সংবিধান সংস্কার বিষয়ক প্রস্তাব
কল্লোল মোস্তফা
সংবিধান ও নির্বাচন সংস্কারের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার কমিশন গঠন করেছে। এসব নিয়ে বিভিন্নজন মতামত/প্রস্তাব দিয়েছেন, এখনও দিচ্ছেন। এই আলোচনা ও বিতর্ক অব্যাহত থাকবে বলেই মনে হয়। এখানে কিছু প্রস্তাবসহ কয়েকজনের অভিমত প্রকাশ করা হলো- যথাক্রমে জাকিয়া আফরিন, কল্লোল মোস্তফা, মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান, আনু মুহাম্মদ এবং কয়েকটি নারী সংগঠন।
নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান ও তার পরবর্তীকালের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সে সময় স্বৈরশাসন থেকে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় উত্তরণের আকাঙ্ক্ষা থাকলেও তা বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের বিষয়টি গুরুত্ব পায়নি। ফলে সংবিধানে এমন অনেক ধারা রয়ে গেছে যেগুলোর মাধ্যমে দেশে সংসদীয় স্বৈরতন্ত্র কায়েম করা সম্ভব হয়েছিল। সেই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে ২০২৪-এর জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও সংবিধান সংস্কারের দাবি প্রবল হয়ে উঠেছে। এই দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে একজন লেখক ও গণতান্ত্রিক অধিকার কর্মী হিসেবে বাংলাদেশের বিদ্যমান সংবিধান সংস্কার বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত সংবিধান সংস্কার কমিটির কাছে নিম্নোক্ত সংস্কার প্রস্তাব পেশ করছি।
সংবিধান পুনর্লিখন নয়, সংস্কার: পুরো সংবিধান নতুন করে লিখতে গেলে যে তীব্র মতাদর্শগত দ্বন্দ্ব তৈরি হবে, তা সামাল দেওয়ার মতো রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব ও সাংগঠনিক ক্ষমতা বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের নেই। কাজেই সংবিধান নতুন করে না লিখে নাগরিকদের রাজনৈতিক অধিকার, মৌলিক অধিকার, প্রধানমন্ত্রীর স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতা খর্ব করা, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিত করা, সুষ্ঠু নির্বাচন, নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক করার জন্য যেসব সংস্কারের প্রয়োজন, সেগুলো সংস্কারে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।
সংবিধান সংস্কার হবে কীভাবে: সংস্কার কমিশন জনগণের বিভিন্ন অংশের মতামতের ভিত্তিতে সংবিধান সংস্কারের সুপারিশ করবে। এরপর রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত সংবিধান সভা কিংবা জাতীয় সংসদের সদস্যদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা তর্ক-বিতর্কের মাধ্যমে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সেসব সংস্কার চূড়ান্ত করতে হবে।
সংবিধানের যেসব সংস্কার করতে হবে:
১) মৌলিক অধিকার: সংবিধানের তৃতীয় ভাগের মৌলিক অধিকারের অনুচ্ছেদসমূহ বিশেষত ৩২ থেকে ৪৪ অনুচ্ছেদগুলোকে ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা’, ‘জনশৃঙ্খলা’, ‘জনসাধারণের নৈতিকতা’, ‘জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে’ বা ‘আইনি বিধিনিষেধ’ ইত্যাদি শর্ত থেকে মুক্ত করে নিরঙ্কুশ মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
২) প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা:
ক) দুবারের বেশি যেন কেউ প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্ট থাকতে না পারেন এবং কোনো দলের নেতৃত্বে থাকতে না পারেন এমন অনুচ্ছেদ সংবিধানে যোগ করতে হবে।
খ) সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ সংশোধন করে রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করার বিধান বাতিল করতে হবে। এর মাধ্যমে অ্যাটর্নি জেনারেল, মহা হিসাবনিরীক্ষক, সরকারি কর্ম কমিশন, বিচারক ইত্যাদি পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর সংশ্লিষ্টতা দূর করতে হবে।
গ) ৫৭(২) অনুচ্ছেদ থেকে ‘প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে’ রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সংসদ ভেঙে দেওয়ার বিধান বাদ দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী কোনো অন্যায় করলে সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ সদস্যের ভোটের মাধ্যমে তাকে অপসারণ করার বিধান যোগ করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীকে অপসারণ করার পর পরবর্তী নির্বাচনের আগপর্যন্ত অন্তর্বর্তী বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের বিধান যোগ করতে হবে।
৩) নির্বাচন:
ক) সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে বৃহৎ দলের একাধিপত্য ঠেকাতে এবং ছোট-বড় সব দলের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে বর্তমানের এলাকাভিত্তিক ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট পদ্ধতির নির্বাচন ব্যবস্থা সংশোধন করে ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট ও সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচনব্যবস্থা (প্রোপরশনাল রিপ্রেজেনটেশন সিস্টেম) অর্থাৎ মিশ্র পদ্ধতির নির্বাচনের বিধান করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজনে সংসদের আসনসংখ্যা বাড়ানো যেতে পারে। সেইসঙ্গে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের বিধান করতে হবে।
খ) নির্বাচন কমিশন সদস্যদের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে দুই-তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্যের অনুমোদনের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশনের সদস্য নিয়োগের বিধান করতে হবে।
গ) নির্বাচন কমিশনের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করতে পৃথক বাজেটের ব্যবস্থা থাকতে হবে যেন বাজেটের জন্য নির্বাহী বিভাগের ওপর নির্ভরশীল থাকতে না হয়।
ঘ) সুনির্দিষ্ট আইন লঙ্ঘন ছাড়া নির্বাচন কমিশনের সদস্যদের যেন অপসারণ করা না যায়, তার বিধান রাখতে হবে।
ঙ) নির্বাচন কমিশন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দলনিরপেক্ষ ও শক্তিশালী হয়ে ওঠার আগপর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচনের ব্যবস্থা পুনর্বহাল করতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করতে হলে জাতীয় ঐকমত্যের বিধান রাখতে হবে যেন কোনো একক দল সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করতে না পারে।
৪) সংসদীয় স্বৈরতন্ত্রের অবসান: সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে দলের বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোট ছাড়া আর সকল ক্ষেত্রে সাংসদ কর্তৃক দলের বিপক্ষে ভোটদানের সুযোগ তৈরি করতে হবে।
৫) সংসদের কাছে সরকারের জবাবদিহি:
ক) সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমকে জবাবদিহির আওতায় আনার জন্য শক্তিশালী ও কার্যকর সংসদীয় স্থায়ী কমিটি প্রয়োজন। এ জন্য সংবিধানের ৭৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে বিরোধী দলের নেতৃত্ব বাধ্যতামূলক করতে হবে এবং সংসদীয় কমিটির সুপারিশ যেন সরকার গুরুত্বের সঙ্গে নিতে বাধ্য হয় তার বিধান যুক্ত করতে হবে।
খ) সংবিধানের ৫৫(৩) অনুচ্ছেদ সংশোধন করে সংসদের কাছে মন্ত্রিসভার সদস্যদের ‘যৌথ জবাবদিহির’ পাশাপাশি ‘ব্যক্তিগত জবাবদিহির’ বিধান রাখতে হবে।
৬) দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চুক্তি: সংবিধানের ১৪৫ ও ১৪৫ক অনুচ্ছেদ সংশোধন করে প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী কর্তৃত্বে দেশি বা বিদেশি যে কোনো পক্ষের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের আগে তা জাতীয় সংসদে পেশ করে প্রকাশ্য আলোচনা বাধ্যতামূলক করতে হবে।
৭) বিচার বিভাগের স্বাধীনতা:
ক) সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ সংশোধন করে রাষ্ট্রপতিকে ৯৫(১) এবং ৯৮ অনুচ্ছেদ অনুসারে বিচারক ও অতিরিক্ত বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শের প্রয়োজনীয়তা থেকে মুক্ত করতে হবে।
খ) সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে অধস্তন আদালতে দায়িত্ব পালনরত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণের (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতিদান, ছুটি মঞ্জুরিসহ) দায়িত্ব সুপ্রিম কোর্টের ওপর ন্যস্ত করতে হবে।
গ) সংবিধানের ৯৫(২) ১০ বছরের বা তার বেশি অভিজ্ঞতা থাকা সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট থেকে বিচারক নিয়োগের বিধান বাতিল করতে হবে। কারণ, এ ধরনের বিধান থাকলে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ হওয়ার সুযোগ বেশি থাকে। তা ছাড়া অভিজ্ঞ অ্যাডভোকেট মানে ভালো বিচারক–এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই।
৮) জরুরি অবস্থা জারি: অনুচ্ছেদ ১৪১ক সংশোধন করে রাষ্ট্রপতি কোন পরিস্থিতিতে জরুরি অবস্থা জারি করতে পারবেন, তা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে যেন ‘বহিরাক্রমণ’ বা ‘অভ্যন্তরীণ গোলযোগের’ মতো অস্পষ্ট ও অনির্দিষ্ট সমস্যার অজুহাত দিয়ে সরকার জরুরি অবস্থা জারি করে জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ করতে না পারে।
৯) সাংবিধানিক আদালত: সংবিধানের বিভিন্ন ধারার ব্যাখ্যার জন্য সাংবিধানিক আদালত গঠন করতে হবে। সাংবিধানিক আদালত অসাংবিধানিকভাবে রাজনৈতিক অধিকার হরণের জন্য কোনো ব্যক্তি বা রাজনৈতিক দলের বিচার করবে।
১০) রাষ্ট্রধর্ম: সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম সংক্রান্ত ২(ক) অনুচ্ছেদটি সংশোধন করে রাষ্ট্র প্রত্যেক নাগরিকের নিজ নিজ ধর্ম পালন ও বিশ্বাসের স্বাধীনতা নিশ্চিত করবে–এ রকম একটি বিধান যুক্ত করতে হবে।
১১) রাষ্ট্রভাষা: সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার পাশাপাশি অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর ভাষারও স্বীকৃতি দিতে হবে।
১২) জাতীয়তা: সংবিধানের ৬(২) এবং ৯ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে বাঙালি ছাড়াও বাংলাদেশের সব জাতিসত্তার স্বীকৃতি দিতে হবে।
১৩) স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা:
ক) সংসদ সদস্যদের দায়িত্ব আইন প্রণয়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে, সংবিধানের ৫৯ ও ৬০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে স্থানীয় অঞ্চলের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে স্থানীয় সরকারের কর্তৃত্ব ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
খ) জেলা-উপজেলা প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের নিজ নিজ স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে জবাবদিহির বিধান রাখতে হবে।
১৪) অর্থনৈতিক অধিকার:
ক) সংবিধানের ১৫ ও ১৭ অনুচ্ছেদে উল্লিখিত অর্থনৈতিক অধিকারগুলোকে, বিশেষত সর্বজনীন শিক্ষা, চিকিৎসা ও সামাজিক নিরাপত্তার অধিকারকে আদালতের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। এ জন্য রাষ্ট্রকে প্রয়োজনে নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেওয়া যেতে পারে।
খ) সংবিধানের ২০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে নাগরিকের জন্য ‘কর্মসংস্থান সৃষ্টি’ এবং ‘বিদ্যমান কর্মসংস্থানের সুরক্ষায়’ রাষ্ট্রের দায়িত্বকে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে এবং তা আদালতের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য হতে হবে।
গ) সংবিধানের ১৩ অনুচ্ছেদকে সংশোধন করে বিভিন্ন জাতিসত্তার মানুষের ‘ঐতিহ্যগত সামষ্টিক মালিকানার অধিকার’ এবং ‘জনস্বার্থের নামে জোরপূর্বক’ নাগরিকদের কৃষিজমি অধিগ্রহণ ও বসতি উচ্ছেদ থেকে সুরক্ষার অধিকার আদালতের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য হিসেবে সংযুক্ত করতে হবে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, সংবিধান সংস্কারের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক অধিকার ছাড়াও সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করার যথেষ্ট গুরুত্ব প্রদান না করার কারণে অনেক ক্ষেত্রে সংস্কারকৃত সংবিধান জনপ্রিয়তা হারিয়েছে। কাজেই সংবিধানের টেকসই সংস্কার করার জন্য রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক সব ধরনের অধিকারের বিষয়েই গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।