অর্থলগ্নী প্রতিষ্ঠানের সাথে একচেটিয়া গোষ্ঠীর জৈবিক সম্পর্ক

২২ পরিবারের অতীত ও বর্তমান-৩

অর্থলগ্নী প্রতিষ্ঠানের সাথে একচেটিয়া গোষ্ঠীর জৈবিক সম্পর্ক

মেহেদী হাসান

বাংলাদেশে পুঁজিবাদের বিকাশ উল্লেখযোগ্য আকার নিয়েছে। এই বিকাশ ধারায় একদিকে তৈরি হয়েছে পাকিস্তানের ২২ পরিবারের চাইতেও সম্পদশালী বেশ কিছু গোষ্ঠী, অন্যদিকে বৈষম্য ও পরিবেশ বিধ্বংসী তৎপরতাও অভূতপূর্ব মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে ‘উন্নয়ন’ ধারার স্বরূপ বিশ্লেষণ, পুঁজি কেন্দ্রীভবনের ধরন, শ্রেণি বিন্যাস,এই ধারার পুঁজিবাদ বিকাশে রাষ্ট্রের ভূমিকা ইত্যাদি পরীক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান প্রবন্ধ কয়েক কিস্তিতে এই অনুসন্ধান বিশ্লেষণ হাজির করবে। তৃতীয় কিস্তিতে ২২ পরিবারের অর্থ পুঁজির যোগানদাতা হিসেবে ব্যাংক, বীমা এবং রাষ্ট্রের সম্পর্কের ধারাবাহিকতা আলোচনা করা হয়েছে।

নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যকার নানা ধরনের বৈষম্যের তুলনামূলক চিত্রগুলো আগের অধ্যায়গুলোতে তুলে ধরা হয়েছে।সীমাবদ্ধ পরিসরের কথা বিবেচনা করে সেখানে অনেক ধরনের পরিমাপক এবং প্রক্রিয়া বিশদ আলোচনা করা হয়নি, শুধু সম্পর্কের কয়েকটি দিক তুলে ধরা হয়েছে মাত্র। দেখানো হয়েছে, রাষ্ট্রীয় বিভাজনের ফলে যদি উৎপাদন ব্যবস্থায় কোন মৌলিক পরিবর্তন না আসে তাহলে শাসনের ধরন পাল্টালেও শোষণ ব্যবস্থার কোন পরিবর্তন হয় না। পাশাপাশি, ঔপনিবেশিক কাঠামোর মৌলিক উপাদানগুলো (বিশেষ করে আমলাতান্ত্রিক কাঠামো) অক্ষুন্ন থাকায় সমাজের বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা বিকাশের কিছু দিক তুলে ধরা হয়েছে।

পুঁজিবাদী বাজার ব্যবস্থায় উৎপাদন, বণ্টন, ভোগ এই তিন প্রক্রিয়ার মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান যে সম্ভব নয় বাংলাদেশের মানুষ সে অভিজ্ঞতা অর্জন করছে বেশ আগে থেকেই। কখনও ‘মুসলিম জাতীয়তাবাদ’, কখনও ‘বাঙালী জাতীয়তাবাদ’ আবার কখনও ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে’র মধ্য দিয়ে মূল রোগের দাওয়াই না দিয়ে বিভিন্ন সময় বাহ্যিক প্রলেপ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। ফলে, মূল রোগের বহি:প্রকাশ ঘটেছে সমাজের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মধ্য দিয়ে। বৈষম্য হলো একটি ব্যবস্থায় সামাজিক উৎপাদন প্রক্রিয়ার বাহ্যিক ফল। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় উৎপাদন উপকরণের মালিকানা পুঁজিপতি শ্রেণির হাতে থাকার এই ফলাফল সমাজের উপরিকাঠামোতে আবার কোন ঘটনার কারণ হিসেবে প্রভাব বিস্তার করে। যে চিত্র উপরিভাগে দেখা যায় তা আসলে তলের কোন না কোন দ্বন্দ্বের বহি:প্রকাশ। বৈষম্য উৎপাদন এবং পুনরুৎপাদনের ক্ষেত্রে সমাজের অভ্যন্তরস্থ পুঁজিবাদী উৎপাদন পদ্ধতিতে পুঁজির ক্রিয়া-প্রক্রিয়া অর্থাৎ সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় শ্রমশক্তির উদ্বৃত্ত মূল্য শোষণের কাঠামোর ধারাবাহিকতার মধ্য দিয়ে বৈষম্য, বিচ্ছিন্নতা, নৈরাজ্য, সংকট ইত্যাদির উদ্ভব ঘটে। তাহলে, কীসের ভিত্তিতে এই উৎপাদন পদ্ধতিটি চলতে পারে? মার্কস বলছেন,     

‘‘পুঁজিবাদী উৎপাদন-পদ্ধতির ভিত্তিমূল হচ্ছে এই যে, আমাদের বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার ফলে পুঁজিপতির পক্ষে যথার্থ মূল্যে শ্রমিকের শ্রমশক্তি কিনে নিয়ে তা থেকে অনেক বেশী মূল্য আদায় করে নেওয়া সম্ভব হয় — শ্রমশক্তির ক্রয় বাবদ যে দাম দেওয়া হয়েছে তা পুনরুৎপাদন করতে যে সময় কাজ করতে হয়, তদপেক্ষ দীর্ঘতর কালের জন্য তাকে খাটিয়ে। এইভাবে যে উদ্বৃত্ত মূল্য উৎপন্ন হচ্ছে, তা পোপ (ধর্মগুরু) ও কাইজার (শাসকশ্রেণি) থেকে শুরু করে নৈশ চৌকিদার ও অধস্তন কর্মচারী পর্যন্ত বেতনভুক ভৃত্যসহ সমগ্র পুঁজিপতি ও ভূস্বামী শ্রেণির মধ্যে ভাগবাটোয়ারা হয়।…যারা কাজ করে না, তারা সকলেই জীবিকা নির্বাহ করতে পারে কেবল এই উদ্বৃত্ত মূল্যের উচ্ছিষ্টে, কোন না কোনভাবে এ উচ্ছিষ্ট তাদের কাছে এসে পৌঁছায়।’’

‘‘..শ্রমিক ও কৃষক — এই শোষিত শ্রেণিগুলির বিরুদ্ধে বিত্তবান শ্রেণিগুলির, ভূস্বামী ও পুঁজিপতিদের সংগঠিত যৌথ শক্তি ছাড়া রাষ্ট্র আর কিছুই নয়। ব্যক্তি পুঁজিপতিরা (এ ক্ষেত্রে শুধু পুঁজিপতিদের কথা ওঠে, কেননা ও ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট ভূস্বামীরাও প্রধানত পুঁজিপতি হিসাবে কাজ করে) যা অপছন্দ করবে, তাদের রাষ্ট্রও সেটা চাইবে না।…বড় জোর রাষ্ট্র শুধু এইটুকু দেখবে যে বাহ্যিক প্রলেপের যে কাজটা রেওয়াজ (হয়ে) দাঁড়িয়েছে, সেটা যেন সর্বত্র সমভাবে কাজে পরিণত হয়।’’

মুনাফা সংবর্ধন পুঁজিপতির মূল চালিকাশক্তি, তার বিপরীত হওয়ার জো নেই। উদ্বৃত্ত মূল্যের উৎপাদন-বর্ধিত পুনরুৎপাদনের স্বার্থে অর্থাৎ পুঁজির পুঞ্জীভবনের স্বার্থে পুঁজিপতি সবসময় চায় রাষ্ট্রযন্ত্রের উপর দখল কায়েম রাখতে এবং এই প্রক্রিয়ায় যদি প্রাণ-প্রকৃতি-জলবায়ু ধ্বংসপ্রাপ্তও হয় তাতেও তার কোন আপত্তি নেই। জনগণের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয়তার প্রতি মনোযোগ দেওয়ার কোন দায় পুঁজির নেই। মুনাফা হলো সেই প্রাণভোমরা যার খোঁজে তাকে যদি বন উজার করে, নদী দূষিত করে, প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস করে তার আয়ত্তে আনতে হয়; তাই সে করে এবং করবে। অন্যদিকে, পুঁজির এই দুর্বার গতি বাধার সম্মুখীন হয় দু’ভাবে —  এক, উৎপাদনের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সঙ্কট এবং দুই, সমষ্টিগত প্রতিরোধের বাহ্যিক শর্তের কারণে। মুনাফা আকাঙ্ক্ষা এবং প্রতিরোধ; এই দুই বিপরীতধর্মী শক্তিকে সাথে নিয়েই তাকে পথ চলতে হয়।   

পুঁজিবাদী পণ্য উৎপাদন-পুনরুৎপাদন (সরল-বর্ধিত) করতে হলে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত পূরণ করতে হয়। এক, অর্থ পুঁজির যোগান; দুই, উৎপাদন উপকরণের যোগান (মেশিনারি, অবকাঠামো, জমি, কাঁচামাল ইত্যাদি); তিন, সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় শ্রমশক্তির যোগান। পাকিস্তান আমলে এই তিন শর্ত পূরণের অবস্থা বিরাজমান ছিল। সরকার বাড়তি যে দায়িত্বটি পালন করে সেটি হলো রাষ্ট্রীয় নীতি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানকেন্দ্রিক পুঁজিপতিদের একচেটিয়াকরণের পথে যে সকল সীমাবদ্ধতা ছিল সেসব দূর করে। অর্থ পুঁজির যোগানদাতা হিসেবে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক-বীমার নিয়ন্ত্রণভার তুলে দেয় বৃহৎ পরিবারগুলোর হাতে; বিদেশ থেকে যন্ত্রপাতি আমদানীর জন্য বড় আমদানীকারকদের পক্ষে কর-শুল্ক-ভর্তুকি ইত্যাদির ব্যবস্থা করে; পূর্বাংশ থেকে কাঁচামাল পশ্চিমাংশে যোগানোর বন্দোবস্ত করে। এবং সর্বোপরি, পুঁজির জন্য উদ্বৃত্ত মূল্য উৎপাদনের জীবন্ত কারিগর শ্রমিকের উপস্থিতি পূর্ব থেকেই ছিল।

অর্থ পুঁজির যোগানদাতা হিসেবে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক-বীমার নিয়ন্ত্রণভার তুলে দেয় বৃহৎ পরিবারগুলোর হাতে; বিদেশ থেকে যন্ত্রপাতি আমদানীর জন্য বড় আমদানীকারকদের পক্ষে কর-শুল্ক-ভর্তুকি ইত্যাদির ব্যবস্থা করে; পূর্বাংশ থেকে কাঁচামাল পশ্চিমাংশে যোগানোর বন্দোবস্ত করে।

মুনাফা সংবর্ধনের জন্য অর্থ পুঁজির যোগান সেক্ষেত্রে প্রাথমিক শর্ত। পুঁজির আদি সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে লুণ্ঠন,দখল বিভিন্ন দেশের ইতিহাসে যেমন দেখা যায় তেমনি তার (পুঁজির প্রাথমিক আহরণ) আবির্ভাবের পর সমাজে সঞ্চিত সেই পুঁজির উপর দখল নেওয়ার জন্য ব্যক্তি পুঁজিপতিদের মধ্যে দ্বন্দ্বও সর্বত্র আমরা দেখতে পাই। এ পর্যায়ে গোষ্ঠীগত আদি ধরনের লুণ্ঠন প্রক্রিয়াতে না গিয়েও রাষ্ট্রীয় যোগসাজশে এবং সম্পর্কিত থেকে পুঁজি আহরণ সম্ভব। সমাজে তখন এই প্রক্রিয়া আত্মীকৃত হয়ে যায় এবং বৈধতা পায় স্বাভাবিক ক্রিয়া হিসেবে। পাকিস্তান আমলে পাঞ্জাবের কোন কোন পরিবার সম্পর্কে এ রকমের ধারণা চালু ছিল যে, তারা শূণ্য হাতে একমাত্র নিজেদের পরিশ্রমের মাধ্যমে পুঁজির মালিক হতে পেরেছেন। বলাই বাহুল্য, কেবলমাত্র নিজেদের দৈহিক এবং মানসিক পরিশ্রমের মাধ্যমে কারো পক্ষে বিশাল পুঁজির মালিক হওয়া সম্ভব নয়; এটি একটি মিথ। এ সমস্ত পরিবারের সামাজিক-রাজনৈতিক সম্পর্কের ইতিহাস একটু যাচাই করলেই তার সত্যতা মেলে। উদাহরণ হিসেবে ভালিকা এবং জাফর-উল-আহসান গ্রুপ এই দু’টো পরিবারের উল্লেখ করা যায়।

ভালিকা গ্রুপ হলো পাকিস্তানের একচেটিয়া পরিবারগুলোর মধ্যে বহু পুরনো গ্রুপ। অন্যদিকে আহসান গ্রুপ ছিল মাঝারি মাপের গ্রুপ যার উত্থান ঘটে ’৬০ এর দশকে। এই পরিবারের উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠার নেপথ্যে প্রধান ভূমিকা পালন করে রাষ্ট্র। সামরিক এবং আমলাদের সাথে ঘনিষ্ট সংশ্লিষ্টতার কারণে রাষ্ট্রীয় নানা সুযোগ-সুবিধা লাভের মধ্য দিয়ে এই পরিবারটি নতুন উদ্যোক্তা হিসেবে শুরু করে এবং পুঁজির বৃহৎ পরিসরে জায়গা করে নেয়। ষাট দশকের পুরো সময়টা জুড়ে এ ধরনের ছোট-বড় অসংখ্য ভুঁইফোড় পুঁজিপতির জন্ম হয়।  

আহসান গ্রুপ ছিল মাঝারি মাপের গ্রুপ যার উত্থান ঘটে ’৬০ এর দশকে। এই পরিবারের উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠার নেপথ্যে প্রধান ভূমিকা পালন করে রাষ্ট্র। সামরিক এবং আমলাদের সাথে ঘনিষ্ট সংশ্লিষ্টতার কারণে রাষ্ট্রীয় নানা সুযোগ-সুবিধা লাভের মধ্য দিয়ে এই পরিবারটি নতুন উদ্যোক্তা হিসেবে শুরু করে এবং পুঁজির বৃহৎ পরিসরে জায়গা করে নেয়।

এটি সম্ভব হয়েছে শাসকবর্গের নীতিগত অবস্থানের কারণে। গোড়া থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীদের সম্পর্কে শাসকশ্রেণি কী ধারণা পোষণ করতো এবং তাদের নীতিগত অবস্থানের কারণে জনগণকে কী ধরনের দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে তার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় প্রভাস চন্দ্র লাহিড়ীর বইতে। এখানে তার ক্ষুদ্র একটি অংশ তুলে ধরা হলো। তাঁর ‘পাক-ভারতের রূপরেখা’-তে তিনি বিপ্লবী সংস্থা ‘যুগান্তর’ দলের একজন প্রবীণ নেতা শ্রীভূপেন্দ্রকুমার দত্তের দেওয়া একটি বিবৃতির উদাহরণ টেনে বলছেন,

‘‘ আমার ব্যক্তিগত মতামত ছাড়াও বাংলাদেশের আর একজন প্রখ্যাত বিপ্লবী নেতার, যাঁর পাকিস্তান সম্পর্কে বিশেষ অভিজ্ঞতা আছে, তাঁর মতও এখানে তুলে ধরছি। এই বিপ্লবী নেতা ও আমার বন্ধুটি আর কেউ নন তিনি হলেন ভূতপূর্ব বিপ্লবী সংস্থা যুগান্তর দলের একজন প্রবীণ নেতা শ্রীভুপেন্দ্রকুমার দত্ত মহাশয়। তিনি পাকিস্তান-পার্লামেন্ট ও পরবর্তীকালে, পূর্ব পাকিস্তান বিধানসভারও সদস্য ছিলেন; সুতরাং তাঁর অভিজ্ঞতাপ্রসূত মতও বিশেষ গুরুত্বেরই দাবি রাখে। ভারত সরকার পাকিস্তানের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাস্তুত্যাগের কারণ নির্ধারণের জন্য যে বিচার বিভাগীয় ‘কাপুর কমিশন’ গড়েছিলেন, সেই কমিশনের কাছে ‍ভূপেন্দ্রবাবু যে বিবৃতি দেন, সেই বিবৃতি থেকে পাকিস্তানে নীতি সম্পর্কিত অংশের কিছুটা এখানে উদ্ধৃত করছি। সেই নীতিটুকুর কথাটা ভালভাবে মনে রাখলেই পাকিস্তানের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ঘটিত সব ঘটনার সব প্রশ্নের মীমাংসার সূত্রও তার মধ্যেই পাওয়া যাবে। ‘কাপুর কমিশনের’ কাছে ভূপেনবাবু বলেছিলেন:

‘‘১৯৫১ সালে তিনি, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের একজন মন্ত্রীর (তাঁর নাম প্রকাশ করা স্বাভাবিক কারণেই সঙ্গত মনে করেননি) বিশেষ ঘনিষ্ঠ বন্ধু হন। সেই বন্ধুটি তাঁকে যা বলেছিলেন, তা-ই তিনি এখানে হুবহু তুলে ধরেছেন। সেই মন্ত্রী বন্ধুটি বলেছিলেন যে, পাকিস্তান সরকারের সেক্রেটারি জেনারেল, তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রীর সাথে পরামর্শক্রমে পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে দু’টি নীতি নির্ধারণ করেন।

সেই নীতি দু’টি হচ্ছে —

(১) দু’দিন আগে হোক, বা পরে হোক, পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তান থেকে বের হয়ে যাবেই; সুতরাং পূর্ব পাকিস্তানের উন্নতির জন্য বিশেষ কিছু খরচ না করে, শুধু যতটুকু না করলেই নয়, ততটুকুই কেবল করতে হবে। পূর্ব পাকিস্তানের জন্য খরচা কম করে তাই দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানকে গড়ে তুলতে হবে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে যে তাতে যেন সেদিকে সন্দেহের উদ্রেক না হয়।

(২) মধ্যবিত্ত শ্রেণির সংখ্যালঘু সম্প্রদায় কখনই পাকিস্তানের বন্ধু (বা অনুরক্ত নাগরিক) হবে না; সুতরাং তাঁদের সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা সর্ব প্রযত্নেই চালিয়ে যেতে হবে। তবে, বিশেষ কারণেই এটা মনে রেখে কাজ করতে হবে যে, ঐ সরিয়ে দেওয়ার কাজটা যেন ধীরে ধীরে হয়। হঠাৎ ব্যাপকাকারে দেখা না দেয়। অধিকাংশ রাজনীতিক নেতারাই দেশত্যাগ করে গিয়েছেন। আজও  যাঁরা আছে, তাঁদের মধ্যবিত্ত শ্রেণির সমর্থকদের যদি চাকরি-বাকরি থেকে ক্রমশ সরিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে সেই সব নেতারাও সমর্থকহারা হীনবল হয়ে পড়বেন। দরিদ্র মুসলমান সম্প্রদায়ের দোহাই দিয়ে এই কাজ ধীরে ধীরে চালিয়ে যেতে হবে। যদি হঠাৎ কোন অঞ্চলে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের জনতা উত্তেজিত হয়ে ব্যাপকভাবে কিছু করতে আরম্ভ করে, তাহলে লক্ষ্য রাখতে হবে যে সেই জনতা যেন শাসনের বাইরে একদম চলে না যেতে পারে। ঘটনা হয়ে যাওয়ার পরে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বা তাঁদের নেতারা যতই চিৎকার করুন না কেন, সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়ার দরকার নেই।..’’

এবার প্রভাস চন্দ্র লাহিড়ী বলছেন,

‘‘ এটাই হল পাকিস্তানের নীতি। যাঁরা এখনও পাকিস্তানে আছেন বা ছিলেন, তাঁরা এই নীতির প্রয়োগ মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছেন ও করেছেন। পাকিস্তানের রাষ্ট্র পরিচালনার নীতির একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্যই এই যে, দেশ বিভাগের, তথা স্বাধীনতার সাথে সাথেই তদানীন্তনকালের প্রধানমন্ত্রী ও সেক্রেটারি জেনারেল মিলে যে নীতির ছক কেটে রেখেছেন এবং যা কায়েদ-ই-আজম মহম্মদ আলি জিন্নাহরও আশীর্বাদপুষ্ট হয়েছিল, সেই নীতিরই প্রয়োগ করে চলেছেন সব গভর্নমেন্টই। ছকের বাইরে কোনও মুসলিম লীগ সরকারই  — লিয়াকত আলি সাহেবের মুসলিম লীগ থেকে আরম্ভ করে আজকের আয়ুব সাহেবের মুসলিম লীগ সরকার পর্যন্ত — কেউই যান নি।’’

দেশের পুঁজিবাদী উৎপাদন-পুনরুৎপাদন (শিল্প-কৃষি-সংস্কৃতি) কী ধরনের হবে তার প্রধান দিক-নির্দেশনা নির্ভর করে শাসকশ্রেণির রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী অনুযায়ী তৈরীকৃত রাষ্ট্রের উপর। বিশেষ করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত শাসকদের দৃষ্টিভঙ্গী উৎপাদন ব্যবস্থায় প্রভাবক এবং অনুঘটকের ভূমিকা পালন করে। আগের অধ্যায়ে আমরা দেখেছি বৃটিশ আমলে অল্প সংখ্যক মুসলিম ব্যবসায়ী বৃটিশ পুঁজির সহায়তায় প্রভূত ধন-সম্পত্তি অর্জন করেছিল। নতুন রাষ্ট্রে এই ব্যবসায়ী পুঁজিকে উৎপাদনী পুঁজিতে রূপান্তরের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল যার এক ধরনের প্রতিফলন রাষ্ট্র নির্মাতা-পরিকল্পনাবিদদের মধ্যে আমরা দেখতে পাই। কিন্তু বণিক পুঁজিকে উৎপাদনী পুঁজিতে রূপান্তর করতে হলে দীর্ঘ একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। মার্কস তার বর্ণনা করছেন এভাবে —  

‘‘..খুশী মাফিক যে কোন একটি পরিমাণ অর্থ অথবা মূল্যকে পুঁজিতে রূপান্তরিত করা যায় না। এই রূপান্তর ঘটাতে হলে,পূর্বশর্ত হিসেবে অর্থ বা পণ্যের মালিকের হাতে একটি ন্যূনতম পরিমাণ অর্থ বা বিনিময় মূল্য থাকা দরকার। অস্থির পুঁজির (মোট পুঁজির যে অংশটি শ্রমিকের শ্রমশক্তি কেনার জন্য পুঁজিপতি ব্যয় করেন ) নূন্যতম পরিমাণ হচ্ছে সারা বছর প্রতিদিন উদ্বৃত্ত মূল্য উৎপাদনের জন্য একটি শ্রমশক্তি ক্রয়ের মূল্য।’’ 

এর পরেই বলছেন,

‘‘…অর্থ বা পণ্যের মালিক বাস্তব ক্ষেত্রে পুঁজিপতিতে পরিণত হয় কেবলমাত্র তখনই যখন উৎপাদনের জন্য আগাম দেওয়া ন্যূনতম অর্থের পরিমাণ মধ্যযুগের ঊর্দ্ধতম পরিমাণকেও বহুলাংশে ছাড়িয়ে যায়। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যেমন তেমনি এখানেও হেগেলের আবিষ্কৃত নিয়মটির (তাঁর ‘লজিক’ নামক রচনায়) যথার্থতা প্রমাণিত হয়, নিয়মটি এই যে, পরিমাণগত পার্থক্য একটি নির্দিষ্ট সীমা ছাড়িয়ে গেলে গুণগত পরিবর্তন এসে যায়।

নিজেকে পুঁজিপতিতে রূপান্তরিত করতে হলে একজন আলাদা অর্থ বা পণ্যের মালিকের দখলে যে নূন্যতম পরিমাণ মূল্য থাকা প্রয়োজন সেটি পুঁজিবাদী উৎপাদনের বিকাশের বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন হয় এবং কোন একটি বিশেষ স্তরে উৎপাদনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সেগুলির বিশেষ টেকনিক্যাল অবস্থা অনুযায়ী বিভিন্ন হয়। উৎপাদনের কোন কোন ক্ষেত্রে, এমন কি পুঁজিবাদী উৎপাদনের একেবারে শুরুতেই, এমন একটি পরিমাণ পুঁজির প্রয়োজন হয় যা তখনও কোন একজন ব্যক্তির হাতে থাকে না।’’

পুঁজির পুঞ্জীভবনের সে সময়টাতে ইউরোপের রাষ্ট্রগুলো যেভাবে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে তার উদাহরণ দিয়ে এর পরপরই মার্কস বলছেন,

‘‘..এর ফলে যেমন ফ্রান্সে কলবেরের যুগে তেমনই আমাদের সময় পর্যন্ত কয়েকটি জার্মান রাষ্ট্রে ব্যক্তিবিশেষের প্রতি আংশিকভাবে রাষ্ট্রীয় ভর্তুকির উদ্ভব হয়; আংশিকভাবে উদ্ভূত হয় শিল্পের ও বাণিজ্যের বিশেষ বিশেষ শাখায় শোষণের জন্য আইনসঙ্গত একচেটিয়া অধিকার নিয়ে যৌথ সমিতি, যেগুলি আধুনিক জয়েন্ট স্টক কোম্পানিগুলির পূর্বগামী।’’

জার্মান পুঁজির বিকাশের একটি স্তরে রাষ্ট্র যেমন আংশিকভাবে ভর্তুকি প্রদানের মাধ্যমে ব্যক্তি পুঁজিকে পৃষ্ঠপোষকতা করে, পাকিস্তান রাষ্ট্রের কর্ণধারগণ পুঁজির বিকাশে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করে ব্যাপকভাবে। পাকিস্তান পুঁজির বিকাশের পর্বগুলো যদি বিবেচনা করি তাহলে দেখবো, পাকিস্তানের শিল্পায়ন কয়েকটি ধারায় বিকশিত হয়েছিল, বিশেষ করে পশ্চিমাঞ্চলে। ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত যেসব সরকার ক্ষমতায় আরোহণ করে তাদের মধ্যে শিল্পায়ন প্রক্রিয়ার গুণগত দিকটির চাইতে পরিমাণগত জায়গাটি ছিল বিবেচনার প্রাধান্যে। অর্থনীতির কয়েকটি ধাপ পর্যবেক্ষণ করে রশিদ আমজাদ এই ধারাবাহিকতাকে কয়েকটি পর্বে ভাগ করেছেন। যেমন  —

ধাপসমূহ

সময়কাল

শিল্পায়নের ধরন এবং ফলাফল

প্রথম

১৯৪৭ -’৫২

বণিক পুঁজির আধিপত্য

দ্বিতীয়

১৯৫২ -’৫৬

আমদানি বিকল্প শিল্প বিকাশের উদ্যোগ; বণিক পুঁজির শিল্প পুঁজিতে রূপান্তর

তৃতীয়

১৯৫৬ -’৫৯

আমদানি বিকল্প শিল্প প্রবৃদ্ধির সীমা সঙ্কোচন

চতুর্থ

১৯৫৯ -’৬৫

বৈদেশিক সাহায্য নির্ভর শিল্পের বিকাশ

পঞ্চম

১৯৬৫ -’৭০

বৈদেশিক সাহায্যের ক্রমাগত হ্রাস এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন শিল্প বিনিয়োগের ধীরগতি

 

১৯৬৮ –’৭১

রাজনৈতিক অস্থিরতা – রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব এবং অর্থনৈতিক অবস্থার চূড়ান্ত অবনতি

ষাটের দশকে পাকিস্তানে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সরকারি প্রভাবে ব্যক্তি মালিকানাধীন শিল্প প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রত্যক্ষ প্রভাব হিসেবে ব্যক্তি মালিকানাধীন শিল্পের ধরন, গতি-প্রকৃতি কী হবে তার দিক-নির্দেশনা ঠিক করার জন্য নীতি-পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।পরোক্ষ প্রভাবের মধ্যে রয়েছে শিল্প প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে ব্যক্তি মালিকানাধীন শিল্প-প্রতিষ্ঠানের (আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে, ক্ষমতাসীন দলের সাথে যে সমস্ত শিল্প মালিকদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল সে সব শিল্প-কারখানার স্বার্থে) মুনাফার পরিমাণ এবং হার বাড়ানোর স্বার্থে রাজস্ব, মুদ্রা এবং বাণিজ্যিক পরিমাপকগুলোকে সাজানো। বেসরকারি খাতে শিল্প বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য দেশের অভ্যন্তরে এবং বাইরে সরকারের হাতে যে সব স্থায়ী-অস্থায়ী সম্পদ ছিল তার একটি তালিকা তৈরী করে তার মধ্যে অনেক ধরনের প্রকল্পকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এ বিষয়ে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা এবং তার ফলাফল নিয়ে আমরা পরবর্তী অধ্যায়ে আলোচনা করবো।

শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের বৃহৎ একচেটিয়া পরিবারগুলোর ইতিহাস পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, বেশীরভাগ ক্ষেত্রে এ সমস্ত পরিবারের শুরু হয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে। পরবর্তীতে কোরিয়ান উলম্ফনের পর এই পুঁজির একটি অংশ শিল্প-কারখানা (টেক্সটাইল থেকে শুরু করে কেমিক্যাল-ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প পর্যন্ত) স্থাপনে নিয়োজিত হয় এবং ব্যাংক, বীমা ও অন্যান্য মধ্যস্থতাকারী অর্থ পুঁজির যোগানদার প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পর্কিত হয়। ইস্পাহানি এবং হাবিব গ্রুপের কথা প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যারা তৎকালীন সময়ে বৃহৎ কোম্পানিগুলো নিয়ন্ত্রণ করার পাশাপাশি দেশের অধিকাংশ মাঝারি ও ক্ষুদ্র ম্যানুফ্যাকচারিং প্রতিষ্ঠানগুলোকেও আয়ত্ত্বাধীন করেছিল।

কোরিয়ান উলম্ফনের পর এই পুঁজির একটি অংশ শিল্প-কারখানা (টেক্সটাইল থেকে শুরু করে কেমিক্যাল-ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প পর্যন্ত) স্থাপনে নিয়োজিত হয় এবং ব্যাংক, বীমা ও অন্যান্য মধ্যস্থতাকারী অর্থ পুঁজির যোগানদার প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পর্কিত হয়। ইস্পাহানি এবং হাবিব গ্রুপের কথা প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়

একচেটিয়া পরিবারগুলোর আধিপত্য এবং বিস্তার নিয়ে তৎকালীন পাকিস্তান টাইমস-এ অনেক লেখালেখি হয়। তার কিছুটা আগের অধ্যায়ে উল্লেখ করা হয়েছে। রশিদ আমজাদ এ ধরনের কয়েকটি রিপোর্টের কথা উল্লেখ করেছেন তার বইতে। ২০ নভেম্বর, ১৯৬১ সালের পাকিস্তান টাইমস-এর একটি রিপোর্টের বিষয়ে তিনি বলেছেন, ‘‘ ..সংরক্ষণ নীতি (পশ্চিম পাকিস্তানকেন্দ্রিক) গ্রহণের কারণে শিল্পের দ্রুত বৃদ্ধি এবং বিকাশের সুযোগ তৈরী করেছে। অপরদিকে এই সুযোগ অল্প সময়ের মধ্যে সম্পদের দ্রুত কেন্দ্রীভবনকেও সম্ভবপর করেছে। এই কেন্দ্রীভবন হলো…সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা, আমদানী অনুমোদন, শিল্প লাইসেন্স এবং সর্বোপরি বর্ধিত দাম উশুলের সুযোগপ্রাপ্তির ফলাফল’’ (ইসলাম জি. ‘Industry’s need for public goodwill’)। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী ম. শোয়েব-এর উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি জানাচ্ছেন, ‘পাকিস্তানে বেশীরভাগ শিল্প ক্ষুদ্র একটি পারিবারিক গ্রুপের হাতে সীমাবদ্ধ’ (পাকিস্তান টাইমস, ১২ জানুয়ারি ১৯৬৩)। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আয়ুব খান ও এটি স্বীকার করেছেন। যদিও তার আমলে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় নতুন অনেকের উত্থান ঘটে একই প্রক্রিয়ায়। প্রেসিডেন্টের উদ্বৃতি দিয়ে রশিদ আমজাদ জানাচ্ছেন, ‘অল্প কিছু গ্রুপের ব্যক্তিবর্গ শিল্প, ব্যাংক এবং বীমা কোম্পানিগুলোকে পরিচালনা করছে অথবা এসব ব্যক্তিবর্গ শিল্প-প্রতিষ্ঠানের পরিচালনার এজেন্ট হিসেবে ভূমিকা পালন করছে এবং পাশাপাশি তারা শিল্পপণ্যের পাইকারি ও খুচরা ব্যবসাও পরিচালনা করছেন (পাকিস্তান টাইমস, ২৭ এপ্রিল ১৯৬৫)’।

পুঁজিপতিদের দৌরাত্ম্য এমন পর্যায়ে উন্নীত হচ্ছিল যে, সে সময় শাসকদের নিজেদের মধ্যেও দ্বন্দ্ব বিভিন্ন সময় প্রকাশ পেতো খোদ সংসদে। মুল হক ছিলেন সে সময় বিরোধী দলের সাংসদ। তার বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে টাইম পত্রিকায় যে সংবাদ ছাপা হয় তার উল্লেখ করে রশিদ আমজাদ জানাচ্ছেন,

‘‘সরকারের ছত্রছায়ায় পিআইসিআইসি (পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্রেডিট এন্ড ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন) কার্টেলগুলোকে তৈরী করছে। প্রতিষ্ঠানটি গুটিকয়েক পরিবারকে ঋণের বরাদ্দ বহুগুণে বাড়িয়ে তাদের বেড়ে উঠতে সহযোগিতা করছে। মোট ঋণের ২৪৪ কোটি রুপির মধ্যে ১৩৮ কোটি রুপি বিতরণ করা হয়েছে ২১টি পরিবারের মধ্যে। এবং খুব দ্রুতই তার সংখ্যা ২২টিতে গিয়ে দাঁড়াবে (পাকিস্তান টাইমস, ১ অগাস্ট, ১৯৬৩)। (১৯৬৩ সালে ‘ব্যবসায়িক অসদুপায়, অতিরিক্ত দাম নির্ধারণ এবং ভোক্তাদের ঠকানো রোধের উদ্দেশ্যে The Anti-Cartel Law Study Group (Government of Pakistan, 1965) প্রতিষ্ঠা করা হয় ১৯৬৩ সালে। গ্রুপটি সে উদ্দেশ্যে ১৯৬৫ সালে একটি রিপোর্ট জমা দেয়। বিরোধী সাংসদ এবং কোন কোন পত্রিকার বিরোধীতা সত্ত্বেও সে সময় রিপোর্টটিকে জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়নি।)’’।১০

কোন কোন গবেষকের ধারণা অনুযায়ী, আয়ুবামলে সরকারি প্রশাসন পরিচালিত হতো এডাম স্মিথ-এর নীতির আলোকে।১১ ‘অদৃশ্য হস্ত’ যাতে ঠিকঠাকভাবে কাজ করতে পারে এজন্য বাজারের উপর থেকে সরকারের ‘দৃশ্যমান হস্ত’ সরিয়ে নেওয়া হয়। নিয়ন্ত্রণ এবং নানা প্রকারের বিধি-নিষেধ তুলে নেওয়া হয়। ফলে, অতি ‍উচ্চহারে উৎপাদনী এবং বাণিজ্যিক মুনাফা লাভের আকাঙ্ক্ষায় পুঁজির মালিকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়। এর প্রভাব পড়ে সমাজের সর্বত্র। পশ্চিমাংশের উৎপাদিত শিল্পপণ্য বিক্রির প্রধান বাজারে পরিণত হয় পূর্বাংশ।     

পুঁজির যোগানদাতা হিসেবে যে সমস্ত প্রতিষ্ঠান বিশেষ ভূমিকা পালন করে তার মধ্যে লগ্নী পুঁজির ভূমিকা এবং যোগসূত্রটি উল্লেখ করা প্রয়োজন। কারা এই প্রতিষ্ঠানসমূহের নীতি নির্ধারক, কারা পরিচালক, রাষ্ট্র কীভাবে এদের পৃষ্ঠপোষকতা করে এই বিষয়গুলো সেক্ষেত্রে প্রধান বিবেচ্য। পাকিস্তান আমলে পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্রেডিট এন্ড ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন (পিআইসিআইসি), ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক অব পাকিস্তান (আইডিবিপি), হাউজ বিল্ডিং ফাইনান্স কর্পোরেশন (এইচবিএফসি), ন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট ট্রাস্ট (এনআইটি) প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানগুলোর পুঁজির লগ্নীর ধরন দেখলে দেখা যায়,এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছিল মূলত: পশ্চিমকেন্দ্রিক শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা বিশেষ করে ব্যক্তি মালিকানাধীন খাতে পুঁজির লগ্নী করা এবং ব্যক্তি পুঁজির বিকাশ ঘটানোর স্বার্থে।

আগের অধ্যায়েই বলা হয়েছে যে, পাকিস্তানের ব্যাংক এবং বীমা কোম্পানিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করতো একচেটিয়া পরিবারগুলো। তারা কেবল যে ব্যাংক এবং বীমাগুলোর উপর দখলিস্বত্ব কায়েম করেছিল তাই নয়; ঋণ বিতরণী সংস্থা পিআইসিআইসি-এর মধ্যেও ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে ছিল। তার কিছু নমুনা পর্যায়ক্রমে নীচের সারণীগুলোতে তুলে ধরা হলো। 

কতিপয় অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণের বরাদ্দ, ১৯৬১-৬২ সাল থেকে ১৯৬৬-৬৭ সাল

(কোটি রুপি)১২

সাল

পিআইসিআইসি

আইডিবিপি

এইচবিএফসি

 

পূর্ব

পশ্চিম

পূর্ব

পশ্চিম

পূর্ব

পশ্চিম

১৯৬১-৬২

২.৯

৯.৫

৮.৭

৮.১

১৯৬২-৬৩

৪.৭

১০.৩

১১.০

৬.৯

১.২

৩.৭

১৯৬৩-৬৪

০.৯

১৩.২

১৯.৫

১৪.৯

৩.২

৩.২

১৯৬৪-৬৫

৩.৮

২২.৭

৮.৬

১৫.০

৩.৫

৩.৬

১৯৬৫-৬৬

৭.৬

১৪.০

৪.৭

১৪.৯

৩.২

২.৯

১৯৬৬-৬৭

১৫.১

১৭.৩

৩.০

৩.০

  সূত্র: এম. এ. রহমান-এর ভিত্তিতে, ‘‘ Regional distribution by certain financial institutions, 1961-’62 to 1966-’67’’, table-1.8, Anil Chatterjee, Ranajit Dasgupta, Kalyan Dutt – Bangladesh economy an analytical study ,1973, page-25.

১৯৬১ সাল থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত অধিকাংশ ঋণের বরাদ্দ পশ্চিম পাকিস্তানি পুঁজিপতিদের হাতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত রাজনৈতিকভাবেই নেওয়া হয়। ১৯৬১-৬৪ সালে যদিও পূর্বাংশের ব্যবসায়ীদের জন্য মোট ঋণের বরাদ্দ ছিল কিন্তু মোট পরিমাণের হিসাবে তুলনায় যথেষ্ট কম। যেমন, তিনটি প্রতিষ্ঠান মিলিয়ে একত্রে পূর্ব পাকিস্তানের যেখানে বরাদ্দ প্রায় ৫২ কোটি রুপি সেখানে পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যবসায়ী এবং শিল্পপতিদের জন্য বরাদ্দ ৭০ কোটি রুপি। পরিমাণগত বরাদ্দের পাশাপাশি গুণগত অবস্থানটি তাৎপর্যপূর্ণ। পশ্চিম পাকিস্তানে যেখানে শিল্পপতিদের জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে বরাদ্দ দেওয়া হয় সেখানে পূর্ব অংশের যে সমস্ত ব্যবসায়ীর সাথে ক্ষমতাবানদের যোগসাজশ ভাল ছিল তারা সে পুঁজি যোগাড় করতে পারে।

১৯৫৯ সালের প্রথম দিকে সরকারের তরফ থেকে বিশাল আকারের সুযোগ-সুবিধা প্রদানের ইঙ্গিত বড়-ছোট ব্যবসায়ীদের মধ্যে দ্রুত বিত্তবান হওয়ার প্রতিযোগিতায় আরও এক ধাপ এগিয়ে দেয়। স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের ঋণ তদন্ত কমিটির পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী সার্বিকভাবে ব্যাংকগুলোতে প্রস্তাবিত মোট ঋণের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ ২২২ জনের মধ্যে বণ্টিত হয়েছে বা তারা ব্যবহার করেছে। এ ধরনের সরকারি-বেসরকারি আরও নানান সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্ত হয়ে দেশের মোট শিল্প সম্পদের অর্ধেকেরও বেশী ২৪ জন বৃহৎ পুঁজির মালিকের হাতে জমা হয়; যাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল দেশের প্রায় ৩০০০ ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান।১৩

১৯৭০ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানে ১৭টি ব্যাংক স্থাপন করা হয় যার মধ্যে ৭টিতেই সরাসরি নিয়ন্ত্রণ ছিল একচেটিয়া পরিবারগুলোর। এই সাতটির মধ্যে সবচাইতে ছোট ব্যাংক; সারহাদ ব্যাংক নিয়ন্ত্রিত হতো ফারুক গ্রুপের দ্বারা। ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠা করা হয় ষাট দশকের শেষের দিকে। বাদবাকীগুলোর অস্তিত্ব ষাট দশকের প্রথম থেকেই ছিল। ১৯টি বিদেশী মালিকানাধীন ব্যাংকসহ পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠিত সমস্ত ব্যাংকের মোট সঞ্চয়ের শতকরা প্রায় ৬০ ভাগ এই ব্যাংকগুলোতে জমা হতো এবং মোট ঋণ এবং অগ্রিম অর্থ প্রদান করা হতো শতকরা প্রায় ৫০ ভাগের মতো। রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত ব্যাংক (দ্যা ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান) এবং পাকিস্তানের বাইরে স্থাপিত অন্যান্য ব্যাংকগুলোকে বাদ দিলে মোট সঞ্চয়ের শতকরা প্রায় ৮৬ ভাগ এবং  মোট ঋণ ও অগ্রিম অর্থের শতকরা প্রায় ৮৪ ভাগ ব্যক্তি মালিকানাধীন এই ব্যাংকগুলো একচেটিয়া পরিবারের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ছিল।১৪

রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত ব্যাংক (দ্যা ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান) এবং পাকিস্তানের বাইরে স্থাপিত অন্যান্য ব্যাংকগুলোকে বাদ দিলে মোট সঞ্চয়ের শতকরা প্রায় ৮৬ ভাগ এবং  মোট ঋণ ও অগ্রিম অর্থের শতকরা প্রায় ৮৪ ভাগ ব্যক্তি মালিকানাধীন এই ব্যাংকগুলো একচেটিয়া পরিবারের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ছিল।

ব্যাংকগুলোর উপর একচেটিয়া পরিবারগুলোর নিয়ন্ত্রণ: ১৯৭০১৫

ব্যাংক

নিয়ন্ত্রণকারী গ্রুপ

রুপি (কোটি)

সঞ্চয়

ঋণ এবং অগ্রিম

হাবিব ব্যাংক

হাবিব

৪২৭.০৮

২৬২.২৭

ইউনাইটেড ব্যাংক

সায়গল

৩২৩.৪৫

২০৩.২৪

মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংক

আদমজী

১৩২.৬৪

৮৪.৩৭

কমার্স ব্যাংক

ফ্যান্সি

৩৭.৫৪

৩১.২৯

অস্ট্রেলেশিয়া ব্যাংক

কলোনি (এফ)

৩৩.৮৮

২৪.৫০

প্রিমিয়ার ব্যাংক

আরাগ

৪.১৯

২.৩৭

সারহাদ ব্যাংক

ফারুক

২.০২

০.৭১

(ক) পরিবারগুলো কর্তৃক নিয়ন্ত্রণ, মোট

৯৬০.৮০

৬০৮.৭৫

১. (ক) সমস্ত ব্যাংকের (দেশী এবং বিদেশী) হিসেবে শতকরা হার

৫৯.৩

৫১.০

২. (ক) দেশীয় ব্যাংকগুলোর মধ্যে শতকরা হার

৬৫.৪

৫৭.০

৩. (ক) রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত এবং দেশের বাইরে অবস্থিত ব্যাংকগুলো বাদে দেশের অভ্যন্তরে সমস্ত ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মধ্যে শতকরা হার

৮৬.৯

৮৪.২

সূত্র: স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান থেকে সংগৃহীত পরিসংখ্যান মোতাবেক (১৯৭২)। ‘‘Control of banks by monopoly houses: 1970’’, Table 2.3,  Rashid Amjad, Private Industrial Investment in Pakistan: 1960-1970, (2007), page-48.

১৯৬৯ সালে পাকিস্তানে বীমা কোম্পানিগুলোর মধ্যে ৪৭টি ছিল দেশী এবং বাদবাকী ৩০টি ছিল বিদেশী মালিকানাধীন। এগুলোর মধ্যে ১৪টি সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করতো পরিবারগুলো এবং পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ও বাইরে প্রতিষ্ঠিত বীমা কোম্পানিগুলোর সমস্ত সম্পদের শতকরা ৫০ ভাগের মতো সম্পদের মালিকানা তাদের হাতে ছিল। শুধু পাকিস্তানের অভ্যন্তরস্থ বীমা কোম্পানিগুলোর হিসেবে এর শতকরা হার ছিল ৭৬ ভাগ।

বীমা কোম্পানিগুলোর উপর একচেটিয়া পরিবারগুলোর নিয়ন্ত্রণ: ১৯৬৯১৬

ক্রম.

বীমা কোম্পানি

নিয়ন্ত্রণকারী গ্রুপ

মোট সম্পদ (কোটি রুপি)

১.

ইস্টার্ন ফেডারেল

আরাগ

৩৩.২৮

২.

হাবিব

হাবিব

১৫.২৮

৩.

নিউ জুবিলি

ফ্যান্সি

৭.২৯

৪.

আদমজী ইন্স্যুরেন্স

আদমজী

৬.৭২

৫.

প্রিমিয়ার

প্রিমিয়ার

৩.৯৪

৬.

সেন্ট্রাল ইন্স্যুরেন্স

দাউদ

২.৩৪

৭.

ইউনাইটেড

ভালিকা

১.৫৫

৮.

ইস্টার্ন ইন্স্যুরেন্স

এ.কে. খান

১.৪০

৯.

ইন্টারন্যাশনাল জেনারেল ইন্স্যুরেন্স

ওয়াজির আলি

১.২১

১০.

ক্রিসেন্ট স্টার

মিলওয়ালা

০.৯৯

১১.

ন্যাশনাল সিকিউরিটি

কলোনি (এন)

০.৯৮

১২.

খাইবার

জাফর-উল-আহসান

০.৮৭

১৩.

ইউনিয়ন

নিশাত

০.৬০

১৪.

ইউনিভার্সাল

গান্ধারা

০.৪৪

(ক) মোট

৭৬.৮৯

১. (ক) দেশী-বিদেশী মিলিয়ে মোট বীমা কোম্পানিগুলোর হিসেবে শতকরা হার

৫০.৪

২. (ক) কেবলমাত্র দেশের অভ্যন্তরে স্থাপিত বীমা কোম্পানির হিসেবে শতকরা হার

৭৬.১

সূত্র: কন্ট্রোলার অব ইন্স্যুরেন্স-এর হিসেবের ভিত্তিতে (করাচি, ১৯৭১, পিপি. ৩৩৪-৯ এবং ৫১২-২৭।) ‘‘Control of insurance companies by monopoly houses: 1969’’, Table 2.4, Rashid Amjad, Private Industrial Investment in Pakistan: 1960-1970, (2007), page-49.

ভুট্টো ব্যাংকগুলোকে রাষ্ট্রীয়করণ করেছিলেন এজন্য যে, তিনি জানতেন ব্যাংকগুলো হলো প্রধান জায়গা যেখান থেকে বড় পুঁজিপতিরা পূর্বে সম্পদ কেন্দ্রীভূত করতে পেরেছিলেন। ১৯৭১ সালের পূর্বে বৃহৎ পুঁজিপতিরা তাদের নিজেদের স্থাপিত ব্যাংক থেকেই বেশীরভাগ মূলধন সংগ্রহ করতেন। পরিবারগুলো ১৯৫৯ পর্যন্ত ঋণের ক্ষেত্রে শতকরা প্রায় ৩ শতাংশ হারে ভর্তুকিও পেতো। পরে এর হার আরও বাড়ে। সরকারি ব্যাংক এবং অর্থনির্বাহী প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণভার সরকার মূলত: এই বৃহৎ পরিবারগুলোর হাতে ছেড়ে দেয়। যেমন: ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান-এর প্রধান ছিলেন এম.এ রেঙ্গুনওয়ালা। পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্রেডিট এন্ড ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন (পিআইসিআইসি)-এর চেয়ারম্যান ছিলেন ওয়াহিদ আদমজী। আহমেদ দাউদ ছিলেন ন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট ট্রাস্ট (এনআইটি)-র প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং পিআইসিআইসি-র ভাইস চেয়ারম্যান।১৭

রাষ্ট্রীয় প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বৈদেশিক ঋণ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানের উপর বৃহৎ পুঁজিপতিদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার নমুনা পর্যবেক্ষণ করলে উপলব্ধি করা যায় যে, রাষ্ট্রটি কাদের দ্বারা মূলত পরিচালিত হতো। ব্যাংক, বীমার উপর নিয়ন্ত্রণ ছাড়াও রাষ্ট্রীয় ঋণ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পিআইসিআইসি-র পরিচালনা পর্ষদ নিয়ন্ত্রণ করতো ৭টি নেতৃস্থানীয় একচেটিয়া পরিবার। তৃতীয় বৃহত্তম একচেটিয়া পরিবারের মি. আদমজী-র নেতৃত্বে পিআইসিআইসি ১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত সর্বমোট ঋণের শতকরা প্রায় ৬৫ ভাগ বিতরণ করে ৩৭টি বৃহৎ পরিবারের মধ্যে। যার মধ্যে ১৩টি পরিবারের হাতে মোট পরিমাণের শতকরা প্রায় ৭০ ভাগ কেন্দ্রীভূত হয়। আইডিবিপি প্রতিষ্ঠানটিকে স্থাপন করা হয় বিদেশ থেকে প্রাপ্ত ঋণদানের মাধ্যমে প্রধানত মাঝারি মানের বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার জন্য। এই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একজন পরিচালক ছিলেন যিনি মনোপলি পরিবারের প্রতিনিধিত্ব করতেন। কিন্তু তাতে অন্যান্য পরিবারগুলোর হাতে অর্থ পুঁজির সঞ্চালন হওয়ার ক্ষেত্রে কোন অসুবিধা হয়নি। ষাটের দশকে আইডিবিপি-র বিতরণকৃত মোট ঋণের শতকরা প্রায় ৩০ ভাগ, ৩০টি মনোপলি পরিবারের হাতে জমা হয়। ৩০টি পরিবারের মধ্যে আবার ৭টি পরিবারের হাতে সঞ্চিত হয় শতকরা প্রায় ৭০ ভাগের মতো ঋণের অর্থ।১৮ 

ব্যাংক, বীমার উপর নিয়ন্ত্রণ ছাড়াও রাষ্ট্রীয় ঋণ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পিআইসিআইসি-র পরিচালনা পর্ষদ নিয়ন্ত্রণ করতো ৭টি নেতৃস্থানীয় একচেটিয়া পরিবার। তৃতীয় বৃহত্তম একচেটিয়া পরিবারের মি. আদমজী-র নেতৃত্বে পিআইসিআইসি ১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত সর্বমোট ঋণের শতকরা প্রায় ৬৫ ভাগ বিতরণ করে ৩৭টি বৃহৎ পরিবারের মধ্যে। যার মধ্যে ১৩টি পরিবারের হাতে মোট পরিমাণের শতকরা প্রায় ৭০ ভাগ কেন্দ্রীভূত হয়।

অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠানে একচেটিয়া পরিবারগুলোর প্রতিনিধিত্ব, ১৯৭০ ১৯

প্রতিষ্ঠান

পরিচালকের সংখ্যা

পরিবারের প্রতিনিধিত্ব

পরিবার

পিআইসিআইসি

২৫

আদমজী, দাউদ, ফ্যান্সি, ভালিকা, রেঙ্গুনওয়ালা, ক্রিসেন্ট, এ.কে. খান

আইডিবিপি

১১

ফিরোজ সন্স

আইসিপি

১৩

হাবিব, আরাগ, সায়গল, আদমজী, এ.কে.খান

এনআইটি

১৩

দাউদ, হাবিব, বাওয়ানি, আদমজী, সায়গল

নোট: ক) এ.কে খান বোর্ড অব ডিরেক্টর-এর পদে বহাল হন ১৯৬৯ সালে। তার আসার আগে ষাট দশকের পুরো সময়টা জুড়ে বোর্ড অব ডিরেক্টরস-এ ছিলেন আমিন গ্রুপের এ.জলিল।

 খ) তারা গ্রুপের পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে প্রতিনিধিত্ব না করলেও প্রতিনিধিত্বকারী ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় ব্যাংক বা বীমা কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে নিজ নিজ গ্রুপের স্বার্থ রক্ষা করে চলতেন।

সূত্র: বার্ষিক প্রতিবেদন ১৯৭০, (ক) পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্রেডিট এন্ড ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন (পিআইসিআইসি), (খ) ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক অব পাকিস্তান (আইডিবিপি), (গ) ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব পাকিস্তান (আইসিপি) এবং (ঘ) ন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট (ইউনিট) ট্রাস্ট (এনআইটি)। ‘‘Representation of monopoly houses on financial institutions 1970’’, Table 2.5 Rashid Amjad, Private Industrial Investment in Pakistan: 1960-1970, page-50.

জনগণের সঞ্চিত অর্থ শিল্প-কারখানার খাতে সঞ্চালনের উদ্দেশ্যে সরকার ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠা করে ন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট ট্রাস্ট (এন.আই.টি)এবং ১৯৬৫ সালে প্রতিষ্ঠা করে ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব পাকিস্তান (আই.সি.পি)। এই দু’টো প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণভার তুলে দেওয়া হয় একচেটিয়া পরিবারগুলোর হাতে। দাউদ গ্রুপের এ. দাউদের কথা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। যেটি গুরুত্বপূর্ণ যে, এনআইটি হতে মোট বিনিয়োগের শতকরা প্রায় ৫০ ভাগেরও বেশী তুলে দেওয়া হয় মনোপলি গ্রুপগুলোর হাতে। যদি সরকার এবং বিদেশী মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাদ দেওয়া হয় তাহলে শতকরা প্রায় ৭৩ ভাগ বিতরণ করা হয় এই পরিবারগুলোর ভেতরে। বৃহৎ পরিবারগুলোর নিয়ন্ত্রিত কোম্পানিগুলোতে আইসিপি-র বিনিয়োগ এবং পরিচালনা পর্ষদে সদস্য সংখ্যা কম থাকলেও বিতরণের হার কোনো অংশে কম হয়নি। সরকারি-বেসরকারি প্রধান প্রতিষ্ঠানগুলোর পদাঙ্কই এইগুলো অনুসরণ করে। যেমন, আইসিপি-র বিনিয়োগকৃত অংশের শতকরা প্রায় ৪০ ভাগ যায় মনোপলি গ্রুপগুলোর হাতে (এক্ষেত্রে আইসিপি-র বিনিয়োগের একটি বড় অংশ বিদেশী মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত হয়)। যদি এক্ষেত্রে বিদেশী মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাদ দেওয়া হয় তাহলে তার অংশগ্রহণের শতকরা হার বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় প্রায় ৯০ ভাগ।২০  

জনগণের সঞ্চিত অর্থ শিল্প-কারখানার খাতে সঞ্চালনের উদ্দেশ্যে সরকার ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠা করে ন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট ট্রাস্ট (এন.আই.টি)এবং ১৯৬৫ সালে প্রতিষ্ঠা করে ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব পাকিস্তান (আই.সি.পি)। এই দু’টো প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণভার তুলে দেওয়া হয় একচেটিয়া পরিবারগুলোর হাতে।

পিআইসিআইসি এবং আইডিবিপি থেকে একচেটিয়া পরিবারগুলোতে ঋণ বিতরণের পরিমাণ- (১৯৫৮ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত পিআইসিআইসি-র ঋণ এবং ১৯৬১ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত আইডিবিপি-র ঋণ)২১

পিআইসিআইসি

বিতরণকৃত মোট ঋণের শতকরা হার

আইডিবিপি

বিতরণকৃত মোট ঋণের শতকরা হার

১৩ টি মনোপলি পরিবার

৪৪.৭% (৬৪.০৯ কোটি রুপি)

৭টি মনোপলি পরিবার

২২.১% (২৬.০২ কোটি রুপি)

৩৭ টি মনোপলি পরিবার

৬৩.৫% (৯১.১৩ কোটি রুপি)

৩০টি মনোপলি পরিবার

৩১.৯% (৩৭.৪৫ কোটি রুপি)

সূত্র:  ‘‘Loans from P.I.C.I.C. and I.D.B.P. to monopoly houses’’, Table 2.6, Rashid Amjad, Private Industrial Investment in Pakistan: 1960-1970, page-51.

সরকারি-বেসরকারি সূত্রে প্রাপ্ত অর্থ পুঁজি একচেটিয়া পরিবারগুলো সম্পদ বৃদ্ধিতে লগ্নীকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকার ফলে তাদের হাতে বিশাল পরিমাণ সম্পদ পুঞ্জিভূত হতে থাকে। যার একটা বড় অংশ নিয়োজিত হয় ব্যবসা-শিল্প উদ্যোগে। এই পরিবারগুলোর সম্পদের দিকে তাকালে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। পূর্ব পাকিস্তানে যাদের হাতে শিল্প উদ্যোগের ভার দেওয়া হয় তাদের বেশিরভাগ ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের একচেটিয়া পরিবারগুলোর সাথে সম্পর্কিত।

পূর্ব পাকিস্তানে যাদের হাতে শিল্প উদ্যোগের ভার দেওয়া হয় তাদের বেশিরভাগ ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের একচেটিয়া পরিবারগুলোর সাথে সম্পর্কিত।

ছক: ১৯৭০ সালে একচেটিয়া পরিবারগুলোর সম্পদের তালিকা। (মোট স্থায়ী সম্পত্তির দাম হিসেবে) (কোটি রুপি)২২

ক্রম.

নাম

তালিকাভুক্ত কোম্পানি (নন ফিনান্সিয়াল)

তালিকাভুক্ত কোম্পানি (ম্যানুফ্যাকচারিং)

তালিকা বহির্ভূতসহ সমস্ত ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি

পশ্চিম পাকিস্তান

১.

সায়গল

৪৬.০৬

৪৬.০৬

৫৩.৬৫

২.

ক্রিসেন্ট

২৩.৭৮

২৩.৭৮

২৭.০১

৩.

কলোনি (এন)

২৩.৫৯

২১.৩১

২৪.০৪

৪.

ভালিকা

৩১.২০

২২.৮৩

২২.৮৩

৫.

দাউদ

২২.০০

১৯.৭৯

২১.৯৭

৬.

আদমজী

১৬.৬৫

১৬.৬৫

১৮.৬৫

৭.

হোতি

১৬.৬৮

১৬.৬৮

১৬.৮৩

৮.

ওয়াজির আলী

১১.৯৩

১১.৯৩

১৬.১০

৯.

হাবিব

১৩.৯৮

১৩.৮৫

১৪.৩৫

১০.

আমিনস

২২.১৮

১৩.০৪

১৩.০৪

১১.

বাওয়ানি

১২.৫৩

১২.৫৩

১২.৫৩

১২.

নিশাত

৭.৭০

৭.৭০

১২.১৩

১৩.

কলোনি (এফ)

৯.৬৬

৯.৬৬

৯.৬৬

১৪.

গান্ধারা

৬.৯৫

৬.৯৫

৯.৩৯

১৫.

জাফর-উল-আহসান

৮.০২

৮.০২

৯.০২

১৬.

হুসেইন

৮.৯৪

৮.৯৪

৮.৯৪

১৭.

গুল আহমেদ

৬.৬৩

৬.৬৩

৮.৭৪

১৮.

হেইসনস

৫.০৭

৫.০৭

৮.০৯

১৯.

প্রিমিয়ার

৭.০৪

৭.০৪

৭.৯৫

২০.

বি.ই.সি.ও

৬.৪০

৬.৪০

৬.৪০

২১.

মন্নু

৬.০০

২২.

রহিমতুলা

৫.২৭

৫.২৭

৫.২৭

২৩.

মওলা বক্স

৩.২১

৩.২১

৫.২১

২৪.

শাহনেওয়াজ

৩.৭১

৩.৭১

৫.২১

২৫.

রিয়াজ-ও-খালিদ

৫.০৯

৫.০৯

৫.০৯

২৬.

নুন

৪.৮৮

৪.৮৮

৪.৮৮

২৭.

ফাতেহ

৪.৬৫

৪.৬৫

৪.৬৫

২৮.

ফ্যান্সি

১০.৭৮

৩.৬৩

৪.৪৩

২৯.

করিম

৩.৮৬

৩.৮৬

৩.৮৬

৩০.

জি. ফারুক

৩.৮১

৩.৮১

৩.৮১

৩১.

দাদা

৩.৭৪

৩.৭৪

৩.৭৪

৩২.

হাফিজ

৩.৫৫

৩.৫৫

৩.৫৫

৩৩.

আরাগ

২.৪১

২.৪১

৩.৩৮

৩৪.

দাদাভায়

২.৯৭

২.৯৭

২.৯৭

৩৫.

খানজাদা

২.৮৭

২.৮৭

২.৮৭

৩৬.

হাজী দোস্ত

২.৬৭

২.৬৭

২.৮৭

৩৭.

মিলওয়ালা

২.০০

৩৮.

রেঙ্গুনওয়ালা

১.৮৩

১.৮৩

১.৮৩

৩৯.

হারুন

.৭৫

.৭৫

১.১৬

৪০.

এ. খালীলি

১.০৪

১.০৪

১.০৪

৪১.

ইস্পাহানি

১.০০

৪২.

ফিরোজসন্স

.৯৮

.৯৮

.৯৮

পূর্ব পাকিস্তান

১.

দাউদ

৩১.১৮

৩১.১৮

৩১.১৮

২.

আদমজী

২১.৩৩

২০.৯৬

২২.১২

৩.

এ. খালীলি

১৪.৬০

১৪.৬০

১৪.৬০

৪.

ইস্পাহানি

৮.১৪

৮.১৪

১৩.৮৪

৫.

ফ্যান্সি

১২.০

১২.০

১২.০

৬.

বাওয়ানি

১১.১২

১১.১২

১১.৯২

৭.

আমিনস

৬.৪৮

৬.৪৮

৬.৪৮

৮.

করিম

৬.৩৫

৬.৩৫

৬.৩৫

৯.

মওলা বক্স

৫.৯০

৫.৯০

৫.৯০

১০.

এ.কে.খান

৫.০

১১.

গুল আহমেদ

৪.১৯

৪.১৯

৪.১৯

১২.

হাফিজ

৩.৫০

৩.৫০

৩.৫০

১৩.

বাওয়া

২.৮৯

২.৮৯

২.৮০

১৪.

মন্নু

২.৫০

২.৫০

২.৫০

১৫.

হাবিব

.৫০

১৬.

রহিমতুলা

.১০

.১০

.১০

Note: Estimates of fixed assets of quoted companies were obtained from the balance sheets. In the case of non-quoted companies, assets were estimated as follows: (a) For firms mainly in the cotton textiles, jute manufacturing and sugar industries, after finding their production capacity, the value of their fixed assets was found from equivalent sized firms which had come into production about the same time. (b) Where equivalent companies on the K.S.E. were not available the value of fixed assets was obtained through indirect enquiries. Estimates in these cases were therefore not very reliable but since these normally were the smaller companies controlled by the monopoly houses, this would not significantly affect the overall size of the monopoly house.

সূত্র: (1) Government of Pakistan, 1965, ‘Report of the Anti-Cartel Law Study Group’ (unpublished; made available to the author). (2) State Bank of Pakistan, Balance Sheet Analysis of Joint StockCompanies, 1965-70 (Karachi). (3) Tareen, A. K. (ed.), Directory of Pakistan Cotton Textile Industry (Karachi, 1970). (4) Haidari, I. and Khan, A. H., 1968, Stock Exchange Guide toPakistan (Economic and Industrial Publications, Karachi, various issues). (5) Haidari (1969). (6) Haidari (1970). (7) I.P. and S. (1966a). (8) I.P. and S. (1972). (9) Information collected by the author from the I.P. and S. Department, Karachi, for sanctions made during the Third Plan period. (10) Direct enquiries in Karachi including interviews with members of the major monopoly housesএর ভিত্তিতে “Monopoly houses’ assets in Pakistan in 1970”, Appendix B—Table B.I ,Rashid Amjad, Private Industrial Investment in Pakistan: 1960-1970, 2007, page-195.

একদিকে যখন পশ্চিম পাকিস্তানে পুঁজির একচেটিয়াকরণের পথ পরিষ্কার হচ্ছে অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানে তখন এর বিরুদ্ধে সমাজের বিভিন্ন অংশে আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। সে সময় হাজী মোহাম্মদ দানেশ একচেটিয়া পুঁজিপতিদের স্বার্থে‘উন্নয়নের’ চেহারা তুলে ধরে সমালোচনায় বলেছেন,

‘‘স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পর হইতে দেশে শিল্পের অগ্রগতি হইয়াছে এবং কলকারখানার সংখ্যা ও উৎপাদন বৃদ্ধি পাইয়াছে। গত ১৭ বৎসরেই ইহা ঘটিয়াছে। ইহা বিশেষ কোন সরকারের কৃতিত্ব নহে। তবে এই সঙ্গে ইহাও স্মরণ রাখা দরকার যে, গত ১৭ বৎসরে দেশে শিল্পের যে অগ্রগতি সম্ভব ছিল তাহা হয় নাই। আজওইস্পাত শিল্প ও যন্ত্র নির্মাণ শিল্প গড়িয়া উঠে নাই। মূল সম্পদ এখনও আসে কৃষি হইতে। আজওদেশ অনগ্রসর কৃষি প্রধান দেশই রহিয়াছে। ..ইহা ছাড়া, শুধু সারা দেশের কলকারখানার সংখ্যা দ্বারা পাকিস্তানের মত দেশের উন্নয়নের পরিমাপ করা চলে না। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে-দেশের এই উভয় অংশে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলেও একই পর্যায়ে উন্নয়নকার্য চলিতেছে কিনা তাহা একটি প্রধান বিচার্য বিষয়।…এই দিক দিয়া বিচার করিলে দেখা যায় যে, যদিও পূর্ব পাকিস্তান সবচেয়ে বেশী বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ করে তথাপি উহার অধিকাংশ পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়নের জন্য ব্যয়িত না হইয়া উহার সিংহভাগ ব্যয় করা হয় আদমজী, দাউদ, সায়গল, গান্ধারা প্রমুখ মুষ্টিমেয় বড় ধনিকের স্বার্থে। পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়ন পরিকল্পনা রচনা ও পরিচালনার দায়িত্ব এখানে গণনির্বাচিত সরকারের হাতে না দিয়ে উহা রাখা হইয়াছে সুদূর রাওয়ালপিন্ডিতে—বড় ধনিকগোষ্ঠীর পেটোয়া একটি চক্রের হাতে। তদুপরি, পূর্ব পাকিস্তানে শিল্প, ব্যাংক, ব্যবসা প্রভৃতির উপর অবাধ অধিকার আদমজী, দাউদ, সায়গল, গান্ধারা প্রমুখ মুষ্টিমেয় বড় ধনিকের হাতে তুলিয়া দেওয়া হইয়াছে। এ সবের ফলে পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়ন কাজ অবহেলিত। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ভিতর বৈষম্য বিরাজ করিতেছে।

..পশ্চিম পাকিস্তানের কতকগুলি অঞ্চল বিশেষতঃ সাবেক বেলুচিস্তান ও সিন্ধু সম্পর্কেও একই কথা খাটে। ..বস্তুত: আইয়ুব সরকার ‘উন্নয়নের’ নামে আদমজী, দাউদ, সায়গল, গান্ধারা প্রমুখ মুষ্টিমেয় বড় ধনিকদের স্বার্থরক্ষায় যে নীতি অনুসরণ করিতেছে, তাহার ফলে দেশে এক বৈষম্যমূলক ও অসম অর্থনীতি গড়িয়া উঠিয়াছে। ইহার পরিণাম হইবে মারাত্মক। দ্বিতীয়ত: দেশের উন্নয়নের প্রধান নিরিখ হইল জনগণের জীবন ধারণের উন্নয়ন। এদিক দিয়া বিচার করিলেও দেখা যায় যে, আদমজী, দাউদ, সায়গল, গান্ধারা প্রমুখ সামান্য কয়েকটি ধনিক পরিবার শ্রমিকদিগকে শোষণ করিয়া বৎসরে কোটি কোটি টাকা মুনাফা করিতেছে। ইহাদের মুনাফার হার হইল শতকরা ২০০-৩০০ ভাগ, যা সভ্য দুনিয়ার কোন দেশেই নাই, কোন কোন কোম্পানি, যেমন:গান্ধারা ইন্ডাস্ট্রিজ গত ৪/৫ বৎসরে কোটি কোটি টাকার মালিক হইয়াছে। অপরদিকে সমস্ত কল-কারখানা যাহাদের শ্রমে চালু থাকে, সেই শ্রমিকের শ্রেণি থাকে উপবাস। ..মুষ্টিমেয় বৃহৎ ব্যবসায়ী বাজারের কারসাজি দ্বারা জিনিসপত্রের দাম ক্রমাগত বাড়াইতেছে। এই ফাটকাবাজীর দ্বারা ইহারা কোটি কোটি টাকা লাভ করে। অপরদিকে নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্রের দাম আকাশচুম্বী হওয়ার ফলে জনগণের ঘরে ঘরে হাহাকার পড়িয়া গিয়াছে।..বস্তুত: আইয়ুব সরকারের ‘উন্নয়নের’ বদৌলতে সারা পাকিস্তানে আজ আদমজী, দাউদ, সায়গল প্রমুখ গুটিকয়েক ধনিক পরিবারের শোষণের সাম্রাজ্য গড়িয়া উঠিতেছে। বড় বড় ভূস্বামীরা অবাধে কৃষকদের শোষণ করিতেছে, ব্যবসায় মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের অবাধ কর্তৃত্ব কায়েম হইয়াছে এবং গ্রামে গ্রামে দুর্নীতিপরায়ণ টাউটদের রাজত্ব চলিতেছে। পক্ষান্তরে শ্রমিক, কৃষক ও জনগণ দিন যাপন করে অভাবে ও উপবাসে।’’২৩

আগের পর্ব: ২২ পরিবারের অতীত ও বর্তমান-২

পরের পর্ব: ২২ পরিবারের অতীত ও বর্তমান-৪

মেহেদী হাসান: লেখক, অনুবাদক। ইমেইল:mehedi hassan1@gmail.com

তথ্যসূত্র:

  1. কার্ল মার্কস, ফ্রেডরিক এঙ্গেলস, রচনা-সংকলন, প্রথম খণ্ড, দ্বিতীয় অংশ, বাস-সংস্থান সমস্যা: প্রথম ভাগ; প্রুধোঁ কীভাবে বাস-সংস্থান সমস্যার সমাধান করেন, ভারবি, কলকাতা, ২০০০, পৃঃ-২২৮।
  2. পূর্বোক্ত, পৃঃ-২৭৬।
  3. Rashid Amjad, Private Industrial Investment in Pakistan: 1960-1970, Cambridge University Press.2007, page-42.
  4. প্রভাস চন্দ্র লাহিড়ী: পাক-ভারতের রূপরেখা; শ্যামা প্রকাশনী, চাকদহ, নদীয়া, কলিকাতা, প্রথম প্রকাশ: ভাদ্র ১৩৭৫ (বাংলা), পৃঃ- ২৪০, ২৪২।
  5. Karl Marx, Capital, Volume I, part I,বাংলা অনুবাদ-প্রগতি প্রকাশন, সম্পাদনা: প্রফুল্ল রায়,পৃঃ- ৩৮১।
  6. পূর্বোক্ত, পৃঃ- ৩৮৩-৩৮৪।
  7. Rashid Amjad, Private Industrial Investment in Pakistan: 1960-1970,Cambridge University Press.2007, page-167.
  8. —Ibid— page-42.
  9. —Ibid—page-44, 45.
  10. —Ibid— page-45.
  11. Pakistan: The Unstable State, Editors: Hassan Gardezi, Jamil Rashid, Vanguard books Ltd , , 1983, page -9.
  12. Anil Chatterjee, Ranajit Dasgupta, Kalyan Dutt – Bangladesh economy an analytical study,People’s Pub. House, 1973, page-25.
  13. Shaid Ur Rehman, Who owns Pakistan:Fluctuating Fortunes of Business Mughals, page-12 or, download link: https://b-ok.asia/ireader/2555853.
  14. Rashid Amjad, Private Industrial Investment in Pakistan: 1960-1970, Cambridge University Press, 2007.page-48.
  15. —Ibid—
  16. —Ibid— page-49.
  17. Shaid Ur Rehman, Who owns Pakistan: Fluctuating Fortunes of Business Mughals or download link: https://b-ok.asia/ireader/2555853
  18. Rashid Amjad, Private Industrial Investment in Pakistan: 1960-1970, Cambridge University Press.2007, page-50.
  19. —Ibid—page-50.
  20. —Ibid—page-51.
  21. —Ibid—
  22. —Ibid—page-195.
  23. জনাব আইয়ুব খাঁর জবাবে হাজী মোহাম্মদ দানেশ, পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির পুস্তিকা, অক্টোবর, ১৯৬৪।বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র: দ্বিতীয় খণ্ড, সম্পাদক: হাসান হাফিজুর রহমান। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, তথ্য মন্ত্রণালয়, হাক্কানী পাবলিশার্স, প্রথম প্রকাশ, নভেম্বর, ১৯৮২। পৃ:-২৩৫-২৩৬।
Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •