পুন:প্রকাশ
মোশাহিদা সুলতানা ও কল্লোল মোস্তফা
যথেষ্ট সম্ভাবনাময় হলেও বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় চিনিশিল্প প্রতিষ্ঠান ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট শ্রমিক-কর্মচারী-কর্মকর্তা ও আখচাষিদের জীবন-জীবিকা দীর্ঘদিন ধরেই গভীর সংকটে নিমজ্জিত। উৎপাদিত চিনি অবিক্রীত পড়ে থাকে গুদামে, চিনির উৎপাদন খরচ চিনির বাজারমূল্যের দ্বিগুণেরও বেশি। বেসরকারিভাবে আমদানীকৃত চিনির সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না রাষ্ট্রায়াত্ব চিনিকলগুলো। চিনিকলের শ্রমিকরা নিয়মিত বেতন পান না, দিনে দিনে কমে যাচ্ছে আখ চাষ। চিনিশিল্পের এই সংকটের কার্যকারণ ও তার সমাধানের উপায় অন্বেষণ করতে গিয়ে তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ ও মাঠপর্যায়ে অনুসন্ধানের ওপর ভিত্তি করে এই প্রবন্ধটি প্রথম প্রকাশিত হয় সর্বজনকথা, ফেব্রুয়ারি ২০১৬ সংখ্যায়। সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত এইসব সমস্যার সমাধানের উদ্যোগ না নেয়ার কারণে সাম্প্রতিক কালে রাষ্ট্রায়ত্ত চিনি শিল্প ও আখ চাষের সংকট আরো ঘনীভূত হয়েছে। আর এই সংকটকে কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর মতো রাষ্ট্রায়াত্ব চিনিকলগুলোও বন্ধ করার পায়তারা চলছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সর্বশেষ সংবাদ অনুসারে, সরকার দীর্ঘদিন ধরে অর্থসংকটে ভুগতে থাকা চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশনকে অর্থ দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে যার ফলে চলতি মৌসুমে নিবন্ধিত আখচাষিদের সার, কীটনাশক ও সেচের জন্য ঋণ দেওয়া সম্ভব হয়নি। তাই আশঙ্কা করা হচ্ছে, আসছে মৌসুমে আখ উৎপাদন আরো কমে যেতে পারে যার ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত চিনি শিল্পের লোকসান ও সংকটের পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পাবে। বর্তমান পরিস্থিতির বিবেচনায় রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিশিল্প ও আখ চাষের সংকট ও তার সমাধানের উপায় নিয়ে সর্বজনকথা, ফেব্রুয়ারি ২০১৬ সংখ্যায় প্রকাশিত লেখাটি পুন:প্রকাশ করা হলো।
১. ভূমিকা
দীর্ঘদিন ধরে গভীর সংকটে নিমজ্জিত বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় চিনিশিল্প প্রতিষ্ঠান ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট শ্রমিক-কর্মচারী-কর্মকর্তা ও আখচাষিদের জীবন-জীবিকা। রাষ্ট্রীয় চিনিকলগুলোর উৎপাদিত চিনি অবিক্রীত পড়ে আছে গুদামে। এসব কারখানায় চিনির উৎপাদন খরচ চিনির বাজারমূল্যের দ্বিগুণেরও বেশি। লোকসান দিয়ে বিক্রি করা হলেও বেসরকারিভাবে আমদানীকৃত চিনির সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না এই চিনি। ফলে চিনিকলের শ্রমিকরা নিয়মিত বেতন পান না, প্রায়ই বেতনের বদলে চিনি প্রদান করা হয় তাদের। আখচাষিরা আর চিনিকলগুলোতে আখ সরবরাহ করতে চান না, দিনে দিনে কমে যাচ্ছে আখ চাষ। চিনিকলের কাছে আখ বিক্রি করে পাওনা আদায়ের জন্য মাসের পর মাস ঘুরতে হয় তাদের। এদিকে পর্যাপ্ত আখ না পাওয়ায় চিনিকলের যন্ত্রপাতি ও শ্রমশক্তিবছরের বেশিরভাগ সময় অব্যবহৃত থাকে এবং আখ থেকে চিনি উৎপাদনের খরচ বাড়তে থাকে। চিনি খাতের এই সংকট নিরসনে ২০১৫ সালের শেষের দিকে এসে সরকার কিছু বাজার নিয়ন্ত্রণমূলক নীতি গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে দুই দফায় নতুন করে আমদানির ওপর সংরক্ষণমূলক শুল্ক আরোপ এবং ভ্যাট আরোপ। যুক্তি হচ্ছে, শুল্ক আরোপ করে বেসরকারি আমদানি নিয়ন্ত্রণে রাখা ও পিছিয়ে থাকা রাষ্ট্রীয় খাতকে প্রতিযোগিতায় টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। এই বাজার নিয়ন্ত্রণ নীতি আসলে এই চিনিশিল্পকে রক্ষা করে টেকসই উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে কি না-এই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে আমরা চিনিশিল্পের সংকটের কার্যকারণ ও তার সমাধানের উপায় অন্বেষণ শুরু করি। তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ ও মাঠপর্যায়ে সাক্ষাৎকার গ্রহণের মধ্য দিয়ে এই প্রবন্ধে চিনিশিল্পের সংকট ও সমাধানের বিবিধ উপায় অন্বেষণ করা হয়েছে।
১.১ বাংলাদেশের চিনিশিল্প: ইতিহাস ও গুরুত্ব
প্রাচীনকাল থেকে বাংলাদেশ এবং এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে গুড়, সুক্কার (Sukker) বা খণ্ডেশ্বরী (Khandeswari) তৈরির জন্য আখের চাষ হয়ে আসছে (বাংলাপিডিয়া, ২০১৪)। সপ্তম শতাব্দীতে চিনিশিল্পের প্রযুক্তি শেখার জন্য চীনাদের এদেশে আসার কথা জানা যায়। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মার্কোপোলো এদেশে চিনিশিল্পের অস্তিত্ব লক্ষ করেন। সপ্তম শতাব্দীতে এদেশ থেকে চিনি রপ্তানি হতো বসরা, বন্দর আব্বাস, জেদ্দা ও মাসকটে। এই এলাকা থেকে উপমহাদেশের মাদ্রাজ, সুরাট ও সিন্ধু অঞ্চলে চিনি রপ্তানি হতো। এ অঞ্চল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে যাওয়ার পর এখান থেকে প্রতিবছর চিনি রপ্তানি হতো ১৮২০ টন, যা থেকে ব্রিটিশ ব্যবসায়ীরা কমপক্ষে ৫০ শতাংশ মুনাফা অর্জন করত। ওয়েস্ট ইন্ডিজে উৎপাদিত চিনির স্বার্থ রক্ষার জন্য ব্রিটিশ সরকার বাংলাদেশের চিনির ওপর শুল্ক আরোপ করে। এই নীতি সত্ত্বেও এ অঞ্চলের চিনিশিল্প বিকাশ লাভ করে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে কোটচাদপুর, কেশবপুর, ত্রিমোহনী, ঝিকরগাছা, নারিকেলবাড়ী, চাদগাজী, চিত্রা ও ভৈরব এলাকা চিনিশিল্পের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হতো। এসময় শুধু উত্তরবঙ্গই ৭৭ হাজার ৯৮৪ টন চিনি উৎপাদন করত। বিংশ শতাব্দীর শুরুতেও এই এলাকায় ১৭টি চিনিকল ছিল। কিন্তু এরপর ঔপনিবেশিক নীতির চাপে চিনিকলগুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভারত ভাগ হওয়ার সময় বাংলাদেশ অঞ্চলে ৫টি ব্যক্তিমালিকানাধীন চিনিকল ছিল, যার সম্মিলিত উৎপাদনক্ষমতা ছিল ৩১ হাজার টন (মুহাম্মদ, ১৯৮০)।
বর্তমানে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের অধীনে মোট ১৫টি চিনিকল চালু রয়েছে, যার মধ্যে ৩টি ব্রিটিশ আমলে, ৯টি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আমলে এবং ৩টি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্থাপিত হয়েছে। ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির ২৭ নম্বর আদেশবলে বাংলাদেশ সুগার মিলস করপোরেশন গঠিত হয়। ১ জুলাই ১৯৭৬ বাংলাদেশ সুগার মিলস করপোরেশন ও বাংলাদেশ ফুড অ্যান্ড অ্যালাইড ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনকে একীভূত করে বাংলাদেশ সুগার অ্যান্ড ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন গঠন করা হয় (বিএসএফআইসি, ২০১৪খ)। প্রতিষ্ঠানটির নাম চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন হলেও এখন আর এর অধীনে কোনো খাদ্যশিল্প প্রতিষ্ঠান অবশিষ্ট নেই। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত এর আওতায় থাকা ঘানির তেল, তেল রিফাইনারি, টোব্যাকো কোম্পানি, কোল্ড স্টোরেজ ও মৎস্য প্রক্রিয়াকরণ, ময়দা, বিস্কুট ও কোল্ড ড্রিংকস, বেকারিসহ মোট ৫৭টি খাদ্যশিল্প প্রতিষ্ঠান এবং ৩টি চিনিকল (কালিয়াচাপড়া, দেশবন্ধু ও ন্যাশনাল) বেসরকারি করা হয়েছে (বিএসএফআইসি, ২০১৪গ)।
বাংলাদেশের চিনিকলগুলোতে সরাসরি ১৬ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়। আর আখ চাষের ওপর নির্ভর করে উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পাঁচ লাখ চাষিসহ প্রায় ৫০ লাখ মানুষের জীবিকা। কৃষিভিত্তিক চিনিশিল্পকে কেন্দ্র করে গ্রামীণ এলাকায় রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ, ব্যাংক, হাটবাজার, অন্যান্য ব্যবসা-বাণিজ্যকেন্দ্র ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন অবকাঠামো ও প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। চিনির উপজাত চিটাগুড়, আখের ছোবড়া ইত্যাদি কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করেও বিভিন্ন শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছে, যার মাধ্যমে বহু কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে (বিএসএফআইসি, ২০১৪খ)।
রাষ্ট্রীয় চিনিকলগুলোর একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় এবং দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে চিনির মূল্য নিয়ন্ত্রণ। ২০০২ সালের আগ পর্যন্ত বিএসএফআইসি কর্তৃক এককভাবে চিনি উৎপাদন ও আমদানি করে দেশব্যাপী বিস্তৃত বিপণন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে নির্ধারিত দরে সুষ্ঠু বিপণনের মাধ্যমে ভোক্তাসাধারণের স্বার্থ সংরক্ষণ করে এসেছে সরকার। ২০০২ সালে মুক্তবাজার অর্থনীতিতে চিনি আমদানি অবাধ করা হয় (বিএসএফআইসি, ২০১৪ক)। বেসরকারি পর্যায়ে আমদানিকারকরা সাদা চিনি আমদানি করে বাজারজাত শুরু করে। পরে র-সুগার আমদানি করে পরিশোধিত চিনি উৎপাদনের জন্য সরকারের নিবন্ধিত ৬টি সুগার রিফাইনারি ২০০৪ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে উৎপাদনে আসে। এর মধ্যে চালু আছে ৫টি এবং এই ৫টি বেসরকারি রিফাইনারি প্রতিবছর উৎপাদন করতে পারে প্রায় ৩২ লাখ মেট্রিক টন চিনি (বিএসএফআইসি, ২০১৪ক)।
১.২ বর্তমান সংকটের প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশের চিনিশিল্পের ইতিহাসের মতোই চিনিশিল্পের সংকটের ইতিহাসও বহুদিনের। রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলো শুরু থেকেই নানা অবহেলা, অব্যবস্থাপনা ও লুণ্ঠনের শিকার। চিনিকলের সাথে সম্পর্কিত চাষিদের হয়রানির ইতিহাসও বহু পুরনো। সত্তরের দশকের শেষ বছরে নভেম্বর মাসের ২৫ তারিখে এক তরুণ আখচাষির পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার কার্যকারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ দেখেছিলেন, আখচাষিরা আখের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে না, আখ বিক্রি করতে গিয়ে নানাভাবে হয়রানি ও প্রতারণার শিকার হয়ে আখ উৎপাদনে নিরুৎসাহ হচ্ছে এবং কারখানায় আখ বিক্রির বদলে গুড় উৎপাদনকারীর কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে, রাষ্ট্র আখচাষিকে প্রণোদনার মাধ্যমে আকৃষ্ট করার বদলে গুড় নিয়ন্ত্রণ আইন, পুলিশি নির্যাতন এবং গুলি চালিয়ে পর্যন্ত আখ বিক্রি করতে বাধ্য করার চেষ্টা করছে। চিনিশিল্পের সংকটের কারণ হিসেবে আখচাষিদের এই সমস্যা ছাড়াও তিনি আরো তিনটি কারণকে চিহ্নিত করেছিলেন : পুরনো যন্ত্রপাতি, মিলের অভ্যন্তরে দুর্নীতি ও সুষ্ঠু চিনি নীতির অভাব (মুহাম্মদ, ১৯৮০)। এই সমস্যাগুলোর প্রায় সবই এখন পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে চলে আসছে, কোনো কোনোটি আরো তীব্র হয়েছে। সাম্প্রতিককালে চিনি আমদানি উদারীকরণের ফলে চিনিশিল্পের এই সংকট আরও বেড়েছে।
গত চার বছরে (২০১১-১৪) চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন চিনির দাম কমিয়েছে পাঁচবার। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথমবার যখন দাম কমানো হয়, তখন প্রতি কেজি চিনির দাম ছিল ৬০ টাকা। সেই চিনির দাম নেমে এসেছে ৩৭ টাকায়। কিন্তু যখনই চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন দাম কমায়, তার চেয়েও দু-তিন টাকা কমে বাজারে চিনি বিক্রি করে বেসরকারি চিনি পরিশোধনকারীরা (প্রথম আলো, ২০১৫)। সরকারি চিনিকলগুলোর দর যখন ৪০ টাকা করা হয়, তখন বেসরকারি চিনিকল সিটি গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক বিশ্বজিৎ সাহা এক সাক্ষাৎকারে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের প্রতি কেজির উৎপাদনব্যয় পড়েছে সাড়ে ৪৩ টাকা। কিন্তু আমরা ডিলারদের দিচ্ছি ৪২ টাকায়।’ উৎপাদনব্যয়ের চেয়ে কম দামে কেন চিনি বিক্রি করছেন- জানতে চাইলে তাঁর জবাব, ‘উপায় কী! সুগার করপোরেশন চিনি দিচ্ছে ৪০ টাকায়। আমাদেরও তো চিনি বিক্রি করতে হবে। সে কারণে কম দামে চিনি বিক্রি করতে হচ্ছে।’ বেসরকারি চিনিকলগুলো চিনি বিক্রিতে যতটুকু ‘লোকসান’ দিচ্ছে তা অন্য ভোগ্যপণ্যের মাধ্যমে (যেমন:ভোজ্যতেল, আটা-ময়দা) ক্রেতাদের কাছ থেকে তুলে নিচ্ছে (প্রথম আলো, ২০১৪)।
ওপরে উল্লিখিত সংকট বিবেচনায় শিল্প মন্ত্রণালয় চিনির শুল্ক বাড়াতে দুটি প্রস্তাব দেয়। একটি হচ্ছে অপরিশোধিত চিনির স্পেসিফিক ডিউটি বহাল রেখে সংরক্ষণমূলক শুল্ক ২০ থেকে ৪০ শতাংশে পুনর্নির্ধারণ। অন্যটি হচ্ছে স্পেসিফিক ডিউটি ও সংরক্ষণমূলক শুল্ক অপরিবর্তিত রেখে রিফাইনারিগুলোর এক্সগোডাউন পর্যায়ে বিক্রয়যোগ্য চিনির দামের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ। পরে চিনির আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট আরোপের এই প্রস্তাব সংবলিত এনবিআরের পাঠানো সারসংক্ষেপে অর্থমন্ত্রী অনুমোদন দেন। এনবিআরের পাঠানো সারসংক্ষেপে বলা হয়, পরিশোধিত-অপরিশোধিত চিনির ট্যারিফ মূল্য বৃদ্ধি ও ভ্যাট আরোপের ফলে চিনির দাম কেজি প্রতি যথাক্রমে সাড়ে ৫ ও ৭ টাকা বাড়তে পারে। এরই ধারাবাহিকতায় অপরিশোধিত চিনির টনপ্রতি ট্যারিফ মূল্য ৩২০ থেকে ৩৫০ ডলার এবং পরিশোধিত চিনির ট্যারিফ মূল্য ৪০০ থেকে ৪৩০ ডলার করা হলো (বণিক বার্তা, ২০১৫)।
এছাড়া প্রজ্ঞাপন জারি করে ডিসেম্বরের ২৩ তারিখে পরিশোধিত ও অপরিশোধিত চিনি আমদানিতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ভ্যাট আরোপ ও শুল্ক পুনর্নির্ধারণ করায় কেজি প্রতি চিনির মূল্য প্রায় ১১% বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করা হচ্ছে। অর্থাৎ সংরক্ষণমূলক বাজার নিয়ন্ত্রণ নীতি গ্রহণ করে রাষ্ট্রীয় চিনিকলগুলোকে উৎসাহিত করতে গিয়ে এর ভার পড়ছে ভোক্তার ওপর। কিন্তু ভোক্তার ওপর ভার বাড়িয়ে কি চিনিশিল্পকে সংকট থেকে উদ্ধার করা সম্ভব?
২.চিনির বাজার সংকটের কারণ অনুসন্ধান
বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে মোট ১৫টি চিনিকলের বার্ষিক চিনি উৎপাদনক্ষমতা ২.১ লাখ মেট্রিক টন (বিএসআইএফসি, ২০১৪)। উৎপাদনক্ষমতার এই হিসাবটি করা হয়েছে ২৬ লাখ মেট্রিক টন আখ থেকে ৮ শতাংশ হারে চিনি উৎপাদন ধরে নিয়ে (বিএসএফআইসি, ২০১৪ক), অর্থাৎ এই উৎপাদনক্ষমতার হিসাব শুধু স্থাপিত যন্ত্রপাতির ক্ষমতা বা লোকবলের ওপর নয়, বরং নির্ভর করে আরও অনেক বিষয়ের ওপর; যেমন-পর্যাপ্ত আখ উৎপাদন, আখের গুণগত মান, কত দক্ষতার সাথে আখ মাড়াই করে অধিক চিনি আহরণ করা যায়, যন্ত্রাংশের কার্যকারিতা এবং আখ সংগ্রহ থেকে শুরু করে উৎপাদিত চিনি রক্ষণাবেক্ষণ পর্যন্ত সার্বিক সমন্বয় সাধনের দক্ষতা। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, ১৯৭১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সর্বনিু চিনি উৎপাদন হয় ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে (১৯,৬০৪ মেট্রিক টন) এবং সর্বোচ্চ চিনি উৎপাদন হয় ১৯৯৪-৯৫ অর্থবছরে (২.৭ লাখ মেট্রিক টন) (বিএসএফআইসি, ২০১৪ক)। শুধুমাত্র কোনো নির্দিষ্ট একটি কারণে চিনি উৎপাদনের এই তারতম্য হয় না, বরং অনেকগুলো বিষয় দ্বারা মোট উৎপাদন প্রভাবিত হয়। এই প্রবন্ধে উৎপাদন সম্পর্কিত এই প্রতিটি বিষয়ের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে পরবর্তী অংশে। এই অংশে মূলত কিভাবে উদারীকরণ নীতি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে চিনিশিল্পের বিকাশকে নিরুৎসাহ করেছে এবং সংকট ত্বরান্বিত করতে ভূমিকা রেখেছে, সে বিষয়ে আলোকপাত করা হবে।
২.১ চিনি আমদানি উদারীকরণ
দেশের চাহিদার সাথে স্থানীয় জোগানের পার্থক্য থাকলে আমদানি ছাড়া দেশের চাহিদা পূরণ সম্ভব নয়। চিনির স্থানীয় চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশকে সব সময়ই আমদানির ওপর নির্ভর করতে হয়েছে। তবে এই আমদানি কখন কার দ্বারা কিভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়েছে তা প্রভাবিত করেছে বর্তমান চিনিকলগুলোর সাফল্যের সম্ভাবনাকে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এবং বাংলাদেশ পুষ্টি কাউন্সিলের সুপারিশ অনুযায়ী মাথাপিছু বার্ষিক চিনির চাহিদা ৮.৫ কেজি। সেই হিসাবে বর্তমানে দেশে চিনির বার্ষিক চাহিদা প্রায় ১৪ লাখ মেট্রিক টন বলে মনে করা হয় (বিএসএফআইসি, ২০১৪ক)। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে চিনি উৎপাদন হয়েছে ৭৭ হাজার ৪৫০ মেট্রিক টন। এবং ওই একই বছর চিনিকলগুলোতে চিনির প্রারম্ভিক মোট মজুদ ছিল ১.৮ লাখ মেট্রিক টন (বিএসএফআইসি, ২০১৫খ)। অর্থাৎ স্থানীয় ভোক্তাদের চাহিদা মেটাতে মিলগুলো থেকে উৎপাদিত চিনির পরিমাণ ছিল প্রায় ২.৬ লাখ মেট্রিক টন। সাধারণভাবে হিসাব করলে দেশের চাহিদা মেটাতে আমদানি করার প্রয়োজন ছিল প্রায় ১১.৪ লাখ মেট্রিক টন। অথচ ২০১৪-১৫ অর্থবছরে র-সুগার আমদানির পরিমাণ ছিল ১৯.৫ লাখ মেট্রিক টন (বিএসএফআইসি, ২০১৫ক)। অর্থাৎ ১৫টি মিল দেশীয় চাহিদা পূরণ করার পর যা অতিরিক্ত প্রয়োজন তার ৭০ শতাংশ (৮.১ লাখ মেট্রিক টন) বেশি র-সুগার আমদানি করা হয়। যখন এই অতিরিক্ত চিনি আমদানি হয়, তখন আমরা দেখি মিলের চিনি অবিক্রীত পড়ে আছে, কিছু কিছু মিলে শ্রমিকের বেতন সময়মতো পরিশোধ করা যাচ্ছে না। এবং কৃষকরা আখ চাষে নিরুৎসাহ হচ্ছে। এই সংকটের পেছনে রয়েছে সরকারের আমদানি উদারীকরণ নীতি।
২০০২ সালে বেসরকারি উদ্যোগে চিনি আমদানি অনুমোদনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় চিনিশিল্প উদারীকরণ। ২০০৪ সাল থেকে রিফাইনারিগুলো উৎপাদনে আসার আগে নিবন্ধনপত্রে শর্ত রয়েছে উৎপাদিত পণ্যের ৫০ শতাংশ রপ্তানি করা হবে (বিএসএফআইসি, ২০১৪ক)। কিন্তু এই শর্ত প্রতিপালিত হচ্ছে না। উপরন্তু প্রয়োজনের অতিরিক্ত র সুগার আমদানি করার সময় মূলত দুটি যুক্তি দেওয়া হয়Ñ১. বেসরকারি রিফাইনারিগুলো বাড়তি র সুগার আমদানি করে দেশে রিফাইন করে বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করবে। ২. বেসরকারি রিফাইনারিগুলো এই বাড়তি মজুদ করা চিনি প্রয়োজনের সময় বাজারে ছেড়ে চিনির মূল্য নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখবে। কিন্তু দেখা গেছে, এই প্রাইভেট রিফাইনারিগুলো বিদেশে তো রপ্তানি করছেই না, বরং স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে দেশের ১৫টি চিনিকলে উৎপাদিত চিনির বাজারের কাছে হুমকিস্বরূপ আবির্ভূত হচ্ছে। এবং দেশি চিনিকলগুলোর অবিক্রীত চিনির মজুদ ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে।
চিত্র ২.১ : ২০০৯-১০ থেকে ২০১৪-১৫ পর্যন্ত মজুদ বৃদ্ধি (সূত্র : বিএসএফআইসি, ২০১৫ক)
চিত্র ২.২ : র সুগার আমদানি বৃদ্ধি (বিএসএফআইসি, ২০১৫ক)
২০০৩-০৪ অর্থবছরে সাদা ও র সুগার নির্বিশেষে আমদানি পর্যায়ে সিএফআর (কস্ট অ্যান্ড ফ্রেইট বা পরিবহন খরচসহ আমদানিমূল্য) মূল্যের ওপর রেগুলেটরি ডিউটি (সংরক্ষণমূলক আমদানি শুল্ক) আরোপিত ছিল। পরে ২০০৬-০৭ অর্থবছরে পৃথকভাবে সাদা চিনি ও র সুগার আমদানি পর্যায়ে স্পেসিফিক ডিউটি আরোপের মাধ্যমে শুল্ক সুবিধা দেওয়া হয়। ২০১৪-১৫ সাল পর্যন্ত এই শুল্কহার সাদা চিনিতে টনপ্রতি ৪৫০০ টাকা এবং র-সুগারে ২০০০ টাকা নির্ধারিত ছিল। ২০১৫ সালের আগস্ট থেকে স্পেসিফিক ডিউটি বা নির্ধারিত শুল্কের পাশাপাশি পুনরায় রেগুলেটরি ডিউটি আরোপ করা হয়। সাদা চিনির জন্য প্রতি টন টারিফ মূল্য ৪০০ ডলার ও ২০ শতাংশ ডিউটি (শুল্ক) এবং র সুগারের জন্য প্রতি টন ৩২০ ডলার ও ২০ শতাংশ ডিউটি (শুল্ক) প্রযোজ্য হবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড আমদানীকৃত চিনির ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব দেয়, কিন্তু তা বাস্তবায়িত হওয়ার আগেই আমদানিকারকরা চিনির দাম স্থানীয় বাজারে বাড়িয়ে দেয়। কেজি প্রতি চিনির মূল্য ৩৯-৪২ টাকা থেকে একলাফে ৪৪-৪৬ টাকা হয়ে যায় (বণিক বার্তা, ২০১৫)। এর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, প্রাইভেট রিফাইনারিগুলো আগের মজুদ করা পূর্বের দামে কেনা চিনি বর্ধিত ডিউটি (শুল্ক) ও ভ্যাটের অজুহাত দেখিয়ে বেশি দামে বাজারে ছেড়েছে। এই উদাহরণ থেকে বোঝা যায়, ২০০২ সাল থেকে যখন চিনি আমদানি অবাধ করে দেওয়া হয়, তখন থেকে শুরু করে সরকার চিনির মূল্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে এবং ২০১৫-এর শেষের দিকে এসে যখন পুনরায় ডিউটি (শুল্ক) আরোপ করে আমদানি সীমিত করার উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার, ততদিনে বেসরকারি আমদানিকারকরা বাজারের ওপর এত বেশি নিয়ন্ত্রণ অর্জন করে ফেলেছে যে এখন সরকার চাইলেও বেসরকারি রিফাইনারিগুলোর আমদানি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না। অর্থাৎ নি¤œ শুল্কে আমদানি সহজ হওয়ার পর থেকে অতিরিক্ত আমদানি বেসরকারি রিফাইনারিগুলোকে নির্বিচারে ক্ষমতায়ন করেছে। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরের ২৩ তারিখে চিনির ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয় এবং ভবিষ্যতে এর ফলে চিনির দাম বাড়বে। দেখা যাচ্ছে, সরকার আমদানিকারকদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে দায় চাপিয়ে দিচ্ছে ভোক্তার ওপর।
ছক:২.১ ২০০৩-০৪ থেকে ২০১৫-১৬ পর্যন্ত আমদানি শুল্ক ও সমুদ্রপথে চিনি আমদানির চিত্র (সূত্র: বিএসএফআইসি, ২০১৫ক)
দেশের বেসরকারি চিনি রিফাইনারিগুলো মূলত বড় বড় কনগ্লোমারেটের মালিকানাধীন। বিতরণ ও বিপণনে তারা অনেক আগে থেকেই দক্ষভাবে খাদ্যদ্রব্য বাজারজাত করার সক্ষমতা অর্জন করে এসেছে। অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যের বিতরণে অভিজ্ঞ এইসব বেসরকারি উদ্যোক্তা অল্প পরিশ্রমে ও সাশ্রয়ে এই বিপণন ও বিতরণ করায় প্রতিযোগিতার বাজারে তারা এখন আগ্রাসী ভূমিকা পালন করে আসছে। আর এ কারণে বাজার উদারীকরণের আগে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প সংস্থা বাজারে যেমন মূল্য নিয়ন্ত্রণে মুখ্য ভূমিকা রাখতে পেরেছিল, এখন তা পারছে না। অর্থাৎ প্রতিযোগিতা সৃষ্টির নামে অসম প্রতিযোগিতার একটি ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে বেসরকারি ব্যবসায়ীদের বাজারের ওপর দখল বৃদ্ধি করে। ১.১ নম্বর চিত্রে দেখানো হয়েছে প্রতিবছর বিক্রয়যোগ্য চিনির মজুদ আমদানি উদারীকরণের পর থেকে কিভাবে বেড়ে চলেছে। এবং অন্যদিকে শুল্ক সুবিধা ব্যবহার করে বেসরকারি রিফাইনারি কোম্পানিগুলো প্রয়োজনের তুলনায় ক্ষেত্রবিশেষে এমনকি ৭০ শতাংশ পর্যন্ত অতিরিক্ত আমদানি করেছে।
২.২ উদারীকরণ ও আখের বাজারে নিয়ন্ত্রণহীনতা
উদারীকরণের ফলে আরো যে বিষয়টি দৃশ্যমান হচ্ছে তা হলো দিন দিন আখ চাষে ব্যবহৃত জমির পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। আখ চাষ কমে যাওয়ার পেছনে আরো অন্যান্য কারণের ওপর পরবর্তী অংশে আলোকপাত করা হয়েছে। তবে এই চাষ কমে যাওয়ার সাথে বাণিজ্য উদারীকরণেরও একটি সম্পর্ক রয়েছে। প্রতিবছর লোকসানের শিকার হয়ে রাষ্ট্রীয় মিলগুলো কৃষকদের আখ চাষে উৎসাহিত করতে পারছে না। ২০০৩-০৪ অর্থবছরের আগে আখ চাষকৃত জমির পরিমাণ কিছুটা হলেও স্থির ছিল। কিন্তু ২০০৩-০৪-এর পর থেকে জমির পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেতে থাকে। এবং লক্ষ করলে দেখা যাবে, আখ চাষের আওতাধীন মিলের জমি ২০০৩-০৪ অর্থবছরের তুলনায় ২০১৫-১৬-তে এসে প্রায় ৩৫% হ্রাস পেয়েছে (বিএসএফআইসি,২০১৫ক)। বেসরকারি খাতে চিনি আমদানির ওপর নির্ভরতা যত বাড়তে থাকবে, দেশীয় চিনি বিদেশি চিনির সাথে প্রতিযোগিতায় বাজার হারাবে। দেশীয় মিলগুলোর পক্ষে কৃষকদের আখ চাষে উৎসাহিত করা তত বেশি কঠিন হয়ে উঠবে। ইতোমধ্যেই চিনিশিল্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল আখের উৎপাদন ও বাজার উভয়ই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে শুরু করেছে। চিনিশিল্পের জন্য এই পরিবর্তন আশু সমস্যা সমাধানে একটি বড় হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
চিত্র ২.৩ : আখ চাষকৃত জমির পরিমাণ হ্রাস (সূত্র : বিএসএফআইসি, ২০১৫ক)
৩. চিনিশিল্পের উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনাগত সংকটের কারণ অনুসন্ধান
রাষ্ট্রীয় চিনিকলগুলোর সংকটের একটা বড় কারণ হলো চিনির উৎপাদন খরচ আমদানি করা চিনির বাজারদরের তুলনায় অনেক বেশি। শুধু আমদানি করার সুগার বা অপরিশোধিত চিনিই নয়, পার্শ্ববর্তী ভারতে যেখানে বাংলাদেশের চিনিকলগুলোর মতোই সরাসরি আখ থেকে ‘প্লান্টেশন হোয়াইট সুগার’ বা সাদা চিনি উৎপাদন করা হয়, সেখানেও চিনির উৎপাদন খরচ আমাদের চিনিকলগুলোর তুলনায় অনেক কম, কেজি প্রতি ৩০ থেকে ৩২ রুপি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বৃহৎ চিনিকল থেকে উৎপন্ন র-সুগারের দাম সাধারণভাবেই প্লান্টেশন হোয়াইট সুগারের চেয়ে কম পড়ে বলে ভারতেও আখ থেকে চিনি উৎপাদনকারী অনেক চিনিকল বাজারের প্রতিযোগিতায় সংকটে পড়ে; কিন্তু ভারতীয় চিনিকলগুলোর চিনির উৎপাদন খরচ বাংলাদেশের মতো এত বেশি নয় বলে সেই সংকটও বাংলাদেশের চিনিকলগুলোর মতো মারাত্মক নয়। ভারতীয় চিনিকলের উৎপাদন খরচের সাথে বাংলাদেশের চিনিকলগুলোর উৎপাদন খরচের এই বিপুল পার্থক্যের কারণ হলো, একদিকে আমাদের চিনিকলগুলো মাড়াই করার মতো পর্যাপ্ত আখ পায় না, যে কারণে বছরের একটা বড় সময়জুড়ে চিনিকলগুলো বন্ধ থাকে, যদিও বেতন-ভাতাসহ বিভিন্ন স্থির খরচ সারা বছরই বহন করতে হয় চিনিকলগুলোকে। অন্যদিকে মাড়াই করার জন্য যে আখ পাওয়া যায় তা থেকে চিনি আহরণের পরিমাণ ভারতের চেয়ে অনেক কম, যে কারণে ভারতে প্রতি টন আখ থেকে যে পরিমাণ চিনি আহরণ করা হয় তার মাত্র অর্ধেক আহরণ করা হয় বাংলাদেশের চিনিকলগুলো থেকে।
ছক ৩ : মহারাষ্ট্রের চিনিকলের আখ মাড়াই ও চিনি আহরণের হার
বিবরণ | মৌসুম | ||||
২০০৮-০৯ | ২০০৯-১০ | ২০১০-১১ | ২০১১-১২ | ২০১২-১৩ | |
চালু চিনিকলের সংখ্যা | ৫০ | ৫৭ | ৪২ | ৪২ | ৫৪ |
মাড়াই দিবস | ১০৭ | ১৭০ | ১৮৬ | ১৫৭ | ১৩০ |
আখ মাড়াই (মিলিয়ন টন) | ৪০.০৩ | ৬১.৩৯ | ৮০.২২ | ৭৭.১৩ | ৭০.০৪ |
চিনি উৎপাদন (মিলিয়ন টন) | ৪.৫৮ | ৭.০৭ | ৯.০৫ | ৮.৯৮ | ৭.৯৯ |
আখে চিনির হার (%) | ১৩.৩৬ | ১৩.৪৬ | ১৩.২৬ | ১৩.৫৯ | ১৩.৩৭ |
আখ থেকে চিনি আহরণের হার (%) | ১১.৪৬ | ১১.৫৫ | ১১.৩১ | ১১.৬৫ | ১১.৪৩ |
অনাহৃত চিনির হার (%) | ১.৯ | ১.৯১ | ১.৯৫ | ১.৯৪ | ১.৯৪ |
সূত্র: VSI, 2013
চিনিশিল্পের উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনাগত সংকটের কারণ অনুসন্ধানের জন্য প্রথমে চিনি উৎপাদন প্রক্রিয়া সম্পর্কে ধারণা অর্জন করা প্রয়োজন।
৩.১ চিনি উৎপাদন প্রক্রিয়ার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
বাংলাদেশের চিনিকলগুলোতে সরাসরি আখ থেকে খাওয়ার উপযোগী সাদা চিনি বা প্লান্টেশন হোয়াইট সুগার উৎপাদন করা হয়। এ প্রক্রিয়ায় আখ থেকে চিনি উৎপাদনের জন্য আখ কেটে রোলার মিলের মাধ্যমে চাপ প্রয়োগ করে রস আহরণ করা হয়। এরপর রস নানাভাবে ছাঁকন ও রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরিষ্কার ও বিশুদ্ধ করে বাষ্পীভবনের মাধ্যমে ঘন সিরাপে পরিণত করা হয়। ঘন সিরাপকে এরপর ‘ভ্যাকুয়াম প্যান’-এ পাঠানো হয়, যেখানে ‘ভ্যাকুয়াম প্যান বয়েলিং’-এর মাধ্যমে চিনির সিরাপে ক্রিস্টাল বা স্ফটিকের আবির্ভাব ঘটে। এই ক্রিস্টালসমৃদ্ধ ঘন দ্রবণ থেকে ক্রিস্টালাইজার ও সেন্ট্রিফিউগাল মেশিনের মাধ্যমে গুঁড়ো চিনি আহরণ করা হয়, সেই সাথে উপজাত হিসেবে পাওয়া যায় ঝোলাগুড় বা মোলাসেস। চিনির রস আহরণের পর থেকে যাওয়া ছোবড়া বা বাগাসে (নধমধংংব) বয়লারের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয় (শর্মা ও কুমার, ২০১৫)।
চিত্র ৩.১ : কারখানায় আখ থেকে চিনি উৎপাদনের ফ্লো চার্ট
৩.২ আখ মাড়াইয়ের পরিমাণ এবং চিনি আহরণের হারের সাথে চিনির উৎপাদন খরচের সম্পর্ক
২০১১-১২ সালে চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের ১৫টি চিনিকলে মোট ১৫.৬৩ লাখ মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে গড়ে ৬.৮৫ শতাংশ হারে চিনি আহরণের মাধ্যমে মোট ১.০৭ লাখ টন চিনি উৎপাদিত হয়। এই চিনি উৎপাদনে কাঁচামাল ও মৌসুমি শ্রমশক্তিসহ মোট অস্থায়ী খরচ হয় ৪৯৭.৩২ কোটি টাকা এবং স্থায়ী শ্রমিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন-ভাতা, কারখানার যন্ত্রপাতির অবচয়, ঋণের সুদ, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ, বিমা, প্রাশাসনিক খরচসহ মোট অপরিবর্তনশীল খরচ হয় ৪৪১.৭৭ কোটি টাকা। এভাবে ১.০৭ লাখ টন চিনি উৎপাদনের মোট খরচ হয় ৯৩৯.০৯ টাকা। ঝোলাগুড়সহ বিভিন্ন উপজাত বিক্রি করে আয় হয় ৪৭.৪৫ কোটি টাকা। বিভিন্ন উপজাত বিক্রি বাবদ আয় বাদ দিয়ে চিনি উৎপাদন বাবদ প্রকৃত খরচ দাঁড়ায় ৮৯১.৬৪ কোটি টাকা, অর্থাৎ প্রতি কেজি চিনি উৎপাদনে খরচ ৮৩.২৪ টাকা। এখন চিনি আহরণের হার একই রেখে যদি একই সময়ে ২০০৬-০৭ মৌসুমের মতো ২৩.৩৫ লাখ টন আখ মাড়াই করা সম্ভব হতো, তাহলে অপরিবর্তনশীল খরচ আগের মতোই থাকত এবং পরিবর্তনশীল খরচ হতো ৭৪২.৮৯ কোটি টাকা। কিন্তু আখ মাড়াই বেশি হওয়ার কারণে চিনি উৎপাদন হতো ১.৬০ লাখ টন ও বিভিন্ন উপজাত বিক্রি বাবদ আয় হতো ৭০.৮৫ কোটি টাকা। ফলে ১.৬ লাখ টন চিনি উৎপাদনের জন্য প্রকৃত খরচ হতো ১ হাজার ১৮৪.৬৬ কোটি টাকা, অর্থাৎ প্রতি কেজি চিনি উৎপাদনে খরচ পড়ত ৭০.৮৫ টাকা। আবার একই সাথে চিনি আহরণের হার যদি ১ শতাংশ বেশি হতো, অর্থাৎ ৭.৮৫% হতো, তাহলে ৭৪২.৮৯ কোটি টাকা খরচ করে ১.৬ লাখ টনের বদলে ১.৮৩ লাখ টন চিনি উৎপাদিত হতো। ফলে প্রতি কেজি চিনি উৎপাদনের খরচ ৬০.৭৬ টাকায় নেমে আসত। এভাবে দেখা যায়, চিনি আহরণের পরিমাণ যত বাড়ে, কেজি প্রতি চিনির দাম তত কম পড়ে। ২৩.৩৫ লাখ টন আখ মাড়াই করে যদি ভারতের মহারাষ্ট্রের চিনিকলগুলোর কাছাকাছি হারে চিনি আহরণ করা যেত তাহলে কেজি প্রতি চিনির খরচ বাজারদরের প্রায় কাছাকাছি চলে আসত। যেমনÑচিনি আহরণের হার ১০.৮৫ শতাংশ করা সম্ভব হলে কেজি প্রতি চিনির দাম পড়ত ৪৩.৯৬ টাকা।
কাজেই বাংলাদেশের চিনিশিল্পের সংকট অনুসন্ধান করতে হলে আমাদের দেখতে হবে চিনিকলগুলো কেন মাড়াইয়ের জন্য পর্যাপ্ত আখ পাচ্ছে না, কেন আখ মাড়াইয়ের পরিমাণ দিন দিন কমছে এবং কেন আখ থেকে চিনি আহরণের হার পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের তুলনায় বাংলাদেশে এত কম।
ছক ৩.২ : আখ মাড়াই ও চিনি আহরণের হারের সাথে চিনির উৎপাদন খরচের সম্পর্ক
আখ মাড়াই (লাখ মে. টন) | ১৫.৬৩ | ২৩.৩৫ | ১৫.৬৩ | ২৩.৩৫ | ১৫.৬৩ | ২৩.৩৫ | ১৫.৬৩ | ২৩.৩৫ | ১৫.৬৩ | ২৩.৩৫ |
চিনি আহরণের হার (%) | ৬.৮৫ | ৬.৮৫ | ৭.৮৫ | ৭.৮৫ | ৮.৮৫ | ৮.৮৫ | ৯.৮৫ | ৯.৮৫ | ১০.৮৫ | ১০.৮৫ |
চিনি উৎপাদন (লাখ মে. টন) | ১.০৭ | ১.৬ | ১.২৩ | ১.৮৩ | ১.৩৮ | ২.০৭ | ১.৫৪ | ২.৩ | ১.৭ | ২.৫৩ |
মোট অস্থিতিশীল খরচ (কোটি টাকা) | ৪৯৭.৩২ | ৭৪২.৮৯ | ৪৯৭.৩২ | ৭৪২.৮৯ | ৪৯৭.৩২ | ৭৪২.৮৯ | ৪৯৭.৩২ | ৭৪২.৮৯ | ৪৯৭.৩২ | ৭৪২.৮৯ |
মোট অপরিবর্তনশীল খরচ (কোটি টাকা) | ৪৪১.৭৭ | ৪৪১.৭৭ | ৪৪১.৭৭ | ৪৪১.৭৭ | ৪৪১.৭৭ | ৪৪১.৭৭ | ৪৪১.৭৭ | ৪৪১.৭৭ | ৪৪১.৭৭ | ৪৪১.৭৭ |
মোট উৎপাদন খরচ (কোটি টাকা) | ৯৩৯.০৯ | ১,১৮৪.৬৬ | ৯৩৯.০৯ | ১,১৮৪.৬৬ | ৯৩৯.০৯ | ১,১৮৪.৬৬ | ৯৩৯.০৯ | ১,১৮৪.৬৬ | ৯৩৯.০৯ | ১,১৮৪.৬৬ |
উপজাত বিক্রির আয় (কোটি টাকা) | ৪৭.৪৫ | ৭০.৮৫ | ৪৭.৪৫ | ৭০.৮৫ | ৪৭.৪৫ | ৭০.৮৫ | ৪৭.৪৫ | ৭০.৮৫ | ৪৭.৪৫ | ৭০.৮৫ |
মোট প্রকৃত উৎপাদন খরচ (কোটি টাকা) | ৮৯১.৬৪ | ১,১১৩.৮১ | ৮৯১.৬৪ | ১,১১৩.৮১ | ৮৯১.৬৪ | ১,১১৩.৮১ | ৮৯১.৬৪ | ১,১১৩.৮১ | ৮৯১.৬৪ | ১,১১৩.৮১ |
প্রতি কেজি চিনির উৎপাদন খরচ (টাকা) | ৮৩.২৪ | ৬৯.৬৩ | ৭২.৬৫ | ৬০.৭৬ | ৬৪.৪৪ | ৫৩.৮৯ | ৫৭.৯ | ৪৮.৪২ | ৫২.৫৭ | ৪৩.৯৬ |
সূত্র : বিএসএফআইসি, ২০১৫গ
৩.৩ আখ সরবরাহের ঘাটতি
চিনিকল লাভজনক হওয়ার একটা অত্যাবশ্যকীয় শর্ত হলো পর্যাপ্ত আখ সরবরাহ এবং বছরে অন্তত ১২০ দিন মাড়াই মৌসুম। আমাদের চিনিকলগুলো পর্যাপ্ত আখ না পাওয়ার কারণে ৪০ থেকে ৮০ দিনের বেশি আখ মাড়াই করতে পারে না। মাড়াই কম হলেও সারা বছর নির্দিষ্ট কিছু খাতে খরচ ঠিকই করতে হয়, যেটাকে স্থির খরচ বলে। পর্যাপ্ত আখ না পাওয়ার কারণে কম পরিমাণ চিনি উৎপাদন হয়; ফলে কেজি প্রতি চিনির স্থির খরচ বেড়ে যায়।
চিনিকলে পর্যাপ্ত আখ না পাওয়ার কারণগুলো হলো :
৩.৩.১ আখ চাষের জমি হ্রাস ও চিনিকলে আখ সরবরাহে কৃষকের অনীহার কারণ
- আখ লাগানোর পর পরিপক্ব হতে মোটামুটি ১ বছর সময় লাগে। জমিতে শুধু আখ চাষের চেয়ে অনেক ক্ষেত্রে ধান ও সবজি চাষ করলে চাষির জন্য তা বেশি লাভজনক। ফলে দিনে দিনে জমিতে আখ চাষের পরিমাণ কমছে।
- চিনিকলের তুলনায় গুড় উৎপাদকের কাছে আখ বিক্রি লাভজনক হওয়ায় কৃষক প্রায় ক্ষেত্রে গুড় বিক্রেতার কাছে আখ বিক্রি করেন।
- চিনিকলের কাছ থেকে আখ চাষের জন্য প্রয়োজনীয় সার/কীটনাশক/বীজ সংগ্রহ করতে হলে প্রায় ১১ শতাংশ সুদ প্রদান করতে হয়। এগুলো সময়মতো পর্যাপ্ত পাওয়া যায় না, বেশি দামে কিনতে হয় এবং অনেক সময় ওজনে কম দেওয়া হয় বলে চাষিদের অভিযোগ।
- চিনিকলের কাছে আখ বিক্রি করতে না চাওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ সময়মতো পাওনা বুঝে না পাওয়া। বিক্রির টাকা আদায় করার জন্য কৃষককে মাসের পর মাস ধরনা দিতে হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই চাষির পক্ষে ৩ থেকে ৬ মাস অপেক্ষা করার সুযোগ থাকে না, ফলে তাকে দালালদের কাছে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ লস দিয়ে পাওনার রসিদ বিক্রি করে দিতে হয়।
- চিনিকলে আখ নিজের সুবিধামতো সময়ে বিক্রি করা যায় না। চিনিকলের দৈনিক মাড়াই ক্ষমতা নির্দিষ্ট হওয়ার কারণে কোন চাষির কাছ থেকে কবে আখ কেনা হবে তার একটা পারমিট বা পুর্জি দেওয়া হয় চাষিকে। সময়মতো পুর্জি পাওয়া নিয়ে কৃষককে ভুগতে হয়। জমিতে আখ পরিপক্ব হওয়ার পরও সময়মতো পুর্জি পাওয়া যায় না।
- পুর্জি পাওয়ার পর ক্ষেত থেকে আখ চিনিকলে বা চিনিকলের ক্রয়কেন্দ্রে পরিবহন করতে গিয়ে সমস্যায় পড়তে হয়। সময়মতো ট্রাক বা ট্রাক্টর ভাড়া পাওয়া যায় না।
- ক্রয়কেন্দ্রে চাষিকে আখের ওজন কম দেওয়ার অভিযোগ দীর্ঘদিনের।
৩.৩.২ একরপ্রতি আখের ফলন কম হওয়া
বাংলাদেশে একরপ্রতি আখের ফলন গড়ে ১৮-১৯ টন, যা পৃথিবীর অন্যান্য আখ উৎপাদনকারী দেশের তুলনায় খুবই কম। এ কারণেও চিনি উৎপাদনের পরিমাণ কম হচ্ছে। ভারতের মহারাষ্ট্রে একরপ্রতি আখ উৎপাদন ৩২ টন, উত্তর প্রদেশে ২৪ টন এবং সারা ভারতের গড় উৎপাদন ২৮ টন (SANDRP, ২০১৩)। বাংলাদেশের বিএসআরআই উদ্ভাবিত আখের বিভিন্ন জাতের একরপ্রতি উৎপাদন ৩০ থেকে ৪০ টন হওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে ফলন হয় তার তুলনায় অনেক কম।
ছক ৩.৩ : বিএসআরআই উদ্ভাবিত বিভিন্ন জাতের আখের একরপ্রতি ফলন ও চিনি ধারণক্ষমতা
বিবরণ | ঈ-২/৫৪ | এলজেসি | ঈ-১৬ | ঈ-২০ | ঈ-২১ | ঈ-২৬ | ঈ-৩১ | ঈ-৩২ | ঈ-৩৩ | ঈ-৩৪ | ঈ-৩৫ | ঈ-৩৬ | ঈ-৩৭ | ঈ-৩৮ | ঈ-৩৯ | ঈ-৪০ |
গড় ফলন (টন/একর) | ৩২ | ৩২ | ৩৭ | ২৯ | ২৯ | ২৪ | ৩৬ | ৪২ | ৪০ | ৩৮ | ৩৮ | ৩৬ | ৪১ | ৪৬ | ৪১ | ৪২ |
চিনির হার (%) | ১২.৯৭ | ১৩.১৯ | ১৪.৫ | ১৩.৫ | ১৪.৪ | ১৪.৭ | ১২.৯ | ১৩ | ১৫ | ১২.৮ | ১৫ | ১৫ | ১৪.৪ | ১৪.৭ | ১৪.২ | ১৪.৯ |
সূত্র:ইক্ষু প্রযুক্তি হ্যান্ডবুক, বিএসআরআই, ২০১২
যেসব কারণে একরপ্রতি আখের ফলন কম হচ্ছে তার মধ্যে রয়েছে :
- উচ্চ ফলনশীল ও অধিক চিনিযুক্ত ইক্ষু জাতের সীমিত চাষাবাদ।
- গুণগত মানসম্পন্ন ইক্ষু বীজের অপ্রতুল ব্যবহার। পরিচ্ছন্ন বীজ উৎপাদন ও বিতরণ কর্মসূচি দুর্বল হওয়া যার প্রধান কারণ।
- অপ্রতুল আগাম চাষ। আগাম মৌসুমে পর্যাপ্ত খালি জমির অভাবে আগাম চাষ ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে, যা আখের ফলন হ্রাসের অন্যতম কারণ।
- ইক্ষু ক্ষেতে পর্যাপ্তসংখ্যক গাছ না থাকা। একরপ্রতি ৩০ টন ফলন পাওয়ার জন্য ক্ষেতে ৪০-৪৫ হাজার মাড়াইযোগ্য ইক্ষু গাছ থাকা প্রয়োজন। কিন্তু সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে মাত্র ২৫-৩০ হাজার মাড়াইযোগ্য ইক্ষু ক্ষেতে থাকে, যা থেকে কাক্সিক্ষত ফলন পাওয়া যায় না।
- ইক্ষুর ক্ষতিকর পোকামাকড় সময়মতো দমন না করা।
- ইক্ষুর রোগ সময়মতো দমন করতে না পারা। ইক্ষুর রোগ একবার দেখা দিলে রোগাক্রান্ত গাছ ঝাড়সহ উপড়ে ফেলতে হয়।
- আধুনিক ইক্ষু উৎপাদন প্রযুক্তি ও উপকরণের অপ্রতুল ব্যবহার।
- সঠিক পদ্ধতিতে সাথি ফসল চাষ ও পরিচর্যা না করলে সাথি ফসল ও ইক্ষু উভয়েরই ফলন কম হয়।
- পর্যাপ্ত সেচ সুবিধার অভাব।
- জলাবদ্ধতা ও পানি নিষ্কাশন সমস্যা।
- মুড়ি ইক্ষু ব্যবস্থাপনা সমস্যা।
- বিলম্বে ইক্ষু কর্তন সমস্যা। সেচ প্রয়োগ না করলে কিংবা পর্যাপ্ত বৃষ্টি হলে মার্চ-এপ্রিল মাসে ইক্ষুর ওজন প্রায় ৩০ শতাংশ হ্রাস পায় (রহমান ও হক, ২০১৫)।
৩.৪ চিনি আহরণের অতি নিম্নহার
রাষ্ট্রীয় চিনিকলগুলোর চিনি আহরণের হার খুবই কম-মাত্র ৬ থেকে ৭ শতাংশ। অথচ ভারতে আখ থেকে চিনি আহরণের হার গড়ে ১১ থেকে ১২ শতাংশ। ২০১২ সালে ভারতের চিনি আহরণের হার ছিল ১১.২৩% এবং ব্রাজিলের ১৪.১% (গনি, ২০১২)। অর্থাৎ ১০০ কেজি আখ থেকে ভারত বা ব্রাজিল যে পরিমাণ চিনি আহরণ করে, বাংলাদেশ করে তার প্রায় অর্ধেক। চিনি উৎপাদনের মোট খরচের প্রায় ৪০ শতাংশ খরচ হয় কাঁচামাল বাবদ। চিনি আহরণের এই অতি নিম্নহারের কারণে বাংলাদেশে চিনিকলগুলোর কাঁচামাল বাবদ খরচ ভারতীয় চিনিকলগুলোর তুলনায় দ্বিগুণ, যা শেষ পর্যন্ত প্রতি কেজি চিনি উৎপাদনে বাড়তি খরচ হিসেবে যোগ হচ্ছে।
প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের চিনিকলগুলোর কাঁচামাল আহরণের হার এত কম হওয়ার কারণ কী? আখ থেকে কী পরিমাণ চিনি আহরণ হবে তা কয়েকটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে- আখে কী পরিমাণ চিনি রয়েছে এবং আখে থাকা চিনির কী পরিমাণ কারখানায় যান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আহরণ করা সম্ভব হচ্ছে। চিনিকল কর্তৃপক্ষের বক্তব্য হচ্ছে, তারা কৃষকদের কাছ থেকে যে আখ পান তার গড় চিনি ধারণক্ষমতা ৮ থেকে ৯ শতাংশ। ফলে ২.৩৫ থেকে ২.৪০ শতাংশ কারখানা লস বাদ দিলে কার্যকর চিনি আহরণের হার ৬ থেকে ৭ শতাংশের বেশি হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। অন্যদিকে ইক্ষু গবেষণা সংস্থার বক্তব্য হলো, আখে চিনির পরিমাণ ১২ শতাংশের কম থাকে না। কারখানাগুলোতে চিনি লস বেশি হওয়ার কারণেই চিনি আহরণের হার কম হয় এবং কারখানাগুলো এই লস অনুমোদিত মাত্রার মধ্যে দেখার জন্য ব্যাক ক্যালকুলেশন করে আখের চিনির হার কম করে দেখায়! আমাদের পর্যবেক্ষণ হলো, চিনি কম আহৃত হওয়ার পেছনে আখে চিনির হার, ক্ষেত থেকে আখ পরিবহনের সমস্যা এবং কারখানায় অপেক্ষাকৃত কম পরিমাণ আহৃত হওয়া-এই সবগুলো সমস্যাই কমবেশি দায়ী।
৩.৪.১ আখের জাত ও চাষাবাদের ব্যবস্থাপনাগত সংকট
বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা সংস্থা আখের যে জাতগুলো অবমুক্ত করেছে তার সবগুলোরই চিনি ধারণক্ষমতা ১২ শতাংশের বেশি। কোনো কোনো জাতের চিনি ধারণক্ষমতা ১৪ শতাংশেরও বেশি। তাহলে চিনিকলগুলোতে কেন মাত্র ৮ থেকে ৯ শতাংশ চিনি ধারণকারী আখ পাওয়া যাচ্ছে? আমরা যদি চিনিকলগুলোর দেওয়া চিনি ধারণের হারকে সঠিক ধরে নিই তাহলে এর কারণগুলো হতে পারে :
- অঞ্চলভেদে মাটির বৈশিষ্ট্য, জমির উচ্চতা, আবহাওয়া ইত্যাদি বিবেচনায় রেখে উপযুক্ত জাতের আখ চাষ না করা।
- আখের জাতগুলোকে আগাম, মধ্যম ও নাবি-এই তিন রকম সময়ে পরিপক্ব হওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করে বিভিন্ন সময়ে চাষাবাদ এবং সে অনুযায়ী আখ কাটা ও চিনিকলের মাড়াই কর্মসূচি নির্ধারণ করার ব্যর্থতা।
- অপ্রতুল আগাম চাষ। আগাম চাষের আখ পরিপক্বতা অর্জনের পর্যাপ্ত সময় পায় এবং আখে চিনির পরিমাণ বেশি হয়।
- অপ্রতুল মুড়ি আখ চাষ। মুড়ি আখ ৯-১০ মাসে পরিপক্ব হয় এবং চিনি আহরণ বেশি হয়।
- পোকামাকড় ও রোগবালাই সঠিকভাবে দমন না করার কারণে আখে কাক্সিক্ষত চিনি পাওয়া যায় না।
- আখ চাষের জন্য বিএসআরআই সুপারিশকৃত প্রযুক্তি প্যাকেজ ও উপকরণ কৃষকের কাছে সঠিকভাবে না পৌঁছানো (রহমান ও হক, ২০১৫)।
ইক্ষু গবেষণা সংস্থার বক্তব্য হলো, যদি এসব কারণে আখে পর্যাপ্ত চিনি পাওয়া না যায় সেক্ষেত্রেও চিনিকলগুলোকে এর দায় বহন করতে হবে। চিনিকল অঞ্চলে চাষিরা কোন জাতের আখ চাষ করবে, চাষিদেরকে কোন জাতের বীজ দেওয়া হবে তা দেখভাল করার দায়িত্ব চিনিকল কর্তৃপক্ষের। চিনিকলে এই কাজটি দেখভাল করার জন্য নিজস্ব লোকবল রয়েছে, যারা ঘুরে ঘুরে কৃষকদেরকে আখ চাষে উদ্বুদ্ধ করবে, চাষিরা সঠিক প্রক্রিয়ায় আখ চাষ করছে কি না, সময়মতো রোপণ করছে কি না, পর্যাপ্ত সার কিংবা সেচ দিচ্ছে কি না বা রোগাক্রান্ত হলে সঠিক মাত্রায় উপযুক্ত কীটনাশক ব্যবহার করছে কি না, সেটাও তাদের নিশ্চিত করার কথা। এই কাজগুলো ঠিকমতো সম্পন্ন না হলে আখের জাত যতই ভালো হোক না কেন, তা থেকে পর্যাপ্ত চিনি পাওয়া যাবে না।
৩.৪.২ আখ পরিবহনের সংকট
জমি থেকে কেটে ফেলার পর সাধারণত ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই আখ মাড়াই করে ফেলতে হয়; নইলে ধীরে ধীরে আখের ভেতরে থাকা চিনি নষ্ট হতে থাকে। পরিবহন সংকট ও ব্যবস্থাপনাগত সমস্যার কারণে অনেক সময় দেখা যায়, পুর্জির তারিখ অনুযায়ী চাষি আখ কাটলেও তা যানবাহনের অভাবে সময়মতো কারখানায় নিয়ে যেতে পারছে না। সাধারণত কারখানার ৭ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে থাকা চাষিদেরকে স্ব উদ্যোগে আখ পরিবহন করতে হয়। এর চেয়ে দূরে থাকা চাষিরা নিকটস্থ ক্রয়কেন্দ্রে আখ পৌঁছে দেয় এবং ক্রয়কেন্দ্র কারখানা কর্তৃপক্ষ নিজস্ব যানবাহনের মাধ্যমে তা পরিবহন করে কারখানায় নিয়ে আসে। আখ পরিবহনের জন্য কারখানার ট্রাক/ট্রাক্টরগুলো জীর্ণ ও পুরনো হয়ে যাওয়ার কারণে এগুলো প্রায়ই মাঝপথে নষ্ট হয়ে যায়। আবার আখ কারখানায় পৌঁছানোর পরও ব্যবস্থাপনাগত ও কারখানার যান্ত্রিক ত্র“টির কারণে যদি মাড়াই করতে দেরি হয়, তাহলেও আখে চিনির পরিমাণ কম পাওয়া যাবে। পরিবহন করার সময় অনেক সময় আখ চুরি হয়। অভিযোগ রয়েছে, অপরিপক্ব আখ সরবরাহের কারণে চাষির কাছ থেকে আখ কেনার সময় ওজন কম দেখানো হলেও কারখানায় তা ঠিকই পরিপক্ব হিসেবেই গছিয়ে দেওয়া হয়; ফলে কারখানা আখের ওজনের তুলনায় কম চিনি পায়, যা চূড়ান্ত হিসেবে চিনি আহরণের হার কমিয়ে দেয়।
ছক ৩.৪ : ২০১২-১৩ মৌসুমে ইক্ষু পরিবহনের জন্য মিলসমূহের নিজস্ব যানবাহন, সচল ও অচল যানের সংখ্যা
যানের নাম | সংখ্যা | |||
মোট | সচল | অচল | ||
ট্রাক | ১২১ | ৯২ | ২৯ | |
ট্রাক্টর | ৯৯৮ | ৭০৯ | ২৮৯ | |
ট্রেইলারস | ৩৩০৪ | ২৬০৯ | ৬৯৫ |
সূত্র: বিএসএফআইসি, ২০১৪খ
৩.৪.৩ কারখানার প্রসেস লস
কারখানায় প্রবেশের পর আখের মধ্যে থাকা চিনির কতটুকু আহরণ করা যাবে তা নির্ভর করে কারখানার ইফিশিয়েন্সি বা কর্মদক্ষতার ওপর। আখের মধ্যে যতটুকু চিনি থাকে তার সবটুকুই কারখানায় আহরণ করা যায় না; এর একটা অংশ লস হয়। মিলিংয়ের মাধ্যমে আখ থেকে রস আহরণের সময় কিছু পরিমাণ চিনি আখের ছোবড়ায় বা বাগাসেতে থেকে যায়। আখের রস বিশুদ্ধকরণ পর্যায়ে যে লসটুকু হয় তা প্রেসমাডে জমা হয়। চিনিকে ক্রিস্টালে পরিণত করার সময় কিছু সুক্রোজ মোলাসেস বা ঝোলাগুড়ের মধ্যে চলে যায়। আর কিছু লস থাকে অনির্দিষ্ট, যা আসলে আখ থেকে রস আহরণের সময় সুক্রোজ ইনভার্সন, আখের রস পরিষ্কারকরণ ও বাষ্পীভবন কিংবা রস/সিরাপ উপচে পড়ে লিকেজ হয়ে নানাভাবে নষ্ট হয় (এফএও, ২০০১)।
বাংলাদেশের চিনিকলগুলোতে কাগজে-কলমে এই হার সব সময়ই গড়ে ২.৩৫ থেকে ২.৪০ হারে দেখানো হয়। ভারতের তুলনায় এই হার ০.৫ শতাংশ বেশি। ভারতের মহারাষ্ট্রের চিনিকলগুলোতে চিনি লসের গড় হার ১.৯২৫ শতাংশ। অর্থাৎ বাংলাদেশের চিনিকলগুলোর এই চিনি লসের হার সাধারণভাবেই অগ্রহণযোগ্য।
আবার চিনি আহরণে লসের হার আসলেই ২.৩৫ থেকে ২.৪০ কি না, সেটা নিয়েও প্রশ্ন আছে। বিএসআরআই মনে করে, এই লসের হার বাস্তবে ৩ থেকে ৩.৫ শতাংশের কম নয়। এই আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। দেখা গেছে, পাশাপাশি এলাকার দুটি চিনিকলে আসা আখের চিনির পরিমাণের মধ্যে পার্থক্য অনেক। জয়পুরহাট চিনিকলে আখের পোল (সুক্রোজ) ৯.৫৫% দেখানো হলেও পার্শ¦বর্তী রংপুর চিনিকলে তা দেখানো হয়েছে মাত্র ৮.০৫%। একেবারে পাশাপাশি দুটি অঞ্চলে আবহাওয়া কিংবা চাষাবাদের ধরনের মধ্যে এমন কোনো পার্থক্য থাকার কথা নয়, যার কারণে দুটি অঞ্চলের আখের পোলের পরিমাণে এত বেশি পার্থক্য থাকবে। হতে পারে, নষ্ট পুরনো যন্ত্রপাতির কারণে লস বেশি হওয়ার কারণে হোক বা চুরি-দুর্নীতির কারণেই হোক, চিনি আহরণে লসের পরিমাণ গড় মাত্রার (২.৪%) চেয়ে বেশি হয়েছে এবং সেই লস গোপন করার জন্যই আখে চিনির পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে কম দেখানো হয়েছে। কারখানার সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যক্তি স্বীকার করেছেন যে কাগজে-কলমে যে হিসাব দেখানো হয় তার সাথে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। কিন্তু কোন খাতে কত পরিমাণ বাড়িয়ে বা কমিয়ে দেখানো হয় সেটা স্বীকার করতে তাঁরা রাজি হননি। কারখানার যন্ত্রপাতিতে সমস্যা থাকলে চিনি আহরণের হার কেমন করে কমতে পারে তার কিছু উদাহরণ এখানে দেওয়া হলো-
- আখ মাড়াই করে রস বের করার যন্ত্র (রোলার) ঠিকঠাক কাজ না করলে, আখের পরিমাণ অনুযায়ী পর্যাপ্ত চাপ প্রয়োগ করতে সক্ষম না হলে আখের ছোবড়ায় স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি রস থেকে যায়। ছোবড়ায় বেশি রস থাকলে তা বয়লারে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করলে সমস্যা তৈরি হয়, স্টিম তৈরি কম হয় এবং তার ফলে আবার রোলার ঠিকভাবে কাজ করে না; যার কারণে আবার রস আহরণ কম হয়।
- কোনো যন্ত্র হঠাৎ করে নষ্ট হয়ে গেলে পুরো প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং আহৃত রসটুকু নষ্ট হয় বা ফেলে দিতে হয়। মিলগুলোতে যন্ত্রপাতি নষ্ট হওয়ার কারণে এভাবে রস ফেলে দেওয়া বা ‘ড্রেন আউট’ করার ঘটনা বিরল নয়। আবার যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে মাঠ থেকে কেটে আনা আখ যদি ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে মাড়াই করা না যায় তাহলে আখের মধ্যে চিনি সময়ের সাথে সাথে নষ্ট হতে থাকে।
- রস প্রক্রিয়াজাত করার সময় যদি রসের তাপমাত্রা ও অম্লত্ব নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে কম বা বেশি হয় তার ফলে সুগার ইনভার্সন (সুক্রোজ ভেঙে গ্লুুকোজ ও ফ্রূক্টোজে পরিণত হওয়া) বেড়ে যায়, যা চিনি আহরণের হার কমিয়ে দেয়।
- বিএসএফআইসির কর্মপরিকল্পনা অনুসারে দেখা যায়, সাধারণত চিনিকলের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল ২০ বছর। এই হিসাবে গত শতাব্দীর ত্রিশ থেকে ষাটের দশকে স্থাপিত চিনিকলসমূহের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল অনেক আগেই শেষ হয়েছে। ফলে চিনিকলসমূহের বয়লার, টার্বো-অল্টারনেটর, মিল টারবাইন, কেইন প্রিপারেশন ডিভাইস, মিলিং প্লান্ট, সেন্ট্রিফিউগাল মেশিন ও ফিল্টার স্টেশন অতি পুরনো ও জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। এতে কারখানাগুলো ক্ষমতা অনুসারে উৎপাদন কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে পারছে না (বিএসএফআইসি, ২০১৪ক)।
৩.৫ কারখানার টেকনিক্যাল পারফরম্যান্সের সমস্যা: ভারতীয় বেঞ্চমার্কের সাথে তুলনা
বাংলাদেশের চিনিকলগুলো প্রতি টন আখ মাড়াইয়ে বিদ্যুতের ব্যবহার, রক্ষণাবেক্ষণ খরচ, আখ মাড়াইকালে সময়ের অপচয় ইত্যাদি কারিগরি মানদণ্ডেও ভারতীয় চিনিকলগুলোর তুলনায় যথেষ্ট পিছিয়ে রয়েছে। এখানে উদাহরণস্বরূপ ভারতের মহাহিসাব নিরীক্ষক (সিএজি) ২০০৫ সালে তামিলনাড়ূর চিনিকলগুলোর কারিগরি মান যাচাই করতে গিয়ে যে মানদণ্ডগুলো ব্যবহার করেছিলেন তার সাথে রংপুর ও জয়পুরহাট চিনিকলের পারফরম্যান্সের তুলনা দেওয়া হলো-
ছক ৩.৫ : রংপুর ও জয়পুরহাট চিনিকলের পারফরম্যান্সের তুলনা
খাত | ভারতীয় মানদণ্ড | রংপুর চিনিকল | জয়পুরহাট চিনিকল | ||||
২০১০-১১ | ২০১১-১২ | ২০১২-১৩ | ২০১০-১১ | ২০১১-১২ | ২০১২-১৩ | ||
আখ মাড়াইকালের তুলনায় সময় অপচয় (%) | ৮ | ১৫.৩২ | ২১.৩৬ | ১১.৮৯ | ৬. | ১১. | ১১.৪৯ |
প্রতি টন আখ মাড়াইয়ে বিদ্যুতের ব্যবহার (কিলোওয়াট-ঘণ্টা) | ২১ | ২৪.৭৭ | ২৯.২১ | ২৩.৭৫ | ১৫.৬৭ | ১৭.৭৫ | ১৬.১১ |
প্রতি টন আখ মাড়াইয়ে রক্ষণাবেক্ষণ খরচ (টাকা) | ৩০ রুপি | ১৯৯.৫৯ | ৪৭২.৫৯ | ২৭৯.০৫ | ১৭২.৩৬ | ২৭৩.৮৫ | ২৫০.৩১ |
সূত্র: ১. CAG, 2005, ২. রংপুর চিনিকল ২০১৪, ৩. জয়পুরহাট চিনিকল ২০১৪
৩.৬ ঋণের সুদ পরিশোধের দায়
প্রতিবছর ঋণের সুদ বাবদ বিপুল অর্থ খরচ হওয়ার কারণে চিনির উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। গড়ে চিনির উৎপাদন খরচের প্রায় ৫ ভাগের ১ ভাগই হলো ঋণের সুদ। ২০১২-১৩ সালে এক কেজির উৎপাদন খরচ ছিল ৮৩.২৩ টাকা, যার মধ্যে ঋণের সুদ বাবদ খরচ ছিল ১৫.৫৫ টাকা। এই ঋণ পরিশোধ করতে না হলে প্রতি কেজি চিনির উৎপাদন খরচ হতো ৬৭.৬৮ টাকা (বিএসএফআইসি, ২০১৪ঘ)।
৩.৭ উপজাতের সর্বোচ্চ ব্যবহার না করা
চিনিকলগুলোতে আখ থেকে চিনি উৎপাদন করতে গিয়ে উৎপন্ন উপজাত মোলাসেস বা ঝোলাগুড় সীমিত পরিমাণে অ্যালকোহল বা স্পিরিট উৎপাদনে ব্যবহৃত হচ্ছে, ব্যাগাসে বয়লারের জ্বালানি হিসেবে এবং প্রেসমাড জৈবসারের কাঁচামাল হিসেবে বিক্রি করা হচ্ছে। ঝোলাগুড় থেকে স্পিরিট উৎপাদন হয় কেবলমাত্র কেরু অ্যান্ড কোং চিনিকলের সাথে সংযুক্ত ডিস্টিলারিতে। এরকম আরো কয়েকটি চিনিকলে ডিস্টিলারি স্থাপন করা হলে এবং ঝোলাগুড় ব্যবহার করে অ্যালকোহল ছাড়াও অ্যাসিটিক এসিড/ভিনেগার, মোলাসেস কুকিজ ইত্যাদি উৎপাদনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে সার্বিকভাবে চিনিকলের লোকসান কমে আসবে। ব্যাগাসে ব্যবহার করে কোজেনারেশনের মাধ্যমে ৫০ থেকে ১০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন করে চিনিকলের কাজে লাগানোর বাইরে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা যায়। ২০১২-১৩ সালে কেরু অ্যান্ড কোং চিনি উৎপাদন খাতে ৩৫.২৭ কোটি টাকা লোকসান করলেও ডিস্টিলারি ইউনিট ১৬ হাজার ৪৪৫ টন ঝোলাগুড় ব্যবহার করে প্রতি টন ঝোলাগুড় থেকে ৩০৮ লিটার হারে অ্যালকোহল উৎপাদন করে ৫৭.৫০ কোটি টাকা মুনাফা অর্জন করেছে (বিএসএফআইসি, ২০১৫গ)। ২০১২-১৩ সালে মোট ঝোলাগুড় উৎপাদিত হয়েছে ৫৮ হাজার ৭৩৮ টন (বিএসএফআইসি, ২০১৪গ)। এই বিপুল পরিমাণ ঝোলাগুড়ের এক-তৃতীয়াংশ কেবল একটি ডিস্টিলারিতে অ্যালকোহল উৎপাদনে ব্যবহৃত হচ্ছে। বাকি অংশ কাঁচামাল হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। চিনিকলগুলোতে বাকি অংশটুকুও কাজে লাগানো হলে চিনিকলের লোকসান আরো কম হতো।
৩.৮ দুর্নীতির কারণে বাড়তি খরচ
আখচাষি থেকে শুরু করে চিনিকলের আশপাশে বসবাসকারী জনগণ, এমনকি চিনিকলের বিভিন্ন স্তরের শ্রমিক-কর্মচারীদের চিনিকল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে সাধারণ একটি অভিযোগ হলো চুরি ও দুর্নীতি :
- মিলের খুচরা যন্ত্রাংশ ক্রয় ও বিভিন্ন মেরামতকাজে দুর্নীতি।
- উপজাত বিক্রির বিষয়ে দুর্নীতি।
- বিভিন্ন টেন্ডার ও কন্ট্রাক্ট প্রদানের বেলায় কমিশন নিয়ে কাজ প্রদানের অভিযোগ।
- আখের ওজন, সার/বীজ/কিটনাশকের ওজন নিয়ে কারচুপি।
- পুর্জি প্রদান ও মূল্য পরিশোধে অনিয়ম।
- যানবাহন পরিচালনা ও মেরামতে চুরি-দুর্নীতি।
৩.৯ চিনি বিক্রির যথাযথ উদ্যোগের অপ্রতুলতা
চিনিকলের আশপাশের খুচরা বিক্রেতা ও ব্যবহারকারীদের সাথে কথা বলে দেখা গেছে, দেশি চিনির ভালো চাহিদা এবং স্বাস্থ্যসম্মত ও বেসরকারি চিনির চেয়ে বেশি মিষ্টি বলে বিবেচিত হলেও তারা চাহিদা অনুযায়ী চিনি পায় না। ডিলাররা চিনি উত্তোলন করে না বলে পাইকারি বিক্রেতা মারফত চিনি খুচরা বিক্রেতাদের কাছে পৌঁছায় না। ডিলারদের চিনি তুলতে না চাওয়ার কারণ হলো, দেশি চিনির দাম বেশি। সরকারি চিনির দাম কমানো হলে বেসরকারি চিনি আমদানিকারকরা তার সাথে পাল্লা দিয়ে দাম কমায়। আবার মিলগেটে সরকারি চিনির দাম বেসরকারি চিনির সমান হলেও তা ডিলারের কাছে যথেষ্ট আকর্ষণীয় হয় না। কারণ বেসরকারি চিনি বিক্রেতারা বাকিতে চিনি সরবরাহ করলেও সরকারি চিনিকল থেকে চিনি কিনতে হলে অগ্রিম অর্থ জমা দিতে হয়। আবার উত্তরবঙ্গকেন্দ্রিক চিনিকলগুলোর মিলগেটে চিনির দর প্রতিযোগিতামূলক হলেও দেশের বিভিন্ন অংশে পরিবহন করতে হলে বাড়তি খরচ পড়ে। অন্যদিকে বেসরকারি চিনিকলগুলোর রিফাইনারি নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম ইত্যাদি অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ার কারণে প্রধান প্রধান ক্রয়কেন্দ্রে চিনি বিক্রি করতে পরিবহনে তুলনামূলক খরচ কম হয়। উৎপাদিত চিনি একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত গুদামজাত করে রাখা যায়। এরপর চিনি নষ্ট হতে থাকে। ফলে উৎপাদিত চিনি বিক্রি করতে হলে বেসরকারিভাবে আমাদানীকৃত চিনির সাথে প্রতিযোগিতামূলকভাবেই তা করতে হবে এবং প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য চিনি সরবরাহ, বিতরণ ও বিপণন ব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনতে হবে, প্রচার-প্রচারণার যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে। সাম্প্রতিককালে চিনি প্যাকেটজাত করে খুচরো বিক্রি করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা ব্যাপক আকারে লক্ষ করা যায়নি।
৪. সংকট থেকে উত্তরণের উপায়
৪.১ আাখ চাষ ও চাষির সমস্যার সমাধান
- আখচাষিকে আখ বিক্রির সাথে সাথে অর্থ পরিশোধ করতে হবে। এই লক্ষ্যে চিনিকলগুলোর জন্য বাজেটে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করতে হবে। পুর্জি বিতরণের সকল অনিয়ম বন্ধ করতে হবে।
- একরপ্রতি গড় ফলন বর্তমান ১৮-২০ টন থেকে ৩০ টনে উন্নীত করার জন্য বিদ্যমান উচ্চ ফলনশীল ও অধিক চিনিযুক্ত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন জাতের চাষাবাদ বাড়াতে হবে।
- চাষিদেরকে সময়মতো শোধিত বীজ, সার, কীটনাশক সরবরাহ করতে হবে। এক্ষেত্রে সকল অনিয়ম দূর করতে হবে।
- মিলের নিজস্ব জমি লিজ প্রদান না করে কারখানার নিজস্ব ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সঠিকভাবে আখ চাষের নজির স্থাপন করতে হবে।
- আখ রোপণ থেকে শুরু করে কর্তন পর্যন্ত যথাযথ কৃষি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে রোগমুক্ত সর্বোচ্চ ফলন নিশ্চিত করতে হবে।
- আখ কাটার সময় প্রথমে মুড়ি আখ, তারপর যথাক্রমে আগাম, মধ্যম ও নাবি আখ কাটতে হবে এবং আখ কাটার পর ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে মাড়াই সম্পন্ন করতে হবে। চিনিকল কর্তৃক আরও বেশি করে আখ সময়মতো পরিবহনের জন্য পর্যাপ্ত ট্রাক-ট্রেইলার-ট্রাক্টরের ব্যবস্থা করতে হবে।
- আখের আধুনিক জাত দীর্ঘস্থায়ী হয় না, নানা কারণেই দ্রুত রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে ফলন কমে যায়। ফলে বিএসআরআইকে ক্রমাগত নতুন নতুন জাত অবমুক্ত করতে হবে, যেন নিয়মিত প্রতিকূল পরিবেশে ভালো ফলন নিশ্চিত করা যায়। এই লক্ষ্যে বিএসআরআইর প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যা, যেমন-ফুল ফোটাতে সক্ষম প্যারেন্ট জাতের সংকট, ব্রিডিংয়ের ক্ষেত্রে আলো ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের সমস্যা ইত্যাদির সমাধান করতে হবে।
- চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের সাথে বিএসআরআইর সমন্বয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে (রহমান ও হক, ২০১৫ এবং রহমান ও অন্যান্য, ২০০২)।
৪.২ কারখানা ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ও প্রক্রিয়াকরণ অপচয় কমিয়ে চিনি আহরণের হার বৃদ্ধি
যেসব কারণে কারখানায় চিনি আহরণ কম হচ্ছে, চিনি বেশি অপচয় হচ্ছে, মাড়াইঘণ্টা বেশি নষ্ট হচ্ছে, জ্বালানি নষ্ট হচ্ছে এবং খরচ বেশি হচ্ছে, সেগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের জন্য সুনির্দিষ্ট প্রকল্প হাতে নিতে হবে এবং জাতীয় বাজেটে তার জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে। চিনিকলগুলোর ঋণ মওকুফ করে ঋণের সুদ পরিশোধের দায় থেকে অব্যাহতি দিতে হবে। নিয়মিত তদারকির মাধ্যমে কারখানার প্রসেস লস, অপচয় ও দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। কারখানাকেন্দ্রিক সমস্যা সমাধানের জন্য বিএসএফআইসির কতগুলো সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব রয়েছে, এগুলোর জন্য দ্রুত অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে। এর মাধ্যমে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় হবে, তার তুলনায় অর্থ তেমন বেশি নয়।
ছক ৪.১ : কারখানাকেন্দ্রিক সমস্যা সমাধানের জন্য বিএসএফআইসির কতগুলো সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব
ক্রম | বর্তমান সমস্যা | সমস্যা উত্তরণের কর্মপরিকল্পনা | সুফল |
১ | চিনিকলসমূহের বয়লার অতি পুরনো ও জরাজীর্ণ | আধুনিক প্রযুক্তির বয়লার প্রতিস্থাপন | ১৫% জ্বালানি সাশ্রয় |
২ | পুরনো মিল টারবাইন | মিল টারবাইন প্রতিস্থাপন | ১৫%-২০% স্টিম সাশ্রয় |
৩ | কেইন প্রিপারেশন ডিভাইস না থাকা | নতুন কেইন প্রিপারেশন ডিভাইস সংযোজন | রিকভারি হার ০.৩% বৃদ্ধি |
৪ | পুরনো টার্বো-অল্টারনেটর | নতুন টার্বো-অল্টারনেটর সংযোজন | স্টিম সাশ্রয় ২০% |
৫ | পুরনো মিলিং প্লান্ট | নতুন মিলিং প্লান্ট সংযোজন | স্টিম সাশ্রয় ২০% রিকভারি ০.৩% বৃদ্ধি |
৬ | পুরনো সেন্ট্রিফিউগাল মেশিন | আধুনিক সেন্ট্রিফিউগাল মেশিন সংযোজন | রিকভারি হার ০.১% বৃদ্ধি চিনির গুণগত মান উন্নয়ন |
সূত্র : বিএসএফআইসি, ২০১৪গ
৪.৩ কারখানার উপজাতের সর্বোচ্চ ব্যবহার
উৎপন্ন চিটাগুড়ের সর্বোচ্চ ব্যবহারের জন্য আরও কয়েকটি ডিস্টিলারি স্থাপন করতে হবে। এছাড়া চিটাগুড় ব্যবহার করে অ্যাসিটিক এসিড/ভিনেগার, মোলাসেস কুকিজ, বেকারস ইস্ট ইত্যাদি উৎপাদনের উদ্যোগ নিতে হবে। চিনিকলের বর্জ্য প্রেসমাড, ডিস্টিলারির বর্জ্য স্পেন্টওয়াশ এবং বেকারস ইস্ট প্লান্টের বর্জ্য থেকে বায়ো কম্পোস্ট বা জৈব সার প্লান্ট স্থাপন করা যায়।
- প্রতিটি কারখানায় জৈব সার উৎপাদন ইউনিট স্থাপন করতে হবে।
- কোজেনারেশনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে বাড়তি বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করতে হবে।
৪.৪ আখ মাড়াই মৌসুম ছাড়াও সারা বছর কারখানাকে কাজে লাগাতে হবে
- মাড়াই মৌসুম ছাড়াও সারা বছর যেন কারখানার জমি, অবকাঠামো, শ্রমশক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার হয় সেজন্য কারখানার জমিতে কৃষিভিত্তিক বিভিন্ন শিল্প স্থাপন করা যেতে পারে; যেমন-আম, আনারস, টমেটো, আলু ইত্যাদি প্রক্রিয়াকরণ কারখানা স্থাপন, ভোজ্য তেল শোধনাগার স্থাপন, মসলা উৎপাদন কারখানা ইত্যাদি।
- যেহেতু বিট বছরে দুইবার চাষাবাদ করা যায়, সেহেতু আখের সাথি ফসল হিসেবে বিট চাষাবাদ ও বিট থেকে রস আহরণের জন্য ডিফিউশন ইউনিট স্থাপন করা যেতে পারে। ফলে আখ মাড়াই মৌসুম শেষেও চিনিকল অলস থাকবে না এবং চিনির উৎপাদন খরচ কমে আসবে।
- চিনিকলের নিজস্ব জমিতে রিফাইনারি স্থাপন করে সারা বছর রিফাইন সুগার উৎপাদন করলে একদিকে চিনিকলগুলোর লোকসান কমবে, অন্যদিকে চিনির বাজারের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ বাড়বে।
- ২০১৩ সাল থেকে নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলে ৭৩.৪৭ কোটি টাকা ব্যয়ে কোজেনারেশন পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং সুগার রিফাইনারি স্থাপনের একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে বার্ষিক অতিরিক্ত ৪০ হাজার মেট্রিক টন রিফাইন্ড সুগার উৎপাদন ও ৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে চিনিকলের আয় বৃদ্ধি পাবে (বিএসএফআইসি, ২০১৪গ)। প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে এবং সকল চিনিকলের জন্য এ ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে।
৪.৫ চিনি আমদানি নিয়ন্ত্রণ ও চিনি বিক্রির উদ্যোগ
- দেশে চিনির চাহিদা ও রাষ্ট্রীয় চিনিকলগুলোর উৎপাদিত চিনির পরিমাণ মাথায় রেখে বেসরকারিভাবে আমদানীকৃত চিনির পরিমাণের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে হবে।
- রাষ্ট্রীয় চিনিকলগুলোর উৎপাদন ব্যয় হ্রাস করে প্রতিযোগিতার ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টার পাশাপাশি চিনি আমদানির ওপর পর্যাপ্ত শুল্ক আরোপের মাধ্যমে দেশীয় চিনিকলগুলোকে সুরক্ষা দিতে হবে। একই সাথে আমদানির ওপর শুল্ক আরোপ যদি চিনির মূল্য বৃদ্ধি করে তাহলে সরকারকে বাড়তি ভর্তুকি দিয়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ করতে হবে। নতুবা চিনি আমদানির ওপর কোটা আরোপ করে চিনি আমদানি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
- চিনির বিতরণ বিস্তৃত করার জন্য ডিলারদের পর্যাপ্ত প্রণোদনা দিতে হবে। চিনির দাম প্রায় সমপরিমাণ থাকলেও ডিলাররা সরকারি চিনি বিক্রির ক্ষেত্রে যেসব সমস্যার কারণে বেসরকারি চিনি বিক্রিতে উৎসাহিত বোধ করে সেসব সমস্যার সমাধান করতে হবে।
- চিনির সরবরাহ, বিতরণ ও বিপণন ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। বিপণন বিভাগের কর্মকর্তাদের সাথে সাক্ষাতে জানা গেছে, তারা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে বিপণনে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। আমদানিকারকরা র-সুগার আমদানির পর রিফাইন করে বিক্রির মাধ্যমে অধিক মুনাফা করার দরুন বিপণন ও বিতরণে অধিক ব্যয় করতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ত মিলগুলো তা পারে না। মিল থেকে উৎপাদিত চিনির গুণগত মান সম্পর্কে ভোক্তাদের অবহিত করার জন্য বিজ্ঞাপন একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি হলেও বিএসএফআইসি স্বাধীনভাবে কনগ্লোমারেটদের সাথে সরাসরি প্রতিযোগিতায় যেতে যথেষ্ট চেষ্টা করে না। সরকার সঠিকভাবে উদ্যোগী হলে বিপণন ও বিতরণে নতুন নতুন পদ্ধতি গ্রহণ সম্ভব।
৪.৬ প্রয়োজনীয় ভর্তুকি প্রদান
যেহেতু উৎপাদিত চিনি একটি নির্দিষ্ট সময়ের চেয়ে বেশিদিন গুদামে সংরক্ষণ করা যায় না, নষ্ট হয়ে যায়, তাই চিনিকলগুলোর উৎপাদন খরচ আমদানীকৃত চিনির সমপরিমাণ বা কাছাকাছি না হওয়া পর্যন্ত প্রয়োজনে লস দিয়ে হলেও বেসরকারিভাবে আমদানীকৃত চিনির সাথে প্রতিযোগিতা মূল্যেই চিনি বিক্রি করতে হবে। দেশীয় চিনিশিল্প ও আখচাষিদের বৃহত্তর স্বার্থে চিনিশিল্প টিকিয়ে রাখতে মধ্যবর্তী সময়টুকুতে সরকার এই লসের টাকাটা চিনিকলগুলোকে ভর্তুকি হিসেবে প্রদান করবে। প্রয়োজনে সরকার চিনিকলগুলোর কাছ থেকে উৎপাদিত চিনি ন্যায্য মূল্যে কিনে নিয়ে ভোক্তাদের কাছে ভর্তুকি মূল্যে বিক্রি করতে পারে। এতে একদিকে চিনিকলগুলো লসের হাত থেকে রক্ষা পাবে, অন্যদিকে চিনির বাজারে সরকারের পর্যাপ্ত নিয়ন্ত্রণ থাকবে। উল্লেখ্য, বিএসএফআইসির কৌশলগত কর্মপরিকল্পনা থেকে দেখা যায়, ২০০৬-০৭ অর্থবছর থেকে ২০১২-১৩ অর্থবছর পর্যন্ত চিনির উৎপাদন ব্যয় ও বিক্রয়মূল্যের পার্থক্যটুকু ভর্তুকি হিসেবে বিএসএফআইসিকে প্রদানের জন্য ১৬০৮.৯৭ কোটি টাকার দাবি পেশ করা হয়। এর মধ্যে ২০০৬-০৭ সালে ২৬.৩০ কোটি টাকা, ২০১২-১৩ সালে ১৭৫ কোটি টাকা ও ২০১৪-১৫ সালে ১৩৫ কোটি টাকা, অর্থাৎ মোট ৩৩৬.৩০ কোটি টাকা প্রদান করা হয়েছে। ২০১২-১৩ অর্থবছর পর্যন্ত দাবীকৃত অবশিষ্ট ১০ হাজার ২৭২.৬৭ কোটি টাকা অদ্যাবধি ছাড় করা হয়নি। এছাড়া সরকারি সিদ্ধান্ত অনুসারে আমদানীকৃত এবং স্থানীয় ক্রয়কৃত চিনির মোট ক্রয়মূল্যের সাথে সরকার নির্ধারিত বিক্রয়মূল্যের পার্থক্য ৪৭৯.৪৭ কোটি টাকা প্রদানের জন্যও দাবি পেশ করা হয়েছে। উক্ত অর্থ পরিশোধে সরকার কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এ দুই খাতে মোট সরকারের কাছ থেকে পাওনা ১৭৬২.১৪ কোটি টাকা অবিলম্বে ছাড় করতে হবে। (বিএসএফআইসি, ২০১৫গ)।
৫. উপসংহার
এই গবেষণায় দেখা গেছে, চিনিশিল্পের সংকটকে বহুদিন ধরে জিইয়ে রাখা হয়েছে। সংকটের কার্যকারণ ও এর সমাধান সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত হবার পরও তা নিরসনের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। মাঝে মাঝে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে সেগুলোও অব্যবস্থাপনা, ত্র“টিপূর্ণ বাস্তবায়নকৌশল এবং পরিকল্পনার সমন্বয়হীনতার জন্য কোনো কাজে আসেনি। সংকট নিরসনে সব সময়ই অর্থাভাব, বিনিয়োগের অপ্রতুলতা ও ক্রমবর্ধমান লোকসানের অজুহাত দেওয়া হয়েছে। একপর্যায়ে চিনি আমদানি উদারীকরণের মধ্য দিয়ে বিদ্যমান সংকট আরও ঘনীভূত করা হয়েছেÑঅবাধে আমদানি করা চিনির সাথে অসম প্রতিযোগিতায় পড়ে চিনিকলগুলো অবিক্রীত চিনি ও দেনার ভারে ডুবতে বসেছে। ভারতের সাথে উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে তুলনা করে এই গবেষণায় দেখা গেছে যে কাঠামোগত ও ব্যবস্থাপনাগত কিছু পরিবর্তন এনেই চিনিকলগুলোর উৎপাদনশীলতা বাড়ানো সম্ভব। শুধু সংরক্ষণমূলক বাজারনীতি গ্রহণের মধ্য দিয়ে চিনিশিল্পের এই সংকট নিরসন সম্ভব নয়। বাজার নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি চিনিকলগুলোর উৎপাদন, বিতরণ ও বিপণন প্রতিটি স্তরে পরিবর্তন এনেই এ শিল্পের সুরক্ষা সম্ভব। ভ্যাট বা শুল্ক আরোপের মতো ভোক্তা অধিকার ক্ষুণ্ণকারী পদক্ষেপের বদলে আমদানির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ ও এর পাশাপাশি উৎপাদনব্যয় হ্রাসের উদ্যোগ নিতে হবে।
তথ্যসূত্র
[কুলকামি] Kulkami (2009) Cane Sugar Manufacture in India Sugar Technologists’ Association of India, 2009)
[গনি] Osman Gani (2012) Challenges in Sustainability and Corporate Social Responsibility: The Sugar Industry in Bangladesh Prakruthi, India
[জয়পুরহাট চিনিকল] জয়পুরহাট চিনিকল (২০১৪) জয়পুরহাট চিনিকলের কার্য সম্পাদনী প্রতিবেদন, মৌসুম ২০১৩-১৪
[প্রথম আলো] প্রথম আলো, ১৯ অক্টোবর ২০১৫
[প্রথম আলো], প্রথম আলো, ১ আগস্ট ২০১৪
[এফএও] Food and Agriculture Organization of the United Nations, (2001) Sugar Processing and By-products of the Sugar Industry, Issue 144, By Antonio Valdes Delgado, Carlos de Armas Casanova.
[বণিক বার্তা] বণিক বার্তা, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৫
[বাংলাপিডিয়া] বাংলাপিডিয়া (২০১৪)
[বিএসএফআইসি] বিএসএফআইসি (২০১৫ক), পারচেজ ডিভিশন থেকে সরাসরি সংগৃহীত, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৫, অপ্রকাশিত
[বিএসএফআইসি] বিএসএফআইসি বাজেট ২০১৫-১৬ (২০১৫খ)
[বিএসএফআইসি] বিএসএফআইসিকে লাভজনক পর্যায়ে উনীত করার লক্ষ্যে কৌশলগত পরিকল্পনার সারসংক্ষেপ (২০১৫গ)
[বিএসএফআইসি] বিএসএফআইসি (২০১৪ক) চিনিকলগুলোর আধুনিকায়ন, অপচয়, দুর্নীতি রোধ এবং চিনিকলসমূহে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের সুযোগ সৃষ্টিসহ সারা বছর চালু রাখার পরিকল্পনা, বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন, জানুয়ারি ২০১৪
[বিএসএফআইসি] বিএসএফআইসি (২০১৪খ) বার্ষিক প্রতিবেদন ২০১২-১৩
[বিএসএফআইসি] বিএসএফআইসি প্রেজেন্টেশন (২০১৪গ), অপ্রকাশিত
[বিএসএফআইসি] বিএসএফআইসি বাজেট ২০১৪-১৫ (২০১৪ঘ)
[বিএসআরআই] ইক্ষু প্রযুক্তি হ্যান্ডবুক (২০১২) বিএসআরআই
[ভিএসআই] VSI (2013) Technical Performance of Sugar Mills in Maharashtra, Season 2012-13, 37th Annual Report 2012-13
[মুহাম্মদ] আনু মুহাম্মদ, আখ কাহিনী, সাপ্তাহিক বিচিত্রা, ১৯৮০
[রহমান ও হক] ড. এ বি এম মফিজুর রহমান ও মো. মাহবুবুল হক, বাংলাদেশে ইক্ষু উৎপাদন পরিস্থিতি এবং চিনি ও গুড়শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত ও টেকসই করার জন্য কৌশলপত্র, কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন, ২০১৫ (অপ্রকাশিত)
[রহমান ও অন্যান্য] ড. মো. শরিফুর রহমান, ড. এম এ সামাদ মিয়া ও ড. মু. খলিলুর রহমান, বাংলাদেশে ইক্ষুর চিনি আহরণ হার বৃদ্ধির প্রযুক্তিগত দিকসমূহ, বিএসআরআই, ২০০২।
[রংপুর চিনিকল] রংপুর চিনিকল (২০১৪) রংপুর চিনিকলের কার্য সম্পাদনী প্রতিবেদন, মৌসুম ২০১৩-১৪
[শর্মা ও কুমার] Chetan Sharma and Vikas Kumar (2015) Quantification of Sugar Content Loss in various Byproducts of the Sugar Industry by, International Journal of Advance Industrial Engineering, Vol. 3, No. 2 (June 2015)
[এসএএনডিআরপি] How Efficient is Maharashtra’s Sugarcane Crop? South Asia Network on Dams, Rivers, and People, SANDRP (2013)
[সিএজি] CAG (2005) Audit Report (Commercial), Tamilnadu for the Year 2004-05
392