সম্পাদকীয় ভূমিকা
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ কোভিড-১৯ এর বিস্তারে আজ এক মহা বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। এই মুহুর্তে নিকট প্রতিবেশি ভারতের পরিস্থিতি সবচাইতে সঙ্গীন। পাশের আরেক দেশ মিয়ানমারে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখলের পর প্রতিদিন প্রতিবাদী মানুষদের খুন করছে সেনাবাহিনী। বিশ্বের কেন্দ্র/শক্তিশালী/‘ধনী’ দেশগুলোর সেনাবাহিনী অন্য দেশ/অঞ্চল দখল করে আর প্রান্ত/দুর্বল/‘গরীব’ দেশগুলোর সেনাবাহিনী দখল করে তার নিজের দেশ। অতএব দুর্বল দেশগুলোর মানুষদের দুই প্রবল পরাক্রান্ত শক্তির থাবার নীচে থাকতে হয়।
ভারতে মানুষ যে অক্সিজেনের অভাবে, চিকিৎসার অভাবে মারা যাচ্ছেন এই পরিস্থিতি হঠাৎ করে তৈরি হয়নি। গত কয় দশকে উন্নয়নের নামে সর্বজন স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা সেখানে ক্রমে শক্তিশালী হবার বদলে ব্যবসায়ীদের হাতে চলে গেছে। সেখানে মানুষ বাঁচানোর অক্সিজেন নেই, কিন্তু মানুষ মারার অস্ত্র আছে। ক্ষমতাসীনরা জনগণের টাকা দিয়ে সর্বজনের হাসপাতাল সম্প্রসারণ না করে সেই টাকা প্রাণঘাতী যুদ্ধে, যুদ্ধাস্ত্র ক্রয়ে ব্যয় করেছে। ভারত এখন তাই বিশ্বের বৃহত্তম অস্ত্র আমদানিকারক, আর সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের উপরই।
বহু দেশে নব্য উদারনৈতিক পুঁজিবাদের শক্তিবৃদ্ধিতে সামাজিক নিরাপত্তা সংকুচিত হয়েছে, সর্বজন স্বাস্থ্যব্যবস্থা থেকে বাজেট কমানো হয়েছে। এই বাস্তবতায় করোনা কোটি কোটি নিরন্ন নিপীড়িত মানুষের জন্য এক ভয়াবহ বিপদ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বহু অঞ্চলের মতো ভারতেও করোনাকালে ধনী কতিপয় গোষ্ঠী আরও বেশি ধনী হয়েছে। ভারতে এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সহযোগী হিসেবে যেমন আছে ধর্ম উন্মাদনা তেমনি আছে অন্য জাতি-বর্ণ-ধর্ম বিদ্বেষ। ভারতের এই বিদ্বেষী রাজনীতি বিধি বিধান বিষয়ে একটি দীর্ঘ লেখা এই সংখ্যায় থাকছে।
আমরাও এদেশে একইরকম বিপদে আছি। করোনাকালে আমাদের দেশেও সর্বজন স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা শক্তিশালী করার বদলে নিপীড়নের আয়োজন বিস্তৃত করা হয়েছে। শ্রমজীবী মানুষের জন্য সহায়তা ব্যবস্থার বদলে তাদের বিপদ বাড়ানোর ব্যবস্থা হয়েছে। চিকিৎসা ঝুঁকি তো আছেই তার সাথে যোগ হয়েছে কাজ, আশ্রয় ও আয়ের চরম অনিশ্চয়তা। লকডাউনে সবকিছু বন্ধ থাকলেও খোলা রাখা হলো পোশাক কারখানা। আমরা সরকার এবং মালিক মহোদয়দের থেকে শুনলাম, তাঁরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে শ্রমিকদের পরিবহণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করবেন। বহু কারখানা তার কিছুই করেনি। সরকারও এ নিয়ে মাথা ঘামায়নি। শ্রমিকদের পরিবহণ ব্যয় কয়েকগুণ বেড়েছে, বেড়েছে ভোগান্তি ও ঝুঁকি। এখন সেই মালিকেরা বেতন বোনাস দেবার জন্য কম সুদের সরকারের ঋণ চায়। এর আগেও তারা প্রণোদনা পেয়েছে, কিন্তু সেইসাথে ছাটাই আর শ্রমিক নিপীড়নও চলেছে, মজুরি বকেয়া থেকেছে। করোনা আক্রমণের এক বছরে পোশাক শিল্পেই ছাঁটাই হয়েছেন তিন লক্ষাধিক শ্রমিক। অন্যান্য শিল্পে পরিস্থিতি আরও নাজুক। এছাড়া পাট ও চিনিকল একের পর এক বন্ধ করে প্রায় লক্ষ পরিবারকে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে। মজুরি বকেয়া থাকছে বহু প্রতিষ্ঠানে। এর দাবি করলে পুলিশী আক্রমণের ঘটনাও অনেক।
শ্রমিকদের অবস্থার এই চিত্র স্পষ্ট করেছে সর্বশেষ বাঁশখালীর ঘটনা। বকেয়া মজুরি পরিশোধ আর বাড়তি কর্মঘন্টা কমানোর দাবিতে শ্রমিকেরা যখন সরব হতে থাকেন তখন সন্ত্রাসী ও পুলিশ তাদের ওপর গুলি চালায়। নিহত শ্রমিকদের সংখ্যা এখন পর্যন্ত সাত। জখম শ্রমিকদের সংখ্যা অনেক বেশি। কোম্পানি নিয়োজিত পুলিশ ও সন্ত্রাসীদের দ্বারা আক্রান্ত, নিহত, জখম শ্রমিক ও গ্রামবাসীই এখন উল্টো মামলা ও হুমকির শিকার। ‘অন্ধকার থেকে আলোর মিছিলে প্রিয় বাংলাদেশ’ এই বিজ্ঞাপনী প্রচার দিয়ে এই প্রকল্পের যাত্রা শুরু করেছিল এস আলম গ্রুপ ২০১৬ সালে। এই প্রকল্পে তার সহযোগী চীনা কোম্পানি আর পৃষ্ঠপোষক সরকার। প্রথম থেকেই এই প্রকল্পে পাওয়া যায় কোম্পানি-সরকারের যোগসাজসে প্রতারণা, জালিয়াতি, অনিয়ম আর জোর জবরদস্তির নানা চিত্র। এর কারণে এই প্রকল্প এলাকার গরীব মানুষ আর প্রকল্পের শ্রমিকদের উপর জুলুমের অনেক ঘটনা ঘটেছে, পুলিশ-সন্ত্রাসীদের গুলিতে মানুষ খুনজখম করা তার অংশ। ২০১৬ সালেও এখানে নিরস্ত্র গরীব মানুষ গুলি করে খুন করা হয়েছে। তাঁদের অপরাধ ছিল তাঁরা এই প্রকল্প নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। এই প্রাণবিনাশী প্রকল্প প্রথম থেকেই কীরকম অনিয়ম ও মিথ্যাচারের উপর দিয়ে চলছে তা নিয়ে ২০১৬ সালে প্রকাশিত বেশ কয়টি অনুসন্ধানী লেখা পুন:প্রকাশ ছাড়াও বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে একটি লেখা এই সংখ্যায় প্রকাশ করা হলো। এছাড়া মজুরের দেশে মজুরের জীবন বুঝতে থাকছে কয়েকজন শ্রমিকের সংক্ষিপ্ত জীবন কাহিনী।
বাংলাদেশের মানুষের জন্য চরম নিরাপত্তাহীনতা, নিপীড়ন এবং হয়রানির কুখ্যাত অস্ত্র ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮’। সাধারণভাবে কোনো আইনের তোয়াক্কা না করে কোনো কারণ না দেখিয়ে বিভিন্নজনকে তুলে নেওয়া, গোপন জায়গায় আটকে রাখা, ক্রসফায়ার, গুম, হেফাজতে নির্যাতন খুন সবই চলছে। সমাজে ভয়ের রাজত্ব সৃষ্টি করতে, ভিন্নমত দমন করতে এবং নিপীড়নমূলক ব্যবস্থাকে আইনী পোশাক পড়াতে এর ওপর জারি করা হয়েছে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮’। করোনাকালে এই আইন প্রয়োগ করে ধরপাকড়েই সরকার বেশি ব্যতিব্যস্ত ছিল। এই আইনের বিস্তারিত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা হয়েছে এই সংখ্যায় প্রকাশিত একটি লেখায়।
তথাকথিত লকডাউনে ব্যক্তিগত গাড়ি দিয়ে ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে জট লেগে গেলেও পুলিশের প্রধান আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু ছিলেন রিকশা-ভ্যান চালকেরা। বহু রিকশা-ভ্যান আটক করা হয়েছে, বহু রিকশা-ভ্যান উল্টে রাখা হয়েছে, বহু রিকশা-ভ্যানচালকের কাছ থেকে ঘুষ আদায় করা হয়েছে। সেজন্য এই দাবি খুব যুক্তিসঙ্গত যে, ‘আগে আমাদের যে টাকা সরকারের কাছে আছে সেখান থেকে আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করেন তারপর চলেন সবাই মিলে লকডাউন করি। আগে শ্রমিকদের যাতায়াতের ব্যবস্থা করেন, বকেয়া মজুরি দেন তারপর কারখানা খোলেন। আগে গাড়ি উল্টান তারপর রিকশা উল্টাতে আসেন, রিকশার গদি টানাটানি করেন। লকডাউন সফল করতে হলে সবার ঘরে খাবার পৌঁছাতে হবে।’
বিশ্বজুড়ে পুঁজির আগ্রাসনে স্থায়ী স্থিতিশীল কর্মসংস্থান ক্রমেই দুর্লভ হয়ে উঠছে। নব্য উদারতাবাদী মডেলে বিস্তৃত হচ্ছে চুক্তিভিত্তিক, খন্ড, অস্থায়ী, ঠিকাদার ভিত্তিক কাজ। ‘আউটসোর্স’ এখন একটি প্রধান ধরনে পরিণত হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে শ্রমিকের সংগঠিত হওয়া, নিশ্চিত কাজ, নিয়মিত কাঠামোবদ্ধ মজুরি সবকিছু থেকেই শ্রমিক বঞ্চিত হয়। পুঁজিপতির খরচ কমে, মুনাফা বাড়ে, মধ্যস্বত্ত্বভোগী ভাগ বসায়, শ্রমিকের জীবন ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। শিল্পোন্নত দেশগুলোতেও এই মডেলে অনিশ্চিত কাজে নিয়োজিত মানুষের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। যুক্তরাজ্যের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে লেখার অনুবাদে এই পরিস্থিতিই তুলে ধরা হয়েছে। বাঁশখালীর শ্রমিকেরাও এরকম পরিস্থিতির শিকার।
বাংলাদেশে সর্বজনের বিশেষজ্ঞ খুব দুর্লভ। উচ্চ ডিগ্রিধারী বিশেষজ্ঞ নামে আমরা যাদের দেখি তাদের অধিকাংশ আসলে কোনো না কোনো আন্তর্জাতিক পুঁজি লগ্নী প্রতিষ্ঠান, বাণিজ্যিক বা করপোরেট প্রতিষ্ঠান বা প্রকল্পের সাথে যুক্ত। কোম্পানি বা মুনাফালোভী তৎপরতা কিংবা তাদের পৃষ্ঠপোষকদের সাথে কোনো বিশেষজ্ঞ যখন যুক্ত থাকেন, বা অর্থের বিনিময়ে তাদের সেবা দান করতে নিয়োজিত হন তখন তার ভূমিকা থাকে কর্মচারির, বিশেষজ্ঞ হিসেবে স্বাধীন ভূমিকা পালনের কোনো সুযোগ তাদের থাকে না। এই বাস্তবতায় ডক্টর নূরুল ইসলামের মতো মানুষ এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম এবং জাতীয় ভরসা। তাঁর এবং তাঁর মতো মানুষদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে একটি লেখা প্রকাশ করা হলো।
বৈশ্বিক পুঁজির সম্প্রসারণ, কেন্দ্রীভবন এবং আগ্রাসন এখন আগের যে কোনো সময়ের চাইতে অনেক বেশি। একদিকে এই ব্যবস্থা অন্তর্নিহিত সংকটে জর্জরিত অন্যদিকে তা উচ্চ মুনাফাযোগ্য নতুন নতুন বিনিয়োগ ক্ষেত্রের সন্ধানে মরিয়া। যুদ্ধ, মাদক থেকে প্রাণপ্রকৃতি সর্বত্রই তার থাবা। এখন তা মানুষের শরীর, মন, খাদ্যাভ্যাস সবকিছুকে নিজের চাহিদা মতো সাজাতে ব্যগ্র। প্রযুক্তিগত বিকাশকে কাজে লাগিয়ে মানুষকে তা অসহায় গিনিপিগে পরিণত করার নানা পথ সন্ধান করছে। বিল গেটসকে কেন্দ্র করে অনুসন্ধানী একটি লেখায় এর ভয়াবহ চিত্র পাওয়া যায়। তার অনুবাদ এখানে প্রকাশ করা হলো।
বিশ্বজুড়ে একদিকে যেমন নিপীড়ন শোষণ জাতিবিদ্বেষ সংঘাত সন্ত্রাস বাড়ছে অন্যদিকে তেমনি তার বিরুদ্ধে জনপ্রতিরোধও তৈরি হচ্ছে নানা মাত্রায়। কিন্তু জনপ্রতিরোধ কি লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে বারবার? সাম্রাজ্যবাদী- স্বৈরতন্ত্রী শাসকদের ক্ষমতার খুঁটি কি আরও শক্ত হচ্ছে? নিপীড়নের ব্যবস্থাবলী কি আরও সম্প্রসারিত হচ্ছে? এর কারণ কী? এবিষয়ে এই সংখ্যার একটি লেখায় কিছু প্রশ্ন ও পর্যবেক্ষণ রাখা হয়েছে। আমরা এবিষয়ে আরও লেখা আশা করি।
করোনাকালে সমাজে বিদ্যমান নানামুখি বৈষম্য আরও জোরদার হয়েছে। করোনাপূর্ব রাজনৈতিক অর্থনৈতিক বিধিব্যবস্থার কারণে এবং করোনাকালে গৃহীত বিধি ব্যবস্থায় বৈষম্যপীড়িত মানুষেরা আরও পীড়নের শিকার হচ্ছেন। প্রণোদনা প্যাকেজে নারীর প্রান্তিক অবস্থান কিংবা অনুপস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে একটি লেখায়।
এছাড়া এসএম সুলতানের শিল্পকর্ম কেন্দ্র করে তাঁর চিন্তার জগৎ বিশ্লেষণ, চলচ্চিত্র পর্যালোচনা সহ ধারাবাহিক লেখা ‘নারী-পুরুষের মানস : পুরুষতান্ত্রিক ধারণা ও বৈষম্যের জৈবসামাজিক ভিত্তি’, ‘সিপি গ্যাং ও বেশ্যা ব্যানার’, ‘এঞ্জেলা ডেভিসের সাথে কথোপকথন’, ‘স্মরণ’ এ সংখ্যাতেও প্রকাশিত হলো। নতুন দুটি বিভাগ এই সংখ্যায় যোগ করা হলো- ‘সাক্ষাৎকার’ ও ‘অভিজ্ঞতা/মতামত/চিঠিপত্র’। এবারের সাক্ষাৎকারে পাট থেকে পলিথিনের বিকল্প, সোনালীব্যাগ-এর জন্মকথা এবং তার উৎপাদন জটিলতা নিয়ে বিস্তারিত বলেছেন এর উদ্ভাবক বিজ্ঞানী।
আনু মুহাম্মদ
২৮ এপ্রিল ২০২১