‘‘এই ঘটনায় দোষীদের শাস্তি না হলে শুধু বেগমগঞ্জ না সারা দেশের নারীরা পরাজিত হবে”

‘‘এই ঘটনায় দোষীদের শাস্তি না হলে শুধু বেগমগঞ্জ না সারা দেশের নারীরা পরাজিত হবে”

নোয়াখালির বেগমগঞ্জের এখলাসপুরে নারী ধর্ষণ, বিবস্ত্র করে নির্যাতন ও তা ভিডিও ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশের প্রতিবাদের অংশ হিসেবে এবং নির্যাতিত নারীর প্রতি সমবেদনা ও সংহতি জানাতে গত ৯ অক্টোবর, ২০২০, শুক্রবার লেখক-গবেষক ও নৃবিজ্ঞানী রেহনুমা আহমেদের সমন্বয়ে ৬ সদস্যের একটি নারী প্রতিনিধিদল ঢাকা থেকে নোয়াখালি যান। ফিরে এসে তারা ১০ অক্টোবর, ২০২০ সংবাদপত্রের জন্য একটি বিবৃতি প্রদান করেন। পাহাড়-সমতলে নারী হত্যা ও নিপীড়ন এবং ক্ষমতার ব্যবহার করে বিচারহীনতার যে দৃষ্টান্ত তৈরি হয়েছে তা একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের অস্বস্তিকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এই ধরনের ঘটনা এবং ক্ষমতাকে ব্যবহার করে দোষীদের পার পেয়ে যাওয়ার চলমান প্রক্রিয়াকে ধিক্কার ও নির্যাতিত নারীর প্রতি সংহতি জানিয়ে সর্বজনকথার এই সংখ্যায় বিবৃতিটি প্রকাশ করা হলো।

১০ অক্টোবর ২০২০

যৌথ বিবৃতি

গতকাল, শুক্রবার ২৪ আশ্বিন ১৪২৭, ৯ অক্টোবর ২০২০, লেখক-গবেষক ও নৃবিজ্ঞানী রেহনুমা আহমেদের সমন্বয়ে আমরা ৬ জন ঢাকা থেকে নোয়াখালি সদর ও বেগমগঞ্জে যাই। বেগমগঞ্জের নারী ধর্ষণ ও বিবস্ত্র করে যৌন নির্যাতনের ঘটনার প্রতিবাদের অংশ হিসাবে এবং ওই নারীর প্রতি গভীর সমবদেনা ও জোরালো সংহতি প্রকাশ করতেই আমাদের এই সফর।

উল্লেখ্য, ৩২ দিন আগে নোয়াখালি জেলার বেগমগঞ্জে একজন ৩৭ বছর বয়সী নারীকে গণধর্ষণ ও বিবস্ত্র করে নির্মম নির্যাতন চালানো হয় এবং ‘দেলোয়ার বাহিনী’ নামে পরিচিত ধর্ষক ও নির্যাতকরা এই ঘটনার ভিডিও ধারণ করে। দেলোয়ার বাহিনী রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় এলাকায় ত্রাস ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করে বলে জানা যায়। ৪ অক্টোবর সামাজিক মাধ্যমে ভিডিওটি ভাইরাল হলে বিশেষভাবে নারীরা এবং একইসাথে দেশবাসী বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ইতোমধ্যে, সন্ত্রাস ও যৌন নির্যাতনের শিকার নারী নিজে বাদী হয়ে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন’ এবং ‘পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে’ দুটি মামলা দায়ের করেন।

দুপুর ২টায় নোয়াখালি জেলা প্রেসক্লাবে পৌঁছে আমরা সাংবাদিকদের সাথে মত বিনিময় করি। সেখানে উপস্থিত ছিলেন নোয়াখালি জেলার সাংবাদিকবৃন্দ, আইনজীবী, নারী ও মানবাধিকার কর্মী, সাংস্কৃতিক কর্মী এবং শিক্ষার্থীরা। আমাদের মধ্যকার স্বতঃর্স্ফূত আলাপ এসকল বিষয়কে ঘিরে হয়: দোষীদের শাস্তি, বেগমগঞ্জের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, মিডিয়াকর্মীদের ভূমিকা, গণতান্ত্রিক জনসম্পৃক্ততার পরিবর্তে ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন তৈরির সংস্কৃতি, বিচারহীনতা, ধর্ষণের ঘটনা ঘটার পর রাজনৈতিক নেতাদের ‘বিচার হবে’র আশ্বাসপ্রদানের পরিবর্তে আমরা চাই এমন রাজনৈতিক নেতৃত্ব যারা ধর্ষক-তৈরি হওয়ার রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রক্রিয়ার বিরোধী, এবং নির্যাতনের শিকার নারীর নিরাপত্তা ও বৃহত্তর ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন।

নোয়াখালি জেলা প্রশাসকের সাথে সাক্ষাৎকালে আমরা এ বিষয়ে জোরারোপ করি যে নোয়াখালি জেলার নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রশাসনিক আকাঙ্ক্ষার সাথে রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ে গড়ে ওঠা বিভিন্ন বাহিনীর উপস্থিতি সংঘাতময়। মূল সমস্যার সম্মুখীন হওয়া একান্ত জরুরি। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নির্যাতিত নারীর জন্য ঘর তুলে দেওয়া হবে জেনে আমরা জেলা প্রশাসককে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।

নোয়াখালি জেলার পুলিশ সুপারের সাথে সাক্ষাৎকালে তিনি আমাদের অবহিত করেন পুলিশ কীভাবে নির্যাতিত নারীকে সহায়তা করছে, এবং তদন্ত ও মামলা বর্তমানে কোন পর্যায়ে। নির্যাতিত নারীর সাথে সাক্ষাৎ করার অনুমতি পাওয়ার পর আমরা সন্ধ্যা ৭:৩০টায় বেগমগঞ্জ থানায় যাই। এসময় আমাদের সাথে নোয়াখালি জেলার বার কাউন্সিলের সভাপতি অ্যাডভোকেট গোলাম রসুল মামুন, মানবাধিকার কর্মী আব্দুল আওয়াল, নিজেরা করি’র আয়শো সিদ্দিকা লাকীসহ আরো কয়েকজন ছিলেন।

নির্যাতনের শিকার নারীর সাথে দেখা হলে আমরা তাঁকে জানাই যে এই লড়াই কেবল বেগমগঞ্জের কোন এক নারীর বা নোয়াখালির না, এটি সারা দেশের নারীর লড়াই, নারী নির্যাতন-বৈষম্যের বিরুদ্ধে থাকা সকল সচেতন নাগরিকের লড়াই। বেগমগঞ্জের নারীর পাশে সারা দেশের ধর্ষণ নির্যাতন বিরোধীরা আছেন এবং থাকবেন। এই পরিস্থিতিতে কোন ভয়ভীতি, হেনস্তার কাছে পরাস্ত হবার কোনও সুযোগ নেই। তিনি যে কোনোভাবেই একা নন এ বিষয়ে আমরা তাঁকে বারেবারে আশ্বস্ত করি। তাঁর সাহস ধর্ষণ ও ধর্ষণের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শক্তি জোগাবে এবং সঙ্গী হয়ে থাকবে।

কে মুসলমান, কে হিন্দু, কে ধনী, কে গরীব, কে শিক্ষিত, কে অশিক্ষিত, এইসব বিবেচনার বাইরে আসতে হবে নারীদের। কেবল নারী হিসাবে নারীর উপর যে বর্বর নির্যাতন হয়েছে তার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ লড়াই এখন জরুরি।

নির্যাতিত নারী আমাদের নিকট তাঁর ক্ষোভ-দু:খ এবং দাবির কথা ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি না হলে শুধু বেগমগঞ্জ না সমগ্র দেশের নারীরা পরাজিত হবে। এই ঘটনার বিচার না হলে এ ধরনের ঘটনা বন্ধ হবে না। কে মুসলমান, কে হিন্দু, কে ধনী, কে গরীব, কে শিক্ষিত, কে অশিক্ষিত, এইসব বিবেচনার বাইরে আসতে হবে নারীদের। কেবল নারী হিসাবে নারীর উপর যে বর্বর নির্যাতন হয়েছে তার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ লড়াই এখন জরুরি। তিনি বলেন, এই ঘটনার বিচার না হলে মাথা উঁচু করে তিনি যেমন গ্রামে যেতে পারবেন না, তেমনি দেশের নারীরাও মাথা উঁচু করে চলতে পারবে না। কারণ ধর্ষক-নিপীড়করা শুধু তাঁকে নয় সারা দেশের নারীদেরই বিবস্ত্র করেছে।

নোয়াখালিতে এই ধরনের যৌন নির্যাতনের ভয়াবহতা কেন এতোদিন প্রকাশ পেল না সেটি জরুরি প্রশ্ন । পত্র পত্রিকা এবং এলাকাবাসীর কাছ থেকে জানা গেছে ঘটনায় জড়িত সন্ত্রাসী দেলোয়ার বাহিনীর সদস্যসহ সম্রাট বাহিনী, সুমন বাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনী নোয়াখালির বেগমগঞ্জে ত্রাস সৃষ্টি ও সন্ত্রাসী কাজ করে আসছিল। সুমন বাহিনীর হাত ধরেই দেলোয়ার বাহিনীর উত্থান। ক্ষমতাশীলদের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতাই এই ধরনের ঘটনা ঘটাতে পারছে। এই আন্দোলন ধর্ষকের গ্রেপ্তার বা শাস্তির দাবির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে বিচারের মুখ দেখবে না। এরজন্য প্রয়োজন ক্ষমতাশীল শক্তির ছত্রচ্ছায়ায় থাকা নিপীড়ক-নির্যাতক বাহিনীর ক্ষমতার উৎসকেও প্রশ্ন করা ও তার বিরুদ্ধেও আন্দোলন করা। দেলোয়ার বাহিনীদের রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎসকে আড়াল করে নারীর জন্য নিরাপদ জীবন, নিরাপদ বিচরণ নিশ্চিত করা সম্ভব না।

আমরা জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার এবং থানার ওসিকে নির্যাতিত নারীর নিরাপত্তা প্রদানে সর্বোচ্চ ভূমিকা রাখার বিষয়ে সচেষ্ট থাকার আহবান জানাই। বেগমগঞ্জের ঘটনাসহ এ যাবত নারীর উপর ঘটে যাওয়া ধর্ষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে শক্তিশালী সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার আহবান জানাই।

রেহনুমা আহমেদ       লেখক-গবেষক ও নৃবিজ্ঞানী
বীথি ঘোষ                শিক্ষক ও সাংস্কৃতিক কর্মী
জান্নাতুল মাওয়া         রাজনৈতিক কর্মী এবং আলোকচিত্রী
মাহফুজা হক             সাংস্কৃতিক ও মানবাধিকার কর্মী
শিপ্রা বোস               উন্নয়নকর্মী
তাসলিমা আখতার      শ্রমিক ও নারী আন্দোলন সংগঠক এবং আলোকচিত্রী

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *