খগারহাটের কৃষক ও করোনা

Hide

করোনা পূর্বকাল কোনো স্বাভাবিক কাল ছিল না বাংলাদেশের মানুষের জন্য। টিকে থাকার জন্য অমানুষিক পরিশ্রম আর অনিশ্চয়তা ভরা জীবন। চিকিৎসা, শিক্ষা, নিরাপত্তা সবই ধরা ছোঁয়া থেকে অনেক দূরে। জীবন এমন ছিল বলেই করোনা ভাইরাস আক্রমণের পর কোনোরকমে জীবন নিয়ে ঝুলে থাকা বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ আছড়ে পড়ছে পাতালে। তারই একটি খন্ডচিত্র..

নীলফামারী জেলাধীন ডিমলা উপজেলার খগারহাট বাজার। সপ্তাহে দুটি বারে হাট বসে, লোকে থাকে গিজগিজ। হাটবার ছাড়াও কম কিসে! কাঁচাবাজার, মাছ, মাংস, কাপড়, ওষুধের দোকান ছাড়াও নিত্যনতুন ক্যানভাসাররা আসে যেন পালা করে। কেউ আসে জোঁক বা সান্ডার তেল নিয়ে, কেউ আসে স্বামী-স্ত্রীর মহব্বতবর্ধক সোলায়মানি তাবিজের ভান্ডার নিয়ে। কোন ক্যানভাসার বা হকার বেচাকিনি কম হয়েছে বলে মুখ গোমড়া করে ফিরে গেছে, এমন রেকর্ড অন্তত খগারহাট বাজারের কপালে নেই। খগারহাটে লোকের অভাব হয় না কি সকাল, কি ভরদুপুর, কি রাত বারোটায়ও।

কিন্তু এখন? খগারহাটের একেবারে প্রধান রাস্তা সংলগ্ন চায়ের দোকানদার দোমাসুর (ছদ্মনাম) কথাই ধরুন না, বেচারা মোটে পাঁচ হাজার টাকার মত মূলধন খাটিয়ে ব্যবসা করে আসছিল অনেক দিন হয়, ঘরে বউ-ছেলে-বাচ্চাকাচ্চা মিলে সাত-সাতটি পেটের অন্নের সংস্থান ওইটুকুন ক্ষুদ্র ব্যবসা। দোমাসুকে কেউ ‘ক্যামন আছেন’ প্রশ্ন করলে হাসিমুখে জবাব আসত : চলছে আপনাদের দোয়ায়!
হ্যাঁ, চলছিল! দৈনিক তিন-চারশ টাকায় এ যুগে অনেকের পরিবার চলছেই তো। কিন্তু এখন গিয়ে দোমাসুকে প্রশ্ন করুন-ক্যামন আছেন?
কুশল বিনিময়ের সুযোগটা ঘটবে দোকানঘরের পিছন দিকের ভাঙা বেড়ার খানিকটা অংশ কেটে তৈরি করা নতুন দরজা দিয়ে ঢোকার পর।
ক্যামন আছেন?-প্রশ্নের জবাবে দোমাসু এখন কুঁকড়ে যায়, চোখ মিলিয়ে মৃদু কণ্ঠে যা উত্তর আসবে তাতে কেউ বুঝতে সক্ষম হতেও পারেন, নাও পারেন।

স্থানীয় সরকারের চৌকিদার, মেম্বার, চেয়ারম্যান আর পুলিশের চাপে জর্জরিত দোমাসু দোকানের সম্মুখ অংশ খুলতে পারে না ২৬ তারিখের পর থেকে। কিন্তু ক্ষুধা, পেট, সংসারের কাছে এসব যে অবৈধ খবরদারি কিংবা মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা, তা দোমাসু মিয়াকে পরিস্থিতির ‘চোর’ বানিয়ে ছেড়েছে।
দোমাসু মিয়া এবার নিজেই নিজের ইজ্জত যেন চুরি করতে নেমেছে, সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে দোকানে বসে থাকে চোরের মত, যেন দুটি টাকা এরই মাঝেও বেচাকেনা হয়; অন্তত বউ-বাচ্চার মুখে মোটা চাল না হোক, একটু খুদ যেন জোটানোর ব্যবস্থা হয়।
খগারহাটে দোমাসু তো একজন নয়, বহু।

এবার চলুন ডিমলার মরিচ চাষিদের ক্ষেত কিংবা বাড়িতে যাই।
ক্ষেতে গাছ আছে, মরিচ আছে, কৃষক আছে, আছে অভাব…নেই শুধু মরিচের দাম! পোড়ামুখো, অসভ্য করোনা বাংলাদেশে ঢোকার আগেও কৃষকরা মণপ্রতি মরিচ বিক্রি করত তেরো-চৌদ্দশ টাকায়, আর এখন? যেন পানির দর! তিনশ থেকে সর্বোচ্চ চারশ টাকা।
চৈত্র মাসের এমন দিনে পাটশাকের স্বাদে ভরপুর থাকে উত্তরবঙ্গের রান্নাঘরগুলো, এক জোড়া পাটশাকের আঁটি বিক্রি হচ্ছিল সপ্তাহখানেক আগেও বিশ টাকা। আর এখন বিশ টাকার পাটশাক বিক্রি করতে গেলে কৃষকের চোখ ভিজে যাচ্ছে।

শুধু কি মরিচ আর পাটশাক? উত্তরবঙ্গের অগণিত কৃষক যা কিছু আবাদ করছে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, তার সব কিছুই এখন পানির দরের চেয়েও নিম্নগামী। পুঁইশাক, লালশাকে অনেকে হিসাব মেলাতে চেয়েছে সংসারের… এখন বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে চার-পাঁচ টাকা কেজি দরে। শসা কিছুদিন আগেও গ্রাম্য বাজারে ত্রিশ টাকার নিচে পাওয়া যেত না, এখন তিন-চার টাকায়ও ভোক্তা নিচ্ছে না। বেগুন গ্রাম্য বাজারে পাওয়া যাচ্ছে পাঁচ-ছয় টাকা কেজি দরে…বাজারের পাঁচ-ছয় টাকা দরের বেগুন কৃষক কত টাকায় বিক্রি করতে পেরেছে? হিসাবটা কেউ মিলিয়ে দিবেন কি?
খগারহাটের আশপাশে অনেক ক্ষুদ্র কৃষক বেঁচে থাকার লড়াইয়ে দু-তিনটি করে দুধেল জাতের গাভিতে সাধ্যমত বিনিয়োগ করেছিল! বাজার থেকে এক কিলোমিটার পূর্বে তেমনই এক কৃষক নালু মিয়ার (ছদ্মনাম) ঘরে দুটি উন্নত জাতের গাভি থেকে প্রতিদিন বিশ লিটার দুধ সংগ্রহ হত। আশপাশের বাজারের চায়ের দোকানগুলোতে সরবরাহ করে চার সদস্যের পরিবারটি দিন গুজরান করত।

দুধ থেকে গরুর খাদ্য কিনে অবশিষ্ট চালান যেত বউ-বাচ্চার গতরে, বেচারা আজ দুসপ্তাহ ধরে পনেরো-বিশ টাকা দরে বাড়ি বাড়ি হাঁক ছাড়ছে। তার পরও দৈনিক দশ লিটারের বেশি দুধ ঘরেই থাকছে।
নালু মিয়ার সাদাসিধে বউ আজ আসন্ন দিনের দুর্ভোগ কল্পনা করে হাজারো দিব্যি দিচ্ছে আর করোনার চৌদ্দগুষ্টিকে উদ্দেশ করে অভিশাপ বর্ষণ করছে।

আজ উত্তরবঙ্গের এমন হাজারো দোমাসু কিংবা নালু মিয়ার মত ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা কিংবা প্রান্তিক কৃষক চোখে সরষে ফুল দেখছে।
প্রশ্ন উঠবে, এ আবার নতুন কি? সারা বিশ্ব যখন দুর্যোগে নাকাল, তখন খগারহাট তো বিশ্ব মানচিত্রের বাইরে নয়?
এমন জুতসই প্রশ্ন বা প্রশাসনের দায় এড়ানোর কৌশলের কী-ইবা জবাব আছে আমাদের পল্লিগাঁয়ের কৃষক, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার!
এমন প্রশ্নের উত্তর দেয়ার মত বিদ্যাজ্ঞান, শিক্ষা, ভাষা, সংগঠন, তেজ আমাদের নিুআয়ের মানুষদের নেই!
খরা, বন্যা, আগুন, পাহাড়ধস কিংবা করোনাকে এদের কাছে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছিল ন্যাচারাল ডিজাস্টার বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে! আর এসবের প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ আক্রান্তের তালিকায় তারাই যে সবচেয়ে বেশি থাকবে, নানা তরিকায় সেটাও যুগ যুগ ধরে বুঝিয়ে আসছিল সংশ্লিষ্ট দরবারের কর্তৃপক্ষ।

তাই এত দিনের সংস্কার ভেঙে, আমাদের কৃষক একবারও বলবে না হয়ত, এগুলো (দুর্যোগ) সবই কেন শুধু তাদেরকেই জ্বালায়, পোড়ায়, মারে?

সমস্ত বিপদে বাংলার মানচিত্রে থাকা এই সিংহভাগ নিম্নআয়ের কৃষক, শ্রমিক, উদ্যোক্তাদেরই যদি বুক পেতে দিতে হয়, তাহলে তোমাদের মত কোট-টাই-চশমা পরা কর্তৃপক্ষের কী কাজ?

সঠিক প্রশ্নের দিকে না গিয়ে মুখস্থ উত্তর শোনার যে অভ্যস্ততা আমরা লাভ করেছি তার সংস্কার না হলে অদৃশ্য করোনা শুধু নয়, দৃশ্যমান হাজারো ছোট-বড় করোনাও প্রতিনিয়ত কুরে কুরে খাবে আমাদের প্রান্তিক মানুষদের! আর আমরা নিম্নআয়ের মানুষরা ব্যাঙের মত লুকিয়ে থাকব, মরব কিংবা কখনও বা থপথপ করে এগোব আর পিছাব!

সেলিম রানা: লেখক। ডিমলা, নীলফামারী।

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *