২২ পরিবারের অতীত ও বর্তমান-১৩
‘বিমূঢ় পরিস্থিতি’ — ডিম পাড়ে হাঁসে খায় বাঘডাসে
মেহেদী হাসান
বাংলাদেশে পুঁজিবাদের বিকাশ উল্লেখযোগ্য আকার নিয়েছে। এই বিকাশধারায় একদিকে তৈরি হয়েছে পাকিস্তানের ২২ পরিবারের চেয়েও সম্পদশালী বেশ কিছু গোষ্ঠী, অন্যদিকে বৈষম্য ও পরিবেশ বিধ্বংসী তৎপরতাও অভূতপূর্ব মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে ‘উন্নয়ন’ ধারার স্বরূপ বিশ্লেষণ, পুঁজির কেন্দ্রীভবনের ধরন, শ্রেণীবিন্যাস, এই ধারার পুঁজিবাদ বিকাশে রাষ্ট্রের ভূমিকা ইত্যাদি পরীক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান প্রবন্ধ ধারাবাহিকভাবে এই অনুসন্ধান বিশ্লেষণ হাজির করছে। ত্রয়োদশ কিস্তিতে মূলত প্রেসিডেন্ট আব্দুস সাত্তারের সময়কালে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের দৈন্যদশা, নব্য ধনিক শ্রেণীর দাপট এবং জনগণের দৈনন্দিন জীবনে তার প্রভাব নিয়ে তৎকালীন সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর ও অভিমত তুলে ধরা হয়েছে।
‘‘…যেখানে মুনাফা নেই কিংবা নামমাত্র মুনাফা, পুঁজি তা পরিহার করে চলে। যথেষ্ট মুনাফা থাকলে পুঁজি অত্যন্ত সাহসী হয়ে ওঠে। ১০ শতাংশের মতো মুনাফা থাকলে পুঁজি যেকোন স্থানে বিনিয়োজিত হবে; ২০ শতাংশের মতো থাকলে সৃষ্টি হবে আগ্রহের; ৫০ শতাংশ হলে দেখা দেবে সুস্পষ্ট দুঃসাহস; ১০০ শতাংশ হলে তা সমস্ত মানবিক অধিকার পদদলিত করতেও প্রস্তুত থাকবে; আর যদি মুনাফা ৩০০ শতাংশ হয়, তবে এমন কোন অপরাধ নেই যা সংঘটিত করতে তার কোন নীতিবোধের বালাই থাকবে অথবা পুঁজির মালিকের গলায় ফাঁসির দড়ি পড়ার আশংকা আছে এমন ঝুঁকি নিতেও সে পিছ পা হবে না।’’ – কার্ল মার্কস১
প্রেসিডেন্ট ঘোষিত ‘বিমূঢ় পরিস্থিতি’র কয়েকটি নমুনা
১৯৮১ সালের ৩০ মে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন বিচারপতি আব্দুস সাত্তার। পরে তিনি ১৯৮১ সালের ১৫ নভেম্বর দেশব্যাপী অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ৬৬% ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তাঁর শাসনকালে সরকারের মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ প্রকাশিত হয়। এই সময়ে প্রেসিডেন্ট অর্থনীতিতে ‘বিমূঢ় পরিস্থিতি’ সৃষ্টি হয়েছে বলে উল্লেখ করেন। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সেনাপ্রধান হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ কর্তৃক এক সামরিক অভ্যুত্থানে রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তার ক্ষমতাচ্যুত হন। এই সময়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সাথে সম্পর্কিত থেকে যত ধরনের দুর্নীতি, লুটপাট, দখল, চোরাই কারবার, হত্যাযজ্ঞ ইত্যাদির মাধ্যমে বিত্তশালী ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠী তৈরি হচ্ছিল তার অল্প কয়েকটি নমুনা নিম্নে উপস্থাপন করা হলো
নমুনা-১
দেশের ‘বিমূঢ় পরিস্থিতি’তে আন্তর্জাতিক ‘সাহায্য’-এর তুলনামূলক কমতি প্রবণতা, বৈদেশিক বাণিজ্যে ঘাটতির পরিমাণ দিন দিন বৃদ্ধি সত্ত্বেও দেশে বিদেশী বিনিয়োগ উপযোগী ‘চমৎকার পরিবেশে’ বিদেশী পুঁজিপতিদেরকে বিনিয়োগের আহ্বান জানান প্রেসিডেন্ট আব্দুস সাত্তার। বিদেশী পুঁজি বিনিয়োগকারীদের সব রকমের সুযোগ সুবিধা দেয়া ছাড়াও পুঁজির নিরাপত্তা ও যুক্তিসঙ্গত মুনাফা নিজ দেশে পাঠাবার ব্যাপারে দায়িত্ব গ্রহণের প্রেক্ষিতে তিনি বেশ কয়েকটি বিদেশী যৌথ উদ্যোগসহ প্রায় ৬ হাজার শিল্প ইউনিট স্থাপনের অনুমতি দেন।২
একই দিনে ‘ব্যবস্থাপনা সংকট’ শিরোনামে ‘দৈনিক বাংলা’-য় একটি নিবন্ধ ছাপা হয়। সেখানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী অধ্যাপক শামসুল হক বলেছেন, ‘‘দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সমস্যার মূলে রয়েছে ব্যবস্থাপনার দক্ষতা ও উদ্যোগের অভাব।…মুদ্রাস্ফীতি আছে, মন্দা আছে, বেকারত্ব আছে, শ্রমিক অসন্তোষ আছে আর দুর্নীতিতো আছেই।…আমাদের দেশের অফিস আদালত থেকে শুরু করে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, শিল্প এলাকা ও বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানগুলি লাভজনক প্রতিষ্ঠান হয়ে না উঠতে পারার মূলেও এই ব্যবস্থাপনার অভাবকে দায়ী করা যায়। কল-কারখানাগুলি অধিকাংশই পূর্ণ ক্ষমতায় চালু নয়। কখনো কাঁচামালের অভাবে উৎপাদন বন্ধ, কখনো বিদ্যুৎ বিভ্রাট, কখনো বা ধর্মঘট। যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে যাওয়াও খুব সাধারণ ঘটনা। পরিবেশগত বিশৃঙ্খলা কাজের গতি মন্থর করে। উৎপাদন পরিস্থিতিতে রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধির ঘটনা তাই বড় একটা ঘটে না।…আমাদের দেশে কি শিল্পকাজে, কি ব্যবস্থাপনার দক্ষতার ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব; কখনোই তেমনভাবে আরোপ করা হয়নি। …স্বজনপ্রীতি এবং নানা ধরনের দুর্নীতির ভিড়ে দক্ষতা চাপা পড়ে গেছে। উদ্যোগ হারিয়ে গেছে।’’
(২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮২, দৈনিক বাংলা)
দশদিন আগে যে চালের মন ছিল ২৪০ টাকা এখন সেটা ২৮০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। আটা বিক্রি হতো প্রতি সের ৪ টাকায়। এখন হচ্ছে প্রতি সের সাড়ে ৫ টাকায়। চিকন চাল ২৫০-৫৫ টাকা দরে বিক্রি হতো। কিন্তু এখন হচ্ছে ২৭৫ থেকে ২৮০ টাকা মন দরে। আটা কোনো কোনো স্থানে ৪ টাকার পরিবর্তে ৬ থেকে ৭ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
নমুনা-২
জনগণের জীবনযাত্রার উপর চাপের বিষয়টি সম্পর্কে সরকার ভালভাবেই অবগত ছিল কিন্তু ‘বিমূঢ় পরিস্থিতি’র এই দিকটিকে খুব যে গুরুত্বের সাথে সরকার বিবেচনা করেছে অবস্থাদৃষ্টে তেমন মনে না হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। সরকারের আগ্রহের মূল জায়গাটি ছিল দেশী বিদেশী বিনিয়োগ। লুণ্ঠন প্রক্রিয়াকে বন্ধ করার কোন উপায় তাদের হাতে ছিল না কিন্তু অপরদিকে বিনিয়োগের জন্য বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা প্রদানের কাজটি অব্যাহত থাকায় লুণ্ঠনজীবীদের ব্যবসা বৃদ্ধি করতে কোনপ্রকার অসুবিধা হয়নি। উদাহরণ হিসেবে পণ্যদ্রব্যের দামের বিষয়টি বিবেচনা করা যায়। দেশের বিভিন্ন স্থানে চাল, আটা, গুড়াদুধসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়িয়ে দেয় ব্যবসায়ীরা। কোন কোন পত্রিকাতে প্রতিবেদন ছাপা হয় এই মর্মে যে, চাল গড়ে মন প্রতি ৪০ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। দশদিন আগে যে চালের মন ছিল ২৪০ টাকা এখন সেটা ২৮০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। আটা বিক্রি হতো প্রতি সের ৪ টাকায়। এখন হচ্ছে প্রতি সের সাড়ে ৫ টাকায়। চিকন চাল ২৫০-৫৫ টাকা দরে বিক্রি হতো। কিন্তু এখন হচ্ছে ২৭৫ থেকে ২৮০ টাকা মন দরে। আটা কোনো কোনো স্থানে ৪ টাকার পরিবর্তে ৬ থেকে ৭ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। গুঁড়া দুধের দাম প্রসঙ্গে একটি দৈনিক পত্রিকায় লেখা হয়,
‘‘শীত এলে যেমন বসন্ত দূরে থাকতে পারে না, টিসিবি গুঁড়া দুধের দাম বাড়ালে ব্যবসায়ীরাও তেমনি হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারেন না। মূল্য বৃদ্ধির ব্যাপার যে একসূত্রে গাঁথা — সবাই দাম বাড়াতে এক পায়ে খাড়া। একটু ইশারা, একটু সুযোগ পেলেই হল — করিৎকর্মা ব্যবসায়ীরা দাম বাড়াতে এক লহমা সময় অপচয় করেন না। …আমদানীকৃত গুঁড়া দুধের মূল্যবৃদ্ধি ঘোষণা করে টিসিবি কর্তৃপক্ষ বোধহয় তাদের ঠোঁট নাড়াও বন্ধ করতে পারেন নি। অমনি ব্যবসায়ীরা দাম দিয়েছেন চড়িয়ে। টিসিবি কর্তৃপক্ষ বাড়িয়েছেন পাঁচ পাউন্ডের টিন প্রতি ছ’ টাকা থেকে বিশ টাকা। বেসরকারী ব্যবসায়ীরা বাড়িয়েছেন বিশ থেকে পঞ্চাশ টাকা। এই ঘটনায় অবশ্য অবাক হবার জো নেই। প্রাইভেট সেক্টরের পারফরমেন্স নাকি বরাবরই পাবলিক সেক্টরের চাইতে ভাল।…আমরা তো বুঝতে পারি না, যে দুধ আগেই আমদানী হয়েছে, যে দুধ দু’চারদিন আগেও কিছুটা কম দামে বিক্রি হচ্ছিল, সেই দুধের দাম ব্যবসায়ীরা বাড়ালেন কোন যুক্তিতে? সে কি ঝোপ বুঝে কোপ মেরে ক্রেতাসাধারণের পকেট ফাঁক করার সেই শাশ্বত ফিকির?’’ (২ ও ৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮২, দৈনিক বাংলা)
টিসিবি কর্তৃপক্ষ বাড়িয়েছেন পাঁচ পাউন্ডের টিন প্রতি ছ’ টাকা থেকে বিশ টাকা। বেসরকারী ব্যবসায়ীরা বাড়িয়েছেন বিশ থেকে পঞ্চাশ টাকা।
বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের অভাব না থাকলেও দিনকে দিন দাম বৃদ্ধি ছিল বিভিন্ন পত্রিকার প্রধান শিরোনামের অংশ। সরকার, আড়তদার ব্যবসায়ীদের স্বীকারোক্তি সত্ত্বেও এই ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটে গেছে। দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, ঢাকার বিভিন্ন চালের আড়তে পর্যাপ্ত পরিমাণ চাল আমদানী হচ্ছে। বেচাকেনাও হচ্ছে। বাজারগুলিতেও চাল সরবরাহের কোন কমতি নেই। বাজারগুলিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ চাল আছে এবং বিক্রি হচ্ছে। সরকারি গুদামেও বিপুল পরিমাণ চাল মজুদ রয়েছে। আড়তদাররাও স্বীকার করছে বাজারে চালের কোন সংকট নেই। তা সত্ত্বেও ভবিষ্যতে কোন এক সময়ে সংকট সৃষ্টি হতে পারে এরূপ প্রচারণায় বিভ্রান্ত ও আতঙ্কিত হয়ে এক শ্রেণীর লোক চাল কিনছে এবং মজুতদাররাও মজুত করছে। সাথে সাথে দাম বাড়ছে। সরকারের বাজার পরিদফতরের হিসেব মতে এক দিনে ঢাকার বাজারে বিভিন্ন জাতের চালের পাইকারী মূল্য মনপ্রতি গড়ে ৫ থেকে ১০ টাকা বৃদ্ধি এবং খুচরা মূল্য ১০ টাকা হতে ২০ টাকা বেড়েছে। আড়তদার সমিতির বক্তব্য মোতাবেক,
‘‘দাম বৃদ্ধি সাময়িক।..কতিপয় (!) স্বার্থান্বেষী ব্যবসায়ী ও ক্রেতাসাধারণের মজুত করার প্রবৃত্তির ফলে চালের এ কৃত্রিম মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে। এছাড়া এ বিষয়ে কতিপয় সংবাদপত্রের প্রচারণায় জনমনে উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়েছে এবং সকলেই সামর্থ্য অনুযায়ী প্রয়োজনের অধিক চাল কেনায় আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। অথচ বাজারে এবং দেশে চালের মজুত চাহিদা অনুযায়ী মোটেও ঘাটতি নেই বলে জানিয়েছেন বাদামতলী ও জিনজিরা চাউল আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক।’’
একই পত্রিকার সম্পাদকীয় পাতায় বলা হয়, ‘ছিনিমিনি বন্ধ করুন’। বলা হয়, ‘‘খাদ্য নিয়ে এবং চালের দামের উধর্বগতি উপলক্ষ্য করে একশ্রেণীর (!) ব্যবসায়ী ও মতলববাজ (আখের গোছানোর) সে ধরনের খেলারই পাঁয়তারা করছে।…যেসব মুনাফাখোর ব্যবসায়ী জিনিসপত্রের কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করে এবং গেল গেল রব তুলে দাঁও মারে এবং যেসব মতলববাজ রাজনীতিক ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে আগ্রহী, তারাই সম্ভবত খাদ্য সংকটের রটনায় মুখর হয়ে উঠেছে।’’ (৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮২, দৈনিক বাংলা)
দাম বৃদ্ধি নিয়ে দেশের মানুষের যখন নাভিশ্বাস তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অধ্যাপক এম. এ. মতিন বলেন, ‘পরিস্থিতি সম্পূর্ণ সন্তোষজনক’। (৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮২, দৈনিক ইত্তেফাক)
নমুনা-৩
‘‘জিনিসপত্রের দাম সব দেশেই অর্থনীতির নিয়ম অনুসারে বাড়ে কমে। চাহিদা বেশি ও সরবরাহ কম থাকলে দাম বাড়ে এবং সরবরাহ বাড়লে দাম কমে। কিন্তু আমাদের দেশে আজকাল কোন নিয়মনীতিই খাটছে না। বাজার ভর্তি জিনিসপত্র থাকলেও দাম কমে না। এর কারণ দু’টো- এক, এখন বাজার পরিস্থিতির নিয়ন্তা হল ব্যবসায়ী সমাজ। তারা যেমন খুশী তেমন দাম হাঁকে, তার কমে কোনকিছু বেচেও না। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কোন কার্যকর কর্তৃপক্ষ চোখে পড়ে না। ফলে পোয়াবারো হয়েছে মুনাফা শিকারী ব্যবসায়ীদের। বাজারে আজকাল একটা কথা চালু হয়ে গেছে যে, সাহস করে যে দামই চাওয়া যায় সে দামই নাকি পায় ব্যবসায়ীরা। দুই, মুষ্টিমেয় লোকের হাতে কালো টাকার ছড়াছড়ি। টাকা যেন তাদের হাতের ময়লা। বাজারে এসে কাগজের টুকরার মত তারা টাকা উড়াচ্ছে। তাদের দৌলতে বাজারে কোন জিনিসই পড়ে থাকে না। তাদের কৃত্রিম সচ্ছলতার এই ক্ষুধার্ত হাঙ্গরের হা সবকিছু গপাগপ গিলছে। মুনাফালোভী ব্যবসায়ী ও হঠাৎ বিত্তের অধিকারীদের দৌরাত্ম্য থেকে জনসাধারণকে বাঁচাবার কেউ নেই। বাজারে এই অশুভ অধ্যায়ের সূচনা বায়াত্তর-তিয়াত্তর সাল থেকে। তখন বণিক ও নব্যধনিকদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কর্তৃপক্ষের কড়ে আঙ্গুলটিও নড়েনি’’।৩ (৪ জানুয়ারি ১৯৮২, দৈনিক বাংলা)। বলাই বাহুল্য, সামরিক সরকারের আমলে পণ্যের দামের উর্দ্ধগতি রোধ করা সম্ভব হয়নি।
নমুনা-৪
একই সময়ে প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনার কারণে সচল মিল অচল করে দেওয়ার প্রক্রিয়া জোরদার হতে থাকে। পত্রিকার সূত্র মোতাবেক – ‘‘মোবারকগঞ্জ চিনিকলে উৎপাদিত চিনি অবিক্রীত থাকায় গুদামজাত করার সংকট দেখা দিয়াছে এবং একারণে যে কোন মূহুর্তে উৎপাদন বন্ধ হইয়া যাইতে পারে। কর্তৃপক্ষীয় সূত্রে জানা গিয়াছে, চলতি আখ মাড়াই মৌসুমের বিগত ৮৯ দিনে মিলটিতে ৭ হাজার ৭ শত ৮২ টন চিনি উৎপাদিত হইয়াছে। কিন্তু চিনি রাখার আর যায়গা নাই। ধারণ ক্ষমতা সাড়ে ৭ হাজার টনের অনেক বেশী চিনিতে বর্তমানে গুদাম ঠাসা। উৎপাদিত চিনি রাখার বিকল্প কোন ব্যবস্থা না হইলে যে কোন মূহুর্তে মিলের উৎপাদন বন্ধ হইয়া যাইতে পারে বলিয়া কর্তৃপক্ষ আশঙ্কা করিতেছেন।…হোলসেল ডিলাররা বরাদ্দকৃত চিনি না তোলাতেই এই সংকট দেখা দিয়াছে। তাহারাই চিনির প্রধান ক্রেতা, তাহাদের চিনি দেওয়া হয় মণপ্রতি ৫৬০ টাকা দরে। কিন্তু বর্তমানে খোলা বাজারে চিনির দর অনুরূপ হওয়ায় বরাদ্দ পাওয়া সত্ত্বেও তাহারা চিনি তুলিতেছে না।’’ (১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮২, দৈনিক ইত্তেফাক)
চলতি আখ মাড়াই মৌসুমের বিগত ৮৯ দিনে মিলটিতে ৭ হাজার ৭ শত ৮২ টন চিনি উৎপাদিত হইয়াছে। কিন্তু চিনি রাখার আর যায়গা নাই। ধারণ ক্ষমতা সাড়ে ৭ হাজার টনের অনেক বেশী চিনিতে বর্তমানে গুদাম ঠাসা।
নমুনা-৫
‘‘১৯৭২-৭৩ সাল হইতে ১৯৮১ সালের জুন পর্যন্ত টিসিবি উহার আমদানী চালানে বর্ণিত পণ্যের পরিমাণ অপেক্ষা ১ শত ২২ কোটি ২৬ লক্ষ টাকার পণ্য কার্যত আনিয়াছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ হইতে নগদমূল্যে টিসিবি যেসব পণ্য আমদানী করিয়া থাকে তম্মধ্যে উপরোক্ত অংকের পণ্য কম পাওয়া গিয়াছে। ইহা ছাড়া বিভিন্ন সময়ে পণ্য আমদানীর ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন দর উপেক্ষা করিয়া সর্বোচ্চ দর গ্রহণের ফলে আলোচ্য সময়ে টিসিবিকে বৈদেশিক মুদ্রায় ২ কোটি ৯৮ লক্ষ টাকা বেশী প্রদান করিতে হইয়াছে। আরও জানা গিয়াছে যে, টিসিবি সরকারি নীতি উপেক্ষা করিয়া শুধু ১৯৭৮ এবং ১৯৮০ সালেই ১ কোটি ৯২ লক্ষ ১৪ হাজার ডলার মূল্যের ৭৮ হাজার ৪ শত মেট্রিক টন বাতিল এম, এস বিলেট আমদানী করিয়াছে। ১৯৭৭-৭৮ সালে টিসিবি কেবল পিঁয়াজ আমদানী বাবদেই প্রায় ৭ লক্ষ টাকা লোকসান দেয়।…বিগত দশ বছরে টিসিবি উন্নয়ন প্রকল্পে স্থানীয় মুদ্রা ব্যয় নির্বাহের জন্য নির্ধারিত তহবিলের নামে অথবা দান ও উপহার হিসাবে যে পরিমাণ পণ্য পাইয়াছে, উহার মূল্য হইবে প্রায় ৯৯ কোটি টাকা। অথচ আলোচ্য সময়ে টিসিবি সরকারের নিকট জমা দিয়াছে মাত্র ৪৮ কোটি টাকা। অভিযোগে প্রকাশ, বিভিন্ন সময়ে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনায় ১ কোটি ৩৬ লক্ষ ৭ হাজার টাকা মূল্যের ১ লক্ষ ৩০ হাজার বস্তা টিসিবির সিমেন্ট জমিয়া পাথরে পরিণত হইয়াছে।
…টিসিবি’র আমদানীকৃত ৯ শত ১৭ টন শুকনা মরিচ বর্তমানে বিভিন্ন গুদামের ‘শোভা বর্ধন’ করিতেছে। এই মরিচের জন্য ১০ হাজার বর্গফুট স্থান সম্বলিত গুদাম ভাড়া করিতে হইয়াছে এবং বর্তমানে প্রতিমাসে গুদামের ভাড়া হিসাবে টিসিবির ব্যয় হইতেছে ২৫ হাজার টাকা। একটি দায়িত্বশীল মহলের মতে গুদামে সংরক্ষিত এই বিপুল পরিমাণ মরিচ অদূর ভবিষ্যতে খাদ্যের অনুপযোগী হইয়া পড়িবে এবং সস্তাদরে নিলামে বিক্রয় করিতে হইবে। টিসিবি’র হিসাব সংরক্ষণ বিভাগের এক পরিসংখ্যানে দেখা গিয়াছে যে, ইতিমধ্যেই বিভিন্ন গুদামে টিসিবি কর্তৃক আমদানীকৃত ৬৫ লক্ষ টাকা মূল্যের বিভিন্ন পণ্য ব্যবহারের অনুপযোগী হইয়া পড়িয়াছে। …’৭৮-’৮০ সালে টিসিবি বিশ্বের ৩৮টি বাণিজ্য মেলায় অংশগ্রহণের জন্য অফিসার প্রেরণ করে। ফলে টিসিবির ব্যয় হয় প্রায় ২৭ লক্ষ টাকা। পক্ষান্তরে আলোচ্য মেলায় স্টল পরিচালনা বাবদ ক্ষতি হয় বৈদেশিক মুদ্রায় প্রায় ২৩ লক্ষ টাকা। …শুধু ব্যবসায়-বাণিজ্য নহে, সম্পত্তি ক্রয়ের ক্ষেত্রেও টিসিবির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গিয়াছে। প্রায় ৩ বছর পূর্বে টিসিবি ২৩০ নং তেজগাঁও শিল্প এলাকায় গুদাম ক্রয়ের নামে যে ৮০ লক্ষ টাকা অগ্রিম প্রদান করিয়াছিল, উহার সম্পূর্ণ অর্থই এখন পানিতে ডুবিয়া গিয়াছে।’’(৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮২, দৈনিক ইত্তেফাক)
নমুনা-৬
বিটিএমসি’র ৪টি মিল বন্ধের নির্দেশ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন ছাপা হয় একটি দৈনিকে। সেখানে বলা হয়, ‘‘বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস কর্পোরেশন (বি, টি, এম, সি) লোকসানের পরিমাণ হ্রাস করার জন্য আগামীকাল (শুক্রবার) হইতে ৪টি টেক্সটাইল মিল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করিয়া দিতেছে। চলতি অর্থ বৎসরের ৬ মাসে কর্পোরেশনের ৫৬টি মিলে লোকসানের পরিমাণ দাঁড়াইয়াছে প্রায় ১৫ কোটি টাকা। স্বাধীনতার পর হইতে গত অর্থ বৎসর পর্যন্ত কর্পোরেশনের মিলগুলিতে লোকসানের পরিমাণ দাঁড়াইয়াছে কমপক্ষে ৪০ কোটি টাকা। কর্পোরেশনের ৫৬টি মিলের মধ্যে কেবল ১ নং ঢাকেশ্বরী কটন মিল, ২ নং ঢাকেশ্বরী কটন মিল, আদর্শ কটন মিলস ও মোহিনী কটন মিলে স্বাধীনতার পর লোকসান হইয়াছে প্রায় ৩৫ কোটি টাকা। সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের এক বৈঠকে উল্লিখিত ৪টি মিল আগামী শুক্রবার হইতে বন্ধ করিয়া দেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। …বর্তমানে কর্পোরেশনের বিভিন্ন মিলের গুদামে প্রায় ৪৫ কোটি টাকা মূল্যের সুতা ও কাপড় অবিক্রিত অবস্থায় পড়িয়া রহিয়াছে। তন্মধ্যে সুতা প্রায় ৩৭ কোটি টাকার ও কাপড় ৮ কোটি টাকা মূল্যের। ইতিপূর্বে মিলগুলিতে অবিক্রিত সূতার চাইতে কাপড়ের মওজুদই বেশী থাকিত। বর্তমানে আমদানীকৃত সুতা ও ভারত হইতে চোরা পথে সুতা আসিয়া বাজার ছাইয়া গিয়াছে, তাই মিলগুলিতে উৎপাদিত সুতার মওজুদ বাড়িয়া উঠিতেছে। অপরদিকে প্রিন্টের কাপড় আমদানী বন্ধ হইয়া যাওয়ায় মিলে উৎপাদিত লংক্লথ ও মার্কিন কাপড়ের চাহিদা বাড়িয়াছে।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস কর্পোরেশন (বি, টি, এম, সি) লোকসানের পরিমাণ হ্রাস করার জন্য আগামীকাল (শুক্রবার) হইতে ৪টি টেক্সটাইল মিল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করিয়া দিতেছে। চলতি অর্থ বৎসরের ৬ মাসে কর্পোরেশনের ৫৬টি মিলে লোকসানের পরিমাণ দাঁড়াইয়াছে প্রায় ১৫ কোটি টাকা।
প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রিগুলি এই সকল কাপড় প্রিন্ট করিয়া বিদেশী প্রিন্ট বলিয়া বাজারে চালাইয়া দিতেছে। মিলগুলি প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রির চাহিদা অনুযায়ী কাপড় উৎপাদন করিয়া বিক্রয় করিতেছে। প্রসেসিংকারীদের চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহকৃত কাপড়ের গাঁইটে ১ হাজার গজের বেলে ক্ষেত্রবিশেষে ‘অদৃশ্য কারণে’ ১ হাজার গজের ঊর্দ্ধেও কাপড় চলিয়া যাইতেছে বলিয়া অভিযোগে প্রকাশ। বর্তমানে কার্পোরেশনের নিকট প্রায় ১৫ হাজার বেল তুলা মওজুদ রহিয়াছে এবং আই, ডি, এ ঋণ ও পণ্য বিনিময়ের আওতায় যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েট ইউনিয়ন ও পাকিস্তান হইতে আমদানীকৃত প্রায় ৬৩ হাজার বেল তুলা আসার পথে রহিয়াছে। ….অদক্ষ প্রশাসন, মিলের জন্য কাঁচামাল ক্রয়ে ও উৎপাদিত পণ্য বিক্রয়ে হেরফের, শ্রমিক-কর্মচারীদের অসন্তোষ, কাজে ফাঁকি ও বিদ্যুৎ বিভ্রাটের দরুন দিনে দিনে মিলগুলিতে লোকসানের পরিমাণ বৃদ্ধি পাইতেছে বলিয়া অভিজ্ঞ মহলের ধারণা।’’(৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮২, দৈনিক ইত্তেফাক)
নমুনা-৭
‘‘পরিকল্পনাহীন উৎপাদন পদ্ধতি, সীমাহীন দুর্নীতি, মাথাভারী প্রশাসন ইত্যাদির কারণে পাকশীর নর্থ বেঙ্গল পেপার মিল ডুবতে বসেছে। ’৭৮ থেকে এ পর্যন্ত মিলটি লোকসান দিয়েছে ৯ কোটি টাকা। …মিলের প্রশাসনিক বিভাগের ব্যবস্থাপক আলাপ প্রসঙ্গে জানিয়েছে যে, আর্থিক সংকট মিলটির নাভিশ্বাস তুলেছে। অবস্থা এমন যে, ব্যাংক কোন ঋণ দিতে চাচ্ছে না।…উৎপাদন ক্ষমতা অনুসারে দৈনিক ৩ শিফটে কমপক্ষে ৬০ টন কাগজ উৎপাদিত হতে পারে এই মিলটিতে। কিন্তু এখন কতটুকু উৎপন্ন হয়? এর জবাব পাওয়া মুস্কিল। কেননা, উৎপাদনের কোন ঠিক-ঠিকানা নেই। একদিন ৫ টন, কোনদিন ৭ টন আবার কোনদিন জ্বালানি পুড়লেও এক দিস্তা উৎপাদন হয় না। তবে সেগুলোর প্রধান হলো: উৎপাদনে সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব, যান্ত্রিক ত্রুটি, প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের অবহেলা, প্রয়োজনীয় মাল-মশলা মজুদ না থাকা ইত্যাদি।
এ প্রসঙ্গে একজন শ্রমিক জানালেন যে, আমরা ছোট মাথায় যেটা বুঝি, সেটা বড় সাহেবদের বড় মাথায় ঢোকে না। আর ঢোকে না বলেই পাল্প থাকে তো জ্বালানি থাকে না আবার জ্বালানি থাকে তো পাল্প থাকে না। আরেকজন শ্রমিক বললেন, ‘কী করে এই মিল চলবে? কী করে মুনাফা হবে? সিভিল বিভাগে ৩ জন সাব এ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ারসহ ৫ জন ইঞ্জিনিয়ার অথচ শ্রমিক মাত্র ১৫ জন। প্রতি ৩ জন শ্রমিকের জন্যে যদি ১ জন ইঞ্জিনিয়ার থাকে তো সেখানে মোটা বেতন ভাতা ইত্যাদি খরচ ছাড়া আর কী আশা করা যায়?’ শ্রমিকের মতে, মিলের প্রতিটি বিভাগে বাহুল্য কিছু কর্মকর্তা আছেন, যাদের কাজ আড্ডা দেয়া, বড় সাহেবদের তেল দেয়া আর মাসান্তে মোটা টাকা পকেটে তোলা।…দুর্নীতি সম্পর্কে মিলের শ্রমিক ও অন্যান্য বিভাগের কর্মচারীরা অভিযোগ করেন যে, জ্বালানি আখের ছোবড়া আর খুচরা যন্ত্রপাতি কিনবার নামে এক শ্রেণীর কর্মকর্তা পকেট ভারী করছেন। কাগজ বিক্রয় বিভাগেও রয়েছে দুর্নীতি। টনপ্রতি কমপক্ষে ১ হাজার টাকা পৃথক করে না দিলে পার্টি কাগজ পায় না। একটি সূত্রে জানায় যে, গত ২ বছরে তৈরী বেশ কিছু পরিমাণ কাগজ মিলের গুদামে পড়ে আছে। এসব কাগজ বিক্রিতে কর্তৃপক্ষ ‘ধীরে চল’ নীতি গ্রহণ করেছেন। তবে সেলামি গুনলে সহজেই কাগজ বেরিয়ে আসে। জ্বালানি ও খুচরা যন্ত্রাংশ ক্রয় সম্পর্কে একজন কর্মচারী জানান যে, বিপুল পরিমাণ জ্বালানি খরচ হয় মিলটিতে। প্রতিদিন লাগে ১ লাখ ২০ হাজার টাকার জ্বালানি। ব্যয়ের মতো চুরির ব্যাপারটাও এখানে বিরাট। মিল হয়তো বন্ধ থাকলো, কিন্তু এই বন্ধের সময়টুকু কাগজপত্রে দেখানো হলো চালু।
‘কী করে এই মিল চলবে? কী করে মুনাফা হবে? সিভিল বিভাগে ৩ জন সাব এ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ারসহ ৫ জন ইঞ্জিনিয়ার অথচ শ্রমিক মাত্র ১৫ জন। প্রতি ৩ জন শ্রমিকের জন্যে যদি ১ জন ইঞ্জিনিয়ার থাকে তো সেখানে মোটা বেতন ভাতা ইত্যাদি খরচ ছাড়া আর কী আশা করা যায়?’
…ট্যাংকের তেল ট্যাংকেই থাকলো, মাঝখান দিয়ে মোটা টাকা উঠলো বড় সাহেব মাঝারি সাহেব আর ছোট সাহেবের পকেটে। টাকা ভাগাভাগি হলো পদমর্যাদা অনুসারে।…এ ধরনের ব্যাপার ঘটে থাকে খুচরা যন্ত্রপাতি ক্রয়ের বেলাতেও। আদৌ যন্ত্রটি খারাপ নেই, তবু তা খারাপ দেখিয়ে আরেকটি কেনা হলো। তবে ‘আরেকটি’ কেনা হলো কাগজপত্রে। আসলে পুরাতন মালটিই চালিয়ে দেয়া হলো নতুন কেনার দামে। যিনি এসব দেখাশোনার কর্মকর্তা, তিনিও ভাগ পাচ্ছেন। অতএব, বাধা দেয়ার কেউ নেই। …এই মিলটিতে প্রায় ৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রয়োজন। সরবরাহ হয়ে থাকে গ্রিড থেকে। ফলে গ্রিড সরবরাহ বন্ধ থাকলে মিল অচল। ..মিলের নিজস্ব জেনারেটরে ১ দশমিক ৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়ে থাকে এবং তা গ্রিড সরবরাহ না থাকলে মিল এলাকা ও এলাকার বাসা বাড়ীতে সরবরাহ করা হয়। … (এ কারণে লোকসানের বিষয়ে জানতে চাইলে) একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা জানান যে, ‘আপনাদের কাছে কোনরকম তথ্য সরবরাহ না করার জন্যে আমাদের লিখিত নির্দেশ দেয়া হয়েছে।’’(১৭ ফাল্গুন ১৩৮৮ (বাংলা), ১৯৮২, সংবাদ)
ট্যাংকের তেল ট্যাংকেই থাকলো, মাঝখান দিয়ে মোটা টাকা উঠলো বড় সাহেব মাঝারি সাহেব আর ছোট সাহেবের পকেটে। টাকা ভাগাভাগি হলো পদমর্যাদা অনুসারে।…এ ধরনের ব্যাপার ঘটে থাকে খুচরা যন্ত্রপাতি ক্রয়ের বেলাতেও। আদৌ যন্ত্রটি খারাপ নেই, তবু তা খারাপ দেখিয়ে আরেকটি কেনা হলো।
নমুনা-৮
৫ মার্চ, ১৯৮২। একটি জাতীয় দৈনিকের সম্পাদকীয় পাতায় লেখা হয়, ‘‘১৭ হাজার টাকার কাগজ উৎপাদন করতে খরচ পড়েছে প্রায় দু’লাখ টাকার মত। এই রেকর্ড স্থাপন করেছে নর্থ বেঙ্গল পেপার মিল।…দেশের সর্বত্রই যেখানে রাষ্ট্রায়ত্ত কল-কারখানা রয়েছে, কর্মকর্তাদের কাজের নমুনা কম বেশী এ রকমই। মাথাভারী প্রশাসন, অকারণ ছোটাছুটি, গাড়ী হাঁকানো, আর মিলের জন্য কেনাকাটার নামে যা চলে তাকে চুরি বললে কম বলা হবে। আখের ছোবড়া পাকশীস্থ এ মিলে আনতে কী খরচ পড়েছে, তার হিসেব নিতে গেলে চোখ চড়ক গাছ। এভাবে মিলে কারখানায় লোকসান হয়। আর লোকসান পোষাতে দাম বাড়িয়ে কর্তপক্ষ পরিত্রাণের পথ খোঁজেন। কিছু বললে, একটা ঢালাও জবাব তাদের তৈরী; বিশ্ব বাজারে তেলের দাম বাড়ছে, মুদ্রাস্ফীতি চলছে, কী করে উৎপাদন খরচ কম পড়বে।…অথচ সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে প্রকাশ, শিল্পোন্নত দেশসমূহে মুদ্রাস্ফীতি কমে আসছে, ’৮০ সালের তুলনায় ভোগ্য পণ্যের দাম কমছে। ওসব দেশে সিমেন্ট, কাগজ, নিউজপ্রিন্টসহ বহু পণ্যের দাম কমেছে। বিশ্ব বাজারে এখন তেলের দামও কমছে। অবশ্য তার প্রতিক্রিয়া তৃতীয় বিশ্বে পড়তে কিছু সময় নেবে। আমাদের দেশে এ তিনটির দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা চলছে। ইতিমধ্যেই সিমেন্টের দাম ব্যাগ প্রতি ২৯ টাকার মত বেড়েছে। তেলের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে নিউজপ্রিন্টের দাম বাড়ানোর জন্য দেন দরবার চলছে ঊর্দ্ধ মহলে।
কিছু বললে, একটা ঢালাও জবাব তাদের তৈরী; বিশ্ব বাজারে তেলের দাম বাড়ছে, মুদ্রাস্ফীতি চলছে, কী করে উৎপাদন খরচ কম পড়বে।…অথচ সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে প্রকাশ, শিল্পোন্নত দেশসমূহে মুদ্রাস্ফীতি কমে আসছে, ’৮০ সালের তুলনায় ভোগ্য পণ্যের দাম কমছে। ওসব দেশে সিমেন্ট, কাগজ, নিউজপ্রিন্টসহ বহু পণ্যের দাম কমেছে। বিশ্ব বাজারে এখন তেলের দামও কমছে।
সরকার ও রাষ্ট্রায়ত্ত মিলের কর্মকর্তারা কার্যত অভিন্ন! তাই ২ লাখ টাকা খরচ করে ১৭ হাজার টাকার কাগজ উৎপাদন করে তারা শংকিত নন। কারণ লোকসানের টাকাটা তাদের পকেট থেকে যায় না। এটা গৌরী সেনের টাকা। তারা শুধু হতভাগ্য দেশবাসীর উন্নতির জন্য গাড়ী ছুটিয়ে খেটে মরছেন। এই দৌড়ের ধাক্কায় পাকশীস্থ কাগজের কলের গাড়ী যদি কোন দিন ঢাকার কোন অভিজাত বিপণী এলাকায় কিংবা সুস্বাদু ও দামী খাদ্যের রেস্তোরাঁর সামনে পার্ক করা দেখা যায় তাতে কেউ বিস্মিত হবে না। কারণ হরহামেশাই নানা সংস্থার গাড়ী, যেসব সংস্থা পল্লী অঞ্চলে কাজে নিযুক্ত, সেগুলো প্রায় ঢাকার রাজপথে, মার্কেট ইত্যাদি স্থানে দেখা যায়।…খরচের এই বেপরোয়া ধারা খেসারত দিতে হচ্ছে শিক্ষক, শিক্ষাব্রতী ছাত্র, অভিভাবকদের। কোন কারণ জানতে চাইলে তারা বাঙালকে হাইকোর্ট দেখানো মতে বিশ্ব অর্থনীতির ছবক দেন। এভাবে পুঁজি প্রত্যাহারের পক্ষে উপস্থাপিত মোক্ষম যুক্তি। স্বাভাবিকভাবেই বেসরকারি মহল এর ফলে হাতে স্বর্গ পায়। তারা দোহার ধরেন, বেসরকারি হাতে সব ছেড়ে দেয়া হোক। দেশবাসী দেখতে পাবে কী সেবাটাই না তাদের আমরা করি, দেশের মানুষের অর্থ নিয়ে ভর্তুকি দেয়া, লোকসান দেয়ার বিরুদ্ধে তারা এমন অকাট্য যুক্তি দেন। দেশবাসী ভাবে, হবেও বা। কাজের মধ্যে হচ্ছে সরকারি বেসরকারি বিতর্কের এই কানামাছি খেলায় দেশবাসী প্রাণ ওষ্ঠাগত করার ব্যবস্থাটা নিঁখুত। সরকারি খাতে লোকসান, বেসরকারি খাতে গেলে ক্রেতাদের মাথার হাত আর নামে না।
..সম্প্রতি রাষ্ট্রায়ত্ত মিল সম্পর্কে যে পার্লামেন্টারি কমিটির রিপোর্ট বেরিয়েছে, তাতে অব্যবস্থা, চুরি ও দুর্নীতির কথা আছে।..ঐ রিপোর্টের কথাগুলো মত বক্তব্য ইতিপূর্বে পত্রিকায় যতবার এসেছে তা বানোয়াট, ভিত্তিহীন, মিথ্যা কিংবা রিপোর্টের বক্তব্য খন্ডন করে ব্যাখ্যার কোনো ত্রুটি কোনো কর্তৃপক্ষই রাখেননি।…সরকারি খাতকে কেন্দ্র করে এক আমলাতান্ত্রিক বুর্জোয়া শ্রেণী গড়ে উঠছে। যারা শিল্পপতি বা ব্যবসায়ী নন, কিন্তু তাদের মতই সচ্ছলবিত্ত হয়ে উঠছেন দিনে দিনে। প্রথমোক্তরা মুনাফা করেন। আর এরা লোকসান থেকে উপার্জন করেন। স্বাভাবিকভাবেই এটা করমুক্ত। সরকার শুধু কলকারখানা চালানোর ক্ষেত্রে মাথাভারি প্রশাসন ব্যবস্থাটা বদল নয়, এতে নিযুক্ত সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পত্তির (স্ব-নামে বেনামে) হিসেব, তথা কোন ইন্টেন্ডিং বিজনেসের পার্টনার, কোন এজেন্সির সাথে জড়িত খোঁজ নিন। কোনো ধরনের ব্যবসা কিংবা অনুরূপ প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত বা প্রভাব বিস্তারে সক্ষম ব্যক্তিকে সরকারি খাতে প্রশাসনিক কিংবা নীতি নির্ধারক পদে রাখলে সেখান থেকেই স্থায়ী দুর্নীতির উৎসমুখ সহস্য ধারায় প্রবাহিত হয়। রাষ্ট্রায়ত্তের একযুগ কালের মধ্যে এই শিক্ষাটা কিংবা অভিজ্ঞতা সরকার অর্জন করেননি। একথাটা যুক্তিযুক্ত নয় বলেই মনে করি।’’ (৫ মার্চ, ১৯৮২, সংবাদ)
নমুনা-৯
‘‘খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, ১৫ কোটি টাকার অনাদায়ী কৃষি ঋণের মধ্যে মহকুমার কৃষি ব্যাংকের শাখাগুলোতেই সব চেয়ে বেশী বকেয়া পড়েছে। এই বকেয়া টাকার অংক দাঁড়াবে ৮ কোটির উপর।…গাইবান্ধা ও গোবিন্দগঞ্জ শাখাতেই অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ ৫ কোটি টাকার মতো।…মহকুমার অন্যান্য ৯টি নতুন কৃষি ব্যাংকের শাখায় ১০ লাখ থেকে ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত অনাদায়ী রয়েছে। এসব টাকা অনাদায়ী থাকার পিছনে বড় কারণ হলো বিভিন্ন ব্যাংকের শাখা থেকে এমন অনেক ঋণ গ্রহীতাদের নামে টাকা দেয়া হয়েছে, যাদের কোন প্রকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি নেই। এমন কি তাদের অনেককেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাছাড়াও অনেক ভূয়া ব্যক্তির নামেও কৃষি ঋণ বিতরণের নজির আছে। ফলে এসব ঋণ গ্রহীতাদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা নিয়েও সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।…নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, বিভিন্ন সময়ে উক্ত ৪টি ব্যাংকের কর্মচারীরা কোনরূপ সঠিক তদন্ত ছাড়াই বহু কৃষকের নামে ঋণ প্রদান করেন।…অপর দিকে স্বাধীনতা পরবর্তীকালে এ মহকুমায় অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, বন্যা ও খরাজনিত কারণে বারবার ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হওয়ায় অনেক অভাবগ্রস্ত কৃষকের পক্ষে ঋণ শোধ করাও সম্ভব হয়নি। এ অবস্থায় ঋণ গ্রহীতাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলা দায়ের ও গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি হওয়ায় উকিল-মোক্তার বাবদ তাদের প্রচুর অর্থ গচ্চা দিতে হচ্ছে। অনেকে আদালতে টাকা জমা দিয়েও মামলা থেকে রেহাই পায়নি। পুলিশ তাদের হয়রানি করছে বলে অভিযোগে প্রকাশ।…মহকুমার বাণিজ্যিক ও সমবায় ব্যাংক থেকে প্রদত্ত ঋণের ক্ষেত্রেও একই ধরনের অভিযোগ আছে।…এ ক্ষেত্রেও এমন অনেক ব্যক্তির নামে ঋণ বিতরণ করা হয়েছে যাদের কোন স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি নেই। এমন কি নাম ঠিকানারও কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাছাড়া এক ব্যক্তির ঋণ অপর ব্যক্তির তুলে নেয়ারও বহু অভিযোগ রয়েছে। মৃত ব্যক্তির নামেও ঋণ বিতরণের অভিযোগ রয়েছে।
স্বাধীনতা পরবর্তীকালে এ মহকুমায় অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, বন্যা ও খরাজনিত কারণে বারবার ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হওয়ায় অনেক অভাবগ্রস্ত কৃষকের পক্ষে ঋণ শোধ করাও সম্ভব হয়নি। এ অবস্থায় ঋণ গ্রহীতাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলা দায়ের ও গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি হওয়ায় উকিল-মোক্তার বাবদ তাদের প্রচুর অর্থ গচ্চা দিতে হচ্ছে।
..গাইবান্ধা কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাংক থেকে শ্যালো পাম্প, হস্তচালিত নলকূপ, গরু ক্রয়, পান চাষ, পুকুর সংস্কার, তামাক চাষ, তুলা চাষ, সি, সি, লোন বাবদ প্রদত্ত প্রায় ৩ কোটি টাকার উপর ঋণ অনাদায়ী আছে। দীর্ঘদিন থেকে এই ব্যাংকের ডিরেক্টর বোর্ডের সভাপতির সাথে সরকারের মামলা চলছে। কয়েক মাস আগে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে ডিরেক্টর বোর্ড ভেঙ্গে দেয়ার পর থেকেই উক্ত মামলার সূত্রপাত। তখন থেকেই এই ব্যাংকের কাজকর্ম ঠিকভাবে চলছে না।’’(৫ মার্চ, ১৯৮২, সংবাদ)
নমুনা-১০
‘‘ঢাকেশ্বরী ১ নং ও ২ নং, আদর্শ এবং মোহিনী মিলের মত বস্ত্রকল সংস্থা কর্তৃক স্থাপিত নতুন ৬টি মিলকেও লোকসানের কারণ দেখিয়ে বিক্রি করার পায়তারা হচ্ছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭৮-’৭৯ এবং ’৭৯-’৮০ সালে স্থাপিত বরিশাল টেক্সটাইল, দাবোয়ানী টেক্সটাইল, কিশোরগঞ্জ টেক্সটাইল, দিনাজপুর টেক্সটাইল, কোহিনূর টেক্সটাইল ও রাজশাহী টেক্সটাইল মিলগুলিতে বর্তমানে কোটি কোটি টাকা লোকসান দেখানো হচ্ছে। উক্ত সূত্রে জানা গেছে, এই ৬টি মিলে ’৭৯-’৮০ সালে লোকসান দেখানো হয়েছে ৩ কোটি ৬৩ লাখ ৪৯ হাজার টাকা। ’৮০-’৮১ সালে এই লোকসানের পরিমাণ ১ কোটি ২৯ লাখ ২৫ হাজার টাকা বেড়ে ৪ কোটি ৯২ লাখ ৭৪ হাজার টাকায় উন্নীত হয়েছে। এই মিলগুলিতে বর্তমানে লোকসান দেখানোর চরম প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে। ’৮১-’৮২ সালের প্রথম ৬ মাসেই এই মিলগুলিতে ৭ কোটি ১৭ লাখ ৯ হাজার টাকা লোকসান দেখানো হয়েছে।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, বস্ত্রকল সংস্থা কর্তৃক প্রণীত লাভ-লোকসানের পরিকল্পনায় ’৮১-’৮২ সালে বরিশাল টেক্সটাইল মিলে লোকসানের পরিমাণ ১ কোটি ৯ লাখ ১৬ হাজার টাকা নির্ধারণ করা (!) হয়েছে। অথচ গত ৬ মাসেই বরিশাল টেক্সটাইল মিল লোকসানের এই নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করে ১ কোটি ৬২ লাখ ৬৮ হাজার টাকা লোকসান দিয়েছে। দিনাজপুর টেক্সটাইল মিলের জন্য লাভ-লোকসানের পরিকল্পনায় ৯৫ লাখ ৯২ হাজার টাকা লোকসান নির্ধারণ করা হয়েছে। গত ৬ মাসে দিনাজপুর টেক্সটাইল মিল লোকসান দিয়েছে ১ কোটি ১৮ লাখ ২০ হাজার টাকা। এমনিভাবে অপর চারটি মিলও লাভ-লোকসানের পরিকল্পনায় নির্ধারিত লোকসানের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। বর্তমানেও লোকসানের এই গতি অব্যাহত রয়েছে বলে জানা গেছে। উক্ত সূত্রে আরো জানা গেছে, বস্ত্রকল সংস্থা কর্তৃক এই লোকসানের মাত্রা নির্ধারণের পর আন্তর্জাতিক বাজারে তুলার দাম বাড়েনি। বাজেট প্রণয়ন করার সময় তুলার দাম ছিল পাউন্ড প্রতি গড়ে ৮০ হতে ৮৫ মার্কিন সেন্ট। বর্তমানে তুলার দাম কমে পাউন্ড প্রতি ৬৫ হতে ৭০ মার্কিন সেন্ট-এর মধ্যে রয়েছে।’’(৬ মার্চ, ১৯৮২, সংবাদ)
নমুনা-১১
‘‘টিএসপি’র দাম নাকি আবার বাড়ছে। এ সারের দাম এখন যেখানে প্রতি টন ৩ হাজার ৮শ’ টাকা বাড়িয়ে তা ৫ হাজার টাকা করার প্রস্তাব হয়েছে। অজুহাত, আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দর বৃদ্ধি।…কিন্তু মাসও হয়নি সারের দাম পাইকারীভাবে বাড়ানো হয়েছে। বৃদ্ধির হার শতকরা ১৮ থেকে ২৮ ভাগ।…সরকার সার অন্যান্য কৃষি উপকরণের দাম দফায় দফায় যেমন বেপরোয়াভাবে বাড়িয়ে চলেছেন তা দেখে সত্যি তাজ্জব বনতে হয়। সব কিছুর পিছনে যুক্তি কিন্তু শেষ পর্যন্ত একটিই — ভর্তুকি। সে সারেরই হোক, পাম্প, বীজ যেটারই হোক — সরকারের এমন এক ভাব যেন ভর্তুকি দিয়ে দিয়ে তার হাঁপ ধরে গেছে।…উৎপাদন বাড়ানোর তাবৎ উপকরণের দাম বছর বছর দফায় দফায় চলেছেন বাড়িয়ে। এই সারের কথাই ধরা যাক। গত দশ বছরে ফসল বাড়ানোর জরুরী প্রয়োজনীয় এই উপকরণটির দাম ক’দফা বাড়ানো হয়েছে সরকারের তা স্মরণ আছে কি? ’৭৪-’৭৫ সালের তুলনায় টিএসপি সারের দাম বেড়েছে শতকরা ২৬৩ ভাগ, এমপি ২০০ ভাগ, ইউরিয়ার দাম শতকরা ১৬৪ ভাগ। দাম বাড়ানোতেই সব নয়, সারের পুরো ব্যাপারটাই সরকার এমনভাবে পরিচালনা করছেন যাতে পরিকল্পনার আভাস আদৌ মেলে না। সার যেখানে আমদানী করা হচ্ছে প্রতি বছর, সেখানে এর মধ্যে একবার সার রপ্তানি করেও দেখিয়েছেন সরকার। এ ছাড়া উৎপাদনের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি যে কেমন তা বোঝার জন্য আশুগঞ্জের ‘শ্বেত হস্তি’ই যথেষ্ট। ৯শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে এই সার কারখানাটি উদ্বোধনের পর এখন পর্যন্ত তাতে ভাল করে উৎপাদন সম্ভব হয়নি। কারখানাটির ‘আত্মরক্ষার’র জন্য নাকি সারের দাম বাড়ানো হয়েছে শতকরা ২৫ ভাগ। এরপরও নাকি এ প্রতিষ্ঠানে লোকসান হচ্ছে ৫শ’ টাকা করে। সব ব্যবস্থা না করেই কারখানাটি উদ্বোধন করা হয়। ফল হয়েছে, শুরু না হতেই বন্ধ। জানুয়ারি ১লা তারিখ থেকে উৎপাদন স্থগিত ছিল। ১৯শে ফেব্রুয়ারি আবার উৎপাদন শুরু হয়েছে বটে, তবে মেরামতের ২০ শতাংশ কাজ নাকি এখনো বাকী। আর এর মধ্যে গচ্চা গেছে ৩০ কোটি টাকা। চট্টগ্রাম টিএসপি কারখানাটিও নাকি গত দু’বছরে লোকসান দিয়েছে ৫ কোটি টাকা।
… কি সুন্দর ব্যবস্থা। অব্যবস্থার জন্য লোকসান হচ্ছে, তার দায়টা চাপিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা কৃষকের ঘাড়ে। ভর্তুকির আসল রহস্যটা যে কোথায় তা বোঝা সত্যি মুশকিল। অনেক অর্থনীতিবিদের মতে সরকার ভর্তুকির ব্যাপারটাকে খুবই বাড়িয়ে দেখাচ্ছেন। আমদানী করা কোন পণ্য আর দেশে উৎপন্ন সে পণ্যের দাম তুলনামূলকভাবে দেখলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়। আমাদের দেশের উৎপাদিত কৃষি পণ্য বিক্রি হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজার দরের অনেক কমে। দেশী পণ্যের ‘হিসেব মূল্য’ বিবেচনায় আনলে ভর্তুকির কথা বড় হয়ে আসতে পারে না। দাম বাড়ানোর ফলে উপকরণের ব্যবহার না কমে পারে না। সারই তার প্রমাণ। ষাটের দশকে এর ব্যবহার শুরু হওয়ার পর চাহিদা যেমন বেড়ে চলছিল, দফায় দফায় মূল্য বৃদ্ধিতে আজ আশির দশকে এসে দেখা যাচ্ছে চাহিদায় ভাটা। ফসলের বাড়তি উৎপাদনের পয়সা দিয়ে কৃষক উপকরণের বর্ধিত মূল্য পুষিয়ে নেবে — এ যুক্তি আর যেখানে হোক ছোট কৃষকের বেলায় খাটতে পারে না। বর্ধিত মূল্যের বোঝা টেনে তার পক্ষে আবাদই সম্ভব নয়। বাড়তি উৎপাদনের কথা তো সেখানে আসতেই পারে না।’’ (৬ মার্চ, ১৯৮২, সংবাদ)
নমুনা-১২
‘‘চলতি বছর ভেড়ামারা থানার তুলা চাষীরা তুলা নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন। উৎপাদিত তুলা রাখার জায়গার অভাব এবং ক্রেতার অভাবে ইতিমধ্যেই চাষীর ঘরে শত শত মণ তুলা নষ্ট হয়ে যেতে শুরু করেছে বলে চাষীগণ জানিয়েছেন।…গত ২২ ও ২৬ জুন ফেব্রুয়ারি স্থানীয় তুলা উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ চাষীদের নিকট হতে তুলা ক্রয় করার কথা ঘোষণা দিলে দূর দূরান্ত হতে শত শত চাষী বিপুল পরিমাণ তুলা নিয়ে সময়মত ক্রয়কেন্দ্রে হাজির হন। কিন্তু বোর্ডের উর্দ্ধতন কর্মকর্তাগণ কৃষকদের নিকট হতে তুলা ক্রয়া না করে সকলকে ফিরিয়ে দেন।…একদিকে বিভিন্ন উপকরণের মূল্যবৃদ্ধিজনিত কারণে অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর তুলা উৎপাদন খরচ প্রায় দেড় গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে নানান প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে উৎপাদিত তুলার ন্যায্য মূল্য ও বিক্রির নিশ্চয়তা না পেয়ে তুলাচাষীরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস কর্পোরেশন তুলা ক্রয়ের জন্যে চুয়াডাঙ্গা, আলফাডাঙ্গা, জীবন নগর ও দামুড়হুদায় ৪টি এবং তুলা উন্নয়ন বোর্ড গোকূলখালীতে অতিরিক্ত ১টিসহ ৫টি ক্রয়কেন্দ্র খুলেছে। উৎপাদিত মোট তুলার ৭৫ ভাগ বি,টি,এম,সি এবং ২৫ ভাগ তুলা উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষের কেনার কথা থাকলেও টাকার অভাবে উক্ত ক্রয়কেন্দ্রগুলো থেকে বি,টি,এম,সি এ পর্যন্ত ৭ হাজার ৭শ’ মন এবং তুলা উন্নয়ন বোর্ড মাত্র ৮শ’ ৫০ মন তুলা ক্রয় করে তুলা কেনা বন্ধ করে দিয়েছে। এদিকে বি,টি,এম,সি’র ক্রয়কৃত তুলার অর্ধেক মূল্য ১৫ দিনের মধ্যে চাষীরা হাতে পায়নি বলে অভিযোগ করেছে। অন্যদিকে সরকার নির্ধারিত ৩টি গ্রেডের গুণগত মান অনুযায়ী তুলার মূল্য নির্ধারণ করেছে। ‘এ’ গ্রেড ৫শ’ ৩০ টাকা, ‘বি’ গ্রেড ৫শ’ ২০ টাকা এবং ‘সি’ গ্রেড ৫শ’ টাকা মণ হিসেবে নির্ধারিত থাকলেও চাষীদেরকে সর্বনিম্ন মূল্য দেয়া হচ্ছে বলে চাষীরা জানিয়েছে। টাকার অভাবে মহকুমার সবক’টি ক্রয়কেন্দ্রে তুলা ক্রয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নিরুপায় হয়ে চাষীরা একশ্রেণীল প্রভাবশালী চাষী ও দালাল-ফরিয়াদের কাছে অল্প মূল্যে তুলা বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।’’(৮ মার্চ, ১৯৮২, সংবাদ)
নমুনা-১৩
‘‘উৎপাদন খরচা পোষায় না বলে এলুমিনিয়ম ও এনামেল শিল্প কারখানাগুলো সংকটে পড়েছে। এসব কারখানা স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের পর সরকার পুঁজি প্রত্যাহার নীতি অনুসরণ করে ১৮টি এলুমিনিয়ম ও এনামেল কারখানার মধ্যে ১৬টিই বেসরকারি মালিকদের ফিরিয়ে দিয়েছেন এবং বিক্রি করে দিয়েছেন। এসব কারখানায় উৎপাদিত ৫ কোটি টাকার মাল অবিক্রীত পড়ে আছে। লোকসান দিয়ে বিক্রি করার চেয়ে মাল মজুত রাখার নীতি মালিকরা নিয়েছেন। তেজগাঁস্থ রহিম মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ লে-অফ ঘোষণা করেছে। অন্যেরাও তার পথ ধরবে বলে চিন্তা-ভাবনা করছেন। মালিকরা উৎপাদন খরচা বেশী পড়ার কারণ হিসেবে বলেছেন যে, এসব কারখানার জন্য তার কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত এলুমিনিয়ম খণ্ড ও এনামেল পাত আমদানী করে এবং বেসরকারি কারখানার মালিকদের অভিযোগ যে টিসিবি’র আমদানীকৃত কাঁচামালের দাম বেশী এবং তাদের তা কিনতে বাধ্য করা হয়। মালিকরা বলেছেন, এর সাথে তারা সরকারিভাবে নির্ধারিত মজুরি, গ্যাস ও ইলেকট্রিক বিল, আয়করসহ আগের বকেয়া শোধ দিয়ে থাকে। তাতে উৎপাদন খরচা বেশী পড়ে।’’
মালিকদের এইসব যুক্তিকে প্রশ্ন করে বিশ্লেষণ করে পত্রিকা বলছে, ‘‘টিসিবি’র কাঁচামালের দাম বেশী দিয়ে কিনতে তাদের বাধ্য করা হয় — এই একটি যুক্তি ছাড়া অন্যান্য খরচাদি সম্পর্কে বক্তব্য কতখানি যুক্তিসঙ্গত? সরকারি নির্ধারিত মজুরি আজকে বাজারের অবস্থায় কি অযৌক্তিক? আর উৎপাদন করতে গেলে গ্যাস ও ইলেকট্রিক বিল দিতে হবে। আয়কর মুনাফার সাথে সম্পর্কিত। অবশিষ্ট থাকে আগের বকেয়া পরিশোধ। এই বকেয়া যদি রাষ্ট্রায়ত্ত আমলের বকেয়া হয় তা নিয়ে নিশ্চয়ই কেনার সময় আলাপ-আলোচনা হয়েছিল আর তারও আগের হলে তার দায় মালিকেরই বর্তাবে। সুতরাং এই বকেয়ার প্রশ্নটি অস্পষ্ট।… কিন্তু একটা বিষয় সম্পর্কে কোন কথা এখানে ঠাঁই পায়নি। এলুমিনিয়মের জিনিসপত্রের দাম গত কয়েক বছরে বেশ বেড়েছে। সাধারণ লোকের গাঁট থেকেই মুনাফা উঠেছে মালিকদের ঘরে। আজ তাদের ক্রয়ক্ষমতার অভাবের জন্য ৫ কোটি টাকার মাল অবিক্রীত পড়ে আছে, না মালিকরা মাল গুদামজাত করেছেন — দাম বাড়ানোর জন্য আগেভাগে থেকেই সরকোরের উপর চাপ সৃষ্টির পন্থা হিসেবে — সে কথাটা স্পষ্ট হওয়া দরকার।…বেসরকারি মালিকরা এলুমিনিয়ম শিল্পের যে সংকট ও অসুবিধার কথাগুলো তুলেছেন সেগুলো এবং অননুমোদিত এলুমিনিয়ম শিল্পের প্রশ্নটির সমাধান খুঁজে বের করা সরকারের উচিত। বেসরকারি মালিকরা যে সব কার্যকারণ উল্লেখ করেছেন তাদের লোকসানের কারণ হিসেবে তার যৌক্তিকতাও যাচাই করে দেখতে হবে। নতুবা একদিকে শ্রমিকরা শোষণ ও বঞ্চনার শিকার হবে, অন্যদিকে দেশের সাধারণ মানুষকে নতুন করে বাড়তি দামের বোঝা বহন করতে হবে।..’’(১১ মার্চ, ১৯৮২, সংবাদ)
নমুনা-১৪
৮ মার্চ দৈনিক সংবাদ-এ একটি কলাম ছাপা হয়। সেখানে একটি জাতীয় পত্রিকার ছাপা দু’টি সংবাদ ধরে ‘অল্পদর্শী’ তাঁর বিশ্লেষণ হাজির করেছেন। সংবাদ দু’টির প্রথমটি ‘রোম যখন পুড়ছে’ সম্পর্কে লেখক বলছেন, ‘‘সংক্ষেপে সংবাদটি এই: ধানমন্ডিবাসী এক ভদ্রলোক বিবাহ বার্ষিকী উদযাপনে তিন লক্ষাধিক টাকা খরচ করে প্রায় পাঁচশ অতিথিকে দশটি আস্ত খাসির রোষ্ট, অগণিত মুরগীর রোষ্ট, মাছ-মাংসের কাবাব, গরু ও খাসির ঝালমাংস, রূপচান্দাসহ চার প্রকারের মাছ এবং সব্জির সঙ্গে গরুর মাংসের একটা ‘চীনা’ আইটেমসহ মোট আঠারো প্রকারের খানাপিনায় আপ্যায়িত করেন। হাতিয়া হতে আনীত দৈ এবং তার সাথে খেজুড়ের গুড় নাকি ছিল খানার শেষ আইটেম। এখানেই আপ্যায়নের শেষ নয়। ডিনারের পর অতিথিদের প্রত্যেককে একটি করে উপঢৌকন দেয়া হয়। দ্রব্যগুলো নম্বরযুক্ত অবস্থায় টেবিলে স্তুপীকৃত ছিল। কে কোনটি নেবে তা নির্ধারণের জন্য লটারি হয়। লটারির উদ্বোধন নাকি করেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং। পরে অন্যরা একে একে নম্বরযুক্ত টোকেন তোলেন এবং তদনুযায়ী অতিথিরা যার যার উপহার স্বহস্তে তুলে নেন। উপহার সামগ্রীর মধ্যে নাকি কলম, উলেন চাদর, শাড়ী, সেন্টের বোতল, বড় ফ্লাস্ক, জামা-কামড়ের প্যাকেট প্রভৃতি দামী দামী বস্তু ছিল। এগুলো ছিল সবই বিদেশী মাল। মোটর গাড়ী ছিল না বলেই মনে হয়, কেনন প্রকাশিত খবরে তার উল্লেখ নেই। ঐ সময়টায় গেটের বাইরে নাকি শতাধিক ভিক্ষুক জমে যায়। ওদের নিয়ন্ত্রণকর্মে পুলিশ নিয়োজিত ছিল।
দ্বিতীয় সংবাদটি অবশ্য ষ্টাফ রিপোর্টার লিখিত প্রতিবেদন নয়। নাম ঠিকানাসমেত প্রকাশিত একটি চিঠির মধ্যে সংবাদটি পাওয়া যায়। এটির সার সংক্ষেপ হচ্ছে: জিলা ঢাকা, থানা কেরানীগঞ্জ, কলাতিয়া ইউনিয়ন অধীন গূয়ডুরী গ্রামের মো: জামাল (পিতা মৃত মনসুর আলী ওরফে বশা মিয়া) নামক এক গরীব মাছ বিক্রেতাকে বিগত ১৪-১-৮২ তারিখে বাড়ী হতে ডেকে নিয়ে গিয়ে ধলেশ্বরী নদীর পূর্ব প্রান্তে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। পরদিন ভোরে জামালের মৃতদেহ গ্রামে আনা হলে সমাগত লোকজনের উপস্থিতিতেই এক ব্যক্তি মৃত ব্যক্তির মুখে কলাগাছের ডগা ঢোকাতে থাকে। লোকেরা বাধা দিলে সে ব্যক্তি নাকি বলে যে, জনৈক প্রভাবশালী ব্যক্তির নির্দেশে সে ঐ কাজ করছে, অন্যদের মাথাব্যথা কেন? এক পর্যায়ে গ্রামের কবর হতে লাশ উত্তোলিত এবং ময়না তদন্ত হয়। ময়না তদন্তের পর গ্রামবাসিগণ লাশ পুনরায় দাফন করতে উদ্যত হলে বিগত ২৬-১-৮২ তারিখে প্রকাশ্য দিবালোকে উক্ত প্রভাবশালী ব্যক্তি তার সশস্ত্র দলবলের সহায়তায় লাশ ছিনিয়ে নিয়ে যায় এবং মোকদ্দমায় কেউ সাক্ষী দিলে প্রাণে শেষ করার হুমকি দেয়।
…আমি মাত্র দু’টি সংবাদের উল্লেখ করেছি। উক্ত উভয় ধরনের অসংখ্য সংবাদ বিগত সাত বছর ধরে প্রকাশিত হচ্ছে। পাঠকও পাঠ করছেন। আপাতদৃষ্টে মনে হতে পারে যে, উল্লিখিত দু’টি ঘটনাকে একত্রে বিচার করা সমীচীন নয়। কেননা প্রথমটি মিলনাত্মক নাটক, অভিনেতা উঁচু দরের কমেডিয়ান। তিনি স্মরণ করিয়ে দেন বাদশা হারুন-আল-রশীদের দরবারের কথা। দ্বিতীয়টি পৈশাচিক ট্রাজেডি। মহাভারতে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ অধ্যায় এবং ঐতিহাসিককালে রোম সম্রাট নিরো কর্তৃক রোম নগর ভস্মীভূত ও সভাকবি এবং মন্ত্রী সেনেকাকে হত্যার কাহিনী ব্যতীত তুল্য দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া কষ্টকর। মধ্যযুগের ক্ষুদে রাজা-বাদশাগণ নাকি এভাবেই দেশে ‘‘ন্যায়ের শাসন’’ চালাতেন। কিন্তু ধীরেসুস্থে চিন্তা করলে প্রতীয়মান হবে যে, আলোচ্য দু’টি ঘটনার নায়ক পৃথক হলেও প্রকৃত প্রস্তাবে ওরা একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ মাত্র। বাংলাদেশের হাল সমাজে উভয় শ্রেণীর লোক সমাজে প্রভাবশালী ব্যক্তিরূপে পরিচিত। স্বেচ্ছায় হোক, ভয়ে হোক, দায়ে ঠেকে হোক দেশবাসী ওদের অনুগত। মোট জনসংখ্যার শতকরা ৮৭ জন অভুক্ত অর্ধভুক্ত থাকা সত্ত্বেও উক্ত প্রভাবশালী ব্যক্তিদের প্রভাব প্রতিপত্তির শৃংখল হতে মুক্ত হওয়ার কোন সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা নেই।
…হারুন-আল-রশীদের বাগদাদ শহরে নাকি দশ সহস্র ভিক্ষুক ছিল। হারুন-আল-রশীদের রাজ প্রাসাদের বাইরে ঐ ভিক্ষুকদের ভিক্ষা করার স্বাধীনতা ছিল। ওরা বাইরে ভিক্ষা করতো। হারুন-আল-রশীদ প্রহরী বেষ্টিত প্রাসাদে আমোদ-ফূর্তি, আদর-আপ্যায়ন করতেন। আমাদের রাজধানী ঢাকা শহরে ভিক্ষুকের সংখ্যা কত জানি না, তবে বাংলাদেশে ওদের সংখ্যা নাকি বিশ লাখ। ধানমন্ডির প্রভাবশালী ব্যক্তিটি পুলিশ প্রহরীর সহায়তায় শতাধিক ভিক্ষুকের সম্ভাব্য উৎপাত ঠেকিয়ে ভিতরে প্রধানমন্ত্রী এবং অন্যান্য মান্যবর ব্যক্তিদের সংগে ধুমধামের সাথে বিবাহ বার্ষিকী পালন করেছেন। অপরদিকে কেরানীগঞ্জ থানার প্রভাবশালী ব্যক্তি আপন প্রভাব বলে আইনকে তাচ্ছিল্য ভরে উপেক্ষা করে আপন জিঘাংসাবৃত্তি চরিতার্থ করেই শুধু ক্ষান্ত হননি, উপরন্তু পৈশাচিক আনন্দে শব দেহের উপর অত্যাচার চালিয়েছেন। খোঁজ নিলে দেখা যাবে উভয় ব্যক্তির ক্ষমতার মূল উৎস অর্থবিত্ত এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা যাদের হাতে, তাদের সংগে মিত্রতা।
অপরদিকে বাংলাদেশের মতো গরীব দেশে মাত্র দশ বছরকাল মধ্যে বিস্ময়কর রকমের অর্থবিত্তের মালিক হওয়ার একটি মাত্র পন্থাই বিদ্যমানঃ সেটি হচ্ছে আইনকে ফাঁকি দিয়ে অথবা আইন বাঁচিয়ে অথবা ক্ষমতাসীনদের যোগসাজশে আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে চুরি-ডাকাতি, সরকারি অর্থ আত্মসাৎ অথবা ব্যবসার নামে জনসাধারণের মাথায় লাঠি মেরে অর্থবিত্ত সংগ্রহ করা। স্বাধীন হওয়ার পূর্বে বাঙালী কোটিপতির সংখ্যা ছিল নাকি মাত্র দু’জন। এখন তার সংখ্যা শতাধিক। পরাধীন বাংলাদেশে কোন ব্যক্তি ধানমন্ডির উক্ত প্রভাবশালী ব্যক্তিটির মতো মহা-সমারোহে বিবাহ বার্ষিকী উদযাপন করেছেন বলে মনে পড়ছে না। মাত্র দশ বছরকাল মধ্যে কিছু লোকের এরূপ অত্যাশ্চর্য ভাগ্য পরিবর্তন সৌভাগ্যবানদের জন্য ছাপ্পর ফেড়ে আসা নিয়ামতরূপে গণ্য হতে পারে কিন্তু দেশের শতকরা ৮৭ জনের জন্য যে নিঃসন্দেহে ভাগ্য-বিড়ম্বনা তার প্রমাণ সরকারি এবং জাতিসংঘ কর্তৃক প্রকাশিত কাগজপত্র।’’
বাংলাদেশের মতো গরীব দেশে মাত্র দশ বছরকাল মধ্যে বিস্ময়কর রকমের অর্থবিত্তের মালিক হওয়ার একটি মাত্র পন্থাই বিদ্যমানঃ সেটি হচ্ছে আইনকে ফাঁকি দিয়ে অথবা আইন বাঁচিয়ে অথবা ক্ষমতাসীনদের যোগসাজশে আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে চুরি-ডাকাতি, সরকারি অর্থ আত্মসাৎ অথবা ব্যবসার নামে জনসাধারণের মাথায় লাঠি মেরে অর্থবিত্ত সংগ্রহ করা।
পরিশেষে লেখক পাঠকদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, ‘‘ধানমন্ডির ‘অর্জি’তে প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যক্তির উপস্থিতি এবং মন্ত্রীর বাড়ীতে খুনীর অবস্থান প্রভৃতি ঘটনাবলীর সংবাদ পাঠ করার পর প্রভাবশালী ব্যক্তিদের যোগসূত্র কোথায়, কাদের সংগে তা পাঠক নিজেই স্থির করে নিতে পারবেন।’’(৮ মার্চ, ১৯৮২, সংবাদ)
বি:দ্র: উপরে যে ঘটনাগুলোর উল্লেখ করা হলো সেগুলো সারা দেশে প্রতিদিন যে ঘটনাগুলো ঘটছিল সেসবকে পর্বতসারির সাথে তুলনা করলে তা একটি পর্বতের সামান্য উঁচু চূড়া মাত্র। ১৯৮২ সালের ফেব্রুয়ারি এবং মার্চ মাসের দু’টি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার (দৈনিক বাংলা এবং সংবাদ) বিষয়ের সাথে প্রাসঙ্গিক এবং অন্যান্য অসংখ্য প্রতিবেদনের দিকে তাকালেই দেশের তৎকালীন সামগ্রিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি হতে পারে। (চলবে)
মেহেদী হাসান: গবেষক, লেখক। ই-মেইল: mehedihassan1@gmail.com
তথ্যসূত্র ও টীকা
১। ‘‘Capital eschews no profit, or very small profit, just as Nature was formerly said to abhor a vacuum. With adequate profit, capital is very bold. A certain 10 per cent will ensure its employment anywhere ; 20 per cent certain will produce eagerness ; 50 per cent positive audacity ; 100 per cent will make it ready to trample on all human laws ; 300 per cent, and there is not a crime at which it will scruple, nor a risk it will not run, even to the chance of its owner being hanged. If turbulence and strife will bring a profit, it will freely encourage both. Smuggling and the slave-trade have amply proved all that is here stated.’’ Karl Marx; Capital: A Critique of Political Economy, Introduced by Ernest Mandel, Translated by Ben Fowkes, Vol-1, Penguin Books, first published 1976, page-926.
২। শিরোনাম: ইনভেস্টার্স ফোরামে প্রেসিডেন্ট সাত্তার; বিদেশী পুঁজি বিনিয়োগে সব সুবিধা দেয়া হয়েছে, ১৮শ বর্ষ , ৮৬ সংখ্যা, ২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮২, পৃঃ ১, দৈনিক বাংলা, https://drive.google.com/file/d/16kXnoZNnhGRTjvlZJGkhX2pai4ijOWCY/view। উক্ত অনুষ্ঠানে শিল্পসচিব জনাব এবিএম গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘‘বিদেশী পুঁজিতে স্থাপিত বেসরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের কোন ইচ্ছাই সরকারের নাই। স্থানীয় বেসরকারি পুঁজিকে যতটা, বিদেশী বেসরকারি পুঁজিকেও ঠিক ততটা সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হইবে। যেসব দেশের সহিত বাংলাদেশের চুক্তি আছে, সেসব দেশের এখানকার বিনিয়োগকারীদিগকে রয়্যালটি, টেকনিক্যাল ফি দেশে প্রেরণের সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হইবে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্ব হইতেই এদেশে ২৬টি বিদেশী শিল্প প্রতিষ্ঠান কাজ করিতেছে। এখনও তাহারা ভালভাবেই ব্যবসা করিতেছে। তাহাদের অনেকে মুনাফাও পুনর্বিনিয়োগ করিয়াছে। নতুন ৫৭টি যৌথ উদ্যোগের প্রকল্প অনুমোদন পাইয়া উৎপাদন শুরু করিয়াছে কিংবা কারখানা স্থাপন করিতেছে।’’ শিরোনাম: পারস্পরিক কল্যাণে এদেশে বিনিয়োগ করুনঃ প্রেসিডেন্ট; প্রাকৃতিক সম্পদ ও স্থানীয় দক্ষতার ভিত্তিতে দ্রুত শিল্পায়নই লক্ষ্য, ২৯ বর্ষ, ৪০ সংখ্যা, ফেব্রুয়ারি ২, ১৯৮২, পৃঃ ১, দৈনিক ইত্তেফাক, https://drive.google.com/file/d/1jEDvaOpCvEZaLkkOFGjg0gGWf3wMqwhf/view
৩। মোটাদাগে ইংরেজীতে যাকে বলে crony capitalism; meaning ‘a friend, or a person or group who works for someone in authority; vice versa, especially one who is willing to give and receive dishonest help to accumulate capital’.