প্রদোষকালের “বেলা”, প্রান্তিক বসু আর “ছৌ”

সিনেমা

প্রদোষকালের “বেলা”, প্রান্তিক বসু আর “ছৌ”

মুহম্মদ আনোয়ার হোসেন

আমি সুন্দর কিছু ভাগাভাগি করার ইচ্ছা থেকে সিনেমা বানাই, এমন বিষয় যা শুধু ছবি তোলা বা কথায় বলা যায় না। (বার্লিনালে প্রতিভা – ২০২২, প্রান্তিকের/বসুর পাতা।)- প্রান্তিক বসু/ প্রান্তিক নারায়ণ বসু।

সিনেমা সম্বন্ধীয় তথ্য

বেলা (২০২১) | ৫৮ মিনিট | ২০২১ | বাংলা | ভারত।

নির্মাণঃ প্রান্তিক নারায়ণ বসু। শ্রেষ্ঠাংশেঃ মানভূম শ্রমজীবী ছৌ নৃত্যদল ও অন্যান্য। চিত্রায়নঃ রিজু দাস, প্রান্তিক নারায়ণ বসু। শব্দঃ আনন্দ গুপ্ত। প্রযোজনাঃ অঞ্জলি মন্তেইরো, কে.পি. জয়শঙ্কর।

ভূমিকা

প্রতিষ্ঠিত মূল্যবোধ, জনপ্রিয় দৃষ্টিভঙ্গি, জীবনযাপন, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ব্যাপক শক্তিশালী প্রভাব বিস্তারকারি। আমাদের সিদ্ধান্ত, মূল্যবোধ, ভাবনা, নৈতিকতা, হ্যাঁ, না ইত্যাদি নির্ধারিত হয়, প্রতিষ্ঠিত জনপ্রিয় সংস্কৃতি দিয়ে। প্রায়শ আমরা না দেখে বা নিজের মতামত বা জীবনযাপনের চেষ্টা না করে, নিজেরা জেনে বা না জেনে প্রচলিত জীবনযাপন এবং মূল্যবোধের সাথে তাল মিলিয়ে স্বস্তি বোধ করি, শান্তি খুঁজি। প্রথাগত জীবনযাপনের ফলে জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে পরিবেশ ও প্রাণের বিনাশে অংশগ্রহণ করি। আমাদের থেকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল ও ক্ষমতাহীনদের প্রতি আমাদের কোনোপ্রকার সংবেদনশীলতা কাজ করেনা, তত্ত্বীয় এবং ব্যাবহারিক উভয় অর্থে। পর্যায়ক্রমে অন্যসব প্রজাতিকে ধ্বংস করে, সস্তা শ্রমের জন্য, বড় বাজারের জন্য, শোষণ করার স্বার্থে মানুষকেন্দ্রিকতা, প্রজনন প্রবৃত্তি এবং পুনরুৎপাদন প্রবণতা ভয়াবহ হারে বাড়ছে এবং বাড়ানো হচ্ছে। এসবের ফলশ্রুতি,পরিবেশ বিনাশ। যার ভয়াবহতা উপলদ্ধি করার ইচ্ছা, বোধ, সমকালীন অধিকাংশ মানুষ হারিয়ে ফেলেছে। পৃথিবীর আবহাওয়া বা অন্যান্য প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলো এখন আর প্রকৃতির উপরে নির্ভর করে বদলায়না, এর প্রধানতম বদলের নিয়ামক “মানুষ”!! “প্রকৃতি” নিজে নয়!? এ ভয়াবহতা উপলদ্ধি করার কেউ নেই!

পরিবেশ বিষয়ক এসব তথ্য আর ভাবনা আলোচিত হয়েছে, জেনিফার বেইকওয়াল, নিকোলাস ডি পেনসিয়ার ও এডওয়ার্ড বার্টিনস্কির পরিবেশ বিষয়ক সিনেমা ত্রয়ী, “প্রক্রিয়াজাত ভূদৃশ্য”(২০০৬), “জলছাপ” (২০১৩) আর “পরিবেশ পরিবর্তন অধ্যায়ঃমানবযুগ” (২০১৮) সিনেমায়। (পড়তে পারেন সর্বজনকথায় উল্লেখকৃত সিনেমাত্রয়ী নিয়ে “মহাপ্রয়াণের বয়ানঃপরিবেশ বিষয়ক এক সিনেমা ত্রয়ীর পর্যালোচনা”)। মানুষের ভাবনা, কাজে এসব কোনো “মূল্যবান” বা “ক্রিয়াশীল” বিষয় নয়, মানুষ যে কোনো মূল্যে “সফল” হতে চায়। পৃথিবী ধ্বংস করে মঙ্গলে যাবার স্বপ্নে বিভোর। মানবসৃষ্ট দূষণের ফলে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে বা যাচ্ছে!? প্রতিদিন মানবসৃষ্ট কারণে নানান প্রজাতি বিলুপ্ত হচ্ছে চিরতরে! কিন্তু জনপ্রিয় মত, নৈতিকতা, প্রতিষ্ঠিত পরিবার কাঠামো, অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিনাশ আমরা বোধহয় ভাবতে পারিনা বা চাইনা। সব কিছু ধ্বংস করে, এমনকি নিজেদেরকেও!?

মানুষের তৈরি পুঁজিবাদ এখন নিজে মানুষের চেয়ে ক্ষমতাবান, মানুষ ধ্বংস করে, পুঁজি কেন্দ্রিভুতকরণে তার দ্বিধা নেই, শক্তিশালী বাধা নেই। অধিকাংশ মানুষ এখন পুঁজির দাস, কেউ শারীরিকভাবে, কেউ মানসিকভাবে আবার কেউ হতে বাধ্য হচ্ছে। কারো নাম “শিল্পপতি” “শিল্পী” “চাকুরিজীবী” “রাজনীতিবিদ” “বুদ্ধিজীবী” “উদ্যোক্তা” “ব্যাবসায়ি”বা কেউ ক্ষমতাহীন “অপর” । পুঁজিকেন্দ্রিক ক্ষমতা-দর্শনের, যাপনের বাইরের প্রান্তিক মানুষদের “আদিবাসী”, “উপজাতি”, “ট্রাইবাল” বা ঢাকার বর্তমান সরকারের চালু করা “ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী” কারো মতে “ইন্ডিজেনাস পিপল”, “সুবিধাবঞ্চিত” ইত্যাদি ইত্যাদি যেভাবেই উপস্থাপন করি, তাদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি কিন্তু প্রায়শ, লাউ-কদুর মত, একইরকম। পার্থক্যশব্দে, বস্তুতে-ভাবনাতে বা ব্যবহারিক চর্চায় নেই। এদের “যাপন” “দর্শন” অর্থনৈতিকভাবে ক্ষমতাবানদের নিকট অপ্রয়োজনীয়, বর্জনীয়। অর্থনৈতিকভাবে যে কাঠামো, যাপন, নৈতিকতা লাভজনক নয় সে ভাব, চর্চার অবাধ বিকৃত ব্যাখ্যা, উপস্থাপন, অবজ্ঞা, আক্রমণ, দখলের মাধ্যমে বিনাশের প্রবণতা, নিষ্ঠুরতা ক্রমবর্ধমান আর প্রশ্নহীন।

“বেলা” প্রচলিত গতানুগতিকতা এড়িয়ে ছৌ পরিবেশনার ভিতর দিয়ে অজনপ্রিয়, “অনৈতিক” “অসফল”“বাতিল” অপর ভাবনাদের প্রকাশ করে ধ্যানমগ্ন সুরে। রাজনীতি, যৌনতাকেন্দ্রিক ভূমিকা এবং “দিন-রাত” “নারী-পুরুষ” ভাবনার সীমাবদ্ধতা পার হয়ে যেখানে এসব “বিচার-বিবেচনা” “নৈতিকতা-অনৈতিকতা” “সফলতা-বিফলতা” মিশে যায়, সে মুক্তাঞ্চলের জীবন পরিবেশন করে। “বেলা” পশ্চিম বাংলার পুরুলিয়ার একটা গ্রাম, সেখানকার “কুর্মি মাহাতো” মানুষদের নিয়ে প্রান্তিক বসু’র নির্মাণ “বেলা” (২০২১)। বার্লিনালে দেয়া সাক্ষাৎকারে প্রান্তিক বেলা’র মানুষদের “কুর্মি এবং মাহাতো” বলে উল্লেখ করেছেন আর উইকিপিডিয়ার ইংরেজি সংস্করণে উল্লেখ আছে “কুর্মি মাহাতো” আর একই পাতা বাংলায় শুধু “মাহাতো” উল্লেখ করা হয়েছে। অধিকাংশ আলোচনায় প্রান্তিকের সিনেমাত্রয়ীকে (সখিসোনা, রঙ মহল, বেলা), অভিহিত করা হয়েছে সাঁওতাল যাপন হিসেবে। কুর্মি এবং মাহাতো এসব জাতিগত বৈচিত্র্য উল্লেখিত হয়নি। তো ছৌ নাচ বা ছৌ পরিবেশনা নিয়ে “বেলা”। প্রধানত এসব মানুষেরভাব, দর্শন, শিল্পের অন্যতম প্রকাশ “ছৌ” যা বিশেষত পুরুষেরাই পরিবেশন করেন। তাদের নিয়ে প্রান্তিক নারায়ণ বসুর প্রায় এক ঘণ্টার কবিতাময় মগ্ন চলচ্চিত্র “বেলা” ।

ছৌ, বাংলা সিনেমা, ঋত্বিক, মহাশ্বেতা আর বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত

ফুল গাছটি লাগইছিলাম

ধুলা মাটি দিয়া রে

সেই ফুল ফুটিয়া রইলো

অগম দৈরার মাজারে।।

গাছে আইলো বড় আম

ছয় আনা সাত আনা দাম

বড় আম বড় মিঠা লাগেরে

বাঁকুড়া বাজারে লাজ লাগে রে ।।

আম গাছে আম নাই

কুটা কেন লাড়ো রে

তোমার দেশে আমি নাই

আঁখি কেন ঠাররে রে ।।

কদম তলায় মোহন চূড়া

দাঁড়ায় আছে নবীন ছুড়া

ওরে ছুড়া মোদের পাড়ায় যাবি লো

গাঁথে দেবো বিনি সুতার মালা ।।

চড়পে চড়পে যাবো

বাছেবাছে টোপা লেব

সেই টুপায় চালভাজা খাবোরে

সফল জনম আর কি পাবো ।।

-উত্তরা (২০০০) সিনেমায় ব্যবহৃত গান।

প্রচলিত নৈতিকতা, পুঁজিকেন্দ্রিক মানব সমাজে “সফল জনম” সহজ বা কাঙ্ক্ষিত কিছু নয়। মানুষ এখন আর চিন্তা করেনা কী “ভালো” বা “খারাপ” আর “আদর্শ” “নীতি” শব্দেরা ধীরে ধীরে আমাদের ব্যবহার্য তালিকা থেকে মুছে যাচ্ছে, এখন আর “সফল জনম” নিয়ে কেউ চিন্তা করেনা, যে কোনো ধরনের/ যে কোনোভাবে “অর্থকেন্দ্রিক” সফলতা দরকার। কিন্তু প্রচলিত, জনপ্রিয়, গতানুগতিক বহুল চর্চিত এ পথের বাইরে কেউ কেউ যেতে চায়, ঝুঁকি, বিপদের কথা জেনে, বুঝে, তবে সংখ্যায় বা পরিমাণে নগন্য। আমাদের চারপাশে প্রচলিত যৌনতা-প্রেম-পরকিয়া-পরিবার, বিশ্বাস-অবিশ্বাস, ভাল-খারাপ, পছন্দ-অপছন্দ, সন্তান-সংসার-সম্পর্ক, বন্ধুত্বের ফলে পৃথিবীর বিপন্নতা, প্রাণের বিনাশ কেউ দেখে, কারো ভিতরে ক্ষরণ হয়। কেউ এসবের পরিবর্তন চায়, নিজেকে অসফল ও বিপন্ন করে!

মহাশ্বেতা দেবীর বইগুলোর কথা বলা যায়, “অগ্নিগর্ভ” (১৯৭৮), “অরণ্যের অধিকার” (১৯৭৯), “চোট্টি মুন্ডা এবং তার তীর” (১৯৮০) সহ অনেক অনেক চরিত্র, ভাব। ঋত্বিক ঘটকের সিনেমার আদিবাসী গ্রাম, গল্প, ছৌ, আর জঙ্গল নির্ভর জীবনের আভা। এসবের সাথে আরো জড়িয়ে রয়েছে হালের প্রয়াত নির্মাতা বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের “বাঘবাহাদুর” (১৯৮৯), “উত্তরা” (২০০০), “চরাচর” (১৯৯৪) এর গল্প, আবহ, স্থান আর চরিত্রেরা। আমার কাছে মনে হয়েছে বাঙালি নির্মাতাদের ভিতরে উনি প্রান্তিক ভাব, ভাবনা, রাজনীতি, যাপন, স্বপ্ন, ইচ্ছেপূরণ এসব বিষয় নিয়ে ভালো পরিমাণের এক সিনেমার পৃথিবী রচনা করেছেন। যেখানে, শব্দ, সিনেমা, সাহিত্য, রাজনীতি, সময়ের বদলসহ, আরো সব বিষয়েরা রয়েছে খুব কাব্যিকভাবে। বা পবন দাস বাউলের গান, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, সতীনাথ ভাদুড়ী’র “রাঢ় বাংলা”, এসব মিলিয়ে বাঁকুড়া, বীরভূম, বর্ধমান, মেদিনীপুর, পুরুলিয়া ধীরে ধীরে তার নানান চরিত্র নিয়ে মনে জায়গা জুড়ে ধীরে স্মৃতির অংশ হয়ে যাচ্ছিল। পাশাপাশি সত্যজিৎ রায়ের “অরণ্যের দিনরাত্রি” (১৯৭০) বা “আগুন্তুক” (১৯৯১) কৌতূহল তৈরি করেছে, কিন্তু উপস্থাপন, দৃষ্টিভঙ্গি অনেকাংশে সমস্যাক্রান্ত, সীমাবদ্ধ।

এসব নানান বিষয় মিলে পশ্চিম বাংলার আদিবাসী প্রধান, সভ্যতা-দূষণ থেকে দূরের এ জায়গাগুলো সব সময় কৌতূহল আর আগ্রহের বিষয় হিসেবে ছিল। বাংলা সিনেমা আর সাহিত্য, সংস্কৃতির ভিতর দিয়ে, তাই প্রান্তিক বসুর “হাওয়া মহল” (২০১৫), “সখিসোনা” (২০১৭), “রঙ মহল” (২০১৯) এবং “বেলা” (২০২১) সহজেই কৌতূহল তৈরি করে, আকৃষ্ট করে ।

“চরৈবেতি” বা যাত্রা চালিয়ে যাওয়ার দর্শন “বেলা”

সাম্প্রতিক বছর পর্যন্ত, ভারতের সাঁওতাল আদিবাসীদের নিজস্ব লিখিত ভাষা ছিল না। তাদের গল্প এবং পৌরাণিক কাহিনী সংরক্ষিত ছিল এবং প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মৌখিকভাবে প্রবাহমান ছিল। প্রতিটি বর্ণনার একেক ভিন্ন রূপ রয়েছে, অনেকটা কাছাকাছি পাহাড়ের পাথরের মতো যা বিভিন্ন বর্ণে ধরা দেয়।

প্রান্তিক নারায়ণ বসু (৩ মে, ২০২১, দেসিস্তফিল্ম এর খবরে ব্যবহৃত উদ্ধৃতি) ।

“আদিবাসী” সম্পর্কিত সিনেমায়, আলাপে, খবরে, গবেষণায়, ছবিতে কী কী থাকবে? অঢেল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সুন্দর নারী, পুরুষ, বাচ্চা, বৃদ্ধের, বৃদ্ধার অগণিত মসলাদার শিল্পসম্মত সুন্দর উপস্থাপন, যা মানুষ প্রজনন কেন্দ্রিক দর্শন আর মনোভাবকে আরো চাঙ্গা করবে। খানিক বিরহে ভোগাবে, প্রকৃতি নিয়ে, জীবন নিয়ে সাময়িক ভাবালুতা তৈরি হবে। তারপর আবার পুনঃপ্রজনন আর পণ্যের পুনঃপৌনিক উৎপাদন ভিন্ন ভিন্ন নামে। বা নানাবিধ “সমস্যা-সমাধান” কেন্দ্র করে যেমন নারী অধিকার, ভূমি সমস্যা, জাতিগত অধিকার, পরিবেশ দূষণ ইত্যাদি। অথবা শহরের শরীর-মন-যাপন-শিক্ষা নিয়ে, বনে-জঙ্গলে বা প্রান্তিক কোনো গ্রামে কতটা “অরগানিক” “প্রাকৃতিক” জীবনযাপন, চাষবাস করে জীবন বদলে গিয়েছে, পরিবেশ বদলে গিয়েছে ধরনের প্রেরণামূলক পণ্য। কিন্তু ফলাফল সেই আগের মত, দূষণ, শোষণ, বিনাশ, প্রজনন, পুঁজির কেন্দ্রীভূতকরণ, অভিন্ন নৈতিকতার অভিন্ন ফলাফল। অর্থকেন্দ্রিক পণ্যের পুনঃউৎপাদন, মানুষকেন্দ্রিকতা আর প্রজনন কেন্দ্রিক পরিবার কাঠামো। শারীরিক বা মানসিকভাবে এর বাইরে কিছু নেই।

এসবের ফলে বনজীবী বা কৃষি নির্ভর প্রান্তিক মানুষ, প্রান্তিক ভাবনা, যাপন নিয়ে নিজের ভূমিতেই হয়ে পড়ে ভূমিহীন, ভূমিদাস, ক্ষমতাহীন অপর। পক্ষান্তরে ভূমি হয়ে যায় অর্থনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান মানুষের ভালোলাগা-খারাপলাগা, সফলতা-বিফলতা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পুঁজি উৎপাদনের ক্ষেত্র। সাথে নানান নামে, নানান ধাপে চলে মানুষ প্রজনন আর পুনঃউৎপাদনের দর্শন বিক্রয়। যেমন “চিরায়ত” “প্রাকৃতিক” বা “প্রকৃতির প্রয়োজনেই প্রকৃতির মানুষকে দরকার, মানুষ নিজেও প্রকৃতির অংশ” ইত্যাদি, ইত্যাদি সীমাবদ্ধ, সমস্যাক্রান্ত, বুদ্ধিহীন, আবেগহীন জড় চিন্তা-ভাবনা আর উপস্থাপনার ভিতর দিয়ে, পৌনঃপুনিক পুনরাবৃত্তি ।

বেলা এসব পুনরাবৃত্ত না করে ভিন্ন নির্মাণ, বিষয়, নির্বাচন, উপস্থাপন, বক্তব্য, দর্শন ভিন্নস্বরে পরিবেশন করতে চায়। “বেলা” শুরু হয় এক দিনের শেষে যখন আকাশ জুড়ে মেঘ, গম্ভীর ভারি মেঘের ডাক। নানা বয়সি বাচ্চারা খেলছে, দূরে বিষবাস্প আর দূষণের আধার কারখানা। সন্ধ্যার আঁধারে কয়েকজন তরুণ হেঁটে যাচ্ছে, তাদের কথোপকথনে শোনা যায় তারা নাচের মহড়া শুরু করে দেবে, যদিও কেউ কেউ আসেনি কিন্তু তারা ভাবছে নিশ্চয় বাজনার শব্দে তারা চলে আসবে, আর দরজা খোলা। যারা আসেনি তাদের প্রতি রয়েছে অভিমান, ভালবাসা এবং প্রতীক্ষা। মেঘের ডাক, বাজনার শব্দ আর খুব কম বৈদ্যুতিক আলোতে গাছতলায় নাচের মহড়া চলছে। যেন অতীত দিনের হ্যাজাকের আলোতে হচ্ছে মহড়া। খানিক স্বপ্ন আর কল্পনার মতন। আমরা নাচ দেখতে থাকি, নাচ শেষে ঝিঁ ঝিঁ পোকা আর মেঘেদের ডাকের ভিতর দিয়ে নাচিয়েরা বাড়ি ফিরতে থাকে বৈদ্যুতিক তারের লাইন গোছাতে গোছাতে, সাথে জ্বলতে থাকা আলো। আর বাড়ির নারীরা, জমির চালের গুড়ো থেকে বানানো মণ্ড গুলিয়ে তরল করে উঠান জুড়ে সুন্দর সুন্দর সব নানান আকৃতির দেখতে সমরূপ বিভিন্ন ছবিতে ভরিয়ে তুলছেন। সাদা চালের গুড়ার আঁকাআঁকির মাঝখানে ছোট করে সিঁদুরের ফোঁটা, একপাশে আঁকা চলছে আর আরেক পাশ দিয়ে গরু ছাগল দিন শেষে ঘরে ফিরছে, আঁকার মাঝেই কেউ হাঁটছে। একই সাথে চলছে নির্মাণ-বিনির্মাণ, তৈরি-ধ্বংস। আছে বিভিন্ন পর্ব-প্রথা পালনের অংশ হিসেবে প্রাণী হত্যা কিন্তু সে হত্যা কেউ তত্ত্ব দিয়ে মহান করছেনা বা দোষারোপ করছেনা। সহজ যাপনের অংশ। এবং বেলায় দেখানো ছৌ যা তাদের নিজেদের ভাব, যাপন, দর্শন, প্রকৃতির সাথে সম্পর্ক ইত্যাদির এক প্রকাশভঙ্গী। ছৌ নিয়ে প্রান্তিক জানান,

প্রশ্নঃ আপনি আমাদের ছৌ “উপস্থাপন/পরিবেশন(পারফর্ম)” সম্পর্কে বলবেন?

উত্তরঃ অন্যান্য সমস্ত নৃত্যের ঢংয়ের (ফর্মের) মতো, ছৌ-এর মধ্যে রয়েছে অসাধারণ শৃঙ্খলা, সমন্বয় এবং অনুশীলন। ব্যুৎপত্তিগতভাবে, ছৌ ছায়া শব্দ থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ ছায়া, চিত্র বা মুখোশ। কথিত আছে পুরুলিয়ায় (যেখানে বেলা অবস্থিত) প্রত্যেকটি ছেলেই ছৌশিল্পী, এবং তারা অল্প বয়সে পুকুরে সাঁতার কাটতে শেখার কারণে পানির নিচে হাত-পা ছোড়াছুড়ি করার কৌশল জানে। আর ছৌ নাচের সাথে যে গানগুলি হয় তাকে ঝুমুর বলা হয় এবং সেগুলি দোহার (যুগল) ঢং/ফর্ম অনুসরণ করে। এগুলি রাঢ় বাংলার প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং এর উদ্ভিদ ও প্রাণীজগতের সাথে জড়িত। উদাহরণস্বরূপ, ঝুমুর গানের পুনরাবৃত্ত পরিমাপ এখানের প্রতিধ্বনি থেকে অনুপ্রেরনায় সমৃদ্ধ যা এ ঢেউখেলানো ভূখণ্ডে ডাকার সময় হয়। এবং ছৌ নৃত্যে ঘাড় ও ধড়ের সূক্ষ্ম বাঁকময়ূরের গতিবিধির অনুকরণ। এই সূক্ষ্মতাগুলি সাধারণত দর্শক দ্বারা উপেক্ষিত হয় ফলত প্রায়শই হারিয়ে যায় পরিবেশনার মহিমা।

প্রশ্নঃ বেলা-র শেষ দিকে এমন একটা ধারণা আছে যে, এই জীবনযাত্রা নিরুদ্দেশের (হারিয়ে যাওয়ার/ মুছে যাওয়ার) হুমকিতে রয়েছে। এমনকি ছৌ পরিবেশনা শহরের ভিড়ের জন্য নির্ধারিত বলে মনে হচ্ছে।

উত্তরঃ তাদের জীবনযাত্রা একটা ধ্রুবক রূপান্তরের অধীনে, অনেকটা আমাদের চারপাশের সবকিছুর মতো, হয়তো একটু ধীর, কিন্তু এটি কি অনিবার্য নয় (বিদ্যমান নৈতিকতা, যৌনতা, জীবনযাপন, পরিবার কাঠামো বা অর্থনৈতিক ব্যাবস্থায়)? আমি যে অঞ্চলে রঙ মহলের শুটিং করেছি সেখানে এই পরিবর্তন সম্ভবত অনেক কম; সেখানে একটা নির্দিষ্ট কিন্তু স্বাগত প্রতিরোধ রয়েছে, যেমন পথলগাড়ি আন্দোলন (ভূমির প্রতি সার্বভৌম অধিকারসহ নানান দাবি জানানো হয়েছিল, পড়তে পারেন উইকিপিডিয়ার পাতা)। কিন্তু বেলার সম্প্রদায় দ্বারপ্রান্তে। অনেক ছৌ নৃত্যশিল্পী সারা দেশের শহরে চলে যান এবং (সস্তা) অভিবাসী বা পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন (করতে বাধ্য হন কারণ তাদের ভূমি রিসোর্ট, প্রাকৃতিক কৃষি, কারখানা, ইকো পার্ক নানাবিধ নামে বেদখল)। একটা দল যখন এফ.টি.আই.আই-তে একটি পরিবেশনার জন্য পুনেতে এসেছিল, তখন কাছাকাছি একটি নির্মাণ স্থাপনার দুই শ্রমিক ঢোল, ধামসা এবং শাহনাইয়ের শব্দ শুনতে পেয়ে সাথে সাথে ক্যাম্পাসে ছুটে আসেন, যেখানে পরিবেশনা হচ্ছিল। জানা গেল তারা পাশের গ্রামের (বাজনা শুনে চিনতে পেরে আনন্দে, উত্তেজনা ধরে না রাখতে পেরে ছুটে এসেছে)। বাড়ি থেকে এত দূরের একটা জায়গায় তাদের পুনর্মিলনের আনন্দ ছিল দেখার মতো।

প্রশ্নঃ সিনেমায়, আমরা পুরুষদের বেশিরভাগকেই ছৌ পরিবেশনায় নিযুক্ত দেখতে পাই যখন মহিলারা বাড়িতে এবং বাইরে উভয় ক্ষেত্রেই উত্পাদনশীল শ্রমের সাথে জড়িত। গ্রামের নারী-পুরুষ সম্পর্ককে কীভাবে দেখেন?

উত্তরঃ লিঙ্গ ভূমিকার ক্ষেত্রে এটি বেশ বিভক্ত ছিল। যদিও পুরুষরা তাদের কর্মক্ষমতার জন্য নারীদের সাজে, এবং মহিলারা তাদের দৈনন্দিন কাজকর্মে প্রচুর শারীরিক শক্তি প্রদর্শন করে (এখানে প্রচলিত নারী-পুরুষ ধারনা কাজ করেনা), অন্যথায় সীমানা বরং অনমনীয়। তাই ছৌ নাচের শারীরিক দৃঢ়তার জন্য পুরুষালি হওয়ার যুক্তিটি এক বিন্দু সত্য নাও হতে পারে (কারণ তারা শেষত পুরুষালী আচরণ থেকে মেয়েলী আচরণে রূপান্তরিত হন। ফলে এখানে ভিন্নতর এক মনোভাবনা, দৃষ্টিভঙ্গি কার্যকর যা প্রচলিত নারী-পুরুষ, পুরুষালী-মেয়েলী ধারনাকে, নৈতিকতাকে ভেংগে দেয়)। সাম্প্রতিক সময়ে, কয়েকটি মহিলা ছৌ নাচের দল গড়ে উঠেছে। কিন্তু তাদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি এবং আমাদের দেশের (ভারত) নারী ক্রীড়া দলের প্রতি (দৃষ্টিভঙ্গির মত) একই রকম।”- প্রান্তিক নারায়ণ বসুর সাক্ষাৎকার, ফার্স্টপোষ্ট, মে, ২০২১।*

এসব ভাবনার বিন্যাস বেলা’য় ছৌ আর নানান কাজকর্মের ভিতর দিয়ে পুরুলিয়ার মানুষদের জীবন, দর্শন, রাজনীতি, যৌনতা, নৈতিকতা, ভূমি সম্পর্কিত তাদের যাপন, শিল্প, উপস্থাপন এবং এ উৎপাদনের ধরন (মুড অফ প্রডাকশন) প্রকাশ করেন পর্যবেক্ষণমূলক দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে।

ধান পাকছে মাঠে, ধান কাটা হচ্ছে। নতুন ধান খানিক রেখে, মাড়িয়ে খড় আলাদা করে, সিদ্ধ করে বা না করে, শুকিয়ে (প্রয়োজন মত), ঢেঁকিতে ভেংগে চাল, তুস আর কুড়া আলাদা করা হবে। চাল সামনের দিনের খাবার, কিছু চাল পিঠা বা পার্বণের জন্য। এরকম কিছু চাল আবার ঢেঁকিতে গুড়ো করে বানানো হবে নানান পিঠা, ক্ষীর (কিছু কিছু ধানের জাত রয়েছে যা পিঠা বা ক্ষীর জাতীয় খাবারের জন্য বেশ জনপ্রিয়, বিখ্যাত, যেমন বাসমতি, গোবিন্দভোগ তবে সাধারণত যেকোনো সুগন্ধি চাল বা অগ্রায়ণের যেকোনো আতপ চালে ক্ষীর, পিঠা ভালো হয়। ঢাকা কেন্দ্রিক অঞ্চলে তুলসিমালা, বেগুনবিচি, কালোজিরা, বাঁশফুলসহ আরো নানান ধানের নানান চালের ক্ষীর, পিঠা জনপ্রিয়।)। আর কিছু চালের গুড়ো পানি মাখিয়ে সাদা তরল তৈরি করা হবে, উঠানে বা দেয়ালে ছবি আঁকার জন্য। বনের কাঠ কুঁড়িয়ে রান্না, হয়তো বা বিক্রি করে প্রয়োজনীয় কোনো সদাই। সংসারের নারীরা এসবে ব্যস্ত, পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে বিকট শব্দে বনের থেকে কাটা গাছের স্তূপ দিয়ে ভরা ট্রাক, আবার সভ্যতা। বনের মানুষ হয়ে ছৌ নাচ দলের পুরুষেরা, বনের গাছ কেটে পরিবারের অর্থনৈতিক চাকা সচল রাখেন, বাধ্য হন কারণ তাদের ভূমি, বন, নদী তাদের দখলে নেই। সভ্য মানুষের চাহিদা অনুযায়ী নানান ধরনের কাঁচামালের জোগান দিতে ব্যস্ত!

দিনের পর দিন মহড়া শেষে নাচিয়েরা যায় বড় সদরে নাচতে আরো ভিন্ন ভিন্ন দলের সাথে, আমরা দেখি সাধারণ মানুষগুলোই ধীরে ধীরে চোখের সামনে বদলে যেতে থাকে। পুরুষেরা কেউ কোনো পশু, কেউ নারী, কেউ ভিন্ন কিছু, চোখ মাতাল করিয়ে দেয়া রঙ আর নাচ। কিন্তু বসু চূড়ান্ত পরিবেশনা কম দেখান বরং কল্পনা করে নিতে আহ্বান জানান। মহড়া যতটুকু দেখি তার চেয়ে চূড়ান্ত পরিবেশনা দেখি অনেক কম, যেন চলাটাই প্রধান, আলাদা করে কোনো গন্তব্য নেই বা গন্তব্যের প্রয়োজন নেই । আমরা দেখি মানুষগুলো রাতে আবার সদর থেকে রাস্তা ধরে লরি করে ফিরছে, রাস্তা শেষ করে আবার জঙ্গলের ধুলা উড়িয়ে ছুটছে গাড়ি, গ্রামে পৌঁছানোর জন্য।

বেলায় প্রান্তিক নারায়ণ বসু কারো ব্যক্তি জীবন বা পরিবার বা পারিবারিক মূল্যবোধ দেখিয়ে “ইন্টেমেসির” পরাকাষ্ঠা দেখাননি যদিও তিনি তার নির্বাচিত “চরিত্র” ও “বিষয়ের” সাথে যথেষ্ট একাত্ম। সমস্যা-সমাধান-প্রেরণাদায়ক পণ্যের “হিরো”নন বরং তিনি ভিন্নভাবে এসব “দৃষ্টিভঙ্গিকে” প্রশ্নের সামনে দাঁড় করান। তিনি অন্তরঙ্গ হতে বলেন। বেলা’য় মানুষেরা গাছের মত সাবলীল আর মাছের মত দল বেঁধে আছে। “বেলা” শব্দের কিন্তু দুরকম ব্যবহার আছে, পুরুলিয়ার এক গ্রামের নাম থেকে এসেছে “বেলা” শব্দ । যেখানে সিনেমার অধিবাসীগণ বাস করেন। আবার ভিন্নদিকে “বেলা” মানে বাংলাতে “সময়”। প্রান্তিক সময়কে তার মতো করে ব্যবহার ও ব্যাখ্যার চেষ্টা করেছে “বেলা”য়। ফলে বেলার “নির্মিত সময়” ব্যবহৃত “বিষয়”, “সময়” সিনেমার ভাবনাকে ব্যবহার করে ব্যাকরণসম্মত পরিমিতিবোধ বজায় রেখে। সারা সিনেমা জুড়ে দারুণভাবে শব্দেরা কাব্যিকতার অংশ হয়ে ছবির সাথে মিশে এবং মেশার ভিতর দিয়ে নিজের স্বাতন্ত্র্যভাব বজায় রেখে পরিষ্কার পরিব্রাজনে মগ্ন। সমভাবে চিত্রায়ন, সম্পাদনা, চিত্রনাট্য, রঙ, প্রযোজনা, দারুণ সংমিশ্রণ, অনুমেয় কিন্তু কাঙ্ক্ষিত।

প্রান্তিক বসু এক সাক্ষাৎকারে জানান,

“আমি দিন-রাত, প্রকৃতি এবং নগরায়ন, মেয়েলি এবং পুরুষত্বের প্রান্তিকতা/মুছে যাওয়ার/প্রদোষকালের অভিজ্ঞতা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি।” “আকর্ষণীয় বিষয় হল, এ ভাবনা ফিকশন এবং নন-ফিকশনের চির-অস্পষ্ট লাইনে এসেছে। চূড়ান্ত ছবিতে আমরা যা দেখি, তার কিছুই তৈরিকৃত নয়; সময়ের সাথে সাথে ঘটে যাওয়া সমস্ত কার্যক্রম, মহড়া এবং প্রস্তুতির শুটিং করা হয়েছিল। পরে সম্পাদনা করার সময়ে কয়েক দিনের কাঠামো উঠে আসে এবং এভাবে চলচ্চিত্রের পুরো সময়ের নির্মাণকে কাল্পনিক করে তোলে। আমি বেলায় থাকার সময় যে সময় অনুভব করেছি তার প্রতি সত্য থাকার চেষ্টা করেছি, যা একই সাথে সুন্দর এবং বিরোধপূর্ণ ছিল।” “স্ক্রল. ইন” কে দেয়া প্রান্তিকের সাক্ষাৎকারের নির্বাচিত অংশ (এপ্রিল, ২০২১) ।**

 বেলায় পুরুষেরা ছৌ অনুশীলন করেন, মহিলারা উঠান জুড়ে ছবি আঁকেন, কাঠ জোগাড় করেন, ধান কাটেন। এসব স্মৃতির মতো করে ধারণকৃত। ফোনে এক পরিযায়ী শ্রমিক জানান তিনি বেলা থেকে অনেক দূরে থেকেও বেলাকে ভুলতে পারছেননা, কি করে ভুলবেন একসাথে ছৌ আর মহড়া, জঙ্গলে বেড়ানো। “প্রদোষকাল” সিনেমায় কবিতার মত করে আছে।  প্রথাগত “নারী-পুরুষ” নির্মাণ না করে প্রান্তিক নারী-পুরুষ ধারনা মিশে যায় যেখানে, সে মানবিক/প্রাণীজ রহস্যময় প্রদোষকালের দর্শন পরিবেশন করেন। “ধীর গতি সিনেমা” ধরনের নির্মাণ, দর্শনের ব্যবহার সিনেমার সম্মোহনী মাত্রাকে গভীরতর করে, ভাবনার, কল্পনার সুযোগ করে দেয়। “বেলা” বেলার স্থানীয় অভিজ্ঞতা, দর্শন, যাপন এক মগ্ন সংবেদনশীল যাত্রার ভিতর দিয়ে চলচ্চিত্র হিসেবে পরিবেশন করে।

বেলায় পুরুষেরা ছৌ অনুশীলন করেন, মহিলারা উঠান জুড়ে ছবি আঁকেন, কাঠ জোগাড় করেন, ধান কাটেন। এসব স্মৃতির মতো করে ধারণকৃত। ফোনে এক পরিযায়ী শ্রমিক জানান তিনি বেলা থেকে অনেক দূরে থেকেও বেলাকে ভুলতে পারছেননা, কি করে ভুলবেন একসাথে ছৌ আর মহড়া, জঙ্গলে বেড়ানো। “প্রদোষকাল” সিনেমায় কবিতার মত করে আছে।  প্রথাগত “নারী-পুরুষ” নির্মাণ না করে প্রান্তিক নারী-পুরুষ ধারনা মিশে যায় যেখানে, সে মানবিক/প্রাণীজ রহস্যময় প্রদোষকালের দর্শন পরিবেশন করেন।

প্রান্তিক নারায়ণ বসু     

কলকাতা কেন্দ্রিক প্রান্তিক বসুর/প্রান্তিক নারায়ণ বসুর প্রথম দিকের একটা কাজ হলো “জীবন সম্পর্কিত একটি ছোট সিনেমা” (২০০৭) যেখানে দুজন নব্য তরুণ সিনেমা বানাবে সামনের চলচ্চিত্র উৎসবের জন্য কিন্তু তারা “বিষয়” খুঁজে পাচ্ছেনা। পরিচালক জানায় সে কখনো ব্যবহৃত পথে চলবেনা, নিজের মতো করে নিজের পথ খুঁজে নেবে ফলাফল যা হওয়ার হবে। সাধারণ কাজ। পরের কাজ “এক দুই” (২০১১) যেখানে দক্ষিণ এশিয় কাব্যধারা সিনেমার ব্যাপক প্রভাব, বসু নিজের মতো করে এখানে দক্ষ নন, অন্যান্য নির্মাতাদের ছায়া, রুচি, দৃষ্টিভঙ্গির ছায়াক্রান্ত।

দক্ষিণ এশিয় কাব্যধারা সিনেমায় প্রায় শুরু থেকেই অনবদ্য সব কাজ হয়েছে। যেখানে রয়েছেন কুমার সাহনি, মনি কাউল, জন আব্রাহাম। জনের “মায়ের কাছে চিঠি” (১৯৮৬)কে আমার দুর্দান্ত বিয়োগান্তক মহাকাব্য মনে হয়। বা তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদের “মুক্তির গান” (১৯৯৫) ইয়াসমিন কবিরের চলচ্চিত্র, এনামুল করিম নির্ঝরের “আহা!” (২০০৭), বা সমসাময়িক ভিমুক্তি জয়সুন্দরিয়ার “পরিত্যক্ত ভূমি” (২০০৫), ছত্রাক (২০১১), অমিত দত্ত’র, “ক্রমশ” (২০০৭) “নয়নসুখ” (২০১০) বা হালের যুধাজিৎ বসুর, “কলসুবাই” (২০২০), পায়েল কাপাডিয়া, বাভিপিন ভিজয়, যে শুরু থেকেই ভিন্ন স্বরে তার যাত্রা ঠিক করেছে। কঙ্কনা সেনশর্মার “গঞ্জে একটি মৃত্যু” (২০১৬) বা মূলধারার “বিষয়” “দর্শন” নিয়ে কাব্যিক ঢংয়ে বানানো আদিত্য বিক্রম সেনগুপ্তের “আসা যাওয়ার মাঝে” (২০১৪) “জোনাকি” (২০১৮) বা “একদা কলকাতায়” (২০২১)। মিন ভামের “কালো পাখি” (২০১৫) জাহিদুর রহিম অঞ্জনের “মেঘমল্লার” (২০১৫) ইত্যাদি ইত্যাদি। আর ঋত্বিকের কাব্যময়তা তার দু এক সিনেমা বাদে খুব সাধারণ অংশ হয়ে সিনেমার শরীর জুড়ে রয়েছে শব্দে, সংগীতে, দৃশ্যায়ন আর চিত্রনাট্যের বিন্যাসে। বা বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের কথা শুরুতেই উল্লেখ করেছিলাম, তার সিনেমা অনেক সময় কবিতার মতো, তিনি নিজে বাংলা ভাষার চর্চিত কবিদের একজন। আরো রয়েছেন আনন্দ পট্টবর্ধন, সঞ্জয় কাক, তাদের কাজের তীব্র রাজনৈতিক মতামত ভাবনায় রেখে, যেমন আমার মতে ঋত্বিক ঘটকের কাজ তীব্র রাজনৈতিক হয়েও কাব্যিক। বা মৃণাল সেনের নিরাভরণ সিনেমাগুলো, যেমন “ভুবন সোম” (১৯৬৯) বা “ধ্বংসাবশেষ” (১৯৮৪) ইত্যাদি, ইত্যাদি। তবে কাব্যিক সিনেমার মানচিত্র আরো বড়, শক্তিশালী এবং ক্রমবর্ধমান।

“এক দুই” এবং “হাওয়া মহল”-এর পরে প্রান্তিক সাঁওতাল জীবন-দর্শন নির্ভর আভিযাত্রা শুরু করে বানিয়েছেন পুরাণ নির্ভর সিনেমা “সখিসোনা” (২০১৭) যা তাকে প্রভূত প্রশংসা, পুরষ্কার এনে দিয়েছে। তারপর “রঙ মহল” (২০১৮) যেখানে তিনি শুরু করেছেন তার সাঁওতাল জীবন দেখার আগ্রহ ফিকশন-ননফিকশনের বৃত্তের বাইরে দাঁড়িয়ে।  রঙ মহল সাঁওতালদের নিয়ে বানানো আভাগার্দ এক চলচ্চিত্র।

“এক দুই” এবং “হাওয়া মহল”-এর পরে প্রান্তিক সাঁওতাল জীবন-দর্শন নির্ভর আভিযাত্রা শুরু করে বানিয়েছেন পুরাণ নির্ভর সিনেমা “সখিসোনা” (২০১৭) যা তাকে প্রভূত প্রশংসা, পুরষ্কার এনে দিয়েছে। তারপর “রঙ মহল” (২০১৮) যেখানে তিনি শুরু করেছেন তার সাঁওতাল জীবন দেখার আগ্রহ ফিকশন-ননফিকশনের বৃত্তের বাইরে দাঁড়িয়ে।  রঙ মহল সাঁওতালদের নিয়ে বানানো আভাগার্দ এক চলচ্চিত্র। যেখানে পুরুলিয়ার ভূমির রঙ, গঠন সাঁওতালদের বাড়ির রংয়ের সাথে মিলে যায়, সাঁওতাল সৃষ্টিকাহিনী মিলে যায় বাড়ির কাঠামোর গঠনের সাথে, প্রথাগত কোনো প্রামাণ্যচিত্র নয় বরং বেশি। রঙ মহল আমাদের কোনো তথ্য বা সমাধান দেয়না কিন্তু রংয়ের দুনিয়ায় আমন্ত্রণ জানায়, দেখতে বলে, গল্প তৈরি করার সুযোগ করে দেয়। এখানে ধীরে তৈরি হচ্ছে বসুর নিজের কথা, রাজনীতি, দৃষ্টিভঙ্গি। রঙ মহল নানানরূপে দেখা যায়, ধরে নেয়া যায় এটা একটা স্থাপত্য কেন্দ্রিক সিনেমা বা পুরাণকথা বা আদিবাসি মানুষের জীবনের সাধারণ গল্প বা যাপন নির্ভর সিনেমা। প্রান্তিকের দেয়া “রঙ মহল” নিয়ে সাক্ষাৎকার তার দৃষ্টিভঙ্গি পরিষ্কার করে,

“প্রশ্নঃ এ সিনেমায় (রঙ মহল) আপনার উচ্চাকাঙ্ক্ষা কী?

প্রান্তিকঃ এ (রঙ মহল) সিনেমায় আমি একটা ভারতীয় আদিবাসী গ্রামে প্রকৃতি এবং সংস্কৃতির অন্যান্য পারস্পরিক সম্পর্কের দিকে একটি সূক্ষ্ম দৃষ্টিভঙ্গি নেওয়ার চেষ্টা করেছি এবং বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে বিদ্যমান পরিবেশগত শিল্পের একটি দৃষ্টান্তের মতো গল্প চিত্রিত করেছি। আমরা যদি শহুরে যুক্তির বাইরে তাকাই, আমরা দেখতে পাব যে আদিবাসীদের দৈনন্দিন জীবনে পুরাণগুলি/মিথগুলি খুব গভীরভাবে জড়িত। তাদের কাছে একটি গাছ শুধু একটি গাছ নয়; একটি পুকুর জল ধরে রাখার জন্য মাটিতে একটি গর্ত নয়। তারা প্রায়শই কারো মতো ব্যক্তিত্ব বা পরিবারের একজন এবং গভীর পারিবারিক আবেগ ও  মূল্যবোধের সাথে যুক্ত। (আর) আমি দৈনন্দিন জাগতিকতার মধ্যে পৌরাণিকতার অবস্থান ধরার চেষ্টা করেছি।” -বার্লিনালে ২০১৯ এ প্রান্তিকের দেয়া রঙ মহল নিয়ে সাক্ষাৎকারের অংশ (পরিমার্জিত গুগল অনুবাদ।) ।***

এরপরে “বেলা”’য় (২০২১) তিনি আরো গভীর আর সহজ হয়েছেন, নিজের দৃষ্টিভঙ্গি আরো প্রসারিত করছেন, সরল করছেন, আরো নিরাভরণ, অলঙ্কারবিহীন করছেন। আর বেলা নিয়ে তার ভাবনায় প্রকাশিত তার দর্শন, যাপন এবং রাজনীতি,

প্রশ্নঃ আপনার আগের স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমাগুলো (সখিসোনা, রঙ মহল) সাঁওতাল লোককাহিনীর কল্পনাপ্রসূত রূপরেখা ব্যবহার করেছে। তুলনামূলকভাবে, বেলা আরো শান্ত, “ন্যূন্যতম উপস্থিতি বজায় রাখা (ফ্লাই-অন-দ্য-ওয়াল)” প্রামাণ্যচিত্র। আপনি কীভাবে চলচ্চিত্রের ধরন/ফর্ম সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিলেন?

উত্তরঃ (বেলা) আমার আগের সিনেমার মতো নয়, বেলার জন্য আনুষ্ঠানিক কাঠামো তৈরি হয়েছিল কর্মপ্রক্রিয়া চলাকালীন। আমি নৃত্যদলের সাথে শুরু করেছিলাম, এবং বেশিরভাগ সময়  নর্তকদের রূপান্তর খুঁজে পেতে আগ্রহী ছিলাম যে যখন তারা তাদের যাপিত পুরুষ জীবন ছেড়ে নাচের মেয়ে ভূমিকায় অভিনয় করছিল আর রূপান্তরিত হচ্ছিল, (বেলা) “রূপান্তরিত হওয়ার” সময়ের খোঁজ। যেহেতু ছৌ নাচ বেশিরভাগই পুরুষদের দ্বারা চর্চা করা হয়, তাই আমি গ্রামে এবং আশেপাশে মহিলাদের এবং তাদের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করতে চেয়েছিলাম। ফলে “ধরণ(ফর্ম)” হিসেবে “ঢংমিশ্রণ(জাক্সটাপজিশন)” নিজে একটা গল্প বলছে, আর সাথে কোনো ধরনের “বক্তব্য (ভয়েসভার)” যোগ করলে শিক্ষামূলক বা উপদেশমুলক হয়ে উঠত। কারণ যখন আমাদের দেখতে বলা হয় তখন আমরা দেখি, কিন্তু কিছু বলা না হলে আমরা নিজেরাই পর্যবেক্ষণ করি। ফলে নিজের হস্তক্ষেপকে সীমিত রেখেছিলাম, এবং বেলায় “সিনেমা ভেরিতে” ধরণ বেছে নিয়েছিলাম।” -প্রান্তিক নারায়ণ বসুর সাক্ষাৎকার, ফার্স্টপোষ্ট, ২০২১।****

প্রশ্নঃ সখিসোনা, রঙ মহল এবং বেলা সাঁওতালি সংস্কৃতি, আচার-অনুষ্ঠান এবং রীতিনীতির সাথে দর্শকদের সম্পৃক্ত করে। তাদের প্রতিটি একে অপরের থেকে কতটা আলাদা?

উত্তরঃ বেশ ভিন্ন। এছাড়াও, এই তিনটি চলচ্চিত্রের সবকটিই সাঁওতালি ভাষায় নয়, বা বিশেষভাবে সাঁওতালি সংস্কৃতির সাথে জড়িত নয়। রঙ মহল একটি সাঁওতালি গ্রামে শ্যুট করা হয়েছিল এবং তাদের সৃষ্টিপুরাণ নিয়ে এখানে বলা হয়, সখিসোনা হল একটি লোককাহিনী চলচ্চিত্র যা বানানো হয়েছিল মেদিনীপুরের মোগুলমারিতে। আর বেলা পুরুলিয়ার একটি গ্রামে সংঘটিত হয়েছিল, যেখানে সখিসোনার নৃত্যশিল্পী ও সঙ্গীতশিল্পীরা থাকেন। তারা কুর্মি এবং মাহাতো নামে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। একজন বহিরাগতের চোখে, এটি অনুরূপ দেখা যেতে পারে এবং আমাদের শহুরে দৃষ্টি কেবল এটিকে “আদিবাসী সংস্কৃতি” হিসাবে দলবদ্ধ করে। তাদের স্বাতন্ত্র্যসূচক ব্যক্তিত্বের সন্ধান করতে সক্ষম হওয়ার জন্য আমাদের পর্যবেক্ষণকে সত্যিই সংবেদনশীল করতে হবে। এসব এক চলমান প্রক্রিয়া, এ সিনেমাগুলো নিয়ে আমার এরকম প্রচেষ্টা ছিল। আশা করি, আমি এ সিনেমাগুলোর ভিতর দিয়ে বাংলার তিনটি ভিন্ন ভিন্ন চিত্র পরিবেশন করতে পারব।”

-প্রান্তিক নারায়ণ বসু । জুলাই ১৯, ২০২১। তরঙ্গ মুখ।*****

প্রান্তিক মনোযোগ দিয়ে দেখেছেন জীবন যা এখনো পুরোপুরি প্রজনন, পুনঃউৎপাদন আর পুঁজিকেন্দ্রিক হয়ে উঠেনি। প্রতিষ্ঠিত নারী-পুরুষ, গ্রাম-শহর, দিন-রাত ধরনের ক্ষমতাবান “বিপরীতকামী-স্বাভাবিকতা”র সংকীর্ণ পথে, জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠিত “দর্শন” “যাপন” “সফলতা” “নৈতিকতা” পুনরাবৃত্ত না করে এসব ধারনা যেখানে মুছে যায় সে মুক্ত-স্বাধীন সময়, স্থান আর সম্ভাবনার খোঁজ পরিবেশন করেছেন।

 দক্ষিণ এশিয় নতুন কাব্যধারা সিনেমা

“আমি বিশ্বাস করি যে শ্রবণ বা শোনা একটি শিল্প এবং আমি এও বিশ্বাস করি যে শব্দ শোনা বা প্রশংসা করার জন্য আপনাকে নীরবতা শুনতেও শিখতে হবে।”  -সুকান্ত মজুমদার (বার্লিনালে প্রতিভা ২০০৭ সালের সুকান্ত মজুমদারের পাতা থেকে।)

কাব্যিক সিনেমা দক্ষিণ এশিয় সিনেমার নতুন কোনো বৈশিষ্ট্য নয়। এখানের সিনেমার শুরুর দিকের কাজেই রয়েছে অসংখ্য কাব্যিক সিনেমার প্রভাব, শুরুর আলাপ ধরে বলা যায় গত শতকের ৫০ এর দশকে সত্যজিৎ রায়ের “পথের পাঁচালী” (১৯৫৫) বা ঋত্বিক ঘটকের “অযান্ত্রিক” (১৯৫৮) বা এরপরের কাব্যিক সব সিনেমা “মায়া দর্পন” (১৯৭২) , “মাটি মানস” (১৯৮৫) বা “চরাচর” (১৯৯৩) বা ঋতুপর্ণ ঘোষের “তিতলি” (২০০২), কিরণ রাওয়ের “ধোবি ঘাট” (২০১০), আশিক মুস্তফার “ভিতর এবং বাহির” (২০১৭, ৮ মিনিট, সংলাপহীন একক শটের প্রামাণ্যচিত্র), মুহম্মদ আনোয়ার হোসেনের “একজন অচেনা পরিব্রাজক ফ ফ এর ভিতর” (২০১৭) সহ এর আগের, পরের বা এখানে যাদের উল্লেখ রয়েছে তাদের বাইরে রয়েছেন/রয়েছে নানান বৈচিত্র্যসম্পন্ন সব উদাহরণ যা পরিমাণে অনেক। এখানের জীবনে এবং শিল্পে কাব্যিকতা নতুন নয় বা দক্ষিণ এশিয় সিনেমার ক্ষেত্রেও নতুন নয় বা তেমন অনালোচিত বা ভুলে যাওয়া কোনো ধরন নয়। যদিও লোকপ্রসার, জনপ্রিয়তা খুব বেশি নয় বা এ ধরনের কাজের ধারনার ভিতরেই বোধ করি “জনপ্রিয়তা” বা “মাপকাঠি” “বাজার” “সামাজিক স্বীকৃতি” “প্রচলিত মূল্যবোধ” “আবেগের পরিমিতি” “বস্তুনিষ্ঠতা” “সময়ের প্রয়োজন” “আর্থিক বিবেচনা” ইত্যাদি ইত্যাদি বিষয়কে সজাগভাবেই পরিহার করার প্রবণতা থাকে। ভিন্নদিকে নির্মাণের ধরন, শব্দের বিন্যাস, রঙ বা চিত্রায়ন, সম্পাদনা সব কিছুতেই থাকে একটা সজাগ পরিহার, নির্বাচন, ব্যক্ত বা অব্যক্ত করণ।

কাব্যিক ধারার নতুনতম নির্মাণ বা নির্মাতাদের কাজের ভিতরে বা বিষয় নির্বাচনে যেমন রয়েছে সমরূপতা ঠিক তেমনি তাদের ভিতরে রয়েছে প্রচুর বিপরীত ভাবনা, বৈশিষ্ট্য, লক্ষ্য। এধারার নতুনতম এবং আলোচিত অধিকাংশ কাজের ভিতরে খুব সাধারণ জীবনের অংশ হিসেবে রাজনীতি, পরিবেশ বিষয়ক ভাবনা এসেছে। এবং কাব্যিকতার কোনো ছাড় না দিয়েই নির্মাতাগণ নির্মাণ করছেন শক্তিশালী রাজনৈতিক সব সিনেমা (পায়েল কাপাডিয়া “একটি না জানার রাত” (২০২১), চৈতন্য তামাহানে “কোর্ট” (২০১৪) ইত্যাদি, ইত্যাদি) বা প্রান্তিকের আলোচিত সিনেমার পরিবেশ, যৌনতাকেন্দ্রিক রাজনীতি। যে কাজগুলো আর নির্মাতাদের উল্লেখ শুরু থেকে এখানে পর্যায়ক্রমে উল্লেখ করা হয়েছে তাদের ক্ষমতা বা প্রভাব সমকালীন দক্ষিণ এশিয় সিনেমায় ক্রমবর্ধমান (শিল্পী হিসেবে, মানুষ হিসেবে বা তাদের কাজের/শিল্পের)। এসব ভাবনা, সিনেমায় দিন দিন আরো প্রজ্ঞাবান হচ্ছে যা উল্লিখিত নির্মাণ আর নির্মাতাদের উল্লেখ করে বলা যায়। এ প্রবণতা এ ধরনের সিনেমায় শক্তিশালী ঢং হিসেবে ব্যবহার এবং নির্মাণ আর নির্মাতাদের বৈচিত্র্য, সংখ্যা আর মানের বিচারে যেকোনো সময়ের চেয়ে প্রবল।

প্রান্তিক বসু/প্রান্তিক নারায়ণ বসু এর ব্যতিক্রম নন যদিও তার রাজনীতি তিনি সরাসরি প্রকাশ করেননা। তিনি খানিক মৃদুভাষী আর রহস্যময়তা নিয়ে নিজের রাজনৈতিক বক্তব্য, বিষয়, নির্বাচন, দেখানোর ভঙ্গি, দেখার ভঙ্গি, নৈতিকতা, স্বপ্ন সম্পাদনা-শব্দে-বিন্যাসে ছড়িয়ে রাখেন। এসব ভাবনা ধরে শুরুতে শব্দশিল্পী সুকান্ত মজুমদারের কথা উল্লেখ করেছিলাম, তার শব্দের কাজেও রয়েছে কাব্যিকতা, দেখতে পারেন তার সিনেমার কাজ “শুনতে কি পাও?” (২০১২), “বিলের নারী” (২০১৬) বা পড়তে পারেন তার শব্দ বিষয়ক ভাবনা উদ্রেককারী লেখা । তিনি নিজে সিনেমার সাথে জড়িয়ে থাকা একজন মানুষ, তত্ত্বীয় এবং ব্যবহারিক দুভাবেই । ফলে দক্ষিণ এশিয় এসব নতুন সিনেমার গভীরতা আর ভাবনার প্রসারতা বোঝাতে বোধহয়, সুকান্ত মজুমদারের কথার উল্লেখ দুর্দান্ত, যে, “(শব্দ)শোনা” একটি শিল্প এবং এজন্য আপনাকে “নীরবতা (নিঃশব্দ) শোনা/শ্রবণ শিখতে হবে।”

ফলে বলা যায় এসব সিনেমায় যারা কাজ করছেন তারা যা দেখাচ্ছেন সে যেমন আপনাকে ভাবাবে, তেমন কি? কীভাবে? দেখানো হচ্ছে? বা কেন কিছু দেখানো? বা শোনানো হচ্ছেনা? বা কেন হচ্ছেনা? সে ভাবনা সজাগ রাখবে। এসব নতুন ধরনের সিনেমায় রাজনীতি, রাজনৈতিক বক্তব্য ইত্যাদি সহজ, সরল কিন্তু দৃঢ়ভাবে উপস্থাপিত হয়। ফলে নতুনভাবে দক্ষিণ এশিয় চলচ্চিত্রে কাব্যিক ভাষার শক্তিশালী ব্যবহার নানানমুখি ভাবে সিনেমাকে আরো বেশি রাজনৈতিকভাবে প্রাপ্তমনস্ক, সৌন্দর্যগতভাবে দুর্দান্ত, বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে আরো গভীর, সরল, প্রাণীজ ও দার্শনিক করে তুলেছে। যেখানে পরিবেশ, প্রতিবেশ বিনাশি পুনঃউৎপাদন (যেকোনোভাবে), মানুষ প্রজননকেন্দ্রিকতা এবং এ চর্চার ব্যবহারিক ও তত্ত্বীয় পণ্যের পুনঃউৎপাদনের পুনরাবৃত্তির প্রবণতা ও নৈতিকতাকে দৃঢ়ভাবে বাস্তবতার মোকাবেলা করতে বাধ্য করতে চায়। ভিন্ন মুক্ত সম্ভবের পৃথিবীর ইশারা জানায়।

প্রান্তিক বসুর/প্রান্তিক নারায়ণ বসুর পশ্চিম বাংলার প্রান্তিক মানবিক/প্রাণীজ সিনেমার (সখিসোনা, রঙ মহল, বেলা বা হাওয়া মহল) ভাবনা আমাদের যে গভীর বোধ তৈরি করে সেসব ভাবনারা কবিতা, জীবন, যাপন, দর্শন, উপস্থাপন, পুরাণ, রাজনীতি সবকিছুর সাথে মিলে নতুনতর দক্ষিণ এশিয় কাব্যিক সিনেমার ভূমি উন্মোচন ও প্রসারিত করে। যেখানে প্রয়োজনীয় অংশ হিসেবে রাজনীতি দুর্দান্তভাবে উপস্থাপিত, যেন পরিব্রাজনময় ধ্যানমগ্নকবিতা।

লেখকঃ মুহম্মদ আনোয়ার হোসেন। চলচ্চিত্রকার, চলচ্চিত্র সমালোচক।  raiparasadardi@gmail.com

দোহাই

সাঁওতাল

কুর্মি/মাহাতো

পুরুলিয়া জেলা

ছৌ নাচ

https://www.imdb.com/name/nm6098283/

BELA |Directed by Prantik Narayan Basu | India, 2021

VISIONS DU RÉEL 2021: BELA BY PRANTIK BASU

Bela । 2021 । 58m

মহাপ্রয়াণের বয়ানঃ পরিবেশ বিষয়ক এক সিনেমা ত্রয়ীর পর্যালোচনা – মুহম্মদ আনোয়ার হোসেন

Rang Mahal (Palace of Colours) |2019

A Short Film About Life |PRANTIK NARAYAN BASU | 2007

EK, DO | FTII| 35mm

https://vimeo.com/34286659

https://indiaifa.org/grants-projects/prantik-narayan-basu.html

*Could you tell us a little about the Chhau performances?

Like all other dance forms, Chhau involves tremendous discipline, coordination and practise. Etymologically, it is derived from the word Chhaya, meaning shadow, image, or mask. It is said that every other boy in Purulia (where Bela is located) is a Chhau dancer, and that they learn the techniques of somersaulting underwater as they learn how to swim in the ponds at a young age. The songs that accompany Chhau dance are called Jhumur, and they follow the dohar (couplet) form. These are entwined with the landscape of Rarh Bengal and its flora and fauna. For example, the repeated meter of Jhumur songs derive inspiration from the echoes that occur while calling out in this undulating terrain, and that the subtle turn of the neck and torso in the Chhau dance is an imitation of the movements of a peacock. These nuances are usually overlooked by the viewer who is often lost is the grandeur of the performance. 

There is a sense, towards the end of Bela, that this way of life is under threat of disappearance. Even the Chhau performances seem destined for a town crowd.

Their way of life is under a constant transformation, much like everything around us, maybe a little slower, but isn’t that inevitable? This change is probably much less in the region where I shot Rang Mahal; there is a certain welcome resistance too, in the form of the Pathalgadi Movement, for instance. But the community in Bela is at the threshold. Many of the Chhau dancers move to cities across the country and contribute to the migrant workforce. When the team had come to Pune for a performance at the FTII, two workers from a nearby construction site heard the sounds of the dhol, dhamsa and shahnai, and immediately rushed to the campus where they were performing. It turned out that they were from their neighbouring village. The joy of their reunion in a place so far away from home was a sight to behold.

In the film, we see men mostly engaged in the Chhau performances while women are largely responsible for productive labour, both at home and in the village. How did you see the relation between men and women in the village?

It was quite compartmentalised, in terms of gender roles. While the men dress up as women for their performance, and the women display immense physical strength in their daily activities, the lines otherwise are rather rigid. So the argument of Chhau dance being masculine for its physical rigour fails to hold true after a point. Of late, few female Chhau dance groups have formed. But the attitude towards them is very similar to the ones towards the women’s sports teams in our country.

https://www.firstpost.com/art-and-culture/prantik-basu-on-bela-his-meditative-documentary-that-juxtaposes-the-chhau-art-form-with-life-in-a-bengal-village-9593891.html

পথলগাড়ি আন্দোলন

https://indianexpress.com/article/lifestyle/art-and-culture/bela-prantik-basus-documentary-is-a-persuasive-instance-of-preservation-7346309/

** “I attempted to trace the thresholds of day and night, nature and urbanisation, feminine and masculine,” the 35-year-old filmmaker told Scroll.in. “Interestingly, it all came to the ever-blurring lines of fiction and non-fiction. What we see in the final film, nothing of it is staged in the production; all the activities, rehearsals and the preparations were shot as they happened over the course of time. It is during the editing that the structure of a couple of days came up and that in a way fictionalises the entire construct of time in the film. I tried to remain true to the sense of time that I experienced during my stay in Bela, which was idyllic and conflicted at the same time.”

https://scroll.in/reel/992724/in-documentary-bela-a-timeless-dance-and-the-pressures-of-the-present

*** What is your ambition in the film?

In this film, I attempted to take a micro look at the unique correlation of nature and culture at an Indian tribal village and portray a parable-like tale of an existing ecological art at the threshold of extinction. If we look beyond the urban rationale, we will find that myths are very deeply entwined in the everyday lives of the indigenous people. For them, a tree is not just a tree; a pond not a mere hole on the ground to hold water. They are often personified and associated with more familial values. I tried to trace the mythical in the mundane.

https://shortsblog.berlinale.de/2019/02/27/an-interview-with-prantik-basu-about-rang-mahal/

**** Your previous short films (Sakhisona, Rang Mahal) made imaginative use of Santhali folklore. In comparison, Bela registers as a more sober, fly-on-the-wall documentary. How did you decide on the film’s form?

Unlike my previous films, the formal structure for Bela developed during the process. I started with the dance group, and was mostly interested in tracing the transformation of the dancers from the people they were to the gender-bending roles they played. Since the Chhau dance is mostly practiced by men, I meandered to observe the women and their activities in and around the village. The juxtaposition in itself was telling a story, so adding a voiceover would have made it didactic. We see when we are told to look, but on our own, we observe. So I limited my intervention to the least, and aimed for a cinema verité approach in Bela.

https://www.firstpost.com/art-and-culture/prantik-basu-on-bela-his-meditative-documentary-that-juxtaposes-the-chhau-art-form-with-life-in-a-bengal-village-9593891.html

***** DS. Sakhisona, Rang Mahal and Bela engage the audience with the Santhali culture, ritualistic practices and customs. How distinct is each of them from one another?

PNB: Quite different. Also, not all of these three films are in Santhali, or engage with the Santhali culture in particular. While Rang Mahal was shot in a Santhali village and [deals] with their creation myth, Sakhisona is a folklore [film] from Mogulmari, which is in Midnapur. And Bela takes place in a village in Purulia, where the dancers and musicians from Sakhisona reside. They belong to different communities, namely the Kurmis and the Mahatos. To an outsider’s eye, it might appear similar, and our urban gaze simply clubs it as “adivasi culture.” We really need to sensitize our observation to be able to trace their distinctive individuality. It is an ongoing process, and that is what my attempt was with these films. Hopefully, I am able to present three very different vignettes of Bengal in them.

https://vaguevisages.com/2021/07/19/interview-with-bela-filmmaker-prantik-narayan-basu/

https://www.digiakshare.com/post/bela-2021-mubi-review-a-meditative-documentary-that-transports-yousensuously

https://www.tribuneindia.com/news/archive/features/in-sync-with-nature-749729

https://kultur.beykozkundura.com/en/filmatique-interview-with-prantik-narayan-basu/

AN UNKNOWN WALKER INTO THE ff

https://vimeo.com/235146887

মহাশ্বেতা দেবী 

ঋত্বিক ঘটক 

যুক্তি তক্কো আর গপ্পো

অযান্ত্রিক

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত 

উত্তরা (২০০০) 

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •