যুদ্ধোত্তর রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান: ভেতর-বাহির

২২ পরিবারের অতীত ও বর্তমান-৬

যুদ্ধোত্তর রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান: ভেতর-বাহির

মেহেদী হাসান

বাংলাদেশে পুঁজিবাদের বিকাশ উল্লেখযোগ্য আকার নিয়েছে। এই বিকাশধারায় একদিকে তৈরি হয়েছে পাকিস্তানের ২২ পরিবারের চেয়েও সম্পদশালী বেশ কিছু গোষ্ঠী, অন্যদিকে বৈষম্য ও পরিবেশ বিধ্বংসী তৎপরতাও অভূতপূর্ব মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে ‘উন্নয়ন’ ধারার স্বরূপ বিশ্লেষণ, পুঁজির কেন্দ্রীভবনের ধরন, শ্রেণিবিন্যাস, এই ধারার পুঁজিবাদ বিকাশে রাষ্ট্রের ভূমিকা ইত্যাদি পরীক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান প্রবন্ধ কয়েক কিস্তিতে এই অনুসন্ধান বিশ্লেষণ হাজির করবে। ষষ্ঠ কিস্তিতে যুদ্ধোত্তর সদ্যোজাত রাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় খাতের লুণ্ঠনের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক প্রক্রিয়ার বিভিন্ন দিক এবং লুম্পেন ধনিক শ্রেণির বিকাশের পারস্পরিক সম্পর্ক আলোচনা করা হয়েছে।

যুদ্ধোত্তর বছরগুলোতে রাজনৈতিক অভিজাতরা তাদের ক্ষমতার ভিত্তিকে সুসংহত করার জন্য সরকারের ভেতরে-বাইরে প্রকাশ্য এবং গোপন প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিল এবং সেই লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয়কৃত উদ্যোগের সংস্থানগুলো ব্যবহার করেছিল। উৎপাদনী প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে যেমন এর প্রভাব পড়ে, তেমনি সমাজের সর্বস্তরে এর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। সাধারণভাবে রাষ্ট্রীয়করণ একদিকে যেমন উৎপাদন-বণ্টন-ভোগের ক্ষেত্রে সর্বজনের (সর্বজাতীয় স্তরের) বিকাশের সুযোগ এবং সম্ভাবনা তৈরি করেছিল, অন্যদিকে বুর্জোয়া রাজনৈতিক আদর্শগত সম্মিলনের অভাবে সেই সুযোগ ঠিক বিপরীতভাবে, একই গতিতে, দ্রুত বিনষ্ট হতে থাকে। ভিত্তিমূলক উৎপাদনী ব্যবস্থার পরিবর্তে অনুৎপাদনশীল পরজীবী লুণ্ঠন ব্যবস্থার মৃগয়াক্ষেত্রে পরিণত হয় রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো। রাষ্ট্রীয় সঞ্চয়, উৎপাদন ক্রমাগত লুণ্ঠনজীবী ব্যক্তি-পুঁজির অধীনস্থ হতে থাকে।

রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দক্ষ, উৎপাদনশীল অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে বিকশিত করার দৃষ্টিভঙ্গির অনুপস্থিতিতে এসব প্রতিষ্ঠান ক্রমাগত ভঙ্গুর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে থাকে। এর কারণ হিসেবে ‘উন্নয়ন’ সম্পর্কিত শ্রেণিস্বার্থের দৃষ্টিভঙ্গিকে তাই বিবেচনায় আনতে হয়। ‘উন্নয়ন’ কিংবা ‘বিকাশ’ কোন পথে হবে, সেটি নির্ভর করে সরকার কোন শ্রেণি-গোষ্ঠীর স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে তার ওপর। সে হিসেবে আওয়ামী লীগ সরকার প্রকৃত অর্থে একটি উৎপাদনশীল শ্রেণির বিপরীতে মধ্যবিত্ত, ব্যবসায়ী, নব্যধনী (অনুৎপাদনশীল প্রক্রিয়ায় সঞ্চিত সম্পদের মালিক) এবং বড় কৃষক শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করত (পূর্ববর্তী অধ্যায় ৫-এ দেখানো হয়েছে)। যদিও পরবর্তী সময়ে নানা ঘুরপথে বেড়ে ওঠা উদ্যোক্তা শ্রেণির একটা অংশের সঙ্গে শাসক শ্রেণির মিত্রতার সম্পর্ক তৈরি হয়।

রাষ্ট্রীয়করণের ফলে শহরের উচ্চমধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের যে অংশটি আইয়ুব খান সরকারের আমলে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় শিল্পোদ্যোক্তা শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল, তারা সাময়িকভাবে বিপর্যস্ত হলেও গ্রামাঞ্চলের বড় কৃষক এবং মধ্যস্বত্বভোগী কিংবা ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের পুঁজি সম্প্রসারণে বিশেষ কোনো ঝামেলায় পড়তে হয়নি। একদিকে ব্যক্তি-পুঁজির সমর্থনে সংবিধানসম্মত নানা ধরনের উদ্যোগ এবং অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন (প্রকাশ্য-গোপন) পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে দুর্বল করার চেষ্টা দেখা যায় যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে। সমাজতন্ত্র এবং রাষ্ট্রীয়করণের পূর্ববর্তী ঘোষণার কারণে আওয়ামী লীগ সরকার যদিও এই স্লোগানগুলোকে কিছুদিন পর্যন্ত ব্যবহার করেছে, কিন্তু দেশি-বিদেশি পুঁজির লবিস্টদের আনাগোনা কিংবা প্রকাশ্য-গোপন লেনদেন এবং চাপ-বোঝাপড়ার কারণে সেই স্লোগানও বেশিদিন ধরে রাখতে পারেনি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতা থাকাকালীনই নীতি-পরিকল্পনার মধ্যে তার একটা প্রভাব এবং প্রতিফলন দেখা দিতে শুরু করে। পূর্বতন সময়ের মধ্যবিত্ত শ্রেণির আধিপত্য, অধিপতি শ্রেণির ক্ষমতা সম্পর্কের চর্চা, অপরাপর বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে, বিশেষ করে মার্কিন-ভারতের নির্ভরশীলতার সম্পর্কের প্রতিফলন স্পষ্ট হতে দেখা যায় নীতি-পরিকল্পনার মধ্যে। অভ্যন্তরীণ সামাজিক জনমতের চাপ কিংবা আন্তর্জাতিক কৌশলগত কারণে যা ছিল ধীরগতির এবং গোপন, পরবর্তীকালের সামরিক-বেসামরিক সরকারগুলোর আমলে সেসব নীতিমালার জোরেশোরে এবং প্রকাশ্য বাস্তবায়ন দেখতে পাওয়া যায়।

আইয়ুব খান সরকারের আমলে বেড়ে ওঠা নব্য বাঙালি পুঁজিপতি শ্রেণি বাংলাদেশে খুব একটা শক্ত অবস্থানে ছিল না, তা আগেই বলা হয়েছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে বিন্যাসকৃত শিল্প উদ্যোগের বাইরে নিজেরা শিল্পের নতুন কোনো শাখায় বিনিয়োগেও উৎসাহী ছিল না। লীগ সরকার যখন শিল্পকারখানা রাষ্ট্রীয় মালিকানায় নিয়ে নেয়, তখন এই শিল্পপতিদের প্রকাশ্য দাবি অনুযায়ী পাট ও তুলা টেক্সটাইল ইউনিটের একটি অংশ রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ আওতার বাইরে রেখে দেয়। বাঙালি শিল্পপতিরা রাষ্ট্রীয়করণের আগে এসবের মালিক ছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এই দেশি-বিদেশি পুঁজিপতিরা প্রথম দিকে বিশেষভাবে সুযোগ না পেলেও পরবর্তী সময়ে ‍নানান কায়দায় সেগুলোকে কবজায় নিয়ে নেয়। সামরিক সরকারের সময় তারা সামনের কাতারে এসে শামিল হয়।[i]

রাষ্ট্রীয়করণে সরকারের ঘোষণা এবং তার বাস্তবায়নের বৈপরীত্য শুরু দেখেই দৃশ্যমান হতে থাকে। বেশ কিছু ব্যক্তিখাত রাষ্ট্রীয়করণের বাইরে রাখা হয় কিংবা ‘Disinvestment’[ii] পলিসির আওতায় নিয়ে আসা হয় (এসব প্রতিষ্ঠানকে পরবর্তী সময়ে ‘রাষ্ট্রের বোঝা’ বা লোকসানি প্রতিষ্ঠান হিসেবে নামমাত্র মূল্যে ব্যক্তিমালিকদের হাতে তুলে দেওয়া হয়)। প্রাইভেট খাত এভাবে বিস্তৃত একটা পরিসর পায়, যেখানে নব্য (দখল, লুণ্ঠন প্রক্রিয়ায় হয়ে ওঠা ধনী) কিংবা পূর্বতন পুঁজির মালিকদের বিনিয়োগের শর্ত তৈরি হয়, বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে যখন মূলধন, সংগঠন অর্থাৎ উৎপাদনী ক্ষেত্রে ঝুঁকির প্রাথমিক ধাক্কা সামলে নিয়ে চলনসই একটি অবস্থানে নিয়ে আসা হয়। পুরাতন মালিকদের ক্ষেত্রে এই সুযোগ দু’ভাবে তৈরি হয়। এক. ব্যক্তিমালিকদের শিল্পকারখানা যেগুলো রাষ্ট্রের অধীন নিয়ে আসা হয়, সেসবের ক্ষতিপূরণ লাভের মাধ্যমে এবং দুই. পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রীয় ব্যাংক-বিমা থেকে ঋণ, পণ্য উৎপাদনে ভর্তুকি, আমদানি-রপ্তানিতে কর-শুল্ক ছাড়-রেয়াত ইত্যাদি প্রাপ্তির মাধ্যমে।

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয় যে, ‘সমাজতন্ত্রে উত্তরণকালীন’ সরকারি খাতের সম্পূর্ণ বিকাশ, সমাজতান্ত্রিক প্রতিশ্রুতিসম্পন্ন রাজনৈতিক কর্মী এবং দক্ষ ব্যবস্থাপক ব্যক্তি গড়ে ওঠার পূর্বপর্যন্ত ব্যক্তি-পুঁজিকে উৎসাহ-পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করা হবে। এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই সংবিধান এবং যাবতীয় নীতি-পরিকল্পনা গৃহীত হতে থাকে। একদিকে সমাজতন্ত্র সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণার অভাব, অন্যদিকে শিল্পনীতিতে সরকারি এবং বেসরকারি খাতের কার কতটুকু ভূমিকা থাকবে–এই নিয়ে স্বচ্ছ নীতিমালার অভাবে সাধারণভাবে সামগ্রিক শিল্পখাতের বিনিয়োগে অচলাবস্থা তৈরি হয়। রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পখাতে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগকে একদিকে যেমন বাধাগ্রস্ত করা হয়, আবার অন্যদিকে প্রাথমিক অবস্থায় নানা ধরনের দ্বন্দ্ব-সন্দেহ-দোদুল্যমানতা ইত্যাদির কারণে ব্যক্তিমালিকরাও প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ করা থেকে কিছুদিনের জন্য বিরত থাকে। তা সত্ত্বেও এই টানাপোড়েনের মধ্যেই গোপন-প্রকাশ্য, বৈধ-অবৈধ উপায়ে ব্যক্তি-পুঁজির সম্প্রসারণ ঘটতে থাকে।[iii] যদিও রাষ্ট্রীয়করণের মধ্য দিয়ে ব্যক্তিখাতের শিল্প সম্পদের পরিমাণ ৫৮.২ শতাংশ থেকে কমে এসে দাঁড়ায় ১২.১ শতাংশে, কিন্তু পরিবহণ, ব্যাংক-বিমা, বৈদেশিক বাণিজ্যের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ রাষ্ট্রীয় খাতে থাকা সত্ত্বেও অন্যদিকে কৃষিখাতের প্রায় ৬০ শতাংশ, পরিবহণ এবং নির্মাণ, অভ্যন্তরীণ কাঁচা পাটের ব্যাবসা, পাইকারি এবং খুচরা ব্যাবসা, ইন্ডেন্টিং ব্যাবসা, আমদানি, চা (ব্রিটিশ পুঁজির মালিকানাধীনসহ), ক্ষুদ্র ও মাঝারি কুটিরশিল্প ছিল ব্যক্তি-পুঁজির মালিকানাধীন।[iv]

রাষ্ট্রীয়করণের প্রথম ভাগে পাট, তুলা, চিনি, সার এবং সিমেন্টশিল্পকে রাষ্ট্রের আওতায় আনা হয়। নিরাপদ দিয়াশলাই, বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক এবং ঔষধ, খাদ্যশিল্পের আংশিক রাষ্ট্রীয়করণ করা হয়। এসব খাতে ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বকে বাধাগ্রস্ত করা হয়নি। এ ছাড়া রাষ্ট্রীয় খাতের সঙ্গে যৌথভাবে ব্যক্তি-পুঁজির বিনিয়োগ ছিল–কাগজ ও নিউজপ্রিন্ট, লোহা ও স্টিল (রি-রোলিং মিল এবং মিনি বিলেট মিল বাদে), জাহাজ নির্মাণ এবং ভারী প্রকৌশল (মেশিন টুলস, গাড়ি, বাস, ট্রাক, ট্রাক্টর এবং পাওয়ার টিলার উৎপাদন/সংযোজন খাতসহ), ভারী ইলেকট্রিক্যাল শিল্প, খনিজ, তেল এবং গ্যাস, সিমেন্ট, পেট্রো-কেমিক্যালস (সার, পিভিসি, ইথিলিন ও সিনথেটিক ফাইবার), ভারী এবং মৌলিক রাসায়নিক ও মৌলিক ফার্মাসিউটিক্যালস, শিপিং (কোস্টাল জাহাজ এবং ৫০০০ DWT-র উপরের ট্যাংকার), ফরেস্ট এক্সট্রাকশন (যান্ত্রিক) শিল্পে।[v]

রাষ্ট্রীয় খাতের সঙ্গে যৌথভাবে ব্যক্তি-পুঁজির বিনিয়োগ ছিল–কাগজ ও নিউজপ্রিন্ট, লোহা ও স্টিল (রি-রোলিং মিল এবং মিনি বিলেট মিল বাদে), জাহাজ নির্মাণ এবং ভারী প্রকৌশল (মেশিন টুলস, গাড়ি, বাস, ট্রাক, ট্রাক্টর এবং পাওয়ার টিলার উৎপাদন/সংযোজন খাতসহ), ভারী ইলেকট্রিক্যাল শিল্প, খনিজ, তেল এবং গ্যাস, সিমেন্ট, পেট্রো-কেমিক্যালস (সার, পিভিসি, ইথিলিন ও সিনথেটিক ফাইবার), ভারী এবং মৌলিক রাসায়নিক ও মৌলিক ফার্মাসিউটিক্যালস, শিপিং (কোস্টাল জাহাজ এবং ৫০০০ DWT-র উপরের ট্যাংকার), ফরেস্ট এক্সট্রাকশন (যান্ত্রিক) শিল্পে।

রাষ্ট্রীয়করণ কর্মসূচি ছিল নির্দিষ্ট সীমার আওতায়। যেসব প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ ২৫ লাখ টাকার বেশি ছিল, সেসব প্রতিষ্ঠানকেই কেবল এই কর্মসূচির আওতায় আনা হয়। বাদবাকি পরিত্যক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো ‘disinvestment’-এর আওতায় রাখা হয়। রাষ্ট্রায়ত্ত খাত মূলত গঠিত হয় গ্যাস, খনিজ উত্তোলন এবং উন্নয়ন, পেট্রোলিয়াম প্রক্রিয়াজাতসহ উৎপাদনী শিল্প ইউনিটগুলোকে হিসাবে নিয়ে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবহণ কিংবা পানি সরবরাহের কোনো কোনো খাত সম্পূর্ণভাবে সরকারি খাতে নিয়ে আসা হয়, আবার কোনো কোনোটা আংশিকভাবে। কিন্তু এসব সংস্থার কার্যক্রম ভিন্ন ভিন্ন আইন দ্বারা পরিচালিত হতো। অধিগ্রহণ করা পরিত্যক্ত কোনো কোনো খাত ছাড়া বাদবাকিগুলোর ক্ষেত্রে রাষ্ট্র সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতার দায়িত্ব নেয়।[vi]

ছক- ১৭:  ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রীয়করণ কর্মসূচির পূর্ববর্তী ও পরবর্তী ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকানা (সংখ্যা)[vii]

ক) রাষ্ট্রীয়করণের পূর্বে:

 

 ১৯৬৯-৭০ সালে মোট প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা:৩১২১
i)      ইপিআইডিসির মালিকানাধীন৫৩
ii)    অবাঙালি মালিকানাধীন৭৮৬
iii)  বিদেশি ব্যক্তিমালিকানাধীন
iv)   বাঙালি মালিকানাধীন২২৭৩

খ) রাষ্ট্রীয়করণকালে:

 

  
 

i) রাষ্ট্রীয়কৃত প্রতিষ্ঠান:

ক) ইপিআইডিসি ইউনিট

খ) অবাঙালিদের পরিত্যক্ত ইউনিট

গ) বাঙালি ইউনিট

৫৩

২২১

৭৫

ii)  বাঙালি ব্যক্তিমালিকানাধীন ইউনিট২১৯৮
iii) বিদেশি মালিকানাধীন
iv)    পরবর্তী সময়ে বিক্রি অথবা disinvestment-এর জন্য রাখা পরিত্যক্ত ইউনিট৫৬৫

সূত্র: Sobhan, Nationalisation, op. cit. Department of Industries, Government of Bangladesh. টেবিল-৭, Ownership of manufacturing industries immediately before and after nationalisation 1972.

Muhammad Fazlul Hassan Yusuf, Nationalisation of Industries In Bangladesh; Political and Administrative, University of Tasmania, December, 1980, p. 419.

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রাষ্ট্রীয়করণের উদ্দেশ্যের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তান বাদে আন্তর্জাতিক পুঁজিবিরোধী কিংবা সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিকে আঘাত করার কোনো কর্মসূচি ছিল না। উপরন্তু রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণকালে যেসব শিল্প ইউনিটে বিদেশি অংশীদাররা ছিল, তাদের যথোপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হয়। বহুজাতিক কোম্পানির শেয়ারহোল্ডারদের শেয়ার রাষ্ট্রীয় আওতার বাইরে যথাবিহিত সম্মানের সঙ্গে রেখে দেওয়া হয়। উদাহরণ হিসেবে চা-শিল্পের কথা বলা যায়। ব্রিটিশ ব্যক্তি-পুঁজির মালিকানাধীন যেসব চা-শিল্প ছিল, সেগুলো রাষ্ট্রীয়করণ প্রক্রিয়ার বাইরে রেখে দেওয়া হয়। কার্যত সেগুলোকে স্পর্শ থেকে বিরত রাখাই হয়নি, উপরন্তু নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধার মাধ্যমে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করা হয়। ধারণা করা হয়, বৈদেশিক ঋণের প্রভাবের কারণে এমনটি করা হয়েছে। বিদেশি ঋণনির্ভরতা এবং ঋণের নানা ধরনের শর্তাবলির কারণে বহুজাতিক কিংবা সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিকে ধরাছোঁয়ার বাইরে সংরক্ষণ করা হয়। তৎকালীন একটি হিসাবে দেখা যায়, ১৯৭০ সালে চা-শিল্পের প্রায় ৫৬ শতাংশ ব্রিটিশ ব্যক্তি-পুঁজির মালিকানাধীন ছিল এবং চা উৎপাদিত অঞ্চলের (বাগানসহ) প্রায় ৪৭ শতাংশ তাদের দখলে ছিল এবং তাদের মালিকানাধীন চা-শিল্প দেশের শতকরা ৪ ভাগ রপ্তানি আয় এবং শতকরা ১ ভাগ ম্যানুফ্যাকচারিং মূল্য সংযোজন করত। [viii]

রাষ্ট্রীয়করণের উদ্দেশ্যের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তান বাদে আন্তর্জাতিক পুঁজিবিরোধী কিংবা সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিকে আঘাত করার কোনো কর্মসূচি ছিল না। উপরন্তু রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণকালে যেসব শিল্প ইউনিটে বিদেশি অংশীদাররা ছিল, তাদের যথোপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হয়। বহুজাতিক কোম্পানির শেয়ারহোল্ডারদের শেয়ার রাষ্ট্রীয় আওতার বাইরে যথাবিহিত সম্মানের সঙ্গে রেখে দেওয়া হয়।

আওয়ামী লীগের রাষ্ট্রীয়করণের ঘোষণা ‘সমাজতন্ত্র’ সাপেক্ষে দেওয়া হলেও কোনো কোনো গবেষক এর বিপরীত চরিত্রকেই প্রধান বলে দেখিয়েছেন। একটি গবেষণায় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের শিল্পকারখানা এবং পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের শিল্পকারখানার অনুপাত তুলে ধরা হয়। সেখানে দেখা যায়, কেন্দ্রীয় পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের তুলনায়ও বাংলাদেশে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের অনুপাত অনেক কম ছিল।

ছক১৮: বৈশ্বিক অর্থনীতির খাতওয়ারি ব্যবস্থা (জিডিপি খাতওয়ারি বিন্যাসের অনুপাত হিসাবে)[ix]

খাত(কেন্দ্রীয়) পুঁজিবাদী বিশ্বসমাজতান্ত্রিক বিশ্ব(প্রান্তস্থ) ‘উন্নয়নশীল’ বিশ্ব
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন১৫৬০১০
কো-অপারেটিভ মালিকানাধীন১০৩০
ব্যক্তিমালিকানাধীন৭৫১০৮৫
মোট১০০১০০১০০

সূত্র: টেবিল-২৩, The sectoral system of the world economy, Muhammad Fazlul Hassan Yusuf, Nationalisation of Industries In Bangladesh; Political and Administrative, University of Tasmania, December, 1980, p. 366.

বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মালিকানার ক্ষেত্রে এই অনুপাত ছিল মোট ১৮ শতাংশ। বাদবাকি ৮২ শতাংশ ছিল ব্যক্তিমালিকানাধীন পুঁজির খাতে। গুণগত বিচারে কোনো কোনো গবেষক বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ‘সমাজতন্ত্রের’ চেয়ে বহুলাংশে ‘পুঁজিবাদী চরিত্রসম্পন্ন’[x] বলে মন্তব্য করেছেন। পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পার্থক্য বিশ্লেষণ করে তাঁরা দেখিয়েছেন যে, সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শ্রমিক শ্রেণির ক্ষমতা, ভূমি, উৎপাদনী শিল্প, প্রাকৃতিক সম্পদ, ব্যাংকিং, অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান, দেশি এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যসহ উৎপাদনের উপায়ের সামাজিক মালিকানা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন সাপেক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ভিন্নভাবে বললে, ব্যক্তি-পুঁজির সংবর্ধন প্রক্রিয়ার বিলোপ সাধন হলো সেই পার্থক্য, যেটি পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিন্নতাসূচক বৈশিষ্ট্য নির্মাণ করে। বাজারব্যবস্থাকে কেন্দ্রীয় সমাজতান্ত্রিক প্রক্রিয়া-পরিকল্পনার আওতায় আনা হয় এবং কেন্দ্রীয় নীতির সহযোগী ভূমিকা পালন করে বাজার। সর্বোপরি, পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জাতীয় আয়ের ক্ষেত্রে চরম বৈষম্যের বিপরীতে সমবণ্টন প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়, যেখানে সম্পদ থেকে উপস্বত্বভোগীদের আয়ের ধরন কার্যত বাতিল করা হয়। বাংলাদেশের ‘সমাজতন্ত্র’ এই মডেলের সঙ্গে কোনোভাবেই খাপ খায়নি।[xi]

বড় ভূমির মালিক, নব্যধনী মধ্যবিত্তের স্বার্থে নীতি-পরিকল্পনা প্রণয়ন

যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে যে সংবিধান রচনা করা হয় তাতে ‘সমাজতন্ত্রের’ ঘোষণা দিয়ে সরকার তিন ধরনের মালিকানা ব্যবস্থা নির্দেশ করে। বাংলাদেশের খসড়া সংবিধানের ১৩ (ক) তে রাষ্ট্রীয়করণ (nationalised) খাত, (খ) সমবায় কাঠামোভিত্তিক ব্যক্তিমালিকানার খাত, (গ) সব ধরনের সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানার খাত রাখার বন্দোবস্ত করা হয়। রাষ্ট্রীয় মালিকানার উল্লেখ করে ব্যক্তিখাতের প্রাধান্যকে ‘একটি সমাজতান্ত্রিক আবরণ’[xii] দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছিল। সংবিধানের একই আর্টিকেলে সাধারণভাবে বলা হয়েছিল যে, যন্ত্রপাতি এবং উৎপাদন উপায়ের মালিক হবে জনগণ।

ব্যক্তিগত মালিকানার বিষয়ে সংবিধানে যেভাবে বলা হয়েছে তার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে বদরুদ্দীন উমর বলেছেন, ‘আর্টিকেলগুলোর অর্থ দাঁড়ায়: যাবতীয় (সম্পত্তির) সবকিছুর মালিক হলো ঈশ্বর এবং ১৯৫৬ সালের সংবিধানে এ ধরনের বিধান ছিল। (এই ধারাগুলো) আইয়ুব আমলের ১৯৬২ সালের কুখ্যাত দৃষ্টিভঙ্গির পুনরাবৃত্তি।’[xiii] এর প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল ‘ঈশ্বরের খেদমতগার’ হিসেবে জাগতিক শোষণ-শাসন বজায় রাখা এবং জনগণের পরিশ্রমের ফসল ভোগ করা।[xiv] যুদ্ধোত্তর সংবিধান তারই ধারাবাহিকতা রক্ষা করে চলে। অন্যদিকে, ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিকানা বিলোপের পরিবর্তে ব্যক্তি-পুঁজি এবং বিদেশি বিনিয়োগের বিকাশ এবং কেন্দ্রীভূত করার যাবতীয় বিধি ভাষার মারপ্যাঁচে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো সংবিধানে। পাকিস্তান আমলের ‘ঈশ্বরের খেদমতগার’ মুসলিম লীগ এবং পরবর্তীকালের বিভিন্ন সময়ের শাসকদের তৈরি করা বিভিন্ন বিধান সদ্যোজাত বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সংবিধানের বিভিন্ন ধারার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে নেয় নতুন শব্দ, বাক্য, শ্রেণিবিন্যাসের মাধ্যমে। নানা ধরনের আবরণের মধ্যে ব্যক্তি-পুঁজির বিকাশের বীজ লুক্কায়িত ছিল সদ্য ভূমিষ্ঠ রাষ্ট্রীয় বিধানে।

সংবিধানে সন্নিবেশিত পরস্পরবিরোধী অবস্থানকে একটি কাঠামোতে আবদ্ধ করার লীগ-এর প্রয়াসকে বিভিন্ন ধারার বিশ্লেষকরা প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন বিভিন্ন সময়। তাদের ধারণা অনুযায়ী, সংবিধানে সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে যেসব বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, সেখানে নানাভাবে বিপরীতমুখী অবস্থানকে জায়গা করে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের সংসদীয় গণতন্ত্র, একদলীয় শাসন প্রভৃতির সঙ্গে সমাজতন্ত্রের অন্তর্গত বৈশিষ্ট্যের যে বিস্তর ফারাক ছিল, তাদের বিশ্লেষণে সেই বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে।[xv] যাই হোক, মূলত এই সংবিধান ছিল সমাজে আধিপত্যকারী শ্রেণির রাজনৈতিক প্রকাশ। ‘উদারনৈতিক পুঁজিতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি’র তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটে সংবিধানে। শ্রেণিগত ভিত্তি এবং অন্যান্য শ্রেণির সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্ক পর্যালোচনা করে বদরুদ্দীন উমর বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন শাসক শ্রেণি ছিল মূলত ‘গ্রামীণ ভূমিস্বার্থের সঙ্গে জড়িত বিত্তবান জোতদার এবং অন্যরা লুম্পেন ধরনের নতুন বিত্তশালী ফরিয়া গোষ্ঠী, নতুন শিল্পপতি ও প্রশাসনিক আমলাতন্ত্র এবং কতিপয় সাম্রাজ্যবাদী ও আন্তর্জাতিক শক্তির একটি সম্মিলিত জোট’[xvi] এবং সংবিধানে এই শ্রেণিগত দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রতিফলন ঘটে।

কোনো কোনো গবেষক এই সংবিধানকে ব্রিটিশ এবং ভারতীয় সংবিধানের অনুকরণ বলে মনে করেছেন। কিন্তু তাদের ধারণা অনুযায়ী, বৃটিশ রাষ্ট্রে কিংবা ভারতে প্রতিষ্ঠানগুলো ঐতিহাসিক যেসব আন্দোলন-সংগ্রামের পরিপ্রেক্ষিতে বিবর্তিত হয়ে একধরনের গণতান্ত্রিক চেহারা পেয়েছিল, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান নির্মাণের ক্ষেত্রে সে ধরনের ঐতিহাসিক বিশেষ ধারাবাহিকতা ছিল না।[xvii] যেহেতু সমাজতান্ত্রিক ধারার আন্দোলনের চর্চা আওয়ামী লীগের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে খাপ খায় না এবং অন্যান্য দেশের অনুকরণে সংবিধান রচনা করা হয়, ফলে সংবিধান রচনায় নানা ধরনের বৈপরীত্য থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। সংবিধান প্রণয়ন নিয়ে সে সময় সমাজতান্ত্রিক শিবির থেকে যেমন প্রশ্ন উত্থাপিত হয় তেমনি[xviii] খোদ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের ভেতর থেকেও এই প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। আবুল মনসুর আহমেদ সংবিধানে প্রণীত বিভিন্ন নীতির সমালোচনা করে বলেছেন, ‘আমাদের সংবিধানের মূল ত্রুটি দুটি: এক. বিধানের ত্রুটি, দুই. ভাষার ত্রুটি।’[xix]

একদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতকে অর্থনীতির প্রধান দিক বলা হয়; সব ধরনের শোষণ থেকে কৃষক এবং শ্রমিকের মুক্তির কথা বলা হয়, অন্যদিকে ব্যক্তি-পুঁজির বিকাশের নানা ধরনের পথ খোলা রাখা হয়। অর্থনীতির বৃহত্তর অংশ গঠিত হয়েছিল কৃষিখাত দ্বারা এবং কৃষির এই বিশাল অংশ সরকারি খাতের বাইরে রেখে দেওয়া হলো।[xx] জমি এবং অন্যান্য উৎপাদন উপায়ের মালিকানা বড় ভূমির মালিকদের হাতে কেন্দ্রীভূত হওয়ার কারণে ভূমিহীন, ক্ষুদ্র এবং মাঝারি কৃষকদের শ্রমের উদ্বৃত্ত অংশ ‍উক্ত শ্রেণির হাতে কেন্দ্রীভূত হয়। উৎপাদন এবং বণ্টনের অধিকাংশ সুবিধা ভোগ করে পরজীবী এই শ্রেণিটি। উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগের শ্রেণিগত ভিত্তি জমির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত থাকার কারণে কার্যকর ভূমি সংস্কারের মতো কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা সম্ভব ছিল না এবং সংবিধানে তারই প্রতিফলন ঘটে।

আওয়ামী লীগ সরকার পরিবারপ্রতি ভূমির সিলিং নির্ধারণ করে ১০০ বিঘা বা ৩৩ একর। কিন্তু এই নীতি কৃষিতে সামন্তীয় অবশেষের কোনো উচ্ছেদ ঘটাতে পারেনি। কৃষিতে বণ্টন প্রথা এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি; বরং সামন্তীয় সম্পর্ক উচ্ছেদ না করার ফলে কো-অপারেটিভ এবং সমন্বিত কৃষি পদ্ধতির দ্বারা বড় মালিক-জোতদাররাই লাভবান হয়েছে।[xxi] এছাড়া আওয়ামী লীগের অন্যথা ছিল না। কারণ, দলীয় শক্তির গ্রামীণ ভিত্তি; জোতদারদের চাপ উত্তরোত্তর বেড়ে যাওয়ায় এ সিদ্ধান্ত নিতেই হতো।[xxii] এ ছাড়া সরকার ৮ একর পর্যন্ত ভূমির ওপর রাজস্ব আদায় মওকুফ করে দেয়। এর ফলে মোট আবাদি জমির চার ভাগের তিন ভাগ (অধিকাংশ ক্ষেত্রে যেসব জমির মালিকানা ছিল বড় ভূমির মালিকদের) করের আওতা থেকে মুক্ত থাকে। ১৯৭৩ সালের একটি হিসাবে দেখা যায়, প্রায় ১ কোটি ২৬ লাখ পরিবার ছিল ভূমিহীন, যার মধ্যে প্রায় ৭৮ লাখ ভূমিহীন কৃষক বড় ভূমির মালিকদের থেকে ফসল অথবা নগদ টাকার বিনিময়ে জমি চাষ করতে বর্গা নিত। অন্যদিকে, ভূমিহীন, ক্ষুদ্র কৃষকদের হাতে জমি না থাকায় সরকারি এজেন্সিগুলোর মাধ্যমে দেওয়া সরকারের নিম্ন সুদের ঋণ, সমন্বিত চাষের জন্য অবমূল্যায়িত আধুনিক যন্ত্রপাতি এবং সরকারি দেওয়া অন্যান্য সুবিধা সুফলভোগী ছিল বড় ভূমির মালিকরা।[xxiii]

রেহমান সোবহান আওয়ামী লীগের ভূমি ভিত্তির প্রসঙ্গ তুলে ধরে দেখিয়েছেন যে, ভূমি সংস্কারের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে সরকার গঠিত একটি কমিটি ২৫ মার্চ ১৯৭২ সালে ভূমির সিলিং ১০০ বিঘা থেকে কমিয়ে ৩০ বিঘা করার প্রস্তাব করে।[xxiv] এটা কার্যকর হয়নি। তবে সিলিং যা-ই নির্ধারণ করা হোক না কেন, গ্রামাঞ্চলে কার্যত নামে-বেনামে তার চেয়ে আরও বহুগুণ বেশি জমির মালিকানা ছিল বড় কৃষক, জোতদারদের হাতে। গ্রামাঞ্চলে তারাই ছিল আওয়ামী লীগের ভিত্তি। রেহমান সোবহানের ভাষ্য অনুযায়ী, সরকারের দৃষ্টিতে, ভূমির সিলিং নামিয়ে আনার ফলে আওয়ামী লীগের ঐতিহ্যগত ভিত্তি কাঠামোতে কিছুটা ফাটল ধরে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মূল সমর্থক গোষ্ঠীর মধ্যে এর ফলে একধরনের বিচ্ছিন্নতা দেখা দেয়। এরা হলো সেই ধনী কৃষক, যারা ছিল দলের নির্বাচনি এলাকার মূল সমর্থক এবং যাদের সন্তানরা দলের ছাত্রসংগঠনের অগ্রগামী কর্মী ছিল।[xxv]

অনুপম সেন বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগের বৃহদংশের শ্রেণিচরিত্র ও আদর্শগত ধ্যানধারণা সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির পরিপন্থি ছিল’ এবং সমাজতন্ত্র সম্পর্কে পরিষ্কার উপলব্ধি না থাকার দরুন যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয় তার মধ্যে,

‘সবচেয়ে বড় ত্রুটি ছিল কৃষিখাত। কৃষিখাতকে প্রায় স্পর্শ না করে কেবল শিল্প ও বাণিজ্যখাতে রাষ্ট্রস্বত্বকে প্রাধান্য দিয়ে সমাজতন্ত্র কায়েম করা সম্ভব নয়। যেসব দেশে বলিষ্ঠ আত্মনির্ভর সমাজতন্ত্র গড়ে উঠেছে, সেসব দেশে শিল্প, কৃষি ও বাণিজ্যের প্রায় এককালীন সামাজিকীকরণের মাধ্যমেই তা সম্ভব হয়েছে। কৃষিতে উৎপাদন, কৃষির উদ্বৃত্তের ব্যবহার, কৃষিতে উৎপাদন উপকরণের বণ্টন ও প্রয়োগ, বৃহৎ, ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পে কৃষিতে উদ্বৃত্ত শ্রমশক্তির বিকল্প চাহিদা-সৃষ্টি, শিল্পে কৃষিজাত দ্রব্যের ব্যবহার, কৃষিতে শিল্পসামগ্রীর প্রয়োগ, কৃষকের শিল্পসামগ্রীর চাহিদা বৃদ্ধি প্রভৃতি নানা সূত্রে কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্য অবিনাভাবে (inseparably) গ্রন্থিত। সমাজতন্ত্র হলো সমাজের সব মানুষের কল্যাণে এই তিনটি খাতের সব সম্পদের সামাজিকীকরণ ও পরিকল্পিত উৎপাদন ও বণ্টন। কোনো একটি খাতকে সমাজের বা রাষ্ট্রের স্বত্বে বা সামগ্রিক পরিকল্পনায় না এনে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা প্রায় অসম্ভব। এই সত্যের আংশিক উপলব্ধি থেকেই ১৯৭৫ সালে প্রতি গ্রামে বহুমুখী সমবায় প্রতিষ্ঠা করা সংকল্প ঘোষিত হয়। কিন্তু এই ব্যবস্থায়ও ভূমিস্বত্বের স্বার্থ খুব বেশি ক্ষুণ্ন করা হয়নি। সমবায়ের উৎপাদিত পণ্যের বণ্টনে মালিকানার জন্য এক-তৃতীয়াংশ সংরক্ষিত রাখা হয়েছিল। বস্তুত বঙ্গবন্ধু সরকার যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে যে অর্থনীতি স্থাপন করতে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তা ছিল শিল্পখাতে রাষ্ট্রস্বত্বের প্রাধান্য-প্রদত্ত মিশ্র অর্থনীতি, বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি নয়। কিন্তু তা-ও সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের এ দেশি সহযোগীদের সহ্য হয়নি।’[xxvi]

বড় ভূমির মালিক এবং নব্য ধনী মধ্যবিত্তদের স্বার্থ হাত ধরাধরি করে নীতি নির্ধারণে কাজ করে যাচ্ছিল। তারা নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে এবং নানাবিধ উপায়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন কাঠামোতে ক্রমান্বয়ে জায়গা করে নিয়েছিল। বদরুদ্দীন উমরের ভাষ্যমতে: “এভাবে বাংলাদেশে সামন্তীয় অভিজাত, পুঁজিপতি এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো আওয়ামী লীগের ‘সমাজতন্ত্রে’র পতাকাতলে সমবেত হয়ে সামনে এগিয়ে চলছিল।”[xxvii] শিল্প পলিসিতে বারবার বদল করে ব্যক্তি-পুঁজির শক্ত অবস্থান তৈরির প্রচেষ্টা চলছিল।[xxviii], [xxix] পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য যারা ‘সমাজতান্ত্রিক পরিকল্পনা’র একটি রূপরেখা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে তাদের নিজেদের মতো করে কাজ করে যাচ্ছিলেন, সেসব ন্যূনতম পরিকল্পনাও আলোর মুখ দেখতে পারেনি একদিকে শাসকশ্রেণির ‘জাতীয়তাবাদী’ রাজনৈতিক স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি-সদুদ্দেশ্যের অভাবে, অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানগুলোর পারস্পরিক সমন্বয়হীনতার অভাবে।[xxx]

আইয়ুব খানের সময়ে শিল্পায়ন এবং নগরায়নের প্রক্রিয়ার পাশাপাশি পরিবহণ ও যোগাযোগ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় একধরনের উল্লম্ফন ঘটে। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় বৃদ্ধির কারণে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি ডাক্তার, আইনজীবী, শিক্ষক এবং অন্যান্য পেশাজীবীর সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। পূর্ব পাকিস্তানে শিল্পকারখানা তৈরি হওয়ার কারণে একটি নতুন শিল্প শ্রমিক শ্রেণির পাশাপাশি একটি নতুন স্থানীয় অভিজাত শ্রেণি এবং একেবারে একটি নতুন মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের (প্রকৃত অর্থে একটি মুসলমান মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়) বিকাশ ঘটে।[xxxi] সামন্তীয় অভিজাত, পুঁজিপতিদের সঙ্গে জনগণের সরাসরি সম্পৃক্ততা না থাকায় রাজনৈতিক পরিসরে সে শূন্যস্থান পূরণ করে মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়। বিত্ত-বৈভবের প্রাপ্তির অধরা স্বপ্ন যাদের তাড়িয়ে বেড়াত, সেই সদ্যোজাত মুসলমান মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় ও শিক্ষার্থীদের একটি বিশাল অংশ শেখ মুজিব এবং তার ছয় দফার মধ্যে সর্বজনীন ভোটাধিকার, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও জাগতিক স্বপ্নপূরণ প্রতিষ্ঠার আশার আলো দেখতে পায়। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে রাষ্ট্র পরিচালনায় এই শ্রেণি-গোষ্ঠী-সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করে আওয়ামী লীগ। এই সম্প্রদায়ের হাত ধরেই বাংলাদেশের ‘সমাজতন্ত্রে’র যাত্রা শুরু হয়। রাষ্ট্রীয়করণের নামে ব্যক্তি-পুঁজির নানা খাতকে গোপন-প্রকাশ্য মদত দেয়। প্রথমে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে রাষ্ট্রের আওতায় আনে; সেবা-শুশ্রূষা করে, করের অর্থে রুগ্‌ণ শিল্পকে পরিচর্যা করে, পরবর্তী সময়ে ধারাবাহিকভাবে এসব প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীন করে ব্যক্তি-পুঁজির হাতে তুলে দেয়।[xxxii]

অল্প বিনিয়োগে চটজলদি এবং ঝুঁকিহীন অর্থবিত্ত বানানোর একটি উপায় হিসেবে উচ্চাকাঙ্ক্ষী উঠতি মুসলমান বাঙালি মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে আমদানি-রপ্তানি কমিশন এজেন্সির (ইন্ডেন্টিং) বিকাশ ঘটে ষাটের দশকে। যুদ্ধ-পূর্ব বাংলাদেশে তাদের প্রয়োজন ছিল সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্রের ভেতরে প্রবেশ করা। এই সুযোগ তৈরি হয় একই দশকে যখন পশ্চিম পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাদেশিক পূর্ব পাকিস্তান সচিবালয়গুলোতে বাঙালি আমলারা উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হয়। এর আগে কমিশনভোগীদের জন্য রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা ভোগের তেমন সুযোগ হয়নি। কারণ, পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের ‘গুরুত্বপূর্ণ’ সচিবালয় অধিদপ্তর এবং সরকারি করপোরেশনগুলোতে উচ্চপদে আসীন ছিল অবাঙালি প্রশাসক আমলারা। ‘অগুরুত্বপূর্ণ’ সচিবালয় এবং করপোরেশনগুলোতে যখন বাঙালি আমলাদের নিয়োগ দেওয়া হয়, তখন ইন্ডেন্টিং ব্যবসায়ীদের সুযোগ তৈরি হয় রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা আদায় করে শিল্পে বিনিয়োগ করার।

আইয়ুব সরকারের আমলে পশ্চিম পাকিস্তানি পুঁজিপতিদের ছত্রছায়ায় এই ইন্ডেন্টারদের কেউ কেউ শিল্পে বিনিয়োগ করে বাঙালি নব্য শিল্প পুঁজিপতি হিসেবে সমাজে জায়গা করে নেয়। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে যেসব সিনিয়র আমলা এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্কিত রাজনীতিবিদরা রাষ্ট্রীয়করণের বিরোধী অবস্থানে ছিল, তাদের সঙ্গে উল্লিখিত কমিশনভোগী এজেন্ট (আমলাদের একটি অংশ ইন্ডেন্টিং ব্যাবসার সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল) এবং ষাটের দশকের নব্য শিল্প-পুঁজির মালিকরা পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে নীতি-পরিকল্পনায় ব্যক্তি-পুঁজির অনুপ্রবেশের অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। এই গোষ্ঠীর সঙ্গে পরিকল্পনা কমিশনের উদ্যোগ নিয়ে কোনো কোনো সদস্যের সঙ্গে দ্বন্দ্ব ছিল ‘ওপেন সিক্রেট’ বিষয়।[xxxiii]

রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প ধ্বংসের কৌশল: সুনির্দিষ্ট এবং দীর্ঘমেয়াদি নীতি-পরিকল্পনার অভাব

শিল্পায়নের পথ বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের সামনে কয়েকটি পথ খোলা ছিল। এক. রাষ্ট্রীয় ন্যূনতম হস্তক্ষেপ এবং পরিকল্পনার মাধ্যমে শিল্প উৎপাদন-বণ্টন ইত্যাদির ক্ষেত্রে ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের ওপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করা। কৃষিতে ব্যক্তিমালিকানাধীন উৎপাদন এবং বাজার অর্থনীতিকে পরিপুষ্টকরণের নীতি-পরিকল্পনা গ্রহণ। দুই. উৎপাদনের উপায়ের ওপর জনগণের মালিকানা, কর্তৃত্ব এবং নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। বৈদেশিক বাণিজ্যের একচেটিয়া আধিপত্য খর্ব করা এবং সাম্রাজ্যবাদী পুঁজি বাজেয়াপ্ত করে সর্বজনের মালিকানার অধীন নিয়ে আসা। তিন. উল্লিখিত দুই মডেলের মাঝামাঝি পথ অনুসরণ করা।

ব্যক্তি-পুঁজির বিকাশে প্রথম মডেলটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে গ্রহণ করা হয় এবং এর ফলে অর্থনৈতিক ক্ষমতা ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠীর হাতে পুঞ্জীভূত-কেন্দ্রীভূত হয়। সে অনুযায়ী রাজনৈতিক ক্ষমতাও কুক্ষিগত হয় পুঁজির প্রতিনিধিত্বকারী গোষ্ঠীর হাতে। ফলে, সর্বজনের মধ্যে অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা, বিচ্ছিন্নতাবোধ এবং সমাজের নানা স্তরে বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি হয়। তাত্ত্বিক অবস্থান থেকে বিচার করলে, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয়করণের ফলে যেহেতু ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠীর হাতে সম্পদ কেন্দ্রীভবনের সম্ভাবনার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়, তাই এর উৎপাদন-বণ্টন-ভোগের সুফল সিংহভাগ শ্রমিক শ্রেণিসহ সর্বজনের ভাগ্যে জোটে। সমাজতান্ত্রিক শিল্পায়নের জন্য রাষ্ট্রীয়করণ তাই একটি অত্যাবশ্যকীয় শর্ত। এই মডেলে এক. সামগ্রিক উৎপাদনের উল্লম্ফন ঘটে এবং এর ফলে জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পায়। দুই. বাজারে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের কারণে সর্বজনীন বাজারব্যবস্থা স্থাপিত হয়। তিন. সহযোগী শিল্পায়নের বিভিন্ন শাখা স্থাপনের প্রক্রিয়ায় ভিত্তিমূলক শিল্প বিকাশের যাবতীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। বৈদেশিক ঋণনির্ভরতার বিপরীতে স্থানীয়ভাবে মূলধন সংগ্রহের নানা পরিকল্পনা গ্রহণসহ স্থানীয় চাহিদা পূরণ, কৃষিতে সমবায়ীকরণ, প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর সর্বজনের পূর্ণ কর্তৃত্ব-নিয়ন্ত্রণ এবং মালিকানা ইত্যাদির যাবতীয় কর্মকাণ্ড কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার অধীন পরিচালিত হয়। গণতান্ত্রিক নীতি অনুযায়ী সম্পদের উৎপাদন-বণ্টন পরিকল্পনা গ্রহণের ফলে সুনির্দিষ্ট জবাবদিহিতার অবস্থা-অবস্থান বিরাজ করে। বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির বিকাশের মধ্য দিয়ে উৎপাদনী সক্ষমতা, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে অন্যদিকে আন্তর্জাতিক একচেটিয়া পুঁজির আধিপত্যবিরোধী অবস্থানের বিপরীতে দাঁড়ানোর শক্তি অর্জন করে। এ ধরনের পদক্ষেপের প্রয়োজনে সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থায় তাই অর্থনীতি, শিল্প, প্রশাসন, বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি অর্থাৎ স্থানীয় সামগ্রিক বিকাশের প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক পরিকল্পনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। এসবের সামগ্রিক বিচারে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয়করণ না সোভিয়েত মডেল, না পশ্চিম ইউরোপ মডেল, না ভারতীয় মডেল, না বাংলাদেশপন্থি মডেল–সুনির্দিষ্ট কোনো পথেই অগ্রসর হয়নি।

বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয়করণ না সোভিয়েত মডেল, না পশ্চিম ইউরোপ মডেল, না ভারতীয় মডেল, না বাংলাদেশপন্থি মডেল–সুনির্দিষ্ট কোনো পথেই অগ্রসর হয়নি।

নমুনা হিসেবে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের দাম নির্ধারণ, ঋণের দায়, লোকসানের দায়, মুনাফা হার হ্রাসের প্রক্রিয়াগত দিকগুলোর কথা উল্লেখ করা যায়। রাষ্ট্রায়ত্ত কলকারখানার উৎপাদিত পণ্যের প্রাথমিক ভোক্তা ছিল ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো। যাদের চাপের কারণে রাষ্ট্রীয় শিল্পের উৎপাদিত পণ্যের দাম বাজারের সঙ্গে সংগতিহীন অবস্থানে রাখা হতো। উৎপাদন খরচের তুলনায় দাম কম রাখার ফলে শিল্পের বিভিন্ন শাখা বিভিন্নভাবে ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যায়। বাজারদরের সঙ্গে সমন্বয় না করে কোনো কোনো শিল্পের ক্ষেত্রে ভর্তুকি প্রদান সত্ত্বেও এসব শিল্পকারখানা লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়ার ঝুঁকি এড়াতে পারেনি। বিশেষত সেসব শিল্প ইউনিটকে দ্রুত লোকসানি খাতে নিয়ে নেওয়া হয়, যেগুলো চাহিদানুযায়ী পণ্যের জোগান দিতে সমর্থ ছিল না। তার বিপরীতে সর্বজনের সম্পদ নিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রদত্ত ক্ষতিপূরণ, বাজারের সঙ্গে বিক্রয় দরের সামঞ্জস্য বিধান, বণ্টন ব্যবস্থাপনা-কৌশল, মুনাফা আহরণ পদ্ধতি ইত্যাদি বিষয়ের প্রতি রাষ্ট্রের শিথিল অবস্থান কিংবা অব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি কিংবা ক্রমাগত হাত গুটিয়ে নেওয়ার কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের মুনাফা-সম্পদ প্রভৃতি ব্যক্তি নানা উপায়ে পুঁজির মালিকদের হাতে জমা হতে থাকে।[xxxiv]

সর্বজনের সম্পদ নিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রদত্ত ক্ষতিপূরণ, বাজারের সঙ্গে বিক্রয় দরের সামঞ্জস্য বিধান, বণ্টন ব্যবস্থাপনা-কৌশল, মুনাফা আহরণ পদ্ধতি ইত্যাদি বিষয়ের প্রতি রাষ্ট্রের শিথিল অবস্থান কিংবা অব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি কিংবা ক্রমাগত হাত গুটিয়ে নেওয়ার কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের মুনাফা-সম্পদ প্রভৃতি ব্যক্তি নানা উপায়ে পুঁজির মালিকদের হাতে জমা হতে থাকে।

একদিকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি থেকে বঞ্চিত করা এবং অন্যদিকে পুষ্টিহীনতার দায় সে শিল্পের ঘাড়েই চাপিয়ে দেওয়ার দৃষ্টিভঙ্গি রাষ্ট্রীয় খাতকে বিকশিত হতে দেয়নি যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে। সেসময় থেকে পরবর্তী যত সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে, তারা সবাই যাবতীয় লোকসানের দায় চাপিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ওপর। এই সুযোগকে পরিপূর্ণভাবে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করে বেড়ে ওঠে দেশি-বিদেশি পুঁজির মালিক। আন্তর্জাতিক বাজারদরের ওঠানামার কারণে আমদানি পণ্যের ওপর যে মালিকদের ভর্তুকি দেওয়া হতো, তাদের লোকসানের দায়ও রাষ্ট্রীয় খাতের হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ ছাড়া অধিগ্রহণ করা শিল্পে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ঋণের দায় তো ছিলই। অভ্যন্তরীণ উৎপাদনী ব্যবস্থাপনা (ব্যবস্থাপনা কমিটিতে যাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তারা মূলত পুঁজিরই প্রতিনিধিত্ব করতেন এবং বেশির ভাগ কমিটি পরিচালিত হতো অ্যাডহক ভিত্তিতে) এবং বাহ্যিক বাজার ব্যবস্থাপনা-এই দুইয়ের চাপে পড়ে শিল্পের ভিত্তি প্রথম থেকে নড়বড়ে হয়ে পড়ে। বিনিয়োগ, দাম, মুনাফা, মজুরির প্রতিটি ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দমিয়ে রাখার ফলে সম্পর্কিতভাবে একদিকে যেমন ব্যক্তি-পুঁজির হাতে তুলে দেওয়ার শর্ত পূরণ হয়, অন্যদিকে অসহযোগিতার সম্পর্ক এবং অনুৎপাদনশীল-‘অবৈধ’ আয়ের সুযোগ তৈরি হয়।[xxxv]

রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভেতর থেকে পঙ্গু করে দেওয়া এবং ব্যক্তি-পুঁজির হাতে তুলে দেওয়ার শর্ত তৈরির একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো শিল্পকারখানায় ক্রমাগত মুনাফা হার হ্রাসের প্রবণতাকে বাড়তে দেওয়া। পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতিতে পুঁজির পারস্পরিক প্রতিযোগিতার ফলে সাধারণভাবে মুনাফা হারের হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে। এক পুঁজি অন্য পুঁজিকে উৎপাদিত মূল্যের অনুপাতে কম দামে পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য করে। মার্কস-এর পাঠ থেকে জানা যায়, পণ্য উৎপাদনে পুঁজির কাছে যে শ্রমশক্তি বিক্রয় করা হয়, উৎপাদনী প্রক্রিয়ায় সে শ্রমশক্তি নিয়োজনের অনুপাত যদি হ্রাস পায় অর্থাৎ অপরিবর্তনীয় পুঁজির অনুপাত বৃদ্ধির ফলে যদি শ্রমিকের সংখ্যা কিংবা শ্রমশক্তির আনুপাতিক পরিমাণ-হার হ্রাস পায়, অন্যদিকে মূল্য উৎপাদন-পুনরুৎপাদনের ধারক বিধায় যদি পণ্য হিসেবে শ্রমিকের শ্রমশক্তির মূল্য হ্রাস পায়, তাহলে নির্দিষ্ট পুঁজির মুনাফার হার কমে যায়।[xxxvi] ক্রয়ক্ষমতার অভাবে জীবনধারণের প্রয়োজনীয় পণ্য শ্রমিকের পক্ষে কেনা সম্ভব হয় না এবং তার ফলে বাজারে পণ্যের দাম কম থাকা সত্ত্বেও পণ্য অবিক্রীত থেকে যায়।

যুদ্ধোত্তরকালে পুঁজিতান্ত্রিক পদ্ধতিতে চলা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন দিক থেকে লোকসানের কবলে পড়ে। একদিকে উৎপাদন খরচের তুলনায় কম দামে পণ্য বিক্রি এবং অন্যদিকে বহুমুখী দুর্নীতির কারণে ক্রমাগত লোকসানের কবলে পড়তে হয়। পাটশিল্পসহ অনেক শিল্পে এভাবে ক্রমাগত লোকসান দেখা দিলেও কিছু গোষ্ঠীর সম্পদ বৃদ্ধির পথ পরিষ্কার হয়। রাষ্ট্রীয় শিল্পকারখানার ‘অসন্তোষজনক’ কর্মক্ষমতার কারণ সম্পর্কে কোনো কোনো গবেষক কিছু দিক চিহ্নিত করে দেখিয়েছেন রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ‘অসন্তুষ্টি’র নেপথ্যে যেমন মনুষ্যসৃষ্ট কারণ রয়েছে, তেমনি পরিস্থিতিগত প্রভাবও রয়েছে। যদিও চিহ্নিতকরণের ক্ষেত্রে আদর্শগত প্রশ্নটিকে বিবেচনার কেন্দ্রে রাখা হয়নি, তবুও সাধারণভাবে টেকনিক্যাল দিকসহ যেসব দিকের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণগুলো হলো:[xxxvii]

এক. কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিচালনা কৌশল ছাড়াই শিল্পকারখানাগুলোকে রাষ্ট্রীয়করণের আওতায় আনা,[xxxviii]

দুই. প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রণের জন্য অ্যাডহক ভিত্তিতে পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া,

তিন. উৎপাদনশীলতার প্রশ্নে প্রযুক্তিগত সংমিশ্রণ, উৎপাদিত পণ্যের দাম নির্ধারণ, শিল্পের মূলধন তহবিলের জোগান প্রশ্নে সুনির্দিষ্ট পলিসি, সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনার জন্য রাষ্ট্রীয়করণের প্রভাবের অনুধাবন এবং সরকারি-বেসরকারি খাতের পারস্পরিক দ্বান্দ্বিক ভূমিকার মীমাংসা ইত্যাদির অভাব,

চার. ভর্তুকির ভূমিকার প্রশ্নের মীমাংসা না হওয়া এবং উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের উদ্যোগের প্রশ্নটি অমীমাংসিত রাখা,

পাঁচ. ব্যবস্থাপনার প্রশ্নে একটি সুনির্দিষ্ট এবং সন্তোষজনক সাংগঠনিক কাঠামোগত প্রক্রিয়ার জন্য কোনো উদ্যোগ গ্রহণ না করা,

ছয়. শ্রমিক এবং ব্যবস্থাপকদের মধ্যকার সম্পর্কের প্রশ্নে আলাদাভাবে আচরণবিধির রূপরেখা তৈরির সমস্যা,

সাত. রাষ্ট্রীয়কৃত শিল্পের স্তরে যথাযথ স্বায়ত্তশাসনের অনুপস্থিতি এবং অপারেশনাল দক্ষতাকে সীমাবদ্ধ করে এমনসব সিদ্ধান্ত গ্রহণ,

আট. একদিকে ব্যবস্থাপক কর্মকর্তা, প্রকৌশলী, হিসাবরক্ষক, অর্থনৈতিক বিশ্লেষক, মার্কেটিং বিশেষজ্ঞ এবং দক্ষ শ্রমিকের অভাবের ফলে সমস্যাজনক পরিস্থিতির উদ্ভব, অন্যদিকে রাজনৈতিক নেতৃত্বের মদতপুষ্ট অদক্ষ এবং অযোগ্য কর্মী-কর্মকর্তাদের প্রাধান্য-আধিপত্যের কারণে পরিস্থিতি ঘোলাটে আকার ধারণ করা,

নয়. ধ্বংসপ্রায় যোগাযোগব্যবস্থা, চোরাকারবার, শ্রমিক ছাঁটাই বৃদ্ধি এবং বিদেশি বাজারের ক্রমাগত লোকসান গভীর সংকটের শর্ত তৈরি,

দশ. সাধারণভাবে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা এবং মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে বণ্টনব্যবস্থার অসদাচরণের যৌথতার কারণে সার্বিক অর্থনীতির দৈন্য অবস্থা সৃষ্টি,

এগারো. রাষ্ট্রীয়করণের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের ভেতরে এবং বাইরের মূলধারার রাজনীতিবিদ, দেশি-বিদেশি পুঁজির লবিস্টদের প্রচার-প্রচারণা রাষ্ট্রীয়কৃত শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিবর্গ, বিশেষ করে সমাজতন্ত্র সম্পর্কে যাদের ভেতরে একধরনের মোহ বা বাস্তবতাবিবর্জিত আকাঙ্ক্ষা (wishful thinking pattern) কাজ করত, তাদের চৈতন্যে চিড় ধরাতে সক্ষম হওয়া,

বারো. রাষ্ট্রীয়করণে মূলধারার সামগ্রিক রাজনৈতিক গোপন-প্রকাশ্য বিরোধিতা, শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গ্রহণে অপ্রয়োজনীয় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং প্রতিকূল প্রচারের সাপেক্ষে অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ইত্যাদির কারণে গোড়া থেকেই অক্ষম করে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা,

মোটকথা, শক্তিশালী ভিত্তি এবং দৃঢ় অবস্থানে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর না দাঁড়ানোর মূল দায়ভার বর্তায় সরকারের ওপর। দীর্ঘ মেয়াদে দক্ষতা, ক্ষমতা, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ থেকে বিরত থাকার কারণ হিসেবে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির অক্ষমতাকে উল্লেখ করা যায়। অবস্থা পরিবর্তনকালীন সন্ধিক্ষণে সরকার রাষ্ট্রীয় খাত এবং ব্যক্তিখাতের সীমা নির্ধারণে অক্ষমতার পরিচয় দেয়, ফলে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে সরকার রাষ্ট্রীয় খাতকে ভগ্নদশা থেকে নিজস্ব ভিত্তির ওপর শক্তভাবে দাঁড়া করাতে পারত, সেসব থেকে বিরত থাকে কিংবা অসমর্থ হয়।[xxxix]

উপরোক্ত ফাঁকফোকর গলে অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, অদক্ষতা, ক্রমাগত লোকসান, বৈদেশিক বাণিজ্যে ঘাটতি, সর্বজনের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস প্রভৃতি বৃদ্ধি পেতে থাকে। অন্যদিকে, মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীদের আধিপত্য-নিয়ন্ত্রণ এবং কর্তৃত্ব তৈরি হয় অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থায়। একদিকে সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রীয় শিল্পকারখানার লোকসান ক্রমাগত বাড়তে থাকে (এর মধ্যেও কোনো কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠানের লাভ যুদ্ধ-পূর্ব সময়ের তুলনায় বৃদ্ধি পায়), অন্যদিকে ব্যক্তি-পুঁজিপতিরা তাদের খোলস থেকে ক্রমান্বয়ে বেরিয়ে আসতে থাকে।

যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে অর্থনীতির বেশ কিছু খাত রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের অন্তর্ভুক্ত হলেও মূলত ছিল পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থাধীন পরিচালিত। রাষ্ট্রীয় খাত এবং ব্যক্তি-পুঁজির খাত পাশাপাশি অবস্থান করছিল। বিশ্বের যেসব দেশে শ্রমিক শ্রেণির পার্টির নেতৃত্বে ‘সমাজতান্ত্রিক’ বিপ্লব হয়, সেখানে প্রাথমিক অবস্থায় অর্থনীতির কিছু খাতে ব্যক্তি-পুঁজির ব্যবস্থা রাখা হয়, কিন্তু সেসব খাতকে সার্বিক নজরদারির মধ্যে রাখা হয়। যেখানে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে কৃষকদের সঙ্গে যৌথ সম্পর্ক থেকে শ্রমিক শ্রেণি রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করে; উৎপাদনী উপায়ের মালিকানা-কর্তৃত্ব-নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে পুরো ব্যবস্থাকে পরিচালিত করে, সেখানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রযন্ত্রে শ্রমিক শ্রেণির কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ দূরের বিষয় ন্যূনতম কর্তৃত্বও ছিল না। যার ফলে রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার নানা ক্ষেত্রে পেটি বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব, আমলাতন্ত্র এবং টেকনোক্র্যাটদের নিয়ন্ত্রণ, আধিপত্য এবং কর্তৃত্ব তৈরি হয়।

বাংলাদেশ এমন মডেল হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে জায়গা করে নেয়, যেখানে সর্বজনের বিপরীতে সামগ্রিক রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ওপর মুষ্টিমেয় ‘অভিজাত’ রাজনীতিবিদ, সামরিক শাসক, আমলাতন্ত্র, টেকনোক্র্যাট, পেশাজীবী ব্যবস্থাপক অর্থাৎ ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠীর কর্তৃত্ব-আধিপত্য এবং নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়।

‘সমাজতন্ত্র’ সম্পর্কে বাস্তবসম্মত পরিষ্কার দৃষ্টিভঙ্গি, নীতি, পরিকল্পনাহীনতার অভাবে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে নানা ধরনের অব্যবস্থা, অনিয়ম, দুর্নীতি, লুটপাটের ধারা প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ এমন মডেল হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে জায়গা করে নেয়, যেখানে সর্বজনের বিপরীতে সামগ্রিক রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ওপর মুষ্টিমেয় ‘অভিজাত’ রাজনীতিবিদ, সামরিক শাসক, আমলাতন্ত্র, টেকনোক্র্যাট, পেশাজীবী ব্যবস্থাপক অর্থাৎ ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠীর কর্তৃত্ব-আধিপত্য এবং নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। পাবলিক সেক্টরের শিল্পকারখানার ব্যবস্থাপনা এবং পরিচালনার জন্য অর্পিত দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিক বনে যায়। পুঁজিবাদী বাজার অর্থনীতির অন্তর্নিহিত উপাদানগুলোর ধারাবাহিকতা থাকার কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্পদ ব্যক্তিখাতের সম্পদ এবং পুঁজির বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়। যে প্রক্রিয়া উৎপাদন ব্যবস্থায় শোষণ থেকে শুরু করে সামাজিক বণ্টনে চরম আয়বৈষম্য এবং অরাজকতা তৈরির নেপথ্যে অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করে।[xl]

আগের পর্ব: ২২ পরিবারের অতীত ও বর্তমান-৫

পরের পর্ব: ২২ পরিবারের অতীত ও বর্তমান-৭

মেহেদী হাসান: লেখক, গবেষক। ই-মেইল: mehedihassan1@gmail.com

তথ্যসূত্র:

[i] ফজলুল হাসান ইউসুফ তার গবেষণায় বলেছেন, “…Attuned to careful nurturing by the government the Bengali entrepreneurs did not develop into an efficient and driving class and were unwilling to set up new enterprises for which there was ample scope outside the reserved list for the public sector. In addition to the abandoned units which were intended to be disinvested almost from the time of their take-over by the Awami League Government, advocates of the private sector were openly demanding “disinvestment” of the enterprises placed under the nationalised sector. Afterwards, denationalisation was explicitly demanded in respect of jute and cotton textile units previously owned by the Bengali owners.” Muhammad Fazlul Hassan Yusuf, Nationalisation of Industries In Bangladesh; Political and Administrative, University of Tasmania, December, 1980, p. 374.
[ii] শিরোনাম: Disinvestment by James Chen, October 28, 2020, https://www.investopedia.com/terms/d/disinvestment.asp

[iii] “The contradictions in nationalisation policy inhibited declaration of an industrial policy in an atmosphere of fast accumulation of private wealth”. Muhammad Fazlul Hassan Yusuf, Nationalisation of Industries In Bangladesh; Political and Administrative, University of Tasmania, December, 1980, page -375.

[iv] — Ibid— p. 372.

[v] — Ibid— p. 412.

[vi] “..It appears that in Bangladesh economic nationalism was interpreted in terms of localisation of capitalism by supplanting foreign capital and control with that of the national middle class instead of a truly national ownership.” — Ibid—p. 380.

[vii] — Ibid— p. 419.

[viii] — Ibid— p. 381-382.

[ix] — Ibid— p. 366.

[x] — Ibid—

[xi] — Ibid— p. 367.

[xii] Badruddin Umar, Politics and society in East Pakistan and Bangladesh, Mowla Bros. 1974, p. 212।

[xiii] — Ibid—

[xiv] — Ibid—

[xv] “…The constitutional goal of achieving socialism through parliamentary democracy was contradictory in many respects. Authority of the parliament itself was curbed due to the existence of a constitutional provision empowering the President to enact laws. Absolute majority in the parliament of one party and the undisputed charisma and authority of the Prime Minister Mujibur Rahman turned the parliament into a house of the mutes.” Muhammad Fazlul Hassan Yusuf, Nationalisation of Industries In Bangladesh; Political and Administrative, University of Tasmania, December, 1980, p. 367.

[xvi] বদরুদ্দীন উমর আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য শ্রেণির পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে বলছেন: “The grand alliance of the above mentioned ruling parties is, in fact, nothing other than a grand alliance of landed interests (jotdars and others), of lumpen-type new rich phorias, of a new class of industrial and administrative bureaucracy and of certain imperialist and foreign powers. This alliance, by virtue of its anti-people policies, is now fast losing political ground in this country’’. Badruddin Umar, Politics and society in East Pakistan and Bangladesh, Mowla Bros. 1974, p. 320-321.

[xvii] “…The framers of the Constitution sought to emulate the Indian and British variety of democratic socialism. Because of the inner contradictions of the party in power this turned out to be deceptive. British socialism had its roots in distinctively British ideas and British institutions and was evolutionary. Socialism as embodied in the Indian constitution had behind it a long tradition of political process. Bangladesh had no such enduring tradition in respect of socialist ideas.” Muhammad Fazlul Hassan Yusuf, Nationalisation of Industries In Bangladesh; Political and Administrative, University of Tasmania, December, 1980, p. 367.
[xviii] শিরোনাম: Ajker Bangladesh, Questions of 41 Years, 7 August 2012, https://www.youtube.com/watch?v=rZeOOys1vI8
[xix] আবুল মনসুর আহমদ, আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, খোশরোজ কিতাব মহল, ঢাকা, ২০১৩, পুনর্মুদ্রণ, পৃ. ৬১৭।

[xx] Muhammad Fazlul Hassan Yusuf, Nationalisation of Industries In Bangladesh; Political and Administrative, University of Tasmania, December, 1980, p. 121-122.

[xxi] — Ibid— p. 137.

[xxii] Badruddin Umar, Politics and society in East Pakistan and Bangladesh, Mowla Bros. 1974, p. 247.

[xxiii] Muhammad Fazlul Hassan Yusuf, Nationalisation of Industries In Bangladesh; Political and Administrative, University of Tasmania, December, 1980, p. 137-138.

[xxiv] Rehman Sobhan, Untranquil Recollections; Nation Building in Post-Liberation Bangladesh, Sage, Select Publications, 2021, p. 119

[xxv] — Ibid— p. 119-120

[xxvi] অনুপম সেন, বাংলাদেশ: রাষ্ট্র ও সমাজ; সামাজিক অর্থনীতির স্বরূপ, দ্বিতীয় সংস্করণ, ঢাকা: অবসর প্রকাশনা সংস্থা, ১৯৯৯, পৃ. ৬৮-৬৯।

[xxvii] Badruddin Umar, Politics and society in East Pakistan and Bangladesh, Mowla Bros. 1974, p. 248.

[xxviii] “The question of ownership was addressed in the very first paper on industrial policy presented to the cabinet by the Bangladesh Planning Commission in December 1972. The paper addressed the issue of the private public sector mix in industrial ownership and the role of foreign investment. Subsequent policy interventions in June 1974 and again early in 1975 sought to modify provisions of the 1972 policy.” Rehman Sobhan, An Industrial Strategy for Industrial Policy : Redirecting the Industrial Development of Bangladesh in the 1990s, Source: The Bangladesh Development Studies, Vol. 19, No. 1/2, Industrial Policies and State of Industrialization in Bangladesh (March-June 1991), pp. 201-215 Published by: Bangladesh Institute of Development Studies, URL: http://www.jstor.org/stable/40795402. p. 205.

[xxix] “The policy announced in 1973 was revised in the middle of 1974 when, in view of the rising prices both at home and abroad, the ceiling on private sector investment was raised to Tk. 30 million from the original Tk. 2.5 million. The 1974 policy was further amended in December 1975 and the ceiling on private investment was raised to Tk. 100 million.” A. M. A. Rahim, A Review of Industrial Investment Policy in Bangladesh, 1971-1977, Source: Asian Survey, Vol. 18, No. 11 (Nov., 1978), pp. 1181-1190, Published by: University of California Press, URL: http://www.jstor.org/stable/2643300, p. 1183.

[xxx] “…Essentially the middle class character of the political party launching the programme, lack of leadership and cadres suitable for the building up of the avowed socialism, a tendency to ignore the practical difficulties in implementation, failure to provide institutional supports, distorted priorities, absence of a strong and motivated working class party, retention of the property foundations of social relations in all spheres, piecemeal planning and nationalisation, and indifferent efforts to mobilise domestic savings and inculcate self-reliance,and an excessive dependence on foreign aid all combined to prepare a seed bed which could not possibly germinate the Bangladesh industrial nationalisation programme into a socialist nationalisation.” Muhammad Fazlul Hassan Yusuf, Nationalisation of Industries In Bangladesh; Political and Administrative, University of Tasmania, December, 1980, p. 383-384.

[xxxi] Caf Dowlah, The Bangladesh Liberation War, the Sheikh Mujib Regime and Contemporary Controversies, Lexington Books Lanham, 2016, p. 40.

[xxxii] “..In Bangladesh too, in spite of all rhetoric on socialism, nationalisation turned out to be a needed boost to the ailing private sector, first taking certain enterprises under public care followed by treatment, nursing and then rehabilitation and finally according them freedom.” Muhammad Fazlul Hassan Yusuf, Nationalisation of Industries In Bangladesh; Political and Administrative, University of Tasmania, December, 1980, p. 385.

[xxxiii] Rehman Sobhan, Untranquil Recollections; Nation Building in Post-Liberation Bangladesh, Sage, Select Publications, 2021, p. 116.

[xxxiv] “Compensation payment for nationalisation of enterprises, system of selling prices, distribution mechanism and capitalist profit making made transfer of resources from the nationalist industries to private sector possible.” Muhammad Fazlul Hassan Yusuf, Nationalisation of Industries In Bangladesh; Political and Administrative, University of Tasmania, December, 1980, p. 389.

[xxxv] — Ibid— p. 389-390.

[xxxvi] “…The general rate of profit can therefore fall in one or another branch of business if competition etc. forces the capitalist to sell below the value, i.e. to realize a part of the surplus labour not for himself, but for those who buy from him. But the general rate cannot fall in this way ; it can fall only if the proportion of surplus labour to necessary labour falls relatively, and this, as we saw earlier, takes place if the proportion is already very large, or, expressed differently, if the proportion of living labour set into motion by capital is very small – if the part of capital which exchanges for living labour is very small compared to that which exchanges for machinery and raw material. The general rate of profit can fall in that case, even though absolute surplus labour rises.” Karl Marx, Grundrisse, Foundations of the Critique of Political Economy (Rough Draft), Translated with a Foreword by Martin Nicolaus, Penguin Books, in association with New Left Review, Reprinted 1993, p. 435.

[xxxvii] Muhammad Fazlul Hassan Yusuf, Nationalisation of Industries In Bangladesh; Political and Administrative, University of Tasmania, December, 1980, p. 391-392.

[xxxviii] “There is sufficient evidence from Bangladesh to suggest that the public sector played a critical role in initiating the process of industrialisation in Bangladesh in the 1950s and 1960s. There is also evidence relating to Bangladesh to suggest that the escalation in the role of the public sector after 1971 derived from circumstantial rather than exclusively policy compulsions. There is no evidence to suggest that policy interventions designed to raise the productivity/efficiency and market profitability of the public sector if effectively carried out could not significantly improve its performance.” Rehman Sobhan, An Industrial Strategy for Industrial Policy : Redirecting the Industrial Development of Bangladesh in the 1990s. Source: The Bangladesh Development Studies, Vol. 19, No. 1/2, Industrial Policies and State of Industrialization in Bangladesh (March-June 1991), pp. 201-215 Published by: Bangladesh Institute of Development Studies, URL: http://www.jstor.org/stable/40795402. p. 205.

[xxxix] Muhammad Fazlul Hassan Yusuf, Nationalisation of Industries In Bangladesh; Political and Administrative, University of Tasmania, December, 1980, p. 391-392.

[xl] “A democratic ideal of nationalisation could check the lop sided development and concentration of wealth. Instead the Bangladesh variety of nationalisation depended on foreign induced industrial expansion resulting in heightened social inequalities and development on distorted priorities, long term decapitalisation of the economy and failure to absorb the vast multitude of unemployed and underemployed. External debts and influences of the donor agencies and donor countries even tended to encroach upon the sovereignty of the State.” — Ibid— p. 385-386.

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •