আখচাষ ও রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিশিল্প সংকট: কারণ ও তার প্রতিকার

সংবাদ সন্মেলন
পাটকল চিনিকল বিষয়ে সরেজমিন অনুসন্ধান ও গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলন-২

গত ২১ ডিসেম্বর, ২০২০ ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সর্বজনকথার আয়োজনে ‘পাটকল চিনিকল বিষয়ে সরেজমিন অনুসন্ধান ও গবেষণা প্রতিবেদন’ প্রকাশ উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সংবাদ সম্মেলনে আখচাষ ও চিনিকল বিষয়ে সরেজমিন অনুসন্ধান ও গবেষণার লিখিত প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোশাহিদা সুলতানা। এখানে এই গবেষণা সারসংক্ষেপ পত্রটি প্রকাশ করা হলো। এছাড়া সংবাদ সম্মেলনে পাটকল বিষয়ক অনুসন্ধান ও গবেষণার লিখিত প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন গবেষক ড. মাহা মির্জা। সম্পূরক বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, পাটকল শ্রমিক আবদুল হালিম মিঠু ও চিনিকল শ্রমিক ফেরদৌস ইমাম। পাটকল চিনিকল সহ সামগ্রিক রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প ও রাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং সর্বজনকথার সম্পাদক আনু মুহাম্মদ।

রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো বন্ধ করার পর এখন চেষ্টা চলছে রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলো বন্ধ করার। যুক্তি সেই একটাই- লোকসান। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে এসে লোকসানের বোঝা কমানোর কথা বলে রাষ্ট্রায়ত্ত ১৫টি চিনিকলের মধ্যে ৬টি চিনিকলের (পঞ্চগড়, সেতাবগঞ্জ, শ্যামপুর, রংপুর, পাবনা, কুষ্টিয়া) চিনি উৎপাদন বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি)। প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী বন্ধ হওয়া ছয় চিনিকলে ২ হাজার ৮৮৪ জন শ্রমিক কর্মচারী কর্মরত। রাষ্ট্রায়ত্ত পাটশিল্পের মতোই রাষ্ট্রায়ত্ত চিনি কলগুলোর লোকসানের উপর যত বেশি আলোকপাত করা হয়, লোকসানের প্রকৃত কার্যকারণগুলো নিয়ে ততটুকু আলোচনা হয় না। কারণ সেই আলোচনা হলে স্পষ্ট হয়ে যাবে কীভাবে সমস্যার কারণ ও সমাধান সুনির্দিষ্টভাবে জানা থাকার পরেও তার সমাধান না করে বরং সেই সমস্যাগুলোকে কাজে লাগিয়ে সর্বজনের প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করা ও কিছু চেনা গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেয়ার যৌক্তিকতা তৈরি করা হয়। 

সংকটের প্রকৃত কার্যকরণ

রাষ্ট্রীয় চিনিকলগুলোর সংকটের একটা বড় কারণ হলো চিনির উৎপাদন খরচ আমদানি করা চিনির বাজারদরের তুলনায় অনেক বেশি। এই খরচের একটা বড় অংশ আবার ঋণের সুদ। যেমন রংপুর চিনিকলে প্রতি কেজি চিনি উৎপাদনে গত মৌসুমে খরচ হয়েছে ১৮৬ টাকা ২৪পয়সা। এই চিনিকলের ১৫৮ কোটি টাকা ব্যাংকঋণ আছে। এর সুদ হিসাব করলে প্রতিকেজি চিনি উৎপাদনের খরচ দাঁড়ায় ৩১১ টাকা ৯৭ পয়সা। সেই চিনি বিক্রি হয়েছে মাত্র ৫৩ টাকা ৩৫ পয়সা কেজি দরে। পঞ্চগড় চিনিকলে গত মৌসুমে প্রতি কেজি চিনির উৎপাদন খরচ ছিল ৩০২ টাকা (সুদসহ)। একইভাবে প্রতি কেজি উৎপাদনে কুষ্টিয়ায় ২৭৩, শ্যামপুরে ২৬২, সেতাবগঞ্জে ২৪৯ এবং পাবনায় ১৭৮ টাকা ব্যয় হয়েছে। আর বিক্রি হয়েছে ৫৩ থেকে ৫৭ টাকা কেজি দরে। (প্রথম আলো, ৩ ডিসেম্বর ২০২০)

আমাদের অনুসন্ধানে আমরা দেখি চিনিকলগুলোর বাড়তি উৎপাদন খরচের কারণগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করা যায় (১) আখচাষ ও উৎপাদন প্রক্রিয়াজনিত কারণ (২) আর্থিক সংকট ব্যবস্থাপনাজনিত কারণ ও (৩) অন্যান্য ব্যবস্থাপনাজনিত কারণ

(১) আখচাষ ও উৎপাদন প্রক্রিয়াজনিত কারণ

আখের অপর্যাপ্ত সরবরাহ

চিনিকলগুলো পুরো মাড়াই মৌসুম জুড়ে আখ থেকে চিনি উৎপাদনের জন্য পর্যাপ্ত আখ পায় না। তাই বছরের একটা বড় সময়জুড়ে উৎপাদন বন্ধ থাকে। যদিও বাজারজাতকরণ, বিতরণ, মেরামত, লেনদেন ও ব্যবস্থাপনার কাজ সারা বছরই চলে, কিন্তু বেশিরভাগ মিলে পণ্য বহুমুখীকরণ (অ্যালকোহল, স্যানিটাইজার, জীবাণুনাশক, বায়োগ্যাস, জৈবসার, বর্জ্য ছোবড়া থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন) না করার কারণে সরাসরি উৎপাদনের সাথে জড়িত শ্রমিক, কর্মচারীরা সারাবছর কাজ করার সুযোগ পান না। কিন্তু বেতন-ভাতাসহ বিভিন্ন স্থির খরচ সারা বছরই বহন করতে হয় চিনিকলগুলোকে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় কুষ্টিয়া চিনিকলে ২০০৬-০৭  অর্থবছরে মাড়াই দিবস ১৪২ ছিল, যা ২০১৮-১৯ এ এসে প্রায় অর্ধেক (৬৯ দিন) হয়ে গেছে। এমনকি লাভজনক মিল কেরু এন্ড কোম্পানির ক্ষেত্রেও মাড়াই দিবস ২০০৬-০৭ অর্থবছরে ১৫২ থেকে ২০১৮-১৯ এ ৮২ দিনে নেমে এসেছে।(বিএসএফআইসি, ২০১৮-১৯, বিএসএফআইসি, ২০০৬-০৭)

মাড়াইয়ের জন্য পর্যাপ্ত আখ না পাওয়ার কারণঃ

  • খরচের তুলনায় আখের দাম পাওয়া যায়না, চিনি কলে সময় মতো বিক্রি করা যায় না, বিক্রি করলেও সময় মতো অর্থ পাওয়া যায় না। ফলে কৃষকরা আখের বদলে ধান বা সবজি চাষ করছেন আর যারা আখ চাষ করছেন তারা চিনি কলের বদলে গুড় উৎপাদকের কাছে বিক্রয় করছেন।
  • আখের চাষাবাদ ব্যবস্থার বিভিন্ন সংকটের কারণে বাংলাদেশে একরপ্রতি আখের ফলন গড়ে ১৮-১৯ টন, যা পৃথিবীর অন্যান্য আখ উৎপাদনকারী দেশের তুলনায় খুবই কম। ভারতের মহারাষ্ট্রে একর প্রতি আখ উৎপাদন ৩২ টন, উত্তর প্রদেশে ২৪ টন এবং সারা ভারতের গড় উৎপাদন ২৮ টন। ইক্ষু গবেষণা ইন্সটিটিউটের বক্তব্য অনুযায়ী উঁচু মানের আখের ফলন করা সম্ভব কিন্তু মাঠ পর্যায়ে এর প্রতিফলন না থাকার মূল কারণ আখ চাষের প্রক্রিয়া, সারের ব্যবহার সুষ্ঠুভাবে হয় না, এবং এগুলো তদারকির ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের অবহেলা। (মোস্তফা ও সুলতানা, ২০১৬) অন্যদিকে ভালো মানের আখ উৎপাদনের জন্য যথেষ্ট প্রণোদনা নেই। অর্থাৎ সব গ্রেডের আখের দাম একই রকম। এতে করে মান বাড়ানো নিয়ে কৃষকদের মধ্যে যথেষ্ট উৎসাহ দেখা যায় না।

চিনি আহরণ হার কম

আমরা আরও দেখেছি যে, মাড়াই করার জন্য যে আখ পাওয়া যায় তা থেকে চিনি আহরণের হার তুলনামূলকভাবে অনেক কম- ৬% থেকে ৭%, যেখানে ভারতে বা ব্রাজিলে এই হার ১২% থেকে ১৪%- ফলে টনপ্রতি আখ থেকে চিনি উৎপাদন কম হয়। ফলে ১০০ কেজি আখ থেকে ভারত বা ব্রাজিল যেখানে ১২-১৪ কেজি আখ উৎপাদন করতে পারে সেখানে বাংলাদেশ করে তার প্রায় অর্ধেক। (মোস্তফা ও সুলতানা, ২০১৬) ২০১৮-১৯ বছরে চিনি আহরণ হার সর্বনিম্ন ছিল রংপুর চিনিকলে (৪%) এবং সর্বোচ্চ ছিল নর্থ বেঙ্গল চিনিকলে (৬.৯২%)। (বিএসএফআইসি, ২০১৮-১৯) চিনি উৎপাদনের মোট খরচের প্রায় ৪০ শতাংশ খরচ হয় কাঁচামাল বাবদ। চিনি আহরণের অতি নিম্নহারের কারণে বাংলাদেশে চিনিকলগুলোর কাঁচামাল বাবদ খরচ ভারতীয় চিনিকলগুলোর তুলনায় দ্বিগুণ, যা শেষ পর্যন্ত প্রতি কেজি চিনি উৎপাদনে বাড়তি খরচ হিসেবে যোগ হচ্ছে। নষ্ট ও পুরাতন যন্ত্র ব্যবহারের কারণে শুধু যে চিনি কম আহরিত হচ্ছে তাই নয়, সেই সাথে প্রতি টন আখ মাড়াইয়ে বিদ্যুতের ব্যবহার, রক্ষণাবেক্ষণ খরচ, আখ মাড়াইকালে সময়ের অপচয় ইত্যাদিও অনেক বেশি হচ্ছে যার ফলে চিনির উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে।

আখ থেকে চিনি আহরণের হার কম হবার কারণ:

  • আখে চিনির হার কম হওয়ার কারণ হলো- অঞ্চলভেদে মাটির বৈশিষ্ট্য, জমির উচ্চতা, আবহাওয়া ইত্যাদি বিবেচনায় রেখে উপযুক্ত জাতের আখ চাষ যথাযথ ভাবে না হওয়া। আবার আখে চিনি থাকলেও সময় মতো পরিবহন করতে না পারা, এবং দূর থেকে আখ আনার কারণে বা কারখানায় নেয়ার পর সময় মতো মাড়াই না হওয়ার কারণে আখ থেকে সর্বোচ্চ পরিমাণ চিনি আহরণ করা যায় না।
  • অন্যদিকে আখে চিনি থাকলেও কারখানায় প্রসেসিং এর সময় আখ থেকে চিনি কম আহরণ হওয়ার কারণ হলো- আখ মাড়াই করে রস বের করার যন্ত্র (রোলার) ঠিকঠাক কাজ না করা, মেয়াদ উত্তীর্ণ, নষ্ট ও পুরাতন যন্ত্রপাতির (টার্বো-অল্টারনেটর, মিল টারবাইন, কেইন প্রিপারেশন ডিভাইস, মিলিং প্লান্ট, সেন্ট্রিফিউগাল মেশিন ও ফিল্টার স্টেশন) ব্যবহার, কোনো যন্ত্র হঠাৎ করে নষ্ট হয়ে গেলে পুরো প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আহৃত রসটুকু নষ্ট হওয়া, রস প্রক্রিয়াজাত করার সময় রসের তাপমাত্রা ও অম্লত্ব নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে কম বা বেশি হওয়া ইত্যাদি। চিনিকল কর্তৃপক্ষের বক্তব্য হচ্ছে, তারা কৃষকদের কাছ থেকে যে আখ পান তার গড় চিনি ধারণক্ষমতা ৮ থেকে ৯ শতাংশ। ফলে ২.৩৫ থেকে ২.৪০ শতাংশ কারখানা লস বাদ দিলে কার্যকর চিনি আহরণের হার ৬ থেকে ৭ শতাংশের বেশি হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। অন্যদিকে ইক্ষু গবেষণা সংস্থার বক্তব্য হলো, আখে চিনির পরিমাণ ১২ শতাংশের কম থাকে না। কারখানাগুলোতে চিনি লস বেশি হওয়ার কারণেই চিনি আহরণের হার কম হয় এবং কারখানাগুলো এই লস অনুমোদিত মাত্রার মধ্যে দেখানোর জন্য ব্যাক ক্যালকুলেশন করে আখের চিনির হার কম করে দেখায়!

(২) আর্থিক-সংকট ব্যবস্থাপনাজনিত কারণ

আখচাষ ও উৎপাদন প্রক্রিয়াজনিত কারণে পর্যায়ক্রমে যে অর্থ সংকট তৈরি হয়েছে তা মোকাবেলা করতে গিয়ে সরকার একটি লেজে গোবরে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সংকট মোকাবেলা করতে গিয়ে আধুনিকায়নে বিনিয়োগ না করে, কৃষকদের পর্যাপ্ত প্রণোদনা না দিয়ে, প্রয়োজন অনুসারে ভর্তুকি না দিয়ে সরকার চিনি ও খাদ্যশিল্প কর্পোরেশনকে ঋণ নিতে বাধ্য  করেছে। কর্পোরেশন এই ঋণের একটি বড় অংশ চুক্তিভিত্তিতে কৃষকদের দিয়েছে আখচাষে অনুপ্রাণিত করতে। পরবর্তীতে কৃষকদের কাছ থেকে আখ ক্রয়ের সময় আখের বিনিময়ে ঋণের অর্থ পরিশোধ করিয়ে নিয়েছে। কিন্তু কর্পোরেশন এই ঋণ বাবদ প্রাপ্ত অর্থ সময় মতো ব্যাংকে ফেরত দেয়নি। এমনকি ঋণের পরিমাণের বেশি আখ যারা সরবরাহ করেছে তাদের অনেকের টাকা পরিশোধ করতে দেরি হয়েছে। প্রতিবছর চক্রবৃদ্ধিহারে এই সুদাসল বাড়তে বাড়তে চিনির উৎপাদন খরচ দিনে দিনে বেড়ে গেছে।

ঋণের সুদ পরিশোধের খরচ ২০০৬-০৭ অর্থ বছরে যেখানে ছিল মোট উৎপাদন খরচের ৬.৫%, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা বেড়ে ৩৭% এ দাঁড়িয়েছে। সব মিলের মধ্যে সেতাবগঞ্জ ও পঞ্চগড় চিনিকলে ঋণের সুদ বাবদ খরচ উৎপাদন খরচের সর্বোচ্চ (৪৪.৭%) এবং কেরু এন্ড কোম্পানিতে সর্বনিম্ন (২১.৮%)। (বিএসএফআইসি, ২০১৮-১৯, বিএসএফআইসি, ২০০৬-০৭)

(৩) অন্যান্য অব্যবস্থাপনাজনিত কারণ

চিনিকলগুলোতে আখ থেকে চিনি উৎপাদন করতে গিয়ে উৎপন্ন বিভিন্ন উপজাত যেমন: মোলাসেস বা ঝোলাগুড়, ব্যাগাসে, প্রেসমাড ইত্যাদি যথাযথ ভাবে কাজে না লাগানো এবং মিলের খুচরা যন্ত্রাংশ ক্রয় ও বিভিন্ন মেরামতকাজে দুর্নীতি, উপজাত বিক্রির বিষয়ে দুর্নীতি, বিভিন্ন টেন্ডার ও কন্ট্রাক্ট প্রদানের বেলায় কমিশন নিয়ে কাজ প্রদান, আখের ওজন, সার/বীজ/কিটনাশকের ওজন নিয়ে কারচুপি, পুর্জি প্রদান ও মূল্য পরিশোধে অনিয়ম ইত্যাদি কারণেও চিনিকলগুলো লোকসানে থাকে।

চিনিকলগুলোর লোকসানের আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো- আমদানীকৃত চিনির চেয়ে স্বাস্থ্যসম্মত ও ভালো চিনি হিসেবে দেশীয় চিনিকলগুলো থেকে উৎপাদিত চিনির বাড়তি চাহিদা থাকা সত্ত্বেও বেসরকারি কোম্পানির সাথে প্রতিযোগিতামূলক ভাবে চিনি সরবরাহ, বিতরণ ও বিপণন ব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় পরিবর্তন না আনার কারণে ডিলার থেকে পাইকারি বিক্রেতা এবং পাইকারি থেকে খুচরা বিক্রেতার কাছে চিনি পর্যাপ্ত পরিমাণে পৌঁছায় না। ফলে একদিকে আগ্রহী ক্রেতা বাজারে দেশি চিনি খুঁজে পায় না, অন্যদিকে চিনিকলগুলোর গুদামে অবিক্রীত চিনি নষ্ট হতে থাকে। 

মিল-বন্ধ পরবর্তী সম্ভাব্য সংকট

বন্ধ চিনিকল থেকে আখ চালু চিনিকলে নিয়ে গেলে চালু মিলগুলো আগের চেয়ে বেশি চিনি উৎপাদন করতে পারবে এরকম যুক্তি দেখিয়ে চিনিকল কর্তৃপক্ষ ছয়টি চিনিকল বন্ধের যৌক্তিকতা দেখাচ্ছে। কৃষকদের কাছে এটি প্রহসন। আমরা অনুসন্ধান করতে গিয়েছিলাম প্রকৃতপক্ষে কি ঘটছে দেখতে। জানা গেল আখ চালু মিলগুলোতে পরিবহন করে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশনা ইতোমধ্যে দিয়ে দিয়েছে বিএসএফআইসি। 

চিত্র ১: চালু থাকা চিনিকলগুলোতে মাড়াই বন্ধ থাকা মিল অঞ্চল থেকে আখ স্থানান্তের নির্দেশনা

নতুন ভাবে আখ সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা আলাদাভাবে দেখলে মনে হতে পারে, “আখ তো কাজে লাগছেই, তাহলে সমস্যা কোথায়?”  এর পেছনে কি সমস্যা রয়েছে তা বুঝতে হলে আরো একটু খতিয়ে দেখা দরকার।

ভৌগলিক দূরত্বের ভিত্তিতে মিল বন্ধ করলে কি আশংকা রয়েছে সেটা প্রথমে বোঝা জরুরি। 

প্রথমেই ম্যাপে দেখে নেই গোল লাল দাগ দিয়ে চিহ্নিত বন্ধ হয়ে যাওয়া চিনিকলগুলোর ভৌগলিক অবস্থান।

চিত্র ২- মানচিত্রে লাল চিহ্নিত করা মিল গুলো বন্ধ করা হয়েছে, মানচিত্র: শাফকাত আকন্দ

বেকারত্ব ও অনিশ্চয়তা

বন্ধ করে দেয়া ছয়টি মিলে স্থায়ী কর্মচারী ও শ্রমিক সংখ্যা ১৬৯২ জন (পঞ্চগড়ে ২৩৩, সেতাবগঞ্জে ৩৫৭  শ্যাম্পুরে ২৬৩ , রংপুরে ১৯৪, পাবনায় ৩৮০, কুষ্টিয়ায় ২৬৫)। (বিএসএফআইসি,২০২০) মৌসুমি কর্মচারী ও শ্রমিকের সংখ্যা ৯৬৫ (পঞ্চগড়ে ৪৭, সেতাবগঞ্জে ২৫৬, শ্যামপুরে ২২৬, রংপুরে ৬৪, পাবনায় ২১৯, কুষ্টিয়ায় ১৫৩) (বিএসএফআইসি, ২০২০), অস্থায়ী সাময়িক কর্মচারী ও শ্রমিক সংখ্যা ৫৫১ (পঞ্চগড়ে ১৯৪, সেতাবগঞ্জে ১৫৩, রংপুরে ৬, পাবনায় ৭০, কুষ্টিয়ায় ১২৮) (বিএসএফআইসি, ২০১৯)।

যদিও কর্তৃপক্ষ বলছে শ্রমিক কর্মচারীদের বদলি করে চালু মিলগুলিতে তাদের নতুন করে নিয়োগ দেওয়া হবে কিন্তু তবু এই স্থায়ী, অস্থায়ী ও মৌসুমি শ্রমিক কর্মচারীদের কর্মসংস্থান নিয়ে ব্যাপক অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে কেননা চালু থাকা মিলগুলোর শ্রমিক কর্মচারী ধারণ করার সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। আমাদের অনুসন্ধানে অধিকাংশ শ্রমিক কর্মচারী মনে করছেন এধরনের পুনর্বিন্যাস সম্ভব নয়। মিলে কাজের অভিজ্ঞতা থেকে তাঁরা মনে করেন কিছু পদ পুনর্বিন্যাস সম্ভব হলেও সবাইকে স্থানান্তরিত করা যাবে না। বিশেষ করে নারী শ্রমিক ও কর্মচারীরা এমন পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি অনিশ্চয়তায় রয়েছেন। তাছাড়া, অন্য অঞ্চলে গিয়ে কাজ করতে গিয়ে তাঁরা হেনস্থার শিকার হতে পারেন। অন্য চালু মিলগুলোতেও ৫-৬ মাস ধরে বেতন ভাতা পাচ্ছেন না শ্রমিক কর্মচারীরা। মিল যখন লোকসান দিয়ে যাচ্ছে এবং সরকার ভর্তুকি দিতে নারাজ, তখন এমন অবস্থায় নতুন সহকর্মী যোগদান করলে ওই অঞ্চলের কর্মীরা তাদের প্রতি সহযোগী না হয়ে উলটো শত্রুভাবাপন্ন হতে পারেন। এছাড়া যেখানে কিছু উদ্যোগ নিলেই মিলের লোকসান কমিয়ে আনা যায়, সেখানে এই পরিবর্তনের কারণে চালু মিলগুলো লাভের মুখ দেখবে এই নিয়ে কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনার দক্ষতার প্রতি তারা আস্থা হারিয়েছেন। সবমিলে ৩ হাজারের বেশি শ্রমিক কর্মচারী কর্মসংস্থান হারিয়ে, অথবা অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে অর্থনৈতিকভাবে, মানসিকভাবে ও সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। 

চাষিদের ক্ষতির আশংকা

সরকার আখের মূল্য নির্ধারন করে দেয়ার কারণে আখচাষিরা আখ চাষের আগে নিশ্চিতভাবে জানতেন যে তাদের আখের ক্রেতা রয়েছে। অবিক্রীত থাকার, দাম না পাবার ঝুঁকি কম ছিলো। অন্যদিকে বাজারে সবজি ও ধানের দাম ওঠানামা করায় আখচাষিরা অন্য কিছুর তুলনায় আখচাষে কিছুটা নিশ্চয়তা পেতেন। লাভ কম হলেও বিক্রির নিশ্চয়তা তাদেরকে আখচাষে উদ্বুদ্ধ করতো। এবছর থেকে কৃষকদের ঋণ দেয়া, সার, কীটনাশক বিতরণ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ইতোমধ্যে আখচাষিরা আখের বদলে অন্য কিছু চাষের দিকে যাচ্ছেন। এতে পরের বছর অন্য শস্যে সরবরাহ বেশি হওয়ায় ন্যায্য দাম পাবার সম্ভাবনাও কমে যাবে। চাষিদের আয়ে অনিশ্চয়তা বাড়বে। যদিও চিনিকল কর্তৃপক্ষ দাবি করছে এক অঞ্চলের কৃষকদের উৎপাদিত আখ নিয়ে তারা অন্য মিলে মাড়াই করবেন, তবু আশংকা রয়েছে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অনিশ্চয়তার মুখে আখচাষিরা আখ উৎপাদন থেকে সরে আসবেন। সেতাবগঞ্জে কৃষকদের সাথে আলাপ করতে গিয়ে জানা গেছে তারা ইতোমধ্যে অনেকেই আখ চাষ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

চিনি আহরণ হার কমে যাওয়ার আশংকা

কর্পোরেশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বন্ধ হওয়া চিনিকলে চিনি উৎপাদন বন্ধ হলেও ওই এলাকায় উৎপাদিত আখ নিকটস্থ চালু মিলগুলোতে সরবরাহ করে চিনি উৎপাদন বাড়াবে। যেমন, ঠাকুরগাঁও চিনিকল বন্ধ হয়ে যাওয়া পঞ্চগড় ও সেতাবগঞ্জ চিনিকল সংলগ্ন এলাকা থেকে আখ এনে মাড়াই করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জয়পুরহাট চিনিকল আখ আনবে শ্যামপুর ও রংপুর থেকে, নর্থ বেঙ্গল চিনিকল আনবে পাবনা থেকে, মোবারকগঞ্জ, কেরু, ও ফরিদপুর চিনিকল আনবে কুষ্টিয়া থেকে। কোনো কোনো চিনিকল থেকে আখ উৎপাদন এলাকার দূরত্ব এত বেশি যে যেসব পুরনো ও কম শক্তি সম্পন্ন ট্রাক ব্যবহার করে এগুলো এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে নেয়া হয় সেগুলোর সর্বনিম্নে ২-৩ ঘণ্টা থেকে সর্বোচ্চ ৭-৮ ঘণ্টা পর্যন্ত লেগে যেতে পারে আখ পরিবহন করে আনতে। আখ মাঠ থেকে সংগ্রহের পর মিলে আনতে আনতে এমনিতেই সুক্রোজের পরিমাণ কমে যায়, এবং চিনি আহরণ ক্ষমতা কমে যায়, এর সাথে দূরত্ব, সঠিক তদারকির অভাব, সমন্বয়হীনতা, এবং জ্বালানি খরচ যোগ হলে উৎপাদন খরচ আরো বেড়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। 

এবারে ম্যাপে দেখি, একেবারে উত্তরদিকে বন্ধ হয়ে যাওয়া পঞ্চগড় চিনিকল (PSM) ও সেতাবগঞ্জ চিনিকল (SSM) এলাকা থেকে আখ পরিবহন করে নিয়ে আসা হবে ঠাকুরগাঁও চিনিকলে (TSM) । ম্যাপে (চিত্র ৩) এক ঘণ্টা ৫ মিনিট দেখা যাচ্ছে আসলে মিল থেকে দূরত্ব । অর্থাৎ মিলের চেয়ে আরো উত্তরের এলাকার  দূরত্ব এখানে আরো বেশি হবে। যদি ধরে নেই গড় দূরত্ব এক ঘণ্টাও হয় তবুও রাস্তার অবস্থা ও পুরানো ট্রাক (চিত্র ৪) ব্যবহার করলে এই সময় ২-৩ ঘণ্টা পর্যন্ত লাগতে পারে বলে শ্রমিক কর্মচারীরা জানিয়েছেন।

চিত্র ৩- পঞ্চগড় থেকে ঠাকুরগাঁও চিনিকলের দূরত্ব
চিত্র ৪ – ঠাকুরগাঁ চিনিকলে ট্রাকের অবস্থা

লোকসান বেড়ে যাওয়ার আশংকা

পুরানো চিনিকলগুলো বন্ধের কারণে কর্পোরেশনের মোট চিনি উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ডিসেম্বরের ২ তারিখে নেয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বন্ধ হয়ে যাওয়া মিলগুলোতে পূর্বে সরবরাহকৃত আখ চালু মিলে সরবরাহের সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও তাদের যেই লক্ষমাত্রা ধরা হয়েছে তা পূরণ হওয়া নিয়ে আশঙ্কা রয়েছে। যেসব মিল বন্ধ হয়ে গেছে সেগুলো চালু অবস্থায় যতো আখ ব্যবহার করতো এখন ততো আখ নতুন করে চালু মিলগুলোতে যুক্ত না হবার আশঙ্কা রয়েছে যদি কৃষকেরা আখ চাষ কমিয়ে দেন। এতে লোকসান বেড়ে যেতে পারে। চালু মিলগুলোতে সক্ষমতার ব্যবহার আগের চেয়ে বেশি ধরা হলেও সমন্বয়ের অভাবে মাড়াই মৌসুমে পরিকল্পনামাফিক মাড়াই দিবস বাড়ানো নাও যেতে পারে। যদি একই সময়ে বেশি আখ মাড়াইযোগ্য হয়ে যায় এবং অন্যদিকে নির্দিষ্ট সময়ে আখের সরবরাহ না থাকে, তখন মাড়াইযোগ্য  আখ দেরিতে মাড়াইয়ের কারণে অপচয় হতে পারে। আহরণহার কমে গিয়ে লোকসান হতে পারে। আহরণহার কমে গিয়ে উল্টো লোকসান হতে পারে। এমনিতেই নিজ এলাকায় তারা পুর্জি পায় না, পুর্জি পাওয়া নিয়ে রয়েছে নানান অনিয়ম। একাধিক অঞ্চলের কৃষক পুর্জির আওতায় এলে এখানে সমন্বয়হীনতা আরো বেড়ে যাবে। কৃষকেরা আখ নিয়ে তা বিক্রি করতে পারবেন না, এই আশংকায় আখচাষই করবেন না।

চিত্র-৫ রংপুরের একজন কৃষক আগুন দিয়েছেন আখ ক্ষেতে।

রংপুরে একজন কৃষক (চিত্র ৫) মিল বন্ধের প্রতিবাদে তিন বিঘা জমির আখ পুড়িয়ে ফেলেছেন। তার বক্তব্য হল “রংপুর চিনিকলের চেয়ে ছোট জয়পুরহাট চিনিকলে আখ দিতে গেলে জমিতেই আখ শুকিয়ে যাবে। ছয় মাসেও তাঁরা আখ মাড়াই করতে পারবেন না। ফলে ধানের আবাদও করা সম্ভব হবে না। তাই আখ পুড়িয়ে দিলে আগামী বোরো মৌসুমে ধানের আবাদ করা যাবে।” সেই চিন্তা থেকে আখখেতে তিনি আগুন দিয়েছেন। উল্লেখ্য রংপুর (RSM) ও শ্যামপুর (ShSM) চিনিকল থেকে আখ নিয়ে যাওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে বিএসএফআইসি। লোড, আনলোড ছাড়াও রাস্তার অবস্থা, ট্রাফিক জ্যাম, এবং ট্রাকের গতি (চিত্র ৬) বিবেচনায় রংপুর চিনিকল থেকে আখ জয়পুরহাটে (JSM) নিয়ে যেতে কৃষকদের মতে গড় সময় লাগবে ৬-৭ ঘণ্টা। (চিত্র ৭)

চিত্র ৬- রংপুর থেকে জয়পুরহাট চিনিকলের দূরত্ব
চিত্র ৭- পুরানো ট্রাকের অবস্থা

দূর থেকে আনা নেয়ার ঝক্কি, পরিপক্ব হবার সময়ের সাথে মাড়াইয়ের চাহিদার সময়ের ব্যবধান বেশি হয়ে গেলে কৃষকেরা আখচাষ করলে সেগুলো অবিক্রীত পড়ে থাকতে পারে। এর মধ্যে একজন কৃষক সময় টিভিতে বক্তব্য দিয়েছেন যে তিনি জয়পুরহাটে চিনি নিয়ে ফেরত আসতে ৪ দিন লেগেছে। অপেক্ষা করতে করতে আখ শুকিয়ে গেছে। এধরনের অভিজ্ঞতার পর আখ চাষিরা আখ চাষ কমিয়ে দেবেন বলেই দ্রারনা করা যায়। তাদের বিক্ষোভ অন্তত তাই জানান দিচ্ছে।

আবার লোকবল পুনর্বিন্যাস হলেও তাদেরকে যদি যথাযথভাবে কাজে লাগানো না যায় কিন্তু অন্যদিকে বেতন দিতে হয়, তাহলে সেদিক থেকেও লোকসানের সম্ভাবনা বেড়ে যেতে পারে।

স্থানীয় অর্থনীতির ক্ষতি

চিনিকলগুলোকে ঘিরে গড়ে উঠেছে একটি স্থানীয় অর্থনৈতিক নির্ভরতার সম্পর্ক। আখের বর্জ্য থেকে তৈরি প্রেসমাড আশেপাশের কৃষি কাজে সার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। মিল বন্ধ হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে সারের এই সরবরাহ থাকবে না। ব্যাগাস ও মোলাস কেনা বেচা করেও একটি ব্যবসায়ী শ্রেণি তৈরি হয়েছে। তারা অর্থনৈতিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। মিল এলাকা ঘিরে গড়ে উঠেছে আবাসিক এলাকা, বিদ্যালয়, কলেজ, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, বাজার, পরিবহন ব্যবস্থা, ব্যাংক ছাড়াও আরো অন্যান্য সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। মিলের শ্রমিক কর্মচারীদের উপর নির্ভর করে এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা। কর্মহীন হয়ে গেলে এই স্থানীয় অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কর্মহীন হয়ে সামাজিক, রাজনৈতিক, ও সাংস্কৃতিক জীবনও বিপর্যস্ত হবে। আর্থিক ক্ষতির বাইরে এইসকল ক্ষতির মূল্য দিতে হবে এমনসব মানুষকে যাদের উপর চিনিকলের ব্যবস্থাপনার দায় বর্তায়নি। দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার মাশুল দিতে গিয়ে একেকটি অঞ্চলের ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা জনপদ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

চিত্র ৮- জৈবসার কারখানা না থাকলেও মিলের বর্জ্য কিনে ব্যবহার করে স্থানীয় কৃষকেরা।
চিত্র ৯- আবাসিক এলাকা
চিত্র ১০- আবাসিক এলাকায় প্রবেশের মুখে গেস্ট হাউজ, সেতাবগঞ্জ চিনিকল
চিত্র ১১- সেতাবগঞ্জ স্কুল

এই সাম্রগ্রিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে করণীয় হিসেবে আমাদের দাবী:

* মিল চালু করতে হবে।

* অনতিবিলম্বে শ্রমিক, কর্মচারীদের বকেয়া বেতন পরিশোধ করতে হবে।

* প্রয়োজনে ভর্তুকি দিতে হবে।

* মিল চালু করার পর আমরা এর লোকসানের যেসব কারণ সনাক্ত করেছি সেগুলো দূর করার উপর জোর দিতে হবে।

রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিশিল্প ও আখ চাষের সমস্যা নতুন নয় এবং এগুলোর সমাধানের উপায়ও সংশ্লিষ্টদের বহুদিন ধরেই জানা। কিন্তু জানা থাকার পরেও এইসব সুনির্দিষ্ট সমস্যার সমাধানের সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ না নিয়ে উল্টো তৎপরতা চলে এই সংকট ঘনীভূত করার। মিল বন্ধ না করে মিলকে কীভাবে জনস্বার্থে ব্যবহার করা যায় তার জন্য আরও কিছু সুপারিশ নিচে দেয়া হল- 

আখের প্রাপ্যতা বৃদ্ধি:

  • আখের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার জন্য আখচাষিকে আখ বিক্রির সাথে সাথে অর্থ পরিশোধ করতে হবে। এই লক্ষ্যে চিনিকলগুলোর জন্য বাজেটে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করতে হবে। পুর্জি বিতরণের সকল অনিয়ম বন্ধ করতে হবে।
  • একর প্রতি গড় ফলন বর্তমান ১৮-২০ টন থেকে ৩০ টনে উন্নীত করার জন্য বিদ্যমান উচ্চ ফলনশীল ও অধিক চিনিযুক্ত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন জাতের চাষাবাদ বাড়াতে হবে।
  • চাষিদেরকে সময়মতো শোধিত বীজ, সারসহ উৎপাদন উপকরণ সরবরাহ করতে হবে। এক্ষেত্রে সকল অনিয়ম দূর করতে হবে।
  • আখের আধুনিক জাত দীর্ঘস্থায়ী হয় না, নানা কারণেই দ্রুত রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে ফলন কমে যায়। ফলে বিএসআরআইকে ক্রমাগত নতুন নতুন জাত অবমুক্ত করতে হবে, যেন নিয়মিত প্রতিকূল পরিবেশে ভালো ফলন নিশ্চিত করা যায়। এই লক্ষ্যে বিএসআরআইর প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যা, যেমন-ফুল ফোটাতে সক্ষম প্যারেন্ট জাতের সংকট, ব্রিডিংয়ের ক্ষেত্রে আলো ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের সমস্যা ইত্যাদির সমাধান করতে হবে।

চিনি আহরণ হার বাড়াতে করণীয়

  • আখ কাটার সময় প্রথমে মুড়ি আখ, তারপর যথাক্রমে আগাম, মধ্যম ও নাবি আখ কাটতে হবে এবং আখ কাটার পর ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে মাড়াই সম্পন্ন করতে হবে। চিনিকল কর্তৃক আরও বেশি করে আখ সময়মতো পরিবহনের জন্য পর্যাপ্ত ট্রাক-ট্রেইলার-ট্রাক্টরের ব্যবস্থা করতে হবে।
  • চিনিকলের যন্ত্রপাতি আধুনিকায়ন করতে হবে।
  • নিয়মিত তদারকির মাধ্যমে কারখানার প্রসেস লস ও অপচয় বন্ধ করতে হবে।
  • উন্নতমানের আখ উৎপাদনের জন্য কৃষকদের প্রণোদনা দিতে হবে। প্রয়োজনে মিলের লভ্যাংশ দেয়ার উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে।

আর্থিক সংকট নিরসনে করণীয়

  • ঋণ মওকুফ করতে হবে।
  • আখচাষ, চিনি উৎপাদন, ও ব্যবস্থাপনা সংকট নিরসনে দেয়া সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে।

ব্যবস্থাপনা সংকট নিরসনে করণীয়

  • প্রতিটি কারখানায় জৈব সার উৎপাদন ইউনিট স্থাপন করতে হবে।
  • কো-জেনারেশনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে বাড়তি বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করতে হবে।
  • মাড়াই মৌসুম ছাড়াও সারা বছর যেন কারখানার জমি, অবকাঠামো, শ্রমশক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার হয় সেজন্য কারখানার জমিতে কৃষিভিত্তিক বিভিন্ন শিল্প স্থাপন করা যেতে পারে; যেমন-আম, আনারস, টমেটো, আলু ইত্যাদি প্রক্রিয়াকরণ কারখানা স্থাপন, ভোজ্য তেল শোধনাগার স্থাপন, মসলা উৎপাদন কারখানা ইত্যাদি।
  • যেহেতু বিট বছরে দুইবার চাষাবাদ করা যায়, সেহেতু আখের সাথি ফসল হিসেবে বিট চাষাবাদ ও বিট থেকে রস আহরণের জন্য ডিফিউশন ইউনিট স্থাপন করা যেতে পারে। ফলে আখ মাড়াই মৌসুম শেষেও চিনিকল অলস থাকবে না এবং চিনির উৎপাদন খরচ কমে আসবে।
  • চিনিকলের নিজস্ব জমিতে রিফাইনারি স্থাপন করে সারা বছর রিফাইন সুগার উৎপাদন করলে একদিকে চিনিকলগুলোর লোকসান কমবে, অন্যদিকে চিনির বাজারের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ বাড়বে।
  • চিনির বিতরণ বিস্তৃত করার জন্য ডিলারদের পর্যাপ্ত প্রণোদনা দিতে হবে। ডিলাররা সরকারি চিনি বিক্রির ক্ষেত্রে যেসব সমস্যার কারণে বেসরকারি চিনি বিক্রিতে উৎসাহিত বোধ করে সেসব সমস্যার সমাধান করতে হবে।
  • চিনির সরবরাহ, বিতরণ ও বিপণন ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে।
  • যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল, শ্রমিক নিয়োগ, পুর্জি প্রদানে অনিয়ম দুর্নীতি অবহেলা প্রতিরোধ করতে হবে।

চিনিকল সংকট সম্পর্কে আরো জানতে পড়ুন

সুলতানা ও মোস্তফা, ২০১৬। মোশাহিদা সুলতানা ও কল্লোল মোস্তফা: ‘আখচাষ ও রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিশিল্প: সংকট কেনো?’, সর্বজনকথা, ফেব্রুয়ারি সংখ্যা।  

তথ্যসূত্রঃ

বিএসএফআইসি (২০২০), ডিসেম্বর ২: ‘চিনিকলে আখ মাড়াই কার্যক্রম সম্পর্কিত নির্দেশনা’।

বিএসএফআইসি (২০১৯), ‘বার্ষিক প্রতিবেদন ২০১৮-১৯’

বিএসএফআইসি (২০০৭), ‘বার্ষিক প্রতিবেদন ২০০৬-০৭’

প্রথম আলো,(২০২০), ‘বন্ধ হচ্ছে সরকারি ছয় চিনিকল’, ডিসেম্বর ৩, ২০২০  

Social Share
  •  
  •  
  • 504
  •  
  •  
  •  
  •  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *