় দেখা যায়, “যে সমস্ত শিল্প-কারখানাগুলো রাষ্ট্রীয়করণ করা হয়েছিল তার উচ্চপর্যায়ে লীগ ঘনিষ্ঠদের নিয়োগ দেওয়া হয় যারা কারখানাগুলোর বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রাংশ এবং কাঁচামাল ভারতে পাচার করে রাতারাতি প্রচুর অর্থ-সম্পদের মালিক বনে যায়। অন্যদিকে, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত এবং আমদানীকৃত পণ্যের বণ্টনের জন্য যে সমস্ত লাইসেন্সধারী ডিলার ছিল তাদের অধিকাংশই ট্রেডিং পেশার ছিল না। দলের কর্মীরা লাইসেন্স বের করে নিয়ে সেগুলো উচ্চদামে অন্যান্য ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দিত। ধান, পাট এবং ত্রাণের পণ্য ভারতে পাচারের সাথে জড়িত ছিল দলের কর্মী এবং নেতৃত্বের সাথে সম্পর্কিত ব্যক্তিরা। বেশীরভাগ ইন্ডেন্টিং (আমদানী-রপ্তানী) পারমিট দলীয় কর্মী এবং সমর্থকদের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া, অবাঙ্গালীদের ‘পরিত্যক্ত’ ৬০,০০০ বাড়ি-ঘর দলীয় নেতা-কর্মীদের নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়। এসবের ফলে যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে ক্ষমতাবান শাসকদলের ছত্রচ্ছায়ায় রাতারাতি একটি লুম্পেন ধনী গোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটে যারা সরাসরি কোনপ্রকার উৎপাদনী বিনিয়োগের সাথে জড়িত ছিল না। এই গোষ্ঠীটিই আবার তাদের দলের নীতি নির্ধারণে প্রভাব বিস্তার করে। আওয়ামী লীগ যুদ্ধপূর্ব বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানের একচেটিয়া পরিবারের বিরোধীতা করলেও যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে তাদের নেতৃত্বেই ২২ পরিবারের পরিবর্তে ‘২,০০০ ব্যক্তির’[52] হাতে পুঁজির কেন্দ্রীভবন, পুঁঞ্জীভবন ঘটে এবং গোটা এই শ্রেণিটি বাংলাদেশের অর্থনীতির ‘সমাজতান্ত্রিক’ রূপান্তরের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিল! (চলবে)

আগের পর্ব: ২২ পরিবারের অতীত ও বর্তমান-৪

পরের পর্ব: ২২ পরিবারের অতীত ও বর্তমান-৬

   

মেহেদী হাসান: লেখক, গবেষক। ইমেইল:mehedihassan1@gmail.com

তথ্যসূত্র:

[1] প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমানের বক্তব্য অনুযায়ী, ‘‘My government believes in internal social revolution. There must be a change in old social systems.. . My government and the party are pledged to introduce a scientific socialist economy.. . First step, namely, nationalisation has been taken as the beginning of a planned programme towards socialisation of resources.’’ মুহাম্মদ ফজলুল হাসান ইউসুফ, Nationalisation of Industries in Bangladesh; Political and Administrative Perspectives, For the degree of PhD, University of Tasmania, December, 1980, পৃঃ-১১১।

[2] প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমান বলেছিলেন: ‘‘Socialism as we shall practise in Bangladesh.’’ পূর্বোক্ত, পৃঃ-১১৬।

[3] ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পূর্বে আওয়ামী লীগের মেন্যুফেস্টোতে বলা হয়েছিল, ‘‘Islam was the `favoured religion of the vast majority of the population’ and that no law would be formulated or enforced contrary to the laws of Islam by the government’’. পূর্বোক্ত, পৃঃ-৯৯

[4] ড. কামাল হোসেন (তৎকালীন আইনমন্ত্রী)-এর ভাষ্য অনুযায়ী, ‘‘…to us socialism means freedom from economic exploitation. By socialism we understand a social system in which everybody would equally share the needed sacrifice to build up the nation and its economic system.’’ পূর্বোক্ত, পৃঃ-১১৬।

[5] ড. কামাল হোসেনের ভাষ্যমতে, “We (AL) are not doctrinaire. Ours is not an ideological party”.পূর্বোক্ত, পৃঃ-১১৭।

[6] মওলানা ভাসানীর সাপ্তাহিক হককথা সমগ্র, সংগ্রহ ও সম্পাদন: আবু সালেক,  ঘাস ফুল নদী, তৃতীয় সংস্করণ, ফেব্রুয়ারি, ২০০৬, ঢাকা পৃঃ-২০।

[7] ফজলুল হাসান ইউসুফ, পূর্বোক্ত, পৃঃ-১১৩।

[8] পূর্বোক্ত, পৃঃ-১১০।

[9] বদরুদ্দীন উমর, Politics and society in East Pakistan and Bangladesh, Mowla Bros. (1974), পৃঃ-১১৪।

[10] বদরুদ্দীন উমর, পূর্বোক্ত, পৃঃ-১৩৫-১৩৬।

[11] প্যারিসের Le-Monde পত্রিকায় ১৯৭১ সনের ৩১শে মার্চ প্রকাশিত।‘‘Is the West Pakistan Government not aware that I am the only one able to save East Pakistan from communism? If they take the decision to fight I shall be pushed out of power and communists will intervence in my name. If I make too many concessions, I shall lose my authority. I am in a very diffucult position. …’’  ইন্দু সাহা, পূর্ব বাঙলার গণআন্দোলন শেখ মুজিব, নওরোজ কিতাবিস্তান, ১৯৭১, ঢাকা, পৃঃ-১৬৭। 

[12] পূর্বোক্ত, পৃঃ-৮৩।

[13] বদরুদ্দীন উমরের ভাষ্য অনুযায়ী, ‘‘….the Awami League has openly declared, and quite naturally, that they have nothing to do with class struggle since they do not represent any particular class. They rather claim to represent the ‘whole nation.’’ বদরুদ্দীন উমর, পূর্বোক্ত, পৃঃ-১৫২।

[14] অনুপম সেন, বাংলাদেশ: রাষ্ট্র সমাজ; সামাজিক অর্থনীতির স্বরূপ, ২য় সংস্করণ, ঢাকা: অবসর প্রকাশনা সংস্থা, ১৯৯৯, পৃঃ-৬৭-৬৯।

[15] Caf Dowlah: The Bangladesh Liberation War, the Sheikh Mujib Regime, and Contemporary Controversies, Lexington Books,  London, 2016,  page-28.

[16] তালুকদার মনিরুজ্জামান, The Bangladesh Revolution and Its Aftermath, University Press Limited, Dhaka, Second edition, 1988, পৃঃ ২৯।

[17] পূর্বোক্ত, পৃঃ ৭১-৭২।

[18] পূর্বোক্ত, পৃঃ ১৫৭।

[19] অনুপম সেন, পূর্বোক্ত, পৃঃ-৬৬।

[20] বদরুদ্দীন উমর, পূর্বোক্ত, পৃঃ-১৫৯।

[21]রেহমান সোবহান, Untranquil Recollections; Nation Building in Post-Liberation Bangladesh, Sage, Select Publications, 2021,  পৃঃ-১০১।

[22] পূর্বোক্ত

[23] ফজলুল হাসান ইউসুফ, পূর্বোক্ত, পৃঃ-৯৪।

[24] ফজলুল হাসান ইউসুফ, পূর্বোক্ত, পৃঃ-৬৮-৭০।

[25] তালুকদার মনিরুজ্জামান, পূর্বোক্ত, পৃঃ ১৫৯।

[26] সৈয়দ গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, ‘‘Bangladesh Public Service Commission — Formative Phase’’,  Indian Journal of Public Administration vol. 35 iss. 2, 10.1177_0019556119890207, SAGE Publications, 1989, পৃঃ ২৬২।

[27] রেহমান সোবহান, পূর্বোক্ত, পৃঃ ১০৬।  

[28] সৈয়দ গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, পৃঃ-২৬২।

[29] রেহমান সোবহান, পূর্বোক্ত, পৃঃ-৪৫।

[30] পূর্বোক্ত, পৃঃ-৪৬।

[31] পূর্বোক্ত, পৃঃ-৪৮।

[32] সৈয়দ গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, পূর্বোক্ত, পৃঃ-২৬২-২৬৩।

[33] বদরুদ্দীন উমর, পূর্বোক্ত, পৃঃ-২৪৬।

[34] পূর্বোক্ত 

[35] ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগের জন্য শিল্পঋণ সংস্থা ও শিল্প ব্যাংক থেকে অনুমোদিত ঋণের মোট পরিমাণ ছিল মাত্র ৭ কোটি ৯২ লক্ষ টাকা (১৯৭২/৭৩-১৯৭৪/৭৫ কালপর্বে)। অনুপম সেন, পূর্বোক্ত, পৃঃ-৭৩।

[36] ফজলুল হাসান, পূর্বোক্ত, পৃঃ-১৩২-১৩৪।

[37] ‘‘A moratorium on nationalisation was declared for a period of 15 years from the date of going into production of the enterprise which was peviously 10 years form the date of investment. It was also provided that compensation would be paid on fair and equitable basis in the event of nationalisation of any industry after this period.’’ পূর্বোক্ত, পৃঃ-১৩৪।

[38] পূর্বোক্ত

[39] বদরুদ্দীন উমরের ভাষ্যমতে, ‘This moratorium will be there so long as Awami League is in power as political representative of the exploiting classes of Bangladesh. বদরুদ্দীন উমর, পূর্বোক্ত, পৃঃ ২৪৭।

[40] যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কর্ণধারদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের মধ্য দিয়ে যুদ্ধপূর্ব দৈনিক পত্রিকা ‘দ্যা পিপল’-এর মালিক আবিদুর রহমান শীর্ষ ধনাঢ্য ব্যক্তিতে পরিণত হন। রেহমান সোবহান, পূর্বোক্ত, পৃঃ-৬৩।

[41] ফজলুল হাসান ইউসুফ, পূর্বোক্ত, পৃঃ-১৩১।

[42]https://bn.wikipedia.org/wiki/১৯৭৪ এর_দুর্ভিক্ষ#:~:text=১৯৭৪এর%20দুর্ভিক্ষ%20বাংলাদেশে%20১৯৭৪,প্রত্যক্ষ%20এবং%20পরোক্ষভাবে%20মৃত্যুবরণ%20করে, শিরোনাম: ১৯৭৪এর দুর্ভিক্ষ, ১৪ এপ্রিল, ২০২২।

[43] https://cpd.org.bd/%E0%A6%96%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%AF-%E0%A6%93-%E0%A6%A6%E0%A7%81%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AD%E0%A6%BF%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B7%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%9C%E0%A6%A8/,  শিরোনাম, খাদ্য দুর্ভিক্ষের রাজনীতি – রেহমান সোবহান, মার্চ ২৬, ২০২১।

[44] পূর্বোক্ত

[45] ১৯৭৪ সালে (দুর্ভিক্ষের বছর) কিউবাকে পাট বিক্রি করতে রাজি হওয়ায় বাংলাদেশের জন্য গম বহনকারী যুক্তরাষ্ট্রের জাহাজকে মাঝসমুদ্র থেকেই ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। দুর্ভিক্ষের বছর অর্থাৎ ১৯৭৪/৭৫ সালে বাংলাদেশে খাদ্য আমদানীর পরিমাণ কম ছিল না। দুর্ভিক্ষের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে অনুপম সেন বলেছেন, ‘হঠাৎ মুদ্রাস্ফীতির ফলে গ্রামীণ ভূমিহীন কৃষক, দরিদ্র কৃষক প্রভৃতির ক্রয়ক্ষমতার আকস্মিক হ্রাস’। অনুপম সেন, পূর্বোক্ত, পৃঃ-৭৮-৭৯। অন্যদিকে, দুর্ভিক্ষের সময় খাদ্যদ্রব্য মজুদ এবং চোরাকারবারি করে প্রভূত অর্থ সম্পদের মালিক হতে দেখা যায় একটি গোষ্ঠীকে যারা ক্ষমতার বলয়ের চারপাশে ঘোরাঘুরি করেছে। সাপ্তাহিক হক কথাসহ অন্যান্য পত্রিকাতে সে সময় এসব নিত্যদিনের খবর হিসেবে পাওয়া যেত। 

[46] বদরুদ্দীন উমরের ভাষ্যমতে, ‘‘At present they may control about 5% of the total credit but soon large deposits may flow into foreign banks and insurance companies and credit may thus be manipulated not only by domestic interests but also by foreign ones.’’ বদরুদ্দীন উমর, পূর্বোক্ত, পৃঃ-১৩৬।

[47] চা শিল্পকে রাষ্ট্রীয়করণের প্রভাবমুক্ত রাখার ক্ষেত্রে ‍বৃটিশ স্বার্থ ছিল প্রধান। বদরুদ্দীন উমর সে প্রসঙ্গে তখন লিখেছেন, ‘‘Some may argue that the tea industry, of which the majority interest is British is at present a losing concern and a liability, and hence it would be economically wiser to leave it untouched. But such people forget that nationalisation of private interests, particularly foreign interests, is basically not an economic but a political decision. বদরুদ্দীন উমর, পূর্বোক্ত, পৃঃ-১৩৭।

[48] রাষ্ট্রীয়করণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রাক্তন ব্যক্তি পুঁজির মালিক এবং আমলাতন্ত্রের শক্তিশালী অবস্থান তৈরীর সম্ভাবনার বিষয়ে বদরুদ্দীন উমর লিখেছিলেন, ‘‘This ‘harmonisation’ of class interests will have to be effected by giving the ex-capitalists and bureaucrats wide-ranging powers within the framework of nationalisation and the public sector. They will inevitably emerge as the leading factor in the organisation of industries. The more industries are taken over from the private sector and the more new industries are organised in the course of time the more will be the power of these industrial bureaucrats.’’ বদরুদ্দীন উমর,পূর্বোক্ত, পৃঃ-১৫২।

[49] ফজলুল হাসান ইউসুফ, পূর্বোক্ত, পৃঃ-৩৩।

[50] পূর্বোক্ত, পৃঃ-৩৮।

[51] ফজলুল হাসান, পূর্বোক্ত, পৃঃ-১২২

[52] তালুকদার মনিরুজ্জামান, পূর্বোক্ত, পৃঃ ১৫৯।

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •