বাঙালী শিল্পোদ্যোক্তা: পুঁজির সম্প্রসারণ প্রক্রিয়া

২২ পরিবারের অতীত ও বর্তমান-৭

বাঙালী শিল্পোদ্যোক্তা: পুঁজির সম্প্রসারণ প্রক্রিয়া

মেহেদী হাসান

বাংলাদেশে পুঁজিবাদের বিকাশ উল্লেখযোগ্য আকার নিয়েছে। এই বিকাশধারায় একদিকে তৈরি হয়েছে পাকিস্তানের ২২ পরিবারের চেয়েও সম্পদশালী বেশ কিছু গোষ্ঠী, অন্যদিকে বৈষম্য ও পরিবেশ বিধ্বংসী তৎপরতাও অভূতপূর্ব মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে ‘উন্নয়ন’ ধারার স্বরূপ বিশ্লেষণ, পুঁজির কেন্দ্রীভবনের ধরন, শ্রেণিবিন্যাস, এই ধারার পুঁজিবাদ বিকাশে রাষ্ট্রের ভূমিকা ইত্যাদি পরীক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান প্রবন্ধ কয়েক কিস্তিতে এই অনুসন্ধান বিশ্লেষণ হাজির করছে। এই সপ্তম কিস্তিতে পশ্চিম পাকিস্তানী একচেটিয়া ২২ পরিবারের পাশাপাশি বাংলাদেশে উদ্যোক্তা পুঁজির মালিকগোষ্ঠীর বিকাশ প্রক্রিয়া এবং রাষ্ট্রের সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্কের ধারাবাহিকতা পর্যালোচনা করা হয়েছে।

বাঙালী মালিকানায় পুঁজির সংবর্ধন

যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে উৎপাদনী[1] এবং অনুৎপাদনী – এই দুই প্রক্রিয়াতেই পুঁজির কেন্দ্রীভবন, পুঞ্জীভবন হয়েছিল। পাকিস্তান আমলের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয় আওয়ামী লীগ শাসনের প্রাথমিক অবস্থায়। রাষ্ট্রীয় খাত শিল্প উৎপাদনের প্রধান ধারা হিসেবে গৃহীত হলেও সরকারের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী, আমলাতন্ত্র এবং কাঠামোগত দুর্বলতার কারণে তার ভেতরে অবক্ষয়ের শুরু হয় যাত্রাকালীন সময়টাতেই।

কৃষি ছিল অর্থনীতির প্রধান ধারা। ১৯৭১ সালে রাষ্ট্রীয় খাতে শিল্প সম্পদের হার ছিল প্রায় ৩৪ শতাংশ, ১৯৭২ সালে সে হার বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৯২ শতাংশে। এই সময়ে জিডিপি’তে শিল্প খাতের অবদান ছিল মাত্র ৭.৮ শতাংশ যার মধ্যে বৃহৎ শিল্প উৎপাদনের হার ছিল প্রায় ৩.৭ শতাংশ।[2] কিন্তু এর ধারাবাহিকতা দীর্ঘ সময় ধরে রাখা যায়নি। বিভিন্ন সময়ে ফরমান জারী করে ব্যক্তি পুঁজির সম্প্রসারণের ব্যবস্থা করা হয়, শিল্প অর্থনীতিতে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব খাতের অবদান কমতে থাকে এবং ব্যক্তি পুঁজির বিকাশের প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ হয়। বণ্টন ব্যবস্থায় আয় বৈষম্য কমানোর ব্যবস্থা না করে উৎপাদন বৃদ্ধি ছিল সরকারের মূল মনোযোগের বিষয়। বিতরণ ব্যবস্থায় সরকার দলীয় নেতা-কর্মী-সমর্থকদের কর্তৃত্ব এবং নিয়ন্ত্রণ থাকার কারণে উৎপাদিত পণ্যের সুফল সর্বজনের খাতে প্রবাহিত হওয়ার পরিবর্তে চোরাকারবারী তৎপরতার প্রসার লাভ করে। দেশে দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি তৈরি হলে এর শিকার হয় নিম্ন আয়ের মানুষজন। সামগ্রিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব দেখা দেয়। তার মাঝেই কতিপয় ব্যক্তির সম্পদ পুঞ্জীভূত করার প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে।

পূর্ব পাকিস্তানের ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মোট স্থায়ী সম্পত্তির মধ্যে শতকরা প্রায় ৪৭ শতাংশ ছিল বাঙালী পুঁজিপতিদের।[3] এদের সাথে পশ্চিম পাকিস্তানি পুঁজিপতি এবং রাজনীতিবিদদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার কারণে আওয়ামী লীগের মধ্যে তারা গুরুত্বপূর্ণ ‘প্রেসার গ্রুপ’ হয়ে উঠতে পারেনি। যার ফলে যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয়করণকালে নিজস্ব সম্পত্তি টিকিয়ে রাখার মতো শক্তিশালী কোন অবস্থান তাদের ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের নীতিগত অবস্থান এবং পরিকল্পনার কারণে অল্প সময়ের মধ্যেই ব্যক্তিগত খাতে সম্পদ কেন্দ্রীভূত ও পুঞ্জীভূত করার সুযোগ তৈরি হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে দেশে কোটিপতি আমানতকারী ছিল ৫ জন, ১৯৭৫ সালে তা ৪৭ জনে উন্নীত হয়।[4]

শিল্পে যে ব্যক্তি মালিকানাধীন পুঁজি অর্থনীতির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ গঠন করে তাদের পথ চলা শুরু হয় পাকিস্তান রাষ্ট্র ব্যবস্থার অধীনে। যখন সরকারি নীতি-পরিকল্পনা এবং সংস্কার কর্মসূচির মাধ্যমে প্রধানত পাকিস্তানের পশ্চিম অংশে শিল্পায়নের বিকাশ ঘটানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল তখন পূর্ব পাকিস্তানে অল্প সংখ্যক বাঙালী ছাড়াও মারওয়ারি এবং বৃটিশ ব্যবসায়ী অল্প কিছু ব্যবসা-শিল্প নিজেদের আওতায় নিয়ে নিতে পেরেছিল। ফারজানা নাহিদের গবেষণা অনুযায়ী, বাঙালী মুসলিম পুঁজিপতিদের হাতে মোট ২,২৫৩ টি কারখানা ছিল এবং তা ছিল (পূর্ব পাকিস্তানের) মোট শিল্প সম্পদের মাত্র ১৮ শতাংশ। পশ্চিম পাকিস্তানী অবাঙালী পুঁজিপতিদের হাতে থাকা বৃহৎ আকারের ইউনিটের তুলনায় এগুলো ছিল খুবই ক্ষুদ্র আকারের।[5] ১৯৭০ দশকে, আইয়ুব খান পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে যখন পাকিস্তানের শিল্পায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেন সে সময়কালে কয়েকটি পরিবার যেমন: বেক্সিমকো, রহিমআফরোজ, আকিজ, কর্ণফুলী, আলফা টোব্যাকো, নাভানা, এসিআই, প্রগতি প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের উত্থান দেখা যায়। নীচের সারণীতে তাদের সম্পদের পরিমাণ এবং সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা উল্লেখ করা হলো:

ছক-১৯: ১৯৬৯-৭০ নাগাদ পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালী নেতৃস্থানীয় ব্যবসায়ীদের তালিকা।

ব্যবসায়ী গ্রুপ

প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা

বৈধ সম্পদের পরিমাণ (কোটি)

এ.কে.খান

১২

৭.৫ রুপি (১.৫৭৫ মার্কিন ডলার)

গুই বক্স ভূঁইয়া

৬.৫ রুপি (১.৩৬৫ মার্কিন ডলার)

জহরুল ইসলাম

১৪

৬.০ রুপি (১.২৬ মার্কিন ডলার)

মো. ফকির চাঁদ

১০

৬.০ রুপি (১.২৬ মার্কিন ডলার)

মকবুলুর রহমান এবং জহরুল কাইয়ুম

৫.০ রুপি (১.০৫ মার্কিন ডলার)

আলহাজ্ব মুসলিমউদ্দিন

৫.০ রুপি (১.০৫ মার্কিন ডলার)

আলহাজ্ব শামসুজ্জোহা

৫.০ রুপি (১.০৫ মার্কিন ডলার)

খান বাহাদুর মুজিবুর রহমান

৪.৫ রুপি (.৯৪৫ মার্কিন ডলার)

আফিল

৪.০ রুপি (.৮৪ মার্কিন ডলার)

সাত্তার

৩.০ রুপি (.৬৩ মার্কিন ডলার)

আশরাফ

৩.০ রুপি (.৬৩ মার্কিন ডলার)

ভান্ডারি

৩.০ রুপি (.৬৩ মার্কিন ডলার)

সফদার আলী

৩.০ রুপি (.৬৩ মার্কিন ডলার)

ইব্রাহিম মিয়া

৩.০ রুপি (.৬৩ মার্কিন ডলার)

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

২.৫ রুপি (.৫২৫ মার্কিন ডলার)

মোহাম্মদ আবদুস সামাদ (ডেল্টা গ্রুপ)

২.৫ রুপি (.৫২৫ মার্কিন ডলার)

সূত্র: Barnov, 1986, Table 2.5: Leading Bangladesh Family Businesses in East Pakistan, 1969-1970. উদ্ধৃতি: Farzana Nahid, Entrepreneurial Capacity and State Incapacity: Family Firms In Bangladesh, 2017, page-31.

অন্যদিকে, পশ্চিম পাকিস্তানকেন্দ্রিক একচেটিয়া পরিবারগুলোর হাতে সম্পদের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে, দাউদ (১১.৭৮ কোটি মার্কিন ডলার), সায়গল (১১.৬৮৭ কোটি মার্কিন ডলার), আদমজী (৯.৯৩৭ কোটি মার্কিন ডলার), জলিল (৮.৮১৬ কোটি মার্কিন ডলার), কলোনি (৭.১৯৭ কোটি মার্কিন ডলার), ফ্যান্সি (৬.৯৪১ কোটি মার্কিন ডলার), ভালিকা (৬.৭২ কোটি মার্কিন ডলার), বাওয়ানি (৪.৯৮৫ কোটি মার্কিন ডলার), ক্রিসেন্ট (৪.১৯৪ কোটি মার্কিন ডলার), ওয়াজির আলী (৪.১৯৪ কোটি মার্কিন ডলার), গান্ধারা (৩.২১৭ কোটি মার্কিন ডলার), ইস্পাহানি (৩.২৩৪ কোটি মার্কিন ডলার), হাবিব (২.৮৬ কোটি মার্কিন ডলার), খাইবার (২.৬৭৮ কোটি মার্কিন ডলার), নিশাত (২.৭০৭ কোটি মার্কিন ডলার), বেকো (২.৩৯ কোটি মার্কিন ডলার), গুল আহামদ (২.২৯৩ কোটি মার্কিন ডলার), আরাগ (২.২১৩ কোটি মার্কিন ডলার), হাফিজ (২.২১২ কোটি মার্কিন ডলার), করিম (২.০০৩ কোটি মার্কিন ডলার), মিলওয়ালা (২.০১৬ কোটি মার্কিন ডলার), দাদা (১.৯০৩ কোটি মার্কিন ডলার) (’৭০ দশকের দামস্তর অনুযায়ী)।[6]

পশ্চিম পাকিস্তানকেন্দ্রিক একচেটিয়া পরিবারগুলোর তুলনায় তৎকালীন বাঙালী পুঁজিপতিদের অবস্থান ততটা শক্তিশালী ছিল না বিধায় এবং ৪২টি পরিবারের মধ্যে দাউদ, আদমজী, বাওয়ানি, আরাগ, ইস্পাহানি, গান্ধারা, দাদা এবং হাবিব পরিবারের পূর্ব অংশে বড় বিনিয়োগ থাকায় রাষ্ট্র থেকে শুরু করে সমাজের সর্বক্ষেত্রে তাদের দাপটই ছিল বেশী। বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর পশ্চিম পাকিস্তান বা ভারতে চলে যাওয়ায় অর্থনীতি ক্ষেত্রে তাদের দাপট শেষ হলে বাঙালীদের মধ্য থেকে নতুন উত্থান তৈরি হয়।

ইস্ট পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (ইপিআইডিসি)-র মাধ্যমে এ অঞ্চলে যে উদ্যোক্তা শ্রেণির বিকাশের উদ্যোগ দেখা যায় সেখানে পাট নির্ভর শিল্পখাতে আদমজী, বাওয়ানিদের আধিপত্য দেখা যায়। আনোয়ার গ্রুপ, এ.কে. খান এন্ড কোম্পানি লিঃ, আকিজ গ্রুপ, রহিম আফরোজ, বেক্সিমকো প্রভৃতি পরিবারগুলো বৃহৎ একচেটিয়া পরিবারগুলোর তুলনায় রাষ্ট্রীয়ভাবে কম সুযোগ-সুবিধা পেলেও পুঁজির নিজস্ব নিয়মেই সমাজের অভ্যন্তরে বেড়ে উঠতে থাকে। নীচে একটি ছকের সাহায্যে পূর্ব পাকিস্তানে যে শিল্পপুঁজির প্রতিনিধিত্ব দেখা যায় তার একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা দেওয়া হলো —

ছক: ২০ কতিপয় বাঙালী শিল্প উদ্যোক্তার বিবরণী

নাম

প্রতিষ্ঠাকাল

প্রজন্ম

ব্যবসার মূল ধরণ

মূল খাত

অন্যান্য শিল্প ব্যবসা প্রতিষ্ঠান

প্রতিষ্ঠান (সংখ্যা)

আনোয়ার গ্রুপ

১৮৩৪

টেক্সটাইল

ভোগ্যপণ্য

পাট, সিমেন্ট, অটোমোবাইল, তথ্য ও প্রযুক্তি, রিয়েল এস্টেট, অর্থলগ্নী প্রতিষ্ঠান (ব্যাংক, বীমা), আসবাবপত্র, কেবল।

২৮

এ.কে. খান এন্ড কোঃ লিঃ

১৯৪৫

টেক্সটাইল, পাট, গভীর সমুদ্রে মাছ ধরা এবং মৎস প্রক্রিয়াজাতকরণ, ক্লিয়ারিং এন্ড ফরোওয়ার্ডিং, আইএসপি/এএসপি, তথ্য ও প্রযুক্তি, ডিস্ট্রিবিউশন, প্ল্যানটেশন, পানি, কৃষি, সিকিউরিটিজ এন্ড স্টক।

২২

আকিজ গ্রুপ

১৯৫০

তামাক

কৃষি

বিড়ি ও সিগারেট, প্রিন্টিং ও প্যাকেজিং, টেক্সটাইল, হ্যান্ড বোর্ড, ফার্মাসিউটিক্যাল, চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ, রিয়েল এস্টেট ব্যবসা, খাদ্য ও পানীয়।

৩০

রহিম আফরোজ গ্রুপ

১৯৫৪

নবায়নযোগ্য জ্বালানি

জ্বালানি

গাড়ী বাজারজাত ও পরবর্তী ব্যবস্থাপনা, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ, টায়ার-ব্যাটারি-লুব্রিকেন্টস বিক্রয়, জরুরী বিদ্যুৎ পণ্য, ডিজেল ও গ্যাস জেনারেটর, লাইটিং পণ্য, ইলেট্রিক্যাল যন্ত্রপাতি, সৌর ব্যবস্থা, কমপ্রেসড ন্যাচারাল গ্যাসভিত্তিক সল্যুশনস এবং পাওয়ার রেকটিফায়ারস।

২০

বেক্সিমকো

১৯৫৬

ঔষধ

ঔষধ

টেক্সটাইল, ট্রেডিং, রিয়েল এস্টেট, সেবা ব্যবসা, নির্মাণ, তথ্য যোগাযোগ ও প্রযুক্তি, গণমাধ্যম, সিরামিকস, এভিয়েশন, ফার্মাসিউটিক্যালস, ফিনান্সিয়াল সার্ভিসেস, জ্বালানি। 

৩৫

স্কয়ার গ্রুপ

১৯৫৯

ঔষধ

ঔষধ

প্রসাধনী সামগ্রী, গৃহস্থালী পণ্য, খাদ্য পণ্য, টেক্সটাইল, ভোগ্যপণ্য, স্পিনিং, নিট ফ্যাব্রিক্স, ফ্যাশন, তথ্য ও প্রযুক্তি, হাসপাতাল

২৮

সূত্র: Table 4.1, Seven Case Studies, Farzana Nahid, Entrepreneurial Capacity and State Incapacity: Family Firms In Bangladesh, 2017, page-121-124. (এখানে ১৯৭১ পরবর্তী ব্যবসাও অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে)

বাঙালী পুঁজিপতিদের সাথে তৎকালীন পাকিস্তান রাষ্ট্র-রাজনৈতিক দলের সম্পর্ক এবং ধারাবাহিকতা[7]

১৯৬০ সালে, আইয়ুব সরকারের দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় (১৯৬০-১৯৬৫ সাল) কর ব্যবস্থা, শিল্প ঋণে ভর্তুকি, রপ্তানি পণ্যের উপর নানাবিধ ছাড় এবং আমদানি শুল্ক ব্যবস্থার সংস্কারের ফলে ১৯৭০ সাল নাগাদ ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের প্রবৃদ্ধি হতে থাকে। এই সংস্কার কার্যক্রমের ফলে যদিও পশ্চিম পাকিস্তান কেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটে তা সত্ত্বেও উপরোল্লিখিত পূর্ব পাকিস্তান কেন্দ্রিক অল্প কিছু বাঙালী পরিবার তাদের ভিত্তি তৈরি করতে সমর্থ হয় সরকারের সাথে ভালো সম্পর্ক রাখার মাধ্যমে। ১৯৫৬ এবং ১৯৬০ সালে ইস্যুকৃত শিল্প-বাণিজ্য লাইসেন্সের মাত্র ৩০ শতাংশ পূর্ব পাকিস্তানের হাতে ছিল, অন্যদিকে, পশ্চিম অংশের শিল্পায়ন ত্বরান্বিত করার জন্য সরকার পূর্ব অংশের কৃষি উদ্বৃত্ত পশ্চিম অংশের শিল্পের যোগানে ব্যবহারের জন্য নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল।

যুদ্ধপূর্ব সময়ে বাঙালীদের মধ্যে অল্প কিছু উদ্যোক্তা রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করে তুলনামূলক ক্ষুদ্র আকারে পুঁজির সংবর্ধন ঘটায়; অন্যদিকে, পাটকেন্দ্রিক বৃহৎ শিল্প-প্রতিষ্ঠান-ব্যবসা পশ্চিম পাকিস্তানভিত্তিক অবাঙালী পুঁজিপতিদের হাতে কেন্দ্রীভূত হওয়ায় এবং তাদের কাছে এ অঞ্চলের পাটের ব্যাপক চাহিদা থাকার কারণে এ অঞ্চলের কৃষিপণ্য বিশেষ করে পাটকেন্দ্রিক উৎপাদন-সম্প্রসারণের প্রতি পাকিস্তান সরকারের আগ্রহ দেখা দেয়। ফারজানা নাহিদের গবেষণা থেকে জানা যায় যে, ১৯৫৪ সালে, সরকার পূর্ব পাকিস্তানে আঞ্চলিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান, এটমিক এনার্জি সেন্টার, পাট গবেষণা প্রতিষ্ঠান, হাইড্রোলিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা ছাড়াও পানি সেচ প্রকল্পে ভর্তুকি, কম দামে সার বিক্রয় এবং কৃষি কাজে ব্যবহার্য যন্ত্রপাতি কেনার উপর শুল্ক ছাড় ইত্যাদির উদ্যোগ গ্রহণ করে। ফলে, অবাঙালী বৃহৎ শিল্প মালিকদের পাশাপাশি এ অঞ্চলের বাঙালী ঠিকাদার, ব্যবসায়ীরাও (শিল্প মালিকদের সহযোগী) লাভবান হয়। 

১৯৪০ সালের পূর্বে খান বাহাদুর এন্ড কো., ডব্লিউ রহমান, কুমুদিনী, আনোয়ার, এপেক্স, ইস্পাহানি এবং ৪০ দশকে এ. কে. খান, ইসলাম, ডেল্টাকে যেমন এ অঞ্চলে দেখা যায় তেমনি নানা ধরনের নীতি-পরিকল্পনা গ্রহণ ও সংস্কারের মধ্য দিয়ে ১৯৫০-এর দশকে মো. ভাই, স্কয়ার, এলিট, আবুল খায়ের, পেসিফিক, বেক্সিমকো, আকিজ, রহিমাফরোজ, পারটেক্স, অপসোনিন, হামিদ, আবুল মোনেম, প্রাইড; ১৯৬০ এর দশকে কর্ণফুলী, আলফা টোব্যাকো, নাভানা, সফদার আলী, ইব্রাহিম মিয়া, এসিআই, প্রগতি এবং ১৯৭০ দশকে সিটি, কনকর্ড, যমুনা, মেঘনা, সানম্যান, ফ্লোরা, নাসির-এর মতো ব্যবসায়ী পরিবারগুলোকে বিকশিত হতে দেখা যায়।

পশ্চিম পাকিস্তানকেন্দ্রিক বৃহৎ পুঁজির মালিকানার পাশাপাশি পূর্বাংশে কয়েকটি গোষ্ঠীর ক্ষুদ্র আকারের শিল্পোদ্যোগ দেখা যায় পাকিস্তান আমলে। ১৯৪০ সালের পূর্বে খান বাহাদুর এন্ড কো., ডব্লিউ রহমান, কুমুদিনী, আনোয়ার, এপেক্স, ইস্পাহানি এবং ৪০ দশকে এ. কে. খান, ইসলাম, ডেল্টাকে যেমন এ অঞ্চলে দেখা যায় তেমনি নানা ধরনের নীতি-পরিকল্পনা গ্রহণ ও সংস্কারের মধ্য দিয়ে ১৯৫০-এর দশকে মো. ভাই, স্কয়ার, এলিট, আবুল খায়ের, পেসিফিক, বেক্সিমকো, আকিজ, রহিমাফরোজ, পারটেক্স, অপসোনিন, হামিদ, আবুল মোনেম, প্রাইড; ১৯৬০ এর দশকে কর্ণফুলী, আলফা টোব্যাকো, নাভানা, সফদার আলী, ইব্রাহিম মিয়া, এসিআই, প্রগতি এবং ১৯৭০ দশকে সিটি, কনকর্ড, যমুনা, মেঘনা, সানম্যান, ফ্লোরা, নাসির-এর মতো ব্যবসায়ী পরিবারগুলোকে বিকশিত হতে দেখা যায়। নমুনা হিসেবে কয়েকজন পুঁজিপতির পুঁজির ধরন, সঞ্চয়নের প্রক্রিয়া, রাজনৈতিক-সামাজিক সম্পর্ক তুলে ধরা হলো।

১: আনোয়ার গ্রুপ

বাঙালী পুঁজিপতিদের মধ্যে কেউ কেউ সরাসরি রাষ্ট্রের সহযোগিতা পেয়েছেন কেউবা পরোক্ষভাবে। বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরনো যে ক’জন পুঁজিপতি আছে তাদের মধ্যে এই পরিবারটি পাকিস্তান জন্মের আগেই বড় পুঁজিপতিদের ক্লাবে জায়গা করে নেয়। গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা, লাক্কু মিয়া ১৮৩৪ সালে ছোট একটা চিরুনি এবং বোতাম কারখানা দিয়ে তার ব্যবসা শুরু করেন। পরে তৃতীয় প্রজন্মের আনোয়ার হোসাইন এর হাত ধরে ব্যবসা আরও বিকশিত হয়। প্রথম দিকে, বৃটিশ আমলে তেমন কোন সুবিধা না পেলেও পরের দিকে, বিশেষ করে পাকিস্তান রাষ্ট্র হওয়ার পরবর্তী সময়ে আনোয়ার এবং তার পরবর্তী প্রজন্মের সাথে রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ যোগাযোগ-সম্পর্ক স্থাপিত হয় এবং রাষ্ট্রের তরফ থেকে তারা নানা সুবিধা পায়।

আইয়ুব সরকার যখন টেক্সটাইল এবং পাট খাতে ট্রেড পলিসি উদারীকরণ করে তখন সে ‍সুযোগ ব্যবহার করে আনোয়ার গ্রুপ তাদের টেক্সটাইল ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য বিভিন্ন ধরনের রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি সুবিধা ভোগ করে। বাঙালী মুসলিম ব্যবসায়ীদের মধ্যে আনোয়ার প্রথম পূর্ব পাকিস্তানে প্রিন্টিং মিল স্থাপন করেন। ১৯৬৮ সালের দিকে তিনি পূর্ব পাকিস্তান ক্ষুদ্র শিল্প সংস্থার (ইপসিক, পরে যার নাম হয় বিসিক) পৃষ্ঠপোষকতায় ২০টি সিল্ক লুম কিনে নেন এবং এ অঞ্চলে বাঙালীদের মধ্যে প্রথম সিল্ক কারখানা স্থাপন করেন। ১৯৭০ সালে আবার ইপসিকের কাছ থেকে ৯ লাখ পাকিস্তান রুপি দিয়ে রাশিয়ান মেশিনের ১২ লুমসহ কাটলারি কারখানা কিনে নেন এবং স্টেইনলেস স্টিলের চামচ ও এনামেল কাটলারি তৈরির কারখানা স্থাপন করেন। ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় তার অধিকাংশ ব্যবসা-পাতি নষ্ট হয়ে যায়। যুদ্ধের পর আবার তিনি সেসব পুনরুদ্ধার করেন।

আনোয়ার অন্যতম ধনাঢ্য ব্যবসায়ী হেলালউদ্দিনের মেয়ে আমেনাকে বিয়ে করেন যিনি পরে গ্রুপের কো-চেয়ারম্যান হন। জামাতা আখতার বাংলাদেশ ফিন্যান্স এবং ইনভেস্টমেন্ট কোঃ লিঃ (বিএফআইসি)-র একজন পরিচালক নির্বাচিত হন। আনোয়ার হুসাইনের দ্বিতীয় মেয়ে, সেলিনা বেগম মালার বিয়ে হয় প্রাক্তন সংসদ সদস্য হায়দার আলীর ছেলে তারেক আকবর আলীর সাথে। মালার দাদাশ্বশুর ছিলেন বার্মায় পাকিস্তানের দূত। এছাড়া অন্য দুই মেয়েরও বিয়ে হয় দুই বৃহৎ শিল্পপতির দুই ছেলের সাথে।

আনোয়ারের ছেলে মনোয়ার ১৯৯৩ সালে গ্রুপে যোগদানের পর আনোয়ার স্টিল মিলস, আনোয়ার গ্যালভানাইজিং, মনোয়ার ইন্ডাস্ট্রিজ, সানসাইন কেবল, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, সিটি ইন্স্যুরেন্স এবং বিএফআইসি-র পরিচালক হন। তিনি চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র এবং বৃহৎ শিল্পপতি সিকান্দার হোসেন লালুর মেয়েকে বিয়ে করেন। আনোয়ারের দ্বিতীয় পুত্র হোসেন মেহমুদ, হোসেন ডাইং এন্ড প্রিন্টিং ও মেহমুদ ইন্ডাস্ট্রিজ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি সিটি ইন্স্যুরেন্স এবং বিএফআইসির পরিচালক, সিটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড রিসার্চ (এনআইটিইআর)-র পরিচালক। তিনি সাবেক সচিবের ভাইয়ের মেয়েকে বিয়ে করেন। হোসেইন খালেদ (আনোয়ারের তৃতীয় পুত্র) ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ-এর সভাপতি এবং বাংলাদেশ বেটার বিজনেস ফোরামের কো-চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনিও শিল্পপতি আব্দুর রওফের কন্যাকে বিয়ে করেন। আনোয়ার নিজেও রাজনীতির সাথে পরে সম্পৃক্ত হন এবং জেনারেল এরশাদের দল থেকে সংসদ সদস্য হন।[8]

পুঁজির মালিক শ্রেণি বৈবাহিক-পারিবারিক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার, রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা নিজেদের ব্যবসার অনুকূলে আনা, নিজেদের স্বার্থে রাষ্ট্রীয় নীতি-পরিকল্পনা গ্রহণে প্রভাবিত করা কিংবা ভূমিকা রাখা ইত্যাদি ধরনের কাজগুলো সহজে করতে পারে এবং করে। এ কারণে সাধারণত পুঁজিপতিদের সাথে পুঁজিপতিদের আত্মীয়তার সম্পর্ক হতে দেখা যায়। রাষ্ট্রের সাথে পুঁজির জৈবিক সম্পর্ক যেমন পরস্পরকে সমৃদ্ধ করে তেমনি সামাজিক এ ধরনের সম্পর্ক পুঁজিকে নিরাপদ করতে সহযোগিতা করে। পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের নানা ধরনের বৈষম্য নীতির কারণে পূর্বাংশের পুঁজিপতিরা নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্য সুরক্ষার পথ হিসেবে সামরিক-বেসামরিক ক্ষমতাশালী পরিবারগুলোর সাথে আত্মীয়তা গড়ে তোলে, বিশেষ করে বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে তোলার দিকে নজর দেয় যাতে তারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাসীনদের যোগসাজশে ব্যাংক ঋণ থেকে শুরু করে নানা ধরনের রাষ্ট্রীয় সুবিধা আদায় করতে পারে। গোষ্ঠীগত সম্পর্ক পুঁজির সম্প্রসারণকে যেমন সমৃদ্ধ করে তেমনি শক্তিশালী পুঁজি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের বিপদ-আপদ থেকে পুঁজির পারস্পরিক সম্পর্কে আবদ্ধ গোষ্ঠীকেও উদ্ধার করে।

আনোয়ার গ্রুপের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান ছাড়াও বিনিয়োগ অংশীদার হিসেবে অন্যান্য দেশি-বিদেশী পুঁজির সাথে সম্পৃক্ততা রয়েছে। আন্তর্জাতিক পুঁজির সাথে সম্পর্কের সুফল গ্রুপের পুঁজির সম্প্রসারণের দিক থেকে যেমন সুবিধা বয়ে আনে তেমনি রাষ্ট্রীয় শুল্ক-কর ইত্যাদি রেয়াত-রেহাইয়ের কারণে বিদেশী পুঁজিও লাভবান হয় বিপরীতভাবে। অন্যদিকে যৌথ বিনিয়োগ দেশী-বিদেশী পুঁজির বাজার বিস্তারে সহায়ক হয়। বাংলাদেশে বৃহৎ পুঁজির মালিকদের প্রায় সবার সাথেই আন্তর্জাতিক পুঁজির ঘনিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে।

২: এ. কে. খান গ্রুপ

আবুল কাশেম খান (এ.কে.খান) ১৯৪৭ সালে চট্টগ্রামের বন্দর নগরীতে এ.কে.খান এন্ড কোম্পানি লিঃ প্রতিষ্ঠা করেন। একটি ম্যাচ ফ্যাক্টরি দিয়ে যাত্রা শুরু হয় তার। বলা হয়ে থাকে তিনি এবং তার সন্তানরা অনেক বেশী রাষ্ট্রীয় সুবিধাভোগী, তাদের ব্যবসার জোর বাড়ানোর জন্য সরকারের পৃষ্ঠপোষকতাই মুখ্য। তার বাবা আব্দুল লতিফ খান ছিলেন ফাতেহাবাদের সাব-রেজিস্ট্রার। তার দাদার দাদা সমশের খান ছিলেন ষোল শতকে গাওর-এর মন্ত্রী। এসব কারণে এই পরিবার রাজনীতিবিদ এবং আমলা পরিবার হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত। পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পূর্বে এ. কে. খান ছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের উকিল, পরে তিনি মুন্সেফ (বিচারক) পদে আসীন থাকেন ১৯৪৪ সালের পূর্ব পর্যন্ত। ১৯৪৫ সালে জুডিশিয়াল চাকুরী ছেড়ে দিয়ে তিনি মুসলিম লীগে যোগ দেন, মুসলিম লীগের জেলা সভাপতি নির্বাচিত হন এবং প্রাদেশিক মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সদস্য হিসাবে তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৯৪৬-এ তিনি ভারতের গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হলেও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ-র নির্দেশনায় উক্ত পরিষদে যোগদান থেকে বিরত থাকেন এবং ১৯৪৭-এ পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য হন। পরবর্তীতে আইয়ুব খানের মন্ত্রীসভার সদস্য হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন।

বৃটিশ পুঁজিপতিদের সাথে পাল্লা দিয়ে বেঙ্গল বার্মা স্টিম নেভিগেশন কোম্পানি স্থাপন করা এবং রেঙ্গুনে প্রতিষ্ঠিত চালকল ছেড়ে চট্টগ্রামে বসতি স্থাপনকারী অন্যতম ধনী আব্দুল বারী চৌধুরীর মেয়েকে বিয়ে করেন এ. কে. খান। ১৯৪৫ সালে যখন এ. কে. খান বিচারকের চাকুরী ছেড়ে দিয়ে মুসলিম লীগের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত তখন তার শ্বশুরের আমন্ত্রণে তাঁর নির্মাণ ব্যবসায় যোগদান করেন। নির্মাণ ব্যবসা এখনকার মতো তখনও খুব উচ্চ মুনাফা সৃষ্টিকারী খাত এবং আকর্ষণীয় ছিল।

আইয়ুব খান সরকার পূর্ব পাকিস্তানের বাজার ব্যবস্থা সম্প্রসারণের তাগিদে অবকাঠামো নির্মাণের জন্য যে ক’জনের উপর ভরসা করেছিলেন তাদের মধ্যে এ. কে. খান এবং তার শ্বশুর আব্দুল বারী চৌধুরী ছিলেন অন্যতম। রাস্তাঘাট, বাড়ি-ঘর, পতেঙ্গায় এয়ারপোর্ট ইত্যাদি নির্মাণের জন্য ঠিকাদারদের ব্যাপক চাহিদা ছিল। আর সরকারি বড় বড় নির্মাণ কাজ সরকারের ঘনিষ্ট লোকজনই পেতেন। এ. কে. খানের সে যোগাযোগ বরাবরই ছিল রাজনীতি করার কারণে। এই সম্পর্কের মধ্য দিয়েই আরাকান রোডের মতো বড় বড় প্রকল্পের নির্মাণ কাজের দায়িত্ব পান। পরে শ্বশুরের সহায়তায় নিজে শিল্প-কারখানা গড়ে তোলেন। ১৯৫৪ সালে দাউদ গ্রুপের কাছ থেকে ৫ কোটি পাকিস্তানি রুপি দিয়ে চিটাগাং টেক্সটাইল মিলস লিঃ কিনে নেন। কথিত আছে, তিনি তার রাজনৈতিক যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে ঠিকাদারী, লাইসেন্স এবং ব্যাংক ঋণ সংগ্রহ করতেন।

শিল্প, গণপূর্ত, সেচ, বিদ্যুৎ ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে তিনি নিয়োগ পান ১৯৫৮ সালে এবং ১৯৬২ পর্যন্ত সে পদে বহাল থাকেন। ১৯৬২-৬৮ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য ছিলেন বিরোধী দলের সদস্য হিসেবে। মন্ত্রীত্ব থাকাকালীন তিনি বিভিন্ন খাতের বেশ কিছু কোম্পানি তৈরি করেন। ১৯৫৯ সালে ইস্টার্ণ ইন্স্যুরেন্স লিঃ, এ. কে. খান ডকিং এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিঃ এবং এ. কে. খান লেদার এন্ড সিনথেটিকস লিঃ। ১৯৬০ সালে যৌথ বিনিয়োগে প্রতিষ্ঠা করেন খান এলাইন কর্পোরেশন লিঃ এবং ১৯৬৬ তে এ. কে. খান জুট মিলস লিঃ।

তাঁর শিল্পমন্ত্রীত্ব (১৯৫৮-৬২) থাকার সময় সরকার দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ঘোষণা করে এবং এ সময়  তিনি পাকিস্তানের পূর্বাংশে শিল্প-কারখানা গড়ে তোলার উপর গুরুত্ব দেন। পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (পিআইডিসি)-এর দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য তিনি নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেন। পূর্বের তুলনায় পূর্বাংশের উন্নয়ন বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এ.কে খানের মন্ত্রীত্ব গ্রহণের পূর্বে পূর্ব পাকিস্তানে বড় ধরনের শিল্প-কারখানা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কঠোর বিধিনিষেধ ছিল। তিনি সে জায়গাগুলো বেশ কিছুটা শিথিল করেন। বনশিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশন (১৯৫৯), শিল্প উন্নয়ন ব্যাংক (১৯৬১) গড়ে তুলতে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেন। পূর্ব পাকিস্তানে শিল্প-কারখানা গড়ে তুলতে এই ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

১৯৬০ সালের দিকে, পাট শিল্পের কাঁচামাল এবং যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ইউরোপের দেশগুলো পিআইডিসি’র মাধ্যমে ঋণ প্রদান করতো। অবশ্য শর্ত ছিল যে, যাদের হাতে ৭৫ লাখ টাকার সমপরিমাণ সম্পদ রয়েছে তারাই কেবল পাবে ঋণ সুবিধা। সে হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানের পুঁজিপতিদের সামর্থ্য না থাকায় পশ্চিম অংশের পুঁজির মালিকরাই এই সুবিধা ভোগ করতো। এ. কে. খানের মন্ত্রীত্বের সময় এই ধরনের শর্ত শিথিল করা হয়। এরপর পূর্বাংশে যেখানে ১টি মাত্র জুট মিল ছিল সেখানে প্রায় ৪৫টি জুট মিল স্থাপিত হয়।

তিনি টেক্সটাইল শিল্পেও এ ধরনের পরিবর্তনে উদ্যোগী হন। পূর্বে বেশিরভাগ টেক্সটাইল মিলের মালিক ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের পুঁজিপতিরা, পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তানে নতুন ৩০টি টেক্সটাইল মিল প্রতিষ্ঠিত হয়। মন্ত্রীত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর পর তিনি ১৯৬২-৬৮ পর্যন্ত ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংকের (পরবর্তীতে পূবালী ব্যাংক) চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

এ. কে. খানের পুত্র জহির খানও পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। ১৯৬৯ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত অল পাকিস্তান টেক্সটাইল মিলস এসোসিয়েশন-এর চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং রাজনীতির সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত হন। মুস্তাফিজুর রহমান সিদ্দিকী (এ. কে. খানের বড় মেয়ে লতিফার স্বামী) ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম সারির একজন শিল্পপতি, পাকিস্তান সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৫৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং মেক্সিকোতে পাকিস্তানের দূত হিসেবে কাজ করেন। ১৯৫৮-৬৪ সাল পর্যন্ত এ. কে. খান গ্রুপের ফিন্যান্স ডিরেক্টর হিসেবে যোগদান করেন। সিদ্দিকী আওয়ামী লীগে যোগদান করেন ১৯৬৪ সালে এবং কোষাধ্যক্ষ হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৬৪-১৯৭২ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে অধিষ্ঠিত থাকেন।  ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

পূর্বেই বলা হয়েছে যে, এ. কে. খান পরিবারের মধ্যে রাজনীতি এবং ব্যবসার এক ধরনের যুগলবন্দী সম্পর্ক রয়েছে। পরষ্পর পরষ্পরকে সমৃদ্ধ করে। তার নির্বাচনী এলাকায় সরকারি খরচে অবকাঠামো নির্মাণের জন্য নিজেই ঠিকাদারের দায়িত্ব নিয়েছেন। এসব ‘উন্নয়ন’ কাজের কারণে ‘জনপ্রতিনিধি’ হিসেবে জনগণের সম্মতি আদায় করতে পেরেছেন, রাজনৈতিক ভিত্তি মজবুত হয়েছে। প্রজন্মের মধ্যেও সে ধারা বর্তমান। এছাড়া, তিনি যেমন একদিকে তার ব্যবসায়িক স্বার্থে সরকারের ব্যয় বরাদ্দ দিয়েছেন তেমনি তার সাথে সম্পর্কিত ব্যবসায়ে শুল্ক ছাড় এবং নিজেদের স্বার্থে ও প্রয়োজনে আইন প্রণয়নে ভূমিকা রেখেছেন।

১৯৬০ সালে এ. কে. খান এলাইন ইউনিয়ন এজি, অস্ট্রিয়া (জার্মানির সিমেন্স এজি-র একটি সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান)-এর সাথে যৌথ বিনিয়োগ করে খান এলাইন কর্পোরেশন লিমিটেড নামে। এই কোম্পানি ইলেকট্রিক মটরস, পানির পাম্প, ইলেকট্রিক ফ্যান, এক্সজস্ট ফ্যান, ট্রান্সফরমার, সুইচবোর্ড এবং সুইচগিয়ার উৎপাদন করতো। একই বছর গ্রুপটি আন্ধারমানিক টি কোম্পানি লিঃ স্থাপন করে। পরবর্তী সময়গুলোতে আরও অন্যান্য খাতে বিভিন্ন দেশের সাথে যৌথ বিনিয়োগে চুক্তিবদ্ধ হয়।

৩: স্কয়ার গ্রুপ

স্কয়ার গ্রুপের যাত্রা শুরু হয় ছোট একটা ঔষধের দোকান, ‘হোসাইন ফার্মেসি’ দিয়ে। মেডিক্যাল অফিসার ডা. ইয়াকুব চৌধুরী এই দোকান প্রতিষ্ঠা করেন। ইয়াকুব চৌধুরীর ছেলে স্যামসন এইচ চৌধুরী পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তানে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি তৈরি করে ব্যবসা সম্প্রসারণে উদ্যোগী হন।[9] ঔষধ কোম্পানি হিসেবে দাঁড়ানোর পর গ্রুপটি পরবর্তীতে টয়লেট্রিজ এবং ভোগ্যপণ্য উৎপাদনেও পুঁজি বিনিয়োগ করে। ১৯৫৬ সালে প্রথম ঔষধের কারখানা স্থাপন করেন ইসন্স (ইয়াকুব হোসাইন এন্ড সন্স) নামে। এই ফ্যাক্টরির ম্যালেরিয়ার ঔষধ ব্যাপক জনপ্রিয় হলে স্যামসন তাঁর তিন বন্ধু ডা. কাজী হারুনুর রশীদ, ডা. পি.কে সাহা এবং রাধা বিনোদ রায়কে নিয়ে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি (১৯৫৮) প্রতিষ্ঠা করেন। ঐ সময়টাতে পূর্ব পাকিস্তানে কোন ঔষধ ফ্যাক্টরি ছিল না। ঔষধ শিল্পের বেশীরভাগ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি পুঁজিপতিদের হাতে। যদিও এই খাতে গ্ল্যাক্সো স্মিথক্লাইন, নোভার্টিজ এর মতো বহুজাতিক ঔষধ কোম্পানিগুলোই পুরো পাকিস্তানের ঔষধ শিল্পের উপর একচেটিয়া আধিপত্য করতো। সেখানে স্কয়ার ছিল পূর্বাংশে বাঙালী মালিকানাধীন প্রথম ঔষধ কোম্পানি। গ্রামে স্থাপিত কোম্পানিটির মুনাফা যখন বৃদ্ধি পেতে থাকে তখন এটি শহরে স্থানান্তর করা হয়। 

স্যামসন এইচ চৌধুরী কয়েকবার বাংলাদেশ ব্যাপ্টিস্ট চার্চ ফেলোশিপ (বিবিসিএফ)-এর সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং ১৯৫৬-১৯৬৯ সাল পর্যন্ত ১৪ বছর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি ন্যাশনাল চার্চ কাউন্সিল অব বাংলাদেশ এবং ন্যাশনাল ইভানজেলিক এ্যালায়েন্স এরও সভাপতি হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন।[10]

পাবনায় তিনি প্রথম প্রাথমিক ধরনের প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে কারখানা স্থাপন করেন, প্রাথমিক স্তরে রাষ্ট্রের কাছ থেকে উল্লেখযোগ্য কোন সুবিধা পাওয়া যায়নি। ক্রমান্বয়ে ব্যবসা সম্প্রসারিত হলে তখন লাইসেন্স, ব্যাংক ঋণ ইত্যাদি ধরনের সুবিধা আদায় করতে পারেন। পাকিস্তান সরকারের আঞ্চলিক বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গীর কারণে এ অঞ্চলের অন্যান্য একচেটিয়া সহযোগী বাঙালী পুঁজিপতিদের মতো এ গ্রুপটি ব্যাপকভাবে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা আদায় করতে পারেনি। এছাড়াও অন্যান্য বাঙালী পুঁজিপতিদের চাইতে তুলনামূলকভাবে নবীন হওয়ার কারণে রাষ্ট্র-ব্যবসার যোগাযোগ বা সম্পর্ক ততটা ঘনিষ্ট হয়নি। আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের স্বীকৃতি পাওয়ার পর তার নিজের এবং পরবর্তী প্রজন্মের মধ্য দিয়ে যে সম্পর্কটি হতে দেখা যায়।

৪: আকিজ গ্রুপ

পুঁজি যেমন একটি প্রক্রিয়াগত বিষয় তেমনি এটি একটি সামাজিক সম্পর্ক। পুঁজির বিভিন্ন ধরন থাকলেও মূলত শ্রমশক্তিকে কাজে লাগিয়ে উদ্বৃত্ত মূল্য উৎপাদন এবং তা উশুলের প্রক্রিয়ায় অর্থ, সম্পদ ইত্যাদি পুঁজি ‘হয়ে ওঠে’। পুঁজির ‘হয়ে ওঠা’র প্রক্রিয়া ধারাবাহিক রাখার ক্ষেত্রে ব্যক্তি নানা সম্পর্কের মধ্য দিয়ে সংগঠকের ভূমিকা পালন করে মাত্র। এই প্রক্রিয়ায় আকিজ – যিনি একসময় শ্রমশক্তি বিক্রয় করে জীবন ধারণ করতেন পরবর্তীতে তিনি পুঁজির মালিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। কথিত আছে যে, ১৯৪০ সালে, ১২ বছর বয়সে কলকাতায় চা বিক্রি দিয়ে আয় রোজগার শুরু। রেস্তোরাঁয় শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। পরে ফল, সব্জি ইত্যাদি কেনা-বেচার মধ্য দিয়ে জমাকৃত অর্থ পরবর্তীতে তামাক ব্যবসায় বিনিয়োগ করেন। নিজে একটি বিড়ি ফ্যাক্টরি (আকিজ বিড়ি) স্থাপন করেন খুলনায়। ১৯৫২ সালে অল্প কিছু শ্রমিক নিয়োগ করে বিড়ি তৈরি করে সেগুলো স্থানীয় বাজারে বিক্রয় করতেন। সে সময় ভারত থেকে তামাক পাতা আমদানি এবং স্থানীয় খোলা বাজার থেকে কেনার কারণে তার ব্যয় বেশী হয় এবং যে কারণে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত অন্যান্য বিড়ির (বিধু বিড়ি, ওয়াহাব বিড়ি, সুরমা বিড়ি) সাথে প্রতিযোগিতা পাল্লা দেওয়া সম্ভব হয়ে উঠছিল না। তিনি বিড়ি বিক্রয়ের পাশাপাশি চাল, মশুর ডাল, লবন, তেল এবং বিস্কুট ব্যবসাতেও বিনিয়োগ করেন। ১৯৫৪ সালে আকিজ সরকারি তামাক লাইসেন্স যোগাড় করেন এবং ১৯৫৫ সালে ‘আকিজ বিড়ি’র লেবেল ব্যবহার করেন।

খুলনায় সে সময়ে ১৩টি পাটকল ছিল যারা স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পাটের উপর নির্ভরশীল ছিল। এ পাটের যোগানদাতা ছিল স্থানীয় ঠিকাদার। লাভজনক ব্যবসা হওয়ার কারণে আকিজ অন্যান্য ব্যবসার পাশাপাশি পাটকলে কাঁচাপাট যোগানের ঠিকাদার হিসেবে ব্যবসা শুরু করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি তার কারখানায় ১৫০ জন শ্রমিক নিয়োগ করেন এবং তামাক ও পাট ব্যবসার কলেবর আরও বৃদ্ধি করেন। অন্যদিকে তামাক পাতা এবং পাট কেনার সুবাদে বাগেরহাটে নিত্য যাওয়া-আসার মধ্য দিয়ে এক পাট ব্যবসায়ীর সাথে পরিচয় সূত্রে তার তৃতীয় মেয়েকে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে বিয়ে করেন।

এদিকে ১৯৬০ সালের দিকে তার বিড়ির চাহিদা বেড়ে প্রতিদিন ৪০ লাখে দাঁড়ায় এবং এজন্য আরও বড় ধরনের সুযোগ-সুবিধা ও শ্রমিক নিয়োগ জরুরী হয়ে পড়ে। এজন্য জমি কিনে সেখানে তার কারখানা ও কাঁচাপাটের জন্য গুদাম তৈরি করেন। ১৯৬০ সালের শেষের দিকে বিড়ির চাহিদা প্রতিদিন ৫ মিলিয়নে উন্নীত হয়। অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়ায় যে, ১৯৬৪ সালের দিকে তামাক এবং কাঁচাপাটের জন্য তাকে আরও জমি কিনে আরও বড় কারখানা তৈরি করতে হয়। এছাড়া অন্যান্য লাইসেন্স, পরিবহণ ইত্যাদি যাবতীয় ব্যবস্থাও করতে হয়।

১৯৬৫ সালে আইয়ুব খান সরকার ভারত থেকে যাবতীয় আমদানির ব্যাপারে বিধিনিষেধ আরোপ করার কারণে বিড়ির পাতা আমদানির বিকল্প খুঁজতে হয়। সে সময় কাগজের বিড়ি কোম্পানির মধ্যে নামকরা ছিল আজিজ বিড়ি, কারিগর বিড়ি, জামিল বিড়ি। আকিজ ১৯৭০ সালে নামকরা বিড়ি কোম্পানির মতো কাগজের বিড়ি উৎপাদন করা শুরু করেন ব্যাংক থেকে ৫ লাখ টাকা (তৎকালীন ১ লাখ ৫ হাজার মার্কিন ডলার) ঋণ নিয়ে। ঘনিষ্ট সম্পর্ক থাকার কারণে ব্যাংক ম্যানেজার নিজেই জামানতকারী হন (আকিজের পক্ষে) এবং তাকে বড় ঋণ সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে যাবতীয় ব্যবস্থা করে দেন।

পরবর্তীতে সশস্ত্র যুদ্ধের পরিণতিতে সারা দেশে যখন অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সংকট শুরু হয় তখন তার তামাক এবং পাটের ব্যবসা বন্ধ করে দেন। কিন্তু এর পাশাপাশি আরেকটি উল্লেখযোগ্য কাজ করেন, যেটি তাকে যুদ্ধের পরে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রীয় অবস্থানে নিয়ে আসে। যুদ্ধের কারণে অনেক হিন্দু ব্যবসায়ী তাদের পণ্য এবং সম্পদ ছেড়ে অন্যান্য অঞ্চলে বিশেষ করে ভারতে চলে যান। এই ব্যবসায়ীদের যাবতীয় পণ্য তিনি পানির দরে কিনে নেন এই ধারণা থেকে যে, বাংলাদেশ রাষ্ট্র হওয়ার পর এ সমস্ত পণ্যের চাহিদা বহুগুণ বেড়ে যাবে। পরবর্তীতে তার ধারণার বাস্তব প্রতিফলন ঘটে। যুদ্ধশেষে যখন সে সমস্ত পণ্যের চাহিদা প্রচুর বেড়ে যায় তখন তিনি সেসব চার/পাঁচগুণ দামে বিক্রি করে প্রচুর মুনাফা অর্জন করেন। যা দিয়ে পরে ব্যবসার আরও প্রসার ঘটান।

৫: বেক্সিমকো গ্রুপ

১৯৫৬ সালে ফজলুর রহমান নিউ ঢাকা ইন্ডাস্ট্রিজ লিঃ (এনডিআই) স্থাপন করেন। জুট মিল স্থাপনের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন বাঙালীদের মধ্যে প্রথম। প্রথমাবস্থায় তিনি ওকালতি পেশার পাশাপাশি রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। বেঙ্গল প্রভিন্সিয়াল মুসলিম লীগের কার্যকরী কমিটির সদস্য এবং অল পাকিস্তান মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় সদস্য ছিলেন। ১৯৩৭ সালে, বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৪৩ সালে চিফ হুইপ হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। ১৯৪৬ সালে রাজস্ব মন্ত্রী হন। পরের বছর পুনরায় আইন সভার সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫১ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত খাজা নাজিমুদ্দিনের মন্ত্রীসভায় শিক্ষা, বাণিজ্য ও শরণার্থী মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। মুসলিম লীগের প্রার্থী হিসেবে ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন থেকে। 

যদিও ১৯৭২ সালের দিকে ফজলুর রহমানের পুত্র সোহেল এফ রহমান ও সালমান এফ রহমান বেক্সিমকো প্রতিষ্ঠা করেন কিন্তু তাদের ব্যবসার যাত্রা শুরু পাকিস্তান আমলেই। পিতার মৃত্যুর পর পৈতৃকসূত্রে প্রাপ্ত পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি ব্যবসা, জুট মিলের হাল ধরা, ঔষধ ব্যবসায় বিনিয়োগ ইত্যাদির গোড়াপত্তন তখন থেকেই। উল্লেখ্য যে, বেশীরভাগ ঔষধ ছিল আমদানি নির্ভর এবং ১৯৭০-এর দশক পর্যন্ত ঔষধ শিল্পের সিংহভাগ নিয়ন্ত্রণ করতো বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। স্থানীয় ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো শতকরা মাত্র ১০ ভাগ উৎপাদন করতো। যুদ্ধোত্তর সময়ে দেশে ঔষধের ব্যাপক চাহিদা থাকায় সে সুযোগ গ্রহণ করেন রহমান ভ্রাতৃদ্বয়। আমলাদের সাথে সখ্যতার কারণে আমদানি-রপ্তানি লাইসেন্স পাওয়াতে সুবিধা হয় এবং ঔষধ আমদানির ব্যবসায় পুঁজি বিনিয়োগ করেন।  ১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন বেক্সিমকো ফার্মা লিঃ। ১৯৭৮ সালে রহমানদের পিতার প্রতিষ্ঠিত নিউ ঢাকা ইন্ডাস্ট্রিজ লিঃ – যেটি ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রীয়করণের অধীনে নিয়ে আসা হয়েছিল – সেটি তাদের কাছে ফেরৎ দেওয়া হয়। ১৯৮০ সালে, জার্মানির বায়ের এজি (Bayer AG) এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আপজন ইনক (Upjohn Inc.)-এর পণ্যের উৎপাদন এবং বিপণনের লাইসেন্সি হয় বেক্সিমকো ফার্মা। ১৯৮৩ সাল থেকে পাশাপাশি নিজস্ব পণ্য উৎপাদন শুরু করে এবং ১৯৯২ সাল থেকে বিদেশে পণ্য রপ্তানি শুরু করে।

৬: রহিম আফরোজ গ্রুপ

মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান আব্দুর রহিম, রহিম আফরোজ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা, ১৯৫০ সালে একটি ছোট ট্রেডিং প্রতিষ্ঠান ‘রহিম আফরোজ’ স্থাপন করেন। তারও আগে কলকতাতায় তার ছোট দর্জি দোকান এবং কাপড়ের ব্যবসা ছিল। ১৯৪০ সালের গোড়ার দিকে তিনি ট্রেডিং ব্যবসার সাথে জড়িত হন। দেশভাগের সময় তিনি চট্টগ্রাম চলে আসেন এবং নতুন করে ব্যবসা শুরু করেন। বাজারজাতকরণের লাইসেন্স প্রাপ্তির পর তিনি ডানলপ টায়ার এবং লুকাস ব্যাটারি কেনা-বেচা শুরু করেন এবং ব্যাটারি কারখানা স্থাপন করেন।

১৯৫৯ সালে লুকাস ব্যাটারি বাজারজাত করার শর্তে একটি বৃটিশ কোম্পানির সাথে চুক্তিবদ্ধ হলে তিনি এই ব্যবসার দিকে মনোযোগী হন। বৃটিশ কোম্পানিটি তার জমি লিজ নিয়ে কারখানা স্থাপন করেছিল এবং কোম্পানিটির যাবতীয় উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণের জন্য আব্দুর রহিমের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়। নিজে লেখাপড়ার সুযোগ পাননি কিন্তু তার পরবর্তী প্রজন্মকে তিনি লেখাপড়া করে ব্যবসার হাল ধরার জন্য দেশে-বিদেশে পড়াশুনার জন্য প্রেরণ করেন।

আব্দুর রহিম উপলব্ধি করেছিলেন যে, পাকিস্তানে বিদ্যুতের ঘাটতি রয়েছে, এছাড়া বিদ্যুতের দাম তুলনামূলকভাবে বেশি। তাই তিনি চাহিদার ঘাটতিকে হিসেবে নিয়ে টায়ার বিক্রির পাশাপাশি ছোট-বড় ব্যাটারি প্রস্তুত করা শুরু করলেন। যদিও জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে প্রধান জায়গা ছিল কিন্তু রহিমআফরোজ উৎপাদিত ব্যাটারির দাম তুলনামূলক কম থাকার দিন দিন তার চাহিদা বাড়তে থাকে। বাড়তি চাহিদা পূরণ করতে বাড়তি যোগান এবং বাড়তি শ্রমিক; বাড়তি যন্ত্রপাতি এবং নতুন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রয়োগ রহিমআফরোজকে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির দিকে নিয়ে যায়। পরবর্তী প্রজন্মের প্রতিষ্ঠান কাঠামো বিন্যাসে বৈচিত্র্য, বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ এবং রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধার জন্য লবিং ইত্যাদির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে বৃহৎ পুঁজির প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়।    

শেষ কথা

বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত এ অঞ্চলে অল্প কিছু পুঁজিপতি জায়গা করে নিতে পেরেছিল যদিও জাতীয় অর্থনীতিতে তার অবদান ছিল খুব কম। পশ্চিম পাকিস্তানের বৃহৎ পুঁজিপতিদের শিল্পায়নে অংশগ্রহণ অনেক বেশী ছিল এবং রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা-পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়ার ভাগ তাদের অংশেই বেশী ছিল। সেই তুলনায় এ অঞ্চলের পুঁজিপতিদের মধ্যে যাদের সাথে মুসলিম লীগ সরকার এবং পশ্চিম অংশের বৃহৎ পুঁজিপতিদের সাথে যোগসাজশ বেশী ছিল তারাই রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা বেশী ভোগ করেছিল লাইসেন্স, পারমিট, কর ও শুল্ক ছাড়-রেয়াত, অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা ইত্যাদির মাধ্যমে। এছাড়া আন্তর্জাতিক পুঁজিকে জায়গা করে দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রীয় নানা সুযোগ-সুবিধা যে সব বিদেশী বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান পেতো তাদের সাথে যৌথ বিনিয়োগের মাধ্যমেও স্থানীয় পুঁজিপতিরা তাদের পুঁজি বাড়াতে সক্ষম হয়।

পূর্বাংশের বৃহৎ পুঁজির পরিধির বাইরে যারা ছিল কিন্তু যাদের মধ্যে প্রবণতা ছিল বড় হয়ে ওঠার, তাদের সাথে সরাসরি সম্পর্ক না থাকলেও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে লবিং-এর জন্য নানা ধরনের উদ্যোগ ছিল। বাংলাদেশ হওয়ার পর সরকারের সাথে যারা ঘনিষ্ঠতা বজায় রাখতে পেরেছিল তারাই পরবর্তীতে বৃহৎ পুঁজিপতির কাতারে এসে দাঁড়ায়। 

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নির্মাণ এবং ব্যক্তি পুঁজির মালিকানার বিকাশ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, একদিকে সদ্যজাত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা যেমন কেন্দ্রীভূত হয়েছিল একদলীয় শাসন ব্যবস্থার হাত ধরে এবং এর প্রয়োজনে পুরাতন আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে জিইয়ে রাখার একটা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, অন্যদিকে শিল্পভিত্তির পরিবর্তে পরগাছা ধরনের ব্যক্তি পুঁজির বিকাশ ঘটে যাদের পুঁজির প্রাথমিক উৎস ছিল লুণ্ঠন, চোরাচালান, অবৈধ দখলদারিত্ব, কমিশন, মধ্যস্বত্ত্বভোগী কায়-কারবার ইত্যাদির মাধ্যমে অর্থাৎ বণ্টন এবং বিতরণকেন্দ্রিক কর্মকাণ্ডকে ভিত্তি করে। উৎপাদনশীল ব্যক্তি পুঁজির যুক্ততা হয় পরে। জন্মলগ্নে সাধারণত উৎপাদনী বিনিয়োগের মধ্য দিয়ে ব্যক্তিগত সম্পদের কেন্দ্রীভবন-পুঞ্জীভবন ঘটেনি। বরং তার বিপরীতে উৎপাদিত সম্পদের বণ্টন-বিতরণকে কেন্দ্র করে নব্য এই ধনিক শ্রেণির জন্ম হয় যাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিল সরকার। সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জনগণের যে আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয় তার বিপরীতে পুঁজির আদিম সঞ্চয়ের ধারা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার দরুণ প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ বৈষম্য ও  দুর্ভিক্ষের শিকার হয় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ।[11]

(চলবে)

আগের পর্ব: ২২ পরিবারের অতীত ও বর্তমান-৬

পরের পর্ব: ২২ পরিবারের অতীত ও বর্তমান-৮

মেহেদী হাসান: লেখক, গবেষক। ই-মেইল: mehedihassan1@gmail.com

[1]উৎপাদনী পুঁজিকে অন্যভাবে বলা যায়, Accumulation by extraction, appropriation। অর্থ (মূলধন), উৎপাদনের উপায় (যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল, অবকাঠামো ইত্যাদি), জীবন্ত শ্রমিক যখন একটি উৎপাদন-পুনরুৎপাদনের প্রক্রিয়াতে নিয়োজিত হয় এবং উৎপাদনের এই প্রক্রিয়ায় পুঁজির পুঞ্জীভবন ঘটে। এই প্রক্রিয়ায় সরাসরি জীবন্ত শ্রমিক বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, যন্ত্রপাতিকে (মৃত শ্রম) কাজে লাগিয়ে কাঁচামালকে বাজারের উপযোগী পণ্যে রূপান্তরিত করে। পণ্য উৎপাদন-পুনরুৎপাদনের পর্যায়েই মূলত উদ্বৃত্ত মূল্য উৎপাদন-পুনরুৎপাদন হয়। রাষ্ট্রীয় কিংবা ব্যক্তি পুঁজির মালিক বাজার থেকে এই উদ্বৃত্ত মূল্য উশুল করে। শ্রমিকের শ্রমশক্তির উদ্বৃত্ত অংশের উপর ভিত্তি করে পুঁজি আহরিত  হয় বলে অন্য ভাষায় একে ’Accumulation by extraction’বলা যায়। যার একটি অংশ পুঁজির মালিক পণ্য পুনরুৎপাদনের কাজে নিয়োজিত করে এবং অন্য অংশ থেকে ভোগ-বিলাসের পাশাপাশি রাষ্ট্র, ভূমির মালিক, ব্যবসায়ী-বণিক, ব্যাংক মালিক অর্থাৎ অন্যান্য পুঁজিপতি এবং কর হিসেবে রাষ্ট্রের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া হয়। রাষ্ট্রীয়ভাবে বৈধ, অবৈধ প্রক্রিয়া-পলিসির সাথে সম্পর্কিত উপায়েই পুঁজি বেড়ে ওঠে (যেমন: শ্রমিকের কর্মঘন্টা মজুরী নির্ধারণে ম্যানুপুলেশন, লাইসেন্সিং প্রক্রিয়া, ওভার-আন্ডার ইনভয়েসিং, লিঙ্গ বৈষম্য অনুপাতে মজুরীর হারের তারতম্য বিধান, কর, পণ্যের মূল্য নির্ধারণ ইত্যাদিসহ আরও নানা ধরনের প্রক্রিয়ায়)। একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমানায় এই উৎপাদন-বণ্টন-বিতরণ-ভোগ-সঞ্চালন জনগণের কোন অংশের স্বার্থের সাপেক্ষে পরিচালিত হবে তা যেমন ক্ষমতাবান শাসক শ্রেণির উপর নির্ভর করে তেমনি একটি নির্দিষ্ট উৎপাদন ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় কিংবা ব্যক্তি অর্থাৎ কোন পুঁজির মালিকানা-কর্তৃত্ব-নিয়ন্ত্রণে থাকবে তা নির্ভর করে মূলত রাষ্ট্রীয় নীতি-পরিকল্পনায় কোন শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব এবং আধিপত্য রয়েছে – তার উপর।

[2]‘‘Government ownership of industrial assests jumped from 34% in 1971 to 92% in 1972. That time industrial sector was contributing only 7.8 percent of the country’s GDP of which only 3.7 percent was from large-scale industries’’. Farzana Nahid, Entrepreneurial Capacity and State Incapacity: Family Firms In Bangladesh, Kualalampur, 2017, page-31.

[3]Muhammad Fazlul Hassan Yusuf, Nationalisation of Industries In Bangladesh; Political and Administrative, University of Tasmania, December, 1980, p.-109.

[4]শিরোনাম: দেশে কোটিপতির সংখ্যা বাড়ছে, যুগান্তর প্রতিবেদন, ০৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২, https://www.jugantor.com/todays-paper/second-edition/592815

[5]Farzana Nahid, Entrepreneurial Capacity And State Incapacity: Family Firms in Bangladesh, Kualalampur, 2017, page-26.

[6]—Ibid—page-29.

[7]গবেষক ফারজানা নাহিদ বাংলাদেশের পুঁজির উদ্যেক্তাদের মধ্যে প্রথম সারির ৭টি পরিবারের সাথে রাষ্ট্র-রাজনীতির সম্পর্ক নিয়ে বিস্তৃত গবেষণা করেন।তাঁর গবেষণার সারসংক্ষেপে পাওয়া যায়, একটি দুর্বল চরিত্রের (অগণতান্ত্রিকভাবে দমন-পীড়নে সবল কিন্তু পুঁজির দিক থেকে দুর্বল) রাষ্ট্রের মধ্যেও ব্যক্তি পুঁজির মালিকরা কী প্রক্রিয়ায় বেড়ে ওঠে। তিনি লিখেছেন, ‘‘ This study examines family businesses with strong entrepreneurial capacity, operating in a developing economy governed by what can be characterized as a state with little capacity to nurture vibrant domestic firms. The empirical focus of this study is that of entrepreneurial family firms in Bangladesh and their rise as major corporate enterprises in spite of the state’s incapacity to help foster the development of domestic firms. These family firms emerged in Bangladesh, a weak state marked by persistent political turmoil, a deeply fractured bureaucracy stemming from the country’s double partition history, an inefficient and inexperienced political and judicial institutions, and a governance system heavily plagued by corruption and rent seeking.’’ Farzana Nahid, Entrepreneurial Capacity And State Incapacity: Family Firms in Bangladesh, Kualalampur, 2017. page-iii. তাঁর গবেষণার উপর ভিত্তি করে বর্তমান গবেষণায় ৬টি উদ্যোক্তা পরিবারের নমুনা পর্যালোচনা করা হয়েছে।

[8]https://en.wikipedia.org/wiki/Anwar_Hossain_(industrialist)

[9]https://www.samsonchowdhury.com/en/timeline.php

[10]https://en.wikipedia.org/wiki/Samson_H._Chowdhury

[11]https://www.youtube.com/watch?v=xwWfOmnT9IE

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •