বাংলাদেশের ৫০ বছর ও তারপর-২
সংবিধান, নির্বাচন, পরিকল্পনা কমিশন এবং দুর্ভিক্ষ
আনু মুহাম্মদ
১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানের হানাদার সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। এরপর ৫২ বছর অতিক্রম করছে এই দেশ। এই সময়ে দুইজন রাষ্ট্রপতি খুন হয়েছেন, দুই দফা প্রত্যক্ষভাবে সামরিক শাসন এসেছে, সংবিধান সংশোধন হয়েছে ১৬ বার, নির্বাচনের নানা রূপ দেখা গেছে। পাশাপাশি অর্থনীতির আয়তন ক্রমে বেড়েছে, জিডিপি ও বিশ্ববাণিজ্যে উল্লম্ফন ঘটেছে, অবকাঠমো ছাড়াও সমাজে আয় ও পেশার ধরনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন এসেছে। সম্পদের কেন্দ্রীভবন ও বৈষম্যও বেড়েছে। সর্বজনের বদলে কতিপয় গোষ্ঠীর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণে আটকে গেছে দেশ।
এই ধারাবাহিক লেখায় এই দেশের একজন নাগরিক তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সাথে সাথে ইতিহাসের নানা নথি পর্যালোচনা করে এই দেশের রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, সংস্কৃতির গতিমুখ তুলে ধরতে চেষ্টা করেছেন। দ্বিতীয় পর্বে আলোচনা করা হয়েছে ১৯৭৩-৭৪ সময়কালের সংবিধান সংশোধন, জাতীয় ও ডাকসু নির্বাচন, সংসদে ভিন্ন স্বর এবং পরিকল্পনা কমিশনে টানাপোড়েন সংশ্লিষ্ট কিছু দিক।
১০ই জানুয়ারি দেশে প্রত্যাবর্তনের পর থেকে শেখ মুজিবের বক্তৃতা ও বিভিন্ন সিদ্ধান্তের দিকে আমার বিশেষ মনোযোগ ছিল। মনে আছে তিনি বিভিন্ন স্থানে যে বক্তৃতা দিতেন তা সেই দিন রাত পৌনে ৯টায় বাংলাদেশ বেতারে পুনঃপ্রচারিত হতো। আমি নিয়মিত শুনতাম। টিভিতেও দেখতাম। তাঁর বক্তৃতা সবসময়ই আকর্ষণীয় ছিল, বিশেষ করে জনবিচ্ছিন্ন আমলা-ভদ্রলোকদের সাথে লুটেরা, দুর্নীতিবাজ, চোরাচালানী ধরনের লোকজনের বিরুদ্ধে তাঁর কঠোর বক্তব্য ভালো লাগতো। কিন্তু তিনি যখন বক্তৃতায় বিরোধী বামপন্থী দলগুলোর বিরুদ্ধে বিষোদগার করতেন, এমনকি ‘লাল ঘোড়া দাবড়ানো’র কথা বলতেন সেই সুর ভালো লাগতো না। আমার প্রত্যাশা ছিল অনেক উঁচু, নিশ্চয়ই আরো অনেকেরই তাই ছিল। ভাবতাম তিনি সবকিছু নতুন করে গড়ে তোলায় বিপ্লবী নেতৃত্ব দেবেন। কিন্তু চারপাশে যা দেখছিলাম তাতে ক্রমেই আমার আশাভঙ্গ হতে থাকে।
স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত অবকাঠামো, জনবলের সংকট, অর্থনীতি গুছিয়ে তোলার জটিলতার পাশাপাশি আরব-ইসরাইল যুদ্ধ থেকে সৃষ্ট তেল সংকট বাংলাদেশকে খুবই অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলেছিলো। তবে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশ ক্রমেই নিজের অবস্থান তৈরি করছিল। বিশ্বজুড়ে শেখ মুজিব তখন খুবই নন্দিত নেতা ছিলেন। এক বছরের মধ্যে বিশ্বের ৯২টি দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। তবে যুক্তরাষ্ট্র স্বীকৃতি দিতে চার মাস সময় নেয়। বাংলাদেশ দ্রুতই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থারও সদস্যপদ গ্রহণ করে। তবে ১৯৭২-৭৩ সালে জাতিসংঘের সদস্যপদ পাবার পথে বাধা সৃষ্টি করে চীনের ভেটো। পাকিস্তানের সমর্থনে চীন একাধিকবার ভেটো প্রদান করে। পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহান বলছেন, চীনের এই বিরোধিতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ সরকার চীন সম্পর্কে বৈরীভাব প্রকাশ থেকে বিরত থাকে। (জাহান, ১৯৭৩) এক পর্যায়ে চীন নিরস্ত হয় এবং ১৯৭৪ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্যপদ লাভ করে।[1] ১৯৭৪ সালের ২৫শে সেপ্টেম্বর দেশের সরকারপ্রধান হিসেবে শেখ মুজিব জাতিসংঘে প্রথম ও শেষবারের মত ভাষণ দেন। মনে আছে টিভিতে তার ভাষণ দেখেছিলাম। বাংলায় তাঁর ভাষণ শুনে খুবই ভালো লেগেছিল।
বিশ্বজুড়ে শেখ মুজিব তখন খুবই নন্দিত নেতা ছিলেন। এক বছরের মধ্যে বিশ্বের ৯২টি দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। তবে যুক্তরাষ্ট্র স্বীকৃতি দিতে চার মাস সময় নেয়। বাংলাদেশ দ্রুতই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থারও সদস্যপদ গ্রহণ করে। তবে ১৯৭২-৭৩ সালে জাতিসংঘের সদস্যপদ পাবার পথে বাধা সৃষ্টি করে চীনের ভেটো।
সেসময় দেশের ভেতর অর্থনৈতিক অস্থিরতা বৃদ্ধির পেছনে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সংকট যেমন ভূমিকা রেখেছে, ভেতরের অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, ভুলনীতিও যে বড় কারণ ছিল তা তৎকালীন বিভিন্ন দলিলপত্র থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনায় দলীয় বিবেচনায় এমন লোকজনকে নিয়োগ দেয়া হয় যাদের দুর্নীতি, অনিয়ম, অযোগ্যতায় এসব প্রতিষ্ঠান দ্রুত লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। এসব রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান, লাইসেন্স-পারমিটই ব্যক্তি পুঁজি গঠনের প্রধান উৎস হিসেবে কাজ করে।[2] প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের প্রভাবশালী সদস্য রেহমান সোবহান লক্ষ্য করেছেন যে, ‘রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের সম্প্রসারণের অন্যতম ফল হলো ব্রিফকেস পুঁজিপতিদের এক নতুন গোষ্ঠীর অভ্যুদয়..’ । (সোবহান, ২০২২; পৃ. ১১৮)
এসব রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান, লাইসেন্স-পারমিটই ব্যক্তি পুঁজি গঠনের প্রধান উৎস হিসেবে কাজ করে। প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের প্রভাবশালী সদস্য রেহমান সোবহান লক্ষ্য করেছেন যে, ‘রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের সম্প্রসারণের অন্যতম ফল হলো ব্রিফকেস পুঁজিপতিদের এক নতুন গোষ্ঠীর অভ্যুদয়..’।
চাল, লবণের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছিল। খাদ্যদ্রব্যসহ বাচ্চার দুধের জন্যও হাহাকার বাড়ছিল। জিনিসপত্রের দামবৃদ্ধি ছাড়াও সন্ত্রাস, ছিনতাই, ডাকাতি নিয়ে সবাই তখন আতংকিত। অনিয়ন্ত্রিত অস্ত্র ছিল আরেকটি বড় সমস্যা। মুক্তিযুদ্ধে বহু মানুষের কাছে অস্ত্র গেছে। মুক্তিবাহিনী, মুজিববাহিনী ছাড়াও দেশের ভেতর কাদেরিয়া বাহিনী, হেদায়েত বাহিনী যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। অনেক বাম সংগঠন দেশের মধ্যেই লড়াই করেছে। তাছাড়া পাক বাহিনীর সহযোগী রাজাকার আলবদরদের হাতেও অস্ত্র থাকার সম্ভাবনা। কাদের কাছে কতো অস্ত্র আছে তা কেউ জানে না।
এরকম পরিস্থিতিতে ১৭ই জানুয়ারি শেখ মুজিব সবার প্রতি অস্ত্র জমা দিতে আহবান জানালেন এবং সময় দিলেন ১০ দিন। একমাত্র তাঁর আহবানেই তখন অস্ত্র জমা পড়তে পারে, পরিস্থিতি এরকমই ছিল। ২৪ জানুয়ারি শেখ মুজিব টাঙ্গাইলে গেলেন কাদের সিদ্দিকীর বাহিনীর অস্ত্র জমা নিতে। ৩০ জানুয়ারি মুজিববাহিনীর পক্ষ থেকে ৫০ হাজার অস্ত্র জমা দেয়া হয় আনুষ্ঠানিকভাবে। (জাহান, ১৯৭৩) সে সময়ে আমরা পত্রিকায় প্রায়ই অস্ত্র জমা সংক্রান্ত খবর আর ছবি দেখতাম। রেডিও টেলিভিশনেও ক্রমাগত আহবান বা উৎসাহমূলক খবর আলোচনা প্রচার হচ্ছিল। খবরে ছবিতে অস্ত্র জমা দেবার খবর দেখলেও সবাই বলাবলি করতে থাকলো বহু অস্ত্র জমা দেয়া হয়নি। কাদের কাছে আছে, কীভাবে এগুলোর ব্যবহার হবে তা নিয়ে শংকা-কথাবার্তা আমরা শুনতে থাকি। বিশেষ করে গ্রামে একদিকে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি অন্যদিকে ডাকাতির ঘটনা ও আতংক ব্যাপক আকার নিতে থাকে। অন্যদিকে দেশজুড়ে রক্ষীবাহিনী ততদিনে একটা ত্রাস হয়ে উঠেছিল।[3] প্রধানত বাম কর্মীরাই তাদের ত্রাসের শিকার হয়েছিলেন।
সংবিধানের চাপা পড়া অঙ্গীকার ও সংশোধনী
কীভাবে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণীত হলো এবং তা গণপরিষদে পাশ হলো সে বিষয়ে গত পর্বে আলোচনা করেছি। এভাবে প্রণয়ন এবং গত ৫০ বছরে বহুরকম কাটাছেঁড়ার পরও প্রস্তাবনাসহ এর কয়েকটি ধারা দেখলে সেগুলো যে এখনও সংবিধানের মধ্যে টিকে আছে তা অবিশ্বাস্য মনে হবে। যদিও এসব প্রস্তাবনা/অঙ্গীকারের কার্যকর কোনো ভূমিকা নাই!
সংবিধানের প্রস্তাবনা এবং দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি দেয়া আছে। যেমন প্রস্তাবনায় আছে:
‘আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা – যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’
কয়েকটি ধারায় আছে:
ধারা ১৪: ‘রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে মেহনতী মানুষকে – কৃষক ও শ্রমিকের এবং জনগণের অনগ্রসর অংশকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তি দান করা।’
ধারা ১৫: ‘রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের মাধ্যমে উৎপাদনশক্তির ক্রমবৃদ্ধিসাধন এবং জনগণের জীবনযাত্রার বস্তুগত ও সংস্কৃতিগত মানের দৃঢ় উন্নতিসাধন, যাহাতে নাগরিকদের জন্য নিম্নলিখিত বিষয়সমূহ অর্জন নিশ্চিত করা যায়:
(ক) অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা;
(খ) কর্মের অধিকার, অর্থাৎ কর্মের গুণ ও পরিমাণ বিবেচনা করিয়া যুক্তিসঙ্গত মজুরীর বিনিময়ে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার অধিকার;
(গ) যুক্তিসঙ্গত বিশ্রাম, বিনোদন ও অবকাশের অধিকার; এবং
(ঘ) সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার, অর্থাৎ বেকারত্ব, ব্যাধি বা পঙ্গুত্বজনিত কিংবা বৈধব্য, মাতাপিতৃহীনতা বা বার্ধক্যজনিত কিংবা অনুরূপ অন্যান্য পরিস্থিতিজনিত আয়ত্তাতীত কারণে অভাবগ্রস্ততার ক্ষেত্রে সরকারী সাহায্য লাভের অধিকার।’
ধারা ১৭তে ‘একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা’র কথা বলা হয়েছে।
ধারা ২০ এর ২ উপধারায় বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র এমন অবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা করিবেন, যেখানে সাধারণ নীতি হিসাবে কোন ব্যক্তি অনুপার্জিত আয় ভোগ করিতে সমর্থ হইবেন না…’
এ পর্যন্ত কোনো সরকারই উপরোক্ত ধারাগুলোতে বর্ণিত অঙ্গীকার বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় নীতি-কর্মসূচি গ্রহণ করেনি, বরং পুরো উল্টোযাত্রা চলছে দেশে। বলা যায়, সকল সরকারই কমবেশি সংবিধান ভঙ্গ করেছে এবং প্রমাণ করেছে শপথ নিলেও সংবিধান তাদের কাছে প্রয়োজনমত ব্যবহারের একটি কাগজমাত্র।
‘আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা – যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’
সংবিধান গ্রহণের সময়ে এর বিভিন্ন দিক নিয়ে সংসদের বাইরে থেকে যারা পর্যালোচনা বিশ্লেষণ করেছেন তাঁদের মধ্যে বদরুদ্দীন উমর অন্যতম। তিনি ১৯৭২ সালের ২৯ অক্টোবর প্রকাশিত তাঁর “A constitution for ‘perpetual’ emergency” নিবন্ধে সংবিধানের মূল চরিত্র সম্পর্কে বিশ্লেষণ করে যে সিদ্ধান্ত টেনেছিলেন তা পরবর্তীকালে সঠিক প্রমাণিত হয়েছে।[4] তাঁর এই লেখার একটি প্রাসঙ্গিক অংশ ফিরোজ আহমদ অনুবাদ করেছেন:
“শাসক-শ্রেণী যে রাষ্ট্রের মৌলিক সবগুলো প্রতিষ্ঠানকেই বিপুল পরিমাণে অবিশ্বাস করে এই সংবিধান তারই ইঙ্গিতবহ এবং সংবিধানটি সংসদীয় সংখ্যাধিক্যের সাহায্যে সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় রসদ জোগান দেয়। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ ইঙ্গিত দেয় যে বর্তমান পরিস্থিতিতে এমনকি সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতাকেও নির্ভরযোগ্য শর্ত হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে না। ফলে এটাকে স্রেফ প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব একটা হাতিয়ার বানিয়ে ফেলা হয়েছে, যাকে শাসকগোষ্ঠীর একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রে অসীম ক্ষমতা চর্চা করার অধিকার দেয়া হয়েছে।…. এবং এ কারণেই শাসকশ্রেণীর একনায়কত্ব একজন প্রধানমন্ত্রীর সংসদীয় স্বৈরতন্ত্রের রূপে পর্যবসিত হবার দিকে যাচ্ছে… আগামীকাল যদি পরিস্থিতি বেসামরিক কর্তৃত্বের বাইরে চলে যায় এবং শাসক শ্রেণীর জন্য আরও খারাপ হয়ে ওঠে, সংসদীয় ধরনটি রাষ্ট্রপতির ধরনের শাসন দিয়ে কিংবা আরও খারাপ কিছু দিয়ে প্রতিস্থাপিত হতে পারে।’ (আহমদ, ২০১৫)
বিভিন্ন সংশোধনীর মধ্য দিয়ে সংবিধান ক্রমে আরো অগণতান্ত্রিক ও সাম্প্রদায়িক হয়েছে। জাতিবিদ্বেষী অবস্থানও অব্যাহত থেকেছে। ১৯৭২-এ গৃহীত এই সংবিধানের সংশোধনী শুরু হয় ১৯৭৩ সালে নির্বাচিত সংসদের প্রথম থেকেই। সংবিধানের প্রথম সংশোধনী বিল পাস হয় ১৯৭৩ সালের ১৫ জুলাই। এর বিষয় ছিল ‘যুদ্ধাপরাধীসহ অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার’ নিশ্চিত করা। প্রথম সংশোধনী পাস হওয়ার পর আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল), আইন ১৯৭৩ প্রণয়ন করা হয়, এটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তা ঝুলে যায় নানা রাজনৈতিক বিবেচনা ও যোগসাজশের কারণে। পরে এর অধীনে ২০১০ সালে ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল’ গঠন করা হয়।
সংবিধানের প্রথম সংশোধনীর দুই মাস পর ১৯৭৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় সংশোধনী বিল পাস করা হয়। ‘জরুরী অবস্থা’ ঘোষণার বিধান চালু করা হয় এই সংশোধনীর মাধ্যমে, সংশোধনে যুক্ত ‘ধারা নবম-ক ভাগ’-এ ১৪১ ক। (১) ধারায় বলা হয়,
‘রাষ্ট্রপতির নিকট যদি সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হয় যে, এমন জরুরী অবস্থা বিদ্যমান রহিয়াছে, যাহাতে যুদ্ধ বা বহিরাক্রমণ বা অভ্যন্তরীণ গোলযোগের দ্বারা বাংলাদেশ বা উহার যে কোন অংশের নিরাপত্তা বা অর্থনৈতিক জীবন বিপদের সম্মুখীন, তাহা হইলে তিনি জরুরী অবস্থা ঘোষণা করিতে পারিবেন।’ (সরকার, ১৯৯৬)
বিলটি পাসের সময় বিরোধী দল এবং স্বতন্ত্র কয়েকজন সদস্য সংসদ থেকে ওয়াকআউট করেছিলেন।
দ্বিতীয় সংশোধনীতে সংবিধানে চার ধরনের বিধান সংযোজন করা হয়। এগুলো হলো: ১. জরুরি অবস্থা ঘোষণার বিধান; ২. সংসদকে নিবর্তনমূলক বা বিনা বিচারে আটকসংক্রান্ত আইন প্রণয়নের ক্ষমতা দেওয়া; ৩. মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী আইন পাসের বিধান আনা এবং ৪. সংসদের দুটি অধিবেশনের মাঝে বিরতির পরিমাণ বাড়ানো। ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে সংবিধান সংশোধনের কয়েক মাস পরে, ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, নিবর্তনমূলক আটকের বিধান রেখে বিশেষ ক্ষমতা আইন পাস করা হয়। সে বছরই ২৮ ডিসেম্বর মৌলিক অধিকার স্থগিত করে দেশে প্রথমবারের মতো জরুরী অবস্থা জারি করা হয়। ১৯৭৪ সালের ২৩ নভেম্বর সংবিধানের তৃতীয় সংশোধনী সংসদে পাস হয়। ১৯৭৪ সালের ১৬ মে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা দিল্লি চুক্তি নামে পরিচিতি পেয়েছিল। এই চুক্তিতে দুই দেশের মধ্যে ছিটমহল এবং অপদখলীয় জমি বিনিময়ের কথা ছিল। (ইসলাম, ২০২৩)
পরের সংশোধনীগুলির অধিকাংশও শাসক দলের স্বার্থে করা, ক্ষমতায় টিকে থাকতে ধর্মীয়করণ করা হয়েছে কিন্তু তা নিয়ে জনগণের কোনো দাবি কিংবা প্রত্যাশা ছিল না, নিপীড়নমূলক করা হয়েছে সেটা তাদের জনভীতি থেকে করা। এসবের মধ্য দিয়ে বরং সংবিধানের উপরোক্ত নীতিমালার সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ বহু নীতি প্রনয়ন ও বাস্তবায়ন করা হয়েছে।ক্রমে আমরা পরবর্তী সংশোধনীগুলোও দেখতে থাকবো।
জাতীয় ও বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচন
১৯৭৩ সালের ৭ই মার্চ স্বাধীন দেশে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং একই বছরের সেপ্টেম্বরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনও হয়। দুটোতেই সরকারি দল ও তার অঙ্গ সংগঠনগুলো যে ভূমিকা গ্রহণ করে তা শুধু অপ্রত্যাশিতই ছিল না বরং তা তাদের জনপ্রিয়তায় ধ্বস নামাতেও ভূমিকা রাখে।
আসলে জনভিত্তি এবং শেখ মুজিবের আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তার কারণে সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় সুনিশ্চিত ছিল। সেসময় মুজিব উচ্ছ্বাসের সামনে খুব কম জায়গাতেই অন্য কারও শক্তভাবে দাঁড়াবার ক্ষমতা ছিল। কিন্তু তারপরও সরকারের বিরুদ্ধে প্রার্থী অপহরণ, ভোটকেন্দ্র দখলসহ গুরুতর বহু অভিযোগ পাওয়া গেল। বস্তুত নির্বাচনের আগে থেকেই এই আশংকা প্রকাশিত হতে থাকে। যেমন ৩রা মার্চ তৎকালীন ন্যাপনেত্রী মতিয়া চৌধুরী এক জনসভায় বলেছেন,
গত একবছরে অবাধ লুটতরাজ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি আর রিলিফ চুরির বিশ্বরেকর্ড ভঙ্গ করে আওয়ামী লীগ এবার ‘বঙ্গবন্ধু’কে একমাত্র পুঁজি করে জনতার কাছে ভোট চাইতে এসেছে। একদিকে মুখে গণতন্ত্রের কথা বলা হচ্ছে অন্যদিকে আজও ‘সামনে আছে জোর লড়াই বঙ্গবন্ধু অস্ত্র চাই’ বলে আওয়ামী লীগ কর্মীরা ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করে চলেছে। এর নাম কি গণতন্ত্র? (মুসা, ১৯৯১; পৃ. ১০৪)
৭ই মার্চ নির্বাচনের খবর নিয়েই পরদিন পত্রিকা প্রকাশিত হয়। কিন্তু সেদিন দৈনিক সংবাদের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত কয়েকটি খবরের শিরোনাম ছিল এরকম: ‘সিলেট-১ কেন্দ্রে ব্যালট বাক্স ছিনতাই’, ‘পটুয়াখালীতে ব্যালট পেপার ছিনতাই’, ‘ঘটনাস্থল চট্টগ্রাম: ৩১ খানা ব্যালট পেপারসহ ২ ব্যক্তি গ্রেফতার’, ‘ধামরাইতে রক্ষীবাহিনী সন্ত্রাস চালিয়েছে: আমেনা’, ‘জাসদ এর দুজন হাইজ্যাক’, ‘ঢাকায় একটি কেন্দ্রে সংঘর্ষ, একটি কেন্দ্রে গুলী’, ‘পটিয়ায় ভোট সশস্ত্র লোকেরাই দিয়েছে?’, ‘কুমিল্লা শহরে ব্যাপক সন্ত্রাস: নির্বাচন প্রহসনে পরিণত’, ‘কালিগঞ্জেও সন্ত্রাস চলেছে’, ‘রাজশাহীর ভোট কেন্দ্রে সন্ত্রাস’, ইত্যাদি। (পূর্বোক্ত)
সেদিন দৈনিক সংবাদের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত কয়েকটি খবরের শিরোনাম ছিল এরকম: ‘সিলেট-১ কেন্দ্রে ব্যালট বাক্স ছিনতাই’, ‘পটুয়াখালীতে ব্যালট পেপার ছিনতাই’, ‘ঘটনাস্থল চট্টগ্রাম: ৩১ খানা ব্যালট পেপারসহ ২ ব্যক্তি গ্রেফতার’, ‘ধামরাইতে রক্ষীবাহিনী সন্ত্রাস চালিয়েছে: আমেনা’, ‘জাসদ এর দুজন হাইজ্যাক’, ‘ঢাকায় একটি কেন্দ্রে সংঘর্ষ, একটি কেন্দ্রে গুলী’, ‘পটিয়ায় ভোট সশস্ত্র লোকেরাই দিয়েছে?’, ‘কুমিল্লা শহরে ব্যাপক সন্ত্রাস: নির্বাচন প্রহসনে পরিণত’, ‘কালিগঞ্জেও সন্ত্রাস চলেছে’, ‘রাজশাহীর ভোট কেন্দ্রে সন্ত্রাস’, ইত্যাদি।
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জাসদ, ভাসানী ন্যাপ, মোজাফফর ন্যাপ, শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল নির্বাচনে বহুরকম অনিয়মের অভিযোগ করে। মোজাফফর ন্যাপের সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ও সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ ভট্টাচার্য ৯ মার্চ প্রদত্ত বিবৃতিতে বলেন:
‘…কমপক্ষে ৭০টি নির্বাচনী আসনে যেখানে ন্যাপ ও অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক দলের প্রার্থীদের সুনিশ্চিত বিজয়ের সম্ভাবনা ছিল, সেই আসনসমূহে শাসকদল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার, অস্ত্রের ঝনঝনানি, ভয়ভীতি, সন্ত্রাস প্রয়োগ, গুন্ডাবাহিনী ব্যবহার, ভুয়া ভোট, পোলিং বুথ দখল, পোলিং এজেন্ট অপহরণ, বিদেশি সাহায্য সংস্থা, জাতিসংঘ, সরকারি গাড়ি এবং রেডক্রসের গাড়ির অপব্যবহার প্রভৃতি চরম অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপের মাধ্যমে উক্ত নির্বাচনী কেন্দ্রসমূহে নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করিয়াছে এবং বিরোধী দলের প্রার্থীদেরকে জোরপূর্বক পরাজিত করিয়াছে।..’ (সংবাদ, ১০ই মার্চ, ১৯৭৩। উদ্ধৃতি, মুসা, ১৯৯১, পৃ. ১০৫)
শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল ১১ই মার্চ সংবাদ সম্মেলনে দাবি করে,
‘মেজর জলিল (জাসদ), ড. আলীম আল রাজী (ন্যাপ-ভাসানী), মোস্তাক আহমদ চৌধুরী (ন্যাপ-মোজাফফর), কাজী হাতেম আলী (শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল) এবং আরও কয়েকটি জায়গায় নিশ্চিতভাবে বিরোধী দলগুলি জয়লাভ করিয়াছে।’ (গণকন্ঠ, ১২ই মার্চ, ১৯৭৩। উদ্ধৃতি, মহিউদ্দীন, পৃ. ১২)
শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দলের নেতা নির্মল সেন সেসময় অনিকেত নামে দৈনিক বাংলায় নিয়মিত কলাম লিখতেন। নির্বাচনের কয়দিন পর তিনি লেখেন তাঁর বিখ্যাত ‘আমি স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’ শিরোনামের লেখাটি। তিনি সেখানে প্রশ্ন করেন:
(১) ১৯৭২ সাল হতে আজ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত কটি হত্যাকাণ্ডে কিনারা হয়েছে?
(২) কজন হত্যাকারী গ্রেফতার হয়েছে?
(৩) কটি গাড়ী হাইজ্যাক হয়েছে? সে হাইজ্যাকার কারা? কী তাদের পরিচয়? কী তাদের ঠিকানা?
(৪) যারা গ্রেফতার হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে?
(৫) পুলিশ বাহিনীর পক্ষ থেকে প্রায়ই অভিযোগ করা হয় যে, অভিযুক্তদের ধরা হলে ফোনের জন্য মুক্তি দিতে হয়। এই অভিযোগ কতটুকু সত্য? এই ফোন কারা করে থাকেন? (মুসা, ১৯৯১; পৃ. ১০৭)
বলাই বাহুল্য, এই প্রশ্নগুলোর কোনো উত্তর পাওয়া যায় নাই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ বা ডাকসু নির্বাচন হয় একই বছরের ৩রা সেপ্টেম্বর। এটা ছিল ছাত্রছাত্রীদের প্রত্যক্ষ ভোটে তৃতীয় ডাকসু নির্বাচন। প্রথম ১৯৭০ সালে সহসভাপতি (ভিপি) হন আসম আবদুর রব, দ্বিতীয়বার ১৯৭২ সালে ভিপি হন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। তৃতীয়বারের নির্বাচন ১৯৭৩এ, সেখানে মুজিববাদী ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন মিলে একটি প্যানেল করে। ছাত্র ইউনিয়ন থেকে নূহ-উল আলম লেনিন ভিপি ও ছাত্রলীগের ইসমত কাদির গামা সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী। এর বিপরীতে জাসদপন্থী ছাত্রলীগের ভিপি প্রার্থী ছিলেন আফম মাহবুবুল হক, জিএস পদে প্রার্থী ছিলেন জহুর হোসেন। এই নির্বাচনে ব্যালট বাক্স ছিনতাই, হামলা ইত্যাদি করে সরকারি ছাত্র সংগঠনের লোকজন।
এ বিষয়ে বিভিন্ন প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা পাওয়া যায়। কবি আবু করিমের প্রত্যক্ষদর্শী বর্ণনায়,
‘ডাকসুর ব্যালট বাক্স যে মুজিবাদীরা ছিনতাই করে তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক হাজার ছাত্রছাত্রীর মধ্যে অনেকেই দেখেছে। ছিনতাইকর্মে মাত্র দুই তিনজন লিপ্ত ছিল না, কয়েক শত কর্মী এই কাজে লিপ্ত ছিল। ছিনতাইকারীরা নিশ্চিত মনে বোমা ফাটিয়ে, স্টেনগানের ব্রাশফায়ার করে, শ্লোগান দিয়ে তাদের কাজ শেষ করে। কেউ কেউ মুখে রুমাল, কাপড় ইত্যাদি জড়ালেও তখনকার পরিপ্রেক্ষিতে সবাই মুখ ঢেকে রাখেনি।…শামসুন নাহার হলে ভোট গণনাকারী বাংলা বিভাগের শিক্ষক মনসুর মুসার বুকে স্টেনগানের নল ঠেকিয়ে গুন্ডারা তাকে ব্যালট পেপার প্রদান করতে চাপ প্রয়োগ করে। তিনি ও তাঁর সহযোগী অধ্যাপিকাগণ কোনোমতে প্রাণরক্ষা করতে সক্ষম হন।…’ (হক, ২০২০; পৃ. ১৬৯)
মহিউদ্দীন আহমদও ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের প্রায় একইরকম বর্ণনা দিয়েছেন।
এর কয়েকবছর পর আমি যখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই তখন ওখানেও একইরকম ঘটনার কথা শুনেছিলাম। ব্যালট বাক্স ছিনতাই করতে এসে গুলিগালাজ করেছিল ছাত্রলীগ। পরিসংখ্যান বিভাগের তরুণ শিক্ষক কাজী সালেহ আহমদের, আক্ষরিক অর্থেই, কানের কাছ দিয়ে গিয়েছিল গুলি। তিনি অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিলেন এবং পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যও হয়েছিলেন।
জাতীয় সংসদে ভিন্নস্বর
১৯৭৩ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯২টি আসনেই জয়লাভ করে। অনেক ভয়ভীতি জোরজবরদস্তি সত্ত্বেও এই সংসদে যে কয়জন আওয়ামী লীগের বাইরে থেকে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন জাতীয় লীগ ও জাসদের দুজন এবং স্বতন্ত্র পাঁচজন। এদের মধ্যে ছিলেন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা এবং আবদুল্লাহ সরকার। এই সংসদ চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে কার্যত অচল হবার আগে পর্যন্ত এই দুজন বেশ কিছু বিষয়ে মৌলিক প্রশ্ন তুলেছিলেন এবং সংসদে ভিন্ন কন্ঠের অস্তিত্ব বজায় রেখেছিলেন।
১৯৭৩ এর নির্বাচনের সময় আবদুল্লাহ সরকার কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য ছিলেন না। তিনি চাঁদপুরের হাইমচর থেকে স্বতন্ত্র সদস্য হিসেবে সংসদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। কয়েকবছর আগে সেই সংসদে আবদুল্লাহ সরকার উপস্থাপিত বক্তব্য এবং প্রশ্নোত্তর সংকলিত করে তা প্রকাশ করেছেন তাহেরা বেগম জলি, এই দুরূহ কাজে তাঁকে সহযোগিতা করেছেন হায়দর আনোয়ার খান জুনো, ফিরোজ আহসান ও নজরুল ইসলাম। (জলি, ২০১৯) সংসদে তিনি জনস্বার্থ বিষয়ক বিভিন্ন বিষয়ে মতামত দিয়েছেন, সুপারিশ করেছেন, প্রশ্ন করেছেন, গৃহীত নীতিমালা অগ্রহণযোগ্য হলে প্রতিবাদ করেছেন। এই গ্রন্থে সংকলিত এসব বক্তব্যের ভেতর থেকে তৎকালীন পরিস্থিতি, বিতর্ক ও বিভিন্ন পদক্ষেপ বিষয়ে জানা যায়। এর মধ্যে কয়েকটি এখানে উপস্থিত করছি:
১৬ই জুন ১৯৭৩: শিক্ষামন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি বলছেন-
‘১১ই মে ১৯৭৩ হতে বাংলাদেশ বেসরকারী কলেজ শিক্ষক সমিতি দেশের সকল বেসরকারী কলেজকে রাষ্ট্রায়ত্ত কলেজে পরিণত করা সহ অন্যান্য দাবী দাওয়ার ভিত্তিতে অবিরাম ধর্মঘট করে আসছে। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে প্রায় ৪৫০টি বেসরকারী কলেজের তিন লক্ষ পঁচাশী হাজার ছাত্রছাত্রীর লেখাপড়া সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে। এই সকল ধর্মঘটী কলেজের প্রায় ৯২০০ শত শিক্ষক আজ বহুদিন ধরে আর্থিক অভাবে এই দুর্মূল্যের দিনে কায়ক্লেশে কালাতিপাত করছেন।’ (জলি, ২০১৯; পৃ. ৩৯)
একইদিন রেলওয়ে সম্পর্কে জানাচ্ছেন: ‘…রেলওয়ের যান্ত্রিক ওয়ার্কশপগুলি পাহাড়তলিতে ও সৈয়দপুরে অবস্থিত। সেগুলির অধিকাংশ কর্মচারীই ছিল অবাঙালী। তাদেরকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে উপযুক্ত কর্মচারীর অভাবে সেগুলি সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে আছে। স্বাধীনতার পর এখন পর্যন্ত উপযুক্ত কর্মচারী নিয়োগ করা হয় নাই। এর ফলে দেখা গেছে, সৈয়দপুরে উৎপাদন ক্ষমতা কমে অর্ধেকে নেমে এসেছে।…আমরা যদি রেলওয়ের যন্ত্রপাতি তৈয়ার করতে না পারি, তাহলে বিদেশ থেকে যন্ত্রপাতি এনে আমরা কোনদিন উন্নতি করতে পারব না।…’ (পূর্বোক্ত, পৃ.৪৮)
২৮শে জুন ১৯৭৩: ব্যক্তিগত গাড়ী ও জ্বালানি প্রসঙ্গে বলছেন-
‘প্রাইভেট কার, মোটর সাইকেল ইত্যাদির আমদানী পাঁচ বৎসরের জন্য বন্ধ রাখতে হবে, এগুলো ক্রয় করতে যে বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হত সেই বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে অন্যান্য প্রকল্প তৈরী করতে হবে। প্রাইভেট কার বা মোটর সাইকেল বন্ধ করার পক্ষে আমার যুক্তি হলো, এই গুলো ক্রয় করতে বা জ্বালানী বাবদ যে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হবে, তা দিয়ে অনেক বাস আমদানী করে ব্যবহার করলে সাধারণ মানুষের যাতায়াতের সুবিধা হবে। যে পরিমাণ টাকা দিয়ে একজন লোক সুযোগ সুবিধা পেত তা দিয়ে অনেক লোকের সুবিধা হবে।’ (পূর্বোক্ত, ১০৬)
২রা জুলাই, ১৯৭৩: জাতীয়করণকৃত প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রশাসক নিয়োগের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন-
‘…সরকার জাতীয়করণের উদ্দেশ্যে মিল, কলকারখানায় যেসব লোক নিয়োগ করেছে, প্রশাসক নিয়োগ করেছে, ষেখানে যোগ্যতার কোন মূল্য দেওয়া হয় নাই। প্রশাসকের পদগুলি দলের লোক দ্বারা পূর্ণ করা হয়েছে। যোগ্যতার মাপকাঠিতে বিচার করে প্রশাসক নিয়োগ না করায় জাতীয়করণ প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। এটা অত্যন্ত দু:খজনক এবং সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে নৈরাশ্যজনক।’ (পূর্বোক্ত, পৃ. ১২৪)
একই দিন দেশে মানুষের নিরাপত্তাহীনতার পরিস্থিতি নিয়ে বলছেন-
‘আপনি জানেন আজকাল সকাল বেলা সংবাদপত্র খুললেই প্রাণ কাঁপতে থাকে, না জানি কি সংবাদ আজ বহন করে এনেছে, না জানি কার মূল্যবান প্রাণ ডাকাতের গুলিতে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে, না জানি কোন রাজনৈতিক নেতার হত্যার খবর বহন করে এনেছে, না জানি কোন ব্যাঙ্ক লুটের খবর বহন করে এনেছে।…হত্যা, রাহাজানি, লুটতরাজ, রেপিং এর সংবাদ নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে।..কালোবাজারী, মুদ্রাস্ফীতি, কাল টাকায় বাজার ছেয়ে গিয়েছে। সরকারের প্রশাসন ব্যবস্থা ঠিকমত কাজ করতে পারছে না।’ (পূর্বোক্ত, পৃ. ১২৪-১২৬)
আজকাল সকাল বেলা সংবাদপত্র খুললেই প্রাণ কাঁপতে থাকে, না জানি কি সংবাদ আজ বহন করে এনেছে, না জানি কার মূল্যবান প্রাণ ডাকাতের গুলিতে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে, না জানি কোন রাজনৈতিক নেতার হত্যার খবর বহন করে এনেছে, না জানি কোন ব্যাঙ্ক লুটের খবর বহন করে এনেছে।
একই দিনে শ্রমিকদের নিয়ে সরকারি তৎপরতার বিপদ সম্পর্কে জানাচ্ছেন-
‘শ্রমিক শক্তিকে কাজে লাগানোর চেষ্টা না করে সরকার তাদেরকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করার চেষ্টা করছেন। যার ফলে আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি এই শ্রমিকদের দিয়ে সরকার সবুজ বাহিনী, লাল বাহিনী গঠন করেছেন। যারা লাল, সবুজ টুপি পরে লাঠি, ডাণ্ডা হাতে নিয়ে মিলে, ফ্যাক্টরীতে ঘুরে বেড়ায়। মিল-ফ্যাক্টরীর উৎপাদন বাড়াবার জন্য কোন কাজ তারা করে না। এই যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য রাজনৈতিক সুবিধা-স্বার্থ সংগ্রহের জন্য শ্রমিকদের বিভ্রান্ত পথে পরিচালিত করেছেন তা জাতির জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ।’ (পূর্বোক্ত, পৃ. ১২৯)
প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও কমিশন
১৯৭২ সালের প্রথমেই গঠিত হয় পরিকল্পনা কমিশন। প্রথমে এর চেয়ারমান ছিলেন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। পরে প্রধানমন্ত্রীই এই দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ডেপুটি চেয়ারম্যান ছিলেন নূরুল ইসলাম। আর এর সদস্য ছিলেন রেহমান সোবহান, মোশাররফ হোসেন ও আনিসুর রহমান। এই তিনজনই তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক, ছুটি নিয়ে কমিশনে যোগ দিয়েছেন। রেহমান সোবহান পাকিস্তানের দুই অর্থনীতি, অর্থাৎ দুই অঞ্চলের বৈষম্য নিয়ে সবচাইতে সোচ্চার অর্থনীতিবিদদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় ছিলেন। বস্তুত তিনি ১৯৫০ দশকের শেষ থেকেই এদেশের রাজনৈতিক তৎপরতার বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন এবং নানাভাবে কাজও করেছেন। ৬০ দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক থাকাকালে তিনি বৈষম্য ও বঞ্চনা বিষয়ে সরব ছিলেন। সে সময়ে ৬ দফার সাথে সম্পর্কিত অর্থনৈতিক বিশ্লেষণেও তাঁর বিশেষ ভূমিকা ছিল। (সোবহান, ২০১৬) ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি প্রবাসী সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে জনসংযোগ জনমত গঠন ও বিভিন্ন সরকারের সমর্থন আদায়ে কাজ করেছেন। সুতরাং তিনি নবগঠিত সরকারের খুবই পরিচিত ও আস্থাভাজন ছিলেন।
কিন্তু পরিকল্পনা কমিশন যেভাবে প্রথম গঠিত হয় তাতে রেহমান সোবহান বিস্মিত ও চিন্তিত হয়েছিলেন। তিনি লিখেছেন, ১০ই জানুয়ারি শেখ মুজিব দেশে ফেরার পর ১১ই জানুয়ারি নূরুল ইসলাম ও তিনি তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গেছেন, মানুষের ভীড়ে কাছে ঘেঁষতে না পেরে ফেরত গিয়ে আবার ১২ই জানুয়ারি গেছেন। অনেক ভীড়ের মধ্যে থেকে তাদের ডেকে নিয়ে আলাদা করে বসেন শেখ মুজিব। বিভিন্ন কুশলাদি বিনিময়ের পর,
‘বঙ্গবন্ধু নূরুল ইসলামকে জানালেন যে, তিনি তাঁকে পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান এবং আমাকে সদস্য নিয়োগ করছেন। তিনি আনিসুর রহমানকেও সদস্য নিয়োগ করতে চাইলেন। যখন শুনলেন যে, আনিস এখনও যুক্তরাষ্ট্রের উইলিয়াম কলেজে আছে তখন তাঁকে ফেরত আসতে খবর পাঠাতে বললেন। নূরুল এবং আমি বললাম যে, যে প্রতিষ্ঠান এখনও জন্মই নেয়নি তার সদস্য নিয়োগে বঙ্গবন্ধুর আরও সময় নেয়া উচিৎ। অন্যদের সাথেও কথা বলার পরামর্শ দিলাম।… বুঝলাম যে, বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্ত তার নিজের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সম্পর্কে মূল্যায়ন থেকেই হয়। তাজউদ্দীন মন্ত্রীসভায় অর্থমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও তাঁর সঙ্গেও তিনি এ বিষয়ে কথা বলেননি। তাজউদ্দীন এই সিদ্ধান্তের কথা জেনেছেন নূরুলের কাছ থেকে।’ (সোবহান, ২০২২; পৃ.৩৫-৩৬)
এই কমিশন প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মূল দায়িত্বে ছিল, সেই সূত্রে আরও অনেকগুলো নীতি নির্ধারণী বিষয়ে তাদের দায়িত্ব ছিল। এর মধ্যে প্রধান দুটো বিষয় ছিল- ভূমি সংস্কার এবং পরিত্যক্ত প্রতিষ্ঠানসহ রাষ্ট্রীয়করণ নীতিমালা। পরিকল্পনা কমিশন দ্রুততার সাথেই প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন সম্পন্ন করেছিল। তবে অন্যান্য ক্ষেত্রে তাদের উদ্দীপনা ব্যবহারের সুযোগ কমই ছিল।
১৯৭২ সালের ২৫শে মার্চ আনিসুর রহমানের দিনলিপিতে ছিল:
‘অধ্যাপক নূরুল ইসলাম ও রেহমান সোবহান জানান যে, প্রধানমন্ত্রী হঠাৎ মত পরিবর্তন করেছেন, এবং আগামী কালকেই পাট, বস্ত্র ও চিনি শিল্পসমূহ রাষ্ট্রায়ত্ত করবার ঘোষণা দিতে চান। এটা ‘টপ সিক্রেট’ বলে রেহমান সোবহান প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণাটি লিখবেন এবং আমাকে নিজে এটি টাইপ করতে হবে। আনিসুজ্জামান এটি বাংলায় অনুবাদ করবেন।’ (রহমান, ২০০৪; পৃ. ১০২, ১০৮)
২৬শে মার্চ পরিত্যক্ত শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠানসমূহ রাষ্ট্রায়ত্ত করার ঘোষণা দেয়া হয়।
ভূমি সংস্কার নিয়ে অনেক সময় দিয়ে কাজ করছিলেন সদস্যরা। তবে ১৯৭২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি অধ্যাপক আনিসুর রহমানের দিনলিপিতে লেখা ছিল: ‘বঙ্গবন্ধু পরিকল্পনা কমিশনের সঙ্গে আলোচনা না করেই ভূমি মালিকানার সিলিং ১০০ বিঘা ঘোষণা করে দিয়েছেন।’ রেহমান সোবহানের ভাষ্য অনুযায়ী, ১৯৭২ সালের মাঝামাঝি পরিকল্পনা কমিশন ভূমি সংস্কার বিষয়ে একটি কমিটি গঠন করে যার প্রধান ছিলেন মোশাররফ হোসেন। ভূমি সংস্কারের খসড়া প্রণয়নের দায়িত্ব ছিল আনিসুর রহমানের ওপর। কমিশন বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে সদস্য নিয়ে একটি স্টাডি গ্রুপ গঠন করেছিল। তাদের সুপারিশের ভিত্তিতে আনিসুর রহমান খসড়া প্রণয়ন করেন এবং কমিশনে জমা দেন। কমিশনে তা আরও সংযোজন পরিমার্জন শেষে তা ভূমিসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়। এই খসড়া প্রস্তাবের সারসংক্ষেপে রহমান জানাচ্ছেন যে,
‘….পরিকল্পনা কমিশন প্রস্তাব করে যে, ভূমি সংস্কারের প্রথম পর্যায়ে যে আয়তনের জমি ঐতিহাসিকভাবে বেশি ফলনশীল হয়েছে তাদের ব্যক্তিগত মালিকানায় রেখে বড়ো আয়তনের জমি ইকুইটি ও ফলনশীলতা বৃদ্ধির খাতিরে ছোট করা, অর্থাৎ একটা সীমার ওপরে জমি রাষ্ট্রায়ত্ত করা। এইভাবে যে উদ্বৃত্ত জমি পাওয়া যাবে সেখানে দৃষ্টান্তমূলক সমবায়ভিত্তিক চাষ হবে। বর্তমানে যেসব বর্গাচাষী এ-সমস্ত জমিতে চাষ করছে তাদের এই সমবায়গুলিতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নেওয়া হবে।….সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য, এবং যাতে সমবায়ভিত্তিক চাষের বাস্তব পরীক্ষার জন্য অর্থপূর্ণ আয়তনে জমি উদ্বৃত্ত পাওয়া যায়, এই বিবেচনায় জমির মালিকানার সর্বোচ্চ সীমা প্রস্তাব করা হয় ১০ স্ট্যান্ডার্ড একর, যে সীমা বিভিন্ন ভৌগোলিক অঞ্চলে জমির ফলনশীলতার তারতম্য অনুযায়ী কমবেশি হবে (যথা কুমিল্লার জন্য ৭.৫ একর এবং যশোহরের জন্য ১৩.৮ একর)।’ (রহমান, ২০০৪; পৃ.৫১-৫২)
প্রস্তাবের বিষয় উল্লেখ করে রহমান আরও জানান,
‘পরিকল্পনা মন্ত্রী তাজউদ্দিন ভূমি সংস্কারের এই খসড়া প্রস্তাব সর্বান্তকরণে সমর্থন করে ক্যাবিনেটে পাঠান। পরিকল্পনা কমিশন প্রস্তাব করেছিল যে এই খসড়া প্রস্তাবটি জনমত যাচাইএর জন্য বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে সমাজের কাছে পেশ করা হোক। কিন্তু ক্যাবিনেট থেকে এই প্রস্তাবটি আর ফেরত আসেনি। দেশের প্রধান খাত কৃষিখাতে প্রগতিশীল সংস্কারের এই প্রস্তাবের নীরব মৃত্যুতে একথা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, দেশ রাজনৈতিক নেতৃত্বের অঙ্গীকার অনুযায়ী সমতাবাদ ও সমাজতন্ত্রের পথে, এমনকি গুরুত্বপূর্ণ আর্থ-সামাজিক সংস্কারের প্রশ্নে সমাজের সঙ্গে সংলাপ যা প্রকৃত গণতন্ত্রের পরিচায়ক, সে পথেও যাচ্ছে না।..’ (রহমান, ২০০৪; পৃ.৫১-৫২)
‘পরিকল্পনা মন্ত্রী তাজউদ্দিন ভূমি সংস্কারের এই খসড়া প্রস্তাব সর্বান্তকরণে সমর্থন করে ক্যাবিনেটে পাঠান। পরিকল্পনা কমিশন প্রস্তাব করেছিল যে এই খসড়া প্রস্তাবটি জনমত যাচাইএর জন্য বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে সমাজের কাছে পেশ করা হোক। কিন্তু ক্যাবিনেট থেকে এই প্রস্তাবটি আর ফেরত আসেনি।
কেন এই প্রস্তাবের অপমৃত্যু ঘটলো? প্রধানমন্ত্রীর অবস্থান কী ছিল? এ বিষয়ে লিখেছেন রেহমান সোবহান,
‘… বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বেশ খোলাখুলি কথা বললেন। তিনি যুক্তি দিলেন যে, ইতিমধ্যে তিনি রাষ্ট্রীয়করণ নীতি গ্রহণের মধ্য দিয়ে সীমার বাইরে চলে গেছেন। কার্যত ব্যবসায়ী জগতে এটা তার পুরনো সমর্থন ভিত্তির অনেককে দূরে ঠেলে দিয়েছে। গ্রামে তাঁর ক্ষমতা ভিত্তিকে আঘাত করা তাঁর জন্য খুব বেশি তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে। এই একই ধনী কৃষক শ্রেণী শুধু তাঁর পার্টির এলাকাগত সমর্থন তৈরি করে নাই, তাঁদের সন্তানেরা পার্টির ছাত্র ভিত্তির নেতৃত্ব গঠন করেছে। … রাজনৈতিক নেতৃত্ব ধনী কৃষকদের স্পর্শ করতে একেবারেই অনাগ্রহী ছিল।’ (সোবহান, ২০২২; পৃ. ১২৪-২৫)
বস্তুত পরিকল্পনা কমিশনের সাথে আমলাতন্ত্র, মন্ত্রীসভা ও প্রধানমন্ত্রীর এক জটিল সমীকরণ তৈরি হয়েছিল। এই জটিলতা এতো বেড়েছিল যে, কিছুদিনের মধ্যেই একে একে প্রথমে আনিসুর রহমান এবং পরে নূরুল ইসলাম ও রেহমান সোবহান কমিশন থেকে পদত্যাগ করেন। কমিশনের এই সদস্যরা দুইবছরের মধ্যে সবাই কমিশন ত্যাগ করেছেন। পরবর্তী কালে এই সময়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে নিজের উচ্চ প্রত্যাশা, চেষ্টা এবং হতাশার কথা লিখেছেন আনিসুর রহমান (রহমান, ১৯৯৩; রহমান, ২০০৪)। রেহমান সোবহান নিজের অভিজ্ঞতার পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকা এবং কমিশনের কাজের পদ্ধতিগত নানা সমস্যা নিয়ে লিখেছেন (সোবহান, ২০১৬; সোবহান, ২০২২)। নূরুল ইসলাম পরিকল্পনা কমিশনের অভিজ্ঞতা ও দর্শনগত সংকট নিয়ে লিখেছেন (ইসলাম, ১৯৭৯)।
পরিকল্পনা কমিশনের কাজ করতে গিয়ে কমিশনের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও কাজের ধরন প্রত্যক্ষ করেছেন সোবহান। এই সময় স্মরণ করেই তিনি লিখেছেন,
‘…এটা উল্লেখ করা দরকার যে, প্রধানমন্ত্রী প্রশাসনের সকল পর্যায়ে, সকল ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত কাজের সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করেন। বিভিন্ন জনের ক্ষমতা ও পদমর্যাদার ওঠানামা সবই নির্ভর করতো এই সম্পর্কের ওপর।… প্রধানমন্ত্রীর কাজের ধরন পরিকল্পনা কমিশনের জন্য বাস্তব ক্ষেত্রে খুবই গুরুতর সমস্যার সৃষ্টি করলো। যতোই তিনি একক সদস্য বা এমনকি কমিশনের স্টাফদের সাথে ব্যক্তিগত যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করেন ততোই কমিশনের সামষ্টিক কর্তৃত্ব খর্ব হয় এবং প্রতিষ্ঠানের কাজের শৃঙ্খলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মন্ত্রীসহ সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের মন্ত্রণালয়ে কর্তৃত্ব রাখতে পারছেন না তাদের নীচ স্তরের কারও সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি যোগাযোগ থাকার কারণে। যত সময় যাচ্ছে নানা ঘটনায় প্রকৃতপক্ষে প্রতিটি মন্ত্রীই তাদের মাথার ওপর দিয়ে মন্ত্রণালয়ের অন্যদের সাথে প্রধানমন্ত্রীর কাজের সম্পর্কের কারণে নিজেদের ক্ষমতা খর্বিত হতে দেখেন।…মন্ত্রীর কর্তৃত্বের এই ক্ষয় কোনো নীতি গ্রহণ বা কার্যকর ভাবে মন্ত্রণালয় পরিচালনায় তাদের আত্মবিশ্বাস হ্রাস করে। যত দিন যেতে থাকে সকল নীতি ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত হয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো অথবা তার নিজের উদ্যোগে গৃহীত হবার ঘটনা বাড়তে থাকে।’ (সোবহান, ২০২২, পৃ. ৭২-৭৩)
পরিকল্পনা কমিশনের সাথে যুক্ত একজন আমলার বিষয়ে সোবহান লিখেছেন যার কথা এখানে উল্লেখ করা দরকার, তার নাম ড. আবদুস সাত্তার। ১৯৭২ সালেই পরিকল্পনা কমিশনের সচিব হিসেবে তিনি নিযুক্ত হয়েছিলেন, কিন্তু তার কাজের ধরনে এবং খবরদারিতে বিরক্ত হয়ে কমিশনের সকল সদস্য ঐক্যবদ্ধভাবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়ে তাকে সেখান থেকে সরানোর আবেদন করেন। প্রধানমন্ত্রী তাদের আবেদন গ্রহণ করেন কিন্তু তাকে নিজের সচিবালয়ে এমন জায়গায় স্থাপন করেন যাতে কমিশনের সকল কিছু তার মাধ্যমেই প্রধানমন্ত্রীর কাছে যেতে হতো। (সোবহান, ২০২২, পৃ. ৫৭-৮) এর ফলে তাজউদ্দীনের নেতৃত্বাধীন পরিকল্পনা কমিশনের চাইতে প্রধানমন্ত্রী নেতৃত্বাধীন কমিশন আরো দুর্বল হয়ে পড়ে। (ঐ, পৃ. ৬৯)
সোবহানের ভাষ্যমতে এই পরিস্থিতির আগে একবার ড. সাত্তার রেহমান সোবহানের সঙ্গে দেখা করেন। তাঁর ভাষায়,
‘সাত্তার আগে না জানিয়েই আমার বাসায় এসে আমার হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিল। বঙ্গবন্ধুর জন্য তৈরি করা হয়েছে এই নোট, যেখানে তানজানিয়া বা ঘানার মতো একদলীয় শাসন কায়েম করতে বাংলাদেশের বর্তমান ব্যবস্থা পরিবর্তনের সুফল ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আমি বলেছি যে, এটা সেই দলের জন্য একেবারেই প্রযোজ্য নয়, যারা ২৪ বছর ধরে গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছে …’ (সোবহান, ২০২২; পৃ. ৫৭)
একদলীয় শাসন সম্পর্কে চিন্তাভাবনা যে বেশ আগে থেকেই শুরু হয়েছিল এই ঘটনা নিশ্চয়ই তার একটি প্রমাণ। কিন্তু এক্ষেত্রে সাত্তারের ভূমিকা সম্পর্কে সোবহান পরিষ্কার কোনো তথ্য পাননি।
‘সাত্তার আগে না জানিয়েই আমার বাসায় এসে আমার হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিল। বঙ্গবন্ধুর জন্য তৈরি করা হয়েছে এই নোট, যেখানে তানজানিয়া বা ঘানার মতো একদলীয় শাসন কায়েম করতে বাংলাদেশের বর্তমান ব্যবস্থা পরিবর্তনের সুফল ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান হিসেবে অধ্যাপক নূরুল ইসলাম তাঁর অভিজ্ঞতা নিয়ে পরে বই লিখেছিলেন। সেখানে তিনি বলছেন, আমলাদের বদলে পেশাজীবী বিশেষজ্ঞ ও বিদ্যায়তনিক অর্থনীতিবিদদের নেতৃত্বে পরিকল্পনা কমিশন গঠনই ছিল অতীতের ধারাবাহিকতা থেকে একটা ভিন্নযাত্রা। কিন্তু ‘সমস্যা শুরু হয় তখনই যখন দেখা যায় রাজনৈতিক নেতৃত্বের এ বিষয়ে দৃঢ় কোনো অঙ্গীকার নেই।’ তিনি সুনির্দিষ্টভাবে আরও বলেন, তখন দুইপথের মধ্যে বাছাই করার ব্যাপার ছিল-
‘একদিকে কঠোর কৃচ্ছতা…যার জন্য দরকার হতো মতাদর্শিক প্রেরণা যা স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছিল না। অন্যদিকে ছিল ধনী প্রভাবশালী দেশগুলো থেকে বিপুল বিদেশি সাহায্যের চেষ্টা যার সাথে থাকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে কাজ করার পথে নানা বিধিনিষেধ। বাংলাদেশ বৃহৎ বিদেশি সাহায্যের পথই গ্রহণ করলো।’ (ইসলাম, ১৯৭৯; পৃ. ৮)
নূরুল ইসলাম আরও লিখেছেন, এর কারণে পরবর্তী সময়ে প্রথম পরিকল্পনায় বর্ণিত আদর্শিক অবস্থানে ক্ষয় দেখা দিল এবং এমন নতুন সামাজিক শ্রেণী/শক্তির দেখা যেতে লাগলো যাদের অস্তিত্ব আগে ছিল না। এই সময়ে কারা নির্ধারক ভূমিকা পালন করছিল তাদের চিহ্নিত করে তিনি বলছেন,
‘১৯৭৪ সালের মধ্যে কিছুজন দেখা গেল যারা ব্যবসা, ফটকাবাজারী, নির্মাণ এবং অন্যান্য তৎপরতায় বিপুল মুনাফা অর্জন করেছে। তাদের সাথে যুক্ত হয়েছে বিদেশি সাহায্য সংস্থার পাশাপাশি বিদেশি কর্পোরেশন..! (পূর্বোক্ত, পৃ. ১৬)
১৯৭৪ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার ওপর বিশেষ সম্মেলন করে। কমিশনের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালনের এক পর্যায়ে পদত্যাগ করে ততদিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেরত গেছেন ড. আনিসুর রহমান। তিনি এই সম্মেলন সম্পর্কে লিখেছেন,
‘অর্থনীতি সমিতি এই সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীকে প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানাবার সিদ্ধান্ত নেয়। দেশের চারদিকে তখন শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব নানান প্রশ্নের সম্মুখীন এবং তিনি সভা সমিতিতে যাওয়া প্রায় বন্ধ করে দিয়েছেন।…আমি গেলাম তাঁদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কাছে।…আমাদের সকলের সনির্বন্ধ অনুরোধ সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী কিছুতেই অর্থনীতি সমিতির সম্মেলনে আসতে রাজী হলেন না- এর অন্তর্নিহিত বাস্তবতা যে তাঁর জন্যে কতটা করুণ তা বলাই বাহুল্য।’ (রহমান, ২০০৪, পৃ. ৯৯)
তিনি আরও বলেছেন,
‘পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার ওপর অর্থনীতি সমিতির সম্মেলনে আমাকেও কিছু বলতে হয়েছিল। আমি বলেছিলাম যে, এই পরিকল্পনা একইসঙ্গে আমাদের ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার শ্রেষ্ঠ এবং নিকৃষ্টতম ফসল। শ্রেষ্ঠ এই জন্য যে, এই পরিকল্পনা টেকনিক্যাল মেধা ও যোগ্যতার দিক দিয়ে বিশ্বের যেকোন দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনার সঙ্গে তুলনীয়; নিকৃষ্টতম এই জন্য যে, এই পরিকল্পনা আকাশেই উড়ছে দেশের মাটি স্পর্শ করতে পারেনি।’ (পূর্বোক্ত, পৃ. ১০০)
ঐ সময়কাল নিয়ে অর্থনীতি সমিতির প্রকাশনাতে বলা হয়েছিল, ‘ততোদিনে দেশের অর্থনৈতিক গতিপথ নির্ধারণে অর্থনীতিবিদদের সামর্থ্য নিয়ে বিশ্বাস টলে গেছে।’ এবং ‘পরিবেশটা তখন জাতীয় হতাশা এবং বিশ্বাসভঙ্গের।’ (সমিতি, ১৯৭৪)
অর্থনীতি সমিতির ঐ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেছিলেন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি ড. মাজহারুল হক। তিনি তাঁর সভাপতির ভাষণে কিছু গুরুতর প্রশ্ন উত্থাপন করেন। তিনি সমাজতন্ত্র শব্দ ব্যবহারের যৌক্তিকতা নিয়েই প্রশ্ন তোলেন যখন পুরো তার উল্টো কাজ করা হচ্ছে। তিনি স্পষ্ট করেই বলেন যে, ‘সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দিকে যাবার ক্ষেত্রে শাসক দল পুরেপুরি অনুপযুক্ত, উপরন্তু সে লক্ষ্য পূরণের জন্য তাদের ন্যূনতম আন্তরিকতাও নাই।’ তিনি বরং তাঁর পর্যবেক্ষণে দেখেন লুটপাট, অতিভোগ, অপচয় উল্লাসই দেশে মূল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনারও কঠোর সমালোচনা করেন। বলেন,
‘এই পরিকল্পনা পাকিস্তানের চতুর্থ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার আরেকটি সংস্করণ ছাড়া আর কিছু নয়। সমাজতন্ত্রের বাগাড়ম্বর সত্ত্বেও এটা মোটেই সমাজতান্ত্রিক পরিকল্পনা নয়।’ (হক, সমিতি, ১৯৭৪)
(চলবে)
(ভিন্ন নির্দেশ করা না থাকলে এই লেখায় বিভিন্ন উদ্ধৃতির অনুবাদ এই লেখকের।)
আগের পর্ব: বাংলাদেশের ৫০ বছর ও তারপর-১
পরের পর্ব: বাংলাদেশের ৫০ বছর ও তারপর-৩
আনু মুহাম্মদ: শিক্ষক, লেখক এবং সর্বজনকথা-র সম্পাদক। ইমেইল: sarbojonkotha@gmail.com
তথ্যসূত্র
আহমদ, ২০১৫। ফিরোজ আহমদ: বাংলাদেশের সংবিধান ও রাষ্ট্রের গতিমুখ: সূচনাকাল। সর্বজনকথা ১ম বর্ষ ৩য় সংখ্যা মে-জুলাই।
ইসলাম ১৯৭৯। Nurul Islam, Development Planning in Bangladesh, Dhaka, 1979
ইসলাম ২০২৩। মঞ্জুরুল ইসলাম, সংবিধান সংশোধনের রাজনীতি-২, প্রথম আলো, ২৭ আগস্ট ২০২৩।
উমর ১৯৮৭। Badruddin Umar: Politics and Society in Bangladesh, Subarna, Dhaka, 1987.
জলি ২০১৯। ৭৩ এর সংসদ ও একজন আবদুল্লাহ সরকার, সম্পাদক: তাহেরা বেগম জলি। ঢাকা, ডিসেম্বর।
জাহান ১৯৭৩। Rounaq Jahan: Bangladesh in 1972: Nation Building in a New State, Asian Survey, Vol. 13, No. 2 (Feb., 1973).
পারভেজ, ২০১৫। আলতাফ পারভেজ: মুজিব বাহিনী থেকে গণবাহিনী ইতিহাসের পুনর্পাঠ। ঢাকা, ঐতিহ্য।
মহিউদ্দীন ২০১৪। মহিউদ্দীন আহমদ: জাসদের উত্থান পতন : অস্থির সময়ের রাজনীতি। ঢাকা
মুসা ১৯৯১। আহমেদ মুসা: ইতিহাসের কাঠগড়ায় আওয়ামী লীগ। ঢাকা। পরিবেশক: ডানা পাবলিশার্স।
রহমান ২০০৪। মো: আনিসুর রহমান: পথে যা পেয়েছি, দ্বিতীয় পর্ব, অ্যাডর্ণ পাবলিকেশন, ফেব্রুয়ারি।
রহমান ১৯৯৩। Anisur Rahman: The Lost Moment, UPL, 1993.
হক ২০২০। যে জীবন জনতার, কমরেড আফম মাহবুবুল হক স্মারকগ্রন্থ, কমরেড আফম মাহবুবুল হক স্মৃতি সংসদ, ঢাকা।
সরকার ১৯৯৬। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার: গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান।
সমিতি, ১৯৭৪। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি প্রকাশনা, ঢাকা, ১৯৭৪।
সোবহান ২০১৬। Rehman Sobhan: Untranquil Recollections. The Years of Fulfilment, Sage, Delhi.
সোবহান ২০২২। ——————-: Untranquil Recollections From Dawn to Darkness, UPL, Dhaka.
টীকা:
1 চীনের পূর্ণ স্বীকৃতি আসে ১৯৭৫ এর পট পরিবর্তনের পর। তবে আমার মনে আছে এর আগেই একই বছরের মে মাসে দৈনিক পত্রিকায় শিরোনাম দেখেছিলাম যে, চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছে। তার মানে যোগাযোগ আগেই হয়েছিল।
[2] এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত তথ্য বিশ্লেষণ পাওয়া যাবে সর্বজনকথায় ২০২২ থেকে প্রকাশিত মেহেদী হাসান রচিত – ‘২২ পরিবারের অতীত ও বর্তমান’ শীর্ষক ধারাবাহিক লেখায়।
[3] এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় গবেষণা আরো হওয়া দরকার। কিছু তথ্য ভাষ্য পাওয়া যায় বিভিন্ন জনের আত্মজৈবনিক লেখায়। এ নিয়ে বিস্তারিত তথ্য উপাত্তসহ বিশ্লেষণের পরিশ্রমী কাজ করেছেন আলতাফ পারভেজ (পারভেজ, ২০১৫)।
[4] [4]Badruddin Umar: “A constitution for ‘perpetual’ emergency”, Holiday, October 29, 1972. এর আগে তিনি প্রস্তাবিত সংবিধান যে চার মূলনীতির ওপর প্রতিষ্ঠার দাবি করেছে তাকেই প্রশ্ন করে লিখেছেন- ‘The Proposed Constitution: A Fundamental Measures Against Socialism, Democracy, Nationalism and Secularism, Holiday, October 22, 1972. এই লেখাগুলো সংকলিত হয়েছে তাঁর Politics and Society in Bangladesh (1987) গ্রন্থে।