পুরুষ-প্রাধান্যের প্রণোদনা ঋণের প্যাকেজ এবং রাষ্ট্রের রূপকল্পে সৃষ্ট পরনির্ভর নারী

“মেয়েরা খাবে সবার শেষে”

পুরুষ-প্রাধান্যের প্রণোদনা ঋণের প্যাকেজ এবং রাষ্ট্রের রূপকল্পে সৃষ্ট পরনির্ভর নারী

সায়েমা খাতুন

করোনাকালে সমাজে বিদ্যমান নানামুখি বৈষম্য আরও জোরদার হয়েছে। করোনাপূর্ব রাজনৈতিক অর্থনৈতিক বিধিব্যবস্থার কারণে এবং করোনাকালে গৃহীত বিধি ব্যবস্থায় বৈষম্যপীড়িত মানুষেরা আরও পীড়নের শিকার হচ্ছেন। করোনাকালে, কোভিড-১৯ মোকাবিলায়, বাংলাদেশে বিভিন্নরকম বিধিনিষেধ যেভাবে আরোপ করা হয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন জনগোষ্ঠীকে সহায়তার জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে যেসব প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে সেগুলো বিশ্লেষণ করলে সমাজের শ্রেণি লিঙ্গীয় বৈষম্য তাতে স্পষ্ট ধরা পড়ে। এই লেখায় প্রণোদনা প্যাকেজে নারীর প্রান্তিক অবস্থান কিংবা অনুপস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে।     

এ বছরের শুরুতে অর্থমন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবনায় ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য সরকার সর্বশেষ দুটি অর্থনৈতিক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করলে এ পর্যন্ত করোনাকালের দুর্যোগকালীন প্রণোদনা দাঁড়ায় মোট ২৩ টিতে এবং অর্থ বরাদ্দ ১.২১ লাখ কোটি থেকে বেড়ে ১.২৪ লাখ কোটিতে দাঁড়ায়, যা দেশের জিডিপির ৪.৪৪ শতাংশ। সুখের কথা হল, শেষ পর্যন্ত সরকার এ বছর কুটির, ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি (CMSME) এবং নারী উদ্যোক্তাদের জন্য প্রথম ১,৫০০ কোটি টাকার প্রণোদনাটি বরাদ্দ করেছে এবং দ্বিতীয়টি বরাদ্দ করেছে সামাজিক সুরক্ষাজালের আওতায় ১৫০টি উপজেলায় বয়স্ক, বিধবা এবং স্বামী পরিত্যক্ত নারীদের জন্য, যার পরিমাণ ১,২০০ কোটি টাকা। সিএমএসএমইর আওতায় বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা ৩০০ কোটি এবং জয়িতা ফাউন্ডেশন ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়েছে। করোনাকালীন সংকটকে সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করে দেশে সামাজিক সুরক্ষা ও কল্যাণ অর্থনীতির পরিকাঠামোর উপাদানগুলো প্রবর্তনের একটা মুহূর্ত তৈরি হতে দেখা যাচ্ছিল। অর্থনীতির ক্ষেত্রেও নারীদের স্বনির্ভরতার সহযোগী পরিকাঠামো প্রবর্তনের একটা বিরাট সুযোগ এসেছিল। এই বৃহৎ আকারের প্রণোদনাগুলোর পরিকল্পনা সেরকম লক্ষ্যে অগ্রসর হতে পারতো, যেমন, নারীদের টার্গেট করে কোনো ধরনেরই প্রণোদনা বরাদ্দ নিঃসন্দেহে বেশ আশাব্যাঞ্জক। কিন্তু একটু গভীরে তলিয়ে দেখলে পিতৃতন্ত্রের কাঠামোকৃত পরনির্ভর নারীর মৌলিক কোনো রূপান্তরের সুযোগ এতে তৈরি হবে বলে আশা যায় কি?   

করোনাকালে নারীর আলাদা করে সামাজিক-অর্থনৈতিক সুরক্ষার প্রয়োজন কেন?

যদি প্রশ্ন হয়, নারীর জন্য আলাদাভাবে প্রণোদনার দাবী কেন যেখানে আয়-রোজগার নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার জন্যই থেমে গেছে, তবে বলতে হয়, আয়-রোজগারের ক্ষতির বিষয়টির স্পষ্টতই লিঙ্গীয় একটা চেহারা আছে। এই ক্ষয়-ক্ষতির ব্যাপকতা ও গভীরতা নারীর কাজের প্রকৃতি, পেশা গ্রহণ ও কর্মজীবন পরিচালনায় যে লিঙ্গীয় কাঠামোগত প্রতিবন্ধকতা রয়েছে তার সাথে সম্পর্কিত। নারীর সকল কর্মকান্ডের উপর পুরুষের নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারী, নারী-পুরুষের ঘর-বাহিরের পৃথক পারিসরিক বিভাজন, সংসারের চাকা ঘোরানো ও পরিবারের ভাত-কাপড়ের সংস্থানের আদর্শিক দায়-দায়িত্বের সাথে সম্পর্কিত। 

বিদ্যমান কাঠামোগতভাবে নারীর পরনির্ভরতা ও নাজুকতা যেভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে:  

এক। নারীদের জমি ও সম্পত্তির মালিকানা নগণ্য: নারীর ভূমিহীনতা ও নিঃস্বতা ব্যাপক ও পরিব্যাপ্ত। বিশ্বব্যাংকের এক হিসাব অনুযায়ী গ্রামীণ গৃহস্থালী ভূমি-মালিক পরিবারগুলোর ক্ষেত্রে মাত্র ১৭% নারী একা বা যৌথভাবে জমির মালিক, যেখানে ৭০% পুরুষ জমির মালিক। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার কৃষি শুমারী অনুযায়ী, বাংলাদেশের মাত্র ৪.৭% কৃষি জমির মালিক নারী। এতে আরও বলা হয়েছে যে, নারীর সম্পত্তির উপর অধিকার নির্ভর করে প্রধানত বাবা বা স্বামীর সাথে সম্পর্কের উপর। এই সম্পর্ক নড়বড়ে হয়ে গেলে, যেমন বাবার মৃত্যূ বা অক্ষমতা, স্বামীর সাথে সম্পর্ক দুর্বল হয়ে পড়া, দ্বিতীয় বিয়ে, পরিত্যাক্ত হওয়া বা তালাকের মত অনিশ্চয়তা পরিবারের সম্পত্তির উপর তার অধিকারকে নাজুক করে দেয়। তার নিজের খাওয়া-পরা ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তাই নড়বড়ে হয়ে পড়ে। সম্পত্তির পিতৃতান্ত্রিক মালিকানা ব্যবস্থায় নারীকে কাঠামোগতভাবে সম্পূর্ণ পুরুষের মুখাপেক্ষী ও পরনির্ভর করে রাখে। নারীর ধন-সম্পদ অর্জন ও রক্ষা, সম্পদ ব্যবহার করে জীবনমানের উন্নতি প্রায় সম্পূর্ণভাবে বিয়ে, সংসার ও পুরুষ-নির্ভর। মূলধারার অর্থনীতির বিশ্লেষণে নারীর এই বিশেষ পরিস্থিতির প্রতি আলোকপাত করে না।

নারীর সম্পত্তির উপর অধিকার নির্ভর করে প্রধানত বাবা বা স্বামীর সাথে সম্পর্কের উপর। এই সম্পর্ক নড়বড়ে হয়ে গেলে, যেমন বাবার মৃত্যূ বা অক্ষমতা, স্বামীর সাথে সম্পর্ক দুর্বল হয়ে পড়া, দ্বিতীয় বিয়ে, পরিত্যাক্ত হওয়া বা তালাকের মত অনিশ্চয়তা পরিবারের সম্পত্তির উপর তার অধিকারকে নাজুক করে দেয়। তার নিজের খাওয়া-পরা ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তাই নড়বড়ে হয়ে পড়ে।

দুই। নারীর পক্ষে পুঁজি যোগাড় ও সঞ্চয়ন উভয়ই দুরূহ: ম্যারেজ এবং মার্কেট এর আন্ত:সম্পর্ক উন্মোচন না করে অর্থনীতিতে নারীর অবস্থা বোঝার কার্যকর কোনো উপায় নেই। সম্পত্তির মালিকানা থেকে ব্যবসায়ের পুঁজি সৃষ্টি কিংবা জামানত দিয়ে ব্যাংক ঋণ লাভ কোনটাতেই নারীর পক্ষে প্রবেশের সহজ রাস্তা নেই। এমনকি, নারীর নিজের আয়-রোজগারের উপরও অনেক ক্ষেত্রে স্বামী/পিতা/বা কর্তা পুরুষের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত। ফলে নিজের এবং সন্তানের জীবন-যাপনের প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ কিংবা ভরণ-পোষণের জন্য নারীর পুরুষের উপর নাজুকভাবে নির্ভরতা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কাঠামোকৃত প্রকল্প। এটা নারীর কোনো চয়েস বা পছন্দ এমনকি যোগ্যতারও বিষয় নয়। ভূমি, ব্যবসার পুঁজি বা ক্যাশ পুরুষের একচেটিয়া কারবার। নারীর পক্ষে ব্যবসায় উদ্যোগ পরিচালনার দক্ষতা ও প্রশিক্ষণ অর্জন, ব্যবসায়ের প্রয়োজনীয় তথ্যে প্রবেশের পথও নাগালের বাইরে।

তিন। ঘর-বাহিরের পরিসরের লিঙ্গীয় বিভাজন এবং নারীর অন্তরীণতার নীতি: সামাজিক আদর্শে নারীর কর্তা পুরুষ-নিয়ন্ত্রিত গৃহে অন্তরীণ অবস্থান এবং স্বাধীন চলাচলের উপর নিয়ন্ত্রণের নীতি হালে সামান্য শিথিল হলেও মোটাদাগে অপরিবর্তিত রয়েছে। নারীর যৌনতার উপর নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণের জন্য পিতা বা স্বামীর অনুমোদন ছাড়া ঘরের বাইরে চলাচল এবং অর্থনৈতিক কর্মপরিচালনা করা এখনও অনেকটাই অসম্ভব রয়ে গেছে। নারী কোথায় কখন কার সাথে যাবে, যোগাযোগ করবে তা সামাজিক আদর্শগতভাবে নজরদারীর অধীন। সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নারীর পরিসর ঘরের ভেতর এবং পুরুষের পরিসর বাহির নারীকে সকল ধরনের মূলধারার অর্থনৈতিক কর্মকান্ড থেকে দূরে অসুবিধাজনক পরিস্থিতিতে থাকতে বাধ্য করে। যে কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা কাজের জায়গা প্রধানত পুরুষের বলে ধরে নেয়া হয় এবং নারী সেখানে বহিরাগত ও অনাকাঙ্ক্ষিত। বহিরাগত ও অনাকাঙ্ক্ষিত হিসেবে নারীকে ব্যবসা ও কাজের জগতে বিশেষভাবে প্রস্তুত হয়ে এবং নানাবিধ কৌশল অবলম্বন করে সাফল্য অর্জন করতে হয়।

চার। লিঙ্গীয় শ্রমবিভাজন: নারীর দিনরাত অবৈতনিক শ্রমের উপরই পিতৃতান্ত্রিক পরিবার দাঁড়িয়ে থাকে। শ্রমিক-কৃষক-শিক্ষিত চাকুরে সকল পরিবারই নারীর অবৈতনিক গার্হস্থ্য ও সেবাকর্মকে আদর্শ ও স্বাভাবিক ধরে নেয়। পরিবারের জন্য রান্নাবান্না, ঘর-বাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, শিশুদের দেখভাল, অতিথি সৎকার, রোগীর সেবা-শুশ্রুষা, পরিবারের সদস্যদের শারীরিক ও মানসিক প্রশান্তি দেয়ার কাজ নারীর জন্য বৈবাহিক শর্ত স্বরূপ এবং পারিবারিক ও সামাজিক বাধ্যবাধ্যকতা। নারীর দৈনিক শ্রমশক্তি, সময় এবং কর্মঘন্টার অধিকাংশ ব্যয় হয় গৃহশ্রমে। তদুপরি, চাইল্ড কেয়ারের কোনো সামাজিক বা প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা না থাকাতে শিশুদের দেখাশুনা করতে গিয়ে পুরুষের সাথে সমানভাবে চাকরি ও ব্যবসার আয়-রোজগারের জগতে অংশগ্রহণ সম্ভব হয় না।   

পাঁচ। নারীর প্রতি সহিংসতা ও যৌন নিপীড়ন: নারীর প্রতি ঘরে-বাইরে সহিংসতা এবং যৌন নিপীড়ন ক্রমবর্ধমান এবং নৃশংসতর হয়ে দেখা দিয়েছে। নারীর পক্ষে শিক্ষা গ্রহণ এবং কর্মস্থলে যাতায়াত যৌন হয়রানির ঝুঁকিপূর্ণ এবং ধর্ষণের ভীতি নারীর নিত্যদিনের সঙ্গী।  

ছয়। প্রাপ্ত বয়স্ক নারীর উপর পুরুষের অভিভাবকত্বের নীতি:  প্রাপ্ত বয়স্ক নারীর অর্থনৈতিক উদ্যোগ ও প্রকল্পে পুরুষের অভিভাবকত্ব আশা করা এবং পুরুষ অভিভাবকহীন নারীকে ব্যবসা সহায়তা প্রত্যাখ্যান করার প্রবণতা ব্যাংক ও বিনিয়োগ সংস্থাগুলোর ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত চর্চা। নারীর অর্থ পরিচালনার যোগ্যতার প্রতি পুরুষালি সাংস্কৃতিক, ভাষাগত ও প্রতীকী অবজ্ঞা, নারীর দক্ষতা ও যোগ্যতাকে হেয় প্রতিপন্ন ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা নারীর প্রতিদিনের যাপিত অভিজ্ঞতা।   

নারীর এই কাঠামোকৃত নাজুকতা ও পরনির্ভরতাকে আমলে না নিয়ে কোনো অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বা প্রণোদনাকে নারী-বান্ধব বলা যায় না। নারীদের অদৃশ্যমানতা মূলধারার অর্থনীতির ক্ষেত্রে প্রকট হওয়াতে করোনাকালে নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি পরিমাপ করা সহজ নয়। এই ক্ষতি পরিমাপের সামান্য কিছু চেষ্টা করা হয়েছে। এই হিসেব পর্যাপ্ত না হলেও কিছু দূর-নিরীক্ষণ গবেষণা ও জরিপ থেকে এই সম্পর্কে মোটাদাগের একটা ধারণা পাওয়া যায়। আমাদের হাতে আছে, সিপিডি, ইউএন উইমেন, ব্র্যাকের মত কিছু প্রতিষ্ঠিত সংস্থা র‌্যাপিড একশন রিসার্চধর্মী কিছু কাজের ফলাফল, যেগুলো আমাদের অন্তত একটা প্রাথমিক ধারণা পেতে সাহায্য করে এবং উন্নয়নের মূলধারায় কিছু দিক নির্দেশনা দেয়।

নারীর এই কাঠামোকৃত নাজুকতা ও পরনির্ভরতাকে আমলে না নিয়ে কোনো অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বা প্রণোদনাকে নারী-বান্ধব বলা যায় না। নারীদের অদৃশ্যমানতা মূলধারার অর্থনীতির ক্ষেত্রে প্রকট হওয়াতে করোনাকালে নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি পরিমাপ করা সহজ নয়।

করোনাকালের প্রণোদনা নারীর জন্য কতটা সহায়ক হয়েছে এই বিষয়কে উপজীব্য করে সিপিডির ১৫ এপ্রিল ২০২১ এর সর্বশেষ সংলাপ “সরকারের আর্থসামাজিক পুনরুদ্ধার ব্যবস্থা: নারীরা কতটা উপকৃত হয়েছে” শীর্ষক অনলাইন সংলাপে নারীদের টার্গেট করে প্রণোদনার সুপারিশ এবং করোনায় আর্থসামাজিক পুনরুদ্ধার প্রকল্পের লিঙ্গায়িত দিকটিকে মনোযোগে নিয়ে আসা অত্যন্ত সুখের বিষয়। কিন্তু এই সুখকর আলোচনায় বেশ কিছু কাঁটা আছে যাকে আমরা রোজগেরে কর্তা পুরুষকে কেন্দ্র করে আবর্তিত মূলধারার অর্থনীতির আলোচনার “ব্লাইন্ড স্পট” বলতে পারি। এই ব্লাইন্ড স্পট পুরুষ-কেন্দ্রিক অর্থনীতির এক বিশেষ ধরণের চিন্তার কাঠামোতে পাকাপাকিভাবে গেড়ে বসে আছে। এই নীতি-প্রণেতাদের এই অন্ধত্বের ফলেই জীবন-জীবিকাতে নারীর আত্মনিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজনীয় ও কার্যকর কোনো নীতি গ্রহণ এবং সংস্কার নিয়ে আসা সম্ভব হয় না। করোনা অতিমারির মতদুর্যোগের শিক্ষা ও অভিজ্ঞতার ভেতর এই অস্বাভাবিক অবস্থা সামাল দিতে যে রূপকল্প নারীর সামাজিক-অর্থনৈতিক স্বাবলম্বন প্রতিষ্ঠায় কোনো মৌলিক রূপান্তর নিয়ে আসতে পারতো, সরকারের নীতি-নির্ধারকেরা যথারীতি সেদিকে হাঁটেন নি। সংলাপে এবং প্রণোদনা প্যাকেজগুলোর মূল্যায়নের বিভিন্ন আলোচনায় বলা হয়েছে যে, সরকারকে দ্রুতগতিতে এই প্রণোদনা কার্যকর করতে হয়েছে বলে নারীদের জন্য আলাদা করে ভাবার অবস্থা ছিল না। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক লীলা রশিদ, যিনি এই প্রণোদনা পরিকল্পনার পুরোভাগে ছিলেন, তিনিও বলেছেন যে, এটা কারো জন্যে আলাদা ছিল না। কিন্তু ক্ষতির প্রকৃতি ও পরিমাণ যেহেতু আলাদা, পরিকল্পনাতেও সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের সবচেয়ে বেশি সহায়তার নীতি থেকে শুরু হতে পারতো, যেখানে নারীরা থাকতে পারতো সুরক্ষার অগ্রভাগে। কিন্তু করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের সহায়তার কথা ভাবতে ভাবতে প্রায় “ডাক্তার আসার আগেই রোগী মারা গেল” অবস্থা চলে এসেছে।

কিন্তু এই সুখকর আলোচনায় বেশ কিছু কাঁটা আছে যাকে আমরা রোজগেরে কর্তা পুরুষকে কেন্দ্র করে আবর্তিত মূলধারার অর্থনীতির আলোচনার “ব্লাইন্ড স্পট” বলতে পারি। এই ব্লাইন্ড স্পট পুরুষ-কেন্দ্রিক অর্থনীতির এক বিশেষ ধরণের চিন্তার কাঠামোতে পাকাপাকিভাবে গেড়ে বসে আছে।

সংখ্যা-পরিসংখ্যানে নারীর অর্থনৈতিক বিপর্যয়

মার্চ ২০২০  থেকে দেশজুড়ে ভয়াল মহামারি মোকাবেলায় যখন সমস্ত ব্যবসা-বাণিজ্য, কলকারখানা, উৎপাদন বন্ধ হয়ে সারাদেশের কোটি মানুষের আয়-রোজগার, জীবন-জীবিকা বিপর্যস্ত, তখন এমনই একটা রোজা এবং ঈদ পার করছিল মানুষ। বিনা প্রস্তুতিতে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত করে বন্ধ হয়ে গেল সারাদেশের ছোট-বড় সকল অর্থনৈতিক কর্মকান্ড। শাটার বন্ধ হয়ে গেল শহরের বড় বড় মার্কেট, মল, অলি-গলির সমস্ত দোকান-পাটের। মুদি-দর্জি-তরকারিওয়ালা-ফেরিওয়ালা-হকার-পাইকার-খুচরা বিক্রেতার পেটে লাথি পড়ল। হাজারে হাজারে মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে ফিরে গেল। শহরের বাসা-বাড়িতে কাজ করে খাওয়া গৃহকর্মী, ড্রাইভারদেরও ছাড়ান দেয়া হল।  সারাদেশে কুটির-ক্ষুদ্র-ছোট-মাঝারি শিল্পগুলো মুখ থুবড়ে পড়ল। বিপুল সংখ্যক মানুষ চাকরি হারিয়ে পথে বসল। মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে চাকরি হারিয়ে হাজার হাজার নারী-পুরুষ শ্রমিক দেশে প্রত্যাবর্তন করল। দ্রুততম গতিতে অর্থনীতির ভাষায় সৃষ্টি হয়েছে নব্য দরিদ্র শ্রেণির।

সিপিডির এক হিসেবে এ সময় করোনার ফল হিসেবে দারিদ্র্যের হার বেড়েছে ২৪.৩% থেকে ৩৫%, ১ কোটি ৭৫ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র সীমার নিচে চলে গেছে, যাদের নতুন গরীব বলা হচ্ছে। করোনা মহামারি মোকাবেলায় সরকারের বড় বড় ব্যবসায়ি, ধনিক শ্রেণি এবং পুরুষ পক্ষপাতি নীতি এই নব্য দরিদ্র শ্রেণির জন্মে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। মোটামুটি খেয়ে পরে বেঁচে থাকা স্বাবলম্বী মানুষেরা গরীবের মিছিলে সামিল হতে বাধ্য হয়েছেন। এই মিছিলে সমানভাবে নারীরাও রয়েছেন, হয়েছেন গরীবের তস্য গরীব। কিন্তু নারীদের আয়, চাকুরি, ও জীবিকা হারানোর খবর অনেকটা অদৃশ্য রয়ে গেছে।

করোনা মহামারি মোকাবেলায় সরকারের বড় বড় ব্যবসায়ি, ধনিক শ্রেণি এবং পুরুষ পক্ষপাতি নীতি এই নব্য দরিদ্র শ্রেণির জন্মে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। মোটামুটি খেয়ে পরে বেঁচে থাকা স্বাবলম্বী মানুষেরা গরীবের মিছিলে সামিল হতে বাধ্য হয়েছেন। এই মিছিলে সমানভাবে নারীরাও রয়েছেন, হয়েছেন গরীবের তস্য গরীব। কিন্তু নারীদের আয়, চাকুরি, ও জীবিকা হারানোর খবর অনেকটা অদৃশ্য রয়ে গেছে।

২০২০ এর জুন মাসে পরিচালিত একটি জরিপে দেখা যাচ্ছে অনেক ক্ষুদ্র, ছোট, মাঝারি উদ্যোগ (SME) আংশিক বা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে ৭০% ভাগ কর্মী কর্মচ্যূত হয়েছেন, এর মধ্যে ২৫% পুরুষ একং ১৭% নারী। এই সেক্টরে জড়িত আছে দেশের ৫ কোটি ১৭ লক্ষ মানুষের জীবন ও জীবিকা। বিশ্বব্যাংকের হিসেবে জুন-জুলাই ২০২০ এ ৬৮% লোকের চাকরি হারানো চিত্র পাওয়া যায় (খান, ২০২০)। ইউএন উইমেনের একটা জরিপ ( মে ২০২০) থেকে দেখা যাচ্ছে যে, ৩৮% নারী তাদের আয়-রোজগার হারিয়েছে। বলতে গেলে নারীদের আয়-রোজগারের সিংহভাগ হলো অপ্রাতিষ্ঠানিকখাত যেখানে রয়েছে কুটির, ক্ষুদ্র, ছোট, ও মাঝারি শিল্পে (CMSME) নিয়োজিত নারী, গৃহকর্মী, দিনমজুর, ফেরিওয়ালা, যৌনকর্মী ইত্যাদি। নারীদের মোট কর্মসংস্থানের ৯১.৪% ই আসে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত থেকে। বিবিএস ২০১৬-১৭ এর জরিপ অনুযায়ীও দেখা যায় যে, গ্রামীণ নারীর কর্মসংস্থানের ৯৩% এবং শহরের নারীর কর্ম সংস্থানের ৮৭.৩% অপ্রাতিষ্ঠানিকখাতে হয়ে থাকে। এই অপ্রাতিষ্ঠানিকখাতের নিয়োজিত কর্মীরা করোনাকালে দ্রুততম সময়ে কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েন। হাজার হাজার প্রত্যাগত ও অভিবাসী নারী শ্রমিক বিদেশে কর্মচ্যূত হয়ে দেশে ফিরে আসেন যাদের অদূর ভবিষ্যতে কাজ ফিরে পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। সাধারণ ছুটি বা লক ডাউনে নারীদের জীবন-জীবিকার উপর চরম আঘাত হানে। নারী-উদ্যোক্তাদের ব্যবসা করোনাকালে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। করোনাকালে নারী ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সংকট নিয়ে জাসমিন জাইমের একটি গবেষণা এর বাস্তব অবস্থা তুলে ধরেছে (জাইম, ২০২০)।  

গ্রামীণ নারীর কর্মসংস্থানের ৯৩% এবং শহরের নারীর কর্ম সংস্থানের ৮৭.৩% অপ্রাতিষ্ঠানিকখাতে হয়ে থাকে। এই অপ্রাতিষ্ঠানিকখাতের নিয়োজিত কর্মীরা করোনাকালে দ্রুততম সময়ে কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েন। হাজার হাজার প্রত্যাগত ও অভিবাসী নারী শ্রমিক বিদেশে কর্মচ্যূত হয়ে দেশে ফিরে আসেন যাদের অদূর ভবিষ্যতে কাজ ফিরে পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।

তৈরি পোশাকখাতে নারী শ্রমিক ৩০ লাখ যারা মোট শ্রমিকের ৬৫%। এদের এক তৃতীয়াংশ বিশ্ববাজারে রপ্তানি ক্রয়াদেশ কমে যাওয়াতে কারখানা বন্ধ হওয়ার ফলে চাকরিচ্যূত হয়েছেন, সময়মত বকেয়া বেতনও পাননি এবং নিম্নমজুরিতে কাজ করবার ফলে তাঁদের তেমন কোনো সঞ্চয়ও নেই। এদের মধ্যে অনেকে গর্ভবতী, দুগ্ধদানকারী, একক নারী কারখানা থেকে কোনো সহায়তা ছাড়াই অতিমারির মধ্যে দিন যাপন করেছেন। জুন-জুলাই ২০২০ এ করা রাব্বানীর একটি জরিপে দেখা যাচ্ছে যে ৭৭% শ্রমিকের পরিবারে পর্যাপ্ত খাবার নেই। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের এক ওয়েবিনারে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক শাহীন আনাম জানান, বিউটি পার্লারে কর্মরত ১০,০০,০০০ নারী বেকার হয়েছে, যাদের বৃহদাংশ আদিবাসী। ১,৫০,০০০ যৌনকর্মী খাদ্য সংকটে জীবন-যাপন করেছে যাদের এমনকি স্বাভাবিক সামাজিক জীবনেও প্রবেশাধিকার নেই। এইসব আংশিক চিত্র থেকে আমরা ধারনা করতে পারি, বাস্তব পরিস্থিতিতে নারীরা কতটা নাজুক আর নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছেন।

কীভাবে প্রণোদনা প্যাকেজে নারীর অর্থনৈতিক সুরক্ষা উপেক্ষা করা হয়েছে এবং রাষ্ট্র পর-নির্ভর নারীর পুনরুৎপাদন করছে?

১। প্রণোদনা প্যাকেজ পুরোটাই ব্যাংকিং চ্যানেলে সরবরাহ করা ঋণ মাত্র। প্রণোদনা প্যাকেজগুলো প্রধানত ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে ক্লায়েন্ট সম্পর্কের মাধ্যমে পাওয়া ঋণের প্রকল্প। ব্যাংকিং চ্যানেলে বিলি করা ঋণসুবিধা হওয়ার ফলে প্রথমেই নারীরা এই সুযোগ থেকে বাদ পড়ে যাবেন। নারীর ক্ষুদ্র উদ্যোগ গবেষক জাসমিন জাইমের গবেষণায় দেখা যাচ্ছে যে, নারীদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা ও পরিচালনা করবার জন্য পুরুষের সমর্থন ও সাহায্যের উপর নির্ভর করতে হয় (জাইম, ২০২০)। কে না জানে বাংলাদেশের নারীরা ব্যাংকিং কাঠামোগত প্রতিবন্ধকতার জন্য প্রবেশ করতে পারে না বলেই ক্ষুদ্র ঋণের জন্মভূমি হয়ে বৈশ্বিক পরিচিতি লাভ করেছে। ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ পেতে হলে যে কোল্যাটারাল বা জামানতের প্রয়োজন, তার অর্থ হল, সম্পত্তির মালিকানা থাকা। পরিবারের সম্পত্তির মালিকানায় নারীর অংশ নগণ্য এবং নারীর নামে যদি কিছু সম্পত্তি থেকেও থাকে, তার নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার ভার থাকে তার তথাকথিত পুরুষ অভিভাবকদের হাতে। তহশিল অফিস থেকে শুরু করে আইন-আদালত, ব্যাংক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো পুরোপুরি পুরুষের নিয়ন্ত্রণে। সম্পত্তির অধিকার না থাকার কারণে বেশিরভাগ নারী যে জামানত হিসেবে কোনো কিছু দেখাতে পারবে না, সেটা খুবই পরিষ্কার।

বাংলাদেশের নারীরা ব্যাংকিং কাঠামোগত প্রতিবন্ধকতার জন্য প্রবেশ করতে পারে না বলেই ক্ষুদ্র ঋণের জন্মভূমি হয়ে বৈশ্বিক পরিচিতি লাভ করেছে। ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ পেতে হলে যে কোল্যাটারাল বা জামানতের প্রয়োজন, তার অর্থ হল, সম্পত্তির মালিকানা থাকা। পরিবারের সম্পত্তির মালিকানায় নারীর অংশ নগণ্য এবং নারীর নামে যদি কিছু সম্পত্তি থেকেও থাকে, তার নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার ভার থাকে তার তথাকথিত পুরুষ অভিভাবকদের হাতে।

২। প্রণোদনার বড় অংশ বৃহৎ শিল্পমালিকদের জন্যে বরাদ্দ করা হয়েছে, যেখানে নারীর উপস্থিতি বিরল। কুটির, ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্প (সিএমএসমিই) এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে বরাদ্দ এসেছে ছোট আকারে এবং দেরিতে। নারীদের ব্যবসায় উদ্যোগের প্রধান ক্ষেত্রই হল, কুটির, ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্প এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত। নারী উদ্যোক্তারা করোনাকালে যে কঠিন পরিস্থিতিরি মধ্যে ব্যবসা ও সংসার একই সাথে পরিচালনা করেছেন জাসমিন জাইমের ঢাকার উদ্যোক্তাদের মধ্যে গবেষণায় একটি পরিষ্কার চিত্র দেখা যায় (জাইম, ২০২০)। এই খাতের জন্য বিশেষভাবে যে প্রণোদনা সেটি নারী উদ্যোক্তাদের জন্য সুলভ হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে যে, ব্যাংকের সাথে পুরনো প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়িক সম্পর্ক না থাকলে ক্ষতিগ্রস্ত নারী উদ্যোক্তা এই ঋণসুবিধা নিতে পারছেন না। নারী উদ্যোক্তাদের অনেকের পক্ষে কম সংখ্যক কর্মচারি নিয়ে ব্যবসার লাইসেন্স, টিআইএন নম্বর, পরিবেশ পরিপত্র ইত্যাদি ধরণের কাগজপত্র তৈরি রাখা সহজসাধ্য থাকে না। অনেকে বাড়ি থেকেই বিভিন্ন পণ্য ও সেবা দিয়ে থাকেন, যার জন্য ব্যবসার জন্য লাইসেন্স ও প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক প্রস্তুতি নেয়ার সুযোগ থাকে না। 

৩। চাকরি হারিয়ে কর্মহীন হয়ে পড়া নারী-পুরুষ কারো জন্যেই বেতন বা মজুরি সুরক্ষার কোনো পরিকল্পনা রাখা হয় নি। গারমেন্টসের নারীরা কর্মচ্যূত হয়ে অনেকে গ্রামে ফিরে গেছেন। প্রণোদনা এই বিপুল সংখ্যক নারীদের সুরক্ষার আওতায় নিয়ে আসেনি। পরিবারের আয় সংকুচিত হয়ে আসায় শ্রমবাজারের বাইরে থাকা গৃহিণী নারীর সংসার সামলানোর সংকট কোনো গবেষণাতেই খোঁজা হয় নি, কোনো প্রকল্পের আওতায়ই আসেনি।

৪। ঘরে থাকার নির্দেশনার ফলে নারীদের পক্ষে গৃহকাজের চাপ বহুগুণে বর্ধিত হয়েছে। পরিবারে  রোগীর সেবা-শুশ্রষা, ঘরে থাকা বাচ্চাদের দেখভাল, অনলাইন স্কুলের পড়াশোনার তদারকি, গৃহকর্মীর সহায়তা বন্ধ হয়ে যাওয়াতে নারীর উপর দুইতিনগুণ কাজের বোঝা চেপেছে। এর মধ্যে যেমন ঘরে নারীর প্রতি গার্হস্থ্য/পারিবারিক সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের নৃশংস চেহারা প্রকটভাবে দেখা যাচ্ছে।

৫। কোভিড-১৯ প্রণোদনা বাংলাদেশে কেবল ব্যাংক ঋণ আকারে সরবরাহ করবার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, যেখানে বিশ্বের কল্যাণমূলক রাষ্ট্রগুলো, এমন কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত চরম পুঁজিবাদী দেশেও প্রণোদনা সরাসরি আর্থিক সহায়তা হিসেবে দেয়া হয়েছে। সরাসরি নগদ সহায়তার আওতা বাড়লে বাংলাদেশের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য আরও অনেক বেশি কল্যাণমূলক ফলাফল বয়ে আনতে পারতো। ব্যাংক ঋণ একটা বিশেষ শ্রেণিকেই উপকৃত করতে পারে। ব্যাংকের বাইরে একটা বিরাট ক্ষতিগ্রস্ত জনসংখ্যার মানুষের কাছে যে এই প্রণোদনার সুফল পৌঁছাবে না, তা দিবালোকের মত স্পষ্ট।  

সরাসরি নগদ সহায়তার আওতা বাড়লে বাংলাদেশের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য আরও অনেক বেশি কল্যাণমূলক ফলাফল বয়ে আনতে পারতো। ব্যাংক ঋণ একটা বিশেষ শ্রেণিকেই উপকৃত করতে পারে। ব্যাংকের বাইরে একটা বিরাট ক্ষতিগ্রস্ত জনসংখ্যার মানুষের কাছে যে এই প্রণোদনার সুফল পৌঁছাবে না, তা দিবালোকের মত স্পষ্ট।

৬। করোনাকালে প্রতিদিন ৪ জন নারী ধর্ষিত হয়েছে এবং ২০২০ এ ১৩,৮৮৬ কন্যাশিশুর বাল্য বিয়ে হয়েছে, এপ্রিল ২০২০ এ ২৭ টি জেলায় ৪,২৪৯ নারী এবং ৪৫৬ শিশু গৃহসহিংসতার শিকার হয়েছে, যার মধ্যে ১,৬৭২ জন নারী এবং ৪২৪ জন শিশু জীবনে প্রথমবারের মত সহিংসতার শিকার হল (মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, ২০২০), যা পরিষ্কারভাবে করোনাকালে নারীর অধস্তনতার ও পরনির্ভরতার পুনরুৎপাদনের সাক্ষ্য দেয়।

করোনাকালে প্রতিদিন ৪ জন নারী ধর্ষিত হয়েছে এবং ২০২০ এ ১৩,৮৮৬ কন্যাশিশুর বাল্য বিয়ে হয়েছে, এপ্রিল ২০২০ এ ২৭ টি জেলায় ৪,২৪৯ নারী এবং ৪৫৬ শিশু গৃহসহিংসতার শিকার হয়েছে, যার মধ্যে ১,৬৭২ জন নারী এবং ৪২৪ জন শিশু জীবনে প্রথমবারের মত সহিংসতার শিকার হল

সচেতনতা কার দরকার?

নারী উন্নয়নের মূলধারার আলোচনার সীমাবদ্ধতাগুলোর একটা বড় ক্ষেত্র হল, খোদ নারীকেই নারীর অনুন্নয়নের জন্য দায়ী করা এবং সমাধান হিসেবে নারীদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিকে টার্গেট করা। নারীরা যে প্রণোদনা ঋণের প্যাকেজ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন, কিংবা ওয়াকিবহাল হলেও ঋণ গ্রহণে আগ্রহী বা সাহসী নন, তার দায় কার? কীভাবে কারা এই প্রণোদনা পাচ্ছেন, বা পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন, তার খবরগুলো ঠিক কোথায় কীভাবে নারীরা সংগ্রহ করবেন, তা কি স্বচ্ছভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের কানে পৌঁছে দেয়া হয়েছে? আমি নিজে বেশ কিছু নারী উদ্যোক্তা সাংবাদিক বন্ধু, ব্যাংকার আত্মীয়-স্বজন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সহকর্মীদের সাথে প্রায় সারাবছর ধরে দফায় দফায় বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ করে পুরোপুরি সন্তোষজনকভাবে বিষয়টিকে জানতে বুঝতে পারিনি। একজন সাধারণ নারীর পক্ষে সেটা কত কঠিন হবে সেটা আন্দাজ করতে কষ্ট হবার কথা নয়।

পলিসি মেকার, অর্ধনীতিবিদ এবং ব্যাংকারদের নারীদের “সচেতনতা সৃষ্টি”র এই সুপারিশ পরিহাসমূলক। কে কীভাবে কার সচেতনতা সৃষ্টি করবে, কীভাবে সেটা পরিমাপ করা হবে, সে সব অনির্দিষ্ট ও অস্পষ্ট এক গোলক ধাঁধা। এই কথামালা নারীর অজ্ঞানতা ও অশিক্ষাকে দোষারোপ করে নীতি-প্রণেতাদের এক ধরনের দায়মুক্তি দেয়।

স্বনামধন্য উদীয়মান চামড়ার পণ্য উৎপাদনকারী গুটিপার স্বত্তাধিকারী তাসলিমা মিজির সাথে সাক্ষাৎকার থেকে জানতে পারি যে, এই রকম ক্ষুদ্র উদ্যোগগুলোও কোনো ঋণ সুবিধা গ্রহণ করতে সক্ষম হয়নি। মিজি বলেন, সেক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত, প্রভাব-পরিচয়হীন নারী উদ্যোগগুলোর অবস্থা সহজেই অনুমেয়। যে যত বড় ও প্রভাবশালী, তার ঋণ পাওয়ার সম্ভাবনাও তত বেশি। মিজি কেবল একজন নারীকে দেখেছেন যিনি প্রণোদনার ঋণসুবিধা লাভ করতে পেরেছেন। সম্প্রতি ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যববস্থাপনা পরিচালক ও সিইওর জনাব সেলিম আর এফ হোসেইনের আলোচনা থেকে জানা যায় যে ব্র্যাক ব্যাংক, যেটি বিশেষভাবে সিএমএসএমইতে বিশেষায়িত, সফলভাবে এই খাতে ১৬০০ কোটি টাকা ঋণ ছাড় করা সম্ভব হয়েছে, এর মধ্যে ৫০ কোটি টাকা তারা নারী উদ্যোক্তাদের দিতে সক্ষম হয়েছেন, যেটা তাদের হিসেবে এসএমই সেক্টরের নারী উদ্যোক্তার সংখ্যার সাথে সমানুপাতিক। সেলিম হোসেইন, লীলা রশিদসহ অনেকেই একমত হয়েছেন যে, ব্র্যাক বাদে আর সব বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাছ থেকে ব্যবসার অতিরিক্ত কিছু আশা করা বাস্তবসম্মত নয়। সেক্ষেত্রে বাণিজ্যিক চরিত্রের প্রণোদনা থেকে অর্থনীতির পুনরুদ্ধার, ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার আশাই বা কতটা বাস্তব সম্মত?   

নীতি-নির্ধারকরা যখন আমার “অসচেতন” দাদীর “সংসারে সবার খাওয়া হলে, সবাই পরিতৃপ্ত হলে সবশেষে মেয়েরা খাবে” নীতি অনুসরণ করে রাষ্ট্রের নীতি তৈরি করছেন, তখন প্রশ্ন আসে, কুইনাইন অসুখ সারাবে বটে, কিন্তু কুইনাইন সারাবে কে?

কোভিড-১৯ অতিমারির সময়কালে সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজগুলো যে নারী-বান্ধব ছিল না, এবং নারীর জন্য তেমনভাবে কার্যকর হয়নি, সেটার জন্য খোদ নারীদেরই দোষারোপ করা যায় কি? এই প্রণোদনা নারীদের কাছে পৌঁছানোর লক্ষ্যে আদৌ পরিকল্পনা করা হয়ছে কি? নারীর আত্মনির্ভরতার বাগাড়ম্বরে মূল বাঁধা হিসেবে জপতপে একটা কথাই ঘুরে ফিরে দেখানো হয় “সচেতনতার অভাব”, কেবল “অ্যাওয়ারনেস” না থাকার ফলেই যেন নারীর স্বনির্ভরতা/স্বাধিকার স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে অর্জন করা গেল না। পলিসি মেকার, অর্ধনীতিবিদ এবং ব্যাংকারদের নারীদের “সচেতনতা সৃষ্টি”র এই সুপারিশ পরিহাসমূলক। কে কীভাবে কার সচেতনতা সৃষ্টি করবে, কীভাবে সেটা পরিমাপ করা হবে, সে সব অনির্দিষ্ট ও অস্পষ্ট এক গোলক ধাঁধা। এই কথামালা নারীর অজ্ঞানতা ও অশিক্ষাকে দোষারোপ করে নীতি-প্রণেতাদের এক ধরনের দায়মুক্তি দেয়। কাঠামোগত বাধাগুলোকে পাশ কাটিয়ে কেবল স্থিতাবস্থাকে আরেকটু সহনীয় করে দিন-যাপনের পথ করে দেয়, কিন্ত স্বাধীন-স্বনির্ভর সমমর্যাদার নাগরিক হিসেবে নারীকে দাঁড়াতে যে ফ্রেমওয়ার্কের প্রয়োজন, সেটা তৈরি হয় না। সবচেয়ে ক্ষতিকর যে ফল আমরা ভোগ করি, তা হল, দশকের পর দশক ধরে উন্নয়নের প্রকল্পে কিংবা জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়নের লক্ষমাত্রা অর্জনের বিপুল যজ্ঞে মণকে মণ ঘি ঢেলেও নারীর পুরুষ-নির্ভর জীবন-জীবিকার অবসান ঘটে ওঠে নাই এবং এই অবস্থায় আশু স্বনির্ভর নারী সমাজ গড়ে তোলার আশা করবার অনেক ভরসাও দেখা যায় না। পরিস্থিতি দেখে এটা না বলা কঠিন যে, কাউকে যদি সচেতন করতে হয়, সেটা আমাদের উচ্চ-পর্যায়ের নীতি-নির্ধারকদেরই করা দরকার। কোভিড-১৯ এ বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে চাঙ্গা করাবার জন্য নজীরবিহীনভাবে বড় আকারের প্রণোদনার বিপুল টাকার জটিল অংকে নারীর হিস্যা ঠিকমত বুঝে পাওয়া কঠিন। খাওয়া-পরা, আয়-রোজগার, জীবন-জীবিকা – এসব যেন পুরুষেরই বিষয়, নারী তো ঘরে বসেই প্রণোদনার সুফল স্বামী, বাবা, ছেলের আয়-রোজগার, ব্যবসা-বাণিজ্যে উন্নতির বাতাসে সব আপসে-আপোষে পেয়ে যাবে। তাছাড়া, তাড়াহুড়া করে দুর্যোগের ভেতর আলাদা করে নারীদের নিয়ে ভাববার সময় কোথায়? পুরুষ বাঁচলে তবেই তো নারীর বাঁচা। পুরুষ খেয়ে থাকলে নারীর ক্ষুধা-তৃষ্ণা মেটানো প্রশ্ন আসে। একবছর সময় লাগলো কেন, অর্থনীতির মহামন্দায় বিপর্যস্ত নারীদের সংসার চালানোর সাহায্য আসতে? এই এক বছর কীভাবে তারা চলেছেন, কীভাবে সন্তানের অন্ন-বস্ত্র সংস্থান করেছেন, সংসারের ঘানি টেনেছেন? কেউ তা জানা-বোঝার প্রয়োজন বোধ করেনি। নীতি-নির্ধারকরা যখন আমার “অসচেতন” দাদীর “সংসারে সবার খাওয়া হলে, সবাই পরিতৃপ্ত হলে সবশেষে মেয়েরা খাবে” নীতি অনুসরণ করে রাষ্ট্রের নীতি তৈরি করছেন, তখন প্রশ্ন আসে, কুইনাইন অসুখ সারাবে বটে, কিন্তু কুইনাইন সারাবে কে? খোদ রাষ্ট্রের রূপকল্প যে পুরুষতন্ত্রের কড়িবর্গায় নির্মিত সেটা আড়াল করে নারীর পশ্চাদপদ অবস্থার জন্য মোল্লা-মৌলবাদীদের দোষারোপ করে আর কত দিন পার পাওয়া যাবে? 

সায়েমা খাতুন: নৃবিজ্ঞানী, শিক্ষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। ইমেইল: sayemakhatun@yahoo.com   

তথ্যের উৎস:

The Bussiness Standard, August 26, 2020,,‘Women entrepreneurs get less priority in stimulus package’, Covid-19 made banks more reluctant to finance women entrepreneurs

Dhaka Tribune Sept 29, 2020,4 women raped every day on average in Bangladesh amid Covid-19 pandemic

Genoni, M. E., Khan, A. I., Krishnan, N., Palaniswamy, N., & Raza, W. (2020). Losing Livelihoods: The Labor Market Impacts of COVID-19 in Bangladesh.

Brac, Sept 23, 2020, Impact of COVID-19 on women entrepreneurs and informal sector workers, https://www.brac.net/latest-news/item/1290-impact-of-covid-19-on-women-entrepreneurs-and-informal-sector-workers

Jaim, J. (2019). Patriarchal practices of male family members: Women business-owners in Bangladesh. Nottingham Business School.

Jaim, J. (2021), Exist or exit? Women business‐owners in Bangladesh during COVID‐19. Gender Work Organ, 28: 209-226. https://doi-org.ezproxy.lib.uwm.edu/10.1111/gwao.12546

Jasmine Jaim (2020) Bank loans access for women business-owners in Bangladesh: Obstacles and dependence on husbands, Journal of Small Business. Management, DOI: 10.1080/00472778.2020.1727233

UN Women Bangladesh, Sept 23 2020, Covid-19 Bangladesh: Rapid Gender Analysis (May 2020), Gender in Humanitarian Action (GiHA) Working Group.

Khan, Islam Towfiqul (November 5, 2020) Employment Implication of Stimulus Packages: Employment Implications of Stimulus Packages, Challenges for Recovery, Center for Policy Dialogue, Dhaka

CPD, April 15, 2021,Women need targeted support to tackle the impact of COVID-19

https://blogs.worldbank.org/endpovertyinsouthasia/gain-economic-empowerment-bangladeshi-women-need-equal-property-rights#:~:text=Among%20rural%20households%20that%20own,to%2070%20percent%20of%20men.

https://cpd.org.bd/women-need-targeted-support-to-tackle-the-impact-of-covid-19/
https://en.prothomalo.com/business/local/government-acknowledges-beauty-sector-as-industry

https://www.brac.net/latest-news/item/1290-impact-of-covid-19-on-women-entrepreneurs-and-informal-sector-workers

https://www.dw.com/en/covid-19-lockdown-increases-domestic-violence-in-bangladesh/a-53411507

https://www.newagebd.net/article/127493/bangladesh-approves-two-fresh-stimulus-packages-of-tk-2700-crore

https://www.tbsnews.net/feature/panorama/women-entrepreneurs-get-less-priority-stimulus-package-124321

https://www.thedailystar.net/business/news/govt-approves-two-new-stimulus-packages-tk-2700-crore-2029281

https://www.dhakatribune.com/business/2021/01/14/what-is-the-progress-on-stimulus-package-distribution

http://www.xinhuanet.com/english/2021-01/18/c_139677131.htm

 

Social Share
  •  
  •  
  • 903
  •  
  •  
  •  
  •  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *