রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধের রাজনৈতিক অর্থনীতি

পাটশিল্প বিশেষ ক্রোড়পত্র-২

রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধের রাজনৈতিক অর্থনীতি

মোশাহিদা সুলতানা

ছবি: বাংলা ট্রিবিউন

আমি একবার পাটমেলায় গিয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বর্ণাঢ্য আয়োজন করা হয়েছিল সেবার। পাটজাত পণ্যের এত রকমের বৈচিত্র্য থাকতে পারে, সেদিন প্রথম আবিষ্কার করেছিলাম। ব্যাগ, শাড়ি, পর্দা, সোফা, গিফট বক্স, গয়না, ল্যাম্পশেড, কার্পেট থেকে শুরু করে ঘর সাজানোর নানান রকম উপকরণ ও শিশুদের খেলনায় এত বৈচিত্র্য আমাকে সত্যিই মুগ্ধ করেছিল। বহুদিন ধরেই শুনে আসছি যে, আমরা দেশীয় ও বৈশ্বিক চাহিদা মেটাতে পণ্যের ডিজাইন ও মানের মধ্যেবৈচিত্র্য আনতে পারিনি। আমি আশাবাদী হয়ে উঠেছিলাম পাটের ভবিষ্যৎ নিয়ে। এই আশাবাদের কারণ শুধু এই নয় যে বাংলাদেশ পরিবেশবান্ধব এই শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে বিশ্বের কাছে নতুন করে পরিচিত হবে।এই আশাবাদের কারণ ছিল, এর মধ্যে দিয়ে অতীতের ধ্বংস হয়ে যাওয়া কর্মসংস্থানগুলো নতুন করে ফিরে আসবে। দেশেরশ্রমিকের মুখে হাসি ফুটবে আর প্রতিটি পণ্যের বুননে বুননে সেই হাসি উদ্ভাসিত হতে থাকবে। মেলা থেকে কেনা পাটের ব্যাগ আর শাড়িটা অতি যত্নে ব্যবহার করেছি, এখনো করছি। এত মমতার কারণ হয়তো পাঠ্যবইয়ে পাটকে সোনালি আঁশ হিসাবে চেনার সঙ্গে সঙ্গে আমরা মনের পটে কৃষক-শ্রমিকের হাসিও এঁকে নিয়েছিলাম সেই শৈশবেই। আর তাই পাট বললেই আমি এর পরিবেশবান্ধব বৈশিষ্টের পাশাপাশি এর পেছনের কৃষক-শ্রমিকদের জীবন জীবিকা দেখতে পাই।

বিভিন্ন সময় লক্ষ করেছি, পাটকলের শ্রমিকদের বকেয়া আদায়ের দাবিতে রাস্তায় নামতে হয়েছে, ভুখা মিছিল করতে হয়েছে, নিজেদের ন্যায্য অধিকারের দাবিতে অনশন করতে হয়েছে।

বিভিন্ন সময় লক্ষ করেছি, পাটকলের শ্রমিকদের বকেয়া আদায়ের দাবিতে রাস্তায় নামতে হয়েছে, ভুখা মিছিল করতে হয়েছে, নিজেদের ন্যায্য অধিকারের দাবিতে অনশন করতে হয়েছে। এর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জেনেছি, দীর্ঘদিন তাঁদের বেতন দেওয়া হয়নি লোকসানের অজুহাত দেখিয়ে। এমনকি এই করোনাকালেও যখন বকেয়া বেতনের দাবিতে শ্রমিকেরা শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করেছেন, তাঁদের ওপর গুলি চালিয়েছে পুলিশ। শেষ পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে গত ১ জুলাই, ২০২০থেকে ২৬টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জেগেছে, দেশ-বিদেশে যখন পাটের চাহিদা বেড়ে চলেছে, তখন ঠিক এই মহামারির সময় পাটকলগুলো বন্ধ করতে চাওয়ার উদ্দেশ্য কী? কিছুদিন আগেও না পত্রিকায় পড়লাম চামড়াশিল্পকে পেছনে ফেলে পাটশিল্প এগিয়ে? আর অর্থনৈতিক লাভ ক্ষতির অজুহাতই যদি আসে, কেন সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও মাঝে মাঝে লাভ করলেও রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো লোকসানের ভরকেন্দ্র হিসেবে এতটা পরিচিতি অর্জন করেছে, যেখানে বেসরকারি পাটকলগুলো কিভাবে চলছে, কেন লাভ-লোকসান করছে, বন্ধও হয়ে যাচ্ছে তা নিয়ে কোনো আলোচনা নেই? তাহলে এই দুই মডেলের পার্থক্য কি এই পাটকল বন্ধের রাজনৈতিক অর্থনীতি বুঝতে কোনো দিক নির্দেশনা দেয়? এই প্রবন্ধে এই দুই মডেলের পার্থক্য তুলে ধরে দেখানোর চেষ্টা করব কেন রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধ করা ব্যাক্তিমালিকানাধীন পাটকলগুলোর স্বার্থ রক্ষার পথ নিশ্চিত করে।

কেন সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও মাঝে মাঝে লাভ করলেও রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো লোকসানের ভরকেন্দ্র হিসেবে এতটা পরিচিতি অর্জন করেছে, যেখানে বেসরকারি পাটকলগুলো কিভাবে চলছে, কেন লাভ-লোকসান করছে, বন্ধও হয়ে যাচ্ছে তা নিয়ে কোনো আলোচনা নেই? তাহলে এই দুই মডেলের পার্থক্য কি এই পাটকল বন্ধের রাজনৈতিক অর্থনীতি বুঝতে কোনো দিক নির্দেশনা দেয়?

করোনাসংকট বনাম রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের পরিকল্পিত লোকসান

অনেকেই ভাবছেন, চারদিকে অনেক ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, লোকসান হচ্ছে, তাই টিকে থাকতে না পেরে করোনাকালে হয়তো এই পাটকলগুলোও লোকসানের কারণে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে। কিন্তু যা ভাবানোর চেষ্টা করা হয়, তার পেছনেও আরও কিছু থাকে, যা সহজ চোখে ধরা পড়ে না। অর্থাৎ লোকসানের অজুহাতটি মোটেই এত সহজ ও সাধারণ নয়। রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো দীর্ঘদিন ধরেই লোকসান করে আসছিল। লোকসানেরকারণগুলোও বহুদিন ধরেই জানা। বিভিন্ন সময়ে লোকসানের কারণ হিসাবে দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, সমন্বয়হীনতা, পাট ক্রয়ে সিন্ডিকেটের প্রভাব, আধুনিকায়নে গাফিলতি, বাজারজাতকরণে উদ্যোগের অভাব এগুলোকে চিহ্নিত করা হলেও এই ব্যাপারে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। বরং লোকসানের অজুহাত দেখিয়ে বিভিন্ন সময় শ্রমিকের বকেয়া বেতন দেওয়া হয়নি, পেনশনের অর্থ আটকে দেওয়া হয়েছে, এবং পাটকল বন্ধ করে তা খুব অল্প দামে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। আশির দশক থেকেই লোকসানের অজুহাত দেখিয়ে পাটকল বন্ধের দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়েছে। এরপর কিছু বেসরকারিকরণ করা হয়েছে,কিছু কোনোদিন চালু করা হয়নি, অথবা পরিত্যক্ত জমি দেখিয়ে ঋণ নিয়ে অন্য কিছু করা হয়েছে। অর্থাৎ অতীত অভিজ্ঞতা দিয়েই বোঝা যায়, বন্ধ করে দেয়ার পরিকল্পনা আসলে এবারও আগেই করা হয়েছিল, তা বাস্তবায়ন করা হয়ে ওঠেনি। শেষ পর্যন্ত দুর্যোগের সময় সংকটগ্রস্ত অর্থনীতির অজুহাত দেখিয়ে অযৌক্তিক ও অন্যায্য এই পদক্ষেপকে গ্রহণযোগ্যকরার চেষ্টায় এই সময়টাকে বেছে নেওয়া হলো।

২৬টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধ করলে গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমেবর্তমানে কর্মরত ২৪ হাজার ৮৮৬ জন শ্রমিকের প্রাপ্য বকেয়া মজুরি, শ্রমিকদের পিএফ জমা, গ্র্যাচুইটি এবং সেই সঙ্গে গ্র্যাচুইটির সর্বোচ্চ ২৭ শতাংশ হারে অবসায়নের সুবিধা একসঙ্গে শতভাগ পরিশোধ করা হবে বলে জানিয়েছে মন্ত্রণালয়। গোল্ডেন হ্যান্ডশেক ও ২০১৪ সাল থেকে অবসরপ্রাপ্ত ৮ হাজার ৯৫৪ জন শ্রমিকের প্রাপ্য সব বকেয়া পরিশোধ বাবদ সরকারি বাজেট থেকে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হবে। এতে শুধু প্রায় ২৫ হাজার শ্রমিক কর্মহীন হবেন না, চুক্তি ভিত্তিতে নিয়োজিত আরো  প্রায় ২৬ হাজার শ্রমিক ও এর সঙ্গে জড়িত অন্যান্য মানুষের জীবিকা হুমকির সম্মুখীন হবে। কর্মহীন হয়ে যাওয়া এই বিপুলসংখ্যক শ্রমিককে আশ্বস্ত করতে গিয়ে পাটমন্ত্রী জানিয়েছেন, গোল্ডেন হ্যান্ডশেক দেওয়ার পর সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের (পিপিপি) মাধ্যমে পাটকলগুলোকে আধুনিকায়ন করে উৎপাদনমুখী করা হবে। তখন এসব শ্রমিক সেখানে চাকরি করার সুযোগ পাবেন। সাধারণভাবে দেখলে মনে হবে, শ্রমিকদের নিশ্চয়তা তো দেওয়াই হলো, আর বন্ধ করার মানে হলো নতুন করে চালু হওয়া। কিন্তু এই আশা দেখানো মোটেই এত সরল নয়। কারন এর পরে যা হতে যাচ্ছে তা নিয়ে অনিশ্চয়তাই শুধু নেই, করোনাকালীন অর্থনীতি পুনরুদ্ধারেও পাটকল বন্ধের কোনো ভূমিকা নেই। কারণ, এর মধ্যে দিয়ে অর্ধ লক্ষাধিক মানুষের জীবিকাকে হুমকির মধ্যে ফেলে দেয়া হল।

সরকারের প্রতিশ্রুতির উপর অনাস্থা

যে কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সময়ে পাটকলের শ্রমিকদের সময়মতো বকেয়া বেতন পরিশোধ করতেই ব্যর্থ হয়েছে, সিন্ডিকেটের চক্র ভাঙতে ব্যর্থ হয়েছে, প্রতিবাদ সমাবেশ দমনে পুলিশ লেলিয়ে দিয়েছে, সেই কর্তৃপক্ষের এ ধরনের প্রতিশ্রুতির ওপর শ্রমিকেরা ভরসা করবে কী করে? আর লোকসান কমানোর সমস্ত উপায়যখন জানা আছে, তখন অগণতান্ত্রিক উপায়ে নেওয়া এমন সিদ্ধান্ত তাঁরা কী কারণেমেনে নেবেন? ৫০০০ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা হলেও এখনো পরিষ্কার নয় যে আসলে শ্রমিকদের পাওনা কত টাকা। ঘোষণার পর একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়েছে শ্রমিকদের প্রকৃত পাওনা হিসাবের জন্য। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে পিএফ, গ্র্যাচুইটি ও গোল্ডেন হ্যান্ডশেক সুবিধাসহ অবশিষ্ট সকল পাওনার ৫০%স্ব স্ব ব্যাংক হিসাবে এবং বাকী ৫০% স্ব স্ব নামে সঞ্চয়পত্র আকারে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে পরিশোধ করা হবে। উল্লেখ্য সরকার স্থায়ী শ্রমিকদের পাওনা বেতন পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দিলেও অস্থায়ী শ্রমিকেরা কোনো সুবিধা পাবেন না। তাতে প্রায় ১৮ হাজার ২০০ জনবদলি শ্রমিক এবং প্রায় ৭ হাজার অস্থায়ী শ্রমিকের জীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এর আগে আদমজী জুটমিলের বহু অস্থায়ী শ্রমিক মিল বন্ধের সময় কোনো সুবিধা পাননি বলে এবারও শ্রমিকেরা অনাস্থায় ভুগছেন।  

যে কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সময়ে পাটকলের শ্রমিকদের সময়মতো বকেয়া বেতন পরিশোধ করতেই ব্যর্থ হয়েছে, সিন্ডিকেটের চক্র ভাঙতে ব্যর্থ হয়েছে, প্রতিবাদ সমাবেশ দমনে পুলিশ লেলিয়ে দিয়েছে, সেই কর্তৃপক্ষের এ ধরনের প্রতিশ্রুতির ওপর শ্রমিকেরা ভরসা করবে কী করে?

অনিশ্চয়তা নিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করলেও তাদেরকে নানানভাবে ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে। পাটকল এলাকায় পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে যেন তারা সংগঠিত হতে না পারে। প্রথমে খুলনার ইস্টার্ন জুট মিলের শ্রমিক নেতা অলিয়ার রহমান এবং প্লাটিনাম জুট মিলের শ্রমিক নেতা নূর ইসলামকে গভীর রাতে সাদা পোশাক পরিহিতরা ধরে নিয়ে এবং তাদের গ্রেপ্তার অস্বীকার করে এলাকায় আতংক তৈরির চেষ্টা করা হয়। পরে একবছর আগের একটি ঘটনার জের ধরে তাদের গ্রেপ্তার দেখায় পুলিশ।অস্থায়ী শ্রমিকেরা যেন আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারেন সেজন্যই পরিকল্পিতভাবে এই থমথমে পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে। এতে সুবিধা প্রাপ্তি নিয়ে সরকারের উপর শ্রমিকদের অনাস্থা আরো ঘনীভূত হয়েছে।

প্রথমে খুলনার ইস্টার্ন জুট মিলের শ্রমিক নেতা অলিয়ার রহমান এবং প্লাটিনাম জুট মিলের শ্রমিক নেতা নূর ইসলামকে গভীর রাতে সাদা পোশাক পরিহিতরা ধরে নিয়ে এবং তাদের গ্রেপ্তার অস্বীকার করে এলাকায় আতংক তৈরির চেষ্টা করা হয়। পরে একবছর আগের একটি ঘটনার জের ধরে তাদের গ্রেপ্তার দেখায় পুলিশ।অস্থায়ী শ্রমিকেরা যেন আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারেন সেজন্যই পরিকল্পিতভাবে এই থমথমে পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে।

গত ২১শে জুলাই অর্থমন্ত্রনালয় প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে যে জুন মাসের ১ সপ্তাহের বকেয়া মজুরি এবং ৬০ দিনের নোটিশ মেয়াদের মজুরি এবংঅপরিশোধিত নববর্ষ ভাতা পরিশোধের জন্য সরকার ৮০ কোটি ৭৯ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। সরকার যদি গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে পাওনা পরিশোধ করতই তাহলে একটু একটু করে টাকা পরিশোধের অর্থ কী? তাছাড়া অবসরে যাওয়া শ্রমিকদের পাওনা তো বহুদিন আগের। তাদের অর্থ ছাড়ের পেছনে কারন কী? এর আগে শ্রমিকেরা দেখেছেন অবসর ভাতা পাবার জন্য বৃদ্ধ শ্রমিকেরা সিবিএ নেতাদের পেছনে ঘুরে ঘুরে মোটা অংকের কমিশন দিয়েছেন। কাজেই সব মিলে অন্সথার সংকট, কোথায় যাবেন, কি করবেন এই নিয়ে শ্রমিকেরা কষ্টে দিনানিপাত করছেন।

রাষ্ট্রায়ত্ত পাটশিল্প বেসরকারিকরণ করা হলেই যে সব অব্যবস্থাপনা দূর হয়ে যাবে, লাভ হবে, এ ব্যাপারে কোনো নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না। এর আগে পাটকল ব্যক্তিমালিকানায় দেওয়ার নাম করে সস্তায় জমি ওযন্ত্রপাতি লুটপাট করা, বিশাল জমি দেখিয়ে ব্যাংকঋণ নিয়ে শেষ পর্যন্ত শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ করতে না পারার নজির রয়েছে। এ রকম তিনটি পাটকল যেমন এজ্যাক্স, সোনালি ও মহসিন পাটকল বন্ধের কথা সব শ্রমিকই জানেন।কাজেই পাবলিক প্রাইভেট অংশিদারিত্বের মাধ্যমে নতুন করে মিল তৈরির প্রতিশ্রুতিতে স্বাভাবিকভাবেই তাদের কোনো আস্থা নেই।

এর আগে পাটকল ব্যক্তিমালিকানায় দেওয়ার নাম করে সস্তায় জমি ওযন্ত্রপাতি লুটপাট করা, বিশাল জমি দেখিয়ে ব্যাংকঋণ নিয়ে শেষ পর্যন্ত শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ করতে না পারার নজির রয়েছে। এ রকম তিনটি পাটকল যেমন এজ্যাক্স, সোনালি ও মহসিন পাটকল বন্ধের কথা সব শ্রমিকই জানেন।

রাষ্ট্রায়ত্ত ও ব্যাক্তিমালিকানাধীন পাটকলের মজুরি বৈষম্য

ভবিষ্যতে যে নতুন পাটকলে চাকরিতে বর্তমান শ্রমিকদের অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, তার অর্থ আসলে কী? বিদ্যমান বেসরকারি পাটগুলো বেশির ভাগই অস্থায়ী শ্রমিক নিয়োগের মাধ্যমে ও কম মজুরি দিয়ে খরচ কমিয়ে থাকে। বেসরকারি খাতে মাসিক মজুরি মাত্র ২ হাজার ৭০০ টাকা। অন্যদিকে, ২০১৫ সালে মজুরি কমিশন বিজেএমসির অন্তর্ভুক্ত পাটকলগুলোর মূল বেতন ৮ হাজার ৭০০ টাকা নির্ধারণের পর ২৬টি পাটকলের শ্রমিকদের তা পাওয়ার কথা। অর্থাৎ বিজেএমসির শ্রমিকেরা চাকরিচ্যুত হলে বেসরকারি পাটকলে অস্থায়ীভাবে কাজ করতে হবে এবং তখন তাঁদের বেতন প্রায় তিন ভাগের এক ভাগে নেমে আসবে। এ বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে দুটি বেসরকারি পাটকল মণ্ডল পাটকল ও সাগর পাটকলের মজুরি সম্পর্কে জানতে পেরেছি। এখানে অস্থায়ী শ্রমিকেরা সপ্তাহে ছয়দিন কাজ করলে ১ হাজার ৩০০ টাকা, আবার পাঁচ দিন কাজ করলে ১ হাজার টাকা পান।একজন শ্রমিক পুরো মাস কাজ করলে তাঁর বেতন হয় ৫ হাজার ২০০ টাকা। আবার অস্থায়ী ভিত্তিতে এক দিন কাজ করলে প্রতিদিন একজন শ্রমিক ১৬৫ টাকা পান। কেউ কেউ অন্য মিলে ২৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত পান। অর্থাৎ এখানে কোনো সুনির্দিষ্ট স্কেল নেই।

একটি শ্রমিক পরিবারের বাসস্থান, যানবাহন, চিকিৎসা, শিক্ষা বাবদ খরচ বাদ দিয়ে এবং খাদ্যে প্রয়োজনীয় পুষ্টিমান বাদ দিলেও শুধু এক দিনের খাবার খরচ ২০০ টাকা হয় (প্রতিটি পাঁচ সদস্যের পরিবারে যদি ২.৫কেজি চাল ১০০ টাকা, ১০০ গ্রাম ডাল ১০ টাকা, ৫০০ গ্রাম আলু ১০ টাকা, ডিম/সবজি ৫০ টাকা, তেল, লবণ, পেঁয়াজ, মসলায় ১০ টাকা এবং অন্যান্য ২০টাকা ধরা হলে)। একটি নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে কী করে একজন শ্রমিকের বেতনকোনোমতে টিকে থাকার খাদ্য খরচের চেয়েও কম হয়? কর্মহীন হয়ে যাওয়া শ্রমিকদের চাকরিচ্যুত করে কেন পরে নতুন পাটকলে কর্মসংস্থানের আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে, তা বোঝা খুব সহজ। বেসরকারীকরণ করলে শ্রমিকদেরকে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর মজুরির তিন ভাগের এক ভাগ মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য করানো সহজ হয়ে যাবে। রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের অনুপস্থিতিতে শ্রমিকদের শোষণের জাঁতাকলে পিষ্ট করে পাটকলের মালিকদের লাভ বৃদ্ধি এর মূল উদ্দেশ্য। তাই ১৬৫ টাকা মজুরি আড়াল করে মধ্যম আয়ের দেশের মিথ্যা স্বপ্ন দেখায় পাটমেলার প্রদর্শনীতে। চাকচিক্যের মধ্যে প্রশ্নহীন থেকে যায় বেসরকারি পাটকলের নিম্ন মজুরি।

একটি নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে কী করে একজন শ্রমিকের বেতনকোনোমতে টিকে থাকার খাদ্য খরচের চেয়েও কম হয়? কর্মহীন হয়ে যাওয়া শ্রমিকদের চাকরিচ্যুত করে কেন পরে নতুন পাটকলে কর্মসংস্থানের আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে, তা বোঝা খুব সহজ। বেসরকারীকরণ করলে শ্রমিকদেরকে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর মজুরির তিন ভাগের এক ভাগ মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য করানো সহজ হয়ে যাবে।

পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের খরচ বনাম রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল নবায়ন খরচ

শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ এর আগে কীভাবে প্রযুক্তিগত নবায়নের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি করে পাটকলের লোকসান কমানো যায়, তার একটি প্রস্তাব শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কাছে পেশ করেছিল। তারা প্রস্তাব করেছিলেন, এই নবায়নের সময় পাটকল চার মাস বন্ধ রাখা অবস্থায় শ্রমিকেরা ৫০ ভাগ মজুরি নিতে প্রস্তুত। এর জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখারও প্রস্তাব দেয়। এর পাশাপাশি যন্ত্রাংশ প্রতিস্থাপন করে নবায়ন বাবদ যে খরচ হবে, বাজার যাচাই করে তার একটি হিসাবও উপস্থাপন করেন তারা। সেই হিসাবে ১ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করলেই এই পাটকলগুলোকে নবায়ন করে উৎপাদন বাড়ানো যায় বলে তারা দেখিয়েছেন। অথচ আমরা দেখলাম, এই করোনাকালে অর্থসংকট দেখিয়ে ১ হাজার কোটি টাকা দিয়ে নবায়নের পরিবর্তে পিপিপি করার জন্য প্রাথমিকভাবেই ৫ হাজার কোটি পর্যন্ত খরচ করতে প্রস্তুত সরকার। পরবর্তীতে পিপিপির পেছনের খরচ না হয় বাদই দিলাম। এত দিনের বকেয়া মজুরি দিতে অসুবিধা হলে এখন হুট করে এত টাকা কোথা থেকে আসে? অর্থাৎ যেকোনো মূল্যে পাটকল বন্ধ করে বেসরকারিকরণ করার ব্যাপারে সরকারের একটা বেপরোয়া ভাব লক্ষ করা যায়। আর এরজন্য মোক্ষম সময় হিসেবে করোনাকালকে বছে নিতে তারা একটুও দ্বিধা করেনি। চলমান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে যেন এই লুটপাটের আকাঙ্ক্ষা চোখে না পড়ে, তাইএই তৎপরতা।

তারা প্রস্তাব করেছিলেন, এই নবায়নের সময় পাটকল চার মাস বন্ধ রাখা অবস্থায় শ্রমিকেরা ৫০ ভাগ মজুরি নিতে প্রস্তুত। এর জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখারও প্রস্তাব দেয়। এর পাশাপাশি যন্ত্রাংশ প্রতিস্থাপন করে নবায়ন বাবদ যে খরচ হবে, বাজার যাচাই করে তার একটি হিসাবও উপস্থাপন করেন তারা। সেই হিসাবে ১ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করলেই এই পাটকলগুলোকে নবায়ন করে উৎপাদন বাড়ানো যায় বলে তারা দেখিয়েছেন। অথচ আমরা দেখলাম, এই করোনাকালে অর্থসংকট দেখিয়ে ১ হাজার কোটি টাকা দিয়ে নবায়নের পরিবর্তে পিপিপি করার জন্য প্রাথমিকভাবেই ৫ হাজার কোটি পর্যন্ত খরচ করতে প্রস্তুত সরকার।

পাটকল মডেলে সামাজিক দায়বদ্ধতা: রাষ্ট্রায়ত্ত বনাম ব্যক্তিমালিকানাধীন

 এই রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো স্বাধীনতার পূর্বে ব্যক্তি মালিকানাধীন ছিল। বর্তমান ব্যক্তি মালিকানাধীন পাটকলগুলোর সাথে এই বন্ধ হয়ে যাওয়া রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর একটা গুণগত পার্থক্য রয়েছে। এই পাটকলগুলোর বিশাল জমি ছাড়াও এগুলোকে ঘিরে তৈরি হয় বিদ্যালয়, হাসপাতাল, খেলার মাঠ, বাজার ও মসজিদ। ঐতিহাসিকভাবে এধরনের কলকারখানার মডেল উদ্ভব হয় শুধু শ্রমিকদের দূর দূরান্ত থেকে শহরের দিকে আকৃষ্ট করতেই না, বরং তখন সামাজিক দায়ভারের অংশ হিসেবে ব্যক্তি মালিকানাধীন পাটকলগুলোও এই নাগরিক সুবিধাসহ কারখানার মডেল তৈরি করে। এটা শুধু পাটকলের ক্ষেত্রেই না, আমরা এই বৈশিষ্ট্য দেখে এসেছি চিনিকল, রেলওয়ে, টেলিফোন, বিদ্যুৎ, পানি ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানেও। চিনিকল বা পাটকলের মত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো যখন বিপুল পরিমাণ মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি করে তখন এর সুফল শুধু মালিকেরাই পায় না, একটি জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র এই সুবিধা নাগরিকদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতেও ভূমিকা রাখতে পারে। সে হিসাবে এই মডেলকে পুরনো না বরং বলা যাবে শ্রমিককল্যাণমুখী মডেল। অর্থাৎ শ্রমিকেরা শুধু বেতন নয়, অপর্যাপ্ত হলেও কিছু নাগরিক সুবিধাও পেয়ে এসেছেন। এটি তাদের জীবনকে শুধু নিরাপত্তাই দিয়ে আসেনি, এই পাটকলগুলো ঘিরে গড়ে উঠেছে একটা গোটা কমিউনিটি। এই কমিউনিটির মত প্রকাশের সুযোগ থাকে, সংগঠিত হয়ে দাবি আদায়ের সুযোগ থাকে। সর্বোপরি জীবনের মান উন্নয়নের স্বার্থে তারা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে নাগরিক সুবিধা আদায়ে দর কষাকষিও করতে পারেন।  

অন্যদিকে ব্যক্তি মালিকানাধীন পাটকলগুলোতে শ্রমিকরা অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ পান। এই পাটকলগুলোতে কোনো নাগরিক সুবিধা দেয়া হয় না। দাবি দাওয়া নিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে সংগঠন গড়ে ওঠারও কোনো সুযোগ এখানে নেই। এই নতুন ব্যাক্তিমালিকানাধীন পাটকলগুলো নব্যউদারবাদী মডেল অনুসরণ করে গড়ে উঠেছে যাতে শ্রমিকদের অস্থায়ী নিয়োগ দিয়ে, শোষণ জারি রেখে মুনাফা অর্জন নিশ্চিত করা যায়। বিশ্বব্যাংকের নব্যউদারবাদী পাটখাত সংস্কারের ফলাফল হিসেবেই এই মডেল দাঁড়িয়েছে। এই মডেলে সামাজিক দায়ভার বরাদ্দ (corporate social responsibility fund) থাকে কিন্তু শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে তা ব্যয় করার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।

নব্য-উদারবাদী করপোরেট মডেলে শ্রমিকের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহন, কোনোকিছুই রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে স্বীকৃত অধিকার নয়, বরং পণ্য হিসেবে ধরা হয়। কারণ নব্য-উদারবাদ একই সঙ্গে এসব সেবাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে বাণিজ্যিকীকরণেও উৎসাহিত করে। অর্থাৎ এই মডেল অনুযায়ী শ্রমিকরা শুধু কম মজুরিই পান না, বাজারমুখী অর্থনীতিতে তাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পরিবহনসেবা বাজার থেকে উচ্চমূল্যে কিনতেও বাধ্য করা হয়।

আধুনিক কর্পোরেট মডেলে ব্যবসায়ী শুধু মুনাফা করবে এবং মুনাফার একটি অংশ চাইলে সে সামাজিক দায় মেটাতে স্বেচ্ছায় কাজে লাগাতে পারে। কিন্তু সেই সামাজিক দায় তারা কিভাবে মেটায় সে নিয়ে বিস্তর গবেষণা রয়েছে। এবং দেখা যায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই সামাজিক দায়ের জন্য বরাদ্দ অর্থ শেষ পর্যন্ত ব্যবসার বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করা হয় অথবা ব্যবসা যাদের কাছ থেকে সুবিধা লাভ করে তাদের নেটওয়ার্কের মধ্যে চ্যারিটি হিসাবে দিয়ে গুডউইল প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়। এইসব সামাজিক দায়ভার বরাদ্দকে ব্যবহার করে এভাবেই গড়ে উঠেছে সামাজিক ব্যবসার ধারনাটি। এসকল ব্যবসা সামাজিক ব্যবসা হিসাবে পরিচিত হলেও এগুলোর আসল উদ্দেশ্য পণ্য বা সেবা বাজারজাতকরণ ও বিক্রয়। সামাজিক ব্যবসার নামে এরকম উদাহরণ তৈরি করেছে ড্যানোনের দই। এই দই অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের জন্য তৈরি করে তাদের কাছে বিক্রির কথা বলা হলেও দেখা গেছে, শ্রমিকেরা যে মজুরি পান তা দিয়ে এই দই কেনার সামর্থ্য তাদের থাকে না। অর্থাৎ সামাজিক ব্যবসা নাম হলেও এধরনের পণ্যের ভোক্তা আসলে দেশের স্বচ্ছল অংশই। অর্থাৎ আধুনিক ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল মডেলের মত শ্রমিকদের প্রতি সামাজিক দায় পূরণ করে না।

সামাজিক ব্যবসার নামে এরকম উদাহরণ তৈরি করেছে ড্যানোনের দই। এই দই অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের জন্য তৈরি করে তাদের কাছে বিক্রির কথা বলা হলেও দেখা গেছে, শ্রমিকেরা যে মজুরি পান তা দিয়ে এই দই কেনার সামর্থ্য তাদের থাকে না। অর্থাৎ সামাজিক ব্যবসা নাম হলেও এধরনের পণ্যের ভোক্তা আসলে দেশের স্বচ্ছল অংশই।

আকিজ জুটমিলের মত একটি বড় ব্যক্তিমালিকানাধীন পাটকল, যা বাংলাদেশের পাটসূতার বাজারের এক তৃতীয়াংশ উৎপাদন করে, সেই জুটমিলও অস্থায়ী শ্রমিক নিয়োগ করে। আকিজ জুটমিলের শ্রমিকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিদিনের মজুরি হিসেবে তারা কেউ ১৫৫ টাকা, কেউ ১৮০ টাকা, কেউ ২০০ টাকা, কেউ বা ২৮০ টাকা পর্যন্ত পেয়ে থাকেন। শুধু কিছু অপারেটর ও সিনিয়র অপারেটর ৭৫০০ টাকা থেকে ৮০০০ টাকা পর্যন্ত পেয়ে থাকেন। এই জুটমিলটি ভবিষ্যতে ৫০ হাজার শ্রমিক নিয়োগ করে পাটখাত সম্প্রসারণে অবদান রাখতে চায় কিন্তু শ্রমিকের মজুরি বাড়ানোর ব্যাপারে তাদের কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা চোখে পড়েনি। আকিজ গ্রুপ সামাজিক অবদানের অংশ হিসাবে যে স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছে সেখানে অস্থায়ীভাবে নিয়োগ প্রাপ্ত শ্রমিকেরাতাদের সন্তানদের পড়ানোর সামর্থ্য রাখেন না।

আকিজ জুটমিলের মত একটি বড় ব্যক্তিমালিকানাধীন পাটকল, যা বাংলাদেশের পাটসূতার বাজারের এক তৃতীয়াংশ উৎপাদন করে, সেই জুটমিলও অস্থায়ী শ্রমিক নিয়োগ করে। আকিজ জুটমিলের শ্রমিকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিদিনের মজুরি হিসেবে তারা কেউ ১৫৫ টাকা, কেউ ১৮০ টাকা, কেউ ২০০ টাকা, কেউ বা ২৮০ টাকা পর্যন্ত পেয়ে থাকেন।

বর্তমান সময়ে এসে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি দমন করে যদি এমন কোনো পাটকলের উদাহরণ প্রতিষ্ঠা করা যায় যেখানে শ্রমিকদের তিনগুণ মজুরি দিয়েও লাভ করা যায়,তাহলে বিরাষ্ট্রীয়করণ করে শ্রমিকদের তিনভাগের এক ভাগ মজুরি প্রদানের লাভজনক মডেল প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো যদি বন্ধ না করে নবায়ন করে তারপর ওই একই মজুরি দিয়ে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা যেত এবং তারপর বিরাষ্ট্রীয়করন করে মালিকানা হস্তান্তর করা হত তাহলে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়ত এই আধুনিক বেসরকারি পাটকলগুলো। কারণ তাদের উপরও মজুরি বাড়ানোর চাপ তৈরি হত, সামাজিক দায়বদ্ধতার ব্যাপারে জবাবদিহি করতে হত। সে পথে যেন যেতে না হয়ে তাই এই গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের ব্যবস্থা। আর এর মধ্যে দিয়ে বিস্মৃত হবে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের সামাজিক দায়বদ্ধতার দৃষ্টান্ত। যত বেশি বিস্মৃতি তত বেশি শ্রমিক অধিকার হরনের পথ সুদৃঢ় হয়।

পাটের গুণগত মান ও বৈচিত্র্য: রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বনাম ব্যক্তিমালিকানাধীন পাটকল

রপ্তানি যখন ঊর্ধ্বমুখী, যখন সারা বিশ্বে পাটের কদর বাড়ছে, পণ্য তৈরিতে বৈচিত্র্য বাড়ছে এবং বাংলাদেশের জন্য বিপুল সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্তহয়েছে, ঠিক তখনই দেখছি, বিজেএমসির অন্তর্ভুক্ত ২৬টি পাটকলের অবদান ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। বর্তমানে বিজেএমসির অবদান মোট উৎপাদনের ৮ দশমিক ২১ শতাংশ। রপ্তানিতে এ হার কমে ৪ দশমিক ৪ শতাংশে নেমেছে। কয়েকজন শ্রমিকের সঙ্গে আলাপের সূত্রে জানতে পারলাম, সিন্ডিকেট শুধু বিজেএমসিকে ৭০০ থেকে ১০০০টাকা বাড়তি দামে পাট কিনতেই বাধ্য করছে না, মানসম্পন্ন পাট দিতেও অবহেলাকরছে। কর্মরত পাটকল শ্রমিক বকেয়া বেতন না পেয়ে অর্থকষ্টে পড়ে একটি বেসরকারি পাটকলে কাজ করতে গিয়ে লক্ষ করেছেন, বেসরকারি পাটকল উচ্চমানের পাট ক্রয়করলেও বিজেএমসির পাটকলগুলোয় নিম্নমানের পাট সরবরাহ করা হয়। এর ফলে উৎপাদনহ্রাস পায় এবং লোকসান বাড়ে।

কর্মরত পাটকল শ্রমিক বকেয়া বেতন না পেয়ে অর্থকষ্টে পড়ে একটি বেসরকারি পাটকলে কাজ করতে গিয়ে লক্ষ করেছেন, বেসরকারি পাটকল উচ্চমানের পাট ক্রয়করলেও বিজেএমসির পাটকলগুলোয় নিম্নমানের পাট সরবরাহ করা হয়। এর ফলে উৎপাদনহ্রাস পায় এবং লোকসান বাড়ে।

এছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলে প্রস্তুত সূতা ও পণ্যের বৈচিত্র্যের যে তফাত রয়েছে সেটাও পরিকল্পিতভাবেই করা হয়েছে। নবায়ন না করায় ও নিম্নমানের পাট ব্যবহার করায় রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো সবসময়ই পিছিয়ে ছিল। আকিজ জুটমিল সারা পৃথিবীর প্রায় ৪০টি দেশে যে পাটসূতা রপ্তানি করে তা সারা পৃথিবীর পাটসূতার ২৫% চাহিদা পূরণ করে। এই জুটমিলটি মাত্র ১০ হাজার শ্রমিক নিয়োগ করে যেখানে এত বড় বাজার দখল করে রেখেছে সেখানে বিজেএমসির সদ্য বন্ধ হয়ে যাওয়া ২৫টি পাটকল কেন তা তৈরি করতে পারবে না? এনিয়ে বিস্তর আলোচনা ও বিশ্লেষণের সুযোগ রয়েছে। 

‘ম্যানডেটরি প্যাকেজিং অ্যাক্ট ২০১০’ প্রণয়ন করা হয়েছিল পলিথিন ওপ্লাস্টিকের ব্যবহার কমিয়ে পাটের ব্যবহার বাড়ানোর উদ্দেশ্যে। চাল, গম, আটা, চিনিসহ ১৮টি পণ্যের মোড়ক ব্যবহারে পাটের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার আদেশ জারি হয়েছিল। এগুলো বাস্তবায়ন হলে দেশের বাজারে পাটের বিপুল চাহিদার সৃষ্টি হওয়ার কথা। ইউরোপে পলিথিন শপিং ব্যাগ ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এবং এর বিকল্প হিসেবে পাটের ব্যাগ ও পাটজাত মোড়কের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশের যখন পাট খাতকে শ্রমিকবান্ধব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে পাট খাত সম্প্রসারণের কথা, তখন করোনাকালে বাংলাদেশ একে সংকুচিত করে, শ্রমিকদের কর্মহীন করে যে পিপিপি মডেলের নীতি গ্রহণ করতে চায় তা আসলে পাটপণ্যে কতটুকু বৈচিত্র্য আনতে পারবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। বাংলাদেশের মোট রপ্তানির ৬০% এর বেশি এখনো পাটসূতা। আরো বেশি মূল্য সংযোজন করে যে পাটপণ্য উৎপাদন করা যায় তা এখনো ১০% এর নিচে। ব্যক্তিমালিকানাধীন পাটকলগুলোর রপ্তানির পরিমাণ ৯৬% এর কাছাকাছি,অথচ পাটপণ্যের রপ্তানি কম। এথেকে বোঝা যায় পাটপণ্যে এখনো এত বৈচিত্র্য রয়েছে তা বলা যায় না। অর্থাৎ পাটমেলায় যে পাটপণ্যের সম্ভার দেখেছিলাম তা এখনো মোট রপ্তানির ১০ শতাংশের  নিচে,বরং কাঁচা পাট মোট রপ্তানির প্রায় ২৭ শতাংশ ।

উপসংহার 

পাটের বিপুল সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পাটকলগুলোর টেকসই উন্নয়নের পথ প্রশস্ত করা প্রয়োজন ছিল। পাট ক্রয়ে সিন্ডিকেটের প্রভাব ভাঙা উচিৎ ছিল। এই সিন্ডিকেটের টিকে থাকার ক্ষমতার উৎস তাদের বিদ্যমান ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা। পাটকল বন্ধও নয়, বেসরকারিকরণও নয়, বরং দুর্নীতি টিকিয়ে রাখার জন্য যে চক্র ক্রিয়াশীল হয়ে বছর বছর লোকসানের পরিস্থিতি তৈরি করছে, তাকে নির্মূলকরার মধ্যে দিয়েই একমাত্র পাট খাত সম্প্রসারণ করা সম্ভব ছিল। কিন্তু এসব কিছুই না করে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো বন্ধ করায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হল পাট শ্রমিক। শ্রমিক কল্যাণমুখী একটি মডেলকে চিরতরে বিস্মৃত করে, এক তৃতীয়াংশ মজুরি দেয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুতিতে দেশ এগিয়ে গেল এক ধাপ। প্রয়োজন ছিল বেসরকারি পাটকলগুলোয় ন্যূনতম মজুরি বাড়ানো। তা না বাড়িয়ে যেসব কলে মজুরি বেশি দেয়া হয় সেগুলো বন্ধ করার অর্থ হচ্ছে, শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি দিয়েও যে লাভ করা সম্ভব- এটা শ্রমিকদের স্মৃতি থেকে মুছে ফেলা । 

পাটকল বন্ধও নয়, বেসরকারিকরণও নয়, বরং দুর্নীতি টিকিয়ে রাখার জন্য যে চক্র ক্রিয়াশীল হয়ে বছর বছর লোকসানের পরিস্থিতি তৈরি করছে, তাকে নির্মূলকরার মধ্যে দিয়েই একমাত্র পাট খাত সম্প্রসারণ করা সম্ভব ছিল।

পাটমেলায় দেখানো স্বপ্নে অভিভূত আমি আজকে শ্রমিকদের পরিস্থিতি দেখে অনুধাবন করতে বাধ্য হচ্ছি, পাটশিল্প বিকাশের নামে সরকারেরগৃহীত নীতি কোনোভাবেই শ্রমিকবান্ধব নয়। ২৬টি পাটকল বন্ধের পেছনে রয়েছে শ্রমিক কল্যাণমুখী রাষ্ট্রায়ত্ত মডেল বিস্মৃতির মধ্যে দিয়ে ভবিষ্যতে শ্রমিক শোষণের এক মহাপরিকল্পনা। সোনালি আঁশের বুননে শ্রমিকের হাসির বদলে খুঁজে পাচ্ছি শ্রমিক পিতার শিশুকে মুখে পর্যাপ্ত খাদ্য দিতে না পারার তীব্র যন্ত্রণা।একজন সচ্ছল পিতা যখন পাটের ব্যাগ ভর্তি করে নিজের শিশুর জন্য পর্যাপ্তখাদ্য কিনবেন, আর পাটের ব্যাগের পেছনের কারিগরেরা যখন সন্তানের জন্য সবচেয়ে সস্তা পুঁটি মাছটাও কিনতে না পেরে খালি ব্যাগ নিয়ে ঘরে ফিরবেন, তখন পাটমেলায় প্রদর্শিত পণ্যের উন্নয়ন-চাকচিক্য এক নিমেষে বিলীন হয়ে যাবে।

Social Share
  •  
  •  
  • 193
  •  
  •  
  •  
  •  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *