নারীপুরুষের মনস্তত্ত্ব : জৈবিক সীমানা

নারী-পুরুষের মানস : পুরুষতান্ত্রিক ধারণা ও বৈষম্যের জৈবসামাজিক ভিত্তি-৩

নারীপুরুষের মনস্তত্ত্ব : জৈবিক সীমানা

মনিরুল ইসলাম

নারীপুরুষের (জৈবিক) পার্থক্যসমূহ প্রকারগত নয় মাত্রাগত। (বৈশিষ্ট্যগুলির) বিন্যাসের ক্ষেত্রে সাদৃশ্যের জায়গাগুলো ব্যাপক… এটা আরও সত্য মনস্তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে। নারী ও পুরুষ কী করতে সক্ষম তা (জেন্ডারগত ধারণার) স্থুল ছাঁচের মানদণ্ডে বিচার করে (তাদের) বাধাগ্রস্ত করা থেকে অবশ্যই আমাদের সরে আসতে হবে। … এই ছাঁচগুলো লিঙ্গীয় পার্থক্যের কারণ নয় বরং লিঙ্গীয় পার্থক্য থেকেই এগুলোর উৎপত্তি হয়েছে সে সম্ভাবনাই বেশি।১৮ অ্যান ক্যাম্বেল, A mind of her own

জৈবনিক প্রক্রিয়া আমাদের ব্যক্তিত্ব ও আচরণগত প্রবণতার ভিত্তিকে প্রতিফলিত করে। স্বাধীন ইচ্ছা বা রাজনৈতিক শুদ্ধতার নামে যদি আমরা আমাদের মস্তিষ্কের উপর জৈবিক প্রক্রিয়ার প্রভাবকে অস্বীকার করি (তাহলে) আমরা আমাদের আপন প্রকৃতির সঙ্গেই সংঘর্ষে লিপ্ত হতে থাকব…। … জৈবিক প্রক্রিয়ার প্রভাব অনেক শক্তিশালী কিন্তু তা আমাদের বাস্তবতাকে স্থবির করে ফেলে না। এই বাস্তবতাকে আমরা বদলে ফেলতে পারি এবং আমাদের বুদ্ধি ও প্রবল ইচ্ছাশক্তিকে ব্যবহার করতে পারি যৌন হরমোনগুলোর প্রভাবকে উন্মোচিত করার জন্য কিংবা যখন আমাদের মস্তিষ্কের …উপর এদের প্রভাব পাল্টানোর প্রয়োজন হয়।১৯

-লোনান ব্রিজেন্ডি, The Female Brain

পুরুষের দ্বারা আচরিত এক ধরনের ‘গর্ভধারণ’ আচারের প্রচলন ছিল প্রাচীন মিশর, চীন, ভারত, প্রাক-সেলটিক ইউরোপ, পপুয়া নিউগিনি ইত্যাদি স্থানে। ইংরেজ নৃতত্ত্ববিদ এডওয়ার্ড টাইলর প্রথম এই বিষয়টি সবার গোচরে আনেন। তিনি এর নাম দেন কুভাড (Couvade), যাকে বাংলায় বলা যায় (ডিমে) ‘তা দেওয়া’। কোনো নারী গর্ভবতী হলে তার স্বামী বা নিকটজন কোনো পুরুষ এই আচার পালন করত। মনস্তত্ত্ববিদ ক্যারেন হর্নাই একে বলেছেন- (পুরুষের) ‘গর্ভ ঈর্ষা’ (Womb envy)। কয়েক দশক আগে থেকে এ যুগের পুরুষদের মধ্যে এক ধরণের সমস্যা লক্ষ্য করা গেছে যাকে বলা হচ্ছে কুভাড সিন্ড্রোম (Couvade syndrome). এমন নামকরণের কারণ হল- এই সমস্যা দেখা দেয় গর্ভবতী নারীদের স্বামী বা সঙ্গীর মধ্যে। গর্ভকালে নারীদের যেসব শারীরিক ও মানসিক উপসর্গ দেখা দেয় তার অনেকগুলোই থাকতে পারে কুভাড সিন্ড্রোমে আক্রান্তদের। যেমন- সকালে বমিভাব, হালকা ‘প্রসব-বেদনা’, প্রসব-পরবর্তী বিষন্নতা ইত্যাদি। চমকপ্রদ ব্যাপার হচ্ছে নারীদের ক্ষেত্রে যেসব হরমোনের বৃদ্ধির কারণে এসব উপসর্গ দেখা দেয়, পুরুষের ক্ষেত্রেও সেগুলোর পরিমাণ মোটামুটি বেড়ে যায়। এসব পুরুষের দেহে দুগ্ধ তৈরির হরমোন প্রোল্যাকটিনের পরিমাণ শতকরা ২০ ভাগ বৃদ্ধি পায়। ‘স্ত্রী হরমোন’ এস্ট্রোজেন এবং সংকট মোকাবেলা করার হরমোন কর্টিসোলও বেড়ে যায়। অন্যদিকে ‘পুরুষ হরমোন’ টেস্টোস্টেরন কমে যায়। হরমোনের এই পরিবর্তন পুরুষের মানসিক অবস্থাকে সন্তান পালনের অন্য পুরুষের চেয়ে অধিক উপযোগী করে।২০ এই ঘটনা থেকে নারীপুরুষের মনস্তত্বের জৈবনিক ভিত্তি সম্পর্কে জীববিজ্ঞানীদের পূর্বতন ধারণা বেশ কিছুটা পাল্টে গেছে। মস্তিষ্কের গঠন ও হরমোনের তারতম্য দেখে ঢালাওভাবে বলে দেওয়া যাচ্ছে না যে-নারীর শরীর ও মানসে মাতৃত্বভাব জন্মগত এবং সার্বজনীন এবং পুরুষের জৈবনিক প্রক্রিয়া মাতৃসুলভ (সন্তান বাৎসল্য এবং সন্তানপালনের সক্ষমতা ) বৈশিষ্ট্য বর্জিত। অন্যান্য মানসিক বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রেও তাই। নরনারীর মানসগত পার্থক্যের জৈবিক ভিত্তিকে অনুধাবনের অনেক পর্যায়ে তাই বহুমাত্রিক বিচার বিশ্লেষণ করা জরুরি। তা না হলে আমরা বড় ধরণের ধারণাগত বিভ্রান্তিতে পড়তে পারি।

জন্মগতভাবে নারীপুরুষের মানসিক প্রবণতার পার্থক্য কতটুকু, এর জৈবিক-ভিত্তি কী এবং পরিণত মানস গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে এর প্রভাব কেমন তা আমাদের এই আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। মন কোনো বায়বীয় বস্তু নয়, এর বস্তুগত অস্তিত্ব আছে। জীববিজ্ঞানের আধুনিক জ্ঞান অনুযায়ী বস্তুগতভাবে মনের অস্তিত্ব পুরোপুরিই মস্তিষ্কের ভেতরে। শরীরের অন্যান্য অংশে যেমন নারীপুরুষের ক্ষেত্রে পার্থক্য রয়েছে, মস্তিষ্কের গঠন ও কার্যপ্রণালীতেও রয়েছে বেশ কিছু ভিন্নতা। জীববিজ্ঞানের সাম্প্রতিক আবিষ্কার মানসিক প্রবণতার জৈবিক-ভিত্তি সম্পর্কে অনেক সুনির্দিষ্ট তথ্য ও উপাত্ত দিতে পারছে। তবে এসব তথ্য ও উপাত্তকে আমাদের মাত্রাজ্ঞান ও বাস্তবতার নিরিখেই বিচার করতে হবে। অতীতে অনেক ক্ষেত্রেই আমরা দেখেছি সরলীকৃত, পক্ষপাতদুষ্ট এবং নির্ধারণবাদী (deterministic) ব্যাখ্যার মাধ্যমে জৈবনিক প্রক্রিয়া সম্পর্কিত তথ্য উপাত্তগুলোকে প্রচলিত বৈষম্যমূলক ধারণার পক্ষে ব্যবহৃত হতে। জৈব-নির্ধারণবাদ (Biological determinism) বা এ ধরণের বিচ্যুতিগুলোকে বর্ণবৈষম্য, লিঙ্গবৈষম্য, দাসপ্রথা ইত্যাদি নানা ধরণের বৈষম্যের পক্ষে ধারণাগত ভিত্তি তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই এ ধরণের অপব্যবহার ছিল উদ্দেশ্যমূলক। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এগুলো উদ্দেশ্যমূলক ছিল না বরং বিজ্ঞানী ও গবেষকদের চিন্তায় প্রচলিত ধারণার প্রতি পক্ষপাতের কারণে তারা জৈব-নির্ধারণবাদী ব্যাখ্যায় উপনীত হয়েছেন। জীববিজ্ঞানে পর্যবেক্ষিত সত্য-ঘটনাগুলোকে (facts) ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে এইসব বিচ্যুতির কথা আমাদের মনে রাখতে হবে।

যে বয়সে শিশুদের উপর সমাজের বিশেষ কোনো প্রভাব থাকে না সে বয়সের মেয়ে শিশু ও ছেলে শিশুর উপর বিভিন্ন মনস্তাত্বিক গবেষণার মাধ্যমে আন্দাজ করা গিয়েছিল যে জন্মগতভাবে বা প্রকৃতিগতভাবে নারীপুরুষের মানসিক প্রবণতায় ভিন্নতা রয়েছে । কিন্তু মস্তিষ্কের ভেতর নারীপুরুষের মানস নিয়ন্ত্রণকারী অংশগুলোর গঠন ও কার্যকারীতা সম্পর্কে বস্তুগত তথ্য উদঘাটন করতে সক্ষম হয়েছে আধুনিক স্নায়ু-বিজ্ঞান (Neuro-science)। জীববিজ্ঞানের এই শাখা মস্তিষ্কে মনের অবস্থানকে আরও সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করেছে। মস্তিষ্কের কর্টেক্সের নিচে অবস্থিত একটি অঞ্চল আমাদের মানসিক বিভিন্ন ক্রিয়াকর্মের নিয়ন্ত্রক। প্রযুক্তিগত উন্নতির কারণে গত তিনদশকে এগুলোর গঠন ও ক্রিয়াকর্ম সম্পর্কে অত্যন্ত স্পষ্ট ও বিশদভাবে জানা সম্ভব হয়েছে। ইতোপূর্বে মস্তিষ্ক সম্পর্কে জানার একমাত্র উপায় ছিল লাশের ব্যবচ্ছেদ। কিন্তু এই যুগে মানবদেহের বিভিন্ন অংশের অন্তর্ভেদী (গভীরকে  উন্মোচনকারী) প্রতিবিম্ব তৈরির প্রযুক্তির মাধ্যমে জীবিত মানুষের মস্তিষ্কের গঠন ও কার্যকলাপ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাচ্ছে। জীবিত মানুষ কোন ধরনের মানসিক ক্রিয়ার জন্য মস্তিষ্কের কোন অংশকে ব্যবহার করে আধুনিক নিউরো-রেডিওলজি তার ছবি অনেক নিখুঁতভাবে প্রতিবিম্বিত করতে পারছে। নিউরো-ফিজিওলজির আধুনিক জ্ঞান মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপের জৈব-রাসায়নিক ভিত্তি সম্পর্কেও অনেক পরিপূর্ণ ধারণা দিতে সক্ষম হচ্ছে। জন্মগতভাবে এবং বংশগতির দিক থেকে নারী পুরুষের মস্তিষ্কের গঠন ও কার্যকারিতার পার্থক্যও এখন অনেকটাই স্পষ্ট। এর ফলে নারীপুরুষের মানসিক জন্মগত পার্থক্যের বস্তুগত ভিত্তিকে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে। মস্তিষ্কের যে সব অংশে আমাদের মানসিক ক্রিয়া-কর্ম চলে তাকে আমরা আমাদের মনের অবস্থান বলে চিহ্নিত করতে পারি। এই অংশগুলোকে মোটামুটি ৭টি কার্যকরি অঞ্চলে ভাগ করা যায়। নারী ও পুরুষের ক্ষেত্রে এই অংশগুলোর আকার এবং কার্যকারিতা এক নয়। যদিও এই পার্থক্যগুলো প্রকারগত নয় মূলত মাত্রাগত। আমাদের এই আলোচনার প্রয়োজনে এই অংশগুলো সম্পর্কে এবং নারী পুরুষের ক্ষেত্রে এগুলোর গঠন কার্যগত পার্থক্য কী তা সংক্ষেপে জেনে নেব। ( দেখুন ছক-১)

চিত্র ১: মস্তিষ্কে মনের অঞ্চলের বিভিন্ন্ অংশ। ২১  

ছক ১ : মস্তিষ্কের মানসিক ক্রিয়া-কর্ম নিয়ন্ত্রক অংশ সমূহ-

 

অংশের নাম

কার্যকারিতা

নারী ও পুরুষে পার্থক্য

1

সিঙ্গুলেট কর্টেক্সের সম্মুখভাগ

[Anterior Cingulate Cortex (ACC)]

বিভিন্ন বিকল্পের মধ্যে কোনটি উপযুক্ত তা বিচার করে, সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। একে বলা যায় সমস্যা নিয়ন্ত্রক কেন্দ্র।

পুরুষের চেয়ে নারীর ক্ষেত্রে আকারে বড়।

2

প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্স

[Prefrontal Cortex (PFC):]

এটি আবেগ নিয়ন্ত্রণের মূল কেন্দ্র। আবেগকে দুর্নিবার হতে বাধা দেয়। এটি অ্যামিগডেলাকে ব্রেকের মত নিয়ন্ত্রণকরে।

পুরুষের চেয়ে নারীর ক্ষেত্রে আকারে বড়। এবং পুরুষের চেয়ে নারীর ক্ষেত্রে আগে পরিণত হয়।

3

ইন্সুলা (Insula)

বাস্তবতাকে অনুমান ও আন্দাজের ক্ষমতাকে (Gut feelings) নিয়ন্ত্রণ ও প্রক্রিয়াকরণ করে।

সক্রিয় নারীদের ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত বড়।

4

হ্ইাপোথ্যালামাস

(Hypothalamus)

হরমোন নিঃসরণের সমন্বয়কারী। বয়সন্ধিতে টেসটিস ও ওভারিকে সক্রিয় করে।

বয়সন্ধিতে নারীদের ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত আগে সক্রিয় হয়।

5

অ্যামিগডেলা

(Amygdala)

এটি হল পাগলা ঘোড়া। আমাদের রিপু বা

প্রবৃত্তির মর্মস্থল। শুধু PFC এটাকে বশীভূত করতে পারে।

পুরুষের ক্ষেত্রে আকারে বড়।

6

পিটুইটারি গ্রন্থি

(Pituitary Gland)

সন্তান জন্মদান ক্ষমতা, বুকের দুধ তৈরি এবং মাতৃসুলভ প্রবণতা বৃদ্ধিকারী হরমোন নিঃসরণ করে।

বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই।

7

হিপোক্যাম্পাস

(Hippocampus)

ক্রোধ, বিবাদ, রাগ, অনুরাগ, রোমান্স সকল ধরণের আবেগময় অনুভূতির স্মৃতি সংরক্ষিত রাখে।

পুরুষের চেয়ে নারীর ক্ষেত্রে আকারে বড় এবং অধিক সক্রিয়।

নারী ও পুরুষের মস্তিষ্কের মানস নিয়ন্ত্রণকারী অংশ এবং এই অংশের উপর প্রভাবসৃষ্টিকারী শারীরতাত্ত্বিক জৈব-রসায়নের ক্ষেত্রে বেশ কিছু জন্মগত পার্থক্য রয়েছে। এই পার্থক্য শুধু গঠন এবং আকারের নয়। বিভিন্ন জৈব রাসায়নিক উপাদানের (যেমন-হরমোন) প্রতি মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের প্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্রেও নারীপুরুষের মধ্যে ভিন্নতা রয়েছে। জৈবিক এই পার্থক্য নারী ও পুরুষের পৃথক মানসিক গঠনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখলেও শুধু জৈবিক ছাঁচে তাদের মানস গড়ে ওঠে না। সামাজিক সম্পর্ক ও সামাজিক তাগিদ এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখে। এমনকি মস্তিষ্ক ও শারীরতাত্ত্বিক প্রক্রিয়ার মধ্যে বেশ কিছুটা নমনীয়তা (Plasticity) থাকে যার কারণে সামাজিক ও পরিবেশগত তাগিদের সঙ্গে অভিযোজনের জন্য বেশ কিছুটা শারীরতাত্ত্বিক পরিবর্তন ঘটতে পারে। ১নং ছকে মস্তিষ্কের এই পার্থক্যকে ভালো ভাবে লক্ষ্য করলে মনে হয়- নারী পুরুষের চেয়ে আবেগ নিয়ন্ত্রণে বেশি দক্ষ। নারীর বাস্তবতা সম্পর্কে অনুমান ও আন্দাজের ক্ষমতা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাও পুরুষের চেয়ে বেশি। পুরুষ নারীর চেয়ে অনেক আগ্রাসী, ইন্দ্রিয় পরায়ণ এবং উগ্র। রাগ, ক্রোধ, আবেগময় অনুভূতি, রোমান্স ইত্যাদিও স্মৃতি পুরুষের চেয়ে নারীর ক্ষেত্রে দীর্ঘ মেয়াদী ও গভীর। কিন্তু আসল বাস্তবতা হল গঠনের এসব পার্থক্য থেকে মোটাদাগে বলা যাবে না সকল নারী মানসিকভাবে এরকম এবং পুরুষেরা সেরকম হবে। এখানে আমরা দেখছি আবেগকে নিয়ন্ত্রণকারী অংশ PFC পুরুষের চেয়ে নারীর ক্ষেত্রে আকারে বড় এবং পুরুষের চেয়ে নারীর ক্ষেত্রে আগে পরিণত হয়; তার মানে এই নয় যে সর্বক্ষেত্রেই নারী পুরুষের চেয়ে কম আবেগ প্রবণ এবং আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পুরুষের চেয়ে বেশি পারদর্শী হবে। এর ভিত্তিতে বড়জোর আমরা বলতে পারি জৈবিকভাবে তাদের (নারীপুরুষের) প্রকৃতির তার এমনভাবে বাধা যে তাদের মধ্যে মানসিকভাবে এরকম হবার প্রচ্ছন্ন সম্ভাবনা (potential) রয়েছে। যে কোনো জীব বা জৈবসত্তার (individual) ক্ষেত্রে এই প্রচ্ছন্ন সম্ভাবনাকে বলা হয় জৈবনিক সম্ভাবনা (Biological potential)। মস্তিষ্কের মানস-নিয়ন্ত্রণকারী অংশের জৈবনিক সম্ভাবনার সঙ্গে তার উপর সামাজিক পরিবেশের প্রভাবের মিথষ্ক্রিয়ায় প্রতিটি নারীপুরুষের পৃথক মানসিক প্রবণতা, ব্যক্তিত্ব ও আচরণের নির্দিষ্ট ধরন গড়ে ওঠে।

বড়জোর আমরা বলতে পারি জৈবিকভাবে তাদের (নারীপুরুষের) প্রকৃতির তার এমনভাবে বাধা যে তাদের মধ্যে মানসিকভাবে এরকম হবার প্রচ্ছন্ন সম্ভাবনা (potential) রয়েছে। যে কোনো জীব বা জৈবসত্তার (individual) ক্ষেত্রে এই প্রচ্ছন্ন সম্ভাবনাকে বলা হয় জৈবনিক সম্ভাবনা (Biological potential)। মস্তিষ্কের মানস-নিয়ন্ত্রণকারী অংশের জৈবনিক সম্ভাবনার সঙ্গে তার উপর সামাজিক পরিবেশের প্রভাবের মিথষ্ক্রিয়ায় প্রতিটি নারীপুরুষের পৃথক মানসিক প্রবণতা, ব্যক্তিত্ব ও আচরণের নির্দিষ্ট ধরন গড়ে ওঠে।

প্রাইমেটদের বিভিন্ন প্রজাতির ক্ষেত্রে দেখা গেছে, যে প্রজাতির ক্ষেত্রে সামাজিক বন্ধন যত কম তাদের মানসিক প্রবণতায় জৈবিক প্রবৃত্তির প্রভাব তত বেশি। মানুষের ক্ষেত্রে শক্তিশালী সামাজিক প্রভাবের কারণে যে কোনো বৈশিষ্ট্যের জৈবনিক সম্ভাবনা পরিবর্তিত রূপে প্রকাশিত হয়। অর্থাৎ PFCআকারে বড় হলেও সামাজিক পরিবেশ অনেক নারীকেই বেশি আবেগপ্রবণ করে তুলতে পারে। আবার ভিন্ন পরিবেশে গড়ে ওঠা নারীকে দেখা যায় শক্তভাবে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে। একশো মাইলের মধ্যে বসবাসকারী তিনটি বিচ্ছিন্ন আদিবাসী জাতিসত্তার উপর পর্যবেক্ষণে নৃতাত্ত্বিক মার্গারেট মিড প্রতিটি গোষ্ঠিতে নারীপুরুষের মানসের বড় ধরনের ভিন্নতা লক্ষ্য করেন। আরাপেশ (Arapesh) জাতি-গোষ্ঠিতে নারীপুরুষ উভয়ে নমনীয় স্বভাবের, মুন্ডুগোমর (Mundugumor) জাতিগোষ্ঠিতে নারীপুরুষ উভয়ে আগ্রাসী স্বভাবের এবং চানবুলি (Tchanbuli) জাতি-গোষ্ঠিতে নারীরা আমাদের সংস্কৃতির বিপরীত। অর্থাৎ নারীরা কর্তৃত্ব ও আধিপত্যময় এবং পুরুষেরা নমনীয় স্বভাবের।২২ মস্তিষ্কের গঠন অনুযায়ী নারীদের অধিক নমনীয় এবং পুরুষদের অধিক আগ্রাসী হবার কথা। কিন্তু (মস্তিষ্কের জৈবনিক সম্ভবনা প্রতিটি জাতিগোষ্টির নারীপুরুষের মধ্যে মোটামুটি এক হলেও) সামাজিক পরিবেশের ভিন্নতার কারণে মানসের প্রকাশিত রূপ হয়েছে ভিন্ন। অতএব, জৈবিক বাস্তবতা প্রকাশিত বৈশিষ্ট্যের মৌলিক ভিত্তি হলেও এর প্রভাবকে পরিবর্তন করা সম্ভব, পরিবেশ, বুদ্ধি ও ইচ্ছাশক্তির মাধ্যমে।

এই পরিপ্রেক্ষিতে একটা প্রশ্ন সামনে আসে, তাহল- কেন নারীপুরুষের মস্তিষ্কের মানস-নিয়ন্ত্রণকারী অংশে এই পার্থক্যের উৎপত্তি হল? জীববিজ্ঞানে এই ‘কেন’এর উত্তর পাওয়া যায় জীবের বিবর্তনিক অতীত থেকে। অর্থাৎ ঐ জীবের মধ্যে কোনো একটি বৈশিষ্ট্যের উৎপত্তি হয়েছে কারণ তার বিবর্তনিক অতীতের কোনো এক পর্যায়ে ওই বৈশিষ্ট্যটি তার পূর্বপুরুষের টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় ছিল। বিবর্তনমূলক মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন যে অভিযোজনিক তাগিদ (Selection Pressure) থেকে নারীপুরুষের মস্তিষ্কে এই বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য হয়েছে তার প্রধান কারণ যৌন প্রজননে নারী ও পুরুষের ‘বিনিয়োগ’ এর ভিন্নতা। অন্যান্য যে সব প্রতিকূলতার সঙ্গে অভিযোজনের জন্য অভিযোজনিক তাগিদ সৃষ্টি হয় [যেমন- রোগ, সংহারকারী (Predator), খাদ্যাভাব ইত্যাদি থেকে রক্ষা পাওয়া] সেগুলোর প্রভাব নারীপুরুষের উপর সমান। কিন্তু প্রজননে নারী পুরুষের ভূমিকা সমান নয়। বিবর্তনবৃক্ষে মানুষের বর্গ (Order) প্রাইমেটদের অধিকাংশ প্রজাতির মধ্যে প্রজননে পুরুষ প্রাণীর অংশগ্রহণ যৌন সঙ্গম পর্যন্ত। এরপর গর্ভধারণ, সন্তান জন্মদান এবং সন্তানকে লালন করা (তার খাবার জোগাড় করা, তাকে বিপদ থেকে রক্ষা করা) ইত্যাদি কাজে পুরুষ প্রাণীদের বিশেষ কোনো অংশগ্রহণ থাকে না বললেই চলে। এপদের   (নরবানর) অধিকাংশের ক্ষেত্রেই এটা সত্য। শিম্পাঞ্জি মা জন্মের পর প্রথম ছয়মাস এক মুহূর্তও সন্তানকে কাছ ছাড়া করে না। ওরাংওটাং মা নিজেই ছয় থেকে সাত বছর একাধারে সন্তানকে পালন করে। মানুষ এ দিক থেকে কিছুটা ব্যতিক্রম হলেও মানুষ ও এপদের সাধারণ পূর্বসূরি প্রজাতিগুলোর (Common Ancestor Species) মধ্যে ব্যাপারগুলো এমনই ছিল। এই বাস্তবতায় পুরুষকে তার যৌনসঙ্গী পাওয়ার জন্য অন্য পুরুষদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতে হয়। যে পুরুষ শক্তিশালী, ইন্দ্রিয়পরায়ণ ও আগ্রাসী মনোভাবের এক্ষেত্রে তারই অধিক সংখ্যক যৌনসঙ্গী জোগাড় করা এবং সন্তান জন্মদানে সাফল্য পাওয়ার সম্ভবনা বেশি থাকে। তাই ওইসব প্রজাতির পুরুষ প্রাণীর মস্তিষ্কে এমন বৈশিষ্ট্য প্রাকৃতিকভাবে নির্বাচিত হয়েছে যা তাকে আগ্রাসী ও ইন্দ্রিয়পরায়ণ করবে। অন্যদিকে সন্তান-ধারণ, সন্তানের নিরাপত্তা বিধান এবং সন্তানের বেঁচে থাকার উপকরণ জোগাড় করতে গিয়ে প্রজাতির স্ত্রী-প্রাণীকে হতে হয় অনেক বেশি কৌশলী, বাস্তববাদী ও আপোষকামী। অতএব, তাদের মস্তিষ্কেও এমন বৈশিষ্ট্যই প্রাকৃতিকভাবে নির্বাচিত হয়েছে যা তার মানসকে ঐ সব বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করবে।

পূর্বসূরি প্রজাতির প্রাণীদের মস্তিষ্কের ওই বৈশিষ্ট্য থেকেই নরনারীর মস্তিষ্কের এই বৈশিষ্ট্যগুলো এসেছে বলেই বিবর্তমূলক মনোবিজ্ঞানীদের ধারণা। যদিও অধিকাংশ এপ্ এবং মানুষ ও এপদের সাধারণ পূর্বসূরি প্রজাতিগুলোর সঙ্গে মানুষের সন্তানের নির্ভরতা-কাল এবং সন্তান পালনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে। সন্তানধারণের কালের দিক থেকে মানুষ ও এপদের ক্ষেত্রে বড় ধরনের পার্থক্য নেই। কিন্তু এপ্ সন্তানের (মায়ের উপর) নির্ভরতা-কাল গড়ে মানুষের চেয়ে কম। এপ্ সন্তান গড়ে ৯-১০ বছর বয়সে পূর্ণবয়স্ক হয় (এরপর আর নির্ভরশীল থাকে না) যেখানে (বন্যাবস্থায়) মানুষের সন্তানের ক্ষেত্রে এই বয়স ১৪-১৬ বছর। অন্যদিকে এক সন্তান থেকে পরের সন্তান জন্মের মধ্যবর্তী সময় এপদের ক্ষেত্রে মানুষের চেয়ে বেশি। মানুষের ক্ষেত্রে এই সময় গড়ে তিন বছর যেখানে গরিলাদের চার বছর, শিম্পাঞ্জিদের সাড়ে ছয় বছর এবং ওরাংওটাংদের সাড়ে আট বছর।২৩ এই বাস্তবতায় সন্তান পালনের ভার মানুষের জন্য দুদিক থেকেই বেশি এবং নারীদের পক্ষে এপ্ মায়েদের মত একজন সন্তানের প্রতি সম্পূর্ণ নিয়োজিত হওয়া বা পরিপূর্ণভাবে মনোযোগ দেয়া সম্ভব হয় না। মা কর্তৃক শিশু সন্তানকে পরিত্যাগ করা এবং হত্যা করার ঘটনাও মানব প্রজাতিতে এপদের চেয়ে অনেক বেশি।২৪ এই বাস্তবতার কারণেই মানুষের মধ্যে সন্তান পালনের এমন ধরন বিবর্তিত হয়েছে যেখানে মাতাপিতা উভয়ে অংশ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক অনেক গবেষণার ফলে স্পষ্ট হয়েছে যে সভ্যতার উদ্ভবের অনেক আগের থেকেই মানবীরা সন্তান জন্মদান, সন্তান পালন ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাদের পুরুষ যৌন-সঙ্গী এবং সমাজের বা গোষ্ঠির অন্যান্য নারী পুরুষের (Allo-parents) সহায়তা পেয়েছে।২৫ এটা হয়ত আধুনিক মানুষের (Homo Sepiens) পূর্বসূরি হোমিনিড প্রজাতিগুলোর মধ্যেও ছিল, যাদের মধ্যে সমাজবদ্ধতা ছিল অনেকটাই আধুনিক মানুষদের মত।

আধুনিক নিউরো-অ্যানাটমি এবং নিউরো-ফিজিওলজি আমাদের মানসিক প্রক্রিয়ার শারীরতাত্ত্বিক ভিত্তি সম্পর্কে স্পষ্টতর উপলব্ধি দিতে পেরেছে। কিন্তু এই জ্ঞানের একরৈখিক প্রয়োগ করতে গিয়ে জীববিজ্ঞানীদের মধ্যে অনেকেই নির্ধারণবাদী বিভ্রান্তিতে আক্রান্ত হন। সন্তান ধারণ ও সন্তান পালনের সময় নারীর শরীরে হরমোনগত পরিবর্তন ঘটে এবং এই হরমোনগুলি মস্তিষ্কের সেই অংশগুলোকে উদ্দীপ্ত করে যেগুলোর সক্রিয়তা সন্তানের প্রতি মনোযোগ ও আগ্রহ বাড়ায়। এর থেকে ধারণা করা হয় যে, নারীর ক্ষেত্রে সন্তান বাৎসল্য পরিপূর্ণভাবে একটি জৈবিক ব্যাপার এবং এর প্রভাব অনেক শক্তিশালী। সে কারণে তার ক্ষেত্রে এর অন্যথা (বাৎসল্য-বিরোধী) হওয়া সম্ভব নয় বা ‘প্রাকৃতিক নয়’। এটি নারীর ‘গভীরতম প্রবণতা’ এমন ধারণা থেকে অনেক জীববিজ্ঞানীও মুক্ত নন। যে কোনো প্রজাতির ক্ষেত্রে কোনো একটি বৈশিষ্ট্য যদি জৈবিক হয় তা সার্বজনীন হবার কথা। অর্থাৎ যেসব নারী মা হয়েছে তাদের সবার মধ্যেই একইভাবে থাকার কথা। কিন্তু উপরে মা-কর্তৃক শিশুসন্তানকে পরিত্যাগ করা এবং হত্যা করার যে ঘটনার কথা বলা হয়েছে তা এখনও মানুষের অনেক বন্যাবস্থার আদিবাসী জনগোষ্ঠির মধ্যে নিয়মিত একটি ব্যাপার। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল দক্ষিণ আমেরিকার আইরো ইন্ডিয়ান আদিবাসীরা। নৃতত্ত্ববিদ পল বুগোস ও লরেন ম্যাক্কার্টি তাদের অনুসন্ধানে দেখতে পান এদের একটি জনগোষ্ঠিতে ১৪১টি নবজাতকের মধ্যে ৫৪ জন মা-কর্তৃক নিহত হয়েছে। তারা হিসেব করে দেখেন কিশোরী মায়েদের ক্ষেত্রে শিশু হত্যা সর্বাধিক (প্রায় শতকরা ৫০ ভাগ পর্যন্ত)। একাধিক সন্তানের ভার নিতে না পারা বা অন্য পুরুষের সঙ্গে যৌন-সম্পর্ক স্থাপনই এদের ক্ষেত্রে শিশু হত্যার মূল কারণ। অপর একটি গবেষণায় উইলসন ও ডালি দেখান শিশু হত্যার বেশিরভাগ ঘটে ছোট শিশুর ক্ষেত্রে (নবজাতক থেকে বড়জোর সবেমাত্র হাঁটতে শিখেছে এমন)।২৬ উন্নত সমাজে, যেখানে শিশুকে জন্ম দেওয়া, খাওয়ানো, প্রকৃতির প্রতিকুলতা থেকে রক্ষা করা ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রেই সামাজিক সহায়তা পাওয়া যায় সে সমাজের নারীদের মাতৃ-মানসিকতা এবং বন্য-অবস্থায় প্রতিকুল আদিবাসী সমাজের নারীদের মাতৃ-মানসিকতা এক নয়। সন্তান জন্মের সময় উভয় সমাজের নারীদের একই ধরনের শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন ঘটে। কিন্তু মাতৃ-মানসিকতার ক্ষেত্রে বড় ধরনের পার্থক্যের কারণ হচ্ছে এই মানসিকতা পরিপূর্ণভাবে জৈবিক নয় বরং জৈবিক ও সমাজিক বাস্তবতার মিথষ্ক্রিয়ায় সৃষ্ট।

বয়সন্ধিতে (puberty) মেয়েদের শরীরে ইস্ট্রোজেন, প্রোজেস্টেরন ইত্যাদি হরমোনের বিপুল প্রবাহ দেখা দেয়। এ সম্পর্কে একজন নিউরো-বায়োলজি বিশেষজ্ঞ লিখেছেন- “যৌনবাসনায় (বিপরীত লিঙ্গের কাছে) আকাঙ্ক্ষিত হওয়াই বয়সন্ধিতে একটি মেয়ে তার জৈবিক অস্তিত্বের কারণ (raison d’être) বলে মনে করে। তার বয়সী অন্যান্য মেয়ে এবং মিডিয়ার আকর্ষণীয় নারীদের প্রতিচ্ছবির সঙ্গে সে নিজেকে তুলনা করতে থাকে। নারীর বংশগতির প্রাচীন নকশার উপর নানারকম নতুন হরমোনের জোয়ারের ফলে সৃষ্টি হয়েছে মস্তিষ্কের এই অবস্থা।”২৭ বয়সন্ধিতে মেয়েদের মানসিক অবস্থাকে এভাবে বর্ণনা করা একরকম সরলীকরণ যার থেকে জৈবনির্ধারণবাদী বিচ্যুতি ঘটতে পারে। বয়সন্ধিতে হরমোনের পরিবর্তন বালক-বালিকাদের বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি করে কিন্তু সেটাকেই শুধু তাদের জৈবিক অস্তিত্বের কারণ ভাবা, এমন মানসিকতা সার্বজনীন কোনো ব্যাপার নয় সেকারণে মনে হয় এই মানসিকতায় সামাজিক পরিবেশেরও প্রভাব রয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন সংষ্কৃতিতে বয়সন্ধির বাস্তবতা ভিন্ন হওয়ায় কিশোর কিশোরীদের মানসিক অবস্থাও ভিন্ন হয়ে থাকে। নৃতত্ত্ববিদেরা লক্ষ্য করেছেন, অনেক বন্য অবস্থার ও আদিবাসী সংস্কৃতিতে যৌন বিধিনিষেধ এবং সামাজিক সংস্কার কম থাকায় বয়সন্ধির যৌনতা সংক্রান্ত মানসিক সংকট অনেক কম হয়ে থাকে। এ বয়সে মেয়েদের অন্যান্য শক্তিশালী প্রণোদনা থাকলেও বিপরীত লিঙ্গের কাছে আকর্ষণীয় হওয়ার ব্যাপারটা তাদের মানসিকতার মূল নিয়ন্ত্রক হয় না।২৮ জীববিজ্ঞানের তথ্যের এরকম একরৈখিক বিশ্লেষণ এভাবে আমাদের ভুল ও বিভ্রান্তির দিকে নিয়ে যেতে পারে।

আমাদের সমাজের জনপ্রিয় কালচারে এ ধারণা বেশ প্রবল যে- ‘নারী বা পুরুষের মানসিকতার ক্ষেত্রে বড় ধরনের পার্থক্য রয়েছে এবং এই পার্থক্যের বেশির ভাগটাই জন্মগত’, যা অনেকাংশেই সত্য নয়। প্রচলিত ধারণার মধ্যে নারী ও পুরুষের মানসিকতার যে স্টেরিওটাইপ রয়েছে তার অনেকটাই তৈরি হয়েছে ভিন্ন সামাজিক বাস্তবতার সঙ্গে তাদের মানিয়ে নেবার প্রচেষ্টার ফলে। সামাজিক বাস্তবতা সম্পর্কে অসচেতনতার কারণেই নারীপুরুষের মানসের পার্থক্যকে অনেক সময় ভুলভাবে জৈবিক পার্থক্য বলে চিহ্নিত করা হয়। অন্যদিকে জৈবিক পার্থক্যের একরৈখিক বিচার জন্ম দেয় জৈব-নির্ধারণবাদের। আমাদের এই যাত্রায় এই উভয় বিচ্যুতিই পরিত্যাজ্য।

মস্তিষ্কের মানস নিয়ন্ত্রণকারী অংশ এবং এই অংশের উপর প্রভাব সৃষ্টিকারী শারীরতাত্ত্বিক জৈব-রসায়নের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য আছে কিন্তু তা অপরিবর্তনীয় ও স্থির কোনো বিষয় নয়। এই পার্থক্য সত্ত্বেও বেশিরভাগ নারীপুরুষ যে কোনো মানসিক অবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম। চার দশক আগেও ধারণা ছিল শৈশবের প্রথম দু-তিন বছর পরে মস্তিষ্কের গঠন ও আকারের বিশেষ কোনো পরিবর্তন হয় না। নিউরো-ইমেজিং-এর উন্নতির ফলে গত দুই দশক ধরে বোঝা যাচ্ছে আগে যা ভাবা হয়েছিল মস্তিষ্কের কর্টেক্সের বৃদ্ধি তার চেয়ে আরও অনেক দীর্ঘমেয়াদী। বাল্যকালের পরেও পরিবর্তিত হবার জন্য এর মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণে নমনীয়তা (Plasticity) থাকে। কৈশোরে কিছুটা কমে গেলেও, যৌবনের প্রথম বছর পর্যন্ত এই পরিবর্তন চলমান থাকে। আমাদের সমাজের জনপ্রিয় কালচারে এ ধারণা বেশ প্রবল যে- ‘নারী বা পুরুষের মানসিকতার ক্ষেত্রে বড় ধরনের পার্থক্য রয়েছে এবং এই পার্থক্যের বেশির ভাগটাই জন্মগত’, যা অনেকাংশেই সত্য নয়। প্রচলিত ধারণার মধ্যে নারী ও পুরুষের মানসিকতার যে স্টেরিওটাইপ রয়েছে তার অনেকটাই তৈরি হয়েছে ভিন্ন সামাজিক বাস্তবতার সঙ্গে তাদের মানিয়ে নেবার প্রচেষ্টার ফলে। সামাজিক বাস্তবতা সম্পর্কে অসচেতনতার কারণেই নারীপুরুষের মানসের পার্থক্যকে অনেক সময় ভুলভাবে জৈবিক পার্থক্য বলে চিহ্নিত করা হয়। অন্যদিকে জৈবিক পার্থক্যের একরৈখিক বিচার জন্ম দেয় জৈব-নির্ধারণবাদের। আমাদের এই যাত্রায় এই উভয় বিচ্যুতিই পরিত্যাজ্য।

মনিরুল ইসলাম: বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, লেখক ও শিক্ষক, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ।

ইমেইল: monirul852@gmail.com  

তথ্যসূত্র :

১৮. Ann Camble: A Mind of Her Own: The Evolutionary Psychology of Wmnen, Oxford University Press, 2002, pp-34

১৯. Louann Brizendine :Female Brain, Broadway Books, 2006,New York, pp-6-7

২০.  Ibid, pp- 104-105

২১. Ibid, pp- xiii

২২. Mead, M. (1935). Sex and temperament in three primitive societies. New York: Morrow, pp-279-280.

২৩.   GaldikasB M  Wood J W: Birth spacing patterns in humans and apes; Am J Phys Anthropol, 1990 Oct;83(2):185-91.

২৪. Hrdy S.B. :Infanticide as a Primate Reproductive Strategy; AMERICAN SCIENTIST. Vol.65.No.1, January-February 1977, pp. 40-49

২৫. Hrdy S.B. :Meet the Alloparent: Shared child care may be the secretof human evolutionary success; Natural History Magazine, April/2009.

২৬. Malcom Potts and Roger Short: Ever Since Adam and Eve, The Evolution of Human Sexuality; Cambridge, MA: Havard University Press ,1999.pp-181-182.

২৭. Louann Brizendine : Ibid; pp-31-32.

২৮. Choudhury S. :Culturing the adolescent brain: what can neuroscience learn from anthropology? ; Soc Cogn Affect Neurosci. 2010 Jun-Sep; 5(2-3): 159–167.

Social Share
  •  
  •  
  • 834
  •  
  •  
  •  
  •  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *