কোটা সংস্কার আন্দোলন, কর্তৃত্ববাদ ও নৃশংসতা

১০ম বর্ষ আগাম প্রকাশ

কল্লোল মোস্তফা

ছবি: খালেদ সরকার/প্রথম আলো

দেশের সরকারের ন্যূনতম গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা না থাকলে তার পরিণতি কী হতে পারে তার সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত হলো কোটা সংস্কার আন্দোলনে সরকারের অকল্পনীয় নৃশংসতা ও ২ শতাধিক মানুষ হত্যার ঘটনা। কোটা সংস্কার আন্দোলন ছিল একেবারেই শান্তিপূর্ণ একটি আন্দোলন। সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা বহাল করে উচ্চ আদালতের এক রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে ৫ জুন থেকে যে আন্দোলন শুরু হয় তা শান্তিপূর্ণ মিছিল-সমাবেশের মধ্যেই সীমিত ছিল।

কিন্তু ক্ষমতাসীন সরকার আদালতের দোহাই দিয়ে শিক্ষার্থীদের দাবিদাওয়াকে কোনো গুরুত্ব দেয়নি, এমনকি আলোচনা পর্যন্ত করতে রাজি হয়নি। এর পরিপ্রেক্ষিতে জুলাইয়ের শুরুতে আন্দোলন খণ্ডকালীন সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ পর্যায়ে প্রবেশ করে। তখনও আন্দোলন শান্তিপূর্ণ ছিল। আন্দোলনে সহিংসতা শুরু হয় ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ কর্তৃক বহিরাগত সন্ত্রাসীদের সঙ্গে নিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালানোর ঘটনার মধ্য দিয়ে।

এই হামলার প্রেক্ষাপট তৈরি হয় ১৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে কোটাব্যবস্থার সুযোগ মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিদের না দিয়ে রাজাকারের নাতি-নাতনিদের দিতে হবে কি না, এ রকম একটি মন্তব্যকে কেন্দ্র করে। আন্দোলনকারীরা এই মন্তব্যকে অবমাননাকর মনে করে ১৪ জুলাই রাতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ মিছিল বের করে। সেই মিছিলে শিক্ষার্থীরা স্লোগান দেয়: ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার/ কে বলেছে কে বলেছে, স্বৈরাচার স্বৈরাচার’ কিংবা ‘চাইতে গেলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’।রাজাকারের নাতি-নাতনির সঙ্গে তুলনা করায় শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ হয়ে পরিহাস হিসেবে এই স্লোগানগুলো দিলেও সরকার সমর্থকরা এর মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা নিজেদের ‘রাজাকার’ হিসেবে অভিহিত করেছে বলে প্রচার করতে থাকে এবং আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার যুক্তি তৈরি করে।

১৫ জুলাই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার ফলে বিক্ষোভ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ১৬ জুলাই শিক্ষার্থীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছেড়ে রাস্তায় নেমে এসে সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ করেন। এ সময় পুলিশ ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের সন্ত্রাসীরা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে। পুলিশ শিক্ষার্থীদের ওপর টিয়ার গ্যাস, রাবার বুলেট ও ছররা গুলি নিক্ষেপ করে আর ছাত্রলীগ-যুবলীগের সন্ত্রাসীরা দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র এবং পিস্তল-বন্দুক নিয়ে হামলা করে। এতে ৬ তরুণ নিহত হন, যার মধ্যে চট্টগ্রামে তিনজন, ঢাকায় দুজন এবং রংপুরে একজন। এরপর সরকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে এবং ১৭ জুলাই পুলিশ ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের মাধ্যমে বলপ্রয়োগ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো থেকে শিক্ষার্থীদের বের করে দেয়। এতে আন্দোলন আরও বেশি করে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং আন্দোলনে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী এমনকি স্থানীয় জনসাধারণও যোগদান করে।

পুলিশ ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের হামলায় ১৬ জুলাই ৬ তরুণের নিহত হওয়ার ন্যক্কারজনক ঘটনার পরও সরকারের টনক নড়েনি। নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে যদি তখনও সরকার পুলিশ ও ছাত্রলীগ-যুবলীগকে মাঠ থেকে তুলে নিয়ে কোটা সংস্কার বিষয়ক দাবি নিয়ে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দিত, তাহলেও পরবর্তী নৃশংস হত্যাকাণ্ডগুলো এড়ানো যেত। কিন্তু আমরা দেখলাম ৬টি তাজা প্রাণ ঝরে যাওয়ার পরও সরকার বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে বলপ্রয়োগের পথ থেকে সরল না, যার ফলস্বরূপ পুলিশ ও সরকার সমর্থকদের হামলায় ১৮ জুলাই এক দিনে কমপক্ষে ৪১ জন নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে; যা বাংলাদেশের আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাসে নজিরবিহীন। এর মধ্যে ঢাকায় ৩৩ এবং ঢাকার বাইরে ৮ জন নিহত হন। নিহতদের মধ্যে রয়েছেন শিক্ষার্থী, সাংবাদিক, রিকশাচালক, হকার, দোকানদার, পথচারী। এর মধ্যে স্কুল-কলেজের অপ্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষার্থীও রয়েছে। নিহতদের বেশিরভাগের শরীরে গুলির অথবা মাথায় আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়।

পুলিশ ও সরকার সমর্থকদের হামলায় ১৮ জুলাই এক দিনে কমপক্ষে ৪১ জন নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে; যা বাংলাদেশের আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাসে নজিরবিহীন। এর মধ্যে ঢাকায় ৩৩ এবং ঢাকার বাইরে ৮ জন নিহত হন।

এই বিপুল সংখ্যক প্রাণহানির পর আমরা দেখলাম সরকারের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে আইনমন্ত্রী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব রাখেন, কোটা বিষয়ে আদালতের শুনানি এগিয়ে আনার কথা বলেন এবং ছয়জন নিহতের ঘটনা তদন্তে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠনের কথা জানান।অথচ তার আগপর্যন্ত সরকার ‘আদালতে বিচারাধীন বিষয়ে সরকারের কিছু করার নেই’–এ রকম একটি অবস্থান নিয়ে বসে ছিল। সরকার আলোচনার প্রস্তাব দেয় এমন এক সময়ে যখন ইতোমধ্যে বিপুল সংখ্যক তরুণ হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। শুধু তাই নয়, আলোচনার প্রস্তাবটিও কতটা আন্তরিক ছিল, সেই প্রশ্নও উঠেছে। কারণ, সরকার যখন আলোচনার প্রস্তাব দিচ্ছিল তখনও রাজপথে সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী ও দলীয় ক্যাডার বাহিনী আন্দোলনরত বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালিয়ে যাচ্ছিল।

এভাবে মুখে আলোচনার প্রস্তাব দিয়ে বাস্তবে শিক্ষার্থীদের ওপর সশস্ত্র হামলা জারি রাখার ফলে পরদিন ১৯ জুলাই আরও বেশি সংখ্যক মানুষের মৃত্যু ঘটে। এদিন অন্তত ৮৪ জন নিহতের খবর পাওয়া যায়। আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বিভিন্ন এলাকার স্থানীয় জনসাধারণ ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করেন। আন্দোলন দমনের নামে সরকার এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করে, যা দেখে মনে হতে পারে সরকার দেশের জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। রাস্তায় রাস্তায় পুলিশ-র‌্যাব-বিজিবি বিক্ষোভকারীদের ওপর মুহুর্মুহু টিয়ার গ্যাস, রাবার বুলেট ও ছররা গুলি নিক্ষেপ করে। এমনকি ঢাকার বিভিন্ন স্থানে হেলিকপ্টার থেকে কাঁদানে গ্যাসের শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করার ঘটনা ঘটেছে; যার মধ্যে বিভিন্ন ঘনবসতিপূর্ণ আবাসিক এলাকাও রয়েছে। পুলিশের ছোড়া ছররা গুলিতে বহু মানুষ আহত হন, যাদের অনেকের চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।১০ পুলিশ নাগরিকের জানমাল রক্ষায় গুলি করেছে বলে দাবি করেছে, কিন্তু বাস্তবে আন্দোলন দমনের নামে নির্বিচার গুলি চালিয়েছে। এতে পুলিশের গুলির সামনে বুক পেতে দেওয়া তরুণ কিশোর আন্দোলনকারী যেমন নিহত হয়েছেন, তেমনি নিহত হয়েছেন অনেক সাধারণ মানুষ; যাদের কেউ কর্মস্থলে যাচ্ছিলেন, কেউ কর্মস্থল থেকে ফিরছিলেন, কেউ রিকশাচালক, কেউ হকার, দোকান কর্মচারীসহ বিভিন্ন খেটে খাওয়া মানুষ। নাগরিকের জানমাল রক্ষায় মনোযোগ থাকলে পুলিশের গুলিতে এত বিপুল সংখ্যক মানুষের এভাবে মৃত্যু ঘটত না। সরকারকে নাগরিকদের কাছে জবাবদিহি করতে হলে সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিক্ষোভ দমনে এভাবে ব্যবহার করতে পারত না।

মুখে আলোচনার প্রস্তাব দিয়ে বাস্তবে শিক্ষার্থীদের ওপর সশস্ত্র হামলা জারি রাখার ফলে পরদিন ১৯ জুলাই আরও বেশি সংখ্যক মানুষের মৃত্যু ঘটে। এদিন অন্তত ৮৪ জন নিহতের খবর পাওয়া যায়।

সরকার ১৬ জুলাই মধ্যরাত থেকে মোবাইল ইন্টারেনেট (ফোর-জি) এবং ১৭ জুলাই রাত থেকে ব্রডব্যান্ডসহ পুরো ইন্টারনেট ব্যবস্থাই বন্ধ করে দেয়।১১ গণপরিবহন ব্যবহার করে আন্দোলনকারীরা যেন সুবিধা নিতে না পারে, সে জন্য সরকার সারা দেশের সঙ্গে রেল ও বাস চলাচল বন্ধ করে দেয়, বন্ধ করে দেয় রাজধানীর মেট্রোরেল চলাচল।১২ বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪ ব্যবহার করে ১৯ জুলাই রাত ১২টা থেকে সারা দেশে কারফিউ জারি করে সেনাবাহিনী মোতায়েন করে।১৩ কারফিউ ঘোষণা করে সেনা মোতায়েনের পরও ২০ জুলাই ঢাকা, ময়মনসিংহ, গাজীপুর, সাভার ও নরসিংদীতে বিক্ষোভ ও সংঘর্ষে ৩৮ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়।১৪

বিপুল প্রাণহানির পর সরকারি উদ্যোগে কোটা সংস্কার বিষয়ে আদালতের শুনানি এগিয়ে ৭ আগস্ট থেকে ২১ জুলাই নিয়ে আসা হয়। এদিন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটার পরিবর্তে ৭ শতাংশ কোটা নির্ধারণ করে রায় প্রদান করে। রায়ে মেধার ভিত্তিতে ৯৩ শতাংশ; মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ; ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ১ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর জন্য ১ শতাংশ কোটা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। তবে সরকার প্রয়োজন ও সার্বিক বিবেচনায় আদালত কর্তৃক নির্ধারিত কোটা বাতিল, সংশোধন বা সংস্কার করতে পারবে বলেও রায়ে উল্লেখ করা হয়।১৫ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সেই অনুযায়ী প্রজ্ঞাপন জারি করে ২৩ জুলাই।১৬

অথচ এর কোনো কিছুই প্রয়োজন হতো না, যদি সরকার ন্যূনতম গণতান্ত্রিক আচরণ করত। কোনো গণতান্ত্রিক দেশে নাগরিকরা বিভিন্ন দাবিদাওয়া তুলে আন্দোলন করলে সরকারের দায়িত্ব হলো আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে তার মীমাংসা করা। কোনো ধরনের আলাপ-আলোচনা না করেই শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলনকারীদের ওপর বলপ্রয়োগ কোনো গণতান্ত্রিক আচরণ হতে পারে না। কিন্তু আমরা দেখলাম ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার কোনো উদ্যোগ না নিয়ে বলপ্রয়োগের রাস্তায় হাঁটে।

কিন্তু কোটা সংস্কার আন্দোলন তো একটি অর্থনীতিবাদী আন্দোলন অর্থাৎ এই আন্দোলনের দাবিদাওয়া অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধাকেন্দ্রিক। দেশে উন্নয়নের ঢোল পেটানো হলেও দেশের উচ্চশিক্ষিত তরুণদের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক মানসম্পন্ন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি না হওয়ায় সীমিত সংখ্যক সরকারি চাকরিই এখনো শিক্ষার্থীদের অনেকের জন্য পরম আকাঙ্ক্ষিত। শিক্ষার্থীরা সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটাব্যবস্থার সংস্কার চেয়েছিলেন যেন তারা তাদের শেষ ভরসা সরকারি চাকরিতে যোগদানের ন্যায্য সুযোগটুকু অন্তত পান। দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে একচেটিয়া ক্ষমতায় থাকা সরকারের রাজনৈতিক ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করা এই আন্দোলনের কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। তাহলে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সরকারের এই নৃশংস আচরণের কারণ কী?

দেশে উন্নয়নের ঢোল পেটানো হলেও দেশের উচ্চশিক্ষিত তরুণদের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক মানসম্পন্ন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি না হওয়ায় সীমিত সংখ্যক সরকারি চাকরিই এখনো শিক্ষার্থীদের অনেকের জন্য পরম আকাঙ্ক্ষিত।

ধারণা করা যায়, সরকারের এ ধরনের আচরণের পেছনে দুটো বিষয় কাজ করেছে: একদিকে রয়েছে গোষ্ঠীতান্ত্রিক পৃষ্ঠপোষকতা বিলিবণ্টন ও আমলাতন্ত্রে নিজস্ব লোকের উপস্থিতি নিশ্চিত করার জন্য, বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধা কোটার ব্যবহার, অন্যদিকে রয়েছে জবাবদিহিবিহীন একচেটিয়া ক্ষমতার ঔদ্ধত্য।

বর্তমান সরকারের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার অন্যতম একটি কৌশল হলো বিভিন্ন দেশি-বিদেশি গোষ্ঠীকে নানাভাবে অন্যায্য সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে আনুগত্য ও সহযোগিতা অর্জন। কোটা হলো নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে নিজস্ব গোষ্ঠীকে সুবিধাদি বণ্টনের নিশ্চিত একটি উপায়, যার মাধ্যমে আমলাতন্ত্রে নিজস্ব লোকের সংখ্যাগরিষ্ঠতা সহজে নিশ্চিত করা যায়। ফলে সরকার এ রকম একটি ব্যবস্থা সহজে হাতছাড়া করতে চায়নি।

অথচ স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে এসে দীর্ঘদিন ধরে চলমান কোটাব্যবস্থার সংস্কার যে প্রয়োজন তার যৌক্তিকতা সংশ্লিষ্ট সবাই স্বীকার করেন। আজ থেকে দেড় দশক আগে ২০০৯ সালে সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) এ বিষয়ে কিছু সুপারিশ করেছিল। ওই সুপারিশের মধ্যে ছিল মুক্তিযোদ্ধা, নারী ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর অগ্রাধিকার কোটাগুলো জাতীয় পর্যায়ে বণ্টন করা। এ ছাড়া পিএসসির ২০১৫ ও ২০১৬ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে কোটার প্রয়োগকে অত্যন্ত জটিল, দুরূহ এবং সময়সাপেক্ষ ব্যাপার উল্লেখ করে কোটা প্রয়োগের পদ্ধতি সহজ করার কথা বলা হয়েছিল। ২০১৮ সালে তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলমের নেতৃত্বাধীন একটি কমিটি নবম থেকে ১৩তম গ্রেডে কোটা বাতিল করার সুপারিশ করেছিল, সেই সঙ্গে বলা হয়েছিল কোটা বাতিলের পর কী প্রভাব পড়েছে, সেটি পর্যালোচনা করে প্রয়োজন অনুযায়ী যেন কোটা সমন্বয় করা হয়।১৭ অর্থাৎ কোটাব্যবস্থা সংস্কারের সুপারিশ খোদ আমলাতন্ত্রের ভেতর থেকেই বারবার এসেছে। ফলে শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে কোটা সংস্কার না করার কোনো যুক্তিই ধোপে টেকে না। কিন্তু তারপরও দেখা গেল, সরকার যুক্তির বদলে শক্তি প্রয়োগের পথ বেছে নিয়েছে।

এখন প্রশ্ন হলো: সরকার ২০২৪ সালে আন্দোলনকারীদের দাবি মেনে কোটা সংস্কারে অনিচ্ছুক থাকলেও ২০১৮ সালে কোটা পুরোপুরি বাতিল কেন করেছিল? ২০১৮ সালে নির্বাচনের আগের পরিস্থিতি আর ২০২৪ সালের নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতি এক নয়। ২০১৮ সালেও সরকার কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে মারমুখী আচরণ করেছে, কিন্তু নির্বাচনের আগে বড় কোনো ঝুঁকি নিতে চায়নি। সেই কারণে বাধ্য হয়ে বিরক্তির সঙ্গে হলেও আন্দোলনকারীদের দাবি মেনে নিয়েছিল।

কিন্তু সে সময়ও সরকার আন্দোলনকারীদের দাবি অনুসারে কোটা সংস্কার না করে পুরোপুরি বাতিল করে দিয়েছিল সম্ভবত এ রকম একটা উদ্দেশ্য মাথায় রেখে যেন পরবর্তী সময়ে সুবিধাজনক সময় কোটা পুরোপুরি বাতিল করার পরিপত্রের সাংবিধানিক বৈধতাকে আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যায়। এ রকমই একটি রিট এবং সেই রিটের বিপরীতে ২০১৮ সালের পরিপত্র বাতিল করে হাইকোর্টের দেওয়া রায় থেকেই কিন্তু এবারের আন্দোলনের সূত্রপাত।

বস্তুত কোনো সরকার যদি প্রতিযোগিতাপূর্ণ নির্বাচন ছাড়াই দীর্ঘদিন একটানা ক্ষমতায় থাকে, তাহলে সরকারের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে কর্তৃত্ববাদী দম্ভ তৈরি হয়। এসব ক্ষেত্রে যেহেতু ক্ষমতায় থাকার জন্য নাগরিকদের ভোটের কোনো প্রয়োজন থাকে না, ফলে নাগরিকদের মন জয় করা বা নাগরিকদের দাবিদাওয়াকে গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়ার কোনো তাগিদ সরকারের থাকে না। সরকার দয়া করে নাগরিকদের যা দেবে তাতেই নাগরিকদের খুশি থাকা উচিত বলে মনে করতে থাকে এ ধরনের সরকার। তারা আশা করে নাগরিকরা সরকারের কাছে জোর গলায় কোনো দাবিদাওয়া জানাবে না, বড়জোর অনুনয়-বিনয় করবে।

কোনো সরকার যদি প্রতিযোগিতাপূর্ণ নির্বাচন ছাড়াই দীর্ঘদিন একটানা ক্ষমতায় থাকে, তাহলে সরকারের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে কর্তৃত্ববাদী দম্ভ তৈরি হয়।

এ রকম অবস্থায় নাগরিকদের কোনো অংশ যদি সরকারের কাছে জোর গলায় দাবিদাওয়া জানাতে থাকে, দাবি আদায়ে সরকারকে বাধ্য করার মতো কর্মসূচি দিতে থাকে; দীর্ঘদিন ধরে একচেটিয়া ক্ষমতায় থাকা কর্তৃত্ববাদী সরকারের কাছে তা অসহ্য মনে হতে থাকে, সরকার এটাকে রীতিমতো হুমকি হিসেবে দেখতে থাকে। এ রকম একটা প্রেক্ষাপটেই প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে জবাবদিহিহীন একচেটিয়া ক্ষমতা চর্চাকারী আওয়ামী লীগ সরকার বলপ্রয়োগের মাধ্যমে কোটা সংস্কার আন্দোলন দমন করতে গিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে নৃশংস হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটিয়েছে।

কল্লোল মোস্তফা: লেখক, গবেষক। ইমেইল: kallol_mustafa@yahoo.com

তথ্যসূত্র:

১। চিকিৎসাধীন আরও চারজনের মৃত্যু, নিহত বেড়ে ২০১, প্রথম আলো, ২৫ জুলাই ২০২৪

২। দফায় দফায় হামলা, সংঘর্ষ, গুলি, প্রথম আলো, ১৬ জুলাই ২০২৪; জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও হামলা, প্রথম আলো, ১৬ জুলাই ২০২৪; আহত ২৯৭ জন ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা নেন, প্রথম আলো, ১৬ জুলাই ২০২৪

৩। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থায় ভাবমূর্তি নষ্ট হয় না, প্রথম আলো, ১৫ জুলাই ২০২৪

৪। মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ, প্রথম আলো, ১৫ জুলাই ২০২৪

৫। সারা দেশে বিক্ষোভ-সংঘাত, নিহত ৬, প্রথম আলো, ১৭ জুলাই ২০২৪

৬। দেশজুড়ে বিক্ষোভ, সংঘর্ষ-গুলি, নিহত ২৭, প্রথম আলো, ১৯ জুলাই ২০২৪; সংঘর্ষে তিন দিনে নিহত ১০৩, প্রথম আলো, ২০ জুলাই ২০২৪

৭। আলোচনায় রাজি, এরপরও সহিংসতা হলে কঠোর হবে সরকার, প্রথম আলো, ১৯ জুলাই ২০২৪

৮। চিকিৎসাধীন আরও চারজনের মৃত্যু, নিহত বেড়ে ২০১, প্রথম আলো, ২৫ জুলাই ২০২৪

৯। হেলিকপ্টার থেকে সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ, প্রথম আলো, ২০ জুলাই ২০২৪

১০। চোখে ছররা গুলির আঘাত নিয়ে অনেকেই হাসপাতালে, প্রথম আলো, ২০ জুলাই ২০২৪

১১। ইন্টারনেট বন্ধ, কখন চালু হবে, কেউ জানে না, প্রথম আলো, ২০ জুলাই ২০২৪

১২। সারা দেশে ট্রেন চলাচল বন্ধ, প্রথম আলো, ২০ জুলাই ২০২৪

১৩। সারা দেশে কারফিউ জারি, সেনাবাহিনী মোতায়েন, প্রথম আলো, ২০ জুলাই ২০২৪

১৪। চিকিৎসাধীন আরও চারজনের মৃত্যু, নিহত বেড়ে ২০১, প্রথম আলো, ২৫ জুলাই ২০২৪

১৫। মেধায় নিয়োগ ৯৩ শতাংশ, বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২২ জুলাই ২০২৪

১৬। কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পেলে মেধায় নিয়োগ, প্রথম আলো, ২৪ জুলাই ২০২৪

১৭। চাকরিতে কোটা সংস্কারের সুপারিশ এসেছে বারবার, প্রথম আলো, ১৬ জুলাই ২০২৪

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *