সামরিক শাসনামল ও দেশি-বিদেশি পুঁজির বিকাশ

২২ পরিবারের অতীত ও বর্তমান-১১

সামরিক শাসনামল ও দেশি-বিদেশি পুঁজির বিকাশ

মেহেদী হাসান

বাংলাদেশে পুঁজিবাদের বিকাশ উল্লেখযোগ্য আকার নিয়েছে। এই বিকাশধারায় একদিকে তৈরি হয়েছে পাকিস্তানের ২২ পরিবারের চেয়েও সম্পদশালী বেশ কিছু গোষ্ঠী, অন্যদিকে বৈষম্য ও পরিবেশবিধ্বংসী তৎপরতাও অভূতপূর্ব মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে ‘উন্নয়ন’ ধারার স্বরূপ বিশ্লেষণ, পুঁজির কেন্দ্রীভবনের ধরন, শ্রেণিবিন্যাস, এই ধারার পুঁজিবাদ বিকাশে রাষ্ট্রের ভূমিকা ইত্যাদি পরীক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান প্রবন্ধ কয়েক কিস্তিতে এই অনুসন্ধান বিশ্লেষণ হাজির করছে। একাদশ কিস্তিতে সামরিক শাসকরা ‘পুঁজির ক্রিয়ায়, শোষণ প্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য সূত্রে এবং পারস্পরিক অস্তিত্বের তাগিদ থেকে’ দেশি-বিদেশি অনুত্পাদনশীল লুম্পেন পুঁজির বিকাশকে কীভাবে ত্বরান্বিত করে, তার পর্যালোচনা হাজির করা হয়েছে।

পশ্চিমা পণ্যসমূহের জন্য বাজার উন্মুক্ত ও সম্প্রসারণ করার প্রক্রিয়ার পুঁজিবাদী বিশ্বায়ন প্রসঙ্গে নোয়াম চমস্কি: ‘‘I would call it the extension of transnational, corporate tyranny. These are tyrannical, totalitarian institutions, mega-corporations. They are huge command economies, run from the top, relatively unaccountable, and interlinked in various ways. Their first interest is profit – but much broader than that, it’s to construct an audience of a particular type. One that is addicted to a certain life-style with artificial wants. An audience atomised, separated from one another, fragmented enough so that they don’t enter the political arena and disturb the powerful. It’s completely natural.’’

যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে বণ্টন পুঁজির বিকাশ এবং পুঁজিবাদের বিকৃত রূপ নির্মাণ প্রক্রিয়ায় শাসক-শোষক শ্রেণির ভূমিকা প্রসঙ্গে আনু মুহাম্মদ ‘এখানে পুঁজিবাদ’-এর বিশ্লেষণে বলেছেন,

“আন্তর্জাতিক পুঁজির স্বাভাবিক ক্রিয়া, উদ্বৃত্ত মূল্য আহরণের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে পুঁজিবাদী উত্পাদন সম্পর্কের বিকাশ ঠিকই হচ্ছে, কিন্তু বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থার আওতায় পুঁজিবাদের বিপ্লবী ভূমিকা থেকে তা অনেক দূরে সরে এসেছে। পুঁজিবাদের অবক্ষয়ের চেহারা তাই উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোর তুলনায় এসব দেশে অনেক বেশি প্রকট।

বাংলাদেশের শাসক-শোষক শ্রেণির মৌলিক চরিত্র বিচার-বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে তাদের বিকাশ এবং পুঁজিবাদের চিরায়ত বিপ্লবী ভূমিকা পরস্পরবিরোধী।

পুঁজিবাদের বিপ্লবী ভূমিকার মধ্যে আমরা দেখি ১. উত্পাদনকে বৃহদায়তন পর্যায়ে নিয়ে আসা ২. বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়ন ৩. শিক্ষার বিস্তার ৪. বস্তুবাদী চিন্তাভাবনার প্রসার ইত্যাদি।

ইউরোপ-আমেরিকায় পুঁজিবাদের শুরুতে তখনকার উত্থিত শাসক বুর্জোয়া শ্রেণির স্বার্থের সঙ্গে এসব সংগতিপূর্ণ ছিল। তাদের নিজেদের অধিক মুনাফা অর্জন, পুঁজির স্ফীতিলাভ ইত্যাদির জন্য দরকার ছিল এসব শর্ত পূরণ। কিন্তু বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর শাসক-শোষক শ্রেণিগুলোর জন্য এগুলো প্রতিবন্ধক; আন্তর্জাতিক পুঁজির জন্যও তাই।

গ্রামীণ বুর্জোয়ার, কিংবা বিত্তবানের জন্য জমিতে অধিক পুঁজি বিনিয়োগ, তার উন্নয়ন, উত্পাদনের উপকরণের উন্নয়ন ইত্যাদি যতটা লাভজনক তার চেয়ে অনেক বেশি লাভজনক হচ্ছে ধান-চাল কিংবা নলকূপের ব্যবসা, সুদে লগ্নি করা।

শহরের বিত্তবানদের জন্য শিল্প প্রতিষ্ঠা যতটা লাভজনক তার চেয়ে অনেক বেশি লাভজনক আমদানি-রপ্তানি ব্যবসা, বহুজাতিক কোম্পানির স্থানীয় এজেন্সি গ্রহণ কিংবা একটা সাহায্য সংস্থা খুলে বসা কিংবা কনসালটেন্সি ফার্ম করা। গ্রাম ও শহরের সকল বিত্তবান বুর্জোয়াকে নিজেদের স্বার্থেই বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর স্বার্থ রক্ষা করা, তাদের বাজারের বিস্তার ঘটানো প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়ায়।

এখানে ভেতর থেকে যেহেতু উত্পাদিকা শক্তির বিকাশের, উত্পাদনের বিভিন্ন শাখা, শ্রমবিভাজনের উন্নয়নের সুযোগ সীমাবদ্ধ, সে জন্য উপরিকাঠামোতে শিক্ষা চিন্তা-চেতনায়ও কোনো বৈপ্লবিক অগ্রগতি ঘটতে পারে না।”

তাহলে যুদ্ধোত্তর পর্বে বাংলাদেশে কী ধরনের উত্পাদন সম্পর্কের বিকাশ ঘটানো হয়েছে? এ প্রসঙ্গে তিনি বলছেন,

“পুঁজিবাদ সম্পর্কে বলতে গিয়ে মার্কস বলেছিলেন, এই ব্যবস্থা তার প্রবল শক্তি দিয়ে ‘সকল প্রাক পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে নিজের মতো করে তৈরি করে নেয়’। নিজের মতো করে মানে নিজের প্রতিবিম্ব নয়। অর্থাৎ ইউরোপ-আমেরিকার ধনতন্ত্র বাংলাদেশে কোনোভাবেই সৃষ্টির সম্ভাবনা নেই; নিজের মতো করে মানে ধনতান্ত্রিক উত্পাদন সম্পর্কের উত্পাদন ও পুনরুত্পাদন; এবং বিশ্ব আন্তর্জাতিক একচেটিয়া পুঁজির স্ফীতিলাভের উপযোগী ব্যবস্থা।

আমরা আগেই বলেছি, পুঁজিবাদ বিকাশের জন্য আরও অনেক শর্তের সঙ্গে যে দুটি শর্ত পূরণ করা দরকার বাংলাদেশ-ভারত তার বিপরীত প্রান্তেই অবস্থান করেছে। কিন্তু বিশ্ব পুঁজিবাদের শৃঙ্খলে, তার অধীন উন্নয়ন প্রক্রিয়া পরিচালনা করায় এখানেও ধনতান্ত্রিক উত্পাদন সম্পর্কের বিকাশ ঘটেছে, কিন্তু তা এসব দেশে স্বাধীন কোনো পুঁজিবাদী উন্নয়ন সম্ভাবনা সৃষ্টি করেনি। এখানকার পুঁজি শক্তিশালী আন্তর্জাতিক পুঁজির সঙ্গে স্বাভাবিক নিয়মেই মিশে গেছে।”

এবং ‘বাংলাদেশের সাম্রাজ্যবাদ’ প্রবন্ধের ‘রাধার সংজ্ঞা’য় তিনি বলেছেন,

“শাসক শ্রেণি বলতে ঠিক কাদের বোঝানো হচ্ছে, কারা রাধার ভূমিকা পালন করছেন সেটা সুনির্দিষ্টভাবে বলা দরকার। সাধারণভাবে শাসক শ্রেণি বলতে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন গোষ্ঠীকেই বোঝানো হয়। প্রকৃতপক্ষে শাসক শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে সেই জনগোষ্ঠী যারা বিদ্যমান শাসন ব্যবস্থাকে অক্ষত ও অব্যাহত রাখার ব্যাপারে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকা পালন করেন। এ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন যারা তারা শাসক শ্রেণির প্রতিনিধি, তাদের মুখপাত্র। এ শ্রেণির স্বার্থ রক্ষা করা, শোষণ ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করে রাষ্ট্রযন্ত্র; আমলাতন্ত্র, সেনাবাহিনী, বিচার ব্যবস্থা এবং ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী। অন্যদের ভূমিকা হচ্ছে সহযোগী। ক্ষমতাসীন এবং ক্ষমতাবহির্ভূত শাসক শ্রেণির মধ্যে মাঝেমধ্যে যে ঝগড়া-বিবাদ-সংঘর্ষ হয় তা তাই ভাই ভাইয়ের ঝগড়ার মতো। এখানে শাসিত ও শোষিতদের কোনো ব্যাপার নেই।

১৯৭১-এর পরই বাঙালি শোষক শ্রেণি সুনির্দিষ্ট ও সুসংহতভাবে শাসক শ্রেণির ভূমিকায়ও অবতীর্ণ হয়। এবং সে হিসেবে তার সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক স্থাপিত হয় সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির।

এই সম্পর্ক স্থাপন, এই যোগাযোগ, এই প্রেমবন্ধন কোনো দেনদরবার বৈঠক শলাপরামর্শের মাধ্যমে সাধিত হয় না। পরস্পরের আবেগ যেমন রাধা কৃষ্ণকে যুক্ত করে তেমনি সাম্রাজ্যবাদ আর দেশীয় শাসক শ্রেণি পরস্পরের প্রয়োজনে, অস্তিত্বের খাতিরে প্রবলভাবে আকর্ষণ বোধ করে এবং একে অন্যের সঙ্গে সংযুক্ত হয়।

গ্রামের যে প্রতাপশালী ধনী কৃষক কাম ব্যবসায়ী উত্তরোত্তর স্ফীতিলাভ করছে তার সঙ্গে গুলশানবাসী আমলার ব্যক্তিগত সাক্ষাতের প্রয়োজন হয় না; কিন্তু তাদের একজন নিজের স্বার্থ বজায় রাখার জন্য যে কাজ করে তা স্বাভাবিকভাবেই অপরের স্বার্থ রক্ষা করে। শ্রেণি ঐক্য ব্যক্তিবিশেষের উদ্যোগ ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল নয়। বাংলাদেশের শাসকদের সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থ অভিন্ন যোগসূত্রে বাঁধা হয়ে যায় ব্যক্তির উদ্যোগে নয়; পুঁজির ক্রিয়ায়, শোষণ প্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য সূত্রে এবং পারস্পরিক অস্তিত্বের তাগিদ থেকে।

সে কারণে যখন ইউরোপ-আমেরিকায় যুদ্ধ অর্থনীতির উদ্ভব হয়েছে, যুদ্ধাস্ত্রের শিল্পই অন্যতম প্রধান শিল্পে পরিণত হয়েছে তখন তার ভোগ করার মধ্য দিয়ে অনুন্নত দেশগুলোর শাসক শ্রেণির স্বার্থ রক্ষিত হচ্ছে। একদিকে দুই দেশের মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষ হচ্ছে, অন্যদিকে বরকন্দাজ বাহিনী বিকশিত হয়ে এসব দেশের শাসন ব্যবস্থাকে পাহারা দিচ্ছে। অবরুদ্ধ করছে নিজেদের দেশ। বাংলাদেশের বরকন্দাজ বাহিনী তার সাক্ষাৎ উদাহরণ।” 

সামরিক আমলে শাসক শ্রেণির বিন্যাস

মধ্যবিত্ত যে অংশটি নিয়ে আওয়ামী লীগ গঠিত হয়েছিল সে সম্প্রদায়েরই অন্য অংশটি দ্বারা গঠিত হয়েছিল বিএনপি এবং যারা উত্পাদনশীল পুঁজির প্রতিনিধিত্বকারী ছিল না। তারা যে মধ্যস্বত্বভোগী সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করত সেটি ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত (পূর্ববর্তী অধ্যায়গুলো দ্রষ্টব্য)। সে হিসাবে এ কথা বলা অত্যুক্তি হবে না যে, জিয়াউর রহমানের দ্বারা গঠিত দলটি একই সম্প্রদায়ের বর্ধিত কিংবা অপর অংশ এবং শাসক শ্রেণিরই ধারাবাহিকতা বৈ ভিন্ন কিছু নয়। বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায়, পেটি বুর্জোয়াদের যে অংশটি আওয়ামী লীগের শাসনামলে উদ্বৃত্ত মূল্য শোষণের ভাগ থেকে বঞ্চিত ছিল কিংবা যাদের অত্যধিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল নিজেদের শ্রীবৃদ্ধি ঘটানোর, তাদের সমন্বয়ে তৈরি হয় শাসক শ্রেণির এই দলটি। শাসন ক্ষমতার পটপরিবর্তনের ক্ষেত্রে শাসক শ্রেণির অভ্যন্তরীণ এই দ্বন্দ্বকে বরাবরই ব্যবহার করেছে আন্তর্জাতিক শাসকগোষ্ঠী। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসেবে যাদের চিহ্নিত করা হয়, নেপথ্যে থেকে অবশ্য তাদের কলকাঠি নাড়তে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি।৩ ক্ষমতার রদবদলে আর যা-ই হোক অর্থনীতি, রাজনীতি কিংবা সমাজে স্থিতিশীলতার অবস্থা তৈরি যে হয়নি তা বলাই বাহুল্য। উপরন্তু দীর্ঘ এই অস্থিতিশীলতার সুযোগ ব্যবহার করে দেশীয় লুণ্ঠন পুঁজি আন্তর্জাতিক পুঁজির সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ়তর করেছে। বেসামরিক কিংবা সামরিক, কোনো শাসন ব্যবস্থায়ই এই সম্পর্কের ধারাবাহিকতায় ছেদ ঘটেনি। সামরিক উর্দি কিংবা বেসামরিক কোর্তার নেপথ্যে ব্যবসায়ী পুঁজির প্রক্রিয়াই শাসন করেছে বাংলাদেশের মানুষকে। শাসক-শোষকদের বাহ্যিক পোশাকের ভিন্নতা সাধারণ জনমনে যদিও বিভ্রান্তির তৈরি করে, কিন্তু বাংলাদেশে লুণ্ঠন পুঁজির প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ করলে তাদের শ্রেণিগত ঐক্যের বিষয়টি উপলব্ধি করা যায়।

ছক-২৭: বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদ (১৯৮১) সদস্যদের পেশাগত অবস্থান

পেশা

 

সংখ্যা

শতকরা হার

ব্যবসায়ী

৫৭

৩৩.৫

পেশাজীবী

৫৩

৩১.২

কৃষিজীবী (কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত ধনী সম্প্রদায়)

২৮

১১.৮

শিক্ষক

২০

১১.৭

আমলা (অভিজাত)

১১

৬.৫

ট্রেড ইউনিয়নের নেতা

১.১

অন্যান্য

৪.২

মোট

১৭০

১০০

সূত্র: TABLE 2 Occupational Background of the Members of the BNP Central Executive Committee, 1981, Information from S. M. Fakhruddin, Member, Central Executive Committee of BNP, August 1981, and interviews, Syed Serajul Islam, The State in Bangladesh under Zia (1975-81), Source: Asian Survey, Vol. 24, No. 5 (May, 1984), pp. 556-573, Published by: University of California Press, Stable URL: http://www.jstor.org/stable/2644413.p.564.

ছক-২৮: সংসদ সদস্যদের পেশাগত প্রেক্ষাপট, ১৯৭৯

পেশা

সংখ্যা

শতকরা হার

ব্যবসায়ী

৮৪

২৮

আইনজীবী

৭৮

২৬

কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত (ধনী ব্যক্তিবর্গ)

৫৮

১৯.৩

টেকনোক্র্যাট

২১

শিক্ষক

২০

৬.৬

আমলা

১৯

৬.৪

ট্রেড ইউনিয়ন নেতা

অন্যান্য

১৪

৪.৭

সূত্র: TABLE 4. Occupational Background of the Members of Parliament, 1979, Interviews with MPs and information from Nur Mohammad Khan, an MP and State Minister for Information and Broadcasting, 1981. Syed Serajul Islam, The State in Bangladesh under Zia (1975-81), Source: Asian Survey, Vol. 24, No. 5 (May, 1984), pp. 556-573, Published by: University of California Press, Stable URL: http://www.jstor.org/stable/2644413.p.566.

১৯৭৯ সালে বিএনপির দলীয় গঠন বিন্যাসের ন্যায় সংসদেও অভিজাত আমলা, ব্যবসায়ী গোষ্ঠী-শ্রেণির প্রতিফলন ঘটে। যদিও দলের নেতৃত্বের পর্যায়ের শ্রেণিগত কাঠামোর সঙ্গে সংসদ সদস্যদের শ্রেণিগত কাঠামোকে আলাদা করে দেখার উপায় নেই; যদিও বুর্জোয়া শ্রেণি সম্পর্ক পারস্পরিকতার মধ্য দিয়েই শক্তিশালী হয় এবং যদিও সংসদ সদস্যরা ‘নির্বাচিত’ হন ভোটপ্রথার মাধ্যমে, কিন্তু সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সংসদের সার্বভৌমত্ব ছিল নামেমাত্র। কোনো কোনো গবেষক বলছেন, সংসদ ছিল প্রেসিডেন্টের আজ্ঞাবহ এবং অধীনস্থ, যিনি ছিলেন সামরিক বাহিনীর সর্বেসর্বা। প্রেসিডেন্ট ছিলেন সংসদের ঊর্ধ্বে এবং যখন তিনি প্রয়োজন মনে করতেন তখন সংসদ ভেঙে দিতে পারতেন। বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায়, সামরিক শাসনামলের এই সংসদ ছিল মূলত অনুত্পাদনশীল ব্যক্তি পুঁজির সম্প্রসারণের প্রতিনিধিত্বে পূর্ণ; যার প্রধান ছিলেন সামরিক কর্তাব্যক্তি এবং যিনি ছিলেন দেশীয় বাজার ব্যবস্থা ‘উদার এবং উন্মুক্ত’ করার পক্ষের অগ্রসৈনিক। যার ফলে, একদিকে, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বিলোপ এবং অন্যদিকে বিদেশি পুঁজির থাবা বিস্তৃত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। সর্বজনের ন্যূনতম স্বার্থের পক্ষের পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতার বিকাশ না ঘটিয়ে ক্রমান্বয়ে পঙ্গু করে দেওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণের ফলে পরবর্তী সময়ে সেগুলো লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় এবং ব্যক্তিমালিকানায় তুলে দেওয়া হয়। বন্ধের সিদ্ধান্ত গ্রহণের মধ্য দিয়ে (রাষ্ট্রপতির আজ্ঞাবহ) সংসদ আনুষ্ঠানিকতা পালন করে মাত্র। এর মধ্য দিয়ে ব্যবসায়ী এবং সরকারের পারস্পরিক মৈত্রীবন্ধন শক্তিশালী হয়।

মূলধারার অর্থনীতিবিদরা শাসক শ্রেণির শিল্পায়ন সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা করে বলেছেন যে, ১. শিল্পায়ন নীতি তৈরির ক্ষেত্রে কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গির অনুপস্থিতি, ২. বাস্তববাদী এবং অভিজ্ঞতাগত বিবেচনার অভাব, বিশেষত উত্পাদনশীল উদ্যোগী মালিকানার ক্ষেত্রে, ৩. সরকারি ঋণের মাধ্যমে বেসরকারি শিল্পায়নের ব্যর্থ প্রচেষ্টা ইত্যাদি ধরনের কেন্দ্রীয় সীমাবদ্ধতার কারণে শিল্পায়ন প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।৭, ৮অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় শিল্প-কারখানাগুলোতে স্থাপিত যন্ত্রপাতির যতটুকু উৎপাদনী ক্ষমতা ছিল তার পূর্ণ ব্যবহার করা হয়নি। এমনকি অব্যবহারের (Under-utilisation) কারণ উদ্ঘাটন বিষয়ে প্রচণ্ড অনীহা ছিল। শিল্পনীতি, পরিকল্পনা গ্রহণের ক্ষেত্রে পুরাতন এবং নব্য ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের (non-industrial entrepreneurial class) আধিপত্য এবং প্রভাবের কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়। ট্রেড এবং শিল্পনীতি (TIP) নীতি নিয়ে অনুসন্ধানকৃত বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে দেখা যায় যে, প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে (বিশেষ করে শিল্প-কারখানায়) দৃশ্যমান উত্পাদনের চেয়ে উত্পাদনের সক্ষমতা ছিল অনেক বেশি। সক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার না করার বিষয়ে কোনো ধরনের তদন্ত, অনুসন্ধান, বিশ্লেষণ কিংবা যাচাই-বাছাই তো করেইনি; উপরন্তু ব্যক্তিখাতনির্ভর অর্থনীতি সম্প্রসারণের আকাঙ্ক্ষায় সরকার দুই রাষ্ট্রায়ত্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (BSB, BSRS) থেকে প্রাইভেট সেক্টরে প্রচুর পরিমাণ ঋণ প্রদান করে (পূর্ববর্তী অধ্যায় দ্রষ্টব্য), যার অধিকাংশই অনাদায়ী থেকে যায়। যার ফলে যত দিন গেছে ঋণখেলাপির সংখ্যা তত বেড়েছে।

ছক- ২৯: বিভিন্ন শিল্প খাতের সক্ষমতার ব্যবহার (শতকরা হার হিসাবে)

শিল্প

১৯৭২-৭৩

১৯৭৪-৭৫

১৯৭৬-৭৭

জুট মিল

৫৬

৬৯

৬৮

টেক্সটাইল মিল

৬০

৫৯

৬৭

সুগার মিল

১১

৫২

৮২

সিগারেট

১৮

২৩

২৭

সার

৬২

৬২

৬২

স্টিল

২৭

২৯

৮০

ডিজেল ইঞ্জিনিয়ারিং

৪৫

৫৭

৪৭

কাগজ

৬৯

৪৯

৫০

নিউজপ্রিন্ট

৫৪

৫৩

৩৭

দিয়াশলাই

২৮

৩১

৩৫

সিমেন্ট

২৩

৩৫

৮০

ফার্মাসিউটিক্যালস

১৩

৪৯

৫৪

পেট্রোলিয়াম

৫২

২২

৭২

কাচ

৯৭

৭৬

৭৭

 সূত্র: World Bank, Subsector study Vol. 2 Part 1, 1980. A.M. Quamrul Alam (1989), Privatisation policy and the problem of industrial development in Bangladesh, South Asia: Journal of South Asian Studies, 12:2, 49-68, DOI: 10.1080/00856408908723127, http://dx.doi.org/10.1080/00856408908723127, p.63.

সক্ষমতার তুলনায় কম উত্পাদনের কারণ হিসেবে কামরুল আলম কয়েকটি বিষয়ের উল্লেখ করেছেন। যেমন: অপর্যাপ্ত এবং অনিয়মিত কাঁচামালের জোগান, যন্ত্রপাতি ভঙ্গুর অবস্থা-অপব্যবহার-অযত্ন, শ্রমিকের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের অভাব, প্রশাসনিক দীর্ঘসূত্রতা, অপর্যাপ্ত পরিবহণ ব্যবস্থা, প্রয়োজনীয় খুচরা যন্ত্রাংশের অভাব, সম্পর্কিত বৈদেশিক বিনিময়ের স্বল্পতা, প্রয়োজনীয় চলতি মূলধনের অভাব, স্থানীয় বাজারের কার্যকর চাহিদার অভাব ইত্যাদি। অন্যদিকে নতুনভাবে স্থাপিত শিল্প ইউনিটগুলোকেও সক্ষমতার তুলনায় কম ব্যবহার করা হতো। এ ছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত দুটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দীর্ঘমেয়াদি ঋণের অনুমোদনের দীর্ঘসূত্রতা সময়মতো উৎপাদন শুরু করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করত (ব্যাংকের সিদ্ধান্ত পেতে এক বছরের অপেক্ষাসহ ঋণ আবেদন এবং বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরুর মাঝখানে পঞ্চাশ মাস অতিবাহিত হতো। আরও তেইশ মাস লাগত যন্ত্রপাতি আমদানি করতে এবং পরবর্তী পনেরো মাসের বেশি লাগত উৎপাদনে যেতে)। অন্যদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত (খেলাপি) ঋণগ্রহীতারাও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার সুযোগ গ্রহণ করে। রাষ্ট্রীয় নানাবিধ অব্যবস্থাপনা ঋণ পরিশোধ না করার অজুহাত হিসেবে হাজির হয় নব্য ধনী চক্রের কাছে। প্রকৃত শিল্পোদ্যোক্তারা একই কারণে নানা ধরনের বাধার সম্মুখীন হয়।১০ এভাবে একদিকে দেশীয় শিল্প বৈরী চেষ্টা, অন্যদিকে বিদেশি ব্যক্তি বিনিয়োগ আকর্ষণের নানাবিধ উদ্যোগের মধ্য দিয়ে সামরিক বাহিনীর শাসন জারি থাকে।

বিদেশি ব্যক্তি বিনিয়োগ (Private Foreign Investment-PFI)

কর কর্তন-পরবর্তী লাভের শতভাগ বছর শেষে নিজ দেশে পাঠানোর পূর্ণ স্বাধীনতা, পুঁজির প্রত্যাবাসন, লভ্যাংশ নিশ্চিতকরণে সরকারের নিশ্চয়তা এবং বিনিয়োগ-পরবর্তী দশ বছরের মধ্যে রাষ্ট্রীয়করণ না করার শর্ত (রাষ্ট্রীয়করণ করা হলেও উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ সাপেক্ষে পুষিয়ে দেওয়ার শর্তসহ) নানাবিধ সুবিধা সত্ত্বেও বিদেশি ব্যক্তি বিনিয়োগ ১৯৭৩-৭৪ এবং ১৯৭৪-৭৫ সাল পর্যন্ত ০.০৪ শতাংশ এবং ০.০ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। সরকারের তরফ থেকে ধারণা করা হয়েছিল যে, বিদেশি বিনিয়োগের ফলে স্থানীয় উদ্যোক্তারা শিল্প বিনিয়োগে উত্সাহী হবে। দেশি-বিদেশি ব্যক্তি বিনিয়োগকে উত্সাহিত করার জন্য সরকারেরর নানাবিধ গৃহীত উদ্যোগও উদ্যোক্তাদের সন্তুষ্ট করতে পারেনি। তারা পুরোপুরি সরকারি নিয়ন্ত্রণমুক্ত হতে চেয়েছিল। দেশীয় উদ্যোক্তাদের চেয়ে তুলনামূলক অধিক সুবিধা দেওয়া সত্ত্বেও বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আরও অবাধ সুবিধা লাভের আশা করে এবং আঁচ করতে পেরেছিল যে, বিনিয়োগের নীতি ভবিষ্যতে আরও শিথিল করবে সরকার। তখন তারা অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করতে পারবে। সে আশা পূর্ণ হতে তাদের বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি। ডিসেম্বর ১৯৭৫ সালে পিএফআই পলিসিতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন করে সরকার।১১ যেসব খাত আগে সরকারের হাতে ছিল সে ধরনের ১০টি খাতে পিএফআই অনুমোদিত হয় এবং বিদেশি পুঁজির সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগকৃত খাতগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। এবং বিদেশি পুঁজিকে কোনো অবস্থায়ই রাষ্ট্রীয়করণ করা হবে না; তার নিশ্চয়তার বিধান করা হয়। প্রথম ‘পঞ্চবার্ষিকী’১২ পরিকল্পনার বছর শেষ হলে সরকার দ্বিবার্ষিক পরিকল্পনা (১৯৭৮-৮০) প্রণয়ন করে, যেখানে বিদেশি ব্যক্তি বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরির জন্য বেশকিছু উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (১৯৮০-৮৫) দেশি-বিদেশি ব্যক্তি বিনিয়োগের সীমা তুলে দেওয়াসহ পিএফআই-এর জন্য অবাধ এবং উন্মুক্ত স্বাধীনতা দেওয়ার বন্দোবস্ত করে।

১৯৮০ সালে Foreign Investment Promotion and Protection Act পাস হয় মূলত পিএফআই-এর প্রতি সরকারের দায়বোধ এবং অঙ্গীকারের জায়গা থেকে; বিদেশি ব্যক্তি বিনিয়োগের আদর্শ ক্ষেত্র হিসেবে আকর্ষণীয় করার প্রয়োজনবোধ থেকে।১৩ যে কারণে সরকারকে লভ্যাংশ নিশ্চিতকরণ থেকে শুরু করে বিদেশি পুঁজির জন্য নিরাপত্তামূলক যাবতীয় অঙ্গীকার এবং প্রভূত সুযোগ-সুবিধা প্রদান করতে হয়। নতুন নতুন যেসব ধারা সংযুক্ত করা হয় সেসবের বিশ্লেষণ করে রেহমান সোবহান এবং দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলছেন,

“The main provisions of the Act were: identification of the fields where PFI is acceptable; assurance of protection and equitable treatment; terms of sanction, indemnification, compensation, guarantee against expropriation and nationalization; repatriation facilities. Thus, an important and constant demand by potential investors, and the donors patronizing them, was met by the Government of Bangladesh.।”১৪

পাশাপাশি, বিদেশি ব্যক্তি পুঁজির প্রতি সরকারি ‘বিশেষ দুর্বলতা’ এবং রপ্তানিমুখী শিল্পায়নের বিশ্বব্যাংকীয় কৌশলগত ব্যবস্থাপত্রের প্রতি সরকারের ‘বিশেষ অঙ্গীকার’ থাকার কারণে সামরিক শাসনাচ্ছাদিত ‘বহুদলীয় গণতান্ত্রিক’ পরিবেশের সংসদে ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং চালনা বন্দরের আশপাশে রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল গড়ে তোলার আইন পাস করে। এতৎসত্ত্বেও আশানুরূপ বিদেশি বিনিয়োগ হয়নি। যদিও দেশীয় বাজার উন্মুক্তকরণ এবং উদারীকরণের উদ্যোগে সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির ওপর নির্ভরশীলতার যে দৃষ্টিভঙ্গি সেটি অটুট থাকে। সাম্রাজ্যবাদী পুঁজি সম্প্রসারণের পথ উন্মুক্তকরণে এবং স্থানীয় উত্পাদন যাতে বহুজাতিক করপোরেশন নিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হয় সে জন্য নানাবিধ বিধি-ব্যবস্থা গ্রহণ করে।

ছক- ৩০: ১৯৭৩-৮৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে বিনিয়োগ (১৯৮২-৮৩ সালের দামস্তর অনুযায়ী, কোটি টাকা)১৫

সাল

মোট বিনিয়োগ

মোট বিদেশি পুঁজির আগমন

বিদেশি ব্যক্তি বিনিয়োগ

মোট বিনিয়োগে পিএফআই-এর হার ( শতাংশ)

মোট বিদেশি পুঁজির আগমনে পিএফআই-এর হার (শতাংশ)

১৯৭৩-৭৪

৫০০

৪৪০.৫

০.১৯৫

০.০৪

০.০৪

১৯৭৪-৭৫

১,০১৯.৩

৮৯১.১

০.১৬৮

০.০২

০.০২

১৯৭৫-৭৬

১,১১৫

১,২৫৮

৪৩.০৩৭

৩.৮৬

৩.৪৩

১৯৭৬-৭৭

১,০৬১.৪

৬২১.৮

১.৭১৮

০.১০

০.২৮

১৯৭৭-৭৮

১,৬৫১.২

১১৭.৪

১০.৫৮

০.৪০

০.৯০

১৯৭৮-৭৯

১,৮৮১.২

১,২৬৩.৫

২৩.৫৫৪

১.২৫

১.৮৬

১৯৭৯-৮০

২,৯১৫.৮

২,২১৬.৪

৯.৬৩২

০.৩৩

০.৪৩

১৯৮০-৮১

৩,৩৭৪.১

২,৩২৯.১

১৯.৩৮৫

০.৫৮

০.৮৩

১৯৮১-৮২

৩,৬৩৪.৫

২,৮২৭.৬

৬.১৮৯

০.২১

০.২২

১৯৮২-৮৩*

৩,৮৩০.৪

২,৭৩৪.০

৫০.১৯৪

১.৩১

১.৮০

*Data on investment for 1982-3 are World Bank projections.

সূত্র: TABLE 1, Financing investment in Bangladesh 1973-83 (Taka m. at current prices) Reza et al., p.24, Rehman Sobhan and Debapriya Bhattacharya, Courting Private Foreign Investment: The Bangladesh experience, Development Policy Review (SAGE, London, Beverly Hills and New Delhi), Vol. 4 (1986), 211-232.

১৯৭১ সালে বহুজাতিক করপোরেশন গ্ল্যাক্সো, ফাইজার, আইসিআই এবং অরগ্যানোন ছাড়াও পাকিস্তান টোব্যাকো, লিভার ব্রাদার্স, পাকিস্তান অক্সিজেন এবং ফিলিপস কোম্পানি তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে। পেট্রোলিয়াম ড্রিলিং, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে অতিজাতিক করপোরেশনের আধিপত্য ছিল এবং অভ্যন্তরীণ নদী পরিবহণ ব্রিটিশ কোম্পানির নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। ব্রিটিশ পুঁজির মালিকানাধীন কয়েকটি চা কোম্পানি (ডানকান ব্রাদার্স, জেমস ফিনলে, শ ওয়ালেছ) যুদ্ধ-পূর্ব সময়ে যেমন তাদের পুঁজিকে নিরাপদ এবং মুনাফাকে নিশ্চিত করতে পেরেছিল, যুদ্ধোত্তরকালীনও সে ধারা অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয়। রাষ্ট্রায়ত্তকরণ কর্মসূচির সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানি পুঁজি বাদে শিল্পোন্নত রাষ্ট্রের পুঁজিপতিদের মুনাফা সম্প্রসারণ এবং নিজ দেশে অর্থ পাঠানোয় কোনো ধরনের বাধার সম্মুখীন হতে হয়নি। প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন যে, সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির পরিমাণ বাংলাদেশে বিশাল আকারের না হলেও এর রাজনৈতিক দিক, বিশেষ করে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র-সংস্থার প্রভাব যথেষ্টভাবেই অব্যাহত ছিল।১৬

ছক- ৩১: বাংলাদেশে খাতওয়ারি পিএফআই, ১৯৭৩-১৯৮৩ (১৯৯৮২-৮৩ দামস্তর অনুযায়ী, কোটি মার্কিন ডলার)১৭

সাল

খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ

তামাক

টেক্সটাইল

ফার্মাসিউটিক্যালস

অন্যান্য কেমিক্যালস

মেটাল

ইলেকট্রিক্যাল পণ্য

ইলেকট্রনিকস

বিবিধ

মোট পিএফআই

১৯৭৩-৪

০.০২৪

০.০২৪

১৯৭৪-৫

০.০১৪

০.০০৫

০.০১৯

১৯৭৫-৬

২.৯০১

০.০০১

২.৯০২

১৯৭৬-৭

০.০৯২

০.০০৩

০.০১৪

০.০০৩

০.১১২

১৯৭৭-৮

০.৬৩৮

০.০৬১

০.৬৯৯

১৯৭৮-৯

১.৫০৮

০.০১১

০.০১৯

০.০১

১.৫৪৮

১৯৭৯-৮০

০.৪২৮

০.১৮১

০.০০৪

০.০১

০.৬২৩

১৯৮০-৮১

০.১৪১

০.৭৩৯

০.০৩৬

০.১৮৩

০.০২৮

০.০৬

১.১৮৭

১৯৮১-৮২

০.০১৩

০.২৩৩

০.০৮২

০.৩২৮

১৯৮২-৮৩

০.৮৬২

০.১৬৮

০.২৫৩

০.০১৯

০.০৫

০.০৩৯

০.৭২১

২.১১২

মোট পিএফআই (নগদ)

৬.৪৫৩

০.১৬৮

০.৬০৪

০.০১৪

০.৭৫৮

০.১৩৬

০.২৩৩

০.৩

০.৮৮৮

৯.৫৫৪

নির্দিষ্ট খাতে পিএফআই-এর শতাংশ (মোটের ওপর)

৬.৭৫৪

০.১৭৬

০.৬৩২

০.০১৫

০.৭৯৩

০.১৪২

০.২৪৪

০.৩১৪

০.৯২৯

 

সূত্র: TABLE 1, Financing investment in Bangladesh 1973-83 (Taka m. at current prices) Reza et al., p.24,  Rehman Sobhan and Debapriya Bhattacharya, Courting Private Foreign Investment: The Bangladesh experience, Development Policy Review (SAGE, London, Beverly Hills and New Delhi), Vol. 4 (1986), 211-232.

সামরিক শাসন-পূর্ব সময়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিদেশি ব্যক্তি বিনিয়োগের পরিমাণ বেড়ে গেলেও অর্থনীতিতে মোট বিনিয়োগের তুলনায় তার গড় হারের ক্ষেত্রে এই পরিবর্তন খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু ছিল না। একটি গবেষণায় দেখা যায় যে, ১৯৮২ সালের দিকে যেখানে সিঙ্গাপুরে পিএফআই ছিল ২০০ কোটি মার্কিন ডলার, মালয়েশিয়ায় ১০০ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি এবং পাকিস্তান ও শ্রীলংকায় ৬ কোটি মার্কিন ডলার।১৮ সে হিসেবে বাংলাদেশে পিএফআই-এর পরিমাণ তুলনামূলক কম (বিদেশি বিনিয়োগের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রভাবের দিকগুলো যে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ তা নিয়ে পরবর্তী অধ্যায়ে পর্যালোচনা হাজির করা হবে)।

যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয়করণ কর্মসূচির সময়কালেও ম্যানুফ্যাকচারিং খাত অর্থনীতিতে কৃষির পর দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল। বাস্তবে দেখা যায় যে, শাসক শ্রেণির রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে উত্পাদনী খাতকে প্রাধান্য দিয়ে অর্থনীতির ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করার কোনো ধরনের কর্মসূচি ছিল না। অন্যদিকে বহুজাতিক-অতিজাতিক করপোরেশনের স্থানীয় বাজার বিস্তারে সরকারের সহযোগী ভূমিকার কারণে স্থানীয় পুঁজির মালিকদের বিদেশি কোম্পানির স্থানীয় এজেন্ট হওয়ার ক্ষেত্রে বেশি আগ্রহী হতে দেখা যায়। উদাহরণ হিসেবে ১৯৭৭ থেকে ১৯৮২ সাল নাগাদ দেশীয় ম্যানুফ্যাকচারিং এবং বাণিজ্যিক খাতগুলোর তুলনা উল্লেখ করা যায়। ১৯৭৭ সালে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের অংশগ্রহণ যেখানে ছিল শিল্পখাতের ৪৫.২ শতাংশ, সেখানে ১৯৮২ সাল নাগাদ কমে এসে দাঁড়ায় ২৪.৮৬ শতাংশে। অন্যদিকে বাণিজ্যিক বিভিন্ন খাতের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই খাতে ১৯৭৭ সালে অংশগ্রহণ ছিল ২০.০৯ শতাংশ; ১৯৮২ সাল নাগাদ পর্যন্ত ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়ে এই হার দাঁড়ায় ৬৯.০৭ শতাংশে। এ ছাড়া ‘বিবিধ’ খাতের ভূমিকা ৩৪.১৪ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়ায় ৬.১৩ শতাংশে (এ সমস্ত খাত যে ব্যবসা-বাণিজ্যের মুনাফার সঙ্গে সম্পর্কিত তা বলাই বাহুল্য)। ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের ব্যয়ের বিনিময়ে বাণিজ্যিক খাতের এই ক্রমবৃদ্ধি অর্থনীতির গতিপথ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কোনো কোনো গবেষক অবশ্য ১৯৮০ সালটিকে এই পরিবর্তনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বছর হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এ বছরটিতে ম্যানুফ্যাকচারিং খাত থেকে বাণিজ্যিক খাতের দিকে একটি উল্লম্ফন ঘটে। ম্যান্যুফ্যাকচারিং খাতের অংশগ্রহণ ৪১.৬৪ শতাংশ থেকে ২০.২৫ শতাংশে নেমে আসে, অন্যদিকে বাণিজ্যিক খাতে এই হার বেড়ে দাঁড়ায় ৪১.০৫ শতাংশ থেকে ৬৮.৭৩ শতাংশে।১৯

অন্যদিকে মাইনিং থেকে শুরু করে উত্তোলন সংক্রান্ত খাত এবং সেবা-পরিষেবা ও কৃষি, পরিবহণ, যোগাযোগ খাতে বিদেশি ব্যক্তি বিনিয়োগ তুলনামূলকভাবে উল্লেখযোগ্য ছিল না। ১৯৭৭-৮২ সাল নাগাদ বিদেশি মোট বিনিয়োগ সাপেক্ষে বাণিজ্যিক খাতে পিএফআই-এর হার ছিল ৫৬.৩ শতাংশ এবং ম্যান্যুফ্যাকচারিং খাতে ছিল ৩০.৮ শতাংশ। ‘বিবিধ’ খাতে ১২.৪২ শতাংশ। এ ছাড়া আরও অন্যান্য খাত মিলিয়ে এই হার ১ শতাংশের বেশি হয়নি। জাতীয় ক্ষেত্রের অর্থনৈতিক বিন্যাসে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী যেমন কাঠামোগত সমন্বয় করা হয়েছিল সামরিক সরকারের সময়ে তেমনি বিদেশি ব্যক্তি বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও কাঠামোগত পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। উল্লেখ্য যে কেমিক্যাল, ফার্মাসিউটিক্যালস এবং পেট্রোলিয়াম খাতে রাষ্ট্রের সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যুদ্ধ-পূর্ব সময়ের তুলনায় হ্রাস পায়। অন্যদিকে পিএফআই-এর হার বৃদ্ধি পায় খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে (প্রাথমিকভাবে গভীর সমুদ্রে মাছ শিকার খাতের সঙ্গে সম্পর্কিত)। ১৯৭৩-৮৩ সালে এই হার ছিল মোট বিনিয়োগের ৬৭.৫৪ শতাংশ।

‘কাঠামোগত সমন্বয় কর্মসূচি’র অধীন সরকার রপ্তানিনির্ভর শিল্পায়নকে গুরুত্ব দিয়ে পরিকল্পনা কর্মসূচি গ্রহণ করলে পিএফআই-এর ক্ষেত্রেও বিন্যাস লক্ষ করা যায়। কেমিক্যাল শিল্পে (ফার্মাসিউটিক্যালস ছাড়া) বিনিয়োগ হয় ৭.৯৩ শতাংশ, ইলেকট্রনিকস খাতে এই হার দাঁড়ায় ৩.১৪ শতাংশ। কোনো কোনো গবেষক এই পরিবর্তনকে ব্যাখ্যা করে বলেছেন, “This change of sectoral emphasis of PFI may in part be explained by the overall shift of the development policy of Bangladesh towards a more export-oriented growth strategy designed to attract foreign capital into sectors with export prospects.”।২০ উল্লেখ্য যে, পূর্বেকার রাষ্ট্রের সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে, বিশেষ করে বহুজাতিক করপোরেশনগুলোর ক্ষেত্রে। স্থানীয় উদ্যোক্তাদের সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অনেক বেশি আগ্রহ দেখা যায়। এ ক্ষেত্রেও লভ্যাংশ এবং বাজার নিশ্চয়তার জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা অব্যাহত থাকে। কারণ, “Those pharmaceutical transnationals seeking an outlet in Bangladesh prefer to go in for licensing arrangements with local entrepreneurs rather than to risk equity participation. This guarantees them access for their brand names and a market for their formulations without staking their own capital.”২১

ছক- ৩২: বাংলাদেশে বিদেশি ব্যক্তি বিনিয়োগ (বিভিন্ন দেশের অংশগ্রহণ) (মোটের ওপর শতকরা হার)২২

দেশ

বিনিয়োগের অংশ (১৯৭৪-৮৪)

রেমিট্যান্সের অংশ (১৯৭৬-’৮৪)

কানাডা

১১.৬

০.৩

জার্মানি (এফআর)

৪.৮

০.১৫

জাপান

১৬.৯

নেদারল্যান্ডস

৩.৭

০.৭

সুইডেন

১৪.৫

০.১

সুইজারল্যান্ড

৪.৪

৩.৭

যুক্তরাজ্য

৩.৯

৭৭.০

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র

৪.৭

১৫.৬

বাহরাইন

১.৫

হংকং

৩.৪

ভারত

১.০

০.৩

সিঙ্গাপুর

১৩.৪

দক্ষিণ কোরিয়া

৮.৩

০.০১

সূত্র: TABLE 3, Private foreign investment by major countries: country source and profits and dividends (% of total), for share of investment, Department of Industries; for share of remittances, Bangladesh Bank, Statistics Department. Rehman Sobhan and Debapriya Bhattacharya, Courting Private Forein Investment: The Bangladesh experience, Development Policy Review (SAGE, London, Beverly Hills and New Delhi), Vol. 4 (1986), 211-232.

ব্যক্তি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশের অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে পরিবর্তন হয়েছে। অন্যান্য দেশের চেয়ে জাপান এককভাবে শীর্ষে ছিল। পরবর্তী সময়ে এ অবস্থানের পরিবর্তন ঘটে। এবং মোট বিনিয়োগের প্রায় ৫৩.৮ শতাংশ বিনিয়োগ করা হয়েছে অগ্রণী শিল্পোন্নত দেশগুলো থেকে। দেখা গেছে, বাংলাদেশে বিদেশি পুঁজির বিনিয়োগকৃত ১০৯টি ফার্মের মধ্যে প্রায় ৪৭টি ফার্ম ছিল পশ্চিম ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। ‘উন্নয়নশীল’ দেশগুলোর মধ্যে সিঙ্গাপুরের ব্যক্তিমালিকানাধীন ফার্ম ছিল সবচেয়ে বেশি (১৩টি ফার্ম)। পুঁজি বিনিয়োগ এবং প্রতিষ্ঠানের সংখ্যার দিক থেকে শিল্পোন্নত দেশগুলোর পুঁজিপতিদের বিনিয়োগের পরেই ‘উন্নয়নশীল’ দেশগুলোর বিনিয়োগ ক্রমাগত বেড়েছে।

বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ হয়েছে বিভিন্ন ধরনে। কখনো প্রযুক্তিগত সহযোগিতার নামে; কখনো মার্কেটিং ও ম্যানেজমেন্ট কোলাবোরেশন নামে, কখনো লাইসেন্সিং প্রক্রিয়া এবং যৌথ বিনিয়োগের নামে। ১৯৭৪ সালে বিদেশি যৌথ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিধিবিধান শিথিল করা হয়, সেই সুযোগে বিদেশি অংশীদাররা তাদের শেয়ারের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে সচেষ্ট হয়। পরবর্তী সময়ে যখন বিদেশি বিনিয়োগের সীমা তুলে দেওয়া হয় তখন বাংলাদেশে অবাধ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে তাদের আর কোনো বাধা রইল না। অগ্রগামী শিল্পোন্নত দেশের বিনিয়োগকে প্রকৃত অর্থে রাষ্ট্রীয়করণের বাইরে রাখার উদ্দেশ্য ছিল প্রথম থেকেই। যার জন্য কিছুদিনের মধ্যে স্থানীয় বিনিয়োগের মধ্যে তাদের অন্তর্ভুক্ত করার নানাবিধ উদ্যোগ গ্রহণ করতে দেখা যায়। ১৯৭৪-৭৫ সাল নাগাদ বিদেশি পুঁজির সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগ যেখানে ছিল শতকরা প্রায় ৫০ ভাগের মতো; বিনিয়োগের সীমা এবং বিনিয়োগ ও মুনাফার ক্ষেত্রে বিভিন্ন বাধা অপসারণের পর ১৯৭৮-৭৯ সাল নাগাদ তার হার বেড়ে দাঁড়ায় ৮৭ শতাংশ এবং ১৯৮২-৮৩ সাল নাগাদ তা ৯৮.৯ শতাংশে এসে পৌঁছে। বিনিয়োগের সম্ভাব্য আকর্ষণীয় ক্ষেত্র হওয়ার কারণে ১৯৭৪ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত প্রায় প্রতিবছর বড় আকারের এক বা একাধিক বিনিয়োগ প্রস্তাব আসে বাংলাদেশে।

উল্লেখ্য যে, বিদেশি বিনিয়োগের যে পরিসংখ্যান পাওয়া যায়, তা কিন্তু প্রতিবছরই উত্সদেশ থেকে আসা নতুন বিনিয়োগ নয়; পুরাতন বিনিয়োগেরই বর্ধিত অংশের সমন্বয়ে গঠিত। প্রথমাবস্থায় বিনিয়োগকৃত পুঁজির সঙ্গে এ দেশের সস্তা শ্রমশক্তি, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রভৃতির মধ্য দিয়ে যে বর্ধিত পুঁজি অর্জিত হয়েছে সে অংশকেও নতুন বিদেশি বিনিয়োগের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মোটকথা, পুনর্বিনিয়োগকৃত বিদেশি ব্যক্তি বিনিয়োগই সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের মূল ধরন।২৩

বাংলাদেশে শিল্পায়নের ভিত্তি এবং তার প্রয়োজনে প্রযুক্তিগত সক্ষমতা তৈরি–এর কোনোটিই যে বিদেশি বিনিয়োগের মনোযোগের কেন্দ্রে ছিল না, তা বলাই বাহুল্য। বরং তার বিপরীতে, অবস্থাদৃষ্টে প্রমাণিত যে, মুনাফা সর্বোচ্চকরণে যে যে ধরনের সুযোগ তৈরি করা কিংবা সুযোগের সদ্ব্যবহার করা প্রয়োজন, ক্ষমতাবান শ্রেণির পৃষ্ঠপোষকতার মধ্য দিয়ে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা তার সবটুকুই আয়ত্ত করতে পেরেছে। রেহমান সোবহানদের গবেষণা অনুযায়ী, “In the sectoral pattern, a marked shift has taken place in favour of commerce. This means that even the small amount of foreign private capital which is coming into the country is attracted more to the circulation phase of the reproduction system of the economy than to production. It contributes relatively little to the process of industrialization and the enhancement of the country’s technological capabilities”. এমনকি, “in the case of fresh capital brought in, the share of capital equipment has been small, so that the contribution of new PFI to capital formation has been less than its value. One of the important facets of PFI in Bangladesh, which to some extent signifies at least its short-run effect, is that it puts pressure on the country’s balance of payments. Remittance of profits and dividends constitutes a net drain on the external accounts of Bangladesh, which is now an exporter of capital to the rest of the world. All these characteristics of PFI in Bangladesh indicate, within the given context of the country, how foreign capital objectively responded to the different measures targeted to attract PFI and to direct it towards a desirable (Foreign capitalist’s own) social goal”।২৪

অন্যদিকে যা এসেছে তার বিপরীতে গেছে কত–মুনাফা, লভ্যাংশ ও মূলধন? এককথায় বলা চলে, বহুগুণ এবং বহু বছর ধরে (এ সম্পর্কিত দুটি ছক তথ্যপঞ্জিতে দেওয়া হলো)।২৫ ব্রিটিশ এবং পাকিস্তান আমলে যেভাবে এ অঞ্চলের সম্পদ ব্রিটেনে এবং পাকিস্তানে পাচারের ব্যবস্থা হয়েছিল, স্বাধীন বাংলাদেশে এ দেশের শাসক শ্রেণি পরিকল্পিতভাবে আইনি বিধিবিধানের মাধ্যমে ‘‘net drainage of resources’’ প্রক্রিয়াকেই স্থায়ী রূপ দিতে সক্ষম হয়।

একদিকে বিদেশি পুঁজির২৬, পণ্যের বাজার বিস্তৃতি দখলের মধ্য দিয়ে মুনাফা আহরণ এবং নিজ নিজ দেশের সম্পদ, সঞ্চয় বৃদ্ধি; অন্যদিকে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোয় তুলনামূলক সুবিধাপ্রাপ্ত স্থানীয় শিল্প গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিবিধ প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা–পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের কেন্দ্রীয় এই দর্শনকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে২৭ বাংলাদেশ নির্মাণের প্রচেষ্টা শুরু করে সামরিক সরকার২৮। এর ফলে কাদের জীবনমান পর্যুদস্ত হয় এবং কারা লাভবান হয়? সার্বিকভাবে, আনু মুহাম্মদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী,

“বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বণিক পুঁজির যে দাপট, উত্পাদনের সঙ্গে সম্পর্কহীন পণ্য সঞ্চালনের মধ্য দিয়েই যার বৃদ্ধি, তার সাক্ষাৎ মানব প্রতিনিধি হচ্ছে ব্যবসায়ী এবং কথিত শিল্পপতিরা। আমদানি-রপ্তানি, ইনডেন্টিং, বহুজাতিক সংস্থার সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান, গার্মেন্টস ইত্যাদি ক্ষেত্রে এদের বিপুল প্রসার দেশে বহুসংখ্যক কোটিপতি সৃষ্টি করেছে। তাদের এই সৌভাগ্যও সাম্রাজ্যবাদ দ্বারা নির্ধারিত ও পরিপুষ্ট। সংঘবদ্ধভাবেই এরা এখন নিজেদের স্বার্থ পূরণের জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রকে পরিচালিত করে, তাদের চাওয়ার সঙ্গে আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকের সুপারিশ (সঠিকভাবে বললে চাপ) খাপে খাপে মিলে যায়। সেগুলো পূরণের জন্য প্রয়োজনে বাকরুদ্ধ করা হয় জনগণকে। কাঁচামাল কিংবা সস্তা শ্রমশক্তির মাধ্যমে তৈরি অর্ডার দেওয়া পণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে সরবরাহ এবং বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর পণ্যের বাজার এ দেশে নিশ্চিতভাবে বজায় রাখার ব্যাপারে তাদের এবং সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থ একীভূত। আন্তর্জাতিক পুঁজির সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন দেশীয় বণিক পুঁজির বিকাশই জাতীয় উন্নয়ন হিসেবে পরিগণিত। এই উন্নয়নের বাধা অপসারণের জন্য যে ধরনের রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন, সেগুলো গ্রহণে রাষ্ট্রের কোনো কার্পণ্য নেই।’’২৯

ফলে (আনু মুহাম্মদের বক্তব্য অনুযায়ী),

“বাংলাদেশে বর্তমানে অনুত্পাদক শাসক শ্রেণির জীবিকার ধরনে কোনো শৃঙ্খলা নেই—তাদের শোষণ প্রক্রিয়াও শৃঙ্খলাবদ্ধ প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি পায়নি, যেমনটি পেয়েছে পুরনো পুঁজিবাদী ব্যবস্থায়। সে কারণে এখানে শাসক শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত উচ্চবিত্ত মধ্যবিত্ত, কোটিপতি অ-কোটিপতি সবারই জীবিকা অর্জনের, তার রক্ষণের, এর মাধ্যমে নিশ্চিত ভবিষ্যতের কোনো নিশ্চয়তা নেই। আয়-উপার্জন হচ্ছে বিভিন্ন চোরাগোপ্তা পথে, ব্যয়ের ধরনেরও ব্যক্তিক্রম দেখা যায় না। সে কারণে অস্থিরতা আছে, প্রতিযোগিতার নগ্ন বীভত্সতা আছে। এবং নিজেদের স্বার্থপূরণের কাজ করার মধ্য দিয়ে সাম্রাজ্যবাদের শৃঙ্খলকে রক্ষা করা, তাকে শক্তিশালী করা, এখানে বিদ্যমান ব্যবস্থায় আরও লুটপাটের অ্যাভিনিউ সৃষ্টি করার জন্য আছে সোল্লাস অস্থিরতা।’’৩০(চলবে)

আগের কিস্তি: ২২ পরিবারের অতীত ও বর্তমান-১০

মেহেদী হাসান: গবেষক, লেখক। ইমেইল: mehedihassan1@gmail.com

তথ্যসূত্র ও টীকা

শিরোনাম: Media and Globalization: An Interview with Noam Chomsky, interviewed by P. Sainath, Published by Third World Network, Monday, July 1, 1996, https://www.corpwatch.org/article/media-and-globalization

সিআইএ দেশে দেশে; সম্পাদনা: দেবেন সিকদার, বুলবুল প্রকাশনী, চট্টগ্রাম, ১৯৮৬, পৃ. ৮৬-৮৯।

শিরোনাম: In Conversation with Lawrence Lifschultz, The daily star, Thu Dec 4, 2014 04:55 PM, Last update on: Wed Dec 2, 2015 08:21 PM, Url: https://www.thedailystar.net/in-conversation-with-lawrence-lifschultz-53386 এবং Lawrence Lifschultz, Bangladesh: The Unfinished Revolution; , Zed Press, London N1, July 1979.

Syed Serajul Islam, The State in Bangladesh under Zia (1975-81), Source: Asian Survey, Vol. 24, No. 5 (May, 1984), pp. 556-573, Published by: University of California Press, Stable URL: http://www.jstor.org/stable/2644413.p.564.

—Ibid—p.566.

—Ibid—

রেহমান সোবহানের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, “three central limitations of Bangladesh’s past industrial policies: (i) the absence of strategic vision in the formulation of industrial policies, (ii) prevalence of ideological predilections over pragmatic and empirical considerations specially in the matters of ownership of enterprises and (iii) the abortive attempt at promoting private industry through public credit.” Rehman Sobhan; An Industrial Strategy for Industrial Policy : Redirecting the Industrial Development of Bangladesh in the 1990s, The Bangladesh Development Studies Vol. XIX, March-June 1991, Nos. 1 & 2, p.201, Stable URL: http://www.jstor.org/stable/40795402

“The issue of stimulating private investment has also remained common to all industrial policies. Successive policies in this area have sought to make adjustments in policy rather than to enunciate any quantum shifts in the incentive structures for promoting industrialisation. … Industrial policies in Bangladesh thus serve as an excellent example of policy formulation without a strategic vision”. Rehman Sobhan; —Ibid—

A.M. Quamrul Alam (1989), Privatisation policy and the problem of industrial development in Bangladesh, South Asia: Journal of South Asian Studies, 12:2, 49-68, DOI: 10.1080/00856408908723127, http://dx.doi.org/10.1080/00856408908723127, p.63.

১০—Ibid—p.64.

১১“The investment ceiling was raised to Taka 100m. and a series of important policy measures were initiated to increase the role of the private sector, both indigenous and expatriate, in the field of industrial development. Subsequently this investment ceiling was abolished and at present there is virtually no ceiling on private (including foreign) investment, though permission has to be sought at different levels of the government, depending upon the value of the investment involved.” Rehman Sobhan and Debapriya Bhattacharya, Courting Private Forein Investment: The Bangladesh experience, Development Policy Review (SAGE, London, Beverly Hills and New Delhi), Vol. 4 (1986), 211-232.

১২’Policies Without Strategy’ প্রসঙ্গে রেহমান সোবহান বলছেন, “In Bangladesh most such policies degenerate into proforma exercises which do little to promote the pace and direction of industrialisation. Their influence where it works tends to degenerate into providing bureaucrats with the opportunity to use the policy to extract rents from one or another provision of the policy. Industrial policies in Bangladesh thus serve as an excellent example of policy formulation without astrategic vision. Whilst four Five Year Plans have been formulated and two major donor funded studies carried out to assist in the formulation of industrial policy, the industrialisation of the country continues to move on essentially ad hoc impulses. The Five Year Plans have been useful in identifying the priorities for public sector industrial investment. Though even in this area the actual direction of public investment has derived more from the priorities assigned by particular donors to finance a particular project rather than investment programmes which reflect the slated priorities of the Government of Bangladesh (GOB).” Rehman Sobhan; An Industrial Strategy for Industrial Policy : Redirecting the Industrial Development of Bangladesh in the 1990s, The Bangladesh Development Studies, Vol. 19, No. 1/2, Industrial Policies and State of Industrialization in Bangladesh (March-June 1991), pp. 201-215 URL: http://www.jstor.org/stable/40795402.

১৩“The launching of the NIP in 1982 by the new martial law regime must thus be viewed as a continuation of the policy changes initiated in 1975 with a view to promoting private enterprise and to providing a new impetus in the drive to solicit PFI to come to Bangladesh. It is worth recollecting that early in March 1982, on the eve of the declaration of martial law, Jamaluddin Ahmad, the Minister of Industries, aided by UNIDO, hosted a large gathering of prospective private foreign investors with a view to impressing on them the worth of Bangladesh as a host to PF1.U The NIP thus represented no qualitative change in the direction of the current policy towards PFI. Besides reiterating the government’s sincere commitment to PFI, the NIP merely broadened the existing incentive scheme (fiscal, infrastructural, taxation and other facilities), simplified the sanctioning procedure and identified the preferred areas of foreign investment.” Rehman Sobhan and Debapriya Bhattacharya, Courting Private Forein Investment: The Bangladesh experience, Development Policy Review (SAGE, London, Beverly Hills and New Delhi), Vol. 4 (1986), 211-232.

১৪—Ibid—

১৫—Ibid—

১৬রেহমান সোবহান এবং দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের গবেষণা অনুযায়ী, “The equity share of PFI in the domestic economic structure inherited at independence was thus not only quantitatively insignificant but also, outside a few sectors, only marginally relevant to the performance of the economy. This is not to say that external influences over the Bangladesh economy were unimportant. The control of the East-wing economy by West Pakistani capitalists who dominated the available private investment options in the region constituted a form of surrogate foreign investment which reproduced many of the socio-economic conditions associated with the dominant presence of PFI in a less developed economy.” —Ibid—

১৭—Ibid—

১৮—Ibid—

১৯—Ibid—

২০—Ibid—

২১—Ibid—

২২—Ibid—

২৩“During the period 1977-82 the structure of sources of financing has undergone a remarkable change. In 1977 the majority of the PFI came in through direct remittances from abroad in the form of cash (52.3%), but in 1982 the share of such remittances had gone down to only 14.6%. This exogenous financial flow of capital is supplemented physically by capital equipment imported into the country in lieu of, or in part payment of, a foreign investor’s equity share. This component has, however, never risen above 14.9% in one year (1979), with the lowest limit being 0.01% (1980). The combination of financial resources and equipment brought in from abroad in aggregate constitutes the full value of PFI coming from outside. In contrast, the share contributed by the reinvested earnings of foreign investors in total PFI during this same period increased from 47% to 84.3%. Despite some variations in this pattern in 1979 and 1981, this tendency for foreign investors already operating in Bangladesh to emerge as the principal source of capital derived from their operating surpluses has become manifest. On average, during the period 1977-82,69% of the PFI in Bangladesh came from reinvested earnings, whereas 30.8% (26.6% as cash and 4.2% as capital equipment) came from outside.” —Ibid—

২৪—Ibid—

­২৫ ছক: যথাক্রমে ৩৩ ও ৩৪। বিদেশি কোম্পানিগুলোর উত্স দেশে অর্থ পুঁজি পাঠানোর পরিমাণ এবং হার

 

সূত্র: TABLE-4,5. Breakdown of remittances by foreign companies for major countries (1976-83) (Taka m.) and Private foreign investment and foreign company remittances, 1976-84 (Taka m.). Statistics Department, Bangladesh Bank. —Ibid—

২৬“In the sectoral pattern, a marked shift has taken place in favour of commerce. This means that even the small amount of foreign private capital which is coming into the country is attracted more to the circulation phase of the reproduction system of the economy than to production. It contributes relatively little to the process of industrialization and the enhancement of the country’s technological capabilities.” —Ibid—

২৭“Indeed, the political instability of the country is itself a product of an underdeveloped infrastructure, inadequate institutions, unsatisfactory logistics, all of which constitute a serious constraint for potential investors. The gravity of these factors is sufficient to neutralize the effect of the lucrative incentive packages on offer along with the supply of cheap labour in the country.” —Ibid—

২৮“The Government thus remains dependent on private entrepreneurs acting according to their reading of the market to make their choices.” Rehman Sobhan; An Industrial Strategy for Industrial Policy : Redirecting the Industrial Development of Bangladesh in the 1990s, The Bangladesh Development Studies, Vol. 19, No. 1/2, Industrial Policies and State of Industrialization in Bangladesh (March-June 1991), pp. 201-215 URL: http://www.jstor.org/stable/40795402.

২৯সিআইএ দেশে দেশে; সম্পাদনা: দেবেন সিকদার, বুলবুল প্রকাশনী, চট্টগ্রাম, ১৯৮৬, পৃ. ৯২।

৩০সিআইএ দেশে দেশে; সম্পাদনা: দেবেন সিকদার, বুলবুল প্রকাশনী, চট্টগ্রাম, ১৯৮৬, পৃ. ৯২।

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •