বাংলাদেশে অসহিষ্ণুতার বিস্তার এবংধর্মীয়সম্প্রীতির প্রশ্ন

বাংলাদেশে অসহিষ্ণুতার বিস্তার এবং ধর্মীয় সম্প্রীতির প্রশ্ন

কাজী জাবের আহমেদ আল জাহাঙ্গীর

সর্বজনকথার আয়োজনে ‘স্বৈরতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রের পথ: বৈষম্যহীন বাংলাদেশের সন্ধানে’ শিরোনামে দিনব্যাপী সেমিনারে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বৈষম্য, কৃষকের ন্যায্যমূল্য ও খাদ্যপণ্যের সিন্ডিকেট, পাঁচ দশকে শিল্পায়নের সমস্যা, বৈষম্য নিরসনে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের ভূমিকা, উচ্চশিক্ষার সংকট, জনস্বাস্থ্যের সংকট, লিঙ্গীয় বৈষম্যের নানান রূপ, জাতিগত সংকট নিরসনে করণীয় এবং বাংলাদেশে ধর্মীয় সম্প্রীতির পথে বাধা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এর বেশ কয়টি বক্তৃতা গত দুই সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। এই সংখ্যায় প্রকাশিত হচ্ছে একজন সুফিসাধকের বক্তব্য। ইসলামী সাধক চিন্তাবিদ কাজী জাবের আহমেদ আল জাহাঙ্গীর এর এই বক্তৃতা অনুলিখন করেছেন নিশাত তাসনিম। 

আমরা বর্তমান সমাজের অধিকাংশ মানুষ ইসলাম থেকে সরে গিয়েছি। আমরা বলি আমরা মুসলমান। কিন্তু মুসলমান আসলে কী সেটাই জানে না। এখন এই মুসলমান হয়ে গেছে অনেক প্রকার। এই মুসলমানের ধর্মও অনেকপ্রকার হয়ে গেছে। যেরকম ইসলাম এখন রাজনৈতিক ইসলাম আছে, ইসলাম এখন সৈনিক ইসলাম আছে, লেবাসি ইসলাম আছে, আবার ইসলাম প্রেমেরও – এই প্রেমের ইসলাম অনেক আদি থেকেই। এখন দেখেন যারা নাকি ইসলামকে শুধু লেবাস মনে করে, পোশাক মনে করে, পোশাকের মধ্যে আবদ্ধ। প্রথম তার চিন্তা হইল, আমাকে সে অ্যাটাক করবে কী দিয়ে? আমাকে আটকাবে কী দিয়ে? তখন দেখে – আপনার চুল এত লম্বা কেন? আপনার দাড়ি এত লম্বা কিন্তু আপনার মোচ এত লম্বা কেন? মোচ কাটেন না কেন? মোচ ডুবিয়ে পানি খেলে তো হারাম হয়। আল্লাহপাক নিষেধ করেছেন। এখানে আল্লাহ দাড়ি মোচ চুলের বিবেচনায় বিচার করবে এরকম একটা চিন্তা। চুল আমার, দাড়ি আমার, মোচ আমার – আপনি ডিসিশন দিচ্ছেন কতটুকু রাখবেন, কেমনে রাখবেন – কি আশ্চর্যের বিষয়!

লেবাস বদলালেই, পোশাক বদলালেই চরিত্র – স্বভাব বদলায় না। সাদা পাঞ্জাবী পড়লেই কী মন সাদা হয়? সাদা পাঞ্জাবী পড়লেই, সাদা টুপি পড়লেই কি মন একদম পবিত্র হয়ে গেল? কখনোই না। পোশাক পাল্টিয়েছে, স্বভাব পাল্টায় নাই। নারীরা হাতমোজা, পা-মোজা, বোরকা পড়লেন – পর্দা হয়ে গেল? হাতমোজা, পা-মোজা বোরকা এটা কখনোই পর্দা নয়। কারণ এটা হল পোশাক। পোশাক আপনি শালীনতার জন্য পড়বেন। পর্দার মূল বিষয় হচ্ছে তাকওয়া। গুনাহ করতে, অপরাধ করতে ভয় পাওয়া। আপনি যখনি অপরাধ করতে যাবেন তখনি যেন আল্লাহর ভয় আপনার হৃদয়ে ভেসে ওঠে, আপনার হৃদয় জাগ্রত হয় যে, হায় হায় এই অপরাধটা করছি! আল্লাহ তো আমাকে ক্ষমা করবে না, রসুল তো আমাকে ক্ষমা করবে না। এই তাকওয়াটা আপনার থাকতে হবে।  

বাংলাদেশে অনেক ভাস্কর্য মূর্তি ভাঙ্গা হল। কেন- শিরক হয়? তো, সবই তো ভাঙলেন – বাংলাদেশ কি শিরকমুক্ত হয়েছে? মূর্তির সাথে শিরক থাকে না তো। শিরক থাকে যখন মানুষের অন্তরে, কলবে, মনে খান্নাসরূপী শয়তান থাকে। মানে কামনা বাসনা অবস্থান করে যতক্ষণ মানুষের প্রাণের সাথে, নফসের সাথে, তখনই সে শিরকে ডুবে থাকে। এই শিরক থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য রাব্বুল আলামিন বললেন যে তোমরা তোমাদের অন্তর থেকে খান্নাসরূপী শয়তানকে তাড়িয়ে দাও, তোমরা শিরকমুক্ত। আর নইলে তোমরা শিরকে ডুবে আছ। আল্লাহ বলেছেন, লা ইকরাহা ফিদ দ্বীন – স্বভাবের উপরে কোন বলপ্রয়োগ চলবে না। লাকুম দ্বীন – তোমার স্বভাব, তোমাদের স্বভাব, উকুম ওয়ালইয়া দ্বীন – তোমাদের স্বভাব তোমাদের কাছে, আমাদের স্বভাব আমাদের কাছে। লা ইকরাহা ফিদ দ্বীন – ধর্মের মধ্যে দ্বীনের স্বভাবের উপরে কোনপ্রকার বলপ্রয়োগ চলবে না।

এখন ঢোল বাজালে আরেকজনে বলে যে আমরা এখন নামাজ পড়ব, ঢোল বাজানো যাবে না আপনার মন্দিরে। তো, এখন যদি প্রশ্ন করা হয় যে উনার মন্দিরে উনি ইবাদত করছে ঢোল বাজিয়ে, আপনার মসজিদে আপনি মাইক চালিয়ে ওয়াজ করছেন, সূরা কেরাত পড়ছেন। যে নিরপেক্ষতা ইসলামের মূল মানদণ্ড – সেই খানে আপনি কি বল প্রয়োগ করলেন না তার উপরে? যে আমি যখন নামাজ পড়ব তুমি তখন ঢোল বাজাতে পারবা না। আর ঢোলওয়ালা যদি বলে যে আমি যখন ঢোল বাজাবে তখন তুমি মাইক বাজাতে পারবা না – এটিই তো বলপ্রয়োগ।

আপনি দেখেন একটা অলির দরবারে যখন ওরশ হয় নারী পুরুষ পাশাপাশি বসে থাকে। কাওয়ালীসহ নানা সঙ্গীত হয়, শোনে। এইটা (নাকি) বিরাট বড় বেদাত, গুনাহ। অনেক বড় গুণাহ, পর্দা নাই। কিন্তু মানুষ খেয়াল করে না, হজ করতে গেলে একত্রে একসাথ কাবা ঘরকে যে তাওয়াফ করছে এবং হাজরে আসওয়াদকে চুম্বন করার জন্য হুড়োহুড়ি করছে। মৌলবী সাব ওখানে তো ফতোয়া উঠান না এই জায়গায় নারী পুরুষ একসাথে, পর্দা নাই। এইখানে নারী পুরুষ আলাদা করেন না। খালি পীরের দরবারেই পর্দা নাই চোখে দেখেন তাই না?

যে কাবা ঘরের ভেতরে নারী পুরুষ বাড়ি থেকে এত সুন্দর হিজাব বোরকা, কাপড় পড়ে গেছে, ছেলেরা পাঞ্জাবী টুপি পায়জামা পড়ে গেছে – ওখানে যাওয়ার পরে বলে সব খোলেন। যান এহরামের কাপড় পড়ে আসেন। এহরামের কাপড় সেলাই ছাড়া। সেলাই থাকলে এহরামের কাপড় হবে না। দুই টুকরা ছেলেরা একটা উপরে আরেকটা নিচে গায়ে বাঁধে। মেয়েরা তিন টুকরা, সেলাই নাই। সারা বিশ্বের সকল দেশের মুসলমানরা ওইখানে যেয়ে হজ করছে – ওইটা নিয়ে কোন কিছু দেখে না।

আমাদের সমাজের ভেতরে পরমত সহিষ্ণুতার স্থানটা নাই। অন্যের মতটাই সহ্য করতে পারে না। কিন্তু কোরআন কী বলেছে? রসূলের কাছে যেই আসছে – ইহুদী আসলেও ইহুদীর কথাটাও রসূল মন দিয়ে শুনেছেন এবং তাকে উত্তর দিয়েছেন। এই পরমত সহিষ্ণুতা এখন নাই। আমার মতের বিরুদ্ধে একটা কথা হলেই বলে তুই তো কাফের হয়ে গেছিস, মুরতাদ হয়ে গেছিস, তোর আর বেঁচে থাকার অধিকারই নাই। তো, আমার যদি বেঁচে থাকার অধিকার না থাকে তাহলে আল্লাহ আমাকে মারে না কেন? আপনারা পিটিয়ে মারেন কেন? আপনাদের এই অধিকার কে দিল যে ‘ওর বেঁচে থাকার অধিকার নাই, ওকে পিটিয়ে মেরে ফেল?’ আপনারা মারবেন কেন? আল্লাহ আমার অক্সিজেনটা বন্ধ করে দিলেই তো হয়। বাতাস নিচ্ছি, ছাড়ছি। ছাড়তে না পারলেও মরে যাবে, নিতে না পারলেও মরে যাব। তো, এই ছোট একটা কাজ আল্লাহ করে দিলেই হয়। না। তারা দলটল জোগাড় করে, মসজিদের মাইকে অ্যানাউন্স করে এসে পড়ল আমার বাড়িতে।

আমাদের সমাজের ভেতরে পরমত সহিষ্ণুতার স্থানটা নাই। অন্যের মতটাই সহ্য করতে পারে না। কিন্তু কোরআন কী বলেছে? রসূলের কাছে যেই আসছে – ইহুদী আসলেও ইহুদীর কথাটাও রসূল মন দিয়ে শুনেছেন এবং তাকে উত্তর দিয়েছেন। এই পরমত সহিষ্ণুতা এখন নাই। আমার মতের বিরুদ্ধে একটা কথা হলেই বলে তুই তো কাফের হয়ে গেছিস, মুরতাদ হয়ে গেছিস, তোর আর বেঁচে থাকার অধিকারই নাই। তো, আমার যদি বেঁচে থাকার অধিকার না থাকে তাহলে আল্লাহ আমাকে মারে না কেন?

তারা কী করল? সূফীদের দরবারে গিয়ে পাগড়ী, পাঞ্জাবী টুপি পরা অবস্থায় প্রথমেই থাবা দিয়ে ধরল ডেকচিটা। ডেকচিটা নিয়ে তিন মৌলবীসাবে দৌড়। তারপরে আমার বাড়ি থেকে নিল তিনটা মোরগ, মোরগ নিয়ে দৌড়। তো, ডেকচি চুরি কি ধর্ম? ইসলাম? মোরগ চুরি করল। খাসি, ছাগল এগুলো পীরের দরবারে বেঁধে রেখেছে – নিয়ে দৌড়। দেখেন – ওই ফুটেজগুলো দেখেন। কী ড্রেস, কী তাদের লেবাস, আর কী তাদের চেহারা! মাশাল্লাহ! গরু নিয়া দৌড়, দুম্বা নিয়া দৌড়, এই টিন, ইট, বালু সিমেন্ট, হলুদ মরিচ – আমার বাড়ি থেকে খড়িকাঠের দাও আর বটিটা পর্যন্ত ছাড়ে নাই। কিচ্ছু রাখে নাই – ফ্যান-ট্যান সব নিয়ে গেছে। এটা কি ইসলাম?

গরু নিয়া দৌড়, দুম্বা নিয়া দৌড়, এই টিন, ইট, বালু সিমেন্ট, হলুদ মরিচ – আমার বাড়ি থেকে খড়িকাঠের দাও আর বটিটা পর্যন্ত ছাড়ে নাই। কিচ্ছু রাখে নাই – ফ্যান-ট্যান সব নিয়ে গেছে। এটা কি ইসলাম?

তো, জিজ্ঞেস করেছিলাম যে এত রাতে আপনারা কেন গেলেন? বলে, দ্বীনের দাওয়াত দিতে গিয়েছি। হায় হায়! আল্লাহ বাঁচিয়েছে! দ্বীনের দাওয়াত দিতে এসেছেন? দ্বীনের দাওয়াত দিতে এসে দেখি সব নিয়ে গেছেন। আর যদি দ্বীন প্রতিষ্ঠা করতেন তাহলে তো বাড়িই তুলে নিয়ে যেতেন! এটা দ্বীন হতে পারে না। দ্বীন কী? সূফীরা কী করেছে? সূফীরা এখনো মানুষের সেবা করে। আপনি যান বাবা শাহজালালের মাজার শরীফে। বাবা শাহজালাল ওফাত হয়েছেন কিন্তু বাবা শাহজালালের মাজারকে কেন্দ্র করে আপনার লক্ষ লক্ষ টাকা, কোটি কোটি টাকা দান, দক্ষিণা, সদকা হচ্ছে। সেইখানে মানত দিচ্ছে। সেই টাকা দিয়ে হসপিটাল চলছে, এতিম বাচ্চাকাচ্চাদের খাবার-দাবার দিচ্ছে, মাদ্রাসা চলছে, মসজিদ তৈরি হচ্ছে, এইরকম জনকল্যাণে অনেক কিছু হচ্ছে। ঢাকা শহরে আপনি যান শাহ আলী বাবার মাজারে, গোলাপ শাহর মাজারে, এটা মূলত জনকল্যাণেই ব্যবহার হয়। তাহলে সূফীরা মানুষের সেবা করে। আর আমাদের এই ধর্মান্ধ যারা উগ্রবাদী, মৌলবাদী গোষ্ঠী তারা ধর্মকে ব্যবহার করে নিজেদের আখের গোছায়, পুঁজি করে।

বাংলাদেশে ঢোল বাজিয়ে গান গায় দরবারে এর জন্য মাজার ভাঙতে হবে, দরবার ভাঙতে হবে, খানকাহ ভাঙতে হবে। কিন্তু সৌদি আরবে যে নাইট ক্লাব খুলেছে, সিনেমা হল খুলেছে, বার খুলেছে – এইগুলো নিয়ে বাংলাদেশের একটা মৌলবী আজ পর্যন্ত কথা বলে নাই।

আরেকটা বিষয় দেখেন। আল্লামা ইকবালের একটা কথা মনে পড়ে। আল্লামা ইকবাল বলেছিলেন, আমি পাকিস্তান,  আরব ঘুরেছি। আমি সেখানে মুসলমান দেখেছি, ইসলাম দেখি নাই। আর আমি ইউরোপ আমেরিকায় ঘুরেছি। সেখানে ইসলাম দেখেছি, মুসলমান দেখি নাই। ইউরোপ আমেরিকার মধ্যে ইসলাম আছে, মুসলমান নাই। কারণ ওরা মানুষকে এইভাবে জোর জবরদস্তি করে মানুষের যে ব্যক্তিস্বাধীনতা সেটাকে হরণ করে না। এবং তাদের কাজ যখন বলে ১১টায় হবে তো সেটা ১১টাতেই হবে, সাড়ে ১১টায় করে না। আর আমাদের দেশে আমরা অফিসেও ঠিকমতো যাই না, অফিসের কাজও আমাদের ঠিকমতো হয় না। কিন্তু আমরা নামাজ জামাতের সাথে পড়ি। এজন্য এখন ইসলামে সাম্য আনতে গেলে কী করতে হবে? ঘুষের টাকা নিয়ে মসজিদে ঢুকবেন? নামাজ পড়বেন? পকেটে ঘুষের টাকা। ঢুকেছে মসজিদে। নামাজ পড়ে এসে আবার ঘুষ নেয়। তাহলে কী সে ধার্মিক হল? ঘুষের টাকায় কি কোরবানি দিবেন? ঘুষের টাকায় হজ করবেন? তাহলে কীভাবে মুসলমান হলেন? মুসলমান হওয়ার যে বিধিবিধান সেটাই তো আগে ভঙ্গ করে রেখে দিয়েছেন। এজন্য আমাদের কী করতে হবে? ভেতরগত পরিবর্তন করতে হবে। পোশাকের পরিবর্তন, ব্যক্তির পরিবর্তন কখনোই মূল পরিবর্তন নয়। ভেতর – মন মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। আত্মশুদ্ধি লাভ করতে হবে। ইসলামের মূল বিষয় হল আত্মশুদ্ধি।

দেখেন, নারীরাও আল্লাহর অলি হয়। মা হাজেরা আল্লাহর অলি – ইসমাইল নবীর মাতা, ইব্রাহিম নবীর স্ত্রী। তার সাথে আল্লাহ সরাসরি কথা বলেছেন। মা মরিয়ম আল্লাহর অলি। তার সাথে আল্লাহ সরাসরি কথা বলেছেন – কোরআন দলিল, বলে নাই? কিন্তু বর্তমানে সমাজের নারীদেরকে ইসলাম থেকে একদম, মানে সামাজিক যে ইসলামের ভেতরে – নারীরা মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তে পারবে না। সারামাস নারী রোজা রাখবে কিন্তু ঈদের নামাজে আপনার স্ত্রী আপনার সাথে যেতে পারবে না। অনেক ফতোয়া দিয়ে দিবে। কিন্তু এগুলো কোরআনের ভেতরে নাই। এগুলো মানুষের তৈরি।

এই সমাজে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা শুনলে মওলানা সাহেবেরা ক্ষেপে যান। ধর্মনিরপেক্ষতা কখনো ধর্মহীনতা নয়। ধর্মনিরপেক্ষতা কী? আমার নিজের ধর্মটা আমি করব, আমার পাশে অন্য ধর্মের যে আছে সে তারটা করুক। যদি আমার ক্ষমতা থাকে, আমি আমার আদর্শ দিয়ে, আমার চরিত্র দিয়ে, আমার মহানুভবতা দিয়ে, আমার মনুষ্যত্ব দিয়ে আমার পাশে অন্য ধর্মাবলম্বী যে আছে তাকে নিজের ধর্মে আনার চেষ্টা করব। এখন আমাকে দেখলেই অন্য ধর্মের মানুষ দেশ ছেড়ে চলে যেতে চায়। এটা কি ধর্ম হল? আজকে এই বাংলাদেশে, একটা শ্রেণী ধর্মকে পুঁজি করে উগ্রবাদী এবং মৌলবাদী কায়দায় সমাজে যে বিশৃঙ্খলা তৈরি করেছে তার জন্য সরকার মহোদয়কে, প্রশাসনকে সজাগ হতে হবে। এই দুই চার লক্ষ, দুইচার দশ লক্ষ মানুষ এই মৌলবাদীদের ভেতরে,  তারাই যে ইসলামটাকে ক্যারি করে, ইসলামের মূল কান্ডারী হয়ে গেছে, এজেন্ট হয়ে গেছে তা কিন্তু নয়। বৃহৎ অংশ সূফীবাদের ভেতরে বসে আছে। সূফীরা শান্তিতে বিশ্বাসী। এজন্য তারা রাস্তায় নামে না। যদি তারা রাস্তায় নামে, বাংলাদেশে তিনটা দরবারের মানুষ যদি রাস্তায় নামে, ঢাকা শহরে জায়গা হবে না। বাংলাদেশে এমন এক দরবার আছে যার বৎসরে গুরুদক্ষিণাই উঠে – আজ থেকে তাও দশ বছর আগের কথা – ২০০০ কোটি টাকা। পীরের চেহারাটা দেখে খালি গুরুদক্ষিণাই ২০০০ কোটি টাকা দেয়, তাহলে মুরীদ কতখানি হতে পারে। অন্য কোন কিছু নয়। এটাকে নাজরানা বলা হয় আরবিতে। আরেক জায়গা আছে ১০০০ কোটি টাকা উঠে এরকম। ঠিকানা দিয়ে দিলে আবার মৌলবাদীরা চলে যেতে পারে। এজন্য নাম বললাম না।

সূফীরা শান্তিতে বিশ্বাসী। এজন্য তারা রাস্তায় নামে না। যদি তারা রাস্তায় নামে, বাংলাদেশে তিনটা দরবারের মানুষ যদি রাস্তায় নামে, ঢাকা শহরে জায়গা হবে না।

আচ্ছা, একটা জিনিস বুঝতে পারি না, আরবের পোশাকটাকে বাংলাদেশে কেন জোর করে আনতে হবে? বড় পাঞ্জাবী আরবের পোশাক। এখন আমি যদি প্যান্ট শার্ট পড়ি আমি কি মুসলমান হতে পারব না? প্যান্ট শার্টের সাথে, পোশাকের সাথে কি মুসলমানের, মুসল্লির কোন সম্পর্ক আছে? মুসল্লির আটটা গুণ আছে সূরা মারীযে। সূরা মারীয হচ্ছে ৭০ নাম্বর সূরা। সেই সূরা মারীয এর ৮টা গুণের মধ্যে একটা গুণেও দাড়ি, ‍টুপির কোন সম্পর্ক নাই। সম্পর্ক হল সব মনুষ্যত্ব আর মহানুভবতার। কাজেই আপনারা আমাদের দেশের মধ্যে বড় পাঞ্জাবী এনেছেন। কিন্তু আরবের খাওয়া কি আনতে পেরেছেন? পাঞ্জাবী পরা সুন্নত। উটে চড়াও তো সুন্নত। ঘোড়ায় চড়াও তো সুন্নত। মাওলানা সাহেবেরা একজনও একটা উট কিনে চড়ে বাড়ির থেকে বায়তুল মোকাররমে এসে উটটা বেঁধে নামাজ পড়লেন না! আমাদের খালি বেদাতি বেদাতি বলে। এই যে বেদাতি বেদাতি বলেন, বেদাত যদি ধরি পুরো খুলে যাবে সব। সব বেদাত। এ টু জেড বেদাতের মধ্যে আমরা বসে আছি। সমস্ত কিছু – কারণ রাসূলের পরে, সাহাবা একরামদের পরে এই বেদাত আসছে। বেদাত দুই প্রকার। উত্তম বেদাত এবং খারাপ বেদাত। বেদাতে হাসানা,  বেদাতে ছইয়া। তো এখন, খালি বলে, এই ঢোল বাজান? এইটাতো বেদাতি! মাজার পাকা করেছেন – বেদাতি। দরবার করেছেন – বেদাতি। আচ্ছা বেদাতি বেদাতি যে করেন, আপনি কি সহি? আপনার শরীরেও বেদাত আছে। কেউ উট কিনে না। সবাই গিয়ে পালসার কিনে। পালসার মোটরসাইকেল কিনে না? মোল্লাসাব পালসার ব্যবহার করে না? বাংলাদেশে একজন মওলানা সাহেব কিংবা একজনকেও কি দেখেছেন যে উট কিনে সুন্নত আদায় করছে? উটের উপরে চড়ে আসছে যাচ্ছে? ঘোড়ার উপরে চড়ছে? গাধা, খচ্চরের উপরে উঠেছে? না। এরা কিনে মার্সিডিজ, বিএমডব্লিউ, প্রাডো – এগুলো কিনে। এক্স করোলা কিনে। তাহলে বেদাত যে বলেন, আপনারা আগে এগুলো ঠিক করেন। ভাত খান কেন? রুটি খান। খেজুর খান।

আমার দেশের একটা নিজস্ব সংস্কৃতি আছে। কালচার আছে। ঐতিহ্য আছে। আমি আমার দেশের সংস্কৃতি ব্যবহার করব। দেখেন, ভিন্নতা অনুষ্ঠানে থাকবেই। কোরআনের মূল বিষয় হল গিয়ে এবাদতের স্থানে। সালাত হল এবাদতের অংশ। সিয়াম এবাদতের অংশ। আর পোশাক হল আপনার চাহিদা অনুযায়ী আপনার অনুষ্ঠানের অংশ। পোশাক কখনো এবাদতের অংশ না। পোশাক নিয়ে ঠেলাঠেলি করে, খাবার নিয়ে ঠেলাঠেলি করে ধর্ম থেকে মানুষকে সরিয়ে দিয়েন না।

ধর্মের দোহাই দিয়ে তারা বাংলাদেশের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য – সব ধ্বংস করার চেষ্টায় লিপ্ত। বাউল গান হতে দিচ্ছে না। গত সপ্তাহেও একটা দরবার ভেঙেছে। এই গত সপ্তাহে আমার বাড়িতে হামলা হল, আমাদের উপর হামলা হল আজ পর্যন্ত পুলিশ এবং সেনাবাহিনী স্পটে যাদের অস্ত্রসহ পেল তাদের অ্যারেস্ট করল না। আজ পর্যন্ত পুলিশ একবারও এলাকায় ঘুরে দেখে নাই থানা থেকে। যা করেছে আদালত থেকে – তাও আমরা হাজির হওয়াতে। যদি আমরা হাজির না হতাম তাহলেও তো (শেষ হয়ে) গিয়েছিলাম। তাহলে অপরাধীর কি কোন শাস্তি হবে না এই দেশে? একটা জুলুম অত্যাচারের কি শাস্তি হবে না? আপনি আপনারটা নিয়ে থাকেন আমি আমারটা নিয়ে আছি। আমি তো বলি নাই আপনি এখানে আসেন। আপনার মন চাইলে আসবেন, না মন চাইলে না আসবেন। আমার মত আমি যতটুকু বুঝেছি আমি প্রকাশ করেছি। আমারটা আপনার ভাল লাগে নাই। আপনি আমাকে গ্রহণ করেন না। স্কিপ করেন। কিন্তু আপনি আমাকে হত্যা করতে আসবেন কেন? আপনি একজনের সম্পদ লুঠ করতে আসবেন কেন?

ধর্মের দোহাই দিয়ে তারা বাংলাদেশের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য – সব ধ্বংস করার চেষ্টায় লিপ্ত। বাউল গান হতে দিচ্ছে না। গত সপ্তাহেও একটা দরবার ভেঙেছে। এই গত সপ্তাহে আমার বাড়িতে হামলা হল, আমাদের উপর হামলা হল।

কাজেই আমার শেষ কথাটা হল যে, ইসলামের মধ্যেই কোনপ্রকার বলপ্রয়োগ, খুনাখুনি, মারামারি, হত্যাকাণ্ড এগুলো নাই। ইসলাম প্রেমের ধর্ম। প্রেম আছে এজন্য আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছে। পশুকেও সৃষ্টি করেছে। মানুষের মধ্যে নফস আছে, প্রাণ আছে। পশুর মধ্যেও প্রাণ আছে। কিন্তু মানুষের প্রাণের সাথে আরেকটা জিনিস মানুষকে আল্লাহ দিয়েছেন। সেটা হল ব্যক্তিস্বাধীনতা। মেরেকেটে, ভেঙ্গেচুরে, আগুন ধরিয়ে কোনদিনও কোনদেশেই ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব না। বড়জোর সম্ভব রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। মেরেকেটে, আগুন ধরিয়ে, পুড়িয়ে, খেদিয়ে, জিন্দা কবর দিয়ে রাজতন্ত্র কায়েম করা যায়, গণতন্ত্র আনা যায় না।

এখন কথা বলতে পারি না। ঘরে বসে কথা বলা লাগে। কারণ আমাদের তো দল নাই। এখানেই রাখলাম। বাহিরে কথা বললে গলায় চিমনি দিয়ে ধরে, লাঠি দিয়ে মাথায় বাড়ি দেয় আর বলে “কও শান্তির ধর্ম ইসলাম?” আরে মারতে আসছেন, চাপাতি দিয়ে আমাকে কোপাইতে আসছেন, আমার বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন পেট্রোল বোমা দিয়ে আর আপনারা বলেন শান্তির ধর্ম ইসলাম? এই শান্তি? আপনাদের কাছে তো কোনো মুসলমানই শান্তিতে নাই। সৌদির কাছে ইয়েমেন শান্তিতে নাই। এখানেই রাখলাম। আপনারা সবাই দোয়া করবেন। আসসালামু আলাইকুম।    

কাজী জাবের আহমেদ আল জাহাঙ্গীর: সুফিসাধক।  

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •