ভারতীয় নাগরিকত্ব আইন, মুসলমান এবং মহামারী: নয়া করোনা, কৌশল পুরানা

ভারতীয় নাগরিকত্ব আইন, মুসলমান এবং মহামারি: নয়া করোনা, কৌশল পুরানা

সায়েমা খাতুন

ভারতে প্রাণ প্রকৃতি ও মানুষ বিদ্বেষী ফ্যাসিবাদী শাসনের নানা আয়োজন আমরা প্রত্যক্ষ করছি গত বেশ কিছুদিন থেকে। বৃহৎ পুঁজি-হিন্দুত্ববাদ-সাম্রাজ্যবাদের ঐক্যবন্ধন কীভাবে একদিকে মানুষে মানুষে হিংসা বিদ্বেষ অন্যদিকে নাগরিকদের চরম নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করে তা ভারতে প্রকটভাবে প্রকাশিত করোনা আক্রমণের আগে পরে। ভারতে নাগরিকত্ব আইন, সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী প্রচারণার বিশ্লেষণ করে দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন সংহতির গুরুত্ব সামনে এনেছে এই প্রবন্ধ।  

নাগরিকত্ব আইনের মরার উপর করোনা খাঁড়ার ঘা

করোনা মহামারি ভারতে সংখ্যালঘু মুসলিম বিদ্বেষ প্রচারের আরেক মহামারিতে পরিণত হয়েছে। এ বছরের মার্চের গোড়ায় জনসমাবেশের উপর ভারতীয় সরকারের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে দিল্লীর নিজামুদ্দিন মারকাজ  মসজিদে তাবলীগ জামাতের এক পূর্ব নির্ধারিত আন্তর্জাতিক ধর্মীয় সমাবেশে  ৯,০০০ ধর্ম প্রচারক যোগদান করলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এর সাথে ৪,০০০ এর বেশি নিশ্চিত সংক্রমণ এবং ২৭টির মত করোনাজনিত মৃত্যুর যোগ খুঁজে পায়। এই ঘটনাটিকে ‘সুপার স্পেডার’ বলে গণ্য করা হয় এবং তাবলীগ জামাতের সদস্য এবং তাদের সংস্পর্শে আসা ৪০,০০০ মানুষকে কোয়ারান্টিনে পাঠানো হয়। ভারতীয় গণমাধ্যম এই ঘটনাকে ২০ কোটি সর্বভারতীয় মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ প্রচারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যাপকভাবে এমন প্রচার করে যেন ভারতে মহামারি ছড়িয়ে পড়বার জন্য প্রত্যেকটি মুসলমান দায়ী। করোনা মহামারি থেকে রক্ষা পেতে হিন্দুত্ববাদীদের বড় বড় ধর্মীয় সমাবেশ, গো-মূত্রপান অনুষ্ঠানও পাশাপাশি অনুষ্ঠিত হচ্ছিল, কিন্তু বিজেপি নিয়ন্ত্রিত মিডিয়াতে সেগুলোকে ‘সুপার স্প্রেডার’ তকমা থেকে ছাড় দেয়া হয়। মহামারির রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় মুসলমানদের সাথে বৈষম্যপূর্ণ আচরণের সংবাদের সাথে সাথে সামাজিকভাবেও মুসলমানদের কোনঠাসা করবার ঘটনাগুলো প্রকাশিত হচ্ছে। হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদী গণমাধ্যমে মুসলমানদের বিষয়ে সংবাদ পরিবেশনা, ব্যবহৃত ভাষা ও অলংকারে তাদের এক ধরনের ‘বিজ্ঞানবিরোধী’, ‘যুক্তিশীলতাবিরোধী’, ধর্মান্ধ দানবীয় ইমেজকে প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করছে। এসবের মধ্য দিয়ে ভারতে মুসলমানদের যেন অধস্তন দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকের মর্যাদায়উপস্থাপন করা হচ্ছে। দেখুন, এমন একটি কার্টুন।

সূত্র:  https://pbs.twimg.com/media/EVfwUvAXQAEUvv4?format=jpg&name=small

ভারতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে বিদ্বেষপূর্ণ ভাষা প্রয়োগের কৌশল এবং মহামারি মোকাবেলার সাড়ার ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে মুসলিম-বিদ্বেষী নীতি। বিজেপি নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম ‘করোনা জেহাদ’, ‘মুসলিম ভাইরাস’ ধরনের জাতিবিদ্বেষী ও বর্ণবাদী শব্দবন্ধ ব্যবহার করছে। মুসলমানী পোশাকে কাউকে দেখলে রাস্তায় হিন্দুত্ববাদীরা মন্তব্য ছুঁড়ছে, “ঐ করোনা আসছে”, তাদের সাথে মস্করা করেছে, মারতে আসছে। “এটা কি ধরনের ব্যবহার?” – প্রশ্ন করেন, উত্তর মিরাটের দোকানদার, আব্দুর রশিদ। তিনি মুসলিমভীতি ছড়িয়ে দেয়ার জন্যে ভারতীয় গণমাধ্যমকে দায়ী করেন। তাবলীগ জামাত থেকে করোনা- সংক্রমণের খবর ভারতীয় গণমাধ্যমে এমনভাবে ছড়িয়ে দেয়া হতে থাকে যে, মুসলমানরা ইচ্ছাকৃতভাবে ভারতে করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে দিচ্ছে। এই ধরনের পরিবেশনার ফলে মুসলমানরা হিন্দুত্ববাদীদের এবং পুলিশের দ্বারা নিত্যদিন বিদ্বেষপূর্ণ ও সহিংস আচরণের মুখোমুখি হচ্ছেন। ফল বিক্রেতা মোহাম্মদ ইদ্রিস পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে ঠেলায় ফল বিক্রি করতেন। এখন হিন্দু প্রধান পাড়ায় তাকে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। পুলিশ তাদের আটকাচ্ছে, পিটাচ্ছে। মুসলমান ফেরিওয়ালারা এখন কার্যত মুসলমান অধ্যুষিত এলাকা ছাড়া বেচাকেনা করতে পারছে না। এলাকায় এলাকায় অধিবাসীরা মুসলমানদের প্রবেশ ঠেকাতে গেইট বন্ধ করে রেখেছে। ফলে মুসলমানদের ব্যবসা লাটে উঠার যোগাড়। বিজেপির স্থানীয় নেতা ভিনিত আগরওয়াল সারদা, এই তাবলীগি জামাতের প্রচারকদের ‘সুইসাইড বোমাবহনকারী’ হিসেবে অভিহিত করেছেন এবং দাবী করেন যে, কয়েক প্রজন্ম ধরে আর কেউ এমন অপরাধ করতে সাহস না পায়।  (ডয়চে ভেলে, এপ্রিল ১৭,২০২০)।

প্রখ্যাত ভারতীয় লেখক অরুন্ধতী রায় বলেন, ‘ভারতীয় মুসলমানদের সাথে মোদী সরকারের আচরণ ও করোনা মহামারিকে ব্যবহারের কৌশল লক্ষ্য করেন, দেখবেন তা অবিকল ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানীতে ইহুদীদের প্রতি ব্যবহৃত ভাষা ও মতাদর্শের অনুরূপ। ঠিক যেভাবে ইহুদীদের ঘেটোর ভেতর আটকে ফেলা হয়েছিল, তাদের জীবনাচরণকে কলঙ্কিত করা হয়েছিল, টাইফাসের মহামারিকে ব্যবহার করে তাদের অপবাদ, অপমান ও অপদস্ত করা হয়েছিল, ঠিক একই কৌশল ভারতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হচ্ছে।’  অরুন্ধতী ভারতের এই ফ্যাসিবাদী আদর্শের দিকে দ্রুত এগিয়ে যাওয়াকে বিশ্বসমাজের নজরদারীতে রাখবার আহ্বান জানান এবং একে গণহত্যা দিকে মোড় নিতে যাচ্ছে বলে বিশ্বসমাজকে হুঁশিয়ার করে দেন (রায়,২০২০)। তিনি আরও বলেন, এ কেবল করোনার মহামারি নয়, এ ঘৃণা, জাতিবিদ্বেষ, অন্ধবিশ্বাস, ক্ষুধা ও দারিদ্রের মহামারিও। করোনা ভাইরাস ভারতের বিদ্যমান সকল ধরনের বৈষম্যকে বিশ্বের দরবারে সম্পূর্ণ নগ্ন করে ছেড়েছে। মহামারি ছড়িয়ে পড়বার ঠিক আগে নাগরিক আইন সংশোধনীর বিরুদ্ধে গত বছরের ডিসেম্বর থেকে গড়ে ওঠা প্রতিবাদে সামিল দিল্লীর মুসলমাদের উপর সহিংসতায় রাষ্ট্রীয় ইন্ধন এবং সহযোগিতার প্রচুর সাক্ষ্য পাওয়া গেছে। মিডিয়া এই হামলাকে ‘দাঙ্গা’ বলে প্রচার করতে সচেষ্ট ছিল।

এ কেবল করোনার মহামারি নয়, এ ঘৃণা, জাতিবিদ্বেষ, অন্ধবিশ্বাস, ক্ষুধা ও দারিদ্রের মহামারিও। করোনা ভাইরাস ভারতের বিদ্যমান সকল ধরনের বৈষম্যকে বিশ্বের দরবারে সম্পূর্ণ নগ্ন করে ছেড়েছে।

অরুন্ধতী বলেন, এই ট্র্যাজেডি একদম সাক্ষাৎ, বাস্তব, এবং মহাকাব্যিক, কিন্তু এটা কোনভাবেই নতুন কিছু নয় (It is immediate, real and epic, but not new), দীর্ঘ সময় ধরে পরিকল্পিত ছক কেটে একে এগিয়ে নেয়া হয়েছে । কিন্তু দুঃখজনকভাবে বিশ্বনেতারা এই ভয়াবহ পরিণতির দিকে চোখ বন্ধ করে রাখার নীতি গ্রহণ করেছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দিল্লীর সহিংসতার সময় দিল্লীতে থাকলেও এ বিষয়ে একদম নিশ্চুপ ছিলেন। ভারতীয় টিভির উগ্র জাতীয়তাবাদী উপস্থাপকেরা স্টুডিওতে বসেই  খোলাখুলিভাবে ‘মব লিঞ্চিং’ এর উস্কানি দিয়ে যাচ্ছিল, ঠিক যেমনটি রুয়ান্ডার গণহত্যায় মিডিয়া করেছিল। ঠিক সেই একই প্যাটার্ন ভারতে এখন পুনরাবৃত্তি হতে দেখা যাচ্ছে। সামনের দিনগুলোতে অনাহার ও দূর্ভিক্ষের ভয়াবহতা এখনও পুরোপুরি ঠাহর করা যাচ্ছে না।

তবে ভারতে করোনায় আক্রান্ত হয়ে, চিকিৎসার অভাবে, অনাহারে, বেকারত্বে বিশাল সংখ্যক মানুষের মৃত্যুর আশংকা সৃষ্টি হয়েছে, এই মৃত্যুর মিছিলে যে মুসলমান, নিম্নবর্ণের হিন্দু, আদিবাসী, গরীব, শ্রমিক, কৃষক, প্রবীণ ও শিশুদের সংখ্যাই ভারী হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

নাগরিকত্ব আইনে কীভাবে মরছিল মুসলমানরা, হিন্দুরা এবং প্রান্তিক মানুষেরা?

কোভিড- ১৯ মহামারির প্রাদুর্ভাবে দেশব্যাপী স্বাস্থ্যগত জরুরী অবস্থায় লকডাউন ঘোষনার আগ পর্যন্ত ভারতে নাগরিকত্ব সংশোধন আইন, ১৯৫৫ সালে পাশ হওয়া নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনী, CAA (Citizenship Amendment Act 2019), এবং ২০১৫ থেকে শুরু করে ৩১ আগস্ট, ২০১৯ হালনাগাদ করা দেশব্যাপী জাতীয় নাগরিকপঞ্জীর NRC (National Register of Citizens 2019) বিরুদ্ধে নজীরবিহীন প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে উত্তাল ছিল গোটা ভারত। ২০১৮ সালে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ‘এনআরসি নয়’ আন্দোলন সূত্রপাত হয়। দিল্লীর শাহীনবাগে নারীদের নেতৃত্বে সিএএ ও এনআরসি এর বিরুদ্ধে ২০১৯ এর ১৪ ডিসেম্বর থেকে এক অভূতপূর্ব লাগাতার অবস্থান ধর্মঘট বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করছিল যেখানে ১০১ দিন ধরে নারীরা রাতদিন অবস্থান করে বিভিন্ন ধরনের অহিংস প্রতিবাদ অনুষ্ঠান   চালিয়ে আসছিল। ২৩ মার্চে ভারত জুড়ে লকডাউন ঘোষণার ফলে ২৪ মার্চ ২০২০ সরকার তাদের এই সমাবেশ উঠিয়ে নিতে বাধ্য করে।  

এনআরসি অনুযায়ী ২১ ডিসেম্বর ২০১৪ সালের আগে ভারতে আসা লোকজন ৬ বছর ধরে বসবাস করে থাকলে ভারতীয় নাগরিকত্ব লাভের অধিকারী হবে। কিন্তু সেটা প্রমাণ করবার জন্য  প্রয়োজনীয় কাগজ যোগাড় করা অনেকের পক্ষেই সম্ভব হবে না। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ রাজ্যসভায় বলেন যে, ২০২০ সালের মধ্যে সারা দেশে এনআরসি করে দেশের প্রতি ইঞ্চি থেকে অবৈধ অভিবাসীদের বিতাড়ন করা হবে। জেলায় জেলায় ম্যাজিস্ট্রেটদের বিশেষভাবে বিদেশীদের খুঁজে বের করবার জন্যে নিয়োজিত করা হবে।

এর আগে ২০০৩ সালে আসামে অহমীয়দের দাবী অনুসারেই এনআরসি চালু করা হয়েছিল। বিদেশী ও খিলঞ্জীয়া (দেশীয়) অহমীয়দের ভেতর একটা আবেগঘন বিভাজন। আসামে বাঙালী খেদাও আন্দোলনের ফলে অহমীয়ভাষী বনাম বাংলাভাষীদের মুখোমুখি অবস্থান ছিল অনেক দিন ধরে। অহমীয়দের ভয় হচ্ছে যে, বাঙালীরা সংখ্যায় বেশি হয়ে গেলে তাদের চাকরী-ব্যবসা হারিয়ে ফেলবে। শুরুতে অহমীয়দের দাবীর ফলে সেখানে এনআরসি কার্যকর হলে দেখা যায়, ৩.২৯ কোটি অহমীয়দের মধ্যে ২.৯ কোটি নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছেন। ১৯ লক্ষ হিন্দু-মুসলমান এই তালিকা থেকে বাদ পড়ে যায়। অবৈধ অভিবাসী হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার ফলে তারা কার্যত রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়ে। আসামের ক্ষেত্রে যেভাবে এনআরসি করা হয়েছে তাতে কেবল ভারতে জন্ম গ্রহণ করলেই নাগরিকত্ব মিলবে না। ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের মধ্যে যার বাবা-মা, বা পূর্বপ্রজন্মের কেউ ভারতে প্রবেশ করেছে কেবল তারাই ভারতের নাগরিক গণ্য হবে। কিন্তু যদি কেউ সে বছর ভারতে জন্মায়, কিন্তু তার পরিবার এর পরে প্রবেশ করে ৪৮ বছর বয়সে এসে সে-ও অবৈধ বিদেশী নাগরিক হিসেবে গণ্য হবে। ১৯৭১ সালের আগে থেকে বাবা-মা, দাদা-দাদী, নানা-নানীর সাথে এক সাথে বাস করলেও নাগরিক প্রমাণ হবে না, যদি স্বাস্থ্য বিভাগের ইস্যুকৃত জন্ম সনদ না থাকে, অথবা জন্মের এক বছর পরে সনদ ইস্যু না হয়। এরই মধ্যে আসামের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে ব্যর্থ হওয়াদের জন্য ডিটেনশন সেন্টার করা হয়েছে।

২০১১ সাল থেকে ৬টি ডিটেনশন সেন্টারে সরকারি হিসেবেই ২৭ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। গত বছরের মে মাসে গোয়ালপাড়ার ৩৬ বছরের চা ওয়ালা সুব্রত দেকে অবৈধ নাগরিক বলে পুলিশ ডিটেনশন সেন্টারে ধরে নিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত পাঁচজনের সংসার চালাচ্ছিল। সুব্রতের স্ত্রী কামিনী দে বলেন ১৯৫১ সালের আদমশুমারীতে তাদের বাপ-দাদার নাম ছিল। এত জটিলতা  বোঝা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। কেরানীর ভুলে সুব্রতের নাম সুবোধ হয়ে যাওয়াতে তাদের এই ভয়ংকর পরিণতি ভোগ করতে হয়। সম্ভবত এমন অসংখ্য মর্মন্তুদ ঘটনার ফলে উদ্ভুত পরিস্থিতিকে সামাল দেয়ার জন্যেই সিএএকে নিয়ে আনা হয়েছে (আবদুল গনি, আউটলুক ৪ নভেম্বর ২০১৯)।

ছবি: ৩,০০০ লোকের ধারন ক্ষমতা সম্পন্ন আসামের গোয়ালপাড়ায় একটি ডিটেনশন সেন্টার। এমন আরো ১০ টি  সেন্টার তৈরির প্রস্ততি চলছে।

এনআরসির প্রতিক্রিয়া সামাল দিতে ৯ ডিসেম্বর ২০১৯ এ ভারতীয় লোকসভায় সিএএ পাস করা হয় যাতে স্পষ্ট করে পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশে থেকে আগত হিন্দু, খৃষ্টান, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ ও পার্সী- এই ৬ টি ধর্মসম্প্রদায়ের সংখ্যালঘুদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দেয়ার কথা বলা হয়েছে,  কেবল মুসলমানদের বাদ দেয়া হয়েছে। এমন আইন করা হয়েছে যে, বাংলাদেশী নাগরিক ভারত ভ্রমণ করবার সময় ভিসার  মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে হিন্দু হলে প্রতিদিন তাকে যে জরিমানা গুণতে হবে, মুসলমান হলে তা হবে বহুগুণ বেশী। মুসলমান-বিদ্বেষী এই আইনী পরিকাঠামোর সংস্কার ভারতীয় সংবিধানের ১৪ নম্বর ধারার পরিপন্থী, যেখানে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে, “Indian constitution prohibits the state from denying to any person equality before the law or the equal protection of the laws within the territory of India.” এনআরসির ফলে আসামের ১৯ লক্ষ হিন্দু-মুসলমান বাঙালীর রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়বার সম্ভাবনা, নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে না পারা মানুষের জন্যে ডিটেনশন ক্যাম্প তৈরি করা, প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্যে অশুভ বার্তা বহন করে। এক আসামেই এখন ১০ টা ডিটেনশন ক্যাম্প প্রস্তুত আছে, নাগরিকত্ব অস্বীকৃত মানুষদের জন্য তৈরি হচ্ছে আরও জেলখানা। আসামে বিদেশী বললে ‘বাংলাদেশ থেকে আগত অবৈধ অভিবাসী’ বোঝানো হচ্ছে। এতে যে বাংলাদেশকে জড়ানো হয়েছে তা স্পষ্ট এবং তাতে করে বাংলাদেশ যে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের এই আইনের এক অংশীজন হয়ে পড়েছে তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। এনআরসি এবং সিএএর মাধ্যমে ভারত রাষ্ট্র হিসেবে ধর্ম পরিচয় নির্বিশেষে সকল নাগরিকের সমান অধিকারের সাংবিধানিক মূলনীতি এবং ভারতের প্রতিষ্ঠাকারীদের সেকুলার আদর্শের মৌলিক বদল ঘটিয়ে উচ্চবর্ণ হিন্দু ও ধনীদের কর্পোরেট স্বার্থের সংরক্ষণকারী রাষ্ট্রে রূপান্তরের প্রাতিষ্ঠানিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের এই ফ্যাসিবাদী রূপান্তর বাংলাদেশের এবং গোটা দক্ষিণ এশিয়ার জন্যে এক অশনি সংকেত।

মুসলমান-বিদ্বেষী এই আইনী পরিকাঠামোর সংস্কার ভারতীয় সংবিধানের ১৪ নম্বর ধারার পরিপন্থী, যেখানে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে, “Indian constitution prohibits the state from denying to any person equality before the law or the equal protection of the laws within the territory of India.”

অরুন্ধতী রায় বলেন, ভারত সরকার একটি গরীব-বিরোধী, উচ্চবর্ণের কর্পোরেট- মিলিটারি শাসিত রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হতে যাচ্ছে। যেখানে কাগজ-পত্র, নথিতে নাম-পরিচয়ে হাজার বিভ্রান্তি ভারতীয় আমলাতন্ত্রের স্বাভাবিক অবস্থা, গরীব-অশিক্ষিত লোকের পক্ষে এসব দলিল হাজির করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। মামলা-মোকাদ্দমা, কোর্ট-কাছারি করবার মত শিক্ষাগত সামর্থ্য, শক্তি, সময়, যোগাযোগ কোনটাই তাদের নেই। নারীদের ক্ষেত্রে বিয়ের পরে স্বামী শ্বশুরের বাড়ি চলে যাওয়ার ফলে কাগজ-পত্র সঠিকভাবে গুছিয়ে রেখে নিজের নাগরিকত্বের প্রমাণ হাজির করা এক চরম দুর্ভোগের সৃষ্টি করবে। বিশ্লেষকরা আরও বলছেন, ভারতে চরম অর্থনৈতিক সংকটকে আড়াল করতেই ধর্মীয় পরিচয়ের রাজনীতিকে সামনে নিয়ে আসা হয়েছে। তবে এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, বিজেপির মতাদর্শিক নির্দেশনা দাতা হল ১৯২৫ সালে প্রতিষ্ঠিত উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ বা আরএসএস, যার সদস্য সংখ্যা ২০১৬ সালে ৬০ লক্ষ ছাড়িয়েছে। আরএসএসের অভীষ্ট ও কৌশল অনেক পুরনো। 

এনআরসি এবং সিএএর মাধ্যমে ভারত রাষ্ট্র হিসেবে ধর্ম পরিচয় নির্বিশেষে সকল নাগরিকের সমান অধিকারের সাংবিধানিক মূলনীতি এবং ভারতের প্রতিষ্ঠাকারীদের সেকুলার আদর্শের মৌলিক বদল ঘটিয়ে উচ্চবর্ণ হিন্দু ও ধনীদের কর্পোরেট স্বার্থের সংরক্ষণকারী রাষ্ট্রে রূপান্তরের প্রাতিষ্ঠানিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের এই ফ্যাসিবাদী রূপান্তর বাংলাদেশের এবং গোটা দক্ষিণ এশিয়ার জন্যে এক অশনি সংকেত।

১৯৫১ সালের আদমশুমারীর পরে করা ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনের সংশোধন করে সংসদে উত্থাপন করা হয় ‘নাগরিকত্ব সংশোধন আইন ২০১৬’, সিএএ, যা সে সময় অনুমোদন পায়নি। ৯ ডিসেম্বর ২০১৯ সালে শেষ পর্যন্ত এই আইন ভারতীয় লোকসভায় বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে পাশ হয়ে যায়। এই সংশোধনীতে বলা হয় আফগানিস্তান, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সংখ্যালঘু হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান, শিখ ও পার্সী ধর্মাবলম্বীরা ভারতে অবস্থান করলে অবৈধ অভিবাসী বলে গণ্য হবেন না। এই আইন প্রণয়ন করবার পর থেকে এমন ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোন মামলা হয়ে থাকলে তা তুলে  নেয়া হবে এবং তারা স্বাভাবিকীকরণ প্রক্রিয়ায় নাগরিকত্ব লাভের জন্য আবেদন করতে পারবেন। এর জন্যে তাদের ভারতে নিবাসকাল আগের “এগার বছরের কম নয়” এর স্থলে “ছয় বছরের কম নয়” হবে।

এ বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারিতে পূর্ব দিল্লীর জাফরাবাদে সিএএ বিরোধীদের উপর, বিশেষ করে মুসলমানদের টার্গেট করে হিন্দুত্ববাদীদের হামলায় অন্তত ৫৩ জন মৃত্যুবরণ করে। অভিযোগ এসেছে যে, মুসলমানদের বাড়িঘর, ব্যবসা-বাণিজ্যের উপর এলাকার বাইরে থেকে আসা সংগঠিত গোষ্ঠি পরিকল্পিত আক্রমণ চালায়। ঘর-বাড়ি, দোকান-পাট ভাংচুর, জ্বালানো-পোড়ানোর সময়, মানুষের উপর হামলার সময় জরুরী সাহায্য চেয়ে থানার ফোন কলগুলোর কেউ উত্তর দেয়নি এবং দিল্লীর প্রশাসনকে বিস্ময়কর রকম নিষ্ক্রিয় দেখা যায়। মার্চ মাস পর্যন্ত অনেকে নিখোঁজ বলে জানা  গেছে। মুসলমানদের উপর এই সহিংসতা ২০০২ সালে গুজরাটের গণহত্যার পুরোনা স্মৃতি ফিরিয়ে নিয়ে আসে। ফিরিয়ে আনে ৭৩ বছর আগে দেশভাগের ঐতিহাসিক  দাঙ্গা, দেশান্তর ও সহিংসতার মর্মন্তুদ দুঃস্বপ্ন। এর আগে ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৯ এ জামিয়া মিলিয়ায় শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ সমাবেশে পুলিশ নির্মমভাবে হামলা চালায়। ৫ জানুয়ারি ২০২০ এ দিল্লীর জওহরলাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫০ জন মুখোশ পরা সন্ত্রাসী রড, হকিস্টিক, এসিড নিয়ে হামলা চালিয়ে ৩৯ জন শিক্ষার্থী ও শিক্ষককে গুরুতর আহত করে, যারা মূলত বেতনবৃদ্ধি ও সিএএর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছিলেন।

সংসদে এবং গণমাধ্যমের তর্ক-বিতর্কে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী এবং বিজেপির নেতাদের আর এক যুক্তি হল, মুসলমান নিপীড়িত হলে তাদের আশ্রয়ের জন্যে রয়েছে অনেক মুসলমানপ্রধান দেশ। কিন্তু হিন্দুদের আশ্রয় লাভের জন্য রয়েছে কেবল ভারত। বিজেপি নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া কিংবা হালের জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা, যেমন, আধুনিক ভারতীয় আধ্যাত্মিক গুরু সাধগুরু কিংবা বাবা রামদেব এই নাগরিকত্ব আইনকে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের নিপীড়িতের জন্যে হিতকর হিসেবে আলোচনা করেন। তাই যদি হয়ে থাকে, তাহলে শ্রীলংকার তামিল হিন্দু ও মুসলমান, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমান, বাংলাদেশের ও পাকিস্তানের আহমেদিয়া মুসলিম, পাকিস্তানের শিয়া মুসলমানদেরও বিভিন্ন সময়ে নির্যাতন ও নিপীড়নের ইতিহাস রয়েছে। বাংলাদেশে নাস্তিক, নারীবাদী, সমকামী-অধিকারকর্মী এমনকি ভিন্নমতাবলম্বীদের পীড়নের ফলে দেশত্যাগের ঘটনাও আছে। এটি মানবতাবাদী কল্যাণকর আইন হলে সকল ধরনের নিপীড়িত মানুষের আশ্রয় লাভের সুযোগ করে দিতে পারতো। কিন্তু, বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন এক অশুভ ফ্যাসিবাদী চেতনার দ্বারা পরিচালিত। তাই সংখ্যালঘুর নিপীড়ন নিবারণের বাতাবরণে মানবতাবাদী পরিকল্পনা হিসেবে সিএএ-কে বিশ্বাস করবার কোন উপায় নেই।

শ্রীলংকার তামিল হিন্দু ও মুসলমান, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমান, বাংলাদেশের ও পাকিস্তানের আহমেদিয়া মুসলিম, পাকিস্তানের শিয়া মুসলমানদেরও বিভিন্ন সময়ে নির্যাতন ও নিপীড়নের ইতিহাস রয়েছে। বাংলাদেশে নাস্তিক, নারীবাদী, সমকামী-অধিকারকর্মী এমনকি ভিন্নমতাবলম্বীদের পীড়নের ফলে দেশত্যাগের ঘটনাও আছে। এটি মানবতাবাদী কল্যাণকর আইন হলে সকল ধরনের নিপীড়িত মানুষের আশ্রয় লাভের সুযোগ করে দিতে পারতো। কিন্তু, বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন এক অশুভ ফ্যাসিবাদী চেতনার দ্বারা পরিচালিত। তাই সংখ্যালঘুর নিপীড়ন নিবারণের বাতাবরণে মানবতাবাদী পরিকল্পনা হিসেবে সিএএ-কে বিশ্বাস করবার কোন উপায় নেই।

বিজেপির প্রদর্শিত যুক্তি বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তাকে বিশ্বের দরবারে আনুষ্ঠানিকভাবে নিয়মিত সংখ্যালঘু পীড়নকারী দেশ হিসেবে দাঁড় করায়। এ কথা সত্য যে বাংলাদেশ থেকে ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পঞ্চাশের দশক থেকে ১৯৭১ এবং এর পরে বিভিন্ন ধর্মীয় সহিংসতায় বিপুল সংখ্যক হিন্দু (আবুল বারাকাতের হিসাব অনুযায়ী এ পর্যন্ত ১ কোটি ১৩ লাখ, ২০১৬) দেশত্যাগ করেছেন। আরেকটি হিসাবে দেখা গেছে যে, ১৯৭২ সাল থেকে হিন্দু জনসংখ্যার হিসাবে ৪৯ লাখ হিন্দু নিখোঁজ (বড়ুয়া:২০১৭)। কিন্তু আশ্চর্য যে, এই দেশগুলো ভারতের এই অভিযোগ/দাবী নিয়ে এখনও পর্যন্ত তেমন কিছু বলেনি। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর দলিলে দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মিয়ানমার, শ্রীলংকার মত দেশগুলোতে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের উপর নিপীড়নের কমবেশি চিত্র, তথ্য-উপাত্ত আছে। স্বয়ং ভারতেরও বিভিন্নভাবে নিজ দেশের সংখ্যালঘুর জনগোষ্ঠির উপর নিপীড়নের রেকর্ড আছে। দেশভাগের সময় দাঙ্গায় উৎপীড়নের শিকার হয়ে ভারত থেকে পাকিস্তান ও বাংলাদেশে পালিয়ে আসা মুসলমান এবং পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া হিন্দু শরণার্থীদের স্মৃতি এখনও সমাজে জীবন্ত আছে। দক্ষিণ এশিয়ায় এক একটি ধর্মীয় ও জাতি পরিচয়ের আধিপত্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রগুলো বিভিন্নভাবে সংখ্যাগুরুর নামে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে নাগরিক হিসেবে সংখ্যালঘুদের অধিকার সংকুচিত করছে। কিন্তু এ যাবৎ কাল বিশ্বের দরবারে ভারত পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি অর্জন করেছিল। সাংবিধানিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে মোটামুটি ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোয় তার নীতি অনুসরণের পর ২০১৪ তে বিজেপির ক্ষমতায় আসবার পর থেকে আকস্মিক ও অভাবনীয়ভাবে খোলাখুলি একটি হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রে রূপান্তর করতে শুরু করেছে। বিজেপির ভারত তার নিজের দেশের সংখ্যালঘুদের অধিকার সংকোচনে আর কোন রাখঢাক রাখেনি। ধর্ম পরিচয়কে রাষ্ট্রীয় ও আইনী বৈধতায় প্রাধান্য দিয়ে ভারতীয় রাষ্ট্রের মৌল চরিত্রই বদলে দিয়েছে। প্রতিবেশী দেশের নিপীড়িত সংখ্যালঘুদের দুঃখ-ক্লেশ নিবারণের বাহানায় ভারত নিজের দেশের সংখ্যালঘুদের উপর পীড়নমূলক রাষ্ট্রীয় নীতি ও আইন প্রবর্তন করতে শুরু করেছে। এই আইনের প্রতিক্রিয়া কেবল ভারতে সীমাবদ্ধ থাকবে না, পাশ্ববর্তী তিনটি দেশে ছড়িয়ে যেতে পারে বহুমাত্রিক পথে। এটা সহজেই অনুমেয় যে, এটি গোটা দক্ষিণ এশিয়ার বহুজাতিক সমাজের বৈচিত্র্য ও সহিষ্ণুতার চরিত্রের উপর আঘাত হানতে সক্ষম হবে।

একবিংশ শতাব্দীর কোন আধুনিক রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব আইন যে সরাসরি ধর্ম পরিচয়কে নির্দিষ্ট করতে পারে, সেটা গোটা বিশ্বের জন্যই বিস্ময়কর এক অভিজ্ঞতা। ভারতের “নিপীড়িত মুসলমান” ক্যাটেগরি  তৈরি করেছিল উইলিয়াম হান্টারের মত কপট-দরদী ইংরেজ প্রশাসকেরা। পরিচয়ের ক্যাটাগরি তৈরির ক্ষেত্রে ধর্মপরিচয়কে প্রাধান্য দেয়া ছিল ব্রিটিশদের শাসন-কৌশল। ব্রিটিশরাই সারা ভারতের হিন্দুদের জন্য অভিন্ন পারিবারিক আইন এবং সারা ভারতের মুসলমানদের জন্য পৃথক পারিবারিক আইন তৈরি করেছিল, এবং ধর্মের রেখায় বিভাজিত শাসনের নীতি গ্রহণ করেছিল, যা শেষ পর্যন্ত ভারতে হিন্দু-মুসলমানদের সামাজিক বন্ধনের বুনটকে অত্যন্ত কার্যকরভাবে ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হয়েছিল, শেষ পর্যন্ত বৃটিশ শাসনের শেষ কয়েক বছরে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে সম্পর্কের চরম অবনতি থেকে থেকে দাঙ্গা পর্যন্ত গড়ায় । এই নীতি ও মডিউলগুলো এখন বিজেপির শাসনের মূলমন্ত্রে অনুসরিত হচ্ছে, যেখানে ভারতের হিন্দুদের জীবনাচরনের ব্যাপক বৈচিত্র্যকে অস্বীকার করে, এক কল্পিত মিথিক ইতিহাসের মতাদর্শিক আবেগীয় হাতিয়ারে হাজার বছর ধরে একভাবে বিরাজিত মনোলিথিক হিন্দুজাতির কল্পনা করা হয়েছে। আশ্চর্য মিল যে, ‘নিপীড়িত মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র’ এর হীনমন্য কল্পনারই আদলে ‘নিপীড়িত হিন্দুজাতি’ কল্পনা করা হয়েছে, ‘বিদেশী শক্তি যাদের মন্দির ধ্বংস করেছিল’, সেই জাতির জন্য একমাত্র আশ্রয় রূপে আজকের ভারতকে কল্পনা করা হয়েছে। ভারতীয় কংগ্রেস সাংসদ, প্রখ্যাত লেখক শশী থারুর যাকে বলেছেন, ‘হিন্দু পাকিস্তান’। এই হিন্দু জাতি কল্পনায় ভুলে যাওয়া হয়েছে যে, তারা যে ‘গৌরবশালী প্রাচীন হিন্দু জাতি’ কল্পনা করছে তারা একক ধর্মের অনুসারী হওয়ার কারণে হিন্দু বলে অভিহিত হয়নি। সিন্ধু নদীর তীরে বসবাসরত সকল ধর্মবিশ্বাসী মানুষদের হিন্দু বলা হয়েছে, এবং হিন্দু বলে কোন একক বা সমরূপ ধর্মাচরণ নেই। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর জীবদ্দশাতে কেরালার শাসক চেরামান পেরুমল ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে ভারতে প্রথম মসজিদ নির্মাণ করান ৬২৪ খৃষ্টাব্দে। মহম্মদ বিন কাশেম আরব থেকে সিন্ধুতে পৌঁছান ৬৭২ খৃষ্টাব্দে। ৭ম শতাব্দী থেকে ভারতে মুসলমান সমাজ গড়ে উঠতে দেখা গেছে, যারা একাধারে স্থানীয় ধর্মান্তরিত এবং কালে কালে বিভিন্ন দেশ থেকে আগতদের সংমিশ্রণ। বিগত এই হাজার বছরেরও  বেশি সময় ধরে হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্কের গাঁথুনিতেই ভারত হাজার বছর ধরে গঙ্গা ও যমুনার মত বৈচিত্র্যময় ভূ-ভাগের ভেতর প্রবাহিত হয়েছে, যেখানে শাসক-শাসিতের সম্পর্ক পুরোপরি হিন্দু-মুসলমান ধর্মীয় লাইনে ছিল না। শ্রেণী ও বর্ণপ্রথাকে বাদ দিয়ে ভারতীয় জনতার শোষণ-পীড়নকে প্রধান দু’টি ধর্মের লাইন দিয়ে সরল অংক করা প্রতারণামূলক। ভারতে সামজিক স্তরায়ন ও বৈষম্য গভীর ও জটিল। হিন্দু-মুসলমানসহ বিভিন্ন সম্প্রদায় ঐতিহাসিকভাবে এবং বিভিন্ন অঞ্চলে জৈবভাবে সমাজের নকশায় এমনভাবে মিশে আছে যে, একে আচমকা নাগরিকত্বের ছুরি-কাঁচি দিয়ে অস্ত্রোপচার করে আলাদা করা সম্ভব হবে না। অমর্ত্য সেন সম্প্রদায়গুলোর সম্পর্কের গাঁথুনিকেই ভারতের পরিচয়ের মৌল বৈশিষ্ট্য হিসেবে অভিহিত করেছেন; বিভাজিত, একক, একশিলা জাতি পরিচয়কে নয়। শাসক-শাসিতের বাইনারি বিভাজনে এই সম্পর্ক বোঝা যাবে না।

এই নীতি ও মডিউলগুলো এখন বিজেপির শাসনের মূলমন্ত্রে অনুসরিত হচ্ছে, যেখানে ভারতের হিন্দুদের জীবনাচরনের ব্যাপক বৈচিত্র্যকে অস্বীকার করে, এক কল্পিত মিথিক ইতিহাসের মতাদর্শিক আবেগীয় হাতিয়ারে হাজার বছর ধরে একভাবে বিরাজিত মনোলিথিক হিন্দুজাতির কল্পনা করা হয়েছে। আশ্চর্য মিল যে, ‘নিপীড়িত মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র’ এর হীনমন্য কল্পনারই আদলে ‘নিপীড়িত হিন্দুজাতি’ কল্পনা করা হয়েছে, ‘বিদেশী শক্তি যাদের মন্দির ধ্বংস করেছিল’, সেই জাতির জন্য একমাত্র আশ্রয় রূপে আজকের ভারতকে কল্পনা করা হয়েছে।

ব্রিটিশদের ঔপনিবেশিক বিদ্যার কৌশলে কন্যাকুমারিকা থেকে হিমালয় পর্যন্ত সারা ভারতের মুসলমানদের বিচিত্র ও ভিন্ন ভিন্ন রীতি-রেওয়াজের প্রেক্ষিতকে উপেক্ষা করে হিন্দুত্ববাদী বুদ্ধিজীবী, বলিউড, সাহিত্য, টিভি চ্যানেলের সম্মিলিত অবিরাম আগ্রাসী প্রচারণায় মুসলমানদের সমরূপ একটা চেহারা দাঁড় করানো হচ্ছে ‘বিদেশী শক্তি’ রূপে। কিন্তু মুসলমানেরা এই ভারতীয় সমাজের মহামানবের সাগরতীরে হাজার বছর ধরে বিস্তীর্ণ জলরাশির পানির সাথে লবণের মত মিশে গেছে, ভারতই ভারতীয় মুসলমানদের যুগ যুগান্তের মাতৃভূমি – ভারতীয় মুসলমানদের আর কোন দেশ নেই, ভাষা নেই, জাতি নেই। অন্যদিকে বৃটিশ ঔপনিবেশিকদের পিতৃভূমি বৃটেন, যাকে তারা সমৃদ্ধ করেছে ভারতকে লুন্ঠন ও শোষণ করে। অথচ এই কর্পোরেট রাষ্ট্রশক্তি পশ্চিমা ঔপনিবেশিক লুন্ঠন এবং সমাজের গভীরে ক্ষতিকর রূপান্তরণ, বৈশ্বিক পুঁজিবাদী আগ্রাসনের প্রতি সহনশীলতা এবং মিথোজীবিতার সম্পর্কে আগ্রহী। 

ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকদের ক্যাটেগরি করে ভারত আধুনিক রাষ্ট্রের চরিত্রের এক মৌলিক বৈশিষ্ট্য, ধর্মের সাথে রাষ্ট্রযন্ত্রের বিযুক্তি, ধর্মবিশ্বাস নির্বিশেষে সমান অধিকারকেই সরাসরি অস্বীকার করছে যা, এমনকি বিশ্বজনীন মৌলিক মানবাধিকারের চেতনার সাথেও সাংর্ঘষিক। ইসলামী শরীয়তভিত্তিক রাষ্ট্রের ধারণাকে ঠিক একই কারণে এই ধর্ম নিরপেক্ষতা ও বিশ্বজনীন মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রত্যাখ্যান করা হয়। ভারত জুড়ে নজীরবিহীন প্রতিবাদ- প্রতিরোধের মূল জায়গাটা এখানেই যে, রাষ্ট্রের মৌল চেতনার মধ্যে ধর্মীয় পরিচয় রাষ্ট্রের জন্য কোন সুবিধা দেয়া বা না দেয়ার নির্ধারক হতে পারে না।

ইসলামী শরীয়তভিত্তিক রাষ্ট্রের ধারণাকে ঠিক একই কারণে এই ধর্ম নিরপেক্ষতা ও বিশ্বজনীন মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রত্যাখ্যান করা হয়। ভারত জুড়ে নজীরবিহীন প্রতিবাদ- প্রতিরোধের মূল জায়গাটা এখানেই যে, রাষ্ট্রের মৌল চেতনার মধ্যে ধর্মীয় পরিচয় রাষ্ট্রের জন্য কোন সুবিধা দেয়া বা না দেয়ার নির্ধারক হতে পারে না।

আমাদের প্রশ্নটা একেবারে গোড়ায় করা দরকার যে, রাষ্ট্রের নাগরিক হওয়ার সাথে ধর্ম পরিচয়ের কি লেনা-দেনা থাকতে পারে? নাগরিক হিসেবে বৈধতা পাওয়ার ক্ষেত্রে কারো ধর্মবিশ্বাস কিভাবে চাবিকাঠি হতে পারে? ধর্ম-বিশ্বাস ও পরিচয় কি নাগরিকের ব্যক্তিগত বিষয় নয়? রাষ্ট্র কি এতে হস্তক্ষেপ করতে পারবে? এমনকি রাষ্ট্র কি ধর্ম পরিচয় নিয়ে আদৌ প্রশ্ন করার এখতিয়ার রাখবে? অথচ, এই আইনের মাধ্যমে ভারতীয় নাগরিকদের ধর্মপরিচয়কে কি ব্যক্তিগত জায়গা থেকে আইনী ও রাষ্ট্রীয় পরিচয়ে প্রতিষ্ঠা কর হয় না? ধর্ম পরিচয়ে পরিচিত হতে না চাওয়া, কোন ধর্মেই বিশ্বাস না করা, ঈশ্বরের ধারণায় বিশ্বাস না করা, অজ্ঞেয়বাদী বা নাস্তিক হওয়ার কোন সুযোগ কি তাহলে এই ভারতে থাকছে না? যদি তাই হয়, তবে ক্ষমতার জোরে ভারতীয় সমাজকে আমূল বদলে দেয়ার প্রজেক্টেরই এক আইনী ধাপ হল এই নাগরিকত্ব আইন। 

“এই সমস্যার নাড়ী পোঁতা আছে বৃটিশ-ভারতের পার্টিশনে” 

গণসংহতি আন্দোলন আয়োজিত ২৪ ডিসেম্বর ২০১৯ এর সিএএ বিষয়ে গোলটেবিল বৈঠকে নৃবিজ্ঞানের অধ্যাপক সাঈদ ফেরদৌস বলেন, এই সমস্যার নাড়ীপোঁতা আছে বৃটিশ ভারতের পার্টিশনের সহিংসতা, যন্ত্রণা ও দুর্ভোগের মধ্যে। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, সর্বপ্রাণবাদী, প্রকৃতি পূজারী – বিচিত্র ধর্মে বিশ্বাসী বহুজাতির ভারতবর্ষকে স্বাধীনতার স্থপতিরা  কেন মনোলিথিক হিন্দু-মুসলমান দুটিমাত্র জাতির কল্পনা করেছিল, কেমন করে করেছিল, তা আজও এক ধাঁধার মত রয়ে গেছে। এছাড়াও হিন্দুধর্ম নিজেই এক বহুবিচিত্র বিশ্বাস ও আচার-বিচারের সমন্বিত বিশ্বাসের সমষ্টি,  মুসলমানের মধ্যেও আছে শিয়া, সুন্নী, আহমেদিয়া, আহলে-হাদিস, কাদেরিয়া-চিশতিয়া তরিকা, শরীয়তী ও মারেফতি ধারা, বৌদ্ধদের আছে হীনযানী-মহাযানী ধারা। আছে সেকুলার, অজ্ঞেয়বাদী, অবিশ্বাসী, নশ্বৈরিক ও নাস্তিক গোষ্ঠী। চাকমা, গারো, সাঁওতাল, মনিপুরী, হাজং, পাত্র, মুন্ডা, কোল, মুরং, কুকি, লুসাই, বনযোগী, বাজিকর, ধীবর, শবর, যাযাবর, বেদেদের বহু বিচিত্র ধর্মের মানুষদের কথা পার্টিশনের করার সময় ভাবা হয়নি কেন, আজও তার  কোন পরিষ্কার জবাব নেই। ‘হিন্দুন্তান-পাকিস্তান’ বাইনারি পরিচয়ভিত্তিক রাষ্ট্র হলে এতো রকম মানুষেরা কোথায় যাবে? হিন্দুস্তানে ট্রাইবাল এবং আদিবাসীদের কি হবে? মুসলমানের রাষ্ট্রে আদিবাসীদের জায়গা কোথায় হবে – এ নিয়েবিন্দুমাত্র ভাবনা-চিন্তা  করা হয়েছিলো বলে মনে হয়না। 

এছাড়াও হিন্দুধর্ম নিজেই এক বহুবিচিত্র বিশ্বাস ও আচার-বিচারের সমন্বিত বিশ্বাসের সমষ্টি,  মুসলমানের মধ্যে আছে শিয়া, সুন্নী, আহমেদিয়া, আহলে-হাদিস, কাদেরিয়া-চিশতিয়া তরিকা, শরীয়তী ও মারেফতি ধারা, বৌদ্ধদের আছে হীনযানী-মহাযানী ধারা। আছে সেকুলার, অজ্ঞেয়বাদী, অবিশ্বাসী, নশ্বৈরিক ও নাস্তিক গোষ্ঠী। চাকমা, গারো, সাঁওতাল, মনিপুরী, হাজং, পাত্র, মুন্ডা, কোল, মুরং, কুকি, লুসাই, বনযোগী, বাজিকর, ধীবর, শবর, যাযাবর, বেদেদের বহু বিচিত্র ধর্মের মানুষদের কথা পার্টিশনের করার সময় ভাবা হয়নি কেন, আজও তার  কোন পরিষ্কার জবাব নেই।

ভারতীয় কংগ্রেস নেতা মাওলানা আবুল কালাম আজাদ তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম’ এ (১৯৮৮) এই ইঙ্গিত দেন যে, ভারতীয় নিপীড়িত মুসলিমের জন্যে “হাজার বছরের নিপীড়িত ইহুদী”দের ইসরাইল রাষ্ট্রের আদলে মুসলমানদের জন্যে পৃথক বাসভূমির ধারণা পেয়েছিলেন অক্স-ব্রিজ শিক্ষিত মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ লন্ডনে তার তরুণ বন্ধুদের কাছ থেকে। ইহুদী রাষ্ট্রের মডেলে মুসলমানদের জন্যে পৃথক আবাসভূমির ধারণা যে বিভ্রান্ত্রিকর সেটা তারা অনুধাবন করতে সমর্থ হননি। তারা সম্ভবত মুসলমানদের বিস্তীর্ণ ইতিহাসের বৃহৎ বৈচিত্র অনুধাবন করতে সক্ষম বা ইচ্ছুক হয়নি। মুসলমান মুঘলরা ভারতে মাত্র আড়াইশত বছর আগে সাড়ে তিনশত বছর ধরে ভারতের শাসক ছিল, ত্রয়োদশ থেকে ষোড়শ শতক চারশত বছর বাংলা ছিল মুসলমান শাসকদের অধীনে, অটোম্যানরা চৌদ্দশত থেকে বিংশ শতকের গোড়ার দিক পর্যন্ত তুরস্কে সাম্রাজ্য পরিচালনা করেছে। ইউরোপ, আফগানিস্তান, ইরান, সিরিয়া, আরবের বিস্তীর্ণ ভূখন্ডে মুসলমানরা শত শত বছর শাসক হিসেবে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছে। ত্রয়োদশ থেকে ষোড়শ শতকে চারশত বছর পর্যন্ত মুসলমান সুলতানেরা বাংলায় সমৃদ্ধ শাসনকাল পরিচালনা করেছিল। তাই ভারতীয় মুসলমান হিসেবে আলাদাভাবে হীনমন্যতার অন্তত ঐতিহাসিক কোন কারণ ছিল না। ইউরোপীয় ইহুদীদের নিপীড়নের সাথে মুসলমানদের অবস্থার বিন্দুমাত্র কিছু তুলনীয় ছিল না। বরং মুসলমানদের চাইতে বহুগুণ নিপীড়িত, দলিত, লাঞ্ছিত-বঞ্চিত, জাতিগোষ্ঠী ব্রিটিশ ভারতে ছিল এবং এখন স্বাধীন ভারতেও আছে। মুসলমানদের মধ্যেই আছে আশরাফ-আতরাফ, উঁচু-নিচু জাত-বংশ, জোলা- সৈয়দ। শ্রেণী, লিঙ্গ, বর্ণ ও জাতপাতের বৈষম্য দূর না করে সব নিপীড়িত জাতি-ধর্মের জন্যে পৃথক পৃথক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার দাওয়াইয়ের হঠকারী অবাস্তব কল্পনা আর কী হতে পারে?

মুসলমানদের জন্যে পৃথক রাষ্ট্র’ পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাকারীরা ভারতীয় মুসলমানদের জন্য মোটেই কোন নিরাপদ ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেনি। বরঞ্চ তারা পাকিন্তান প্রতিষ্ঠার ফলস্বরূপ স্বাধীন ভারতের মুসলমান ভাই-বোনদের আরও বেশী বিপদজনকভাবে সংখ্যালঘু ও কোণঠাসা হয়ে পড়বার বিপদ আন্দাজ করতে ব্যর্থ হয়েছে। ‘হিন্দুদের জন্য কল্পিত হিন্দুস্তান’ এ আজ ৭৩ বছর পর ভারতীয় মুসলমানদের জীবন দিয়ে তার খেরাসত দিতে হচ্ছে। ভারতীয় মুসলমানদের অধিকতর নিপীড়িত বর্গে পরিণত হওয়ার দিকে ঠেলে দেয়ার দায় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাকারীদের কোন অংশে কম নয়, যারা নিজেরা ছিলেন উঁচু শ্রেণীর শিক্ষিত ভূমি -মালিক মুসলমান। কৃষক, শ্রমিক, মেহনতী মুসলমানদের বাস্তবতা ও জীবন-সংগ্রাম বোঝার ক্ষমতা বা আগ্রহ কোনটাই তাদের ছিল না। ভারতে শ্রেণী, লিঙ্গ, জাতিবর্ণ  বৈষম্যের গভীরতা এবং সমাজের গভীরে ঔপনিবেশিক ক্ষয়-ক্ষতি সম্পর্কে তারা বোকার স্বর্গে বাস করেছিলেন।

ঔপনিবেশিক ইতিহাসবিদ্যার পরিকাঠামোয় ভারতের ইতিহাসের যুগ বিভাজন করা হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে :  বৌদ্ধ যুগ, হিন্দু যুগ, মুসলমান যুগ, এবং আধুনিক যুগ হিসেবে। এই কলোনিয়াল ইতিহাসবিদ্যাকে ভেঙ্গে ভারতের ইতিহাসের স্বরাজ কায়েমে নিয়োজিত ইতিহাসবিদেরা তাই বিজেপি সরকারের টার্গেটে পরিণত হয়েছে। রামচন্দ্র গুহ, ইরফান হাবিব, রমিলা থাপারের মত বিশ্বখ্যাত ভারতবেত্তাদের গ্রেফতার, হয়রানি, অপদস্থ করা থেকে এটা পরিষ্কার যে ভারতের অতীত ইতিহাসের বয়ান আজ বর্তমানের ক্ষমতার খেলার পাটাতন তৈরি করেছে। ইংরেজদের বানানো ওরিয়েন্টাল ভারতের প্রাচীন মিথিক গৌরবের গাঁথা তুলে আনছে রামায়ণ-মহাভারতের মহাকাব্যিক বয়ানের একমাত্রিক হ্রাসকৃত ব্যাখ্যায়, যার বহুপাঠ আদতে এই বহুসংস্কৃতির রীতি-রেওয়াজেরই স্বাক্ষর। এই মহাকাব্যিক বয়ানের বিপুল বৈচিত্র্য, অসংখ্য আঞ্চলিক ভার্সনগুলো ভারতীয় সমাজের মহাসাগরের মত বৈচিত্র্যময়তার গল্প বলে যাচ্ছে। বৈচিত্র্যময় উৎস থেকে আগত বিশ্বাস ও সংস্কৃতিসমূহকে গ্রহণ করা বহুত্ববাদী ভারতই ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতা। প্রাচীন গৌরব নিয়ে মনোবেদনা অথবা শ্রেষ্ঠত্বের গরিমায় ভোগা তখনই বাড়তে থাকে যখন বর্তমান নিয়ে অসন্তুষ্টি বা আত্মবিশ্বাসে কোথাও ঘাটতি থাকে।

ইংরেজদের বানানো ওরিয়েন্টাল ভারতের প্রাচীন মিথিক গৌরবের গাঁথা তুলে আনছে রামায়ণ-মহাভারতের মহাকাব্যিক বয়ানের একমাত্রিক হ্রাসকৃত ব্যাখ্যায়, যার বহুপাঠ আদতে এই বহুসংস্কৃতির রীতি-রেওয়াজেরই স্বাক্ষর। এই মহাকাব্যিক বয়ানের বিপুল বৈচিত্র্য, অসংখ্য আঞ্চলিক ভার্সনগুলো ভারতীয় সমাজের মহাসাগরের মত বৈচিত্র্যময়তার গল্প বলে যাচ্ছে। বৈচিত্র্যময় উৎস থেকে আগত বিশ্বাস ও সংস্কৃতিসমূহকে গ্রহণ করা বহুত্ববাদী ভারতই ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতা। প্রাচীন গৌরব নিয়ে মনোবেদনা অথবা শ্রেষ্ঠত্বের গরিমায় ভোগা তখনই বাড়তে থাকে যখন বর্তমান নিয়ে অসন্তুষ্টি বা আত্মবিশ্বাসে কোথাও ঘাটতি থাকে।

গত ২৪ মার্চ ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তড়িঘড়ি সারা দেশে ২১ দিনের লকডাউন ঘোষনা করলে ১৩০ কোটি মানুষের চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। কোন পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়াই এই ঘোষণার ফলে বিভিন্ন নগরাঞ্চলে আটকে পড়া অগণিত অভ্যন্তরীণ স্থানাস্তরিত শ্রমিক শত শত মাইল পায়ে হেঁটে ঘরে ফিরতে শুরু করেন এবং পথে পথে পুলিশি হয়রানি ও নির্যাতন, অপদস্তকরণ, ক্ষুধা, অনাহার, ক্লান্তির মধ্যে যেন এক বাইবেলীয় দেশান্তরণের অভিজ্ঞতা ভেতর গেছেন। অসংখ্য মানুষের অবর্ণনীয় দুর্ভোগের কোন সীমা-পরিসীমা ছিল না। আমি দুঃখে পাথর হয়ে গেছি শুনে যে, একটি বারো বছরের মেয়ে শত শত মাইল পাড়ি দিয়ে বাড়ির কাছে এসে চরম ক্লান্তিতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। এর মধ্যে আবার কোন কোন হাসপাতালে করোনা চিকিৎসায় ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে মুসলমান ও হিন্দুদের জন্যে পৃথক ওয়ার্ডের ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রখ্যাত ভারতীয় ঐতিহাসিক রামচন্দ্রগুহ ২৫ এপ্রিল জনপ্রিয় নিউজ পোর্টাল ওয়্যার-এ দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে টিভি উপস্থাপক কিরণ থাপারকে বলেন, বিজেপি সরকার এবং ভারতীয় মিডিয়া উভয়ই কোভিড-১৯ মহামারিকে সাম্প্রদায়িক রূপ দিচ্ছে। মধ্যযুগের ইউরোপে ‘ব্ল্যাক ডেথ’ মহামারির সময় সংখ্যাগরিষ্ঠ খ্রিষ্টানরা সংখ্যালঘু ইহুদীদের আসুরিক হিসেবে চিত্রায়িত করে বিভিন্নভাবে দোষারোপ ও দুর্ব্যবহার করেছিল। কিন্তু এই একবিংশ শতকের আধুনিক ভারতে ইউরোপের ইতিহাসের নিকৃষ্টতম যুগের মত একই ধরনের আচরণ অভাবনীয়। এমনটি সম্ভব হচ্ছে দায়িত্বহীন মিডিয়া,আত্মতুষ্ট রাজনৈতিক শ্রেণী এবং সরকারের স্বেচ্ছাকৃত রাজনৈতিক কৌশলে।

ভারতের এই কর্তৃত্ববাদী গরীব-বিরোধী কর্পোরেট-উচ্চবর্ণের রাষ্ট্রে রূপান্তরনের কাঠামোগত, আইনগত, ভাষাগত ও গণমাধ্যমিক প্রস্তুতি এবং সহিংসতার উত্থান নিয়ে গুরুতর আলাপ ভারতের ভেতরে এবং আঞ্চলিক পরিসরে বাকী রয়ে গেল। সিএএ-এনআরসি-এনপিআর এর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে সংগঠিত প্রতিবাদ- প্রতিরোধও আকস্মিক বৈশ্বিক মহাদুর্যোগে আপাতত অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হয়ে গেছে। কিন্তু আমরা নজরে রাখবো যে, এই মহামারির রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার ভেতর জীবন-মরণের প্রশ্নে মুসলিম-বিদ্বেষ, জাতি-বিদ্বেষ, গরীব, আদিবাসীকে উপেক্ষার নীতি নতুন করোনায় পুরোনো কৌশলে জারী আছে। বাংলাদেশ এবং দক্ষিণ এশিয়ার নাগরিক হিসেবে আমাদের উদ্বেগ ও শংকাগুলো তোলা থাকবে না। সামনের দিনগুলোতে নাগরিকত্ব আইনের নামে নাগরিকত্ব থেকে উচ্ছেদ করে মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকবার অধিকার ও মর্যাদা কেড়ে নিয়ে ভারতে, মিয়ানমারে কিংবা আর কোথাও রাষ্ট্রহীন মানুষের সৃষ্টি রোধ করতে দক্ষিণ এশিয়ার সংগ্রামী জনতাকে নিজেদের মধ্যে মৈত্রীর বন্ধন গড়ে নিতে হবে। এই কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রীয় শক্তিগুলোকে সর্বজনতার জবাবদিহিতার মুখোমুখি করতে আমাদের সম্পূর্ণ নতুন করে প্রস্তুতি নিতে হবে।

সায়েমা খাতুন: নৃবিজ্ঞানী ও শিক্ষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

ইমেইল: sayemakhatun@juniv.edu

তথ্যসূত্র:

Baruya, S Arun Joyti (Novernber 29, December 1, 2017) 10th Session: Minority Youth towards inclusive and diverse societies, HRC/Forum on Minority Issues, Bangladesh Minority Council

Citizenship (A) Bill 2019

Hasan, Md. Kamrul (Noverber 20, 2016), No Hindu will be left under 30 years

Naila, Mohammad (April 17, 2020) Conoravirus Spread in India Sparks Itolerance Toward Minority Muslims

India Times, (August 3, 2019) If NRC is deployed across India, how will you prove your citizenship

Punj, Shwweta, (December 18, 2019) Citizenship Amendment Act: The anatomy of a protest

Varadarjan, Siddhartha (April 21, 2020) In India, A Pandemic of Prejudice and Repression, New York Times

2020 Tablighi Jamaat Hotspot Corona Virus Delhi

Social Share
  •  
  •  
  • 126
  •  
  •  
  •  
  •  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *