যে আগুনের আঁচ লাগে না রাষ্ট্রের গায়ে

বস্তিতে আগুন

যে আগুনের আঁচ লাগে না রাষ্ট্রের গায়ে

প্রকাশ দত্ত

শ্রেণি বিভক্ত সমাজের অভ্যন্তরে যে আগুন জ্বলছে তা আপাতদৃষ্টিতে চোখে দেখা না গেলেও তার তাপ খুবই ভয়ঙ্কর। এটা শোষিত শ্রেণির জনগণ কতটা উপলব্ধি করে তা জানা না গেলেও, শোষক শ্রেণি ঠিকই সেই উত্তাপ উপলব্ধি করে। তাই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে শোষিত শ্রেণিকে শায়েস্তা করতে তাদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। তারই একটি হচ্ছে বস্তিতে আগুন লাগিয়ে বস্তি উচ্ছেদ। বস্তি গড়ে তোলার পিছনে যেমন কার্যকারণ থাকে। তেমনি বস্তি উচ্ছেদের পিছনেও থাকে নানা কার্যকারণ। এ ধরনের কাজ শোষক শ্রেণি করে থাকে তার নিপীড়ক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই। ‘বস্তিবাসীর জীবন আর আগুন লাগার জন্য দায়ী হচ্ছে কপাল’ এই কথাটাই যখন বেশিরভাগ বস্তিবাসী বিশ্বাস করে তখন রাষ্ট্র ও সরকার নিরাপদ থাকে। কিন্তু যখন প্রশ্ন উঠে বস্তির দখল নিয়ে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব অথবা বড় কোনো সুপার মার্কেট গড়ে তোলার জন্য আগুন লাগানো হয় বস্তিতে, তখন রাষ্ট্র ও সরকার অস্বস্তিতে পড়ে।
২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে ৯৩টি বস্তিতে আগুন লাগে বা লাগানো হয়। ২০১৯ সালে সারাদেশে ১৭৪টি, ২০১৮ সালে ৫২৫টি, ২০১৭ সালে ২৫৪টি বস্তিতে আগুন লাগে। ২০১৭ থেকে ২০১৯ তিন বছরে সবচেয়ে বেশি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে চট্টগ্রামের ৬০২টি বস্তিতে, ঢাকায় ঘটেছে ৯৬টি বস্তিতে।
২০১৪ সালের বস্তি শুমারী অনুযায়ী ঢাকা শহরের ২ সিটি করপোরেশনে মোট বস্তির সংখ্যা ছিল ৩,৩৯৪টি। ২০২০ সালে অক্টোবরে কল্যাণপুরে নতুন বাজার বস্তির ৭ নং সেকশন এলাকায় অগ্নিকাণ্ডে দু’জন দগ্ধ হয়। ২৩ নভেম্বর মহাখালীর সাততলার বটতলার মসজিদ রোডের বস্তিতে আগুন লেগে পুড়ে যায় আড়াই শতাধিক ঘর। ২৪ নভেম্বর মঙ্গলবার মোহাম্মদপুর জহুরি মহল্লায় বিজলি বস্তিতে আগুন লেগে শতাধিক ঘর পুড়ে যায়। একইদিনে কয়েক ঘন্টার মাথায় রাত আনুমানিক সোয়া ২টার দিকে কালশি বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন বাউনিয়া বাঁধ বি-ব্লকের বস্তিতে আগুন লেগে অন্তত ৪৩টি বস্তিঘর এবং ১২টি দোকান পুড়ে যায়। ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে ৯৩টি বস্তিতে আগুন লাগে বা লাগানো হয়। ২০১৯ সালে সারাদেশে ১৭৪টি, ২০১৮ সালে ৫২৫টি, ২০১৭ সালে ২৫৪টি বস্তিতে আগুন লাগে। ২০১৭ থেকে ২০১৯ তিন বছরে সবচেয়ে বেশি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে চট্টগ্রামের ৬০২টি বস্তিতে, ঢাকায় ঘটেছে ৯৬টি বস্তিতে। গত পাঁচ বছরে দেশের বস্তিগুলোয় ১,২০০টির বেশি অগ্নিকাণ্ড ঘটলেও একটিও অভিযোগপত্র দাখিল করেনি পুলিশ। ২০১০ থেকে ২০১৮ সালে সর্বোচ্চ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে রাজধানী ঢাকায়। ২০১০ থেকে ২০১৮ সালে সারাদেশে ছোট-বড় ১৬,০০০ অগ্নিকাণ্ডে মারা গেছে ১,৫৯০ জন। শুধু গত বছরেই রাজধানীসহ সারাদেশে অন্তত ৩২টি বস্তিতে আগুন লাগে। আর এতে মারা গেছে নারী-শিশুসহ ২০ জন। তথাকথিত উন্নয়ন অভিযানের নামে কোথাও উচ্ছেদ করা হয় বস্তি, কোথাও কেড়ে নেওয়া হয় কৃষকের ফসলি জমি, কোথাও উচ্ছেদ হয় ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষ। যেমন সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবনের চিম্বুক পাহাড়ে নাইতংপাড়ায় পাঁচতারা রিসোর্ট নির্মাণের নামে উচ্ছেদ করা হবে ম্রো সম্প্রদায়ের মানুষকে।
২০১০ থেকে ২০১৮ সালে সারাদেশে ছোট-বড় ১৬,০০০ অগ্নিকাণ্ডে মারা গেছে ১,৫৯০ জন।
প্রচলিত সমাজে জীবনের সব চাওয়া আর স্বপ্নকে ভুলে গিয়ে ভারবাহী পশুর মত যারা বস্তিতে জীবন-যাপন করছে তারা রাষ্ট্রের কাছে নিছক পরিসংখ্যান ছাড়া আর কিছুই নয়। কোলের সন্তানকে ঘুমের মধ্যে রেখে খুব সকালে উঠে শহরের বাসাবাড়িতে বাবুদের সংসার সাজাতে ছুটে বেড়ানো সেই মানুষগুলোর শেষ আশ্রয় হচ্ছে এই বস্তিগুলো। অভাবের তাড়নায় বস্তির শিশুকে ছাড়তে হয় পরম মমতায় ঢাকা মায়ের কোল। যে কারণে শিশুকাল তাদের জীবনে হয়েছে শিশুশ্রমের কাল। আমাদের দেশের দৈনিক পত্রিকাগুলোর সাহিত্য পাতায় খুব বেশি থাকে না বস্তি নামক মানুষের জীবন কথা। নিষ্ঠুর সত্য হচ্ছে মুনাফার ক্রুশে বিদ্ধ অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সব চাওয়া-পাওয়া পুঁজির চাওয়া-পাওয়ার সাথে জড়িত। পুঁজির শোষণ যেমন মানুষকে পাঠিয়েছে বস্তিতে আবার পুঁজির স্বার্থে আগুন জ্বালানো হয় বস্তিতে। তাই আগুনের চেয়েও নির্মম নিষ্ঠুর হচ্ছে পুঁজির শোষণ। পুঁজির স্বার্থে গড়া এই পৃথিবীর তাবৎ ঘটনার বিষয়বস্তুর প্রেক্ষিতে সকল ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্যদিয়ে প্রতিফলিত হয় শ্রেণির স্বার্থ। যেমন বস্তির আগুন আর বসুন্ধরা সিটিতে লাগা আগুন। এই দু’টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় রাষ্ট্রের ভূমিকা লক্ষ্য করলে বোঝা যায় রাষ্ট্র কার স্বার্থের পাহারাদার।
পুঁজির শোষণ যেমন মানুষকে পাঠিয়েছে বস্তিতে আবার পুঁজির স্বার্থে আগুন জ্বালানো হয় বস্তিতে। তাই আগুনের চেয়েও নির্মম নিষ্ঠুর হচ্ছে পুঁজির শোষণ।
মানুষকে জমি থেকে, বাড়ি থেকে, বস্তি থেকে উচ্ছেদ করে কায়েমি স্বার্থবাদীদের পুঁজি স্ফীত করতে শাসক-শোষকগোষ্ঠীর ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতা প্রত্যাশীরা একই রেখায় দাঁড়িয়ে আছে। যে কারণে বস্তির আগুনের আঁচ লাগে না প্রধানমন্ত্রীর গায়ে। আজ তাই মানুষের মত জীবন, নিরাপদ পৃথিবী আর শিশুর মুখের নির্মল হাসির জন্য মুনাফার শিকলে বাঁধা পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব ব্যবস্থা উচ্ছেদে বস্তিবাসী, হকার, মুটে-মজুর, শ্রমিক, শ্রমজীবী, কৃষক, ছাত্র, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী তথা ব্যাপক জনগণকে এক কাতারে দাঁড়িয়ে লড়তে হবে অভিন্ন শত্রুর বিরুদ্ধে। প্রকাশ দত্ত: যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ, কেন্দ্রীয় কমিটি। ই-মেইলঃ pkdutta.dhaka@gmail.com
Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *