বাংলাদেশের ৫০ বছর ও তারপর

বাংলাদেশের ৫০ বছর ও তারপর

আনু মুহাম্মদ

১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানের হানাদার সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। এরপর ৫২ বছর অতিক্রম করছে এই দেশ। এই সময়ে দুইজন রাষ্ট্রপতি খুন হয়েছেন, দুই দফা প্রত্যক্ষভাবে সামরিক শাসন এসেছে, সংবিধান সংশোধন হয়েছে ১৬ বার, নির্বাচনের নানা রূপ দেখা গেছে। পাশাপাশি অর্থনীতির আয়তন ক্রমে বেড়েছে, জিডিপি ও বিশ্ববাণিজ্যে উল্লম্ফন ঘটেছে, অবকাঠমো ছাড়াও সমাজে আয় ও পেশার ধরনসহ বিভিন্নক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন এসেছে, সম্পদের কেন্দ্রীভবন ও বৈষম্যও বেড়েছে। সর্বজনের বদলে কতিপয় গোষ্ঠীর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণে আটকে গেছে দেশ। এই লেখায় এই দেশের একজন নাগরিক তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সাথে সাথে ইতিহাসের নানা নথি পর্যালোচনা করে এই দেশের  রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, সংস্কৃতির গতিমুখ তুলে ধরতে চেষ্টা করেছেন। প্রথম পর্বে ১৯৭২-৭৩ সালের কিছু দিক আনা হয়েছে।

১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানের হানাদার সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। এরপর ৫২ বছর অতিক্রম করছে এই দেশ। এই সময়ে দুইজন রাষ্ট্রপতি খুন হয়েছেন, দুই দফা প্রত্যক্ষভাবে সামরিক শাসন এসেছে, সংবিধান সংশোধন হয়েছে ১৬ বার, নির্বাচনের নানা রূপ দেখা গেছে। পাশাপাশি অর্থনীতির আয়তন ক্রমে বেড়েছে, জিডিপি ও বিশ্ববাণিজ্যে উল্লম্ফন ঘটেছে, অবকাঠমো ছাড়াও সমাজে আয় ও পেশার ধরনসহ বিভিন্নক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন এসেছে, সম্পদের কেন্দ্রীভবন ও বৈষম্যও বেড়েছে। সর্বজনের বদলে কতিপয় গোষ্ঠীর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণে আটকে গেছে দেশ। এই লেখায় এই দেশের একজন নাগরিক তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সাথে সাথে ইতিহাসের নানা নথি পর্যালোচনা করে এই দেশের  রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, সংস্কৃতির গতিমুখ তুলে ধরতে চেষ্টা করেছেন। প্রথম পর্বে ১৯৭২-৭৩ সালের কিছু দিক আনা হয়েছে।  

বাংলাদেশে ১৯৭২ সাল শুরু হয় নতুন রাষ্ট্রে নতুন জীবনের উথাল পাথাল স্বপ্ন ও বিপুল সম্ভাবনার ভাব নিয়ে। সেসময় চারদিকে মুক্তিযুদ্ধের ক্ষত ও গৌরব, ভাঙাচোরা, অনিশ্চয়তা, অস্থিরতা। যুদ্ধ হঠাৎ করে শেষ হলেও তার প্রভাব ছিল সর্বব্যাপী। বিভিন্ন বয়স ও শ্রেণীর নারী-পুরুষ, একেবারে বোধশক্তিহীন অপরিবর্তনীয় না হলে, এর প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে পারেনি। শারীরিকভাবে, নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত তো হয়েছেন অনেকেই, মনোজগতেও বিস্তর ভাঙচুর হয়েছে- প্রত্যাশা, জীবনবোধ, জীবন-জগৎ সম্পর্কে কৌতূহল, নিজের ভূমিকার পুনর্বিন্যাস করবার চাপ ইত্যাদি। একাত্তরের সর্বব্যাপী প্রভাব আমি নিজের একাত্তর পরবর্তী অস্থিরতা, জীবনবোধের পরিবর্তনের মধ্যেও টের পাই।

তখন আমি ক্লাস টেনের ছাত্র। ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ আরও অনেকের মতো আমারও বয়স বাড়িয়ে দিয়েছে, বদলে দিয়েছে মনোযোগের ক্ষেত্র। পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর ভয়াবহ আগ্রাসন আর তার বিরুদ্ধে মানুষের অদম্য লড়াই চোখে দেখে, শুনে আর পড়ে এসব নিয়ে কোন দেশে আর কী কী হল সেগুলো নিয়ে আমার আগ্রহ তখন প্রবল। মুক্তিযুদ্ধে যাত্রা করতে গিয়ে রাজাকারদের হাতে বন্দী ও নির্যাতনের শিকার হওয়া, সেনানিবাসে পাক বাহিনীর হাতে তুলে দেবার আগ মুহূর্তে অবিশ্বাস্য ঘটনায় মুক্ত হয়ে বাকি সময় নানাভাবে যুক্ত থাকার চেষ্টার পর অতৃপ্তি নিয়ে নতুন দেশে নতুন সম্ভাবনায় আরও কিছু করার তাড়না ক্রমে বাড়ছিল। ভিয়েতনামে তখনও সশস্ত্র লড়াই সারা বিশ্বকে উদ্দীপ্ত করছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় শুনেছি তাদের লড়াই-এর কথা। আমার মতো অনেকেরই সেদিকেই মনোযোগ। চে গুয়েভারা, ক্যাস্ট্রোর কথা শুনি; আরও আগের চীন বিপ্লব, রুশ বিপ্লব নিয়ে নানা লেখা-কথা সামনে আসে। ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থনের গুরুত্ব আরও বেশি করে খেয়াল করেছি ডিসেম্বর মাসে যখন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের সমর্থনে ৭ম নৌবহর পাঠানোর কথা বলার পর সোভিয়েত ধমকে বিরত হয়েছে। পাশের দেশে নকশালবাড়ী আন্দোলনের কথা শুনি। এসব নিয়ে বই খুঁজি, পত্রিকা খুঁজি, মানুষ খুঁজি। যুদ্ধপূর্ব কৈশোরে আমি কবিতা লিখতাম, গল্প লিখতাম, ছবিও আঁকতে চাইতাম। গল্প উপন্যাস পড়ে পড়ে শব্দ আর ভাবনার নির্মাণ দেখে বিস্মিত হতাম, ছবি আঁকার ওস্তাদদের কাজ দেখে মোহিত হতাম। এই বিস্ময় নিয়ে নিজে ভাবনা আর সৌন্দর্যবোধ কিংবা কৈশোরপ্রেম কালিতে তুলিতে আনতে চেষ্টা করতাম। হতো কিনা জানিনা, কিন্তু এসবের মধ্যেই আমার নেশা ছিল। আনন্দেই ছিলাম। যুদ্ধোত্তর কালে শব্দ, ভাষা, ভাবনার গতিপথ যেন নতুন বিষয়বস্তুর সন্ধানে নামে। মানুষের মুক্তির লড়াই-সম্ভাবনা আর জয়-পরাজয় সবকিছু তখন প্রবলভাবে সামনে।

উচ্চ প্রত্যাশা আর অনিশ্চয়তা

নতুন রাষ্ট্রের শুরু হয় অনিশ্চয়তা দিয়ে। যে প্রবাসী সরকার মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছে তারা ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর প্রধান জেনারেল নিয়াজীর আত্মসমর্পণের সময় উপস্থিত ছিল না, পরের এক সপ্তাহও এই সরকারের প্রধান ব্যক্তিরা দেশে আসেননি। এক সপ্তাহ পরে এই সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট লোকজন ঢাকায় আসেন। একটা কঠিন যুদ্ধের পর দেশ স্বাধীন হলো। অথচ এতো কাছে থেকেও সরকারের ঢাকা পৌঁছাতে এই বিলম্ব কেন সেই প্রশ্ন তখনই আমার এবং অনেকের মাথায় এসেছিলো। এতো বছর পরেও এর সন্তোষজনক বা পরিষ্কার জবাব পাই নাই।

একটা কঠিন যুদ্ধের পর দেশ স্বাধীন হলো। অথচ এতো কাছে থেকেও সরকারের ঢাকা পৌঁছাতে এই বিলম্ব কেন সেই প্রশ্ন তখনই আমার এবং অনেকের মাথায় এসেছিলো। এতো বছর পরেও এর সন্তোষজনক বা পরিষ্কার জবাব পাই নাই।

২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানী বাহিনীর গণহত্যা শুরুর পর স্বাধীন বাংলাদেশের লড়াই স্পষ্ট রূপ নেয়। প্রবাসী সরকার ঘোষণা করা হয় ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল, আনুষ্ঠানিকভাবে সেই সরকার শপথ গ্রহণ করে ১৭ এপ্রিল, মুজিবনগরে। সেখানে উপস্থাপিত হয় ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’, যা কার্যকর বলা হয়েছিল ২৬শে মার্চ থেকে। সেখানে ঘোষিত সরকারে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করা হয়েছিল শেখ মুজিবুর রহমানকে, যিনি তখন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। বস্তুত তাজউদ্দীন আহমদই ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠক। ১৭ই এপ্রিল উপস্থাপিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বলা হয়,

‘যেহেতু বাংলাদেশের জনগণ তাদের বীরত্ব, সাহসিকতা ও বিপ্লবী কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশের উপর তাদের কার্যকরি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে; সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যে ম্যান্ডেট দিয়েছেন সে ম্যান্ডেট মোতাবেক আমরা, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, আমাদের সমবায়ে গণপরিষদ গঠন করে পারষ্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র ঘোষণা করছি এবং এর দ্বারা পূর্বাহ্নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা অনুমোদন করছি….’

১৯৭১ সালের ২২শে ডিসেম্বর দেশে ফিরে প্রবাসী সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করলেও তাদের অনেক ধরনের সমস্যায় পড়তে হয়। সারা দেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ছিল বেশ নাজুক, মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে তখন অনেক ধারা, সরকারের মধ্যেও ঐক্যমতের অভাব। সেসময় এসব বিষয়ে আমার বিস্তারিত জানা ছিল না। আসলে মুক্তিবাহিনী-মুজিববাহিনী, তাজউদ্দীন-শেখ মণির যে বৈরী বিরোধের খবরাখবর পরে জেনেছি তা তখন খুব কম জনেরই জানা ছিল। দেশে তখনও ভারতীয় সৈন্যরা অবস্থান করছে। প্রথমদিকে জনগণ তাদের স্বাগত জানিয়েছে, কিন্তু ক্রমেই তাদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠতে শুরু করেছিল। মেজর জলিল আটক, দেশের বিভিন্ন ধরনের সম্পদ পাচার এগুলো কানে আসে। 

৮ই জানুয়ারি যখন পাকিস্তানের কারাগার থেকে শেখ মুজিবের মুক্তির খবর এলো, পুরো দেশ যেন তখন নতুন প্রাণ পেলো, উচ্ছ্বাস আর উৎসব। আমাদের পরিবারেও তার ছোঁয়া। আমার রাশভারী বাবার মুখেও স্বস্তি আর আনন্দের ভাব। আমাদের বাসায় টেপ রেকর্ডার ছিল যাতে মাইক্রোফোন লাগিয়ে কথা বলা যেত, রেকর্ড করা যেত, আমরা তাই নিয়ে এই সুখবর সবাইকে জানাতে পাড়া ঘুরলাম। ১০ই জানুয়ারি আর আমাকে ঠেকানো গেল না। তেজগাঁও এয়ারপোর্টে কীভাবে গেলাম আর ফিরলাম জানিনা। শেখ মুজিবকে নিয়ে চলা ট্রাক-এর কাছাকাছি চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু ভয়ংকর ঠেলাঠেলিতে স্যান্ডেল কোথায় গেল, চশমা ভেঙে গেল, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আর যাওয়া হলো না। বাসায় বিধ্বস্ত অবস্থায় ফিরলাম, কিছু পরে দেখলাম আব্বা ফিরছেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে। তিনি ভাষণ শুনেছেন। তবে বললেন,

‘শুনলাম শেখ সাহেব নাকি প্রধানমন্ত্রী হবেন। ঠিক হবে না, তাঁর উচিৎ ছিল গান্ধীর মতো সব বিতর্কের উর্ধ্বে থাকা।’

দুদিনের মধ্যেই সরকার পুনর্গঠিত হলো। সংসদীয় পদ্ধতির সরকার, শেখ মুজিব প্রধানমন্ত্রী, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী রাষ্ট্রপতি। তাজউদ্দীন আহমদ অর্থমন্ত্রী, তখনও তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। এর পরপরই তিনি এই পদ থেকে অব্যাহতি পান, পরে মন্ত্রীত্বও। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠক তাজউদ্দীন আহমদ মুক্তিযুদ্ধের পর প্রথম থেকেই শেখ সাহেবের বৈরী আচরণের শিকার হয়েছেন। এর স্পষ্ট কারণ এখনও জানা নাই। আরেকটি প্রশ্নও গুরুতর। কেন শেখ মুজিব তাঁর অনুপস্থিতিতে কীভাবে সবকিছু হলো তা মুক্তিযুদ্ধের এই প্রধান সংগঠকের কাছ থেকে শুনলেন না এবং কিছু বললেনও না? তাজউদ্দীন যে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার জন্য বারবার চেষ্টা করেছেন কিন্তু সফল হননি তার সাক্ষ্য-প্রমাণ আছে। এসব প্রশ্নের জবাব এতো বছর পরেও পরিষ্কার হয়নি। এটাও তাৎপর্যপূর্ণ যে,  ১০ বা ১৭ই এপ্রিল নিয়ে পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকারগুলোরও তেমন উৎসাহ দেখা যায়না। মুজিবনগরে শেখ মুজিব থেকে শেখ হাসিনা কেউ গিয়েছেন বলে মনে করতে পারছি না। 

প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনিসুর রহমান দুজনকেই ঘনিষ্ঠভাবে দেখেছেন। সরকারি নীতি উদ্যোগ বিতর্কও দেখেছেন খুব কাছে থেকে। তিনি লিখেছেন,

‘…তাজউদ্দীন মুজিবের নেতৃত্ব কখনো চ্যালেঞ্জ করেননি কিন্তু মার্কিন সাহায্য সম্মন্ধে দুজনের এ বিপরীতমুখী অবস্থানের মধ্যে তাঁদের সমাজদর্শনগত চিন্তার মধ্যে যে একটা মৌলিক পার্থক্য ছিল-একজনের স্পষ্ট সমাজদর্শনবিহীন বিদেশী সাহায্য-মানসিকতা, আর অপরজনের সমাজতন্ত্রের প্রতি নিজের মতো করে নিষ্ঠা এবং বিদেশী সাহায্যকে সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা- তা অত্যন্ত স্পষ্ট। এরকম বিপরীতমুখী অবস্থান নিয়ে দুজনের পক্ষে একই পার্টিতে একসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা যে সম্ভব ছিল না তা বলাই বাহুল্য।’ (রহমান, ২০০৪, ৩৭)

যাইহোক, বাংলাদেশে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবস্থান নিয়ে প্রথম থেকেই মানুষের মধ্যে প্রশ্ন, শংকা ও ক্ষোভ তৈরি হচ্ছিলো। এগুলো আরও বাড়ছিল বিভিন্ন স্থানে তাদের ভূমিকা দেখে ও শুনে। বাংলাদেশের অস্ত্রসহ বিভিন্ন শিল্প-কারখানা ইত্যাদির সম্পদ তারা নিয়ে যাচ্ছে, প্রতিবাদ করলে অত্যাচার করছে এগুলো আমরাও শুনতাম। এর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিলকে ভারতীয় বাহিনীর আটক করা নিয়ে এবিষয়ে বহুরকম কথা শোনা গেল। সেসময় মওলানা ভাসানী প্রকাশিত সাপ্তাহিক হককথায় মেজর জলিলের মা মোসাম্মৎ রাবেয়া খাতুনের বিষয় উল্লেখ করে জানানো হয়-

‘স্বাধীনতার ১১ দিন পর গত ২৭শে ডিসেম্বর যশোর হতে মেজর জলিলের অন্তর্ধানের পর থেকেই সারা বাংলাদেশে নানা কথার কানাঘুষা চলতে থাকে। …এই স্বাধীনচেতা মেজরের মা মোসাম্মৎ রাবেয়া খাতুন বরিশালের উজিরপুর থেকে জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝিতে প্রধানমন্ত্রীর নিকট একখানা স্মারকলিপি প্রেরণ করেন। কিন্তু তাঁর তরফ থেকে কোন প্রকার জবাব বা বিধান না পেয়ে ফেব্রুয়ারী মাসের শেষের দিকে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী সমীপে এক দুঃখিনী মায়ের ফরিয়াদ’ এই শিরোনামায় তিন পৃষ্ঠাব্যাপী মুদ্রিত একটি খোলা চিঠি বিলি করেন।…স্বাধীনচেতা এই মেজরের অপ্রত্যাশিত বীরত্ব ও সাফল্যই তাঁকে ভারতীয় বাহিনীর কোপদৃষ্টিতে ফেলে।…স্নায়ু সংঘর্ষটি চরমে পৌঁছালো যখন মেজর জলিল ভারতীয় বাহিনীর জিনিষপত্র সংগ্রহ অভিযানে প্রতিবাদ করে বসলেন।…বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় বহুল আলোচিত হবার উপক্রম হলে প্রায় আড়াই মাস চুপচাপ থাকার পর সরকার মেজর জলিলের গ্রেফতারের কথা স্বীকার করে তার বিচার হবে বলে ঘোষণা করেন।’ (হককথা, ১৬ই এপ্রিল ১৯৭২; উদ্ধৃতি- হককথা সমগ্র ২০০২, পৃ. ১৩৯-৪০)

সেসময়ে শেখ মুজিবের একটি বড় কৃতিত্ব এবং দেশবাসীর একটি বড় স্বস্তির ঘটনা হলো ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে ভারতীয় বাহিনীকে সসম্মানে তাদের দেশে ফেরত পাঠানো। দেশে বিদেশি সৈন্য আর তাদের লোকজনদের আচরণ কথাবার্তা ঔদ্ধত্য মনে হচ্ছিল, আশংকাও হচ্ছিল, ভালো লাগছিল না।

এর কয়েকমাসের মধ্যে সরকারী দলের মধ্যে ভাঙন দেখা দেয়। ১৯৭২ সালের ২৩শে জুলাই ছাত্রলীগের দুই অংশ সম্মেলন আহবান করে এবং দুই দলই তাদের সম্মেলনের প্রধান অতিথি হিসাবে শেখ মুজিবের নাম ঘোষণা করে। একদিকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন নূরে আলম সিদ্দিকী এবং আবদুল কুদ্দুস মাখন। অন্যদিকে আসম আবদুর রব এবং শাজাহান সিরাজ, যাদের পেছনে মূল ব্যক্তি ছিলেন সিরাজুল আলম খান। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত শেখ মুজিব ছাত্রলীগের কোন অংশের সম্মেলনে যাবেন তা নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল। শেষে তিনি প্রথম গ্রুপের সাথেই যান যারা মুজিববাদকে আদর্শ হিসেবে ঘোষণা করে। আর দ্বিতীয় অংশ এরপর সংগঠনের লক্ষ্য হিসেবে ঘোষণা করে- বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র।

আসলে শেখ মুজিবের সাথে দ্বিতীয় অংশের টানাপোড়েন চলছিল আগে থেকেই। এরাই চাচ্ছিলেন গণপরিষদ বাতিল করে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠা। শেখ মুজিব তাদের পরিত্যাগ করায় তারা অন্য পথ গ্রহণ করেন,  ১৯৭২ সালের ৩১শে অক্টোবর মেজর আবদুল জলিল ও আসম আবদুর রবকে যুগ্ম-আহবায়ক করে ‘জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল’ (জাসদ) নামে নতুন দল গঠনের ঘোষণা দেয়া হয়। আমি সেসময় জাসদ ও সর্বহারা পার্টির খবরাখবর আগ্রহ নিয়ে জানতে চেষ্টা করতাম। সংবাদপত্রে নিয়মিতই জাসদের খবর থাকতো, আর সর্বহারা পার্টির খবর থাকতো প্রধানত দেয়াল লেখায়। জাসদ ছিল প্রকাশ্য দল, আর সর্বহারা পার্টি ছিল আত্মগোপনে থাকা দল যারা নতুন রাষ্ট্রের জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের আওয়াজ দিচ্ছিলো।  

এর মধ্যে ১৯৭২ সালের ৩রা জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) এবং হল সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্রলীগের মধ্যে বিরোধ তখন সহিংস, তাদের তখন দুটি প্যানেল। এই অবস্থায় বিজয়ী হয় ছাত্র ইউনিয়ন, স্বাধীন দেশে ডাকসুর প্রথম সহসভাপতি হন ছাত্র ইউনিয়নের নেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এবং সাধারণ সম্পাদক মাহবুব জামান।

কিশোরদের উদ্যোগ, আকাঙ্ক্ষা ও হতাশা

আগেই বলেছি, আমার নিজেকে দিয়ে বুঝতে পারি সেসময়ের কিশোর-তরুণদের আগ্রহ উৎসাহ কীভাবে বদলে যাচ্ছিল। স্কুলের পড়াশোনার চাইতে বেশি আগ্রহ তখন অন্য নানারকম কাজ করার। বয়সে কিছু বড় বন্ধু কবি আখতার, বন্ধু পিউ সহ পাড়ার কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করলাম ‘অংকুর পরিষদ’। একটা পত্রিকা বের করতে শুরু করলাম অংকুর নামেই, প্রথমে সাইক্লোস্টাইল কয়েক সংখ্যা বের করার পরে ছাপা পত্রিকার উদ্যোগ নিলাম। এক প্রেসের খোঁজ পেলাম, আমাদের পাড়া থেকে বেশ দুরে পুরনো ঢাকার বেচারাম দেউড়ী। কীভাবে যোগাযোগ হলো মনে নাই, আসা যাওয়া করতে হতো বেশিরভাগ সময় হেঁটে, কিছু পথ কখনও বাসে। লেখা জোগাড়, ছাপা, বিতরণ এগুলোর জন্য আখতার ও আমি এই দুজনই ছিলাম সক্রিয়। তখন পেনফ্রেন্ডসহ কিছু যোগাযোগ ব্যবস্থা কাজ করতো। এধরনের নেটওয়ার্কে অংকুরে লেখার জন্য খবর দিয়েছি। প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের কাছেও সরাসরি চলে গেছি যেভাবে তা বোধহয় ঐ বয়সেই সম্ভব। যেমন খোঁজ করে একদিন হাজির হলাম শিল্পী কামরুল হাসানের অফিসে। বললাম, আমরা একটা পত্রিকা বের করি, আপনি একটা প্রচ্ছদ এঁকে দেন। এখন ভেবে অবাক হই, কীভাবে গেলাম এবং তিনি আমাদের বসিয়ে কাগজে কয়েকটি টান দিয়ে সত্যি সত্যি একটা ছবি এঁকে দিলেন। আমরা খুব খুশি হয়ে ফিরলাম। একদিন হাজির হলাম কমলাপুরে কবি জসিমউদ্দীনের বাসায়। বললাম লেখা নিতে এসেছি। তিনি আমাদের বসিয়ে মুড়ি নারিকেল গুড় খাওয়ালেন। পোস্টেও বিভিন্ন লেখা পেয়েছি। তার মধ্যে একটি লেখার কথা মনে আছে, বেশ গোছানো আর সুন্দর হাতের লেখার জন্য। লেখকের নাম আলী রীয়াজ, তিনিও তখন স্কুলের ছাত্র, কোথাও এই খবর দেখে লেখা পাঠিয়েছেন। অংকুর বেশ কয়েকটি সংখ্যা বের হয়েছিল। 

পাড়ায় এক বাসায় এক রুম পেলাম আমাদের কাজের জন্য। কীভাবে মনে নাই, নিশ্চয়ই সহৃদয় অভিভাবক আমাদের ওপর আস্থা রেখেছিলেন। সেখানে ছোটদের ছবি আঁকার স্কুল করলাম। পাড়ার দুই শিল্পী বোন শান্তি ও লিলুও আমাদের সাথে যোগ দিল। কারও যোগাযোগে তখনকার চারুকলার এক সিনিয়র ছাত্র অলক রায়কে পেলাম, তিনি এসে ছবি আঁকা শেখাতেন। তখনও পাড়ায় অনেক খোলা মাঠ ছিল,  খেলাধুলা নিয়মিত হতো। সবাই মিলে পাড়ার সেসব খোলা জায়গায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও হলো কয়েকটা। পাশাপাশি তখন আমরা পল্লীমা সংসদের সাথেও কাজ করতাম, যা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আমার বড় ভাই ময়না তাঁর কিশোর কালে, স্বাধীনতার আগে। ১৯৭২ সালেই সেই সংসদের উদ্যোগে, যার সাথে আমার মুক্তিযুদ্ধের সময়ে যোগাযোগ, কাজ ও নানা পরিকল্পনা হয়েছে সেই ইউনিট কমান্ডার শহীদ আবদুল্লাহ হেল বাকির নামে ‘শহীদ বাকি স্মৃতি পাঠাগার’ হয়েছে। তার সহযোগী শহীদ বাবুল-এর নামে হয়েছে স্কুল-‘শহীদ বাবুল একাডেমী’।     

মনে আছে আমরা অংকুর পত্রিকা প্রকাশের পর উচ্ছ্বাস আর উদ্দীপনার জোরে বিভিন্ন স্কুলে গেছি তা বিতরণ করতে। সিদ্ধেশ্বরী বালক ও বালিকা বিদ্যালয়, সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট হাই স্কুল, কলেজিয়েট স্কুল, ভিকারুননিসা স্কুল সহ আরও অনেক প্রতিষ্ঠানে বন্ধুদের নিয়ে গেছি। পত্রিকা বিক্রি, লেখা চাওয়া, পরামর্শ চাওয়া ইত্যাদির জন্য শিক্ষার্থী ছাড়াও সরাসরি প্রধান শিক্ষকের রুমে গেছি। সহযোগিতা এবং উৎসাহই পেয়েছি, কোনো সমস্যা হয়নি। সেসময় এরকম হাঁটতে হাঁটতে আমরা কয়জন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও গেলাম। মনে আছে, বিভিন্ন ছাত্রছাত্রীর সাথে কথা বলতে বলতে দেখি কলাভবনের নীচতলায় করিডোর দিয়ে দলেবলে ডাকসু ভিপি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম আসছেন। তাঁকেও আমাদের পত্রিকার কথা বললাম, কপিও দিলাম।

শুনলাম, পত্রিকা ও টিভিতেও দেখলাম, প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল খোলা হয়েছে। শহীদ ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তহবিল তৈরি করা হচ্ছে। মনে হলো এর জন্য তো আমরাও কাজ করতে পারি, টাকা সংগ্রহ তো আমাদেরও করা উচিৎ। কীভাবে তোলা যায়? চিন্তা হলো চ্যারিটি শো-করার। এগুলো করতে গেলে যে কতোরকম ঝামেলায় পড়তে হয়, পরিশ্রম করতে হয় সেই ধারণা ছিল না। কিন্তু উদ্যম আর প্রেরণা ছিল, সুতরাং ঠিকই সবকিছু হয়ে গেল। কয়জন মিলে কয়দিন মেলা ব্যস্ত, মেলা কাজ, গুলিস্তান এলাকায় বিভিন্ন ভবনে বিভিন্ন চলচ্চিত্র পরিবেশকদের খুঁজে কীভাবে যেতে পারলাম মনে নাই। ছবি জোগাড় হলো, গুলিস্তান হল ভাড়া করা হলো, টিকেট ছাপিয়ে পল্লীমা ও অংকুরের বন্ধুরা ঘরে ঘরে গিয়ে বিক্রি করলেন। হল মোটামুটি ভরলো।

টিকেট বিক্রির টাকা থেকে খরচ বাদ দিয়ে থাকলো যতদূর মনে পড়ে ৩৫২ টাকা ৬০ পয়সা। তারপর আর বেশি দেরি না করে কয়েকদিন পর প্রধানমন্ত্রীর হাতে সেই টাকা পৌঁছানোর চিন্তা করলাম। টাকা একটা খামে ভরে পাড়ার আমার ছোট বড় ১২/১৩ জনের একটি দল এক বিকালে কোনো পূর্বযোগাযোগ ছাড়া হেঁটে হেঁটে রওনা হলাম মিন্টো রোডে প্রধানমন্ত্রীর সেসময়ের কার্যালয় পুরনো গণভবনের দিকে। আমরা তখন এতটুকু জানি যে ওখানে প্রধানমন্ত্রী অফিস করেন, মনে হয় সংবাদপত্র দেখেই এই ধারণা। কিন্তু ঐদিন আছেন কিনা, দেখা করতে পারবেন কিনা কিছুই আমাদের জানা নাই, কে জানাবে? আমাদের সাথে ওরকম কারও যোগাযোগ নাই। আর আমাদের এসব নিয়ে কোনো টেনশনও নাই। 

যাইহোক, সন্ধ্যার আগে আগে আমরা পৌঁছালাম। গেটের পাশের ছোট্ট ঘরে আমাদের বসতে বলা হলো,  কিছুক্ষণ পর ডাক এলো। গেট থেকে বেশ কিছুটা পথ হাঁটতে হয়। তারপর ভবনের দোতলায়। বড় একটা ঘর। এখনকার মতো শানশওকত নাই। ঘরজুড়ে সাদা সোফা। অনেক নেতাই সেখানে উপস্থিত, মনে হয় কোনো সভা চলছিল। আমরা ঢোকার পর উঠে এলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব। ফটোগ্রাফারকে ডেকে ছবি তুলতে বললেন। স্বভাবসুলভ ভঙ্গীতে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী খবর তোদের?’ আমি বললাম, ‘আমরা প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে দেবার জন্য চ্যারিটি শো করে এই টাকাটা তুলছি, সেটা দিতে আসছি।’ বলে তাঁকে খামটা দিলাম। তিনি হেসে খোঁজখবর নিয়ে তারপর বললেন, ‘কী চাস তোরা?’ থতমত খেয়ে গেলাম। কারণ আমরা কোনো কিছু চাওয়ার কথা ভাবিই নাই, তার জন্য যাইও নাই। বরং আমরা উল্টো কোন কাজের দায়িত্ব পাবার আশায় গেছি। মানে তিনি আমাদের যদি তখন কোনো কাজ দিতেন আমরা নিশ্চয়ই মহা আনন্দে করতাম। চারিদিকে কিশোর তরুণদের অনেকের মনের অবস্থা এরকম যে, গ্রামে, বস্তিতে বা কোথাও শিক্ষাসহ বিভিন্ন কাজে পাঠালে সবাই যেতে প্রস্তুত। আবার জিজ্ঞাসা করলেন। আমার মাথায় কিছু আসছিল না, হঠাৎ অংকুর পত্রিকার কথা মনে এলো। বললাম, ‘আমরা একটা পত্রিকা বের করি, বিজ্ঞাপন দেবেন?’ প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিজ্ঞাপন চাওয়া! তিনি হেসে বললেন, ‘সব শেষ করে দিয়েছে হানাদার পাক বাহিনী। সব ভাঙাচোরা। কী দেব তোদের?’ পরে কাউকে ডাকলেন, কিছু বললেন। আমাকে পরের দিন যেতে বললেন সচিবালয়ে। গিয়ে পেলাম একটা চেক! অবশ্য আমাদের চাওয়া এরকম কিছু ছিল না।

স্বভাবসুলভ ভঙ্গীতে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী খবর তোদের?’ আমি বললাম, ‘আমরা প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে দেবার জন্য চ্যারিটি শো করে এই টাকাটা তুলছি, সেটা দিতে আসছি।’ বলে তাঁকে খামটা দিলাম। তিনি হেসে খোঁজখবর নিয়ে তারপর বললেন, ‘কী চাস তোরা?’ থতমত খেয়ে গেলাম। কারণ আমরা কোনো কিছু চাওয়ার কথা ভাবিই নাই, তার জন্য যাইও নাই।     

আমার বুঝমতো যুদ্ধোত্তর অস্থির সমাজের নানা দিক নিয়ে আমি তখন লিখতে শুরু করেছি। তার কিছু অংকুর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। আর চিঠি, গল্পাকারে অভিজ্ঞতা, ক্ষোভ নিয়ে গদ্য ইত্যাদি লিখি আর ডাকে বিভিন্ন পত্রিকায় পাঠাই। তখন প্রধান পত্রিকা দৈনিক ইত্তেফাক আর তারপর ট্রাস্ট পরিচালিত দৈনিক বাংলা। এসব পত্রিকায় আমার লেখাগুলো ঠিক যেন মানানসই ছিল না। এই সময়ই হাতে পেলাম বিচিত্রা। নতুন স্বপ্ন নতুন উদ্যম নতুন যাত্রা ভিন্ন সম্পর্ক ভিন্ন বন্ধু ভিন্ন জগত তৈরি করছে, করতে চেষ্টা করছে। পুরনো অনেক নেতৃত্বই এর সঙ্গে তাল রক্ষা করতে পারেনি। সেজন্য ১৯৭২ এ বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমরা উদ্ধত তরুণদের সমাবেশ দেখি, যারা পুরনো ধাঁচ থেকে বের হবার চেষ্টা করছেন, নতুন গতিপথ তৈরির চেষ্টা করছেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্বে তখন তরুণেরাই। নাটক, চলচ্চিত্র, গল্প, প্রকাশনা, কবিতা, সংগঠন, রাজনীতি সর্বত্র।

বিচিত্রা সম্পাদক শাহাদত চৌধুরী ছিলেন এই সংবেদনশীল উদ্যমী তরুণদেরই একজন। তিনিও একবছরে অনেকখানি বদলে গেছেন ভেতর থেকে। ১৯৭১ এর আগে শাহাদত চৌধুরী শিল্পী এবং চিত্রসাংবাদিকতার মধ্যেই ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ২ নং সেক্টরে খালেদ মোশাররফের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন। ঢাকা শহরে যে মুক্তিযোদ্ধারা গেরিলা অপারেশন চালিয়েছেন তাদের সাথে কাজ করেছেন শাহাদত চৌধুরী ও তাঁর ভাই ফতেহ চৌধুরী। তাঁদের বন্ধুদের বেশ কয়জন শহীদ হয়েছেন, শহীদ রুমী তাঁদের একজন। বেঁচে আছেন যারা তাঁদের মধ্যে শহীদুল্লাহ খান বাদল, নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু অন্যতম। এই যুদ্ধের অভিজ্ঞতার কারণেই ১৯৭২ থেকে তাঁর শিল্প প্রতিভা, সাংবাদিকতার ঝোঁকের কেন্দ্রে এলো রাষ্ট্র ও সমাজ। এই পরিবর্তনই তৈরি করলো সেই বিচিত্রা যার সূত্রে আমার চেনা শাহাদত চৌধুরী তৈরি হয়েছেন। সম্পাদকের সাথে সাথে আদিতে চলচ্চিত্র আর সিনে তারকা বিষয়ে আগ্রহী বিচিত্রা ক্রমে তখন মনোযোগ দিচ্ছে সমাজ রাজনীতি অর্থনীতি নিয়ে। নতুন ভাবনা আর দুর্ভাবনা। চিন্তা আর তার প্রকাশের ধরন ভিন্ন, স্পষ্ট এবং আক্রমণাত্মক। নিয়মিত পড়তে থাকলাম বিচিত্রা। মনে হয় তখন দাম ছিল আট আনা। এরপর থেকেই বিচিত্রা হয়ে ওঠলো আমার লেখার গন্তব্য। চারদিকের জগৎ নিয়ে ভাবনা ক্ষোভ প্রস্তাব যা কিছু লিখি সেগুলো বিচিত্রায় ডাকে পাঠাই এবং সেগুলো ছাপা হয়- চিঠিপত্র, অভিমত, ভিন্নমত কিংবা আলাদা লেখা হিসেবে।

সবাই কিছু একটা করতে চায়। আর সরকার তখন বলছে ক্লাশে যেতে। যুদ্ধের ক্ষয়, জয়, রক্ত, সবকিছু নিয়ে অপ্রস্তুত জনগোষ্ঠীকে তখন বলা হচ্ছিল যুদ্ধপূর্বকালের মতো ‘স্বাভাবিক’ জীবনে ফিরে যেতে। সেসময় আমি একটা লেখা লিখেছিলাম সব স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় তিনবছরের জন্য বন্ধ রাখার দাবি জানিয়ে। আমার প্রস্তাব ছিল এই সময়ে সব ছেলেমেয়েরা গ্রাম শহরের গরীবদের মধ্যে কাজ করবে, তাদের সাক্ষর করবে, ঘরবাড়ি ঠিক করবে, স্বাস্থ্য পরিস্থিতি দেখবে। এই লেখাটাও পাঠালাম বিচিত্রায়, তবে অভিমত বিভাগে গুরুত্ব দিয়ে এই লেখা ছাপানোর পর বুঝলাম প্রস্তাবটি হাস্যকর নয় এবং এর গুরুত্ব অন্য অনেকেই উপলব্ধি করেন। ‘সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হোক’ শিরোনামের ঐ লেখার একটি অংশ এখানে দিতে চাই:

‘…যে কয়জন মুষ্টিমেয় ছেলে-মেয়ে আমাদের দেশে শিক্ষাঙ্গনে প্রবেশ করতে পারে তাদের মধ্যে উচ্চশিক্ষিত হতে পারে খুব কম সংখ্যক। ডাক্তার হচ্ছে, ইঞ্জিনিয়ার হচ্ছে, ব্যবসায়ী হচ্ছে, বড় চাকুরে হচ্ছে। এখানে অসুবিধা হলে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। তাদের শিক্ষার ফল তাদের সেই গন্ডিতেই ঘুরছে। সাধারণ মানুষের কোনো কাজেই এ শিক্ষা আসছে না অর্থাৎ দেশের বৃহত্তম অংশ তথা গোটা জাতি তথা দেশটাই যে অবস্থায় ছিল সে অবস্থাতেই থেকে যাচ্ছে। সুতরাং যতদিন পর্যন্ত শিক্ষা সার্বজনীন না হবে, শিক্ষা দেশের জন্য সাধারণ মানুষের জন্য না হবে, সে পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে।

যতদিন স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকবে ততদিন ছাত্ররা বাধ্যতামূলকভাবে কল-কারখানায়, বস্তিতে. শিল্প এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে সাধারণ মানুষের সংস্পর্শে আসবে। সমস্যা সমাধানে সক্রিয় অংশ নেবে। নতুন সামাজিক ব্যবস্থার রূপ দেবে। ততদিন শিক্ষা ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর ব্যাপারটা পূর্ণ হবে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি ছাত্ররা এভাবে নেমে এলে দেশের সব দুর্নীতির উচ্ছেদ ঘটবে। দেশ নতুন পথে আলোর পথে, প্রীতির পথে এগিয়ে যাবার পথ খুঁজে পাবে।..’

এরপর লেখাটিতে কাজের পদ্ধতি ও পরিকল্পনা ব্যাখ্যা করা হয়েছিল! কী প্রত্যাশা! কী স্বপ্ন!! তবে এতোবছর পরেও মনে হয় এই পথই ছিল যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের জন্য যথার্থ!

সেসময়ই সামনে আমার ম্যাট্রিক পরীক্ষা। সরকার সেশন ঠিক রাখবার জন্য যুদ্ধের পর আর কোন বিরতি দেয়নি। আমাদের পরীক্ষা হবার কথা ছিল ১৯৭২এর জুন মাসে, কিন্তু সেসময় অনুষ্ঠিত হলো আগের বছরের অর্থাৎ ১৯৭১ এর বাতিল পরীক্ষা। আমাদের পরীক্ষার সময় ঘোষণা করা হলো- ডিসেম্বর মাস।

যাইহোক, এক প্রহসনের এসএসসি পরীক্ষা দিলাম, দিতেই হলো। পরীক্ষা হলো সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে, ছোট আকারে পাঁচটা পরীক্ষা। আমি বিজ্ঞান বিভাগে ছিলাম, তার বিষয় ও নম্বর হলো এরকম – মোট ৩০০ নম্বর; বাংলা-৭৫, ইংরেজি: ৭৫, পদার্থবিজ্ঞান: ৫০, রসায়ন: ৫০, গণিত: ৫০। দেশজুড়ে তখন এই পরীক্ষা নিয়ে বিপুল উৎসাহ। অনেক আগে পড়াশোনা ছেড়ে দেয়া, ক্লাশ সেভেন এইট পড়া সবাই এই পরীক্ষাকে একটা সুযোগ বিবেচনা করে যোগ দিয়েছে এই যজ্ঞে। পরীক্ষার হলে গিয়ে দেখি চারিদিকে নকল উৎসব, নকল ছোঁড়াছুড়ি। শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত নকল উৎসব। অসম্ভব এক পরিস্থিতি! ইচ্ছামতো যে যার মতো পরীক্ষা দিল, পাশের হার কেন যে ১০০ হল না সেটাই বিস্ময়ের। প্রথম বিভাগই বেশিরভাগ। আমার সহপাঠীদের এমন অনেকে ‘স্টার’ পেল যারা লজ্জাই পাচ্ছিলো রেজাল্ট বলতে।

শিক্ষাবর্ষ নষ্ট না করবার সরকারি প্রত্যয় এবং তা বাস্তবায়নের সেই ছিল চেহারা। এই ঘটনায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিছুদিন বন্ধ রেখে সবাইকে সামাজিক ভূমিকায় নিয়োজিত করবার আমার চিন্তা আরও পোক্ত হল। কিন্তু সেই সম্ভাবনা তখন ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। প্রেরণা, মানুষের জন্য সংবেদনশীলতা, সামষ্টিকবোধ সব যেন ক্ষয়ে যাচ্ছে। ক্ষমতাবানদের দুর্নীতি, ডিলারশীপ, পারমিট, ব্রিফকেস ব্যবসা ইত্যাদি নানা খবর চারদিকে। ১৯৭৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত  ‘আবার তোরা মানুষ হ’, ১৯৭৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘আলোর মিছিল’ চলচ্চিত্রে এর কিছু ছবি পাওয়া যায়। তখন অসহিষ্ণুতা বাড়ছে, বাড়ছে সহিংসতাও। একদিকে ছিনতাই, ডাকাতি আর অন্যদিকে পিটিয়ে হত্যা করা চলছে। বিচিত্রা এই নিয়ে তখন লেখা ছাপছে। গণপিটুনীতে মারা যাবার আগের মুহূর্তে একজন শিক্ষিত তরুণের ছবি ছাপা হল বিচিত্রা প্রচ্ছদে। আক্রান্ত তরুণের সেই দৃষ্টি আমার এখনও মনে পড়ে। সাহস আর উদ্দীপনা যে তরুণের চোখে থাকতে পারতো সেই তরুণের চোখে কী আতঙ্ক আর অভিযোগ!

সেই সম্ভাবনা তখন ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। প্রেরণা, মানুষের জন্য সংবেদনশীলতা, সামষ্টিকবোধ সব যেন ক্ষয়ে যাচ্ছে। ক্ষমতাবানদের দুর্নীতি, ডিলারশীপ, পারমিট, ব্রিফকেস ব্যবসা ইত্যাদি নানা খবর চারদিকে। ১৯৭৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত  ‘আবার তোরা মানুষ হ’, ১৯৭৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘আলোর মিছিল’ চলচ্চিত্রে এর কিছু ছবি পাওয়া যায়।

গ্রামের মানুষের জীবন: আনন্দ ও উদ্বেগ

এসএসসি যা চলতি ভাষায় ম্যাট্রিক পরীক্ষা নামে পরিচিত ছিল সেই পরীক্ষার পর কলেজে ভর্তির আগে লম্বা কয় মাসের বিরতি। সেসময় আমার এবং আমার ভাইবোনদের প্রধান আনন্দ গন্তব্য হলো নানাবাড়ী। আমার মা-র অকাল মৃত্যুর পর সেটা আমাদের জন্য আরও হয়ে দাঁড়িয়েছিল অস্তিত্বের অবলম্বন। পরীক্ষা শেষের পর ছুটির সুযোগে আমি একাই লম্বা সফরে গেলাম। ১৯৭৩ সালের প্রথম দিকে, আগের মতোই ট্রেনে। এই সময়ে ট্রেনে আগের তুলনায় অনেক ভীড় আর শ্রমজীবী মানুষের গ্রাম শহর ছুটাছুটি দেখলাম। পরে ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ চলচ্চিত্র দেখে সেই সময়ের ট্রেনচিত্র মনে পড়েছে।

এই সময়ে যখন গ্রামে গেছি তখন আমার মনে অনেক প্রশ্ন। অনেক কিছু বোঝার তাড়না, চোখ, কান সব খাড়া, উপলব্ধির জগতও তখন অনেককিছু বুঝতে আগ্রহী। আগের মতো নয়, এবারে বেড়ানোর পাশাপাশি নানা তথ্য নিচ্ছি, বিভিন্ন স্তরের মানুষদের সাথে কথা বলছি, নানা নানীসহ প্রিয় মানুষদেরও নানা প্রশ্ন করি। এর মধ্যে আমার বয়সী মামা বেলাল এবং মামাতো ভাই খলিল সহ পরিকল্পনা হলো কয়েকজন আত্মীয়ের বাড়ী বেড়াতে যাবো। এগুলো একেকদিকে ৫/১০ মাইলের মধ্যে। তখন গ্রামের রাস্তা ভালো বলতে বোঝায় সেখানে মাটি ভালোমতো বিছানো আছে। তখন গ্রামের পরিবহন মানে গরু বা মোষের গাড়ী, যেগুলো আরও অনেক দূরে যাবার জন্য, বিভিন্ন পণ্য পরিবহন বা পরিবারের পরিবহন হিসেবেই ব্যবহৃত হতো। যেমন আমরা আরও ছোটবেলায় আম্মাসহ সব ভাইবোনেরা ট্রেনে গিয়ে স্টেশন থেকে মোষের গাড়ীতে কয়েক ঘন্টায় নানাবাড়ী যেতাম। মেয়েদের জন্য পালকি বা হেঁটে আর ছেলেদের জন্য কম দূরত্বে হয় হেঁটে অথবা সাইকেলে চলাচল করাই নিয়ম।

আমি ততোদিনে খেলাচ্ছলেই সাইকেল চালানো শিখেছি। আর ওরা তো আগে থেকেই পারে। বড় সাইকেল।  তিনজন তিনটা সাইকেল নিয়ে রওনা হয়ে গেলাম। প্রায় পনেরো দিন বিভিন্ন এলাকা ঘুরলাম। সব এলাকাতেই নানাকিছু বুঝতে চেষ্টা করলাম যেগুলো আগে এভাবে মাথায় আসে নাই। ফসল, পেশা, মজুরি, বিভিন্ন ধর্ম, নারী পুরুষের সম্পর্ক, বিভিন্ন পরিবারে সমাজে দ্বন্দ্ব সংঘাত, দারিদ্র ও ধনাঢ্য ব্যক্তিদের অবস্থা, হাটবাজার, জমি কেনা বেচা, বিচার শালিস, মারামারি ইত্যাদি। সেসময় গ্রামে দোকানপাট ছিলো হাতে গোনা। প্রতিদিন নয়, সপ্তাহে এক বা দুইদিন বেশ কয়টি গ্রামের মধ্যে একটি হাট বসতো। সেটাই ছিল কেনাবেচা আনন্দ বেদনার পাওয়া হারানোর বড় কেন্দ্র। সাধারণত এসব হাট ইউনিয়ন অফিস/ তহশীলদার অফিসের কাছে, নদী বা খালের পাশে বসতো। পণ্য আসতো যেতো গরু বা মোষের গাড়ী আর নৌকায়। ট্রাকে পণ্য পরিবহন সেসময় প্রায় দেখাই যেতো না, হলেও তা ছিল থানা বা জেলা সদর থেকে। ব্যাংক তখন খুবই সীমিত, থানা কেন্দ্র ছাড়া ব্যাংক ছিল না। এনজিও, গ্রামীণ ব্যাংক তখনও আসে নাই। গ্রামে প্রাতিষ্ঠানিক মহাজন না থাকলেও সুদী কারবার হতো, অঘোষিতভাবে কিছু ব্যক্তির কাছে গেলে সুদে টাকা পাওয়া যাবে এটা সবাই জানতো। কেউ কেউ নিয়মিতভাবে না হলেও মাঝেমধ্যে এভাবে ‘টাকা লাগাতো’।

সেসময় গ্রামে দোকানপাট ছিলো হাতে গোনা। প্রতিদিন নয়, সপ্তাহে এক বা দুইদিন বেশ কয়টি গ্রামের মধ্যে একটি হাট বসতো। সেটাই ছিল কেনাবেচা আনন্দ বেদনার পাওয়া হারানোর বড় কেন্দ্র। সাধারণত এসব হাট ইউনিয়ন অফিস/ তহশীলদার অফিসের কাছে, নদী বা খালের পাশে বসতো। পণ্য আসতো যেতো গরু বা মোষের গাড়ী আর নৌকায়।

শিক্ষা তখনও এই মাত্রায় বাণিজ্যিক হয়নি। প্রাথমিক স্কুল মানে কেবল সরকারি স্কুল, আর তা ততোদিনে বেশিরভাগ গ্রামে হয়েছে। এবং সেটাই প্রধান স্কুল। কিন্ডারগার্টেন বা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল তখন গ্রামের কেউ দেখে নাই, শহরে থেকে আমরাও শুনি নাই। তখনকার দিনে হাইস্কুল পড়তে হলে বেশিরভাগ গ্রাম থেকে দূরে যেতে হতো। আমার মা এরকম একটা স্কুলে পড়তেন, হেঁটে যেতেন মাইল দুয়েক, সেটা ৪০ দশকের শেষ ও ৫০ দশক শুরুর দিকের কথা। এরপরও ৮০ দশক পর্যন্ত সেই স্কুলটিই এলাকার প্রধান হাইস্কুল ছিল। এগুলো প্রধানত প্রাইভেট ছিল কিন্তু বাণিজ্যিক ছিল না, এগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কোনো স্বচ্ছল ব্যক্তি বা পরিবারের অর্থানুকূল্যে, তারা তাদের কারও নামে বা নাম না দিয়ে স্কুল করতে চেয়েছেন। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এরকম বহু স্কুল ও কলেজই দীর্ঘসময় শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে।

শহরে তখন যে হাইস্কুলগুলো প্রধান সেগুলো প্রায় সবই ছিল সরকারি। এগুলো সবই ছিল বেশ বড় এলাকা নিয়ে, এলাকার প্রধান শিক্ষা কেন্দ্র, প্রায় সবগুলোতেই বড় মাঠ, মিলনায়তন, বড় গাছ ছিল। সিদ্ধেশ্বরী স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষার পর আমি ঘটনাক্রমে ঢাকার তিনটি সরকারি হাইস্কুলে পড়েছি- এগুলো হলো নতুন প্রতিষ্ঠিত খিলগাঁও সরকারি উচ্চবিদ্যালয়, কয়েক দশকে বিখ্যাত গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরী হাই স্কুল, এবং বহু পুরনো ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল। ঢাকার বাইরে সরকারি হাইস্কুল দেশে তখনও খুবই কম ছিল, এখনও কমই আছে। জেলাতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে থানা পর্যায় ছাড়া সরকারি হাইস্কুল দেখাই যায় না। গত পাঁচ দশকে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বেড়ে যাওয়ায় অনুপাতে এখন এগুলো একেবারেই প্রান্তিক। এখন বাণিজ্যিক স্কুলই মূলধারা, তবে মাঠ, ভবন, আয়োজনে সরকারি হাইস্কুলই এখনও অনেকের কাছে কাঙ্ক্ষিত, যদিও সরকারের এবিষয়ে কোনো আগ্রহ দেখা যায় না।  

শহরে তখন যে হাইস্কুলগুলো প্রধান সেগুলো প্রায় সবই ছিল সরকারি। এগুলো সবই ছিল বেশ বড় এলাকা নিয়ে, এলাকার প্রধান শিক্ষা কেন্দ্র, প্রায় সবগুলোতেই বড় মাঠ, মিলনায়তন, বড় গাছ ছিল।

গ্রামে ইউনিয়ন পর্যায়ে তখন এমবিবিএস ডাক্তার ছিল তো নাইই, কেউ আশাও করতো না। এরকম ডাক্তার খুঁজতে হলে থানা বা জেলা পর্যায়ে যেতেই হতো। দোওয়া দরুদ, মন্ত্রপাঠ, পীর দেবদেবী ছাড়া প্রধান ভরসা ছিল আয়ুর্বেদ, কবিরাজ আর হোমিওপ্যাথির ওপর। আর ছিলেন ডিগ্রী ছাড়া এলোপ্যাথ ডাক্তার। আমরা নানাবাড়ী গেলে দেখতাম মণি ডাক্তারকে। খবর পাঠালে তিনি সাইকেলে করে এসে রোগী দেখতেন। লম্বা গড়ন, লম্বা ‘ব্যাপারী শার্ট’ আর পায়জামা- মাঝে মধ্যে ধুতি পরতেন।  আমাদেরও চিকিৎসা করেছেন তিনি। সবাই তাঁর ওপর খুব ভরসা করতো। ইউনিয়ন পর্যায়ে সরকারি একটা ব্যবস্থা ছিল তখন, ডিসপেনসারি। ওষুধপত্র থাকার কথা থাকতো, কিন্তু বেশিরভাগ সময় পাওয়া যেতো না। আমিও গেছি বেশ কয়েকবার ওখানে।

মেয়েদের সন্তান ধারণ ও প্রসবে গ্রামের ধাত্রীসহ যার যার যোগাযোগ মতো কাজ হতো। বিধিব্যবস্থায় মানুষের বিশেষত নারীর পরম্পরায় প্রাপ্ত জ্ঞানই ছিল প্রধান ভরসা। আমাদের জন্ম হয়েছিল নানাবাড়ীতে আলাদা করে বানানো অস্থায়ী ঘর বা আঁতুড় ঘরে। পরে জেনেছি দেখেছিও- তার হাইজিন, সুরক্ষার যাবতীয় ব্যবস্থা ছিল, যা খুব বিস্তারিত মানতে হতো। এরমধ্যে রোদ আর আগুনের ভূমিকা ছিলো খুব বেশি। গরম পানি, গরম তেল, সেক দেওয়া কাপড় ইত্যাদি। আর বিভিন্নরকম বিধিনিষেধ ছিল ঘরে ঢোকা বা বাইরে যাবার ক্ষেত্রে, জ্বীন ভূতের হাত থেকে রক্ষার কথা বলা হতো, তাদের সাথে সাথে বিভিন্ন রোগ বালাই থেকেও এর মাধ্যমে রক্ষার উপায় তৈরি হতো। সবাই এরকম আলাদা ব্যবস্থা করতে পারতো না, ঘরেই আয়োজন করতে হতো।  

আমাদের জন্ম হয়েছিল নানাবাড়ীতে আলাদা করে বানানো অস্থায়ী ঘর বা আঁতুড় ঘরে। পরে জেনেছি দেখেছিও- তার হাইজিন, সুরক্ষার যাবতীয় ব্যবস্থা ছিল, যা খুব বিস্তারিত মানতে হতো। এরমধ্যে রোদ আর আগুনের ভূমিকা ছিলো খুব বেশি। গরম পানি, গরম তেল, সেক দেওয়া কাপড় ইত্যাদি। আর বিভিন্নরকম বিধিনিষেধ ছিল ঘরে ঢোকা বা বাইরে যাবার ক্ষেত্রে, জ্বীন ভূতের হাত থেকে রক্ষার কথা বলা হতো, তাদের সাথে সাথে বিভিন্ন রোগ বালাই থেকেও এর মাধ্যমে রক্ষার উপায় তৈরি হতো।

গ্রামে একটা ছোট বেড়ার ঘরের মসজিদ ছিল। মসজিদে গিয়ে নিয়মিত নামাজ পড়া মানুষের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। আমিও ঐ মসজিদে জুম্মার নামাজ পড়েছি। জুম্মার নামাজের দিন ওখানে দুই তিন সারি মানুষ হতো। অন্যদিন দুই-তিনজন। এখন তো এলাকায় বেশ কয়টি পাকা মসজিদ ও মাদ্রাসা। সেখানে উপস্থিতি এখন অনেক বেশি। মন্দির এবং শ্মশান ছিল আরেকটু দূরে যেদিকে হিন্দু জনসংখ্যা একটু বেশি ছিল, এখন অনুপাত অনেক কমে গেছে।

যাইহোক, ১৯৭৩ সালের সেই সময়ে তখন কর্মহীন মজুর আর ছোট কৃষক মিলেই গ্রামের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। জিনিষপত্রের দাম বেশ বাড়তে শুরু করেছে, বেশিরভাগ মানুষের কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু দেখলাম মানুষ বেশি ক্ষুব্ধ অন্য দুটি কারণে। একটি হলো-  সরকারি দলের লোকজনদের দাপট, দ্বিতীয় হলো বিভিন্ন পদের ব্যক্তিদের দুর্নীতির বিস্তার। একমাসেরও বেশি সময় সেবার গ্রামে অনেক কিছুই যেন নতুন করে দেখলাম। ফিরে আমার অভিজ্ঞতা নিয়ে নিজের তাগিদ থেকে লিখলাম। বিচিত্রায় গুরুত্ব দিয়েই ছাপা হলো, শিরোনাম- ‘গ্রামের আনন্দ ফিরিয়ে আনুন’। তখনও বিচিত্রা অফিসে আমার যাওয়া হয়নি, কারও সাথে পরিচয়ও হয়নি।                  

সাম্রজ্যবাদ বিরোধী মিছিলে গুলি ও ভুখা মিছিল

১৯৭৩ সালের ১লা জানুয়ারির ঘটনায় আমার মাথায় প্রশ্ন আরও বাড়লো। সাম্রজ্যবাদ বিরোধী মিছিল ছিল ঐদিন সকালে। ভিয়েতনামে মার্কিন সাম্রজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র ইউনিয়নের সেই মিছিলের ওপর পুলিশ গুলি চালায় তোপখানা রোডে। ছাত্র ইউনিয়নের দুজন অগ্রণী কর্মী মতিউল ও কাদের এই গুলিতে নিহত হন। সেদিন কোনো কাজে কলেজিয়েট স্কুলে গিয়েছিলাম। পথে বিক্ষোভ মিছিল, ভাঙচুর, ভেঙে ফেলা শেখ মুজিবের ছবি দেখেছি। পরে জেনেছি পুরো ঘটনা। ছাত্র ইউনিয়ন তখন বেশ বড় জাতীয় সংগঠন। সুতরাং তাদের বিক্ষোভ  দ্রুত ছড়িয়ে গেছে, পরদিন সম্ভবত হরতালও পালিত হয়েছিল। ডাকসুর সহসভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম শেখ মুজিবকে দেয়া ডাকসুর আজীবন সদস্যপদের কাগজ ছিড়ে ফেলেছেন সেই খবরও পেলাম। ২ জানুয়ারি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মোজাফফর ন্যাপ) সরকারের পদত্যাগ দাবি করে। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ও ডাকসু ‘ছাত্রহত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী বা যেকোনো মন্ত্রীই হোক না কেন, তাঁর অপসারণ’ ও ‘বাংলাদেশে সকল মার্কিন প্রচার ও তথ্যকেন্দ্র সরকারিভাবে বন্ধ ঘোষণা’সহ ৭ দফা দাবি পেশ করে। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ৩রা জানুয়ারি এসব দাবি মেনে নেবার আহ্বান জানায়।

কিন্তু এর মধ্যেই শুনলাম সিপিবি-ন্যাপ এর ওপর মুখে এবং শারীরিকভাবে সরকারি দলের পাল্টা আক্রমণ শুরু হয়েছে। ৬০ দশকের শেষভাগে যিনি ছাত্র ইউনিয়নের মতিয়া গ্রুপের প্রধান, তৎকালীন ন্যাপনেত্রী, অগ্নিকন্যা নামে তখন বিখ্যাত, সেই মতিয়া চৌধুরী ১৯৭৩ এর ২রা জানুয়ারি আওয়ামী লীগের বাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হলেন। আওয়ামী লীগের সভায় সিপিবি-ন্যাপকে খুবই আপত্তিকর ভাষায় গালিগালাজ করার কথাও শুনলাম। এগুলো কিছু পত্রিকায় আসে, কিছু মুখে মুখে ছড়ায়। ঐসময়ের ঘটনাবলী সম্পর্কে প্রত্যক্ষদর্শী ও ১৯৭১- এ মুজিববাহিনীর সদস্য গবেষক মহিউদ্দীন আহমদ পরে এভাবে লিখেছেন যে,

‘বিরোধীদলীয় একটি সংগঠনের এরকম ‘ঔদ্ধত্য’ সহ্য করার মতো মানসিকতা আওয়ামী লীগের ছিল না। ৪ জানুয়ারি আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর একটি দল তোপখানা রোডে মার্কিন তথ্যকেন্দ্রের পাশে অবস্থিত ন্যাপের এবং পুরানা পল্টনে ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় অফিসে হামলা করে এবং সবকিছু তছনছ করে দেয়। ছাত্র ইউনিয়ন ও ন্যাপের একটি মিছিলে তারা অতর্কিত আক্রমণ করে অনেককে আহত করে। এই প্রতি আক্রমণে দিশাহারা হয়ে ছাত্র ইউনিয়ন তাদের আন্দোলনের ইতি টানে।’ (মহিউদ্দীন, ২০১৪; পৃ. ৯৪-৯৫)

কয়েক দিন পর অবাক হয়ে তাই পত্রিকায় ছবিসহ খবর দেখলাম- শেখ মুজিবের কাছে ছাত্র ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দের ক্ষমা প্রার্থনা। শুধু তাই নয়, এর কয়েকমাস পরে অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়ন সরকারি ছাত্রলীগের সাথে জোটবদ্ধ হয়, প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জাসদ ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। এই ধারাতেই ১৯৭৩-এর সেপ্টেম্বরে গঠিত হয় আওয়ামী লীগ, সিপিবি ও ন্যাপ মিলে  ত্রিদলীয় ঐক্যজোট।

মনে আছে সেসময় মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ভূখা মিছিলে গিয়েছিলাম। কোথা থেকে খবর পেয়েছিলাম মনে নাই। মিছিলে হাঁটতে হাঁটতে একসময় দেখলাম এটি পৌঁছে গেল পুরনো গণভবনে। গেটের সামনে ভাসানীসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। আমিও এগিয়ে গেলাম, বয়সের কারণেই কেউ হয়তো খেয়াল করেননি। প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যেই ছিল এই মিছিল, কিন্তু জানলাম তিনি তখন গণভবনে নেই। সরকারি দলের অন্যান্য নেতারা সেখানে ছিলেন। দেখলাম তাঁরা বেশ আদব লেহাজের সঙ্গে মওলানা ভাসানীকে ভেতরে নিয়ে যাচ্ছেন। আমি ফিরে এলাম। পরের দিন সকালে পত্রিকার পাতা খুলে প্রথম পাতাতেই যে ছবি দেখলাম তাতে বুঝলাম নেতারা কী ফাঁদে ফেলেছেন ভাসানীকে। তাঁর সামনে রাখা আছে কেক ইত্যাদি। ভুখা মিছিল শেষে মওলানা ভাসানীকে খাদ্যসহ দেখানোর এই চেষ্টা আমার কাছে খুবই আপত্তিকর মনে হয়েছে।  

সাইকেল, রাজনৈতিক দল ও বয়স্ক শিক্ষা

১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি শুরু হলো আমার কলেজ জীবন। আমার একসময়ের স্কুল গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরী স্কুলের পাশেই ঢাকা কলেজ। আমার বাসা থেকে বেশ দূরে। সহজ ছিল না এতদূর যাতায়াত। সেসময় আমার একটা সাইকেল হল, এই সাইকেলই আমাকে বাঁচিয়ে দিল- আমার গতি বাড়ালো, আমার স্বাধীনতা বাড়ালো। তখন ঢাকা শহরের এরকম করুণ অবস্থা হয়নি। অনেকেই সাইকেল চালাতেন, চালানো সম্ভব ছিল। আমি মৌচাক, পুরনো গণভবন হয়ে রমনা পার্কের ভেতর দিয়ে শাহবাগ হয়ে কলেজে যেতাম। সেসময়ই আমার সাপ্তাহিক বিচিত্রায় নিয়মিত যাতায়াত এবং আরও ঘনঘন লেখালেখি শুরু হলো। সাইকেল থাকার কারণেই বিভিন্ন জায়গায় আমার যাওয়া বেড়ে গেলো। আমার তখন যাবার জায়গা কয়েকটি: ঢাকা কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন তৎকালীন পাবলিক লাইব্রেরি, তোপখানা রোডের বাংলাদেশ তথ্য দফতরের লাইব্রেরি এবং বিচিত্রা। আর মাঝে মধ্যে সিনেমা হল, সভা সমাবেশ সেমিনার। কিংবা এমনি এমনি ঘোরা। এরকম সময়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন পাবলিক লাইব্রেরী হলে (বর্তমান নাটমন্ডল) এক সেমিনারে আহমদ শরীফ, বদরুদ্দীন উমর ও সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে প্রথম দেখি ও তাঁদের কথা শুনি। তাঁরা তৎকালীন পরিস্থিতিতে উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন।

রাজনৈতিক দল নিয়ে আমার আগ্রহ কৌতুহল বাড়ছে তখন। স্বাধীনতার পর ধর্মপন্থীসহ যুদ্ধাপরাধী সকল দল নিষিদ্ধ হয়। দেশে সরকার ও সরকারের বাইরে প্রায় সকল দলই তখন সমাজতন্ত্রকে লক্ষ্য ঘোষণা করে কাজ করছিল। ১৯৭২-৭৩ নাগাদ এরকম বিভিন্ন গোষ্ঠী, দল ও শক্তির অবস্থান দেখা যায় কয়েকভাবে। যেমন:

(ক) মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ঘনীভূত হতে থাকা সমাজতান্ত্রিক চিন্তায় প্রভাবিত আওয়ামী লীগের ভেতরের কিছু অংশ, বিশেষত তরুণ অংশ। এদের বড় অংশ পরে জাসদে যোগদান করে।

(খ) মস্কোপন্থী ধারার কমিউনিস্ট পার্টি (মণি সিংহ), ন্যাপ (মোজাফফর) ও তাদের সহযোগী সংগঠন সমূহ। আওয়ামী লীগ বিশেষত শেখ মুজিবের ওপর আস্থা স্থাপন করে তাঁরা তখন তাঁদের কর্মসূচি প্রণয়ন করছেন। এক পর্যায়ে তাঁরা আওয়ামী লীগের সাথে ত্রিদলীয় ঐক্যজোটে শরীক হন।

(গ) পিকিংপন্থী ধারায় যারা প্রকাশ্যে রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করতেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ন্যাপ (ভাসানী) এবং লেনিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টি (কাজী জাফর, রাশেদ খান মেনন, হায়দর আকবর খান রনো)।

(ঘ) পিকিংপন্থী ধারায় যারা আত্মগোপনে থেকে সশস্ত্র পথে বিপ্লব সম্পন্ন করতে কাজ করছিলেন তাদের মধ্যে ছিল পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি (সিরাজ শিকদার), পূর্ব বাংলার কমিউনিষ্ট পার্টি (আবদুল মতিন, আলাউদ্দিন আহমদ), পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (আবদুল হক, মোহাম্মদ তোয়াহা) ইত্যাদি।

সেসময় জানা বোঝার আগ্রহেই বিভিন্ন পার্টি অফিসে কিংবা বিভিন্ন দলের সভা সমাবেশে যেতে শুরু করেছি। যাদের অফিসে গেছি তাদের মধ্যে সিপিবি, লেনিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টি অন্যতম। তখন গোপন পার্টির প্রচারপত্র বইপত্র পেলে পড়ি, ফুটপাতে মার্কস-লেনিন-স্ট্যালিন-মাও-হোচিমিন-চে গুয়েভারা-গ্রামসি-জুলিয়াস ফুচিক-ফেনন- চারু মজুমদার প্রমুখের কিংবা তাদের নিয়ে লেখা পুরনো বই পুস্তিকা দেখি। পয়সা কুলালে কিনি, বুঝতে চেষ্টা করি।

সিপিবি অফিসে যাবার পেছনে দেবপ্রিয়, আকাশ, দিবালোকের ভূমিকা ছিল। ঢাকা কলেজে আমার সহপাঠী দেবপ্রিয় ও মণি সিংহের ছেলে দিবালোক সিংহ। দেবপ্রিয় ছাত্র ইউনিয়নের খুবই সক্রিয় এবং আগ্রাসী সংগঠক তখন। কীভাবে ওদের সাথে প্রথম পরিচয় হয় মনে নাই। তবে একটা ঘটনায় মনে হয় আমার প্রতি ওদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়ে থাকবে।

তোপখানা রোডের প্রকাশনা দফতরের পাঠাগারে আমি প্রায় নিয়মিতই পড়তে যেতাম। সেখানে হঠাৎ একদিন ঘোষণা দেখলাম আন্তঃকলেজ রচনা প্রতিযোগিতা আহবান করা হয়েছে। বিষয়- ‘আমার স্বপ্নের সোনার বাংলা’। সিঁড়ি দিয়ে উঠা নামা করতে করতে বারবার চোখে পড়ে এই নোটিশ। এক পর্যায়ে মনে হলো- লিখি, আমার তো কিছু চিন্তা আছে এ বিষয়ে। জমা দিলাম এবং বহুদিন পর আবার সেই নোটিশ বোর্ডে ফলাফল দেখে অবাকও হলাম। তার পুরস্কার বিতরণী হলো ঐ পাঠাগারের মধ্যেই। এক মন্ত্রী এসেছিলেন, তখনকার একমাত্র টিভি চ্যানেল বিটিভিতে বোধহয় দেখানোও হয়েছিল। তারই ফলে হয়তো ছাত্র সংগঠকদের দৃষ্টি পড়েছে বেশি। সেই লেখাটা এখনও মনে মনে খুঁজি-কী ভাবতাম তখন, প্রত্যাশা আর স্বপ্নের ধরন কেমন ছিল তার স্পষ্ট চিত্র পাওয়া যেতো লেখাটা পেলে।

যাইহোক দেবপ্রিয়, দিবালোক বা টুটুলসহ আমরা একসাথে নিয়মিতভাবে একটা দায়িত্ব পালন করতে শুরু করি। সাইকেল থাকায় সহজেই চলে যেতে পারতাম। মগবাজার মোড়ের পাশে বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্র, সেখানে ক্লাশ নেয়া।  আকাশ মাঝে মধ্যে আসতো, এছাড়াও ছিলেন আমাদের সিনিয়র বেনু ভাই। ওদের সূত্রেই সিপিবি অফিসে তখন বেশ কয়েকবারই গেছি। দিবালোকের সাথে ওদের মানে মণিসিংহের বাসায় গেছি। দেবপ্রিয়র সাথে ওদের বাসায় গেছি, বর্তমান হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল-এর বিপরীতে সরকারি বাড়ী। ওর বাবা ছিলেন বিচারপতি, দেবেশচন্দ্র ভট্টাচার্য্য।

সিপিবির কাজ দেখতাম, বেশ আন্তরিক গোছানো কাজ ছিল। কিন্তু তাদের কথা ও কাজ দেখে দুটো প্রশ্ন আমার মাথায় ঘনীভূত হচ্ছিল। একটি হলো- আওয়ামী লীগ তো বিপ্লবী পার্টি নয়, কেন তাদের সাথেই ঐক্য করতে হবে? আর দ্বিতীয়ত, ভারত তো কোনো সমাজতন্ত্রী দেশ নয়, তাকে কেন সবসময় সমর্থন দিতে হবে? এই সরল দুটো প্রশ্ন আমার মাথায় ক্রমে ভারী হয়ে ওঠে। একতা পত্রিকায় একটা প্রশ্নোত্তর বিভাগ ছিল, সেখানে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিতেন নেতৃবৃন্দ। শেষ পর্যন্ত সেখানেও এই প্রশ্ন দুটো জমা দিয়েছিলাম। কিন্তু উত্তর পাই নাই।

সেসময় বাসায় পত্রিকা আসতো দৈনিক বাংলা/ইত্তেফাক ও অবজার্ভার, এর বাইরে আমি নিয়মিত পড়ার চেষ্টা করতাম একতা, হককথা, গণকন্ঠ। বেশির ভাগ দেয়াল থেকে বা বিভিন্ন পাঠাগারে। দেয়ালের চিকা দেখি- জাসদের আর সর্বহারা পার্টির। দুটোরই খুব চমক লাগানো স্লোগান। কিন্তু দুটো নিয়েই নানা প্রশ্ন ঘুরতে থাকে মাথায়। ৭৩ এর লেখার খাতায় নানা মন্তব্য, রোজনামচা, লেখা এখন দেখতে গিয়ে দেখি প্রথম থেকেই জাসদের উপর আমি আস্থা স্থাপন করতে পারিনি। তাদের ওপর সরকারি ভয়াবহ নিপীড়নের কারণে একরকম সহানুভূতি থাকলেও আস্থাবোধ করিনি কখনও, কথাবার্তার বাগাড়ম্বরের কারণেই হয়তো। সর্বহারা পার্টির দেয়ালের লেখাগুলোর অনেকটাই আকর্ষণীয় লাগতো। ঢাকা শহর ও শহরের বাইরে অনেক জায়গাতেই তাদের এসব লেখা দেখেছি। জানিনা, হয়তো তাদের কারও সঙ্গে দেখা হলে একসঙ্গে কাজও করতে চাইতাম। কিন্তু আমার প্রশ্নও ছিল কিছু। ওদের পার্টির নামের সাথে পূর্ব বাংলা আমার পছন্দ হতো না। কেননা একটা বড় যুদ্ধের মধ্য দিয়ে একটি দেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তার নাম স্বীকার না করা আমার কাছে গ্রহণযোগ্য হয় নাই।

আমার চিন্তা ছিল, বাংলাদেশ স্বীকার করতে হবে আর সেইসাথে বিপ্লবী রাজনীতি দাঁড় করাতে হবে। মানে বিপ্লবী রাজনীতিকে অবশ্যই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের লড়াইএর ওপর দাঁড়াতে হবে। যতদূর মনে পড়ে সেসময় একদিন নতুন প্রকাশিত একটা পত্রিকা বঙ্গবার্তা-য় বদরুদ্দীন উমরের এবিষয় নিয়ে লেখা পড়লাম। তিনি ঠিক এ বিষয়টা নিয়েই লিখেছেন এবং এই দৃষ্টিভঙ্গীকেই বিস্তৃত করেছেন দেখে আমি খুব স্বস্তি পেলাম। বদরুদ্দীন উমরের প্রথম নাম জানি পত্রিকার একটি খবরে, তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছেন। এরপর বদরুদ্দীন উমরের প্রথম যে বই পড়ি তার নাম পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি, পাবলিক লাইব্রেরীতে। আরও পরে তাঁর সম্পাদিত সংস্কৃতি পত্রিকার সাথে সাক্ষাৎ ঘটে।  

সংবিধান প্রণয়ন

স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দুটো কাজ খুব দ্রুত সম্পন্ন হয়। একটি হলো সংবিধান প্রণয়ন, আরেকটি হলো প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন। এই দুই বিষয়েই কথা বলা দরকার। প্রথমে সংবিধান।  

১৯৭০ সালে নির্বাচিত কেন্দ্রীয় ও প্রদেশিক সংসদে নির্বাচিত সদস্যদের মধ্যে মৃত, বহিষ্কৃত, দলত্যাগীদের বাদ দেবার পর বাকি সদস্যদের নিয়ে স্বাধীনতার পর ‘বাংলাদেশে গণপরিষদ’ গঠিত হয়। এই গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় ১০ই এপ্রিল, ১৯৭২। দুই দিনের এই অধিবেশনের দ্বিতীয় দিনে ড. কামাল হোসেনকে প্রধান করে ৩৪ সদস্য বিশিষ্ট একটি ‘খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি’ গঠন করা হয়।

১৯৭০ সালে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের নিয়ে গণপরিষদ গঠন অনেকের কাছেই গ্রহণযোগ্য হয়নি, তা নিয়ে সমালোচনা হয় বিভিন্ন দিক থেকে। এর সদস্যদের সম্পর্কে কঠিন অভিযোগ উত্থাপন করেন বিদ্রোহী ছাত্রলীগ নেতা আসম রব ও শাহজাহান সিরাজ। ১৯৭২ সালের ৬ই অক্টোবর এক বিবৃতিতে তাঁরা বলেন,

‘…পরিষদ সদস্যদের প্রায় ৯০ শতাংশই যেখানে স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত না থেকে আরাম আয়েশে গা ভাসিয়ে দিয়ে এবং নানা ধরনের অসামাজিক কাজে লিপ্ত থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন ভারতে নির্লিপ্ত জীবন যাপন করেছে, সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত একটি স্বাধীন দেশের সংবিধান তৈরির অধিকার সেসব গণপরিষদ সদস্যের আদৌ আছে বলে দেশবাসী মনে করে না।…’ (মহিউদ্দীন আহমদ, ২০১৪, পৃ. ৮৪) 

এই খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটিতে একমাত্র বিরোধী দলীয় সদস্য ছিলেন ন্যাপ (মোজাফফর) নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। বস্তুত তিনিই ১৯৭২ সালে প্রস্তাবিত সংবিধান নিয়ে সবচাইতে বেশি সংখ্যক গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ, সুপারিশ ও সমালোচনা উপস্থিত করেন। এর পরেই ছিলেন সংসদ সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা, যিনি খুব মৌলিক একটি বিষয় উত্থাপন করেছিলেন যা প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় বাংলাদেশ বস্তুত দীর্ঘমেয়াদী সংকটে পতিত হয়। 

মনে রাখা দরকার যে, গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনের আগেই ২২ মার্চ ১৯৭২ রাষ্ট্রপতির জারী করা নির্বাহী আদেশ বলে প্রণীত ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ সদস্য (সদস্যপদ বাতিল) আদেশ’ ঘোষিত হয়। এই আইনটির অনুচ্ছেদ অনুযায়ী:

“৩। (১) কোন নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হয়ে এবং উক্ত দলের সদস্যপদ লাভ করে কোন ব্যক্তি পরিষদ-সদস্য নির্বাচিত হয়ে তিনি যদি

 (ক) উক্ত দল থেকে পদত্যাগ করেন; অথবা

(খ) উক্ত দল হতে বহিষ্কৃত হন;

 তবে তার মেয়াদকালের অসমাপ্ত সময়ের জন্য তিনি আর পরিষদ-সদস্যপদে থাকবেন না। আইনটির ৫ সংখ্যক ধারা অনুযায়ী এই আইনের অধীনে প্রণীত কোন আদেশ বা গৃহীত কোন ব্যবস্থা সম্পর্কে কোন আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না।

৫। এই আদেশের অধীনে প্রণীত কোন আদেশ বা গৃহীত কোন ব্যবস্থা সম্পর্কে কোন আদালত কোন প্রশ্ন উত্থাপন করিবেন না।”

এভাবে গণপরিষদের অধিবেশনের আগেই সরকার দলীয় সদস্যদের স্বাধীন মত প্রকাশের পথ আটকে দেয়া হয়।  আর নতুন সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে যে বিধান রাখা হয় তাতে সরকারি দলের সদস্যদের দলের নেতা/নেত্রীকে সমর্থন দেয়াই একমাত্র কাজ হয়ে দাঁড়ায়, স্বাধীনভাবে চিন্তা করা বা মতামত দেবার কোনো উপায় ছিল না। গত পাঁচ দশকে সামরিক-বেসামরিক কোনো সরকারই এই ধারা পরিবর্তন করেনি। 

আগেই বলেছি, সংবিধান নিয়ে আলোচনায় সবচাইতে বেশি সংশোধনী প্রস্তাব তোলেন ন্যাপ দলীয় সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। এর পর মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা। লারমা খুবই মৌলিক একটি প্রশ্ন ধরে বলেন যে,

‘….বাংলাদেশের নাগরিকগণকে ‘বাঙালি’ বলে পরিচিত করবার জন্য জনাব আ: রাজ্জাক ভূইয়ার প্রস্তাবে আমার একটু আপত্তি আছে যে, বাংলাদেশের নাগরিকত্বের যে সংজ্ঞা, তাতে করে ভালভাবে বিবেচনা করে তা যথোপযুক্তভাবে গ্রহণ করা উচিৎ বলে মনে করি। আমি যে অঞ্চল থেকে এসেছি, সেই পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীরা যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশে বাস করে আসছে। বাংলাদেশের বাংলা ভাষা বাঙালিদের সংগে আমরা লেখাপড়া শিখে আসছি। বাংলাদেশের সংগে আমরা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সবদিক দিয়েই আমরা একসংগে একযোগে বসবাস করে আসছি। কিন্তু আমি একজন চাকমা। আমার বাপ, দাদা চৌদ্দ পুরুষ- কেউ বলে নাই, আমি বাঙালি। …’

স্পীকার সাহেব যেন অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন, ‘আপনি কি বাঙালি হতে চান না?’ এর উত্তরে লারমা বলেন, ‘আমাদিগকে বাঙালি জাতি বলে কখনও বলা হয় নাই। আমরা কোন দিনই নিজেদেরকে বাঙালি বলে মনে করি নাই। আজ যদি এই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সংবিধানের জন্য এই সংশোধনী পাশ হয়ে যায়, তাহলে আমাদের এই চাকমা জাতির অস্তিত্ব লোপ পেয়ে যাবে। আমরা বাংলাদেশের নাগরিক। আমরা আমাদেরকে বাংলাদেশী বলে মনে করি। কিন্তু বাঙালি বলে নয়।’ (সূত্র: বাংলাদেশ গণপরিষদ বিতর্ক, খণ্ড ২ সংখ্যা ১৩, মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর, ১৯৭২; উদ্ধৃতি- আহমদ, ২০১৫)

এই বক্তব্য সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করা হয়। লারমা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য পরিষদের বৈঠক বর্জন করেন। আমরা জানি এই অস্বীকৃতি এবং বলপ্রয়োগের মাধ্যমে সকল জাতিকে বাঙালী বানানোর অদ্ভুত, অযৌক্তিক ও স্বেচ্ছাচারী উদ্যোগ দীর্ঘমেয়াদে কী ভয়াবহ পরিণতি বয়ে এনেছে। পাকিস্তানের আইয়ুব আমলে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র করে যে ভয়াবহ মানবিক ও পরিবেশগত বিপর্যয় এবং সংঘাতের সূচনা করা হয়েছিল সেটাই এর মাধ্যমে আরও জোরদার হলো স্বাধীন বাংলাদেশে।

সেসময় খসড়া প্রস্তাবিত সংবিধান নিয়ে প্রকাশ্য দলগুলোর মধ্যে জাসদ, লেনিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টি, সিপিবিও তাদের বিভিন্ন সমালোচনামূলক মতামত দেয়। মওলানা ভাসানী এবং তার নেতৃত্বাধীন ন্যাপও সরব ছিল। সংবিধান পাশ হয়ে গেলে সিপিবি ও মোজাফফর ন্যাপ কিছু সমালোচনা সহ গ্রহণ করে নিলেও অন্যরা তা গ্রহণ করেননি। এই সংবিধানের অধীনেই দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ৭ই মার্চ, ১৯৭৩। (চলবে)

পরের পর্ব: বাংলাদেশের ৫০ বছর ও তারপর-২

আনু মুহাম্মদ: শিক্ষক, লেখক এবং সর্বজনকথা-র সম্পাদক। ইমেইল: sarbojonkotha@gmail.com 

তথ্যনির্দেশ

আহমদ, ২০১৫। ফিরোজ আহমদ: ‘বাংলাদেশের সংবিধান ও রাষ্ট্রের গতিমুখ: সূচনাকাল’। সর্বজনকথা ১ম বর্ষ ৩য় সংখ্যা মে-জুলাই। 

মহিউদ্দীন ২০১৪। মহিউদ্দীন আহমদ: জাসদের উত্থান পতন : অস্থির সময়ের রাজনীতি। ঢাকা

মুহাম্মদ ২০০৭। আনু মুহাম্মদ: সত্তর দশকে, একুশে বাংলা প্রকাশন।

রহমান ২০০৪। মো: আনিসুর রহমান: পথে যা পেয়েছি, দ্বিতীয় পর্ব, অ্যাডর্ণ পাবলিকেশন।

হককথা ২০০২। মওলানা ভাসানীর সাপ্তাহিক হক কথা সমগ্র। সংগ্রহ ও সম্পাদনা: আবু সালেক। ঘাস ফুল নদী।

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •