অ্যাঞ্জেলা ডেভিসের সাথে কথোপকথন-৩

অ্যাঞ্জেলা ডেভিসের সাথে কথোপকথন-৩

ব্যবস্থাগত পরিবর্তন বিষয়ে আমাদের আলোচনা করতে হবে

অনুবাদ: ফাতেমা বেগম

২০১৪ সালে বেশ কয়েক মাস ধরে ই-মেইলের মাধ্যমে মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ নারীবাদী লেখক ও অধিকার আন্দোলনে সক্রিয় ব্যক্তিত্ব অ্যাঞ্জেলা ডেভিসের সাথে এই দীর্ঘ কথোপকথনে অনেক বিষয় পরিষ্কার করেছেন লেখক এ্যাক্টিভিস্ট ফ্রাংক বারাত। এতে মার্কিন সমাজ, বর্ণবাদী আক্রমণ, ফিলিস্তিনি জনগণ সহ বিশে^র বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের লড়াই নিয়ে তাঁর বক্তব্য সংকলিত হয়েছে। এটি সংকলিত হয়েছে একটি গ্রন্থে, নাম: Freedom is a Constant Struggle: Ferguson, Palestine and the Foundations of a Movement। এর অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে সর্বজনকথায় প্রকাশিত হচ্ছে। এবারে তৃতীয় পর্ব।

 

শেষবার আমরা ফারগুসনের ব্যাপারে কথা বলছিলাম। সংগঠিত অপরাধের প্রেক্ষিতে প্রধান জুরি তখনও রায় প্রকাশ করেনি। এরিক গার্নার নামে আরেকজন কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিকে পুলিশ হত্যা করল। আমি আবার এ ব্যাপারে কথা বলতে চাই। দুইজন কৃষ্ণাঙ্গ নিহত হল, অথচ পুলিশ স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এখানে কী পরিবর্তন আবশ্যক?

প্রথমত, আমি উল্লেখ করতে চাই, পুলিশ কর্তৃক কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষ ও নারীদের হত্যাকাণ্ড কোন অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। রবার্ট ডি জি কেলি লিখিত প্রবন্ধটি আপনার কাছে বেশ আকর্ষণীয় মনে হতে পারে। প্রবন্ধের নাম হোয়াই উই ওনট ওয়েট। তখন আমরা ফারগুসন রায়ের ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। ঠিক সেই সময় যারা পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছিল, প্রবন্ধটিতে সেই সকল কৃষ্ণাঙ্গর একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছিল।

এই হত্যাকাণ্ডগুলো সবই কি কয়েক মাসের মধ্যে ঘটেছিল?

ঠিক তাই- যে সময়কালে গ্র্যান্ড জুরি সাক্ষ্য তথ্য শুনছিল। আমরা এই মামলাগুলোকে প্রায়শ ব্যতিক্রম হিসাবে গণ্য করি। অভিযুক্তদের বিপথগামী হিসাবে বিবেচনা করি। বাস্তবে কিন্তু এরকম ঘটনা সব সময় ঘটে চলেছে। আমাদের ধারণা হল, অপরাধীকে শাস্তি দিতে সক্ষম হওয়া মানেই সুবিচার সংঘটিত হওয়া। কিন্তু বাস্তবে ভয়ংকর যে ঘটনাটি ঘটেছে তা হল মাইকেল ব্রাউন ও এরিক গার্নারের হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত দুইজন পুলিশ অফিসারকে গ্র্যান্ড জুরি অভিযুক্ত করেনি। অবশ্য তাঁদেরকে অভিযুক্ত করা হলেও কোন কিছুর পরিবর্তন হত কি না সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। আমি বলতে চাচ্ছি যে অপরাধী পুলিশরা অভিযুক্ত হলেও তাতে কোন পরিবর্তনের নিশ্চয়তা নেই।

নর্থ ক্যারোলাইনায় জোনাথন ফেরেল নামের একজন তরুণ অটোমোবাইল দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিলেন। তিনি একজনের বাড়ির দরজায় করাঘাত করে সাহায্য প্রার্থনা করেন। সেই বাড়ির লোক তাঁকে চোর সন্দেহ করে পুলিশকে ফোন করে। পুলিশ এসে তৎক্ষণাৎ সেই তরুণকে গুলি করে হত্যা করে। প্রাথমিক পর্যায়ে পুলিশকে অভিযুক্ত করা হয়নি। অতঃপর প্রসিকিউটরের চাপে শেষ পর্যন্ত গ্র্যান্ড জুরি সেই পুলিশকে অভিযুক্ত করতে বাধ্য হয়। এখানে গুরুত্বপূর্ণ হল, আমাদের ব্যবস্থাগত পরিবর্তনের ব্যাপারে কথা বলতে হবে। শুধু ব্যক্তির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিয়ে আমাদের সন্তুষ্ট থাকা যাবে না।

সুতরাং আমাদের আরও অনেক কিছু নিয়ে ভাবতে হবে। পুলিশের ভূমিকা পুনর্বিবেচনা করতে হবে। তার মানে হচ্ছে, সম্ভবত পুলিশের ওপর কমিউনিটির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। পুলিশ অপরাধ করার পরে কেবল তার জন্য গৃহীত পদক্ষেপের পর্যালোচনা নয়, বরং পুলিশ সংস্থাগুলোর কার্যক্রমে নিয়ন্ত্রণ ও নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রয়েছে এমন সম্প্রদায়-সংস্থাগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তার মানে, বর্ণবাদকে বৃহত্তর পর্যায়ে বিবেচনা করতে হবে। এর আরও অর্থ দাঁড়াচ্ছে, যে প্রক্রিয়াগুলো সহিংসতাকে প্রথম অবলম্বন হিসাবে ব্যবহার করতে পুলিশকে উৎসাহিত করে এবং প্রাতিষ্ঠানিক সহিংসতা ও অন্যান্য ধরনের সহিংসতার মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে, সেই প্রক্রিয়াগুলো লক্ষ করতে হবে। বিশেষত, ফারগুসন প্রসঙ্গে এর অর্থ হচ্ছে দেশব্যাপী পুলিশকে বেসামরিকীকরণ করার দাবি করতে হবে।

সুতরাং আমরা একটি ব্যবস্থাগত পরিবর্তনের কথা বলছি, তাই না?

হ্যাঁ, সঠিক বলেছেন।

সিস্টেম বা ব্যবস্থার একেবারে গভীর পর্যায় পর্যন্ত?

হ্যাঁ, পুরাপুরিভাবে।

আপনি একজন কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষের কথা বলেছিলেন, যিনি তাঁর গাড়িটি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় সাহায্য চাইছিলেন, কিন্তু লোকজন তাঁকে চট করে চোর বা এরকম কিছু একটা ভেবে নেয়। আপনি কি মনে করেন যে এর জন্য দায়ী সমাজ ও মিডিয়া, যারা গতানুগতিকভাবে কৃষ্ণাঙ্গদেরকে সম্ভাব্য বিপজ্জনক, সম্ভাব্য অপরাধী হিসাবে চিত্রায়িত করে- মানুষের মনে এই ভাবমূর্তি তৈরি করে, একটি পক্ষপাতদুষ্ট পূর্বধারণা তৈরি করে?

হ্যাঁ, সম্পূর্ণভাবে। এবং সত্যিকার অর্থে দাসযুগ থেকেই এই গতানুগতিক ধারণাগুলো প্রচলিত আছে। ফ্রেডরিক ডগলাসের লেখায় বর্ণের সাথে অপরাধ আরোপ করার ব্যাপারটি পাওয়া যায়। তিনি উল্লেখ করেছেন যে একজন সাদা বর্ণের মানুষ কাল মুখ বানিয়ে অসংখ্য অপরাধ করেছিলেন। কারণ তিনি ভালভাবে জানতেন যে সাদা বর্ণের মানুষ হওয়ার কারণে তাঁকে কখনই সন্দেহ করা হবে না। অন্যদিকে কাল ত্বক ও অপরাধ পরস্পর সম্পর্কিত-এই মতাদর্শগত ধারণার শিকার হয়েছেন সকল কৃষ্ণাঙ্গ।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে বর্ণবাদের বিবর্তনের সাথে সব সময় অপরাধের পরিমাপ সংযুক্ত করা হয়েছে। তাই আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে কিভাবে অপরাধী হিসাবে কৃষ্ণাঙ্গদের ব্যাপারে এই গতানুগতিক ধারণা অদ্যাবধি বিদ্যমান আছে। জাতিগত প্রোফাইলিং করা তার একটি উদাহরণ। কৃষ্ণাঙ্গরা বিপজ্জনক, এই ধারণাটি চালু আছে। সম্প্রতি টুইটারে একটি সংলাপ চলছে, অপরাধী হিসাবে সাদা মানুষ। বেশ কিছুসংখ্যক সাদা মানুষ তাঁদের নিজেদের অপরাধের কথা বর্ণনা করেছেন, যার জন্য তাঁদেরকে কখনও সন্দেহভাজনদের তালিকাভুক্ত হতে হয়নি। তাঁদের মধ্যে একজনের বর্ণনায় পাওয়া যায়, সে এবং তার কৃষ্ণাঙ্গ বন্ধু একটি ক্যান্ডি বার চুরি করার অপরাধে একসাথে গ্রেফতার হয়। পুলিশ সাদা ব্যক্তিকে ক্যান্ডি বারটি দিয়ে দেয় এবং তার কৃষ্ণাঙ্গ বন্ধুকে জেলখানায় পাঠায়।

এর সত্যতা সর্বত্র বিরাজমান। প্যারিসেও প্রোফাইলিং করা হয়। প্যারিসে আপনি কোন মরোক্কান বা আলজেরিয়ান গোত্রের কারোর সাথে কথা বলে জানতে পারবেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আফ্রিকান-আমেরিকানদের মতই তারা একটি গৎবাঁধা এবং বানানো ধারণার শিকার হয়। আপনি কেন সেইসব ধারণাকে গৎবাঁধা এবং বানানো মনে করছেন? এটা কি ডিভাইড অ্যান্ড রুল কৌশল?

বর্ণবাদ খুব একটি জটিল ব্যাপার। বর্ণবাদের খুব গুরুত্বপূর্ণ কাঠামোগত উপাদান রয়েছে। বর্ণবাদের অবসান বা বর্ণবাদকে চ্যালেঞ্জ করা সম্পর্কে আলোচনা করার সময় প্রায়শই এমন কাঠামোগত উপাদানগুলোকে বিবেচনায় নেয়া হয় না। মানসিক কাঠামোতেও এর প্রভাব থাকার কারণে গতানুগতিক ধারণাটির অস্তিত্ব টিকে থাকছে। গত কয়েক দশক এবং শতক যাবৎ কৃষ্ণাঙ্গদেরকে যেভাবে মানুষ হিসাবে অবমাননা করা হচ্ছে, অর্থাৎ তাদেরকে মানুষের চাইতে নিচু পর্যায়ের কিছু ভাবা হচ্ছে, তাদেরকে মিডিয়ায় প্রতিনিধিত্বমূলক রাজনীতিতে ও অন্যান্য যোগাযোগ মাধ্যমে যেভাবে দেখা যায়, এবং সামাজিক আদান-প্রদানে যেভাবে দেখা যায়, সেগুলোর মাধ্যমে কৃষ্ণাঙ্গ ও অপরাধীকে এক করে দেখা হয়। তাই বুঝতে অসুবিধা হয় না এই গতানুগতিক ধারণার অস্তিত্ব কেন দীর্ঘকাল যাবৎ টিকে আছে।

প্রশ্ন হলো, প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তি আচরণে বর্ণবাদের প্রভাব বোঝার জন্য কেন অদ্যাবধি কোন গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেয়া হয়নি? যত দিন পর্যন্ত আমরা বর্ণবাদকে সেই ব্যাপক পরিসরে প্রশ্নবিদ্ধ করতে না পারব, তত দিন এই গতানুগতিক ধারণা টিকে থাকবে।

ওবামার ব্যাপারে কী বলবেন? তিনি এখনও ফারগুসন পরিদর্শনে যাননি। এই মুহূর্তে, রাজনৈতিক দৃশ্যপটে তাঁর অবস্থান কোথায়?

আমার মতে, এই মুহূর্তে বর্ণবাদ, বর্ণবাদী সহিংসতা এবং পুলিশি সহিংসতার বিরুদ্ধে যে উল্লেখযোগ্য আন্দোলন গড়ে উঠতে দেখছি, তার অন্যতম ব্যাখ্যা হতে পারে ওবামার নির্বাচিত হওয়ার ঘটনাটিকে বর্ণবাদ-পরবর্তী যুগের সূচনাবিন্দু হিসাবে স্বাগত জানানো। অবশ্য একজন ব্যক্তি নির্বাচিত হয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ওপর বর্ণবাদের প্রভাব এবং বর্ণবাদ সম্পর্কে সারা দেশের দৃষ্টিভঙ্গিতে রূপান্তর ঘটিয়ে ফেলতে পারবেন- এই রকম ভাবটা অর্থহীন। তবে সকলেই দেখেছে যে একজন কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট নিজেকে সমর্পণ করছেন বর্ণবাদিতায়, বর্ণবাদী সহিংসতায়। ওবামার সক্রিয় নেতৃত্বে সহিংসতার প্রভাব আরও বেড়েছে। না, ওবামা ফারগুসন পরিদর্শন করেননি। অ্যাটর্নি জেনারেল, এরিক হোল্ডার পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। এই প্রশাসনের বিরুদ্ধে সমালোচনা প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, এরিক হোল্ডার ইতিপূর্বে পুলিশের সামরিকীকরণের গুরুত্বের পক্ষে বক্তব্য দিয়েছিলেন। ফারগুসনে, প্রাথমিক পর্যায়ে আমরা সামরিক পোশাক দেখেছি, সামরিক যন্ত্রপাতি দেখেছি। মজার ব্যাপার হচ্ছে, পুলিশ প্রথমে যে সামরিক পোশাক, অস্ত্র, প্রযুক্তি ইত্যাদি ব্যবহার করছিল তা পরবর্তীতে শেষের দিকে দৃশ্যমান ছিল না।

যাই হোক, আমি মনে করি, যে কেউ ক্ষমতায় থাকুক না কেন আমরা সরকারের ওপর  নির্ভর করতে পারি না। একমাত্র গণ-আন্দোলনেই সমাধান সম্ভব। আর এই মুহূর্তে চলমান বিক্ষোভের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, এর কারণে সমস্যাগুলো চাপা পড়ার হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে।

আপনি উল্লেখ করেছেন যে একজন ব্যক্তির পক্ষে পুরা ব্যবস্থা বদলানো সম্ভব নয়, তাহলে যে ব্যবস্থা ওবামাকে নির্বাচিত করল, সেই ব্যবস্থাই কিভাবে তাকে বাধাগ্রস্ত করল?

হ্যাঁ, অবশ্যই। কিছু কৌশলযন্ত্র প্রেসিডেন্সিকে নিয়ন্ত্রণ করে, এবং কোন পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সেগুলো প্রতিবন্ধকতা হিসাবে কাজ করে। তবে দৃঢ়তর পদক্ষেপ না নেয়ার জন্য ওবামার ক্ষেত্রে এটা কোন অজুহাত হতে পারে না। আমি মনে করি, চাইলে ওবামা কিছু পদক্ষেপ নিতে পারতেন। কিন্তু কেউ যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদবিরোধী সংগ্রামের ইতিহাস লক্ষ করে, তাহলে দেখতে পাবে, কেবল একজন প্রেসিডেন্টের অধিকতর প্রগতিশীল পথে চলার ফলশ্রতিতে কোন পরিবর্তন ঘটেনি।

গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে প্রতিটি পরিবর্তন ঘটেছে। দাসত্বের যুগ থেকে শুরু করে গৃহযুদ্ধ, এবং সেই গৃহযুদ্ধে কৃষ্ণাঙ্গদের অংশগ্রহণ সত্যিকার অর্থে সেই রকম পরিবর্তন ঘটিয়েছে। অধিকাংশ মানুষের ধারণা হল, দাসত্ব প্রথার বিলোপসাধনে আব্রাহাম লিংকনের ভূমিকাই প্রধান ছিল। দাসপ্রথার বিলোপ ত্বরান্বিত করতে আব্রাহাম লিংকন অবশ্যই সাহায্য করেছেন, কিন্তু দাসত্বের বিরুদ্ধে জয়লাভের পেছনে প্রধান ভূমিকা ছিল দাসদের পক্ষ থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করার সিদ্ধান্ত এবং সেই উদ্দেশ্যে নারী-পুরুষ-নির্বিশেষে ইউনিয়ন সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার ঘটনা। দাসপ্রথার অবসান ঘটিয়েছে স্বয়ং দাসরা এবং সেই সাথে অবশ্যই দাসপ্রথা বিলোপের আন্দোলন। নাগরিক অধিকার আন্দোলনের সময়কালে লক্ষ করলে দেখা যাবে, গণ-আন্দোলনের কারণেই সরকার বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছিল, ঘটনাচক্রে সেইসব গণ-আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তাহলে বর্তমানকালে কেন তার ব্যতিক্রম হবে?

তাই আপনি কি মনে করেন নতুন আন্দোলনের জন্য ফারগুসন ঘটনা অনুঘটক হিসাবে কাজ করতে পারে? এটা কি পরিবর্তনের সূচনাবিন্দু হতে পারে?

আমি মনে করি, আন্দোলন গড়ে উঠতে এবং পরিণত হতে সময় লাগে। সেটি স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘটবে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নেপথ্যের সংগঠন এবং কঠোর পরিশ্রমের ফলে আন্দোলনগুলো ঘটে থাকে। গত দুই দশক যাবৎ আসলে পুলিশি সহিংসতা, বর্ণবাদ, বর্ণবাদী পুলিশ-সহিংসতা, কারাগারের বিরুদ্ধে, কারাগার-শিল্প কমপ্লেক্সের বিরুদ্ধে সংগঠিত সংগ্রাম টিকে আছে এবং আমি মনে করি, এখন যে ধারাবাহিক বিক্ষোভগুলো হচ্ছে তা সংগঠিত করার জন্য অনেক কাজ করতে হবে। বিক্ষোভে প্রতিফলিত হচ্ছে যে অনেক সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে প্রচলিত ধারণার চাইতে রাজনৈতিক সচেতনতা বেশি কাজ করে। অর্থাৎ বর্ণবাদী পুলিশ-সহিংসতা এবং পদ্ধতিগত সমস্যাগুলোর মধ্যকার সংযোগ সম্পর্কে জনগণ জানে। সিআইএর গোপন কারাগার এবং নির্যাতনের সাথে যে কারাগার-শিল্প কমপ্লেক্সের একটি সম্পর্ক আছে তা সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। কাজেই আমি মনে করি, আমাদের আন্দোলনের একটি ভিত্তি রয়েছে। দাবি করব না যে আন্দোলনটি মজবুত একটি সাংগঠনিক পর্যায়ে আছে। আমরা সেই পর্যায়ে এখনও পৌঁছিনি। তবে আন্দোলনের একটি শক্তিশালী ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে এবং জনগণ সেই আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত।

বর্তমান সময়ের আন্দোলনগুলো কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কারাগার-শিল্প কমপ্লেক্স এবং কারাগার বিলুপ্তি আন্দোলনে সফলতা অর্জন করতে পারে? ষাট ও সত্তরের দশক থেকে আমাদের শিক্ষা কী?

আমি মনে করি, ষাট ও সত্তরের দশকের বছরগুলোতে আমরা শিখেছি যে গণ-আন্দোলন প্রকৃতপক্ষে পদ্ধতিগত পরিবর্তন আনতে পারে। যদি কেউ পাসকৃত সমস্ত আইনের দিকে লক্ষ করে তবে সে বুঝতে পারবে যে নাগরিক অধিকারের আইন, উদাহরণস্বরূপ-ভোটিং রাইটস অ্যাক্ট, কোন রাষ্ট্রপতির অসাধারণ পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে ঘটেনি। মানুষের মিছিল এবং সংগঠনের ফলেই এটি ঘটেছে।

আমার মনে পড়ছে, ১৯৬৩ সালে মার্চ মাসের আগে গ্রীষ্মকালে, নাগরিক অধিকার আন্দোলনের সময়কালে ওয়াশিংটনে বার্মিংহামের আলাবামায় একটি শিশু বিক্ষোভ হয়েছিল। বার্মিংহামে বুল কনরের পুলিশি পরিচালনায় উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ফায়ারহোস ও পুলিশের সহিংসতার মুখোমুখি হওয়ার জন্য শিশুদের সংগঠিত করা হয়েছিল। অবশ্য সন্তানদের সেই পর্যায়ে অংশগ্রহণের অনুমতি দিতে অনেকে অসম্মতি প্রকাশ করেছিল; এমনকি ম্যালকম এক্সও মনে করেছিলেন যে শিশুদের এরকম বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে ঠেলে দেয়া ঠিক হয়নি। তবে শিশুরা স্বেচ্ছায় এই অংশগ্রহণ করতে চেয়েছিল। পুলিশি কুকুর এবং ফায়ারহোসের সম্মুখীন সেই শিশুদের ছবি সারা বিশ্বে প্রকাশিত হয়েছিল, যা বর্ণবাদের নির্মমতার বিরুদ্ধে বৈশ্বিক জনমত তৈরি করতে সাহায্য করেছিল। এটি একটি অসাধারণ পদক্ষেপ ছিল। বর্ণবাদের ব্যাপারে দুর্ভেদ্য নীরবতা ভাঙতে শিশুরা যে ভূমিকা রেখেছিল তা প্রায়শই আমরা ভুলে যাই।

তাই আমি মনে করি, ষাট ও সত্তরের দশকের বছরগুলোতে আমরা শিখেছিলাম যে সত্যিই পরিবর্তন সম্ভব। আমরা ঠিক যেমন পরিবর্তন চেয়েছিলাম তা ঘটেনি বা আরও সঠিক অর্থে যথেষ্ট পরিবর্তন ঘটেনি। যদিও আইন-কানুনের ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন ঘটেছিল তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তথাপি আর্থিক ও কাঠামোগত পদ্ধতিতে পরিবর্তন না ঘটার কারণে বর্ণবাদকে নির্মূল করা সম্ভব হয়নি।

সেটাই। আন্দোলনের মাধ্যমে কী করে এমনকি সবচেয়ে অনিচ্ছুক রাজনীতিবিদদের ওপর  চাপ তৈরি করা যায়?

সেই সময়ের প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি জনসন পরিবর্তনে অনিচ্ছুক দক্ষিণের একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন। তিনি পরিষ্কারভাবে বর্ণবাদকে সমর্থন করেছিলেন। তবে তাঁর প্রশাসনের অধীনেই অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ আইন পাস করা হয়েছিল। তাই আমি মনে করি, আন্দোলনের মাধ্যমে পরিবর্তনে অনিচ্ছুক রাজনীতিবিদকেও পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করা সম্ভব। দক্ষিণ আফ্রিকার দৃষ্টান্ত দেখুন। কেউ কখনও বিশ্বাস করেছিল যে দে ক্লার্ক শেষ পর্যন্ত এমন অবস্থান নেবে? এর কারণ ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার অভ্যন্তরে আন্দোলন, দক্ষিণ আফ্রিকার বাইরে দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য আন্দোলন, এবং বৈশ্বিক সংহতি প্রচারণা।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেক্ষিতে কৃষ্ণাঙ্গ রাজনীতির ভবিষ্যৎ কী?

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গ রাজনীতির ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার ব্যাপারে ওবামার কোন প্রধান ভূমিকা ছিল কি না তা আমি জানি না। তবে আমার মতে, মূল উদ্বেগের বিষয় হল বর্ণবাদবিরোধী রাজনীতির ভবিষ্যৎ।

আপনি এ ব্যাপারে আগে কিছুটা বলেছিলেন যে ওবামার নির্বাচিত হওয়ার ঘটনাটি আসলে একভাবে বাধাই তৈরি করেছে…

আসলে, আমার মনে হয়, এখন কৃষ্ণাঙ্গ রাজনীতিকে বৃহত্তর কাঠামোর আওতায় বিচার করা গুরুত্বপূর্ণ। আমরা কৃষ্ণাঙ্গ রাজনীতি সম্পর্কে আগের মত একইভাবে চিন্তা করতে পারি না। আমি বলব, কৃষ্ণাঙ্গ সংগ্রাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্বাধীনতার সংগ্রামের একটি প্রতীক হিসাবে কাজ করে। স্বাধীনতার জন্য বৃহত্তর সংগ্রামের প্রতীক হিসাবে কাজ করে। তাই কৃষ্ণাঙ্গ রাজনীতির আওতার মধ্যে লৈঙ্গিক অধিকারের সংগ্রাম, হোমোফোবিয়ার বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং সেই সাথে দমনমূলক অভিবাসন নীতিগুলোর বিরুদ্ধে সংগ্রামকেও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। কৃষ্ণাঙ্গ র‌্যাডিক্যাল ঐতিহ্য বলে যাকে অভিহিত করা হয় তা উল্লেখ করা গুরুত্বপূর্ণ। কৃষ্ণাঙ্গ র‌্যাডিক্যাল ঐতিহ্য কেবল কৃষ্ণাঙ্গ জনগণের সাথে নয়, বরং স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামরত সকলের সাথে সম্পর্কিত। তাই সেই পরিপ্রেক্ষিতে ভবিষ্যৎকে উš§ুক্ত বিবেচনায় রাখতে হবে। অবশ্য সুনির্দিষ্টভাবে, বিশেষ করে বিপুলসংখ্যক কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠী দারিদ্র্যে নিমজ্জিত থাকার বিবেচনায় কৃষ্ণাঙ্গ স্বাধীনতা এখনও অর্জিত হয়নি। আরও বিবেচনার বিষয় হল, কারাগার-শিল্প কমপ্লেক্সের জালে আটকে পড়া অগণিতসংখ্যক কৃষ্ণাঙ্গ কয়েদি জেলখানায় আছে। একই সাথে ল্যাটিনো জনগোষ্ঠী এবং আদিবাসী আমেরিকান নাগরিকদের দিকেও আমাদের মনোযোগ দেয়া উচিত। আমাদের কৃষ্ণাঙ্গ বর্ণবাদবিরোধী ভিত্তি থেকে মুসলমানবিরোধী বর্ণবাদ কিভাবে আসলে উদ্দীপিত হয়েছে তা দেখতে হবে। এখন তাই পূর্বাপেক্ষা জটিলতা বেশি। আমি কখনই বলতে যাব না যে কৃষ্ণাঙ্গ স্বাধীনতাকে সংকীর্ণ অর্থে দেখা সম্ভব। বিশেষ করে আমাদের মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। কেবল রাজনৈতিক নয়, বরং অর্থনৈতিক আধিপত্যে কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিদের জন্য উত্থানের প্রতীক হয়েছেন রাষ্ট্রপতি ওবামা। তবে এই শ্রেণির উদ্ভব এবং উত্থান অপরিহার্যভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষ্ণাঙ্গদের অবস্থার কোন রূপান্তর করবে না।

খুবই মজার ব্যাপার। নিশ্চিত না ঠিক কিভাবে বলব। দক্ষিণ আফ্রিকার উদাহরণ থেকে আপনি কি মনে করেন যে একদল মানুষ যখন রাজনীতি কিংবা ব্যবসার বিচারে উঁচু অবস্থানে যায়, তখন কি কাল কিংবা নেটিভ আমেরিকান পরিচয় থেকেও অর্থকড়ি বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে? সম্প্রতি আমি চিলিতে গিয়েছিলাম এবং চিলিতে থাকা ফিলিস্তিনিরা পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম সম্প্রদায়। চিলিতে প্রায় ৪ লাখ ৫০ হাজার ফিলিস্তিনি বসবাস করে।

তাই নাকি? আমি এই ব্যাপারটি জানতাম না।

চিলিতে বক্তৃতা দেয়ার সময় আমি ভিলা গ্রিমালদিতে গিয়েছিলাম। সেখানে পিনোশে অনেক মানুষকে নির্যাতন ও হত্যা করেছিল। সেখানকার অধিবাসীদের থেকে জেনেছি, ফিলিস্তিনিরা, যারা চিলির ধনীতম সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে অন্যতম, তারা পিনোশের এই কর্মকাণ্ডকে সমর্থন জানিয়েছিল। নির্যাতন ও হত্যা নয়, পিনোশের নব্য-উদারনীতিভিত্তিক শাসন পদ্ধতির জন্যই তারা তাকে এই সমর্থন জানিয়েছিল। সম্পদ ও সুবিধা অটুট রাখাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। নির্যাতনের প্রতি নিন্দা জানানোর আগে তারা তাদের মানিব্যাগের সুরক্ষা করছিল। দক্ষিণ আফ্রিকায় একই ঘটনা ঘটেছিল…

বিশেষ করে বিশ্ব পুঁজিবাদ এবং নব্য-উদারনীতির এই যুগে এ ব্যাপারগুলো খুব জটিল। দক্ষিণ আফ্রিকায় একটি ক্ষমতাবান, ধনিক, বুর্জোয়া কৃষ্ণাঙ্গ শ্রেণি গড়ে ওঠে, বর্ণবৈষম্য নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রামের সময় যে সম্ভাবনা আমলে নেয়া হয়নি, অন্তত প্রকাশ্যভাবে। আমরা ধরেই নিয়েছিলাম, দক্ষিণ আফ্রিকায় কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায় যদি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা লাভ করে তাহলে কৃষ্ণাঙ্গদের অর্থনৈতিক মুক্তি ঘটবে। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও একই অবস্থা।

আমি প্রকৃতপক্ষে বেশ কিছুদিন যাবৎ ব্রাজিল সফর করছি এবং লক্ষ করছি যে ব্রাজিল এখন বর্ণবাদ সম্পর্কিত কিছু বড় অগ্রগতির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। আমি মনে করি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ আফ্রিকার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করবে কি না সে ব্যাপারে ব্রাজিলের সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ রয়েছে। আমি অবাক হব যদি ফিলিস্তিনিরা পিনোশেকে সমর্থন করে থাকে। তবে সেটা সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য হবে না।

তারা সবাই নয়, তাই না…

না, আপনার কথা অনুযায়ী শতকরা ৬০ ভাগ হলেই যথেষ্ট। খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, কিছু সময়কাল ধরে আমরা বিভিন্ন সংহতি প্রচারণা থেকে বিভিন্ন সংগ্রামকে একত্রীভূত হতে দেখেছি। ফিলিস্তিনি, যারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গ সংগ্রাম থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছে, তাদের উচিত কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়কে স্বাধীনতাসংগ্রাম চালিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করা। অন্যদিকে ব্যক্তি পর্যায়ে ক্ষমতা লাভ হলেই সমগ্র কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ের অবস্থান পরিবর্তিত হবে- এই ধারণার অন্তর্নিহিত সমস্যাটি ফিলিস্তিনিদের উপলব্ধি করতে হবে। ফিলিস্তিনিদের মুক্তির জন্য শুধু অর্থ নয়, তার চাইতেও জটিল প্রয়োজনের হিসাবে পৌঁছাতে হবে।

কৃষ্ণাঙ্গ নারীবাদ এবং কৃষ্ণাঙ্গ সংগ্রাম ফিলিস্তিন আন্দোলনকে কী দিতে পারবে?

আমি জানি না, প্রশ্নটি ঠিক এভাবে করাটা ঠিক হবে কি না, কারণ আমি মনে করি, সংহতি বলতে সব সময় পারস্পরিকতার একটি ব্যাপার বোঝায়। ইতোমধ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমাদেরকে এরকম একটা ধারণা তৈরিতে উৎসাহিত করা হয়েছে যে দুনিয়ার সবচেয়ে সেরাটাই আমাদের আছে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই বিশেষ অবস্থানের কারণে আমরা আন্দোলনকারী হিসাবে সারা দুনিয়ার সংগ্রামরত মানুষদের নসিহত করতে পারি। কিন্তু এ ব্যাপারে আমি একমত নই, আমি মনে করি, আমরা স্রেফ আমাদের অভিজ্ঞতাগুলো ভাগাভাগি করি। কৃষ্ণাঙ্গ ও অশ্বেতাঙ্গ নারীবাদের অগ্রসরতা যেমন ফিলিস্তিনিদের জন্য ধারণা, অভিজ্ঞতা, বিশ্লেষণের উৎস হিসাবে কাজ করতে পারে, তেমনি ফিলিস্তিনি মানুষ এবং নারীবাদের সংগ্রামের অভিজ্ঞতার শিক্ষা থেকে কৃষ্ণাঙ্গ ও অশ্বেতাঙ্গ নারীবাদ নিজেদেরকে সমৃদ্ধ করতে পারে। আমরা যে ধরনের নারীবাদের কথা বলছি, আন্ত পরিচিতি-মিশ্রণের (Intersectionality) পুরো ধারণার মধ্যে সেই বৈশিষ্ট্যটি চিহ্নিত হয়েছে। তার মানে হল, জাতি, শ্রেণি, যৌনতা, জাতীয়তা ও ক্ষমতা থেকে বা ফিলিস্তিনে সংগ্রামের অন্যান্য বিষয় থেকে বিচ্ছিন্নতার মধ্যে লিঙ্গ বিষয়টি দেখতে পারি না। এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণকেও আন্ত পরিচিতি-মিশ্রণের বিস্তৃত ধারণা কল্পনা করতে সহায়তা করেছে।

গত কয়েক বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফিলিস্তিন সংগ্রামের পরিবর্তন কিভাবে ঘটেছে?

আমি অনুভব করি, সত্যিই কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটেছে। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার বিষয়টি দীর্ঘকাল যাবৎ গুরুত্বহীন ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনেকেই প্রগতিশীল, তবে ফিলিস্তিনের বিষয়টি বাদ দিয়ে। রেবেকা ভিলকোমারসনের ফিলিস্তিন ব্যতীত প্রগতিশীলতা (Progressives Except Palestine) বিষয়ক আলোচনা থেকে এই বক্তব্যটি সংগ্রহ করেছি। এখন এ ব্যাপারে পরিবর্তন ঘটছে। ব্যাপক প্রভাব বিস্তারকারী শক্তি জায়নবাদ এখন তার ক্ষমতা হারাচ্ছে। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে স্টুডেন্টস ফর জাস্টিস ইন প্যালেস্টাইন (এসজেপি) নামক সংগঠনের বিকাশ ঘটছে এবং সংগঠনটিতে ব্যাপকসংখ্যক কর্মী যোগ দিচ্ছে, যারা ফিলিস্তিনি, আরব বা মুসলমান নয়। ফিলিস্তিন সমস্যা ক্রমবর্ধমান হারে সামাজিক ন্যায়বিচারের সমস্যাগুলোর সাথে সম্পৃক্ত হচ্ছে। অতীতে ফিলিস্তিন সমস্যা নিয়ে কথা বলতে গেলে আমাকে সব সময় প্রতিরোধ ও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়েছে। কিন্তু এখন ক্রমশই তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে। ফিলিস্তিনে ঘটমান বিষয়গুলোর কারণেই এই গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া সমগ্র বিশ্বে ফিলিস্তিন সংহতি আন্দোলনের ফলে এই গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গ, আদিবাসী নাগরিক ও ল্যাটিনো আন্দোলনের সাথে জড়িত ক্রমবর্ধমান মানুষ ফিলিস্তিনকে তাদের কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করার কারণে সুনির্দিষ্টভাবে এই গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে। গত সাক্ষাৎকারে আমি ফিলিস্তিন আন্দোলনের কর্মীদের কথা উল্লেখ করেছিলাম; বলেছিলাম কিভাবে কাঁদুনে গ্যাসকে প্রতিহত করা যায়, সে ব্যাপারে তারা টুইটারে ফারগুসেনের বিক্ষোভকারীদের পরামর্শ দিচ্ছিল। সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রে সামাজিক গণমাধ্যমের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ।

একটি কনফারেন্স উপলক্ষে আমি সম্প্রতি সেভিলাতে গিয়েছিলাম। সেখানে এসজেপি ইউসিএলএর রহিম কুরওয়ার সাথে সাক্ষাৎ হয়। আপনি তাঁকে চেনেন। আমি তাঁকে বলেছিলাম যে আপনার সাথে আমার দেখা হবে। ছাত্র আন্দোলন বিষয়ে রহিম আপনার জন্য একটি মজার প্রশ্ন রেখেছেন। তিনি প্রশ্ন করেছেন : বর্তমানে ছাত্র আন্দোলনের ভূমিকা কী, এবং বিশেষ করে এমন এক সময়ে, যখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ক্রমবর্ধমান হারে অভিজাতদের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হচ্ছে, তখন ক্যাম্পাস এলাকায় বৃহত্তর সম্প্রদায় ও আন্দোলনের সম্পর্কের ব্যাপারে ছাত্রদের চিন্তাভাবনা কী হবে?

অবশ্যই। ঐতিহাসিকভাবে, জনসমাজের সাথে সংযুক্ত অসংখ্য সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে ইউসিএলএতে কাজ করেছে। আমি নিজে ইউসিএলএ-এর সাথে থেকে সংগ্রাম করেছি। কিন্তু বর্তমানে ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমারেখাকে, এবং বিশ্ববিদ্যালয়কে নব্য-উদারতাবাদীদের একটি দুর্গ হিসাবে স্থাপন করার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে যে চ্যালেঞ্জ করছে, সেই চ্যালেঞ্জগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এসজিপির মাধ্যমে সারা দেশে ক্যাম্পাসগুলোকে বিডিএসের সাথে সংযুক্ত করার ফলে বিডিএস আন্দোলনকে শুধু আরও শক্তিশালী হতেই প্রভাব ফেলেনি, ছাত্রদের জেল বেসরকারীকরণকে চ্যালেঞ্জ করার সম্ভাবনাও উš§ুক্ত করেছে। অনেক ক্যাম্পাসে ছাত্ররা যেখানে ফিলিস্তিনের দখল থেকে মুনাফা অর্জনকারী কর্পোরেশনগুলোর বিরুদ্ধে প্রস্তাব তৈরির প্রচেষ্টা করছে, সেখানে একই সঙ্গে জেলখানার বেসরকারীকরণ থেকে মুনাফা অর্জনকারী কর্পোরেশনগুলোর বিরুদ্ধে প্রস্তাব আনার জন্যও সংগ্রাম করছে। সুতরাং আমি মনে করি, অনেক ব্যাপারে এই দুটি বিষয় পারস্পরিক একটি নির্ভরশীলতায় সংযুক্ত। এবং অনেকের মধ্যে এটি একটি উদাহরণ প্রতিষ্ঠা করেছে।

ফিলিস্তিন প্রেক্ষিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘটনাগুলো দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবৈষম্যবিরোধী সময়ের ঘটনাগুলোর সাথে তুলনামূলক বিচারে কী একই রকম, নাকি ভিন্ন?

অনেক সাদৃশ্য রয়েছে, বিশেষত বিডিএস আন্দোলন কর্তৃক দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের ঐতিহ্যকে অনুসরণ করার সিদ্ধান্তের কারণে। বৈশ্বিক সংহতি তৈরির জন্য বিডিএস মাস বয়কট বা গণবর্জন পদ্ধতি অবলম্বন করেছিল। আমার মনে হয়, জায়নবাদী তদবিরকারীদের অস্তিত্ব কিছুটা পার্থক্য তৈরি করেছে। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী তদবিরও শক্তিশালী ছিল। কিন্তু জায়নবাদী তদবিরের প্রভাবের শক্তির কাছে তা নগণ্য। সেই প্রভাব কৃষ্ণাঙ্গদের গির্জা পর্যন্ত পৌঁছেছে; ইসরাইল তাদের সপক্ষে গুরুত্বপূর্ণ কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিদের নিযুক্ত করার জন্য প্রত্যক্ষভাবে চেষ্টা করেছে। আমি জানি না বর্ণবাদবিরোধ যুগের সময় আমরা সেই স্তরের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলাম কি না। ইসরাইল রাষ্ট্র নিশ্চিতভাবে সেই আন্দোলন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছে। একই সাথে আমি মনে করি, সেই সময়ের সংগ্রামে আজকের আন্দোলনকারী দলগুলোর মত তৃণমূল পর্যায়ের সাথে সম্পৃক্ততা ছিল না। আমার অভিজ্ঞতায়, একটা সময় পর্যন্ত ফিলিস্তিনের সংগ্রামের জন্য উদ্বুদ্ধ হতে সম্ভবত অনেকে দ্বিধাগ্রস্ত হত, কিন্তু এখন সর্বত্র এই সংগ্রামকে আলিঙ্গন করার একটি প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। ফিলিস্তিনি সংহতি নিয়ে দি আমেরিকান স্টাডিজ অ্যাসোসিয়েশন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব পাস করেছে। ন্যাশনাল উইমেন স্টাডিজ অ্যাসোসিয়েশন (এনডাব্লিউএসএ) সম্মেলনের একটি প্যানেলে আমার অংশ নেয়ার সুযোগ হয়েছিল। জায়নিস্টদের প্রভাবের কারণে এনডাব্লিউএসএ কখনও ফিলিস্তিনের পক্ষে অবস্থান নেয়নি। প্রায় ২৫০০ মানুষের একটি উš§ুক্ত সমাবেশে ফিলিস্তিন বিষয়ে সকলের ভোট আহ্বান করা হয়েছিল। উপস্থিত সকলে বিডিএসের সমর্থনে এনডাব্লিউএসএর একটি জোরালো সমর্থন আশা করছিল। বস্তুত প্রায় সকলের সমর্থন অর্জনের মাধ্যমে একটি নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেছিল। সম্ভবত কেবল ১০-২০ জন অংশগ্রহণকারী ছাড়া বাকি সবাই সমর্থনের জন্য উঠে দাঁড়িয়েছিল। অবিরাম করতালির মুখরতায় খুব উত্তেজনাকর একটি অভিজ্ঞতা হয়েছিল।

একটি বৃহত্তর পরিবর্তনের জন্য এই পরিবর্তনগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমি মনে করি, মিডল ইস্ট স্টাডিজ অ্যাসোসিয়েশনও (এমইএসএ) সম্প্রতি বিডিএসের আহ্বানের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে…

…এমনকি ইসরাইলি একাডেমিকও এটাকে একটি বড় পরিবর্তন বলছে।

এখানে স্মরণ করা প্রয়োজন যে এশিয়ান আমেরিকান স্টাডিজ অ্যাসোসিয়েশন প্রথম একটি প্রস্তাব পাস করেছিল, এবং তারপর আমেরিকান স্টাডিজ অ্যাসোসিয়েশন তাদের অনুসরণ করেছে, এবং এখন অবশ্যই…

এমইএসএ এবং…

…ক্রিটিক্যাল এথনিক স্টাডিজ অ্যাসোসিয়েশন। বেশ কিছুসংখ্যক একাডেমিক প্রতিষ্ঠান…

হ্যাঁ, সব কিছুই অসাধারণ। তবে আপনার মতানুযায়ী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ন্যায়বিচারের সপক্ষে আন্দোলন আরও শক্তিশালী করার জন্য আমরা কী করতে পারতাম? এবং আমার মতে, এই প্রশ্নটি সারা বিশ্বের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

হ্যাঁ, আমি মনে করি, আমাদের ক্রমাগত আরও সংযোগ তৈরি করতে হবে। কাজেই ফারগুসন, মাইকেল ব্রাউন, ও এরিক গার্নারের প্রসঙ্গে যখন আমরা বর্ণবাদ সহিংসতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করব, তখন ফিলিস্তিনের সাথে সংযুক্ত হওয়ার ব্যাপারটি ভুলে যাওয়া চলবে না। সুতরাং নানাভাবেই আমাদের আন্ত ব্যক্তি-পরিচয়-মিশ্রণের অনুশীলন করতে হবে। সর্বদা সেই সংযোগগুলোকে গ্রাহ্য করে মানুষকে মনে করাতে হবে যে বিচ্ছিন্নতার মাঝে কিছুই ঘটে না। তাই আমরা যখন পুলিশকে ফারগুসনে বিক্ষোভকারীদের প্রতিবাদ দমন করতে দেখব তখন দখলকৃত ফিলিস্তিনে ইসরাইলি পুলিশ এবং ইসরাইলের সেনাবাহিনী যে বিক্ষোভকারীদের প্রতিবাদ দমন করে, সে সম্পর্কেও চিন্তা করতে হবে।

আমরা পুলিশের সামরিকীকরণের ব্যাপারে কথা বলেছিলাম; ফারগুসনে দেখেছেন, ওয়েস্ট ব্যাংক, গাজাতেও দেখেছেন- এথেন্স, গ্রিসেও এখন দেখতে পাচ্ছেন। পুলিশ বাহিনীকে রোবকপস-এর মত দেখায়। যখন এই সংযোগগুলো একত্রিত করা হবে তখন আন্তর্জাতিক সংগ্রাম অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়াবে।

…কিন্তু তারা ধূর্ত, তাই ফারগুসনে আমরা সে রকম দেখিনি। সেখানে তারা সামরিকীকরণকে কম দৃশ্যমান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তবে আমরা যদি তা নাও দেখি, আমাদের সে ব্যাপারে কথা বলতে হবে। আমি মনে করি, এটি সম্ভবত আরও গুরুত্বপূর্ণ যে অদৃশ্য করার প্রচেষ্টার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মানুষের কাছে এই সামরিক প্রভাবগুলো আরও দৃশ্যমান হতে পারে।

সংযোগ প্রসঙ্গে আরব সাম্রাজ্যের বর্ণবাদী আন্দোলনের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গ সচেতনতা এবং মুক্তি আন্দোলনের সংযুক্তিতে আপনি কি নিজের একটি ভূমিকা দেখতে পান?

আমি আমার নিজের বিশেষ ভূমিকা, নিজের ব্যক্তিগত ভূমিকার ব্যাপারে কথা বলব কি না সে বিষয়ে নিশ্চিত নই। তবে নিশ্চিতভাবে সেই সংযোগগুলো তৈরি করা, তাদেরকে আরও দৃশ্যমান এবং অনুভবনীয় করার প্রচেষ্টায় আমি নিজেকে দেখতে পাই। মাঝে মাঝে আমরা তৃণমূল পর্যায়ের আন্দোলন থেকে শিখি, এবং সেখান থেকে লব্ধ অন্তর্দৃষ্টি যেন আমাদের ব্যক্তিগত অর্জন হিসাবে সীমিত না করি সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। স্বীকার করতে হবে যে সেই মুহূর্তগুলো থেকে আমরা শিখেছি এবং সেখান থেকে অর্জিত অন্তর্দৃষ্টি সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে হবে। আমি নিজেকে সেই ভূমিকাতেই দেখতে পাই।

কৃষ্ণাঙ্গ নারীবাদের ব্যাপারে ফিরে আসি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গ নারীবাদের কতটা অগ্রগতি লক্ষ করছেন?

ফিলিস্তিনি সংহতির উদ্দেশ্যের সাথে আলিঙ্গনাবদ্ধ হওয়া সত্যিই অতি গুরুত্বপূর্ণ। কৃষ্ণাঙ্গ নারীবাদ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বেভারলি গাই-শেফটাল একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। ঐতিহাসিকভাবে স্পেলম্যান কলেজ কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বেভারলি সেই কলেজে শিক্ষকতা করেন…

হাওয়ার্ড জিন সেখানে শিক্ষক ছিলেন…

হ্যাঁ, তিনি শিক্ষক ছিলেন। এলিস ওয়াকার স্পেলম্যানে যোগ দিয়েছিলেন। এটি একটি ছোট আকারের নারী কলেজ। কিন্তু এর ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ফিলিস্তিন প্রতিনিধি দলে বেভারলি গাই-শেফটাল আমাদের সাথে ছিলেন। এই দলে আদিবাসী এবং অশ্বেতাঙ্গ, বুদ্ধিজীবী-আন্দোলনকারী নারীদের প্রতিনিধিত্ব ছিল। বেভারলি গাই-শেফটাল একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তিনি এতই বিনয়ী যে নিজের জন্য কখনও কোন স্থান দাবি করেন না। কিন্তু তিনি যে ভূমিকা পালন করেছিলেন তার গুরুত্বের ব্যাপারে আমি জোর দিতে চাই। স্পেলম্যান কলেজ প্রধানত একটি কৃষ্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠান। সেখানে একটি প্রধান এইচবিসিইউর একমাত্র এসজেপি অধ্যায় রয়েছে। তারা ঐতিহাসিকভাবে পরিচিত অন্যান্য কৃষ্ণাঙ্গ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছে।

আপনি কি আপনার জীবনকালে নারীবাদ সংহতকরণের এমন কোন ঘটনা দেখেছেন, যা কার্যকরভাবে পিতৃতন্ত্র ও শ্বেতাঙ্গ সুবিধাবাদী উদার নারীবাদ- উভয়কেই চ্যালেঞ্জ করেছে?

আমি মনে করি, নারীবাদী আন্দোলনসহ অন্য সকল আন্দোলন তখনই সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী হয়, যখন তারা আন্দোলনের সাথে যুক্ত নয় এমন সকল মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ও দৃষ্টিকোণকে প্রভাবিত করতে শুরু করে। তাই র‌্যাডিক্যাল নারীবাদ বা র‌্যাডিক্যাল বর্ণবাদবিরোধী নারীবাদ এই অর্থে গুরুত্বপূর্ণ যে তারা বিশেষ করে তরুণ সমাজকে সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য বর্তমান সংগ্রাম সম্পর্কে ভাবতে প্রভাবিত করেছে। যতক্ষণ পর্যন্ত লিঙ্গ, লিঙ্গ ও যৌনপরিচয়, শ্রেণি এবং জাতীয়তা কিভাবে এই সংগ্রামে জড়িত সেটা আমাদের বোধগম্য না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত কোন বর্ণবাদবিরোধী সংগ্রামের সাফল্য অর্জনও সম্ভব হবে না। একটা সময় ছিল, যখন স্বাধীনতার সংগ্রামকে কেবল পুরুষদের সংগ্রাম হিসাবে দেখা হত। কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষদের স্বাধীনতা ছিল কৃষ্ণাঙ্গদের স্বাধীনতার সমতুল্য। ম্যালকম এক্স এবং তাঁর মত অন্য অনেক ব্যক্তির দিকে নজর দিলে এরকমটাই মনে হবে। কিন্তু এখন আর এটি সম্ভব নয়। আর আমার মনে হয়, নারীবাদ এমন কোন পদ্ধতি নয়, যা শুধু নারীরাই ধারণ করবে; ক্রমবর্ধমান হারে সকল লিঙ্গের মানুষেরই নারীবাদকে গ্রহণ করতে হবে।

পরিবর্তন প্রসঙ্গে নাগরিক অধিকার আন্দোলন শেষ হওয়ার পর থেকে কৃষ্ণাঙ্গ রাজনীতির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন কী? এর সাথে কি কৃষ্ণাঙ্গ নারীবাদও সম্পর্কিত?

বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের সাথে লিঙ্গ প্রেক্ষিতের আন্ত সংযোগ জরুরি। তবে শ্রেণিভেদ, জাতীয়তা এবং জাতিগত বিষয়গুলোকেও এই আন্ত সংযোগের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। কৃষ্ণাঙ্গ আন্দোলনের পদ্ধতি আগের মত হলে আর কাজ করবে না। কৃষ্ণাঙ্গ সংগ্রাম শুধু কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষদের মুক্তির জন্য সংগ্রাম- এই ধারণাটি আন্দোলনে একটি প্রাচীর তৈরি করেছিল। বর্তমানে এরকম কোন ধারণা টিকে থাকতে পারে না। আমি মনে করি, কৃষ্ণাঙ্গ র‌্যাডিক্যাল ঐতিহ্যকে মুসলমানবিরোধী বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে, যা বর্তমান সময়ে বর্ণবাদের সবচেয়ে জঘন্য রূপ। মুসলমানবিরোধী বর্ণবাদ নির্মূল না করে কৃষ্ণাঙ্গ বর্ণবাদ নির্মূলের চিন্তা একেবারে অর্থহীন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কি বর্ণবাদমুক্ত পুলিশি তৎপরতা এবং কারাদণ্ড হওয়া সম্ভব?

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এই মুহূর্তে, এই পর্যায়ে পুলিশি ব্যবস্থা বর্ণবাদমুক্ত নয়। আমি মনে করি না যে ফৌজদারি বিচারব্যবস্থাটি বর্ণবাদ ছাড়াই কাজ করতে পারে। তার মানে হচ্ছে, একটি বর্ণবাদমুক্ত সমাজের সম্ভাবনা ভাবতে চাইলে সেই সমাজকে কারাগারমুক্ত হতে হবে; আজকের দিনে পুলিশি তৎপরতা বলতে যা বুঝি সেরকম পুলিশি তৎপরতামুক্ত হতে হবে। আমি মনে করি, একটি নিরাপদ সমাজব্যবস্থার কল্পনা করতে হলে একেবারে ভিন্ন ধরনের কাঠামো, সম্ভবত একটি পুনরুদ্ধারক বৈচারিক কাঠামোর ধারণা সামনে নিয়ে আসতে হবে। আমি নিরাপত্তাকে প্রধান বিষয় মনে করি। কিন্তু সেই ধরনের নিরাপত্তা নয়, যা পুলিশি নিয়ন্ত্রণ এবং কারাগারের ওপর  নির্ভরশীল। রূপান্তরিত বিচারব্যবস্থার মাধ্যমে সৃষ্ট একটি কাঠামো সম্ভবত ভবিষ্যতে খুব ভিন্ন ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে।

আপনি কয়েক দশক ধরে আন্দোলন-সংগ্রাম করে চলেছেন। আপনার এই চলার পেছনের প্রেরণা কী? আপনার কি মনে হয়, ভবিষ্যৎ নিয়ে আমাদের আশাবাদী থাকা উচিত?

আশাবাদ পরম প্রয়োজনীয়, এমনকি তা যদি গ্রামসির ভাষায় স্রেফ ইচ্ছার আশাবাদ এবং বুদ্ধির হতাশাবাদও হয়। সমাজের নতুন নতুন পদ্ধতির বিকাশ আমাকে সচল রেখেছে। যদি আন্দোলন বেঁচে না থাকত, যদি সামাজিক প্রতিরোধ সংগ্রাম না থাকত, তাহলে আমি বেঁচে থাকতে পারতাম কি না জানি না। তাই আমি যা করছি তাতে আমি সব সময়ই সমাজের সাথে সরাসরি নিজেকে সংযুক্ত বোধ করি। আমি মনে করি, এটি এমন একটি যুগ, যখন নব্য-উদারবাদ মানুষকে শুধুমাত্র ব্যক্তিকেন্দ্রিক ভাবনায় বাধ্য করতে চায় এবং সামষ্টিক চেতনাকে নিরুৎসাহ করে। তাই আমাদের কাজ হল সামষ্টিক চেতনায় মানুষকে উৎসাহিত করা।

সমষ্টির মধ্যেই আমাদের আশা, ভরসা সঞ্চিত রয়েছে।

 

ফাতেমা বেগম: লেখক ও অনুবাদক

ইমেইল: 

অনুবাদকের টীকা

১) ২০১৪ সালের ১৭ জুলাই তারিখে নিউ ইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্টের ড্যানিয়েল পেন্টালিও নামের পুলিশ অফিসার আফ্রিকান-আমেরিকান এরিক গার্নারকে গ্রেফতার করার সময় মাটিতে শ্বাসরোধ করে রাখে। এরিক গার্নার অচেতন হয়ে গেলে তাঁকে কোন প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়নি। পরবর্তীতে এক ঘণ্টা পর হাসপাতালে নিয়ে গেলে তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হয়।
২) ম্যালকম এক্স একজন কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান (১৯২৫-৬৫)। তিনি মানবাধিকারকর্মী ছিলেন, এবং নাগরিক অধিকার আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।
৩) অগাস্টো পিনোশে চিলিতে ১৯৭৩ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত একজন জেনারেল, রাজনীতিবিদ এবং একনায়ক প্রেসিডেন্টের ভূমিকায় ছিলেন।
৪) University College London Association (UCLA)
৫) Students for Justice in Palestine (SJP)
৬) Boycott, Divestment, Sanctions (BDS)
৭) Historically Black Colleges and Universities (HBCUÑSince 1964)

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *