সামরিক শাসন: বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ-এর ‘সংস্কার’ কর্মসূচির ‘স্বর্ণদশক‘

২২ পরিবারের অতীত ও বর্তমান-১২

সামরিক শাসন: বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ-এর ‘সংস্কার’ কর্মসূচির ‘স্বর্ণদশক‘

মেহেদী হাসান

বাংলাদেশে পুঁজিবাদের বিকাশ উল্লেখযোগ্য আকার নিয়েছে। এই বিকাশধারায় একদিকে তৈরি হয়েছে পাকিস্তানের ২২ পরিবারের চেয়েও সম্পদশালী বেশ কিছু গোষ্ঠী, অন্যদিকে বৈষম্য ও পরিবেশ বিধ্বংসী তৎপরতাও অভূতপূর্ব মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে ‘উন্নয়ন’ ধারার স্বরূপ বিশ্লেষণ, পুঁজির কেন্দ্রীভবনের ধরন, শ্রেণীবিন্যাস, এই ধারার পুঁজিবাদ বিকাশে রাষ্ট্রের ভূমিকা ইত্যাদি পরীক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান প্রবন্ধ কয়েক কিস্তিতে এই অনুসন্ধান বিশ্লেষণ হাজির করছে। দ্বাদশ কিস্তিতে জিয়াউর রহমান শাসনামলে ‘সংস্কার‘ কর্মসূচির নামে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প-কারখানা ব্যক্তি খাতে তুলে দেওয়ার প্রক্রিয়া, ব্যক্তি খাতে উদারহস্তে ঋণ প্রদান এবং আদায়ের অসামঞ্জস্যতা এবং এই প্রক্রিয়ায় নব্য বিত্তশালীদের হাতে সম্পদ পুঞ্জীভবন বিষয়ে পর্যালোচনা হাজির করা হয়েছে।

‘‘বুর্জোয়া রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ধরণগত পার্থক্য রয়েছে কিন্তু তাদের মূলগত বৈশিষ্ট্য একই: ধরণগত ভিন্নতা যতই থাকুক, সবগুলোই; শেষ বিচারে, বুর্জোয়া একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্র।’’-ভ. ই. লেনিন

‘‘বাংলাদেশের শাসকশ্রেণী সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কিত তার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়ার ফলে তার অস্তিত্ব, বিকাশ, স্ফীতি, প্রবণতা সাম্রাজ্যবাদী পুঁজি দ্বারা নির্ধারিত নিয়ন্ত্রিত।’’– আনু মুহাম্মদ

প্রত্যক্ষ সামরিক শাসন লুম্পেন পুঁজির বিকাশ

সামরিক শাসনামল ছিল রাষ্ট্রীয় পুঁজির ক্ষয় এবং ব্যক্তি পুঁজির উত্থান যাত্রার আয়োজন পর্ব। দেশের অর্থনীতিকে ‘নয়া উদারনৈতিক’ বাজার ব্যবস্থার দিকে নিয়ে যাবার ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের শাসকশ্রেণীই প্রথম অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।এবিষয়ে আনু মুহাম্মদ বলেছেন, ‘‘৮০-র দশকটি হলো বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ-এর ‘সংস্কার’ কর্মসূচির ‘স্বর্ণ-দশক’’ এবং ‘‘এই দশকটিতেই বাংলাদেশে সামরিক শাসন কখনও প্রত্যক্ষ কখনও পরোক্ষভাবে বলবৎ ছিল’’। সামরিক বাজেটও দ্রুত বাড়ানো হয়েছে এসময়ে।

১৯৭৫ সালে প্রতিরক্ষা বাজেট ছিল ৩.৪ কোটি মার্কিন ডলার বা জিএনপির ০.৭%। ১৯৭৮ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে ১৩ কোটি মার্কিন ডলারে (মোট জিএনপি-র ১.৮%) দাঁড়ায়। অন্য আরেকটি হিসাবে দেখা যায় যে, ‘‘মুজিব-শাসনামলের প্রতিরক্ষা বাজেট সংশোধন করে ৭৫ কোটি টাকা (জাতীয় বাজেটের ৭%) থেকে বাড়িয়ে ১১০.৯৩৪ কোটি টাকা (জাতীয় বাজেটের ২০%) করা হয়।’’ তবে এই বৃদ্ধি শুধু প্রতিরক্ষা ব্যয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। সাধারণ প্রশাসন ও পুলিশের সংখ্যাও বৃদ্ধি করা হয়। সামরিক শাসনের প্রথম দুই বছরে ‘‘প্রতিরক্ষা ও বেসামরিক প্রশাসনের ব্যয় ২০০ কোটি টাকারও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছিল, যেখানে অন্য সব খাতওয়ারী ব্যয় একত্রে ১০০ কোটি টাকারও কম বৃদ্ধি পেয়েছিল’’। যুদ্ধোত্তর সময় থেকে যে খাতটি অন্যান্য খাতের তুলনায় ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে সেটি হলো এই সামরিক খাত। পাশাপাশি, ১৯৭৯ সালের বিএনপির শাসনামল থেকে ধনী পরিবারের লোকজন ধীরে ধীরে রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি রাষ্ট্রযন্ত্রের শীর্ষ পদে অধিষ্ঠিত হয়।

রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী, প্রক্রিয়াগত নানা ধরনের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে ‘রাষ্ট্রায়ত্ত খাত নির্ধারক’ এবং সাধারণভাবে লাভজনক ভূমিকায় ছিল (পাট ও বস্ত্র শিল্পে সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ, উৎপাদন, লাভ-ক্ষতি নিয়ে রেহমান সোবহান ও সৈয়দ আখতার মাহমুদের গবেষণা)১০। কিন্তু সরকারি মহল থেকে বাংলাদেশের অনুন্নয়ন-অনগ্রসরতার জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত খাতকে দোষারোপ করে ব্যক্তি খাতকে প্রাধান্য দিয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। সামরিক শাসনামলে এই খাতগুলোকে দুর্বল এবং বিনষ্ট করার উদ্যোগ জোরদার হয় ‘নয়া উদারবাদী’১১ দৃষ্টিতে। অনুপম সেন রাষ্ট্রখাত বিষয়ক বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরে বলেছিলেন,

‘‘১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষের পর রাষ্ট্রস্বত্বকেই দোষারোপ করা হয়েছিল বাংলাদেশের সর্ববিধ অর্থনৈতিক দুর্দশার জন্য। তখন থেকে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, বণিক-সংগঠন, এমনকি কয়েক দিন আগে দেশের প্রধানমন্ত্রীও (১০ জুলাই, ১৯৮৮) ’৭২-এর ‘সমাজতন্ত্রীকরণকে’ বা রাষ্ট্রখাতকেই দায়ী করেছেন শিল্পক্ষেত্রে বাংলাদেশের অনগ্রসরতার জন্য। কিন্তু এই বক্তব্য কি যথার্থ বা সত্য? বাংলাদেশ সরকারের অর্থ-মন্ত্রণালয়, অর্থ বিভাগ ও অর্থনৈতিক উপদেষ্টা উইং বাংলাদেশের অর্থনীতির গতি-প্রকৃতির যে চিত্র প্রতিবছর প্রকাশ করা হয় তা থেকে দেখা যাচ্ছে : ১৯৭২/৭৩ সালে ২৮৯.৫ কোটি টাকার শিল্পসামগ্রী উৎপাদিত হয়েছিল, ১৯৭৪/৭৫ সালে এই অঙ্কই ৫৪৮.১ কোটি টাকায় (৭২/৭৩-এর স্থিরীকৃত মূল্যে) উন্নীত হয়, অর্থাৎ দু’বছরে উৎপাদন প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। ১৯৮৫/৮৬ সালে সেটাই বেড়ে দাঁড়ায় ৮২৮.২ কোটি টাকায় (৭২/৭৩-এর স্থিরীকৃত মূল্যে)। এর থেকে স্পষ্টতই প্রতীয়মান, যেখানে মাত্র দু‘বছরে (১৯৭২/৭৩ থেকে ১৯৭৪/৭৫) শিল্প উৎপাদন ২৫৮.৬ কোটি টাকা ‍বৃদ্ধি পেয়েছিল সেখানে পরবর্তী দীর্ঘ এগারো বছরে সেই বৃদ্ধির পরিমাণ ছিল মাত্র ২৮০.১ কোটি টাকা। প্রশ্ন হতে পারে, এই দু‘বছরে (১৯৭২/৭২ থেকে ৭৪/৭৫) শিল্পখাতের উৎপাদন দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেলেও রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানাসমূহের লোকসান হয়তো এই অঙ্কে প্রতিফলিত হয়নি, যে লোকসান অন্য খাত থেকে এনে মেটানো হয়েছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে ১৯৭৩/৭৪, ১৯৭৪/৭৫ ও ১৯৭৫/৭৬ সালে দেশজ উৎপাদনবৃদ্ধির সার্বিক হারও (কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য ইত্যাদি সব খাত মিলিয়ে) ছিল যথাক্রমে ১১.৬, ৩.৫ ও ৯.৬ শতাংশ। বস্তুত ১৯৭৫/৭৬-পরবর্তী কোনো বছরেই দেশজ উৎপাদনবৃদ্ধির হার ১০ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছায়নি। বস্তুত মাথাপিছু আয়বৃদ্ধির হারও সবচেয়ে বেশি ছিল ১৯৭৩/৭৪ ও ১৯৭৫/৭৬ সালে – যথাক্রমে ৮.৫ ও ৬.৯ শতাংশ। ১৯৭৪/৭৫ সালের মুদ্রাস্ফীতির ও ‘দুর্ভিক্ষের বছরে’১২ দেশজ উৎপাদনবৃদ্ধির হার এবং মাথাপিছু আয়বৃদ্ধির হার যথাক্রমে ৩.৫ শতাংশ ও ১.৫ শতাংশে নেমে আসে (দুর্ভিক্ষের কারণ যত না প্রাকৃতিক তার চাইতে বহুগুণ ভূমিকা ছিল গুদামজাতকরণ, চোরাচালানি, আন্তর্জাতিক সংস্থা-রাষ্ট্রের ষড়যন্ত্র ইত্যাদির)। মাথাপিছু আয়বৃদ্ধি এই বছর খুব কমে গেলেও তা ধনাত্মকই (positve) ছিল। কিন্তু ১৯৭৬/৭৭, ১৯৭৯/৮০ ও ১৯৮১/৮২ সালে মাথাপিছু আয় বাড়ার পরিবর্তে -০.৭, -১.২, -১.৫ শতাংশ হারে হ্রাস পেয়ে ঋণাত্মক (negative) হয়ে দাঁড়ায়, অর্থাৎ মাথাপিছু আয় পূর্ববর্তী বছর থেকে পূর্বোক্ত হারে কমে আসে। ১৯৭৬/৭৭ ও ১৯৭৯/৮০ ছিল জেনারেল জিয়াউর রহমানের শাসনকাল ও ১৯৮১/৮২ জেনারেল এরশাদের শাসনামল। এই সময়ে বিশেষভাবে ১৯৭৭ সালের পরে রাষ্ট্রখাতের গুরুত্ব বিশেষভাবে হ্রাস করে ব্যক্তিখাতকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল, তা সত্ত্বেও অর্থনৈতিক অস্থিরতার উপশম হল না কেন?‘‘১৩

তিনি আরও বলেন,

‘‘বাংলাদেশে একটি পরনির্ভরশীল ধনতন্ত্র গড়ে তোলার জন্য, ‘অকৃপণ সাহায্যে’র হাত প্রসারিত করলো বিশ্বব্যাংক ও আই.এম.এফ (International Monetary Fund)।’’ এবং অন্যদিকে, ‘‘১৯৭৭-৭৮ সাল থেকে ব্যক্তি-উদ্যোগের মাধ্যমে শিল্পায়ন করার জন্য শিল্পঋণ সংস্থা, শিল্পব্যাংক ও বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে অবিরাম ধারায় রাষ্ট্রযন্ত্রের কৃপাধন্য বিভিন্ন ব্যক্তির উপর বর্ষিত হওয়া শুরু হল কোটি কোটি টাকার ঋণ। তৎকালীন সামরিক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বলেছিলেন, টাকা কোনো সমস্যা নয়, money is no problem। তাঁর এই বক্তব্যকে যথার্থতা দিয়ে, ১৯৭৭/৭৮ – ১৯৮০/৮১ কালপর্বে, মাত্র চার বছরে, কেবলমাত্র শিল্পব্যাংক ও শিল্পঋণ সংস্থা বিভিন্ন ব্যক্তি বা তথাকথিত শিল্পোদ্যোক্তাদের ৫৬৮ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন করে। একই সময়ে এই দুই সংস্থা থেকে রাষ্ট্রখাতের শিল্পের জন্য অনুমোদনপ্রাপ্ত ঋণের পরিমাণ ছিল ১৬.৯১ কোটি টাকা মাত্র। এই চার বছরে বেসরকারি খাত এই দুই সংস্থাকে ২৪.৪১ কোটি টাকা ঋণ পরিশোধ করে। একই সময়ে সরকারি খাতের ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ছিল ৬৭.৪২ কোটি টাকা, অর্থাৎ সরকারি শিল্পখাত থেকে পরিশোধ বাবদ রাষ্ট্রের প্রাপ্তি ঘটেছিল ৫০.৬০ কোটি টাকা।…একই সময়ে (১৯৭৭/৭৮-১৯৮০/৮১) বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকেও বিপুল পরিমাণে ঋণ দেওয়া হয় ব্যক্তি-উদ্যোগে শিল্পোন্নয়নের জন্য। এই ঋণের পরিমাণ সম্পর্কে কোনো সঠিক তথ্য পাওয়া না গেলেও ১৯৮২ সালে রাষ্ট্রক্ষমতা নিজ হস্তে গ্রহণ করার পর জেনারেল এরশাদ ব্যাংকের দুর্নীতি ও অনিয়ম দূর করে কঠোর হস্তে ঋণ আদায় করার যে সংকল্প ব্যক্ত করেছিলেন তাতে মনে হয় এই অঙ্কের আয়তন ছিল প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। জেনারেল এরশাদ বলেছিলেন, ‘সহস্র কোটি টাকার ঋণ দেওয়ার যৌক্তিকতা দেখাতে তাঁরা অপারগ, কয়েক ‘শ কোটি টাকা আজ অনাদায়ী হওয়ার আশঙ্কা। এইসব দায়ী ব্যক্তি শুধু অনিয়ম, দুর্নীতিই করেননি, তাঁরা জনগণের সঞ্চিত আমানত নিয়ে জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘সামরিক রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়া বাংলাদেশে এই প্রক্রিয়ার জন্মদাতা।’ ১৯৮০-৮১ সালে (মাত্র এক বছর), জিয়ার শাসনামলের শেষ বছরে, শিল্পব্যাংক ও শিল্পঋণ সংস্থা থেকে ব্যক্তিখাতের জন্য অনুমোদিত ঋণের পরিমাণ ছিল বিরাট —  দু‘শ ছাব্বিশ কোটি বিয়াল্লিশ লক্ষ টাকা। জেনারেল এরশাদের আমলে, ১৯৮২ সালে কঠোর হস্তে ব্যাংকঋণ আদায় সম্পর্কে তাঁর বহুল প্রচারিত প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও এই প্রক্রিয়া কেবলমাত্র অব্যাহতই থাকেনি, কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরো জোরদার হয়েছে।’’১৪

পুঁজিবাদী বিকাশ নিশ্চিত করার জন্য সামরিক শাসন ১৯৭৫-১৯৮১ এ সময়কালে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করে। মোটা দাগে এই পদক্ষেপগুলি হলো: ক) ‘কালো টাকা’কে বৈধ করা;১৫ খ) রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান বিলগ্নিকরণ/বিরাষ্ট্রীয়করণ করা’; (গ) বেসরকারি বিনিয়োগের ঊর্ধ্বসীমা বৃদ্ধি ও পরবর্তীকালে বিলুপ্ত করা; ঘ) বেসরকারি বিদেশি বিনিয়োগের ওপর থেকে বিধিনিষেধ প্রত্যাহার; এবং ঙ) বেসরকারি উদ্যোক্তাদের ঋণ প্রদান।১৬ এসব কারণ বিশ্লেষণ করে কোনো কোনো গবেষক জানিয়েছেন যে, বাংলাদেশে সামরিক শাসন রাজনৈতিক শাসকগোষ্ঠীর ব্যর্থতার আকস্মিক প্রতিক্রিয়া নয়, বরং পুঁজিবাদী বিকাশের ধরনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ক্ষমতা ব্লকের কেন্দ্রবিন্দুতে সামরিক-আমলাতান্ত্রিক অভিজাততন্ত্রের উত্থানের পেছনে তিনটি কারণ দায়ী বলে মনে করেন তাঁরা। এগুলো হলোঃ ১. তুলনামূলক স্বায়ত্তশাসিত রাষ্ট্রের গতিশীলতা; ২. শাসক শ্রেণীর সংকট; এবং ৩. রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট যা প্রান্তস্থ পুঁজিবাদী দেশের মৌলিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে নিহিত। তাদের মত অনুযায়ী, সামরিক শাসন বাংলাদেশের পুঁজিবাদের দৈহিক গঠনকে বিভিন্নভাবে পরিবর্তন করে এবং বাংলাদেশকে বিশ্ব পুঁজিবাদী অর্থনীতির সাথে আরও ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত করে। সামরিক শাসন দ্বারা অনুসৃত নীতিগুলি সামরিক-আমলাতান্ত্রিক অভিজাততন্ত্রের ক্ষমতা ও কর্তৃত্বকে শক্তিশালী করেছিল এবং ‘লুম্পেন পুঁজিবাদী’ শ্রেণীর জন্ম দিয়েছিল।১৭

বাংলাদেশে জাতীয়করণ কিংবা ‘সমাজতন্ত্র’ ব্যক্তিগত মালিকানার উত্থানকে বাধা দেয়নি। কোনো কোনো গবেষক মনে করেন, রাষ্ট্রীয় সম্পত্তিকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি সৃষ্টির বিকল্প কিংবা বিরোধী হিসেবে দেখার প্রয়োজন ছিল না মধ্যবর্তী শ্রেণীর, বরং তারা এই দু‘টিকে পরিপূরক হিসাবে দেখেছিল। কেননা, রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে নিতে তাদের কোন সমস্যা হয়নি, বরং সম্পদ আহরণের ক্ষেত্র হিসেবে এই দু‘টি প্রক্রিয়া ছিল একই মুদ্রার দুই দিক। রাষ্ট্রকে তারা ব্যবহার করেছিল নিজেদের সঞ্চয় ভিত্তি নির্মাণের নিমিত্তে। স্বাধীনতার প্রথম দিনগুলোতে লুণ্ঠনের ব্যাপ্তি ও গতি ‘পুঁজির আদিম সঞ্চয়ের’ সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ হলেও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে, বাংলাদেশের মধ্যবর্তী শ্রেণীগুলো যা সংগ্রহ করেছিল তা কোনও শিল্পপতির উত্পাদনশীল সঞ্চয় নয় বরং একজন বণিকের অনুৎপাদনশীল সম্পদ। এর ঐশ্বর্য উৎপাদনের উপায়ে রূপান্তরিত হওয়ার নিয়তি ছিল না, এটি আমদানী-রপ্তানির অর্থনীতিকে পুষ্টি দিয়েছে, বিলাসবহুল পণ্যভোগের অভ্যাসকে উত্সাহিত করেছে। এটি ছিল মধ্যবর্তী সম্প্রদায়ের জাঁকজমকপূর্ণ, অবাধ লুণ্ঠন প্রক্রিয়ায় নিজেদের জীবনযাত্রাকে সমৃদ্ধ করার উপায়।১৮

বেসরকারিকরণ: নব্য ধনীদের ‘সমাজতন্ত্র‘, সর্বজনের স্বার্থ সংকোচনের নীতি

সামরিক শাসনামল ছিল মূলত নব্য ধনীদের জন্য ‘সমাজতন্ত্র‘ (রাষ্ট্রীয়ভাবে উদারহস্তে দান) আর সাধারণ মানুষের জন্য পুঁজিতন্ত্র। সর্বজনের সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থার ন্যূনতম এবং অভাবনীয় দুর্নীতি হলেও রেশনিং, সহজ শর্তে কৃষিঋণ ব্যবস্থা প্রভৃতির মতো সাধারণ যে রক্ষাকবচগুলো ছিল, ক্রমসংকোচন প্রক্রিয়ায় সেসব থেকে রাষ্ট্রের হাত ক্রমান্বয়ে গুটিয়ে নেওয়ার বন্দোবস্ত করা, অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর কলেবর বৃদ্ধি; একদিকে প্রতিবাদের শর্ত সৃষ্টি অন্যদিকে তা দমনের জন্য রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে শক্তিশালী করা – সামরিক আমলে এই দুই প্রক্রিয়াই জোরদার হতে থাকে। এই সুযোগে সর্বজনের উৎপাদিত ফসল নানা প্রক্রিয়ায় তুলে দেওয়া হলো নব্য ধনীদের হাতে।

এ লুণ্ঠনগুলো যে প্রক্রিয়ায় ঘটে তার একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি পরিষ্কার করা যায়। যেমন –

বিক্রয়ের জন্য প্রস্তাবিত শিল্পগুলির একটি তালিকা প্রথমে শিল্প মন্ত্রণালয় দ্বারা প্রস্তুত করা হয় এবং ‘National Reserve Price (NRP)’ নামে একটি ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণ করা হয়। এনআরপি কীভাবে নির্ধারণ করা হয়েছিল তা জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি। এরপরে উদ্যোগগুলি বিক্রয়ের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়। দরদাতাদের দেওয়া দামকে ভিত্তি ধরে এনআরপি নির্ধারণ করা হয়! একটি এন্টারপ্রাইজ সর্বোচ্চ দামে দরদাতার কাছে বিক্রি করার কথা ছিল (শর্ত ছিল যে বিডটি এনআরপির সমান বা তার চেয়ে বেশি হতে হবে।) বলাই বাহুল্য, তা ছিল কাগুজে প্রক্রিয়া। প্রথমত, ক্রেতারা এসেছিলেন সমাজের বিত্তশালী শ্রেণী থেকে। দ্বিতীয়ত, গোষ্ঠীগত মালিকানার কেন্দ্রীভবন থাকায় বাজারে তাদের আধিপত্য ছিল। প্রকৃতপক্ষে, ৭০ শতাংশ বেসরকারি ক্রেতা/মালিকরা ইতিমধ্যে এই খাতে (যে সব খাত বিক্রি করে দেওয়া হয়) সক্রিয় ছিল। তাদের ছিল গোপন-প্রকাশ্য সংঘ (cartel) যারা বিভিন্ন উপায়ে বাজারের সাধারণ প্রতিযোগিতাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারতো। সরকারী উদ্যোগের বিক্রয় এইভাবে ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠীর হাতে পুঁজির কেন্দ্রীকরণকে উত্সাহিত করেছিল।

প্রকৃতপক্ষে, সমস্ত প্রক্রিয়াটি গোপনীয়তার সাথে সম্পন্ন করা হতো, যার ফলে দুর্নীতি এবং প্রক্রিয়াটির ছলচাতুরি সম্পর্কে গুজব ছড়িয়ে পড়ে। বেসরকারিকরণ জনসাধারণের দৃষ্টির অগোচরে ঘটেছিল, এমনকি এর সাথে জড়িত কর্মীরাও গোপন চুক্তির বহু কিছু জানতে পারেনি। কোনো জাতীয় বিতর্ক এবং ন্যূনতম তথ্য ছাড়াই বিক্রয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়।

মাসুদুল হক তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, দরদাতারা মাত্র এক পঞ্চমাংশ থেকে এক চতুর্থাংশ-র মধ্যে অর্থ প্রদান করেছিলেন। সরকার ও সরকারি কর্পোরেশনের কর্মকর্তা, ট্রেড ইউনিয়ন কর্মী এবং ব্যবসায়ীদের তথ্য থেকে জানা যায় যে, প্রকৃত বাজার মূল্যের চেয়ে অনেক কম নির্ধারণ করা হয়েছিল। সর্বোপরি এন্টারপ্রাইজগুলি সহজ শর্তে (পরিশোধের শর্তাবলী) বিক্রি করা হয়েছিল। ক্লেয়ার হামফ্রের কথা উল্লেখ করে গবেষক বলেছেন, ‘তারা (নতুন মালিকরা) ঋণ পরিশোধের কোনও অভিপ্রায় ছাড়াই সরকারের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিল’, ফলে এসব ঋণ পরিশোধ না করার বিষয়টি রয়েই যায়।১৯

শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সরকার (প্রজ্ঞাপন নং JD/IC/TJM-1/82 dated 27.9.82) জাতীয়করণকৃত শিল্প উদ্যোগের সকল শেয়ার তাদের সাবেক বাংলাদেশী শেয়ারহোল্ডারদের কাছে হস্তান্তর করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং শিল্প প্রতিষ্ঠানের একটি তালিকা প্রকাশ করে। ১৯৭২ সনের ২৭ নং অনুচ্ছেদের ৪ নং দফার (২) দফার দ্বিতীয় বিধান অনুসারে সরকার উক্ত আদেশের ৯ অনুচ্ছেদের অধীন ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তির অধিকারী ব্যক্তিগণকে উক্ত শিল্প প্রতিষ্ঠানের বিক্রয়ের শর্তাবলী অনুযায়ী জাতীয়করণের তারিখে সংশ্লিষ্ট শেয়ারহোল্ডিংসমূহে বিক্রয়ের প্রস্তাব প্রদান করে। জাতীয়করণের আগে, এই উদ্যোগগুলি কোম্পানি আইন ১৯১৩-এর অধীনে যৌথ মূলধনী কোম্পানি হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। সরকারি প্রজ্ঞাপনে তাদের সাবেক মালিকদের কাছে শেয়ার হস্তান্তরের শর্তাবলী উল্লেখ করা হয়েছে।

ক্ষতিপূরণ প্রদানের সময় প্রতিটি শেয়ারের জন্য নির্ধারিত মূল্য একই ছিল। যেসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশী শেয়ারহোল্ডারদের ৫১ শতাংশেরও কম শেয়ার ছিল (মালিক হতে গেলে তাদের প্রয়োজন ছিল ৫০ শতাংশের বেশী), তাদের প্রকৃত হস্তান্তরের আগে ৫০ শতাংশ বা তার বেশি নিয়ন্ত্রণকারী শেয়ার অর্জন করতে সক্ষম করার জন্য তাদের অতিরিক্ত শেয়ার কেনার বন্দোবস্ত করা হয়। এই অতিরিক্ত শেয়ার পুনর্মূল্যায়নের ভিত্তিতে বিক্রি করা হয়েছিল (পুনর্মূল্যায়ন প্রক্রিয়াটিই ছিল ধোঁয়াটে)। অনুষ্ঠিত মূল শেয়ারের অর্থ প্রদানের ক্ষেত্রে, ক্রেতাদের তাত্ক্ষণিকভাবে মোট মূল্যের ৫১ শতাংশ এবং এক বছরের সময়কালের মধ্যে বাকি ৪৯ শতাংশ প্রদান করতে হবে। অতিরিক্ত শেয়ারের ক্ষেত্রে ক্রেতাকে পূর্ণ মূল্যের ১০ শতাংশ তাৎক্ষণিকভাবে এবং বাকিটা পাঁচ বছরের মধ্যে ১০টি ষান্মাসিক কিস্তিতে পরিশোধ করতে দেওয়া হয়। যথাসময়ে অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হলে ক্রেতা ঋণখেলাপি কিস্তিতে চুক্তিবদ্ধ হারের চেয়ে ২ শতাংশ বেশি দণ্ডনীয় সুদ পরিশোধ করবেন; এই ধরনের শর্ত ছিল। এভাবে বেসরকারিকরণের নামে সরকার কিছু ব্যক্তির মধ্যে জনগণের সম্পত্তি বণ্টন করে।

যদি প্রাক্তন মালিকরা প্রস্তাবিত শেয়ার কিনতে অস্বীকার করে তবে শেয়ারগুলি অন্যান্য বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের দেওয়া হবে এই মর্মে সিদ্ধান্ত হয়। বেসরকারি ক্রেতাদের কাছ থেকে পর্যাপ্ত সাড়া না পাওয়ায় সরকার তাদের বিএসবি, বিএসআরএস, আইসিবি, বীমা সংস্থা ইত্যাদির মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করার অধিকার সংরক্ষণ করে যারা জাতীয়করণের আগে মিলগুলির শেয়ারহোল্ডার ছিল। নতুন শেয়ারহোল্ডারদের সরকারের পূর্ব অনুমোদন ব্যতীত দায়বদ্ধতার সময়কালের মধ্যে তাদের শেয়ার বিক্রি করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। নতুন পরিচালনার জন্য স্থানান্তরের দিন (বিদ্যমান একই শর্তাবলীতে) সংস্থার সম্পূর্ণ দায়বদ্ধতা গ্রহণ করতে হবে। পরিষেবা সুবিধার জন্য দায়বদ্ধতার পাশাপাশি স্থানান্তরের দিন প্রতিষ্ঠানগুলোতে (তখন পর্যন্ত নিয়োজিত) সমস্ত কর্মীদের গ্রহণ করার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ ছিল। পাশাপাশি, কর্পোরেশন কর্তৃক নিয়োজিত একসংখ্যক কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে কর্পোরেশন থেকে পূর্ববর্তী শেয়ারহোল্ডারদের কাছে হস্তান্তরের পর উদ্বৃত্ত ঘোষণা করা হতে পারে মর্মেও শর্ত ছিল। ১ বছরের সময়কালের মধ্যে সমাপ্তি এবং ছাঁটাই নিষিদ্ধ ছিল।

প্রাক্তন ‘সমাজতান্ত্রিক‘ রাষ্ট্রীয় আবরণ থাকায় শ্রমিকের ছাঁটাইয়ের বিরুদ্ধে একটি নিয়ন্ত্রণ আরোপের ব্যবস্থা হয়েছিল, কিন্তু প্রতিষ্ঠান বন্ধের বিরুদ্ধে স্পষ্ট কোনও নিয়ন্ত্রণ ছিল না। ফলে, বেসরকারিকরণ পরবর্তী ব্যক্তিগত অনেক উদ্যোগকে যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণের ভেতর আনা সম্ভব হয়নি। শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনটি অনেকটা কঙ্কালের কাঠামোর মতো ছিল এবং বেসরকারিকৃত সংস্থাগুলির নকশা সম্পর্কে সামগ্রিক কোন বিধান রাখা হয়নি।

এন্টারপ্রাইজের নিরবচ্ছিন্ন পরিচালনার জন্য সরকার প্রথম পরিচালনা পর্ষদ গঠনের অধিকার সংরক্ষণ করে। এই বোর্ডটি এক বছরের বেশি সময়ের জন্য বা কোম্পানির নিবন্ধ ও স্মারকলিপি অনুসারে একটি নতুন পরিচালনা পর্ষদ নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত, অস্থায়ী বোর্ড হিসাবে কাজ করবে – এই ধরনের শর্ত ছিল। বিক্রয় শর্তাদি লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে সরকার কোম্পানির বিষয়গুলিতে হস্তক্ষেপ করার অধিকার সংরক্ষণ করে। তবে কোনও শর্ত লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে সরকার কী ব্যবস্থা নিতে পারে তা সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে স্পষ্ট করা হয়নি। যার অর্থ, সরকার এই জাতীয় পরিস্থিতিতে কাজ করার জন্য ‘ধরি মাছ, না ছুঁই পানি‘ জাতীয় রাজনৈতিক কৌশল প্রয়োগ করেছে বলে ধারণা করা হয়।

সরকার তার NIP 1982 এবং RIP 1986-এ পাবলিক সেক্টর কর্পোরেশনগুলিকে হোল্ডিং কর্পোরেশন এবং তাদের আয়ত্তাধীন এন্টারপ্রাইজগুলোকে সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং তারপরে সরকারি ৪৯ শতাংশ শেয়ারের ‘ভার লাঘবে’র সিদ্ধান্ত নেয়। অর্থাৎ, হোল্ডিং কর্পোরেশনগুলি ৫১ শতাংশ শেয়ার সহায়ক (সাবসিডিয়ারি) প্রতিষ্ঠানগুলোতে রাখার বন্দোবস্ত করে। হোল্ডিং কোম্পানি কাঠামোর প্রবর্তনকে ভবিষ্যতে বেসরকারি খাতে স্থানান্তরের এবং সরকারি সংস্থার মধ্যে বেসরকারি উদ্যোগের সংস্কৃতি সঞ্চারিত করার একটি পদক্ষেপ হিসাবে দেখা যায়। হোল্ডিং কোম্পানি সরকার এবং সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে একটি বাফার হিসাবে কাজ করে সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে উচ্চ মাত্রার স্বায়ত্তশাসন প্রদানের ব্যবস্থা করতে পারতো। এটি করা হয়েছিল এই অতিকল্পনা থেকে যে, (হোল্ডিং কোম্পানির) এই ধরণটি সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনার ক্ষেত্রে অযৌক্তিক রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে রক্ষা করতে সক্ষম হবে। একে নীতি নির্ধারক (সরকার) এবং বাস্তবায়নকারীদের (সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনাকারী) নীতি ও ক্রিয়াকলাপের মধ্যে একটি সূক্ষ পার্থক্য তৈরির মধ্যবর্তী অবস্থান বলা যায়। হোল্ডিং কর্পোরেশন ধরণ, (তাত্ত্বিকভাবে অন্তত ) সরকারি সংস্থাগুলোর মৌলিক সাংগঠনিক সমস্যার সমাধান করার অবস্থানে ছিল। যেমন, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে জনগণের জবাবদিহিতার সাথে সমন্বয় করা (অন্তত কাগজে-কলমে)।২০ তত্ত্ব এবং চর্চা; ‘দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা’, এ দেশে দেখা হয়নি একের সাথে অন্যের।

অন্যদিকে, প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে বিশিষ্ট পদ অর্জনের সাথে সাথে বেসামরিক ও সামরিক আমলাতন্ত্র সফলভাবে রাষ্ট্রের মধ্যে কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসাবে নিজের আসনটি পাকাপোক্ত করেছিল। ক্ষমতা সংহতকরণের পাশাপাশি অভিজাততন্ত্র তার অর্থনৈতিক প্রকল্প বাস্তবায়নে এগিয়ে যায়। যুদ্ধপূর্ব এবং যুদ্ধোত্তরকালীন বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠায় বিশেষ করে মূলধনী যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল আমদানীর উপর শুল্ক ছাড়, ঋণের সুদ মওকুফ সহ আরও নানাবিধ সুবিধা দেয়া হয়।২১ যা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতানির্ভর পুঁজিবাদের নীতি প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট হয়,, যেখানে রাষ্ট্র আর্থিক সহায়তা দিয়ে বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের সহায়তা করতে এগিয়ে আসে।২২

বেসরকারিকরণের নীতির জন্য প্রাথমিকভাবে দু‘টি কারণ উল্লেখ করা হয়েছিল: প্রথমত, শিল্প ইউনিটগুলির মারাত্মক অব্যবস্থাপনা; দ্বিতীয়ত, অলাভজনক। অব্যবস্থাপনার অভিযোগ আংশিক সত্য হলেও রাষ্ট্রায়ত্ত সব শিল্প প্রতিষ্ঠানের পারফরম্যান্স হতাশাজনক বলে যে দাবি করা হয়েছে তা তথ্যগতভাবে ভুল বলে দাবী করেছেন খোদ মূল ধারার অর্থনীতিবিদগণ। কোনো কোনো গবেষক দেখিয়েছেন যে, ১৯৭৬ থেকে ১৯৮২ সালের জুন পর্যন্ত বিলগ্নিকরণ করা ৯০টি ক্ষুদ্র ও মাঝারি ইউনিট বিলগ্নিকরণের আগের বছরেও প্রায় ৬ কোটি টাকা মুনাফা করেছে। ৩২টি ইউনিটের পারফরম্যান্স ছিল ‘দুর্দান্ত’। শিল্পক্ষেত্রে সরকারের বেসরকারিকরণের নীতি অনুসারে কৃষি ক্ষেত্রেও একই ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল।

বেসরকারিকরণ নীতি কৃষিতে ভিন্ন রূপ নেয়। সারের মতো উপকরণ থেকে ভর্তুকি প্রত্যাহার, নলকূপের ভাড়া বৃদ্ধি, সেচ সরঞ্জামের বেসরকারিকরণ এর মধ্যে অন্যতম। সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখলের পরপরই সরকার সার ও সেচ সরঞ্জাম থেকে ভর্তুকি তুলে নিতে শুরু করে। সার থেকে ভর্তুকি প্রত্যাহারের কারণে ১৯৭৫-১৯৮৪ সময়কালে দাম উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। যেমন ইউরিয়া সারের দাম বাড়ে ৩২৬ শতাংশ, টিএসপি সারের দাম বাড়ে ৩৪৮ শতাংশ এবং এমপি ৩৪০ শতাংশ। এই বিস্ময়কর বৃদ্ধি দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত কৃষকদের এতটাই প্রভাবিত করেছে যে তাদের অনেকে কৃষি উৎপাদন থেকে প্রায় বিতাড়িত হয়েছে। সরকারের কৃষিঋণ নীতির কারণে পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়।

বেসরকারিকরণ নীতি কৃষিতে ভিন্ন রূপ নেয়। সারের মতো উপকরণ থেকে ভর্তুকি প্রত্যাহার, নলকূপের ভাড়া বৃদ্ধি, সেচ সরঞ্জামের বেসরকারিকরণ এর মধ্যে অন্যতম।

গবেষণায় দেখা যায়, ১৯৮১/৮২ সালে ৫ একরের বেশি জমির মালিক কৃষকরা প্রায় ৩১.২ শতাংশ ঋণ পেয়েছিলেন, যেখানে প্রান্তিক কৃষকরা (১ একর বা তার কম জমির মালিক) ব্যাংক ও অন্যান্য সরকারি সংস্থা কর্তৃক বিতরণ করা মোট ঋণের মাত্র  ৩.২ শতাংশ পেয়েছিলেন। উপরন্তু, ১৯৭৫ সাল থেকে সেচ পাম্পের ভাড়া বৃদ্ধি করা হয়েছিল। ১৯৭৫/৭৬ সালে ২ কিউসেক পাওয়ার পাম্পের ভাড়া ছিল ৬০০ টাকা এবং গভীর নলকূপের ভাড়া ছিল ১২০০ টাকা। ১৯৮৩/৮৪ সালে এর পরিমাণ যথাক্রমে ৩৬০০ ও ৫০০০ টাকায় উন্নীত করা হয়। ভাড়া বৃদ্ধির পাশাপাশি পাম্প ও নলকূপের বেসরকারিকরণ শুরু করে সরকার। বেসরকারিকরণের প্রক্রিয়া ১৯৭৯/৮০ সালে শুরু হয়েছিল। ১৯৮৩ সালের শেষ নাগাদ ৪৩ শতাংশ গভীর নলকূপ এবং ৫৬ শতাংশ বিদ্যুৎ পাম্প ৩১৫টি ব্যক্তি মালিকানায় হস্তান্তর করা হয়। সেচ সরঞ্জামের বেসরকারিকরণের ফলে সেচের ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে দরিদ্র কৃষকদের প্রবেশাধিকার কার্যত সীমিত হয়ে পড়েছিল।২৩

আনু মুহাম্মদ সামরিক আমল বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন,

‘‘বাংলাদেশের রেলওয়ে, সড়ক পরিবহণ, পানি, বিদ্যুৎ, শিল্প কারখানা, কৃষি ব্যাংক ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে যতটা পুঁজি গঠিত হচ্ছে তার চাইতে বেশী তা সংগঠিত লুটপাটের মাধ্যমে ব্যবসায়িক পুঁজির মধ্যে দ্রবীভূত হয়ে পড়ে, অর্থাৎ পুঁজি গঠনের হারের চাইতে পুঁজি খেয়ে ফেলার হার অনেক বেশী। এই কারণে বাংলাদেশের জাতীয় পুঁজি বর্তমানে (সামরিক শাসনামলে) নেতিবাচক। অর্থনীতির এই দেউলিয়াপনা এবং নৈরাজ্য বণিক পুঁজিকে আরও উদ্যমী এবং হিংস্র করে তুলেছে। উৎপাদন নেই, বাজারে টাকার সরবরাহ বাড়ছে। দেখা দিচ্ছে মুদ্রাস্ফীতি। বড় ব্যবসায়ী, ব্যাংকার, বড় আমলা এবং বিদেশী বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর সম্মিলিত উদ্যোগে দ্রব্যমূল্যের গতি সবসময়ই উর্ধ্বগামী হয়ে আছে। অন্যদিকে, দেশের ফসলের যথাযথ দাম কৃষক ক্ষুদ্র উৎপাদকের কাছে পৌঁছুচ্ছে না। শ্রমিকসহ সীমিত আয়ের মানুষদের প্রকৃত আয়ও কমছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মুনাফা কমছে এবং এগুলোর ভবিষ্যৎ হয়ে পড়ছে অনিশ্চিত।‘‘২৪

শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান তৈরি না করে, বরং তার বিপরীতে রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল এবং পঙ্গু করার ব্যবস্থা করে বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করার উদ্যোগ বিলগ্নিকরণ, বিরাষ্ট্রীয়করণের পদক্ষেপেই থেমে থাকেনি২৫ উপরন্তু, ‘ব্যাংক ঋণ আকারে’২৬ আরও সহায়তা দিয়ে ‘ব্যক্তি খাত বিকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল’ যার অধিকাংশই ভিত্তিমূলক শিল্পোৎপাদনে কোন ভূমিকা রাখেনি। ১৯৭২ থেকে ১৯৮২ সময়কালে বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক (বিএসবি)২৭, বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা (বিএসআরএস) এবং ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) কর্তৃক প্রদত্ত অর্থায়নের চিত্র পূর্বে উপস্থাপন করা হয়েছে। একই ধরনের চিত্র, ভিন্ন অবস্থান থেকে উপস্থাপন করে গবেষক আলী রিয়াজ দেখিয়েছেন যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পরিবর্তনের পূর্বে বেসরকারি খাত ডিএফআই কর্তৃক প্রদত্ত ঋণের ২১.৬ শতাংশ পেত। যেখানে সেনা অধিগ্রহণের পর ৯৩ দশমিক ৪ শতাংশ ঋণ গেছে বেসরকারি খাতে। এবিষয়ে ডিএফআই থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে আরও জানা যায়, ১৯৭১/৭২-১৯৭৪/৭৫ সময়কালে সরকারি খাতে বার্ষিক গড় ঋণ বিতরণের পরিমাণ ছিল ২ কোটি ৩৮ লাখ ৩০ হাজার টাকা এবং বেসরকারি খাতে ৬ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। ১৯৭৫/৭৬-১৯৮১/৮২ সময়কালে এই পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৪.৭১ কোটি টাকা এবং ৫০.৮৮৯ কোটি টাকা।

বেসরকারি উদ্যোগকে উৎসাহিত করার জন্য সামরিক সরকার প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (১৯৭৩-৭৮) কিছু পরিবর্তন আনে। যেহেতু পরিকল্পনার দুই বছর ইতিমধ্যে শেষ হয়ে গেছে, তাই সরকার পরিকল্পনাটি পুরোপুরি পরিবর্তন করার পরিবর্তে বাকি তিন বছরের জন্য পরিকল্পনার লক্ষ্যমাত্রা সংশোধন করে। যাকে শাসকগোষ্ঠী অভিহিত করে ‘তিন বছর মেয়াদি হার্ড কোর প্ল্যান’ নামে। বেসরকারি খাতে, বিশেষ করে শিল্প খাতে বড় অংশ বরাদ্দ করা হয়েছিল (উদাহরণস্বরূপ, একটি এন্টারপ্রাইজ প্রতিষ্ঠার মোট খরচের ৭০ শতাংশ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো দ্বারা সরবরাহ করা হয়েছিল)২৮। শিল্পে বেসরকারি বিনিয়োগ ১৯৭৩/৭৪ সালে ৮.৭৪ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ১৯৭৭-৭৮ সালে ২০৯.১৪ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। হার্ড-কোর প্ল্যান অনুসরণকারী দ্বি-বার্ষিক পরিকল্পনায় প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার (বিপিসি, ১৯৭৮) ১১ শতাংশের বিপরীতে বেসরকারি খাতকে পরিকল্পনা ব্যয়ের ১৬ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বেসরকারি খাতের সীমাবদ্ধতাকে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও সামরিক সরকার প্রণীত দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (১৯৮০-৮৫) এ বরাদ্দ ২২ শতাংশে উন্নীত হয়।২৯

এছাড়া, ‘বেসরকারি খাতকে পুনরুজ্জীবিত করা, উদ্যোক্তাদের সব ধরণের ঋণ সুবিধা দেওয়া’৩০, এবং শাসকদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে ‘দাতা’ সংস্থাগুলো দ্বারা প্ররোচিত হয়ে সরকার সহজেই পশ্চিমা দেশগুলোর কাছ থেকে আরও বেশি বেশি ঋণ চাওয়ার নীতি গ্রহণ করে। সরকারি ও বেসরকারি খাতে বিদেশি সাহায্যের কথা উল্লেখ করে জিয়াউর রহমান বারবার বলেছেন, ‘টাকা কোনো সমস্যা নয়’ এবং উদ্যোক্তাদের ‘আরও চিন্তাভাবনা করা উচিত এবং নতুন প্রকল্প নিয়ে আসা উচিত’। বিদেশি ঋণনির্ভরতার নানাদিক নিয়ে বিভিন্ন চিত্র বিভিন্ন সময় মূলধারার গবেষকগণও হাজির করেছেন।৩১, ৩২

আলী রিয়াজ তাঁর গবেষণায় বেসরকারিকরণের সাথে বিদেশি ‘সাহায্য (কঠোর শর্তযুক্ত ঋণ)’-এর সম্পর্ক তুলে ধরে বলেছেন যে, ব্যাপক বেসরকারিকরণ, পৃষ্ঠপোষকতানির্ভর পুঁজিবাদের (sponsored capitalism) নীতির আনুগত্য এবং বিদেশি ‘সাহায্যে’র আগমনের পাশাপাশি বেসামরিক-সামরিক আমলাদের স্বায়ত্তশাসিত ভূমিকা বাংলাদেশের সমাজের শ্রেণী কাঠামোর ক্ষেত্রে নাটকীয় পরিবর্তন নিয়ে আসে। এই পরিবর্তনগুলির কেন্দ্রবিন্দু ছিল শ্রেণীর একীভূতকরণ যা পূর্ববর্তী শাসনের অধীনে বাড়তে শুরু করে। যে শ্রেণীকে আমরা এতদিন নব্য ধনী বলে বর্ণনা করে আসছি , তারা এখন রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিদের সহায়তায় বিষয়গুলোকে ‘লুম্পেন পুঁজিবাদী’র অবস্থানে উন্নীত করেছে, যে শ্রেণী পুঞ্জীভূতকরণের অর্থনৈতিক উপায় অবলম্বন করার চেয়ে লুণ্ঠনে বেশি আগ্রহী।৩৩ অন্যদিকে, ‘দাতা’ গোষ্ঠীর প্ররোচনায় প্রবৃদ্ধিমুখী ‘উন্নয়ন’ কৌশল অনুসরণ বাংলাদেশকে কেবল গভীর ঋণের ফাঁদে ফেলেনি; বরং আরও উল্লেখযোগ্যভাবে, উৎপাদনশীল সম্পদের পুনর্বণ্টনে জনসাধারণের হস্তক্ষেপের প্রশ্নটিকে প্রান্তিক করে তুলেছে।৩৪

১৯৭৫ সাল থেকে অনুসৃত অর্থনৈতিক নীতিগুলির প্রাথমিক ফলাফল হলো (বিভিন্ন গবেষণার প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী) শ্রেণীর সংহতকরণ এবং বর্ধন যা পূর্ববর্তী শাসনের অধীনে বাড়তে শুরু করে। সম্পদে সমৃদ্ধ, সংখ্যায় কম এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক সংযোগের ক্ষেত্রে প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ, যারা বাংলাদেশে ‘শিল্পহীন কোটিপতি’ গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত; পণ্ডিতদের ভাষায়, ‘লুম্পেন ক্যাপিটালিস্ট’। তারা জাতীয় সম্পদের ওপর লাগামহীন নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে এবং নজিরবিহীন হারে দেশকে লুটপাটে লিপ্ত থেকেছে।৩৫

বাংলাদেশে খুবই ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠী, ১ হাজার পরিবারের বেশী নয়, সেই সুবিধাভোগী মুষ্টিমেয় পরিবারগুলোই ছিল বাংলাদেশে শিল্প ঋণ প্রধান গ্রহীতা। ১৯৮১-৮২ সাল পর্যন্ত এই পরিবারগুলোর মধ্যে ৩৬টি পরিবারের হাতে ঋণের নিয়ন্ত্রণ ছিল প্রায় ৪৭০ কোটি টাকা, অর্থাৎ বেসরকারি খাতে রাষ্ট্র কর্তৃক বিতরণকৃত মোট ঋণের ৫২ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করতো এই পরিবারগুলো। ব্যক্তিগত আয় কাঠামো থেকে দেখা যায় যে, মোট জাতীয় আয়ের ৩২ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করতো মোট জনসংখ্যার উপরের সারির এই ১০ শতাংশ অর্থাৎ খুবই ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠী। বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতেও একই ধরনের চিত্র দেখা যায়। একটি সংবাদপত্রের প্রতিবেদন তুলে ধরে একজন গবেষক দেখিয়েছেন যে, গ্রামীণ অর্থনীতির সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রায় ৫ হাজার পরিবারের হাতে।৩৬

রাষ্ট্রীয় ঋণ পরিশোধের ইতিবৃত্ত

১৯৮২ সালে সামরিক জান্তা ক্ষমতা দখলের পর সরকার ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্নীতি তদন্তের জন্য একটি কমিটি গঠন করে। এর প্রতিবেদন জনসমক্ষে কখনও প্রকাশিত হয়নি। তবে কোনো কোনো গবেষক জানতে পেরেছেন যে, এই বেসরকারি খাতে মোট বকেয়া ১৯৭৮ এবং ১৯৮১ সালের মধ্যে ৬৮.৮% বেড়েছিল। মোট বকেয়ার শতাংশ হিসাবে মোট ঋণ পরিশোধ ৫১.৭% থেকে ৩৭% এ নেমে এসেছে এবং আদায়যোগ্য পরিমাণের শতাংশ হিসাবে মোট ঋণ পরিশোধ (যার মধ্যে আগের বছরের বকেয়া অন্তর্ভুক্ত রয়েছে) ২৫.৯% এ নেমে এসেছে। সরকারি যে তথ্য পাওয়া যায় সেখানে হিসাবে বহু অসঙ্গতি পাওয়া যায়। যেমন, গবেষক তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে জানিয়েছেন যে, ১৯৮০-৮১ সালে ঋণ পরিশোধের অংশ হিসাবে যে ৪.২ কোটি টাকা রেকর্ড করা হয়েছিল প্রকৃতপক্ষে তা ছিল পুনর্নির্মাণ এবং সমন্বয়সংক্রান্ত। ১৯৮০-৮১ সালে প্রকৃত অর্থে পরিশোধ হয়েছিল ১৬.৮%; ৩৭% নয়। সামরিক আইনের তদন্ত প্রতিবেদনে অনুৎপাদনশীল কাজে ব্যবহৃত ঋণের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১১ কোটি টাকার দেনাদার জহিরুল ইসলাম লন্ডনের বিলাসবহুল এলাকায় ১৭টি বাড়ির মালিক ছিল। প্রকৃতপক্ষে, বেসরকারি উদ্যোক্তাদের উৎপাদনী উদ্বৃত্ত মূল্য আহরণ-উশুলের চাইতে ভাড়াভোগী/কমিশনভোগী মুনাফাখোর হওয়াতেই বেশী আগ্রহী হতে দেখা যায়।৩৭

‘ব্যাংক ঋণের গন্তব্য কোথায়‘? প্রমাণ? দৈনিক ইত্তেফাকের বরাতে আনু মুহাম্মদ তুলে ধরেছেন সেসময়ে ঋণ গ্রহীতাদের গন্তব্য  – 

১. দেশের ৫টি ব্যবসায়ী গ্রুপ বর্তমানে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো থেকে সর্বাধিক সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করছে। এদের ভূমিকা গড ফাদারের মতো। প্রচলিত কোনো নিয়ম-কানুন এদের জন্যে প্রতিবন্ধক হয় না। এদের নির্দেশেই ব্যাংক চলে।

২. বেসরকারি খাতের জন্যে মোট বরাদ্দকৃত ঋণের শতকরা প্রায় ৪০ ভাগ এই কয়টি গ্রুপ ভোগ করে।

৩. শুধু দেশের অভ্যন্তরে নয়, দেশের বাইরে অবস্থিত বাংলাদেশী ব্যাংকের শাখাগুলোও এদের কোটি কোটি টাকা সরবরাহ করছে।

৪. একটি কোম্পানি লন্ডনস্থ একটি ব্যাংকের শাখা থেকে ১৩ কোটি টাকা, আবুধাবিস্থ শাখা থেকে এসওডি হিসেবে ২ কোটি দেরহাম, এল, সি লিমিট হিসেবে এক কোটি ৩০ লক্ষ ডলার এবং লেটার অব গ্যারান্টি হিসেবে এক কোটি দেরহাম এবং ৫০ কোটি টাকা ঋণ ভোগ করছে।

৫. লন্ডনভিত্তিক ব্যবসারত একটি কোম্পানি মাত্র ৪ হাজার পাউন্ড মূল্যের একটি ফ্যাক্টরি দেখিয়ে প্রায় সোয়া দু‘লক্ষ পাউন্ড পরিমাণ ঋণ ভোগ করছে। এর প্রদত্ত ঋণের প্রকৃত সুদের একটি অংশ মওকুফ করে দেয়া হয়েছে।

৬. কোম্পানিগুলো ঋণভোগ করছে, কিন্তু দেয় কর ও আয়কর তারা শোধ করছে না।

এছাড়া অন্যান্য সূত্র থেকে ব্যাংক ঋণের গন্তব্য সম্পর্কে আরো যে ভয়াবহ তথ্যগুলো পাওয়া গেছে তার কয়েকটি এরকম:

৭. যিনি এদেশের সবচে ‘বড়লোক‘ বলে পরিচিত, তিনি ব্যাংক ঋণের ওপর ভিত্তি করেই প্রধানত তার ব্যবসা পরিচালনা করেন। এখন তার ব্যবসার মূল কেন্দ্র বিদেশে। শিল্প, কৃষি ইত্যাদি খাতে উৎপাদনের নামে ঋণ নিয়েই তার ব্যবসা চলে। সম্প্রতি তিনি বিভিন্ন নামে ঢাকার আশে পাশে জমি সংগ্রহ করেছেন তিন হাজার একর, কিছু কিছু জমিতে বাড়ি তুলে মধ্যপ্রাচ্যের বাংলাদেশীর কাছে বিক্রি করবেন। টাকা বিদেশে গৃহীত হবে। অর্থাৎ দেশের জমি বেচেও বিদেশে সঞ্চয় ঘটবে।

৮. একটি ব্যাংক কিছুদিন আগে একটি ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর নামে কয়েক কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন করবার পর, তার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ঋণের জন্যে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জোগাড়ের জন্য কয়েকদিন কর্মব্যস্ত দিন কাটান। ব্যবসায়িক গোষ্ঠীটির এ ব্যাপারে কোন চিন্তা করতে হয়নি।

৯. একজন কোটিপতি শিল্প প্রতিষ্ঠার নামে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে মাত্র কিছুদিন আগে গুলশানে একটি বাড়ি এবং অন্যত্র একটি হোটেল নির্মাণ করেছেন। মর্গেজ দেয়া কারখানায় উৎপাদন নেই-যন্ত্রপাতি যা আছে তাতে ঋণের চার ভাগের এক ভাগও আদায় হবে না।

১০. কিছুদিন আগে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ঢাকাস্থ শাখা থেকে কয়েক লক্ষ টাকা ঋণ নিয়ে একজন ব্যবসায়ী রাষ্ট্রায়ত্ত একটি কারখানা ক্রয় করেন এবং সপ্তাহখানেকের মধ্যেই তার সকল সরঞ্জাম প্রায় দ্বিগুণ দামে আরেক পার্টির কাছে বিক্রয় করেন।

১১. একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে এক ভদ্রলোক শিল্প যন্ত্রাদি ক্রয়ের জন্যে কয়েক কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করেন। ঋণের টাকা নিয়ে তিনি যথাযথ চুক্তির মাধ্যমে নিজেই বিদেশে গিয়ে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ক্রয় করেন। কাগজপত্রে ঋণের পুরো টাকা যন্ত্রাদি ক্রয়ের জন্য দেখানো হলেও সেগুলো কিনতে প্রকৃতপক্ষে লাগে শতকরা দশ ভাগ অর্থ। বছরখানেক পর ব্যাংক পুরনো অকেজো যন্ত্রাদি এবং জমি (যার দাম প্রদত্ত ঋণের এক-চতুর্থাশেও নয়) অনাদায়ী ঋণ পরিশোধ না করায় জবর দখল করে। জবর দখল এখনো রয়ে গেছে।

১২. কোনো সুনির্দিষ্ট জামানত না দেখিয়ে এক ব্যক্তি কিছুদিন আগে দেড় কোটি টাকা ঋণ পেয়েছেন। এই ঋণ নেবার পর টাকাসহ তিনি পাড়ি জমিয়েছেন লন্ডনে।

১৩. কৃষিভিত্তিক শিল্পের নামে কোটি কোটি টাকার ঋণ দিচ্ছে কৃষি ব্যাংক। সে টাকায় পরিবহণের ব্যবসা, বার্জ ক্রয়, হোটেল ব্যবসা সবই চলছে। শিল্প ব্যাংকের দেয়া ঋণের ব্যবহার হচ্ছে একইভাবে।

উপরোক্ত ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করে আনু মুহাম্মদ সেসময়ের যে চিত্র তুলে ধরেছেন তা হলো –

ক. রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ঋণ দেশের কয়েকটি প্রভাবশালী ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে। উৎপাদনমূলক কাজের নামে ঋণ নেয়া হলেও সেগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে ভোগ ও ব্যবসায়।

খ. সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তারা এই পরিস্থিতি বজায় রাখতে অত্যন্ত উৎসাহী।

গ. ব্যাংক ঋণের এই অবস্থার কারণে দেশের সম্ভাব্য উৎপাদনশীল পুঁজি বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে।

ঘ. বিদেশি মুদ্রার যথাযথ ব্যবহার না হওয়ায় বিদেশী মুদ্রার চাহিদা ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে। এই বৃদ্ধি অর্থনীতির উৎপাদন খাতগুলোর কোন কাজে আসছে না।

ঙ. প্রচলিত ব্যাংক ব্যবস্থা দুর্নীতিবাজ প্রশাসন আইনের ফাঁক, ব্যাংক ঋণের এই গতিকে শক্তি যোগাচ্ছে।

চ. বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে যে, দেশের বৃহৎ ব্যবসায়ী, প্রভাবশালী আমলা বিভিন্ন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ইতিমধ্যে কয়েক হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন। একটি সংস্থার অনুসন্ধান রিপোর্টে বেশ কয়েকজন আমলার বিদেশে পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ কয়েকশ মিলিয়ন ডলার বলে উল্লেখ করা হয়েছে।৩৮

শেষ কথা

পঁচাত্তর পরবর্তী বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সামাজিক কাঠামোর প্রকৃতি নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী বলা যায় যে, ক্ষমতা দখলোত্তর সামরিক-আমলাতান্ত্রিক শাসন যে পথ অনুসরণ করেছিল তা রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে সামরিক-আমলাতান্ত্রিক অভিজাততন্ত্রের ক্ষমতা ও কর্তৃত্বকে সুসংহত কেবল করেনি বরং নির্ভরশীল পুঁজিবাদ বিকাশের একটি অধ্যায় শুরু করেছিল। এই প্রক্রিয়া সমাজের একটি ক্ষুদ্র অংশের সম্পদ অর্জনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট কার্যকর ভূমিকা রাখে। পূর্ববর্তী শাসনের সময় থেকেই সমাজের মধ্যবর্তী এই অংশটির উত্থান শুরু হয়েছিল।৩৯

এই উন্নয়ন মডেল, একটি নতুন শ্রেণীর জন্ম দিয়েছে, তবে উৎপাদনী উপায়ের সাথে সম্পর্কিত ভিত্তিমূলক শিল্প বিকাশে তারা তৎপর হয়নি কারণ বাংলাদেশের নতুন পুঁজিপতিরা অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে উত্পাদনশীল বিনিয়োগের মাধ্যমে মুনাফা সর্বোচ্চকরণে কম আগ্রহী। পরিবর্তে, তারা ‘সঞ্চয়ের অতিরিক্ত অর্থনৈতিক পদ্ধতি’র উপর নির্ভর করে; যেমন চুরি, লুণ্ঠন এবং আত্মসাৎ। তারা আমলাতন্ত্রের সাথে সম্পর্কিত এবং তাদের সহায়তার উপর নির্ভরশীল যা পরেরটিকে আরও শক্তিশালী এবং প্রভাবশালী করে তোলে। এভাবে, একটি ‘নির্ভরশীল পুঁজিবাদী মডেলের অনুসরণে’৪০ দেশ বিশ্ব পুঁজিবাদী অর্থনীতির অন্তর্ভুক্ত হয়।৪১

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রকৃতি, ক্ষমতা-ব্লকের গঠন, শাসক শ্রেণীর সদস্যদের আর্থ-সামাজিক পটভূমি এবং ১৯৭৫ সালের অভ্যুত্থানের আগে ও পরের ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করলে স্পষ্টতই দেখা যায় যে, সামরিক জান্তার অভ্যুত্থানগুলো ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে কিছু বিক্ষুব্ধ সামরিক কর্মকর্তার আকস্মিক প্রতিক্রিয়া ছিল না কিংবা নিছক নিজেদের স্বার্থ রক্ষার সামরিক প্রচেষ্টাও ছিল না; বরং বাংলাদেশের পুঁজিবাদী বিকাশের দীর্ঘ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই ঘটনাগুলো ঘটতে থাকে। একাধিক গবেষণানুযায়ী, ১৯৭৫ সাল নাগাদ পুঁজিবাদী বিকাশের প্রক্রিয়া এমন এক সন্ধিক্ষণে পৌঁছায় যেখানে ব্যক্তি পুঁজির বিকাশের জন্য রাষ্ট্রের সক্রিয় ও কার্যকর সমর্থন আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এর সবচেয়ে সহজ উপায় ছিল ক্ষমতাবান গোষ্ঠীর পুনর্গঠন এবং সে অনুযায়ী রাষ্ট্রের উপরিকাঠামোর প্রকৃতি পরিবর্তন করা। ‘সামরিক/বেসামরিক অভ্যুত্থান’ সে লক্ষ্যেই সংগঠিত হয়েছিল। সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ রাষ্ট্রযন্ত্রকে এমনভাবে রূপান্তরিত করার উদ্যোগ নেয় যাতে সামরিক-আমলাতান্ত্রিক অভিজাততন্ত্র কর্তৃত্বের সমস্ত মৌলিক কাঠামোতে একটি প্রধান স্থান দখল করতে পারে। এটি ছিল তাদের দুর্বল অবস্থান থেকে ক্ষমতা-ব্লকের কেন্দ্রে আরোহণের চূড়ান্ত চেষ্টা। ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে শুরু হওয়া সামরিক-আমলাতান্ত্রিক অভিজাততন্ত্রের হাতে পুঁজিবাদী বিকাশ ও ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার প্রক্রিয়া আরও জোরদার হয় ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চের সফল সামরিক অভ্যুত্থানের পর যা লেফটেন্যান্ট জেনারেল এরশাদকে ক্ষমতায় নিয়ে আসে। সব দিক দিয়েই এরশাদ আমল (১৯৮২-১৯৯০) ছিল জিয়া আমলের সম্প্রসারণ মাত্র। শাসকগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক নীতি, রাজনৈতিক কৌশল ও আদর্শিক অবস্থানের লক্ষ্য ছিল পূর্ববর্তী সরকারের ‘অর্জনগুলো’ সুসংহত করা।৪২

‘সামরিক/বেসামরিক অভ্যুত্থান’ সে লক্ষ্যেই সংগঠিত হয়েছিল। সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ রাষ্ট্রযন্ত্রকে এমনভাবে রূপান্তরিত করার উদ্যোগ নেয় যাতে সামরিক-আমলাতান্ত্রিক অভিজাততন্ত্র কর্তৃত্বের সমস্ত মৌলিক কাঠামোতে একটি প্রধান স্থান দখল করতে পারে। এটি ছিল তাদের দুর্বল অবস্থান থেকে ক্ষমতা-ব্লকের কেন্দ্রে আরোহণের চূড়ান্ত চেষ্টা।

যার ফলে, ‘লুম্পেন পুঁজিবাদী’ বিকাশের প্রক্রিয়ায় আয়-সম্পদ-ভোগ বৈষম্যও ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। ১৯৮১ সালে বাংলাদেশে করপূর্ব জাতীয় আয়ের ১১ দশমিক ৮ শতাংশ ছিল ১ শতাংশ মানুষের হাতে। বিপরীতে নিচু তলার ৫০ শতাংশ মানুষের হাতে ছিল সম্পদের ২০ শতাংশ।৪৩

যুদ্ধোত্তর দশ বছরের মধ্যে বেড়ে যায় কোটিপতির সংখ্যা। রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা, আইন-কানুনের বহুবিধ পরিবর্তন, পুনর্বিন্যাস করতে হয় তারই প্রয়োজনে। রাষ্ট্র-ব্যবসায়ের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ  থেকে ঘনিষ্ঠতর হতে থাকে। আনু মুহাম্মদের ভাষ্য অনুযায়ী,

‘‘মাথাপিছু আয়ের হিসেব ধরলে বাংলাদেশ পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশ। গত দশ বছরের হিসাব নিলে ভয়াবহ চিত্র দেখতে পাই। উত্পাদন বাড়েনি, বেড়েছে জনসংখ্যা। শতকরা হিসেবে ধরলে সবচেয়ে বেড়েছে কোটিপতি। দশ বছরে বাংলাদেশ সব কিছুতে পিছিয়ে থাকলেও সৃষ্টি করেছে কোটিপতি। বর্তমানে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের সঙ্গে ‘দক্ষ’ এবং ‘উচ্চাভিলাষী’ যোগাযোগ, কোটিপতি হওয়ার প্রধান ভিত্তি। এই মন্তব্যে অতিরঞ্জন কিছু নেই। ব্যাংকের কোটি কোটি টাকা অনাদায়ই হচ্ছে এইসব কোটিপতির আয়ের উত্স। একটি ‘লুম্পেন’ অর্থনীতি, শিল্প কারখানা কিংবা স্থাবর মালিকানার চাইতে ‘কন্টাক্ট’ এবং ‘কন্ট্রাক্টের’ ওপরই বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এই যোগাযোগ এবং চুক্তির একপক্ষে থাকে রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন অংশের ক্ষমতাবান ব্যক্তি, অন্যপক্ষে থাকে উঠতি কিংবা ইতিমধ্যেই (হয়ে) উঠেছেন এমন কোটিপতিরা। রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন অংশের মধ্যে অন্যতম শক্তিটি হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক। এই পারস্পরিক সম্পর্কে সহযোগিতা করে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা।’’৪৪

ব্যাংকের কোটি কোটি টাকা অনাদায়ই হচ্ছে এইসব কোটিপতির আয়ের উত্স। একটি ‘লুম্পেন’ অর্থনীতি, শিল্প কারখানা কিংবা স্থাবর মালিকানার চাইতে ‘কন্টাক্ট’ এবং ‘কন্ট্রাক্টের’ ওপরই বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে।

এই নব্য কিংবা ‘আদি’ কোটিপতিরা তাদের পুঁজি কোন কোন খাতে বিনিয়োগ করেছে? কোটিপতিদের পুঁজির উৎস এবং বিনিয়োগের ক্ষেত্র সম্পর্কে আনু মুহাম্মদ বলছেন,

‘‘…এই গোষ্ঠী ব্যাংক থেকে এই অর্থ নিয়ে নিজেদের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ব্যবসা পরিচালনা করছে। তৈরি করছে নিজেদের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ভিত্তি। ব্যাংকের কয়েক হাজার কোটি টাকা কিছু লোকের লুণ্ঠনে গত কয়েক বছরে দেশে তৈরি হয়েছে শতাধিক কোটিপতি। যে কোটিপতির সংখ্যা বাহাত্তর সালে ছিল দুই জন। এই কোটিপতিরা শিল্প কিংবা কৃষি উৎপাদনের অর্থ বিনিয়োগ করেনি, বিনিয়োগ করেছে দেশের অভ্যন্তরে শিল্প কিংবা কৃষিপণ্য সঞ্চালনে অথবা আমদানী-রপ্তানিতে। তাদের ভিত্তি বিদেশে। ব্যবসা এদেশে। ব্যবসার মূলধন তাদের নয়, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের। কিন্তু ব্যবসায় মুনাফা ব্যাংক থেকে গৃহীত অর্থ সবই চালান হচ্ছে দেশের বিদেশি ব্যাংকে কিংবা সরাসরি বিদেশে। দেশের অর্থে কিছু কোটিপতি অর্থনীতির কঙ্কালকেই খেয়ে নিচ্ছে ঘুনেপোকার মতো। তাদের স্ফীত দেহের বিশ্রামের জন্যে বিদেশে ক্রীত হচ্ছে বাসভবন, হোটেল, ব্যাংক-ব্যালান্স ইত্যাদি।’’৪৫

’৮০-র দশক ‘‘পরবর্তী অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি, সব দেশেই, বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান সর্বত্রই, রাষ্ট্রকেন্দ্রিক এই অর্থনীতি শেষ পর্যন্ত ব্যক্তি পুঁজির বিকাশে নিয়ে ঠেকেছে, শ্রেণীমৈত্রীর সমাজতন্ত্র শ্রেণী বিভাজন ও বৈষম্যকে আড়াল করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণী রাষ্ট্রীয় খাতের উপর ভর করে বৃহৎ মালিক শ্রেণী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এবং সেই আবির্ভাবের পর তারা রাষ্ট্রায়ত্ত খাত আর প্রয়োজনীয় মনে করেনি। এই শ্রেণীশক্তির নতুন আবির্ভাব ও অর্থনীতির গতিমুখে নতুন মোড় পরস্পরকে তৈরি করেছে, শক্তি যুগিয়েছে।

রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো আয়তনের দিক থেকে এমন বৃহৎ ছিল  যে, এই প্রতিষ্ঠানগুলো বেসরকারি খাতসহ সমগ্র অর্থনীতির গতিধারার নির্ধারক ছিল। কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং সেই সঙ্গে ব্যাংক, বীমাসহ অর্থকরী প্রতিষ্ঠান, পানি-বিদ্যুৎ-টেলিফোনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা যেভাবে দাঁড় করানো হয় তাতে খুব দ্রুত এসব প্রতিষ্ঠানে একদিকে ক্ষমতার অপচয় হতে থাকে, অন্যদিকে সম্পদ পাচার ও লুণ্ঠনের নানা পথ তৈরি হয়। এর ফলাফল হলো: দ্রুত এসব প্রতিষ্ঠানের উপর দাঁড়িয়ে অর্থাৎ জনগণের সম্পদের উপর দাঁড়িয়ে নতুন বিত্তবান শ্রেণী সংহত রূপ নিতে থাকে যাদে অর্থসম্পদ উপার্জন বিদ্যমান আইনব্যবস্থাতে বৈধ ছিল না।

কাজেই যাকে আমরা জানি রাষ্ট্রায়ত্ত খাতে লোকসান হিসেবে তা প্রকৃত বিচারে বলা চলে বরাবরই নতুন বিত্তবান শ্রেণী গঠনের রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি। মূলত রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠন আত্মসাৎ করেই এই শ্রেণী গড়ে ওঠেছে। এই বিত্তবান শ্রেণী গড়ে ওঠার লক্ষণ ৭০ দশকের প্রথমার্ধেই দেখা যায়, ৮০ দশকে এর বিকাশ হয় সবচাইতে দ্রুত, যে দশকটি ছিল এ দেশে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ-এর সংস্কার কর্মসূচির সফল দশক। এই গড়ে ওঠা সংহত শ্রেণীই বাংলাদেশের পরিচালনার অভ্যন্তরীণ শক্তি। এই শ্রেণী ও বাংলাদেশের পুঁজিবাদের চেহারা পরস্পরকে ক্রমশ বর্তমান আকৃতি দান করেছে।’’৪৬

যাকে আমরা জানি রাষ্ট্রায়ত্ত খাতে লোকসান হিসেবে তা প্রকৃত বিচারে বলা চলে বরাবরই নতুন বিত্তবান শ্রেণী গঠনের রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি।

আওয়ামী লীগ শাসনামলের দুর্নীতি, অর্থনৈতিক সংকট এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির পরিপ্রেক্ষিতে ‘গণতন্ত্র’ পুনরুদ্ধারের ঘোষণা দিয়ে সামরিক বাহিনীর জেনারেলরা ক্ষমতা দখলের যৌক্তিকতা তুলে ধরে।৪৭ কিন্তু তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, পাকিস্তান আমলের রাষ্ট্রকাঠামো, উৎপাদন ব্যবস্থা; রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বল এবং ভঙ্গুর দশা; ব্যক্তি পুঁজি আহরণ-সংবর্ধন-সম্প্রসারণের আদিম প্রক্রিয়া; ‘‘মুক্ত বাজার’ অর্থনীতির নিরাকার পুঁজির সাকার শাসনের’’৪৮ বলয়ে ‘দেশী-বিদেশি ব্যক্তি পুঁজির বিকাশের উদ্দেশ্যে বাজারমুখী সংস্কারের’৪৯ ধারাবাহিকতায় কোন বিচ্ছেদ ঘটেনি সামরিক শাসনের ফলে। দেশের অভ্যন্তরে পেটি বুর্জোয়া সম্প্রদায়ের নব্য লুটেরা ধনী অংশ; যাদের হাতে বিভিন্ন ধরনের লুণ্ঠন প্রক্রিয়ায় প্রচুর সম্পদ জমা হয়েছিল এবং আওয়ামী লীগ আমলে যারা সুবিধা করে উঠতে পারেনি; তাদের তাপে-চাপে-প্রভাবে এবং বিদেশি রাষ্ট্র-সংস্থা-পুঁজির আদেশ ও নির্দেশনা অনুযায়ী মূলত বেসামরিক একনায়কতন্ত্র শাসন থেকে সামরিক একনায়তন্ত্র শাসন ব্যবস্থায় পরিবর্তন হয়।৫০ বাজারমুখী সংস্কার৫১ –যে প্রক্রিয়াটি ছিল ধীরগতির –সেটি খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসে; পরে তা দ্রুতগতিসম্পন্ন হয়। এই প্রয়োজনে উপরিকাঠামোতে বহু ধরনের বিন্যাস, পুর্নবিন্যাসের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। রাষ্ট্র ক্ষমতার এই পরিবর্তনকে কোন কোন পণ্ডিত, গবেষক দেখছেন ‘‘সর্বজনের’ শক্তিশালী সংস্থার অভাবে’ আধিপত্যবাদী শ্রেণীর ‘রাষ্ট্রক্ষমতার উপর আধিপত্যবাদী/দখলীস্বত্ব কায়েমের সংকট’ হিসেবে। যা আবার ‘অর্থনৈতিক জৈবিক ভিত্তির সাথে’ সম্পর্কিত।৫২

পরিশেষে আনু মুহাম্মদের বক্তব্যটি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা দরকার। তিনি বলছেন যে,

‘‘ব্যাংক, ভারী শিল্প জাতীয়করণ করাটাই জাতীয় অর্থনীতির বিকাশের যথেষ্ট শর্ত নয়। যথেষ্ট শর্ত পূরণ তখনই হবে যখন রাষ্ট্রযন্ত্র জাতীয় অর্থনীতি বিকাশের অনুকূল শক্তি হবে। এই অনুকূল শক্তি কীভাবে আসতে পারে সে প্রশ্ন ভিন্ন। কিন্তু এখানে আমরা এতটুকু বলতে পারি যে, ১৯৭২ থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রযন্ত্র জাতীয় অর্থনীতি বিকাশের প্রতিকূল শক্তি হিসেবেই কাজ করেছে, যার ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত সকল ব্যাংক শিল্প প্রতিষ্ঠানকে কিছু ব্যক্তির কালো টাকার মালিক হওয়ার ইনস্ট্রুমেন্ট হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। ব্যাংকে জমাকৃত জনগণের টাকা পরজীবী শ্রেণীগুলোর বিশাল বিত্ত বানানোর হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। জাতীয় অর্থনীতির বিকাশকে রুদ্ধ না করে এই ব্যবসায়িক পুঁজির এরকম শ্রীবৃদ্ধি সম্ভব ছিল না বলেই দ্বিতীয়টি ঘটবার সঙ্গে সঙ্গে প্রথমটি নৈরাজ্যের সম্মুখীন হয়েছে।’’৫৩

(চলবে)

মেহেদী হাসান: লেখক, গবেষক। ই-মেইল: mehedihassan1@gmail.com

তথ্যপঞ্জি

১ V.I. Lenin: The State and Revolution: The Marxist Theory of the State & the Tasks of the Proletariat in the Revolution, Source: Collected Works, Volume 25, p. 381-492, First Published: 1918, Transcription\Markup: Zodiac and Brian Baggins, Online Version: Lenin Internet Archive (marxists.org) 1993, 1999.

২ আনু মুহাম্মদ: সামরিক শাসনের দশকে, নবরাগ প্রকাশনী, ২০১১, পৃ: ২৭।

৩ Haque, AKM Masudul: ‘Privatisation in Bangladesh- A Case of Placing the Cart Before the Horse’, (2002), UWSLawRw 6; (2002) University of Western Sydney Law Review 124, p.7.. https://www8.austlii.edu.au/cgi-bin/viewdoc/au/journals/UWSLawRw/2002/6.html.

৪ Lant Pritchett, Kunal Sen, and Eric Werker (ed.): Deals and Development The Political Dynamics of Growth Episodes, Oxford University Press, 2018, p.105.

৫ আনু মুহাম্মদ: বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিমুখ, বাঙ্গালা গবেষণা, ২০২২; প্রথম প্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ২০০৫, পৃঃ ২২।

৬ S. M. Shamsul Alam: ‘The Military and the Crisis of Political Hegemony in Bangladesh’, South Asin Bulletin, volume 10 number 2, (Fall, 1990), Published by Duke University Press, P.35.

৭ Ali Riaz: State, Class and Military Rule in Bangladesh: 1972-1982, Ph.D. University of Hawaii, 1993, p.307.

৮ Amin-Al-Zaman: Party Factionalism in Bangladesh: A case study of the Awami League (1971-97), PHD thesis, Department of Political Science, Aligarh Muslim University (India), 2004, p.46.

৯ Haque, AKM Masudul: ‘Privatisation in Bangladesh; A Case of Placing the Cart Before the Horse’, (2002), UWSLawRw 6; (2002) University of Western Sydney Law Review 124, p.12-13.. https://www8.austlii.edu.au/cgi-bin/viewdoc/au/journals/UWSLawRw/2002/6.html.

১০ Rehman Sobhan, Syed Akhter Mahmood: ‘The Economic performance of Denationalised Industries in Bangladesh: The Case of the Jute and Cotton Textile Industries’, Research Report no,129, June 1991, Bangladesh Institue of Development Studies (BIDS), Dhaka. p.5-6.

১১ Justin Yifu Lin: ‘The Washington Consensus revisited: a new structural economics perspective’ 2015, Journal of Economic Policy Reform, 18:2, 96-113, DOI: 10.1080/17487870.2014.936439

১২ John Pilger: An Unfashionable Tragedy, https://johnpilger.com/videos/an-unfashionable-tragedy

১৩ অনুপম সেন: বাংলাদেশ– রাষ্ট্র  সমাজসামাজিক অর্থনীতির স্বরূপ, ২য় সংস্করণ, ঢাকা: অবসর প্রকাশনা সংস্থা, ১৯৯৯, পৃঃ-৭২।

১৪ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৭২-৭৪।

১৫ Haque, AKM Masudul: ‘Privatisation in Bangladesh; A Case of Placing the Cart Before the Horse’, (2002), UWSLawRw 6; (2002) University of Western Sydney Law Review 124, p.7 &34. https://www8.austlii.edu.au/cgi-bin/viewdoc/au/journals/UWSLawRw/2002/6.html.

১৬ Ali Riaz: State, Class and Military Rule in Bangladesh: 1972-1982, Ph.D. University of Hawaii, 1993, p. 310

১৭—Ibid— p. viii.

১৮—Ibid—p.193.

১৯ Haque, AKM Masudul: ‘Privatisation in Bangladesh; A Case of Placing the Cart Before the Horse’, UWSLawRw 6, 2002. University of Western Sydney Law Review 124, p.16.. https://www8.austlii.edu.au/cgi-bin/viewdoc/au/journals/UWSLawRw/2002/6.html.

২০—Ibid—p.16-18. (১৯-২০ পাদটীকার অন্তর্ভুক্ত অনুচ্ছেদগুলো উল্লিখিত গবেষকের গবেষণার উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে।)

২১—Ibid—p.8.

২২ Ali Riaz: State, Class and Military Rule in Bangladesh: 1972-1982, Ph.D. University of Hawaii, 1993, p. 309.

২৩—Ibid—p. 314-315.

২৪ আনু মুহাম্মদ: সামরিক শাসনের দশকে, নবরাগ প্রকাশনী, ২০১১, পৃ: ৭৯।

২৫ Haque, AKM Masudul: ‘Privatisation in Bangladesh; A Case of Placing the Cart Before the Horse’, (2002), UWSLawRw 6; (2002) University of Western Sydney Law Review 124, p.2.. https://www8.austlii.edu.au/cgi-bin/viewdoc/au/journals/UWSLawRw/2002/6.html.

২৬ ছক:৩৩, ১৯৭১-৭২ থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি

পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ১৯৮০-৮১ অর্থবছরে ঋণ বৃদ্ধির পরিমাণ ছিল ৪৬৩.৩৭ কোটি টাকা।

সূত্র: আনু মুহাম্মদ; সামরিক শাসনের দশকে, নবরাগ প্রকাশনী, ২০১১, পৃ: ৭৬।

২৭ ছক:৩৪, শিল্প ব্যাংক থেকে প্রদত্ত ঋণ

সূত্র: প্রাগুক্ত, পৃ: ৭৭।

২৮ Haque, AKM Masudul: ‘Privatisation in Bangladesh; A Case of Placing the Cart Before the Horse’, (2002), UWSLawRw 6; University of Western Sydney Law Review 124, p.7 &34. https://www8.austlii.edu.au/cgi-bin/viewdoc/au/journals/UWSLawRw/2002/6.html

২৯ Ali Riaz: State, Class and Military Rule in Bangladesh: 1972-1982, Ph.D. University of Hawaii, 1993, p. 315.

৩০ Haque, AKM Masudul: ‘Privatisation in Bangladesh; A Case of Placing the Cart Before the Horse’, (2002), UWSLawRw 6; University of Western Sydney Law Review 124, p.7-8. https://www8.austlii.edu.au/cgi-bin/viewdoc/au/journals/UWSLawRw/2002/6.html.

৩১ ছক: ৩৫ ‘সাহায্য’ (ঋণ) নির্ভরতার ধরণ

সূত্র: Table 7.5; The Dimensions of Aid Dependence, 1975/76-1981/82- Ali Riaz: State, Class and Military Rule in Bangladesh: 1972-1982, Ph.D. University of Hawaii, 1993, p.318-319.

৩২ ছক:৩৬ অর্থনীতিতে ‘সাহায্য‘ (ঋণ)-এর অবদান

সূত্র: Table 7.6, Contribution of Aid in Economoy, 1975/76-1980/81, —Ibid— p.318-319.

৩৩ Ali Riaz: State, Class and Military Rule in Bangladesh: 1972-1982, Ph.D. University of Hawaii, 1993, p319.

৩৪—Ibid—p. 326.

৩৫—Ibid—p. 333.

৩৬—Ibid— p.334.

৩৭ S. M. Shamsul Alam: ‘The Military and the Crisis of Political Hegemony in Bangladesh’, South Asian Bulletin, volume 10 number 2, (Fall, 1990), Published by Duke University Press, P.38.

৩৮ আনু মুহাম্মদ: সামরিক শাসনের দশকে, নবরাগ প্রকাশনী, ২০১১, পৃ: ৭৩-৭৫।

৩৯ Haque, AKM Masudul: ‘Privatisation in Bangladesh; A Case of Placing the Cart Before the Horse’, (2002), UWSLawRw 6; University of Western Sydney Law Review 124, p.8.. https://www8.austlii.edu.au/cgi-bin/viewdoc/au/journals/UWSLawRw/2002/6.html

৪০ Mushtaq H. Khan: ‘The politcal Settlement- Growth and Technical Progress in Bangladesh’, DIIS Working Paper, 2012:01, 2013, Denmark, p.10-11.

৪১ Ali Riaz: State, Class and Military Rule in Bangladesh: 1972-1982, Ph.D. University of Hawaii, 1993, p.336.

৪২—Ibid—p.341-342.

৪৩ রেজাউল করিম বায়রন, আসিফুর রহমান: ‘বৈষম্য বাড়ছেই’, অনুবাদ- মামুনুর রশীদ, ডিসেম্বর ৯, ২০২১, https://bangla.thedailystar.net/সংবাদ/বাংলাদেশ/বৈষম্য-বাড়ছেই-292506

৪৪ আনু মুহাম্মদ: সামরিক শাসনের দশকে, নবরাগ প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১১, পৃ: ৭১।  

৪৫প্রাগুক্ত

৪৬ আনু মুহাম্মদ: বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিমুখ, বাঙ্গালা গবেষণা, ২০২২; প্রথম প্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ২০০৫, পৃঃ ১৮-১৯।

৪৭ Mushtaq H. Khan: ‘The politcal Settlement, Growth and Technical Progress in Bangladesh’, DIIS Working Paper, 2012:01, 2013, Denmark, p.45-46.

৪৮ আনু মুহাম্মদ: বিশ্বায়নের বৈপরীত্য, সংহতি প্রকাশন, ২০২১, ঢাকা, পৃঃ ৫৯-৮৪।

৪৯ Haque, AKM Masudul: ‘Privatisation in Bangladesh; A Case of Placing the Cart Before the Horse’, (2002), UWSLawRw 6; (2002) University of Western Sydney Law Review 124, p.15-16. https://www8.austlii.edu.au/cgi-bin/viewdoc/au/journals/UWSLawRw/2002/6.html

৫০ Mirza Hassan, Selim Raihan: ‘Navigating the Deals World: The Politics of Economic Growth’ in Bangladesh, Deals and Development: the Political Dynamics of Growth Episodes, edited by Lant Pritchett et al. 2017, (96-128), p.106-107. https://doi.org/10.1093/oso/9780198801641.003.0004

৫১ Lant Pritchett, Kunal Sen, and Eric Werker (ed.); Deals and Development The Political Dynamics of Growth Episodes, Oxford University Press, 2018, p.106.

৫২ S. M. Shamsul Alam: ‘The Military and the Crisis of Political Hegemony in Bangladesh’, South Asin Bulletin, volume 10 number 2, (Fall, 1990), Published by Duke University Press, P.33.

৫৩ আনু মুহাম্মদ: সামরিক শাসনের দশকে, নবরাগ প্রকাশনী, ২০১১, পৃ: ৮০।

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •