রাষ্ট্রীয় হেফাজতে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের মৃত্যু

রাষ্ট্রীয় হেফাজতে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের মৃত্যু

প্রকাশ দত্ত

করোনাভাইরাস বিশ্ব মহামারী পরিস্থিতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবন ও জীবিকা অনিশ্চয়তার মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে। সারা পৃথিবীর ন্যায় আমাদের দেশের শ্রমিকদের ওপর চলছে ছাঁটাই, লে-অফ, চাকরিচ্যুতির আক্রমণ। এমন সময় রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধের ঘোষণা যেন চিতার আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়ার মত। সোনালি আঁশ খ্যাত বাংলাদেশের পাট ও পাট শিল্পের এই অবস্থার জন্য কে বা কারা দায়ী? পাটশিল্প গড়ে ওঠার প্রেক্ষাপট এবং পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ থেকে এই প্রশ্নের উত্তর সন্ধানের চেষ্টা করা হয়েছে এই লেখায়।

উপনিবেশিক অবিভক্ত ভারতবর্ষ ছিল বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ শাসন-শোষণের মৃগয়া ক্ষেত্র। আর বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের আনুকূল্যে এবং প্রয়োজনে যে দালাল শ্রেণির জন্ম হয়েছিল সেই শ্রেণির প্রতিনিধিরাই আজও সাম্রাজ্যবাদী লগ্নিপুঁজির স্বার্থে দেশ পরিচালনা করে চলেছে। তাই তাদের কাছে জাতীয় স্বার্থ এবং জনস্বার্থ নয়, প্রভুর স্বার্থ রক্ষা করাই হচ্ছে মূল কাজ।

ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, ১৮৮৫ সালে জর্জ অকল্যান্ড শ্যামসুন্দর সেন নামের একজন বাঙালি অংশিদারকে নিয়ে কলকাতার হুগলি নদীর তীরবর্তী বিশড়া নামক স্থানে প্রথম পাটকল স্থাপন করে। পাটশিল্পের কাঁচামাল পাট, সস্তাশ্রম, বিশ্ব বাজারে পাটজাত পণ্যের চাহিদার ওপর নির্ভর করেই যাত্রা শুরু হয়েছিল পাটশিল্পের। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৪৫ সালে পাটকলের সংখ্যা দাঁড়ায় ১১১টিতে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পাটশিল্পের কারখানাগুলো সব পড়ে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গে। কিন্তু ৮০ শতাংশ পাট উৎপাদন হত পূর্ববাংলায়। অথচ পূর্ববাংলায় কোনো পাটকল ছিল না। ১৯৫১ সালে পূর্ববঙ্গের নারায়ণগঞ্জে বাওয়ানি জুট মিল প্রতিষ্ঠার মধ্যদিয়ে পাটকলের যাত্রা শুরু হয়। সেই একই বছর ১২ ডিসেম্বর ২৯৭ একর জায়গার ওপর ৩ হাজার ৩০০ তাঁত নিয়ে এশিয়ার বৃহত্তম পাটকল স্থাপন করে আদমজীরা তিন ভাই। প্রাথমিকভাবে শেয়ার বিক্রি করে ৭ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে এই পাটকল বার্ষিক ৬০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী শিল্পে পরিণত হয়। বিশ্ব বাজারে পাটের তেজিভাব থাকার কারণে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো এবং একচেটিয়া পুঁজিপতি শ্রেণির দোসর পাকিস্তানের আমলা দালাল পুঁজিপতিগোষ্ঠী পাটশিল্প স্থাপনে আগ্রহী হয়ে ওঠে। একের পর এক প্রতিষ্ঠা হতে থাকে পাটকল। বাংলাদেশ সৃষ্টির আগ পর্যন্ত পাটকলের সংখ্যা ছিল ৭৫টি। এর মধ্যে ৬৭টি পাটকল ছিল পূর্ববঙ্গে। একই সাথে পাটশিল্পের মাধ্যমে যে উদীয়মান শ্রমিক শ্রেণির আবির্ভাব ঘটে তারা ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের পাশাপাশি এদেশের গণতান্ত্রিক সংগ্রামেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

বাংলাদেশ সৃষ্টির আগ পর্যন্ত পাটকলের সংখ্যা ছিল ৭৫টি। এর মধ্যে ৬৭টি পাটকল ছিল পূর্ববঙ্গে। একই সাথে পাটশিল্পের মাধ্যমে যে উদীয়মান শ্রমিক শ্রেণির আবির্ভাব ঘটে তারা ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের পাশাপাশি এদেশের গণতান্ত্রিক সংগ্রামেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয় বাংলাদেশ। পাকিস্তানের শাসক-শোষক গোষ্ঠীর ন্যায় বাংলাদেশের শাসক-শোষকগোষ্ঠীও একই ধারায় সাম্রাজ্যবাদের পদ সেবায় লিপ্ত থাকে। ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ রাষ্ট্রপতির আদেশে পিও ২৭ (বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল এন্টারপ্রাইজেজ ন্যাশনালাইজেশন অর্ডার ১৯৭২) অনুযায়ী ব্যক্তিমালিকানাধীন ও পরিত্যক্ত পাটকলসহ সাবেক ইপিআইডিসির মোট ৬৭টি পাটকলের তদারকি, পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ পাটকল কর্পোরেশন (বিজেএমসি) গঠিত হয়। গঠনের পর থেকেই বিজেএমসির কর্মকর্তা, আমলা, মন্ত্রীসহ পাটশিল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা একটি স্বার্থান্বেষী মহল লুটপাট করতে থাকে। তারপরও ৭১ পরবর্তী দেড় যুগ ধরে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে পাটের অবদানই ছিল বেশি। কিন্তু যাদের অবদানে পাট সোনালি আঁশ হয়েছিল সেই শ্রমিক-কৃষকের ঘরে সে সুদিনেও আশার আলো জ্বলেনি।

পৃথিবীর মঞ্চে তখন সমাজতন্ত্রের তকমা লাগানো সোভিয়েত ইউনিয়নের অস্তিত্ব থাকার কারণে সরকার রাষ্ট্রীয় শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে শ্রমিকদের চাকরির ক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধা ও ট্রেড ইউনিয়ন অধিকারের প্রশ্নটিও সামনে রাখে। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন যতই আসন্ন হতে থাকে পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থা একচেটিয়া পুঁজির শোষণের স্বার্থে রাষ্ট্রীয় মালিকানার বিপরীতে ব্যক্তিগত মালিকানার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে সামনে আনে। তারও একটি প্রভাব পড়ে বাংলাদেশের পাটশিল্পে।

১৯৭৫ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান শেখ মুজিব হত্যা এবং জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা দখলের পর বাংলাদেশে মার্কিন নিয়ন্ত্রণ জোরদার হয় এবং আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংকের নীতি-নির্দেশ বাস্তবায়নের অধিকতর অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। রাষ্ট্রায়ত্ত্ব পাটকল বেসরকারিকরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। বেসরকারিকরণের লক্ষ্যে শক্তিশালী ট্রেড ইউনিয়ন ধ্বংস করে সরকার এবং বিজেএমসি মিলে তাদের বশংবদ নেতৃত্ব সামনে আনে শ্রমিকদের সিবিএ’তে। আর এদের মাধ্যমে শুরু হয় ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্ব এবং ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনকে শ্রমিক শ্রেণি ও জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করার প্রক্রিয়া, জোরদার হতে থাকে বেসরকারিকরণ প্রক্রিয়া।

বাংলাদেশের রাজনীতির মঞ্চে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থে অধিক উপযোগি নেতৃত্ব হিসেবে ২য় সামরিক জান্তা এরশাদ ক্ষমতা দখল করে ১৯৮২ সালে। ফলে সকল ক্ষেত্রে বেপরোয়া লুটপাট এবং আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের নীতি-নির্দেশ দৃঢ় হস্তে কার্যকরি করা হতে থাকে। তারই ফলে জেনারেল এরশাদের আমলে ৩৫টি পাটকল বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয় এবং সরকার পুঁজি প্রত্যাহার করে নেয় আরো ৮টি পাটকল থেকে।

৮০ দশকে পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বসংস্থা বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বকে একই অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে আনতে গ্রহণ করা হয় ‘কাঠামোগত সমন্বয় কর্মসূচি’ এবং পরের বছর আসে ‘কাঠামোগত সমন্বয় সুবিধা’। তারই আলোকে দ্রুত অগ্রসর হতে থাকে বেসরকারিকরণ প্রক্রিয়া। এটা শুধু পাটকলে নয়, ব্যাংক, বীমা, শিল্প কলকারখানাসহ সকল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে কার্যকরি করা হয়। এই নীতির আলোকে বেসরকারি পাটকলের যাত্রা শুরু হয় ১৯৮৪ সালে।

এরই ধারাবাহিকতায় দেশে বর্তমানে বেসরকারি পাটকলের সংখ্যা ২৮৫টি। এর মধ্যে ৫৫টি বন্ধ। যে ৫৫টি পাটকল বন্ধ রয়েছে তা মূলত লোকসানের কারণে নয়। আমাদের দেশে রাষ্ট্রীয় কোষাগার লুটপাটের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হচ্ছে শিল্পস্থাপনের নামে ব্যাংক ঋণ নেওয়া এবং পরবর্তিতে লোকসান দেখিয়ে শিল্প বন্ধ করে দিয়ে দেউলিয়া ঘোষণা করা। রাষ্ট্রীয় এই ব্যবস্থার কারণে ঋণ খেলাপী ও কালো টাকার মালিকেরা জামাই আদরে থাকলেও এদেশের অনেক কৃষক ঋণের জালে জড়িয়ে ঋণ শোধ করতে না পেরে সোনালি আঁশ দ্বারা গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হচ্ছে। 

এরই ধারাবাহিকতায় দেশে বর্তমানে বেসরকারি পাটকলের সংখ্যা ২৮৫টি। এর মধ্যে ৫৫টি বন্ধ।

এদেশের সকল ক্ষমতাসীন সরকারই গণবিরোধী কার্যক্রমে শ্রমিক অঙ্গন ও ছাত্র অঙ্গন থেকে প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছে। যে ছাত্র আন্দোলন ও শ্রমিক আন্দোলন ঠেকাতে তাদের ভূমিকা অব্যাহত থেকেছে। ৯০ পরবর্তি সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো একচেটিয়া লগ্নিপুঁজির সর্বোচ্চ মুনাফা ও বেপরোয়া লুটপাটের স্বার্থে সামনে আনে বিশ্বায়নের স্লোগান। তাদেরই সংস্থা বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের যেসব কর্মসূচি তখন জোরদার করা হয় সেগুলো হলো: (১) শিল্পক্ষেত্রে বিরাষ্ট্রীয়করণ ও ব্যক্তিগত মালিকানার নীতি (২) কৃষি ক্ষেত্রে ভর্তুকি প্রত্যাহার ও ব্যক্তি মালিকানায় বিপণন নীতি (৩) বাণিজ্য ক্ষেত্রে অবাধ আমদানি নীতি ও (৪) অবাধ মুদ্রানীতি। আর রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ঘোষণা করা হয় ‘সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলা’।

বাংলাদেশের অর্থনীতি ও রাজনীতির ক্ষেত্রেও শাসকগোষ্ঠী সে অনুযায়ী নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করতে থাকে। রাজনীতির অঙ্গনে গণতান্ত্রিক এবং শ্রেণি সংগ্রামকে দমন করতে নানা তৎপরতা চলতে থাকে, শিক্ষাঙ্গনে সরকারদলীয় সংগঠনের একচ্ছত্র আধিপত্য ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে সকল ধরনের বাদ-প্রতিবাদ স্তিমিত করার চেষ্টা জোরদার হয়। অন্যদিকে শ্রমিক অঙ্গনে সিবিএ দখল, ইউনিয়ন দখল, নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্যসহ রাষ্ট্রীয় ছত্রছায়ায় সন্ত্রাসের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করা হয়। একইসাথে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করে  বিরাষ্ট্রীয়করণের সপক্ষে মত তৈরি করার চেষ্টা চালানো হয়। শ্রমিক রাজনীতির ক্ষেত্রে সংগ্রামের পরিবর্তে সমঝোতা এবং আপোষকামিতার ধারাকে জোরদার করা হয়।

১৯৯৩ সালে সংস্কার কর্মসূচির আওতায় আরো ১১টি পাটকল বন্ধ করা হয়। ২০০২ সালে এশিয়ার বৃহত্তর পাটকল খ্যাত আদমজি পাটকল বন্ধ করা হয়। এই গণবিরোধী কাজ করার জন্য তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকারের প্রধানমন্ত্রী বিশ্বব্যাংকের কাছে অনেক বেশি আস্থা ভাজন হয়ে উঠে। ১৯৮৪ পরবর্তি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান বিক্রির নামে যে ঢালাও লুটপাট শুরু হয় তাতে দেখা যায়, যে টাকা দিয়ে মিল কেনা হয়, মিলের লোহালক্কড় বিক্রি করে ঐ সমস্ত মিলের মালিকরা তার দ্বিগুণ লাভ করে। অল্প সময়ে অতি দ্রুত ধনী হওয়া দেশের তালিকায় আজ বাংলাদেশের নাম এখন শীর্ষে। আর যাদের নাম এই তালিকায় আছে বিভিন্ন সরকারের সময়ে ভিতর-বাহিরে ক্ষমতার ছত্রছায়ায় তারাই থেকেছে।

শুধু পাট নয় ‘বিশ্বায়ন’ ও ‘মুক্ত বাজার’ অর্থনীতির ফল হিসাবে আমাদের দেশের আখ, চামড়া, সুতা, বস্ত্র এবং পাট ধ্বংস হয়েছে আর অবাধ আমদানি নীতির কারণে বিদেশি পণ্যে সয়লাব হয়েছে দেশের বাজার। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি চলছে। কৃষি ক্ষেত্রে ‘বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন’(বিএডিসি)কে অকার্যকর করার ফলে কৃষি উপকরণের দাম হু হু করে বেড়ে চলেছে। শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতে ব্যক্তিমালিকানার নীতি কার্যকরি করার ফলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য আজ বাজারের পণ্যে পরিণত হয়েছে। আমাদের দেশ যেহেতু নয়াউপনিবেশিক দেশ তাই আমাদের অর্থনীতিসহ জীবনের সকল প্রয়োজনের নিয়ন্ত্রক হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী একচেটিয়া লগ্নিপুঁজি। রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সৃষ্টি হলেও আচড় লাগেনি এই শোষণ প্রক্রিয়ার গায়ে। যে কারণে পাকিস্তান আমলে শ্রমিকরা যে সকল দাবিতে রাস্তায় থাকতো বাংলাদেশ আমলেও সেই একই দাবিতে রাস্তায় থাকতে হয়, এবং জীবনও দিতে হয়।

রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সৃষ্টি হলেও আচড় লাগেনি এই শোষণ প্রক্রিয়ার গায়ে। যে কারণে পাকিস্তান আমলে শ্রমিকরা যে সকল দাবিতে রাস্তায় থাকতো বাংলাদেশ আমলেও সেই একই দাবিতে রাস্তায় থাকতে হয়, এবং জীবনও দিতে হয়।

সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর মধ্যকার প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে কোনো কোনো অঞ্চল এবং দেশকে সাম্রাজ্যবাদীরা অধিক গুরুত্ব দিয়ে অগ্রসর হয়ে থাকে। তারই দৃশ্যমান প্রতিফলন আছে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতিতে ভারতকে কেন্দ্র করে। লগ্নিপুঁজি নির্ভর শিল্প স্থাপন এবং উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সাম্রাজ্যবাদীরা নয়াউপনিবেশিক ভারতকে গুরুত্ব দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। তাই বাংলাদেশের পাটশিল্প ধ্বংস করে ভারতে পাটশিল্প গড়ে উঠার পেছনে রয়েছে সাম্রাজ্যবাদীদের সমঝোতার স্বার্থ। আর সে কারণে পাটকল বন্ধের জন্য শুধু ভারতকে দায়ী করা ভ্রান্ত ও খন্ডিত। আবার বর্তমান সময়ে বিশ্ব রাজনীতিতে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও বৃহৎ সাম্রাজ্যবাদে পরিণত হওয়ার লক্ষ্যে অগ্রসরমান পুঁজিবাদী চীনের যে প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং এতদ্বঞ্চলে ভারতকে ঘিরে যে পদক্ষেপ চলছে তাও গুরুত্বের সাথে মনে রাখতে হবে।

রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ২৫টি পাটকল বন্ধ হওয়ার পর ৫০ হাজার শ্রমিকের জীবনসহ প্রায় ২ কোটি মানুষের জীবন বিপন্ন হয়েছে, এসময় কীভাবে পাটকল লোকসানে পরিণত করা হয়েছে, অব্যবস্থাপনা, বিজেএমসির দুর্নীতি, ট্রেড ইউনিয়ন রাজনীতি, সরকারের ভ্রান্তনীতি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। তবে এর জন্য প্রকৃত দায়ী সাম্রাজ্যবাদ ও তার সংস্থা বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফ এর নীতি নিয়ে আলোচনা কমই হয়েছে।

সোনালি আঁশ নিয়ে এক সময় যে গর্ব করা হতো তার পেছনে ছিল কৃষক আর শ্রমিকের শ্রম, ঘাম, রক্ত। কত কৃষক পাট ধুতে গিয়ে রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন তার খবর কোথাও নেই। পাটকলের কত শ্রমিক চাকরিরত অবস্থায় যক্ষা, শ্বাসকষ্টসহ অন্যান্য পেশাগত রোগে মৃত্যুবরণ করেছেন তার হিসাব কি আছে পরিসংখ্যান ব্যুরোতে? সোনালি আঁশের যখন সোনালি দিন ছিল তখনো অন্ধকার ছিল কৃষকের কুটির আর শ্রমিকের কলোনি।

সরকারের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী খুব দক্ষতার সাথে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধে সর্বশেষ পৌরহিত্য করলেন। শোনানো হচ্ছে যে, প্রাইভেট-পাবলিক পার্টনারশীপ (পিপিপি)’র মাধ্যমে গড়ে ওঠা পাটকলের মধ্য দিয়ে ফিরে আসবে পাটের সুদিন। বৈশ্বিক কারণে পাটের চাহিদা বাড়ছে। এই লাভজনক বিষয়টি লগ্নিপুঁজির চোখে জলজল করে ভাসছে। প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে প্রাইভেট যে অংশিদার তা কি দেশি কোম্পানি হবে না বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানি হবে? দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে পাটের ‘সুদিনের’ ফলে যে লাভ হবে তার ভাগীদার কারা হবে? সোনালি আঁশ নিয়ে এক সময় যে গর্ব করা হতো তার পেছনে ছিল কৃষক আর শ্রমিকের শ্রম, ঘাম, রক্ত। কত কৃষক পাট ধুতে গিয়ে রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন তার খবর কোথাও নেই। পাটকলের কত শ্রমিক চাকরিরত অবস্থায় যক্ষা, শ্বাসকষ্টসহ অন্যান্য পেশাগত রোগে মৃত্যুবরণ করেছেন তার হিসাব কি আছে পরিসংখ্যান ব্যুরোতে? সোনালি আঁশের যখন সোনালি দিন ছিল তখনো অন্ধকার ছিল কৃষকের কুটির আর শ্রমিকের কলোনি। আর লগ্নিপুঁজির স্বার্থে পিপিপি’র মাধ্যমে পুনর্জীবন পাওয়া পাটকলগুলোর লাভ যদি ফুলে ফেঁপে কলাগাছ হতে থাকে তার সাথে জাতীয় ও জনস্বার্থের কোনো সম্পর্ক থাকবে কি? দেখা যাবে নামমাত্র মজুরিতে চাকরি করতে বাধ্য হচ্ছে শ্রমিক। হয়তো থাকবে না ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার, কর্তন করা হবে অর্জিত সুযোগ-সুবিধা। শোষণ নির্ভর সমাজ ব্যবস্থায় শিল্প এবং উৎপাদন পদ্ধতি যত আধুনিক হয় শোষণ তত তীব্র হয়। আর শ্রমিকের ক্ষুধা যত বাড়ে মালিকের মুনাফা তত বাড়ে। তাই রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের মৃত্যু আকস্মিক কোনো বিষয় নয়, এটা রাষ্ট্রীয় হেফাজতে রাষ্ট্রীয় নীতিরই ফলস্বরূপ। আজ তাই দেশ, জাতি ও জনগণের সামনে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধের জন্য দায়ী কারা, লাভবান কারা এবং করণীয় কী তা তুলে ধরতে হবে শ্রমিকশ্রেণির পক্ষের শক্তিকে। করোনা পরবর্তি পৃথিবীব্যাপী পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার যে দম্ভ তা সম্পূর্ণ বেআব্রু হয়ে পড়ার মধ্য দিয়ে যে নতুন বাস্তবতা সামনে আসছে তাকে যুক্তির আলোকে তুলে ধরা এবং বিশ্ব শ্রমিকশ্রেণি ও জনগণকে সেই পথে আহ্বান করা। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেই পথের পথ প্রদর্শক হতে হবে শ্রমিক শ্রেণিকে।

প্রকাশ দত্ত: যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ, কেন্দ্রীয় কমিটি।

ই-মেইলঃ pkdutta.dhaka@gmail.com

 

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *