চা-শ্রমিকদের ভূমি অধিকার কেন নিশ্চিত করা হবে না

আগাম প্রকাশ

মোহন রবিদাস

বাংলাদেশের চা-বাগানগুলোতে কর্মরত ১৫ লক্ষাধিক চা-শ্রমিক একটি বৈচিত্র্যময় ও স্বতন্ত্র জনগোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমল থেকে শুরু করে আজ অবধি তারা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছেন। কিন্তু তাদের মজুরি, জীবনযাত্রার মান ও অধিকার নিয়ে এখনও অনেক প্রশ্ন। চা-শ্রমিকদের উল্লেখযোগ্য সমস্যা হলো ভূমি অধিকারের অভাব। এই জনগোষ্ঠীর নিজস্ব জায়গা-জমির কোনো আইনগত দলিল না থাকায় তারা নানাবিধ আর্থ-সামাজিক বঞ্চনা ও অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হচ্ছেন। এই লেখায় চা-শ্রমিকদের ভূমি অধিকারের গুরুত্ব ও সমস্যা নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।

বাংলাদেশের চা-বাগানগুলোতে কর্মরত ১৫ লক্ষাধিক চা-শ্রমিক একটি বৈচিত্র্যময় ও স্বতন্ত্র জনগোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমল থেকে শুরু করে আজ অবধি তারা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছেন। কিন্তু তাদের মজুরি, জীবনযাত্রার মান ও অধিকার নিয়ে এখনও অনেক প্রশ্ন। চা-শ্রমিকদের উল্লেখযোগ্য সমস্যা হলো ভূমি অধিকারের অভাব। এই জনগোষ্ঠীর নিজস্ব জায়গা-জমির কোনো আইনগত দলিল না থাকায় তারা নানাবিধ আর্থ-সামাজিক বঞ্চনা ও অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হচ্ছেন। এই লেখায় চা-শ্রমিকদের ভূমি অধিকারের গুরুত্ব ও সমস্যা নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।

ঐতিহাসিক পটভূমি

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে চা-শ্রমিকদের বাংলাদেশের সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও চট্টগ্রামের চা-বাগানে নিয়ে আসা হয়। তাদেরকে বলা হতো ‘বাগান শ্রমিক’। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের বংশধররা একই বাগানে কাজ করে আসছেন, কিন্তু জমির মালিকানার স্বীকৃতি পাননি। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ও পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান আমলে তাদেরকে শুধু শ্রমিক হিসেবেই দেখা হতো, স্থানীয় সম্প্রদায়ের অংশ নয়। ফলে তারা ভূমিহীন হয়ে পড়েন। স্বাধীনতার পরও এ ব্যবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। বরং রাষ্ট্রীয়করণের পর বাগানগুলো সরকারি মালিকানায় এলেও শ্রমিকদের ভূমি অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পরবর্তী সময়ে বেসরকারিকরণের মাধ্যমে বাগানগুলো আবার ব্যক্তিগত মালিকানায় ফিরে গেলেও শ্রমিকদের অবস্থান অপরিবর্তিত থেকে যায়।

আইনি পর্যালোচনা

বাংলাদেশের ভূমি আইন ফ্রেমওয়ার্কে চা-শ্রমিকদের ভূমি অধিকার অস্পষ্ট। ভূমি সংস্কার আইন, ২০২৩-এ বর্গাচুক্তি ও চাষাবাদ সংক্রান্ত বিধিনিষেধ রয়েছে, কিন্তু চা-শ্রমিকদের ভূমি অধিকারের সরাসরি উল্লেখ নেই। অন্যান্য প্রাসঙ্গিক কানুনে, যেমন: বাংলাদেশ চা শ্রমিক কল্যাণ তহবিল আইন, ২০১৬, তাদের কল্যাণের কথা বলে, কিন্তু ভূমি অধিকার নয়। ভূমি আপিল বোর্ড বিধিমালা, ২০২৫ ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির রুলস করেছে, কিন্তু চা-বাগানের শ্রমিকদের জন্য নির্দিষ্ট বিধান নেই।

এ ছাড়াও পয়স্তি ও শিকস্তি সংক্রান্ত আইনে নদীভাঙন ও চর জেগে ওঠা জমির মালিকানা নিয়ে গাইডলাইন থাকলেও, তা চা-শ্রমিকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। ফলে তারা আইনি সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত।

ভূমি দলিলের অনুপস্থিতি: বহুমুখী সংকট

অর্থনৈতিক বঞ্চনা : ভূমির দলিল না থাকায় চা-শ্রমিকরা ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিতে পারেন না। জমিকে জামানত হিসেবে রাখার সুযোগ না থাকায় তারা ক্ষুদ্র ব্যবসা, শিক্ষা বা স্বাস্থ্যসেবার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থসংস্থান করতে পারেন না। এর ফলে দারিদ্র্যের চক্র থেকে বের হওয়া তাদের জন্য অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

জমি দখলের ঝুঁকি: আইনগত মালিকানা না থাকায় চা-শ্রমিকদের জমি অনায়াসেই দখল হয়ে যাচ্ছে। প্রভাবশালী ব্যক্তিরা প্রায়ই এই সুযোগ নিয়ে তাদের বসতভিটা বা চাষের জমি দখল করে নেন। আদালতে এর প্রতিকার চাইলেও দলিলের অভাবে তারা হেরে যান।

ভূমিহীনতার যন্ত্রণা: বর্তমানে চা-শ্রমিকরা বাগানের জমিতে কেবল ‘অনুমতিপ্রাপ্ত বাসিন্দা’ হিসেবে বসবাস করেন। তাদের কোনো দলিল, পাট্টা বা আইনগত মালিকানা নেই। ১৯৫০ সালের রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন অনুযায়ী খাসজমির ওপর তাদের কোনো অধিকার স্বীকৃত নয়। এমনকি তারা যে ঘরবাড়ি নির্মাণ করেছেন, যে জমি চাষ করেন, তার কোনোটিতেই তাদের আইনগত অধিকার নেই।

অর্থনৈতিক ন্যায্যতা: চা-শ্রমিকরা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। বাংলাদেশ প্রতিবছর প্রায় ১০ কোটি কেজি চা উৎপাদন করে, যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ রপ্তানি হয়। এই সম্পদ সৃষ্টিতে চা-শ্রমিকদের ভূমিকা অগ্রগণ্য। অথচ তারাই থেকে যাচ্ছেন সম্পদহীন ও অধিকারবঞ্চিত। উৎপাদনশীলতার দিক থেকেও ভূমি অধিকার গুরুত্বপূর্ণ। অধিকার ও নিরাপত্তা পেলে শ্রমিকরা আরও উৎসাহের সঙ্গে কাজ করবেন, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাবে।

জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদ ও শ্রমখাত সংস্কার কমিশনের সাম্প্রতিক উদ্যোগ

জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদ অনুযায়ী বসতির অধিকার একটি মৌলিক মানবাধিকার। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (ILO) কনভেনশন ১৬৯ অনুযায়ী আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভূমি অধিকার সংরক্ষিত থাকা উচিত। বাংলাদেশ এসব আন্তর্জাতিক চুক্তির স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র হিসেবে চা-শ্রমিকদের ভূমি অধিকার নিশ্চিত করতে বাধ্য।

শ্রমখাত সংস্কার কমিশন কর্তৃক ‘চা-শ্রমিকের ভূমি অধিকার নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে উদ্যোগ গ্রহণ’ সংক্রান্ত সুপারিশ বাস্তবায়নে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনা মোতাবেক ভূমিহীন চা-শ্রমিকদের তথ্যসহ মতামত ৩১/০৮/২০২৫ খ্রি. তারিখের মধ্যে প্রেরণের জন্য মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয় (টি-সেল) থেকে সকল উপজেলা নির্বাহী অফিসকে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছিল (হয়তো অন্য জেলাগুলো থেকেও এ-সংক্রান্ত চিঠি ইস্যু করা হয়েছে), যা ইস্যু করা হয় গত ২৮/০৮/২০২৫ খ্রি. তারিখে।

মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ইস্যু করা চিঠি

প্রথমত, চা-শ্রমিকদের দীর্ঘদিনের দাবি (ভূমি অধিকার) নিশ্চিতকরণের জন্য সরকারের এই উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই। তবে এত অল্প সময়ে এত গুরুত্বপূর্ণ ও সময়সাপেক্ষ কাজ সম্পাদন করার নির্দেশনা কেন দেওয়া হলো এবং কোন প্রক্রিয়ায় এই ভূমি অধিকার নিশ্চিত করা হবে তা চা-শ্রমিকরা এখনো জানেন না। এ বিষয়ে স্থানীয় বা জাতীয় পর্যায়ে কোনো আলোচনা/পর্যালোচনার কোনো উদ্যোগও এখন পর্যন্ত পরিলক্ষিত হয়নি।

যেহেতু চিঠিতে স্থায়ী ও অস্থায়ী চা-শ্রমিকের তালিকা চাওয়া হয়েছে, তা-ও আবার মাত্র তিন দিনের মধ্যে তাই কিছু প্রশ্ন থেকেই যায়:

১) অবসরে যাওয়া অথবা চাকরিচ্যুত কিংবা যাদের চা-বাগানে কাজ নাই তাদের বিষয়টা কীভাবে দেখা হবে তার কোনো নির্দেশনা চিঠিতে (যেটা ইউএনওদের দেওয়া হয়েছে) দেওয়া হয় নাই। তাহলে কি তারা ভূমি অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে?

২) বিগত সরকারের আমলে চা-শ্রমিকদের ভূমি অধিকার দেওয়ার নামে ‘কলোনিবাসী’ করার কুপরিকল্পনা বিভিন্ন সময়ে হাতে নেওয়া হয়েছিল, যেখানে গুচ্ছগ্রাম পদ্ধতি/বহুতল ভবন নির্মাণ করে চা-শ্রমিকদের মূল বসতভিটা থেকে সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। বর্তমান উদ্যোগ সেই পরিকল্পনারই বর্ধিত উদ্যোগ কি না, সেটা অস্পষ্ট থেকে যাচ্ছে।

৩) ভূমি অধিকার নিশ্চিত করার প্রক্রিয়ায় যথেষ্ট সতর্কতা এবং সুনির্দিষ্ট আইন ও নীতিমালা (যেমন: মনিপুরী জনগোষ্ঠী তাদের নিজস্ব জমি নিজ জনগোষ্ঠীর বাইরে কাউকে বিক্রি করতে চাইলে সরকারের অনুমতির প্রয়োজন পড়ে) থাকা আবশ্যক। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ ধরনের কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না।

সমাধানের পথ: একটি সমন্বিত উদ্যোগ

শ্রমখাত সংস্কার কমিশন কর্তৃক উদ্যোগ: শ্রমখাত সংস্কার কমিশন কর্তৃক গৃহীত ‘চা-শ্রমিকের ভূমি অধিকার নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে উদ্যোগ গ্রহণ’ কর্মসূচিটি নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। তবে এই কমিশনের উদ্যোগে চা-বাগান মালিক, চা-শ্রমিক, চা-শ্রমিক প্রতিনিধি, ছাত্র-যুবক ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে একটি বিশেষ বৈঠক/আলোচনা করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে যেখানে কোন প্রক্রিয়া বা নীতিমালা অনুসরণ করে এই ভূমি অধিকার নিশ্চিত করা হবে তা তুলে ধরাসহ এই সংশ্লিষ্ট সকল বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে হবে।

আইনি সংস্কার: চা-শ্রমিকদের জন্য একটি বিশেষ ভূমি আইন প্রণয়ন করা জরুরি। এই আইনে তাদের দীর্ঘদিনের বসবাসের স্বীকৃতি দিয়ে ভূমির মালিকানা প্রদানের ব্যবস্থা থাকতে হবে।

জরিপ ও দলিল প্রদান: চা-বাগান এলাকায় একটি বিশেষ ভূমি জরিপ পরিচালনা করে চা-শ্রমিকদের জমির পরিমাণ নির্ধারণ করতে হবে। এরপর তাদের নামে দলিল প্রদান করতে হবে।

আর্থিক সহায়তা কর্মসূচি: দলিল প্রাপ্তির পর তাদের জন্য বিশেষ ঋণ কর্মসূচি চালু করতে হবে যাতে তারা কৃষি বা ক্ষুদ্র ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে পারেন।

আঞ্চলিক উদাহরণ ও শিক্ষা: ভারতের আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে চা-শ্রমিকদের ভূমি অধিকার নিয়ে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এ বছর থেকে আসামে ‘টি ট্রাইব ল্যান্ড রাইটস’ আইনের মাধ্যমে শ্রমিকদের জমির আইনি দলিল দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ এসব অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিতে পারে।

উপসংহার

চা-শ্রমিকদের ভূমি অধিকার কেবল একটি আইনি সমস্যা নয়, এটি একটি মানবিক ও নৈতিক ইস্যু। ১৮০ বছর ধরে এই জনগোষ্ঠী দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রেখে আসছে। এই মৌলিক অধিকার তাদের প্রাপ্য। ভূমি অধিকার প্রতিষ্ঠায় কেবল চা-শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে না, বরং দেশের সামগ্রিক উন্নয়নেও তাতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। এটি শুধু তাদের অধিকার নয়, বরং একটি সভ্য ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ার জন্য অপরিহার্য। সর্বোপরি শ্রমখাত সংস্কার কমিশনের তৎপরতায় সঠিক প্রক্রিয়ায় চা-শ্রমিকদের ভূমি অধিকার নিশ্চিত হোক এই প্রত্যাশা করি।

মোহন রবিদাস: চা-শ্রমিক সন্তান, শমশেরনগর চা-বাগান, কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার

ই-মেইল: robidasmohan@gmail.com

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *