প্রাণশক্তি ও গণক্ষমতা: জলে ডোবা জমিতে ভাসা রাজনৈতিক সম্ভাবনা
পারভেজ আলম
এই লেখার বিষয়বস্তু এসএম সুলতানের একটি পেইন্টিং। পেইন্টিংটি ‘হত্যাযজ্ঞ’ নামে প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮৬ সালে। ইংরেজিতে ছবিটি ‘আফটার দ্য ফ্লাড’ নামে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হয়েছে। পেইন্টিংটিতে সুলতান বাংলার কৃষক জীবের জীবনের (zoe) যে অনন্ত অবস্থা চিত্রায়ণ করেছেন, তা তুলে ধরাই এ লেখাটির উদ্দেশ্য।
বাংলার কৃষকদের বিপ্লবের কর্তা হিসেবে দেখার চল বাংলাদেশের বামপন্থিদের মধ্যে অতি পুরাতন। ভারত ও বাংলাদেশের উত্তর-ঔপনিবেশিক, বিশেষ করে সাবঅল্টার্ন স্কুলের তাত্ত্বিকরাও বাংলার কৃষকের মধ্যে বৈপ্লবিক সম্ভাবনাসম্পন্ন বৈপ্লবিক কর্তার সন্ধান করেছেন (নিজার ৯৬, স্পিভাক ২৭১-৩১৩)। সুলতানের ছবিও উত্তর-ঔপনিবেশিক প্রেক্ষিতে অথবা বি-উপনিবেশায়নের প্রকল্প হিসেবে বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। তাঁর ছবিতে সাবঅল্টার্ন সাবজেক্ট বা নিম্নবর্গের কর্তাসত্তার উপস্থাপনার চেষ্টা রয়েছে কি না, তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। যেমন, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ও সুবীর চৌধুরী সুলতানের ছবির মধ্যে নিম্নবর্গীয় স্বপ্নের (subaltern vision) উপস্থাপনা দেখেছেন। অন্যদিকে, সৈয়দ নিজারের মতে, সুলতানের ছবির বিষয়বস্তু নিম্নবর্গীয় স্বপ্ন নয়; বরং প্রান্তিক কৃষকের কর্মময় ও বস্তুগত জীবনের হাজার বছরের মহাবয়ান (৯৬)। এই বিতর্কে কোনো পক্ষ নেওয়া এই লেখাটির উদ্দেশ্য নয়; বরং এই লেখাটির উদ্দেশ্য সুলতানের ছবির সঙ্গে যুক্ত ইতঃপূর্বেকার উত্তর-ঔপনিবেশিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের স্মরণ নেওয়ার পাশাপাশি তাঁর শিল্পকলায় হাজির থাকা প্রাণশক্তিবাদের সঙ্গে জৈবক্ষমতা ও নয়া বস্তুবাদ সংক্রান্ত সমসাময়িক কিছু তত্ত্বের মধ্যে আলাপের সূত্রপাত ঘটানো। এবং সুলতানের শিল্পকলার কোনো মহাবয়ান সম্বন্ধে মতামত দেওয়ার পরিবর্তে তাঁর একটি ছবির মধ্যে (এবং তাঁর শিল্পের মধ্যেও) হাজির থাকা বিশেষ একটি বয়ানকে তুলে ধরা এবং সেই বিশেষ বয়ানটির একটি ঐতিহাসিক বস্তুবাদী ব্যাখ্যা হাজির করা এই লেখাটির উদ্দেশ্য।
এই পেইন্টিং-এ আমরা দেখি, একটা জলেভাসা মাঠের মধ্যে ছড়ানো-ছিটানো ও জাগরূক একদল মানুষকে। সুলতানের পরিণত পর্বের আরো বহু পেইন্টিং-এর মতো এই পেইন্টিংটিতেও পেশিবহুল ও স্বাস্থ্যবান কৃষকদের উপস্থাপনা দেখা যায়। এই ধরনের উপস্থাপনাকে অপরিসীম প্রাণশক্তির উপস্থাপনা হিসেবে পাঠ করা যায়। সুলতান নিজে বিভিন্ন সময়ে তার শিল্পের মাধ্যমে বাংলার কৃষকমানুষ ও তার সমাজের অন্তর্নিহিত যে শক্তি উপস্থাপনের দাবি করেছেন, আশরাফ আলী ও তারেক মাসুদ যার নাম দিয়েছেন ‘ইনার স্ট্রেংথ’, এবং সৈয়দ নিজার যাকে বলেছেন ‘প্রান্তের জীবনীশক্তি’, তার ধারাবাহিকতাতেই আমি এই লেখায় সুলতানের শিল্পকলায় হাজির-থাকা প্রাণশক্তির (vitality) ধারণাটি হাজির করার চেষ্টা করেছি। সুলতানের ছবি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে প্রাণশক্তি বা ভাইটালিটির ধারণার আশ্রয় নেওয়া নতুন কোনো ঘটনা নয়। তবে এই লেখায় আমার লক্ষ্য সুলতানের শিল্পকলায় হাজির-থাকা প্রাণশক্তিবাদের সঙ্গে সাম্প্রতিক পাশ্চাত্যের কিছু তত্ত্বের সম্পর্ক, দূরত্ব ও পার্থক্য নির্ণয় করা এবং নতুন রাজনৈতিক চিন্তা ও চর্চা গঠনে সুলতানের প্রাণশক্তিবাদের সম্ভাবনার দিকে আলোকপাত করা। এই লেখায় আমি দেখাব যে, এই ছবিতে হাজির-করা কৃষকের দেহ একটি বি-উপনিবেশায়ন প্রকল্প হওয়ার পাশাপাশি তা আধুনিক জৈবক্ষমতার সাবজেকশন এবং তার দ্বারা উৎপাদিত সাবজেকটিভিটির বাইরে-থাকা একধরনের সত্তার উপস্থাপনা (representation) এবং এই উপস্থাপনার মধ্যে মানুষের জীবের জীবনের অনন্ত প্রাণশক্তির তত্ত্ব নিহিত রয়েছে। সবশেষে সুলতানের এই পেইন্টিংটিকে কেন্দ্রে রেখে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ এবং নয়া বস্তুবাদের (new materialism) মধ্যে সংযোগ প্রতিষ্ঠার একটি চেষ্টা এই লেখাটিতে করা হয়েছে। অথবা এভাবেও বলা যায় যে, বস্তুবাদের এই দুটি ঐতিহ্যের মধ্যে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার একটি ময়দানের ভূমিকা পালন করেছে এই পেইন্টিংটি–এই লেখাটির জন্য।
হত্যাযজ্ঞ/After the Flood (১৯৮৬)
পেইন্টিংটি সম্বন্ধে কোনো পূর্বানুমান ও পূর্বধারণার বশবর্তী না-হয়ে এর ঘনিষ্ঠ পাঠ (close reading) করতে গেলে এর মধ্যে উপস্থাপিত মানবদেহগুলোর পরিচয় নির্ণয় করা প্রায় অসম্ভব। পাশ্চাত্য অধিবিদ্যায় (metaphysics) যে ধরনের সাবজেক্টের ধারণা পাওয়া যায়, তার উপস্থিতিও এই ছবিটিতে পাওয়া কঠিন। লিঙ্গপরিচয়ের বাইরে আর কোনো পরিচয় সেঁটে দেওয়া কঠিন এই মানবদেহগুলোর ওপরে। অন্তত ব্রিটিশ ভারতে ঔপনিবেশিক জ্ঞানতত্ত্বের অধীন গড়ে ওঠা জৈবরাজনীতির (Biopolitics) প্রভাবে দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের মধ্যে যেসব ধর্মসম্প্রদায়গত ও জাতিগত আত্মপরিচয় প্রভাবশালী ও প্রতাপশালী হয়েছে, সেসবের কোনো চিহ্ন এই মানবদেহগুলোর উপস্থাপনায় পাওয়া যায় না। মিশেল ফুকোর লেখায় হাজির থাকা জৈবক্ষমতা (Biopower) ধারণাটি নিয়ে আলাপ করতে গিয়ে জুডিথ বাটলার দাবি করেছেন যে, ক্ষমতা একজন সাবজেক্ট বা কর্তার গায়ে তার পরিচয় সেঁটে দেয় (১৯০)। ব্রিটিশ আমলের ভারতীয় উপমহাদেশে পাশ্চাত্য শিল্প সংক্রান্ত জ্ঞানতত্ত্বের হেজিমনির অধীন স্থানীয় জনগণের একধরনের আদর্শপরিচয় ও কর্তাসত্তার সন্ধান করার চল শুরু হয়েছিল। অর্থাৎ, ওপনিবেশিক জ্ঞানকাণ্ডনির্ভর জৈবক্ষমতা এ অঞ্চলের শিক্ষিত সমাজের মানুষের গায়ে আত্মপরিচয় সেঁটে দিয়েছিল। ঔপনিবেশিক জ্ঞানকাণ্ডের হেজিমনি মেনে নিয়ে ও তা আত্মস্থ করার মাধ্যমে আধুনিক শিল্পচর্চা করার প্রচেষ্টা যেমন এই সময়ে শুরু হয়েছে, তেমনি পাশ্চাত্য শিল্পকে অপর ধরে নিয়ে তার বিপরীতে ভারতীয় অথবা প্রাচ্য শিল্পসংক্রান্ত নানান ধাতবাদী (essentialist) ধারণাও গড়ে উঠেছে। আর্য জাতিতত্ত্বের ধারণার প্রভাবে এসময় যেমন আর্য শিল্পের ধারণা গড়ে উঠেছে, তেমনি তা একটি প্রাচীন হিন্দুসভ্যতার ধারণা এবং আধুনিক হিন্দু জাতীয়তাবাদী আত্মপরিচয় নির্মাণের মতাদর্শ গঠনেও ভূমিকা রেখেছে (নিজার ৭৮-৮৪)। আজও দক্ষিণ এশিয়ায় আর্য জাতিতত্ত্বনির্ভর বর্ণবাদী বর্গগুলো শিক্ষা, শিল্প ও রাজনীতির জগতে প্রতাপ নিয়ে হাজির আছে। অন্যদিকে বি-উপনিবেশায়নের উদ্দেশ্য নিয়ে গড়ে ওঠা শৈল্পিক প্রকল্পগুলোও ভারতীয় উপমহাদেশের সমাজ ও সভ্যতাসংক্রান্ত বিভিন্ন ধাতবাদী জ্ঞানতত্ত্বের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে গড়ে উঠেছে এবং এই অঞ্চলের মানুষের বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী ও সাম্প্রদায়িক ধাতের ধারণায় শক্তি জুগিয়েছে। কিন্তু যেসব সাম্প্রদায়িক ও জাতীয়তাবাদী পরিচয় ও ধাতের ধারণা ভারতীয় উপমহাদেশে বহু সফল ও ব্যর্থ বিপ্লব, রক্তপাত এবং মানবিক দুর্যোগের জন্য দায়ী; সেসবের কোনো উপস্থিতি সুলতানের এই পেইন্টিংটিতে পাওয়া যায় না। যদি এই পেইন্টিংটির মানবদেহগুলোর কোনো সাবজেকটিভিটি বা কর্তাসত্তা থেকেই থাকে, তবে তা আধুনিক জৈবরাজনৈতিক ডিসকার্সিভ চর্চার মধ্যদিয়ে উৎপাদিত নয়। এবং এই কারণেই তাকে রাজনৈতিকভাবে এত অচেনা মনে হয়।
আলোচ্য ছবিটি সুলতানের পরিণত পর্বের ছবি, আগেই একবার তা উল্লেখ করেছি। আঁকার স্টাইল ও বিষয়বস্তুর দিক থেকে সুলতানের শিল্পে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে সত্তরের দশকে, যখন থেকে তিনি কৃষকদেহের প্রাণশক্তির উপস্থাপনাকে তার শিল্পচর্চার কেন্দ্রে নিয়ে আসেন। এর আগে, তার আঁকা ল্যান্ডস্কেপ পেইন্টিংগুলোয় প্রকৃতির বিশালতাই ছিল মুখ্য বিষয়। অর্থাৎ, সুলতানের শিল্পচর্চায় একটি বাঁক লক্ষ করা যায়, যারপর তার শিল্পচর্চাকে একধরনের বি-উপনিবেশায়নের প্রকল্প হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায়। সৈয়দ নিজারের ভাষায়: ‘সুলতানের শিল্পকর্ম ঔপনিবেশিক জ্ঞানকাণ্ডের উপস্থাপিত প্রান্তিক কৃষকের জীবনের একটি প্রতিবয়ান।’ কিন্তু এই কৃষক এমন কোনো সাবজেক্ট নয়, যার গায়ে জৈবক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্ক রাখা কোনো পরিচয় সেঁটে দেওয়া যাবে, যেহেতু জৈবরাজনৈতিক ডাকের (বায়োপলিটিক্যাল ইন্টারপেলেশন) কোনো উপস্থিতি এসব পেইন্টিং-এর চরিত্রগুলোর মধ্যে পাওয়া যায় না। জুডিথ বাটলারের মতে, মিশেল ফুকো তার লেখার মধ্যে সাবজেক্ট আর দেহের মধ্যকার সম্পর্ককে দ্ব্যর্থবোধক করে তোলার মাধ্যমে একদিকে যেমন সাবজেক্টের ধারণাকেই বিনির্মাণ করেছিলেন, তেমনি এমন এক দেহের ধারণা নির্মাণ করেছিলেন যাকে এজেন্সির উৎস হিসেবে সাবজেক্টের জায়গায় প্রতিস্থাপন করা যায় (১৯০)। এর ফলে, ফুকোর শেষদিকের লেখালেখিতে এক নতুন সাবজেক্টের ধারণার আবির্ভাব দেখি আমরা, যে সাবজেক্টের ধারণা সার্বভৌমত্বের ওপর নির্ভরশীল নয় (বাটলার ১৯২)। আমাদের কল্পনার সুবিধার্থে আমরা আমাদের আলোচ্য ছবিটিকেও ফুকোর লেখালেখির এই বাঁকের ঘটনার একটি এলিগরি হিসেবে পাঠ করতে পারি। এমন কল্পনা করলে মনে হবে যে, এই ছবিতে জাগ্রত এবং জাগরূক দেহগুলো এমন একধরনের দেহস্থিত সাবজেক্ট, যিনি প্রকৃতি ও অমানবিক শক্তিগুলোর সাপেক্ষে তার দুর্বলতা সম্বন্ধে পূর্ণ সচেতন, যিনি প্রকৃতির ওপর তার এই সার্বভৌমত্বহীনতার সঙ্গে শান্তি স্থাপন করতে পেরেছেন এবং একইসঙ্গে আপন দেহের প্রাণশক্তি আবিষ্কার করেও যিনি বিস্মিত ও মুগ্ধ। এমন ফলদায়ক কল্পনা করা সম্ভব এই কারণেই, যেহেতু ফুকো ও সুলতান উভয়েই এমন এক দেহের ধারণা উপস্থাপন করতে চেয়েছেন, যা পাশ্চাত্য অধিবিদ্যার সাবজেক্টের ধারণাকে অতিক্রম করতে চেয়েছে। তবে, ফুকো যেখানে মূলত পাশ্চাত্য দর্শনে গড়ে ওঠা সাবজেক্টের ধারণার উত্তর-কাঠামোবাদী ক্রিটিক তথা বিচার হাজির করতে গিয়ে তার দেহের ধারণা গড়ে তুলেছেন, সুলতান সেখানে তার শিল্পে দেহকে হাজির করেছেন ওই একই পশ্চিমা সাবজেক্টের ধারণাকে অগ্রাহ্য করতে গিয়ে–এক বি-উপনিবেশায়ন প্রকল্পের অংশ হিসেবে।
আলোচ্য ছবিটি সুলতানের পরিণত পর্বের ছবি, আগেই একবার তা উল্লেখ করেছি। আঁকার স্টাইল ও বিষয়বস্তুর দিক থেকে সুলতানের শিল্পে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে সত্তরের দশকে, যখন থেকে তিনি কৃষকদেহের প্রাণশক্তির উপস্থাপনাকে তার শিল্পচর্চার কেন্দ্রে নিয়ে আসেন। এর আগে, তার আঁকা ল্যান্ডস্কেপ পেইন্টিংগুলোয় প্রকৃতির বিশালতাই ছিল মুখ্য বিষয়।
সুলতানের বি-উপনিবেশায়ন প্রকল্পের রাজনৈতিক সম্ভাবনা, আরো ভালোভাবে বললে তার আঁকা কৃষকদেহের রাজনৈতিক কর্তাসত্তা এবং এজেন্সি নিয়ে ইতোমধ্যে নানান আলাপ ও তর্ক হয়েছে। সুলতানের ছবির মার্কসীয় ও উত্তর-ঔপনিবেশিক ব্যাখ্যা ও বিচার করতে গিয়ে একদিকে যেমন এই কৃষকদের সাবঅল্টার্ন পরিচয়কে মুখ্য করা হয়েছে, তেমনি খোদ সুলতানকেই একজন সাবঅল্টার্ন শিল্পী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। অন্যদিকে, সৈয়দ নিজারের মতে, ‘সুলতানের চিত্রকলায় স্থান, কাল, ব্যক্তি নির্বিশেষে যে-বাস্তবতার বয়ান আছে, তা হচ্ছে প্রকৃতি, শোষণ ও বঞ্চনার মধ্যে টিকে থাকার মানসিক শক্তি। বৃহৎ কোনো রাজনৈতিক অঙ্গীকারের ইঙ্গিত এখানে নেই (৯৬)।’ তবে, আমার মনে হয়, সুলতানের ছবির দেহগুলোর রাজনৈতিকতা চিহ্নিত বা পাঠ করার ক্ষেত্রে যে সীমাবদ্ধতার মুখোমুখি আমরা হই, তা আসলে তার উপস্থাপনার সীমবদ্ধতা নয়; বরং রাজনীতি সম্পর্কে আমাদের ধারণাগত সীমাবদ্ধতা। আরো ভালোভাবে বললে পাশ্চাত্যের জ্ঞানতত্ত্বের ওপর নির্ভর করে গড়ে ওঠা জৈবরাজনৈতিক ডিসকোর্স ও মতাদর্শের ওপর নির্ভরশীল যে রাজনৈতিক সাবজেকটিভিটি ও এজেন্সির ধারণার সঙ্গে আমরা পরিচিত, তারই সীমাবদ্ধতা। জর্জো আগামবেনের মতে, প্রাচীন গ্রিসের আমল থেকেই পাশ্চাত্য অধিবিদ্যায় মানুষের জীবনকে রাজনৈতিক জীবন (bios) ও জীবের জীবন (zoe) হিসেবে ভাগ করার চল রয়েছে (হোমো স্যাকের ১-৭)।
প্রাচীন গ্রিস থেকে আধুনিক যুগের একটা পর্যায় পর্যন্ত গণতান্ত্রিক রাজনীতির মধ্যেও শুধু স্বাধীন পুরুষদের রাজনৈতিক জীবনই (আধুনিক যুগে পাশ্চাত্যের সাদা পুরুষদের রাজনৈতিক জীবন) রাজনৈতিক জীবন হিসেবে স্বীকৃত ছিল। নারী অথবা দাসদের জীবনকে রাজনৈতিক জীবনের বাইরে রাখা হতো আধুনিক নাগরিক ও মানবাধিকারের ধারণার আবির্ভাবের পরও (আগামবেন, হোমো স্যাকের ১৩০)। তাদের জীবন সীমাবদ্ধ ছিল জীবের জীবনে; ক্ষুধা নিবারণ, সন্তান উৎপাদন ও লালন-পালনের বাইরে যে জীবনের আর কোনো কাজ নেই। মূলত আর সব পশুর সঙ্গে মেলে যেসব মানবিক বৃত্তি ও কর্ম, তার মধ্যেই জীবের জীবনকে চিহ্নিত করার চল রয়েছে। আন্দোলন-সংগ্রাম করে ভোটের অধিকার আদায় করে নিতে হয়েছে নারীদের। দাসদের বংশধরদেরও নাগরিক অধিকারের আন্দোলনের মাধ্যমে সাদাদের সমান অধিকার আদায় করে নিতে হয়েছে। নারী স্বাধীনতার, বিশেষ করে কালোদের অধিকারের রাজনীতি এখনো যে জারি আছে তা-ই নয়; নতুন করে আবার বেগবান করতে হয়েছে, যেহেতু বর্তমান পাশ্চাত্যে বর্ণবাদী জৈবরাজনীতি নতুন করে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। পাশ্চাত্য অধিবিদ্যার রাজনৈতিক জীবনের ধারণার এই সিলসিলা মাথায় রাখলে আমাদের বুঝতে সুবিধা হয় কেন সুলতানের ছবিতে হাজির-থাকা কৃষকের জীবনকে অরাজনৈতিক মনে হয়, যেহেতু এই অধিবিদ্যা স্বীকৃত রাজনৈতিক জীবনকে এই ছবিগুলোতে সাধারণত খুঁজে পাওয়া যায় না। মূলত এ কারণেই সুলতানের ছবির মার্কসীয় ও উত্তর-ঔপনিবেশিক ব্যাখ্যাকাররা তার ছবির রাজনৈতিকতা নিয়ে আলাপ তুলতে গেলে প্রায়ই হাতে গোনা এমন কিছু ছবির দ্বারস্থ হন, যেগুলোর মধ্যে আমাদের কাছে পরিচিত রাজনৈতিক জীবনের (যেমন: কৃষক বিদ্রোহ) ছাপ পাওয়া যায়।
প্রাচীন গ্রিস থেকে আধুনিক যুগের একটা পর্যায় পর্যন্ত গণতান্ত্রিক রাজনীতির মধ্যেও শুধু স্বাধীন পুরুষদের রাজনৈতিক জীবনই (আধুনিক যুগে পাশ্চাত্যের সাদা পুরুষদের রাজনৈতিক জীবন) রাজনৈতিক জীবন হিসেবে স্বীকৃত ছিল। নারী অথবা দাসদের জীবনকে রাজনৈতিক জীবনের বাইরে রাখা হতো আধুনিক নাগরিক ও মানবাধিকারের ধারণার আবির্ভাবের পরও
আমাদের আলোচ্য ছবিটি অবশ্য এমন একটি পেইন্টিং যাতে এমনকি কৃষকদের সাংসারিক এবং কৃষিভিত্তিক উৎপাদনব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত প্রতিদিনকার জীবনকেও খুঁজে পাওয়া যায় না, যা সাধারণত সুলতানের অধিকাংশ ছবিতে পাওয়া যায়। বরং এই দাবি করা যায় যে, এই ছবিতে হাজির-থাকা মানুষের জীবের জীবনকে তার এজেন্সির চূড়ান্ত অনুপস্থিতির মধ্যে উপস্থাপন করা হয়েছে। এই ছবির মানবদেহগুলোর কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ আছে শুধু নিদ্রা, বিশ্রাম, জেগে-ওঠা, আশ্চর্য ও মুগ্ধ হওয়া ইত্যাদির মধ্যে। মানুষের যে জীবের জীবনকে এক্ষেত্রে উপস্থাপন করা হয়েছে, তা শুধু অন্যান্য জীবের জীবনের সঙ্গেই নয়, এমনকি গাছের জীবনের সঙ্গেও সাযুজ্যপূর্ণ। বন্যার পর পলিমাটির পুষ্টি গ্রহণ করে প্রাণপ্রকৃতি যেমন নতুন করে জেগে ওঠে, সজীব হয়ে ওঠে, এই জীবের জীবনও তেমনি। আধা জলে ডোবা যেই জমির মধ্যে তারা শুয়ে-বসে আছে; সেই জমির ঘাস বা ধানের জীবনের সঙ্গে এই জীবের জীবনের মিল আছে। এ এমন এক জীবের জীবন, যা তার প্রাকৃতিক নিবাসের সঙ্গে এক আয়েশি ঐক্যের সম্পর্কে নিজেকে আবিষ্কার করেছে। মোটাদাগে, ছবিটিতে মানুষ নামক জীবের জীবনের এই ধরনের উপস্থাপনাই আমরা দেখি। কিন্তু ছবিটি নিঃসন্দেহে একটি বিপর্যয় বা দুর্যোগ-পরবর্তী ছবিও। ছবিটির উপরের দিকে (বাঁ দিগন্তে) ধ্বংসাবশেষ হাজির করার মাধ্যমে এবং জলে ডোবা মাঠের মধ্যে মানবদেহগুলোকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখার মাধ্যমে এই বিপর্যয়কে তুলে ধরা হয়েছে। এই ধ্বংসাবশেষ হয়তো একটি বন্যা কিংবা ঝড়ের ফলাফল হতে পারে। যুদ্ধের ফলাফলও হতে পারে। অথবা তা খোদ বিপর্যয় (catastrophe) ধারণাটিরই এক ধরনের উপস্থাপনা। কিন্তু এই ধ্বংসাবশেষকে নেপথ্যে হাজির করার মাধ্যমে মুখ্য করে তোলা হয়েছে জীবনের পুনরুত্থান। ছবিটির বাংলা (হত্যাযজ্ঞ) এবং ইংরেজি নামও (আফটার দ্য ফ্লাড) মূলত বিপর্যয়েরই ইঙ্গিতবাহী, এখন তা মানবসৃষ্ট হোক বা প্রাকৃতিক বা উভয়ই।
বাংলাদেশের ইতিহাসে গণহত্যা এবং বন্যা–এই দুই-ই তো সবচেয়ে পরিচিত বিপর্যয়। কিন্তু এ ধরনের বিপর্যয়গুলোর যে ধরনের উপস্থাপনা দেখতে আমরা অভ্যস্ত, এ ছবিটি তেমন নয়। এ কোনো বিপর্যয়-পরবর্তী অবস্থায় মৃত্যু ও যাতনার উপস্থাপনা নয়; বরং বিপর্যয় প্রভাবিত ও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মানুষকে মনে হচ্ছে সুখী, নিরাপদ, পুনর্জাগরিত ও পুনরুত্থিত। প্রকৃতির মধ্যেই যেন তারা খুঁজে পেয়েছে তাদের নিবাস। ছবিটি তাই স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশে (অথবা বাংলাদেশ নিয়ে) বিপর্যয়-পরবর্তী উপস্থাপনার যে প্রভাবশালী বয়ান ও চর্চা হাজির আছে, যাতে সাধারণত মৃত্যু, দারিদ্র্য ও দুর্দশার উপস্থাপন করা হয়; তার প্রতিবয়ান হাজির করে। এই প্রতিবয়ান হাজির করতে গিয়েই সুলতান দ্বারস্থ হয়েছেন এমন এক প্রাণশক্তির ধারণার কাছে, যা তার ভাষায় ‘অমিয় শক্তি’ (নিজার ৯৯)। বাংলার কৃষকরা হাজার বছর ধরে যে নিপীড়নের শিকার হয়েছে, তার প্রতি চ্যালেঞ্জ জানানোর উদ্দেশ্যেই সুলতান অমিয় শক্তিধর কৃষকদেহের উপস্থাপন করেছেন। বহুবিধ বিপর্যয়ে বিপর্যস্ত বাংলার কৃষকসাধারণের যে ধরনের উপস্থাপনা জয়নুল আবেদিনের ছবিতে সাধারণত পাওয়া যায়, তা-ও সুলতানের ছবির প্রেক্ষাপট হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার সুযোগ তৈরি করে দেয়। তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষের সময়কার হাড়জিরজিরে জনগোষ্ঠীর যেসব ছবি আবেদিন এঁকেছেন, তার প্রভাব বাংলাদেশের শিল্পকলায় এ ধরনের উপস্থাপনার ধারাবাহিকতা সৃষ্টিতে অবদান রেখেছে। তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষ নিঃসন্দেহে বাংলার জনজীবনে একটি বড় বিপর্যয়ের উদাহরণ, যে দুর্ভিক্ষে বাংলার তিরিশ লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল। এই তিরিশ লাখ মানুষও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন বিপর্যয়ের শিকার, যদিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে পাশ্চাত্য ইতিহাসচর্চায় তাদের স্মরণ তেমন একটা নেওয়া হয় না। তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষ যে মানবসৃষ্ট ছিল, তা ইতোমধ্যে বহুল আলোচিত (সেন ১২৭৩-১২৮০)। ব্রিটিশ সরকার ও তার যুদ্ধকালীন বন্ধুদের নীতি ও সিদ্ধান্ত বাংলার মানুষের জীবনকে এই বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করার বদলে পরিত্যক্ত করেছে। জয়নুল আবেদিনের ছবি এদিক থেকে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, তার আঁকা দুর্ভিক্ষকবলিত মানুষের ছবিগুলো বহুদিক থেকেই নাজি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের সেই মানুষের ছবির সঙ্গে মিলে যায়, যাদেরকে ‘দার মুসলমান’ বলা হতো। কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের এই মুসলমানদের আগামবেন ‘বেয়ার লাইফ’-এর একটি উদাহরণ হিসেবে হাজির করেছেন (রেমনেন্টস ৬৯)। কোনো সার্বভৌম ক্ষমতা ও ব্যবস্থার অধীন যখন মানুষের জীবের জীবনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় বহির্ভূত বা বহিষ্কৃত হিসেবে, তখন সার্বভৌম ক্ষমতার অধীন জীবের জীবনের ওই অবস্থাকেই আগামবেন বলেন বেয়ার লাইফ বা উন্মুক্ত জীবন (হোমো স্যাকের ৮)। জয়নুলের আঁকা ছবিতে তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষকালীন বাংলার মানুষের উপস্থাপনাও আমাদের সামনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার বেয়ার লাইফের একটি উদাহরণ হাজির করে। এ এমন এক জীবের জীবন, যা ব্রিটিশ রাজের সার্বভৌম ক্ষমতার নিরাপত্তাবঞ্চিত, যাকে মৃত্যুর মুখে তুলে দেওয়া হয়েছিল। এ এমন এক বেয়ার লাইফ, যাকে আশিলি এমবেম্বের ভাষা ব্যবহার করে নেক্রোপলিটিক্সের অধীন থাকা জীবনও বলা যায়। জৈবক্ষমতা এবং সার্বভৌম ক্ষমতা কীভাবে ঔপনিবেশিক শাসনের পরিপ্রেক্ষিতে কাজ করে, তা ব্যাখ্যা করতে গিয়েই এমবেম্বে নেক্রোপাওয়ার এবং নেক্রোপলিটিক্সের ধারণা হাজির করেছেন। তার মতে, নেক্রোপলিটিক্স হলো এমন একটা রাজনৈতিক ব্যবস্থা, যেখানে ‘সার্বভৌমত্ব মানে হলো কার মূল্য আছে আর কার নেই, কে খরচযোগ্য আর কে নয়–তা নির্ধারণ করার ক্ষমতা’। আমরা এভাবেও বলতে পারি যে, জয়নুল যে দুর্ভিক্ষকবলিত মানবদেহগুলোর ছবি এঁকেছেন, তা মূলত ব্রিটিশ সরকারের নেক্রোপলিটিক্সে জর্জরিত মানবদেহের উপস্থাপনা। সুলতানের ছবিগুলোকে এ ধরনের উপস্থাপনার প্রতিবয়ান হিসেবেও পাঠ করা যায়। কেননা, নেক্রোপলিটিক্সে জর্জরিত ও দুর্ভিক্ষকবলিত বেয়ার লাইফ ধরনের জীবের জীবন আঁকার বদলে তিনি এমন এক জীবের জীবন এঁকেছেন, যার আছে অপরিসীম প্রাণশক্তি, প্রতিটা দুর্যোগের পরেই যে পুনর্জীবিত হয়–পুনরুত্থিত হয়।
বাংলাদেশের ইতিহাসে গণহত্যা এবং বন্যা–এই দুই-ই তো সবচেয়ে পরিচিত বিপর্যয়। কিন্তু এ ধরনের বিপর্যয়গুলোর যে ধরনের উপস্থাপনা দেখতে আমরা অভ্যস্ত, এ ছবিটি তেমন নয়। এ কোনো বিপর্যয়-পরবর্তী অবস্থায় মৃত্যু ও যাতনার উপস্থাপনা নয়; বরং বিপর্যয় প্রভাবিত ও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মানুষকে মনে হচ্ছে সুখী, নিরাপদ, পুনর্জাগরিত ও পুনরুত্থিত। প্রকৃতির মধ্যেই যেন তারা খুঁজে পেয়েছে তাদের নিবাস।
আমাদের আলোচ্য ছবিটিকে বহুবিধ দেহের মধ্যকার আন্তঃসংযুক্তির উপস্থাপনা হিসেবেও পাঠ করা যায়, যে দেহগুলো শুধু মানবদেহই নয়। মানব ও অমানবদেহের মধ্যকার এই আন্তঃসম্পর্ক সুলতানের পরিণত পর্বের ছবিগুলোর সাধারণ বৈশিষ্ট্য। ‘আদম সুরত’ সিনেমায় সুলতান বর্ণনা করেছেন যে, তার ছবিতে সবকিছু ‘রিলেটেড’; এসব ছবিতে গাছ, মানুষ ও ঘরবাড়ির মধ্যে একটা ‘কার্ভের রিলেশন’ হাজির করার মাধ্যমে সবকিছুর খুব কাছাকাছি একটা সম্বন্ধকে উপস্থাপন করা হয়েছে (আদম সুরত 00:২৩:৪৬–00:২৪)। আমাদের আলোচ্য ছবিতেও এ ধরনের সম্বন্ধের হাজির দেখি আমরা। ছবিটির নিচের (অথবা সামনের) অংশের মানবদেহগুলোর ইনডিভিজুয়ালিটি তথা ব্যক্তিসত্তা বেশ পরিষ্কারভাবেই উপস্থাপন করা হয়েছে; কিন্তু তাদের ব্যক্তিসত্তা ফুটিয়ে তোলার জন্য দেহগুলোর মধ্যে দূরত্ব ও বিচ্ছিন্নতার আশ্রয় নেওয়া হয়নি। প্রতিটা মানবদেহ পরস্পরকে ছুঁয়ে আছে এবং তারা নিমজ্জিত আছে তাদের চারপাশের প্রকৃতির মধ্যে। মানব ও অমানবদেহের এক জট (entanglement) হাজির করা হয়েছে ছবিটির মধ্যে। এই জট ছবির একটা বড় অংশজুড়ে এতটা প্রকটভাবে হাজির যে, দেহগুলোর সংমিশ্রণ কিছু বস্তুর সমাহার হওয়ার পাশাপাশি খানিকটা তরঙ্গরূপও ধারণ করেছে। কিছু ক্ষেত্রে, মানবদেহগুলোর সঙ্গে অমানবদেহগুলো যে জায়গাগুলোয় মিলেছে সে জায়গাগুলোয় ফুটে উঠেছে অপবর্তনমূলক নকশা। সুলতানের ছবিতে প্রকৃতির মধ্যে মানবদেহের উপস্থাপনাকে মোস্তফা জামান বর্ণনা করেছেন ‘দেহের সংসদ/সমাবেশ’ (assembly of bodies) হিসেবে, যে সমাবেশে মানবদেহ ও প্রকৃতির মধ্যে, ব্যক্তিদেহ ও সমাজদেহের মধ্যে মৈত্রীর বন্ধনের উপস্থাপনা পাওয়া যায় (‘সুলতান’স আ টেম্পরাল ভিশন’)। আমাদের আলোচ্য ছবিটিতে যে সমাবেশ বা সংসদের উপস্থাপনা আমরা দেখি, তা যে মানব এবং অমানবদেহ নিয়ে গঠিত তা-ই নয়; বরং এই সংসদ বা সমাবেশের ডাক দিয়েছে এক অমানবিক শক্তি–একটা বন্যা, অথবা হয়তো তুফান, অথবা তুফান ও বন্যা দুটি-ই। আরো ভালোভাবে বললে, এই সংসদের ডাক দিয়েছে কোনো একটা বিপর্যয়। এ এমন এক বিপর্যয় যা এই জলে ডোবা মাঠের পটভূমিকে আকার দিয়েছে এবং তাতে মানবদেহগুলোকে ছড়িয়ে দিয়েছে। এই ছবিতে যদি কোনো কর্তাসত্তাকে সবচেয়ে সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা যায়, তবে তা এই বন্যা বা ঝড়–এই বিপর্যয়।
সাম্প্রতিক দুনিয়ায় বিষয়বস্তুকেন্দ্রিক অস্তিত্ববিদ্যা (object oriented ontology) এবং নয়া বস্তুবাদের (new materialism) অনুসারীদের মাধ্যমে অমানবিক বিভিন্ন সত্তার কর্তারূপ (actant) আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। পাশ্চাত্য চিন্তার ইতিহাসে সাম্প্রতিক এই পরিবর্তন বড় ঘটনা বটে, যেহেতু মানবিক সাবজেক্টের স্বাধীন ইচ্ছানির্ভর রাজনীতির ধারণার মধ্যেই ইউরোপের রাজনৈতিক চিন্তা দীর্ঘদিন সীমাবদ্ধ ছিল। নৃতাত্ত্বিক ব্রুনো লাতুর এ কারণেই সাবজেক্টের জায়গায় গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছেন ‘এক্টেন্ট’-এর ধারণা অর্থাৎ অমানবিক সত্তার কর্তারূপের ধারণা। বাংলায় যদিও আমরা সাধারণত সাবজেক্টকে কর্তা এবং সাবজেকটিভিটিকে কর্তাসত্তা হিসেবে অনুবাদ করি; কিন্তু ‘কর্তা’ শব্দটি স্বাভাবিকভাবেই সাবজেক্টের চেয়ে আলাদা দ্যোতনা ধারণ করে। এভাবেও বলা যায় যে, বাংলা ভাষায় কর্তা ধারণাটার মধ্যেই সাবজেক্ট এবং এক্টেন্টের ধারণাকে ধরা সম্ভব, যেহেতু কর্তা ধারণাটি প্রথম থেকেই কর্মের ধারণার সঙ্গে যুক্ত। আর কে না-জানে যে, স্বাধীন ইচ্ছা বা এজেন্সি থাকুক বা না-থাকুক, বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তিও প্রাকৃতিক নিয়মেই এমন সব কর্ম সংঘটন করে, যার প্রভাব পড়ে সরাসরি মানুষের জীবনে। বিশেষ করে, এই করোনা পেন্ডামিকের সময় আমরা দেখলাম কীভাবে ভাইরাসের মতো আধা জীব ও আধা জড় একটা সত্তা পরিণত হয়েছে প্রধান রাজনৈতিক সত্তায়, যার কাছ থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য পৃথিবীর দেশে দেশে মানুষ তাদের রাজনৈতিক অধিকারগুলো লম্বা সময়ের জন্য ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে।
স্বাধীন ইচ্ছা বা এজেন্সি থাকুক বা না-থাকুক, বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তিও প্রাকৃতিক নিয়মেই এমন সব কর্ম সংঘটন করে, যার প্রভাব পড়ে সরাসরি মানুষের জীবনে। বিশেষ করে, এই করোনা পেন্ডামিকের সময় আমরা দেখলাম কীভাবে ভাইরাসের মতো আধা জীব ও আধা জড় একটা সত্তা পরিণত হয়েছে প্রধান রাজনৈতিক সত্তায়, যার কাছ থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য পৃথিবীর দেশে দেশে মানুষ তাদের রাজনৈতিক অধিকারগুলো লম্বা সময়ের জন্য ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে।
ব্রুনো লাতুর প্রস্তাবিত ‘অবজেক্ট অরিয়েন্টেড ডেমক্রেসি’ এবং ‘ডিঙ্গোপলিটিক্সের’ ধারণা সাম্প্রতিক সময়ে জন্ম দিয়েছে বহু আলোচনা ও তর্কের। বিষয়বস্তুনির্ভর গণতন্ত্রের সারকথা হলো, সংসদীয় গণতন্ত্রে যেসব বিষয় ও বস্তুর প্রতিনিধিত্ব করেন জনপ্রতিনিধিরা, সেগুলোর আরো বাস্তবসম্মত উপস্থাপন করতে হবে। অর্থাৎ, সুন্দরবনে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প নিয়ে কথা বলার সময় সুন্দরবন ও তারমধ্যে বসবাসকারী সব সত্তার বাস্তবসম্মত রিপ্রেজেন্টেশন করার দিকে নজর দেওয়াও গণতন্ত্রের কাজ। লাতুরের দাবি, বিজ্ঞানচর্চায় রিপ্রেজেন্টেশন বলতে আমরা যা বুঝি, সংসদীয় গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে তা বুঝি না। আমরা ভাবি যে, সংসদীয় পদ্ধতি ঠিক থাকলেই রিপ্রেজেন্টেশনের শর্ত পূরণ হয়। কিন্তু লাতুরের প্রস্তাব হলো, রাজনৈতিক রিপ্রেজেন্টেশনের এই সীমাবদ্ধতা দূর করার জন্য এই দুই ধরনের (বৈজ্ঞানিক ও গণতান্ত্রিক) রিপ্রেজেন্টেশনের মধ্যকার সরল বিভাজনটিকেও চ্যালেঞ্জ করতে হবে (ডিঙ্গোপলিটিক্স ১৬)। কিন্তু এ ধরনের গণতন্ত্রের জন্য বিষয়বস্তুর সঙ্গে কর্তার সরল বিভাজন ও বৈপরীত্যের ধারণার ঊর্ধ্বেও ওঠা প্রয়োজন। অর্থাৎ, মানুষই হলো সাবজেক্ট আর বাকি সবকিছু তার কাছে অবজেক্ট–এই অধিবিদ্যক বাইনারি অতিক্রম করতে হবে। লাতুর তাই প্রস্তাব করেন, আমাদেরকে ভাবতে হবে এমন এক ‘ডিঙ্গোপলিটিক্স’-এর ধারণা, যা অবজেক্ট বা বিষয়বস্তুর ধারণা অতিক্রম করে ‘থিং’ নিয়ে চিন্তা করতে পারে। তথাকথিত রিয়েলপলিটিক্সের বিপরীতে যে ডিঙ্গোপলিটিক্সের প্রস্তাব করেন লাতুর, তা জার্মান ডিং ও ইংরেজি থিং শব্দের ধাতুগত অর্থের ওপর নির্ভরশীল। অক্সফোর্ড ডিকশনারি এবং হাইডেগারের বরাত দিয়ে লাতুর দেখান যে, ইংরেজি থিং শব্দটির আদি অর্থ হলো ‘সমাবেশ বা সংসদ’। থিং ধারণাটি দিয়ে তিনি এমন এক সমাবেশের কথা বলেন যার মধ্যে শুধু মানুষই নয়; বরং নানান অমানবিক সত্তারও উপস্থিতি রয়েছে (লাতুর ২৩)।
লাতুর ছাড়াও আরো অনেকেই সাম্প্রতিক সময়ে থিং ধারণাটির রাজনৈতিক গুরুত্ব নিয়ে আলাপ তুলেছেন। বিশেষ করে নয়া বস্তুবাদী তাত্ত্বিকরা থিং শব্দটির ধারণক্ষমতা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলাপ তুলেছেন, যেহেতু থিং বা কিছু শব্দটি দিয়ে আমরা সাধারণত এমন কিছু বোঝাই যা ঠিক ওই বোঝানোর মুহূর্তে বিষয়বস্তু হিসেবে আমাদের সংজ্ঞায়নের বাইরে থেকে যায়। যখন আমরা কোনো কিছুর নাম জানি না, বা যখন আমরা বিষয়, বস্তু ও মানুষের এমন এক সম্মিলিত ও জটপাকানো অস্তিত্বের মুখোমুখি হই যাকে হুট করে কোনো নাম দিতে পারি না, তখনই সাধারণত আমরা থিং বা কিছু শব্দটি ব্যবহার করি। অথবা যখন আমরা সবকিছু (everything) কিংবা কিছু-না (nothing) ধরনের অস্তিত্ব সংক্রান্ত ধারণার কথা বলি। সুলতানের এই ছবিটিতেও আমরা মানুষ, প্রকৃতি ইত্যাদি বিষয়বস্তুর সীমানা ভাঙা ও জটপাকানো একটা কিছুর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হই। এক্ষেত্রে দার্শনিক ও রাজনৈতিক তাত্ত্বিক জেন বেনেটে প্রস্তাবিত প্রাণশক্তিময় বস্তুবাদের (Vibrant Materialism) ধারণা আমাদের জন্য বেশ কাজের হতে পারে, যেহেতু সুলতানের ছবিটিতে আমরা মানুষের জীবসত্তা এবং প্রকৃতির মধ্যে হাজির-থাকা প্রাণশক্তির উপস্থাপন দেখি।
প্রকৃতি, খনিজ পদার্থ, পণ্য ইত্যাদি অমানবিক সত্তা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ ধরনের যে সবকিছু এক্টেন্ট বা কর্তা হিসেবে মানবজীবনে প্রভাব রাখতে পারে; সেসবের কর্তা হয়ে ওঠার সক্ষমতা ও প্রভাবন ক্ষমতাকেই (effective power) বেনেট ভাইটালিটি তথা প্রাণশক্তি ধারণাটি দিয়ে ব্যাখ্যা করেন (viii)। অমানবিক যে কোনো কিছুর মধ্যেই যে ক্ষমতা রয়েছে, যে ক্ষমতা মানবদেহকে ধ্বংস অথবা উন্নত করে, গতি দেয় অথবা থামায়, পুষ্টি দেয় অথবা পচায়; তাকে বেনেট বলেন ‘থিং পাওয়ার’ (ix)। বস্তু এবং প্রাণের মধ্যকার সরল বিভাজনকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে বেনেটের প্রাণশক্তিময় বস্তুবাদ (৮)। তার মতে, মানুষের ক্ষমতাও দিনশেষে ‘এক ধরনের থিং-পাওয়ার’, যেহেতু মানুষ নিজেও এক ধরনের প্রাণশক্তিময় বস্তুত্ব (vibrant materiality)। যেহেতু, মানবদেহও খনিজ পদার্থ থেকে শুরু করে বিদ্যুতের মতো বহু স্বশাসিত ও স্বনিয়ন্ত্রিত সত্তারই সমাচার (বেনেট ১০)। তাই সুলতানের এই ছবিটিতে হাজির-থাকা বন্যা বা তুফান যেমন থিং-পাওয়ারের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে, তেমনি এই ছবির মানবদেহগুলোর পেশিগুলোকেও থিং-পাওয়ারের ধারক হিসেবে পাঠ করা যেতে পারে।
সুলতানের আরো বহু ছবির মতোই এ ছবিতেও বৃহৎ, বলবান ও পুনর্জীবনমূলক (regenerative) পেশির উপস্থাপন করা হয়েছে, এমনকি নারী ও শিশুর দেহেও পেশির হাজির দেখা যায়। অনন্ত সম্ভাবনা কিংবা অসীম প্রাণশক্তির উপস্থাপন করা যেহেতু প্রায় অসম্ভব, তাই অগণিত পেশির জাহেরি উপস্থাপনার মধ্যে তার বাতেনি হাজির করা হয়েছে এ ধরনের উপস্থাপনায়। এই বাতেন বা ভেতরকার শক্তিকেই তারেক মাসুদ তার ‘আদম সুরত’ সিনেমায় নাম দিয়েছেন ‘ইনার স্ট্রেংথ’। এ ছবিতে একটা পুরুষদেহকে দেখে মনে হচ্ছে সে জেগে উঠেছে এবং নিজ দেহের অন্তর্গত স্বনিয়ন্ত্রিত ও স্বশাসিত প্রাণশক্তিকে বিস্ময় ও আনন্দের সঙ্গে উপলব্ধি করছে। প্রাণশক্তিময় বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে সুলতানের আঁকা ছবিতে পেশির উপস্থাপনাকে মানবদেহের অন্তর্গত স্বনিয়ন্ত্রিত ও স্বশাসিত প্রাণশক্তিময় বস্তুত্ব উপস্থাপনার এক ধরনের পুরোভূমিক কৌশলও বলা যেতে পারে। বেনেটের চিন্তা ধার করে এভাবেও বলা যায় যে, এই ছবিটার মধ্যে মানবদেহ এবং প্রাকৃতিক দেহগুলোর মধ্যে ‘থিং পাওয়ার’-এর উপস্থাপনা ধরা পড়ে। থিং পাওয়ারকে আমরা বাংলায় চাইলে ‘কিছুর ক্ষমতা’ বলতে পারি, যা-তা ক্ষমতাও বলতে পারি। তবে ধারণাটির একটি সঠিক অনুবাদ হাজির করা এই লেখাটির উদ্দেশ্য নয়। এমনও হতে পারে যে, ‘গণক্ষমতা’ ছাড়া অন্য কোনো পরিভাষার প্রয়োজন নেই থিং পাওয়ারের ধারণা তুলে ধরার জন্য, যদি আমরা গণ শব্দটিকে এর ব্যাপক অর্থে চিন্তা ও চর্চা করতে পারি। গণ শব্দটির ধারণক্ষমতাও কম নয়। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ অনুযায়ী এর আক্ষরিক অর্থসমূহ: সমুদয় ইত্যাদি; এবং শব্দটি শুধু মানুষের ক্ষেত্রেই নয়; বরং দেবতা এবং রাক্ষসদের সম্মেলন বোঝাতেও ব্যবহৃত হতে পারে। সংস্কৃত সাহিত্যেও শব্দটির ব্যবহার পাওয়া যায় মানুষ, দেবতা এবং জীবের ক্ষেত্রে। বাংলা ভাষায় আধুনিক জীববিজ্ঞানের শ্রেণিবিভাগ সংক্রান্ত পরিভাষা হিসেবেও গণ শব্দটির এমন অর্থ পাওয়া যায়, যাতে সব জীবকেই কোনো-না-কোনো গণের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এবং প্রতিটি গণই একের অধিক প্রজাতিকে ধারণ করতে সক্ষম বর্গ। সুলতানের ছবির রাজনৈতিকতা আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে উঠবে, যদি আমরা গণ ধারণাটিকে ব্যক্তিমানুষের সম্মিলনের ধারণা অতিক্রম করে মানুষ এবং অমানবিক বিভিন্ন সত্তার সম্মিলন হিসেবে চিন্তা করতে পারি এবং গণক্ষমতাকে চিন্তা করতে পারি সবকিছুর মধ্যেই হাজির-থাকা প্রাণশক্তি বা রুহ হিসেবে। সহজ করে বললে, এমন এক সংসদের কথা আমাদের চিন্তা করতে হবে, যা এমন এক গণের প্রতিনিধিত্ব করে যা শুধু মানুষেরই নয়।
দার্শনিক ও নারীবাদী তাত্ত্বিক রোজি ব্রায়দত্তির মতে, জীবের জীবনের (জো) ধারণার মধ্যে এমন এক উত্তর-মানবকেন্দ্রিক (post-anthropocentric) সাবজেক্টের ধারণার সম্ভাবনা রয়েছে, যার মধ্যে সব অমানবিক সত্তার প্রাণশক্তিকেই ধারণ করা সম্ভব হতে পারে (৬৮৬)। তিনি যে জীবের জীবনকেন্দ্রিক অস্তিত্ববিদ্যার প্রস্তাব করেন, তা একদিকে যেমন অ-মানবকেন্দ্রিক (non-anthropocentric), তেমনি আবার তা ‘মানুষের নৃতাত্ত্বিকভাবে সীমাবদ্ধ কাঠামোকে অস্বীকারও করে না’ (৬৯০)। এই লেখায়ও, সুলতানের ছবিকে কেন্দ্রে রেখে আমি মানুষের জীবের জীবন বলতে যা বোঝাচ্ছি, তাও মানুষের জীবের জীবনের নৃতাত্ত্বিক কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু একইসঙ্গে তা তুলে ধরে এই জীবের জীবনের সঙ্গে অন্যান্য জীব ও অজীব সত্তার এমন এক জটবাঁধানো সম্বন্ধ, প্রাণশক্তির দিক থেকে এমন এক রাজনৈতিক ঐক্য–যা প্রাণ ও প্রকৃতির ভেদরেখা অতিক্রম করা এক সম্মিলন।
যদিও আমাদের আলোচ্য ছবিটিতে উপস্থাপিত জীবের জীবন পাশ্চাত্যকেন্দ্রিক সাবজেকটিভিটির ধারণাকে বাতিল করে দেয়; কিন্তু তা একইসঙ্গে আবার মানুষকে রাখে এই জীবের জীবনকেন্দ্রিক উপস্থাপনার কেন্দ্রে। অন্যদিকে বিষয়বস্তুকেন্দ্রিক অস্তিত্বতত্ত্ব এবং নয়া বস্তুবাদী ধারার চিন্তায় প্রকৃতি ও উপনিবেশের ওপর সার্বভৌমত্ব কায়েম করা পাশ্চাত্যের সাদা পুরুষমানুষের সাবজেকটিভিটিকে কেন্দ্রচ্যুত করতে গিয়ে অনেক সময় সর্বজনীন মানুষের ধারণাটিকেই কেন্দ্রচ্যুত করে ফেলার পরিস্থিতি তৈরি হয়। সৈয়দ নিজার যাকে বলেন ‘প্রান্তের জীবনশক্তি’, তার উপস্থাপনার কারণেই সুলতানের ছবিতে প্রাণশক্তির তত্ত্ব উপস্থাপনার জন্য–পাশ্চাত্য নামক কেন্দ্রের চিন্তায় হাজির-থাকা হিউম্যান সাবজেক্টের ধারণার প্রতিবয়ান হাজির করার জন্য–খোদ মানবদেহকেই কেন্দ্রচ্যুত করার কোনো প্রয়োজন তো পড়েইনি; বরং তা কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু হয়েছে। অর্থাৎ, এই জীবনশক্তি পাশ্চাত্যের প্রভিন্সিয়ালাইজেশন ঘটায় স্বাভাবিকভাবেই। সুলতানের ছবিতে হাজির-থাকা উত্তর-ঔপনিবেশিক প্রাণশক্তিবাদের সঙ্গে সাম্প্রতিক পাশ্চাত্যের প্রাণশক্তিময় বস্তুবাদী চিন্তাধারাগুলোর মিলের পাশাপাশি পার্থক্যের এই বিশেষ দিকটিও মাথায় রাখা দরকার। সাম্প্রতিক পাশ্চাত্যের নয়া বস্তুবাদী এবং প্রাণশক্তিময় বস্তুবাদী বিভিন্ন চিন্তাধারা গড়ে উঠেছে মূলত উত্তর-কাঠামোবাদীদের হাতে পাশ্চাত্য অধিবিদ্যার ‘হিউম্যান সাবজেক্ট’ তার সার্বভৌম অবস্থান থেকে কেন্দ্রচ্যুত হওয়ার পর। অন্যদিকে সুলতানের প্রাণশক্তিবাদ পাশ্চাত্য অধিবিদ্যায় হাজির-থাকা হিউম্যান সাবজেক্টের ধারণাকে কেন্দ্রচ্যুত করেছে বি-উপনিবেশায়নের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, বাংলার কৃষকের জীবের জীবনের প্রাণশক্তিকে কেন্দ্রীয় বিষয় বানিয়ে। এই দু-ধরনের প্রাণশক্তিবাদের মধ্যে সাধারণ মিল এই যে, দুই ক্ষেত্রেই পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক চিন্তা ও চর্চার মধ্যে যে ধরনের জীবন ও সত্তার রাজনৈতিক ইচ্ছা ও স্বাধীনতা স্বীকৃত নয়, বা পাশ্চাত্য অধিবিদ্যার ওপর নির্ভর করে যে সত্তাদের রাজনৈতিক এজেন্সির ধারণা প্রকাশ করা কঠিন, সেই ধরনের অস্তিত্বের প্রতি মনোযোগ দেওয়া হয়েছে। উপনিবেশিত প্রজা (subject) এবং পরাজিত (subjugated) সব ‘কিছু’র (যেমন: উপনিবেশিত অঞ্চলের সব প্রাণ ও প্রকৃতি) মধ্যে সাধারণ মিল হলো যে, তা একটি বৈশ্বিক পুঁজিবাদী রেজিমের হাতে শোষণ ও জুলুমের শিকার। উভয়েই এই রেজিমের রাজনীতি ও শাসনের অধীন আবদ্ধ আছে বহির্ভূত জীবন ও সত্তা হিসেবে। জর্জো আগামবেনের মতে, পাশ্চাত্যের নগর (পলিটি) এবং পলিটিক্সের ধারণার মধ্যে সবসময়ই মানুষের জীবের জীবনকে অন্তর্ভুক্ত করে রাখা হয়েছে বহির্ভূত হিসেবে। এমনকি আধুনিক যুগেও দীর্ঘ সময় ধরে নারী, দাস ও উপনিবেশিত জনতার শুধু এই জীবের জীবনটুকুই ছিল। এখনো উপনিবেশিত অঞ্চলের মানুষ বৈশ্বিক রাজনীতিতে নিজেদের রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়নি। এবং সাম্প্রতিক দুনিয়ায় ফ্যাসিবাদের উত্থানের কারণে দীর্ঘ উপনিবেশবিরোধী সংগ্রাম করে স্বাধীন হওয়া বহু রাষ্ট্রের মানুষের জীবনই রাজনৈতিক অধিকারহীন জীবের জীবনে সংকুচিত হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের মানুষের অবস্থাও এমনই। এদিক থেকে চিন্তা করলে, বর্তমান বাংলাদেশের মানুষের জীবের জীবন (zoe) এবং এ অঞ্চলের প্রকৃতির (geo) মধ্যে একটি সাধারণ রাজনৈতিক ঐক্য পাওয়া যাবে, যেহেতু উভয়েই একই বিশ্বব্যবস্থার হাতে রাজনৈতিক অধিকারবঞ্চিত ও শোষিত অস্তিত্বে পরিণত হয়েছে। এই ঐক্যের ধারণা বুঝলে আমরা বাংলাদেশের বাইরেও দক্ষিণ এশিয়ার এবং সারা দুনিয়ার সব প্রাণ, প্রকৃতির সঙ্গে রাজনৈতিক ঐক্যের বন্ধনেও নিজেদের আবিষ্কার করতে পারব।
উপনিবেশিত প্রজা (subject) এবং পরাজিত (subjugated) সব ‘কিছু’র (যেমন: উপনিবেশিত অঞ্চলের সব প্রাণ ও প্রকৃতি) মধ্যে সাধারণ মিল হলো যে, তা একটি বৈশ্বিক পুঁজিবাদী রেজিমের হাতে শোষণ ও জুলুমের শিকার। উভয়েই এই রেজিমের রাজনীতি ও শাসনের অধীন আবদ্ধ আছে বহির্ভূত জীবন ও সত্তা হিসেবে।
যদিও প্রাণশক্তিময় জীবের জীবন সুলতানের বহু ছবিরই সাধারণ বিষয়; কিন্তু এ ছবিটিতে এ ধরনের জীবনের একটি বিশেষ অবস্থাকে, বা এই জীবন সম্পর্কে একটি বিশেষ বয়ানেরও চিত্রায়ণ করা হয়েছে। যদিও এ দাবি করা ভুল হবে-না যে, সুলতানের শিল্পের প্রাণশক্তিবাদের মধ্যেই এই বিশেষ অবস্থা বা বয়ানটির ইশারা পাওয়া যায়; কিন্তু এই ছবিতে তা বিশেষভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। ছবিটি কোনো বিশেষ বা একক দুর্যোগ বা বিপর্যয়ের ঘটনা নয়, নয় ইতিহাসের কোনো বিশেষ গণহত্যার ঘটনা অথবা নয় শুধু মানবঘটিত অথবা প্রাকৃতিক বিপর্যয় (উভয়ই আমাদের ইতিহাসে আছে বহু); বরং এ এক অনন্ত বিপর্যয়ের ঘটনা। এই বিপর্যয়ের মধ্যে থাকা অস্তিত্বের জন্যই সুলতান আশ্রয় খুঁজেছেন প্রাণশক্তির তত্ত্ব ফুটিয়ে তোলা শিল্পচর্চায়। শাহাদুজ্জামানের কাছে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি দাবি করেছেন, ‘ব্রিটিশরা করেছে (শোষণ), পাকিস্তানিরা লুটেপুটে খেয়েছে, এখনো চলছে; কিন্তু ওরা অমিয় শক্তিধর। কৃষককে ওরা শেষ করতে পারবে না, আমার কৃষক এরকম’ (নিজার ৯৯)। আমাদের আলোচ্য ছবিটিতেও কৃষকের জীবের জীবনের এমন একটা অবস্থা তিনি তুলে ধরতে চেয়েছেন, যা অনন্ত বিপর্যয়ের মধ্যেও অনন্ত প্রাণশক্তিময়।
‘আদম সুরত’ সিনেমার শেষদিকে সুলতানের একটি সাক্ষাৎকারকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, হয়তো তার মধ্যেও এমন একটি পাঠের ইশারা রয়ে গেছে। কেন তিনি কৃষকের জীবনকে শিল্পের বিষয় বানালেন, তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সুলতান পাল্টা প্রশ্ন করেন: যারা খাদ্য উৎপাদন ও জীবনধর্মী নানা কাজের সঙ্গে যুক্ত, সেসব মানুষের জীবনকে ছবির বিষয়বস্তু করলে আপত্তি থাকবে কেন? এই প্রশ্ন তোলার সময় তিনি একবার থামেন, ইশারা করেন একটা কিছুর দিকে। এ সময়ই এক মুহূর্তের জন্য পর্দায় হাজির হয় আমাদের আলোচিত এই পেইন্টিংটি (‘আদম সুরত’ ০০:৩৭:৫০–০০:৩৮:১০)। এর পরই তিনি বলেন: ‘বহুকাল যাবৎ এরা, সেই আদিম চেতনা থেকেই, আদিম জীবন থেকেই এরা প্রতিবাদ করে চলেছে, তাদের সাফারিংটা প্রকাশ করতে চেয়েছে।’ আল্লামা ইকবাল তার কবিতার মাধ্যমে এই যাতনা ও প্রতিবাদকে প্রকাশ করেছেন, এই উদাহরণও তিনি এই সময় দেন। অর্থাৎ, ঔপনিবেশিক এবং উত্তর-ঔপনিবেশিক যুগব্যাপী যে অনন্ত বিপর্যয়, যে অনন্ত জরুরি অবস্থার মধ্যে বাংলার কৃষিজীবী সমাজ নিজেদের আবিষ্কার করেছে, যে অবস্থার মধ্যে বারবার তাদেরকে পুনরুৎপাদন করা হয়েছে অধিকারবঞ্চিত ও খরচযোগ্য বেয়ার লাইফ হিসেবে, সেই অবস্থার মধ্যেও যাতনা প্রকাশকারী ও প্রতিরোধী নায়ক হিসেবেই সুলতান কৃষকের প্রাণশক্তিময় জীবের জীবনকে এঁকেছেন–এই দাবি করা যায়।
এই ছবিতে হাজির-থাকা এই অনন্ত অবস্থার সঙ্গে ওয়াল্টার বেনিয়ামিন বর্ণিত অনন্ত জরুরি অবস্থার সঙ্গে একটা তুলনামূলক আলাপ করলে প্রাণশক্তিময় জীবের জীবনের রাজনৈতিক দিগন্তটি আমাদের কাছে আরো পরিষ্কার হয়ে ওঠে। মূলত নাজি আইনজ্ঞ কার্ল শ্মিটের জরুরি অবস্থা সংক্রান্ত তত্ত্বকে খর্ব করতে গিয়ে ওয়াল্টার বেনিয়ামিন লিখেছিলেন: “মজলুমের ঐতিহ্য আমাদের শেখায় যে, যেই ‘জরুরি অবস্থা’র মধ্যে আমরা বসবাস করছি, তা ব্যতিক্রম নয়; বরং স্বাভাবিক অবস্থা” (৩৯২)। কিন্তু এর মাধ্যমে তিনি ঐতিহাসিক বস্তুবাদের ঐতিহ্যে হাজির-থাকা সময় ও ইতিহাসের ধারণার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হাজির করেছিলেন। বেনিয়ামিনের মতে, তার সময়কার ঐতিহাসিক বস্তুবাদী ঐতিহ্যে যে ধরনের যান্ত্রিক, প্রগতিবাদী ও টেলিওলজিক্যাল দৃষ্টিভঙ্গি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে তা কার্যকর ছিল না। যেহেতু পুঁজিবাদী ও ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলো প্রগতি এবং ক্রম-উন্নয়নের ধারণার ওপর ভর করেই এমন সব জরুরি অবস্থা জারি করে, যার মধ্যে সমাজের অধিকাংশ মানুষ খরচযোগ্য ও নিধনযোগ্য জীবে পরিণত হয়। সাময়িক জরুরতের দোহাই দিয়ে কায়েম হওয়া ফ্যাসিবাদ ও একনায়কত্বের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক বস্তুবাদকে শানিত করার জন্যই বেনিয়ামিন সরলরৈখিক সময়ের ধারণা অতিক্রম করে মজলুমের জন্য এক অনন্ত বিপর্যয়ের ইতিহাসের ছবি ধরতে চেয়েছেন তাঁর লেখায়।
পুঁজিবাদী ও ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলো প্রগতি এবং ক্রম-উন্নয়নের ধারণার ওপর ভর করেই এমন সব জরুরি অবস্থা জারি করে, যার মধ্যে সমাজের অধিকাংশ মানুষ খরচযোগ্য ও নিধনযোগ্য জীবে পরিণত হয়। সাময়িক জরুরতের দোহাই দিয়ে কায়েম হওয়া ফ্যাসিবাদ ও একনায়কত্বের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক বস্তুবাদকে শানিত করার জন্যই বেনিয়ামিন সরলরৈখিক সময়ের ধারণা অতিক্রম করে মজলুমের জন্য এক অনন্ত বিপর্যয়ের ইতিহাসের ছবি ধরতে চেয়েছেন তাঁর লেখায়।
আমাদের আলোচিত ছবিটিতেও সুলতান এমন একটি ইতিহাসের ছবি এঁকেছেন, যা বেনিয়ামিন বর্ণিত মজলুমের ঐতিহ্য থেকে পাওয়া শিক্ষার সঙ্গে খাপ খায়। সরলরৈখিক প্রগতির ধারণা অতিক্রম করে ইতিহাসের এক অনন্ত ছবিকে বেনিয়ামিন ধরতে চান–যেন এক ‘আসল জরুরি অবস্থা’র হাজিরা ঘটানো যায়। আসল জরুরি অবস্থা হাজির হয় তখনই, যখন জরুরি অবস্থার যুক্তিকে মজলুমরা দাঁড় করিয়ে দেয় তার পায়ের ওপর (যেহেতু শাসকশ্রেণির মতাদর্শের মধ্যে তা বরাবর মাথার ওপর ভর করেই দাঁড়িয়ে থাকে)। অন্যভাবে বললে, শাসকশ্রেণির ঘোষিত অথবা ঘোষণা না-করেই মতাদর্শিক ও দমনমূলক রাষ্ট্রযন্ত্রগুলোর মাধ্যমে জারি করা জরুরি অবস্থার ফিকশনালিটিটা উন্মোচন করার মাধ্যমেই আসল জরুরি অবস্থার সূচনা ঘটানো যায়। বেনিয়ামিন তা করেছেন অনন্ত জরুরি অবস্থার মধ্যে থাকা মজলুমের ঐতিহ্য থেকে পাওয়া শিক্ষার দাবিতে, আর সুলতান তা করেছেন অনন্ত বিপর্যয়ের মধ্যে থাকা মজলুমের চিত্রায়ণ করার মাধ্যমে। বেনিয়ামিন বর্ণিত আসল জরুরি অবস্থা কাঠামোগতভাবে মাহদীয় সময়ের সঙ্গেও তুলনীয়, যেহেতু তা এমন এক সময়ের ধারণার প্রতিনিধিত্ব করে, যাতে অনন্ত জরুরি অবস্থার মধ্যে আইনের অনন্ত বাতিল অবস্থাটাই উন্মোচিত হয় (আগামবেন, ‘দা মেসায়াহ ১৬২-১৬৩’)।
আমাদের আলোচ্য ছবিটিতে যেমন অনন্ত বিপর্যয়কে উন্মোচন ও বাতিল করে দিতে হাজির মজলুম জীবের জীবনের অনন্ত প্রাণশক্তি। এদিক থেকে চিন্তা করলে জীবের জীবনের এই প্রাণশক্তিকে মাহদীয় প্রাণশক্তিও বলা যায়। এ এমন কোনো জীবের জীবনের চিত্রায়ণ নয়–যা মরণাপন্ন। এ এমন কোনো জীবন নয়–যার গায়ে জৈবরাজনীতি পরিচয়ের ছাপ মেরে দিতে পেরেছে। এ এমন এক জীবন, যা অনন্ত বিপর্যয়ের মধ্যেও অনন্ত প্রাণশক্তিময়। নিম্নবর্গের তাত্ত্বিকরা নিম্নবর্গের যে কর্তাসত্তার ধারণা হাজির করতে চান, যা গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের মতে, ‘কথা বলতে পারে না’, সেই ধরনের কোনো কর্তাসত্তাকে এই ছবিতে উপস্থাপন করার চেষ্টা করা হয়নি। এ ছবিতে উপস্থাপন করা প্রাণশক্তিময় জীবের জীবন–কথা বলে না। কেননা, তার বাণী বা কালেমাকে (logos) সুলতান উপস্থাপন করার চেষ্টা করেননি। তিনি শুধু অনন্ত প্রাণশক্তি তথা সম্ভাবনাময় জীবের জীবনকে ভাষা দিতে চেয়েছেন। এ এমন কোনো ঐতিহাসিক মহাবিপর্যয়ের ছবি (ওয়াল্টার বেনিয়ামিনের লেখায় যেমন) নয়, যাতে ইতিহাসের ফেরেশতার পায়ে লুটিয়ে পড়ছে প্রগতির তুফানে লন্ডভন্ড ধ্বংসস্তূপ; বরং এ এমন এক বিপর্যয় যা প্রাণশক্তিময় পুনরুত্থানের পূর্বরাগ ও পূর্বশর্ত।
অনন্ত বিপর্যয়ের মধ্যে থাকা অনন্ত প্রাণশক্তিময় জীবের জীবনের উপস্থাপনা আমাদেরকে দেয় প্রাণশক্তিময় বস্তু ও জীবনের এক মাহদীয় বৈশিষ্ট্যের ধারণা। বন্যার জলে ডোবা জমিতে নয়া বস্তুবাদ আর ঐতিহাসিক বস্তুবাদের অপবর্তনে যে ছবি আমাদের সামনে ফুটে ওঠে, তাকে মাহদীয় প্রাণশক্তিবাদ নাম দেওয়া যায়। বন্যা-পরবর্তী এই মাহদীয় প্রাণশক্তিবাদের রাজনৈতিক ধর্মতত্ত্ব সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা এই লেখাটির পরিধির মধ্যে পড়ে না। আপাতত শুধু বলা দরকার যে, এ লেখায় আলোচিত বন্যার জলে ডোবা জমিতে যে মাহদীয় প্রাণশক্তিবাদ ভেসে উঠেছে, তা একটা অপেক্ষা, ও প্রতিজ্ঞা–প্রাণশক্তিময় বস্তু এবং প্রাণশক্তিময় জীবনের হাতে–অরাজনৈতিক ও অধিকারবঞ্চিত জীবন ও অস্তিত্ব উৎপাদনরত যন্ত্রটির অনন্ত পরাজয়ের।
পারভেজ আলম: লেখক, গবেষক ও রাজনৈতিক কর্মী
ই-মেইল: stparvez@gmail.com
তথ্যসূত্র:
Agamben, Giorgio. Homo Sacer; Sovereign power and Bare Life, Translated by Daniel Heller-Roazen. Stanford University Press, 2007.
Agamben, Giorgio. “The Messiah and the Sovereign: The problem of Law in Walter Benjamin”. Potentialities; Collected Essays in Philosophy, Edited and Translated by Daniel Heller Roazen. Stanford University Press, 1999.
Agamben, Giorgio. Remnants of Auschwitz, The Witness and the Archive. Translated by Daniel Heller-Roazen. Zone Books, New York, 1999.
Benjamin, Walter. “On the Concept of History”. Selected Writings, volume 4, 1938-1940. Translated by Edmund Jephcott and Others, Edited by Howard Eiland and Michael W. Jennings. Harvard University Press, 1996.
Bennett, Jane. Vibrant Matter: A Political Ecology of Things. Durham: Duke UP, 2010.
Braidotti, Rosi. “Posthuman Feminist Theory.” Oxford Handbook of Feminist Theory, edited by Lisa Disch and Mary Hawkesworth, Oxford UP, 2016, pp. 673–698.
Butler, Judith. “Bodies and power revisited.” Dianna Taylor and Karen Vintges (eds.), Feminism and the Final Foucault. Urbana: University of Illinois Press. P.183-194. 2004.
Masud, Tareque. Adam Surat (Inner Strength), 1989. https://www.youtube.com/watch?v=t_2d5x6TzMs
Mbembe, Achille. “Necropolitics”. Public Culture, Volume 15, Number 1, Duke University Press, pp. 11-40
Nizar, Syed. The colonization of Indian Art and Sultan’s decolonial thought (ভারত শিল্পের উপনিবেশায়ন ও সুলতানের বি-উপনিবেশায়ন ভাবনা). Cyatanno, 2017.
Sen, Amartya. “Famines as Failures of Exchange Entitlements”. Economic and Political Weekly. 11 (31/33), 1976.pp. 1273-1280.
Spivak, Gayatri Chakravorty.”Can the Subaltern Speak?”. In Nelson, Cary; Grossberg, Lawrence (eds.). Marxism and the Interpretation of Culture. Basingstoke: Macmillan. 1988. pp. 271–313.
Zaman, Mustapha. Sultan’s a temporal vision of awakened bodies. The Daily Star. August 11, 2017. https://www.thedailystar.net/star-weekend/sultans-atemporal-vision-awakened-bodies-1446589.
494