মৌলবাদের সংঘর্ষ: ক্রুসেড, জিহাদ এবং আধুনিকতা-১১
আনোয়ার শাইখের কথা
তারিক আলি
২০০২ সালে যখন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসী তৎপরতা অনেক বিস্তৃত এবং ইসলামি মৌলবাদ বিশ্বজুড়ে আলোচিত বিতর্কিত বিষয় তখন তারিক আলির বই The Clash of Fundamentalisms: Crusades, Jihads and Modernity প্রকাশিত হয়। তারিকের এই বই অনুসন্ধান করেছে ধর্মীয় বিভিন্ন মত-পথ, বিভিন্ন ধরনের মৌলবাদী শক্তি, তার ইতিহাস ও রাজনীতি এবং সর্বোপরি তার ভাষায় ‘সবচাইতে বড় মৌলবাদী শক্তি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ’-এর সঙ্গে এর সম্পর্ক। সর্বজনকথার জন্য এই বই (প্রকাশক ভার্সো, 2003)-এর ধারাবাহিক অনুবাদ করছেন ফাতেমা বেগম। এবারে একাদশ পর্ব। এখানে আলোচিত হয়েছে পাকিস্তান থেকে বৃটেনে প্রবাসী ধর্মীয় দাঙ্গায় অপরাধবোধে আক্রান্ত একজন লেখক গবেষকের কথা।
‘এভাবেই আমার দুঃখ দৃশ্যমান হয়েছিল:
তার ধুলো, আমার হৃদয়ে বছরের পর বছর ধরে জমছে,
অবশেষে তা আমার চোখে পৌঁছেছে,
তিক্ততা এখন তাই এত স্পষ্ট যে
আমাকে তাই করতে হয়েছিল যখন বন্ধুরা
আমাকে রক্ত দিয়ে চোখ ধুতে বললো
একযোগে রক্তে মিশে গেল সবকিছু-
প্রতিটি মুখ, প্রতিটি প্রতিমা, সর্বত্র লাল।
সূর্যের উপর রক্ত ঝরেছে, সোনালী আভাকে ধুয়ে দিয়েছে।
রক্তে চাঁদ ফুটেছে, তার রূপালী কিরণ নিভে গেছে।
আকাশ এক রক্তাক্ত সকালের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল,
আর রাতের কান্নায় ছিল শুধু রক্ত …
প্রবাহিত হতে থাকুক। এটা কি বন্ধ করা উচিত,
সেখানে মৃত্যুর রঙে শুধু ঘৃণাই আবৃত থাকবে ।
এটা ঘটতে দিও না, বন্ধুরা,
পরিবর্তে আমার সমস্ত অশ্রু ফিরিয়ে আনো,
আমার ধুলো ভরা চোখ শুদ্ধ করার একটি বন্যা,
চিরতরে আমার চোখ থেকে এই রক্ত ধুয়ে ফেলতে।’
-ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ (১৯১১-৮৪), `লাইনস অন দ্য ম্যাসাকারস ইন ইস্ট পাকিস্তান’ (বাংলাদেশ), মার্চ ১৯৭১
‘পাকিস্তান ইসরায়েলের মতই, একটি আদর্শিক রাষ্ট্র। ইহুদি ধর্মকে ইসরায়েল থেকে বের করে দিন এবং তখন তা তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বে। পাকিস্তান থেকে ইসলামকে সরিয়ে দিয়ে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে পরিণত করুন, এর পতন হবে। গত চার বছর ধরে আমরা এদেশে ইসলামী মূল্যবোধ আনার চেষ্টা করছি।’
– জেনারেল জিয়া-উল-হক (১৯১৬-৮৯), প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, পাকিস্তান, ১৯৮১
নৈতিকতা সহানুভূতি থেকে জন্ম নেওয়া ভালবাসা ছাড়া আর কিছুই নয়। –স্পিনোজা
১৯৮৯ সালে সালমান রুশদির বিরুদ্ধে খোমেনির ফতোয়া সাহিত্য এবং সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনাকে সন্ত্রস্থ করে তোলে। ইসলামিক বিশ্ব এক কষ্টকর নীরবতায় আচ্ছন্ন ছিল। কায়রো এবং আলজিয়ার্সে ইতিমধ্যেই সীমাবদ্ধ কষ্টকর বাকস্বাধীনতাকে আরও খর্ব করা হয়েছিল। তবে নিউইয়র্ক এবং লন্ডনও ভীতিগ্রস্থ। ১১ই সেপ্টেম্বরের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিস্থিতির সাথে এখানে একটি সীমিত সাদৃশ্য টানা যাবে। তখন, এখনকার মতো, প্রকাশকদের বেশ কয়েকটি স্ব-সেন্সরশিপের ঘটনা ঘটেছে। হতবাক লেখকরা বলেন পরিত্যক্ত সাহিত্য প্রকল্পের কথা , ভীত বুদ্ধিজীবীদের ফিসফিস করে কথা বলতে বাধ্য হওয়া, অনুগত ঠোঁটে বিবর্ণ হাসি, দ্রুত নাম পরিবর্তনের কথা : একটি জ্যাজ রেকর্ড লেবেলের মত জিহাদ, তাকে পুনরায় ব্র্যান্ড করা হয়েছে; পেন্টাগন আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার পর ইসলামো-আমেরিকান রক গ্রুপ ‘ডক্টর জিহাদ অ্যান্ড দ্য ইন্টেলেকচুয়াল মুসলিম গেরিলাস’ নামটি বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। কিন্তু আনোয়ার শেখ এমন একজন মানুষ যিনি ভয়ে পরাজিত হতে অস্বীকার করেন।
যৌবনে তিনি প্রবল বিশ্বাসী একজন ধার্মিক ব্যক্তি ছিলেন । আর এখন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সাথে বিবাদ তার জীবনের একটি কেন্দ্রীয় বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে । প্রাক্তন বাস কন্ডাক্টর আনোয়ার শাইখ ওয়েলশের রাজধানী কার্ডিফে প্রায় দুই দশক ধরে, সেইসব মোল্লা এবং রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে অবিরাম একক ভাবে প্রচার চালাচ্ছেন, যারা তাদের জঘন্য কাজগুলোকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য ইসলামকে একটি পোশাক হিসেবে ব্যবহার করে। এবং তার এই কাজ উল্লেখযোগ্য প্রভাবও তৈরী করছে।
আমি কয়েক বছর আগে প্রথম শাইখের কথা শুনি। আমার লাহোরের একজন পুরনো বন্ধু একটি সুইডিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামী আইনের অধ্যাপক। তিনি ব্রিটেনে এলে আমরা বিশ্ব পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে মিলিত হই। তিনি জিজ্ঞেস করলেন আমি আনোয়ার শাইখের কথা শুনেছি কিনা। আমি আমার অজ্ঞতা জানালাম। প্রফেসর তাতে সত্যি অবাক হলেন। এই দুঃসময়ে আমি এত অজ্ঞ হলাম কি করে? কার্ডিফের লোকটি এমন সাহস এবং শক্তির সাথে আলোকিত মূল্যবোধ রক্ষা করছিলেন যে তিনি আমাদের সম্মানের যোগ্য।
‘তুমি কি কখনো দৈনিক জঙ পড়ো না?’ আমার বন্ধু কিছুটা বিরক্তির সাথে জিজ্ঞাসা করলেন। দৈনিক জঙ লন্ডন থেকে প্রকাশিত এবং সমগ্র ইউরোপে বিতরণ করা একটি রক্ষণশীল উর্দু দৈনিক পত্রিকা। স্টকহোমে তিনি দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির সাথে পরিচিত থাকার জন্য এই পত্রিকাটি পড়তেন। আমি বন্ধুকে জানালাম যে পাকিস্তানের সাথে আমার আরও সরাসরি যোগাযোগ ছিল। লাহোরে আমার মায়ের সাথে প্রতিদিন ব্যয় বহুল ফোনালাপ আমাকে দৈনিক জঙ -এর চাইতে অনেক তথ্য সমৃদ্ধ রেখেছিল। তবে এটা সত্য যে, মা কখনো আনোয়ার শাইখের কথা বলেননি। কিংবা তিনি জানতেন না যে শাইখের লেখালেখি পশ্চিম ইউরোপ এবং দক্ষিণ এশিয়ার ইসলামী মৌলবাদী মহলে মধ্যে এমন একটি আলোড়ন সৃষ্টি করছে।
এই আলোচনার পরের সপ্তাহে আমি ব্রিটেনের উর্দু প্রেস থেকে সংবাদপত্রের ক্লিপের একটি সেট সংগ্রহ করি। সেগুলি পড়ে আমার ধারণা স্পষ্ট হয়ে উঠল যে, শুধু কট্টরপন্থীরাই শাইখের লেখায় উত্তেজিত ছিল না। স্টকহোম, কোপেনহেগেন, বার্লিন, প্যারিস এবং আমস্টারডামের পাশাপাশি লন্ডন, বার্মিংহাম, ব্র্যাডফোর্ড এবং গ্লাসগোতে মুসলিমরা শাইখের লেখা প্রচার করছিল এবং লেখাগুলির ধর্ম-বিদ্বেষমূলক প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করছিল। মুখে মুখে এই খবর ছড়িয়ে পড়েছিল। উর্দু সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত ক্ষুব্ধ চিঠিগুলি এই উত্তেজনার প্রমাণ বহন করছিল। শাইখ ১৯৯৪ সালের মার্চ মাসে তার প্রথম বই ইটারনিটি প্রকাশ করেন। নিজেই বইটি প্রকাশ, প্রচার ও বিতরণ করেন। কোন বইয়ের দোকানে তা পাওয়া যেত না। এটি শুধুমাত্র কার্ডিফের একটি পোস্ট অফিস বক্স নম্বরের মাধ্যমে চাওয়া যেত। আমি একটি অনুলিপি সংগ্রহ করলাম। বইটির কেন্দ্রীয় বার্তা ছিল পরিষ্কার: নবম শতাব্দীর মু’তাযিলীদের মতো শাইখ ওহীর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। তিনি কোরানের ঐশীত্বকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। লন্ডনের ডেইলি আওয়াজের প্রতিক্রিয়াটি ছিল একইভাবে পরিষ্কার একটি শিরোনাম:
কার্ডিফের আনোয়ার শাইখ একজন ধর্মদ্রোহী এবং মৃত্যুদন্ড পাওয়ার যোগ্য।
একটি ব্যাপার আমাকে প্রকৃত অর্থে বিস্মিত করেছিল। তা হলো, সম্প্রদায়ের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক উত্তেজনা সত্বেও মুসলিম সংবাদপত্রে শাইখকে নিন্দাকারী চিঠিগুলির স্বর মোটামুটি নমনীয় ছিল। প্রতিক্রিয়া থেকে উৎসাহিত হয়ে শাইখ একটি নতুন পুস্তিকা তৈরি করেন। এর প্রতিক্রিয়ায় মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্ষোভ তৈরী হয়। ১৯৯৭ সালের ১৯শে আগস্ট ডেইলি জঙ ল্যাঙ্কাশায়ারের ওল্ডহাম থেকে জনাব আব্দুল লতিফের একটি চিঠি প্রকাশ করে। সাব- এডিটরের সহায়ক ক্যাপশন, ‘একটি জঘন্য ইসলামবিরোধী প্রচারণা’, চিঠিটির আসল বক্তব্যের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ ছিল। চিঠিতে যারা ধর্মান্ধ না হয়েও বিশ্বাসী তাদের পক্ষ থেকে সাহায্যের জন্য একটি আবেদন ছিল এবং তা প্রবাসী মুসলমানদের চিন্তাভাবনার একটি বিরল অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে:
আনোয়ার শেখের বই ‘ইসলাম, দি আরব ন্যাশনাল মুভমেন্ট’ সম্পর্কে দৈনিক জঙ এ বেশ কয়েকটি চিঠি প্রকাশিত হয়েছে। সাধারণ মুসলমানরা তাদের আলেমদের কাছে এই বইয়ের বিষয়বস্তুগুলি খন্ডন করে উত্তর দেওয়ার জন্য অনুরোধ করে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে আলেমগন নীরব থেকেছেন। ব্রিটেনে কি একজনও মুসলিম আলেম নেই যিনি আনোয়ার শেখের ইসলামের সমালোচনা খণ্ডন করতে পারেন?
আমাদের আলেমদের অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে যে, ফতোয়া দিয়ে ইসলাম বিদ্বেষীদের ভয় দেখানোর সময় শেষ। আধুনিক সময়ে, কেবল যুক্তি দিয়েই জনমত সন্তুষ্ট হবে। এই চিঠি লেখার আরেকটি কারণ হল, আমার স্নাতকোত্তর ছেলে, যে সম্প্রতি একজন ধার্মিক মুসলিম ছিল, সে আর ইসলামের কথা চিন্তা করে না। আমি জেনেছি একজন খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারক তাকে আনোয়ার শাইখের বইটি দিয়েছিলেন।এই বই পাঠই তাকে ইসলাম বিরুদ্ধ করেছে।…
সত্য হল, আমরা মুসলমানরা, অভিশপ্ত রুশদির বইয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে বোকামি করেছি। কারণ আনোয়ার শাইখের তুলনায় রুশদি কিছুই নয়। রুশদি তার মিথ্যার জাল বুনে উপন্যাসকে আকর্ষণীয় করতে চেয়েছিলেন। । তবে আমরা এই প্রেক্ষিতে আমাদের সন্তানদের বুঝাতে সক্ষম হয়েছি। কিন্তু আনোয়ার শাইখ আমাদের বিশ্বাসের ভিত্তি পবিত্র কোরান এবং হাদীসের উদ্ধৃতিগুলির উপর তার কাজ প্রতিষ্ঠা করেছেন ।
এক সপ্তাহ পরে, একই পত্রিকা আমস্টারডামের একজন মুসলিম এম. আনোয়ারের একই রকম বক্তব্যের একটি চিঠি প্রকাশ করে। আনোয়ার শাইখের মতবাদের বিশদ সমালোচনা করার জন্য এই চিঠিতেও ইসলামের আলেমদের কাছে একটি অনুরোধ ছিল, যাতে তরুণ প্রজন্ম সংক্রমিত হয়ে তাদের বিশ্বাস থেকে বিচ্ছিন্ন না হয়ে পড়ে। এই চিঠিতে হতাশার লেখাটি উর্দু প্রেসের অন্যান্য চিঠি-লেখকদের মত একই অভিযোগ ছিল। পশ্চিম ইউরোপের বেশিরভাগ চিঠি লেখকগন শাইখের নিন্দা করলেও, বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠরা তাকে হত্যা করার জন্য বা এমনকি তার ‘নিন্দামূলক’ বই পোড়ানোর জন্যও আহ্বান করেনি। তারা একটি কর্তৃত্বপূর্ণ যুক্তি খণ্ডন দাবি করেছে।
শাইখকে ধর্মদ্রোহী আখ্যায়িত করে শরিয়ার শাস্তি হিসাবে মৃত্যুদন্ড দেয়ার কথা। কিন্তু মুসলিম নেতারা বিষয়টি প্রচারে অনিচ্ছুক ছিলেন। মুমিনদের শান্ত থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। লীডসে থেকে ক্বারী সাইয়্যাদ হুসাইন আহমেদ যুক্তি দিয়েছেন:
আমরা একবার প্রতারিত হয়েছি। শয়তান রুশদি একজন অখ্যাত ব্যক্তি ছিল। আমরা ফতোয়া জারি করে তার মাথার জন্য একটি পুরস্কার নির্ধারণ করেছি। আমরা যদি তা না করতাম, তাহলে রুশদি তার সীমানার শেষ প্রান্তে পৌঁছে যেতেন। ফলে তার মত আর কোন উন্মাদ আমাদের নবীকে অবমাননা করার কথা চিন্তাও করতে পারতো না। রুশদী ও শাইখ একই গোত্রের। তবে আনোয়ার শাইখের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিবাদ সংগঠিত করা উচিত নয় যাতে তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতি লাভ করেন।
শাইখ এবং রুশদীর মধ্যে সাদৃশ্য ভুলভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। কথাসাহিত্যের তাঁতি হিসাবে নয়, শাইখ নিজেকে একজন গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসবিদ হিসেবে গণ্য করেন। অন্যদিকে, রুশদি একজন ‘দুর্নীতিগ্রস্ত আধুনিকতাবাদী, রাগবি স্কুল ও কেমব্রিজের একটি পণ্য, এবং সাধারণ মুসলমানদের জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন একজন ব্যক্তি’ হিসাবে নিন্দিত হয়েছিলেন। শাইখ পাঞ্জাবি কৃষক সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত একজন। উপমহাদেশীয় ইসলামের পরিবেশে তার যৌবন কেটেছে । তিনি তার ধর্মের বিষয়ে বিজ্ঞ। তার রচনা পুনরাবৃত্তিমূলক, এবং মাঝে মাঝে, তার যুক্তিতে একটি অসঙ্গতি তৈরী হলেও , সর্বদা পুনরাবৃত্তিমূলক এবং অসংলগ্ন ধর্মীয় গ্রন্থ এবং উপদেশগুলিতে অভ্যস্ত শ্রোতাদের জন্য লেখা হওয়াতে তা কার্যকরী হতে পেরেছিল। তার বই এবং পুস্তিকাগুলি পশ্চিম ইউরোপ এবং পাকিস্তানের মুসলিম সম্প্রদায়গুলিতে প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের সমীজদাত বা সেপ্টেম্বর-পরবর্তী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অ্যারন ম্যাকগ্রুডারের কার্টুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে। সেগুলি পড়া, অনুলিপি করা, ছড়িয়ে দেয়া হতে থাকে , এবং অবিরাম আলোচনা চলতে থাকে। এটিই শাইখকে গোঁড়া ধর্মের জন্য বিপজ্জনক একজন প্রতিপক্ষ করে তোলে। সে ভিতরের শত্রু। অবশেষে যখন আমি তার সাথে দেখা করলাম, তার আত্মবিশ্বাস দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম। তিনি বললেন:
‘তারা কখনই আমার মুখ বন্ধ করতে সফল হবে না, কারণ আমি লক্ষ লক্ষ নীরব মুসলমানের পক্ষে কথা বলি।’
তাঁর পুস্তিকা, ‘ইসলাম: দ্য আরব ন্যাশনাল মুভমেন্ট’, এ শাইখের উদ্দেশ্য ছিল ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলোকে প্রশ্ন করা । তিনি মুহাম্মদকে আল্লাহর থেকে আলাদা করার মাধ্যমে তা করেন। তার দাবি অনুযায়ী এটি করার মাধ্যমে তিনি কেবল কোরানিক আদেশ – ‘আপনি যদি সত্যবাদী হন তবে আপনার যুক্তি আনুন’ – এটি পালন করছেন তা ঠিক নয়। তার প্রকল্প হল ইসলামের ধর্মতাত্ত্বিক স্থাপত্যকে বিশ্লেষণ করা যাতে দুই চূড়া – কোরান এবং নবী – একই সাথে ভেঙে পড়ে। তার মডেল হলেন সপ্তদশ শতাব্দীর ইহুদি দার্শনিক স্পিনোজা, যিনি একইভাবে ওল্ড টেস্টামেন্টকে উন্মোচন করেছিলেন এবং ফলস্বরূপ, আমস্টারডাম সিনাগগের প্রবীণরা তাকে বহিষ্কার করেছিলেন। যখন আমি শাইখকে জানাই যে (ক) ইহুদি পণ্ডিতদের বারবার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, বহিষ্কার এখনও প্রত্যাহার করা হয়নি এবং (খ) ইসলামে কোন বহিষ্কার নেই, শুধুমাত্র জল্লাদের তরবারি, তখন তার প্রতিক্রিয়ায় তিনি গভীর গলায় হাসলেন। তার গ্রন্থে তিনি যুক্তি দেন যে প্রাচীন সেমেটিক প্রত্যাদেশ সমাধান করার চেয়ে আরও বেশি সমস্যা তৈরি করে।
তিনি ‘প্রত্যাদেশকে এমন একটি উপকরণ হিসেবে দেখেন যা একজন মানুষকে (প্রত্যাদেশবাদী) ঐশ্বরিক করে তোলে, কিন্তু তাতে ঈশ্বরের মর্যাদা হ্রাস হয়। কারণ ঈশ্বর তাঁর ইচ্ছা বাস্তবায়নের জন্য উদ্ঘাটনবাদী, অর্থাৎ নবীর উপর নির্ভরশীল হন।’। একজন পরম সত্তা হিসাবে আল্লাহ মুহাম্মদের রাজনৈতিক ও বস্তুগত চাহিদাগুলি খুব সহজে গ্রহণ করেন। শাইখ তা দেখানোর জন্য কোরান থেকে অধ্যায়, আয়াত এবং নবীর হাদিস উদ্ধৃত করেন। তার দৃষ্টিতে ইসলামের কেন্দ্রবিন্দুতে আল্লাহ নন, নবী অবস্থান করছেন। এক হাজার বছর আগে ইবনে রাওয়ান্দি এবং মুতাজিলাগন এই বিতর্ক শুরু করেছিলেন। এই ধরনের ধারণার কুলুজি সম্পর্কে অজ্ঞতার উন্মোচনে শাইখ নিজেকে একজন অগ্রদূত হিসেবে দেখেন- ‘আমার যুক্তিগুলি মৌলবাদের হৃদপিন্ডের দিকে নিশান করা একটি ছুরির মত।’
শাইখকে পক্ষপরিবর্তনকারী, নাস্তিক ও কাফের ঘোষণা করার পর বিশ্ব মুসলিম ঐক্যের সভাপতি মুফতি মোহাম্মদ সাঈদ আহমাদ সাঈদ বললেন:
আনোয়ার শাইখ দাবি করেছেন যে তিনি আল্লাহ্ বিশ্বাস করেন, কিন্তু নবীকে নন। এটা এমন বলা হলো যে, আমি আমার মাকে স্বীকার করি, কিন্তু আমার বাবাকে না। এই ধরনের ব্যক্তি সাধারণত একজন জারজ হিসাবে পরিচিত হয়।
আল্লাহকে মা হিসেবে আর নবীকে বাবা হিসেবে আখ্যায়িত করা? এই ধরণের আখ্যায়ন, শাইখের বিশ্বাস ‘ইসলাম একটি অগোছালো ধর্ম’, এই ধারণা আরো শক্তিশালী করে তোলে।
তাহলে আনোয়ার শাইখ কে? কার্ডিফে তার সাথে দেখা করতে গিয়ে আমার কি অভিজ্ঞতা হবে তা আমি জানতাম না । সে কি দাড়িওয়ালা মোল্লাদের প্রতিবিম্ব হতে পারে যাদেরকে সে এত নির্দয়ভাবে যন্ত্রণা দেয়? কিন্তু তার পরিবর্তে আমি একজন নিরুদ্বেগ বৃদ্ধ পাঞ্জাবি ব্যক্তিকে আবিষ্কার করলাম। তিনি তার ডোবারম্যান পিন্সার কুকুরের সাথে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। তার বিশাল, সুন্দর বাগান নিয়ে তিনি একজন গর্বিত মানুষ। বাড়িতে তৈরি পানীয় পরিবেশন করলেন। তা তেমন সুস্বাদু লাগেনি। কার্ডিফ আঙ্গুরে তো লিখিত শব্দের শক্তি নেই। দুপুরের খাবারের পর আমরা তার উত্থানের গল্প শুরু করলাম।
‘এ সবের শুরু কীভাবে?’
আমার জানা উচিত ছিল। শাইখ একজন গোঁড়া সুন্নি মুসলিম হিসেবে লালিত-পালিত হয়েছিলেন। তিনি ১৯২৮ সালে ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের গুজরাট থেকে চার মাইল দূরে একটি ছোট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মের দিনটি ছিল হজ্জ্বের দিন। তিনি জানান, ‘আমি খতনাকৃত হিসাবেই জন্মগ্রহণ করেছি, যা আমার পরিবার শুভ বলে মনে করেছিল’ এবং তাই তার নাম রাখা হয়েছিল হাজি মোহাম্মদ। পরে তা পরিবর্তন করে মোহাম্মদ আনোয়ার শাইখ রাখা হয়। খুব অল্প বয়সে তিনি কোরান তেলাওয়াত করতে শিখেছিলেন। কিন্তু ইতিমধ্যেই আরবি ভাষা শিখে ফেলায় তিনি তেলাওয়াতের অর্থ বুঝতে পারেন। তাই কোরান শিক্ষায় সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতীয় মুসলমানদের থেকে তিনি ভিন্ন ছিলেন।
১৯৪৭ সালে, স্বাধীনতা এবং দেশভাগের বছর, উনিশ বছর বয়সী আনোয়ার শেখ লাহোর রেলওয়ে স্টেশনে অ্যাকাউন্টস কেরানি হিসাবে কাজ করছিলেন। তিনি একজন কট্টর মুসলিম ছিলেন। দুটি ভারতীয় প্রদেশের একটি (অন্যটি ছিল বাংলা) পাঞ্জাবে সংঘটিত স্বীকারোক্তিমূলক হত্যাকান্ডের সময়ে তিনিও ক্ষুব্ধ ছিলেন, যা ধর্মীয় ভিত্তিতে বিভক্ত হয়েছিল। বহু শতাব্দী ধরে বসবাসরত পশ্চিম পাঞ্জাবের অমুসলিম সংখ্যালঘুরা এবং পূর্ব পাঞ্জাবের মুসলমানরা গ্রাম ও শহর ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল। প্রতিটি সম্প্রদায়ের রক্তচক্ষুর গল্প, হত্যা, ফাঁসি, ধর্ষণ, ঘরবাড়ি লুটপাট এবং অবশ্যই তাদের বীরত্বপূর্ণ শাহাদতের একটি নিজস্ব সংস্করণ ছিল। অনিশ্চিত পরিস্থিতির কারণ হিসাবে ধর্মীয় বিভাজন আনোয়ার শাইখের মনোযোগ বাড়িয়ে তুলেছিল। পঞ্চাশ বছর পরেও তিনি ১৯৪৭ সালের গ্রীষ্মে দেখা একটি স্পষ্ট স্মৃতি ধরে রেখেছেন। কথা বলতে বলতে তাঁর চোখ আর্দ্র হয়ে ওঠে:
‘ভারত থেকে প্রতিদিন লাহোর স্টেশনে ট্রেন আসছে। প্ল্যাটফর্মে ট্রেনের জন্য অপেক্ষারত লোকজনের চিৎকার শুনতে পেতাম। তাদের হৃদয় বিদারক চিৎকার শুনে আমি তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে স্টেশনে লাশে ভরা ট্রেন দেখতে পেতাম। সকল মুসলিম উদ্বাস্তুদের হত্যা করা হয়েছিল। তবে এটি অবশ্যই একটি দ্বিমুখী ট্রাফিক ছিল। আমাদের দিক থেকে পালিয়ে যাওয়া শিখ ও হিন্দুদেরও নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল।’
সেই সময়, উনিশ বছরের ছেলেটি কেবল তার দিক থেকে ঘটনাগুলি দেখতে পেতেন। ক্রোধান্বিত, এবং তার সহকর্মী মুসলমানদের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার আকাঙ্ক্ষায় আচ্ছন্ন হয়ে তিনি লাহোরের রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন এবং তিনজন নিরীহ শিখকে হত্যা করেন। প্রথম দুইজনকে লাহোরের মধ্যযুগীয় শপিং সেন্টার আনারকলি বাজারের কাছে মুগুর দিয়ে মারধর করে হত্যা করেন। তৃতীয় শিকারকে তিনি নদীর কাছে রাভি রোডে কোদাল দিয়ে নির্দয়ভাবে হত্যা করেন। এরপর কয়েকদিন তিনি বিভোর হয়ে ঘুরে বেড়ান। তিনি কি ধরা পড়ে শাস্তি পাওয়ার জন্য ভীত ছিলেন ?
‘না, ভীত হইনি। জানেন, ১৯৪৭ সালে এক ধরণের উন্মাদনা আমাদের গ্রাস করেছিল। আমি সেই উন্মাদনার একটি অংশ ছিলাম। প্রতিশোধ নেয়ার জন্য আমি তাদের হত্যা করেছিলাম। হত্যা করার সময় ধরা পড়ে খুন হওয়ার ভয় পাইনি। আমি জানতাম ইসলামিক জান্নাতের সত্তর জন হুর আমার জন্য অপেক্ষা করছে। উন্নত স্তনের সত্তর জন কুমারী হুরদের জন্য আল্লাহ আমাকে চুরাশি বছরের যথেষ্ট পূরুষত্ব দান করবেন। একজন যুবকের এর চাইতে বেশি আর কী চাই? সুতরাং আপনি বুঝতে পাচ্ছেন, আমি কেবল নির্ভীকই ছিলাম না, স্বর্গে বিরামহীন যৌনতার জন্যও উন্মুখ ছিলাম। আপনি আমাকে বিশ্বাস করছেন না? আমাকে বিশ্বাস করুন. আমি তো তখন তাই বিশ্বাস করেছিলাম। আমি তখন একজন আকর্ষণীয় তরুণ ছিলাম।’
তিনি কি সত্যিই সেই সময়ে এরকম বিশ্বাস করতে পেরেছিলেন? এটি তার পরবর্তীতে তৈরি একটি যৌক্তিকতা হতে পারে। প্রতিশোধ, পাগলামি, ধর্ম হলে মানতে পারতাম। কিন্তু তা সত্তর জন কুমারীর হাতছানি হতে পারে না। তার বয়স তখন মাত্র উনিশ। একজন যুবকের সেই বয়সে আরও রোমান্টিক স্বপ্ন থাকে, সাধারণত এক বা দুইজনকে কেন্দ্র করে। বৃদ্ধ পুরুষদের জন্য সত্তরজন কুমারীর সাথে আঠাশ বছরকাল উত্থিত ক্ষমতা একটি আকর্ষণ হতে পারে। হয়তো সেদিনই আমার সাথে কথা বলার সময় শাইখের মনে এই যুক্তি তৈরী হয়েছিল। সম্ভবত।
অস্থিরতার অবসান ঘটিয়ে নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তান বাস্তবতা পায়। এরপর জীবন আবার স্থির হয়ে যায়। তখনই আনোয়ার শেখ তার অপরাধের ভয়াবহতা অনুভব করতে পারেন। তিনি জানতেন যে কখনই এই অপরাধের জন্য তাকে শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে না। তাই তিনি নিজেকে শাস্তি দিতে শুরু করলেন। যন্ত্রণা আর আফসোসে তার আত্মা ক্ষতবিক্ষত হতে লাগলো। তিনি তখনও বিশ্বাসী থাকলেও সংশয়বাদে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তার পক্ষে পাকিস্তানে বসবাস করা সম্ভব হচ্ছিল না। সেই সময় কাজের সন্ধানে অন্যান্য দেশে সফর করা সহজ ছিল। কমনওয়েলথ এর অন্তর্ভুক্ত দেশগুলির মধ্যে কোন অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ ছিল না এবং কোন ভিসার প্রয়োজনীয়তা ছিল না। তিনি পঁচিশ পাউন্ড পকেটে নিয়ে ১৯৫৬ সালে কার্ডিফে আসেন। একজন শ্রমিক হিসাবে কাজ শুরু করেন। পরবর্তীতে তিন বছর বাস কন্ডাক্টর হিসাবে কাজ করেন। সর্বদা আত্ম-উন্নতির সন্ধানে থাকা ব্যক্তি হিসাবে তিনি লন্ডনের ইনস্টিটিউট অফ ট্রান্সপোর্টে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন।
তিনি একজন ওয়েলশ নারীকে বিয়ে করে একটি নতুন জীবন গড়তে শুরু করেন। এবং কয়েক বছরের মধ্যে – ষাটের দশকের মাঝামাঝি – তিনি তার সঞ্চয় বিনিয়োগ করে অত্যন্ত সফল একজন প্রোপার্টি ডেভেলপার হয়ে ওঠেন। এটি একটি সাফল্যের গল্প ছিল।
তার তখন সবকিছু ছিল। একটি সহজ জীবন, একটি পরিবার, এবং অনেক বন্ধু। তিনি নিরুদ্বেগ হয়ে পৃথিবী ভ্রমণ করতে পারতেন। কিন্তু অতীত তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছিল। মানসিক বিপর্যয় গভীর পর্যায়ে গিয়েছিল। তিনি এখনও ১৯৪৭ সালের ভয়াবহ গ্রীষ্মের কথা ভুলতে পারেননা। সেই তখন লাশগুলো গ্রামাঞ্চলে আবর্জনায় পরিণত হয়েছিল। এবং লাহোরের পুরানো শহরের রাস্তায় রক্ত বয়ে যাচ্ছিল। তিনি চেষ্টা করেও তার স্মৃতির ভাণ্ডারকে সীলমোহর করতে পারেননি।
‘অদ্যাবধি আমি ভাবতে থাকি যে তিনটি নিরীহ জীবনকে আমি ধ্বংস করেছি। যদি আমি তাদের হত্যা না করতাম তাহলে ওরা হয়তো বেঁচে থাকতো। এমনকি তারা কারা ছিল তাও আমি জানি না। আর ভাবতে শুরু করলাম ধর্মের কারণে এই সব কিছু ঘটেছে। আমি কোরান পড়া ছেড়ে দিইনি। এরপর আরো সজাগ দৃষ্টিতে পড়তে থাকলাম। আগে শত শত বার পড়া বিষয়টি আবার একদিন পড়ছিলাম: “হে মুমিনগণ, নবীর সামনে হাঁটবেন না। তাঁর চাইতে নিজ কণ্ঠস্বর উপরে তুলবেন না।” এইবার নিজের মধ্যে প্রশ্ন তৈরী হলো। কেন? আল্লাহ কেন একজন মানুষকে অন্যের উপরে উন্নীত করবেন? একবার আপনার মধ্যে প্রশ্ন তৈরী হলে আর কখনই প্রশ্ন করা থেকে নিজেকে থামাতে পারবেন না। সেই যাদুমন্ত্র কেটে গিয়েছিল।’
কার্ডিফের লাইব্রেরিগুলিতে আনোয়ার শাইখ এক পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন। তিনি স্পিনোজা, ফ্রয়েড এবং মার্কস পড়েছিলেন। তিনি লেখাগুলির সবকিছুর সাথে একমত না হলেও তাদের এবং অন্যদের লেখা তার বুদ্ধিবৃত্তিক সীমানাকে প্রসারিত করেছিল।
তারপর তিনি পুনরায় কোরান পাঠ করেন। তবে তিনি শুধু কোরান পাঠে সীমিত ছিলেন না। তার জীবনের এই অংশটি বর্ণনা করার সময় তিনি আমাকে হাত দিয়ে ধরে আবার বাগানে নিয়ে গেলেন। সেখানে দূরে আড়ালে আরবি, উর্দু এবং ইংরেজি বই ভর্তি একটি ছোট ঘর ছিল। এগুলি ছিল হাদিস, বা ঐতিহ্য যেমন তারা পরিচিত: নবীর কথা ও কাজের বিবরণ, যা মুসলমানরা কোরানের পরিপূরক এবং তাদের নিজস্ব আচরণের জন্য নির্দেশিকা খুঁজে পেতে পাঠ করে।
‘আমি এই সব বই পড়েছি। উন্মাদ মৌলবাদীদের চেয়ে আমি আমাদের ধর্ম এবং এর ঐতিহ্য সম্পর্কে বেশি জানি। এজন্য তারা আমাকে উত্তর দিতে পারে না। আমি এখন তাদের চ্যালেঞ্জ করছি। তারা যেখানেই চাইবে সেখানেই আমি তাদের সঙ্গে বিতর্ক করব। শতভাগ মুসলিম দর্শকদের সামনে এটা করা যাক। আমি তাতে রাজী। আসুন রেডিও বা টেলিভিশনে করি। কিন্তু তারা করবে না। কেন?’
আমার মতে, সম্ভবত, তারা শাইখকে কোনো প্রচার দিতে চায় না।
‘কিন্তু মোল্লারা ইতিমধ্যেই সব ব্রিটিশ মসজিদে জুমার নামাজে আমার বিরুদ্ধে ফতোয়া দিয়েছে। সুতরাং, বিশ্বাসীরা ইতিমধ্যে আমার অস্তিত্ব সম্পর্কে জানেন। না, তারা আমার সাথে বিতর্ক করতে চান না, কারণ তারা নিজেদেরকে দুর্বল একটি ভিত্তির ওপর তৈরী করেছেন।’
শাইখের শত্রুতা সেই মোল্লা এবং রাজনীতিবিদদের দিকে পরিচালিত হয় যারা নিজেদের স্বার্থে ইসলামকে ব্যবহার করে। ইসলামী সংস্কৃতির কিছু ধর্মনিরপেক্ষ ঐতিহ্য সম্পর্কে তিনি অবগত। তিনি এব্যাপারেও খুব সচেতন যে কট্টর খ্রিস্টান এবং হিন্দু মৌলবাদ, সার্ব এবং ক্রোয়েট ধর্মান্ধরা তার বইগুলি তাদের নিজেদের ঘৃণ্য বিদ্বেষের কাজে ব্যবহার করতে পারে।
শাইখের শত্রুতা সেই মোল্লা এবং রাজনীতিবিদদের দিকে পরিচালিত হয় যারা নিজেদের স্বার্থে ইসলামকে ব্যবহার করে। ইসলামী সংস্কৃতির কিছু ধর্মনিরপেক্ষ ঐতিহ্য সম্পর্কে তিনি অবগত। তিনি এব্যাপারেও খুব সচেতন যে কট্টর খ্রিস্টান এবং হিন্দু মৌলবাদ, সার্ব এবং ক্রোয়েট ধর্মান্ধরা তার বইগুলি তাদের নিজেদের ঘৃণ্য বিদ্বেষের কাজে ব্যবহার করতে পারে। তিনি সবকিছুই জানেন। কিন্তু তিনি আর চুপ থাকতে রাজি নন।
‘অনেকদিন ধরে আমরা মুসলিমরা নিজেদেরকে অজ্ঞতার আবরণে ঢেকে রেখেছি। কয়েক শতাব্দী ধরে আমরা এর মধ্যে বন্দী আছি। কামাল আতাতুর্ক তুরস্ককে আধুনিকীকরণ করার সময় এই ব্যাপারটি বুঝতে পেরেছিলেন। কিন্তু আমাদের সংস্কৃতিকে ধর্মনিরপেক্ষ করতে কোন আদর্শিক ভিত্তি ব্যবহার করেননি। আমি সেই কাজটি করতে চাই। আমি শুধু আজকের জন্য নয়, আগামীকালের জন্য লিখি। আমি ১৯৪৭ সালে যা করেছি তা আমাদের সন্তানরা কখনো করুক, তা চাই না।’
তিনি প্রধানত পাঞ্জাব থেকে নিয়মিত হুমকিমূলক ফোন পান। এই সব হুমকিতে সতর্ক করা হয় যে ঐতিহ্যগত ইসলামিক শাস্তি তার জন্য আসন্ন। তিনি কি ভয় পান না?
‘আমার বয়স এখন আটষট্টি। আমার হার্ট সার্জারি এবং সাতটি বাইপাস হয়েছে। আমার জীবনের কাজ এখন শেষ। যাই ঘটুক না কেন আমি সম্মানের সাথে মরব। আমার সর্বশেষ বই দুটি ব্যাংক ভল্টে জমা করা হয়েছে। সেটা প্রকাশিত হলে খুশি হব।’
একটি নতুন বই?
শাইখ হাসলেন। ‘এই বইয়ের নাম ইসলাম ও যৌনতা । আমি মনে করি ইসলাম বিশ্বের সবচেয়ে যৌন-আবেদিত ধর্ম।’
পাণ্ডুলিপির ৪র্থ অধ্যায়ের শিরোনাম ‘দ্য সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন অব দ্য প্রফেট’। শায়খ লিখেছেন:
যেহেতু আমার উদ্দেশ্য গঠনমূলক এবং সংস্কারমূলক, তাই আমি পরচর্চা বা ঔদ্ধত্যের আশ্রয় নেব না; আমার বর্ণনা হাদিস, কোরান এবং মুসলিম পণ্ডিতদের কর্তৃত্বের উপর ভিত্তি করে করা হবে।
সেখানে হাদিস থেকে মোটামুটি সুস্পষ্ট এবং স্পষ্ট উদ্ধৃতি অনুসরণ করে নবীর পুরুষত্ব এবং তার যৌন অভ্যাস নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। কোনো উপাদানই একেবারে নতুন নয়, কিন্তু ইসলামের ভেতর থেকে আবির্ভূত কোনো ব্যক্তি এই প্রথমবার এই পদ্ধতিতে এগুলি একত্রিত করেছেন। আর এটাই শাইখকে একটি বিপজ্জনক কথোপকথনে পরিণত করেছে। এমনকি ১১ই সেপ্টেম্বরের পরে, কোনও পশ্চিমা প্রকাশক ইসলাম এবং যৌনতাকে স্পর্শ করবে কিনা তাতে আমার সন্দেহ আছে। কিন্তু শাইখ উদ্বিগ্ন নন। তার নিজস্ব প্রকাশনা সংস্থা আছে। তিনি প্রকাশ করবেন এবং তাকে অভিশাপ দিতে দেবেন। শুরুতে তিনি সেই সাঁতারুর মতো ছিলেন যে একটি স্ফীত নদীতে ডুবে যায়, এবং অন্য তীরে পৌঁছাবে কিনা তার নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু এখন তিনি তীরে পৌঁছাতে নিশ্চিত, এবং শান্তিতে আছেন।
‘এখন যাই ঘটুক না কেন আমি আমার মানবতাবাদী এবং যুক্তিবাদী বিশ্বাসে আত্মবিশ্বাসী হয়ে মরব। যদি আমার লেখাগুলি অন্তত কয়েক ডজন মানুষকে ধর্মীয় ঘৃণা ও ধর্মান্ধতা থেকে দূরে সরিয়ে দেয় তবে আমি মনে করি আমি নিজেকে আংশিকভাবে উদ্ধার করব। যদিও কিছুই, কিছুই আমার হাতে নিহত তিন ব্যক্তিকে জীবিত করতে পারবে না। আমি নিজের জন্য চিন্তা করি না। আমি অন্যদের জন্য চিন্তা করি। দেখুন আমরা খালি হাতে একে অপরের সাথে কী করেছি। পারমাণবিক অস্ত্র দিয়ে তারা ধর্মের নামে সবকিছু ধ্বংস করতে পারে। তারা করতে পারে, আপনি জানেন. তারা পারে. . .’
ফাতেমা বেগম: লেখক শিক্ষক অনুবাদক। ই-মেইল: fatemaorama@gmail.com
