পাটশিল্পের সংকট: কারণ ও তার প্রতিকার

সংবাদ সন্মেলন
পাটকল চিনিকল বিষয়ে সরেজমিন অনুসন্ধান ও গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলন-১

গত ২১ ডিসেম্বর, ২০২০ ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সর্বজনকথার আয়োজনে পাটকল চিনিকল বিষয়ে সরেজমিন অনুসন্ধান ও গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সংবাদ সম্মেলনে পাটকল বিষয়ে সরেজমিন অনুসন্ধান ও গবেষণার লিখিত প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন গবেষক ড. মাহা মির্জা। এখানে এই গবেষণা সারসংক্ষেপ পত্রটি প্রকাশ করা হলো। এছাড়া সংবাদ সম্মেলনে আখচাষ ও চিনিকল বিষয়ক অনুসন্ধান ও গবেষণার লিখিত প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোশাহিদা সুলতানা। এরপর সম্পূরক বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, পাটকল শ্রমিক আবদুল হালিম মিঠু ও চিনিকল শ্রমিক ফেরদৌস ইমাম। সবশেষে পাটকল চিনিকল সহ সামগ্রিক রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প ও রাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং সর্বজনকথার সম্পাদক আনু মুহাম্মদ।

এ বছর ২ জুলাই ২৫টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। করোনা মহামারির মধ্যে পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলোর সরকার যখন বিপুল প্রণোদনার মাধ্যমে মানুষের কর্মসংস্থান ধরে রাখবার চেষ্টা করছে বাংলাদেশ সরকার সেখানে মহামারির সুযোগ নিয়ে বিপুল জমিসহ রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো বেসরকারিকরন করার উদ্যোগ নিলো। এবং এই প্রক্রিয়ায় প্রায় ২৫ হাজার স্থায়ী ও ২৫ হাজার অস্থায়ী শ্রমিককে চাকুরিচ্যুত করা হয়েছে। যদিও সরকার থেকে আশ্বাস দেয়া হয়েছিল যে পাটকলগুলো দ্রুত খুলে দেয়া হবে, কিন্তু ইতিমধ্যেই ৬ মাস পার হয়ে যাওয়ার পরও এখন পর্যন্ত মিলগুলো খোলার ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। এছাড়া খুলনার খালিশপুর সহ দেশের বিভিন্ন মিলএলাকায় হাজার হাজার শ্রমিকের পাওনা টাকা পরিশোধ না করেই উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এখানে উল্লেখ্য, শ্রম আইনের ৩২ ধারায় স্পষ্ট উল্লেখ করা আছে যে, পাওনা পরিশোধ না করে কোনোভাবেই শ্রমিককে তার বাসস্থান থেকে উচ্ছেদ করা যাবেনা। অথচ আমরা দেখছি সরকার নিজেই শ্রম আইন লঙ্ঘন করছে।

লোকসানের কারণ সরকারের করণীয়

রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো বন্ধের কারণ হিসেবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যে প্রতিষ্ঠার ৪৮ বছরের মধ্যে ৪৪ বছরই পাটকলগুলো লোকসান করেছে। কিন্তু সরকার যা বলছেনা তা হলো, প্রতিষ্ঠার পর থেকে বা গত পাঁচ দশকে রাষ্ট্রীয় পাটকলগুলোতে নতুন কোনো বিনিয়োগ হয়নি। এবং যন্ত্রপাতি আধুনিকায়নে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। একদিকে, লোকসান ঠেকাতে পাটকল বন্ধ করে দেয়ার কথা বলা হলেও,  লোকসানের কারণসমূহ তলিয়ে দেখলেই বোঝা যায়, শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলেই লোকসানি মিলগুলোকে লাভজনক করা সম্ভব ছিলো। যেমন বিজেএমসির সাম্প্রতিক বার্ষিক প্রতিবেদনগুলোতে লোকসানের প্রধান কারণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে ‘সক্ষমতা অনুসারে উৎপাদন করতে না পারা’। এখন প্রশ্ন হচ্ছে পাটকলগুলো কেন তাদের সক্ষমতা অনুযায়ী উৎপাদন করতে পারছেনা?

বিজিএমসির ব্যাখ্যা নিম্নরূপ: 

  • দীর্ঘদিনেরপুরাতন মেশিনারিজ বিএমআরআই না করায় মেশিনের দক্ষতা হ্রাস পাওয়া।  
  • দক্ষস্পিনার ও তাঁতির অভাব
  • দক্ষমিস্ত্রির অভাবে মেশিনের  রক্ষণাবেক্ষণ না হওয়া। 
  • মেশিনারিজব্রেকডাউন
  • বিশ্ববাজারের চাহিদা অনুযায়ী পাটপণ্যের ডাইভার্সিফিকেশন না হওয়া।

খেয়াল করুন, এই সমস্যাগুলোর কোনটিই কিন্তু সমাধান অযোগ্য নয়। বর্তমানে ২২টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলে মোট তিন ধরণের তাঁত রয়েছে। হেসিয়ান, সেকিং এবং সিবিসি (এর মধ্যে হেসিয়ান তাঁত ৬২৩২ টি, সেকিং তাঁত ৩৬৯৬ টি এবং সিবিসি তাঁত ১০০০ টি।) আধুনিক স্বয়ংক্রিয় তাঁতের তুলনায় এই তাঁত সমুহের উৎপাদন ক্ষমতা এমনিতেই অনেক কম, তার উপর পুরাতন হয়ে যাওয়ায় এগুলির উৎপাদন ক্ষমতা আরও হ্রাস পেয়েছে। ২০১৯ সালে শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ বা স্কপ-এর পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, সংস্কার করার নামে অর্থ অপচয় না করে বরং বেশি উৎপাদন-ক্ষমতা সম্পন্ন আধুনিক ও স্বয়ংক্রিয় তাঁত বসালেই পাটকলগুলোর সক্ষমতা বাড়বে। স্কপের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে পুরোনো যন্ত্রপাতির বদলে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের একটি সুনির্দিষ্ট লিখিত প্রস্তাবও দেয়া হয়েছিল।

উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে স্কপের নির্দিষ্ট সুপারিশ

  • প্রথমধাপে ২৩২ পুরোনো হেসিয়ান তাঁতের পরিবর্তে  ৩০০০ স্বয়ংক্রিয় আধুনিক তাঁত বসাতে হবে (সম্ভাব্য মূল্য ৩০০ কোটি টাকা)।
  • দ্বিতীয়ধাপে ৬৯৬টি সেকিং তাঁতের পরিবর্তে ২০০০টি  আধুনিক স্বয়ংক্রিয় তাঁত  বসাতে  বসাতে হবে। 
  • তৃতীয় ধাপেস্পিনিং, ড্রইং, প্রিপারিং ও ব্যাচিং বিভাগের যন্ত্রপাতি আধুনিকায়ন করতে হবে। যেহেতু আধুনিকায়নের ফলে তাঁতের উৎপাদন অনেক বৃদ্ধি পাবে, তাই সেই বর্ধিত চাহিদা পূরণ করার জন্য প্রয়োজনীয় নতুন প্রি-ভিম এবং ভিম মেশিন প্রতিস্থাপন করতে হবে (সম্ভাব্য ব্যয় ১৫০ কোটি টাকা হতে পারে।)  
  • চতুর্থ ধাপেবর্ধিত উৎপাদন অব্যাহত রাখার জন্য ৬ মাসের পাটের মজুদ গড়ে তুলতে হবে (সম্ভাব্য খরচ ৩০০ কোটি টাকা)।
  • মেশিনারিজেরমেরামত,স্থাপন ও পরিবহনের জন্যে  ১৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখতে হবে। 
  • সংস্কার কর্মকাণ্ড চলাঅবস্থায় শ্রমিকদের সাময়িক কর্মহীন থাকার সময় চার মাসেশ্রমিকদের ৫০ ভাগ মজুরি দিতে হবে (১০০ কোটি টাকা।)   
  • বিজেএমসির সমুদয় ঋণ এককালীন পরিশোধ করতে হবে। 

অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, সবমিলিয়ে মাত্র ১০০০ থেকে ১২০০ কোটি টাকার একটি তহবিল গঠন করলেই রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা অনেকগুন বৃদ্ধি পেতো এবং প্রতি ইউনিটে উৎপাদন খরচ অনেক কমে আসতো। কিন্তু আমরা দেখলাম যে এতো বছরেও এই বহুল আলোচিত সমস্যাগুলোর সমাধানে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। বরং ১২০০ কোটি টাকার তহবিলের বদলে ৫০০০ কোটি টাকার বরাদ্দ দেয়া হলো পাটকলগুলো বন্ধ করে শ্রমিকদের গোল্ডেন হ্যান্ডশেক দেয়ার বাজেট হিসাবে। কাজেই এটা পরিষ্কার যে অর্থের সঙ্কট নয়, বরং সদিচ্ছার অভাবই পাটশিল্পের লোকসানের মূল কারণ। 

অনিয়ম  দুর্নীতি

পাটকল পরিচালনায়, পাট পরিবহনে এবং পাট কেনার বিভিন্ন স্তরে অনিয়ম এবং দুর্নীতির ঘটনাগুলো বহুল আলোচিত। প্রকল্প প্রধান থেকে শুরু করে জুট ম্যানেজার, জুট হেড, পাট চেজার, পাট সাপ্লাইয়ার-দের একটা বড় অংশই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত বলে দীর্ঘদিনের অভিযোগ আছে। দুর্নীতির কারণে পাটকলগুলোর ব্যবস্থাপনা খরচ বেড়ে যাওয়ায় লোকসানও বাড়ছে। অথচ আমরা দেখতে পাচ্ছি, ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কেউই এখনপর্যন্ত চাকরিচ্যুত হননি। বরং তারা নিয়মিত বেতন ওঠাচ্ছেন। বরং মাঝখান থেকে ৫০ হাজারের বেশি শ্রমিককে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।

কিছু বহুল আলোচিত অনিয়ম ও দুর্নীতির উদাহরণ:

  • পাট মন্ত্রণালয় থেকে সঠিক মৌসুমে পাট কেনার বরাদ্দ পাওয়া যায় না।
  • বেসরকারি মালিক কম দামে পাট কিনে গুদামজাত করে, আর বিজেএমসি মৌসুম চলে গেলে ইচ্ছাকৃত ভাবে বেশি দামে নিম্নমানের পাট কেনে।
  • শত শত বেল পাটের ভেতরে বালু এবং পানি দিয়ে ওজন বেশি দেখিয়ে বেশি দাম ধরা হয়।
  • যন্ত্রাংশ রক্ষণাবেক্ষণের খরচ দু-তিন গুণ বেশি দেখানো হয়।

বেসরকারিকরণের ফলে কি পাটশিল্পের সম্প্রসারণ হবে নাকি সংকোচন ঘটবে? 

বলা হচ্ছে রাষ্টায়ত্ত পাটশিল্প বেসরকারিকরণ করা হলে পাটশিল্পের আরো সম্প্রসারণ হবে এবং শ্রমিকদের কর্মসংস্থান বাড়বে! কিন্তু আমরা প্রশ্ন করতে চাই, ইতিপূর্বে যে রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানাগুলো  বেসরকারিকরণ করা হয়েছিল, সেগুলোর বর্তমান অবস্থা কি? নব্বইয়ের দশকে যেসব পাটকল বেসরকারি মালিকানায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল সেগুলোর অবস্থা কী? বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে আমরা ধারণা পাই যে বেসরকারিকরণের ফলে  কিছু কারখানার কর্মসংস্থান বাড়লেও, সামগ্রিক ভাবে কর্মসংস্থান বাড়ে এই যুক্তির পিছনে আদৌ কোনো বাস্তবতা নেই। ১৯৯৮ সালে বিশ্বব্যাংকের একটি সমীক্ষা-প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। এই প্রতিবেদনের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ হলো, খুব কম বেসরকারি উদ্যোক্তাই সরকারি পাটকল কিনে সেগুলো নতুন করে চালানোর ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন। বরং তাদের নজর ছিল পাটকলগুলোর জমি ও অন্যান্য সম্পদের দিকে (ইমপ্লিমেন্টেশন কমপ্লিশন রিপোর্ট, জেএসএসি, বিশ্বব্যাংক, ১৯৯৮, পৃষ্ঠা ৮)।

২০১০ সালে বাংলাদেশ প্রাইভেটাইজেশন কমিশন থেকে আরেকটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় (বেসরকারীকরণকৃত শিল্পপ্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত সমীক্ষা, ২০১০)। রিপোর্ট অনুসারে ১৯৯৩ থেকে ২০১০ পর্যন্ত ব্যক্তিমালিকানায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল দেশের প্রায় ৭৫টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান। পরবর্তীতে এর মধ্যে ৩১টিই প্রতিষ্ঠানই বন্ধ পাওয়া গেছে। অর্থাৎ প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছি কারখানাই আর চালানো সম্ভব হয়নি। বরং এসব ক্ষেত্রে সস্তায় জমি ও যন্ত্রপাতি লুট করা হয়েছে, অথবা পরিত্যক্ত জমি দেখিয়ে বিপুল ব্যাংকঋণ নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, বেসরকারিকরণের ফলে শিল্পের সম্প্রসারণ হবে, এই যুক্তির কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই।

ছবি ১: খালিশপুর মিলের চাকরিচ্যুত শ্রমিক সবজি বিক্রি করছেন। মিল গেইট এলাকায় দুপুর পর্যন্ত সবজি অবিকৃত থেকে যাচ্ছে।
 
 
 

রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের শ্রমিক বেসরকারিকরণের ফলে কী পাবেন? কি হারাবেন?

গত ৩ জুলাই এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী জানিয়েছিলেন যে, ২০১৪ সাল থেকে যে ৯ হাজার শ্রমিক অবসরে গেছেন তাদের প্রাপ্য সব বকেয়া পরিশোধ করা হবে এবং বর্তমানে কর্মরত প্রায় ২৫ হাজার শ্রমিকের প্রাপ্য বকেয়া মজুরি পরিশোধ করা হবে। এছাড়াও শ্রমিকদের গ্র্যাচুইটির টাকা পেনশনের সুবিধা সহ শতভাগ পরিশোধ করা হবে, এছাড়াও মিলগুলো পিপিপি অথবা লিজ মডেলে পুনরায় চালু করা হলে বর্তমান শ্রমিকরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজের সুযোগ পাবেন।

এখানে লক্ষণীয়, মন্ত্রী শুধুমাত্র কর্মরত স্থায়ী শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধের কথাই বলেছেন। অথচ এই মিলগুলোতে প্রায় ২৩ হাজার অস্থায়ী শ্রমিকও দীর্ঘদিন ধরে কাজ করেছেন- তাদের পাওনা পরিশোধের ব্যাপারে কোনো আশ্বাস দেয়া হয়নি, এবং তারা এখনপর্যন্ত পাওনা টাকা বুঝেও পাননি। পাটকলগুলো বন্ধের ৬ মাস পরেও আমরা দেখতে পাচ্ছি, স্থায়ী শ্রমিকদের একাংশ বকেয়া পাওনার অর্ধেক বুঝে পেলেও, একটি উল্লেখযোগ্য অংশ (এক চতুর্থাংশ) এখনো হাতে টাকা পাননি। ৮ হাজার দৈনিক শ্রমিক এখন পর্যন্ত জানেনও না, তাঁরা টাকা পাবেন কি না।

ছবি ২: বন্ধ অবস্থায় খালিশপুর জুট মিল। একসময় এই এলাকা শ্রমিকের কোলাহলে মুখরিত থাকতো।

আমরা যদি ধরেও নেই যে, বন্ধ হওয়া পাটকলগুলো পিপিপি মডেলে আবার চালু হবে এবং আগের কর্মরত শ্রমিকদেরই কর্মসংস্থান হবে, সেক্ষেত্রেও প্রশ্ন আসে শ্রমিকদের সেই কর্মসংস্থানের ধরণ কেমন হবে? তাদের মজুরি কত হবে? রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোতে শ্রমিকেরা যে ধরণের সুবিধাগুলো পেতেন, সেগুলো বহাল থাকবে কিনা? নাকি বর্তমানে বেসরকারি খাতের পাটকল শ্রমিকেরা যেভাবে অত্যন্ত স্বল্প মজুরিতে মানবেতর জীবনধারণ করতে বাধ্য হচ্ছেন, নতুন মডেলের পাটকলগুলোতে সেই পরিস্থিতিই তৈরী হবে?

মজুরি কমিশন ২০১৫ বাস্তবায়নের পর বিজেএমসি’র পাটকলগুলোতে শ্রমিকদের মজুরি (গ্রস স্যালারি) ৮৩০০ টাকায় উন্নীত করা হয় (এর সঙ্গে চিকিৎসা ভাতা, শিক্ষা ভাতা, আবাসন ভাতা এবং পরিবহন ভাতা মিলিয়ে শ্রমিকেরা প্রায় ১৪-১৫ হাজার টাকা ওঠাতে পারেন)। এটা বাঁচার মতো মজুরি নয়। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক ভাবে আমরা দেখছি যে শ্রমিকদের এই নূন্যতম মজুরিকেই  উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ার প্রধান কারণ হিসাবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। প্রচার করা হচ্ছে যে সরকারি মিলের শ্রমিকদের বেতন বেসরকারি শ্রমিকদের চেয়ে তিনগুন বেশি, এবং এ কারণেই পাট খাতের সার্বিক প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত  হচ্ছে। আমরা অনুসন্ধানে দেখেছি বেসরকারি পাটকলে মজুরি তারও তিনভাগের একভাগ। সরকার এই ভয়ানক মানবেতর মজুরিই কি স্থায়ী করতে চান?

শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণের কিছু নূন্যতম শর্ত থাকে। যেমন শ্রমিকের মাসিক খরচ  বিবেচনায় নিতে হয়। পুষ্টি ও সুষম খাদ্যের ব্যয় বিবেচনায় নিতে হয়। ২০১৮ সালে সিপিডির একটি গবেষণায়  দেখানো হয়েছে, কাঙ্ক্ষিত পুষ্টিহার মেটাতে একজন শ্রমিকের প্রতিমাসে ন্যূনতম মজুরি প্রয়োজন ১৭ হাজার ৮৩৭ টাকা। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে কোন যুক্তিতে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল শ্রমিকদের নূন্যতম মজুরিকে তিনগুন বেশি মজুরি হিসাবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে, বা অতিরিক্ত ‘উৎপাদন খরচ’ হিসাবে দেখানো হচ্ছে? বরং আমরা মনে করি সরকারের  উচিত ছিল বেসরকারি পাটকলের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বাড়িয়ে একটি সম্মানজনক স্কেল নির্ধারণ করে দেয়া।

ছবি ৩: ক্রিসেন্ট মিল কলোনিতে শ্রমিকের আবাসন

রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধ অবস্থায় পাট চাষিদের কী হবে?

পাটকলগুলো প্রতিবছর পাটচাষিদের উৎপাদিত পাটের একটা অংশ ক্রয় করে এবং তা কেনা হয় সরকারি নির্ধারিত মূল্যে। অর্থাৎ এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে কৃষকেরা উৎপাদিত পাটের ন্যায্যমূল্য পায়। বিজিএমসির পরিসংখ্যান  অনুসারে, কৃষকের কাছ থেকে সরকার যে পাট কেনে তা দেশের মোট উৎপাদনের ৮ থেকে ১০ শতাংশের মতো। যদিও এটি পাটকলগুলোর লক্ষমাত্রা এবং প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম এবং অনেক ক্ষেত্রেই দেরিতে পাট কেনার কারণে কৃষকেরা মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে পাট বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়, কিন্তু সরকারি পাটকলগুলো বন্ধ হয়ে গেলে, অর্থাৎ সরকার নির্ধারিত দামে পাট কেনা বন্ধ করে দিলে বর্তমানে কৃষকেরা কাঁচা পাটের যে নিশ্চিত দাম পান, সেটিও বন্ধ হয়ে যাবে। এই পরিপ্রেক্ষিতে দেশের পাটচাষিরা ভারতে পাট রফতানির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লে দেশি কাঁচাপাটের বাজার অনিশ্চয়তার মুখে পড়বে।  অর্থাৎ কাঁচা পাটের পুরো বাজারটিই বেসরকারি পাটকল ও পাট রপ্তানিকারকদের সিন্ডিকেটের দখলে চলে যাবে বলে আমরা মনে করি।  

স্থানীয় অর্থনীতির সঙ্কট

শুধু পাটকল চাষিই নয়, খুলনার পাটকল শ্রমিকদের  জীবিকার সঙ্গে  একটি গোটা অঞ্চলের স্থানীয় অর্থনীতি জড়িত। আমরা অনুসন্ধানে দেখেছি, পাটকলগুলো বন্ধের ফলে খালিশপুর এলাকার অসংখ্য মুদির দোকান, ভাতের হোটেল, আসবাবের দোকান, কাপড়ের দোকান সহ  নানা ধরণের  অসংখ্য ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আজ হুমকির মুখে। খালিশপুর এলাকার দোকানিদের সঙ্গে কথা বলে আমরা জানতে পারি, পণ্য বিক্রি প্রায় ৭০ শতাংশের নিচে কমে যাওয়ায়, বেশিরভাগ দোকানীরাই প্রায় ৫-৬ মাস ধরে দোকান ভাড়া দিতে পারছেননা।  এমন অবস্থায় এলাকার প্রায় কয়েক হাজার ক্ষুদ্র ও মাঝারি দোকানের কর্মচারীদের বেকার হয়ে পড়ার আশংকা দেখা দিয়েছে। অর্থাৎ পাটকল বন্ধ হওয়া মানে শুধু পঞ্চাশ হাজার পাট শ্রমিকের চাকরি  চলে যাওয়া নয়, বরং একটা গোটা অঞ্চলের স্থানীয় অর্থনীতি ধ্বংসের মুখে পড়া। 

ছবি ৪: মিল খুলে দেয়া এবং পাওনা পরিশোধের দাবিতে শ্রমিকদের সমাবেশ

“সরকার  কেন ব্যবসা করবে”?

একটি জনপ্রিয় প্রচলিত প্রশ্ন হলো, “সরকার  কেন ব্যবসা করবে”। সরকারের কাজ নাকি শুধু ব্যবসার পরিবেশ সৃষ্টি করা! অথচ, বাজার অর্থনীতির দেশগুলোতে  এরকম বহু খাত থাকে যেগুলো কৌশলগত কারণে সরকারের নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়, সরকারকে ড্রাইভিং ফোর্স হিসেবে কাজ করতে হয়- নইলে তা দেশি বিদেশি ব্যবসায়ি গোষ্ঠীর লুটপাটের ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়ায়। প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক নানা কারণেই পাট শিল্পে বাংলাদেশের অবস্থান তুলনামূলক সুবিধাজনক। বিশ্বের যে অল্প কয়েকটি দেশে উন্নতমানের পাট উৎপাদন হয় বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। পাটশিল্পের উপর একদিকে বিপুল সংখ্যক কৃষিজীবী ও অন্যদিকে বহু দক্ষ শ্রমিক জীবিকার জন্য নির্ভরশীল। এছাড়াও পরিবেশ বান্ধব পণ্য হিসেবে বিশ্ব বাজারে পাট ও পাটজাত দ্রব্যের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। এই বিপুল সম্ভাবনা কাজে লাগানোর জন্য প্রয়োজন কেবল রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা, যথাযথ ব্যবস্থাপনা, দুনীতি রোধ করা ও বৈচিত্রময় পাটজাত পণ্য উৎপাদন ও দেশে বিদেশে বাজারজাত করণ। এই কাজগুলো একটা দেশের পাবলিক সেক্টরের পক্ষেই করা সম্ভব, না পারার কোনোই কারণ নেই। তাছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল থাকা মানে এই নয় যে বেসরকারি পাটকলের বিকাশ রুদ্ধ করা। বেসরকারি পাটকলগুলোকে কেউ বাধা দিচ্ছে না উৎপাদন বাড়াতে বা বাজার বিস্তৃত করতে। তাহলে জনগণের ট্যাক্সের টাকায় গড়ে ওঠা রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর জমি ও যন্ত্রপাতি কেন বেসরকারি উদ্যোক্তাদের হাতে তুলে দিতে হবে?

বেসরকারি উদ্যোক্তারা চাইলেই পাটকল স্থাপন করতে পারেন এবং এবং রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের সাথে প্রতিযোগিতামূলক ভাবে পণ্য উৎপাদন করতে পারেন! কিন্তু অতীতের বেসরকারিকরণের অভিজ্ঞতা বলে,  টেন্ডার ও বিডিং প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির মাধ্যমে পাটকলগুলো কিনে নিয়ে তার জমি ও যন্ত্রপাতি লুণ্ঠনের ঘটনা ঘটেছে, শ্রমিক ছাটাই হয়েছে, বহু দক্ষ স্থায়ী শ্রমিক অস্থায়ী শ্রমিকের অনিশ্চিত জীবন বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন। রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো বেসরকারিকরণের মাধ্যমে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে বলে আমরা মনে করি।

এই পরিপ্রেক্ষিতে পাটশিল্প রক্ষায় আমাদের দাবির মূল দিকগুলো হলো:

১. রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে মিলগুলো অবিলম্বে খুলে দিয়ে উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি করার জন্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। 

২. সকল শ্রমিকের বকেয়া পাওনা অবিলম্বে পরিশোধ করতে হবে।   

৩. পাটশিল্পে লোকসান ও বিপর্যয়ের জন্য দায়ী, অনিয়ম এবং দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।   

 

[মূল গবেষণা প্রবন্ধ: কল্লোল মোস্তফা: রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধ কার স্বার্থে? সর্বজনকথা, ষষ্ঠ বর্ষ, চতুর্থ সংখ্যা। আগষ্ট-অক্টোবর, ২০২০।  এই লেখার সারসংক্ষেপ এবং সরেজমিন অনুসন্ধানের ভিত্তিতে মাহা মির্জা এই প্রতিবেদন উপস্থাপন করেছেন।]  

Social Share
  •  
  •  
  • 405
  •  
  •  
  •  
  •  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *