মৌলবাদের সংঘাত: ক্রুসেড, জিহাদ এবং আধুনিকতা-২

মৌলবাদের সংঘাত: ক্রুসেড, জিহাদ এবং আধুনিকতা-২

তারিক আলি

স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে দুই পাকিস্তানের মানুষের লড়াই নিয়ে লেখা বই থেকে শুরু করে বিশ্ব রাজনীতি, ইতিহাস, বিশ্বে আগ্রাসন প্রতিরোধ ও মুক্তির আন্দোলন ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে তারিক আলি লিখিত বইগুলো গুরুত্বপূর্ণ। ২০০২ সালে যখন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসী তৎপরতা অনেক বিস্তৃত এবং ইসলামী মৌলবাদ বিশ্বজুড়ে আলোচিত বিতর্কিত বিষয় তখন তাঁর বই The Clash of Fundamentalisms: Crusades, Jihads and Modernity প্রকাশিত হয়। তারিকের এই বই অনুসন্ধান করেছে ধর্মীয় বিভিন্ন মত পথ, বিভিন্ন ধরনের মৌলবাদী শক্তি, তার ইতিহাস ও রাজনীতি এবং সর্বোপরি তাঁর ভাষায় ‘সবচাইতে বড় মৌলবাদী শক্তি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ’-এর সাথে এর  সম্পর্ক। সর্বজনকথার জন্য এই বই-এর ধারাবাহিক অনুবাদ করছেন লেখক অনুবাদক ফাতেমা বেগম।   

 বৈশ্বিক সাম্রাজ্য

প্রতিটি ফ্রন্টে প্রথম মুসলিম বাহিনীর সামরিক সাফল্য ছিল অসাধারণ। তাদের অগ্রযাত্রার গতি ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের সবাইকে চমকে দিয়েছিল। প্রারম্ভিক খ্রিষ্টধর্মের সঙ্গে তাদের বৈসাদৃশ্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ৬৩২সালে মুহাম্মদ (সা.)-এর মৃত্যুর বিশ বছরের মধ্যে তার অনুসারীরা মধ্যপ্রাচ্যের অর্ধচন্দ্রাকৃতি অঞ্চল(The Fertile Crescent)[1] জুড়ে প্রথমবারের মতো ইসলামি সাম্রাজ্যের ঘাঁটি স্থাপন করেছিল। এই ঘাঁটিটিই সেই সময় সমগ্র অঞ্চলে ইসলামের বিকাশ উৎসাহিত করতে ব্যবহৃত হয়েছিল। এই সাফল্যে মুগ্ধ হয়ে সমগ্র উপজাতি নতুন ধর্ম গ্রহণ করে। মরুভূমিতে মসজিদ নির্মিত হয়। একইভাবে সেনাবাহিনীরও বিস্তার ঘটে। সৈন্যবাহিনীর দ্রুত বিজয়কে চিহ্নিত করা হয়েছিল‒আল্লাহ যে সর্বশক্তিমান এবং তিনি মুমিনদের পক্ষে‒তার লক্ষণ হিসেবে।

এই অসাধারণ বিজয়গুলো ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে কয়েকটি কারণ যুগপৎ সামনে নিয়ে আসা হয়। ৬২৮ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে পারস্য এবং বাইজেন্টাইন বা পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যগুলো প্রায় এক শতাব্দী ধরে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল: একটি আসুরিক দ্বন্দ্ব উভয় পক্ষকে দুর্বল করেছিল, প্রজারাও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে ছিল এবং এতে নতুন বিজয়ীদের জন্য একটি প্রবেশ পথ উন্মোচিত হয়েছিল। সিরিয়া ও মিশর ছিল বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের অংশ। সাসানিদ পারস্য দ্বারা ইরাক শাসিত ছিল। এই তিন অংশই তখন একটি ঐক্যবদ্ধ এবং উদ্দীপিত উপজাতীয় শক্তির মুখোমুখি হচ্ছিল।

বলপ্রয়োগ বা অত্যাধুনিক সামরিক কৌশল দিয়ে সুদক্ষ ও অভিজ্ঞ যুদ্ধ যন্ত্রে পুষ্ট দুই সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে আরবদের বিজয় ব্যাখ্যা করা যাবে না। মুসলিম জেনারেলদের উট, অশ্বারোহী বাহিনী পরিচালনার দক্ষতা এবং একটি কার্যকর গেরিলাশৈলী সমৃদ্ধ পদাতিক বাহিনী দিয়ে বিকল্প ব্যবস্থা তৈরির ক্ষমতা নিঃসন্দেহে শত্রুকে বিভ্রান্ত করেছিল। তবে যতদিন তেমন বড় আকারের অস্থিরতার সম্মুখীন হয়নি, ততদিন পর্যন্ত যাযাবরদের আক্রমণে এই পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়েছিল। কেবল এই পদ্ধতির মাধ্যমে তারা পরাজয় ঘটাতে পারত না। বিজয়ের জন্য আরেকটি ব্যাপার নিশ্চিত অবদান রেখেছে। আর তা হলো, নতুন আক্রমণকারীদের প্রতি স্থানীয় জনগণের একটি বড় অংশের সক্রিয় সহানুভূতি ছিল। তাদের বেশিরভাগই নিষ্ক্রিয়ভাবে অপেক্ষায় ছিল‒কোন পক্ষ জয়ী হবে তা দেখার জন্য। কিন্তু তারা আর তাদের পুরোনো সাম্রাজ্যের পক্ষে লড়াই বা সাহায্য করতে প্রস্তুত ছিল না।

একীভূত আরব উপজাতিদের উচ্ছ্বাসকে কেবল নতুন ধর্মের আবেদন বা জান্নাতে আনন্দের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। যারা খালেদ ইবন আল-ওয়ালিদের নেতৃত্বে যুদ্ধ করতে এসেছিল এবং দামেস্ক বিজয়ে অংশ নিয়েছিল, জাগতিক আরাম-আয়েশই সেই সকল হাজার হাজার মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছিল। নবম শতাব্দীর তাঁতি-কবি আবু তাম্মাম উল্লেখ করেছেন:

না, জান্নাতের জন্য আপনি স্বাভাবিক জীবন ত্যাগ করেননি:

বরং, আমি বিশ্বাস করি, এটি ছিল রুটি এবং খেজুরের জন্য আপনার তীব্র আকাঙ্ক্ষা।

আহমেদ আল-বালাধুরি একই শতাব্দীর একজন বিশিষ্ট আরব ইতিহাসবিদ ছিলেন। তার আরব বিজয়ের বিবরণ সাধারণত একটি প্রামাণিক হিসেবে গৃহীত হয়। তাঁর উদ্ধৃতিতে কবি আবু তাম্মামের এই মতামত দৃঢ়ভাবে সমর্থিত হয়। তিনি পরাজিত পার্সিয়ান জেনারেল রুস্তমকে উদ্ধৃত করেছেন। রুস্তম আরব আক্রমণের বিরুদ্ধে তার দেশকে রক্ষা করেছিলেন। তিনি একজন আরব দূতকে বলেছিলেন:

‘আমি জানি যে আপনি যা করছেন তা জীবিকার সংকীর্ণ উপায় এবং দারিদ্র্যের কারণেই করতে বাধ্য হয়েছেন।’

৬৩৮ সালে মুসলিম বাহিনী জেরুজালেম দখল করে। এর পরপরই খলিফা উমর শান্তির শর্তাবলি কার্যকর করার জন্য শহরটি পরিদর্শন করেন। জেরুজালেমের পিতৃপুরুষ সোফ্রোনিয়াস তাকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। সেই সময় তিনি মুসলমানদের সাধারণতা এবং অনাড়ম্বরতা দেখে হতবাক হয়েছিলেন। উমর সেই সময়ের অন্যান্য মুসলিম নেতার মতো সাধারণ পোশাক পরেছিলেন। যাত্রার ধুলোর দাগ তার জামাকাপড়ে লেগে ছিল। তার দাড়ি ছাঁটা ছিল না। তার দারিদ্র্যের প্রকাশ পার্সি কুলপতিকে বিস্মিত করেছিল। ইতিহাসে উল্লেখ আছে যে কুলপতি উমরের অনুগত হয়েছিলেন এবং গ্রিক ভাষায় বলেছিলেন:

‘সত্যিই এটি পবিত্র স্থানে দাঁড়িয়ে থাকা ড্যানিয়েল নবির বলা একটি বিধ্বংসীর উদর।’

‘বিধ্বংসীর উদর’ জেরুজালেমে মুসলমানরা বেশিক্ষণ বিশ্রাম নেয়নি। বাইজেন্টাইন এবং পারস্যদের বিরুদ্ধে কৌশলগত বিজয় খুব সহজে আসায় বিশ্বাসীরা অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে এবং নিজেরা যেন সৌভাগ্যে পরিপূর্ণ এরকম একটা অনুভূতি তাদের মাঝে তৈরি হয়। মোটকথা, তাদের নেতা ঈশ্বরের শেষ এবং চূড়ান্ত বাণী পেয়েছিলেন। পারস্য বিজয়ের মাধ্যমে তারা বারো শতাব্দী ধরে শাসনক্ষমতায় থাকা একটি রাজবংশকে উৎখাত করেছিল। আরবরা এর সম্পদ ও সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী হয়েছিল। এই প্রথম তারা সোনা নামে পরিচিত হলুদ ধাতু দেখেছিল। বালাধুরি একজন আরব সৈনিকের কথা লিখেছেন। সৈনিকটি যুদ্ধের লুন্ঠন হিসেবে পাওয়া একজন উচ্চ বংশীয় যুবতিকে মাত্র এক ব্যাগাটেল বা ১০০০ দিরহামের বিনিময়ে বিক্রি করেছিলেন। তাকে এই বোকামির ব্যাখ্যা করতে বলা হলে তিনি জবাবে বলেন, দশশর উপরে আর কোনোসংখ্যা আছে, এটা তার জানা ছিল না।’

রোম দখলকারী জার্মান উপজাতিরা সামাজিক সুবিধার ওপর জোর দিয়ে তাদের ক্ষমতা রক্ষা করেছিল। কিন্তু তারা একটি উচ্চতর সংস্কৃতির কাছে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করেছিল এবং পরে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেছিল। পারস্য জয়ী আরবরা সেখানকার ভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সামাজিক আবেশ আর চর্চার ব্যাপারে সতর্ক হয়ে পড়েছিল। তাই সৈন্যবাহিনীতে যোগদানের সুযোগ নিজেদের বাইরে অন্যদের ছিলনা এবং কিছুদিনের জন্য আন্তঃবিবাহকে নিষিদ্ধ করেছিল তারা। পারস্যের বিস্ময়কর ব্যাপারগুলো দেখে বিমোহিত হলেও, তারা কখনোই তাদের পরিচয়, ভাষা বা নতুন বিশ্বাস ত্যাগ করতে প্রলুব্ধ হয়নি। একটি বিশ্বজনীন রাষ্ট্রের অগ্রদূত হিসেবে একটি সর্বজনীন ধর্ম সম্পর্কে মুহাম্মদের দৃষ্টিভঙ্গির কল্পনাকে তারা ধারণ করেছিল এবং উপজাতিদের বস্তুগত স্বার্থকে এগিয়ে নিয়েছিল। তারা একটি খ্রিষ্টান বা পারস্য সাম্রাজ্যের অভিজাত শাসক হওয়ার জন্য এবং আরবি ত্যাগ করে গ্রিক বা ফারসি ভাষার জন্য আগ্রহী হয়নি।

তার মানে এই নয় যে, তারা পরাজিত সভ্যতাগুলোর সঙ্গে খাপ খাওয়াতে বা তাদের কাছ থেকে শিখতে চায়নি। বরং আরবের সিরিয়া ও পারস্য বিজয়ের ফলে একটি সাংস্কৃতিক সংশ্লেষণ ঘটেছিল, যা দ্রুত হেলেনিস্টিক সংস্কৃতির পরিমার্জিত শিল্প, সাহিত্য এবং মনোবিজ্ঞানকে একটি সাধারণ ঐতিহ্যে পরিণত করে নতুন ইসলামি সভ্যতার বীজ বপন করে। এটি ছিল বহুজাতিগত একটি সামাজিক কাঠামো। উমাইয়াদের শেষ যুবরাজ আল-আন্দালুসে পালিয়ে গিয়েছিলেন। কর্ডোবায় একটি প্রতিদ্বন্দ্বী খিলাফত প্রতিষ্ঠা করে একটি বহুজাতিক কেন্দ্র হিসেবে তিনি বাগদাদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হওয়া সত্ত্বেও এর মাধ্যমে ইসলামের অন্তর্ভুক্ত আব্বাসীয় গোষ্ঠীর জনপ্রিয়তাবাদী এবং সমতাবাদী প্রচার লাভ করে এবং উমাইয়াদের সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ পরাভূত হয়।

চিকিৎসাবিদ্যার বিকাশ ঘটে এবং মুসলমানরা পরবর্তীকালে তাতে উৎকর্ষ সাধন করে। এর মাধ্যমে প্রথম সহস্রাব্দের সময়কালে জ্ঞান কীভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল, মিশে গিয়েছিল এবং পরিপক্ব হয়েছিল তার একটি আকর্ষণীয় উদাহরণ তৈরি হয়। ইসলামের দুই শতাব্দী আগে, দক্ষিণ-পশ্চিম পারস্যের (বর্তমানে খুজেস্তান) শহর, গন্ডেশাপুর একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থান হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিল। নিজস্ব শহরে দমন-পীড়নের মুখোমুখি ভিন্নমতাবলম্বী বুদ্ধিজীবী এবং মুক্তচিন্তকদের জন্য শহরটি এক আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়। এডেসার নেস্টোরিয়ানরা ৪৮৯ সালে তাদের স্কুল জব্দ হওয়ার পর এখানে পালিয়ে এসেছিল। চল্লিশ বছর পর সম্রাট জাস্টিনিয়ান এথেন্সে নিও প্ল্যাটোনিক দার্শনিকদের স্কুল বন্ধ করার আদেশ দেন। এর ছাত্র এবং শিক্ষকরাও গন্ডেশাপুরে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছিলেন। এই শিক্ষা-শহরের খবর প্রতিবেশী সব সভ্যতায় ছড়িয়ে পড়ে। গ্রিক, ইহুদি, আরব, খ্রিষ্টান এবং সিরিয়ানদের সঙ্গে প্রাণবন্ত আলোচনায় অংশ নিতে ভারত, এবং কারো কারো মতে, এমনকি চীন থেকেও পণ্ডিতরা এসেছিলেন। বিভিন্ন বিষয়ের ওপর আলোচনা বিস্তৃত থাকলেও ওষুধশাস্ত্রের দর্শন অনুসারীদের তা সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করেছিল।

ইসলামের দুই শতাব্দী আগে, দক্ষিণ-পশ্চিম পারস্যের (বর্তমানে খুজেস্তান) শহর, গন্ডেশাপুর একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থান হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিল। নিজস্ব শহরে দমন-পীড়নের মুখোমুখি ভিন্নমতাবলম্বী বুদ্ধিজীবী এবং মুক্তচিন্তকদের জন্য শহরটি এক আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়।

ওষুধের তাত্ত্বিক নির্দেশাবলির পাশাপাশি একটি বিমারস্তানের (হাসপাতাল) অনুশীলন গন্ডেশাপুরের নাগরিকদের স্বাস্থ্যসেবার প্রতি সর্বাধিক যত্নশীল হিসেবে বিশ্বে পরিচিত করে। হারিথ বিন কালাদা ছিলেন প্রথম আরব যিনি চিকিৎসক উপাধি অর্জন করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি পারস্যের শাসক চোসরোস অনুশ্রওয়ানের দরবারে নিযুক্ত হন। দুই ব্যক্তির মধ্যে একটি কথোপকথন লিপিকার দ্বারা রেকর্ড করা হয়েছিল। সেই তথ্যানুসারে, চিকিৎসক শাসককে অতিরিক্ত খাওয়া এবং অপরিশোধিত মদ পরিহার করার, প্রতিদিন প্রচুর জল পান করার, মাতাল অবস্থায় যৌনতা এড়ানোর এবং খাওয়ার পর গোসল করার পরামর্শ দেন। দীর্ঘস্থায়ী কোষ্ঠকাঠিন্য মোকাবিলা করতে সক্ষম ছিলেন বলে হারিথ বিন কালাদা অগ্রগামী এনিমা হিসেবে পরিচিত ছিলেন।

৬৩৮ সালের মধ্যে সমৃদ্ধ চিকিৎসা ব্যবস্থা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সেই সময় আরব সেনাবাহিনী শহরটি দখল করে নেয়। এরপর আরবদের মেডিকেল স্কুলে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় এবং তারপর তারা অন্যত্র ক্রমবর্ধমান মুসলিম সাম্রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে। চুক্তি ও নথিপত্রও অন্যত্র প্রবাহিত হতে থাকে। ইবনে সিনা এবং আল-রাজি এই দুই বিশিষ্ট মুসলিম দার্শনিক চিকিৎসকের চিকিৎসা জ্ঞানের উদ্ভব ঘটে, পারস্যের একটি ছোট শহরে। ছোট একটা শহরে তারা চিকিৎসাজ্ঞান লাভ করেছেন‒এটা তারা স্বীকার করতেন।

এডেসা ও এথেন্সে বোনা চিকিৎসাজ্ঞানের বীজ গন্ডেশাপুরে গিয়ে এক বিশাল গাছে পরিণত হয়েছিল। সেই সময় উমরের উত্তরসূরিরা কিন্তু সামরিক ফ্রন্টে অলস বসে ছিল না। তারা মিশর থেকে উত্তর আফ্রিকায় ছড়িয়ে পড়ে। দক্ষিণ তিউনিসিয়ার আল-কায়রাওয়ানে একটি ঘাঁটি প্রতিষ্ঠিত করে সেখানে সব সামরিক শক্তি একত্রিত করে। কার্থেজ একটি মুসলিম শহরে পরিণত হয়। ইফ্রিকিয়ার আরব গভর্নর, মুসা বিন নুসায়র, মহাদেশীয় ইউরোপের সঙ্গে প্রথম যোগাযোগ স্থাপন করেন। সমুদ্রের ওপারে ভূমি দখলের ব্যাপারে তিনি সেপ্টেম (সিউটা)-এর কাউন্ট জুলিয়ানের কাছ থেকে অনেক উৎসাহ এবং সমর্থনের প্রতিশ্রুতি পেয়েছিলেন। মুসার নেতৃস্থানীয় লেফটেন্যান্ট, তারিক বিন জিয়াদ, ৭০০০ জনের একটি বাহিনীকে সংঘবদ্ধ করেন। কাউন্ট জুলিয়ানের নৌকাগুলোর সহায়তায় সেই বাহিনীকে ইউরোপের উপকূলে, পাথরের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়, যা তখন থেকেই তার নামে জাবাল তারিক[2] বা তারিকের পর্বত নামকরণ করা হয়েছিল। সময়টা ছিল ৭১১ সালের এপ্রিল মাস। তখন মুহাম্মদের মৃত্যুর পর একশ বছরেরও কম সময় অতিবাহিত হয়েছে। ক্ষমতাসীন ভিসিগোথ অভিজাতদের জনপ্রিয়তা আবারও মুসলিম সেনাবাহিনীকে সাহায্য করেছিল। একই বছরের জুলাই মাসে তারিকের সেনাবাহিনীর কাছে রাজা রডারিক পরাজিত হন। অত্যাচারী শাসক থেকে মুক্ত করার কারণে স্থানীয় জনগণ আক্রমণকারীদের ব্যানারে সংহতি প্রকাশ করে। শরৎকালে, কর্ডোবা ও টলেডো উভয় শহরই দখল করা হয়। তারিক যে উপদ্বীপ দখল করতে বদ্ধপরিকর তা উপলব্ধি করে মরক্কোর ঈর্ষান্বিত গভর্নর মুসা বিন নুসায়র ১০,০০০ সৈন্যের বাহিনী নিয়ে টলেডোতে তার বিজয়ী অধস্তন তারিকের সঙ্গে যোগ দেন।

একসঙ্গে এই দুই সেনাবাহিনী উত্তর-পূর্বদিকে অগ্রসর হয় এবং সারাগোসা দখল করে নেয়। স্পেনের বেশিরভাগ এলাকা তাদের নিয়ন্ত্রণে আসে। পুরোনো শাসনকে রক্ষা করতে জনগণের একগুঁয়ে অস্বীকৃতি এই বিজয়ের মূল কারণ ছিল। দুই মুসলিম নেতা পিরেনিস অতিক্রম করার পরিকল্পনা করেছিলেন এবং সেখান থেকে প্যারিস দখলের জন্য ফ্রান্সের মধ্য দিয়ে লংমার্চে যাত্রা শুরু করেন। কিন্তু তাদের আন্দালুসিস অভিযানের স্বপ্ন সীমিত থেকে গিয়েছিল।

তারা দামেস্কের খলিফার কাছ থেকে অনুমতি না নিয়ে তাকে কেবল তাদের অগ্রগতির কথা জানিয়েছিলেন। তার কর্তৃত্বের প্রতি অশ্বারোহী বাহিনীর এই অবাধ্য মনোভাবের কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে বিশ্বস্ত সেনাপতি স্পেনের বিজয়ীদের রাজধানীতে ডেকে পাঠান। বিজয়ী দুজনকে সম্মান করলেন না, বরং তিনি নিশ্চিত করেছিলেন যেন তাদের বাকি জীবন অসম্মানের মধ্যে কাটে। এরপর তাদের আর ইউরোপ অভিযানের সুযোগ হয়নি। অল্পসংখ্যক লোক সংগ্রাম চালিয়ে যেতে চাইলেও প্রেরণার অভাবে তাতে আর কোনো সফলতা আসেনি।

ইসলামি বিপ্লবের অগ্রযাত্রা শিগগিরই বন্ধ হয়ে যায়। ৭৩২ সালের অক্টোবরে চার্লস মার্টেলের বাহিনী পোয়েটিসের যুদ্ধে নবির সৈন্যদের ভয়ংকরভাবে পরাজিত করে। এবং প্রথম মুসলিম শতাব্দীর সমাপ্তি রচনা করে: উদাহরণস্বরূপ, নৌঘাঁটিগুলো ফ্রান্সের দক্ষিণে‒নিস এবং মার্সেইতে থাকলেও আপাতত, ইসলাম আইবেরিয়ান উপদ্বীপে সীমাবদ্ধ ছিল। এক শতাব্দী পর আরবরা সিসিলি দখল করে নিয়েছিল। মূল ভূখণ্ডের প্রতি হুমকি হলেও তারা আসলে উপসাগরে থেকে গিয়েছিল। পালেরমো একশ মসজিদের শহর হয়ে ওঠে। কিন্তু রোম মুসলিম আক্রমণ থেকে বেঁচে যায়। বিদেশি নাগরিক বিদ্বেষী উত্তর ইতালীয়রা আজ অবধি সিসিলিয়ানদের ‘আরব’ নামে উল্লেখ করে। আল-আন্দালুসে একসময় এই নাম প্রশংসাসূচক ছিল। কিন্তু বর্তমানে সেটা আর প্রশংসার ব্যাপার নেই।

৯৫৮ সালে সানচো দ্য ফ্যাট তার স্থূলতা নিরাময়ের জন্য মরিয়া হয়ে উত্তর রাজ্য নাভারেতের ঠান্ডা এবং বাতাসময় দুর্গ ছেড়ে দক্ষিণে কর্ডোবাতে যান। পশ্চিম খিলাফতের রাজধানী কর্ডোবা আজকের মতো ধুলোময় প্রাদেশিক শহর ছিল না। লোরকার জিপসি এই শহরকে ‘দূরবর্তী এবং নির্জন’ বলে বর্ণনা করেছে। খলিফা আবদের রহমান‒তৃতীয় কর্ডোবাকে ইউরোপীয় সংস্কৃতির একটি প্রধান শহরে পরিণত করেছিলেন। এর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী শহর ইউরোপে নয়, বরং দূরবর্তী মেসোপটেমিয়ায় ছিল, যেখানে অন্য রাজবংশের অন্য একজন খলিফা বাগদাদে রাজত্ব করছিলেন। উভয়ই তাদের স্কুল, লাইব্রেরি, সংগীতজ্ঞ এবং কবি, চিকিৎসক ও জ্যোতির্বিদ, মোল্লা এবং ধর্মবিরোধী – হ্যাঁ, সরাইখানা ও নাচের মেয়েদের জন্য বিখ্যাত ছিল।

কর্ডোবাতে ভিন্নমতের তীব্র চর্চা চালু ছিল। ইসলামি আধিপত্য আসলে যে জোরপূর্বক আরোপ করা হয়নি, এবিষয়ে তিনটি ধর্মের মধ্যে একটি খাঁটি বিতর্ক গড়ে উঠেছিল। বিতর্কের ফলে একটি আন্দালুসিয়ান সংশ্লেষণ তৈরি হয়েছিল, যা থেকে স্থানীয় ইসলাম ব্যাপকভাবে উপকৃত হয়েছিল। শহরটি ভিন্নমত এবং সন্দেহবাদীদের কারণে পরিচিত হয়ে ওঠে। বাগদাদের মানুষ ‘আন্দালুসিয়ান ধর্মদ্রোহিতা’ সম্পর্কে অর্ধেক প্রশংসায়, অর্ধেক ভয়ে কথা বলত। আন্দালুসিয়ান এর কিছু স্থাপত্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষার এই চর্চার ব্যাপারে এক গভীর আসক্তির নিদর্শন পাওয়া যায়।

কর্ডোবার গ্রেট মসজিদের ভেতরটি খুব চমৎকার। অসীমতার প্রতিফলন, স্তম্ভ-ঘন পরিবেশ শুধু সেই স্থপতিদের দ্বারা তৈরি হওয়া সম্ভব যারা শহরটিকে বুঝতে পেরেছিলেন এবং তারা এর দেওয়ালে বিকশিত বৌদ্ধিক উদ্দীপনার এক বাস্তব অংশ ছিলেন। একটি ক্যাথলিক বেদি, একটি অঙ্গ, বারোক মূর্তি, নিটোল কেরুবিন, ভারী কাঠ-খোদাই এবং নিপীড়ক পেটা-লোহা নির্মাণ দিয়ে স্থানটি নষ্ট করার আগের মসজিদটি কেমন ছিল তা নিয়ে প্রশ্ন আসাই স্বাভাবিক। এই আরোপের বিরুদ্ধে আমার প্রতিবাদী মন ভেতরে ভেতরে চিৎকার করেছিল। আমার এই চিৎকারের ফলে, আক্ষরিক অর্থে, মসজিদের ভেতরে আঁধার নেমে এসেছিল এবং আলোর প্রবাহকে বাধা দিচ্ছিল।

একটি বিশ্বাসের ওপর অন্য বিশ্বাসের বিজয় উদ্‌যাপন করার জন্য এটি যখন প্রথম নির্মিত হয়েছিল তখন কর্ডোবানরা কী অনুভব করছিল? সম্ভবত তাদের ভয় প্রকাশ করার সময় ছিল না। তাদের নিজেদের জীবনেও খুব রূপান্তর ঘটেছিল। শহরে থাকার জন্য অনেকেই খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেছিল। অন্যরা নির্বাসন বেছে নিয়েছিল এবং জাহাজ পথে মরক্কো চলে গিয়েছিল। তাদের অগ্রাধিকারের তালিকায় মসজিদ অবশ্যই তেমন গুরুত্ব পায়নি। অনেক ধর্মান্তরিত মুসলমান গোয়েন্দা বিভাগের গুপ্তচরদের নজরাধীন ছিল। তাই তারা তাদের পুরোনো আস্তানা এড়িয়ে চলত। কিন্তু ক্যাথেড্রালটি নির্মিত হওয়ার পর, তারা অবশ্যই তাদের আনুগত্য দেখানোর জন্য সেখানে প্রার্থনা করেছিল। এই পৈশাচিকতা দেখে তারাও কি প্রথম ভেতরে ভেতরে চিৎকার করেছিল? আমি মনে করি, ধর্মীয় কারণে না হলেও নান্দনিকতার জন্য তাদের ভেতরে চিৎকার হয়েছিল।

১৫২৬ সালে স্পেনের চার্লস যখন প্রথম কর্ডোবা পরিদর্শন করেন, তখন তিনি তার পুরোহিতদের তিরস্কার করেছিলেন:

‘আপনি যা তৈরি করেছেন তা যে কোনো জায়গায় সুলভ এবং যা ধ্বংস করেছেন তা অনন্য।’

মন্তব্যটি যথেষ্ট উদার ছিল, কিন্তু চার্লস বুঝতে পারেননি যে ভেতরে গির্জাটির অস্তিত্বই

মসজিদটি সংরক্ষিত হওয়ার একমাত্র কারণ ছিল।

গির্জা নির্মাণ স্থানটির অসীমতার অনুভূতিকে বিঘ্নিত করছিল। খিলানের লাল এবং সাদা মধ্যপ্রস্তর পাথরের মরূদ্যানকে বাধা দিচ্ছিল। এটি এমন একটি বাঁধের মতো ছিল যা এক দিক থেকে অন্যদিকে দর্শনার্থীদের প্রবাহ বন্ধ করে দেয়। অনেক বছর ধরে আমি মুসলিম বিশ্বের কার্যত সমস্ত উল্লেখযোগ্য মসজিদ দেখেছি, অনেক গির্জা পরিদর্শন করেছি এবং কিছু খুব ব্যতিক্রমী বিন্যাসে উপাসনালয়গুলোর প্রশংসা করেছি। কর্ডোবার মসজিদের মতো আর কোনোটি আমাকে এমন প্রভাবিত করেনি। এটা কি নিছকই একটি আক্রমণকারী ক্যাথিড্রালের ধর্ষণ করার বিরুদ্ধে সংহতি প্রদর্শনের জন্য? এই মসজিদে কোনো ধরনের জাদু আছে বলে আমি মনে করি না: এর ভৌগোলিক কাঠামো, আবদ্ধ থেকে এর অস্বীকৃতি, একটি বাস্তব বিশ্বের সঙ্গে এর যোগসূত্র তার নির্মাণে গেঁথে আছে। এবং সঙ্গে ইতিহাস তো অবশ্যই আছে। সম্ভবত এর ইতিহাস আমাকে প্রভাবিত করেছে, কিন্তু আমি সেই ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা দেওয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখছি। স্থাপত্যের মধ্যেই এর জবাব খুঁজে পাওয়া যাবে।

স্থপতিরা অত্যন্ত যত্নসহকারে মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন। তবে তারা অবশ্যই শহরের পরিবেশকে আত্মস্থ করেছিলেন। তাদের নির্মাণ এমন একটি সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করছে যার সঙ্গে খোদাই করা ইমেজ এর বৈপরীত্য দেখা যাচ্ছিল। মসজিদটি সম্পূর্ণ শূন্যতায় পরিপূর্ণ। কর্ডোবার বিলাসবহুলতার বিবরণ এই শূন্যতাকে আরও জোরদার করেছে। সব দিকই শূন্যতায় পরিপূর্ণ। এই অস্বীকৃতি বাস্তবতাকে নিশ্চিত করে তোলে। এই বিশেষভাবে সৃষ্ট শূন্যতায় শুধু শব্দ বিদ্যমান, কিন্তু কর্ডোবায় (এবং, অবশ্যই, শুধুসেখানেই নয়) মসজিদটি শুধু ঈশ্বরের বাণীর জন্য নয়, একটি রাজনৈতিক এবং সর্বজনীন স্থান হিসেবে নির্মিত হয়েছিল।

কর্ডোবায় কোরআন নিয়ে আলোচনা ও বিশ্লেষণের সময় উভয় পক্ষের মধ্যে কঠোর এবং সংশয়মূলক শব্দ বিনিময় হতো। প্রায়ই স্থানটিতে সেই বিতর্ক প্রতিধ্বনিত হতো। দার্শনিক কবি ইবনে হাজম পবিত্র কলামের মধ্যে বসে সেই সমস্ত বিশ্বাসীকে অভিযুক্ত করতেন যারা যুক্তির মাধ্যমে ধারণার সত্যতা প্রদর্শন করতে অস্বীকার করেছিল। তারা চিৎকার করে তাকে জানাতো, দ্বান্দ্বিক তত্ত্ব ব্যবহার নিষিদ্ধ। ‘কে নিষেধ করেছে?’–ইবনে হাযম তার প্রত্যুত্তরে জিজ্ঞাসা করেন। তিনি বোঝান যে, একমাত্র নিষেধকারীই প্রকৃত ইমানের শত্রু। যুক্তি এবং ঐশ্বরিক সত্যের মিলনের প্রচেষ্টা একটি আন্দালুসিয়ান বিশেষত্ব হয়ে ওঠে। বাগদাদ ও কায়রোতে আন্দালুসিয়ান বিশেষত্বকে গভীর সন্দেহের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়।

এই সংস্কৃতি বিলুপ্ত করতে এবং একটি ‘বিশুদ্ধ’ ইউরোপীয় পরিচয় তৈরি করতে কয়েকশ বছর সময় লেগে যায়। ১৪৯২ সালে গ্রানাডার পতনের মাধ্যমে পুনরুদ্ধারের এই প্রক্রিয়ার সমাপ্তি ঘটে। আইবেরিয়ান উপদ্বীপ থেকে মুসলিম ও ইহুদিদের জাতিগত নির্মূলের মাধ্যমে ইউরোপের চূড়ান্ত সমাধানের প্রথম চেষ্টার সূচনা হয়েছিল।[3] এর অর্থ এই নয় যে, একটি নিখুঁত বিশ্বকে বাইরে থেকে ধ্বংস করা হয়েছিল। কোথাও কোনো নিখুঁত বিশ্ব ছিল না। ইসলামের মধ্যে গৃহযুদ্ধের কারণে আন্দালুসীয় সত্তা দুর্বল হয়ে পড়েছিল। একটি কট্টর বর্বর মৌলবাদ, যা পরবর্তী শতাব্দীর ওহাবি বিশুদ্ধতাবাদকে স্মরণ করিয়ে দেয়, সেই মৌলবাদের অনুসারীরা বহু প্রাসাদ এবং ভবন কাঠামো ধ্বংস করেছিল এবং ইসলামের বিশেষ ধরন নিতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে খ্রিষ্টান, ইহুদি ও মুসলমানদের হত্যা করেছিল। এগুলো দেখায় যে একেশ্বরবাদী বিশ্বাস বলে কিছু নেই। তিনটি ধর্মের মধ্যেই বিরুদ্ধ স্রোত বিদ্যমান। তবে ইসলামিক স্পেনে এমন একটি সময়কাল ছিল যাকে ‘স্বর্ণযুগ’ হিসেবে বর্ণনা করা যেতে পারে। আমাদের নির্দিষ্ট উৎস যাই হোক না কেন, তার প্রভাব/অস্তিত্ব আমাদের মধ্যে থেকে গেছে।

ইসলাম সবসময় অন্যান্য ঐতিহ্যের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে সমৃদ্ধ হয়েছিল। ইহুদি ও খ্রিষ্টান ধর্মের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের মধ্যে তার উৎস নিহিত। এর প্রাথমিক রক্ষকরা আলেকজান্দ্রিয়ার প্রাচীন বিদ্যালয়গুলো থেকে বিশ্বজনীন দার্শনিকদের দ্বারা সর্বপ্রথম উদ্ভাবিত প্রকাশের পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলেন। নিওপ্ল্যাটোমিস্ট এবং সুফি ঐতিহ্যের মধ্যে সরাসরি ও অবচেতন উভয় পর্যায়েই আন্তঃসম্পর্ক ছিল। এটা কোনো সাধারণ জ্ঞান নয় যে ধ্রুপদি সভ্যতার অবসানের পর, প্রাথমিক মধ্যযুগের ইসলামি নবজাগরণ প্রাচীন গ্রিকদের চিন্তাভাবনাকে সংরক্ষণ ও পরিমার্জনা করেছিল, ব্যাবহারিক শিল্প ও বিজ্ঞানে কাজ তৈরি করেছিল যা কয়েক শতাব্দী পর, ইউরোপীয় রেনেসাঁর সঙ্গে বুদ্ধিবৃত্তিক সেতুবন্ধ তৈরি করেছিল এবং সৃষ্ট ধারণাগুলো আধুনিক পশ্চিমে আধিপত্য বিস্তার করেছিল।

কর্ডোবা খিলাফত এবং সিসিলির আরব দখলের সময় উৎপাদিত সাংস্কৃতিক মিশ্রণটি ইসলাম এবং ইউরোপ উভয়ের ইতিহাস ও ভৌগোলিক চেহারায় চিহ্ন রেখে গেছে। প্রাচীন গ্রিস থেকে পশ্চিম ইউরোপের দিকে গতিপথটি ইসলামী বিশ্বের মধ্য দিয়ে একটি দীর্ঘ বৃত্তাকার পথ তৈরি করেছিল। প্রাচীন বিশ্বের একজন বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ, এম আই ফিনলে লিখেছেন:

সত্যিই ‘ইসলামের মধ্যে ইতোমধ্যেই যে অনৈক্য ও সংঘর্ষ ছিল যদি তার বিকাশ না ঘটত, তাহলে এটা সম্ভব যে প্রাচ্য সাম্রাজ্য বা পাশ্চাত্য কেউই টিকে থাকত না।’

জেরুজালেম, জেরুজালেম

খ্রিষ্টধর্ম তার ভুঁইফোঁড় প্রতিদ্বন্দ্বীর অভূতপূর্ব সাফল্যে কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে? ভূমধ্যসাগরীয় এবং তার বাইরের বিশ্ব দখলের সংগ্রামে অগ্রসরমান আরব সেনাবাহিনী সবচেয়ে গতিশীল শক্তিতে পরিণত হয়েছিল। প্রথম সহস্রাব্দের শেষের দিকে, ইসলাম‒ বিশ্ব মধ্য এশিয়া থেকে আটলান্টিক উপকূল পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছিল। আব্বাসীয়দের রক্তক্ষয়ী বিজয়ের পরপরই এর রাজনৈতিক বাহিনী বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ক্ষমতার তিনটি কেন্দ্র আবির্ভূত হয়েছিল: বাগদাদ, কর্ডোবা ও কায়রো। প্রত্যেকের নিজস্ব খলিফা ছিল। প্রতিষ্ঠাতা-নবির মৃত্যুর পরপরই ইসলাম দুটি প্রধান উপদল, সুন্নি সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠে বিভক্ত হয়ে পড়ে। সুন্নিরা আল-আন্দালুস, মাগরেবের কিছু অংশ, ইরান, ইরাক ও অক্সাসের বাইরের অঞ্চলে শাসন করেছিল। কায়রোতে ফাতেমীয় খলিফা শিয়া ঐতিহ্যের অন্তর্গত ছিলেন। চতুর্থ খলিফা আলী এবং তার স্ত্রী নবির কন্যা ফাতিমার বানোয়াট বংশোদ্ভূত হওয়ার দাবি থেকে রাজবংশের নামকরণ করা হয়েছিল। প্রথম চার ফাতেমীয় খলিফা উত্তর আফ্রিকার কিছু অংশ শাসন করেছিলেন। ৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে কিংবদন্তি জেনারেল জওহারের নেতৃত্বে একটি ফাতেমীয় অভিযাত্রী বাহিনী মিশর দখল করার আগপর্যন্ত তারা মাগরেবে বসবাস করেছিলেন।

এই প্রতিটি অঞ্চলের ঐতিহ্য ছিল ভিন্ন ভিন্ন। তদুপরি, প্রত্যেকের নিজস্ব বস্তুগত স্বার্থ এবং চাহিদা অনুযায়ী অ-ইসলামি বিশ্বের সঙ্গে তাদের জোট এবং সহাবস্থানের নীতি নির্ধারিত হয়েছিল। নতুন সাম্রাজ্য গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ধর্ম একটি প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল। কিন্তু এর দ্রুত বিস্তারই কিন্তু আবার তার নিজের ভেঙে যাওয়ার শর্ত তৈরি করেছিল। এই আকারের সাম্রাজ্য পরিচালনার জন্য বাগদাদে প্রয়োজনীয় সামরিক শক্তি এবং আমলাতন্ত্রের অভাব ছিল। সাম্প্রদায়িক বিভেদ কাজ করছিল। একচেটিয়া এবং সর্বময় শক্তিশালী ইসলামি সভ্যতার ধারণাটি দশম শতাব্দীর শুরুতে এবং সম্ভবত, তার আগেই অর্থহীন হয়ে পড়েছিল। খুব শিগগিরই তার অবসান ঘটে।

নাগরিক সংঘাতে জর্জরিত আত্মতৃপ্ত মুসলিম বিশ্ব থেকে পবিত্র ভূমি দখল করাসহ যতটা সম্ভব সম্পদ লুট করে তা ইউরোপে ফিরিয়ে আনার জন্য পশ্চিমা ধর্মপ্রাণবাদীরা প্রথম ক্রুসেড শুরু করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সুন্নি ও শিয়া উপদলের মধ্যে ত্রিশ বছরের যুদ্ধ উভয় পক্ষকে দুর্বল করে দিয়েছিল। উভয় শিবিরের প্রধান শাসক, রাজনীতিবিদ এবং সামরিক নেতারা ক্রুসেডের ঠিক আগের বছরগুলোতে মারা গিয়েছিলেন। ১০৯৪ সালে ইতিহাসবিদ ইবনে তাঘরিবিরদী লিখেছেন, ‘এই বছরকে’, ‘খলিফা ও সেনাপতিদের মৃত্যুর বছর বলা হয়।’ মৃত্যুর স্ফুলিঙ্গ সুন্নি ও শিয়া উভয় শিবিরে উত্তরাধিকারিত্ব দখলের যুদ্ধকে বন্ধ করতে শুরু করে। এই নতুন আন্তঃযুদ্ধ আরব বিশ্বকে আরও দুর্বল করে দিয়েছিল। দুই বছর পর ফ্রাঞ্জ আঘাত হানে। তাদের নির্মম দৃঢ়তায় বিভক্ত ইসলাম বিশ্ব দ্রুত ভেঙে পড়ে।

১০৯৯ সালে, চল্লিশ দিনের অবরোধের পর, ক্রুসেডাররা জেরুজালেম দখল করে। গণহত্যার মাত্রা সমগ্র অঞ্চলকে ভীতসন্ত্রস্থ করে তোলে। এই হত্যাকাণ্ড পুরো দুদিন স্থায়ী হয়েছিল। বেশিরভাগ মুসলিম পুরুষ, নারী ও শিশু নিহত হয়েছিল। শহর রক্ষার জন্য মুসলমানদের সঙ্গে পাশাপাশি ইহুদিরা যুদ্ধ করেছিল, কিন্তু ক্রুসেডারদের প্রবেশ তাদের মধ্যে আতঙ্কের অনুভূতি তৈরি করেছিল। অতীতের আচার-অনুষ্ঠান অনুসরণ করে, বয়স্ক ব্যক্তিরা সমগ্র ইহুদি জনগোষ্ঠীকে সিনাগগে এবং এর চারপাশে সমবেত প্রার্থনা করার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন। তবে এই সিদ্ধান্ত একটি মারাত্মক ভুল ছিল। ক্রুসেডাররা সিনাগগের ঘের ঘেরাও করে, তারপর ভবনে আগুন লাগিয়ে দেয় এবং প্রতি ইহুদির পুড়ে মৃত্যু হওয়া নিশ্চিত করে। বিজয়ী অশ্লীলতার একটি ঘন তৈলাক্ত মেঘ যেন সমগ্র অঞ্চলকে পরবর্তী এক শতাব্দী দীর্ঘকাল ছায়াবৃত করে রেখেছিল। এই নৃশংসতার ঠিক নয়শ বছর পর, ধর্মীয় মৌলবাদ সংঘটিত জঘন্যতম অপরাধগুলোর মধ্যে অন্যতম এই ক্রুসেডের জন্য পোপ ক্ষমা চেয়েছিলেন।

বিজয়ী অশ্লীলতার একটি ঘন তৈলাক্ত মেঘ যেন সমগ্র অঞ্চলকে পরবর্তী এক শতাব্দী দীর্ঘকাল ছায়াবৃত করে রেখেছিল। এই নৃশংসতার ঠিক নয়শ বছর পর, ধর্মীয় মৌলবাদ সংঘটিত জঘন্যতম অপরাধগুলোর মধ্যে অন্যতম এই ক্রুসেডের জন্য পোপ ক্ষমা চেয়েছিলেন।

জেরুজালেমে গণহত্যার খবর ধীরে ধীরে মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। খলিফা আল-মুস্তাজির তার বাসস্থানে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। সম্মানিত ‘কাজি’ আবু সাদ আল-হারাভি, শোকে মাথা মুণ্ডানো অবস্থায় বাগদাদে এসে পৌঁছান এবং রক্ষীদের একপাশে সরিয়ে রাজকীয় মহলে ঢুকে রাগে ফেটে পড়েন। তিনি তিন সপ্তাহ আগে দামেস্ক ছেড়েছিলেন, এবং মরুভূমির সূর্যের ফুসকুড়িতে ভ্রমণের পর তার আর রসিকতা করার অবস্থা ছিল না। রাজপ্রাসাদে তিনি যে দৃশ্য অবলোকন করেছিলেন তা তার ভালো লাগেনি। আরব ইতিহাসবিদরা তার তির্যক মন্তব্য রেকর্ড করেছিলেন:

আপনি কীভাবে উদাসীন হয়ে নিরাপত্তার ছায়ায় ঘুমানোর সাহস করেন, বাগানের ফুলের মতো অসার জীবনযাপন করেন যখন সিরিয়ায় আপনার ভাইদের উটের জিন এবং শকুনের পেট ছাড়া কোনো থাকার জায়গা নেই? রক্ত ঝরেছে! সুন্দরী তরুণী মেয়েদের সম্মান লঙ্ঘিত হয়েছে… সাহসী আরবরা কি অপমান করার জন্য নিজেদের পদত্যাগ করবে এবং বীর পারস্যরা অসম্মান স্বীকার করবে… মুসলমানরা এতটা অপমানিত হয়নি কখনো। তাদের জমি এতটা বর্বরভাবে বিধ্বস্ত হয়নি কখনো…

ইতিহাসবিদরা আরও বর্ণনা করেন যে কীভাবে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষরা তার কথা শুনে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেছিল, বিশেষ করে যখন তিনি প্যালেস্টাইনের ভাগ্য এবং জেরুজালেমের পতনের বর্ণনা করেছিলেন। বক্তৃতা উপস্থিত সবাইকে প্রভাবিত করেছিল, কিন্তু আল-হারাউই সেই আবেগ দেখে শান্ত হননি।

‘মানুষের সবচেয়ে নিকৃষ্ট অস্ত্র হলো অশ্রু ফেলা যখন রেপিয়ারের মতো অস্ত্র যুদ্ধের আগুন জ্বালায়।’

পরের শতাব্দীতে, ক্রুসেডাররা এ অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে। ফ্রাঞ্জরা সেখানে সহাবস্থান করবে এই ধারণা থেকে অনেক মুসলিম ক্ষমতাবান তাদের সঙ্গে বাণিজ্যিক ও সামরিকভাবে সহযোগিতা করতে শুরু করে। যে সভ্যতাকে আক্রমণ করেছিল তার কোমল দিক ক্রুসেডারদের কিছুটা প্রভাবিত করতে শুরু করেছিল। তাদের কয়েকজন নেতা খ্রিষ্টান মৌলবাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে তাদের প্রতিবেশীদের সঙ্গে শান্তি স্থাপন করেন। কিন্তু তাদের অধিকাংশই মুসলিম ও ইহুদি প্রজাদের আতঙ্কিত করে তোলে। তাদের এই সহিংসতার প্রতিবেদন প্রচারিত হতে থাকে।

১১৭১ সালে, একজন অজানা কুর্দি যোদ্ধা, সালাহ আল-দিন (সালাদিন), কায়রোতে ফাতেমীয় শাসনের অবসান ঘটান এবং মিশরের সুলতান হিসেবে প্রশংসিত হন। কয়েক মাস পর, তার অত্যন্ত সম্মানিত পৃষ্ঠপোষক নুর আল-দিনের মৃত্যুতে, যুবক কুর্দি তার সৈন্যবাহিনীসহ দামেস্কে যাত্রা করেন। শহরটি স্বাধীন করে তিনি এর সুলতান হয়েছিলেন। শহরের পর শহর তার আধিপত্য মেনে নেয়। তাতে খলিফা ভয়ে কেঁপে উঠলেন। তিনি জানতেন যে বাগদাদও একদিন তরুণ বিজয়ীর মন্ত্রের অধীন আসবে। সে হয়তো এখানে এসে খলিফাকে তার কর্তৃত্বের আওতায় আনবে। তবে অভিজাতরা তাকে কীভাবে গণ্য করে সেই ব্যাপারে সালাউদ্দিন সচেতন ছিলেন। তিনি জানতেন, সিরিয়ার অভিজাতরা তার কুর্দি-পরিচয় এবং ‘নীচু লালন পালন’-এর প্রতি বীতশ্রদ্ধ ছিল। সর্বোচ্চ ঐক্য প্রয়োজনের তাগিদে তিনি অভিজাতদের এবং তাদের মতো অন্যদের উসকানি না দেওয়াই উত্তম মনে করলেন। সে কারণে তিনি কখনোই বাগদাদের কাছাকাছি যাননি এবং সবসময় খলিফার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন।

কায়রো ও দামেস্কের মসজিদে একই খলিফার নামে প্রার্থনা (খুৎবা) মিশর ও সিরিয়ার ঐক্যের প্রতীক হয়ে ওঠেছিল, ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে একটি সমন্বিত আক্রমণের ভিত্তি স্থাপন করেছিল। কুর্দি নেতা ধৈর্যসহকারে এমন একটি অঙ্গীকার শুরু করেছিলেন যা তখন পর্যন্ত অসম্ভব প্রমাণিত হয়েছিল এবং এই ব্যাপারে তিনি তার পূর্বসূরিদের অতিক্রম করেছিলেন। অঙ্গীকারটি ছিল: জেরুজালেমকে মুক্ত করার জন্য একটি ঐক্যবদ্ধ মুসলিম সেনাবাহিনী তৈরি করা। সাধারণ বিশ্বাসের বিপরীতে ‘পবিত্র যুদ্ধ’ হিসেবে জিহাদের ধারণার একটি সীমিত ধারাবাহিকতা ছিল। ইসলামের প্রারম্ভিক বিজয়ের পর একটি সংঘবদ্ধ স্লোগান হিসেবে এর আবেদন নিঃশব্দে চাপা পড়ে গিয়েছিল। ইসলামের বৈশিষ্ট্যের ছায়ায় সালাদিনের নিজের পক্ষকে একত্রিত করতে প্রথম ক্রুসেডের বর্বর উগ্রতা অবদান রেখেছিল।

‘ফ্রাঞ্জকে সম্মান করুন’, তিনি তার সৈন্যদের উদ্দেশ্য করে বললেন- ‘দেখুন, তারা তাদের ধর্মের জন্য কী দৃঢ়তার সঙ্গে লড়াই করে, অথচ আমরা মুসলমানরা পবিত্র যুদ্ধে কোনো উৎসাহ দেখাই না।’ ফ্রাঞ্জদের মর্যাদা এমন ছিল যে মুসলমানরা সমস্ত পশ্চিম ইউরোপীয়দের এই নামেই উল্লেখ করত।

সালাদিনের লংমার্চ শেষ পর্যন্ত বিজয়ের মধ্যেই শেষ হয়। ১১৮৭ সালে তিনি জেরুজালেম দখল করেন। জেরুজালেম আবার একটি উন্মুক্ত শহরে পরিণত হয়। সিনাগগস পুনর্নির্মাণের জন্য ইহুদিদের রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি প্রদান করা হয়। গির্জাগুলোকে স্পর্শ করা হয়নি। কোনো প্রতিশোধমূলক হত্যাকাণ্ডের অনুমতি দেওয়া হয়নি। তার পাঁচশ বছর আগে খলিফা উমরের মতো, সালাদিন সমস্ত ধর্মের উপাসকদের জন্য শহরের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু টায়ার অঞ্চল দখলে তার ব্যর্থতা একটি ব্যয়বহুল কৌশলগত ত্রুটি হিসেবে প্রমাণিত হয়। পোপ আরবান পবিত্র শহর ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য তৃতীয় ক্রুসেড পাঠান এবং টায়ার অঞ্চল তাদের অপারেশনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হয়ে ওঠে। ক্রুসেড নেতা, রিচার্ড প্লান্টাজেনেট একে পুনরুদ্ধার করে, বন্দিদের মৃত্যুদণ্ড দেয় এবং এর বাসিন্দাদের রক্তে প্লাবিত করে। কিন্তু জেরুজালেম রক্ষা পেয়ে যায়। এটি পুনরুদ্ধার করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। পরবর্তী সাতশ বছর ধরে শহরটি, একটি স্বল্পস্থায়ী এবং অপ্রয়োজনীয় ক্রুসেডার দখলের ব্যতিক্রম ছাড়া, মুসলিম শাসনের অধীন ছিল। এই সময়ের মধ্যে কোনো অংশ রক্তে রঞ্জিত হয়নি।

জেরুজালেম আবার একটি উন্মুক্ত শহরে পরিণত হয়। সিনাগগস পুনর্নির্মাণের জন্য ইহুদিদের রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি প্রদান করা হয়। গির্জাগুলোকে স্পর্শ করা হয়নি। কোনো প্রতিশোধমূলক হত্যাকাণ্ডের অনুমতি দেওয়া হয়নি। তার পাঁচশ বছর আগে খলিফা উমরের মতো, সালাদিন সমস্ত ধর্মের উপাসকদের জন্য শহরের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন।

বিংশ শতাব্দীতে ঘটনার নতুন বাঁক তৈরি হয়েছিল: একচেটিয়াভাবে ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের জন্য ব্রিটিশ-সমর্থিত সফল জায়নবাদী সংগ্রাম জেরুজালেমকে আবারও অস্থিতিশীল করে তোলে। জনসংখ্যাকে জোরপূর্বক অপসারণ এবং আরও রক্তপাত ঘটতে থাকে। আমার এই লেখার সময়, জেরুজালেমের মর্যাদা বিতর্কিত রয়ে গেছে, এর অধিবাসীরা বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং যুক্তির জায়গা আবার সামরিক শক্তি দ্বারা দখল করে।

ক্রুসেড ইউরোপীয় ও আরব চেতনায় গভীর চিহ্ন রেখে গেছে। ১৯২০ সালের জুলাই মাসে ফরাসি জেনারেল হেনরি গৌরাউদ দামেস্কের দায়িত্ব নেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর লুন্ঠনের বিভাজনে সিরিয়াকে ফ্রান্সের কাছে বরাদ্দ করা হয়েছিল। এসময় অটোমান সাম্রাজ্যের সম্পূর্ণ পতন ঘটে। শহরে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে তার প্রথম কাজগুলোর মধ্যে একটি ছিল গ্র্যান্ড মসজিদের কাছে সালাদিনের সমাধি পরিদর্শন করা। সেখানে তার অশ্লীল প্রকাশ সমগ্র আরব বিশ্বকে হতবাক করে দিয়েছিল। তিনি সেখানে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেছিলেন: ‘সালাদিন, আমরা ফিরে এসেছি। আমার উপস্থিতি ক্রিসেন্টের ওপর ক্রসকে পবিত্র করে।’

১৯৮০-এর দশকের লেবাননের গৃহযুদ্ধের সময় ফরাসি দূতাবাসে ক্রুসেডের আরও একটি হাস্যকর নাটক হয়েছিল। একদিন একদল বিশিষ্ট স্থানীয় খ্রিষ্টান অঘোষিতভাবে এসে রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দেখা করতে চান। সাক্ষাত্কার মঞ্জুর হলো। একজন উল্লেখযোগ্য বর্ষীয়ান ব্যক্তি নিখুঁত ফরাসি ভাষায় ব্যাখ্যা করলেন যে তারা সবাই দ্বাদশ শতাব্দীতে এই সুন্দর অঞ্চলে প্রথম আগত ফ্রাঙ্কিশ নাইটদের সরাসরি বংশধর। তাদের পরিবারের গল্প শোনার সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রদূত সহানুভূতিশীল হলেন। তার মুখ আনন্দে হাস্যোজ্জ্বল হয়ে উঠল। তার অফিসে আগেও এরকম অতীত কাহিনি প্রতিধ্বনিত হয়েছিল। এরপর গণ্যমান্য ব্যক্তিরা তাদের আগমনের উদ্দেশ্য প্রকাশ করে। যেহেতু তাদের পূর্বপুরুষ ফরাসি ছিলেন, তাই তারা নিজেদের এবং তাদের পরিবারের জন্য ফরাসি পাসপোর্ট দাবি করে, যাতে তারা তাদের জন্মের দেশে ফিরে যেতে পারে। সেই মুহূর্তে মহামান্যের আচরণে পরিবর্তন দেখা দিল।

‘মেসিয়ার্স’, তিনি বললেন, ‘আপনি যে সময়ের কথা বলছেন, তখন ফরাসি প্রজাতন্ত্রের অস্তিত্ব ছিল না। সে কারণে, আমাকে আপনার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করতে হবে এবং আমাদের মিটিং এখানেই শেষ করতে হবে।’

অটোমানবাদ

ক্রুসেডগুলো এমন একটি বিশ্বকে আক্রমণ করেছিল যা ইতোমধ্যে ধীরগতিতে পতনমুখী ছিল। সালাদিনের বিজয় এই পতন প্রক্রিয়াটিকে সাময়িকভাবে থামিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু খিলাফতের অভ্যন্তরীণ কাঠামোতে অমেরামতযোগ্য ক্ষতি হয়ে গিয়েছিল। আরও নতুন আক্রমণ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছিল। হালাকু খানের নেতৃত্বে একটি মঙ্গোল সেনাবাহিনী ১২৫৮ সালে বাগদাদ অবরোধ করে। মঙ্গোল নেতা খলিফাকে আত্মসমর্পণের শর্তে শহরটিকে রক্ষার প্রতিশ্রুতি দেন। নিরর্থক হলেও খলিফা শেষ অবধি শর্তটি প্রত্যাখ্যান করে চলেন। তাই মঙ্গোল বাহিনী তাদের হুমকি কার্যকর করে, শহরটিকে তছনছ করে এবং শেষ আব্বাসীয় খলিফাকে হত্যা করে। খেলাফতের এক অসম্মানজনক ইতি ঘটে। লাইব্রেরিগুলো পুড়িয়ে দেওয়ায় সংস্কৃতি চিহ্ন পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। মঙ্গোলরা প্রায়ই জ্ঞানের ভান্ডার ধ্বংস করে উন্নততর সভ্যতার প্রতি তাদের বিরক্তি প্রকাশ করত। বাগদাদ কখনোই আর ইসলামি সভ্যতার রাজধানী হিসেবে তার প্রাক-গৌরব ফিরে পায়নি।

মঙ্গোল বাহিনী তাদের হুমকি কার্যকর করে, শহরটিকে তছনছ করে এবং শেষ আব্বাসীয় খলিফাকে হত্যা করে। খেলাফতের এক অসম্মানজনক ইতি ঘটে। লাইব্রেরিগুলো পুড়িয়ে দেওয়ায় সংস্কৃতি চিহ্ন পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়।

আঞ্চলিক ক্ষমতাবানরা তাদের আধিপত্য পুনরুদ্ধার করার কারণে এ অঞ্চলের অন্যত্র ক্ষমতা বৈচিত্র্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। কিন্তু ইসলামের কেন্দ্র বসফরাস এর দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ইসলাম তিনটি মহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। সামরিকশক্তি এবং বাণিজ্যের পিনসার আন্দোলন কোনো মহান মহাপরিকল্পনার ফল ছিল না, তবে এর প্রভাব একই ছিল।

অষ্টম ও নবম শতাব্দীতে মুসলিম সৈন্যরা আফগানিস্তান ও সিন্ধু নদী পাড়ি দিয়ে ভারতে প্রবেশ করতে শুরু করেছিল। উপমহাদেশের দক্ষিণ উপকূলের জনসংখ্যা একইসঙ্গে আরব ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণাধীন হচ্ছিল। গণধর্মান্তর ঘটতে থাকে। স্থানীয় ধর্মের প্রতি অসন্তোষ এবং ইসলামের সরলতা অবশ্যই এই প্রক্রিয়ায় সমান ভূমিকা পালন করেছে। বর্ণপ্রথা এবং ধর্মীয় শ্রেণিবিন্যাসের বোঝায় আক্রান্তদের ইসলাম গ্রহণ করার জন্য মুহাম্মদের একেশ্বরবাদী সার্বজনীনতা এবং ঈশ্বরের সামনে সমস্ত বিশ্বাসীর সমতার সংমিশ্রণ একটি আকর্ষণীয় সূত্র হিসেবে কাজ করে।

পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে, উত্তর-পশ্চিম চীনের জিনজিয়াং অঞ্চলে তিনটি প্রধান স্থল বাণিজ্য-রুটের সংগমে একই ধারা অনুসরণ করা হয়েছিল। সেই সময় মুসলিম বণিক বহর ইন্দোনেশিয়ান দ্বীপপুঞ্জ এবং দক্ষিণ চীনের পাশাপাশি আফ্রিকার পশ্চিম ও পূর্ব উপকূলে পৌঁছেছিল। চতুর্দশ শতাব্দীর মধ্যে ইসলামের মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্র বসফরাসের দিকে অগ্রসর হয়েছিল। তারা রোম রক্ষা করতে পেরেছিল। কিন্তু কনস্টান্টিনোপলের অবসান হলো। এর আগে চারবার দামেস্ক ও বাগদাদ থেকে খিলাফতের সেনাবাহিনী প্রাচ্য খ্রিষ্টধর্মের রাজধানী অবরোধ করেছিল। প্রতিটি ক্ষেত্রেই শহরটি টিকে গিয়েছিল। ১৩০০ সাল থেকে আনাতলিয়া আমিরাতের সীমানা ধীরে ধীরে বিস্তৃত হতে থাকে এবং ক্রমাগতভাবে বাইজেন্টাইন অঞ্চলে প্রবেশ করে। ১৪৫৩ সালে পুরোনো স্বপ্নগুলো বাস্তবায়িত হয়। প্রাচীন শহর বাইজেন্টিয়াম পরে কনস্টান্টিনোপল হয়ে নতুন ‘ইস্তান্বুল’ নাম গ্রহণ করে। দ্বিতীয় মেহমেত নামে একজন নতুন শাসকের আগমন ঘটে। তার পূর্বপুরুষ, উসমান, একশ বছর আগে তার নাম বহনকারী রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

আইবেরিয়ান উপদ্বীপে ইসলামি সভ্যতার সম্পূর্ণ পতনের প্রাক্কালে, অটোমান রাজবংশ দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপে একটি নতুন ইসলামিক ফ্রন্ট খোলার মাধ্যমে তার রাজত্বের উদ্বোধন করে। পরের শতাব্দীর মধ্যে অটোমানরা হাঙ্গেরি দখল করে নেয়, বলকান গ্রাস করে, ইউক্রেন ও পোল্যান্ডের কিছু অংশকে ছিনিয়ে নেয় এবং ভিয়েনার জন্য হুমকি হয়ে ওঠে। স্প্যানিশ ক্যাথলিকরা ভয় পেয়েছিল। আন্দালুসিয়ান মুসলিমরা আশা করেছিল, বিজয়ী অটোমানরা আন্দালুসিয়ান সমুদ্রবন্দরে নৌবাহিনী পাঠাবে এবং তাদের সহধর্মবাদীদের মুক্ত করবে। কিন্তু সালাদিনের মতো একটি মহাদেশীয় জিহাদের ব্যাপারে উসমানীয় পরিকল্পনা ছিল না। ক্রুসেডের চরম আগ্রাসনের সময়ে সালাদিন ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলে গিয়েছিলেন এবং একজন উপদেষ্টা নিশ্চিত করেছিলেন যে, ফ্রাঞ্জ প্লেগকে সিদ্ধান্তমূলকভাবে পরাস্ত করার একমাত্র উপায় হলো তাদের স্বদেশকে জয় করা এবং তাদের সভ্য করা। জেরুজালেম সালাদিনের জন্য যথেষ্ট ছিল। দ্বিতীয় মেহমেত কনস্টান্টিনোপল নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন।

পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দী জুড়ে, মুসলমানদের একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ অটোমান, সাফাভিদ (পারস্য) এবং মুঘল (ভারত) সাম্রাজ্যের অধীন বসবাস করত। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান ইস্তান্বুলের সুলতানকে খলিফা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। সুলতান পবিত্র শহর মক্কা ও মদিনার তত্ত্বাবধায়ক হন। ইস্তান্বুল বিশ্বের নতুন কেন্দ্র হয়ে ওঠে। আরবদের সিংহভাগই সুলতানের প্রজা হয়ে ওঠে। আরবি ঐশ্বরিক ভাষা হিসেবে থেকে যায়। তুর্কি দরবারি ভাষা হয়ে ওঠে। শাসক পরিবার এবং প্রশাসনিক এবং সামরিক অভিজাতরা সমগ্র সাম্রাজ্যে তুর্কি ভাষার ব্যবহার করে। তবে বেশিরভাগ ধর্মীয়, বৈজ্ঞানিক, সাহিত্যিক এবং আইনি শব্দভান্ডারে ফারসি এবং আরবি ভাষার আমদানি ঘটে। তুর্কিদের মূল অবদান ছিল কবিতা, রাষ্ট্রশিল্প ও স্থাপত্যে।

পাঁচশ বছর স্থায়ী অটোমান সাম্রাজ্য অনেক স্তরে একটি অসাধারণ উদ্যোগ ছিল। এটি একটি বহু-ধর্মীয় রাষ্ট্র ছিল যেখানে খ্রিষ্টান ও ইহুদিদের অধিকার স্বীকৃত এবং সুরক্ষিত ছিল। স্পেন ও পর্তুগাল থেকে বিতাড়িত অনেক ইহুদিকে উসমানীয় ভূমিতে আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল এবং অদ্ভুত পরিহাস, এভাবেই একটি বিশাল সংখ্যক মানুষ আরব বিশ্বে ফিরে এসেছিল। তারা কেবল ইস্তান্বুলে স্থায়ী হয়নি; বাগদাদ, কায়রো ও দামেস্ক সাম্রাজ্যের সেবক হওয়ার সুযোগ লাভ করে।

পাঁচশ বছর স্থায়ী অটোমান সাম্রাজ্য অনেক স্তরে একটি অসাধারণ উদ্যোগ ছিল। এটি একটি বহু-ধর্মীয় রাষ্ট্র ছিল যেখানে খ্রিষ্টান ও ইহুদিদের অধিকার স্বীকৃত এবং সুরক্ষিত ছিল। স্পেন ও পর্তুগাল থেকে বিতাড়িত অনেক ইহুদিকে উসমানীয় ভূমিতে আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল

ইহুদিরাই একমাত্র বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত উদ্বাস্তু ছিল না; সংস্কারের যুদ্ধের সময় ক্যাথলিক প্রতিশোধ-স্কোয়াড থেকে পালিয়ে আসা জার্মান, ফরাসি এবং চেক প্রোটেস্ট্যান্টরাও অটোমান সুলতানদের কাছে সুরক্ষা পেয়েছিল। পরবর্তী ক্ষেত্রে একটি অতিরিক্ত রাজনৈতিক উদ্দেশ্য দেখা যায়। উসমানীয় রাষ্ট্র ইউরোপের বাকি অংশের উন্নয়ন নিবিড়ভাবে অনুসরণ করে এবং কয়েকটি প্রধান ইউরোপীয় শক্তির সঙ্গে কূটনৈতিক, বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক জোটের মাধ্যমে জোরালোভাবে তার স্বার্থ রক্ষা করে। অবশ্য পোপকে একজন নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক হিসেবে গণ্য করা হয়নি এবং ক্যাথলিক ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকে সদয়ভাবে দেখা হয়েছিল।

উসমানীয় সুলতান পালাক্রমে ইউরোপীয় লোককাহিনিতে একটি প্রধান চরিত্র হয়ে ওঠেন। প্রায়ই তাঁকে দানবীয় এবং অশ্লীলভাবে উপস্থিত করলেও তিনি তার নিজের ভৌগোলিক এবং ঐতিহাসিক অবস্থান সম্পর্কে সবসময় সচেতন ছিলেন। ফরাসি রাজার কাছে সুলেমান দ্য ম্যাগনিফিসেন্টের এই বিনয়ী পত্রে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি ১৫২০ থেকে ১৫৬৬ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন। চিঠিতে লেখা ছিল:

আমি, যিনি সুলতানদের সুলতান, সার্বভৌমদের সার্বভৌম, পৃথিবীর মুখে রাজাদের মুকুট বিতরণকারী, পৃথিবীতে ঈশ্বরের ছায়া, শ্বেত সাগর এবং কৃষ্ণ সাগরের সুলতান এবং সার্বভৌম প্রভু, রুমেলিয়ার এবং আনাতোলিয়ার, কারামানিয়ার, রুম দেশের, জুলকাদ্রিয়ার, দিয়ারবেকিরের, কুর্দিস্তানের, আজারবাইজানের, পারস্যের, দামেস্কের, আলেপ্পোর, কায়রোর, মক্কার, মদিনার, জেরুজালেমের, সমস্ত আরবের, ইয়েমেন এবং আরও অনেক দেশ যা আমার সম্ভ্রান্ত পূর্বপুরুষ এবং আমার গৌরবময় পূর্বপুরুষেরা (আল্লাহ তাদের সমাধিগুলোকে আলোকিত করুন!) তাদের অস্ত্রের জোরে জয় করেছিলেন এবং যেগুলোকে আমার পবিত্র মহাশক্তি আমার জ্বলন্ত তলোয়ার এবং আমার বিজয়ী ফলকের অধীন করেছেন। আমি, সুলতান বায়েজিদের ছেলে সুলান সেলিমের ছেলে সুলতান সুলেমান খান। তোমার প্রতি, যিনি ফ্রান্সিস, ফ্রান্সের ভূমির রাজা।

ইসলামের মধ্যে বিধর্মী হিসেবে ইহুদি এবং প্রোটেস্ট্যান্টদের তুলনায় ইসলামের বিদ্রোহীদের প্রতি খুব কমই সহনশীলতা দেখানো হতো। সাম্রাজ্যের মোল্লারা নৃশংস এবং দ্রুত শাস্তি নিশ্চিত করত। কাজি সুলতানকে সতর্ক করে বলেছিলেন, ‘মার্টিন লুথারকে মনে রেখো।’ তারা খ্রিষ্টধর্মের সংস্কারকে সমর্থন করার পক্ষে ছিল। কেননা, এটি খ্রিষ্টানদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করে। কিন্তু একজন মুসলিম লুথারের ধারণা তাদের কাছে অগ্রহণযোগ্য ছিল। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের দৃষ্টিকোণ থেকে, অটোমানরা তাদের ধর্মের ঐতিহ্য রক্ষা করেছিল, এর সীমানা প্রসারিত করেছিল এবং আরব প্রাচ্যে একটি নতুন সর্বজনীন সংশ্লেষণ তৈরি করেছিল: একটি অটোমান আরব সংস্কৃতি যা একটি রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে সমগ্র অঞ্চলকে একত্রিত করেছিল। এমনকি যেখানে উসমানীয় শাসনকর্তারা ক্ষমতা দখল করেছিল, যেমন মিশরে আলবেনিয়ান বংশোদ্ভূত মোহাম্মদ আলীর ক্ষেত্রে, একটি সাধারণ প্রশাসন ও আর্থিক ব্যবস্থার নেতৃত্বে রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামো অপরিবর্তিত ছিল।

কিন্তু কী ছিল এই রাষ্ট্র? ত্রুটি সত্ত্বেও, কীভাবে রাষ্ট্রটি এত দীর্ঘ সময়ের জন্য পতন থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছিল? তিনটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য অটোমানকে এবং বিভিন্ন মাত্রায়, সেই সময়ের অন্যান্য মুসলিম সাম্রাজ্যকে চিহ্নিত করে: গ্রামাঞ্চলে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অনুপস্থিতি, যেখানে কৃষকের মালিকানা ছিল না এবং মালিক (অর্থাৎ রাষ্ট্র) নিজে চাষ করেনি; প্রশাসনের কেন্দ্রগুলোতে শক্তিশালী অ-বংশানুক্রমিক আমলাতান্ত্রিক অভিজাতদের অস্তিত্ব; এবং দাসদের একটি অংশসহ একটি পেশাদার প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী। ইউরোপের প্রথম সিভিল সার্ভিস একাডেমি অটোমানদের দ্বারা তৈরি করা হয়েছিল। তারা গোত্রীয় অভিজাততন্ত্র বিলুপ্ত করেছিল, জমিদারী সম্পত্তির মালিকানা নিষিদ্ধ করেছিল। এবং এই পদ্ধতিতে, তারা নিজেদের সাম্রাজ্যের একমাত্র রাজবংশ এবং আধা ঐশ্বরিক ক্ষমতার একমাত্র ভান্ডার হিসেবে সংরক্ষণ করেছিল। তাত্ত্বিকভাবে এটা থাকলেও বাস্তবে অনেক দক্ষ আমলা নানা উপায়ে নিয়মকানুন কিছুটা লঙ্ঘন করতে পেরেছিল, কিন্তু মৌলিক কাঠামোকে কখনো চ্যালেঞ্জ করা যায়নি। রাজবংশের প্রতি হুমকির মোকাবিলায়, অটোমানরা সমগ্র সাম্রাজ্য থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত একটি সিভিল সার্ভিস ক্যাডার তৈরি করেছিল। ‘দেভশারম’ ব্যবস্থায় বলকান এবং অন্যত্র স্থানের খ্রিষ্টান পরিবার থেকে পুত্রসন্তানদের জোরপূর্বক অটোমান রাষ্ট্রের সম্পত্তি বানানো হয়। একাডেমিতে সৈনিক বা আমলা হিসেবে প্রশিক্ষণের জন্য যথেষ্ট বয়স পর্যন্ত আশ্রয়, খাদ্য দেওয়া হয়েছিল এবং শিক্ষিত করা হয়েছিল। এভাবে সার্কাসিয়ান, আলবেনিয়ান, স্লাভ, গ্রিক, আর্মেনিয়ান এবং এমনকি ইতালীয়রাও প্রায়ই সাম্রাজ্যের সর্বোচ্চ পদ দখল করতে পেরেছিল।[4]

তিনটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য অটোমানকে এবং বিভিন্ন মাত্রায়, সেই সময়ের অন্যান্য মুসলিম সাম্রাজ্যকে চিহ্নিত করে: গ্রামাঞ্চলে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অনুপস্থিতি, যেখানে কৃষকের মালিকানা ছিল না এবং মালিক (অর্থাৎ রাষ্ট্র) নিজে চাষ করেনি; প্রশাসনের কেন্দ্রগুলোতে শক্তিশালী অ-বংশানুক্রমিক আমলাতান্ত্রিক অভিজাতদের অস্তিত্ব; এবং দাসদের একটি অংশসহ একটি পেশাদার প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী।

লাঙলের ফলার প্রতি ঐতিহ্যবাহী ইসলাম-যাযাবরদের বিদ্বেষ নিঃসন্দেহে বিশ্বের বৃহৎ এলাকা শাসনকারী রাজবংশের শহুরে পক্ষপাতকে নির্ধারণ করেছিল। কিন্তু মুসলিম রাজত্বের মধ্যে ভূমি সম্পত্তির অনুপস্থিতিও এর কতটুকু কারণ ছিল? এটি কি কেবল স্থানীয় অবস্থার ফলাফল ছিল? ইতিহাস অন্যরকম কথা বলবে। বর্তমান প্রচলন অনুযায়ী ব্যক্তি-আখ্যান এবং জাতীয় নির্দিষ্টতার বিষয় থাকা সত্ত্বেও, এই সত্যটি রয়ে গেছে যে খুব ভিন্ন স্থানীয় পরিস্থিতিতে, কর্ডোবা, বাগদাদ, কায়রো ও ইস্তান্বুলের খিলাফত এবং পরবর্তী সময়ে ভারতে মুঘল সাম্রাজ্য, জমিদারি ব্যবস্থা বা কৃষক-মালিকানা বা গ্রাম যোগাযোগের পক্ষে ছিল না। এর কোনো একটি পুঁজি গঠনে সহায়তা করেছে, যা পরবর্তী সময়ে সম্ভবত শিল্পায়নে অবদান রেখেছে।

জমিতে কাজ করা নিষিদ্ধ ছিল না‒সেটা প্রমাণ করতে ব্যক্তি-আখ্যানের অনুসন্ধানের মধ্য দিয়ে কেউ স্পেনে আরবদের দ্বারা নিযুক্ত কৃষি কৌশলের সমৃদ্ধি আবিষ্কার করতে পারে। কিন্তু স্প্যানিশ উদাহরণটি সাধারণত শহরগুলোর আশপাশের জমিতে সীমাবদ্ধ। সেখানে অনেক চাষাবাদ হতো। কিন্তু তা শহরবাসীর কর্তৃত্বে পরিচালিত হতো। গ্রামাঞ্চলের জমিগুলো রাষ্ট্র থেকে মধ্যস্বত্বভোগীরা ভাড়া নিয়ে জমিতে কাজ করার জন্য কৃষকদের নিয়োগ করতো। এর মধ্য দিয়ে মধ্যস্বত্বভোগীদের কেউ কেউ অনেক ধনী হয়েছিল, কিন্তু তারা শহরে বাস করতো এবং সেখানেই এই উদ্বৃত্ত ব্যয় করা হচ্ছিল। অশান্ত সামরিক গোষ্ঠী এবং গ্রামাঞ্চলের সামাজিক অধীনতার সমন্বয়ের  ওপর নির্ভরশীল অনমনীয় রাজবংশীয় রাজনৈতিক কাঠামো পশ্চিম ইউরোপের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করতে পারেনি।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত অটোমানদের কোনোভাবে টিকে থাকার প্রধান কারণ হলো যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য, জারবাদী রাশিয়া এবং অস্ট্রো-হ্যাবসবার্গস‒এই তিনটি অশুভ শক্তি শিকারির মতো তাদের দিকে নজর রাখলেও লুন্ঠনের ভাগাভাগিতে তারা একমত হতে পারেনি। তাই সাম্রাজ্যকে হাঁটু গেড়ে রাখাই তাদের জন্য একমাত্র সমাধান ছিল। একসময় যা একটি বহুজাতিক সাম্রাজ্যের মডেল ছিল তার দীর্ঘায়িত মৃত্যু-যন্ত্রণা অনিশ্চিত তুর্কি জাতীয়তাবাদকে উৎসাহিত করেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় কয়েক লাখ আর্মেনিয়ানকে হত্যা এবং তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার মাধ্যমে সবচেয়ে খারাপ নৃশংসতা সংঘটিত হয়েছিল। তবে প্রক্রিয়াটি অনেক আগেই শুরু হয়েছিল।[5]

ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকেই এর সমাপ্তি দৃশ্যমান ছিল। আঠারো শতকের গোড়ার দিকে উসমানীয় ভূখণ্ডের কেন্দ্র এবং তার চারপাশে উগ্র জাতীয়তাবাদী আবেগের বিকাশ শুরু হয়েছিল। ফরাসি বিপ্লব এবং কোঁতে দ্বারা প্রভাবিত আধুনিকতাবাদী তুর্কি অফিসাররা ইস্তান্বুলের শাসনের বিরুদ্ধে তৎপরতা শুরু করে। একই সঙ্গে আরব উপদ্বীপে ইবনে ওয়াহাব নামক একজন গোঁড়া ধর্মপ্রচারকের শিক্ষা বিপরীতমুখী প্রভাব ফেলছিল।

আগের পর্ব: মৌলবাদের সংঘর্ষ: ক্রুসেড, জিহাদ এবং আধুনিকতা-১

পরের পর্ব: মৌলবাদের সংঘর্ষ: ক্রুসেড, জিহাদ এবং আধুনিকতা-৩

টীকা:

[1]‘উর্বর ক্রিসেন্ট’ হিসেবেও পরিচিত এই অঞ্চল, যা বর্তমানে ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, ফিলিস্তিন, ইসরায়েল, জর্ডান ও উত্তর মিশর, কুয়েতের উত্তরাঞ্চল, তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল এবং পশ্চিম অংশ নিয়ে বিস্তৃত। ইরানের কিছু অংশ এবং কিছু লেখকের মতে সাইপ্রাসও এ অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত।

[2]বিকৃত নামে আজ তা জিব্রাল্টার হিসেবে টিকে আছে। স্প্যানিশ ইতিহাস রচনায় কাউন্ট জুলিয়ানের ভূমিকা একটি বড় বিতর্কের বিষয়। স্প্যানিশ ঔপন্যাসিক জুয়ান গয়েটিসোলো অবশ্য জুলিয়ানকে তার নাম বহনকারী উপন্যাসে একজন সম্মানিত স্প্যানিয়ার্ডের মডেল হিসেবে বিবেচনা করেন।

[3]জাতিগত নির্মূল প্রক্রিয়ায়, প্রকৃতপক্ষে, ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি ভেঙে দেওয়া হয়। যেহেতু স্নান ইসলামের সঙ্গে যুক্ত ছিল এবং আকর্ষণের ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল, স্পেনের ক্যাথলিক নেতারা তা ধ্বংসের নির্দেশ দিয়েছিলেন। যেহেতু অনেক মুসলমানকে ধর্মান্তরিত করতে বা বহিষ্কার করতে বাধ্য করা হয়েছিল, তাই ধর্মান্তরিতরা গোসল বা অজু করছিল কিনা, সরকারি গুপ্তচররা তার ওপর তীক্ষ্ণ নজর রেখেছিল।

[4]এরকম একটি চিত্র ইভো এন্ড্রির অটোমানবিরোধী সেরা গ্রন্থ, ‘দ্য ব্রিজ অন দ্য ড্রামা’কে অনুপ্রাণিত করেছিল। উসমানীয় সাম্রাজ্যে গ্রিক একীভূত হওয়ার একটি উদাহরণ পাওয়া যায় অটোমানদের পক্ষে আলজেরিয়া বিজয়ী গ্রিক বংশোদ্ভূত অ্যাডমিরাল খাইরেদ্দিন বারবারোসার মহাকাব্যিক ব্যক্তিত্ব থেকে। তার শোষণের গল্প ‘রেড বিয়ার্ড পাইরেট’-এর সংস্করণকে অনুপ্রাণিত করেছে।

[5]তুর্কি ঔপন্যাসিক ইয়াশার কামাল বেশ কয়েকটি উপন্যাসে সামাজিক অবক্ষয় এবং হুমকিময় বৈশ্বিক নৈরাজ্যকে চিত্রিত করেছেন। পুঁজিবাদের উত্থান কেন মুসলিম ভূমিতে না হয়ে পশ্চিম ইউরোপে হয়েছে, তার সবচেয়ে অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ ব্যাখ্যাগুলোর অন্যতম হলো পেরি অ্যান্ডারসনের ‘প্যাসেজেস ফ্রম অ্যান্টিকুইটি টু ফিউডালিজম অ্যান্ড লাইনেজ অব দ্য অ্যাবসলুটিস্ট স্টেট’।

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •