নারী-পুরুষের মানস:পুরুষতান্ত্রিক ধারণা ও বৈষম্যের জৈবসামাজিক ভিত্তি-২
নারীর মনস্তত্ব: অধ্যয়নের ক্ষেত্র ও চ্যালেঞ্জসমূহ
মনিরুল ইসলাম
…নারীর জীবন সম্পর্কে একজন পুরুষ কতটা কম জানতে পারে যখন সে তাকে পর্যবেক্ষণ করে সেই কালো বা গোলাপি চশমা পড়ে যা তার লিঙ্গ তার নাকের উপর বসিয়ে দিয়েছে। হয়ত এরই ধারাবাহিকতায় অসে…গল্প উপন্যাসে তার (নারীর)উদ্ভট স্বভাব, চরম সৌন্দর্য ও চরম আতঙ্কগ্রস্ততার অদ্ভূত সমন্বয়। কারণ এভাবেই প্রেমিক তাকে দেখে থাকে, তার (প্রেমিক) ভালবাসার উত্থান-পতন, সাফল্য-ব্যর্থতার সাথে তাল মিলিয়ে আসে তার(নারীর) স্বর্গীয় সদগুণ বা নারকীয় নিচতা।
– ভার্জিনিয়া উল্ফ৭
১৮৭৪ সালে বিজ্ঞানের পৃথক একটি ধারা হিসেবে স্বীকৃতি পাবার পর ..থেকে সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত মনোবিজ্ঞানের গবেষণাগুলোকে যখন কেউ পর্যালোচনা করবে (তার কাছে) মনে হবে মনোবিজ্ঞান একান্তভাবে পুরুষের বা পুরুষ প্রাণীর আচরণে কেন্দ্রীভূত আছে। অন্যভাবে বলা যায়, নারীদের বিচার করার গৃহিত প্রথম পদ্ধতি ছিল (পুরুষের থেকে) তাদের ঘাটতিকে চিহ্নিত করা। অনেক আগের যেসব গবেষণার বিষয়বস্তু হিসেবে নারীরা অন্তর্ভূক্ত হয়েছে (সেগুলো) এমন সিদ্ধান্তে এসেছে যে নারীরা কোনো না কোনো দিক থেকে (পুরুষের চেয়ে) হীনতর।
– ফ্লোরেন্স ডেনমার্ক, Historical Development of the Psychology of Women৮
নারীর মানস বা মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে আমরা কী জানতে চাই, কেন জানতে চাই তা আমাদের এই পর্যালোচনার শুরুতেই স্পষ্ট করা দরকার। পুরুষের থেকে নারীর মানস কোন কোন দিক থেকে পৃথক শুধু এটুকুই এ অনুসন্ধানের সীমা নয়। কী কারণে এবং কী প্রক্রিয়ায় এই পার্থক্য তৈরি হয়েছে সেটা এই অনুসন্ধানের আরও গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য। নারীর মানস আয়নায় যে বাস্তবতা প্রতিফলিত তা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বৈষম্য,বঞ্চনা ও নিষ্ঠুরতা। সেই বাস্তবতার সঙ্গে তার মানসের প্রকাশিত রূপকে মেলাতে না পারলে এ সম্পর্কে সঠিক উপলব্ধিতে পৌঁছানো সম্ভব নয়। অতএব, এই অনুসন্ধানকে সেই সমাজবাস্তবতার অনুসন্ধানের দিকেও নিয়ে যেতে হবে। লিঙ্গবৈষম্যের কারণে নারীর জন্য অপেক্ষাকৃত প্রতিকূল সমাজ-বাস্তবতা তাকে নানা ধরণের মানসিক সংকটের দিকে নিয়ে যায়। তাই পুরুষশাসিত সমাজে অধিকাংশ নারী পুরুষের তুলনায় মানসিক ভাবে অনেক বেশি বিপর্যস্ত অবস্থায় থাকে। অন্যদিকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ, নারীর মানসের এই সংকটময় অবস্থার প্রকাশিত রূপকে ব্যক্তি হিসেবে তার জন্মগত বা প্রকৃতিগত দৈন্য ও অসহায়ত্বের নিদর্শন হিসেবে উপস্থিত করে। নারীর সার্বিক মুক্তির জন্য তাকে এই সংকটময় মানসিক অবস্থা থেকে মুক্ত হতে হবে এবং এর পাশাপাশি তার মানস সম্পর্কে ভুল এবং বিভ্রান্তিকর ধারণাগুলোকেও দূর করতে হবে।এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য অর্জনের জন্য আমাদের জানতে হবে এসব ধারণার অসঙ্গতিগুলো, উপলব্ধি করতে হবে তার মানসিক অবস্থার কারণ ও গতি-প্রকৃতি। প্রশ্ন হল এই অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে মনোবিজ্ঞানের মূলধারা আমাদের কতটা সাহায্য করতে পারে।
নারীর মানস সম্পর্কে আমাদের সমাজের প্রচলিত ও আধিপত্যকারী ধারণাগুলো পুরুষতান্ত্রিক সমাজ-বাস্তবতা এবং পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে উদ্ভূত হয়েছে। এ সমাজের নারী-পুরুষ সকলের দৃষ্টিকেই পুরুষতন্ত্রের এই চশমা কম-বেশি আচ্ছন্ন করে রেখেছে। এই আচ্ছন্ন দৃষ্টিভঙ্গী থেকে মূলধারার মনোবিজ্ঞানও মুক্ত থাকতে পারেনি। গত তিন দশক আগেও পাশ্চাত্যের মূলধারার মনোবিজ্ঞান বা সাইকোলজি ছিল এক ধরনের সামাজিক বিনির্মাণ যা পুরুষ মনস্তত্ত্ববিদদের দ্বারা তৈরি এবং শুধু পুরুষের জন্যেই।৮ কারণ ওই সময় পর্যন্ত নারীর মানসকে পৃথক একটি পরিপ্রেক্ষিতে অর্থাৎ তার অবস্থান ও বাস্তবতার নিরিখে অধ্যয়ন করার কোন উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ ছিল না এবং মনস্তত্ত্বের গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন মূলত পুরুষ মনস্তত্ত্ববিদগণ। জার্মান মনস্তত্ত্ববিদ উইলহেম উন্ডকে বলা হয় আধুনিক মনোবিজ্ঞানের জনক কারণ ১৮৭৪ সালে তিনিই প্রথম মনস্তত্ত্বকে দর্শন ও জীববিজ্ঞান থেকে পৃথক করেন এবং একে গবেষণাভিত্তিক করার উদ্যোগ নেন। ওই সময় থেকে বিশ শতকের আশির দশক পর্যন্ত মনোবিজ্ঞানের যত গবেষণা হয়েছে তা মূলত পুরুষের এবং পুরুষ প্রাণীর আচরণকে বিচার-বিশ্লেষণ করেছে। অধিকাংশ গবেষণায় বিষয়-বস্তু হিসেবেও নারীদের অন্তর্ভূক্ত করা হয় নি। যেখানে নারীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে সেখানেও তাদের যৌনতা ও জেন্ডারগত পার্থক্যের বিষয়টি যথাযথভাবে উল্লেখ না থাকায় মানুষের মনের উপর এসব বিষয়ের (যৌনতা ও জেন্ডার) প্রভাবকে অনুধাবন করা যায় নি। পুরুষাধিপত্যে আক্রান্ত মনোবিজ্ঞানের এই ধারায় পুরুষের আচরণ ও মনোভাবকে আদর্শ (Norm) বলে ধরে নেয়া হয়েছে এবং সেই মানদণ্ডে বিশ্লেষিত হয়েছে নারীর মানস।
নারীর মনস্তত্বকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করার প্রতিবন্ধক প্রথমত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে নারী সম্পর্কে প্রচলিত ভুল ও বিভ্রান্তিকর ধারণাগুলো। এসব ধারণার বেশির ভাগই অবৈজ্ঞানিক এবং আপাত-পর্যবেক্ষণের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এসব ধারণার দ্বারা সাধারণ অপেশাদার মানুষেরা যেমন আক্রান্ত ও বিভ্রান্ত হন তেমনি হয়ে থাকেন পেশাদার মনোবিজ্ঞানীরাও। নারীর মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে অনুসন্ধান প্রচলিত ভুল ধারণা দ্বারা যেমন আক্রান্ত হয়েছে তেমনি আক্রান্ত হয়েছে (এসব ধারণা দ্বারা প্রভাবিত) বিজ্ঞানীদের পক্ষপাতদুষ্ট সিদ্ধান্ত দ্বারা। উনিশ শতকের যে দুজন বিজ্ঞানীর কাজ মনোবিজ্ঞানকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে তারা হলেন চার্লস ডারউইন এবং সিগমুন্ড ফ্রয়েড। এই দুই বিজ্ঞানীর তত্ত্ব এবং পরবর্তী পর্যায়ে সেই তত্ত্বের জৈব-নির্ধারণবাদী ব্যাখ্যার মাধ্যমে নারীকে বিবর্তনের হীনতর ফসল এবং দুর্বলতর মানস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিশ শতকের প্রথম দিক থেকে নারীরা মনোবিজ্ঞানের অধ্যয়ন,চর্চা ও গবেষণায় আসতে থাকেন। মনোবিজ্ঞানের এই পুরুষ-কেন্দ্রিকতা এবং পুরুষতান্ত্রিক পক্ষপাত-দুষ্টতায় ‘হোচট খেতে’ থাকেন তারা। তাঁরা লক্ষ্য করেন যে মূলধারার মনোবিজ্ঞান শুধু পুরুষতান্ত্রিক ধারণার প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট তাই নয় নারীর জীবনের ভিন্ন বাস্তবতার কোনো প্রতিফলন সেখানে নেই।
উনিশ শতকের যে দুজন বিজ্ঞানীর কাজ মনোবিজ্ঞানকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে তারা হলেন চার্লস ডারউইন এবং সিগমুন্ড ফ্রয়েড। এই দুই বিজ্ঞানীর তত্ত্ব এবং পরবর্তী পর্যায়ে সেই তত্ত্বের জৈব-নির্ধারণবাদী ব্যাখ্যার মাধ্যমে নারীকে বিবর্তনের হীনতর ফসল এবং দুর্বলতর মানস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
মনোবিজ্ঞানে নিয়োজিত নারীদের এই ‘হোচট খাওয়া’ একদিক থেকে তাদের জন্য ইতিবাচক হয়েছিল, কারণ এর প্রতিক্রিয়ায় তাদের অনেকেই মনোবিজ্ঞানের গবেষণায় নিয়োজিত হন। পরবর্তী কালে এরাই তাদেরগবেষণালব্ধ জ্ঞান ও উপলব্ধিদিয়ে নারীর মনস্তত্ব সম্পর্কে অনেক ভুল ধারণার অবসান ঘটাতে পেরেছিলেন। জৈববিবর্তনের ক্ষেত্রে ডারউইনের প্রাকৃতিক-নির্বাচন এবং যৌন-নির্বাচন তত্ত্বকে সরলীকৃত করে সামাজিক প্রপঞ্চকে ব্যাখ্যা করার প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন হার্বার্ট স্পেন্সার ও অন্যান্যরা। এর থেকেই ‘সামাজিক ডারউইনবাদের’ উৎপত্তি ঘটে যার মাধ্যমে অন্যান্য অনেক প্রচলিত ধারণার মত নারীর অধস্তনতা এবং হীনতাকে ‘প্রকৃতিগত’ বলে দেখানো হয়েছিল। বলা হল, যেহেতু পুরুষকে যৌনসঙ্গী পাবার জন্য প্রতিযোগিতা করতে হয় অতএব তাদের মধ্যে বৈচিত্র্য বা পরিবর্তনের ক্ষমতা বেশি থাকে। এই তত্ত্ব দাবী করল-নারীর শরীর প্রজননে প্রচুর শক্তি নিয়োজিত করে অতএব মস্তিষ্কের কাজ (Brain Work) করার জন্য শক্তি তার আর বিশেষ কিছু থাকে না (অর্থাৎ নারীর বুদ্ধি ও চিন্তা পুরুষের চেয়ে নিকৃষ্টতর)। এধরণের জৈবনির্ধারণবাদী ব্যাখ্যার ছড়াছড়ি ছিল সে সময়ের মূলধারার মনোবিজ্ঞানে। ফ্রয়েডের মনোসমীক্ষণের তত্ত্বও এক অর্থে জৈবনির্ধারণবাদী কারণ এই তত্ত্বে দাবী করা হচ্ছে শরীরসংস্থানগত (Anatomical) এবং তার ফলশ্রুতিতে যৌনতার ক্রিয়াগত পার্থক্যই নারীপুরুষের মনস্তাত্বিক পার্থক্যের মূল কারণ। এই তত্ত্ব অনুযায়ী শরীরসংস্থানগত কারণেই (By virtue of Anatomy) নারীর নিয়তি হচ্ছে পুরুষের চেয়ে নৈতিকভাবে কম পরিণত (less morally mature), দুর্বলতর অভিযোজন ক্ষমতাসম্পন্ন (less acculturated) এবং নিকৃষ্টতর ব্যক্তিত্ব-সম্পন্ন হওয়া।৯
নারীর মনস্তত্ত্বের অধ্যয়নে তাই মনোবিজ্ঞানের মূলধারার বাইরে এক পৃথক ধারা তৈরি করা প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছিল। খুব স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিতভাবেই মনোবিজ্ঞানের ক্ষেত্রের নারী গবেষকেরাই প্রথম এগিয়ে আসেন আশার আলো দেখাতে। এ ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম উদ্যোগী হন মার্কিন নারী লিটা হলিংওয়ার্থ। তিনিই প্রথম মনোবিজ্ঞানী যিনি মূলধারার মনোবিজ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত পুরুষতান্ত্রিক পক্ষপাতদুষ্ট ক্ষেত্রগুলোকে পরীক্ষা করে দেখার উদ্যোগ নেন। ১৯১৪ সালে প্রকাশিত তাঁর গবেষণা অভিসন্দর্ভে হলিংওয়ার্থ নারীর সামাজিক ভূমিকা, ঋতুস্রাবের সময় নারীর শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা এবং সামাজিক ডারউইনবাদীদের variability hypothesis ইত্যাদির পর্যালোচনা করেন। গবেষণার মাধ্যমেই তিনি এসব বিষয়ের ব্যাখ্যায় পুরুষতান্ত্রিক পক্ষপাতদুষ্টতার স্বরূপ উন্মোচন করতে সচেষ্ট হন। পরবর্তীকালে তিনি ওই সময়ের বিশিষ্ট নৃতত্ত্ববিদ রবার্ট লোয়ির সঙ্গে যৌথভাবে গবেষণা করেন। ১৯১৬ সালে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে তাঁরা দেখান- বিভিন্ন সংস্কৃতিরএবং জীবতাত্ত্বিক ও মনস্তাত্ত্বিক নানা গবেষণার তথ্য উপাত্তের মধ্যে নারীর প্রকৃতিগত হীনতা বা নিকৃষ্টতার সপক্ষে কোন বস্তুনিষ্ঠ প্রমাণ পাওয়া যায়নি।১০
খুব স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিতভাবেই মনোবিজ্ঞানের ক্ষেত্রের নারী গবেষকেরাই প্রথম এগিয়ে আসেন আশার আলো দেখাতে। এ ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম উদ্যোগী হন মার্কিন নারী লিটা হলিংওয়ার্থ। তিনিই প্রথম মনোবিজ্ঞানী যিনি মূলধারার মনোবিজ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত পুরুষতান্ত্রিক পক্ষপাতদুষ্ট ক্ষেত্রগুলোকে পরীক্ষা করে দেখার উদ্যোগ নেন।
হলিংওয়ার্থ কিছুটা আশার আলো দেখালেও তার সময়ে নারীর মনস্তত্ত্ব অধ্যয়নের যৌক্তিক ও বৈজ্ঞানিক পথ তৈরির প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করা সহজ ছিল না। বিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত মূলধারার মনোবিজ্ঞানে আধিপত্যকারী অবৈজ্ঞানিক ও পুরুষতান্ত্রিক চিন্তার প্রভাব এতটা ‘সর্বব্যাপী’ ছিল যে এর প্রভাব কাটানো ছিল বেশ কঠিন । এমনকি বিশ শতকের অনেক নারী গবেষকও এর দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত ছিলেন। এই ধারার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নাম হেলেন ডয়েস। ফ্রয়েডীয় ঘরানার এই নারী মনোবিজ্ঞানীর Psychology of Women বইয়ে তিনি দেখান নারীর ব্যক্তিত্বের মূল বৈশিষ্ট্য হল আত্মমুগ্ধতা (narcissism) বা আত্মকেন্দ্রিকতা, নিষ্ক্রিয়তা বা নিশ্চেষ্টতা (passivity) এবং মর্ষকামীতা (যে ব্যথা বা নিপীড়নের দ্বারা যৌনতৃপ্তি পায়) যা তার ‘নারীসুলভ’ জীবতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য।১১ নারীর মনস্তত্ত্ব অধ্যয়ণের ক্ষেত্রে ফ্রয়েডীয় ধারার এই জৈবনির্ধারণবাদী বিচ্যুতি কাটানোর ক্ষেত্রে প্রথম উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ মনোবিজ্ঞানী ক্যরেন হর্নাই’র Flight from Womanhood বইটি । হর্নাই সাইকো-অ্যানালিস্ট হিসেবে তার ক্যারিয়ার শুরু করলেও নারী গবেষক হিসেবে লক্ষ্য করেন মনোবিজ্ঞানে পুরুষ গবেষকগণ পুরুষের মনস্তত্ত্ব নির্মাণ করেছেন নারীরটা নয়। তিনিই প্রথম ফ্রয়েডীয় জৈবনির্ধারণবাদী ব্যাখ্যার বিপরীতে নারীর মনস্তত্ত্ব গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উপাদানসমূহের প্রভাবকে চিহ্নিত করেন।তার পথ ধরে পরবর্তীকালে আরও অনেকে ফ্রয়েডীয় তত্ত্বের সীমাবদ্ধতাকে উন্মোচণে এগিয়ে আসেন।
অবৈজ্ঞানিক ও পুরুষতান্ত্রিক চিন্তার প্রভাব এতটা ‘সর্বব্যাপী’ ছিল যে এর প্রভাব কাটানো ছিল বেশ কঠিন । এমনকি বিশ শতকের অনেক নারী গবেষকও এর দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত ছিলেন।
১৯৫০ ও ১৯৬০ এর দশকে এসে নারীর মনস্তত্ত্বের অধ্যয়ণ ও গবেষণা নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। মনোসমীক্ষণ ও সামাজিক ডারউইনবাদের জৈবনির্ধারণবাদী বিভ্রান্তি অতিক্রম করার পর নতুন প্রশ্ন সামনে আসে তা হল নরনারীর মানসিক পার্থক্য গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে কতটা জৈবিক এবং কতটা সামাজিক বিষয়গুলি দায়ী? অর্থাৎ সেই নেচার-নার্চার বিতর্ক। এই বিতর্কে সামাজিক ডারউইনবাদী, ফ্রয়েডীয় এবং ইহুদী-খ্রিস্টান ঐতিহ্যবাদীরা নারী পুরুষের মানস সম্পর্কে প্রচলিত (পুরুষতান্ত্রিক) জেন্ডারগত ধারণার ছাঁচকেই (stereotype) নতুন করে উপস্থিত করেন। তারা সেই পুরানো জৈবনির্ধারণবাদী যুক্তি নতুন করে নিয়ে আসেন। এ সময়ে নতুন ধারার নারী গবেষকগণ বিজ্ঞানের সমসাময়িক জ্ঞান ও বোধের উপর ভিত্তি করে নতুনভাবে জৈবনির্ধারণবাদী যুক্তিকে মোকাবেলা করেছিলেন। এদের মধ্যে অন্যতম ভায়োলা ক্লেইন দেখান পুরুষ-প্রাধান্যের সংস্কৃতিতে পুরুষের ক্ষমতা, বৈশিষ্ট্য ও স্বভাবের বহুবিধ বৈচিত্র্য ও তারতম্যকে স্বীকৃতি দেয়া হলেও নারীদের মোটের উপর কেবল একটি মানসিক ধরণ হিসেবে দেখানো হয়। তেমনি পুরুষের তৈরি একটি সিস্টেমের মধ্যে, পুরুষ গবেষকরা প্রতিটি পুরুষের আলাদা বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করতে পারলেও নারীদের ক্ষেত্রে (যত রকম বৈশিষ্ট্যই থাক) সবাই তাদের বিচারে এক কথায়-‘একেবারে মেয়েলি’ (typically feminine)।১২
পুরুষ গবেষকরা প্রতিটি পুরুষের আলাদা বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করতে পারলেও নারীদের ক্ষেত্রে (যত রকম বৈশিষ্ট্যই থাক) সবাই তাদের বিচারে এক কথায়-‘একেবারে মেয়েলি’ (typically feminine)।
১৯৭০ ও ১৯৮০ এই দুই দশকে মনোবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে পশ্চিমা পুঁজিবাদী দেশগুলোতে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে প্রথমত নারীর মনস্তত্ত্ব অধ্যয়ণের অংশটি মনোবিজ্ঞানের একটি পৃথক বিভাগ হিসেবে স্বীকৃতি পায় (Division 35)।১৩ দ্বিতীয়ত পশ্চিমা বিশ্বে নারীবাদী চিন্তার প্রসার ঘটে এবং নারীবাদী চিন্তকগণ নারীর মনস্তত্ত্ব অধ্যয়নের ক্ষেত্রে অসঙ্গতি ও সীমাবদ্ধতাগুলোকে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গী থেকে চিহ্নিত করতে থাকেন। ৫০ ও ৬০ এর দশকের নারী গবেষকগণ নারীর ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতার সঙ্গে তার জীবতাত্ত্বিক বিশিষ্টতার মিথষ্ক্রিয়ার গুরুত্বকে তুলে ধরেছেন, কিন্তু এ সময়ে নারীবাদীরা দেখালেন নারীর জন্য পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বাস্তবতা আসলে কেমন এবং কীভাবে সেটা মনের উপর ক্রিয়া করে। নারীবাদী লেখক কেট মিলেট তার Sexual Politics বইয়ের ‘মনস্তাত্ত্বিক রাজনীতি’ অংশে লেখেন-“যে ধরণের সার্বক্ষণিক নজরদারীর মধ্যে নারীকে থাকতে হয় সেটা তার শিশুসুলভতাকে স্থায়ী করতে উদ্যত হয় এমনকি উচ্চশিক্ষার মত একটি পরিস্থিতিতেও। টিকে থাকা এবং এগিয়ে যাবার জন্য তাকে সবসময়েই ক্ষমতাধর পুরুষের অনুমোদন নিতে হয়। …পিতৃতান্ত্রিক সংস্কৃতির ইতিহাসে এবং অতীতে ও বর্তমানে এই সংস্কৃতির সকল মাধ্যমে তাকে যেভাবে প্রতিফলিত করা হয়েছে, নারীর অন্তর্গত ভাবমূর্তির উপর এর একটি বিধ্বংসী প্রভাব রয়েছে। সামান্যতম আত্মসম্মান ও মর্যাদার দাবী থেকেও সে রীতিমত বঞ্চিত হয়েছে।”১৪ এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯০ এর দশকে নারীবাদীদের দ্বারা নতুনভাবে লিখিত হয় নারীর মানসের গতিপ্রকৃতি।
নারীবাদী লেখকদের অনুসন্ধানে নারীর মনস্তত্বের অধ্যয়ন নতুন মাত্রা পায় কারণ তারা অন্যান্য গবেষকদের চেয়ে গভীরভাবে নারীর জীবনের বহুমাত্রিক বাস্তবতাকে বিবেচনায় নিয়েছেন। প্রথমদিকে তারা পূর্ববর্তী গবেষণাসমূহের অসঙ্গতি অনুসন্ধানে বেশি ব্যস্ত ছিলেন। কিন্তু বর্তমানে তাদের গবেষণা বহুমাত্রিক রূপ নিয়েছে এবং প্রাসঙ্গিক সকল বিশেষায়িত দিকে বিস্তৃত হয়েছে। পদ্ধতিগত দিক থেকেও এই ধারা এগিয়ে গিয়েছে এবং কিছু নতুন কার্যকর পদ্ধতিও উদ্ভাবিত হয়েছে। সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য দুটি পদ্ধতির একটি হচ্ছে feminist positivist empiricist, যে পদ্ধতি প্রচলিত বিজ্ঞানের তথ্য উপাত্ত সংগ্রহের মাধ্যমেই জেন্ডারের পক্ষপাতদুষ্টতা কাটাতে উদ্যোগী হয়।১৫ অন্য পদ্ধতিটি হচ্ছে contextual approach যে পদ্ধতি নারীর মনস্তত্ত্বকে এমন একটি বহুমাত্রিক কাঠামোর মধ্যে দেখে যেখানে নারীর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতাকে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে।১৬ এই দুই ধরণের অনুসন্ধানের সমন্বয়ই নারীর মনস্তত্ত্বের অধ্যয়ণকে পূর্ণাঙ্গতা দিতে পারে।
এতোক্ষণ আমাদের আলোচনায় আধুনিক মনোবিজ্ঞানের যে সব প্রসঙ্গ ও সমস্যার কথা উল্লিখিত হয়েছে তা যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপের মনোবিজ্ঞানী ও তাদের কাজকে অন্তর্ভূক্ত করলেও সোভিয়েত মনোবিজ্ঞানী বা তাদের কাজকে অন্তর্ভুক্ত করেনি। এ ধারার মনোবিজ্ঞানীরা আমাদের বর্তমান আলোচনায় প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি কারণে। সোভিয়েত মনোবিজ্ঞানীরাই প্রথম ফ্রয়েড ও তার অনুসারীদের পদ্ধতিগত ত্রুটি ও জৈবনির্ধারণবাদী বিচ্যুতিকে যৌক্তিকভাবে খণ্ডন করেছিলেন। যে দর্শনের উপর ভিত্তি করে তারা নরনারীর মানসকে উপলব্ধির পথে এগিয়েছিলেন সেটা আধুনিক মনোবিজ্ঞানের মূলধারার দর্শন না হলেও এটা বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গী থেকে মানুষের মনস্তত্ত্বকে অধ্যয়য়েনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি ধারা। এই দর্শন অনুযায়ী মানুষের মানসকে উপলব্ধি করতে হলে তাকে প্রথমত সামাজিক জীব হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। এই ধারার মনোবিজ্ঞানীদের মতে, মানুষের জন্মগত মানসিক প্রবণতা ও বৈশিষ্ট্য থাকে কিন্তু ওগুলো তার ব্যক্তিত্বের নির্ণায়ক নয়। ব্যক্তিত্বের (personality) বিকাশ তখনই শুরু হয় যখন সে অন্য মানুষের সঙ্গে সামাজিক সম্পর্কে নিয়োজিত হয়।১৭ অর্থাৎ, মানবিক সক্রিয়তার আগে ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটে না। অতএব, নরনারীর ব্যক্তিত্বের পার্থক্য তৈরির ক্ষেত্রেও তাদের পৃথক সমাজ-বাস্তবতা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এর ফলে তাদের ভিন্ন রকমের সামাজিক সম্পর্কের মধ্যে যেতে হয়।
ব্যক্তিত্বের (personality) বিকাশ তখনই শুরু হয় যখন সে অন্য মানুষের সঙ্গে সামাজিক সম্পর্কে নিয়োজিত হয়। অর্থাৎ, মানবিক সক্রিয়তার আগে ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটে না। অতএব, নরনারীর ব্যক্তিত্বের পার্থক্য তৈরির ক্ষেত্রেও তাদের পৃথক সমাজ-বাস্তবতা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এর ফলে তাদের ভিন্ন রকমের সামাজিক সম্পর্কের মধ্যে যেতে হয়।
নারীর মনস্তত্ত্ব অধ্যয়নে কোন কোন বিষয় বা ক্ষেত্রকে আমরা অন্তর্ভুক্ত করব সে প্রসঙ্গে আবার ফিরে আসতে চাই। নারীপুরুষের মানস সম্পর্কে পুরুষতন্ত্রের পক্ষপাতদুষ্ট ধারণা ও বিভ্রান্তি অতিক্রম করে এর গতিপ্রকৃতি ও ভিত্তিকে পরিপূর্ণভাবে বোঝার জন্য আমরা নারীবাদী অনুসন্ধানের উপরিউক্ত দুটো পদ্ধতির সমন্বয় করতে চাই। এ ক্ষেত্রে যে সব প্রশ্নের আলোচনা এখানে গুরুত্বপূর্ণ সেগুলো হচ্ছে-
১) জন্মগতভাবে নারীপুরুষের মানসিক প্রবণতার পার্থক্য কতটুকু? এর জৈবিক ভিত্তি কি এবং পরিণত মানসের গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে এর ভূমিকা কতটুকু?
২) নারীপুরুষের মানস সম্পর্কে প্রচলিত জেন্ডারগত ধারণাগুলোর ভিত্তি কি এবং এগুলো কতটা গ্রহণযোগ্য?
৩) ‘নারীসুলভ’ মানস গড়ে তুলতে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বহুবিধ নিয়ন্ত্রণ, খবরদারী ও নিপীড়ন কতটা ভূমিকা রাখে?
৪) পুরুষের মধ্যে ‘পুরুষালি’ মনোভাব গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে পরিবার, সমাজ ও অন্যান্য বিষয়গুলো কীভাবে ক্রিয়া করে?
৫) লিঙ্গবৈষম্যের মধ্যে গড়ে ওঠা মনস্তত্ত্ব নরনারীর মানসিক ও অন্যান্য সংকটের জন্য কতটা দায়ী ?
৬) লিঙ্গবৈষম্যমুক্ত সমাজ এবং নারীর সার্বিক মুক্তির জন্যনারীপুরুষের মনস্তত্ত্বের বিজ্ঞানভিত্তিক ও নারীবাদী অধ্যয়ন কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
মনিরুল ইসলাম: লেখক, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও শিক্ষক, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল।
ইমেইল: monirul852@gmail.com
তথ্যসূত্র:
৭. Virginia Woolf : Quoted in-Courses in the Psychology of Women:Catalysts for Change (Michele A. Paludi et al); Florence L. Denmark and Michele A. Paludi: Psychology of Women: A Handbook of Issues and Theories(2nd edition),Praeger Publishers, Westport, CT,USA, 2008, pp-192
৮.Florence L. Denmark et al :Historical Development of the Psychology of Women; Florence L. Denmark and Michele A. Paludi: Psychology of Women: A Handbook of Issues and Theories(2nd edition),Praeger Publishers, Westport, CT,USA, 2008, pp-5.
৯. Ibid- pp-12-13.
১০.Ibid- pp-9-10.
১১.Ibid- pp-13-14.
১২. Klein, V. (1950). The stereotype of femininity. Journal of Social Issues, 6, 3–12
১৩.Florence L. Denmark et alIbid- pp-26-27
১৪. Kate Millet : Sexual Politics ; University of Illinois Press, Urbana and Chicago, 1969 (Reprinted on 2000), pp-54
১৫. Riger, S. (2002). Epistemological debates, feminist voices: Science, social values,and the study of women. In W. Pickren & D. Dewsbury (Eds.), Evolvingperspectives on the history of psychology. Washington, DC: American PsychologicalAssociation.
১৬. Wilkinson, S. (2001). Theoretical perspectives on women and gender. In R. K.Unger (Ed.), Handbook of the psychology of women and gender (pp. 17–27). Hoboken, NJ: John Wiley & Sons.
১৭. Karl Levitin : One is not born a Personality : Profiles of Soviet Educational Psychologists, Progress Publishers, 1980, Moscow pp-63-64.
216