Category: বিশেষ লেখা
বাঁশখালী হত্যাকান্ড ২০১৬: সরেজমিন প্রতিবেদন, বিশ্লেষণ, মিথ্যাচারের জবাব ও এলাকার মানুষের কথা
২০২১ সালের ১৭ এপ্রিল বাঁশখালীতে আবারও পুলিশের গুলিতে ৫ জন নিরস্ত্র গরীব খেটে খাওয়া ক্ষুধার্ত মানুষ নিহত হলেন। বাংলাদেশের এস আলম গ্রুপ ও চীনা কোম্পানির যৌথ কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প ঘিরে দখল, বঞ্চনা ও প্রতারণা এবং জনগণের ওপর দমন পীড়ন নির্যাতন এমনকি গুলি করে হত্যার ঘটনা এটাই প্রথম নয়। এর আগেও ২০১৬ সালে এরকম হত্যাকান্ড ঘটেছিল। সেসময় জনগণকে উন্নয়ন সম্পর্কে মিথ্যাচার করে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য জমি দখল করছিল এসব কোম্পানি। সেসময়ই এলাকার মানুষ এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। তখনও গুলি চালিয়ে কমপক্ষে চারজন মানুষকে খুন করা হয়েছিল, জখম ও ঘরছাড়া হয়েছিলেন আরও বহুজন। এরপর যৌথ বাহিনী মোতায়েন করে জবরদস্তির উপর কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ শুরু করা হয়। যে শ্রমিকেরা এখানে কাজ করছিলেন তাদের কর্মঘন্টা ও মজুরি পরিশোধে ভয়ানক জবরদস্তি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে ন্যায্য বিক্ষোভ শ্রমিকদের, সেখানে আবার পুলিশের গুলি, কমপক্ষে পাঁচজন নিহত, কতজন জখম তার হিসাব এখনও হয় নাই। জীবন নাশী এসব প্রকল্পের জন্য বারবার মানুষকে জীবন দিতে হচ্ছে।
২০১৬ সালে নিহতদের পরিবার ও আহতসহ এলাকাবাসীর ওপরই চাপানো হয় মামলা, শুরু হয় আরেকদফা হয়রানি। এরপর হত্যাকান্ডে সরকারি প্রশাসন ও এস আলম গ্রুপের ভূমিকা আড়াল করতে এবং কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পটিকে একটি পরিবেশ বান্ধব প্রকল্প হিসেবে হাজির করতে বিজ্ঞাপন ছাড়াও শুরু হয় যথেচ্ছ মিথ্যাচার। ঘটনাগুলো একইরকম ভাবে এবারেও ঘটে যাচ্ছে। তখন প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর জ্বালানী উপদেষ্টা সরাসরি সমর্থন জানান কোম্পানি ও প্রকল্পের প্রতি। সেকারণে তদন্ত, বিচার কোনোকিছুই আর অগ্রসর হয়নি। এবছরও শুরু হয়েছে, পাইকারি মামলা, হয়রানি ও মিথ্যা প্রচার।
২০২১ সালের হত্যাকান্ড বুঝতে গেলে তাই ২০১৬ সালের ঘটনাবলীর নিবিড় পর্যবেক্ষণ দরকার। সেসময় জনবিক্ষোভ ও হত্যাকান্ডের পর এ বিষয়ে বেশ কিছু অনুসন্ধান হয়েছিল। সেসব লেখা প্রকাশিত হয়েছিল সর্বজনকথা ২০১৬ সালের মে-জুলাই এবং আগস্ট-অক্টোবর সংখ্যায়। আগ্রহী সকলের সুবিধার জন্য এগুলো এখানে আমরা একসাথে হাজির করছি, এখানে পরপর চারটি লেখা দেয়া হলো। এপ্রিল মাসেই লেখক প্রকৌশলী মাহবুব সুমন, কল্লোল মোস্তফা ও নৃবিজ্ঞানী নাসরিন সিরাজ এ্যানি ঘটনাস্থলে গিয়েছেন, কথা বলেছেন বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষের সঙ্গে, এর ভিত্তিতেই তাঁদের লেখায় জানিয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয়। কল্লোল মোস্তফার লেখায় এস আলম গ্রুপের বিজ্ঞাপনী মিথ্যাচারের জবাব পাওয়া যাবে। ঘটনার একমাস পর একইবছরের মে মাসে এই অবরুদ্ধ এলাকা পরিদর্শন করে সেসময়ের পরিস্থিতি ও জনগণের কথা জানিয়েছেন মওদুদ রহমান।
350
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ও পাশের গ্রামবাসী: সংঘাত কাদের এবং কেন?
গত ১৯ ফেব্রুয়ারি রাতে এবং তার পরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় শিক্ষার্থী ও পাশের গ্রামের অধিবাসীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘাত হয়। এর পেছনে কী কারণ? কারা আসলে এর সাথে জড়িত? এটা কি আকস্মিক না দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব-বিরোধের ফলাফল? চাঁদাবাজি, মাদকসহ নানা ব্যবসার সাথে এর সম্পর্ক কী? সমাধান কোথায়? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সরেজমিন অনুসন্ধান করে লিখেছেন মেহেদী হাসান।

চাঁদাবাজি এবং মাদক বাণিজ্যের বিরুদ্ধে গেরুয়াবাসী দীর্ঘদিন ধরে নানাভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করে আসছে।বিভিন্ন সময়ে ছোট-বড় লড়াই-সংঘাত হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় সংঘাত বড় আকারের রূপ ধারণ করেছে। ধারণা করা হচ্ছে মূল ইস্যু- চাঁদাবাজি এবং মাদক বাণিজ্য বন্ধ না হলে এই লড়াই চলতে থাকবে। কিন্তু, এখন লড়াইয়ের গতিমুখ ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা চলছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মূল দাবী,’বিশ্ববিদ্যালয় এবং হল খুলে দেওয়া’র পরিবর্তে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে সাধারণ শিক্ষার্থীদের একাংশ ‘সীমানা’ দেওয়াল তৈরী করে দেওয়া’র দাবী জানাচ্ছে। এলাকার ব্যবসায়ীদের মধ্য থেকেও কেউ কেউ এই দাবীর প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ ঠিকাদারী ব্যবসার সাথে জড়িত। এলাকাবাসীর মধ্যে এই ইস্যুর প্রতি সমর্থন আদায়ের চেষ্টা চলছে। তবে স্থানীয় অধিকাংশ অধিবাসীদের কথা,“ছেলেপুলেরা চাইছে চান্দাবাজি আর ইয়াবা বন্ধ হউক। অথচ কেউ কেউ বলছে; দেওয়াল তোলা, রাস্তা বানানোর কথা। দেওয়াল তুলে দিলেই কী চান্দাবাজি বন্ধ হবে? আর আমাদের তো সাভার যাওয়ার অনেক রাস্তা আছে। নতুন করে বড় রাস্তা বানানোর দরকার কী? তার মানে কী? ঠিকাদারদের জন্য রাস্তা বানানোর দাবী কী আমরা করছি? নেতা-কর্মীদের ভাগ বাড়বে,আমাদের তাতে ফায়দা কী?”
350
আখচাষ ও রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিশিল্প: সংকট কেনো?
পুন:প্রকাশ
মোশাহিদা সুলতানা ও কল্লোল মোস্তফা
যথেষ্ট সম্ভাবনাময় হলেও বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় চিনিশিল্প প্রতিষ্ঠান ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট শ্রমিক-কর্মচারী-কর্মকর্তা ও আখচাষিদের জীবন-জীবিকা দীর্ঘদিন ধরেই গভীর সংকটে নিমজ্জিত। উৎপাদিত চিনি অবিক্রীত পড়ে থাকে গুদামে, চিনির উৎপাদন খরচ চিনির বাজারমূল্যের দ্বিগুণেরও বেশি। বেসরকারিভাবে আমদানীকৃত চিনির সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না রাষ্ট্রায়াত্ব চিনিকলগুলো। চিনিকলের শ্রমিকরা নিয়মিত বেতন পান না, দিনে দিনে কমে যাচ্ছে আখ চাষ। চিনিশিল্পের এই সংকটের কার্যকারণ ও তার সমাধানের উপায় অন্বেষণ করতে গিয়ে তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ ও মাঠপর্যায়ে অনুসন্ধানের ওপর ভিত্তি করে এই প্রবন্ধটি প্রথম প্রকাশিত হয় সর্বজনকথা, ফেব্রুয়ারি ২০১৬ সংখ্যায়। সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত এইসব সমস্যার সমাধানের উদ্যোগ না নেয়ার কারণে সাম্প্রতিক কালে রাষ্ট্রায়ত্ত চিনি শিল্প ও আখ চাষের সংকট আরো ঘনীভূত হয়েছে। আর এই সংকটকে কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর মতো রাষ্ট্রায়াত্ব চিনিকলগুলোও বন্ধ করার পায়তারা চলছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সর্বশেষ সংবাদ অনুসারে, সরকার দীর্ঘদিন ধরে অর্থসংকটে ভুগতে থাকা চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশনকে অর্থ দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে যার ফলে চলতি মৌসুমে নিবন্ধিত আখচাষিদের সার, কীটনাশক ও সেচের জন্য ঋণ দেওয়া সম্ভব হয়নি। তাই আশঙ্কা করা হচ্ছে, আসছে মৌসুমে আখ উৎপাদন আরো কমে যেতে পারে যার ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত চিনি শিল্পের লোকসান ও সংকটের পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পাবে। বর্তমান পরিস্থিতির বিবেচনায় রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিশিল্প ও আখ চাষের সংকট ও তার সমাধানের উপায় নিয়ে সর্বজনকথা, ফেব্রুয়ারি ২০১৬ সংখ্যায় প্রকাশিত লেখাটি পুন:প্রকাশ করা হলো।

১. ভূমিকা
দীর্ঘদিন ধরে গভীর সংকটে নিমজ্জিত বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় চিনিশিল্প প্রতিষ্ঠান ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট শ্রমিক-কর্মচারী-কর্মকর্তা ও আখচাষিদের জীবন-জীবিকা। রাষ্ট্রীয় চিনিকলগুলোর উৎপাদিত চিনি অবিক্রীত পড়ে আছে গুদামে। এসব কারখানায় চিনির উৎপাদন খরচ চিনির বাজারমূল্যের দ্বিগুণেরও বেশি। লোকসান দিয়ে বিক্রি করা হলেও বেসরকারিভাবে আমদানীকৃত চিনির সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না এই চিনি। ফলে চিনিকলের শ্রমিকরা নিয়মিত বেতন পান না, প্রায়ই বেতনের বদলে চিনি প্রদান করা হয় তাদের। আখচাষিরা আর চিনিকলগুলোতে আখ সরবরাহ করতে চান না, দিনে দিনে কমে যাচ্ছে আখ চাষ। চিনিকলের কাছে আখ বিক্রি করে পাওনা আদায়ের জন্য মাসের পর মাস ঘুরতে হয় তাদের। এদিকে পর্যাপ্ত আখ না পাওয়ায় চিনিকলের যন্ত্রপাতি ও শ্রমশক্তিবছরের বেশিরভাগ সময় অব্যবহৃত থাকে এবং আখ থেকে চিনি উৎপাদনের খরচ বাড়তে থাকে। চিনি খাতের এই সংকট নিরসনে ২০১৫ সালের শেষের দিকে এসে সরকার কিছু বাজার নিয়ন্ত্রণমূলক নীতি গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে দুই দফায় নতুন করে আমদানির ওপর সংরক্ষণমূলক শুল্ক আরোপ এবং ভ্যাট আরোপ। যুক্তি হচ্ছে, শুল্ক আরোপ করে বেসরকারি আমদানি নিয়ন্ত্রণে রাখা ও পিছিয়ে থাকা রাষ্ট্রীয় খাতকে প্রতিযোগিতায় টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। এই বাজার নিয়ন্ত্রণ নীতি আসলে এই চিনিশিল্পকে রক্ষা করে টেকসই উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে কি না-এই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে আমরা চিনিশিল্পের সংকটের কার্যকারণ ও তার সমাধানের উপায় অন্বেষণ শুরু করি। তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ ও মাঠপর্যায়ে সাক্ষাৎকার গ্রহণের মধ্য দিয়ে এই প্রবন্ধে চিনিশিল্পের সংকট ও সমাধানের বিবিধ উপায় অন্বেষণ করা হয়েছে।
350