করপোরেট পুঁজির বিরুদ্ধে কৃষকদের দিল্লি ঘেরাও

করপোরেট পুঁজির বিরুদ্ধে কৃষকদের দিল্লি ঘেরাও

নেসার আহমেদ

সম্প্রতি ভারতের মোদি সরকার কৃষি সম্পর্কিত যে আইন পাশ করেছে তার বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদী কৃষক অবরোধ ও আন্দোলন চলছে। কী সেসব আইন আর কেনই বা কৃষকদের এরকম মরণপণ দীর্ঘ প্রস্তুতির লড়াই? ভারতের কৃষিতে এসব নতুন আইনের তাৎপর্য কী? গত কয়েক দশকে ভারতের কৃষিতে কীধরনের পরিবর্তন ঘটেছে? এসব বিষয়ে আদ্যোপান্ত পর্যালোচনা করতে এই লেখা।

ভূমিকা

সেপ্টেম্বর ২০২০ সালে ভারতের মোদি সরকার তিনটি কৃষি আইন পাস করেছে। আইনগুলো হলো অত্যাবশ্যক পণ্য আইন সংশোধন (Essential Commodities (Amendment) Bill, কৃষিপণ্য লেনদেন ও বাণিজ্য উন্নয়ন (The Farmers’ Produce Trade and Commerce (Promotion and Facilitation) Bill, 2020 এবং কৃষিপণ্যের দাম নিশ্চিত করতে কৃষকদের সুরক্ষা ও ক্ষমতায়ন চুক্তি’ সংক্রান্ত বিল (The Farmers (Empowerment and Protection) Agreement of Price Assurance and Farm Service.. এর মধ্যে ২০২০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর একটি এবং ১৮ সেপ্টেম্বর বাকি দুটি বিল লোকসভায় পাস হয়। ২৮ সেপ্টেম্বর দেশটির রাষ্ট্রপতি বিলে স্বাক্ষর করার পর তা আইনে পরিণত হয়। এর প্রতিবাদে কৃষকরা শক্তিশালী প্রতিরোধ আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন। এই বিষয়ে বিচার বিশ্লেষণ করতেই এই লেখা।

মোদি সরকার যখন বিলগুলো সংসদে উত্থাপন করে তখন সংসদে ১২টি বিরোধী রাজনৈতিক দল তার প্রতিবাদ জানিয়েছিল। তাদের বক্তব্য ছিল, আলোচিত তিনটি কৃষি বিল পাস করার সময়ে কেন্দ্রীয় সরকার একাধিক নিয়ম ভঙ্গ করেছে। যেভাবে কৃষি বিল পাস হচ্ছে তা আদ্যোপান্ত অসাংবিধানিক। কারণ কৃষি ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত এমন কোনো আইন কেন্দ্রীয় সরকার প্রণয়ন করতে পারে না। সংবিধানের সপ্তম শিডিউলের ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কৃষি নিয়ে অধ্যয়ন বা গবেষণাসহ কৃষিভিত্তিক  আইন প্রণয়ন করা রাজ্যের তালিকাভুক্ত। ফলে কেন্দ্রীয় সরকার এই বিলগুলোর মাধ্যমে রাজ্যের ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ করছে।

সংসদে যখন বিলগুলো উত্থাপন করা হয় তখন এর প্রতিবাদে অনাস্থা প্রস্তাব আনেন তৃণমূল সাংসদ ডেরেক ও ব্রায়েন। তাদের সঙ্গে যুক্ত হন ডিএমকের (Dravida Munnetra Kazhagam) সাংসদ তিরুচি শিবা। তারা তিনটি বিল পাসের জন্য রাজ্যসভায় ভোট দিতে বলেন। কারণ সংবিধান অনুয়ায়ী এ অধিকার রাজ্য সভারই রয়েছে। কিন্তু রাজ্যসভায় মোদি জোট সংখ্যালঘু হওয়ায় ভোটে দেয়া হয়নি। বিলগুলো তারা ধ্বনিভোটে লোকসভায় পাস করিয়ে নেয়। সিপিএম সাংসদ কে কে রাগেশ বিলে কয়েকটি সংশোধনীর প্রস্তাব এনেছিলেন। সেটাও অগ্রাহ্য করা হয়। এই বিলকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীন জোটের শরিকদের মধ্যেও বিভেদ সৃষ্টি হয়। শিরমণি আকালি দলের নির্বাচিত সাংসদ হরসিমরাত কৌর বাদল মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করেন। পাঞ্জাব ও কেরালার রাজ্যসভা পাল্টা কৃষি বিল পাস করেছে। সংসদে বিলগুলো উত্থাপনের সময় বিরোধীদলীয় সাংসদরা দাবি করেছিলেন,বিলগুলোতে কৃষকদের স্বার্থ উপেক্ষা করা হয়েছে। বড় বড় ব্যবসায়ীদের একতরফাভাবে ফসলের দাম নির্ধারণ ও খাদ্য মজুদের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।

এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার যে, মোদি সরকার এখন যে তিনটি আইন সংসদে পাস করেছে, ওই একই চেষ্টা দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারেরও ছিল। ২০১০ সালের এপ্রিলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এ চেষ্টা করেছিলেন। সেই সময়ও কৃষকরা বিরোধিতা করেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে গুজরাট, অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু ও মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রীদের নিয়ে একটি গোষ্ঠী তৈরি করেছিলেন মনমোহন। ওই কমিটির রিপোর্ট মোদি ২০১১ সালের মার্চে নিজ হাতে জমা দেন মনমোহনের কাছে। তার বিস্তৃত বর্ণনা এখনও মোদির নিজস্ব ওয়েবসাইটে রয়েছে। মোদির ওই রিপোর্টের এমএসপি নিশ্চিতকরণ শীর্ষক অনুচ্ছেদে লেখা ছিল, অনেক ক্ষেত্রেই চাষিরা আগাম চুক্তি করে চাষ করেন। সেক্ষেত্রে তাঁদের স্বার্থরক্ষায় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে লেনদেনে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের (এমএসপির) কমে হতে দেয়া যাবে না। আইনে বিধিবদ্ধভাবে তা নিশ্চিত করতে হবে। অর্থাৎ আন্দোলনরত কৃষক ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো করপোরেট কোম্পানির ফসল কেনার ক্ষেত্রে যে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের লিখিত গ্যারান্টি চাচ্ছেন, মোদি ২০১১ সালে বিরোধী দলে থাকার সময় একই দাবি করেছিলেন।

ভারতীয় সংসদ এবং আন্তর্জাতিক পরিসর ছাড়াও বাইরে বিল পাসের প্রথম দিন থেকেই পাঞ্জাব ও হরিয়ানার চাষিরা এই আইনের প্রতিবাদে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। সময় যত গড়িয়েছে, আন্দোলনে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন শক্তি।

অবরোধের প্রথম দিন পাঞ্জাবের কৃষকদের দিল্লির সীমানায় মিছিল করে আসা

অন্যদিকে চাষিদের দিল্লি ঘেরাও আন্দোলন কিন্তু হঠাৎ ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা নয়। ২০১৪ সালে মোদি সরকার যখন একটু একটু করে কৃষকবিরোধী পদক্ষেপ নেয়া শুরু করে, তখন তার প্রতিক্রিয়ায় ২০১৬ সাল থেকে ভারতের কৃষক বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষক সংগঠনগুলোর মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করে। তাদের লক্ষ্য ছিল মোদির করপোরেট অভিমুখী কৃষিনীতি প্রতিহত করার কর্মনীতি ঠিক করা। এ লক্ষ্য নিয়ে ২০১৭ সালে ভারতের ২৫০টি কৃষক সংগঠন ঐক্যবদ্ধ হয়। গড়ে ওঠে ‘অল ইন্ডিয়া কিষান সংঘ কোঅর্ডিনেশন কমিটি’ (AIKSCC)। এই সমন্বয় কমিটির মধ্যে ধনী কৃষকদের সংগঠন রয়েছে। রয়েছে বামপন্থী ও বাম-ঘেঁষা কৃষক সংগঠনও। তাদের লক্ষ্য ভিন্ন ভিন্ন হলেও কিছু প্রশ্নে ঐকমত্য ছিল। যেমন ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ও মান্ডি প্রশ্নে কোনো ছাড় না দেয়া। ২০২০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর যেদিন বিল তিনটি আইনে পরিণত হয়, ওই একই দিনে সমন্বয় কমিটির মিটিংয়ে নভেম্বরের শেষে দিল্লি অভিযানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সিদ্ধান্ত ছিল পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ ইত্যাদি রাজ্য থেকে কৃষকরা কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে দিল্লি ঘেরাও করবেন। সংগঠনের পক্ষ থেকে ২৫-২৬ নভেম্বর পার্লামেন্ট অভিযানের ডাক দেয়া হয়।

এর আগে তিনটি আইন পাস হওয়ার দিন থেকে স্থানীয় পর্যায়ে হরিয়ানা ও পাঞ্জাবের কৃষকরা আন্দোলন করেছেন। পাঞ্জাবের চাষিরা দুই সপ্তাহ ধরে রেললাইনের ওপর ধরনা চালান। তারা রিলায়েন্সের মল, পেট্রল পাম্প ও আউটলেটগুলো দখল করে রাখেন। আম্বানির রিলায়েন্সের পণ্য ও পরিষেবা বয়কটের ডাক দেন। পাঞ্জাবে ৯০০০ মোবাইল টাওয়ারের ১৪০০ বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। আদানির শস্যগুদামগুলোও কৃষকরা দখল করে রাখেন। তাছাড়া চলমান আন্দোলনের কারণে কৃষিনির্ভর হরিয়ানা বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছে। আঁচ ছড়িয়ে পড়েছে অন্ধ্র, গুজরাট, মহারাষ্ট্র, তেলেঙ্গানা এবং পশ্চিমবঙ্গের মতো বিভিন্ন রাজ্যে। কিন্তু এবারের আন্দোলনে লক্ষণীয় বিষয় হলো গোটা পাঞ্জাব রাজ্য একাট্টা হয়ে পড়েছে। কারণ পাঞ্জাব হলো ভারতের এমনি একটি রাজ্য, যেখানে গ্রাম-শহর ছাড়াও ভিন্ন দেশে প্রবাসী হিসেবে অনেকে বাস করেন। তারা কেউই কৃষির সঙ্গে তাদের যোগসূত্রতা ছিন্ন করেননি। এখন অনেকেই প্রত্যক্ষভাবে কৃষির সঙ্গে যুক্ত নন। কিন্তু অনেকের বাপ-দাদা বা স্বজনরা কৃষির সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। শহরবাসীর মধ্যে কারো কারো এখনো আয়ের বড় উৎস পারিবারিক কৃষি খামার। কৃষির সঙ্গে নানান সূত্রে মানুষের যুক্ততার কারণে চলমান আন্দোলনে গোটা রাজ্য জড়িয়ে গেছে।

তিনটি আইন পাস হওয়ার দিন থেকে স্থানীয় পর্যায়ে হরিয়ানা ও পাঞ্জাবের কৃষকরা আন্দোলন করেছেন। পাঞ্জাবের চাষিরা দুই সপ্তাহ ধরে রেললাইনের ওপর ধরনা চালান। তারা রিলায়েন্সের মল, পেট্রল পাম্প ও আউটলেটগুলো দখল করে রাখেন। আম্বানির রিলায়েন্সের পণ্য ও পরিষেবা বয়কটের ডাক দেন। পাঞ্জাবে ৯০০০ মোবাইল টাওয়ারের ১৪০০ বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। আদানির শস্যগুদামগুলোও কৃষকরা দখল করে রাখেন।

পাঞ্জাবে যখন কৃষক আন্দোলনের তীব্র আকার ধারণ করে, তখন রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রথমে বলা হয় আন্দোলনে বিচ্ছিন্নতাবাদী খালিস্তানিদের যোগ রয়েছে। এরা বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সন্ত্রাসী। আবার কখনো বলা হয়েছে আন্দোলনে মাওবাদীদের যোগ রয়েছে। এমনকি যখন রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিদের সঙ্গে কৃষকদের আলোচনা চলছে ঠিক ওই সময়ে নিষিদ্ধ সংগঠন ‘শিখস ফর জাস্টিস’-এর সঙ্গে জড়িত একটি মামলার তদন্তে পঞ্জাবি অভিনেতা দীপ সিধু ও কৃষক নেতা বলদেব সিংহ সিরসাসহ ৪০ জনকে তলব করেছে এনআইএ। অন্যদিকে সংকট নিরসনে অনেক চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর ভারতের সুপ্রিম কোর্ট হস্তক্ষেপ করে তিনটি বিলের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে এবং একটি কমিটি গঠন করে দেয়। কিন্তু অবস্থার কোনো হেরফের ঘটেনি। কারণ কৃষকদের দাবি, আলোচিত তিনটি কৃষি আইনে লাভবান হবে আম্বানি-আদানিদের মতো দেশি-বিদেশি বড় বড় করপোরেট সংস্থাগুলো; কৃষি উন্নয়নের নামে কৃষকদের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে; নতুন আইনে করপোরেট সংস্থাগুলোকে চাষিদের সঙ্গে চুক্তিভিত্তিক চাষের আইনগত ভিত্তি দেয়া হয়েছে; তাতে কৃষকের হাতে জমি থাকলেও ফসলের ওপর তাদের কোনো অধিকার থাকবে না; করপোরেট সংস্থাগুলো কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ফসল কিনে মজুদ করবে; এবং কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে ফসলের দাম বাড়লে বাজারে ছাড়বে। নতুন আইনে যত খুশি শস্য মজুদের কথা বলা হয়েছে কিন্তু ফসল কেনাবেচার ক্ষেত্রে যে ন্যূনতম মূল্যের গ্যারান্টি ছিল, নতুন আইন বা চুক্তিভিত্তিক চাষের ক্ষেত্রে তা বাদ দেয়া হয়েছে। এতে করে সর্বস্তরের চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

আলোচিত তিনটি কৃষি আইনে লাভবান হবে আম্বানি-আদানিদের মতো দেশি-বিদেশি বড় বড় করপোরেট সংস্থাগুলো; কৃষি উন্নয়নের নামে কৃষকদের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে; নতুন আইনে করপোরেট সংস্থাগুলোকে চাষিদের সঙ্গে চুক্তিভিত্তিক চাষের আইনগত ভিত্তি দেয়া হয়েছে; তাতে কৃষকের হাতে জমি থাকলেও ফসলের ওপর তাদের কোনো অধিকার থাকবে না; করপোরেট সংস্থাগুলো কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ফসল কিনে মজুদ করবে; এবং কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে ফসলের দাম বাড়লে বাজারে ছাড়বে। নতুন আইনে যত খুশি শস্য মজুদের কথা বলা হয়েছে কিন্তু ফসল কেনাবেচার ক্ষেত্রে যে ন্যূনতম মূল্যের গ্যারান্টি ছিল, নতুন আইন বা চুক্তিভিত্তিক চাষের ক্ষেত্রে তা বাদ দেয়া হয়েছে। এতে করে সর্বস্তরের চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

নতুন কৃষি আইনের পক্ষে রাষ্ট্রের যুক্তি ও পারস্পরিক সম্পর্ক

রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এই আইনগুলো কার্যকর হলে কৃষক সরকারি কৃষিপণ্য কেনাবেচার প্রতিষ্ঠান মান্ডির বাইরেও তাদের পণ্য বিক্রি করতে পারবেন। চুক্তিভিত্তিক চাষে কৃষক ও কৃষির উন্নয়ন ঘটবে। বীজ বোনার আগেই কৃষক কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হবেন, উৎপাদিত কৃষিপণ্যের একটি নির্দিষ্ট দাম ঠিক করতে পারবেন। উৎপাদিত পণ্যের বাজার মূল্য নিয়ে ভাবতে হবে না। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে বেসরকারি সংস্থাগুলোও কৃষিপণ্য মজুদ করতে পারবে। কৃষিতে বড় বড় বেসরকারি কোম্পানিগুলো সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে পণ্য কিনে ভোক্তাদের কাছে বিক্রি করতে পারবে। মধ্যস্বত্বভোগীদের দরকার পড়বে না। বিপণনের সুবিধার্থে বড় সংস্থাগুলো তাদের আধুনিক প্রযুক্তি-নির্ভর গুদামে পণ্য মজুদ রাখতে পারবে। কৃষিপণ্য নষ্ট হওয়ার প্রবণতা কমবে। বেসরকারি সংস্থাগুলোর বৃহৎ লেনদেন খাদ্যশস্য সংগ্রহ ও বিপণনের খরচ কমাবে। সব মিলিয়ে ভারতীয় কৃষি আরো দক্ষ, বাজার নির্ভর হয়ে উঠবে। যার সুফল পাবেন ভোক্তা ও কৃষকরা। মূলত কৃষিতে করপোরেট পুঁজি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এগুলো হলো প্রধান যুক্তি। মোদি সরকারের উল্লেখিত যুক্তিগুলো বুঝতে গেলে নতুন তিন কৃষি আইনের আগে কী ছিল এখন কী কী পরিবর্তন আনা হচ্ছে সেদিকে একটু নজর দেয়া দরকার।

ভারতের তিন কৃষি আইনের মধ্যে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনে খাদ্যশস্য মজুদের ঊর্ধ্বসীমা নির্দিষ্ট করা ছিল। আইনটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দুর্ভিক্ষ মোকাবেলা করার জন্য তৈরি করা হয়।এই আইনের দুটি দিক রয়েছে। একটি হলো খোলাবাজারে সরকার স্বীকৃত যেসব ব্যবসায়ী খাদ্যপণ্যের ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল, তাদের পণ্য মজুদের ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে দেয়া হয়। যাতে খোলাবাজারে খাদ্যপণ্য মূল্যের স্থিতিশীলতা বজায় থাকে। কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি না হয়। আইনের দ্বিতীয় অংশটি ছিল সরকারিভাবে অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যপণ্য কেনা এবং রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট কাজে ব্যবহার; যার মধ্যে একটি প্রকল্প ছিল সর্বসাধারণের জন্য রেশনিং ব্যবস্থা।

কৃষিপণ্য লেনদেন ও বাণিজ্য উন্নয়ন নামে দ্বিতীয় আইনটি গড়ে উঠেছিল ষাটের দশকে সবুজ বিপ্লবের সময়। মূলত এ আইনে সবুজ বিপ্লব প্রকল্পের আওতায় উৎপাদিত ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়। ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ঠিক করা হয়েছিল উৎপাদন খরচের সঙ্গে সংগতি রেখে তার ওপর ৫০ ভাগ দাম বাড়ানো। এখানে লক্ষ করার বিষয় হলো, কৃষি খাতে উৎপাদিত সমস্ত পণ্যের ক্ষেত্রে কিন্তু ন্যূনতম সহয়াক মূল্য ছিল না। কিন্তু মূল খাদ্যশস্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বেঁধে দেয়ায় এটাই অলিখিতভাবে সর্বোচ্চ দাম হিসেবে ধরা হয়েছে; বাজারে অন্যান্য কৃষিপণ্য কেনাবেচার ক্ষেত্রে যা প্রভাবক হিসেবে ভূমিকা রেখেছে এবং রাষ্ট্র চাষিদের কাছ থেকে এই মূল্যে সবুজ বিপ্লব প্রকল্পে উৎপাদিত পণ্য কিনেছে। তার ওপর ভিত্তি করে ব্রিটিশ আমলে গড়ে ওঠা সর্বসাধারণের জন্য রেশনিং খাতে বণ্টন করেছে। অর্থাৎ উল্লিখিত দুই কৃষি আইন পরস্পর সম্পর্কিত ছিল। মোদির নতুন কৃষি আইন উল্লিখিত ব্যবস্থাকে বদলে দেয়ার পদক্ষেপ নিয়েছে।

কৃষিপণ্যের দাম নিশ্চিত করতে কৃষকদের সুরক্ষা ও ক্ষমতায়ন চুক্তি’ নামে এই আইন মূলত ভারতে চলমান দ্বিতীয় সবুজ বিপ্লবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। ২০০৫ সালের ১৮ জুলাই মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের মধ্যে Indo বা US-India Knowledge Initiative on Agricultue focused on promoting Teaching, Research, Service and Commercial Linkages চুক্তি স্বাক্ষর হয়, সংক্ষেপে যাকে বলা হয় AKI প্রকল্প। মনমোহন সিং সরকার ঘোষণা দিয়েছিলেন AKI প্রকল্পটি হলো ভারতের দ্বিতীয় কৃষি বিপ্লব, যার ভিত্তি হলো জিএম শস্য উৎপাদন।

একেআই চুক্তির সময় ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের করপোরেট ব্যবসায়ীদের নিয়ে গড়ে ওঠে ইন্দো-মার্কিন ফোরাম। এই ফোরামের যুক্তি ছিল একেআই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গেলে ভারতে যে Agriculture Produce Market Committeee Regulation রয়েছে,তার সংশোধনী এনে চুক্তি চাষ ও খুচরা বাজারে করপোরেট পুঁজি বিনিয়োগের সুযোগ দিতে হবে। এটা হলো উল্লিখিত আইনগুলোর সংক্ষিপ্ত সার। আলোচনার পরবর্তী অংশ এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এগিয়ে নেয়া হবে। বিশেষ করে পুরনো কৃষি আইন গড়ে ওঠার প্রেক্ষাপট এবং নতুন নিয়ে কথা বলব।

১৯৪৩ এর দুর্ভিক্ষ ও ‘অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন ’ সংশোধন

অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন গড়ে উঠেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দুর্ভিক্ষের সময়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় উইনস্টন চার্চিল ছিলেন ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন ইংল্যন্ডের নৌবিভাগের প্রথম লর্ড। ওই সময় ব্রিটিশ নৌবাহিনী জার্মান অবরোধ করে। তিনি ওই অবরোধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনি সমগ্র জার্মানীকে একটা অবরুদ্ধ হিসেবে দেশ ধরে নিয়ে খাদ্যকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেন; যাতে নারী-পুরুষ-শিশু-যুবক, বৃদ্ধ, আহত ও সক্ষমরা অনাহারে থাকে এবং জার্মানীর ওপর চাপ বাড়ে। এই অভিজ্ঞতাটি তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কাজে লাগান। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে খাদ্য সরবরাহের ব্যবস্থাপনা যুদ্ধ পরিকল্পনার অধীনে নিয়ে আসেন।

১৯৩৬ সালে ইংল্যান্ডের খাদ্য মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী সচিব উইলিয়াম বেভেরিজকে প্রধান করে একটি উপকমিটি করা হয়। শুরু হয় এই কমিটির অধীনে খাদ্যশস্য সংগ্রহ এবং যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে সরকার নিজ দেশের মানুষের মধ্যে রেশনিং ব্যবস্থা চালু করে। কিন্তু ভারত উপমহাদেশের জন্য তা প্রথম পর্যায়ে করা হয়নি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতও ছিল চার্চিলের যুদ্ধনীতির অধীন। ১৯৩৯ সালে ভারত সরকারের পক্ষ থেকেও যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ফলে সামরিক প্রয়োজনে শুরু হয় রাষ্ট্রীয়ভাবে খাদ্য সংগ্রহ করা অভিযান। বাংলায় সরকারিভাবে খাদ্য সংগ্রহে প্রথম পর্যায়ে দায়িত্ব দেয়া হয় মুসলিম লীগের সমর্থক এমএ ইসপাহানির ওপর। ইসপাহানি মির্জা আলি আকবরকে এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ করেন। তাকে ভারতের ব্রিটিশ যুগ্ম সচিব দ্রুত চাল কেনার জন্য ২০ লাখ টাকা অগ্রিম দেন। পরবর্তীতে খাদ্য সংগ্রহের জন্য আরো চারজন মূল এজেন্ট নিয়োগ করে। এর মধ্যে হিন্দু মহাসভার এইচ দত্ত শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নাম প্রস্তাব করেন। তফশিল মন্ত্রীদের সুপারিশে এজেন্ট নিয়োগ করা হয় বি কে পোদ্দারকে। কংগ্রেসের মুসলিম সদস্য আহমদ খানকে এবং বাণিজ্যিক যোগাযোগের কারণে আশুতোষ ভট্টাচার্যকে। উল্লিখিত মূল এজেন্টরা মাঠ পর্যায়ের জন্য সব এজেন্ট নিয়োগ করে। তাদের সঙ্গে বাজারের কোনো সম্পর্ক ছিল না।

চাল সংগ্রহের জন্য ব্রিটিশ সরকার বাংলার কিছু অঞ্চল নির্দিষ্ট করে দেয়। চালের মূল্য বাজারে চলতি দামের ওপর ৩ শতাংশ লাভ ধরে নির্ধারণ করা হয়। সাব এজেন্টরা বেশি লাভের আশায় নির্দিষ্ট অঞ্চলের বাইরে গিয়ে গ্রামবাংলা থেকে চাল ছেঁকে নিয়ে আসে।

১৯৪২ সালের ৩ মার্চ ভারত সরকার বেঙ্গল চেম্বার অব কমার্সকে পরামর্শ দেয়, তারা যেন তাদের সমস্ত কর্মচারীর জন্য তিন মাসের খাদ্য মজুদ করে রাখে। ১৯৪২-এর আগস্টে বেঙ্গল ন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ পাটকল, কাগজ প্রস্তুত করা সমিতি, ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাসোসিয়েশন, ট্রাম পরিবহন সংস্থাসহ অন্যান্য শিল্পের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠন করা হয় ‘চেম্বার্স খাদ্যদ্রব্য প্রকল্প’। এই প্রকল্পের আওতাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো তিন মাসের বিপরীতে কেউ ছয় মাস, কেউ বা এক বছরের জন্য খাদ্য মজুদ করে ফেলে। সংগৃহীত এই খাদ্য,প্রতিষ্ঠানের কর্মরত সবার জন্য রেশনিংয়ের মাধ্যমে বণ্টন করা হয়।

সরকার ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের পক্ষে খাদ্য কেনায় বাজারে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। বড় বড় ব্যবসায়ীরাও খাদ্য কিনে মজুদ শুরু করে। ফলে রাতারাতি খাদ্যপণ্যের দাম ৬৫ শতাংশ বেড়ে যায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার চাল ও ধান বিক্রির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ মূল্য বেঁধে দেয়। ব্যবসায়ীদের বড় অংশ তার প্রতিবাদ করে। শুরু হয় খাদ্যপণ্যের চোরাবাজারি ও অবৈধ মজুদ। খাদ্যপণ্য বিক্রির বড় বড় দোকান, গুদাম ও মিলের ঝাঁপ বন্ধ করে দেন ব্যবসায়ীরা।

১৯৪২-এর ২৭ ডিসেম্বর সরকার একটা আদেশ জারি করে। আদেশে কলকাতা ও তার পাশের অঞ্চলের যেসব দোকানে চাল, গম, আটা, ময়দা, ডাল, সর্ষের তেল, লবণ, কয়লা, দিয়াশলাই ইত্যাদি কেনাবেচা হতো ওইসব দোকান ২৪ ঘণ্টার মধ্যে খোলার নির্দেশ দেয়া হয়। একই আদেশ দেয়া হয় খাদ্যগুদাম ও চালকলগুলোর ক্ষেত্রে। ঘোষিত সময় পার হলে অভিযান চালানো হবে, সেটাও হয়। সরকারের পক্ষ থেকে শুরু হয় খাদ্য মজুদের পরিমাণ তালিকাভুক্ত করা। খাদ্যশস্য নিয়ন্ত্রণের আদেশে কালোবাজারি বা প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাদ্যশস্য যারা মজুদ করে রেখেছিল তা বাজেয়াপ্ত করা হয়। সরকারের অনুমতি ছাড়া কলকাতা থেকে অন্য যেকোনো স্থানে খাদ্য সরবরাহ নিষিদ্ধ করা হয়। রেল ও স্টিমারে বেসরকারি খাদ্যের চালান বন্ধ করে দেয়া হয়।

১৯৪৩ সালে খাদ্য মজুদ সংক্রান্ত আইন আরো নির্দিষ্ট করে সরকারি অধিগ্রহণের ক্ষমতা বাড়ানো হয়। খাদ্যশস্য নিয়ন্ত্রণাদেশের অধীনে লাইসেন্সপ্রাপ্ত ব্যবসায়ী ছাড়া অন্য কোনো ব্যবসায়ী খাদ্য মজুদ করলে তা বাজেয়াপ্ত করার নীতি নেয়া হয়। লাইসেন্সপ্রাপ্ত ব্যবসায়ীরা মজুদ আইনের অধীনে মজুদের সঠিক পরিমাণ ঘোষণা না করলে অথবা ঊর্ধ্বসীমার বেশি মজুদ করলে সেই খাদ্যপণ্য অধিগ্রহণ করা হয় এবং মজুদ খাদ্যপণ্য নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বাজারজাত না করলে তাদের খাদ্যও অধিগ্রহণ করা হয়।

১৯৪৩ সালে বড় বড় শিল্প-কলকারখানার বাইরে যেসব ছোট ছোট বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান ছিল তাদের কর্মচারীদের জন্য কলকাতায় সরকার অনুমোদিত ও সরাবরাহকৃত ব্যক্তি মালিকানায় প্রথম পর্যায়ে ১০০টি নিয়ন্ত্রিত মূল্যের দোকান খোলা হয়। এবং এসব দোকানে সরকারের সংগৃহীত খাদ্য স্বল্পমূল্যে বিক্রি করা শুরু হয়। ১৯৪৩ সালেই অসামরিক ক্ষেত্রে খাদ্য সরবরাহের জন্য গঠন করা হয় Directorate of Civil Supplies, এই পরিষদ বাজার থেকে খাদ্যশস্য কিনে অসামরিক ক্ষেত্রে খাদ্য সরবরাহ করা শুরু করে, যার মধ্যে নিয়ন্ত্রিত মূল্যের দোকানও ছিল।১০

১৯৪৫ সালে চালু করা হয় পাবলিক ডিস্ট্রিভিউশন সিস্টেম (পিডিএস)১১ প্রকল্প। এই প্রকল্পের অধীনে ভারতের খাদ্য উদ্বৃত্ত অঞ্চল থেকে সরকারিভাবে খাদ্য সংগ্রহ করে সব শ্রেণি ও পেশার মানুষের জন্য রেশনিং ব্যবস্থা চালুর চেষ্টা করা হয় গোটা ভারতে।

১৯৪৭-উত্তর কংগ্রেস সরকার দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষাপটে কিছু প্রকল্প গ্রহণ করে যার মধ্যে একটি ছিল খোলাবাজারের ব্যবসায়ীদের জন্য কিছু খাদ্যপণ্য মজুদের ঊর্ধ্বসীমা নির্দিষ্ট করে দেয়া। ১৯৪৩ সালে ব্রিটিশ সরকার এই নিয়মটি চালু করেছিল, যা উপরে উল্লেখ করা হয়েছে। ১৯৫৫ সালে ’৪৩-এর আইন সংশোধন করে চালু করে এসেনশিয়াল কমোডিটিস অ্যাক্ট।১২ এই ইসিএ আইনে খোলাবাজারের ব্যবসায়ীদের জন্য কিছু খাদ্যপণ্য মজুদের ঊর্ধ্বসীমা নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়। ১৯৪৭-উত্তর কংগ্রেস সরকার দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষাপটে গড়ে ওঠা আরেকটি কার্যক্রম গ্রহণ করেছিল। সেটা ছিল পাবলিক ডিস্ট্রিবিউশন প্রকল্প বা সর্বসাধারণের জন্য রেশনিং ব্যবস্থা।

ওপরের যে দুটি আইন ভারত সরকার গ্রহণ করেছিল, তার ফলাফল ছিল ইতিবাচক। যেমন ১৯৪৩ সালের খাদ্যপণ্য মজুদের ঊর্ধ্বসীমা আইন ১৯৫৫ সালে সংশোধন করার ফলে ভারতের রাজ্য সরকারগুলো বাড়তি ক্ষমতা পায়।১৩ তাতে রাজ্য সরকারগুলো অবাধ পণ্য যাতায়াতের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ চালু করে। একই সঙ্গে মজুদের ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বসীমা থাকায় অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল কিন্তু বিশাল একটি দেশে, ব্যবসায়ী-মজুদদাররা অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যপণের মজুদ গড়ে তুলে ব্রিটিশ পরবর্তী ভারতে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করতে পারেনি। এই আইনের সঙ্গে দুর্ভিক্ষ রোধে ১৯৪৫ সালের গণরেশনিং ব্যবস্থা কার্যকর ভূমিকা রেখেছিল। সবুজ বিপ্লবের সময় গণরেশনিং ব্যবস্থার পরিধি আরো বাড়ানো হয়েছিল।

মোদি সরকার আলোচিত ‘অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন’ সংশোধন করে দানাশস্য, ভোজ্যতেল, তেলবীজ, পিঁয়াজ,ডাল, আলুসহ সমস্ত ধরনের খাদ্যপণ্যে মজুদের ঊর্ধ্বসীমার বাণিজ্যিক বিধিনিষেধ তুলে দিয়ে তাকে খোলাবাজারে ছেড়ে দিয়েছে। এক্ষেত্রে বলা হচ্ছে কৃষক এখন তার ইচ্ছামতো যেকোনো জায়গায় বা যে কারো কাছে তার উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে পারবে। তবে যুদ্ধ, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে সরকারি নিয়ন্ত্রণ বলবৎ হবে।১৪

সুমন কল্যাণ ভৌমিক তার এক লেখায় জানাচ্ছেন, ২০০২ সালে বাজপেয়ি সরকার প্রথম একবার অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছিল। এতে ২০০৬-এ এসে ভারতে খাদ্য সংকট দেখা দেয়। গমের বাফার স্টক বা মজুদ কমে যায়। ফলে বাজপেয়ি সরকার আবারো আইনটি চালু করে। ২০০৬-০৭ অর্থবছরে তারা ৫৫ লক্ষ টন গম আমদানি করে। মোদি সরকার প্রথম ক্ষমতায় থাকার সময় ২০১৫ সালে হঠাৎ করে অড়হর ডালের দাম বেড়ে ২০০ টাকা কেজি হয়।১৫ ভারতের নিরামিষভোজী মানুষের সংখ্যাও অনেক। ফলে ডালের দাম বাড়ায় অনেকে সমস্যায় পড়েন। তখন এই পণ্য আইনকে কাজে লাগিয়ে ৭০ হাজার টন ডাল বাজেয়াপ্ত করতে হয়। ফলে নতুন সংশোধিত আইন কার্যকর হলে খাদ্য কেনাবেচা ও মূল্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা চলে যাবে করপোরেট কোম্পানির হাতে। এতে প্রান্তিক ও মধ্যবিত্তরা সংকটে পড়বেন। বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়বে। তাদের সীমিত সঞ্চয়ও প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য কেনায় বের হয়ে যাবে। ফলে মোদির এই আইনকে বিরোধিতা করছেন কৃষক ও প্রান্তিক মানুষ।

অবরোধকারীদের দিল্লির সীমান্তে অস্থায়ী তাবু নির্মাণ করে থাকা

প্রথম সবুজ বিপ্লব ও ‘কৃষিপণ্য লেনদেন ও বাণিজ্য উন্নয়ন’ আইন

উল্লিখিত নতুন এ আইনের কেন্দ্রবিন্দুতে প্রধানভাবে আছে সবুজ বিপ্লব। কারণটা হলো সবুজ বিপ্লবের সঙ্গে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য সম্পর্কিত। সবুজ বিপ্লব প্রকল্প গ্রহণ করার আগে ভারতের পক্ষে দীর্ঘদিন যুক্তরাষ্ট্রের পিএল ৪৮০ কর্মসূচির অধীনে গম আমদানি করে গণবণ্টন ব্যবস্থা বা রেশনিংয়ের মাধ্যমে খাদ্য সরবরাহ করে দুর্ভিক্ষ এড়ানো সম্ভব হয়েছে।১৬ সেসময় ভারত সরকার পিএল ৪৮০ কর্মসূচির আওতায় যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ১৬৬৪ কোটি টাকা দেনা হয়ে যায়। মার্কিন সরকার ওই ঋণ মওকুফ করায় ভারতের পক্ষে তহবিলজনিত মুদ্রাস্ফীতি এড়ানো সম্ভব হয়।১৭

১৯৪৭-উত্তর ভারতে চাইলেই সবুজ বিপ্লবের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা সম্ভব ছিল না। এর কারণ হলো ওই সময় ভারতের কৃষি ব্যবস্থাপনা সবুজ বিপ্লবের অনুকুলে ছিল না। সেসময় গ্রামের সংখ্যা ছিল ৫ লাখ ৮৭ হাজার। ৮০ শতাংশের বেশি মানুষ গ্রামে বাস করতেন। আর মাত্র ১৫০০ গ্রামে (০.২৫ শতাংশ) বিদ্যুতের খুঁটি পৌঁছেছিল। তবে সব গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে বিদ্যুৎ যায়নি। ১৯৫১ সালে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়। ০.৫২ শতাংশ গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছায়। এক দশক পরে বিদ্যুৎ পৌঁছায় ৩.৭০ শতাংশ গ্রামে। এ সময় দিল্লি, কলকাতা, মুম্বাই ও চেন্নাইয়ের মতো কয়েকটি শহর বাদ দিলে অনেক শহরের সব অঞ্চলে বিদ্যুতায়ন হয়নি। গ্রামীণ জনগণের একটা ক্ষুদ্র অংশ রাতে কেরোসিন বাতি ব্যবহার করতে পারতেন। বাদবাকিরা রেড়ির তেল। প্রথম পর্যায়ে কেরোসিন তেল সরবরাহ করত বার্মা অয়েল কোম্পানি। ব্যবসাটি ছিল কোম্পানির একচেটিয়া। তাদের তেলের দামও ছিল বেশি। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে ছিল। পরে স্কটিশ একটি তেল কোম্পানি বাজার থেকে রেড়ির তেল হঠাতে ও বার্মা অয়েল কোম্পানির একচেটিয়া ভাঙতে ভর্তুকি দিয়ে কম দামের নিম্নমানের কেরোসিন সরবরাহ করে বাজার ধরে। ৪৭-উত্তর ভারতে জনগণের বড় অংশের ঘরে কেরসিনের আলো পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র কোনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয়নি। সবুজ বিপ্লবের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে ভারতের গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ পৌঁছেছে এবং বিদ্যুৎ ও ডিজেলনির্ভর সেচ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে।১৮

তখন ভারতে খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়াটি ছিল প্রাকৃতিক আবহাওয়া নির্ভর। সবুজ বিপ্লবের আগে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের বৃষ্টিপাতের তারতম্য, প্রাকৃতিক নিয়মের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গড়ে উঠেছিল নানাধরনের কৃষি ও সেচব্যবস্থা। ওই সময় ফসল নির্বাচন, পানি সংরক্ষণ এবং সেচ ব্যবস্থার নানা কৃৎকৌশল গড়ে উঠেছিল স্থানীয় প্রকৃতি-পরিবেশের সঙ্গে সংগতি রেখে। পশ্চিম ও মধ্য হিমালয়ের মানুষ তাদের স্থানীয় উৎস থেকে গড়ে ১৫ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত খাল কেটে পানি নিয়ে ফসল উৎপাদন করেছেন। এই খালের স্থানীয় নাম ছিল কুহল। মেঘালয়ে ঝোরার পানি কৃষিজমিতে নিয়ে যাওয়া হতো চেরা বাঁশের মাধ্যমে। দক্ষিণ বিহারে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে কৃষিজমিতে নিয়ে যাওয়া হতো খাল কেটে। এ ব্যবস্থাকে বলা হতো আহার-পাইন। কর্ণাটকে চাষের জন্য বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ব্যবস্থার নাম ছিল আরাকেরে। তামিলনাড়ুতে ইরিস। রাজস্থানে পানি ধরে রাখা হতো ঢাকা কুয়োতে। বাংলার কৃষি ছিল প্রধানভাবে নদীকেন্দ্রিক। একইভাবে সবুজ বিপ্লবের আগে ফসল নির্বাচন করা হতো পানির পরিমাণের ওপর। ভারতের কম বৃষ্টিপাতের এলাকায় চাষ হতো জোয়ার,বাজরা,রাই ইত্যাদি। আর শূখা এলাকার মানুষ গবাদিপশু পালন করতেন।১৯ ফলে এ রকম একটা গ্রামীণ সমাজে চাইলেই খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব ছিল না। আবার বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানি করলেও সবার পেট ভরছে না। এর মধ্যে ষাটের দশকে খাদ্য সংকটের কারণে অভ্যন্তরীণভাবে প্রচন্ড চাপ তৈরি হয়। খাদ্য সংকটে বহু অঞ্চলে মিছিল হয়। পুলিশের গুলিতে মানুষ মারা যান। এ অবস্থায় পি এল ৪৮০ কর্মসূচির আওতায় মার্কিন খাদ্য পেতে চাপে পড়তে হয়। এই পরিস্থিতিতে ভারত সরকার সবুজ বিপ্লবের পথ গ্রহণ করে।২০

সবুজ বিপ্লব প্রকল্পের সঙ্গে সম্পর্কিত হলো উচ্চফলনশীল বীজ, রাসায়নিক সার, রাসায়নিক কীটনাশক, সেচের জন্য পাম্প ও ডিজেল অথবা বিদ্যুৎ, যা আবার ৫ লাখ ৮৭ হাজার গ্রামে পৌঁছে দিতে হবে। ভারতীয় দেশীয় পুঁজির আকার তখন খুব ছোট।২১ রাষ্ট্রীয় পুঁজির বিকাশ তখন ওই মাত্রায় ঘটেনি। এই পটভূমিতে সবুজ বিপ্লব কার্যকর করার জন্য ভারতীয় রাষ্ট্র, মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি বা আন্তর্জাতিক পুঁজির একটা জোট গড়ে ওঠে। রাষ্ট্র বহুজাতিক কোম্পানির তেল, উচ্চফলনশীল বীজ, রাসায়নিক সার, রাসায়নিক কীটনাশক কিনে ভর্তুকি দিয়ে কৃষক পর্যায়ে সরবরাহ করেছে। কিন্তু প্রথম পর্যায়ে ভর্তুকি নির্ভর সার, কীটনাশক, বীজ, পাম্প ও ডিজেল কিনে উৎপাদন করতে গেলে যেটুকু পুঁজির দরকার, সেটাও অনেক কৃষকের ছিল না। এই সংকট নিরসনে বিশ্বব্যাংকের ঋণ নেয়া হয়। বিশ্বব্যাংক ভারত সরকারের জন্য ১ হাজার ১৪০ কোটি টাকা ঋণ মঞ্জুর করে। কিন্তু ঋণ পাওয়ার শর্ত হিসেবে ভারতীয় টাকার ৩৭.৫ শতাংশ অবমূল্যায়ন করতে হয়।২২ বিশ্বব্যাংকের এই ঋণের ওপর ভিত্তি করে ধনী ও মাঝারি চাষিদের জন্য ব্যাংকঋণ ও সমবায় ঋণের ব্যবস্থা করে সরকার। পরে ১৯৭৩ সালে ইন্দিরা গান্ধী ব্যাংক জাতীয়করণ করে স্বল্প সুদে চাষিদের ঋণ দেয়। এসব কিছু মিলিয়ে ধান-গম ইত্যাদি উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এই পর্ব আরেকটি সংকট হাজির হয়।

সংকটটি ছিল এই প্রকল্পের আওতায় উৎপাদিত কৃষিপণ্যের ন্যূনতম মূল্য পাওয়া না পাওয়া নিয়ে। কারণ সবুজ বিপ্লবের সমস্ত উপকরণ কিনতে হয় বাজার থেকে। ফলে উৎপাদন খরচের বাড়তি মূল্য না পেলে কৃষিতে আবার পুঁজি বিনিয়োগ করা সম্ভব হবে না। ভালোভাবে সংসারও চলবে না। এ অবস্থায় খোদ রাষ্ট্রকে ধান-গমসহ কিছু ফসলের ন্যূনতম মূল্যের গ্যারান্টি দিতে হয়। ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ করা হয় উৎপাদন খরচের ওপর ৫০ শতাংশ লাভ ধরে এবং ১৯৬৪ সালে গঠন করা হয় ফুড করপোরেশন অব ইন্ডিয়া (এফসিআই)। এই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানটি নির্ধারিত মূল্য বেঁধে দেয়া ফসল কিনেছে। ওই ফসল ১৯৪৫ সাল বা ব্রিটিশ আমলে গড়ে ওঠা পাবলিক ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেমের (পিডিএস) মাধ্যমে সবার জন্য বা গণরেশনিং প্রকল্পে বণ্টন করেছে। ১৯৪৭-উত্তর ভারতে বা সবুজ বিপ্লবের আগে আলোচিত গণরেশনিং ব্যবস্থাটি সচল রাখা হয়েছিল পিএল ৪৮০ চুক্তির অধীনে, যে খাদ্য ভারত পেত তা গণরেশনিং-এ বণ্টন করা হতো। সবুজ বিপ্লবের এক পর্যায়ে এসে পি এল ৪৮০ খাদ্য আর প্রয়োজন হয়নি।২৩ এফসিআই কেনা খাদ্য পিডিএস মাধ্যমে বণ্টন করার প্রক্রিয়ার সারা দেশে কয়েক লাখ ডিলার গড়ে তোলা হয়, যারা নাগরিকদের ঘর পর্যন্ত খাদ্য পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব নিয়েছে। ১৯৬৪ সালের পর গণবণ্টন ব্যবস্থায় চাল, গম, আটা, ডাল, চিনি, রান্নার তেল ও কেরোসিন দেয়া হতো এবং রেশনিংয়ের ক্ষেত্রে স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য ভর্তুকির ব্যবস্থাও ছিল। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ভারতে ফুড করপোরেশন ও গণবণ্টন ব্যবস্থাটি পরস্পরের পরিপূরক হয়ে ওঠে।

১৯৬৪ সালে যখন ফুড করপোরেশন অব ইন্ডিয়া (এফসিআই) গঠন করা হয় তখন তার সঙ্গে এগ্রিকালচার প্রোডিউস মার্কেটিং রেগুলেশন অ্যাক্ট চালু করা হয়। এগ্রিকালচার প্রোডাক্ট মার্কেট কমিটির (এপিএমসি) আইনের আওতায় বিভিন্ন রাজ্যে গড়ে ওঠে রাজ্য সরকারের নিয়ন্ত্রিত আড়ত বা মান্ডি। রাজ্য সরকারের এসব আড়তে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের কৃষিপণ্য কেনাবেচা করতে পারতেন লাইসেন্সপ্রাপ্ত এজেন্টরা। গোটা ভারতে এই ধরনের বড় আড়তের সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৪৭৭টি। তার সাথে যুক্ত সাব মার্কেট ছিল আরো ৪ হাজার ৮৮৩টি। আবার এই দুই ধরনের আড়তে যে পণ্য ক্রয়-বিক্রয় হতো তা থেকে রাজ্য সরকার ১ থেকে ২ শতাংশ শুল্ক পেত। এটা ছিল রাজ্য সরকারের আয়ের জায়গা। অন্যদিকে এফসিআই ও এপিএমসি সিস্টেমের মাধ্যমে রাজ্য সরকার কৃষির বাজার পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ করত। যাতে চাষিরা কৃষিপণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম সহায়ক মূল্য থেকে বঞ্চিত না হয়। এই বাজার বা মাণ্ডিগুলো গোটা ভারতে খাদ্যশস্য ক্রয়-বিক্রয়ের নোডাল পয়েন্ট হিসেবে ভূমিকা রেখেছে।

সবুজ বিপ্লবের ফলাফল নিয়ে কথা বলতে কিছু পরিসংখ্যানের দিকে নজর দিতে হয়। ১৯৬১ সালে ভারতে খাদ্য উৎপাদন হতো ৬ কোটি ৯ লাখ টন। ২০০৮ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৯ কোটি ২৪ লাখ টন। অর্থাৎ গত পাঁচ দশকে উৎপাদন বেড়ে দাঁড়ায় ৩.১৫ গুণ। একই সময়ে জনসংখ্যা বেড়েছিল ২.৬৪ গুণ। খাদ্যশস্য উৎপাদনের হার ছিল জনসংখ্যা হারের চেয়ে বেশি। এখানে আর একটি কথা বলা দরকার। সবুজ বিপ্লবের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়েই কিন্তু ভারতের গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুতায়ন ঘটে। ১৯৮৯-৯০ অর্থবছরের হিসাবে দেখা যায় দেশে মোট ডিজেল ব্যবহার হয়েছে ২ কোটি ৭ লাখ টন। তার মধ্যে ৩০ শতাংশ বা ৬২ লাখ টন ব্যবহার হয় সেচপাম্পের জন্য। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ডিজেল ব্যবহার কমে দাঁড়ায় ১২ শতাংশ। তার কারণ ছিল কৃষিক্ষেত্রে বিদ্যুতের ব্যবহার বৃদ্ধি। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ভারতের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদের ২০ শতাংশ ব্যবহৃত হতো কৃষিক্ষেত্রে। প্রথম পর্যায়ে কৃষিক্ষেত্রে ডিজেলে ও বিদ্যুতে ভর্তুকি দেয়া হতো। এর বাইরে বাঁধকেন্দ্রিক সেচ ব্যবস্থাও ছিল।২৪

আলোচিত সবুজ বিপ্লব কিন্তু গোটা ভারতে চালু করা যায়নি; হয়েছিল কিছু বাছাই করা অঞ্চলে। শুরুতে যেসব অঞ্চলের অবকাঠামো উন্নত ছিল, সেখানেই চালু করা হয়। তার মধ্যে পাঞ্জাব, হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশ,অন্ধ্রপ্রদেশ ইত্যাদি রাজ্য ছিল অগ্রসর। পাঞ্জাবের ক্ষেত্রে দেখা যায়, যেসব জোতের আকার বড়,সেখানে কৃষি-যন্ত্রপাতি, সেচ, সার ইত্যাদির মতো অ-শ্রম উপকরণের ব্যবহার হয়েছে বেশি। এসব বড় জোতগুলোই ছিল তুলনামূলকভাবে বেশি উৎপাদনশীল। রাষ্ট্রের ভর্তুকির পাশাপাশি বড় কৃষকরা কৃষিতে ব্যাপক পরিমাণে পুঁজি বিনিয়োগ করেন। প্রতি বছর গড় বিনিয়োগ ছিল ২৫ শতাংশ। তারা খাদ্যশস্যের উদ্বৃত্ত ভাণ্ডার গড়ে তোলেন। সরকার নির্ধারিত মূল্যে পণ্য বিক্রি করে তার একটা অংশ আবার কৃষিতে বিনিয়োগ করেছেন। আর একটি অংশ কৃষিকেন্দ্রিক বাণিজ্য বা কৃষির সঙ্গে সম্পর্কিত শিল্প গড়ে তুলেছেন। কিন্তু যারা ছোট জোতের মালিক বা যাদের জমির পরিমাণ ছিল এক থেকে দুই হেক্টরের মধ্যে; যারা ঋণ করে সেচের পানি, বীজ, সার ইত্যাদি উপকরণ খোলাবাজার থেকে কিনেছেন, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ঋণের কারণে অনেকের ভূমি মালিকানা হাতছাড়া হয়ে যায়। ১৯৭০ থেকে ১৯৮০ সালের হিসাবে দেখা যায়, যাদের জমির পরিমাণ ছিল এক হেক্টরের মধ্যে, তাদের ৬৯.৯ শতাংশের জমি বিক্রি হয়ে গিয়েছে। যাদের জমির মালিকানা ছিল দুই হেক্টরের মধ্যে, তাদের মধ্যে ২৩.৩ শতাংশের জোত ঋণের দায়ে হাতছাড়া হয়েছে। অন্যদিকে হরিয়ানার চিত্র ছিল ভিন্ন। হরিয়ানার ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র জোতগুলো ছিল বেশি উৎপাদনশীল। এর কারণ ছিল পারিবারিক শ্রমের ব্যাপক ব্যবহার ও নিবিড় চাষ। ফলে সবুজ বিপ্লবের প্রতিক্রিয়া কিন্তু সারা ভারতে একই রকম ঘটেনি। ভিন্ন ভিন্ন রাজ্যে তার চিত্র বিভিন্ন।২৫

এবার আসা যাক ‘কৃষিপণ্য লেনদেন ও বাণিজ্য উন্নয়ন আইন’ প্রসঙ্গে। ১৯৬৪ সালে সবুজ বিপ্লব প্রকল্পে উৎপাদিত ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের যে গ্যারান্টি দেয়া হয়েছিল, নতুন আইনে সেই গ্যারান্টি থাকছে না। এতে যেসব রাজ্যের চাষিরা উচ্চফলনশীল ফসল আবাদ করে ভারতকে খাদ্যে আত্মনির্ভর করে তুলছেন। আমদানি নির্ভর অবস্থান থেকে একটা স্বনির্ভর অবস্থানে নিয়ে গিয়েছেন। রাষ্ট্র এখন তাদের ঝেড়ে ফেলতে চাচ্ছে। ফলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। একই সঙ্গে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের গ্যারান্টি যা অন্যসব কৃষিপণ্যে বিক্রির ক্ষেত্রে যে প্রভাবক হিসেবে ভূমিকা রাখত, সেটাও থাকবে না। খাদ্য সংগ্রহ ও তদারকির প্রশ্নে রাজ্য সরকারের যে অধিকারগুলো ছিল ধীরে ধীরে রাজ্যের সে ক্ষমতাও অপসারণ করা হবে। মান্ডির বাইরে করপোরেট কোম্পানিগুলো সব ধরনের কৃষিপণ্য বিনা শুল্কে কিনতে পারবে। এক পর্যায়ে প্রতিযোগিতায় বড় পুঁজির কাছে রাজ্যগুলো হেরে যাবে। এছাড়া এ আইনে বলা হয়েছে, খাদ্যশস্যের মূল্য নির্ধারণ হবে প্রতিযোগিতার নিয়মে। ভারতের মতো একটা কৃষিপ্রধান দেশে অধিকাংশ চাষিই যেখানে প্রান্তিক ও মধ্য, সেখানে প্রতিযোগিতার নিয়মে তারা হার মানতে বাধ্য হবেন। পণ্যমূল্য নির্ধারণে তারা আদতেই কোনো ভূমিকা রাখতে পারবেন না।

ভারত সরকার গ্যাটের শর্ত মেনে কৃষিতে বড় ধরনের প্রদক্ষেপ নিয়েছিল ১৯৯২সাল। ওই বছর কাঠামোগত সংস্কার প্রকল্পের আওতায় গণরেশনিং ব্যবস্থার পরিধি ছোট করে ফেলা হয়। রেশনিং ব্যবস্থাটি শুধু বিলো পোভার্টি লাইন বা বিপিএল কার্ড অধিকারীদের জন্য সীমিত করে দেয়। অথচ বিপিএল কার্ডের বাইরে একটা বড় অংশের মানুষ স্বল্পমূল্যের খাদ্যের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে তাদেরই বিলো পোভার্টি লাইন হিসেবে ধরা হয়েছিল। এছাড়া প্রতি অর্থবছরে বীজ, সার,বিদ্যুতের ওপর থেকে ভর্তুকি কমিয়ে দেয়া হয়েছে।২৬

দিল্লিতে মার্চের আগে সমাবেশ

দ্বিতীয় সবুজ বিপ্লব

মনমোহন সিং ২০০৫ সালের ১৮ জুলাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং জর্জ বুশ সরকারের সঙ্গে অনেকগুলো দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষর করেন। তার মধ্যে Indo বা US-India Knowledge Initiative on Agricultue focused on promoting Teaching, Research, Service and Commercial Linkages  চুক্তি বা AKI  চুক্তি ছিল প্রধান। এই একেআই প্রকল্পকে মনমোহন সিং দ্বিতীয় সবুজ বিপ্লব হিসেবে ঘোষণা দেন।এই একেআই চুক্তির মধ্যে ভারতে জিএম শস্য চাষ, কন্ট্রাক্ট ফার্মিং, জিএম বীজের বাজার নির্মাণ, জিএম শস্যের মেধাস্বত্ব আইন, জিএম শস্যকেন্দ্রিক কৃষি গবেষণা, কৃষিপণ্যের বাজার বেসরকারিকরণ, খুচরা ব্যবসায় বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগ ইত্যাদি বিষয়গুলো ছিল।২৭

২০০৬ সালে ভারতের ন্যাশনাল কমিশন ফার্মার (NCF)-এর প্রকাশিত তথ্যে বলা হয়,এখন সরকারের লক্ষ্য হলো ভারতে দ্বিতীয় সবুজ বিপ্লবের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা।২৮ ভারত-মার্কিন সরকারের মধ্যে যখন এই চুক্তি স্বাক্ষর হয়, তখন দুই দেশের করপোরেট সিইও নিয়ে গঠন করা হয় ইন্দো-মার্কিন সিইও ফোরাম। ফোরামে ভারতের পক্ষে নেতৃত্বে ছিলেন রতন টাটা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি ছিলেন উইলিয়াম হ্যারিসন। এই ফোরাম দাবি করে, দ্বিতীয় সবুজ বিপ্লব সফল করার জন্য ভারতের Agriculture Produce Market Committeee Regulation সংশোধন করা দরকার। সিইও ফোরাম ভারতের উন্নয়নে ২৬টি কমিটি গঠন করে। ২০০৬ সাল-পরবর্তী ভারতে কোথায়, কোন অংশে, কী ধরনের উন্নয়ন করতে হবে তার গাইডলাইন তৈরি করে।

ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যখন একেআই চুক্তি স্বাক্ষর হয় তখন এই চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন যৌথ বোর্ড গঠন করা হয়েছিল। যৌথ বোর্ড মার্কিন সরকারের মূল প্রতিনিধিত্বকারী সংস্থা ছিল পৃথিবীর এক নম্বর খুচরা পণ্যের কারবারি ওয়ালমার্ট, সবচেয়ে বড় খাদ্য ব্যবসায়ী ড্যানিয়েল মিডল্যান্ড এবং রাসায়নিক পদার্থ, বীজ ও জীব প্রযুক্তি গবেষণা নিয়ন্ত্রণকারী একচেটিয়া সংস্থা মনসান্টো। চুক্তি অনুযায়ী এসব কোম্পানিকে ভারতের কৃষি উৎপাদনের প্রাথমিক স্তর থেকে বণ্টন পর্যন্ত সামগ্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে অর্ন্তভুক্ত করা হয়। এসব কোম্পানির বিভিন্ন প্রকল্পের পার্টনার হিসেবে ছিল ভারতের টাটা, আম্বানি, মিত্তাল।২৯

এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, রাষ্ট্র হিসেবে জিএম পদ্ধতিতে ফসল উৎপাদনে এগিয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৯০-এর দশকের গোড়ায় প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ সিনিয়র তার দেশে জিএম ফসল উৎপাদনের ছাড়পত্র দেন। এরপর সেখানে  বেশ কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানি জিএম ফসল উৎপাদন শুরু করে। এখন দেশটিতে জিএম ভুট্টা, তুলা, সয়াবিনের চাষ হচ্ছে। এসব ফসল উৎপাদন ও রপ্তানিতে তারা এগিয়ে আছে।৩০

ভারতের কৃষিতে বায়োটেকনোলজি বা জীবপ্রযুক্তি প্রয়োগের ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে, প্রথম সবুজ বিপ্লব সব রাজ্যে সমানভাবে কার্যকর করা যায়নি। ভারতের সব অঞ্চলে সমানভাবে উন্নততর কৃষি প্রযুক্তি প্রবেশ করেনি। দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে হলে দ্বিতীয় সবুজ বিপ্লব ছাড়া অন্য কোনো উপায় সামনে নেই। জিএম পদ্ধতিতে উদ্ভাবিত ফসলের জাত ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে খাদ্য উৎপাদন বাড়াবে।৩১ এই যুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বহুজাতিক কৃষি বায়োটেকনোলজি সংস্থা মনসান্টোর সঙ্গে ভারতের মহারাষ্ট্র হাইব্রিড বীজ কোম্পানি যৌথ উদ্যোগে মাহিকো-মনসান্টো বায়োটেক প্রতিষ্ঠা করে। ভারতের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাপ্রুভাল কমিটি (জিইএসি) ২০০৯ সালের অক্টোবরে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বিটি বেগুন চাষের অনুমতি দেয়। ভারত সরকারের পরিবেশমন্ত্রী জনগণের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। কোনো কোনো পক্ষ আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষা সাপেক্ষে বিটি বেগুন চাষ অনুমোদন দেয়ার কথা বলে। আবার অনেকেই বিরোধিতা করে। পশ্চিম বাংলাসহ আটটি রাজ্য সরকার ছিল বিটি বেগুন চাষবিরোধী। জিইএসি কর্তৃক অনুমোদনের বিপক্ষে সুপ্রিম কোর্ট অন্তর্বর্তীকালীন ইনজাংশন জারি করে। এক পর্যায়ে এই প্রযুক্তি সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়। তার পরও ভারত সরকার নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিয়ে জিএম শস্যের মধ্যে তুলা ও ভুট্টা উৎপাদনে আগ্রহী। এর ধারাবাহিকতায় ২০১২ সালে বিটি তুলা চাষের অনুমোদন দেয়া হয়। প্রথম ক’বছর ভালো উৎপাদন হলেও পরে বিপর্যয় ঘটে। অনেকে চাষি ঋণের দায়ে আত্মহত্যা করেন।৩২ এর পরও ভারত জিএম ফসল চাষে গুরুত্ব দিচ্ছে ভিন্ন কারণে। বলা হচ্ছে জিন ভাণ্ডারের দিক থেকে ভারত প্রকৃতিগতভাবে সমৃদ্ধশালী দেশ। প্রথম সবুজ বিপ্লব বা HYV-র ফসল চাষের সময় ভারতীয় বিজ্ঞানী ও কৃষকরা অনেক দক্ষতা দেখিয়েছিলেন। তারা সবুজ বিপ্লবের প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে ৩৫০০ উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন করেন। বিভিন্ন পরিবেশ উপযোগী বীজের উন্নয়নও ঘটান, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও সম্ভব হয়নি।৩৩ ভারত সরকার এখানে জিনবৈচিত্র্য ও পূর্বাভিজ্ঞতার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। কিন্তু জিএম ফসল উৎপাদনে যে পরিমাণ পুঁজি বিনিয়োগ করতে হয়, তা ভারতের নিম্ন আয়ের প্রান্তিক চাষি ও মাঝারি চাষিদের নেই। ফলে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে চুক্তি চাষের ওপর গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।

জিএম ফসল চাষের প্রথম পরীক্ষাগার ছিল আর্জেন্টিনা। জিএম ফসল চাষের ফলে নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝিতে দেশটির চিরাচরিত কৃষি ব্যবস্থা একদম বদলে যায়। দুই-তিনটি ফসল বা মনোকালচার চাষে জোর দেয়া হয়। তাছাড়া আর্জেটিনা জিএম বীজ ও নতুন ধরনের কীটনাশক পরীক্ষার জন্য মনসান্টো, ডাউ কেমিক্যাল, ডু-প্লট মতো বহুজাতিক কোম্পানির ল্যাবরেটরি করার ছাড়পত্র দেয়। ফলে ওই দেশের মানুষ তাদের অজান্তে যুক্তরাষ্ট্রের জিএম বীজ কোম্পানির পরীক্ষাগারের গিনিপিগ হয়ে পড়েন। ঢালাও সংস্কার কর্মসূচি এবং মনোকালচার ফসল উৎপাদনের কারণে দেশটি এক পর্যায়ে অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে। মুদ্রার মূল্যমানের পতন ঘটে। রপ্তানিনির্ভর কৃষির কারণে কৃষকরা দেউলিয়া হয়ে যান। জমির দাম চলতি বাজার মূল্যের চেয়ে নিচে নেমে যায়। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো পানির দরে জমি কিনে নেয়। ফলে এককালের উৎপাদক চাষিরা ভূমিহীন পরিণত হন। এই প্রক্রিয়ায় জিএম বীজ কোম্পানিগুলো এককালের উৎপাদক কৃষকদের চুক্তিভিত্তিক শ্রমিকে পরিণত করে। ওই একই সময় বা ১৯৯৫ সালে মনসান্টো ওই দেশে ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে রাউন্ড আপরেডি সয়াবিন বীজের চাষ শুরু করে। এতে এদিকে যেমন আগাছা মারা যায়, তেমনি বহু কৃষিজীবী শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েন এবং মনোকালচার হিসেবে দুই-তিনটি বাণিজ্যমুখী ফসল উৎপাদনে গুরুত্ব দেয়ায় পর জনগণের প্রয়োজনীয় খাদ্য বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়।৩৪

২৬ জানুয়ারি ট্রাক্টর মিছিল

চুক্তি চাষ, ঋণের ফাঁস ও আত্মহত্যা

মোদি সরকার যে তিনটি কৃষি আইন করেছে, তার মধ্যে The Farmers (Empowerment and Protection) Agreement of Price Assurance and Farm Service হলো আরেকটি। ২০০৫ সালের ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবসে আইনটি করা হয়। তবে ২০০০ সাল থেকে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ক্ষুদ্র পরিসরে চুক্তি চাষ শুরু হয়েছিল। এখন তার পরিধি বাড়ানো হচ্ছে। ভারতে কৃষি আইন করার এক্তিয়ার প্রধানভাবে রাজ্য সরকারের। ফলে চুক্তি চাষের ক্ষেত্রে রাজ্যে রাজ্যে কিছু পার্থক্য আছে। আছে আইনগত কিছু জটিলতা। কেন্দ্রীয়ভাবে আইন তৈরি করে পূর্বের অসংগতিগুলো দূর করা হয়েছে। যাতে কৃষিতে পুঁজি ও প্রযুক্তি বিনিয়োগের রাস্তা আরো সহজ হয়।

চুক্তি চাষ মডেলের উৎপত্তি

এ প্রসঙ্গে মূল আলোচনা শুরুর আগে পশ্চিমবঙ্গের গবেষক অভি দত্ত মজুমদারের একটি তথ্য উল্লেখ করা দরকার। তিনি তার একটি লেখায় উল্লেখ করেছেন যে, ভারত সরকার চুক্তি চাষের যে মডেল গ্রহণ করেছে তা দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান বিজনেস স্কুল।৩৫ সেই মডেল অনুসরণ করে চুক্তি চাষের পরিধি বাড়ানো হচ্ছে। একই সঙ্গে ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একেআই চুক্তি বা দ্বিতীয় সবুজ বিপ্লবের বিষয়টি মনে রাখা দরকার। কারণ ২০০২ সালে ক্ষুদ্র পরিসরে চুক্তি চাষ শুরু হলেও তা এখন দ্বিতীয় সবুজ বিপ্লবের সঙ্গে যুক্ত।

চুক্তি চাষ সম্পর্কে বলা হচ্ছে, উৎপাদক কৃষক একটি পক্ষ। ক্রেতা করপোরেট সংস্থা আরেকটি পক্ষ। এ দুই পক্ষ ফসল উৎপাদনে চুক্তিতে আবদ্ধ হবেন। চুক্তিপত্রে ফসলের দাম বা কীভাবে ফসলের মূল্য পরিশোধ করা হবে তা উল্লেখ থাকবে। তাছাড়া ফসলের গুণগত মান, ফসল সরবরাহের নির্দিষ্ট পরিমাণ-সময় উল্লেখ থাকবে। চুক্তি চাষে ফসলের দাম নির্ধারিত করা হবে আবাদের আগেই। সেই শর্ত মেনে চাষি ফসল উৎপাদন ও সরবরাহ করবেন। চুক্তির সময়সীমা হবে ১ থেকে ৫ বছর। বিষয়টি দেখভাল করবে রাজ্যস্তরের রেগুলেটরি বোর্ড। চুক্তিভঙ্গের আইন প্রতিবিধান করার জন্য এই বোর্ড একটি আইনি কাঠামো তৈরি করবে। অনেকে বলছেন, চুক্তি চাষে জমি লিজ দেয়ার ক্ষেত্রে জয়েন্ট স্টক কোম্পানির মডেল গ্রহণ করা হয়েছে। কৃষক কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার পর শেয়ারের মাধ্যমে তার জমির মালিকানা বজায় রাখতে পারবেন। উৎপাদিত ফসল কোম্পানি ক্রয় করায় কৃষককে উৎপাদিত ফসলের বাজার মূল্য নিয়ে ঝামেলা পোহাতে হবে না। এ পদ্ধতিতে উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। কর্মসংস্থানও বাড়বে। কারণ চুক্তিভিত্তিক চাষে কৃষিতে পুঁজি বিনিয়োগ বাড়বে। নতুন প্রযুক্তি ও উন্নত বীজের ব্যবহার হবে। অব্যবহৃত জমি চাষের আওতায় আসবে।

চুক্তি চাষের ভুক্তভোগী কারা?

খুব সংক্ষেপে আমরা যদি বিষয়টি পর্যালোচনা করি, তাহলে মূল বিষয়গুলো হলো, উৎপাদনের দায়িত্ব কৃষকের ঘাড়ে চাপিয়ে চাষের জন্য যাবতীয় উপকরণ সরবরাহ, ফসল নির্বাচন, বাণিজ্যিকীকরণ ইত্যাদি প্রশ্নে কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ হবে একচেটিয়া। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে কৃষিক্ষেত্রে বৃহৎ বীজ কোম্পানিগুলোর বীজ বাজারের প্রসার ঘটবে। বীজ বাজারে কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হবে। উৎপাদিত ফসলের খুচরা ও পাইকারি বাজারের ওপর একচেটিয়া পুঁজির দখল কায়েম হবে। কৃষির উন্নয়নে কৃষির সঙ্গে সম্পর্কিত শিক্ষা, কৃষি গবেষণা, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ইত্যাদি সমস্ত কিছুর নিয়ন্ত্রণ থাকবে কোম্পানির হাতে। অন্যদিকে কোন জমিতে কোন ধরনের ফসল চাষ হবে, সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ, উৎপাদিত পণ্যের কতটা রপ্তানি হবে, কতটা দেশের জনগণের খাদ্যসংস্থানের জন্য ব্যবহৃত হবে ইত্যাদি পরিকল্পনা ও নিয়ন্ত্রণ থাকবে করপোরেট সংস্থাগুলোর হাতে। ফলে চুক্তি চাষ শুধু ফসল আবাদেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। শেষ পর্যন্ত তা ভারতের গোটা কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থাকেই নিয়ন্ত্রণ করবে।

উৎপাদনের দায়িত্ব কৃষকের ঘাড়ে চাপিয়ে চাষের জন্য যাবতীয় উপকরণ সরবরাহ, ফসল নির্বাচন, বাণিজ্যিকীকরণ ইত্যাদি প্রশ্নে কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ হবে একচেটিয়া। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে কৃষিক্ষেত্রে বৃহৎ বীজ কোম্পানিগুলোর বীজ বাজারের প্রসার ঘটবে। বীজ বাজারে কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হবে। উৎপাদিত ফসলের খুচরা ও পাইকারি বাজারের ওপর একচেটিয়া পুঁজির দখল কায়েম হবে।

বলা হচ্ছে, কৃষকের দায়িত্ব হলো কোম্পানির নীতি মেনে ফসল উৎপাদন করে যাওয়া। কিন্তু যদি কৃষক ব্যর্থ হন, তাহলে কোম্পানি আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারবে। যেমন ২০১৯ সালে পেপসিকো কোম্পানি চুক্তিভঙ্গের অপরাধে গুজরাটের কয়েকজন কৃষকের বিরুদ্ধে আদালতে ৫ কোটি টাকার ক্ষতিপূররণের মামলা করে। এর প্রতিবাদে ভারতের কৃষক সংগঠনগুলো দেশজুড়ে প্রতিবাদ অন্দোলন গড়ে তোলে। চাপে পড়ে মামলাটি কোম্পানি প্রত্যাহার করে নেয়।৩৬ কিন্তু প্রতিটি চুক্তিভঙ্গের মামলায় কৃষক সংগঠনগুলো যে মাঠে নামবে, তা আশা করার কোনো কারণ নেই। আর আইনগত লড়াইয়ে করপোরেট কোম্পানির বিরুদ্ধে একজন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি কতটা সফল হবে, তা অনুমান করা যায়। এই আইনগত ঝামেলায় কৃষক তার জমি হারাবেন তা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।

ভারতে চুক্তি চাষের পরিস্থিতি

চুক্তিভিত্তিক চাষের নানান আইনি কাঠামো সামনে রেখে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বেশ কয়েক বছর থেকে চাষ বাড়ছে। যেমন মহারাষ্ট্রে এসএইচ কেলজার গ্রুপ, জয়েন ইরিগেশন, মহেন্দ্র শুভলাভ, টাটা কেমিক্যাল, গোয়ারধন ডেইরি, গার্গি এগ্রিবায়োটেক ম্যারিকো, পেপসি কো, বারুন ফুডস, মেরিকো সানফ্লাওয়ার এবং রালিস কোম্পানি সঙ্গে চাষিদের চুক্তিভিত্তিক চাষ হচ্ছে। পাঞ্জাবে পেপসিকো, নিজরেজ এগ্রোফুড, নেসলের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন চাষিরা। মধ্যপ্রদেশে কারগ্রিল ইন্ডিয়া, এইচএলএল, আইসিআই, আইবিডি, মেরিকো, রালিসের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে চাষিরা আবাদ করছেন। গুজরাটে পেপসিকো রালিসের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন চাষিরা। রাজস্থানে এসএবি, মিলার, বিকাশ, ডাব্লিউ এসপিলি,পেপসিকোর চুক্তিবদ্ধ আবাদ হচ্ছে। তামিলনাড়ুতে রাসিল,কর্ণাটকে মেরিকো,পেপসিকো চুক্তিবদ্ধ চাষ করাচ্ছে। হরিয়ানায় রালিস, ছত্তিশগড়ে মেরিকো, পশ্চিমবঙ্গে পেপসিকোর সঙ্গে চাষিরা চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, তালিকাটি অসম্পূর্ণ। আলোচনা এগিয়ে নেয়ার জন্য উদাহরণ হিসেবে কোম্পানি নাম উল্লেখ করতে হলো। এসব কোম্পানি মূলত সয়াবিন তেল, তুলা, গম, বাসমতি চাল, ফল, আলু ও সবজি উৎপাদনে পুঁজি বিনিয়োগ করেছে।৩৭

এখন প্রশ্ন হলো ভারতের কোন কোন রাজ্যে ঋণের দায়ে কৃষকদের আত্মহত্যার ঘটনা বেশি? ওই তালিকায় প্রথমেই যে রাজ্যের নাম রয়েছে সেটা হলো মহারাষ্ট্র। এরপর নাম আছে গুজরাট, ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ, হরিয়ানা, রাজস্থান, তামিলনাড়ু ও কেরালা। উপরের তালিকায় মহারাষ্ট্রে কিন্তু সবচেয়ে বেশি করপোরেট কোম্পানি চুক্তিভিত্তিক ফার্ম গড়ে তুলেছে, কৃষিতে বেশি পুঁজি ও প্রযুক্তি বিনিয়োগ করেছে। কিন্তু সেই মহারাষ্ট্রেই ঋণের দায়ে চাষিদের আত্মহত্যা বেশি ঘটছে। কৃষিতে পুঁজি-প্রযুক্তি বিনিয়োগ হলেই মানুষের সচ্ছলতা বাড়বে, এটা ভাবার কোনো কারণ নেই। চাষিরা চুক্তি চাষেও নানা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ঋণগ্রস্ত হতে পারেন। তার উদাহরণ উল্লেখিত রাজ্যগুলো।

চাষিরা চুক্তি চাষে বেশি করে ঝুঁকছেন কেন?

পশ্চিমবঙ্গের গবেষক জয়ন্ত সিংহ তাঁর এক প্রবন্ধে দেখান যে, ভারতে এখন কোনো কোনো বছরে খাদ্য হিসেবে গম আমদানি করতে হয়। কিন্তু কিছুদিন আগেও ভারত থেকে গম রপ্তানি করা হতো। ১৯৮৮-৮৯ অর্থবছরে ভারত ১২ লাখ ৭৮ হাজার টন গম রপ্তানি করে। ১৯৮৯-৯০তে প্রাকৃতিক দুর্যোগে গম উৎপাদন কম হলেও রপ্তানি করা হয় ১১ হাজার টন। তাছাড়া ১৯৯৩-৯৪তে ১৩ লাখ টন, ১৯৯৭-৯৮তে ১০ লাখ টন গম রপ্তানি করে। তবে ২০০০ সালে ৭ কোটি টন গম উৎপাদন হয়, এটা ছিল সর্বোচ্চ। ২০০৩ সালে উৎপাদন কমে দাঁড়ায় ৬ কোটি ৫১ লাখ টন। তার পরের বছর থেকে ধারাবাহিকভাবে ১১ লাখ টন করে গম উৎপাদন কমেছে। কৃষিমন্ত্রী শরদ পাওয়ারের আমল থেকে ভারতে গম উৎপাদন কমছে, কিন্তু আমদানি বাড়ছে। তিনি কৃষিমন্ত্রী হওয়ার পর একই বছরে দুই দফায় অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রায় ১০ লাখ টন গম আমদানি করা হয়। গম রপ্তানি হ্রাস পাওয়া ও বিদেশ থেকে আমদানির প্রধান কারণ ছিল সরকারি প্রতিষ্ঠান এফসিআই, যারা খাদ্যের সহায়ক মূল্য নির্ধারণ করে। ওই প্রতিষ্ঠানটি গমের সহায়ক মূল্য কমিয়ে দেয়। প্রতি কুইন্টালের দাম নির্ধারণ করে ৬৪০ টাকা, যা ছিল উৎপাদন খরচের চেয়ে কম। গমের সংগ্রহ মূল্য হওয়া দরকার ছিল প্রতি কুইন্টাল কমপক্ষে ১০০০ টাকা। কিন্তু সরকারের পলিসি ছিল চাষিদের গম চাষে নিরুৎসাহিত করা। ফলে পাঞ্জাব ও হরিয়ানার অভিজ্ঞ চাষিরা নিজেদের ক্ষেতে নিজ উদ্যোগে গম উৎপাদন ছেড়ে দিয়ে পেপসি, আইটি, মাহেন্দ্র ইত্যাদি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি চাষে আবদ্ধ হন। গমের বাজার মূল্য কমিয়ে দেয়ায় তারা চাষ ছাড়তে বাধ্য হন। এই চুক্তিবদ্ধ চাষিদের দিয়ে পেপসিকো টম্যাটোসহ অন্য ফল ও সবজি উৎপাদন করাচ্ছে। যার পুরাটাই রপ্তানি হচ্ছে বিদেশে। পাঞ্জাবে পেপসিকোর টম্যাটো কারখানায় প্রতিদিন ৭০০ টন টম্যাটো প্রক্রিয়াকরণ হয়। তাদের এই কারখানাটি এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বড়।৩৯

চুক্তি চাষের পরিধি বৃদ্ধি কেন? গ্যাট চুক্তি, ভর্তুকি হ্রাস

মূলত ১৯৯২ সালে ভারত সরকার গ্যাট চুক্তির অধীনে প্রথম সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করার পর থেকে ধারাবাহিকভাবে কৃষিতে ভর্তুকি কমিয়ে দিচ্ছে। এর সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে করপোরেটদের চুক্তি চাষের পরিধি বাড়ছে। মাঠ পর্যায়ে এই নীতি বাস্তবায়নের জন্য রাসায়নিক সার, কীটনাশক, বিদ্যুৎ, ডিজেল, বীজ ইত্যাদি থেকে ধাপে ধাপে সরকারি ভর্তুকি কমিয়ে আনা হয়েছে। ফলে কৃষি উৎপাদনের ব্যয় বাড়ছে। কিন্তু উৎপাদিত কৃষিপণ্যের দর বাড়ছে না। কৃষকরা ক্রমাগত ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। চাষিদের এই দুরবস্থার সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে বহুজাতিক কোম্পানি। চাষিদের চুক্তিবদ্ধ চাষে প্রলুব্ধ করছে। কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে সস্তাশ্রম যুক্ত করে কয়েক’শ কোম্পানির সঙ্গে পাঞ্জাব, হরিয়ানা, কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশসহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে চুক্তিবদ্ধ চাষে নেমেছে চাষিরা। এসব জমিতে উৎপাদন হচ্ছে সবজি, টম্যাটো; জিনগত পরিবর্তিত বিভিন্ন বীজের ফসল চুক্তিবদ্ধ কৃষক নিজের জমিতেই উৎপাদন করছে। কিন্তু উৎপাদিত পণ্যের দাম, গুণগত মান এবং পরিমাণ আগেই নির্ধারিত। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী কোম্পানি কৃষককে যাবতীয় কৃষিসামগ্রী, পরামর্শ ও আর্থিক ঋণ দিচ্ছে। ফসল উঠলে কোটা স্লিপের মাধ্যমে চাষিদের কাছ থেকে উৎপাদিত ফসল সংগ্রহ করছে। সুদসহ ঋণের টাকা, ধারে জোগান দেয়া কৃষিসামগ্রী ও পরিষেবা হিসেবে পরামর্শ বাবদ টাকা কেটে নিয়ে চাষিকে এককালীন বা কয়েক কিস্তিতে তার প্রাপ্য মেটাচ্ছে। চুক্তি চাষে উৎপাদিত ফসল রপ্তানি করা হচ্ছে। এই প্রক্রিয়ার চাষাবাদে চাষি লাভবান হচ্ছে, সে দাবি করা যাচ্ছে না। কারণ ১৯৯৫ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত সরকারিভাবে স্বীকার করা হয়েছে, ঋণগ্রস্ত চাষিদের মধ্যে ২,৯০,৭৪০ জন আত্মহত্যা করেছেন। ঋণের উৎস হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিক বা অপ্রাতিষ্ঠানিক যা-ই হোক না কেন চাষিরা দুটোতেই বাঁধা পড়ে আছেন। কিন্তু অপ্রাতিষ্ঠানিক উৎস থেকে ঋণ গ্রহণের দায়ভার থেকে প্রধানত চাষিরা আত্মহত্যা করেছেন। ২০১১ সালের পরও ২০১২, ২০১৩ ও ২০১৪ সালে যথাক্রমে ১৩৭৫৪, ১১৭৭২ ও ৫৬৫০ জন চাষি আত্মহত্যা করেছেন।

তেলেঙ্গানার নারীদের ২৬ জানুয়ারিতে দিল্লির ট্রক্টর মিছিলে অংশগ্রহণ

কারা বেশি আত্মহত্যা করছেন?

পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতিবিদ প্রণব দে ২০১৫ সালে তার গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, যাদের কৃষিজমির পরিমাণ ১ হেক্টর বা তার চেয়ে কম, তাদের ধরা হয় প্রান্তিক কৃষক হিসেবে। যাদের জমি ২ হেক্টরের কম, তারা ক্ষুদ্র কৃষক। ১০ হেক্টর পর্যন্ত যাদের জমি রয়েছে তারা মধ্য কৃষক। তবে প্রান্তিক কৃষকদের মধ্যে আবার ৭৫ শতাংশই হচ্ছেন নিম্নপ্রান্তিক, তাদের গড় জমির পরিমাণ ০.৪০ হেক্টর। জমির এই হিসাবের মধ্যে তাদের বসতবাড়িও রয়েছে। এর বাইরে রয়েছে ভূমিহীন কৃষক। সরকারিভাবে ভূমিহীন কৃষকের দুটি স্তর আছে। যাদের কোনো জমি নেই তারা একটি স্তর, আর যাদের জমির পরিমাণ ০.০০২ হেক্টর তারা আরেকটি স্তর। এভাবে মধ্য কৃষকের মধ্যে যারা ২ থেকে ৪ হেক্টর জমির মালিক তারা হলেন আধা-মধ্য কৃষক। মধ্য কৃষকের এই বর্গের মধ্যে আধা-মধ্যরা দলে ভারি, প্রায় ৬৭ শতাংশ। তিনি ২০১৫ সালের জাতীয় সমীক্ষার তথ্য উল্লেখ করে দেখান, মধ্য ও প্রান্তিক পরিবারের ৪৬ শতাংশই ঋণগ্রস্ত। পরিবারপ্রতি গড় ঋণের পরিমাণ ১,৫৩,৬৪০ টাকা। এর মধ্যে ৬০ শতাংশের ঋণের উৎস ছিল ব্যাংক, সমবায়, সরকার বা প্রাতিষ্ঠানিক। বাদবাকি ৪০ শতাংশের ঋণের উৎস ছিল ভূস্বামী, মহাজন ও সুদের কারবারিরা।এদের মধ্যে যারা নিম্ন প্রান্তিক তারা ব্যাংক, সমবায় বা সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে পৌঁছাতে পারেন না। কৃষি সংকটের কারণে কোনো কোনো সময় সরকার যদি ঋণ মওকুফ ঘোষণা করে সেই সুবিধা পান মুষ্টিমেয় কয়েকজন। কিন্তু যারা অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণের জালে বাঁধা, তারা এই ফাঁদ থেকে মুক্তি পান না। ফলে ঋণগ্রস্তদের মধ্যে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত থেকে যারা ঋণগ্রহণ করেছেন তাদের অনেকেই তা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হন। এদের মধ্যেই আত্মহত্যার হার বেশি। তিনি আরো দেখান যে, ২০১৫ সালেও প্রান্তিক মানুষদের মধ্যে মহারাষ্ট্রে আত্মহত্যা করেছেন ৪০৪০ জন। সাংখ্যার বিচারে তারপর ক্রামান্বয়ে রয়েছে তেলেঙ্গানায় ১৩৪৭, মধ্যপ্রদেশ ১১৯৮, তামিলনাড়ু ৮৯৫, কেরালা ৮০৭, কর্ণাটক ৭৬৮, ছত্তিশগড় ৭৫৫, অন্ধ্রপ্রদেশ ৬৩২, গুজরাট ৬০০, রাজস্থান ৩৭৩ ও পশ্চিমবঙ্গে ২৩০ জন। এর মধ্যে শেষ দুটি রাজ্য ছাড়া অন্য দুই রাজ্যে কৃষক ও কৃষি মজুরের আত্মহত্যার হার প্রায় সমান। ২০০১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত প্রতি বছর গড় আত্মহত্যার সংখ্যা ১০৪৫। এর মধ্যে বিদর্ভ বা তেলেঙ্গানায় তুলা চাষিদের আত্মহত্যার ঘটনা বেশি। মধ্যপ্রদেশে আত্মহত্যা করেছেন সয়াবিন চাষিরা, পশ্চিমবঙ্গে আলু চাষিরা।৪১ অর্থাৎ প্রণব দে যে তথ্য উল্লেখ করছেন, তাতে দেখা যায়, যে রাজ্যে যে ফসল উৎপাদনে পুঁজি বিনিয়োগ হয়েছে বেশি, সে রাজ্যে সেই ফসল উৎপাদনের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনা বেশি। আবার যে রাজ্যে কৃষিতে যত বেশি যান্ত্রিকীকরণ হচ্ছে, সেখানে মজুরি শ্রমিকরা যান্ত্রিকীকরণের কারণে বেকার হচ্ছেন বেশি। এই বেকার শ্রমিকরা কৃষিতে উদ্বাস্তু মানুষে পরিণত হচ্ছেন। তারা ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের শহরাঞ্চলে অপ্রাতিষ্ঠানিক শিল্পের সস্তা মজুর বাহিনীতে পরিণত হচ্ছেন।

যে রাজ্যে যে ফসল উৎপাদনে পুঁজি বিনিয়োগ হয়েছে বেশি, সে রাজ্যে সেই ফসল উৎপাদনের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনা বেশি। আবার যে রাজ্যে কৃষিতে যত বেশি যান্ত্রিকীকরণ হচ্ছে, সেখানে মজুরি শ্রমিকরা যান্ত্রিকীকরণের কারণে বেকার হচ্ছেন বেশি। এই বেকার শ্রমিকরা কৃষিতে উদ্বাস্তু মানুষে পরিণত হচ্ছেন। তারা ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের শহরাঞ্চলে অপ্রাতিষ্ঠানিক শিল্পের সস্তা মজুর বাহিনীতে পরিণত হচ্ছেন।

পাঞ্জাব কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বাথিন্ডা ও সাঙ্গরুর জেলায় ২০০০ থেকে ২০০৮, এই আট বছর কৃষিখাতে ঋণ নেয়া পরিবারদের ওপর একটি সমীক্ষা করেছিল। তাতে দেখা যায় যে, এ সময় এই দুই জেলায় ঋণের কারণে আত্মহত্যা করেছেন মোট ২৯৯০ জন। তার মধ্যে ১২৮৮ জন কৃষক, ৬৭১ জন কৃষি শ্রমিক এবং ৮৬.৫ শতাংশ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি। বাকি ১৩.৫ শতাংশ মাঝারি ও বড় চাষি। কৃষকদের মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ ২-৮ লাখ টাকা। কৃষি শ্রমিকদের বছরে গড় আয় ছিল ২০,৫৬৫ টাকা। কিন্তু মাথাপিছু গড় ঋণের পরিমাণ ৫৮,৬৯২ টাকা। যেসব কৃষক আত্মহত্যা করেছেন, পরে তাদের পরিবার জমি বিক্রি করে ঋণ পরিশোধের চেষ্টা চালাচ্ছেন।৪২

কোন নীতি ও পরিকল্পনা আত্মহত্যার সঙ্গে সম্পর্কিত?

১৯৯২ সালে কাঠামোগত আর্থিক পুনর্বিন্যাসের ফলাফল নিয়ে উৎসা পট্টনায়েক একটা গবেষণা করেছিলেন। তার ওই প্রবন্ধ থেকে যে তথ্য পাওয়া যায়, তাতে দেখা যায়, কাঠামোগত আর্থিক পুনর্বিন্যাস কর্মসূচির কোন কোন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র দারিদ্র্যের হার আশির দশকের চেয়ে নব্বইয়ের দশকে বাড়িয়েছে। তিনি তাঁর গবেষণায় কয়েকটি তথ্য সামনে এনেছেন।

এর মধ্যে একটি ছিল প্রতি অর্থবছরে গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে যে বরাদ্দ দেয়া হতো তা পর্যায়ক্রমে কমিয়ে আনা, যার ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে কর্মসংস্থান কমে যায়। সরকারিভাবে কাজের বিনিময়ে খাদ্য প্রকল্পে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ না দিয়ে কর্মসংস্থান সংকুচিত করা হয়। এর মধ্য দিয়ে গ্রামীণ মানুষের আয় কমে, চাহিদা কমে। দ্বিতীয়, যেসব রাজ্য সরকার বিশ্বব্যাংক বা এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছিল, ওইসব রাজ্যে বিদ্যুতে ভর্তুকি কমিয়ে ইউনিটপ্রতি তার দাম বাড়নো হয় এবং সেচের পানির দাম বাড়ানো হয়। তৃতীয়, বীজ ও সারের ওপর যতটুকু ভর্তুকি ছিল তা ছেঁটে ফেলা। এসব প্রক্রিয়ার মধ্যে কৃষিতে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের উৎপাদনের জন্য মহাজনদের দিকে ঠেলে দেয়া হয়। একই সঙ্গে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেয়া হয় প্রাতিষ্ঠানিক খাতগুলোকে। চতুর্থ, খাদ্যশস্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র যে মিনিমাম সাপোর্ট দিত তা আর না বাড়ানো। এতে কৃষকদের আয় কমিয়ে তাদের জীবনধারণের প্রয়োজনীয় চাহিদা কমিয়ে দেয়া হয়। পঞ্চম, কাজের বিনিময়ে খাদ্য প্রকল্পে খাদ্য বরাদ্দ কমিয়ে ২ কোটি টনের অতিরিক্ত ৪ কোটি টন সরকারি বাফার স্টক গড়ে তোলে এবং অতি উৎপাদনের তত্ত্ব প্রচার করে। পরে সরকারি ভর্তুকিতে ক্রয় করা বাফার স্টকের ২ কোটি টন খাদ্য করপোরেট কোম্পানি কার্গিলের কাছে পশুখাদ্য হিসেবে বিক্রি করে দেয়া হয়।

এই সামগ্রিক তৎপরতার ফলাফল হিসেবে ১৯৯৩-৯৪ থেকে ২০০৪-০৫ অর্থবছরের মধ্যে দারিদ্র্যের সংখ্যা বেড়ে যায়। ১৯৯৩-৯৪ অর্থবছরে গ্রামীণ মানুষের মধ্যে যারা প্রতিদিন ২৪০০ ক্যালরি খাদ্য পেতেন না তাদের সংখ্যা ছিল ৭৫ শতাংশ। ২০০৪-০৫ অর্থবছরের মধ্যে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৭ শতাংশ। ২২০০ ক্যালরি খাদ্য যারা পান না তাদের সংখ্যা আগে ছিল ৫৯ শতাংশ। পরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭০ শতাংশ। আর যারা ১৮০০ ক্যালরি খাদ্য পেতেন না, তাদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক-চতুর্থাংশ। এখানে উল্লেখ করা দরকার, ভারত সরকার দারিদ্র্যের পরিমাপ করে ক্যালরিতে। উৎসা তার গবেষণায় আরো দেখিয়েছেন, গত ৩০ বছরে দারিদ্র্যের উন্নতি দেখাতে গিয়ে ভারত সরকার ক্যালরি হিসাব কয়েক দফা নিচে নামিয়েছে। এর মধ্যে ২০০৪-০৫ অর্থবছরে দারিদ্র্যের সর্বনিম্ন রেখা ধরা হয়েছিল দৈনিক ১৮২০ ক্যালরি, যা প্রতিদিন প্রয়োজনীয় ক্যালরির চেয়ে প্রায় ৬০০ ক্যালরি কম। ১৯৯৪-০৫ অর্থবছরের মধ্যে দেশটিতে যারা ১৮২০ ক্যালরির নিচে খাদ্য গ্রহণ করতে পারতেন, তাদের হার দাঁড়ায় ৫৭ শতাংশ বা ৬২ কোটি ৭০ লাখ। কৃষিপ্রধান দেশে এই বিশাল জনগোষ্ঠী কোনো না কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে ঋণী হয়ে পড়েছেন। তাদেরই একটি অংশ ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন। একটি অংশ চুক্তি চাষে যুক্ত হচ্ছেন।৪৩

খুচরা ব্যবসায় করপোরেট পুঁজি

মোদি সরকার যে তিনটি নতুন কৃষি আইন তৈরি করেছেন, তার মধ্যে একটি আইন হলো খুচরা ব্যবসায় করপোরট পুঁজি বিনিয়োগ সম্পর্কিত, যা The Farmers’ Produce Trade and Commerce (Promotion and Facilitation) Bill ২০২০ আইনে রয়েছে। উপরে এ বিষয়ে কিছু কথা বলেছি। মূল আলোচনায় ঢোকার আগে দু-একটি প্রাসঙ্গিক বিষয়ে কথা বলা দরকার।

হিলারি ক্লিনটন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার পর ২০০৯ সালের ১৭-২১ জানুয়ারি ভারত সফর করেছিলেন। এই তথ্যটি আমাদের অনেকের মনে নাও থাকতে পারে। তিনি ভারতে এসেছিলেন মূলত মুম্বাই হত্যাকাণ্ডে নিহতদের প্রতি সহমর্মিতা জানাতে। তিনি তাজ হোটেল পরিদর্শন করেন। একই সঙ্গে তিনি টাটা, মিত্তাল, আম্বানিদের সঙ্গে বৈঠক করেন। দিল্লির পুসাতে ভারতের কৃষি গবেষণা কেন্দ্র পরিদর্শন করেন এবং ভারতের কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী শরদ পওয়ারকে সঙ্গে নিয়ে আইটিসির সবুজবাড়ির উদ্বোধন অনুষ্ঠানে যান। হিলারি মুম্বাইয়ের ঘটনায় ভারতে এসে যাদের সঙ্গে মিলিত হলেন বা যেসব প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করেছিলেন, তার মধ্যে একটা যোগসূত্র ছিল। দিল্লির পুসাতে তিনি যে এগ্রিকালচার রিসার্চ সেন্টার পরিদর্শন করেন, প্রতিষ্ঠানটি ষাটের দশকে ভারতের প্রথম সবুজ বিপ্লব কার্যক্রমে নেতৃত্ব দিয়েছিল। আর বর্তমান ভারতে যে জিএম ফসল চাষের গবেষণা চলছে, সেখানেও প্রতিষ্ঠানটির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ভারতে কৃষিপণ্যের খুচরা বাজারে বহু আগে থেকেই ইন্ডিয়ান টোব্যাকো কোম্পানি (আইটিসি) যে ভূমিকা তা হিলারীও এড়াতে পারেননি।৪৪

ভারতের গবেষক ও লেখক সুমন কল্যাণ মৌলিক জানাচ্ছেন, ইন্ডিয়ান টোব্যাকো কোম্পানি (আইটিসি) একটি বহুজাতিক কোম্পানি। তার ৩১.৭ শতাংশের মালিক ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানি (বিএটিসি)। কোম্পানি তামাকজাত সামগ্রী বিক্রয় করে। নব্বইয়ের দশকের শেষে তারা কৃষিক্ষেত্রে প্রবেশ করে। ওই সময় আইটিসি সয়াবিনজাত সামগ্রী সারা পৃথিবীতে বিক্রি করেছে। ২০০০ সালে আইটিসি-চৌপাল ভারতে কৃষকদের কাছ থেকে সয়াবিন কিনতে শুরু করে। তাদের উন্নত প্রযুক্তির ক্রয়-বিক্রয় এবং নগদ পেমেন্ট করার কারণে ভারতের মাণ্ডির থেকে ই-চৌপাল বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ২০০১-০২ অর্থবছরে তারা ৬০ হাজার টন সয়াবিন কিনে বিদেশে সরবরাহ করে। ২০০২-০৩ অর্থবছরে ২ লাখ ১০ হাজার টন। তাদের বাজার সম্প্রসারণের সঙ্গে মান্ডিগুলো বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। একই সঙ্গে সয়াবিন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত অসংখ্য প্রতিষ্ঠান কাঁচামালের সংকটে পড়ে। অন্যদিকে সয়াবিন বাজারে একচেটিয়াকরণ করার পর আর্দ্রতার অজুহাত দেখিয়ে আইটিসি সয়াবিনের দাম কমিয়ে দেয় এবং কিনতে অস্বীকার করে। ফলে অনেক চাষি বিপন্ন হয়ে পড়েন। ঘটনাটি উল্লেখ করলাম এ কারণে যে আইটিসি কিন্তু মাণ্ডির বাইরে খুচরা ব্যবসায় পুঁজি বিনিয়োগ করেছিল। এভাবে ভারতের খুচরা বাজারে পুঁজি বিনিয়োগ নিয়ে দেশ-বিদেশের যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক বহুজাতিক কোম্পানির আগ্রহ রয়েছে।৪৫

ওই বৈঠকে হিলারি ভারতীয় নেতৃবৃন্দকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, ভারতের খুচরা বাজারে যেন তাদের বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর দ্রুত প্রবেশাধিকার পায়। এর বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আরো গুরুত্ব দিয়ে এশীয় অঞ্চলে নেতৃত্ব দেয়ার রাস্তা করে দেবে, বিশেষ করে চীনকে মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে। এই বৈঠকের পর পরই ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ঘোষণা দেন যে, ভারতের খুচরা বাজারে বিদেশি কোম্পানি কেনাবেচা করতে পারবে। বিভিন্ন পণ্যের খুচরা ব্যবসার বিপরীতে ৫১ শতাংশ পর্যন্ত মালিকানা রাখতে পারবে।

২০১১ সালের ১৯-২৮ জুলাই ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সচিবদের মধ্যে একটি কৌশলগত বৈঠক হয় দিল্লিতে। এই বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব হিলারি ক্লিনটন। ওই বৈঠকে হিলারি ভারতীয় নেতৃবৃন্দকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, ভারতের খুচরা বাজারে যেন তাদের বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর দ্রুত প্রবেশাধিকার পায়। এর বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আরো গুরুত্ব দিয়ে এশীয় অঞ্চলে নেতৃত্ব দেয়ার রাস্তা করে দেবে, বিশেষ করে চীনকে মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে। এই বৈঠকের পর পরই ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ঘোষণা দেন যে, ভারতের খুচরা বাজারে বিদেশি কোম্পানি কেনাবেচা করতে পারবে। বিভিন্ন পণ্যের খুচরা ব্যবসার বিপরীতে ৫১ শতাংশ পর্যন্ত মালিকানা রাখতে পারবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেন বামপন্থী রাজনৈতিক দল, কৃষকদের সংগঠন কিষাণ জাগৃতি মঞ্চের নেতৃবৃন্দ এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সংগঠন। এর প্রতিক্রিয়ায় ইউপিএ সরকার বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কিছু শর্ত জুড়ে দেন।

শর্তগুলো ছিল-ক) যে শহরে জনসংখ্যা দশ লাখের বেশি এমন ৩৫টি শহরে বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগ করা যাবে; খ)বিনিয়োগ হতে হবে কমপক্ষে ১০০ মিলিয়ন ডলার; গ) ওই বিনিয়োগের অর্ধেকটা খরচ করতে হবে ‘ব্যাক অ্যান্ড ইনফ্রোস্ট্রকচার’ বা কোল্ড স্টোর তৈরির মত পরিকাঠামো তৈরির জন্য; ঘ) স্থানিয় ক্ষুদ্র শিল্প সংস্থাগুলো থেকে ৩০ শতাংশ পণ্য কিনতে হবে; ঙ) ৩০ শতাংশ বেচাকেনা করতে হবে ছোট ও খুচরা দোকানদারদের সঙ্গে।

বিদেশি পুঁজির কাছে ভারতের বাজারটা খুব আকর্ষণীয়। কারণ ২০২৫ সালে এ বাজারে ব্যবসা হবে দেড় ট্রিলিয়ন ডলার।৪৬ ২০১১ সালের ১৯-২৮ জুলাই যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের বিভিন্ন দপ্তরের সচিবদের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকেই ভারতের খুচরা বাজারে বিদেশি বিনিয়োগের প্রস্তাব তৈরি হয়।৪৬ তখন ক্ষমতায় ছিল দ্বিতীয় ইউপিএ সরকার। প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মনমোহন সিং, অর্থমন্ত্রী চিদাম্বরম। এই দ্বিতীয় দফার যে ইউপিএ সরকার, তারা দ্বিতীয় দফার সংস্কার কর্মসূচি ঘোষণা করে। সেখানে দুই দেশের সচিব পর্যায়ের বৈঠকের প্রস্তাব সামনে আনে। খুচরা ব্যবসায় বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগের বিষয়টি রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষণা করা হয়। এক্ষেত্রে চিদাম্বরমপন্থীদের যুক্তি ছিল, ভারতে খুচরা ব্যবসাটি অসংগঠিত। ক্রেতার কাছে খুচরা ব্যবসায়ীরা যে পণ্যটি পৌঁছে দেন, সেই খুচরা ব্যবসায়ী নিজেই কয়েক হাত ঘোরার পর পণ্যটি পান। একটি পণ্য যতবার হাতবদল হবে, ততবার তাতে খরচ যোগ হবে। এভাবে একটা ফ্যাক্টরি বা কৃষিক্ষেত্র থেকে কয়েক দফা হাতবদলের পর পণ্যটি ক্রেতার হাতে আসে। পণ্যটির হাতবদলের কারণে দাম বাড়ে। পণ্যটির গায়ে একটা দাম লেখা থাকার কারণে ক্রেতারা তা টের পান না। এই ছাপা দামটিই কমানো সম্ভব, যদি পণ্যটির হাতবদলের ঘটনা কমানো যায়। এক্ষেত্রে বড় পুঁজি যদি খুচরা ব্যবসায় নামে, তারা ফ্যাক্টরি বা মাঠ থেকে পণ্য ক্রয় করে বিগবাজারে পৌঁছে দেবে। তাতে করে পণ্যটির হাতবদলের ঘটনা কমবে, দামও কমবে এবং ক্রেতারা বিগ বাজারে রকমারি পণ্যের মধ্য থেকে তাদের প্রয়োজনীয়টি কিনবেন। খুচরা বাজারে যদি বৃহৎ সংস্থার পুঁজি বিনিয়োগ হয়, তাহলে পণ্য বিপণনে একক পিছু খরচ কমবে, পণ্যের দামও কমবে। খুচরা ব্যবসায় করপোরেট পুঁজি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এগুলোই ছিল চিদাম্বরমের যুক্তি।৪৭

ভারতীয় গবেষকদের মতে, কৃষির পরে ভারতের খুচরা ব্যবসা হলো কর্মসংস্থানের দ্বিতীয় খাত। তবে তার ৯৭ শতাংশই অসংগঠিত। প্রায় ১৪ শতাংশ মানুষ এই জীবিকার সঙ্গে যুক্ত। সরকারি হিসাবে সারা ভারতে খুচরা পণ্য বাজারজাত করার দোকান রয়েছে ৪ কোটি। সারা ভারত ব্যবসায়ী উদ্যোগ মণ্ডলের হিসাবে ১০ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত রয়েছে এই খাতে। আর পরোক্ষভাবে যুক্ত মানুষের সংখ্যাও ১০ কোটি। তাছাড়া প্রতি হাজার মানুষের জন্য রয়েছে ৪০টি দোকান। পুঁজির দিক থেকে এ বাজারের আয়তন ৩০০ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ১২ লাখ কোটি টাকা। ভারতের মোট জাতীয় আয়ের ১৪ শতাংশের বেশি আসে এ খাত থেকে। সেবা খাতের মধ্যে এই খাতের আয় সবার উপরে। ১৯৯৩-৯৪ অর্থবছরে এই খাতের নিট আয় ছিল ৯৩,২০৬ কোটি টাকা। ২০০২-০৩ অর্থবছরের নিট আয় ছিল ২,০৮,১২১ কোটি টাকা বা ৪৬২৪.৯১ কোটি ডলারের বেশি। এই খাতে আয় বৃদ্ধির হার বছরে ১২ শতাংশের বেশি। ভবিষ্যতে এ বাজারের আয়তন বেড়ে দাঁড়াবে ৬৩৭ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ২৫ লাখ কোটি টাকা।৪৮ ফলে চিদাম্বরম সাধারণ ক্রেতাদের দুর্ভোগের কথা বিবেচনা করে এই খাতটিকে বৃহৎ পুঁজি বা বহুজাতিক কোম্পানির কাছে তুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। মোদি সরকার আইন পাস করে তারই অসংগতিগুলো দূর করার উদ্যোগ নিয়েছে। যাতে করপোরেট পুঁজির খুচরা ও পাইকারি বাজারে প্রবেশের সুযোগ আরো নিশ্চিত হয়। উপরে আমরা আইটিসি কোম্পানির কথা বলেছি।এবার আমরা অন্য কিছু কোম্পানির হদিস জেনে নেব।

ওয়ালমার্ট ২০০২ সালে বেঙ্গালুরুতে তাদের প্রথম অফিস খোলে। এখন তাদের ১৭টি ক্রয়-বিক্রয় কেন্দ্র রয়েছে। ২০০২ সালে তারা ভারত থেকে ১২০ কোটি ডলার পণ্য ক্রয় করেছে। ভারতে তাদের ৪০টি জোগানদার রয়েছে। তবে ভারতের দেশীয় কোম্পানি ভারতী হলো তার সহযোগী প্রতিষ্ঠান।

ভারতের খুচরা বাজারে কয়েক বছর আগে প্রবেশ করেছে ওয়ালমার্ট। সারা পৃথিবীর মধ্যে খুচরা ব্যবসার শীর্ষে রয়েছে কোম্পানিটি। যুক্তরাষ্ট্রসহ ২৭টি দেশে তাদের ১০ হাজারের বেশি ব্যবসা কেন্দ্র রয়েছে। তাদের বার্ষিক ব্যবসার পরিমাণ ৪০ হাজার কোটি বিলিয়ন ডলার। প্রতি মিনিটের মুনাফা ৩৪ হাজার ৮৮০ ডলার। ওয়ালমার্ট ২০০২ সালে বেঙ্গালুরুতে তাদের প্রথম অফিস খোলে। এখন তাদের ১৭টি ক্রয়-বিক্রয় কেন্দ্র রয়েছে। ২০০২ সালে তারা ভারত থেকে ১২০ কোটি ডলার পণ্য ক্রয় করেছে। ভারতে তাদের ৪০টি জোগানদার রয়েছে। তবে ভারতের দেশীয় কোম্পানি ভারতী হলো তার সহযোগী প্রতিষ্ঠান। তার মাধ্যমে গয়নাসহ বাসমতী চাল, সবজি, ফল ক্রয় করে। তাছাড়া ভারতীয় কোম্পানি ফিড ফ্রেশের সঙ্গেও কৃষিপণ্যের বাণিজ্য রয়েছে। ওয়ালমার্ট ভারতীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে ১০০টি হাইপার সুপার মার্কেট তৈরির কাজ শুরু করেছে। শুধু এই খাতেই বিনিয়োগের পরিমাণ ৭ বিলিয়ান ডলার। ইউরোপের টেসকো ও টার্গেট ভারতীয় ফিল্ড ফ্রেশ কোম্পানির সঙ্গে যুক্তভাবে ব্যবসা করছে। ভারত থেকে তারা কাঁচামরিচ, পিঁয়াজসহ বিভিন্ন সবজি ক্রয় করে বিদেশে বাজারজাত করছে। এখানে উল্লেখ করা দরকার আগে ভারতের পাইকারি ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে আইন ছিল বিদেশি কোম্পানির ৫১ ও দেশীয় কোম্পানির ৪৯ শতাংশের পার্টনারশিপ থাকতে হবে। পরে পাইকারি ও গুদামজাত ব্যবসায় ১০০ শতাংশ বিনিয়োগের অনুমতি নিয়ে জার্মানির মেট্রো ক্যাশ অ্যান্ড ক্যারি কর্ণাটকের পাইকারি বাজার প্রায় দখল করে ফেলেছে। এছাড়া ভারতের বাজারে  রয়েছে রিবক, নাইকি, ম্যাকডোনাল্ড, কেনটাকি ফ্রায়েড চিকেন, নোকিয়া ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান। তারা প্রত্যেকেই খুচরা বাজারে প্রবেশের চেষ্টা করছে। কেউ সফল হয়েছে, কেউ হয়নি।

ভারতের পাইকারি ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে আইন ছিল বিদেশি কোম্পানির ৫১ ও দেশীয় কোম্পানির ৪৯ শতাংশের পার্টনারশিপ থাকতে হবে। পরে পাইকারি ও গুদামজাত ব্যবসায় ১০০ শতাংশ বিনিয়োগের অনুমতি নিয়ে জার্মানির মেট্রো ক্যাশ অ্যান্ড ক্যারি কর্ণাটকের পাইকারি বাজার প্রায় দখল করে ফেলেছে। এছাড়া ভারতের বাজারে  রয়েছে রিবক, নাইকি, ম্যাকডোনাল্ড, কেনটাকি ফ্রায়েড চিকেন, নোকিয়া ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান।

অন্যদিকে ওয়ালমার্টকে মডেল করে দেশীয় কোম্পানির মধ্যে রিলায়েন্স খাদ্যদ্রব্য, প্রসাধনী, ইলেকট্রনিসসহ অন্য পণ্যের বাজার সম্প্রসারণ করছে। টাটা রিটেইল চেন হিসেবে ওয়েস্টসাইড, ল্যান্ডমার্ক, স্টার ইন্ডিয়া ইত্যাদি সহযোগীর মাধ্যমে ব্যবসা সম্প্রসারণ করছে।৪৯ আলোচিত এসব দেশি-বিদেশি প্রতিটি কোম্পানি ভারতে কৃষি ও শিল্পের খুচরা-পাইকারি সব ধরনের বাজারে সরাসরি প্রবেশ করতে চাচ্ছে। এই চেষ্টা বাজপেয়ি, মনমোহন সিং হয়ে মোদি পর্যন্ত এসেছে। মোদি সরকার করোনাকালীন সময়ে সেই সুযোগটা নিয়েছেন, যাতে তার সরকারকে প্রতিরোধ বা প্রতিবাদের মুখে পড়তে না হয়। কিন্তু ঘুরে দাঁড়িয়েছেন চাষিরা। তারাই দীর্ঘদিন ধরে ভারতের নাগরিকদের খাদ্য জুগিয়েছেন। এখন লড়াই গড়ে তুলেছেন দেশি-বিদেশি করপোরেট সংস্থার বিরুদ্ধে। এর প্রধান কারণ হলো ভারত সরকার গ্যাট এবং WTO তে স্বাক্ষর করার পর ওই দেশের অর্থনীতির নানা খাতে কর্পোরেট পুঁজি প্রবেশ করেছে। অনেক সরকারি খাত বেসরকারিকরণ করা হয়েছে। তারপরেও দুটি খাতে তার প্রভাব পড়েছিল খুব কম। তার একটি ছিল প্রতিরক্ষা, অন্যটি কৃষিখাত। প্রতিরক্ষা খাতে এখন ব্যাপক পরিমাণে কর্পোরেট পুঁজির প্রবেশ ঘটছে। বাদ রয়েছে কৃষিখাত। কৃষিখাতকে এখনো বড় ধরণের করপোরেট পুঁজি গ্রাস করতে পারেনি। মোদি সরকার সেই পদক্ষেপই নিয়েছে। এখানে উল্লেখ করা দরকার বিশ্বব্যাংকের ২০১৬ সালের রিপোর্ট অনুযায়ি ভারতে সমস্ত উৎপাদন ক্ষেত্র মিলিয়ে মোট কর্মক্ষম শ্রমশক্তির সংখ্যা ৪৮ কোটি ৫ লাখ। এরমধ্যে কৃষিখাতে কর্মরত শ্রমশক্তি ৩০ কোটি। একই সঙ্গে কৃষি ও খুচরা বাজারটি ধরতে গেলে অসংগঠিত। তাদের প্রধানাংশই আবার প্রান্তিক মানুষ। ফলে এই অংগঠিত খাতে করপোরেট পুঁজি ঢুকলে তার পরিনতি হবে ভয়াবহ। এটা ভারতের চাষিরা জানেন। ফলে করপোরেট পুঁজির বিরুদ্ধে তারা যে লড়াই গড়ে তুলেছেন। সেখান থেকে পিছিয়ে আসার উপায় নেই।

নেসার আহমেদ: লেখক ও গবেষক।

ই-মেইল: nesardipock@gmail.com

তথ্যসূত্র:

১) US department of state archive. www.state.gov

২) মোদি সরকারের নয়া কৃষি সংস্কারঃ ইস্ট ইণ্ডিয়া যুগে প্রত্যাবর্তন? মাসিক অনীক, জুলাই ২০২০ কলকাতা

৩) মধুশ্রী মুখোপাধ্যায়: পঞ্চাশের মন্বন্তর চার্চিলের ষড়যন্ত্র, প্রকাশক সেতু। ২০১৭, কলকাতা

৪) জনম মুখোপাধ্যায়: যুদ্ধ দাঙ্গা এবং সাম্রাজে্যর সমাপ্তি, ক্ষুধার্ত বাংলা, গাঙচিল, কলকাতা, ২০২০

৫) ঐ।

৬) ঐ।

৭) ঐ।

৮) ঐ।

৯) ঐ।

১০) ঐ।

১১) ministry of consumer affairs, food and public distribution, govt.of India

১২) legislative.gov.in

১৩) মোদি সরকারের নয়া কৃষি সংস্কারঃ ইস্ট ইণ্ডিয়া যুগে প্রত্যাবর্তন? মাসিক অনীক, জুলাই ২০২০, কলকাতা।

১৪) ঐ।

১৫) ঐ।

১৬) ঐ।

১৭) সম্পদরঞ্জন পাত্র: সুস্থায়ী কৃষি ও স্ব-ক্ষমতা, গাঙচিল,কলকাতা,২০১১

১৮) দীপঙ্কর দে: জ্বালানি,জল ও ভাত-রুটির গল্প, মাসিক অনীক, নভেম্বর-২০১২,কলকাতা

১৯)কল্যাণ রুদ্র: পশ্চিমবঙ্গের জলসম্পদ সংকটের উৎসসন্ধানে, সাহিত্য সংসদ, জানুয়ারি ২০১৫, কলকাতা

২০) সম্পদরঞ্জন পাত্র: পূর্বোক্ত।

২১) দীপঙ্কর দে: পূর্বোক্ত।

২২) সুকান্ত রায়: বিশ্বায়িত পুঁজিবাদ ও ভারতের কৃষি-ব্যবস্থা, মাসিক অনীক, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ২০১২

২৩) সম্পদরঞ্জন পাত্র: পূর্বোক্ত।

২৪) দীপঙ্কর দে: পূর্বোক্ত।

২৫) চিত্তরঞ্জন দাশ: ভারতীয় কৃষির চরিত্র-পুঁজিবাদী, না প্রাক-পুঁজিবাদী, মাসিক অনীক, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর, ২০১২ কলকাতা।

২৬) ধীরেশ ভট্টাচার্য: এখন অর্থনীতি নতুন গ্যাট চুক্তি ও ভারতের জাতীয় স্বার্থ, বাউলমন, নভেম্বর ১৯৯৫

২৭) US departmentof state archive. www.state.gov / সংস্কার রাজনীতির আরেক অধ্যায়, সুতনু ভাট্টাচার্য, মাসিক অনীক, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর-২০১২,কলকাতা।

২৮) মোদি সরকারের নয়া কৃষি সংস্কারঃ ইস্ট ইণ্ডিয়া যুগে প্রত্যাবর্তন? মাসিক অনীক,জুলাই ২০২০ কলকাতা।

২৯)সুতনু ভাট্টাচার্য: সংস্কার রাজনীতির আরেক অধ্যায়, মাসিক অনীক, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর-২০১২,কলকাতা।

৩০) হরলাল নাথ: জিন প্রযুক্তি কৃষক ও কৃষির মৃত্যু পরোয়ানা, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাঃ লিঃ কলকাতা-২০১০।

৩১) কৃষিক্ষেত্রে বায়োটেকনোলজির বাস্তব প্রয়োগের সম্বাবনা, আজকের কৃষি ভাবনা সমিক্ষা ২০০৭, মুখ্য সম্পাদক নীলাংশু মুখার্জি, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি,কলকাতা।

৩২) কার্তিক পাল: ভারতীয় কৃষির বৈপরীত্যের আকার ও কৃষি সংকট, অনীক, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ২০১২  কলকাতা

৩৩) কৃষিক্ষেত্রে বায়োটেকনোলজির বাস্তব প্রয়োগের সম্বাবনা,আজকের কৃষি ভাবনা  সমিক্ষা ২০০৭,মুখ্য সম্পাদক নীলাংশু মুখার্জি, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি, কলকাতা

৩৪) হরলাল নাথ: ঐ।

৩৫) অভি দত্ত মজুমদার: খুচরো বাজারে বিদেশি বিনিয়োগের শেষ বাধাটুকুও কি তাহলে দূর হবে এবার? অনীক, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর-২০১১, কলকাতা

৩৬) চিত্তরঞ্জন দাশ: ভারতীয় কৃষির চরিত্র-পুঁজিবাদ না প্রাক-পুঁজিবাদী, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ২০১২, অনীক, কলকাতা

৩৭) www.deccanherald.com

৩৯) জয়ন্ত সিংহ: কৃষি-শিল্প বিতর্ক গম চাষে উদ্বৃত্ত ভারতকে কেন আমদানি করতে হচ্ছে, নবসাম্রাজ্যবাদ কৃষি-শিল্প বিতর্ক, বিশ্ববঙ্গীয়-২০০৬, কলকাতা

৪০) চিত্তরঞ্জন দাশ: ঐ।

৪১) আত্মঘাতী কৃষক-সত্য এবং অর্ধসত্য, আগস্ট, ২০১৫, মাসিক অনীক, কলকাতা

৪২) পরিচয় কানুনগো: কার প্ররোচনায় কৃষক আত্মহত্যা, মাসিক অনীক, ,সেপ্টেম্বর-অক্টোবর-২০১২, কলকাতা

৪৩) উৎসা পট্টনায়ক: ভারতের কৃষিতে পুঁজিবাদের ব্যাহত বিকাশ, মাসিক অনীক, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ২০১২ কলকাতা

৪৪) অভি দত্ত মজুমদার: ঐ।

৪৫) মোদি সরকারের নয়া কৃষি সংস্কারঃ ইস্ট ইণ্ডিয়া যুগে প্রত্যাবর্তন? মাসিক অনীক, জুলাই ২০২০ কলকাতা

৪৬) সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়: খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নি, মাসিক অনীক, আগস্ট ২০১১, কলকাতা

৪৭) রতন খাসনবিশ: খুচরো ব্যবসায়ে বিদেশি লগ্নি, নবসাম্রাজ্যবাদ কৃষি-শিল্প বির্তক, বিশ্ববঙ্গীয়, ২০০৬, কলকাতা

৪৮) অভি দত্ত মজুমদার: ঐ।

৪৯) ওষুধ শিল্পে বিদেশি বিনিয়োগ, সিদ্ধার্থ গুপ্ত, মে ২০১৬, অনীক। খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নি, সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়, আগস্ট-২০১১ অনীক। খুচরো বাজারে বিদেশি বিনিয়োগের শেষ বাধাটুকুও কি তাহলে দূর হবে এবার? অভি দত্ত মজুমদার, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর-২০১১,মাসিক অনীক কলকাতা

Social Share
  •  
  •  
  • 662
  •  
  •  
  •  
  •  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *