যৌন নিপীড়ন বিরোধী নীতিমালা

বিশেষ লেখা
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলন, ছবি: শহিদুল আলম

[১৯৯৮ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়েই ‘যৌন নিপীড়ন বিরোধী নীতিমালা’ প্রণয়নের তাগিদ তৈরি হয়। কারণ আন্দোলনের মধ্য দিয়েই এটা স্পষ্ট হয়েছিল যে, বাংলাদেশে আইন আদালত এবিষয়ে খুবই অস্বচ্ছ অবস্থায় আছে আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবিষয়ে কোনো বিধিবিধান নাই, ধারণাগত দিক থেকেও সমাজ এ নিয়ে খুবই নাজুক অবস্থায়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক প্রথম এ বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এই নীতিমালা সংগ্রহ করে তা পর্যালোচনা করা হয়। এরপর বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এ্ই নীতিমালার একটি খসড়া প্রণয়ন করা হয়। ২০০০ সালের দিকে এই খসড়া চ’ড়ান্ত করার পর বিভিন্ন বিভাগের ১৭ জন শিক্ষক স্বাক্ষর করে এই নীতিমালা গ্রহণের জন্য উপাচার্যকে অনুরোধ করেন। শিক্ষার্থী-শিক্ষক সমন্বয়ে গঠিত ‘৮ই মার্চ পর্ষদ’ থেকে তা প্রচারের উদ্যোগ নেয়া হয়। এর পর প্রতিবছর ৮ই মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে মিছিল করে এই খসড়া বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যের কাছে জমা দেয়া হতো।  বহু আলোচনা, বিতর্ক ও প্রচারের পর এক পর্যায়ে জাবি শিক্ষক সমিতি এই নীতিমালা গ্রহণ করে এবং তা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গ্রহণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেয়। ২০০৬-৭ সালে আরেকটি যৌন নিপীড়ন বিরোধী আন্দোলনের মুখে সকলের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এই নীতিমালা প্রণয়নের জন্য একটি কমিটি গঠন করে। কমিটি থেকে আগের নীতিমালা পরিবর্ধন পরিমার্জন করে, শিক্ষার্থী-শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী সহ সকলের সাথে ব্যাপক আলোচনা মতবিনিময়ের মধ্য দিয়ে তা চ’ড়ান্ত করা হয়। ১৮ই মার্চ ২০০৭ সালে তা উপাচার্যের কাছে জমা দেয়া হয়। এরও বেশ কিছুদিন পর  বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট তা গ্রহণ করে।

দেশজুড়ে যৌন নিপীড়ন বেড়ে যাবার পরিপ্রেক্ষিতে এরকম নীতিমালার প্রয়োজন তখন অনেকেই অনুভব করতে থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, মহিলা আইনজীবী সমিতি এ নিয়ে কাজ করতে থাকে। এক পর্যায়ে সারাদেশে যৌন নিপীড়নের ভয়াবহতার পরিপ্রেক্ষিতে একটি রিট আবেদনের সূত্রে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ২০০৯ সালের ১৪ই মে এই নীতিমালা গ্রহণে একটি আদেশ জারি করে। কিন্তু এরপর বহু বছর পার হলেও, বহু প্রতিষ্ঠান এই নীতিমালা এখনও গ্রহণ করেনি। আসলে দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসাসহ সবধরনের সরকারি প্রতিষ্ঠান, শিল্প কারখানায় এই নীতিমালা গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা উচিৎ। শুধু তাই নয় সকল রাজনৈতিক দল, শ্রমিক, ছাত্র, পেশাজীবী, সাংস্কৃতিক সংগঠনেও এই নীতিমালা থাকা জরুরী।

বস্তুত যে নীতিমালা দলিল থেকে পরে অনেকেই কাজ করেছেন তা এখানে পুনপ্রকাশ করা হল। যৌন নিপীড়ন সম্পর্কে সজাগ অবস্থান তৈরি এবং এর বিরুদ্ধে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গ্রহণে এই দলিল সহায়ক হবে বলে আমরা আশা করি। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন নিজ নিজ অবস্থা অনুযায়ী এই দলিল পরিমার্জন করে নিজেদের নীতিমালা দাঁড় করাতে পারবেন।]

 

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

নিপীড়ন বিরোধী নীতিমালা

(যৌন এবং সাধারণ হয়রানি ও নিপীড়ন প্রতিরোধ ও প্রতিকার কল্পে প্রশাসনিক বিধি ব্যবস্থা)

১. নীতিমালার প্রয়োজনীয়তা

বাংলাদেশের সংবিধান ধর্ম বর্ণ বয়স পেশা ও লিঙ্গ নির্বিশেষে রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করবার অঙ্গীকার করেছে। তাই যে কোন হয়রানি ও নিপীড়ন যা একজন ব্যক্তির মানসিক ও শারীরিক ক্ষতি করে এবং তার সমান সুযোগ গ্রহণে বাধা সৃষ্টি করে তা নিশ্চিতভাবেই সংবিধান বিরোধী এবং একইসঙ্গে ফৌজদারী অপরাধ। কেউ যদি তাঁর সামাজিক অবস্থান ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে তার উপর নির্ভরশীল কারও উপর এধরনের নিপীড়ন করে তবে সেই অপরাধ আরও নিকৃষ্ট।

১৯৭৩ সালে প্রনীত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এ্যাক্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের জন্য যে পরিবেশ নিশ্চিত করবার কথা বলে তা যে কোনরকম হয়রানি এবং নিপীড়নের ঘটনায় নিদারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেকরকম হয়রানি ও নিপীড়নের মধ্যে গুরুতর একটি হচেছ যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন। উল্লেখ্য যে, বয়স, পেশা, লিঙ্গ নির্বিশেষে যে কেউ যৌন নিপীড়নের শিকার হবার সম্ভাবনা থাকলেও আমাদের সমাজে যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন এর শিকার হয় বিশেষভাবে নারী। 

১.১ যেহেতু হয়রানি ও নিপীড়ন, এবং যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন 

— একজন ব্যক্তিকে চিরজীবনের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত করে,

— তাঁকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে,

— তাঁর উপর স্থায়ী মানসিক চাপ সৃষ্টি করে,

— তাঁর মর্যাদাবোধ খর্ব হয়;

— তাঁর আতœবিশ্বাস বা আতœপ্রত্যয়ে হানি ঘটায়,

— শিক্ষা বা পেশার ক্ষেত্রে বিঘœ সৃষ্টি করে কিংবা তাঁকে চিরস্থায়ীভাবে শিক্ষা বা পেশা ত্যাগে বাধ্য করে,

— এমনকি দেশত্যাগে বাধ্য করে;

— জীবন সংশয় সৃষ্টি করে বা স্থায়ী শারীরিক ক্ষতির সৃষ্টি করে, এবং

— এমনকি জীবনহানি ঘটায়; তাছাড়া এসব ঘটনা,

— পরিবার ও স্বজনদের জীবন বিপর্যস্ত করে;  

— প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা ও ভাবমূর্তি খর্ব করে;

— সমাজে, প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তা এবং মর্যাদা নিয়ে জীবনযাপনের অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করে।

সেহেতু এই বিষয়ে যথাযথ আইনগত ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা থাকা অতি আবশ্যক।

১.২ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এই প্রতিষ্ঠানের সর্বস্তরে এমন একটি পরিবেশ নিশ্চিত করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ যেখানে সকল শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারি কোনরকম প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই নিজ নিজ কর্মক্ষমতা ও সম্ভাবনা বিকশিত করতে পারবে। আর এর জন্য যে কোন ব্যক্তি যাতে এক্ষেত্রে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে না পারে সেজন্য আইনগত ও প্রশাসনিক রক্ষাকবচ নিশ্চিত করতে এই বিশ্ববিদ্যালয় সচেষ্ট। বিদ্যমান বিধি ও ব্যবস্থাবলী যথেষ্ট প্রতীয়মান না হওয়ায় এই সাধারণ হয়রানি ও নিপীড়ন এবং যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন বিরোধী নীতিমালা প্রণয়ন করা হচ্ছে। সংক্ষেপে এটি ‘নিপীড়ন বিরোধী নীতিমালা’ নামে অভিহিত হবে। কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এরকম নীতিমালা এটাই প্রথম। আশা করা যায় যে, এর মাধ্যমে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও এরকম নীতিমালা প্রণয়নে উৎসাহিত হবে।     

২. হয়রানি ও নিপীড়ন: প্রকৃতি ও প্রকারভেদ

এই নীতিমালায় হয়রানি ও নিপীড়নকে দুটি সাধারণভাগে ভাগ করা হয়েছে: (ক) সাধারণ হয়রানি ও নিপীড়ন এবং (খ) যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন। আপাতদৃষ্টিতে যা হাসি ঠাট্টা বা হালকা ব্যাপার মনে হয় তা কারও কাছে যখন অবাঞ্ছিত হয় এবং কেউ যদি সেই আচরণ বারবারই করতে থাকে তখন তা হয়রানি বা নিপীড়নের পর্যায়ভুক্ত হয়। কোন কোন হয়রানি বা নিপীড়ন আরও প্রকট। উদ্দেশ্যমূলকভাবে কাউকে অপদস্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত করবার জন্যই অনেকক্ষেত্রে হয়রানি বা নিপীড়ন করা হয়। এসব ঘটনার শিকার যিনি হন তাঁর জীবন নানা মাত্রায় বিপর্যস্ত হয়।

২.১ সাধারণ হয়রানি ও নিপীড়নের বিভিন্ন ধরনের মধ্যে আছে:    

ক. বিশ্ববিদ্যালয়ে চলাফেরাকালে কটূ বা অবাঞ্ছিত মন্তব্য।

খ. ক্লাশে বা বাইরে অবাঞ্ছিত স্পর্শ বা মন্তব্য দ্বারা ব্যঙ্গ বিদ্রুপ।

গ. চিঠিপত্র, ই-মেইল, এসএমএস, পোস্টার, দেয়াল লিখন, নোটিশ, কার্টুন ইত্যাদি মাধ্যমে হেয় বা উত্যক্ত করবার চেষ্টা।

ঘ. হুমকি প্রদান। এমন আচার আচরণ যা ভীতি সৃষ্টি করে।

ঙ. শিক্ষা, খেলাধূলা, সাংস্কৃতিক বা রাজনৈতিক সাংগঠনিক তৎপরতা  বা শিক্ষাবহির্ভূত ব্যক্তিগত কাজে বাধাপ্রদান বা জোরপূর্বক কোথাও যুক্ত হতে বাধ্য করা।

চ. ক্লাশে বা ক্লাশের বাইরে শিক্ষক কর্তৃক কোন শিক্ষার্থীকে লক্ষ্য করে হয়রানিমূলক আচরণ বা উত্যক্ত করা।

ছ. ক্লাশে বা ক্লাশের বাইরে শিক্ষার্থী কর্তৃক কোন শিক্ষককে হয়রানি বা উত্যক্ত করা।

জ. কুৎসা, চরিত্রহনন চেষ্টা।

ঝ. শারীরিক নির্যাতন।

ঞ. র‌্যাগিং এর নামে নবীন শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন মাত্রায় হয়রানি।   

২.২ সাধারণ হয়রানি ও নিপীড়ন বিশেষ মাত্রা নিলে তা যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন এর রূপ নেয়। এগুলো অনেকভাবে ঘটে থাকে। কথা, শারীরিক স্পর্শ, মানসিক বা শারীরিক আঘাত ইত্যাদিভাবে এবং অনেকসময় পরোক্ষভাবেও হয়রানি বা নিপীড়ন হয়ে থাকে। যথা:

ক. যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ/ বিদ্বেষমূলক অঙ্গভঙ্গী। পোষাক, শরীর, পরিচয় বা চলাফেরা নিয়ে কটূক্তি, টিটকারি এবং ব্যঙ্গবিদ্রুপ।

খ. প্রেম ও যৌন সম্পর্ক স্থাপনের ব্যাপারে চাপ প্রয়োগ কিংবা এমন আচার আচরণ বা হুমকি প্রদান যাতে ভীতি সৃষ্টি হয়। গ. মিথ্যা আশ্বাস, প্রলোভন বা প্রতারণার মাধ্যমে যৌন সম্পর্ক স্থাপন বা স্থাপনের চেষ্টা।  

ঘ. যৌন  আক্রমণের ভয় দেখিয়ে কোন কিছু করতে বাধ্য করা বা ভয়ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনযাপন, শিক্ষা বা কর্মজীবন ব্যাহত করা।

ঙ. যৌন উস্কানিমূলক, বিদ্বেষমূলক বা উদ্দেশ্যমূলকভাবে কুৎসা রটনার জন্য  ছায়াছবি, স্থিরচিত্র, চিত্র, কার্টুন, প্রচারপত্র, উড়োচিঠি, মন্তব্য বা পোষ্টার ইত্যাদি প্রদর্শন বা প্রচার। এরকম কোনকিছুতে যোগ দিতে চাপ সৃষ্টি বা বাধ্য করা। 

চ. স্থির বা ভিডিও চিত্র ধারণ করে ব্ল্যাকমেইল। 

ছ. সম্মতির বিরুদ্ধে শরীরের যে কোন অংশ যে কোনভাবে স্পর্শ করা বা আঘাত করা।

জ. ইচ্ছার বিরুদ্ধে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের উদ্যোগ বা স্থাপনের উদ্দেশ্যে বল বা চাপ প্রয়োগ, ব্ল্যাকমেইল, প্রতারণা, ভয় প্রদর্শন, জালিয়াতি, সুযোগ গ্রহণ বা আঘাত করা।

ঝ. নিজের সামাজিক বা প্রশাসনিক ক্ষমতাকে ব্যবহার করে কারও সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন।

ঞ. ধর্ষণ।

৩. নীতিমালার লক্ষ, উদ্দেশ্য ও আওতা

যেসব লক্ষে সাধারণ হয়রানি বা নিপীড়ন এবং বিশেষভাবে যৌন হয়রানি বা নিপীড়নের বিরুদ্ধে নীতিমালা প্রণয়ন করা হচ্ছে সেগুলো হল:

প্রথমত, হয়রানি বা নিপীড়ন যে একটি দন্ডনীয় গুরুতর অপরাধ সেটা নির্দিষ্ট করবার জন্য।

দ্বিতীয়ত, যারা আক্রান্ত এবং ক্ষতিগ্রস্ত, তাদের মধ্যে একটি নিরাপত্তাবোধ এবং বিচারের প্রতি আস্থা সৃষ্টির জন্য।

তৃতীয়ত, প্রথম থেকেই যাতে সবাই এই অপরাধের ফলাফল সম্পর্কে এবং অপরাধ করলে কী দায় বহন করতে হবে সে সম্পর্কে সতর্ক থাকে সেটি নিশ্চিত করবার জন্য। এবং,

চতুর্থত, আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য প্রতিকারের ব্যবস্থা করা।

৩.১ এই নীতিমালার বিশেষ কাজ হবে:

ক. অভিযোগ প্রদানের নিরাপদ ও সহজ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।

খ. অপরাধীদের প্রয়োজনীয় শাস্তি প্রদান।

গ. অভিযোগকারি  ও সাক্ষèীসহ সকলের নিরাপত্তা বিধানের আইনগত ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নির্দেশ করা।

ঘ. বিচারের ব্যবস্থা সুনির্দিষ্ট ও ত্বরান্বিত করা।

ঙ. বিচার চাইবার কারণে বিচারপ্রার্থীদের হয়রানি, হেয় ও নিগৃহীত করাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে সুনির্দিষ্ট করা।

চ. মিথ্যা অভিযোগকারি/দের শাস্তির ব্যবস্থা রাখা।

৩.২ নীতিমালার আওতা

বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানার মধ্যে অবস্থানরত যে কোন ব্যক্তির জন্য এই নীতিমালা প্রযোজ্য হবে। যেমন:

ক. বিশ্ববিদ্যালয় ও সংযুক্ত স্কুল- কলেজের ছাত্রছাত্রী।

খ. বিশ্ববিদ্যালয় ও সংযুক্ত স্কুল- কলেজের শিক্ষকবৃন্দ।

গ. বিশ্ববিদ্যালয় ও সংযুক্ত স্কুল- কলেজের কর্মকর্তা- কর্মচারীবৃন্দ।

ঘ. বিভিন্ন কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে বসবাসকারী সকল মানুষ।

ঙ. বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কর্মরত বিভিন্ন পেশার মানুষ।

চ. বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্য দিয়ে যাতায়াতকারী কিংবা কোন উদ্দেশ্যে আগত নারী-পুরুষ (বিশেষত: যদি যাতায়াতের     বা অবস্থানের সময়কালে কোন ঘটনা সংঘটিত হয়।)

ছ. বিশ্ববিদ্যালয় বা বিশ্ববিদ্যালযের সঙ্গে যুক্ত স্কুল বা কলেজে ভর্তি হবার ইচ্ছায় আগত ছাত্র ছাত্রী বা তাদের সঙ্গীরা।

জ. বিশ্ববিদ্যালযের যে কোন প্রতিষ্ঠানে চাকুরির সন্ধানে আগত ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ।

৪. অভিযোগ প্রদান, তদন্ত ও শাস্তি নির্ধারণের পদ্ধতিসমূহ

হয়রানি ও নিপীড়নকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করে অপরাধীকে শাস্তি প্রদান এবং আক্রান্তের জন্য যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত করবার জন্য নিুোক্ত ব্যবস্থাবলী গ্রহণ করা হবে।

৪.১ অভিযোগ প্রদান

হয়রানি বা নিপীড়নের শিকার ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ যাতে সহজে, বিনা বাধায় এবং নির্ভয়ে কোথাও তার বা তাদের উপর হয়রানি বা নিপীড়নের ঘটনা জানাতে পারেন সেজন্য যথাযথ প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা থাকতে হবে। এই ব্যবস্থায় কয়েকটি শর্ত অবশ্যই পূরণ করতে হবে:

১. অভিযোগকারী/দের নাম পরিচয়ের গোপনীয়তার নিশ্চয়তা থাকতে হবে।

২. অভিযোগকারী/দের নিরাপত্তা ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থাকলে তার শিক্ষা বা কর্মজীবন অব্যাহত রাখা নিশ্চিত করতে হবে।

৩. আক্রান্ত ব্যক্তি নিজে শারীরিকভাবে উপস্থিত না হতে পারলে তাঁর নিকটাতœীয় বা আইনজীবীর মাধ্যমে অভিযোগ দাখিল করতে পারবেন। সেক্ষেত্রে প্রথম সুযোগে এর সঙ্গে যুক্ততা পরিষ্কার করতে হবে।  

৪. নিরাপত্তার সমস্যা থাকলে ডাকে অভিযোগ প্রেরণ করা যাবে।

৫. অভিযোগকারি নারী হলে অভিযোগ কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত নারী শিক্ষকের কাছে আলাদাভাবে অভিযোগ জমা দিতে পারেন।     

৪.২ অভিযোগ কেন্দ্র: গঠন ও কার্যপ্রণালী

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অভিযোগ প্রদানের জন্য সিন্ডিকেট দুই স্তরে অভিযোগ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করবে। প্রতিটি কেন্দ্র দুই বছর মেয়াদী হবে। তবে কোন সদস্যের কাজে শৈথিল্য বা দায়িত্বহীনতা দেখা গেলে সিন্ডিকেট অভিযোগ কেন্দ্র পুনর্বিন্যস্ত করতে পারবে।

৪.২.ক. প্র্রথম পর্যায়: ‘অভিযোগ কেন্দ্র’: গঠন ও কার্যপ্রণালী 

বিভিন্ন অনুষদ/ইন্সস্টিটিউট/হল/স্কুল-কলেজ/প্রশাসনিক ভবন ক্ষেত্রে একটি করে অভিযোগ কেন্দ্র থাকবে। এই অভিযোগ কেন্দ্র গঠিত হবে ঐ স্ব স্ব ক্ষেত্রের এই বিষয়ে উপযুক্ত ও সংবেদনশীল ব্যক্তিদের সমন্বয়ে। এই কমিটি হবে তিনসদস্য বিশিষ্ট, যার মধ্যে দুইজন নারী হওয়া বাঞ্ছনীয়। 

সাধারণভাবে ঘটনার এক মাসের মধ্যে এবং বিশেষ পরিস্থিতিতে তিনমাসের মধ্যে অভিযোগ দাখিল করা যাবে। এই অভিযোগ কেন্দ্র অভিযোগ প্রাথমিক যাচাইয়ের পর বিষয়টি অনানুষ্ঠানিকভাবে সমাধান করবার মতো কিনা তা বিচার করবেন। হলে তাঁরাই বিষয়টি নিষ্পত্তি করবেন। সেভাবে সমাধান করবার মতো না হলে তা সর্বোচ্চ সাতদিনের মধ্যে অভিযোগ নিষ্পত্তি কেন্দ্রে প্রেরণ করবেন। কেন্দ্র যদি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে উচ্চতর কেন্দ্রে অভিযোগ জমা না দেন, তাহলে অভিযোগকারি সরাসরি তা এই উচ্চতর অভিযোগ নিষ্পত্তি কেন্দ্রে জমা দিতে পারবেন।

৪.২.খ. দ্বিতীয় পর্যায়: ‘অভিযোগ নিষ্পত্তি কেন্দ্র’: গঠন ও কার্যপ্রণালী

এই উচ্চতর কেন্দ্রে সদস্য সংখ্যা হবে ন্যুনতম পাঁচ। পাঁচজনের মধ্যে তিনজন নারী হওয়া বাঞ্ছনীয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছাড়াও এতে বহিঃস্থ এক বা একাধিক ব্যক্তি থাকবেন। বহিঃস্থ ব্যক্তি আইন বিশেষজ্ঞ এবং/অথবা মানবাধিকার কর্মী হওয়া বাঞ্ছনীয়। অভিযোগকারী শিক্ষার্থী হলে শিক্ষার্থী প্রতিনিধি রাখার উদ্যোগ নিতে হবে। অভিযোগকারী কর্মকর্তা/কর্মচারি হলে তাদের প্রতিনিধি রাখার উদ্যোগ নিতে হবে।

এই কেন্দ্র অভিযোগ তদন্ত করবার জন্য প্রয়োজনীয় শুনানী, তথ্য সংগ্রহ, প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পর্যায়ের দলিলপত্র পর্যালোচনার ক্ষমতার অধিকারী হবে। তাদের কাজ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অফিস চাহিবামাত্র সকল সহযোগিতা প্রদানে বাধ্য থাকবে। নিষ্পত্তি কেন্দ্র তদন্ত পরিচালনায় অভিযোগকারী/দের পরিচয় যথাসম্ভব গোপন রাখবেন।  প্রত্যক্ষ সাক্ষ্যপ্রদানে কেউ সমস্যা বোধ করলে পরিচয় গোপন রেখে বা পরোক্ষভাবে যাতে কেউ তথ্য সরবরাহ করতে পারে তার ব্যবস্থা রাখতে হবে। নিষ্পত্তি কেন্দ্র সর্বোচ্চ একমাসের মধ্যে তদন্ত কাজ শেষ করে তাদের রিপোর্ট এবং অপরাধীর শাস্তির নির্দিষ্ট সুপারিশ সিন্ডিকেটকে প্রদান করবে।

৫. শাস্তি

অভিযোগ নিষ্পত্তি কেন্দ্রের সুপারিশ অনুযায়ী সিন্ডিকেট সর্বোচ্চ দুইমাসের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশ, বিধি অনুযায়ী সকল পর্যায় শেষ করবে এবং অপরাধীর শাস্তি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত প্রদান করবেন। বিষয় নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত অভিযুক্ত যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত কোন ব্যক্তি হন তাহলে তার বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ না করা নিশ্চিত করা হবে। 

৫.১ অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী যৌন হয়রানি সৃষ্টিকারী বা নিপীড়ক শিক্ষার্থীদের কমপক্ষে নিুোক্ত শাস্তি দেয়া যাবে।

ক. মৌখিক সতর্কীকরণ

খ. লিখিত সতর্কীকরণ

গ. লিখিত সতর্কীকরণ ও তা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সর্বত্র প্রচার

ঘ. এক বছরের জন্য বহিষ্কার ও প্রচার

ঙ. দুই বছরের জন্য বহিষ্কার ও প্রচার

চ. চিরতরে বহিষ্কার ও প্রচার

ছ. প্রচারসহ চিরতরে বহিষ্কার ও শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে প্রাপ্ত সনদপত্র বাতিল

জ. চিরতরে বহিষ্কার, শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে প্রাপ্ত সনদপত্র বাতিল এবং সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এ বিষয়ক তথ্য সরবরাহ।  কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য, অন্যান্য সকল প্রতিষ্ঠানে অবহিত করা।

 ঝ. চিরতরে বহিষ্কার, শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে প্রাপ্ত সনদপত্র বাতিল, সকল শিক্ষা ও কর্ম প্রতিষ্ঠানে এ বিষয়ক তথ্য সরবরাহ এবং রাষ্ট্রীয় আইনের অধীনে যথোপযুক্ত শাস্তি প্রদানের জন্য পুলিশের কাছে হস্তান্তর। 

৫.২ অপরাধী ক্যাম্পাসে বসবাসরত বা আগত বা যাতায়াতকারী কোন ব্যক্তি হন তাহলে অপরাধের মাত্রা বিবেচনা করে নিুোক্ত শাস্তি বিধান করা যাবে: 

ক. মৌখিক সতর্কীকরণ

খ. লিখিত সতর্কীকরণ

গ. লিখিত সতর্কীকরণ ও তা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সর্বত্র প্রচার

ঘ. ক্যাম্পাসে আগমন, চলাচল বা বসবাস নিষিদ্ধ করা।

ঙ. সম্পর্কিত সকল প্রতিষ্ঠানে অবহিত করা এবং রাষ্ট্রীয় আইনের অধীনে যথোপযুক্ত শাস্তি প্রদানের জন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে হস্তান্তর।

৫.৩ অপরাধী যদি কর্মকর্তা বা কর্মচারি হন তাহলে অপরাধের মাত্রা বিবেচনা করে নিুোক্ত শাস্তি বিধান করা যাবে: 

ক. মৌখিক সতর্কীকরণ।

খ. লিখিত সতর্কীকরণ।

গ. লিখিত সতর্কীকরণ ও তা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সর্বত্র প্রচার।

ঘ. আর্থিক দন্ড। ইনক্রিমেন্ট বন্ধসহ আর্থিক সুবিধা খর্ব।

ঙ. পদাবনতি ও আর্থিক দন্ড।

চ. বাধ্যতামূলক অবসর বা চাকুরিচ্যুতি।

ছ. চাকুরিচ্যুতি ও আর্থিক দন্ড।

জ. চাকুরিচ্যুতি এবং অন্যান্য সকল সমজাতীয় প্রতিষ্ঠানে অবহিত করা।

ঝ. চাকুরিচ্যুতি এবং রাষ্ট্রীয় আইনের অধীনে যথোপযুক্ত শাস্তি প্রদানের জন্য আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার কাছে হস্তান্তর।

৫.৪ অপরাধী যদি শিক্ষক হন তাহলে অপরাধের মাত্রা বিবেচনা করে নিুোক্ত শাস্তি বিধান করা যাবে: 

ক. মৌখিক সতর্কীকরণ।

খ. লিখিত সতর্কীকরণ।

গ. লিখিত সতর্কীকরণ ও তা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সর্বত্র প্রচার।

ঘ. নির্দিষ্ট কোর্স বা পরীক্ষার কাজ থেকে অব্যাহতি।

ঙ. আর্থিক দন্ড। ইনক্রিমেন্ট বন্ধসহ আর্থিক সুবিধা খর্ব।

চ. পদাবনতি ও আর্থিক দন্ড।

ছ. বাধ্যতামূলক অবসর বা চাকুরিচ্যুতি।

জ. চাকুরিচ্যুতি ও আর্থিক দন্ড।

ঝ. চাকুরিচ্যুতি এবং অন্যান্য সকল সমজাতীয় প্রতিষ্ঠানে অবহিত করা।

ঞ. চাকুরিচ্যুতি এবং রাষ্ট্রীয় আইনের অধীনে যথোপযুক্ত শাস্তি প্রদানের জন্য আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার কাছে হস্তান্তর।

৬. মিথ্যা অভিযোগ

যদি প্রমাণিত হয় যে, অভিযোগ ভিত্তিহীন কিংবা কোন এক বা একাধিক ব্যক্তিকে হেয় বা হেনস্তা করবার জন্য উদ্দেশ্যমূলকভাবে সাজানো অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে তাহলে অভিযোগকারী বা অভিযোগকারীদের জন্য সেই একই বিচার ও শাস্তি নির্ধারিত হবে যা নিপীড়কের জন্য প্রযোজ্য।  অভিযোগ নিষ্পত্তি কেন্দ্র বিষয়টি নিয়ে যথাযথ তদন্ত করে প্রযোজ্য শাস্তির সুপারিশ করে সিন্ডিকেট-এর কাছে রিপোর্ট জমা দেবে।

৭. শিক্ষা/পরামর্শ/জনমত গঠন

সবরকম হয়রানি ও নিপীড়নসহ যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন বন্ধের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রচার প্রকাশনা ক্ষেত্রে বিশেষ মনোযোগ দেবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল হল, অফিস ও বিভাগে এই নীতিমালা সহ এই বিষয়ে ব্যাপক প্রচার করবে। সংবিধানের বিধান অনুযায়ী সকলের মতপ্রকাশ, চলাফেরা, পড়াশোনা ও কাজের সুষ্ঠু এবং নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করবার জন্য যথায়থ শিক্ষা, পরামর্শ ও জনমত গঠনের প্রক্রিয়া জারি রাখবে। এসবের পক্ষে, সহমর্মী, পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল একটি সুষ্ঠু শিক্ষার পরিবেশ তৈরির জন্য সার্বিক শিক্ষা, প্রচার ও জনমত সংগঠনের কাজকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হবে।

বিশেষ সুপারিশ: কমিটির সদস্যগণ এই নীতিমালার সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল ল ও অন্যান্য বিধিমালা সংশোধন ও পুনপ্রণয়ন আবশ্যক বিবেচনা করেন এবং এই বিষয়ে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বিশেষ সুপারিশ রাখছেন। 

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *