গোপালগঞ্জে সংঘটিত সহিংসতা আর প্রাণহানি: তথ্যানুসন্ধান পরবর্তী প্রতিবেদন
গত ১৬ জুলাই গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সমাবেশে হামলা ও সে ঘটনা কেন্দ্র করে গোপালগঞ্জে ৫ জনের প্রাণহানি, শিশুসহ প্রায় ৩০০ জন গ্রেফতার এবং সামাজিক একটি অবরোধমূলক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে গত ২২ জুলাই ১১ সদস্য বিশিষ্ট নাগরিকদের একটি দল একটি প্রাথমিক অনুসন্ধান ও পর্যালোচনার উদ্দেশ্যে গোপালগঞ্জ সফর করেন। এই নাগরিক দলে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সামিনা লুৎফা, মোশাহিদা সুলতানা এবং রুশাদ ফরিদী, আইনজীবী সারা হোসেন ও মানজুর আল মতিন, আলোকচিত্রী শহীদুল আলম, সাংবাদিক তাসনিম খলিল, শিল্পী বীথি ঘোষ, লেখক ফিরোজ আহমেদ এবং অধিকার কর্মী নাফিউল আলম সুপ্ত। গুরুত্ব বিবেচনা করে তাদের বক্তব্য এখানে প্রকাশ করা হলো।
আমরা মূলত নাগরিক হিসেবে গোপালগঞ্জের পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা পেতে সেদিন ওখানে গিয়েছিলাম, নানা পক্ষের ব্যক্তিবর্গ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ সংগ্রহ ছিল আমাদের অন্যতম লক্ষ্য। আমরা গোপালগঞ্জে এনসিপির সভাকে কেন্দ্র করে ঘটা হামলা, সংঘর্ষ ও গুলিতে নিহত হবার ঘটনায় অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়েই এ অনুসন্ধানে ব্রতী হয়েছিলাম। সময় স্বল্পতার কারণে সকল বক্তব্যের সত্যাসত্য চূড়ান্ত ভাবে যাচাই করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। তবে স্থানীয় বাসিন্দা এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের সাথে কথা বলে এবং ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে প্রকৃত ঘটনা সম্বন্ধে আমরা একটা প্রাথমিক ধারণা লাভ করতে সমর্থ হই। আমরা যেসব স্থান পরিদর্শন করেছি – গোপালগঞ্জ শহরের লঞ্চঘাট এলাকা, পৌরপার্কের সমাবেশস্থল, নিহত দীপ্ত সাহার গুলি খাওয়ার স্থান ও তার বাড়ি, আশেপাশের এলাকা, হামলা ও আক্রমণের রাস্তা ও লঞ্চঘাট সংলগ্ন ব্রিজ, এনসিপি নেতৃবৃন্দের আশ্রয় নেয়া সেই এসপি অফিস, স্থানীয় সেনা ক্যাম্প, এবং গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। যাদের সাথে কথা বলেছি – লঞ্চঘাট এলাকার রাস্তার হকার, রিক্সাওয়ালা, মুদি দোকান এবং অন্যান্য দোকানের কর্মচারী, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, টহলরত পুলিশ-এপিবিএন, গোলাগুলিতে আহতদের অকুস্থলের আশেপাশের দোকানের মানুষ, নিহত কয়েকজনের পরিবারের সদস্য, স্থানীয় সাংবাদিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্থানীয় নেতা ও কর্মী, বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন সাধারণ ছাত্র, সেনা কর্মকর্তা, পুলিশ সুপার, আইন ও শালিশ কেন্দ্রের পর্যবেক্ষণ দলের সদস্য এবং এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। আমরা সময়ের অভাবে হসপিটাল বা জেল কর্তৃপক্ষের সাথে দেখা করতে পারি নি। কোনো আহত ব্যাক্তির সাথেও দেখা করতে পারি নি।
আমাদের পর্যবেক্ষণসমূহকে তিন ভাগে ভাগ করছি। প্রথম ভাগে, ১৬ জুলাই এর আগে কী ঘটেছে, ২য় ভাগে ১৬ জুলাই কী ঘটেছে এবং এর পরের অবস্থা আমরা যা শুনেছি, দেখেছি এবং উপলব্ধি করেছি তা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। ৩য় ভাগে এ প্রতিবেদন শেষ করা হয়েছে আমাদের সুপারিশ হাজির করার মাধ্যমে।
১৬ জুলাই-এর আগে যা যা ঘটেছে
১. ১৬ জুলাইয়ের আগে আওয়ামী লীগ এবং এনসিপি সমর্থকদের পক্ষ থেকে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে উত্তেজনা ছড়ানোর তৎপরতা চলেছিল বলে জানা যায়। সমাবেশে অংশগ্রহণকারী কয়েকজন আমাদেরকে জানিয়েছেন যে, গোপালগঞ্জে আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দিক থেকে যেকোনো মূল্যে এনসিপির সমাবেশ প্রতিহত করা, এবং সমাবেশে আসলে এনসিপির নেতৃবৃন্দকে ফেরত যেতে দেয়া হবে না, ইত্যাদি প্ররোচনামূলক বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছড়িয়েছিল।
অন্যদিকে গোপালগঞ্জবাসীর প্রতি হুমকি ও উস্কানিমূলক বক্তব্যের নিদর্শন মেলে একাধিক ইউটিউবার কর্তৃক টুঙ্গিপাড়া বিষয়ক প্ররোচণামূলক হুমকি, এনসিপি’র একজন নেতার হাতুড়ি নিয়ে যাওয়া বিষয়ক একটি মন্তব্য, আরেকজন নেতা কর্তৃক ভেকু ভাড়া জানতে চাওয়া এবং আরও অনেকের তৎপরতায়। একই সাথে “টুঙ্গীপাড়ার কবর ভাঙার” হুমকি দেয়া হয়েছিল, এটা স্থানীয় অনেকেই উল্লেখ করেছেন।
এইসব হুমকির সাথে গোপালগঞ্জের বেশ কিছু ব্যক্তি যুক্ত করেছেন “মার্চ টু গোপালগঞ্জ” নামকরণের প্রসঙ্গটিকে, যেখানে অন্যান্য সব জেলায় এনসিপি তাদের কর্মসূচিকে “পদযাত্রা” বলে আখ্যায়িত করে। অন্যদিকে এনসিপির ছাত্র সমর্থকেরা এই নামকরণের বিশেষ কোনো তাৎপর্য আছে বলে মনে করেন না।
২. গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র যারা বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনেরও সদস্য এবং সমাবেশে অংশ নিয়েছিলেন, তারা আওয়ামী সমর্থকদের প্ররোচনামূলক হুমকির ভূমিকা বিষয়ে কথা বলেছেন এবং সেটা উত্তেজনা তৈরি করেছে বলে জানিয়েছেন। এনসিপি সংশ্লিষ্টদের বা সংশ্লিষ্ট বলে অনুমিতদের দিক থেকে প্রচারিত প্ররোচনামূলক বক্তব্য এই উত্তেজনা তৈরিতে কোন ভূমিকা রেখেছে বলে তারা মনে করেন না।
৩. রাজনৈতিক দল হিসেবে এনসিপি গোপালগঞ্জে সমাবেশ করার আগে টুঙ্গীপাড়ার মাজারের বিরুদ্ধে অন্তর্জালে ছড়িয়ে পড়া প্ররোচনামূলক বক্তব্যের সাথে তাদের দলীয় কোনো সংশ্লিষ্টতা না থাকার কথা প্রচার করার এবং এলাকাবাসীকে আশ্বস্ত করার কোন উদ্যোগ নেয়নি। সমাবেশের দিন এনসিপি নেতাদের উত্তেজক বক্তব্য পরিস্থিতিকে গুরুতর পর্যায়ে নিয়ে যায় বলে গোপালগঞ্জের কিছু মানুষ মত প্রকাশ করেন।
ঘটনার বিবরণ
৪. স্থানীয় জনসাধারণের সাক্ষ্য থেকে জানা যায় যে, কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ আসার আগেই চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ জনের একটি দল গোপালগঞ্জ শহরে সমাবেশের মঞ্চ ভাংচুর করে। এছাড়া একটি পুলিশের গাড়ি পোড়ানো ও স্থানীয় ইউএনওর গাড়ি ভাংচুর করা হয় শহরের বাইরে কোটালিপাড়ার রাস্তায়। প্রচুর ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। প্রশাসনের সূত্রে জানা যায় যে গোপালগঞ্জমুখী বিভিন্ন রাস্তা ধরে “সংগঠিত ব্যক্তিরা” গাছের গুড়ি ফেলে পথে পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছিল।
৫. স্থানীয় দোকানদার ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে জানা যায় যে, সমাবেশস্থলের আশেপাশে পুলিশ সকাল থেকেই দোকান ও প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে বারবার নির্দেশনা দিয়েছে। ফলে, সমাবেশের শুরুতে সেখানে অত্যন্ত কম সংখ্যক মানুষ উপস্থিত ছিলেন। আগে থেকেই অনেকেই সংঘাতের আশঙ্কা করছিলেন। স্থানীয় কেউ কেউ জানিয়েছেন সমাবেশ ও জাতীয় নেতৃবৃন্দকে দেখতে তারা গিয়েছিলেন, কিন্তু বেশিক্ষণ থাকেননি।
৬. হামলায় আওয়ামী লিগ সংশ্লিষ্টদের যে সচেতন ও সংগঠিত চেষ্টাও ছিল, সেটা বোঝা যায় দেশীয় অস্ত্র এবং স্থানীয় পুলিশের দাবি মোতাবেক পিস্তলধারীদের সমাবেশস্থলে হামলা করার দাবি থেকে। এছাড়াও সকালে সমাবেশ শুরু হবার আগে কেন সমাবেশস্থলের মঞ্চ ভাংচুর হলো সেটার ব্যাখ্যা খুঁজতে গেলে আওয়ামী সংশ্লিষ্টতার প্রশ্ন আসে।
৭. স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের বক্তব্য থেকে আমরা জানতে পেরেছি যে, সরকারি ভাবে সন্ত্রাস দমন আইনের অধীনে নির্দেশনা অনুযায়ী কার্যক্রম স্থগিত আওয়ামী লীগ গোপালগঞ্জে উল্লেখযোগ্য একটি সময় ধরে কোনো দলীয় কর্মসূচি পালন করতে পারেনি। এ ধারণার উপর নির্ভর করে প্রশাসন জননিরাপত্তার জন্য হুমকিকে ছোটো করে দেখেছে।
৮. বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীসহ স্থানীয়রা দাবি করেছেন যে, সমাবেশস্থল থেকে “মুজিববাদ মুর্দাবাদ” শ্লোগান স্থানীয় মানুষের মাঝে উত্তেজনা তৈরি করে। পুরো সমাবেশ মাইকে শোনা ও লাইভে দেখা স্থানীয়দের অনেকেই স্লোগানকে হুমকি হিসেবে ধরে নিয়ে সমাবেশ স্থলে চলে আসেন, এমনটা দাবি করেছেন স্থানীয় অনেকে। কয়েকজনের ভাষ্য অনুযায়ী ৫ থেকে ৭ হাজার মানুষ সেখানে জড়ো হন।
৯. পুলিশ ও প্রত্যক্ষ্যদর্শীদের সাক্ষ্যে জানা যায় যে, সমাবেশ শেষে এনসিপির জাতীয় নেতৃবৃন্দ গাড়িবহর নিয়ে যখন বের হয়ে যাচ্ছিলেন, তখন লঞ্চঘাটের কাছেই ‘উত্তেজিত জনতা’ বেপরোয়াভাবে হামলা চালায়। টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট নিঃশেষ হয়ে গেলে পুলিশকে পিছু হটতে হয়েছে বহুবার। পুলিশের বক্তব্য অনুযায়ী তাদেরকে পাশের জেলা থেকে রসদ ও বাড়তি ফোর্স সংগ্রহ করতে হয়েছে এবং সরকারি নির্দেশের বাধ্যবাধকতার কারণে তারা চাইনিজ রাইফেল বা কোন মারণাস্ত্র ব্যবহার করেননি। তারা আরো দাবি করেন যে দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। হামলার মুখে এনসিপি নেতৃবৃন্দের গাড়ি ঘুরিয়ে পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়। তখন এনসিপি নেতৃবৃন্দকে রক্ষাই পুলিশের একমাত্র বিবেচনা ছিল বলেও তারা দাবি করেন। জনতা সেখানেও তাদের ঘেরাও করে।
১০. প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে নিজেদের দাবি করা ব্যক্তিদের ভাষ্য অনুযায়ী লঞ্চঘাটে জড়ো হওয়া জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে সামরিক বাহিনী গুলিবর্ষণ করে। গুলি চলার পর উত্তেজিত ও মারমুখী জনতা ঘেরাওস্থল থেকে পিছিয়ে যায় বলে এলাকাবাসী জানান। তাদের বিবরণ অনুযায়ী, নিহতদের মধ্যে একজন, স্থানীয় ব্যবসায়ী দীপ্ত সাহা লঞ্চঘাট সংলগ্ন মিলন ফার্মেসির গলিতে অবস্থানকালে পেছন থেকে পেটে গুলিবিদ্ধ হন। তবে ময়নাতদন্ত ছাড়াই সৎকার হয়ে যাওয়ায় তার মৃত্যুর কারণ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। আমাদের দলের সংগৃহীত সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায় যে গুলিবিদ্ধ হবার সময়ে দীপ্ত নিরস্ত্র ছিলেন, গুলিবিদ্ধ হবার কিছুক্ষণ আগে আরও কিছু মানুষের সাথে তিনি শ্লোগান দিচ্ছিলেন।
নিহতদের মধ্যে ইমন নামের অপ্রাপ্তবয়স্ক আরেকজন উরুতে গুলিবিদ্ধ হন। তাকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় সেনা সদস্যদের গলায় পা দিয়ে চাপা দেয়ার যে ছবি ও ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, সেটা সত্যি হলে তা সুস্পষ্ট মানবাধিকার লঙ্ঘন। তার দেহের নিম্নভাগে গুলি লাগে এবং তার দেহ থেকে ময়নাতদন্তের সময় গুলিটি পাওয়া যায় বলে স্বজনরা দাবি করেছেন। পায়ে লাগা গুলি কী করে প্রাণ নিলো সেটা পরিষ্কার করতে আরো বিস্তৃত অনুসন্ধানের প্রয়োজন। এছাড়া রমজান কাজী দৌড়ে পড়ে যাবার পর তাকে প্রথমে মারধোর করা হয় ও পিঠে গুলি করা হয়, এমন সাক্ষ্য পাওয়া গেছে। একারণে প্রতিটি গুলিবিদ্ধ হবার ঘটনা বিশদ তদন্তের দাবি রাখে।
প্রতিটি নিহত হবার ঘটনায় অস্ত্র ব্যবহারের যৌক্তিকতা ও পরিস্থিতি বিস্তারিত যাচাই করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি বলে আমরা মনে করি এবিষয়ে স্বতন্ত্র ও নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া অত্যন্ত জরুরি।
১১. হামলাকারীদের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র থাকার ব্যাপারে প্রশাসন ও আয়োজকদের তরফ থেকে যে দাবি করা হয়েছে তার সত্যতা সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত হতে পারিনি। সাধারণ প্রত্যক্ষদর্শীদের মধ্যে যাদের সাথে আমরা কথা বলতে পেরেছি, তারা কেউ ‘জনতার’ মধ্যে থেকে আগ্নেয়াস্ত্রধারীদের গুলি করতে দেখেছেন এমন তথ্য দেননি। তবে সকলেই দেশীয় অস্ত্র, বৃষ্টির মত ঢিল এবং ককটেল বিস্ফোরণের কথা উল্লেখ করেছেন।
১২. এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ জানিয়েছেন যে, পরিস্থিতি এত গুরুতর হবে জানা থাকলে তারা সেখানে যেতেন না। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, পরিস্থিতি কতটুকু নাজুক এ বিষয়ে তাদের অবহিত করা হয়নি। তারা আশংকা করেছিলেন যে ঝামেলা হতে পারে কিন্তু তাদের নিজেদের আক্রমণ থেকে বাঁচতে নিরাপত্তার দরকার হবে এটা তারা অনুমান করতে পারেননি। তাদেরকে প্রশাসন যা করতে বলেছে তারা সে অনুযায়ী তাদের গতিপথ ও কর্মসূচি নির্ধারণ করেছেন।
ঘটনার পরে যা ঘটতে থাকলো
১৩. গোপালগঞ্জে ১৪৪ ধারা জারি করা হলো। পুলিশের দাবি অনুযায়ী প্রায় ৩০০ জন গ্রেফতার হয়েছেন। গণমাধ্যমের সূত্র অনুযায়ী প্রায় ১০ হাজারের অধিক মানুষের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়েছে, এবং গ্রেফতারকৃতদের অনেকের বিরুদ্ধে, দণ্ডবিধির অধীনে হত্যা মামলা এবং বিশেষ ক্ষমতা আইনের পাশাপাশি সন্ত্রাস দমন আইনে মামলা হয়েছে। এর জটিলতা হলো অস্ত্রধারী সংগঠিত অপরাধী আর বিক্ষোভে অংশ নেয়া ব্যক্তিরা একই ধরনের আইনী প্রক্রিয়ার মুখোমুখি হন। আওয়ামী স্বৈরশাসনের আমলে এই আইনটির ঢালাও ব্যবহার সমালোচিত হয়েছিল।
১৪. শিশু-কিশোরদের গ্রেফতার করা হয়েছে এবং তাদের বিরুদ্ধে নিপীড়নমূলক সন্ত্রাস দমন আইনে মামলা হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। ১৮ জন শিশুকে যশোরের শিশু সংশোধনাগারে পাঠানো হয়েছে। তাদের আইনজীবী বা অভিভাবকের সাথে তারা দেখা করতে পেরেছে কি না, তা আমরা নিশ্চিত হতে পারিনি।
১৫. ঘটনার দিন থেকে ১৪৪ ধারা জারি থাকলেও, আমরা যেদিন পরিদর্শনে যাই, সেদিন তা ছিল না। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু হলেও সর্বত্র যুবক-বয়সীদের উপস্থিতি কম ছিল। অনেক মানুষই গ্রেফতার ও হয়রানির আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন। ব্যবসায়ী ও শিক্ষার্থী, উভয় ধরনের তরুণরাই আতঙ্কিত বোধ করছেন বলে জানিয়েছেন।
১৬. কোনো গুলিবিদ্ধ বা অন্যভাবে আহতদের সাক্ষাতকার গ্রহণ সম্ভব হয়নি। স্থানীয় সাংবাদিকরা জানিয়েছেন যে এমন অনেকেই জেলার বাইরে অন্যত্র গোপনে চিকিৎসা নিচ্ছেন যদিও সময়ের অভাবে ময়নাতদন্ত ও হাসপাতাল সম্পর্কিত তথ্য যাচাই সম্ভব হয়নি।
১৭. এর মধ্যে সরকার Commissions of Inquiry Act 1956 এর অধীনে একজন সাবেক বিচারপতির নেতৃত্বে ২৪ জুলাই তারিখে ৬ সদস্যের একটি তদন্ত কমিশন গঠন করেছে। কমিশনের সদস্যের মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং সেনাবাহিনীর সদস্য রয়েছেন যাদের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগের অভিযোগ আছে এবং কমিশনের কার্যপরিধিতে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে হতাহত হবার এবং গণগ্রেফতারের অভিযোগ তদন্তের কোনো উল্লেখ নেই, যা খুবই উদ্বেগজনক।
কমিশনের সদস্যের মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং সেনাবাহিনীর সদস্য রয়েছেন যাদের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগের অভিযোগ আছে এবং কমিশনের কার্যপরিধিতে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে হতাহত হবার এবং গণগ্রেফতারের অভিযোগ তদন্তের কোনো উল্লেখ নেই, যা খুবই উদ্বেগজনক।
প্রাথমিক পর্যবেক্ষণের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা নিম্নলিখিত সুপারিশগুলো তুলে ধরছি:
১. দেশের যেকোনো জেলায় সভা-সমাবেশ করার অধিকার যেকোনো রাজনৈতিক দলের আছে। সমাবেশ ঠেকাতে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের এনসিপির সমাবেশস্থলে ও জাতীয় নেতৃবৃন্দের উপর হামলার অপরাধের তদন্ত করে দায়ী ব্যাক্তিদেরকে সুষ্ঠু বিচারের আওতায় আনতে হবে এবং নিশ্চিত করতে হবে যে নির্দোষ ব্যক্তিরা যেন ক্ষতির শিকার না হন এবং কোনো রাজনৈতিক দলের সমাবেশের অধিকার আর ক্ষুন্ন না হয়।
২. আওয়ামী লীগের নানা পর্যায়ের কর্মী, নেতা ও সমর্থক এবং এনসিপির নেতা ও সমর্থকদের একে-অপরের বিরুদ্ধে ১৬ জুলাই এবং তার আগে, নানারকম উস্কানিমূলক বক্তব্য, ভিডিও এবং সামাজিক মাধ্যমের পোস্ট পরিস্থিতিকে সংঘাতময় করে তুলেছে। আমাদের মনে হয়েছে, দলের নেতাকর্মী বা দল বহির্ভূত ব্যক্তিরা যেসব হুমকি দিয়েছেন তা যে উত্তেজনার পরিস্থিতি তৈরি করেছে বা করতে পারে, তার তাৎপর্য এনসিপির নেতৃবৃন্দ উপলব্ধি করতে পারেননি। আর প্রাথমিক ভাবে প্রশাসন কম গুরুত্ব দিয়েছে, তবে পরবর্তীতে পিছিয়ে গেলে আওয়ামী লীগকে সুযোগ দেওয়া হবে ভেবে কর্মসূচি অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এনসিপি নেতাদের যথেষ্ট অবহিত না থেকে দায়িত্বহীন মন্তব্য না ঠেকানো পুরো পরিস্থিতিকে আরো খারাপ দিকে ঠেলে দিয়েছে। সকল রাজনৈতিক দলের পক্ষেই বিদ্বেষমূলক বক্তব্য পরিহার করা প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি।
৩. নিপীড়নমূলক সন্ত্রাস দমন আইনে ঢালাও মামলা ও গ্রেফতার, এমনকি শিশুদের গ্রেফতার – সবই পুরাতন “বন্দোবস্তের” দিকে আমাদের ফেরত নিচ্ছে। ঢালাও মামলা, আটক এবং গ্রেফতারের প্রবণতা পরিহার করা জরুরি এবং গ্রেফতার ও আটকের ব্যাপারে শিশুসহ সকলের আইনগত সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
৪. প্রশাসনের সতর্কতায় বা সঙ্কটের গভীরতা উপলব্ধিতে ঘাটতি ছিল। সেকারণে তাদের প্রস্তুতিও যথেষ্ট ছিলো না বলে আমরা মনে করি। প্রস্তুতি যথাযথ থাকলে হয়তো গুলিবর্ষণ না করেও হামলাকারীদের ছত্রভঙ্গ করা সম্ভব হতো বা আরো আগে থেকে সেনাবাহিনীকে সতর্ক অবস্থায় রাখা যেতো, যেন প্রাণঘাতী অস্ত্রে জনগণের জীবন না যায়। প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের যৌক্তিকতা আমরা পাইনি। আমরা মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং অতিরিক্ত বল প্রয়োগের ঘটনা ঘটেছে কিনা তা যাচাই করতে গ্রহণযোগ্য, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায়বিচারের দাবি জানাচ্ছি। সেই সাথে তদন্তের প্রতিবেদন দ্রুততম সময়ে জনসমক্ষে প্রকাশ করারও দাবি জানাচ্ছি।
৫. যেহেতু এই ঘটনায় সেনাবাহিনী ও পুলিশের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে, তাই গঠিত তদন্ত কমিশনে সেনাবাহিনী, পুলিশ এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধির উপস্থিতি এর নিরপেক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। অভিযুক্ত নিজে তদন্তকারী হবেন না, এটাই নিরপেক্ষতার অন্যতম মূলনীতি। অভিযুক্ত বাহিনী এবং সংস্থাকে বাদ দিয়ে এই কমিশন পুনর্গঠন করা প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি।
৬. গোপালগঞ্জে বিপুল সংখ্যক বহিরাগত সন্ত্রাসী, দেশের নানান জায়গা থেকে পলাতক যুবলীগের নেতা ইত্যাদির আশ্রয় গ্রহণ, অঞ্চলটির অভয়াশ্রমে পরিণত হওয়া বিষয়ক সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া তথ্যকে স্থানীয় জনসাধারণ ও পুলিশ উভয় তরফেই গুজব হিসেবে বলা হয়েছে। কাজেই গোপালগঞ্জ বা অন্য যে কোনো অঞ্চলের মানুষ বা যে কোনো ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গের- মানুষের প্রতি প্ররোচনামূলক বক্তব্য পরিহার করা বাঞ্ছনীয়। প্রতিশোধ নয়, বরং ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই জুলাই এর আকাঙ্ক্ষার প্রকৃত প্রতিফলন ঘটানো সম্ভব।
৭. গোপালগঞ্জের সহিংসতায় একটি সক্রিয় ও কার্যকরী মানবাধিকার কমিশনের অনুপস্থিতি আবারো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে মানবাধিকার কমিশন এর আইন সংশোধন করে পুনর্গঠন করা এবং এ প্রতিষ্ঠানকে কার্যকর করতে আশু পদক্ষেপের দাবি জানাচ্ছি আমরা।
৮. গোপালগঞ্জে এনসিপির সমাবেশে সশস্ত্র ও সংগঠিত হামলা, ৫ জন নিহত এবং অনেকে আহত হবার ঘটনায় স্বতন্ত্র ও স্বাধীন তদন্তের মাধ্যমে চিহ্নিত জড়িতদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানাই আমরা। একইসাথে, কোনো নিরীহ মানুষ যেন হয়রানির শিকার না হন, শিশুদের অধিকার যেন রক্ষা পায়, সকলেই যেন আইনের আশ্রয় পান এবং কোনো বৈষম্যের শিকার না হন এবং যে কোনো প্ররোচণার বিরুদ্ধে সরকার যেন দায়িত্বশীল থাকে, তা নিশ্চিত করার দাবি জানাই।
