তাজরীন অগ্নিকাণ্ডের মামলার টাইমলাইন (২০১২-২০২৫): অপরাধী মালিকশ্রেণী কি আইনের উর্ধ্বে?

১২তম বর্ষ আগাম প্রকাশ

২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর আশুলিয়ার তাজরীন ফ্যাশনস গার্মেন্টস কারখানায় আগুন পুড়ে মারা যান শতাধিক শ্রমিক। মালিকের অবহেলার কারণে ঘটা এই কাঠামোগত হত্যাকাণ্ডের পর অবহেলাজনিত হত্যার অভিযোগে মালিক দেলোয়ারসহ আসামীদের বিরুদ্ধে যে মামলা হয় সেই মামলা আজও চলছে। এর মধ্যে পার হয়ে গেছে ১৩টি বছর! বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে শ্রমিকদের সহযোগিতা করার জন্য এই রাষ্ট্র আদৌ কোন দায় অনুভব করে কিনা এই মামলার টাইমলাইনটি সেই প্রশ্নটাকেই সামনে আনে। তাজরীনের এই মামলাটি শুরু থেকেই পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছেন শ্রমিক আন্দোলনের সাথে যুক্ত কয়েকজন গবেষক, সাংবাদিক, আইনজীবী, সংগীত শিল্পী, রাজনৈতিক কর্মী ও চলচ্চিত্রকার। তাদের পক্ষ থেকে এই মামলার টাইমলাইনটি তৈরি করেছেন সায়দিয়া গুলরুখশহীদুল ইসলাম সবুজ

আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে অবস্থিত তাজরীন ফ্যাশনস অগ্নিকাণ্ডের ১৩ বছর হল ২৪ নভেম্বর ২০২৫ তারিখে। তেরো বছর আগে এই ফ্যাক্টরিতে আগুন লেগে ১১৯ জন শ্রমিক পুড়ে মারা যান। আহত হয় আরও অর্ধশতাধিক শ্রমিক। পরবর্তীতে আহত শ্রমিকদের মধ্যে ৪ জন শারীরিক অসুস্থতাসহ নানা দুঃখকষ্টে মৃত্যুবরণ করেন।

এই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধান করার জন্য ঘটনার পরপরই সরকারি বিভিন্ন সংস্থা থেকে ২টি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। প্রতিটি অনুসন্ধানেই মালিক-কর্তৃপক্ষের শ্রমিক নিরাপত্তা বিষয়ে সার্বিক অবহেলার চিত্র তুলে ধরা হয়।

এর মধ্যে বিশেষভাবে উখেযোগ্য হল, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন। এই প্রতিবেদনের সুপারিশমালায় বলা হয়, “তাজরিন ফ্যাশন লিমিটিড-এ সংঘটিত এই মর্মান্তিক মৃত্যুর বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর। যা দেশে এবং বিদেশে ব্যাপকভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। আগুন লাগার বিষয়টি নাশকতা হতে পারে, তবে এত বিপুল মর্মান্তিক মৃত্যুর জন্য মালিকের অমার্জনীয় অবহেলাই দায়ী। এটি সুস্পষ্ট ভাবে অবহেলাজনিত মৃত্যু ঘটানোর অপরাধ। তাই তাজরীন ফ্যাশন লিমিটেড এর মালিককে দন্ড-বিধির ৩০৪ (ক) ধারায় আইনের আওতায় এনে বিচারে সোপর্দ করার সুপারিশ করা হল।” (তথ্যসূত্র: আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে অবস্থিত তাজরীন ফ্যাশন লিমিটিডে সংঘটিত মর্মান্তিক অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন, ১৭ ডিসেম্বর ২০১২ পৃ: ৪০)।

এই পরিপ্রেক্ষিতে মালিকসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে দুইটি মামলা করা হয়। একটি মামলা দায়ের করেন একজন নিখোঁজ শ্রমিকের ভাই। আশুলিয়া থানার পুলিশ বাদী হয়ে অপর মামলাটি দায়ের করে। আশুলিয়া থানার মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন তিন জন। আশুলিয়া থানার পুলিশ পরিদর্শক মো: মোস্তফা কামাল, সিআইডির সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মো: মনসুর আলী মন্ডল, সিআইডি পুলিশ-এর পরিদর্শক এ কে এম মহসীনউজ্জামান খান। তারা ২০১৩ সালের ২ ডিসেম্বর ৩২৩/৩২৫/৪৩৬/৩০৪/৩০৪-ক/৪২৭ দণ্ডবিধিতে সিএমএম কোর্টে অভিযোগপত্র দাখিল করে। সাক্ষী করা হয় ১০৪ জনকে।

পরবর্তীতে ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সালে অবহেলাজনিত হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত মালিক মো: দেলোয়ার হোসেনসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠিত হয় এবং সাক্ষ্য গ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু হয় ১ অক্টোবর, ২০১৫ তারিখে।

বিগত ১০ বছরে সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ৬৮টি তারিখ ধার্য ছিল। এই ৬৮ দিনের মধ্যে মাত্র ১০ দিন রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করেছে এবং অভিযোগপত্রে উল্লেখিত ১০৪ জনের মধ্যে এ পর্যন্ত মাত্র ১৪ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়।

সাক্ষ্য গ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর থেকে আমরা শ্রমিক আন্দোলনের সাথে যুক্ত কয়েকজন গবেষক, সাংবাদিক, আইনজীবী, সংগীত শিল্পী, রাজনৈতিক কর্মী ও চলচ্চিত্রকার মামলাটির কার্যক্রমকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছি। বিচার প্রক্রিয়াটিকে আমাদের প্রতিবাদী নজরদারিতে রাখার তাগিদ থেকে প্রত্যেকটি সাক্ষ্য-শুনানিতে উপস্থিত থেকেছি। বছরের পর বছর আদালতে আসা-যাওয়া এবং সংশ্লিষ্ট অনেকের সাথে কথা বলার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আমরা মনে করি বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতার পেছনে মামলাটি পরিচালনার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষের দায়সারপনা দায়ী।

কারখানার মালিক ও  দৈনন্দিন পরিচালনার সাথে যুক্ত ব্যক্তিদের শ্রমিক নিরাপত্তার প্রশ্নে অবহেলার কারণে একশত উনিশ জনের অধিক শ্রমিক জ্বলেপুড়ে অঙ্গার হয়ে গেলো, কিন্তু দোষীদের বিচারের মুখোমুখি করতে রাষ্ট্রপক্ষের যে অবহেলার চিত্র আমরা পর্যবেক্ষণ করলাম তা এই বিচার ব্যবস্থার শ্রেণীচরিত্রেরই পরিচায়ক। বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্রপক্ষ মামলার সাক্ষী, তাজরীনের ভুক্তভোগী শ্রমিকদের সাক্ষ্য দেয়ার ক্ষেত্রে অনীহার কথা বলেছেন। তবে ভুক্তভোগী শ্রমিকদের সাথে কথা বলে আমাদের মনে হয়েছে, এ অনীহা এই ব্যবস্থার সাথে শ্রমিকের শ্রেণীগত দূরত্বের স্মারক।

কারখানার মালিক ও  দৈনন্দিন পরিচালনার সাথে যুক্ত ব্যক্তিদের শ্রমিক নিরাপত্তার প্রশ্নে অবহেলার কারণে একশত উনিশ জনের অধিক শ্রমিক জ্বলেপুড়ে অঙ্গার হয়ে গেলো, কিন্তু দোষীদের বিচারের মুখোমুখি করতে রাষ্ট্রপক্ষের যে অবহেলার চিত্র আমরা পর্যবেক্ষণ করলাম তা এই বিচার ব্যবস্থার শ্রেণীচরিত্রেরই পরিচায়ক।

নিহত শ্রমিকের আত্মীয়-পরিজনকে আমরা অনেক সময় বলতে শুনেছি, “বড়লোকের আদালতে গরীবের জীবনের কি দাম আছে, কিসের বিচারের আশা! মালিকের কি বিচার হয়?” একই উপলব্ধি থেকে নিখোঁজ শ্রমিকের ভাই তার দায়ের করা মামলাটি থেকে বিচারের আশা ছেড়ে দেন। তাঁদের এই প্রবঞ্চনার বোধের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে আমরা আরও যুক্ত করতে চাই যে, মালিক শ্রেণীর/কর্পোরেট শ্রেণীর অপরাধ (যেমন, কারখানার পরিচালনায় অব্যবস্থাপনার কারণে শ্রমিকের মৃত্যু, মজুরি চুরি, ট্যাক্স ফাঁকি) চিহ্নিত করা এবং এ ধরণের অপরাধের বিচার করার জন্য এই রাষ্ট্রব্যবস্থা অপ্রস্তুত ও অনাগ্রহী।

মালিক শ্রেণীর/কর্পোরেট শ্রেণীর অপরাধ (যেমন, কারখানার পরিচালনায় অব্যবস্থাপনার কারণে শ্রমিকের মৃত্যু, মজুরি চুরি, ট্যাক্স ফাঁকি) চিহ্নিত করা এবং এ ধরণের অপরাধের বিচার করার জন্য এই রাষ্ট্রব্যবস্থা অপ্রস্তুত ও অনাগ্রহী।

রাষ্ট্রপক্ষের দায়সারাপনা ফুটে ওঠে সাক্ষ্যগ্রহণ প্রক্রিয়ার বিবরণে

মালিক শ্রেণীর অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে অনুশীলিত রাষ্ট্রপক্ষের দায়সারাপনাকে নিম্নে বর্ণিত সাক্ষ্য গ্রহণ প্রক্রিয়ার বিবরণ জলের মতন স্পষ্ট করে।

১ অক্টোবর ২০১৫: রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি।

১ নভেম্বর ২০১৫: রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি।

১০ জানুয়ারী ২০১৬: একজন সাক্ষী হাজির হয়। এই মামলার মূল বাদী, আশুলিয়ার থানার তৎকালীন পুলিশ কর্মকর্তা আদালতে তার সাক্ষ্য দেন। তার সাক্ষ্যের মধ্য দিয়ে সাক্ষ্য গ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু হয়।

৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬: রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি।

১০ এপ্রিল ২০১৬: অগ্নিকাণ্ডের দিন কারখানায় কর্মরত দুই জন শ্রমিক সাক্ষ্য প্রদান করেন।

৮ মে ২০১৬: রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি।

৫ জুন ২০১৬: রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি।

১১ জুলাই ২০১৬: রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি।

১৩ আগস্ট ২০১৬: রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি।

২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬: রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি।

১৩ নভেম্বর ২০১৬: রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি।

২৯ জানুয়ারি ২০১৭: আদালতে তাজরীন অগ্নিকাণ্ডের একজন আহত শ্রমিক সাক্ষ্য দিয়েছেন। রাষ্ট্রপক্ষ, আসামিপক্ষের সকল উকিলের কটাক্ষ উপেক্ষা করে তিনি তার বয়ান দেন, বার বার নানাবিধ অযৌক্তিক প্রশ্ন করে তার বয়ানকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করা হলেও তিনি তার বক্তব্যে অটল ছিলেন।

২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭: রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি।

২ এপ্রিল ২০১৭: রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি।

১৪ মে ২০১৭: রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি।

৭ জুলাই ২০১৭: একজন সাক্ষী হাজির হন। ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ কিছু পুড়ে যাওয়া কাপড়, কয়লা, কাগজপত্র মামলার তদন্তের জন্য আলামত হিসেবে সংগ্রহ করেছিল। এই জব্দ তালিকায় সাক্ষী হিসেবে সই করেছিলেন উপস্থিত সাক্ষী।

১৩ অগাস্ট ২০১৭: রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি।

৮ অক্টোবর ২০১৭: আসামি পক্ষের প্রধান উকিল মারা যাওয়াতে তারা পরবর্তী শুনানির তারিখ ৩ মাস পরে দেয়ার আবেদন করে।

৮ নভেম্বর ২০১৭: রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি।

১১ জানুয়ারি ২০১৮: রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি। বিচারক রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীকে বলেন, সাক্ষী হাজির করতে পারছেন না, এই মর্মে একটা দরখাস্ত আদালতে জমা দেন ।

২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮: ঢাকা বারের নির্বাচনের কারণে আদালত বসেনি।

২২ এপ্রিল ২০১৮: রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি।

২০ জুন ২০১৮: রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি। জামিনে থাকা তিনজন আসামী হাজিরা দেয়নি বলে তাদের নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করার আদেশ দেন আদালত।

৩০ জুলাই ২০১৮: রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি। ১৯শে মে, ২০১৩ তারিখে দেয়া উচ্চ আদালতের এক আদেশের প্রেক্ষিতে অভিযুক্ত তাজরীন কারখানার মালিক মো: দেলোয়ার হোসেনের পাসর্পোট জব্দ করা হয় ও তার বিদেশ ভ্রমনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। অভিযুক্ত মালিকের আইনজীবীরা এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার জন্য আদালতে একটি আর্জি পেশ করেন।

১১ সেপ্টেম্বর ২০১৮: রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি।

১৬ অক্টোবর ২০১৮: বিচারক পূজার ছুটিতে থাকায় আদালত বসেনি।

২৭শে নভেম্বর ২০১৮: রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি।

১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯: বিচারক ছুটিতে থাকায় আদালত বসেনি।

৭ মার্চ ২০১৯: প্রায় দুই বছর পর রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করে। সাক্ষ্য দেন সাভার থানার এস আই আবিদ হোসেন। তিনি ঘটনাস্থলে পাওয়া শ্রমিকদের লাশের সুরতহাল তৈরি করেছিলেন।

৭ এপ্রিল ২০১৯: রাষ্টপক্ষ সাক্ষী হাজির করে নাই। তবে অভিযুক্ত মালিকের জব্দকৃত পাসপোর্ট ফেরত চেয়ে করা আবেদনের বিষয়টি উত্থাপিত হয়, আদালত এ বিষয়ে আদেশ পরবর্তীতে দিবেন বলে জানান।

৮ মে, ২০১৯: রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করার জন্য সময় চেয়ে আবেদন করে এবং সেই আবেদন গৃহীত হয়। প্রধান অভিযুক্ত কারখানার মালিক দেলোয়ার হোসাইন পাসপোর্ট ফেরত চেয়ে যে আবেদন করেছিলেন সে বিষয়ে বিচারক বলেন, এটি তার এখতিয়ারের বাইরে এবং তিনি আসামীকে উচ্চ আদালতে আবেদন করতে বলেন।

২৫ জুন ২০১৯: রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি।

৪ অগাস্ট ২০১৯: রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি।

২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯: রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি।

৭ নভেম্বর ২০১৯: রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারে নাই। তাজরীন ফ্যাশনসের মালিক মো: দেলোয়ার হোসেন জব্দ করা পাসপোর্ট ফেরত চেয়ে যে আবেদনটি করেছিলেন তা আমলে নিয়ে শুনানি শেষে শোনা যায় বিচারক এমন আদেশ দিয়েছেন যে মো: দেলোয়ার হোসেন তার সন্তানদের পাসপোর্ট আদালতে জমা দেয়ার শর্তে নিজের পাসপোর্ট ফেরত পাবেন এবং বিদেশ যেতে পারবেন। উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ১৯শে মে হাই কোর্ট মালিকের বিদেশ যাওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে পাসপোর্ট আদালতে জমা দেয়ার আদেশ দিয়েছিলেন। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীর সহকারি তাৎক্ষনিকভাবে আদেশ দেয়া হয়েছে বলে জানালেও, পরে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মো: মুর্শিদ উদ্দিন খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মামলার অন্যতম আসামি প্রতিষ্ঠানের মালিক দেলোয়ার হোসেন ও চেয়ারম্যান মাহমুদা আক্তারের জব্দ পাসপোর্ট পাওয়ার আবেদন করেন তাদের আইনজীবী। তবে বিচারক এ বিষয়ে এখনও কোনও আদেশ দেয়নি।’ (তথ্যসূত্র: তাজরীন গার্মেন্টসে অগ্নিকাণ্ড, পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণ ২০ জানুয়ারি; বাংলা ট্রিবিউন, ৭ই নভেম্বর ২০১৯)।

৩০ জানুয়ারি ২০২০: বিচারক উপস্থিত না থাকায় সাক্ষ্য গ্রহণ হয়নি।

৩১ মার্চ ২০২০: কোভিড মহামারীজনিত সাধারণ ছুটি থাকায় আদালত বসেনি।

১৫ অক্টোবর ২০২০: বিচারক অনুপস্থিত থাকার কারণে আদালত বসেনি। অগ্নিকাণ্ডে আহত শ্রমিকদের অনেকে যারা গত ৩৪ দিন যাবৎ সম্মানজনক ক্ষতিপূরণের দাবিতে প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থান ধর্মঘট করছেন তারা আদালতে উপস্থিত ছিলেন।

১৩ জানুয়ারি ২০২১: প্রায় দেড় বছর ধরে রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে না পারছে না এই কারণ উল্লেখ করে, আসামি পক্ষের উকিল মামলা খারিজ করার জন্য মৌখিকভাবে আবেদন করলে আদালতে উপস্থিত শ্রমিকদের একজন বলেন, “মহামান্য আদালত আমরা সাক্ষী কিনা জানিনা, কিন্তু আমরা তাজরীনের আহত শ্রমিক, শুনানির খবর পেয়ে এসেছি, আমরা সাক্ষ্য দিতে চাই।” বিচারক তাদের উপস্থিতি আমলে নিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের কৌসুলিকে সাক্ষ্য তালিকায় উপস্থিত শ্রমিকদের নাম আছে কিনা যাচাই করে দেখতে বলেন। উপস্থিত শ্রমিকদের মধ্যে একজনের নাম তালিকায় পাওয়া গেলে তার সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। মালিকপক্ষের উকিলসহ আসামী ও অন্যান্যরা উপস্থিত শ্রমিকদেরকে এজলাসের বাইরে ও ভেতরে নানা ভাবে হয়রানি করে।

২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১: রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি। আদালতে উপস্থিত আহত শ্রমিকদের উদ্দেশ্য করে মালিককে বলতে শোনা যায়, “টাকা দিয়ে সাংবাদিক নিয়ে আসবো, প্রমাণ করবো যে উপস্থিত শ্রমিকরা কেউ আমার কারখানার না।” উপস্থিত শ্রমিকগণ আদালতপাড়ায় এই উস্কানিতে আক্রান্ত বোধ করলেও সাড়া দেয়নি।

২৭ মে ২০২১: কোভিড মহামারীজনিত সাধারণ ছুটি থাকায় আদালত বসেনি।

২৭ অক্টোবর ২০২১: কোভিডজনিত দীর্ঘ স্থিতাবস্থা শেষে সাক্ষ্য শুনানির শুরু হওয়ার কথা থাকলেও ঢাকা বারের জ্যেষ্ঠ আইনজীবি আব্দুল বাসেত মজুমদারের মৃত্যুতে শোক জানিয়ে আদালতের সকল কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়।

১৮ মে ২০২২: তাজরীনের দুজন শ্রমিক মিরাজুল ও হালিমা সাক্ষী দিতে আদালতে হাজির হন। বিচারকার্য চলাকালীন সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা দুজন সাক্ষী হাজিরার কথা বিচারককে অবহিত করে জানতে চান, আজ সাক্ষ্য শুনানি হবে কিনা? বিচারক মহোদয় বলেন, এই মামলায় সাক্ষী এমনিতেই গরহাজির! আজ যেহেতু দুজন উপস্থিত হয়েছেন, অবশ্যই শুনানি হবে।

এই মামলার ১৩ জন আসামির মধ্যে প্রধান আসামী কারখানার মালিক দেলোয়ার হোসেন ও তার স্ত্রী মাহামুদা আখতারসহ ৯ আসামীর উপস্থিতিতে শুনানি শুরু হয়। [একজন আসামী মামলা বিচারাধীন কালে মারা যান।] বিচারক মিরাজুলকে সাক্ষ্য দিতে আগে কাঠগড়ায় ডাকলেন এবং হালিমাকে বিচার কক্ষের বাইরে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। তিনি মিরাজুলকে নাম ও ঠিকানা বলতে বললেন। তারপরে জিজ্ঞেস করলেন, ঐদিনের [তাজরীন অগ্নিকাণ্ডে দিনের] ঘটনা সম্পর্কে কি জানেন? মিরাজুল বলতে শুরু করলে, বিচারক মহোদয় বুঝতে পারলেন কোথাও ভুল হচ্ছে। কারন সাক্ষী নিজের নাম বলছেন, মিরাজুল আর বিচারক মহোদয় বলছেন সিরাজুল। এই বিভ্রাটের কারনে মিরাজুলের সাক্ষ্য গ্রহণ সাময়িক বন্ধ রেখে সংশ্লিষ্ট কর্মীকে নাম সংশোধন করে অপর সাক্ষী হালিমাকে বিচারকক্ষে ডাকা হল।

হালিমা বিচারকের ডানদিকে লালসালুতে মোড়ানো কাঠগড়ায় এসে দাঁড়ালেন। তাকে শপথনামা পড়ানো হলো, “যাহা বলিব সত্য বলিব, সত্য বই মিথ্যা বলিব না।” এবার আরেক বিভ্রাট। হালিমাকে আসামী পক্ষের [ফ্যাক্টরি ম্যানেজারের] যেই আইনজীবী জেরা করবেন তিনি অন্য মামলা পরিচালনার কাজে আরেকটি কোর্টে আছেন। সেই আইনজীবীর অপেক্ষায় হালিমাকে আবার বিচারকক্ষের বাইরে পাঠানো হয়।

বিচারকের নির্দেশে মিরাজুল শপথনামা শেষ করে নিজের নাম ঠিকানা বললেন। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা সম্পর্কে প্রশ্নের জবাবে তিনি জানালেন, “আমি পাঁচ তলায় কাজ করতাম। লাইন সুপারভাইজার ছিলাম। কারখানার মালিক দেলোয়ার স্যার বিকেল ৫টা পর্যন্ত কারখানায় ছিলেন। বিভিন্নজনের সাথে মিটিং করেছেন। তিনি চলে যাওয়ার পর ঐদিন সন্ধ্যা ৬টা থেকে ৭টার মধ্যে আগুন লাগে। আমি ৫তলায় নিজের লাইনে কাজে ব্যস্ত ছিলাম। হঠাৎ নিচের ফ্লোর থেকে আগুন আগুন চিৎকার, চিল্লা-চিল্লি শুনতে পাই। সাথে গরম ধোঁয়া। ফ্লোরের সবাই বুঝে ফেলে আগুন লাগছে। আমি সবাইকে বলি যে যার মত বাঁচতে চেষ্টা কর। ততক্ষণে ধোঁয়ার সাথে আগুন ৫তলায় পৌছে গিয়েছে। [এখন] জানলা দিয়ে লাফ দিয়ে জীবনের তরে পঙ্গু” (ঝুলে থাকা ভাঙা হাত দেখিয়ে বলেন)।

মিরাজুলের সাক্ষ্য গ্রহণের শেষ দিকে আসামী পক্ষের আইনজীবী মহোদয় আদালতে ফিরে আসলেন। হালিমাকে আবার ডাকা হলো। হালিমা তিন তলায় কোয়ালিটি ইনস্পেক্টরের কাজ করতেন । যথারীতি বিচারকের নির্দেশে নাম ঠিকানা বলার পর, একই প্রশ্নের জবাবে হালিমা জানালেন, আগুন লাগে ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর, সময় আনুমানিক পৌনে ৭টা। তিনি বলেন, “হঠাৎ নিচের দিক থেকে হৈ চৈ শুনতে পাই। আমরাও আতঙ্কের মধ্যে জানতে চাই কি হইছে? উপস্থিত ফ্যাক্টরি ম্যানেজার আমাদের বলেন, কিছু হয় নাই, সব ঠিক আছে, তোমরা কাজ কর। আমরা কাজ চালু রাখি। এর মধ্যে আগুন আগুন চিৎকার আরও বাড়তে থাকে। ধোঁয়ার সাথে আগুন আমাদের ফ্লোরের সিঁড়ি দিয়ে দাউ-দাউ করে উপরে ধেয়ে আসতে থাকে। চারদিক ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে যায়। নিচে নামতে গিয়ে গেট তালাবন্ধ পাই। সবাই বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার দিয়ে যে যার মত বাঁচতে চেষ্টা করি। আগুনের তাপ আর ধোঁয়ায় জ্ঞান হারাবার মতন পরিস্থিতি। সবাই মিলে জানালা ভেঙে নিচে লাফ দেই, জীবনটা বাঁচে, কিন্তু চিরতরে পঙ্গু হয়ে যাই।”

এবারে ফ্যাক্টরি ম্যানেজারের পক্ষে তার আইনজীবী জেরা করা শুরু করেন [যেটি ছিল প্রায় হুংকারসম] – “আপনি মিথ্যা সাক্ষী দিচ্ছেন! এখানে কখন এসছেন? কার কার সাথে কথা বলেছেন? আগে কখনো এখানে [আদালতে] আসছেন? কার কার সাথে আলোচনার ভিত্তিতে মিথ্যা সাক্ষী দিলেন?”

২১ জুন ২০২২: রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি।

২৮ আগস্ট ২০২২: রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি।

৪ অক্টোবর ২০২২: রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি।

১ জানুয়ারি ২০২৩: রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি।

২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩: রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি।

৩০ মে ২০২৩: রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি।

১৯ জুলাই ২০২৩: রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি।

৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩: রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি।

১ নভেম্বর ২০২৩: রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি।

২৫ মার্চ ২০২৪: পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের নির্ধারিত তারিখ।

২৯ এপ্রিল ২০২৪:  রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি।

২ জুন ২০২৪ : রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি।

৮ জুলাই ২০২৪ : রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি।

১৯ অগাস্ট ২০২৪ : রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি।

১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ : ঢাকা জেলা আদালতের দ্বিতীয় তলায়, ১ম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ জনাব সফিকুল ইসলামের আদালতে শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। ৭/৮ টি মামলার শুনানির পরে এই মামলার সাক্ষ্য শুরু হয়। মালিকসহ আসামিপক্ষের ১৩ জনের মধ্যে ৮ জনকে আদালতে হাজির করা হয়। বরাবরের মতন আসামিদের হাজিরা গ্রহণের পরে পরবর্তী তারিখ ঘোষণা করতে যাচ্ছিলো। এর মধ্যেই তাজরীনের একজন শ্রমিক মালা (ছদ্মনাম) সরকারি আইন কর্মকর্তার (পাবলিক প্রসিকিউটর/পিপি) টেবিলের পাশে বসা দুইজন আইনজীবীর দিকে এগিয়ে গিয়ে বলেন, তিনি এই মামলার সাক্ষী হিসেবে হাজির আছেন। আইনজীবী দু’জন বিচারকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে মালাকে দেখিয়ে বলেন, একজন সাক্ষী হাজির আছেন। পিপি তখনও আদালতে অনুপস্থিত। দীর্ঘদিন পর একজন সাক্ষী হাজির দেখে বিচারক একটু আশান্বিত হলেন। তিনি মালাকে জিজ্ঞেস করলেন তার নিজের নাম, মাতা, পিতার নাম ও দেশের বাড়ি কোথায়, এখন কোথায় থাকে ইত্যাদি। মালার উত্তরের সাথে মামলার নথি মিলিয়ে দেখলেন।

এ সময় আসামিপক্ষের আইনজীবীরা একটু আপত্তি তুলছিলেন, কারণ মালার কাছে ঐ কারখানার আইডি কার্ড বা জাতীয় পরিচয় পত্র ছিলো না। মালা জানায়, কারখানার আইডি কাজে ঢোকার সময় গেটে রেখে দেয়া হয়, সংশ্লিষ্ট বিভাগ জমা রেখেছিলেন, সেখানেই পুড়ে গেছে। বিচারক বললেন, তা না থাকুক কিন্তু ওর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হবে, কারণ শ্রমিকের নাম, মাতা ও পিতার নামের সাথে মিল আছে। সাক্ষ্য শুনানিতে যেহেতু সময় লাগে, তাই তিনি অন্য মামলা শুনে তাজরীনের মামলায় আবার ফিরে আসবেন জানিয়ে মালাকে পিপি সাহেবের পাশের সিটে বসতে বললেন, আসামিদেরকেও পরে আসার জন্য বললেন।

১২টার দিকে সাক্ষী, আসামি দুপক্ষকেই কাঠগড়ায় ডাকা হয়। বিচারক আবার মালার নাম, ঠিকানা, পিতার নাম লিখে নিলেন। তারপরে কত তলায় কাজ করতেন, আগুন লাগার দিন তারিখ সময় বছর ইত্যাদি জানতে চাইলেন। মালা সব ঠিকঠাক জবাব দিলেন। এরপর কি কাজ করতেন, পদবী কি ছিল, আগুন লাগার সময় কত তলায় ছিলেন, কিভাবে বের হলেন, সিঁড়ি দিয়ে না নেমে কেন জানালা দিয়ে লাফ দিলেন জানতে চাইলেন। সিঁড়ি দিয়ে না নেমে কেন জানালা দিয়ে লাফ দিলেন এই প্রশ্নের উত্তরে মালা জানান, আগুন লাগার পরও কারখানার ফ্লোর ম্যানেজার ধাপের স্টাফরা আগুনে লাগে নাই বলে শ্রমিকদের কাজে মন লাগাতে বলে। তারা বলে, এটা ফলস এলার্ম। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিদ্যুৎ চলে যায়, আগুনের তাপ ও ধোঁয়ায় ফ্লোর অন্ধকার হয়ে যায়। প্রাণ বাচাঁতে নিচে এসে দেখে কেসি (কলাপসিবল) গেইটে তালা লাগানো। তারা বের হতে না পেরে আবার তৃতীয় তলায় ফিরে যায়। ধোঁয়া, অন্ধকার, আগুনের তাপের মধ্যেই তারা নারী, পুরুষ শ্রমিক সবাই মিলে জানালা, এক্সস্ট ফ্যান ভেঙ্গে বের হওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। তৃতীয় তলা থেকে লাফ দিয়ে জানে বাঁচলেও মালার ডান হাত কয়েক জায়গায় ভেঙ্গে যায়, পেটের ভেতর রড ঢুকে যায়। লাফ দিয়ে পড়ে মালা অজ্ঞান হয়ে যান, কে তাকে হাসপাতালে নিয়েছে, কোথায় নিয়েছে তিনি তা বলতে পারবেন না। আশুলিয়া ও ঢাকার হাসপাতালে তার দীর্ঘদিন চিকিৎসা হয়।

মালার বক্তব্য শেষে বিচারক আসামীপক্ষের আইনজীবীদের জেরা করার অনুমতি দেন। বিচারক যে সকল প্রশ্ন করেছিলো, সেই প্রশ্নের উত্তরকে চ্যালেঞ্জ/খন্ডন করে তারা মালাকে প্রশ্ন করতে শুরু করেন। শুরুতেই মালার কাছে যেহেতু কারখানার আইডি নেই তাই সে তাজরীনের শ্রমিক নয় এবং কখনও কাজ করেনি বলে তার সাক্ষ্য মিথ্যা ইত্যাদি বলতে থাকেন। আসামীপক্ষের আইনজীবীরা আরও বলেন, আগুন লাগার কথা লুকানো হয়নি, নীচতলার কেসি গেইটে তালা ছিলো না, মালা মিথ্যা বলছে। তারা দাবি করেন, মালা তাজরীন অগ্নিকাণ্ডে আহত হয়নি, কোথাও সড়ক দুর্ঘটনায় বা অন্য কোনও দুর্ঘটনায় হাত-পা ভাঙ্গছে, এখন কিছু টাকা পয়সার লোভে কোর্টে এসে মিথ্যা সাক্ষী দিচ্ছেন। মালা আসামীপক্ষের প্রতিটি প্রশ্নের উত্তরে বলেন, আপনি সঠিক বলছেন না।

মালার কথা শেষ হলে হঠাৎ দেখা যায় আদালতে আরও একজন সাক্ষী হাজির। তার নাম মো: শাহজাহান। তিনি কারখানার নির্বাহী কর্মকর্তা ছিলেন এবং সাক্ষী তালিকায় তার নাম ১০০ নম্বর। বিচারক নাম ও ঠিকানা নোট করে শুরু করার সাথে সাথেই শাহজাহান কারখানা সম্পর্কে ভালো কথা বলতে শুরু করেন — কারখানাটি ৮ তলা, ৬ তলা পর্যন্ত শ্রমিকরা কাজ করতো, ৭ম ও ৮ম তলা নির্মাণাধীন ছিলো। ভবনটিতে তিনটি সিড়ি ছিলো, তার মধ্যে একটি ১২ ফুট প্রশস্ত, অপর দুইটি ৯ফুট প্রশস্ত। অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাও যথাযথ, সরকারি এবং বেসরকারি সংস্থা থেকে প্রয়োজনীয় সার্টিফিকেট ছিলো, যা যথা সময়ে নবায়নও করে রাখা হয়েছিলো। তিনি আরও বলেন, আগুন লাগার সাথে সাথে কারখানা কর্তৃপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ায় প্রাণহানি কম হয়েছে। এসময়ে আসামীপক্ষের আইনজীবীরা সমস্বরে বলেন, আপনি সঠিক সাক্ষ্য দিয়েছেন। শাহজাহান জবাবে বলেন, তিনি সঠিক সাক্ষ্য দিয়েছেন।

২২ অক্টোবর ২০২৪: রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি।

২৭ নভেম্বর ২০২৪: রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি।

২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫: রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি।

২৫ জুন ২০২৫: রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি।

২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫: তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেডের মালিক ও তার স্ত্রী আদালতে উপস্থিত ছিলেন না। অসুস্থতাজনিত কারণে তারা সময় চেয়ে আদালতের কাছে আবেদন করেন। আদালতে একজন শ্রমিক সাক্ষী দিতে এসেছিলেন। তার সাক্ষ্যে তিনি বলেন, ঘটনার দিন (নভেম্বর ২৪, ২০১২)  তিনি দোতলায় কর্মরত ছিলেন, আগুন নিচতলায় গোডাউনে লেগেছিলো। দোতলা থেকে লাফ দিয়ে নিচে নামতে গিয়ে তিনি আহত হন, নানা হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। তবে ঘটনার পরে ডিসেম্বর মাসের ৬ তারিখে (২০১২) তার পাওনা বুঝিয়ে দেয়ার পরে তিনি বাড়ি চলে যান। আসামিপক্ষের আইনজীবী যখন তাকে জিজ্ঞেস করে যে, অগ্নিকাণ্ডটি কি একটা দুর্ঘটনা ছিল? এই প্রশ্নের উত্তরে উপস্থিত সাক্ষী বলেন, “জ্বী, এটা একটা দুর্ঘটনা ছিল।” এই সময়ে আদালত কক্ষে কথাবার্তা শুরু হয়, রাষ্ট্রপক্ষের উকিল কোনো প্রশ্ন বা আপত্তি না জানালেও, অন্যরা বলেন, আসামি সাক্ষী সাজিয়ে আনসে। সংক্ষিপ্ত সাক্ষ্য শেষে বিচারক রাষ্ট্রপক্ষের উকিলকে বলেন, এই মামলায় সাক্ষী আনা যাচ্ছে না কেন, খোঁজ নেন, সাক্ষী হাজির করেন।

১৮ নভেম্বর ২০২৫:  রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষ্য হাজির করতে পারেনি। দ্বিতীয় দিনের মতন এই মামলার মূল আসামী কারখানার মালিক দেলোয়ার হোসেন “গুরুতর অসুস্থতা”র অজুহাতে হাজিরা দেননি।

৯ মার্চ ২০২৬: আগামী সাক্ষ্য শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছে।

আমরা মনে করি সাক্ষী হাজির না করে মামলা পরিচালনায় দীর্ঘসূত্রিতার পথ বেছে নেয়া বিচার প্রার্থী ভুক্তভোগী শ্রমিকসহ সকলকে হতোদ্যম করে তোলার ব্যর্থ চেষ্টা মাত্র। তাজরীন অগ্নিকাণ্ডে নির্মমভাবে শ্রমিক হত্যার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচার নিশ্চিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এই মামলাটিতে আমাদের প্রতিবাদী নজর থাকবে।

সায়দিয়া গুলরুখ: নৃবিজ্ঞানী ও সাংবাদিক, ইমেইল: gulrukhsaydia@gmail.com

শহীদুল ইসলাম সবুজ: শ্রমিকনেতা, গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সাধারণ সম্পাদক

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •