ধর্মদ্রোহিতার আনন্দ

মৌলবাদের সংঘাত: ক্রুসেড, জিহাদ এবং আধুনিকতা-৩

ধর্মদ্রোহিতার আনন্দ

অনুবাদ: ফাতেমা বেগম

স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে ষাট দশকে দুই পাকিস্তানের মানুষের লড়াই নিয়ে লেখা বই থেকে শুরু করে বিশ্ব রাজনীতি, ইতিহাস, বিশ্বে আগ্রাসন প্রতিরোধ ও মুক্তির আন্দোলন ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে তারিক আলি লিখিত বইগুলো গুরুত্বপূর্ণ। ২০০২ সালে যখন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসী তৎপরতা অনেক বিস্তৃত এবং ইসলামী মৌলবাদ বিশ্বজুড়ে আলোচিত বিতর্কিত বিষয় তখন তাঁর বই The Clash of Fundamentalisms: Crusades, Jihads and Modernity প্রকাশিত হয়। তারিকের এই বই অনুসন্ধান করেছে ধর্মীয় বিভিন্ন মত পথ, বিভিন্ন ধরনের মৌলবাদী শক্তি, তার ইতিহাস ও রাজনীতি এবং সর্বোপরি তাঁর ভাষায় ‘সবচাইতে বড় মৌলবাদী শক্তি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ’-এর সাথে এর  সম্পর্ক। সর্বজনকথার জন্য এই বই-এর ধারাবাহিক অনুবাদ করছেন লেখক অনুবাদক ফাতেমা বেগম

ইসলামে স্পষ্টতই কোনো যাজকের পদ নিষিদ্ধ। আল্লাহর দরবারে সকল বিশ্বাসীর মর্যাদা সমান। মসজিদে কোনো ছোট-বড় শ্রেণি বিভাজনের অনুমতি নেই। তার মানে হলো, যে কোনো মুসলমান কার্যত জুমাবারে বয়ান দিতে পারেন। ইসলাম যদি প্রথম একশবছরে গন্তব্যহীনতায় আটকে যেতে বাধ্য হতো, তাহলে তা শুধু কৌতূহলোদ্দীপক বিমূর্ত কিছু হওয়া ছাড়া আর কি-ই-বা হতে পারত। তবে ইসলামকে সেই পথ কখনোই বেছে নিতে হয়নি। বরং ইসলামের নেতারা খুব দ্রুত বড় বড় সাম্রাজ্যের কর্তৃত্ব লাভ করেন। এতে ইসলামে নানা ধরনের তাৎক্ষণিক উদ্ভাবন প্রবেশ করে। মুহাম্মদের মৃত্যুর অনেক বছর পর কোরআনের প্রথম অনুমোদিত সংস্করণ বের হয়। তৃতীয় খলিফা উসমান এই সংস্করণের নির্ভুলতা নিশ্চিত করেন। এটিই নির্ভুল সংস্করণ হিসেবে গ্রহণযোগ্য হয়। যদিও প্যাট্রিসিয়া ক্রোনের মতো আধুনিক ‘কাফের’ পণ্ডিত দাবি করেন, সপ্তম শতকের শেষ দশকের আগ পর্যন্ত কোরআনের কোনো অস্তিত্ব ছিলনা।

সময়ের হিসাব যাইহোক, বিজিতদের ভূমিতে ইসলামি আধিপত্য জাহির করার জন্য প্রয়োজনীয় সামাজিক ও রাজনৈতিক আচরণ সংক্রান্ত নিয়মাবলি পরিপূর্ণভাবে প্রদানের ক্ষেত্রে কিছু বিষয়ে বেশ বিস্তারিত হওয়া সত্ত্বেও কোরআন শরিফের নির্দেশাবলি যথেষ্ট ছিল না। এর সমাধান হিসেবে হাদিস বা পরম্পরাগত মতবাদের উদ্ভব ঘটে। হাদিস বা পরম্পরাগত মতবাদ হলো: একটি নির্দিষ্ট দিনক্ষণে নবি বা তার সাহাবিরা বা তাদের স্ত্রীরা ‘ক’এবং‘খ’-কে যা বলেছিলেন, তা আবার ‘গ’ এবং ‘ঘ’ জানতে পারল, তারা আবার লেখককে জানালেন এবং লেখক তখন তা লিপিবদ্ধ করে রাখলেন। খ্রিষ্টান ধর্মেও একই প্রথা অনুসৃত হয়েছে। তবে সেখানে পরম্পরাগত মতবাদ চারটি গসপেলে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছিল। চারটি গসপেলের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে অলৌকিক ঘটনা বা অন্য পর্বগুলোর পরস্পর বিরোধী হয় সম্পাদিত হয়েছে অথবা সেগুলোকে একেবারে ন্যূনতম পর্যায়ে নামিয়ে আনা হয়েছে।

হাদিস সংগ্রহে আরবীয় কানাঘুষার এই বিস্ময়কর ধারাটি উপদ্বীপটিতে শুরু হয়ে দামেস্ক পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। এভাবে হাদিস সংকলনকে চার বা এমনকি পাঁচটি ছোট পর্বেও ভাগ করে রাখা যায়নি। নবী স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অলৌকিক কোনো কিছু করার ক্ষমতাকে বাতিল ঘোষণা করেছিলেন। তিনি তার প্রতি নাজিল হওয়া ঐশ্বরিক বাণী আরও বৃহত্তর শ্রোতার কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য শুধুই একজন বার্তাবাহক ছিলেন।

তাই এই নতুন ধর্মটি অলৌকিক ঘটনার বিবরণ তৈরি করত না। তবে কিছু মুসলিম ঘটনাপঞ্জি লেখক খ্রিষ্টধর্মের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা থেকে নিজেদের বিরত রাখতে পারেনি, যদিও তাদের বিবরণগুলো অন্যদের কাছে আরও কম বিশ্বাসযোগ্য ছিল। দুঃখজনক হলো, আরবরা তাদের প্রশংসনীয় কল্পনাশক্তি দিয়ে মুসা, যিশু এবং অন্যদের নিয়ে রচিত সাহিত্যকে অনেক পেছনে ফেলে তারা নিজেরাই অসাধারণ সাহিত্য তৈরি করতে পারত। মুহাম্মদের শুরুর দিকের জীবনী লেখকরা তাকে অলৌকিকতার সঙ্গে মিলিয়ে ফেলেছিলেন, কিন্তু এগুলো মুসা বা যিশুর অলৌকিক কাহিনির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে পারেনি।

হাদিসের ঐতিহ্য তৈরির প্রয়োজন থেকে একটি নতুন বুদ্ধিবৃত্তিক শিল্পের সূচনা ঘটে। এই বুদ্ধিবৃত্তিক শিল্প সপ্তম ও অষ্টম শতাব্দী জুড়ে শত শত পণ্ডিত ও লেখকের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছিল। তবে তাদের অধিকাংশই মেধাগতভাবে এই কাজের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। এজন্যই কোনো কোনো হাদিসের সত্যতা নিয়ে উগ্র যুক্তিতর্কের অবতারণা হয়। এতে নিজেদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত দলগুলো তাদের পক্ষে সমর্থন আদায়ের স্বার্থে পণ্ডিতদের নিয়োগ করতে থাকেন। পরবর্তী সময়ে সুফি মরমিরা, তারা যা শুনতে চায় তার ওপর জোর দিয়ে তাদের নিজস্ব হাদিসের ধারা তৈরি করেন। ‘ইসলামে কোনো সন্ন্যাসবাদ নেই’ যথেষ্ট খাঁটি শোনায়, কিন্তু নবী কি সত্যিই বলেছেন: ‘দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়, কিন্তু তার আগে তোমার উট বেঁধে রাখ?’ যদি তিনি তা বলে থাকেন, তাহলে এর অর্থ কী ছিল? তিনি কি এরকম কোনো ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে, কিছু মুমিন নামাজের সময়কে অন্য কোনো মুমিনের উট চুরির কাজে ব্যবহার করতে পারে? যদি তিনি তা ইঙ্গিত দিয়ে থাকেন, তাহলে এর অর্থ কী ছিল? নাকি কোনো কাফেরকে উট চুরি হওয়া থেকে বিরত রাখার জন্য এটা বলেছিলেন? অথবা উটের মালিককে অনুসরণ এবং মসজিদকে দূষিত করা থেকে বিরত রাখার জন্য এটি পুরোপুরি একটি নিরাপত্তাজনিত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা ছিল? অথবা অন্য কী হতে পারে? হাদিসের যুদ্ধ এখনো চলছে। এগুলোর কোনোটিই প্রামাণিক কিনা, সে ব্যাপারে মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা এক হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে এটি নিয়ে বিতর্ক করছেন, কিন্তু কোনো ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেননি, বা সম্ভবও নয়, যদিও শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ইসলামি পণ্ডিতরা গ্রহণযোগ্য হাদিসের সংখ্যা হ্রাস করেছেন এবং সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য লেখকদের নাম তাতে সংযুক্ত করেছেন।

যাইহোক, হাদিসের সত্যতার চেয়ে বরং ইসলামি সমাজে তারা যে আদর্শিক ভূমিকা পালন করেছিলেন, সেটাই মূল আলোচ্য বিষয়। হাদিসের এই সুন্নি ধারা শিয়াদের ‘ধর্মদ্রোহিতা’কে চ্যালেঞ্জ করে। শিয়াবাদের উত্থান উত্তরাধিকারের বিতর্ককে ঘিরে। ৬৩২ সালে মুহাম্মদের মৃত্যুর পর, তার সঙ্গীরা উত্তরাধিকার নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নেন। তাঁরা আবু বকর এবং তার মৃত্যুর পর উমরকে তাদের নেতৃত্বের জন্য বেছে নিয়েছিলেন। মুহাম্মদের জামাতা আলী সম্ভবত এতে বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন, তবে তিনি কোনো প্রতিবাদ করেননি। কিন্তু তৃতীয় খলিফা হিসেবে উসমানকে নির্বাচন আলীকে ক্রোধান্বিত করেছিল। উমাইয়া বংশের উসমান মক্কার উপজাতীয় অভিজাতদের প্রতিনিধিত্ব করতেন। তার বিজয় অনুগত পুরোনো ধর্মরক্ষক আলী-অনুরাগীদের অসন্তুষ্ট করেছিল। যদি নতুন খলিফা আরও কম বয়সি এবং আরও শক্ত প্রশাসক হতেন, তবে তিনি সবার মধ্যে একটি কার্যকরী সমন্বয় গড়ে তুলতে সক্ষম হতেন। কিন্তু উসমান সত্তর বছর বয়সের একজন বৃদ্ধ মানুষ। তিনি প্রশাসনিক দায়িত্বে তাড়াহুড়ো করতে থাকেন। সেজন্য তিনি সদ্য বিজিত প্রদেশের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিকটাত্মীয় এবং গোষ্ঠী-সদস্যদের নিয়োগ করেন। ৬৫৬ সালে তিনি আলীর সমর্থকদের দ্বারা খুন হন। এরপর আলী নতুন খলিফা হিসেবে অভিষিক্ত হন।

এ ঘটনার মধ্য দিয়ে ইসলামের প্রথম গৃহযুদ্ধের সূচনা হয়। মুহাম্মদের দুই পুরাতন সঙ্গী–তালহা ও আল-জুবায়ের–উসমানের অনুগত সৈন্যদের বিদ্রোহ করার আহ্বান জানান। তাদের সঙ্গে ছিলেন নবীর অল্পবয়সি বিধবা আয়েশা। বসরার কাছে যুদ্ধটি সংঘটিত হয় এবং আয়েশা সেখানে একটি উটে চড়ে ‘দখলদার’কে পরাজিত করার জন্য তার সৈন্যদের উৎসাহিত করতে থাকেন। ‘উটের যুদ্ধ’ নামে পরিচিত এই যুদ্ধে আলীর সেনাবাহিনীই বিজয়ী হয়েছিল। যুদ্ধে তালহা ও আল-জুবায়ের নিহত হন। আয়েশাকে মদিনায় দৃশ্যত গৃহবন্দি করে রাখা হয়।

পরবর্তীকালে, বিরোধীপক্ষ উমাইয়াদের কূটকৌশলে আলী আরেকটি যুদ্ধে পরাজিত হন। যুদ্ধকালে প্রতিপক্ষের সঙ্গে সালিশ মানার সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং পরাজিত হওয়ায় আলীর নিজের দলের কট্টরপন্থিরাই অসন্তুষ্ট হয়েছিল। তাদেরই একজন ৬৬০ সালে কুফার একটি মসজিদের বাইরে আলীকে হত্যা করে। উমাইয়া মেধাবী জেনারেল মুয়াবিয়াকে খলিফা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। কিন্তু আলীর দুই সন্তান হাসান ও হোসেন এই মুয়াবিয়াকে শাসক হিসেবে মেনে নিতে পারেননি। তাঁরা মুয়াবিয়ার সন্তান ইয়াজিদের বিরুদ্ধে কারবালার যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হন। এই পরাজয় ইসলামের মধ্যে স্থায়ী বিভেদ সৃষ্টি করে। এরপর আলীর অনুসারীরা শিয়াবাদী পরিচয়ে তাদের নিজস্ব রাজ্য এবং রাজবংশ তৈরি করে। শিয়াবাদী হিসেবে মধ্যযুগীয় পারস্যরা এবং সমসাময়িক ইরানিরা সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত।

শিয়ারা আয়েশা এবং উমাইয়া বিরোধী একটি নিজস্ব আক্রমণাত্মক ধারা গড়ে তুলেছিল। প্রকৃতপক্ষে আয়েশা আইনত নির্বাচিত খলিফা আলীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে তাকে অসম্মান করাই তাদের উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায়। আলীর অনুসারীরা অভিযোগ করেন যে, কোরআনের প্রথম অনুমোদিত সংস্করণ বের করার সময় যে আয়াতগুলো গোষ্ঠীগত প্রতিদ্বন্দ্বী আলীর সমর্থকদের পক্ষে যায়, সেগুলোকে দুর্বল-হাঁটুর খলিফা উসমান সরিয়ে দিয়েছিলেন। যে ধারাগুলো আয়েশাকে অপরাধী ভাবের সেগুলোর মধ্যে একটি ধারা দাবি করে যে, মৌখিক কোরআনের সময়কালে, ওল্ড টেস্টামেন্টের প্রতি সেই সময়ে চলমান শ্রদ্ধার ধারা বজায় রাখার জন্য ব্যভিচারের শাস্তি হিসেবে ‘মৃত্যু পর্যন্ত পাথর মারার’ সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু উসমানের প্রকাশিত সংস্করণে ভালোভাবে বেত্রাঘাতকেই ব্যভিচারের যথেষ্ট শাস্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

যদি নিজেদের মধ্যে ঐতিহ্য বনাম পালটা-প্রথা, ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যার স্কুলকে ঘিরে বাস্তবিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই এবং সর্বোপরি কোরআনের সত্যতা নিয়ে বিরোধের এই চরম উত্তেজনাকর পরিবেশে ধর্ম নিয়ে সংশয়বাদী ও ধর্মবিরোধীদের সূক্ষ্ম মতবাদ আবির্ভূত না হতো, তাহলে আশ্চর্য হওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। এগুলো যথাসময়েই আবির্ভূত হয়েছিল। লক্ষণীয় বিষয় হলো, ইসলামের প্রথম বারো শতকে এর অনুসারীদের অনেককে অনেকদিন যাবৎ নিপীড়ন সহ্য করতে হয়েছিল। যারা কোরআনকে চ্যালেঞ্জ করেছিল, তাদের বন্দি করা এবং মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। যেমন: নবম শতাব্দীতে ইয়েমেনে ধর্মবিরোধী লেখকরা তাদের সাহিত্য ধারায় সেই সময়ে নবীর নৈতিক অবস্থানকে নিন্দিত এবং অপমানজনক হিসেবে বর্ণনা করেছিল। দুঃখজনকভাবে, কথাসাহিত্য এবং এর লেখক উভয়কেই নিশ্চিহ্ন করা হয়েছিল।

সেই সময় ইসলাম একটি ক্রমবিস্তারমান এবং আত্মবিশ্বাসী ধর্ম ছিল। আন্দালুসীয় (বর্তমান স্পেন, পর্তুগাল, দক্ষিণ ফ্রান্সের কিছুটা অংশ আল-আন্দালুস বলে পরিচিত ছিল) দার্শনিকরা সাধারণত তাদের বিতর্ক ইসলামে অনুমোদিত সীমানার মধ্যেই বজায় রাখতেন।

কিন্তু অনেক কবি, দার্শনিক এবং ধর্মবিরোধীরা জ্ঞান অনুসন্ধানের জন্য বিতর্ক ও ভিন্নমতের সীমানাকে বিস্তৃত এবং ইসলামি সভ্যতাকে সমৃদ্ধ করেছেন। মোল্লাদের প্রতিবাদ প্রায়ই শাসকদের কানে আসত না। এ থেকে অনুমান করা যায় যে, সেই সময় ইসলাম একটি ক্রমবিস্তারমান এবং আত্মবিশ্বাসী ধর্ম ছিল। আন্দালুসীয় (বর্তমান স্পেন, পর্তুগাল, দক্ষিণ ফ্রান্সের কিছুটা অংশ আল-আন্দালুস বলে পরিচিত ছিল) দার্শনিকরা সাধারণত তাদের বিতর্ক ইসলামে অনুমোদিত সীমানার মধ্যেই বজায় রাখতেন। যদিও দ্বাদশ শতাব্দীর কর্ডোভান (বর্তমান স্পেনের আইবেরিয়ান উপদ্বীপ সংলগ্ন আরেক প্রদেশ কর্ডোভার অধিবাসী) ইবনে রুশদ (১১২৬-৯৮) মাঝে মাঝে অনুমোদিত সীমান্ত অতিক্রম করতেন। তিনি ল্যাটিন বিশ্বের কাছে অ্যাভেরোস নামে পরিচিত, তিনি ছিলেন ইসলামি শরিয়া আইনানুযায়ী নির্ধারিত বংশানুক্রমিক বিচারক বা কাজিদের পুত্র ও নাতি। ইবনে রুশদের দাদা একটি মুসলিম শহরের সর্বোচ্চ বিচারক ছিলেন এবং কর্ডোভার প্রসিদ্ধ মসজিদের ইমাম হিসেবেও দায়িত্ব পালন করতেন৷ তিনি নিজেও সেভিল এবং কর্ডোভা উভয় শহরেরই কাজি ছিলেন। তারপরও ধর্মীয় নেতাদের ক্রোধের শিকার হয়ে ইবনে রুশদকে কর্ডোভা থেকে পালিয়ে যেতে হয় এবং তার বই তারা পুড়িয়ে ফেলে। কর্ডোভার গ্রেট মসজিদে (উমাইয়াদ শাসক আবদাল রহমান কর্তৃক অষ্টম শতাব্দীতে নির্মিত) প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয় তার জন্য।

ধর্মীয় নেতাদের ক্রোধের শিকার হয়ে ইবনে রুশদকে কর্ডোভা থেকে পালিয়ে যেতে হয় এবং তার বই তারা পুড়িয়ে ফেলে। কর্ডোভার গ্রেট মসজিদে (উমাইয়াদ শাসক আবদাল রহমান কর্তৃক অষ্টম শতাব্দীতে নির্মিত) প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয় তার জন্য।

ধর্মীয় গোঁড়ামির সঙ্গে সংঘাত তার চিন্তাশক্তিকে যেমন তীক্ষ্ণ করেছিল, তেমনি তাকে সাবধানীও করে তুলেছিল। জ্ঞানদীপ্ত সুলতান আবু ইউসুফ তাকে আকাশের প্রকৃতি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে জ্যোতির্বিজ্ঞানী-দার্শনিক ইবনে রুশদ প্রাথমিকভাবে তার কোনো উত্তর দেননি। সুলতান আবু ইউসুফ গুরুত্ব সহকারে জানতে চাইলেন: ‘এটি এমনকী পদার্থ, যা অনন্তকাল থেকে বিরাজমান?কিংবা একটি শুরু হলো কীভাবে?’ প্রাচীন দার্শনিকদের কাজের ব্যাপারে শাসক সুলতান ইউসুফ যে ওয়াকিবহাল, সেই ইঙ্গিত পেয়ে ইবনে রুশদ ব্যাখ্যা করেছিলেন, কেন যুক্তিবাদী পদ্ধতিগুলো ধর্মীয় গোঁড়ামির চেয়ে উচ্চতর। নিজেকে আধা-বস্তুবাদী দাবি করার মধ্যে মৃত্যুর ঝুঁকি আছে জেনেও ইবনে রুশদ তার শাসককে বিশ্বাস করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সুলতান তার গবেষণাকে উৎসাহিত করেছিলেন। সুলতান ইঙ্গিত দেন যে, তার নিজের কাছে অ্যারিস্টটলের কিছু দুষ্পাঠ্য কাজ সংরক্ষিত আছে এবং তিনি ইচ্ছা প্রকাশ করেন,  কেউ যদি এগুলোর পরিষ্কার এবং সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা দিত। এটা বলে তিনি ইবনে রুশদকে একগুচ্ছ বই উপহার দেন। বইগুলো থেকে তার ‘মন্তব্যগুলো’ খ্রিষ্টান এবং ইহুদি ধর্মতাত্ত্বিকদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। আরবি ভাষায় লিখিত তার মন্তব্যগুলোর বেশিরভাগই হারিয়ে গেছে বা ধ্বংস হয়ে গেছে অথবা আংশিকভাবে কিছু টিকে আছে। ল্যাটিন ভাষায় অতি সামান্য যতটুকু টিকেছিল তা রেনেসাঁর সময় জ্ঞানচর্চায় ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছিল। ‘মন্তব্যগুলো’ দুই রকমের উদ্দেশ্য নিশ্চিত করেছিল: প্রথমত, অ্যারিস্টটলের বিশাল কাজকে সুশৃঙ্খল করা এবং দ্বিতীয়ত, যুক্তিবাদ ও অতীন্দ্রিয়বাদকে নতুন পাঠকদের কাছে পরিচিত করার একটি প্রচেষ্টা। তবে এর সঙ্গে সঙ্গে যুক্তিবাদের নিজস্ব মূল্য তৈরি এবং তার প্রচার হয়েছিল।

নিজেকে আধা-বস্তুবাদী দাবি করার মধ্যে মৃত্যুর ঝুঁকি আছে জেনেও ইবনে রুশদ তার শাসককে বিশ্বাস করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সুলতান তার গবেষণাকে উৎসাহিত করেছিলেন। সুলতান ইঙ্গিত দেন যে, তার নিজের কাছে অ্যারিস্টটলের কিছু দুষ্পাঠ্য কাজ সংরক্ষিত আছে এবং তিনি ইচ্ছা প্রকাশ করেন,  কেউ যদি এগুলোর পরিষ্কার এবং সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা দিত।

দুই শতাব্দী আগে বুখারার কাছে জন্মগ্রহণকারী পারস্য পণ্ডিত ইবনে সিনা (৯৮০-১০৩৭) যুক্তিবিদ্যা, বিজ্ঞান, দর্শন, রাজনীতি এবং চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়নের ভিত্তি প্রদান করেন। দৈনন্দিন জীবন থেকে খুব বিচ্ছিন্ন এবং সংগত কারণে অপ্রযোজ্য বলে তিনি অ্যারিস্টটলের ‘যুক্তি’র সমালোচনা করেছিলেন। একইসঙ্গে একজন চিকিৎসক হিসেবে ইবনে সিনার দক্ষতা তার কর্মচারীসহ খুরাসান ও ইসফাহানের স্থানীয় শাসকদের আকৃষ্ট করেছিল। তার প্রতি তাদের এই আকর্ষণ রাজনৈতিক বিষয়ে পরামর্শ নিতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। তবে পরবর্তী সময়ে ম্যাকিয়াভেলির মতো তিনি এমন ধরনের পরামর্শ দিয়েছিলেন, যা তার কিছু পৃষ্ঠপোষককে বিরক্ত করেছিল। ফলে প্রায়ই তাকে তাড়াহুড়ো করে তার চাকরির শহর ত্যাগ করতে হতো। এই সময়কালে তিনি জনজীবন থেকে অদৃশ্য হয়ে যান এবং একজন চিকিৎসক হিসেবে তার জীবিকা অর্জন করেন। তার ‘কামুনফি’ল-তিব্ব’ (মেডিকেল ক্যানন) ছিল নিয়মিত বহু ঘণ্টার ক্লিনিক্যাল অনুশীলন থেকে শেখা তার নিজস্ব তত্ত্বসহ বিদ্যমান চিকিৎসাজ্ঞানের একটি সারাংশ। এটি ইসলামি বিশ্বের সকল চিকিৎসা-বিদ্যালয় জুড়ে চিকিৎসা শাস্ত্রের প্রধান পাঠ্যপুস্তক হয়ে উঠেছিল এবং এর কিছু অংশ এখনো সমসাময়িক ইরানে পড়ানো হয়। (ত্রয়োদশ শতাব্দীতে তৈমুর লংয়ের নেতৃত্বে) পারস্যের ইসফাহান শহরের পতন ঘটলে ইবনে সিনার বিভিন্ন দর্শনগত ২৮ হাজার প্রশ্ন সংবলিত‘ কিতাব আল-ইনসাফ’ (নিরপেক্ষ বিচারের বই) তাঁর জীবদ্দশাতেই হারিয়ে গিয়েছিল। এই বইটির একমাত্র অনুলিপি তিনি স্থানীয় এক লাইব্রেরিতে জমা দিয়েছিলেন।

পারস্যের ইসফাহান শহরের পতন ঘটলে ইবনে সিনার বিভিন্ন দর্শনগত ২৮ হাজার প্রশ্ন সংবলিত‘ কিতাব আল-ইনসাফ’ (নিরপেক্ষ বিচারের বই) তাঁর জীবদ্দশাতেই হারিয়ে গিয়েছিল।

সত্তা, অস্তিত্ব এবং আধিভৌতিক প্রশ্নগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে দার্শনিক ধারণাগুলোর অংশবিশেষ তার অন্যান্য কাজের মধ্যে পাওয়া যায়। এগুলো পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে পশ্চিম ইউরোপে পৌঁছেছিল এবং ‘অ্যাভিসেনা’ বা ইবনে সিনা (Avicenna) সেখানে তীব্রভাবে বিতর্কিত হয়। আত্মাকে বাদ দিয়ে (সম্ভবত সনাতনী ইসলাম-চিন্তার জন্য একটি ছাড়) তিনি দেহের পুনরুত্থান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। ১২১০ এবং ১২১৫ সালে তার কাজগুলোকে সোরবোনে অধ্যয়ন করা নিষিদ্ধ করার পেছনে সেই সময় জারি করা দুটি ফরমানের একটি ফরমান দায়ী ছিল। তবে পনেরো বছর পর সহানুভূতিশীল পোপ নবম গ্রেগরি সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন।

ইবনে হাজম, ইবনে সিনা ও ইবনে রুশদ ইসলাম প্রতিষ্ঠার প্রথম পাঁচশ বছরে কিছু আধা-প্রাতিষ্ঠানিক চিন্তাধারাকে দৃষ্টান্ত মূলক ভাবে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেন। বিশেষ করে শেষ দুজন–ইবনে সিনা ও ইবনে রুশদ ধর্মীয় গোঁড়ামি ভিত্তিক বিধি নিষেধের ব্যাপারে ক্রোধান্বিত ছিলেন। গ্যালিলিওর মতোই শহিদ হওয়ার ঝুঁকি নিয়ে তারা তাদের গবেষণা চালিয়ে যাওয়াকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। আরও কিছু খুব স্পষ্টভাষী ব্যক্তি ইসলামের সমগ্র চিন্তাকাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন।

ইবনে হাজম, ইবনে সিনা ও ইবনে রুশদ ইসলাম প্রতিষ্ঠার প্রথম পাঁচশ বছরে কিছু আধা-প্রাতিষ্ঠানিক চিন্তাধারাকে দৃষ্টান্ত মূলক ভাবে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেন। বিশেষ করে শেষ দুজন–ইবনে সিনা ও ইবনে রুশদ ধর্মীয় গোঁড়ামি ভিত্তিক বিধি নিষেধের ব্যাপারে ক্রোধান্বিত ছিলেন। গ্যালিলিওর মতোই শহিদ হওয়ার ঝুঁকি নিয়ে তারা তাদের গবেষণা চালিয়ে যাওয়াকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন।

নবম শতাব্দীতে বাগদাদে ধর্মবিরোধী ইবনে রাওয়ান্দি বেশ কয়েকটি বই লিখেছিলেন, যা একেশ্বরবাদী এবং আকাশবাসী-ঈশ্বরভিত্তিক তিনটি প্রভাবশালী ধর্মের (ইহুদি, খ্রিষ্টান ও ইসলামধর্ম) মূলনীতিগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল। এটা করতে গিয়ে তিনি বসরা এবং বাগদাদ-কেন্দ্রিক আলী আর উসমানের দ্বন্দ্বে নিরপেক্ষতা বজায় রাখা তার নিজের মুতাজিলাইট সম্প্রদায়ের ধর্মচিন্তা থেকে আরও বেশি দূরে সরে যান। মুতাজিলারা মনে করত যে যুক্তিবাদ এবং এক ঈশ্বরে বিশ্বাসকে একত্রিত করা সম্ভব। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ঐশ্বরিক বাণীকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং জোর দিয়েছিলেন যে, কোরআন একটি অবতীর্ণ গ্রন্থ নয়। আসলে এটি একটি সৃষ্ট গ্রন্থ। অন্যরা এর রচনার গুণমান, বাগ্মিতার অভাব এবং এর ভাষার ‘অশুদ্ধতা’র তীব্র সমালোচনা করেছেন। তাদের মতে, একমাত্র যুক্তিই ঈশ্বরের প্রতি বাধ্যবাধকতা নির্দেশ করে। তাদের আরও চরম অনুসারীরা অশ্লীলতা এবং অনেক বেশি স্ত্রী থাকার অভিযোগে নবিকে নিন্দা করে।

তারা নিজস্ব গবেষণা এবং পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তি করে গ্রিক দর্শনের অংশ বিশেষকে তাদের অনুমানের সঙ্গে একত্রিত করে বিশ্বকে ব্যাখ্যা করার জন্য একটি যৌক্তিক পদ্ধতি ব্যবহার করেছিল। কোরআন এই প্রকল্পের বাইরে ছিল। মুতাজিলাইট চিন্তাবিদরা ভৌত জগৎকে ব্যাখ্যা করার জন্য তত্ত্ব প্রদান করেছিলেন। তাদের মতে, দেহ হলো পরমাণুর সমষ্টি। পদার্থ আর আকস্মিকতার মধ্যে একটি পার্থক্য টানেন তারা এবং দাবি করেন যে, সব ঘটনাকে ব্যাখ্যা করা যেতে  পারে, পরমাণুর উত্তরাধিকারের মাধ্যমে যা দেহ গঠন করে। তারা মহাবিশ্বের অবস্থান এবং গতিবিধি বোঝার চেষ্টা করার জন্য অবিরাম অনুমান করেছিলেন। তাদের প্রশ্ন ছিল: পৃথিবী কি অচল ছিল? যদিতা-ই হয়, তবে কেন?আগুনের প্রকৃতি কী ছিল? মহাবিশ্বের কেন্দ্রবিন্দুতে কি শূন্যতা ছিল?

পদার্থ আর আকস্মিকতার মধ্যে একটি পার্থক্য টানেন তারা এবং দাবি করেন যে, সব ঘটনাকে ব্যাখ্যা করা যেতে  পারে, পরমাণুর উত্তরাধিকারের মাধ্যমে যা দেহ গঠন করে। তারা মহাবিশ্বের অবস্থান এবং গতিবিধি বোঝার চেষ্টা করার জন্য অবিরাম অনুমান করেছিলেন।

উল্লেখযোগ্যভাবে, নবম শতাব্দীর প্রথমার্ধে এই সম্প্রদায়টি ত্রিশ বছরের জন্য রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অর্জন করেছিল। বাগদাদের আল-মামুন থেকে শুরু করে পরবর্তী তিন খলিফা ধারাবাহিকভাবে রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা, ধর্মতত্ত্ববিদ এবং ‘কাজিদের’ মেনে নিতে বাধ্য করেছিলেন যে, কোরআন মানুষের দ্বারা সংরক্ষিত এবং এটি একটি ঐশ্বরিক পাঠ্য নয়। খলিফারা আদেশ দিয়েছিলেন, কোরআন-কেন্দ্রিক গোঁড়ামির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে ধর্মতাত্ত্বিকরা অস্বীকার করলে তাদের জনসমক্ষে বেত্রাঘাত করা হবে। তবে যুক্তি নির্ভরতার এই সময়কাল দ্রুতই শেষ হয়ে যায়। মুতাজিলিরা ইসলামি বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে পালিয়ে যায়। কিন্তু তাদের দর্শনের অন্তর্নিহিত বিপদ সম্পর্কে আঁচ করতে পেরে তারা আরও সতর্ক হয়।

তারা ক্ষমতায় টিকে থাকলে কী ফলাফল হতো, তা অনুমান করা কঠিন। তাদের ধারণাগুলো আরও বিকশিত হতে সক্ষম হলে নিশ্চিত ভাবে তারা ঈশ্বরের অস্তিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করত। কায়রো ও কওমের কঠোর ধর্মীয় স্কুল এবং সেমিনারিতে বিংশ শতাব্দীর ইসলামি চিন্তাবিদদের জ্ঞানের মানের তুলনায় নবম শতাব্দীর চিন্তাবিদরা প্রতিটি স্তরে আরও উন্নত ছিলেন। সমৃদ্ধির বিচারে নবম ও দশম শতাব্দীর চিন্তাধারার তুলনায় সমসাময়িক ইসলামি চিন্তাধারার দারিদ্র একটি স্পষ্ট  বৈপরীত্য প্রকাশ করে। পশ্চিম ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকার শহরগুলোতে মসজিদ-স্কুলগুলোর দেওয়ালে-গর্তে নোট করে যে ইমামরা শিক্ষা দেন, তারা সম্ভবত মুতাজিলদের অস্তিত্ব স্বীকার করাকেও খুব কঠিন বলে মনে করেন। এই সংকুচিত দৃষ্টিভঙ্গি ‘আধুনিক’ ইসলামের একটি অন্যতম ট্র্যাজেডি।

নবম শতাব্দীর মাঝামাঝি বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে সমৃদ্ধ পরিবেশে ইবনে রাওয়ান্দির মতো সমালোচনামূলক কণ্ঠের আবির্ভাব বিস্ময়কর নয়। মুহাম্মদসহ নবীদের প্রকৃতি, তাদের ভবিষ্যদ্বাণী এবং অলৌকিকতার প্রকৃতি সম্পর্কে তার উপলব্ধি ছিল খুব রূঢ়। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে, ধর্মীয় মতবাদ গুলো সবসময় যুক্তির চেয়ে নিকৃষ্ট। কারণ, একজন ব্যক্তি কেবল যুক্তির মাধ্যমেই সততা এবং নৈতিক মর্যাদা অর্জন করতে পারে। তার আক্রমণের তীব্রতায় বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ ইসলামিক এবং ইহুদি ধর্মতাত্ত্বিকরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। তারা কঠিন ভাবে তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। ইবনে রাওয়ান্দি প্রত্যুত্তরে দেখিয়েছিলেন যে অলৌকিক কাজগুলো ছিল জাদুকরদের ছলনা। তার নিজের ধর্মও সমালোচনা থেকে রেহাই পায়নি। বরং তিনি কোরআনকে একটি স্পষ্ট জাল গ্রন্থ হিসেবে তার যুক্তি দেখান। তার যুক্তি অনুযায়ী কোরআন অবতীর্ণ হয়নি বা এটি কোনো মূল রচনাও ছিল না। সাহিত্যে অনন্য অবদান তো দূরের কথা, এটিকে একটি পুনরাবৃত্তিমূলক এবং কাল্পনিক গ্রন্থ হিসেবে তিনি চিহ্নিত করেন। তিনি তার আস্তিক জীবনের পরিসমাপ্তি টানেন এবং নাস্তিকে পরিণত হন। এই পথ অবশ্য কঠিন এবং নিঃসঙ্গ ছিল। তার কোনো মৌলিক কাজের এখন আর অস্তিত্ব নেই। তার ব্যক্তিজীবন এবং লেখা সম্পর্কে জানতে হলে প্রায় একচেটিয়াভাবেই মুসলিম ও ইহুদি সমালোচকদের লেখার ওপর নির্ভর করতে হয়। তারা ইবনে রাওয়ান্দির ধর্মবিরোধিতাকে খণ্ডন করতে অনেক বড়সড়ো আকারের বই লিখেছিলেন।

তবে এদের মধ্যে সিরিয়ার আলেপ্পোর কবি-দার্শনিক আবু আল-আলা আল-মা’রি (৯৭৩-১০৫৮) ছিলেন ব্যতিক্রম। চার বছর বয়সে গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয়ে তিনি দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছিলেন। একটি অসাধারণ স্মৃতিশক্তি তার এই অক্ষমতাকে পূরণ করেছিল। বিশ্ব সম্পর্কে তার জ্ঞান এবং মানুষের একে অপরকে অকথ্য ক্ষতি করার ক্ষমতা সম্পর্কে তার বোধ তাকে সন্দেহপ্রবণ, হতাশাবাদী করে তুলেছিল। মানুষের চেয়ে প্রাণিজগতের প্রতি তিনি বেশি অনুরাগী হয়ে পড়েছিলেন, যা সাধারণত একজন মুসলমানের জন্য অস্বাভাবিক। তারমতে, পৃথিবী ‘হয় আলোকিত ছুরি বা ধর্মীয় বোকা’ নিয়ে গঠিত। বাগদাদের একাডেমি দুই বছর চেষ্টা করেও তার সন্দেহপ্রবণতা প্রশমিত করতে ব্যর্থ হয়। তিনি কোয়াট্রেন, চার-লাইন ছন্দের স্তবক রচনা করতে শুরু করেন, যা পরে তার পারস্য প্রশংসক ওমর আল-খইয়াম তার কাজে অন্তর্ভুক্ত করেন। যেখানে খইয়ামের আয়াতগুলো ছিল কামুকতাপূর্ণ/সুমিষ্ট এবং তার সংশয়কে বেশি তির্যক ভাষায় প্রকাশ করা হয়েছিল, সেখানে আল-মা’রির ছিল রাজনৈতিক তপস্বীবাদের প্রতি, ধর্মের প্রতি সরাসরি সমালোচনামূলক:

ধর্ম কী? একজন দাসীকে বন্দি রাখা, যাতে অন্য কেউ তাকে দেখতে না পায়;

তার যৌতুকের পরিমাণ যেন পাণিপ্রার্থীদের হতভম্ভ করে দেয়।

আমাকে যেসব মতবাদ শুনিয়েছে

তার একটি শব্দও আমার হৃদয় নেয়নি কাছে।

ভবিষ্যদ্বাণী সম্পর্কে তার মতামত ইবনে রাওয়ান্দির প্রতিধ্বনি মনে হবে:

আমাদের মধ্যকার নবীরাও শিক্ষা দিতে আসেন,

তাদের সঙ্গে যারা মিম্বর থেকে ধর্মপ্রচার করেন:

তারা প্রার্থনা করে, হত্যা করে এবং এরপর মারাও যায়,

তবুও আমাদের অসুস্থতা সৈকতের নুড়ি হয়ে টিকে রয়।

তিনি জানতেন যে, স্বর্গ এবং নরকের পটভূমিকায় রচিত ইবনে রাওয়ান্দির লেখাগুলো ছন্দযুক্ত গদ্য কবিতা, তার নিজস্ব মহাকাব্য রিসালাত আল-গুফরান (ক্ষমা সংক্রান্ত শাস্ত্র)-এ স্থান পেয়েছিল। স্প্যানিশ পণ্ডিত অ্যাসিন প্যালাসিওসের মতে, এই মহাকাব্য দান্তেকে ডিভাইন কমেডি নামের কাব্য গ্রন্থ রচনায় অনুপ্রাণিত করেছিল। রিসালাতে আল-মা’রি ঈশ্বরকে সম্বোধন করা ইবনে রাওয়ান্দির উক্তির উদ্ধৃতি দেন:

তুমি জীবিকার উপায় বণ্টন করেছ এমনভাবে যেমন একজন মাতাল তার নোংরামি প্রকাশ করে। একজন ব্যক্তি যদি এমন বিভাজন করত, তাহলে আমরা তাকে বলতাম: ‘হে প্রতারক! তোমাকে সমুচিত শিক্ষা দিতে হবে।’

আল-মা’রির প্রতিক্রিয়ার অভিব্যক্তিটি ঢাল হিসেবে পরিকল্পিতভাবে করা সুস্পষ্ট একটি ভান:

‘যদি এই যুগলকে সোজা করে দাঁড় করানো হয়, তবে পাপের উচ্চতায় তারা আকারে মিশরীয় পিরামিডের চেয়ে বেশি লম্বা হবে।’

 যে কোনো দোষ থেকে ঈশ্বরকে অব্যাহতি দেওয়ার জন্য সতর্ক থাকার সময়, তিনি নিজেও একই রকম অনুভূতি প্রকাশ করেছিলেন:

আর যেখানে প্রিন্স হুকুম দিয়েছিল, এখন পাখির চিৎকারে

বাতাস প্রবাহিত হয় রাজার দরবারে:

‘এখানে’, এটি ঘোষণা করে, ‘সেখানে একজন শক্তিশালীর বাস

সে যে শুনতে পায় না দুর্বলের কান্নার শ্বাস।’

তাঁর সবচেয়ে বিতর্কিত কাজ, আল-ফুসুল ওয়া আল-গায়াত (অনুচ্ছেদ এবং সময়কাল, তার ভক্তদের খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করেছিল। কেননা, এটি ছিল কোরআনের প্যারডি, এর কারণে তাঁরা তাঁর প্রাণহানির আশঙ্কা করছিল। তবে তেমন কিছুই ঘটেনি। পশুপাখির প্রতি অনুরাগ কবিকে নিরামিষভোজী করে তুলেছিল। তিনি পঁচাশি বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি বংশবৃদ্ধির বিরোধী ছিলেন। কর্মই ছিল বিশ্বের কাছে তার একমাত্র উত্তরাধিকার। যৌনতার প্রতিও কি তার ঘৃণা ছিল? যৌনতার প্রকাশে তার কবিতা কঠোরভাবে অ-সংবেদনশীল ছিল। সেই সময়ের জন্য তা ছিল একটি বিরল ব্যাপার।

বিশেষ করে আবু নুওয়াসসহ বাগদাদের সব কবি তাদের যৌনতার জন্য কুখ্যাত ছিলেন। তারা খুব আপত্তিকর কলি পুনরাবৃত্তি করতেন। দরবারে ও সরাইখানায় একইভাবে সেগুলো গাইতে উপভোগ করতেন। ‘এক হাজার এক রাত’ (কিছু জায়গায় আবু নাভাসের উপস্থিতি ছিল)-এর অনেক গল্প এই সময়ে প্রকাশিত হয়েছিল।

কর্ডোভায়, ঠিক আল-মা’রির মতো সমসাময়িক আরেকজন কবি ওয়াল্লাদা বিনিত-আল-মুস্তাকফি, তার প্রেমিকের কাছে একগুচ্ছ দুঃসাহসী কবিতা লিখেছিলেন। তিনি সেই কবিতাগুলো তার পোশাকের হাতায় এমব্রয়ডারি করেছিলেন এবং জনসমক্ষে তার আবেদনময় প্রকাশ করেছিলেন।

বিচ্ছেদ মানেই কি আমাদের দেখা করার উপায় নেই?

হায়/হ্যাঁ: কষ্ট নিয়ে হাহাকার করে প্রেমিকরা সবাই

আমার জন্য এটা শীতকাল, সময় নয় প্রেম-মিলনের,

কুঁকড়ে থাকা কামনার তপ্ত কয়লার ওপর…

ওয়াল্লাদার সাহিত্যিক জায়গাটি সাহিত্যিকদের জন্য সবচেয়ে বিখ্যাত মিলনস্থানগুলোর মধ্যে একটি হয়ে ওঠে: কবি এবং দার্শনিক, পুরুষ এবং নারীরা এখানে যৌন-উত্তেজক এবং প্রেমের কবিতার আবৃত্তি শুনতে আসতেন। তবে এর বেশিরভাগই কখনো প্রকাশিত হয়নি। আলোচনায় স্বপ্নের বিশ্লেষণসহ অ-সাহিত্যিক নানা বিষয়ে প্রায়ই উত্তপ্ত বিতর্ক হতো।

প্রাক-ইসলামি আরব সংস্কৃতিতে স্বপ্ন একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। তাই স্বপ্নের ব্যাখ্যাকারীদের খুব চাহিদা ছিল। ইসলাম এই প্রথাকে নিষেধ করেনি। সর্বোপরি, মুহাম্মদের কাছে প্রথম প্রত্যাদেশ ‘ভোরের আলোর স্বচ্ছতার সঙ্গে’ স্বপ্নেই দেখা দিয়েছিল। প্রথম প্রধান মুসলিম স্বপ্নবিশ্লেষক ইবনে সিরিন নবীর মৃত্যুর কয়েক বছর পর জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জীবন এবং অনুশীলন সম্পর্কে উপাখ্যানসহ ‘স্বপ্নের ব্যাখ্যা’ সংকলনটি তার মৃত্যুর কয়েক বছর পর ৭০৪ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। ফ্রয়েডের রেটিংসূচিতে বইটির উল্লেখ নেই। তাতে মনে হয়, এই ভিয়েনাবাসী পণ্ডিত সম্ভবত এর অস্তিত্ব সম্পর্কে অবগত ছিলেন না।

ইবনে সিরিনের স্বপ্নের ব্যাখ্যা অত্যন্ত মৌলিক এবং উল্লেখযোগ্যভাবে খোলামেলা হতো। এটি পাঠককে প্রথম শতাব্দীর ইসলামের সামাজিক আচরণ এবং যৌন অনুশীলনের একটি বিরল চিত্র প্রদান করে। স্বপ্নের পাঠোদ্ধারে আশ্চর্য সংখ্যক সমকামিতা, অযাচার, পাশবিকতা, লিঙ্গরূপান্তরবাদের (ট্রান্সভেস্টিজম) পুনরাবৃত্তি পাওয়া যায়। তবে তাতে তিনি অবাক হতেন না। ‘শয়তানেরকাজ’ হিসেবে কামোত্তেজক স্বপ্নগুলো যা ভিজিয়ে দিত সেগুলো বাদ দিয়ে তার কাছে সব স্বপ্নের একটি ব্যাখ্যা ছিল। মাঝে মাঝে ব্যাখ্যায় তিনি সন্দেহজনকভাবে সত্যের কাছাকাছি এসেছিলেন। সেরকম একটি উপাখ্যানে বর্ণিত হয়েছে:

এক ব্যক্তি ইবনে সিরিনের কাছে গিয়ে বলল: ‘আমি একটি অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছি, এবং তা আপনাকে বলতে লজ্জা পাচ্ছি।’ ইবনে সিরিন তখন তাকে তা লিখতে বললেন। লোকটি লিখেছিল: ‘আমি তিন মাস আমার বাড়িতে ছিলাম না। স্বপ্নে বাড়িতে ফিরে এসে আমি দেখতে পেলাম আমার স্ত্রী ঘুমিয়ে আছে এবং দুটি ভেড়া তার গোপনাঙ্গের ওপর তাদের শিং নিয়ে লড়াই করছে, তাদের মধ্যে একজন তার প্রতিপক্ষকে রক্তাক্ত করেছে। সেই স্বপ্ন দেখার পর থেকে আমি আমার স্ত্রীকে এড়িয়ে চলেছি এবং তাকে এত ভালোবাসার পরও নিশ্চিত নই আমি কী ভাবব।’ ইবনে সিরিন উত্তর দিলেন: ‘তাকে আর এড়িয়ে যাবেন না। স্বপ্নটি একজন মুক্ত এবং অনুগত নারীর পরামর্শ দেয়। যখন সে আপনার আসন্ন প্রত্যাবর্তনের কথা জানল, তখন সে এক জোড়া কাঁচি দিয়ে তার গোপনাঙ্গ তাড়াহুড়ো করে শেভ করতে গিয়ে নিজেকে কেটে ফেলেছিল… আপনাকে কেবল আপনার স্ত্রীর কাছে গিয়ে এটি যাচাই করতে হবে। লোকটি তার স্ত্রীর কাছে ফিরে এসে যখন তাকে স্পর্শ করার চেষ্টা করছিল, তখন স্ত্রী তাকে প্রত্যাখ্যান করে বলেছিল: ‘যতক্ষণ-না আপনি ফিরে আসার পর থেকে কেন আমাকে এড়িয়ে গেছেন,তা না বলবেন ততক্ষণ আমার কাছে আসবেন না।’ ব্যক্তিটি স্ত্রীকে তার স্বপ্ন এবং ইবনে সিরিনের ব্যাখ্যার কথা বললেন। স্ত্রী বললেন, ইবনে সিরিন সত্যি কথা বলেছে,’ এবং সে তার ক্ষতস্থানে লাগানো তুলোর ওপর স্বামীর হাতটি রাখল।

ইবনে সিরিনের মৃত্যুর সাতশ বছর পর, তিউনিসীয় লেখক ইবনে মুহাম্মদ আল-নাফজাভি স্বপ্নের অর্থ ব্যাখ্যায় কামোত্তেজক গল্প, কবিতা, চিকিৎসা পরামর্শ এবং মন্তব্যের একটি সংকলন ‘দ্য পারফিউমড গার্ডেন’ লিখেছিলেন। ধর্মগুরুরা এর চরম নিন্দা করেন। তাঁদের মন্তব্য ছিল: এটি একজন ‘নর্দমায় মারা যাওয়া’ পাগলের মনহীন এবং যৌন-আমোদিত কাজ। মন্তব্যটি ইঙ্গিত দেয় যে এটি পূর্ববর্তী বইয়ের তুলনায় অনেক বেশি ধর্মবিরোধী গ্রন্থখণ্ড ছিল। এডওয়ার্ড সাইদ এই বইটিকে ‘জ্ঞানের একটি প্রলুব্ধ অধঃপতন’ হিসেবে প্রাচ্যবাদীদের ভুল ব্যাখ্যার সমালোচনা করেন। এডওয়ার্ডের এই সমালোচনা সম্পূর্ণরূপে ন্যায়সংগত ছিল।

দ্য পারফিউমড গার্ডেন একটি বহুমাত্রিক কাজ। এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো ধর্মীয় ভণ্ডামির কঠোর সমালোচনা, যা পঞ্চদশ শতাব্দীতে প্রথম রচনার সময়ের মতো একইভাবে এখনো প্রাসঙ্গিক। উদাহরণস্বরূপ, শুরুর ছোটগল্পটি একজন ভন্ড নবী মুসাইলিমা এবং তার মোহাবিষ্ট সাজাহ নামের তামিম গোত্রের এক ভণ্ড স্বঘোষিত নারী নবীর বিবরণ। উভয়ই প্রকৃত ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব। মুসাইলিমা ছিলেন পূর্ব আরবের গুরুত্বপূর্ণ হানিফাহ গোত্রের নেতা। তিনিও আল্লাহর সঙ্গে কথোপকথন করেছেন বলে দাবি করতেন এবং সেই অনুযায়ী উপদ্বীপে ক্ষমতার বিভাজনের পরামর্শ দিতেন। মুহাম্মদ সেই ধৃষ্টতাকে প্রত্যাখ্যান করেন এবং তার অনুসারীরা মুসাইলিমাকে ভন্ড নবী হিসেবে নিন্দা করেন। একইভাবে তামিমগোত্রের একজন নেতা ছিলেন সাজাহ,  খ্রিষ্টান ধারণা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তা তিনি পৌত্তলিকতার সঙ্গে সংমিশ্রণ করেছিলেন। নবীর উত্তরসূরিদের সমর্থন আদায়ের জন্য তিনি এবং মুসাইলিমা একতাবদ্ধ হন। সেইপ্রচেষ্টায় দুজনেই পরাজিত হন। যুদ্ধে মুসাইলিমা নিহত হন এবং সাজাহ তার গোত্রে ফিরে এসে পরবর্তী সময়ে মুসলিম হয়ে যান। তবুও সাধারণত সংযত আল-তাবারিসহ প্রাথমিক মুসলিম ইতিহাসবিদরা, তাদের রাজনৈতিক জোটকে একটি যৌন সম্পর্ক হিসেবে বিবেচনা করেছেন। আল-নাফজাভির বক্তব্য অনুসারে, তারা দুজনে পরিচিত হয়ে একে অপরকে যৌনতা দিয়ে পরস্পরকে বিভ্রান্ত করে এবং মুসাইলিমা, অসংযমী হয়ে খুব বাজে একটি পরামর্শ দেন:

শয্যাকক্ষ প্রস্তুত, প্রার্থনা করি আমরা যেন প্রবেশ করতে পারি,

আপনার পিঠের ওপর শুয়ে পড়ুন, আমি আপনাকে কিছু দেখাতে পারি,

আপনার হাত এবং হাঁটুতে উবু হন অথবা বসে নিন,

দুই-তৃতীয়াংশ বা পুরোভাবেই, যা খুশি নিয়ে নিন!

 বইটি একজন উজিরকে সম্বোধন করা হয়েছে, তবে এর সম্পূর্ণ সুর এবং শৈলী থেকে বোঝা যায় যে, এটি শহরের অলি-গলিতে আবৃত্তি করার জন্য লেখা হয়েছিল। কাহিনিকারদের ভ্রমণের মাধ্যমে তা বিদেশে ছড়িয়ে ছিল। এমনকি আরব শ্রোতা যারা কেবল গল্পের রূপরেখা জানতেন, তারাও তৃতীয় বাক্যটির ধৃষ্টতা দেখে হাঁসফাঁস করতেন। মুসাইলিমা সাজাহকে এখানে যৌনকর্মের জন্য এমন অবস্থান নেবার প্রস্তাব দিচ্ছেন যা ইসলামের প্রার্থনার আচারের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়।

নারীবাদী কাজ না হলেও, দ্য পারফিউমড গার্ডেন নারী যৌনতার একটি উপলব্ধি প্রকাশ করে। এতে নারী সমকামিতা গৃহীত হয় এবং আনন্দ সন্ধানে পুরুষদের নিঃস্বার্থ হতে অবিরাম পরামর্শ দেওয়া হয়। কামোদ্দীপক সন্ধানে হতাশাগ্রস্ত আল-নাফজাভি বলেন:

ছোলা-মটর এবং পেঁয়াজ একসঙ্গে ভালো করে রান্না করুন এবং তাতে পাউডার করা সামান্য পেলটার (মাগরেবে পাওয়া তেতো-মিষ্টি মূল) এবং আদা ছিটিয়ে দিন। এটি সন্তোষজনক পরিমাণে খান এবং তাতে যৌন আনন্দ আশ্চর্যজনক ভাবে তীব্র হয়ে উঠবে।

তবে এগুলো ঠিক নয়।

(চলবে)

আগের পর্ব: মৌলবাদের সংঘর্ষ: ক্রুসেড, জিহাদ এবং আধুনিকতা-২

পরের পর্ব: মৌলবাদের সংঘর্ষ: ক্রুসেড, জিহাদ এবং আধুনিকতা-৪

 

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •