বাংলাদেশের ৫০ বছর ও তারপর-৪
একদলীয় ব্যবস্থা এবং রক্তাক্ত ১৯৭৫
আনু মুহাম্মদ
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের শেষ প্রান্তে ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানের হানাদার সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। এরপর ৫২ বছর অতিক্রম করেছে এই দেশ। এই সময়ে দুইজন রাষ্ট্রপতি খুন হয়েছেন, দুই দফা প্রত্যক্ষভাবে সামরিক শাসন এসেছে, সামরিক বাহিনীর ভূমিকা বেড়েছে, সংবিধান সংশোধন হয়েছে ১৬ বার, নির্বাচনের নানা রূপ দেখা গেছে, শাসনব্যবস্থা ক্রমান্বয়ে কর্তৃত্ববাদী হয়েছে। পাশাপাশি অর্থনীতির আয়তন ক্রমে বেড়েছে, জিডিপি ও বিশ্ববাণিজ্যে উল্লম্ফন ঘটেছে, অবকাঠামো ছাড়াও সমাজে আয় ও পেশার ধরনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন এসেছে। সম্পদের কেন্দ্রীভবন ও বৈষম্যও বেড়েছে, কতিপয় গোষ্ঠীর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কর্তৃত্বে আটকে গেছে দেশ। এই ধারাবাহিক লেখায় এই দেশের একজন নাগরিক তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সাথে সাথে ইতিহাসের নানা নথি পর্যালোচনা করে এই দেশের রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, সংস্কৃতির গতিমুখ তুলে ধরতে চেষ্টা করেছেন। চতুর্থ পর্বে ১৯৭৫ সালের ঘটনাবলী-একদলীয় শাসন, একের পর এক নৃশংস হত্যাকান্ড এবং ভয়ংকর অনিশ্চিত সময় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
সেসময় ১লা জানুয়ারি নিয়ে এত হৈ-হল্লা ছিল না। তাই অন্য অনেকের মতো আমার জন্যও নতুন বছর ১৯৭৫ শুরু হয় নীরবেই, খেয়ালও হয় নাই। কদিন পরই আমার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা, প্রস্তুতি বেশ খারাপ। তবে বছর শুরুর দুই দিনের মাথায় যে ঘটনা ঘটলো তার কথা মনে আছে। কারণ ৩রা জানুয়ারি সকালে দৈনিক বাংলার প্রথম পৃষ্ঠায় সিরাজ শিকদারের ছবি বড় করে ছাপা হয় এই খবরের সাথে যে, তিনি ধরা পড়ে ‘পালাতে গিয়ে’ পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন। আগের কয় বছরে এই নাম ছিল বহুল আলোচিত, দেয়ালে দেয়ালে তাঁর পার্টির কথা লেখা, কিন্তু তাঁর ছবি দেখিনি কখনও, প্রথম ছবি দেখলাম মৃত্যুসংবাদসহ। পরে জানলাম ১লা জানুয়ারি চট্টগ্রামে সর্বহারা পার্টির প্রধান সিরাজ শিকদার গ্রেফতার হন, তাঁকে কড়া নিরাপত্তায় ঢাকায় নিয়ে আসা হয় এবং হেফাজতে থাকা অবস্থাতেই পুলিশের গুলিতে তিনি নিহত হন ২রা জানুয়ারি রাতে। ক্রসফায়ার বা এনকাউন্টার নামে রাষ্ট্রীয় যে হত্যাযজ্ঞ গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে আমরা নিয়মিত দেখছি তার শুরু এভাবেই।
আগের বছর থেকে নানা খাতায় দিনের কথাবার্তা লিখি, এ বছরেই আমি নিজের লেখার পয়সায় ডায়েরী কিনে সেখানে লেখা শুরু করি। সেখানে আমার অনুভূতি পাচ্ছি এরকম:
৪.১.৭৫
…তাঁর ওপর আমার বিশ্বাস ভরসা তৈরি হচ্ছিলো…হয়তো তিনিই একটি আদর্শ খাড়া করতে পারবেন যার অনুসরণে শ্রমিক কৃষক বলিষ্ঠ বিদ্রোহী হতে পারে…সুন্দর সমাজ গড়ে উঠতে পারে। তাঁর বর্তমান কার্যক্রম সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত ছিল একথা আমি বলবো না। কিন্তু তাঁর কার্যক্রমে সদুদ্দেশ্য ছিল। তাঁর পথ ধীরে ধীরে সঠিক মোড় নিচ্ছিল।…মাঝে মাঝে মনে হয় এটা যদি অসত্য সংবাদ হতো!…
মনে আছে, এর কদিনের মধ্যে টিভিতে দেখছিলাম শেখ মুজিবের বক্তৃতা। কিন্তু তিনি যখন বললেন ‘কোথায় সিরাজ সিকদার?’ খুবই খারাপ লেগেছিল। ভেবেছি কীভাবে তিনি এরকম কথা বললেন?
জরুরী অবস্থা দিয়ে তখন আরও যেসব কাজ চলছিল তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো বস্তি উচ্ছেদ। আমার পরীক্ষার প্রথম দিনও এরকম উচ্ছেদ হয়েছিল। ডায়েরীতে দেখলাম সেসময়ের ভাবনা এরকম:
৯.১.৭৫
ঢাকা শহর খোলামেলা হয়ে গেছে। বহু বস্তি-দোকানপাট ভেঙে দেয়া হয়েছে। যারা এগুলো অননুমোদিত স্থানে তুলে অন্যায়ভাবে পয়সা কামাই করলো তাদের বিশেষ কোন ক্ষতি হলো না, কিন্তু বহু মানুষের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ালো।…এমন সময়ে এগুলো করা হচ্ছে যার ধাক্কায় সিরাজ সিকদার তলিয়ে গেছেন।
১৬.১.৭৫
বুদ্ধিজীবীদের ইদানিংকার তৎপরতায় আমি বিশেষভাবে ক্ষুব্ধ। তাদের অধিকাংশ সর্বদাই তোষামোদে এবং আপোষমূলক পথে চলতে ব্যস্ত।…আশ্চর্য্য, এত জ্ঞানের বোঝা, এত জানার এই পরিণতি। এরা গণবিরোধী, জনশত্রু।
সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী ও এক দলীয় ব্যবস্থা
জরুরী অবস্থার মধ্যে, ১৯৭৫ সালের শুরুতেই, ঘোষণা করা হয় একদলীয় শাসন ব্যবস্থা। এবছরের ২৫শে জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী বিলটি জাতীয় সংসদে ২৯৪-০ ভোটে পাস হয়। এর মধ্যে দিয়ে সংসদীয় শাসন পদ্ধতির পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি শাসিত পদ্ধতি এবং বহুদলীয় রাজনীতির পরিবর্তে একদলীয় রাজনীতির সূচনা করা হয়। ২৪শে ফেব্রুয়ারি ঘোষণা করা হয় একক দলের নাম ও কাঠামো, তাতে অন্য সব দল নিষিদ্ধ হয়ে যায়। কিছুদিন পর চারটা বাদে বাকি সব পত্রিকাও নিষিদ্ধ করা হয়। আমার তখনকার কয়েকদিনের প্রতিক্রিয়া/ভাবনা ছিলো নিম্নরূপ:
২৫.১.৭৫
…দেশে প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকার চালু হলো। পার্লামেন্ট থাকবে, তবে তার ক্ষমতা সীমাবদ্ধ। দেশের সকল ক্ষমতা থাকবে প্রেসিডেন্টের হাতে। তিনি সরাসরি দেশের জনগণের ভোটে নির্বাচিত হবার কথা। তার কাজের কৈফিয়ত নিতে পারবে পার্লামেন্ট দুই তৃতীয়াংশ ভোটে। খুব সম্ভব প্রেসিডেন্টের হাতে দেয়া ক্ষমতাবলে দেশে একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম হতে যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই বর্তমান সরকারের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান। বহুদিনের গুজব এবার সত্য হলো।…সিরাজ সিকদার নেই, কোনো বিরোধী দল নেই, কোনো সম্ভাবনাও নেই নিকট ভবিষ্যতে। এখন যদি শেখ মুজিবের উপর কিছুটা আস্থাও না রাখতে পারে এদেশের মানুষ তবে তারা হতাশাতেই শেষ হয়ে যাবে। তবু তো মাঝে মাঝে শেখ মুজিবের গলায় স্বীকারোক্তি মেলে- শোষিত ক্ষুধার্ত মানুষের পক্ষে।
২৪.২.৭৫
বাংলাদেশের জন্য একক জাতীয় দল ঘোষণা করা হয়েছে। অন্য সব দল আজ থেকে বাতিল হলো। ধীরে ধীরে শেখ মুজিব কি সাংঘাতিকভাবে গণতন্ত্রকে হত্যা করলেন!
২৫.২.৭৫
শেখ মুজিবের প্রেসিডেন্সিয়াল সরকার, একটি মাত্র জাতীয় দল দেশে স্থিতিশীলতা আনবে সন্দেহ নেই, উন্নয়নের পথে হয়তো কিছুটা এগুবেও, ভালই এগুবে হয়তো, তবুও গণতন্ত্রের এই নির্মম নিষ্পেষণ কি সমর্থনযোগ্য?
২.৩.৭৫
সমর্থন করতে পারি না, মোটেই সমর্থন করতে পারি না। যতই উন্নয়ন সমৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকুক, তা এ পথে সবার, শোষিত মানুষের মুক্তি আনতে পারবে না। শেখ মুজিবের সময় না হোক এর বিপদের মারাত্মক ঝুঁকি অনস্বীকার্য। এক বিরাট গহ্বর সামনে। কিন্তু বামপন্থী কর্মী নেতা আদর্শ- এরা কি এতই অস্থায়ী, দুর্বল?
৬.৩.৭৫
রামপুরা টেলিভিশন নতুন ভবন উদ্বোধন করা হলো আজকে। অনুষ্ঠান দেখলাম বেশ কটা। ভালো লাগলো।
১০.৩.৭৫
ভাসানী অবশেষে পরাজিত হলেন। শেখ মুজিব তাঁকেও বশ করে ফেললেন। তিনি যে কোনো মানুষকে বশ করার ক্ষমতা রাখেন।…তাঁর একটি গুণ অবশ্যই প্রশংসার যোগ্য, তা হচ্ছে বাবা মার প্রতি গভীর অনুরাগ।…সারা দেশ এখন তার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। অবশ্য, সেই পুরনো কথা, জনগণের দুঃখ দুর্দশার কোনো তারতম্য হয়নি।
৭.৪.৭৫
একশো টাকার সব নোট অচল ঘোষণা করা হয়েছে। গ্রামেও এই নিয়ে দৌড়াদৌড়ি।
৪.৫.৭৫
দৈনিক বাংলার খবর: চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বলা হয়েছে স্বল্প সময়ের মধ্যেই স্বীকৃতিপত্র দেয়া হবে।
১৬.৬.৭৫
অর্ডিন্যান্স জারী করা হলো আজ-পত্রিকা বাতিলের। দৈনিকগুলোর মধ্যে থাকছে দৈনিক বাংলা, দৈনিক ইত্তেফাক, বাংলাদেশ অবজার্ভার ও বাংলাদেশ টাইমস।… বাকি দৈনিকগুলোর কর্মচারী, সাংবাদিকদের জীবন, তাদের পরিবারের তথা চাকুরীর কোন নিশ্চয়তা দেয়া হয়নি। শুধু কী এক কমিটির কথা ঘোষণা করা হয়েছে যার কাছে এই সহস্র নব্যবেকার মানুষদের রিপোর্ট করতে হবে। তারপর হলেও হতে পারে।… এই শাসকশক্তির একটি জিনিস লক্ষ্যণীয়, তা হলো জনগণের জীবনের তথা অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা, শিক্ষা, আশ্রয় এগুলোর প্রতি গুরুত্ব না দিয়ে স্বীয় অবস্থান সুদৃঢ় করবার প্রতিই এদের খেয়াল বেশী। এখনও খোদ রাজধানীতে যে সংখ্যক নিরন্ন অনাশ্রয়ী মানুষ পথে ঘাটে পড়ে আছে তারাই এর সাক্ষী। আর অবিরাম সমাজতন্ত্রের কথা বলে বলে তারা মূলত সমাজতন্ত্রকে কলংকিত করছে মাত্র।
২৫.৬.৭৫
সোমবার বিকালে (২৩শে জুন) দেশের ৭৫-৭৬ সালের বাজেট পেশ করা হয়।…একমাত্র কটি পত্রিকা রেডিও টিভি খুব প্রচার চালাচ্ছে – সমাজতান্ত্রিক। যাতে সমাজতন্ত্রের ভাবগন্ধ নাই। বলা হচ্ছে গতবার উন্নয়ন খাতে ব্যয় বরাদ্দ ছিল ৫৫০ কোটি টাকা, এবার ৯৫০ কোটি টাকা অর্থাৎ যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। অথচ একথা স্পষ্টই বোঝা যায় ডলারের সাথে পুনর্মুল্যায়নের ফলে ৫৫০ কোটি টাকা ৯৫০ কোটি টাকার প্রায় কাছেই চলে যায়। শিক্ষা, শিল্প খাতে এবার ব্যয় বাড়ানো হয়নি। শিল্পের খুচরা অংশ নয়- খাদ্যশস্যই বেশি আমদানী করা হচ্ছে।
১.৭.৭৫
কুয়ালালামপুরে মোহাম্মদ আলী-জো বাগনারের আলোড়ন তোলা মুষ্টিযুদ্ধ লড়াই সকালে ঢাকায় বসে টিভিতে সরাসরি দেখলাম বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রের মাধ্যমে। লক্ষ লক্ষ দর্শক আজ এক অভূতপূর্ব আনন্দে এটি উপভোগ করেছেন। বিদেশ থেকে ঢাকার টিভিতে সরাসরি সম্প্রচারিত অনুষ্ঠান এই প্রথম।
১১.৭.৭৫
কেমন এক ঘোরের মধ্যে শেখ মুজিবের কাছে একটা চিঠি পাঠালাম। তাঁর কাছে পৌছাবার সম্ভাবনা কম। চিঠিটিতে ক্ষোভ, অভিযোগ এবং কৈফিয়ত- শহরে পড়ে থাকা মানুষ এবং গ্রামের মৃতপ্রায় মানুষের পক্ষে।
১৭.৭.৭৫
৬১টি জেলা আর তার ৬১জন গভর্নর এবং জেলা কাউন্সিল ইত্যাদি ঘোষণা।
১৮.৭.৭৫
পর পর দুদিন শেখ কামাল ও শেখ জামালের বিয়ের অনুষ্ঠান। মহোৎসব।
১৯৭৫ এর গ্রাম শহর ভাবনা
এই বছরই ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার পর গ্রামে গিয়ে থাকলাম বেশ কিছুদিন। কিন্তু তখনও গ্রামে সংকট কাটেনি, বন্যার পর তখন খরা চলছে। অনেক মানুষের মধ্যেই দুর্ভিক্ষের ছাপ তখনও আছে।
২৭/২৮.২.৭৫
‘আখেরে জামানা/ বলিতে মানা/ কইতে গেলে ধইর্যা মারে। যারা অইল মেম্বর/ তারাই নিল কম্বল/ গরীবে ঝুইলা কাথা পরে।’ অবিকল ‘হাইকোর্টের মাজারে কত ফকির ঘুরে রে’ গানের সুরে এই গানটি এই গাঁয়ে এখন বহুল প্রচারিত ও জনপ্রিয়। তাদের মুখে মুখেই এর উৎপত্তি।
গ্রামে এসে মান্দা সেচা দেখলাম। মাছের চাষের জন্য কোনো কোনো নির্দিষ্ট এলাকা চিহ্নিত করা থাকে। বড় ডোবা ধরনের, প্রচুর ডালপালা থাকে। এই সময়টায় যখন পানি ধীরে ধীরে শুকাতে থাকে তখন উছা জাতীয় সরঞ্জাম দিয়ে পানি সেচা শুরু হয়।
২২.৩.৭৫
ইসলামে যদি থাকে- ব্যক্তি মালিকানা নয়, প্রয়োজন অনুযায়ী ভোগ দখলের অধিকার, লাঙল যার মাটি তার, জোতদারী জমিদারীতে কঠোর নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদি তাহলে বর্তমান ধর্ম প্রচারকরা ইসলামকে কতদূর কৃত্রিম করে ফেলেছে তা ভেবে দেখবার বিষয়। কিন্তু আমি কিছু কিছু বইপত্র পড়ে বুঝতে পারছি এরা ইসলামের এইসব সঠিক বাস্তব প্রগতিশীল অনুশাসনগুলিকে ব্যক্তি ও শ্রেণীস্বার্থে লুকিয়ে রাখছে। ইসলামের এসব বিধিবিধান কমিউনিজমের নিকটতম।
দেশে প্রচন্ড খরা। গ্রামে গ্রামে হাহাকার।
৫.৪.৭৫
বৃষ্টি হবার উপর সারা গাঁ তথা সারা দেশ নির্ভর করছে।…খরায় আম-জাম-লিচু গাছে বোল টিকছে না, আউশ বোনা যাচ্ছে না, ধানের দাম কমছে না, অসুখ কমছে না, কামলার চাহিদা তথা দর কমছে, মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। বৃষ্টি হলে এসবই ঠিক হবে। অনেক অভাবী পরিবার এখন কাঁচা আম খেয়ে ক্ষুধা মিটাচ্ছে।…স্বামী স্ত্রী প্রচুর গোলমাল গ্রামে। তালাক হচ্ছে প্রচুর, বিয়েও হচ্ছে প্রচুর। দুটো কারণ: (ক) দুবছর বিয়ে বন্ধ থাকবে বলে গুজব। (খ) নতুন বিয়ে করলেই পাত্রপক্ষ বেশ টাকা পাচ্ছে।
৯.৪.৭৫
সরিষাবাড়ী থেকে। এই থানা সদর ঠিক শহর নয় তবে কর্মব্যস্ত এলাকা। পাটক্রয়কেন্দ্র প্রায় পনেরোটি। এক বিরাট এলাকার মধ্যে এখানেই একটি জুটমিল আছে-আলহাজ জুট মিল-সরকার নিয়ন্ত্রিত। প্রায় একহাজার শ্রমিক এতে কাজ করছেন। অবশ্য শ্রমিক সংখ্যা বাড়ানোর সুযোগ আছে এখানে-মুশকিল হচ্ছে এটি প্রায়ই বন্ধ থাকে। কর্তৃপক্ষ সজাগ হলে এখানে আরও কিছু কর্মহীন মানুষের সাময়িক বেঁেচ থাকার সংস্থান হতো।…সরিষাবাড়ীতে কলেজ দুটি-দুটিতেই সহশিক্ষার ব্যবস্থা আছে।
১১.৪.৭৫
সন্ধ্যার পর বাইডেকে (বাড়ীর সামনে বড় খোলা জায়গা) বসেছিলাম। সাথে কজন কিশোর তরুণ কামলা।…(গান করেন এরকম) একজনকে গানের কথা বলতেই উত্তর দিল ‘গান আহে না গো’! আবার সমবায়ের প্রশ্ন তুললাম। ওরা কেউ জানে না সমবায় কী! যে বিষয় নিয়ে সারা দেশে আলোড়ন তা নিয়ে ওরা সম্পূর্ণ অজ্ঞ! বললাম ব্যাপারটা। ওরা বুঝতে চাইলো বলে মনে হলো না। শুধু বললো, ‘কাম কইর্যা খাওন দিলেই ওব’।
১৪.৪.৭৫
মধুপুর গড়। দৈর্ঘ্যে প্রায় ৫০ মাইল, প্রস্থে প্রায় ১০ মাইল অর্থাৎ প্রায় ৫০০ বর্গমাইল জুড়ে এ গড়। এর একপাশ গিয়ে ভাওয়াল গড়ের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।…প্রায় মাইল পনেরো এলাকার মধ্যে ঘুরে ফিরে যা দেখলাম তা অত্যন্ত দু:খজনক…এদিক থেকে প্রায় তিন চার মাইল পরিষ্কার হয়ে গেছে। বড় বড় গাছ কেটে বিক্রি করা হয়েছে, অন্যসব গাছপালা কেটে বসতি, আবাদী জমি তৈরী করা হয়েছে। এই কিছুদিন আগে পাহাড়ী এলাকা থেকে নয়শ পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে।…গাছগুলোর সংখ্যা এত অল্প যে একপাশে দাঁড়ালে গড়ের আরেক মাথা স্পষ্ট দেখা যায়। প্রাণীসম্পদ একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। সারা পথে মাত্র একটি বানর দেখেছি।…ধানচাষের জন্য গড়ের ভেতরেই বহু জায়গা নেয়া হয়েছে। ছোট ট্রাক্টর, গভীর নলকূপ ইত্যাদিও নেয়া হয়েছে।…
১৮.৪.৭৫
ভূমিহীনদের অনেকেই আবেদন করেছিলেন। সরকারের দেয়া আদেশ-খাসজমি ভূমিহীনদের মধ্যে বিতরণের পরিপ্রেক্ষিতে।…আদেশ দেয়া হয়েছিল প্রায় দু’বছর-আড়াই বছর আগে। এবং এখনও এখানে কেউই এ জমি পাননি। সবাই তহশীলদারের পরামর্শমতো মুরগী, ঢেঁকি, ঘর অবশিষ্ট সবকিছু বিক্রি করে তার হাতে টাকা দিয়েছে। তাদের অভিযোগ তহশীলদার তাদের কাছ থেকে টাকা নিংড়ে নিয়েছে, অন্যদিকে জমিওয়ালাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে খাসজমিতে তাদের দখল দিয়ে দিচ্ছে। এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতেই আজকে তহশীলদারের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলাম। কথা বলে স্পষ্ট বুঝতে পারলাম অভিযোগ সর্বাংশে সত্য।…যখন কথা বলছিলাম ঠিক তখনই এক স্বচ্ছল গেরস্থ এলেন। সাথে এক ছোট বালক-তার নাতি। তহশীলদার (নায়েব) উঠে গেলেন কি একটা কাজে। আমি গেরস্থকে জিজ্ঞাসা করলাম, কি ব্যাপার? তিনি বললেন তার কিছু খাস জমি আছে। তাই নাতির নামে পত্তনি করিয়ে নিতে এসেছেন। নায়েব বলেছেন-হবে। এজন্যে কিছু খরচাপাতিও করা হয়েছে।
২২.৪.৭৫
গ্রামে ছিঁচকে চুরি বেড়েছে। ভাতের অংশ, ভাতের পাতিল, ডিম, মুরগী, মাছ, লুঙ্গী, শাড়ী চুরি হচ্ছে। বেশি ধরা পড়ছে-পরিচিত। আশেপাশেরই কোনো বাড়ীর।
অন্ধকারে বসে আছে দুই ভাই- ক্ষেতমজুর। ওদের মা মারা গেছে কদিন আগে প্রায় বিনা চিকিৎসায়। শুনছি-এক ভাই নিজে নিজেই বলছে, ‘মা দুইডা জিনিস খাবার চাইছিল দিবার পাই নাই। একডু ভাত আর একটা মিষ্টি। আমারে কয়দিন কইছে-বাবা তুমার ভাতটা আইনো, আমি একটু খামু তুমি বেশিটুক খাইও। আমি নেই নাই। যেইদিন মরছে ঐদিনও কইছে। গাইল পাড়ছি, নেই নাই। এহন মনে অয় একটা দিনের সব ভাত তুইলা দিতে পারতাম। মায়ে জীবনে দুধ খায় নাই।…কি যে পাপ করছি একদিন মায়েরে হপনেও দেহি না।’
২৬.৪.৭৫
মা ছেলের ঝগড়া শুনছি। মা ছেলেকে বলছেন- ‘তুই আমারে ভাত দিবি না ক্যান? তর বাপে কি এই জন্য তোরে জমি দিছে?’ পুত্র ততোধিক ক্রুদ্ধ: ‘এইডা তুমার বাপের সম্পত্তি’?
৩০.৬.৭৫
বাংলাদেশে পাঁচ লাখ একরের বেশী খাসজমি আছে। এর মধ্যে সোয়া লাখ একর জমি- স্বল্পজমি চাষী এবং ভূমিহীনদের মধ্যে বন্দোবস্ত দেয়া হয়েছে বলে প্রকাশ। দেড় লাখ একর জমি মালিকদের ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে।…এখন আবার ভাবা হচ্ছে যেহেতু বন্টনকৃত জমি ভূমিহীন হালচাষের অভাবে ব্যবহার করতে পারছে না (বা এ সম্পর্কে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি) সেহেতু এগুলো ভেবেচিন্তে অন্যভাবে বিলি করা হবে। আর এক চাষী পরিবারের জন্য এক দেড় একর যথেষ্ট নয় বলে পাঁচ একর করে জমি দেয়া হবে। তবে এর অর্ধেক মূল্য (প্রায় কমপক্ষেও দশ হাজার) সাথে সাথে পরিশোধ করতে হবে বাকিটা কিস্তিতে শোধ করতে হবে, যা নাকি ধনী কৃষকদের পক্ষেই সম্ভব… আরও বলা হয়েছে যারা কৃষি সমবায়ে অংশ নেবেন এবং যান্ত্রিক চাষাবাদের নিশ্চয়তা দেবেন তাদেরকে একশ একর পর্যন্ত জমি (প্রায় তিনশ বিঘা) বন্দোবস্ত দেয়া হবে। উল্লেখ্য জমির সর্বোচ্চ সিলিং ১০০ বিঘা। অর্থাৎ অবস্থা এমন দাঁড়াচ্ছে যে, এক মুষ্টিমেয় শ্রেণীর হাতে অধিকাংশ জমি। বাকী সবাই শ্রমিক। পুঁজিবাদী সমবায়ের অধীনে উৎপাদন ব্যবস্থা…যা জাপানী পদ্ধতি স্মরণ করিয়ে দেয়। এদিকে শিল্পও ব্যক্তি মালিকানায় ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে।…‘সমাজতন্ত্রের’ কথা বলা কি শুধু বৈদেশিক সমাজতান্ত্রিক শক্তি থেকে সমর্থন আদায় এবং অভ্যন্তরীণ প্রবল সমাজতন্ত্রমুখী আন্দোলন ঠেকাবার জন্য?
বাকশাল: গঠন প্রকৃতি এবং আকাঙ্খা
আগেই বলেছি, ১৯৭৫ এর ২৫শে জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর ধারাবাহিকতায় দেশের সকল দল নিষিদ্ধ করে প্রতিষ্ঠা করা হয় একদলীয় শাসন। দলের নাম দেয়া হয়-‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’, সংক্ষেপে বাকশাল। দেশকে ৬১ ভাগে ভাগ করে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা, সংসদ সদস্য, আমলা, সেনা কর্মকর্তাদের এসব জেলার গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।
বাকশাল গঠনতন্ত্রে দলের চেয়ারম্যানকেই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী করা হয়। একজন সাধারণ সম্পাদক সহ ১৫ জন সদস্য বিশিষ্ট কার্যনির্বাহী কমিটি-তা চেয়ারম্যানই মনোনীত করবেন। কেন্দ্রীয় কমিটির এক তৃতীয়াংশ চেয়ারম্যান কর্তৃক মনোনীত হবেন। দলীয় কাউন্সিলে চেয়ারম্যান ৫০ জন পর্যন্ত মনোনয়ন করতে পারবেন। বিভিন্ন সরকারি বা আধাসরকারি দফতর বা প্রতিষ্ঠান, কর্পোরেশন, স্বায়ত্বশাসিত সংস্থা এবং সামরিক ও বেসামরিক বাহিনীসমূহের প্রতিনিধি নির্বাচনের ব্যাপারে দলের চেয়ারম্যানের ইচ্ছাই নির্ধারক। চেয়ারম্যান ইচ্ছা করলে গঠনতন্ত্রের যে কোন ধারা পরিবর্তন, সংশোধন ও পরিবর্ধন করতে পারবেন এবং একমাত্র চেয়ারম্যানই গঠনতন্ত্রের ব্যাখ্যা দান করতে পারবেন বলে তখন জানানো হয়েছে।
এখানে বলা দরকার যে, বাকশালের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শেখ মুজিব জনপ্রিয়তায় আগের সব রেকর্ড অতিক্রম করেন ১৯৭১ সালের শুরুতেই। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা প্রায় আকাশ ছুঁয়ে ফেলে। মনে আছে, মুক্তিযুদ্ধের পরে তিনি যখন দেশে ফিরে আসেন তখন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী প্রায় সকল দলের মধ্যে থেকেই তাঁর নেতৃত্বেই একটি সম্মিলিত বা জাতীয় সরকারের প্রস্তাব উঠেছিল। সেসময় যদি তাঁর নেতৃত্বে বাকশালের মতো কোনো দল গঠিত হতো, আমার ধারণা তার গ্রহণযোগ্যতা থাকতো অনেক বেশি। কিন্তু তিনি বরাবর আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবেই ভূমিকা পালন করেছেন। সারাদেশে বহুরকম জটিলতা, অনাস্থা, অবিশ্বাস, বিভেদ এবং সহিংসতার পর একক দল প্রতিষ্ঠা তাই গ্রহণযোগ্যতার চাইতে বরং ভয় এবং ক্ষোভের জন্ম দিয়েছিল। দলের মধ্যেও যে তিনি সমর্থন হারিয়েছিলেন তা স্পষ্ট হয় তাঁকে সেনাবাহিনীর কতিপয় ব্যক্তি হত্যা করার পর যে সরকার গঠিত হয় তা তাঁর দলের লোকজনেই ভরা ছিল।
এটা ঠিকই যে, শেখ মুজিব সমাজতন্ত্র সম্পর্কে আগ্রহবোধ করতেন, উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন, ১৯৫২ সালেই চীনে সফরকালে সেখানকার ব্যবস্থা দেখে পাকিস্তান কবে এমন হবে সে নিয়ে আক্ষেপও করেছেন। চীন বিপ্লবের তিন বছর পর সেখানে গিয়ে যে পরিবর্তন দেখেছেন তাতে তিনি উচ্ছ্বসিত ছিলেন। (রহমান, ২০২০) বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর যে তিনি ‘তিন বছর সময়’ চেয়েছিলেন আমার ধারণা এর পেছনে সেই অভিজ্ঞতা কাজ করে থাকতে পারে। কিন্তু এই দেশে তার পার্টি তো মৌলিকভাবেই ভিন্ন।
অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি নিজেই জানিয়েছেন, দেশে তাঁর সময়ের বিপ্লবী রাজনীতির সঙ্গীদের বিষয়ে তিনি বিশেষ আস্থাশীল ছিলেন না। অনেক ক্ষেত্রে বিরক্ত ছিলেন, ব্যঙ্গ বিদ্রুপও করেছেন। (রহমান, ২০১২) অবশ্য বামপন্থীরা মুজিবের রাজনৈতিক উত্থানে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড়ায়নি। মস্কোপন্থী অংশ শেখ মুজিবের সাথে ঐক্যবদ্ধ রাজনীতির ব্যাপারে ৬০ দশক থেকেই আগ্রহী ছিল, আর পিকিংপন্থী অংশের সাথে রাজনৈতিক ঐক্য না থাকলেও ব্যক্তিগত যোগাযোগ ভাল ছিলো। মওলানা ভাসানী ৬০ দশকের শেষে শেখ মুজিবের মুক্তিকে তাঁর ঐতিহাসিক আন্দোলনের অন্যতম লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচনে ভাসানীর অংশগ্রহণ না করা শেখ মুজিবকে একক সুযোগ দেয়ার জন্যই করা হয়েছিল এরকম ধারণা অনেকেই করেন, এর পক্ষে যথেষ্ট যুক্তিও আছে।
বাকশাল প্রতিষ্ঠার কারণ ও কর্মসূচি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে শেখ মুজিব ২৫শে জানুয়ারি থেকে ২১শে জুলাই পর্যন্ত সংসদে ও বাইরে বিভিন্ন সভায় দীর্ঘ বক্তব্য রেখেছেন। এগুলো থেকে তাঁর আকাক্সক্ষা ও পরিকল্পনার কথা জানা যায়। তিনি দেশীয় ধরনে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংকল্প ঘোষণা করেছেন, একে বাস্তবায়ন করতে আমলাতন্ত্র সংস্কারের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন, জমির মালিকানা বহাল রেখে প্রথমে দেশের সকল অঞ্চলে সমবায় গঠনের কথা বলেছেন, পরে তা মডেল এলাকায় স্থাপনের কথা বলেছেন। জমির ফসল এক ভাগ কৃষক, এক ভাগ সমবায়, এক ভাগ সরকার এই তিন ভাগে ভাগ করার কথা বলেছেন আদি প্রস্তাবে। পরে এর মধ্যে নানা পরিবর্তনের কথা বলা হচ্ছিলো। শিক্ষা চিকিৎসা ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস, বেতন কাঠামোর বৈষম্য হ্রাস, প্রশাসনিক ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস, এলিট চর্চার অবসানের কথাও বলেছেন।
কিন্তু দেশ আসলে কীভাবে অগ্রসর হতো, সমাজতন্ত্রের দিকে যাবার মতো প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো, সংগঠন ও নেতাকর্মীদের অবস্থান ছিল কি না, তাদের শ্রেণীগত ভিত্তি কী ভূমিকা পালন করতো, আদতে সমাজতন্ত্র হতো না এক ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা দিয়ে পুরো ব্যবস্থা নব্য-সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় রূপ নিতো তা নিশ্চয়ই প্রশ্নে রাখতে হবে। কারণ জবাবদিহি নাই, একক ব্যক্তির নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব; দলে, সমাজে কোথাও প্রশ্ন তোলার অবকাশ নাই; একমাত্র ভক্তি আর আনুগত্যই অনুমোদিত। এগুলো দিয়ে সমাজতন্ত্র?
রাষ্ট্র, শ্রেণী নিয়ে জ্ঞানচর্চা আছে এরকম ব্যক্তিরা যখন সমাজের বিপ্লবী রূপান্তরের মতো কঠিন কাজেও শ্রেণীশক্তি, সংগঠন, রাষ্ট্রীয় প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোসহ আর সবকিছুর উপরে একক ক্ষমতাধর শাসক ব্যক্তির আকাঙ্খাকে একমাত্র নির্ধারক মনে করে ইতিহাস ব্যাখ্যা করেন তখন বিস্মিত হতে হয়। সমাজের মধ্যে যেসব ব্যক্তি ক্ষমতাধর তারাই তো গভর্নরসহ নতুন ক্ষমতার কেন্দ্রে বসেছিলেন, গভর্নর করা হয়েছিল সংসদ সদস্য, সরকারি কর্মকর্তা, সেনাবাহিনীর মধ্য থেকে। সবার পার্টি সদস্য হওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। তাদের আগের ভূমিকার পরিপ্রেক্ষিতে ভিন্ন ফলাফল হবার সম্ভাবনা দেখা কষ্টকল্পনা ছাড়া আর কী হতে পারে?
রাষ্ট্র, শ্রেণী নিয়ে জ্ঞানচর্চা আছে এরকম ব্যক্তিরা যখন সমাজের বিপ্লবী রূপান্তরের মতো কঠিন কাজেও শ্রেণীশক্তি, সংগঠন, রাষ্ট্রীয় প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোসহ আর সবকিছুর উপরে একক ক্ষমতাধর শাসক ব্যক্তির আকাঙ্খাকে একমাত্র নির্ধারক মনে করে ইতিহাস ব্যাখ্যা করেন তখন বিস্মিত হতে হয়।
যাইহোক, বাকশাল প্রতিষ্ঠার পর বিভিন্ন বক্তব্যে এর পরিপ্রেক্ষিতে কাঠামো, লক্ষ্য সম্পর্কে শেখ মুজিব যে সব বক্তব্য উপস্থিত করেছিলেন তার মধ্যে কয়েকটি এখানে উদ্ধৃত করা হল। (সরকার, ২০০১) এখান থেকে তৎকালীন পরিস্থিতি, সিদ্ধান্ত, ক্ষোভ ও ভবিষ্যতের আকাক্সক্ষাসহ তাঁর অবস্থান ধারণা করা যায়।
২৬শে মার্চ, ১৯৭৫। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান
‘দুঃখের বিষয়, তারা রাতের অন্ধকারে পাঁচ জন পার্লামেন্ট সদস্যকে হত্যা করেছে, তিন-চার হাজারের মতো কর্মীকে হত্যা করেছে। আরেক দল দুর্নীতিবাজ টাকা-টাকা, পয়সা-পয়সা করে পাগল হয়ে গেছে।’ (পৃ:৩৮৮)
‘হ্যাঁ, প্রেসিডেনসিয়াল ফর্ম অব গভর্নমেন্ট করেছি। জনগণ প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করবেন। পার্লামেন্ট থাকবে। পার্লামেন্টের নির্বাচনে একজন-দুইজন-তিনজনকে নমিনেশন দেয়া হবে। জনগণ বাছবে কে ভালো, কে মন্দ।’ (পৃ:৩৮৮)
‘এত চোরের চোর, এই চোর যে কোথায় পয়দা হয়েছে তা জানি না।’ (পৃ:৩৯০)
চারটি প্রধান কাজ। ‘এক নম্বর হলো- দুর্নীতিবাজ খতম করো, দুই নম্বর হলো- কারখানায় ক্ষেতে-খামারে প্রোডাকশন বাড়ান, তিন নম্বর হলো- পপুলেশন প্ল্যানিং, চার নম্বর হলো- জাতীয় ঐক্য।’…
‘এ বাংলাদেশের ৬৫ হাজার গ্রামে কো-অপারেটিভ হবে। প্রত্যেকটি গ্রামে গ্রামে এই কো-অপারেটিভে জমির মালিকের জমি থাকবে। যে মানুষ কাজ করতে পারে তাকে কো-অপারেটিভের সদস্য হতে হবে। … আপনাদের জমির ফসল আপনি নিবেন, অংশ যাবে কো-অপারেটিভের হাতে, অংশ যাবে গভর্মেন্টের হাতে।’(পৃ:৩৯০)
বাকশাল কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম বৈঠক, এপ্রিল ১৯৭৫
‘পাকিস্তানের সাথে বন্ধুত্ব করার জন্য আমরা চেষ্টা করেছি। আমরা এতো রক্ত দিয়েছি, এতো আমরা আঘাত পেয়েছি, এতো আমাদের ইনটেকচুয়ালকে হত্যা করা হয়েছে, মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আমাদের রাস্তাঘাট ধ্বংস করা হয়েছে, তবুও আমরা বলেছি, আমরা সকলের সাথে বন্ধুত্ব চাই। ১৯৫ জন, যারা কমিটেড ক্রাইম অ্যাগেনইষ্ট হিউম্যানিটি, তাদের পর্যন্ত আমরা মাফ করে দিলাম। … কিন্তু দুঃখের বিষয় তারা এগোচ্ছে না। … কারো সঙ্গে দুশমনি নাই। চায়না রিকগনিশন দিলো না। কিন্তু আমরা চায়নার সাথে বন্ধুত্ব চাই। তারা একটা বিগ কান্ট্রি। আমরা এখনো বন্ধুত্ব চাই। আমার সাথে বন্ধুত্ব আছে রাশিয়ার, আমার বন্ধুত্ব আছে ভারতবর্ষের সাথে, আমার বন্ধুত্ব আমেরিকার সাথে। এ বন্ধুত্ব সকলের সাথে চাই। আমরা কারো সাথে গোলমাল করতে চাই না। কারণ, আমি আমার দেশকে গড়তে চাই।’ (পৃ: ৩৯৯)
জাতীয় ঐক্য প্রসঙ্গে, ‘স্বাধীনতার সাথে যারা বিশ্বাসঘাতকতা করলো, বেঈমানি করলো, রাজাকার হলো, তাদেরও আমরা ক্ষমা করে দিলাম। অন্যদেশে বিপ্লবের পরে এভাবে ক্ষমা করে নাই। একেবারে নির্মূল করে দিয়েছে। … কিন্তু চোরা না শুনে ধর্মের কাহিনী।’ (পৃ: ৪০১)
‘আমি অ্যাডভেঞ্চারিষ্ট নই। আমি খোদাকে হাজের নাজের জেনে কাজ করি। চুপিচুপি, আস্তে আস্তে মুভ করি। সবকিছু নিয়ে। সেজন্য আমি বলে দিয়েছি ৬০টা থেকে ৭৫ কি ১০০টা কো-অপারেটিভ করবো। এই কো-অপারেটিভে যদি দরকার হয়, সেন্ট্রাল কমিটির এক-একজন মেম্বার এক-একটা চার্জে থাকবেন।’ (পৃ: ৪০৪)
‘ফান্ডামেন্টালি আমরা একটা শোষণহীন সমাজ গড়তে চাই, আমরা একটা সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি করতে চাই। বাট দ্যা সিস্টেম ইজ আওয়ারস। উই ডু নট লাইক টু ইমপোর্ট ইট ফ্রম এনিহোয়ার ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড। এইটা আমার মত, পার্টির মত।’ (পৃ: ৪০৬)
‘স্বাধীনতার সাথে যারা বিশ্বাসঘাতকতা করলো, বেঈমানি করলো, রাজাকার হলো, তাদেরও আমরা ক্ষমা করে দিলাম। অন্যদেশে বিপ্লবের পরে এভাবে ক্ষমা করে নাই। একেবারে নির্মূল করে দিয়েছে। … কিন্তু চোরা না শুনে ধর্মের কাহিনী।’
নবনিযুক্ত জেলা গভর্নরদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচী, ২১শে জুলাই ১৯৭৫
‘আজকে যে সিস্টেমটা করা হয়েছে, সেটা নতুন। পার্লামেন্টের মেম্বাররা বা সংসদ সদস্যরা লোকালি শাসন পরিচালনা করেন, এমন নজির দুনিয়ার ইতিহাসে নাই। এই পদ্ধতিতে এপয়েন্টেড গভর্নর, এপয়েন্টেড ম্যাজিস্ট্রেট আছেন। এমন অনেক কিছুই আমরা এখানে দিয়েছি যা অন্য কোথাও নাই এটা একটা নতুন এক্সপেরিমেন্ট।’(পৃ: ৪১০)
‘চারটে যদি মডেল করি, ডিস্ট্রিক্টে যদি আমরা সাকসেসফুল হই, সেখানে যদি মানুষের ওপর অত্যাচার না হয়, অবিচার না হয়, ঘুষ-দুর্নীতি যদি বন্ধ করতে পারেন, জনগণকে যদি মবিলাইজ করতে পারেন, তাহলে আমাদের কাজের সুবিধা হবে।’ (পৃ: ৪১৩)
মডেল গ্রাম নির্ধারণ করে সমবায় গঠন করার কথা বলা হয়েছে, এগুলো করা হবে শহরের কাছে যেখানে বিদ্যুৎ দেয়া সহজ হবে। শিক্ষা ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে।
‘পার্টির সদস্য ছাড়া অন্য কেউ গভর্নর হতে পারবেন না…সরকারি কর্মচারি ভাইদের গভর্নর করেছি, তাঁদের বেলায়ও এমনি করতে হয়েছে।…আপনারা এখন থেকে আর সরকারি কর্মচারি নন, পলিটিক্যাল পার্টি, ওয়ার্কার-রিমেমবার ইট-বাকশালের সদস্য। যেমন আমাদের পার্লামেন্টের মেম্বাররা বাকশালের সদস্য, তেমনি সরকারি কর্মচারীরাও বাকশালের সদস্য। এবং সদস্য হিসেবে তাঁদের সেই পজিশনে সেখানে যেতে হবে এবং সেখানে কাজ করতে হবে।…আর্মি থেকেও একজনকে দিয়েছি। তাঁকেও মেম্বারশীপ দিয়ে খুলনায় গভর্নর করেছি।’(পৃ: ৪১৪)
গভর্নররা ‘যিনি যেখানে থাকবেন, সেখানকার পুলিশ তার আন্ডারে থাকবে। যে রক্ষীবাহিনী সেখানে থাকবে, তা তাঁর আন্ডারে থাকবে। এমনকি, যে আর্মি সেখানে পোস্টিং আছে, সেই আর্মিও তার আন্ডারে থাকবে ঐ মুহূর্তে ঐ জায়গায়। অফকোর্স, তাদের নিজ নিজ কমান্ড আছে। কিন্তু আপনারা যা বলবেন, তা তাদের শুনতে হবে। আপনাদের কর্তব্য আছে অনেক। করাপশন বন্ধ করুন, আল্লাহর দোহাই করাপশন বন্ধ করার চেষ্টা করুন।’ (পৃ: ৪১৯)
বাকশাল গঠনের দিন থেকে প্রকাশ্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে লেনিনবাদী কমিউনিষ্ট পার্টি, ন্যাপ ভাসানীও যথারীতি নিষিদ্ধ হয়ে যায়। তবে তাদের নেতৃবৃন্দের অনেকেই বাকশালে যোগ দেন। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও ন্যাপ (মোজাফফর) নিজেদের বিলুপ্ত করে বাকশালে যোগদান করে। একদলীয় শাসনের জন্য সংবিধান সংশোধন না মানায় ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে জয়ী সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন এবং জেনারেল এমএজি ওসমানী পদত্যাগ করেন। একদলীয় শাসনব্যবস্থা জারির প্রতিবাদে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য আবদুল্লাহ সরকার সংসদ অধিবেশন ত্যাগ করেন। তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি হয় এবং সংসদীয় আসন শূন্য ঘোষণা করা হয়। এর কিছুদিন আগে আবদুল্লাহ সরকার জাসদে যোগদান করেন। এটা খুব তাৎপর্যপূর্ণ যে, মুক্তিযুদ্ধের মাঠে প্রধান দুজন ব্যক্তি তাজউদ্দীন ও ওসমানী নবগঠিত বাকশালে ছিলেন না। তাজউদ্দীন আহমদকে আগেই দূরে ঠেলে দেয়া হয়েছিল।
এটা খুব তাৎপর্যপূর্ণ যে, মুক্তিযুদ্ধের মাঠে প্রধান দুজন ব্যক্তি তাজউদ্দীন ও ওসমানী নবগঠিত বাকশালে ছিলেন না। তাজউদ্দীন আহমদকে আগেই দূরে ঠেলে দেয়া হয়েছিল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাংবাদিকসহ সকল পেশার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা দলে দলে বাকশালে যোগ দিতে থাকেন। তবে প্রবল চাপ থাকা সত্ত্বেও কবি সুফিয়া কামাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আহমদ শরীফসহ হাতে গোনা ব্যক্তিরা বাকশালে যোগ দেয়া থেকে বিরত থাকেন। বাকশালে যোগদান না করা তখন ভয়াবহ ঝুঁকির ব্যাপার। বাকশালে যারা যোগ দেননি তাদেরও অনেকে শেখ মুজিবের অনুরাগী-অনুসারী ছিলেন। দৈনিক বাংলা ভবনে যে কয়জন এই সাহসটুকু দেখালেন তাদের মধ্যে ছিলেন শামসুর রাহমান এবং শাহাদৎ চৌধুরী। এছাড়া সাপ্তাহিক হলিডে সম্পাদক এনায়েতুল্লাহ খান, মর্নিং নিউজ সম্পাদক এবিএম মুসা, বিএফইউজে সভাপতি নির্মল সেন এবং ডিইউজে সভাপতি কামাল লোহানী, দৈনিক পূর্বদেশের আবু জাফর শামসুদ্দীন বাকশালে যোগ দেননি। বিচিত্রায় বসে শুনেছি বাকশাল যোগদান নিয়ে আয়োজিত এক সভায় শামসুর রাহমান প্যান্টের খালি পকেট দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘আমাদের আর কী আছে? আছে শুধু আত্মসম্মান। এটাও দিয়ে দেব?’
বিচিত্রায় বসে শুনেছি বাকশাল যোগদান নিয়ে আয়োজিত এক সভায় শামসুর রাহমান প্যান্টের খালি পকেট দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘আমাদের আর কী আছে? আছে শুধু আত্মসম্মান। এটাও দিয়ে দেব?’
আগেই বলেছি, সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন চারটি পত্রিকা বাদ দিয়ে সব পত্রিকা তখন বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। দৈনিক বাংলা চালু থাকলো, দৈনিক বাংলা ট্রাস্টের পত্রিকা হিসেবে বিচিত্রাও চালু থাকলো। কিন্তু তার কথাবলার শক্তি সীমিত হয়ে গেলো। একটা সংখ্যা হলো ‘শেখ মুজিব দ্বিতীয় বিপ্লব’ প্রচ্ছদ কাহিনী নিয়ে। শাহাদৎ ভাই নানা সামাজিক বিষয়ে মনোযোগ দিলেন। আমার হাতে দিলেন বিদেশি বিভিন্ন পত্রিকা, ভাবানুবাদের নানা কাজ। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি ছিল সিআইএ সংক্রান্ত। মনে আছে ১৯৭৫ সালের ১৪ আগষ্ট গভীর রাত পর্যন্ত আমি সিআইএ নিয়ে বেশ কয়েকটি লেখা পড়ে তার ভিত্তিতে লিখছিলাম। পরদিন সকালে শেখ মুজিব হত্যার কথা শুনে আগের রাতের নাড়াচাড়া করা আর লেখার কথাই মনে পড়লো বেশি।
১৫ই আগষ্ট ও তারপর: ডায়েরীর কথা
আমার ডায়েরীতে এই সময়ের ঘটনাবলীতে আমার সেই বয়সের জানা খবরাখবর, উদ্বেগ, পর্যবেক্ষণ ও ক্ষোভের কিছু নমুনা পাওয়া যায়।
১৫.৮.৭৫
..ভয়ংকর এক দু:স্বপ্নের মত যাচ্ছে দিনটা। সকালে উঠে প্রথমে হতভম্ব, পরে স্তব্ধ এবং শোকার্ত হলাম যখন শুনলাম শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে।…বিপুল জনপ্রিয় শেখ মুজিব যখন মারা গেলেন তখন নিয়ে গেলেন একরাশ গ্লানি।…বলা হয়েছে খোন্দকার মুশতাক আহমদের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থান। এখন দেখছি নিজের কোলে বিশ্বাসঘাতক বসা ছিল শেখ মুজিবের। যারা সামনে তোষামোদ করে তারা পেছনে ছোরা মারতে ওস্তাদ। এতদিন শেখ মুজিব বোঝেননি। প্রচুর বিভ্রান্তিতে ভুগেছেন তিনি তোষামোদীর তাড়নায়।…মৃত্যুর সময় তিনি দেখলেন তিনি একা, নিঃসঙ্গ। নিঃসঙ্গ, ট্র্যাজেডীর মহানায়ক।
১৬.৮.৭৫
পুতুল বিশ্বাসঘাতক সরকার গঠিত হয়েছে।…প্রতিক্রিয়াশীল দেশী-বিদেশী শক্তি উৎফুল্ল। লক্ষ মানুষ চাপা বেদনায় অস্থির। বাইরে পুরো দেশটা চুপচাপ, প্রাণহীন।…বাংলাদেশ এখনও স্বাধীন থাকবার যোগ্য হলো না। এমন নৃশংস ঘটনা আর কোথাও ঘটেছে কিনা জানিনা।
১৯.৮.৭৫
দুপুরবেলা বাংলাদেশ বেতারের (শুক্রবারের পর থেকে রেডিও বাংলাদেশ বলা হচ্ছে!) বাণিজ্যিক অনুষ্ঠানে পাঁচ-সাতটি বিজাতীয় গান শোনা গেল- উর্দু আর হিন্দী ছবির ‘প্রাণমাতানো’ গান। এটা কি উপনিবেশ লাইনে প্রবেশের প্রস্তুতি…ইসলাম বিক্রি করে ফায়দা লোটার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বর্তমান সরকারে স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে। বিদেশ-বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোর বেশ কয়েকটি নয়া বাংলাদেশ সরকারের জুড়ে বসার সাথে নিজেদের স্বার্থের সামঞ্জস্য খুঁজে পেয়ে সন্তুষ্টি পেতে চাইছে।
২১.৮.৭৫
মুশতাক আহমদ যতটা ব্যক্তিত্বহীন-নিষ্প্রাণ-বিশ্বাসঘাতক হিসেবে স্পষ্ট হচ্ছে শেখ মুজিব ততই স্পষ্টতর উজ্জল হয়ে উঠছেন।…‘ভারত আমাদের সবচেয়ে বড় বন্ধু, ইন্দিরা গান্ধী মাতৃতুল্য’ ইত্যাদি ন্যাকামী শুরু করে মুশতাক জাতিকে খেলো করা শুরু করেছে। বোঝা যাচ্ছে এখন আদর্শগত কোন বিরোধই নেই। এটা পুরো ষড়যন্ত্র-প্রাসাদ চক্রান্ত।
১.৯.৭৫
লেখক সাংবাদিকদের তীব্র অশ্রদ্ধা করতে শুরু করেছি-শুরু করেছি ঠিক নয়, এসে যাচ্ছে। আগে ভাবতাম বিপদে পড়ে কিংবা অবস্থার খাতিরে বাধ্য হয়ে বোধ করি তারা এতটা আত্মসমর্পণ করছে, এতটা নিজেকে বিক্রি করছে। এখন দেখছি তা সত্য নয়, এদের চরিত্রই এরকম।…শেখ মুজিব বেঁচে থাকতে তিনি যা কিছুই সিদ্ধান্ত নিতেন, বলতেন, বলতে চাইতেন তাই নিয়ে খবর, সম্পাদকীয় লেখা হতো, বড় বড় নিবন্ধ ছাপা হতো। তোষামোদী তো ছিলই, ব্যাখ্যা-কোটেশন। একবারের জায়গায় শতবার শেখ মুজিবের নাম টেনে আনা এসব কিছুই ছিল তাদের কর্ম। মনে হত শেখ মুজিবের সবকিছুই সর্বোত্তম, এমনকি হাঁচি পর্যন্ত। তিনি যখন জাতীয় দল করলেন, প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকার করলেন তখন সহস্র কন্ঠে এরাই প্রশংসা করলেন- দল বেঁধে গিয়ে বাকশালের সদস্য হলেন।…অথচ এই তারাই এখন বলছেন গণতন্ত্র হত্যা করা হয়েছিল, শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছিল।…ক্ষমতা না থাকলে চুপ করে থাকা উচিত। কিন্তু একই গলায় দুইরকম কথা…।
তিনি যখন জাতীয় দল করলেন, প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকার করলেন তখন সহস্র কন্ঠে এরাই প্রশংসা করলেন- দল বেঁধে গিয়ে বাকশালের সদস্য হলেন।…অথচ এই তারাই এখন বলছেন গণতন্ত্র হত্যা করা হয়েছিল, শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছিল।…ক্ষমতা না থাকলে চুপ করে থাকা উচিত। কিন্তু একই গলায় দুইরকম কথা…।
২২.১০.৭৫
পরশু, কাল এবং আজকে পরপর এই তিনদিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উত্তেজনা চলছে। পরশুদিন আকস্মিকভাবেই এক (প্রায় শতাধিক জনের) ছাত্র মিছিল বের হয়, সম্ভবত সশস্ত্র! এদের শ্লোগান ছিল: ‘শেখ মুজিব জিন্দাবাদ’, ‘মুশতাককে উৎখাত কর’…‘জয় বাংলা’, ‘রক্ত বৃথা যেতে দিব না’… ইত্যাদি। উল্টো একটা মিছিল হতে যাচ্ছিল কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়েছে। আজ তাদের একজন আবার মুজিব সমর্থকদের হাতে প্রহৃত হয়েছে। মিছিল এবং শৃঙ্খলা দেখে মনে হচ্ছে পেছনে খুব সম্ভবত ছাত্র ইউনিয়ন নেতৃত্ব দিচ্ছে। অন্যদিকে কাদের সিদ্দিকী টাঙ্গাইলে ক্রমশঃ শক্তিবৃদ্ধি করছেন। তার এলাকায় মিলিটারীরা এখনও ঢুকতে পারেনি। জাসদ মুশতাক সরকার উৎখাতের কথা বলছে, আন্ডারগ্রাউন্ড তৎপরতাও চালাচ্ছে। এদিকে বর্তমান প্রশাসন গণতন্ত্রের নাম করে ভাঁওতা দেবার চেষ্টা করছে, অন্যদিকে সকল গণবিরোধী আইন চালু রাখছে এবং প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের মুক্তি দিচ্ছে না- বরঞ্চ সমানে ধরপাকড় চলছে।
৩.১১.৭৫
আমি আগে ঠিক খেয়াল করিনি- বেশ সকালেই একটা মিগ বারবার আকাশে চক্কর দিয়েছে এবং বঙ্গভবন ও বাংলাদেশ বেতারের ওপর ডাইভও দিয়েছে। সামরিক হেলিকপ্টারও দেখা গেছে। ঢাকা ও দেশের অন্যান্য সব বেতার সকাল থেকেই সম্পূর্ণ বন্ধ। ট্যাঙ্ক নেমেছে রাস্তায়। শহরে সেনাবাহিনীর জোর তৎপরতা চলছে, ভারী অস্ত্রসহ। ভীতি এবং উদ্বেগ জনমনে সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এখনও, রাত এগারোটা পর্যন্তও এসবের সঠিক কারণ কিংবা পরিণতির খবর পাওয়া যায়নি।…কিছুক্ষণ আগে থেকে অবশ্য বেতার অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে কিন্তু তাতে এসবকিছুই এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। গান টান হচ্ছে, সংবাদে শুধু দেয়া হচ্ছে বিদেশী সংবাদ। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা কাল শেখ মুজিব স্মরণে শোক দিবস পালনের ঘোষণা দিয়েছে।
৪.১১.৭৫
এখনও কোনো নিশ্চিত কিছু জানা যায়নি। বেতার, টেলিভিশন এবং সংবাদপত্র এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ নীরব। যদ্দুর জানা গেছে সমস্ত নিয়ন্ত্রণভার এখন খালেদ মোশাররফের হাতে, খুব সম্ভবত জিয়াউর রহমানের সাথে আপোষের কথাবার্তা চলছে। ডালিম গ্রুপের সাতজন মেজর ক্যাপ্টেন যারা এতদিন বঙ্গভবনে সঙ্গোপনে স্বনির্বাসিত ছিল জীবন রক্ষার তাগিদে তাদেরকে সপরিবারে দেশ থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। মুশতাক ক্যান্টনমেন্টে। খুব সম্ভবত এ অভ্যুত্থান শেখ মুজিবের পক্ষে। সকালে পূর্বঘোষিত ও প্রচারিত শোক মিছিল বিস্ময়করভাবে সুসম্পন্ন হয়েছে, শেখ মুজিবের স্মরণে। মিছিলটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু হয়েছে, শেষ হয়েছে শেখ মুজিবের বাসায়। প্রায় পাঁচ হাজার জনের এ মৌন মিছিলে সামনে পিছনে পুলিশ দল ছিল, অনেকটা প্রটেকশন দেয়ার মতো। মিছিলে শেখ মুজিবের বহুসংখ্যক বৃহদাকৃতি ছবি ছিল। দুদিন ধরে বিমানবন্দর বন্ধ, বহির্বিশে^র সাথে টেলিযোগাযোগ বন্ধ- তথা বাংলাদেশ বহির্বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন।
৫.১১.৭৫
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক চারজন বিশিষ্ট নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী, কামারুজ্জামান এবং তাজউদ্দীন আহমদকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। হত্যাকান্ডের পর ডালিম গ্রুপ সংশ্লিষ্ট পরিবারসহ ৪৫ জনের দল বিশেষ প্লেনে ব্যাংকক পালিয়েছে। এসবই হয়েছে মুশতাকের সক্রিয় ইঙ্গিতে। এবং এসব কিছু সংঘটিত হয়েছে রোববার রাতে, সোমবার সকালে।…খালেদ মোশাররফ এখন চীফ অব আর্মি স্টাফ, জিয়া পদত্যাগ করেছেন। মুশতাকের খোঁজ নেই… তাহের ঠাকুর, শাহ মোয়াজ্জেম প্রেফতার।…আজকের সব কাগজে শেখ মুজিব স্মরণে গতকালের মৌন মিছিলের ছবি এবং সংবাদ গেছে। শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে।
৬.১১.৭৫
কাল গভীর রাতে নতুন প্রেসিডেন্টের নাম ঘোষণা করা হয়েছে, বাংলাদেশের নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে আজ শপথ নিলেন সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি আবু সাদত মুহাম্মদ সায়েম।…আজ রাত সোয়া ৯টায় সায়েম বক্তৃতা দিলেন। জাতীয় সংসদ বাতিল করা হয়েছে। জোটনিরপেক্ষতা, চুক্তি মান্য ইত্যাদি নীতি বলবত আছে। নির্বাচন দেয়া হবে। শেখ মুজিব সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি, দাবী উঠেছে অবশ্য।
৭.১১.৭৫
পটের আবারো পরিবর্তন হয়েছে। ঢাকা ও ময়নামতী থেকে মূলত সিপাহীরা বিদ্রোহ করেছে। ফলত মেজর জেনারেল জিয়া সম্পূর্ণ ক্ষমতায় এসেছেন, তিনি বেতারে নিজেকে প্রধান সামরিক প্রশাসক হিসেবে ঘোষণা করেছেন। খালেদ মোশাররফ এবং অন্যান্য বেশ কয়জন সামরিক অফিসারকে হত্যা করা হয়েছে।… এসব কিছুতে একদিকে যেমন জাতীয়তাবাদী ও মুক্তিযুদ্ধের মাথাগুলো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে তেমনি স্বাধীনতা বিরোধী আলবদর গোষ্ঠী শক্তিপ্রাপ্ত হচ্ছে।
৮.১১.৭৫
ঘোষণা: সায়েম- রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। উপ প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক: তিন বাহিনী প্রধান- জিয়া, তওয়াব ও খান।
৯.১১.৭৫
শুক্রবার (৭ই নভেম্বর) ঘটনাটা পুরোটা পরিচালনা করেছে জাসদ। রব-জলিলকে মুক্তি দেয়া হয়েছে।…যদিও জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গী থেকে খালেদ ও অন্যান্য প্রায় ১০০ জন প্রতিভাবান মুক্তিযোদ্ধা সামরিক অফিসারের নেতৃত্বে আগের ঘটনা ঘটেছিল কিন্তু তাদেরকে ‘ভারতের চর’ বলে প্রমাণিত করার চেষ্টা চলছে।
যদিও জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গী থেকে খালেদ ও অন্যান্য প্রায় ১০০ জন প্রতিভাবান মুক্তিযোদ্ধা সামরিক অফিসারের নেতৃত্বে আগের ঘটনা ঘটেছিল কিন্তু তাদেরকে ‘ভারতের চর’ বলে প্রমাণিত করার চেষ্টা চলছে।
২৫.১১.৭৫
অস্থিরতা, উত্তেজনা আর আশঙ্কার মধ্যে দিয়ে দেশ এগুচ্ছে। ভারতীয় প্রতিক্রিয়া, দেশে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির উত্থান-কুটিলতা, পাকিস্তানী গুজগুজ সর্বোপরি বাংলাদেশকে ঘিরে আন্তর্জাতিক দাবা খেলার চাপে দেশ, জাতি এখন চরম অনিশ্চয়তায় নিক্ষিপ্ত।…বর্তমান ক্ষমতার মূল প্রতিভূ মেজর জেনারেল জিয়ার রাজনৈতিক অপরিপক্কতা এ অবস্থাকে আরও ঘনীভূত করছে।…
২৬.১১.৭৫
পরপর দুদিন বিস্ফোরণের মতো দুটি ঘটনা ঘটলো। গতকাল সকালের দিকে মেজর জলিল-রব, কর্ণেল তাহের সহ ১৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আজ সকালের দিকে ভারতীয় হাইকমিশনার সমর সেনকে ৬ জন সশস্ত্র তরুণ হাইজ্যাক করতে গিয়েছিলেন। পুলিশের গুলিতে ৬ জনের ৪ জনই নিহত হয়েছেন, ২ জন আহত হয়ে পরে জবানবন্দী দিয়েছেন যে তারা জাসদের কর্মী। সমর সেন আহত হয়েছেন।…এদিকে শোনা যাচ্ছে রোববার গভীর রাতে (২৩ শে নভেম্বর) একটা অভ্যুত্থানের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। এর সাথে রব-জলিল-তাহের ছাড়াও বহু সৈনিক-অফিসার জড়িত ছিলেন।
২৭.১১.৭৫
একজন কবির মৃত্যু কেমন হয়? মৃত্যুর সময় কবির অনুভূতি কেমন থাকে?..জানি না কবির ভেতর তখন নতুন কোন কবিতার শব্দাবলী উপস্থিত হয় কিনা। এর উত্তর আমি জানি না, কিন্তু ভাবছি সকাল থেকে যখন প্রথম শুনেছি কবি আবুল হাসানের মৃত্যুসংবাদ। প্রায় একবছর মৃত্যু সামনে রেখে যার মধ্যে জীবন ছিল।…
ভারত সমর সেনের ঘটনা উল্লেখ করে কড়া নোট দিয়েছে।…এদিকে কাজী জাফর-মেননেরা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন।
৮.১২.৭৫
রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ নীতিতে গতকাল ঘোষণা দেয়া হয়েছে: ‘পুঁজি বিনিয়োগের সীমা ৩ কোটি টাকা থেকে ১০ কোটি টাকা করা হয়েছে, কালো টাকা শিল্পে খাটানোর সুযোগ দেয়া হয়েছে।’
…ভাসানী তাঁর ধর্মীয় সভায় দুটো বিপ্লবী ও প্রগতিশীল আহবান জানিয়েছেন: জমি জাতীয়করণ ও যৌথ খামার প্রতিষ্ঠা; সর্বস্তরে অসাম্প্রদায়িকতা নিশ্চিত করা।
১৬.১২.৭৫
১৯৭১ সালের পর ১৬ই ডিসেম্বর আর শুধুমাত্র তারিখ নেই, এর বিস্তৃতি ছড়িয়ে গেছে একটি জাতির অস্তিত্বের ভেতর, গর্বিত রক্তাক্ত উত্থানের ভেতর, আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের-প্রিয় স্বাধীনতার তীব্র উজ্জল আকাঙ্খার ভেতর। একে কি ইচ্ছা করলেই অস্বীকার করা যায়?…আজ খুব কম বাসায় পতাকা উড়েছে, বেতার-টিভির অনুষ্ঠানে চাপা যান্ত্রিকতা। ইতিহাস বলায় অস্বস্তি, বিকৃতি।
১৭.১২.৭৫
শুনলাম- শেখ মুজিবকে শ্রদ্ধা জানানো, জাতীয় দিবসে তাঁকে ‘জাতির পিতা’ ঘোষণার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। বোস্টারের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের অনিচ্ছায় এটি প্রত্যাহার করা হয়েছে।
২৫.১২.৭৫
জিন্নাহ নামের আগে মহামানব এবং শেষে (রা:) যোগ করে তার জন্মদিন পালন এবং ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ ত্যাগ করে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ সজ্জিত রাষ্ট্র গঠনের আহবান জানিয়ে ইশতেহার বেরিয়েছে।..
২৭.১২.৭৫
নূরুল ইসলাম পাটোয়ারীর নোটিশ: ‘পুনরাদেশ না দেয়া পর্যন্ত বিচিত্রার কাজ বন্ধ থাকবে।’…বিচিত্রার প্রকাশনা, সম্পাদনা এসবকিছু পাটোয়ারীর নামে হলেও কাজ সব শাহাদৎ চৌধুরীর হাতে। চলতি সংখ্যা অর্থাৎ ‘বাংলাদেশ:৭৫’ সংখ্যায় বাকশালে যোগ দেয়া সাংবাদিক, লেখক সম্পর্কে কিছু তথ্য প্রকাশ এবং ইদানীং বিচিত্রার স্বাধীন মনোভঙ্গীর প্রতিক্রিয়া সম্ভবত এই নোটিশ।
২৯.১২.৭৫
সেনাবাহিনীর ভেতরে চরম বিশৃঙ্খলা, গুরুতর কোন্দল সম্পর্কে উদ্বেগজনক খবর পাওযা যাচ্ছে। গতকাল চীফ অব ডিফেন্স স্টাফ মেজর জেনারেল খলিলুর রহমানকে অপসারণ করা হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের রাজনীতি: ১৯৭৫ এর আগে পরে
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শাসকদের অভিভাবক হিসেবে কাজ করতে গিয়ে বিশ্বব্যাংক বহুরকম কায়দাকানুন শিখেছে। তাদের সাথে থাকে সুবিধাভোগী আমলা আর কনসালট্যান্টরা। তাদের বিশেষজ্ঞ এবং আমলা কলমে কৃত্রিম প্রয়োজন তৈরি হয়, বিশ্বব্যাংকের পরামর্শ মধুর লাগে, মিডিয়ায় তা অপরিহার্য হিসেবে হাজির হয়।
বাংলাদেশে প্রথম দিকে তারা একটু চাপে ছিল। পরে পিঠ চাপড়াতে চাপড়াতে তারা তাদের সহযোগীসহ এগিয়েছে। তাদের তরিকার সাথে না মিললেও সাবাশ দিয়ে নিজেদের পথ আলতো করে তুলে ধরেছে। আস্তে আস্তে তাদের গলার জোর বেড়েছে, অনুনয় পরিণত হয়েছে হুমকিতে, আলতো পথই পরিণত হয়েছে প্রধান পথে। যেমন ১৯৭৪ সালে বিশ্বব্যাংক তাদের রিপোর্টে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করছে সমাজতান্ত্রিক বলে কথিত প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা দলিলকে, রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ওপর গুরুত্ব দেয়া পরিকল্পনাকে তারা ‘এক অসাধারণ দলিল’ হিসেবে আখ্যায়িত করছে, বলছে এটি বিশ্লেষণে অসাধারণ। (বিশ্বব্যাংক, ১৯৭৪) ১৯৭৫ সালে একদলীয় রাষ্ট্রপতি কেন্দ্রিক ব্যবস্থা চালুর পরও খুশি খুশি ভাব প্রকাশিত হলো তাদের রিপোর্টে। সেখানে প্রশস্তি করে বলা হলো, ‘সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তন আইন শৃঙ্খলার অবনতি, চোরাচালানী, মজুতদারী এবং কালোবাজারী দমন করতে সরকারের হাতকে শক্তিশালী করবে।’
এই সময় খুব দ্রুত বস্তি উচ্ছেদের সাফল্যেও বিশ্বব্যাংক সন্তোষ প্রকাশ করে। এর সাথে সাথে ছিল মৃদু হুমকিসহ বেশ কিছু অর্থনৈতিক সংস্কারের সুপারিশ যা তাদের ভাষায়, ‘বাংলাদেশকে অবশ্যই দ্রুততার সাথে করতে হবে’। তারা সরকারকে মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ‘১৯৭৫/৭৬ সালে বাংলাদেশের ১.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিদেশি সাহায্য লাগবে। বাংলাদেশের জন্য দাতাদের উদারভাবে সাহায্য দিয়ে যাওয়া নিঃসন্দেহে নির্ভর করবে সন্তোষজনকভাবে অর্থনৈতিক নীতি সংস্কার ও ব্যবস্থা গ্রহণের ওপর।’ (বিশ্বব্যাংক, ১৯৭৫) মে মাসে এই রিপোর্ট প্রকাশের তিনমাসের মধ্যে দেশে ভয়ংকর হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে সরকার পরিবর্তন হয়, রাষ্ট্রপ্রধান শেখ মুজিব সপরিবারে নিহত হন, সামরিক শাসন জারি হয়। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও বিশ্বব্যাংককে সন্তুষ্ট দেখা যায়। আগের সরকারের প্রতি ঘোষিত সমর্থন এবং সুপারিশ একইভাবে এই সরকারের প্রতিও উচ্চারিত হয়। আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির জন্য নতুন সরকারের প্রশংসা করা হয়। তবে সাথে এটাও বলা হয় যে, ‘অধিকতর উদার আমদানি নীতি এবং কাঁচামাল-যন্ত্রপাতির যোগান বৃদ্ধিতে শিল্পখাতে বিভিন্ন পর্যায়ে সক্ষমতার উন্নতি হয়েছে… অধিকতর বাজারমুখী অর্থনীতির দিকে কিছু অগ্রগতি হয়েছে।’ রিপোর্টে একইসঙ্গে আশা প্রকাশ করা হয় যে, ‘১৯৭৫ সালের মে মাসে টাকার অবমূল্যায়ন সহ আইএমএফ-এর সাথে চুক্তি অনুযায়ী যে সংস্কার কার্যক্রম শুরু হয়েছে তা অব্যাহত থাকবে’। এবং সর্বোপরি নতুন সরকারের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বলা হয় যে, ‘নতুন সরকার নিশ্চিত করেছেন যে, তারা ভর্তুকি প্রত্যাহার, কৃষি কর বৃদ্ধি এবং আমদানি উদারীকরণসহ অর্থনৈতিক সংস্কার আরও জোরদার করবে।’ (বিশ্বব্যাংক, ১৯৭৬)
আমরা ক্রমে দেখতে থাকবো কীভাবে এসব প্রতিষ্ঠানের নীতিমালা বাংলাদেশের নীতিমালা হিসেবে প্রকাশিত হতে থাকে।
অন্তর্বর্তীকালীন বছর
১৯৭৫ আমার জন্য এক নতুন পর্বে প্রবেশের বছর। বছরের শুরুতে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে আমার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা হয়। এবারের পরীক্ষার চিত্র অবশ্য ১৯৭২ এর শেষে দেয়া ম্যাট্রিক পরীক্ষার চিত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল। আগেরটাকে কোনো পরীক্ষা না বলে হট্টগোল বলাই ভালো, উন্মুক্ত অবাধ নকলোৎসব! আর পরেরটা ভয়ানক কড়া, রক্ষীবাহিনী পুলিশসহ নানা আয়োজন। আগেরটাতে প্রথম ডিভিশন, স্টার-এর ছড়াছড়ি আর পরেরটাতে ফেল-এর ছড়াছড়ি। পরীক্ষার পর পুরো বছরটা ছিলো পড়াশোনার ক্ষেত্রে কোনদিকে যাবো তা নিয়ে অনিশ্চয়তা, নিজেরও দ্বিধাদ্বন্দ্ব। মা-বাবার পরিকল্পনা অনুযায়ী আমার ডাক্তার হবার কথা। সেভাবেই কলেজে বিষয় নিয়েছি, ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছি, উত্তীর্ণও হয়েছি। কিন্তু ততদিনে আমার মনোযোগ পাল্টে গেছে। শেষমুহূর্তে ভর্তি না হবার সিদ্ধান্ত নেবার ফলে অনিশ্চয়তা বেড়ে গেল, ততদিনে আর কোনো সুযোগ নাই। নতুন প্রতিষ্ঠান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন খালি বলে কয়েকটা বিভাগে দ্বিতীয় দফা ভর্তির বিজ্ঞপ্তি দেয় তখনই, তাতেই অনিশ্চয়তা থেকে রক্ষা পাই। আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় ছিল আমার জন্য অন্যতম আকর্ষণ। পরিকল্পনা বা চিন্তার বাইরে থাকলেও বছরের শেষে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হবার মধ্য দিয়ে আমার পরবর্তী যাত্রাপথ নির্ধারিত হয়ে যায়।
এই বছরেরই মাঝামাঝি সাপ্তাহিক বিচিত্রায় খন্ডকালীন দায়িত্ব পালনের জন্য রীতিমত নিয়োগপত্র পাই- পদের আনুষ্ঠানিক নাম বিভাগীয় প্রতিবেদক। এই বছরের অনেকখানি সময়ও সাইকেল ছিলো আমার সচলতার প্রধান উপায়। তবে এ বছর সভা সমাবেশ নাই হয়ে যায়, অন্য সব দলও নাই হয়ে যায়। সাইকেলে আমার প্রধান এবং নিয়মিত গন্তব্য ছিলো তাই সাপ্তাহিক বিচিত্রা অফিস; এছাড়া গন্তব্য ছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কতিপয় গ্রন্থাগার, মাঠ ময়দান এবং প্রায়ই আজিমপুর গোরস্থানে আম্মার কবর। এবছরই আমার সাইকেল চুরি হয়ে যায়। এরপর আর ঢাকা শহরে এভাবে সাইকেল নিয়ে ঘোরা হয়নি।
এবছরই ‘বিশ্ব নারী বর্ষ’ ঘোষণার খবর পাই। এবছর বিশ্বদানবের বিরুদ্ধে ভিয়েতনামের মানুষের দীর্ঘ লড়াইএ বিজয় ছিলো আমার জন্যও এক বড় আনন্দের বিষয়।
১.৫.৭৫
গত ১৭ই এপ্রিল কম্বোডিয়া মুক্ত হয়েছে। লননল ভেগেছে। আর গতকাল দক্ষিণ ভিয়েতনাম মুক্তির মাধ্যমে পুরো ইন্দোচীনে সাম্রাজ্যবাদী হিংস্র প্রভুত্ব শেষ হলো।…আগামী সংখ্যা বিচিত্রা রক্তোজ্জল ভিয়েতনাম, মুক্ত ভিয়েতনাম নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে। থাকছে মহানায়ক হোচিমিনের কথা। এ প্রসঙ্গে কিছু লেখা বিশেষ করে হোচিমিনের শেষ উইল অনুবাদ করছি-ভাল লাগছে।
২১.১১.৭৫
আজ আম্মার অষ্টম মৃত্যুবার্ষিকী গেল।..জুম্মার নামাজের পর আমি, ভাইজান, লুতু, ফজল আর ফাতেমা আম্মার কবর জেয়ারত করতে গিয়েছিলাম। আম্মার কবরের পাশে গেলেই যেন কেমন স্নিগ্ধ ছোঁয়া পাওয়া যায়। স্নেহময় পবিত্র। কবরের ওপর ঘাস। দুপাশে দুটো ফুল গাছ- শেফালী আর কামিনী। সকালে দুগাছের ফুলে কবর সাদা সাদা স্নিগ্ধতায় ঢেকে যায়।…কোন কিছুতে একটু বিষণ্ণতা এলেই কপালের ওপর স্নেহময় মাতৃত্বের তৃষ্ণা হয়- আঁচলের কথা মনে হয়। এসব অভাব বোধ করে আরও বেশি করে মনে পড়ে- আম্মা নাই!
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিপর্বের সব কাজ আজ শেষ হলো।…এখানকার থাকা খাওয়া খরচ মোটামুটিভাবে ৩৫০ টাকার মতো পড়বে। আমি নিজে মাসে আয় করছি ২৫০ টাকার মতো, এরপর আব্বা যদি ১৫০ টাকাও দিতে পারেন তো যথেষ্ট হবে।
৮.১২.৭৫
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিপর্বের সব কাজ আজ শেষ হলো।…এখানকার থাকা খাওয়া খরচ মোটামুটিভাবে ৩৫০ টাকার মতো পড়বে। আমি নিজে মাসে আয় করছি ২৫০ টাকার মতো, এরপর আব্বা যদি ১৫০ টাকাও দিতে পারেন তো যথেষ্ট হবে।… (চলবে)
তথ্যনির্দেশ
বিশ্বব্যাংক ১৯৭৪। World Bank: ‘Bangladesh: Development in a Rural Economy’, Dhaka, September
বিশ্বব্যাংক ১৯৭৫। World Bank: ‘Bangladesh: The Current Economic situation and Short term Outlook’, Dhaka, May.
বিশ্বব্যাংক ১৯৭৬। World Bank: ‘Bangladesh: Current Economic Performance and Short term Prospects’, Dhaka, March.
সরকার ২০০১। মোনায়েম সরকার (সম্পাদিত) বাঙালির কন্ঠ। আগামী প্রকাশনী।
রহমান ২০১২। শেখ মুজিবুর রহমান: অসমাপ্ত আত্মজীবনী, ইউপিএল, ঢাকা।
রহমান ২০২০। শেখ মুজিবুর রহমান: আমার দেখা নয়া চীন, বাংলা একাডেমি, ঢাকা।