এরশাদের সামরিকীকরণ, সংস্কার ও গণতন্ত্রের আন্দোলন

বাংলাদেশের ৫০ বছর ও তারপর-৯

এরশাদের সামরিকীকরণ, সংস্কার ও গণতন্ত্রের আন্দোলন

আনু মুহাম্মদ

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের শেষ প্রান্তে ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানের হানাদার সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। এরপর ৫৪ বছর অতিক্রম করছে এই দেশ। এই সময়ে দুইজন রাষ্ট্রপতি খুন হয়েছেন, দুই দফা প্রত্যক্ষভাবে সামরিক শাসন এসেছে, সামরিক বাহিনীর ভূমিকা বেড়েছে, সংবিধান সংশোধন হয়েছে ১৬ বার, নির্বাচনের নানা রূপ দেখা গেছে, শাসনব্যবস্থা ক্রমান্বয়ে কর্তৃত্ববাদী হয়েছে। ১৯৯০ ও ২০২৪ গণঅভ্যুত্থানে দুবার স্বৈরশাসকের পতন হয়েছে। এই কয়েক দশকে অর্থনীতির আয়তন ক্রমে বেড়েছে, জিডিপি ও বিশ্ববাণিজ্যে উল্লম্ফন ঘটেছে, অবকাঠামো ছাড়াও সমাজে আয় ও পেশার ধরনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন এসেছে। সম্পদের কেন্দ্রীভবন ও বৈষম্যও বেড়েছে, কতিপয় গোষ্ঠীর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কর্তৃত্বে আটকে গেছে দেশ। এই ধারাবাহিক লেখায় আমি ডায়েরী, সাংগঠনিক ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সাথে সাথে ইতিহাসের নানা নথি/ঘটনা পর্যালোচনা করে এই দেশের  রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, সংস্কৃতির গতিমুখ তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি। ব্যক্তিগত বিষয় সেটুকু এনেছি যেটুকু তৎকালীন পরিস্থিতি বোঝার জন্য প্রাসঙ্গিক। নবম পর্বে এরশাদ আমলে সামরিকীকরণের পাশাপাশি সরকারি ও বিরোধী রাজনৈতিক তৎপরতা, বিভিন্ন প্রশাসনিক সংস্কার, স্বৈরতন্ত্রী ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার আয়োজনের পাশাপাশি সর্বব্যাপী প্রতিরোধের শক্তি ও সীমাবদ্ধতার কিছু দিক উঠে এসেছে।

এরশাদের সামরিকীকরণ, সংস্কার ও নির্বাচন

১৯৮১ সালের ৩০শে মে প্রেসিডেন্ট জিয়া নিহত হবার পর থেকে জেনারেল এরশাদ দেশ শাসনে সেনাবাহিনীর জন্য স্থায়ী ভূমিকার কথা বলা শুরু করেছিলেন। এটাই ছিল তার ক্ষমতা গ্রহণের পথ তৈরির কৌশল। তিনি সে অনুযায়ী কিছু পদক্ষেপও নিয়েছেন, তাঁর শাসনামলে প্রশাসনের ব্যাপক সামরিকীকরণ ঘটেছে। ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যদের মধ্যে শতকরা প্রায় ৪০ ভাগ ছিলেন সাবেক সামরিক কর্মকর্তা। সচিবালয়ের উচ্চপদে,  বৃহৎ করপোরেশনের উচ্চপদে, বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের নিয়োগ তখন অনেক বৃদ্ধি পায়। বেসামরিক প্রশাসনে সেনা কর্মকর্তাদের উল্লেখযোগ্য অবস্থান তৈরি হয় তখন থেকেই।

ক্ষমতা সংহত করতে দেশ বিদেশের পূর্বসূরী সামরিক শাসকদের দেখানো পথেই এগিয়েছেন এরশাদ। ১৯৮৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ব্যাপক দমনপীড়নের পর ১৭ই মার্চ, জিয়ার ১৯-দফা কর্মসূচির মত,  ১৮-দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন তিনি। এরপর একই বছরের ১লা এপ্রিল থেকে ঘরোয়া রাজনীতি এবং ১৪ই নভেম্বর থেকে ‘প্রকাশ্য রাজনীতি’ চর্চার অনুমতি আসে। কিন্তু উত্তরোত্তর প্রতিরোধের কারণে কয়েক দফায় তাঁকে এরূপ রাজনৈতিক তৎপরতা বন্ধ করে দিয়ে পুনরায় প্রথম থেকে শুরু করতে হয়।

ক্ষমতা গ্রহণের পর এরশাদ বিভিন্ন সংস্কার কর্মসূচিও গ্রহণ করেন। এর মধ্যে প্রশাসনের পুনর্বিন্যাস ও বিকেন্দ্রীকরণ, ঢাকার বাইরে ৬টি জেলা সদরে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনের স্থায়ী বেঞ্চ স্থাপন, নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়নে কমিশন গঠন, ভূমি সংস্কার পদক্ষেপ, ঔষধনীতি প্রণয়ন, নারী নির্যাতন রোধে ‘পারিবারিক আদালত’ প্রতিষ্ঠা এবং পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ আইন, ১৯৮৯ উল্লেখযোগ্য। সেসময় প্রশাসনিক সংস্কার/পুনর্বিন্যাস কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী দেশের ৪৬০টি থানাকে উপজেলায় এবং ৬৪ মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করা হয়। এর মধ্যে উপজেলা কাঠামো টিকে যায়। ঔষধ নীতির প্রধান উদ্যোক্তা ডা জাফরুল্লাহ চৌধুরী তার বাস্তবায়নে লেগে থাকার ফলে এটি দেশের ওষুধ শিল্পে বড় ইতিবাচক পরিবর্তন আনে। তবে শিক্ষা নীতি, ভূমি সংস্কার, ঢাকার বাইরে হাইকোর্ট বেঞ্চ স্থাপন কার্যকর হয়নি। আর এরশাদের মন্ত্রী মজিদ খানের শিক্ষা নীতির বিরোধিতা ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম ইস্যু ছিল।    

এরশাদের প্রায় ৯ বছরের শাসনামলে চারবার সংবিধান সংশোধন করা হয়, শুরু হয় সপ্তম সংশোধনী দিয়ে। ১৯৮৬ সালের ১০ই নভেম্বর জাতীয় সংসদে সংবিধানের সপ্তম সংশোধনী আইন পাস হয়। এতে ১৯৮২ সালের ২৪শে মার্চ থেকে ১৯৮৬ সালের ১০ই নভেম্বর সামরিক আইন তুলে নেওয়ার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত সামরিক আইন চলাকালে ঘোষিত সকল আদেশ, নির্দেশ, ফরমান, গৃহীত সকল ব্যবস্থা অনুমোদন বা বৈধ করা হয়। ১৯৮৮ সালের ৭ই জুন ভোটারবিহীন নির্বাচনে গঠিত সংসদে অষ্টম সংশোধনী আনা হয়, যাতে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত, বামপন্থী দল ও নারী সংগঠন সবাই এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে। ১৯৮৯ সালের ১০ই জুলাই নবম সংশোধনীতে ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে প্রেসিডেন্টের সাথে সরাসরি নির্বাচনের বিধান রাখা হয়।  ১৯৯০ সালের ১২ই জুন দশম সংশোধনীতে জাতীয় সংসদে ৩০টি আসন ১০ বছর মেয়াদে কেবল নারীদের জন্য সংরক্ষিত এবং পরোক্ষ পদ্ধতিতে এসব নির্বাচনের ব্যবস্থা অব্যাহত রাখার বিধান নতুন করে করা হয়।

১৯৮৪ সালের ২৪শে মার্চ উপজেলা পরিষদের প্রথম চেয়ারম্যান নির্বাচনের ঘোষণা দেয়া হয়। কিন্তু বয়কট ও প্রতিরোধের কারণে তা হতে পারে নি। সরকার এর প্রতিক্রিয়ায় সব বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে, দেশজুড়ে আবার ধরপাকড় শুরু হয়। পরে ১৯৮৫ সালের ১৬ ও ২০ই মে এ নির্বাচন সম্পন্ন হয়। এর মধ্যে প্রেসিডেন্ট জিয়ার মতই এরশাদও নিজের ক্ষমতাকে বৈধতা দেবার জন্য ১৯৮৫ সালের ২১শে মার্চ দেশব্যাপী গণভোট আয়োজন করেন। তেমন সংখ্যক মানুষ ভোট দিতে না এলেও নির্বাচন কমিশনের হিসাব অনুযায়ী গণভোটে এরশাদের পক্ষে শতকরা ৯৪.১৪ ভাগ আস্থা ভোট পড়ে।

বাংলাদেশের ইতিহাস দেখায় যে, সামরিক শাসন জারীর পর বেসামরিকীকরণ প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্ব হচ্ছে সামরিক শাসকের নেতৃত্বে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন। এ লক্ষ্যে প্রথমে এরশাদের এক মন্ত্রীর নেতৃত্বে ১৯৮৩ সালে ‘১৮ দফা কর্মসূচি বাস্তবায়ন পরিষদ’ নামে একটি কমিটি গঠিত হয়। একই বছর ২৭শে নভেম্বর এরশাদের পৃষ্ঠপোষকতায় রাষ্ট্রপতি আহসান উদ্দিনকে চেয়ারম্যান করে ‘জনদল’ নামে একটি দলের নাম ঘোষণা করা হয়। ‘১৮ দফা কর্মসূচি বাস্তবায়ন পরিষদ’ এবং অন্যান্য দলের ক্ষুদ্র কিছু অংশ বা দলছুট ব্যক্তি এতে শামিল হন। এরপর ১৯৮৫ সালের ১৬ই আগস্ট জনদলের সঙ্গে আরও ৪টি দল (কাজী জাফরের ইউপিপি, সিরাজুল হোসেন খানের গণতান্ত্রিক পার্টি, বি এ সিদ্দিকীর নেতৃত্বে মুসলিম লীগের একটি অংশ এবং শাহ আজিজুর রহমানের নেতৃত্বে বিএনপির একটি অংশ) মিলিত হয়ে ‘জাতীয় ফ্রন্ট’ নামে একটি জোট গঠন করে। ১৯৮৬ সালের ১লা জানুয়ারি এগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়ে গঠন করে জাতীয় পার্টি। আরও পরে (১৯৮৬ সালের ২রা সেপ্টেম্বর) সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়ে এরশাদ এর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

এরশাদও খুবই সাফল্যজনকভাবে বিভিন্ন দলের নেতা কর্মীদের নিজ দলে টেনে এনেছিলেন। আরও অনেকের সাথে গোপন বোঝাপড়া ছিল। আওয়ামী লীগের মিজানুর রহমান চৌধুরী এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। এর পর তার অধীনে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন বিশিষ্ট বাম নেতা কাজী জাফর। বামপন্থী নেতাদের মধ্যে আরও যারা পতিত হয়েছিলেন তাদের মধ্যে সিরাজুল হোসেন খান, হাজী দানেশ, আলাউদ্দীন আহমদ, মোস্তফা জামাল হায়দার অন্যতম।

ক্ষমতা নিয়মিতকরণের জন্য এর পাশাপাশি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন চলতে থাকে। প্রথমে তারিখ ছিল ২৭শে মে ১৯৮৪, এরপর ৬ই এপ্রিল ১৯৮৫, তারপর ২৬শে এপ্রিল ১৯৮৬। অবশেষে ১৯৮৬ সালের ৭ই মে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সিপিবিসহ ৮ দল, জামায়াতে ইসলাম সহ মোট ২৮টি দল অংশগ্রহণ করে। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ৭-দলীয় জোট নির্বাচন বর্জন করে। এই নির্বাচন কেন্দ্র করে বিতর্কে ১৫ দল ভেঙে যায় এবং ওয়ার্কার্স পার্টিসহ কয়েকটি বাম দল গঠন করে পাঁচ বাম দল।

ঘোষিত ফলাফল অনুযায়ী জাতীয় পার্টি মোট ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩টি ও শতকরা ৪২.৩৪ ভাগ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়। আওয়ামী লীগ এককভাবে ৭৬টি আসন ও শতকরা ২৬.১৫ ভাগ ভোট লাভ করে সংসদে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ৮-দলীয় জোট সর্বমোট ৯৭টি আসন এবং শতকরা ৩১.২১ ভাগ ভোট পায়। এ ছাড়া ১০টি আসনে জামায়াতে ইসলামী, ৫টি আসনে জয় লাভ করে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)। এছাড়া ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ), মুসলিম লীগ ও জাসদ (রব), বাকশাল, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ (শাহজাহান সিরাজ). ন্যাপ (মোজাফফর) সংসদে আসন পায়। স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও ছিলেন। নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ অবশ্য দাবি করে যে, নির্বাচনে জনগণ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে আওয়ামী লীগ ও জোটের প্রার্থীদেরই জয়ী করেছিল।

সংসদ নির্বাচনের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে এরশাদ ১৯৮৬ সালে ১৫ই অক্টোবর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। প্রধান বিরোধী দলসমূহ এই নির্বাচন বর্জন করে। তার ফলে ভোটার অংশগ্রহণ ছিল খুবই কম। নির্বাচনে ছোট ছোট দল ও স্বতন্ত্র মিলে মোট ১২ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এরশাদ জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে দাঁড়ান এবং সরকারি হিসাবে ‘বিপুল ভোটের ব্যবধানে’ নির্বাচিত হন।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের আন্দোলন ও সাংগঠনিক তৎপরতা

১৯৮৬ ও ৮৭ সালে আমি পরপর দুবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছি। দুবারই এর সভাপতি ছিলেন ড. সৈয়দ শফিউল্লাহ। ১৯৮৭ সালে মানে দ্বিতীয়বারে আমার সাথে যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক রেহনুমা আহমেদ। দেশে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষক সমিতির শুধু বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক কর্মসূচিতে সীমাবদ্ধ থাকার উপায় ছিল না। এই দুবছরই জাতীয় আন্দোলনে শিক্ষকদের ভূমিকা পালনের জন্য সমিতি থেকে আমরা বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করতে সক্ষম হই। সেসময় দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির মঞ্চ হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনেও আমার অনেক দায়িত্ব নিতে হয়। অন্য অনেক কাজের দায়িত্ব ঘাড়ে থাকায় মহাসচিব হবার জন্য অনেক চাপ থাকলেও তা নেয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। আমি যুগ্ম মহাসচিবের দায়িত্ব নেব এই প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মঈনুল ইসলাম সে দায়িত্ব নিতে রাজি হন।  

উল্লেখ্য যে, সেসময় বিশ্ববিদ্যালয় মানে পাবলিক বা সর্বজন বিশ্ববিদ্যালয়। অন্যান্য স্তরের মতো বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতনও ছিল অন্যান্য দেশের তুলনায় খুবই কম। এগুলো নিয়ে বহুদিন কথা হলেও ১৯৮৬ সালেই প্রথম ফেডারেশনের নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতন ভাতাসহ বিভিন্ন দাবি দাওয়া নিয়ে দেশব্যাপী ব্যাপক আন্দোলন তৈরি হয়। এই দাবি দাওয়া নিয়ে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে সভা দেনদরবারও করতে হয়। উল্লেখ করা দরকার যে, পে কমিশনের মাধ্যমে কয়েক দফা বেতন বৃদ্ধির পরও এখনও বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতন বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চল তো বটেই আশে পাশের দেশগুলোর তুলনায়ও অনেক কম। তখন তা আরও কম ছিল। এখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে খন্ডকালীন শিক্ষকতা করে স্বচ্ছলতা আনার চেষ্টা করেন। তখন তার উপায় ছিল না। তখন শিক্ষকদের বাড়তি আয়ের জন্য গবেষণা নামের কনসালট্যান্সী খুঁজতে হতো। কিন্তু সুযোগ থাকলেও সেসব পথে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তার ফলে শিক্ষকতার মত সম্মানজনক পেশা নিয়েও আর্থিক অনটনের মধ্যে আমার মত অনেককে দিন কাটাতে হয়েছে।

আমি ১৯৮৫ সালের মাঝামাঝি থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত ক্যাম্পাসে ছিলাম। মীর মোশাররফ হোসেন হলের সহকারী আবাসিক শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে হতো। সেখানকার বাসায় থাকার জন্য বাসা ভাড়া পুরোটাই কেটে নেয়া হতো। পকেটে অবশিষ্ট থাকতো কমই। তখনও দেখেছি এখনও দেখি অনেকের ধারণা শিক্ষকরা যেসব বাসায় থাকেন সেগুলো ফ্রি! ফ্রি তো নয়ই বাইরের বাসাগুলোর তুলনায় সেগুলোর ভাড়া বেশিই।

ক্যাম্পাসে নিশ্চিন্ত প্রকৃতি ঘনিষ্ঠ জীবন যাপনের সুযোগ ছিল কিন্তু লেখালেখি, সেমিনার সভা সমাবেশ এবং সাংগঠনিক বিবিধ দায়িত্ব পালনের জন্য আমাকে নিয়মিতই ঢাকায় আসতে হতো। আমি তখন লেখক শিবিরের সাধারণ সম্পাদক। ১৯৮৪ সালের পর ১৯৮৬ সালে দ্বিতীয়বারের মত এই দায়িত্ব নিয়েছি। বদরুদ্দীন উমর, হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, আসহাবউদ্দীন আহমদের মত ব্যক্তিদের সাথে কাজ আড্ডা সবই ছিল খুবই আনন্দদায়ক। কিন্তু সংগঠন তখন অনেক বড় হয়ে উঠেছিল, সেজন্য অনেক সময় দিতে হতো। ঢাকার বাইরে যেতে হতো প্রায়ই। এছাড়া ১৯৮১ সাল থেকে আমি বদরুদ্দীন উমর সম্পাদিত সংস্কৃতি পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছি। লেখা সংগ্রহ, সম্পাদনা ও প্রেসের অনেক কাজে সময় দিতে হতো। কামরুদ্দীন আবসার ও ফিরোজ আহসানের সহযোগিতা ছিল অন্যতম ভরসা। এরপর কৃষক শ্রমিক সংগঠনেরও কাজ ছিল। সব কিছুর জন্য ঢাকায় সপ্তাহে অন্তত ৪/৫ দিন যেতে হতো। আমাকে এতবার ঢাকায় যেতে দেখে ক্যাম্পাসের অনেকের মধ্যেই যে প্রশ্ন তৈরি হচ্ছিলো তা একদিন বুঝতে পারলাম যখন কয়েকজন শিক্ষক আমাকে ঘিরে ধরলেন, জিজ্ঞাসা করলেন কেমন টাকা পয়সা পাওয়া যায় ঢাকার কাজে? তাদের বোঝানো কঠিন যে আমি যেসব কাজে যাই সেগুলোতে আয় হয় না উল্টো টাকা খরচ হয়। হয়তো তাঁরা আয় রোজগারের পথ সন্ধান করছিলেন। তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেক দুর্বল ছিল। প্রায়ই বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বাস মিস করে কঠিন অবস্থায় পড়তে হতো। তখন এতো পাবলিক বাসও ছিল না।

বিভাগে ক্লাশের চাপও ছিল অনেক। এখন বিভাগে তরুণ শিক্ষকদের সাধারণত দুটো কোর্স থাকে, তখন আমাকে কমপক্ষে চারটা কোর্স পড়াতে হতো। এর বাইরে পরীক্ষা কমিটি, বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরী, জার্ণাল, সেমিনার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নিয়েও কমবেশি কাজ করতে হতো। আমি ক্লাশ, টিউটোরিয়াল পরীক্ষা, খাতা দেখায় নিয়মিত থাকার চেষ্টা করেছি সবসময়। হলেরও কাজ ছিল।      

এসবের বাইরে লেখালেখির কাজ তো ছিলই। পরিস্থিতির কারণেই বিভিন্ন বিষয়ে কাজ করার তাগিদ তৈরি হতো। এবছরই বইমেলায় প্রকাশিত হয় আমার গ্রামীণ সমাজ ও অর্থনীতি বইটি। যেখানে ১৯৭৪ থেকে পরবর্তী কয়েক বছরে গ্রাম নিয়ে আমার অনুসন্ধানী লেখাগুলো ছিল। এনজিও নিয়ে আমি অনুসন্ধানী কাজ শুরু করেছি ১৯৮০ থেকেই। এর উপর ভিত্তি করে ১৯৮২ প্রথম বড় আকারে যে প্রবন্ধটি প্রকাশ করি তার প্রতিক্রিয়া হয় ব্যাপক। অনেক প্রশ্ন, সমালোচনা, অনুরোধ এবং প্রয়োজন বিবেচনা করে এ বছরই এই নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা শুরু করি।

১৯৮৬ সালের কিছু ঘটনা

৩০.৩. ১৯৮৬

পান্না, আশরাফ, বিপ্লব, নবীসহ ৮ জন সিপিবি থেকে বহিষ্কৃত হয়েছে। মতাদর্শগত দিক থেকে ওরা বেশ কিছুদিন থেকেই সিপিবি রাজনীতির সমালোচক।… সিপিবির এই ভাঙন শুধু এখানে নয়, অন্যান্য জায়গাতেও ঘটছে। যারা সিপিবি থেকে বেরিয়ে আসছে বা পদত্যাগ করছে তাদের অনেকেই গত আন্দোলনে সিপিবির সবচাইতে অগ্রণী কর্মী ছিল।

১২.৪.১৯৮৬

আরজ আলী মাতুব্বরের উপর আমাদের আজকের আলোচনা সভাই হচ্ছে প্রথম সভা। এরকম একজন ব্যক্তিত্ব, নির্ভীক দার্শনিক সম্পর্কে সমাজে কী নীরবতা এবং অজ্ঞতা!

২০.৪.১৯৮৬

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ধর্মঘট ও প্রতিবাদ সমাবেশ হলো।

২২.৪.১৯৮৬

পান্না আশরাফদের পুস্তিকা ‘আমরা কেন সিপিবিতে নেই’ বের হয়েছে। ওদের সহ প্রথম অনুষ্ঠান- লেনিন জন্মবার্ষিকী ও খাপড়া ওয়ার্ড দিবস।

৩০.৪.১৯৮৬

কদিন আগে ক্যাম্পাসে আবার গন্ডগোল। মেরুদন্ডহীন ভিসি, দালাল ও সুবিধাবাদী প্রভাবশালীদের জন্য জুতার পেরেক আর সরানো যাচ্ছে না।..গতকাল খালেদা জিয়ার বিশাল জনসভার পর গভীর রাতে নির্বাচন বিরোধী তৎপরতা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আজ বহুজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। হয়রানি হচ্ছে।

৩.৫.১৯৮৬

ঢাকা শহরে এখন সম্ভবত তুমুল গন্ডগোল হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সভা শেষে ফেরার পথে আমাদের মাইক্রোবাসে আক্রমণ হয়েছিল। শুনেছি গুলিস্তান এলাকাতেও গন্ডগোল ছড়িয়েছে। নির্বাচন বিরোধী তৎপরতার উপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা, তাদের ব্যাপক ধরপাকড় একটা আতংকের পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। দেশের অন্যান্য ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। গত কিছুদিনে লঞ্চ দুর্ঘটনা, সড়ক দুর্ঘটনা, খুন, মারামারি, বোমা, ডাকাতি, আত্মহত্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। মনে হচ্ছে এই নৈরাজ্য সামনে আরও বাড়বে।

৪.৫.১৯৮৬

হরতালের কর্মসূচি ছিল আজ। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ৭ দল ও বাম ৫ দলের। আংশিক হয়েছে।

৫.৫.১৯৮৬

মে দিবস শতবার্ষিকী ও কার্ল মার্ক্স জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ভালো আলোচনা সভা হলো। আজ আমাদের প্রথম গণসঙ্গীতের ক্যাসেটও প্রকাশিত হলো। মূল শিল্পী ও সংগঠক- কামরুদ্দীন আবসার। 

৭.৫.১৯৮৬

আজ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হচ্ছে।…ভোটার উপস্থিতি খুব কম। এই ক্যাম্পাস থেকে কেউ যায়নি।.. টিভিতে আজকে ইতিমধ্যে আজগুবি ভোট পড়া (৯৬%) ও বিজয়ের খবর দেখানো হচ্ছে।

৮.৫.১৯৮৬

বহুসংখ্যক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। ভোট ডাকাতি হয়েছে। ব্যালট বাক্স ছিনতাই, বুথকেন্দ্র দখল, খুন, মারামারি, ১৫ থেকে ২০ ভাগ শতাংশ ভোটারের উপস্থিতি এই হচ্ছে সামগ্রিক ঘটনা।

১৯.৫.১৯৮৬

…ভোর চারটায় লঞ্চ থেকে বরিশাল ঘাটে নেমে ছোট আরেক লঞ্চে উঠলাম, ভেতরের দিকে যেতে হবে, মেহেন্দীগঞ্জ। ছোট নদী দিয়ে যাচ্ছিলাম। অসম্ভব ক্লান্তিহরা, খুব সুন্দর। নদীর পারে প্রচুর গাছপালা, বহুরকমের পাখী। টিয়া পাখী ভর্তি।…

২৩.৫.১৯৮৬

তিনদিনে ঘুম খুব হয়নি। শেষ রাতে মশা এবং প্রচন্ড গরমে ঘুম হলই না। তবে গোসলের ব্যবস্থা ছিল ভালো, নদীতে।…সন্ধ্যায় লঞ্চে ফিরতি রওনা হলাম। চাঁদনী রাত, অসাধারণ। দুর্বল লঞ্চে অনেক ভীড় ছিল। প্রচন্ড গরমের পর যেকোনো সময় ঝড়ের আশংকা ছিল।..       

২৬.৫.১৯৮৬

কাল রাতে লঞ্চ ডুবিতে কয়েকশ মানুষ মারা গেছেন। কদিন আগে আরেকটি হয়েছিল। জীবন এতো তুচ্ছ এদেশে!

২৭.৫.১৯৮৬

লেখক শিবির থেকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপর আলোচনা সভা। তাঁর জন্মবার্ষিকী ছিল গত ১৯ তারিখে। এর আগে অন্য কেউ করেছে বলে শুনিনি। আলোচনা বেশ ভালো হয়েছে। ইলিয়াস ভাই দারুণ। মঞ্জু সরকার, জহুরুল হকও ভালো বলেছেন। কায়েস আহমেদ পার্টি মার্ক্সবাদ এবং তার সাথে সৃজনশীলতার সম্পর্ক নিয়ে প্রচলিত অভিযোগগুলো পুনরাবৃত্তি করলেন বলে বিতর্ক উঠলো। বেশ ভালো। আমিও কিছুটা বললাম। রাতে এগুলোর বিবরণী তৈরি করলাম সাংস্কৃতিক আন্দোলনের জন্য।

২৮.৫.১৯৮৬

ওমর মুখতার। লিবিয়ার জনগণের উপর মুসোলিনীর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তাঁদের সংগ্রামের অসাধারণ কাহিনী।…এই মুখতার বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন কালে বিভিন্ন নামে। এঁরাই মানুষকে গৌরবান্বিত করেন। ব্যক্তির মৃত্যু হয় কিন্তু এরাই ধারাবাহিকতা রক্ষা করেন।

১.৬.১৯৮৬

ভিসি বলেছেন, ‘আনু শিক্ষক সমিতির সম্পাদক হয়ে নিজেকে কী মনে করে?’ অবাক হই নাই। ‘কী মনে করে?’ এরকম কথা অনেকের মুখেই শুনেছি। এদের কাছে আর অনেকের মতো আমার কিছু চাওয়ার নাই। সেজন্যই আমার স্বাভাবিক ব্যবহার তাদের কাছে ঔদ্ধত্ব মনে হয়!

৩.৬.১৯৮৬

বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা প্রকল্পের শেষ কিস্তির টাকা এখনও পাইনি। এত ছোট প্রশাসনেও কত টেলিফোন করতে হচ্ছে। ফাইল গায়েব হয়ে যায়। সকাল বেলাটা এ নিয়েই গেল। দুপুরে প্রুফ দেখে ঢাকায়। অফিসে আবার প্রুফ দেখা, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের লেখা তৈরি, চিঠি লেখা, অর্থনীতির সংকটকাল-র লেখা সম্পাদনা করা। রাতে বাসায় ফিরে টিউটোরিয়াল খাতা দেখা।

৪.৬.১৯৮৬

প্রায় দেড় বছর আগেই হবার কথা, শেষ পর্যন্ত এই পদোন্নতি আজ হলো। বেতন ও বোনাসের টাকা যা পেলাম তা দিয়ে ব্যাংকের রেড একাউন্ট (ওভারড্রাফট) মাত্র স্বাভাবিক হয়েছে। আবার লাল হবার পথে!

৫.৬.১৯৮৬

সারাদিন ঢাকায়।..বিকালে অফিসে হুমায়ুন কবির স্মৃতি সভা।..প্রচন্ড গরম। এর উপর ঢাকায় ঈদের কেনাকাটার প্রচন্ড ভীড়। বোনাস, ধার, অগ্রিম (ওভারড্রাফট) টাকা নিয়ে ছুটছেন নির্দিষ্ট আয়ের মানুষজন। চোরাই টাকা নিয়ে কিছুজন। বাকিরা দর্শক।

১০.৬.১৯৮৬

ঈদ ভয়াবহ সর্বগ্রাসী। বেশিরভাগ মানুষের কয়েক মাসের আয় শেষ করে, ঋণগ্রস্ত করে। ৮/১০ দিনের কাজ বন্ধ হয়ে যায় বহুজনের। তেমন কিছু না করেও বাসায় দেওয়া আর এটা সেটা দেওয়াতে ৪ হাজার টাকা চলে গেছে। আমার বর্তমানের ৫ মাসের বেতন!

৩০.৬.১৯৮৬

কয়েকদিনের একটানা ব্যস্ততা থামলো। ২৭ ও ২৮ জুন লেখক শিবিরের বিশেষ প্রতিনিধি সভা হলো। কেন্দ্রীয় পরিষদের বর্ধিত সভা হলো। তারপর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সভা। মাসখানেক ধরে কাজ করে ২৯ তারিখ সকালে শেষ করলাম ‘সিপিবির রাজনীতি ও লেজুড়বাদ’ লেখাটি। বিকালে কৃষক ফেডারেশনের সভা।

৯.৭.১৯৮৬

অর্থনীতি সমিতির উদ্যোগে বাজেটের উপর সেমিনার। ভালো হয়েছে বলা যাবে না। সবাই লক্ষ্যহীনভাবে কথা বলেছেন। আমি যে কয়টি মৌলিক প্রশ্ন তুললাম সেগুলো নিয়ে কথা বললেন না কেউ। প্রফেসর মোশাররফ এবং ড. সাইদুজ্জামান বাজেট কে বাঁচাতে চেষ্টা করলেন। 

১৬.৭.১৯৮৬

দাউদ হোসেন (সম্ভবত ছদ্মনাম) আমাদের-ডাক্তারদা, উমর ভাই এবং আমার বিরুদ্ধে খুব ভালো একটি সমালোচনা প্রকাশ করেছেন। আমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মতো বিবেচনা যোগ্য এই প্রথম একটা লেখা দেখলাম। তাঁর কিছু ভুল ব্যাখ্যা আছে, কিছু বিভ্রান্তি আছে কিন্তু তিনি মৌলিক কিছু বিষয় চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন।

১৭.৭.১৯৮৬

ডেমরায় দালালদের চক্রান্তে মিল দখল। মালিক তিনবছরে শ্রমিকদের দাবি করা মজুরি দিলে যা খরচ হতো তার থেকে বেশি ক্ষতি স্বীকার করেও শ্রমিকদের দাবি মানতে রাজি না। টাফ কর্মী প্রায় সকলেই ছাঁটাই। বকুলদা খুব অস্থির। এই ছাঁটাই শ্রমিকদের কোথাও কাজের ব্যবস্থা করা গেলে কিছুটা কাজ হতো।

দালাল জাবিতেও কম নাই। শিক্ষকদের দৃঢ় মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান আর আত্মসম্মানে আঘাত করে কতিপয় শিক্ষকই। কয়েকজন ছাত্র নামের দুর্বৃত্তের বহিষ্কারের কথায় কয়েকজন প্রভাবশালী শিক্ষক খুবই বিচলিত। 

২২.৭.১৯৮৬

সংবাদপত্রে কায়দা করে মিথ্যাভাবে ‘বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার’ বলে খবর ছাপা হয়েছে। হল থেকে সংবাদ বিজ্ঞপ্তির নিয়ম নেই। রেজিষ্ট্রার বললেন সিন্ডিকেটে নাকি এটা আলোচনা হবে। মেরুদন্ডহীন সিনিয়র শিক্ষকেরা আশ্বস্ত। ক্রিমিনালদের সম্মান বেঁচেছে!

রাতে জানলাম তারা (এরশাদের ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দ) নাকি আমার, নূরুল আমিন স্যার ও আলী ভাইএর পদত্যাগ দাবি করে পত্রিকায় বিবৃতি দিয়েছে, মিছিল করছে। বুঝতে পারছি এসবের পেছনে কিছু শিক্ষকই আছে। ছি:!

২৫.৭.১৯৮৬

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের নেতৃত্বে সারাদেশে শিক্ষকদের আন্দোলন চলছে। তার অংশ হিসেবেই জাতীয় সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছে। এর মূল প্রবন্ধ লেখার দায়িত্ব আমার উপর। কদিন ধরে লিখছি। সময় কম। চাপ পড়ছে বেশি।

২৭.৭.১৯৮৬

আজ আমার মূল প্রবন্ধ ধরেই জাতীয় সেমিনারে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হয়েছে। লেখার শিরোনাম ছিল- ‘শিক্ষা খাতে ব্যয় এবং সামগ্রিক বাস্তবতা’। স্বাধীনতার পর থেকে শিক্ষা খাতে ব্যয়ের চিত্র, যা আনুপাতিক হারে কমেছে, আর সেই সাথে বিদ্যমান উন্নয়ন ধারা পর্যালোচনা।   

শিক্ষকদের নিয়ে আন্দোলন সহজ নয়। মধ্যবিত্ত এবং বুদ্ধিজীবী। বেশিরভাগ অংশ সচেতন বা অসচেতনভাবেই নানা শৃঙ্খলে আটকে যান। প্রকৃত বেতন হ্রাস এবং স্থিতিহীনতার সমস্যা সমাধানে ধান্ধাবাজী বা সাম্রাজ্যবাদী নেটওয়ার্ক সন্ধান প্রধান প্রবণতা। ফলে যে সুবিধাবাদিতা এবং আন্দোলনবিমুখতা তৈরি হয় তা দূর করা কঠিন। নিজেদের সমস্যা এবং আন্দোলনের গুরুত্বও তাঁরা বুঝতে চান না। খুবই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গেছেন সবাই।…

১.৮.১৯৮৬

সকালে বাস ট্রাক মিনিবাস ধর্মঘট শুরু হয়েছে। মালিকদের ধর্মঘট- বাসভাড়া বাড়ানোর জন্য। আর মন্ত্রী নিজেই মালিক সমিতির সভাপতি! দুর্ভোগের চূড়ান্ত মানুষের।

২.৮.১৯৮৬

ঐক্য প্রচেষ্টার প্রাথমিক উদ্যোগ হিসেবে আজ ‘বিপ্লবী ঐক্যের সমস্যা ও সম্ভাবনা’ আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হলো। বিকাল ৩টা থেকে শুরু হয়ে রাত ১০টায় শেষ হলো। (বিভিন্ন রাজনৈতিক ধারার) ২০টি গণসংগঠন যোগ দিয়েছিল। আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল ৪০টি।

আলোচনা খুব গোছানো হয়নি। আমার উপস্থাপনার পর যে যার মতো আলোচনা করেছেন, অনেক অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তাও হয়েছে। তবে এর মধ্যে থেকে সবার দৃষ্টিভঙ্গী এবং আগ্রহের ধরন বোঝা গেছে। জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট ছাড়া বাকি সবাই ঐক্যের ব্যাপারে আগ্রহী। মজহারের সংগঠন থেকে যারা এসেছিলেন মনে হলো তারা শুধু ঐক্যের বিরোধী নন, সভা পন্ড করতেই এসেছেন। লিখিত বক্তব্যে তাদের বক্তা উস্কানিমূলক বক্তব্য দেয়া শুরু করেন। এনজিওর বিরোধিতা তাদের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যবস্তু হয়ে দাঁড়ায়। সময়ও নেন তারাই বেশি। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করেন তারা, যদিও শেষ পর্যন্ত সুবিধা করতে পারেন নি। এতসবের পর বাস ধর্মঘটের কারণে সবারই ফিরতে অনেক ঝামেলা হলো।

৫.৮.১৯৮৬

সকালে ক্লাস নিয়ে জরুরী ভিত্তিতে ঢাকায় যেতে হলো। দাবি দাওয়া নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সাথে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কমিটির সভা। সচিবালয়ে। সভায় দেখলাম সিনিয়র আমলাদের ভাবসাব- কীভাবে মূল আলোচনাকে পাশ কাটিয়ে যেতে নিয়োজিত থাকে!

১৪.৮.১৯৮৬

ঈদের ছুটির আগে তুমুল গতিতে ক্লাস নিচ্ছি। ক্লাসের চাপ আর খাতা দেখা। এর মধ্যে সংগঠনের কাজ।

৩.৯.১৯৮৬

গত ২৮শে আগস্ট ঢাকার বাইরে গেছি। পাবনা, শিবগঞ্জ, নবাবগঞ্জ এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। ২৮ তারিখ সকালে বিভাগে ক্লাস নিয়ে দুপুরের পর রওনা হলাম। প্রচন্ড রোদ সারাদিন। বাজে ফেরীতে উঠে- নড়াচড়ার জায়গা নেই- বিশ্রী অবস্থা। পাবনায় পৌঁছলাম রাত ৯টায়। মোস্তফা, নজরুল ও মজিবর ভাই বাসস্ট্যান্ডেই ছিলেন। রাতে মোস্তফা ভাইএর সঙ্গে অনেক আলাপ হলো। একসময়কার বহিষ্কৃত অথচ এখন সক্রিয় কর্মী। বহিষ্কারের ঘটনা এখনও মেনে নিতে পারেননি। তার মূল আপত্তি কর্মপদ্ধতি নিয়ে, এবং তাতে কিছুটা সত্যতা আছে বলেও মনে হলো। কিন্তু এটি সংগঠনের অপরিণত অবস্থারই প্রতিফলন।

পরদিন শুক্রবার সকালে প্রেসক্লাবে সেমিনার হলো, ঘন্টাখানেকের বেশি বলতে হলো। পাট, কৃষিঋণ সমস্যা মুখ্য। এরপর সাংগঠনিক সভা। খাবার পরই রওনা হলাম  নবাবগঞ্জ। ঠিকঠাকমতো যানবাহন পেয়ে যাওয়ায় রাজশাহী হয়ে নবাবগঞ্জ পৌঁছলাম রাত ৯টায়। গরমের কমতি নেই। তবে আশরাফের বাসায় ফ্যান থাকায় আগের দিনের চাইতে কম ভোগান্তি হলো। পান্নাও হাজির হলো।…

নবাবগঞ্জে এখনও জামাতীদের প্রভাব সবচাইতে বেশি। তবে জামাতী এমপি হওয়ায় তাদের জনপ্রিয়তা দ্রুত কমছে। লেখক শিবিরের মতো সংগঠন এখানে কঠিন।  শনিবার বিকালে নবাবগঞ্জে ঘরোয়া সভা অনুষ্ঠিত হলো।… 

নবাবগঞ্জ সীমান্তবর্তী এলাকা বলে চোরাচালানের উৎকৃষ্ট জায়গা। নিয়মিত আসে গরু ও কাপড়, যায় বৈদ্যুতিক সাজসরঞ্জাম, ওষুধ, ইলিশ মাছ ইত্যাদি। প্রকাশ্য ব্যাপার, প্রশাসনও জড়িত। পার হবার জায়গা ইজারা দেয়া থাকে। নির্দিষ্ট ফি দিয়ে পার হতে হয়। সন্ধ্যা ৭ টায় নিয়মিতভাবে কারেন্ট চলে যায় মাল পারাপারের সুবিধার জন্য। আশে পাশের গ্রামে প্রায়ই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয় এগুলো কেন্দ্র করেই।… রোববার গেলাম শিবগঞ্জ। আরও ভেতরে। পার হতে হলো মহানন্দা নদী। বিকালে ঘরোয়া আলোচনা সভা বেশ ভালো হলো। অনেকরকম প্রশ্ন আর উত্তর।

এলাকাটি চোরাচালান ব্যবসা নির্ভর। কোনো ধরনের শিল্প কারখানা নেই। চাকুরে ছাড়া অন্য প্রায় সকলেরই আয়ের প্রধান উৎস চোরাচালান। চাকুরেরাও আছে। সামাজিকভাবে এটি স্বীকৃত। উপজেলা হবার পর থেকে মামলার বৃদ্ধি, মুন্সেফ-ম্যাজিস্ট্রেটদের দুর্নীতির কথাও শুনলাম। ছিলাম বিশু এডভোকেটের বাড়ীতে। পরে সোমবার ১ তারিখ আশরাফদের বাসা হয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছতে বিকাল হয়ে গেল। শিক্ষা ব্যবস্থার উপর সেমিনার। এই শাখাতেই সর্বাধিক সংখ্যক শিক্ষক যুক্ত আছেন। হাসান ভাইএর (হাসান আজিজুল হক) প্রচেষ্টাতেই এটা সম্ভব হয়েছে। তাঁরাও আলোচনা করলেন।

পরদিন সকাল দুপুর বহুজনের সাথে কথাবার্তা হলো। বিকালে সাংগঠনিক সভা। রাতে হাসান ভাইএর বাসায় তাঁর সাথে দীর্ঘ আলোচনা। তাঁর কাছে আমাদের প্রত্যাশা, আমাদের ক্ষোভ সবই কথা হলো। তিনি আরও বেশি সময় দেবেন।

ঢাকায় ফিরলাম। ফেরার কথা ছিল  ২ তারিখ,  দেরি হওয়ায় টেনশন হয়েছে বাসায়। টাকা পয়সারও সমস্যা। এসব সফরে অর্থনৈতিক চাপও বেড়ে যায়। এবারে খরচ হলো ৪০০ টাকার বেশি। কিন্তু কী করা যাবে?

৪.৯.১৯৮৬

সরকার দাবিদাওয়া না মানায় আজ থেকে ফেডারেশনের ডাকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ধর্মঘট শুরু হয়েছে। সকালে শিক্ষক সমিতির সাধারণ সভা। বিকালে ঢাকায় ফেডারেশনের সভা। প্রয়োজনীয় বিশ্রাম পাওয়া গেল না। কাল সকালে ফেডারেশনের সভা। আমার এক্সরে।

৭.৯.১৯৮৬

শিক্ষক সমিতির সভা। নতুন কর্মসূচি। বিকালে ঢাকায়।

রাতে হামিদুল হক ছিলেন এখানে। সবিপ (সর্বোচ্চ বিপ্লবী পরিষদ, সর্বহারা পার্টি)- এর প্রতিনিধি হিসেবে কথা বলতে এসেছিলেন। তাঁদের কাজের পদ্ধতি সম্পর্কে সম্যক অবহিত হলাম। তত্ত্বগত অস্বচ্ছতা, গোঁড়ামি এবং ভ্রান্তি সত্ত্বেও কাজে অনেক সঠিকতা, গুরুত্ব এবং আন্তরিকতা আছে। পার্টি প্রক্রিয়া সচল রাখার ব্যাপারেও তারা গুরুত্ব দেন। কর্মীদের বাধ্যতামূলকভাবে কিছুদিন গ্রামে বা শিল্পাঞ্চলে থাকার ব্যবস্থা করা, সকলের আয়ের উপর পার্টি নিয়ন্ত্রণ, মত বিনিময়-পার্টির ভেতরে কর্মীদের বিকশিত করার বিভিন্ন উদ্যোগ বেশ উল্লেখযোগ্য।

৮.৯.১৯৮৬

ধর্মঘট চলছে। শিক্ষক সমিতির কাজ। আর খাতা দেখা, বিরক্ত লাগছে মানের জন্য।

১০.৯.১৯৮৬ 

ফেডারেশনের সভা। তার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শিক্ষকদের দাবি দাওয়া নিয়ে সরকারের প্রতিনিধি কাজী জাফরের সঙ্গে আমার আর সৈয়দ শফিউল্লাহর বৈঠক। শিক্ষক ধর্মঘট পরিস্থিতি নিয়েই আলাপ হলো। সেরকম কাজ হয় নাই। প্রাক্তন প্রগতিশীল নেতা এরশাদের প্রীতি পেয়ে বেশ ধন্য মনে হলো। “শিক্ষকদের সন্তুষ্ট করার সুযোগ প্রেসিডেন্টের নেয়া উচিত” তার সহানুভূতির মূল বক্তব্য এটাই।            

১১.৯.১৯৮৬

জাবিতে সকালে শিক্ষক-শিক্ষার্থী জমায়েত। একমাত্র এখানেই হয়েছে। প্রচন্ড বৃষ্টি থাকা সত্ত্বেও বেশ ভালো জমায়েত হয়েছে। বিকালে ময়মনসিংহ।

১৫.৯.১৯৮৬

ময়মনসিংহে সেমিনার ও সভা শেষে কাল ফিরেছি। বিকালে মনোরঞ্জন বিশ্বাস ও নারায়ণ চৌধুরীর সাথে কথা। তাঁরা ঢাকা ও চট্টগ্রামে লেখক শিবিরের কয়েকটি অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিচ্ছেন।…ফেডারেশনের সভা করে জাবিতে ফিরতে ফিরতে রাত ১২টা। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যদি সরকার সুনির্দিষ্ট ঘোষণা দেয় তাহলে ধর্মঘট স্থগিত হবে।

২১.৯.১৯৮৬

গতকাল এবং আজ দুদিন প্রায় পুরোটা সময়, গত রাতে ফিরেছি রাত ২ টায়, ফেডারেশনের কাজে গেল। সরকারি ঘোষণার পিছু পিছু ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের স্যাঁতস্যাঁতে চরিত্র, বিরক্তিকর। এসব আন্দোলনের চরিত্র এমনই যে, এর মধ্যে থাকলে ইচ্ছার বিরুদ্ধে অনেক কিছুর পেছনে ছুটতে হয়, অর্থহীন এবং অপমানজনক কাজ করতে হয়। সময় ব্যয় করতে হয়। বড় আমলারা শিক্ষকদের প্রতিদ্বন্দ্বী হিাসবে দেখে। তাদের প্রাণপণ চেষ্টায় সরকারি ঘোষণাও হলো না।

আজকেই মালেক ভাইএর টাকায় তারই চাপে ঘরে ফ্রিজ এলো-ঋণের টাকায়। মাসে ৩০০ টাকা কিস্তিতে শোধ দিতে হবে। খুবই ভালো, কিন্তু মাসের নীট আয় কমে দাঁড়ালো ১৫০০ টাকা। কঠিন অবস্থা!

২৮-২৯.৯.১৯৮৬

গত কদিন এক পা বের হবার উপায় ছিল না। বেশ জ্বর আর সাথে অন্য নানা সমস্যা। আজকেই প্রথম বের হলাম। শরীর খুব দুর্বল। এখানে টাফের সমাবেশ। পান্না আশরাফ ভালোই সংগঠিত করেছে।

ফেডারেশনের নাগরিক সমাবেশ। সমাবেশ ভালো হয়েছে জাহাঙ্গীরনগরের শিক্ষকদের বিপুল উপস্থিতির কারণে।

শিক্ষক ধর্মঘট চলছে।

১৪.১০.১৯৮৬

গত কদিন থেকে যানবাহন নিয়ে বেশ ঝামেলা হচ্ছে। তথাকথিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সরকারি রিকুইজিশন, অগ্নিসংযোগ। আমরা ঢাকায় আটকে গেছি।

১৫.১০.১৯৮৬

ফাজলামী আর লাজলজ্জাহীনতার যে সীমা নাই সেটা এরশাদই বারবার প্রমাণ করে। মানুষ সবাই ঘরে বসে ছিল। বিরোধী দলগুলোর ডাকে পূর্ণ হরতাল হয়েছে।… শতকরা ১ ভাগ ভোটও পড়েনি। অথচ এরশাদ নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট!

৩-৪.১১.১৯৮৬

শিক্ষক আন্দোলন জটিল অবস্থায়! জাবিতে শিক্ষক সমিতির সাধারণ সভা। সাভার ধামরাই আঞ্চলিক কাজের পরিকল্পনা নিয়ে বসেছিলাম। ক্যাম্পাসে এরশাদের ‘নতুন বাংলা’র সন্ত্রাসীরা আবার গন্ডগোল পাকাবার চেষ্টা করছে। ফ্রন্টের ছেলেদের খামোকা মারলো। কোনো প্রতিবাদও নেই।

আখচাষী ইউনিয়নের সম্মেলন হলো। আমরাও এর সঙ্গে কাজ করছি।

৫.১১.১৯৮৬

সকালে ভিসির সাথে শিক্ষক সমিতির বৈঠক ছিল। কিছু বিষয় সমাধান করে দায়িত্ব শেষ করতে পারলেই খুশি হতাম।

দেশে এনজিও তৎপরতা ক্রমে বিস্তৃত হচ্ছে। ৮০ সালে এনজিও নিয়ে গবেষণার কাজ শুরু করি এবং এক পর্যায়ে ৮৩ তে ‘সাম্রাজ্যবাদী সংস্থা, টার্গেট গ্রুপ ও কৃষক মুক্তি’ শিরোনামে একটা পুস্তিকা প্রকাশ করি। পরের বছরগুলোতে এনজিওর কাজ আরও অনেক বিস্তৃত হয়েছে। এখন আরও বড় আকারে সারাদেশে এ নিয়ে অনুসন্ধান কাজ শুরু করেছি।

এর মধ্যেই আমাকে খুঁজে বের করেছেন ক্যাথরিন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে এই বিষয় নিয়েই কাজ করছেন। এর মধ্যে কয়দিন কথা হয়েছে। আজ জাহাঙ্গীরনগরে এসেছিলেন। তার কাজ ও কাগজপত্র আমার গবেষণায় কাজে লাগবে। বেশ কিছু কাগজপত্র পেয়েছি ওর কাছ থেকে, আরও পাওয়া যাবে। 

৮.১১.১৯৮৬

গতকাল সকালে সেলিম ভাই  (সেলিম আল দীন) আর বাচ্চু ভাই (নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু) এর আমন্ত্রণে গ্রাম থিয়েটার দেখতে কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর এলাকায় রওনা হলাম বাপ্পীসহ। ট্রেনে ও কাল দিনে রাতে তাদের বহুজনের সাথে অনেক আলোচনা হলো।

গ্রাম থিয়েটার এখনও তরল অবস্থায় আছে। শক্ত কাঠামোর জন্য কাজ চলছে। তবে এর মধ্যে ৫০টি গ্রামে গ্রাম থিয়েটার কাজ করছে। অবস্থা দেখে মনে হলো এই গ্রাম সংগঠনগুলো গড়ে উঠা, তার মধ্যকার প্রবল উৎসাহ সঞ্চার সম্ভব হয়েছে ঢাকা থিয়েটারের মত একটি সংগঠিত দলের অবস্থানের ফলেই। ফরীদি, আফজাল ও সুবর্ণাদের মত তারকাদের ইমেজও কম কাজ করেনি। রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী আবছা ভাবে আছে, দুজনই বললেন। মনে হলো গ্রাম থিয়েটারকে জনগণের সাংস্কৃতিক শক্তি, এখানকার শত শত বছরের দেশীয় ফর্মগুলো সামনে আনা, তার আধুনিকীকরণে সেলিম ভাইএর উৎসাহ এবং অঙ্গীকার সবচাইতে বেশি। তাঁর মধ্যেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। সাংগঠনিক সভাগুলোতেও তাঁর যে উদ্দীপনা দেখলাম তা সত্যিই উৎসাহব্যঞ্জক।

১৫.১১.১৯৮৬

১৩ ও ১৪ তারিখ ছিল উত্তরাঞ্চলীয় ওয়ার্কশপ, বগুড়ায়। আমি, উমর ভাই, দেবেনদা এবং ফিরোজভাই রওনা হলাম ১২ তারিখ সকালে করতোয়ায়। এখন এই আন্তনগর ট্রেন সার্ভিসগুলো খুব ভালো হয়েছে।..১৩ তারিখ ১০টার জায়গায় সাড়ে ১০ টায় শুরু হলো। ভেবেছিলাম বগুড়া শাখা আয়োজিত ওয়ার্কশপের ব্যাপারে হয়তো কেউ গুরুত্ব দেবে না। কিন্তু না, প্রায় সবগুলো শাখাই এসেছিল। দুদিন আলোচনা হয়েছে বিস্তর।

১৯.১১.১৯৮৬

হলের এক ছেলে আত্মহত্যা করেছে। কারণ এখনও জানা যায়নি।

….সরকার নির্লজ্জের মত মিথ্যাভাষণ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য সিদ্ধান্ত প্রকাশ করেছে। বেতন সংক্রান্ত কোনো দাবিই মানেনি। বরঞ্চ স্বায়ত্তশাসন খর্ব করেছে। এরকম আন্দোলনের পরিণতি এরকমই হয়।

২০.১১.১৯৮৬

লেখক শিবিরের ঐক্য প্রস্তাব নিয়ে আজকে আলোচনা হলো। ৪৫টি সংগঠনকে দাওয়াত করেছিলাম, এসেছিল ১২টা। সাম্যবাদী দল ও গ্রুপ, স্বাধীনতা পার্টি, মজদুর পার্টি, সবিপ এবং আমরা। শাহরিয়ার ভাই এসেছিলেন। তার এখন খুব আগ্রহ।

২৭.১১.৮৬

‘মাও সেতুং: চীনের দু:খ’, এত নিম্নমানের দায়িত্বজ্ঞানহীন লেখা। উপায় ছিল না, এর উপর আলোচনা লিখতে সময় দিতেই হলো।…মাও সে তুং সম্পর্কে আমাদের সমালোচনা আছে। কিন্তু এরকম মার্কিনী উদ্ধৃতি নির্ভর কুৎসা তো গ্রহণযোগ্য নয়।

২৯.১১.১৯৮৬

সকালে ক্লাস, বিকালে ঢাকায় সভা। খুবই বিপর্যস্ত অবস্থা। অর্থনৈতিক সংকট সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। আগামী মাসে বেতন ১ পয়সা পাবারও উপায় নাই।.. অর্থাগমের এত সুযোগ আর এত অর্থকষ্ট!

এতসব ঝামেলার মধ্যে বর্তমান তরুণ প্রজন্ম নিয়ে অনুসন্ধানমূলক লেখার কাজ শুরু করেছি- ‘এই সময়ের তরুণেরা’!  

১০.১২.১৯৮৬

জাহাঙ্গীরনগরে শিক্ষক-শিক্ষার্থী যৌথ জমায়েত হলো। প্রায় একবছর শিক্ষক আন্দোলনের একটি ইতিবাচক ফল হলো এই যে সাধারণ শিক্ষকদের মধ্যে থেকে আচ্ছন্নতা অনেক দূর হয়েছে।

৩১.১২.১৯৮৬

ঐক্য প্রচেষ্টার বেশ কয়দিন আলোচনার পর ঐক্য জোটের নাম ও কর্মসূচি ঠিক হলো- গণতান্ত্রিক বিপ্লবী জোট। সবিপ-র একটি অংশ খুবই আপত্তিকর ভঙ্গীতে কিছু অপ্রয়োজনীয় আপত্তি তুলছে।     

১৯৮৭ সালের কথা

১৯৮৭ শুরু হয় ক্লাস এবং ক্যাথারিনের সাথে এনজিও বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা দিয়ে।

এর পরের সপ্তাহে প্রচন্ড শীতের মধ্যে বাজিতপুরে ওয়ার্কশপ ছিল দুই দিনের। ইলিয়াস ভাই এবং মঞ্জু সরকারও গিয়েছিলেন।

সাংবাদিক সম্মেলনের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক বিপ্লবী জোট আত্মপ্রকাশ করে ১১ জানুয়ারি আর ঢাকায় হাজারখানেক মানুষ নিয়ে প্রথম জনসমাবেশ হয় ২৪ জানুয়ারি গণঅভ্যুত্থান দিবসে। এই সময়েই লিখি ‘কোটিপতি: মেড ইন বাংলাদেশ’ লেখাটি। বাংলাদেশে কোটিপতিরা ততদিনে অনেক স্পষ্ট অবস্থানে।

লেখক শিবির থেকে ‘শিল্প সাহিত্য ও মার্ক্সবাদ’ শিরোনামে তিনদিনব্যাপী আলোচনা অধিবেশন শুরু হলো ১৫ জানুয়ারি। প্রথম দিন নন্দনতত্ত্ব ও কথাসাহিত্য, দ্বিতীয় দিন কবিতা ও নাটক, তৃতীয় দিন চলচ্চিত্র ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন। গণনাট্য কর্মশিবির হলো তিনদিন ধরে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। জামিল আহমেদ পরিচালনা করলেন।

বর্ধিত বাসভাড়া নিয়ে আন্দোলন দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এই সময়ে। এবছরও ১৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্র মিছিলে পুলিশী হামলা হয়েছে। এর প্রতিবাদে ১৬ ফেব্রুয়ারি হরতালও হলো।

এই বছরের বইমেলায় প্রকাশিত হলো একাত্তরের ঘাতক ও দালালেরা কে কোথায় গ্রন্থটি। এর প্রধান কাজ করেছেন ‘মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিকাশ কেন্দ্র’ থেকে অধ্যাপক আহমদ শরীফ, লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির এবং সেক্টর কমান্ডার কর্ণেল কাজী নূরুজ্জামান। এসময়েই প্রকাশিত হয় আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের প্রথম উপন্যাস চিলেকোঠার সেপাই।

মার্চ মাসের ১ তারিখে জাহাঙ্গীরনগরে তিনদিনব্যাপী সেমিনার করলাম। প্রথম দিন ‘বেগম রোকেয়া ও নারী মুক্তি’, সন্ধ্যা ছিল মূল আলোচক। দ্বিতীয় দিন ‘মুক্তিযুদ্ধ ও বর্তমান পরিস্থিতি’ বললেন কর্ণেল কাজী নূরুজ্জামান। তৃতীয় দিন ‘বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন এবং স্ট্যালিন’, বললেন বদরুদ্দীন উমর। নতুন সাপ্তাহিক প্রহর-এর জন্য লেখা।

২৪.৩.৮৭

এনজিও নিয়ে কাজের অংশ হিসেবে সকালে গেলাম প্রশিকা অফিসে। কাগজপত্র নিলাম, কথাবার্তা বললাম।.. গেলাম উবিনীগ অফিসে। ছোট হলেও প্রভাবশালী, ফরহাদ মজহারের সংগঠন এটি। শুনলাম তাঁর কথা, এখন প্রধান তৎপরতা এখানেই, বুঝতে সুবিধা হলো।

২৬.৩.৮৭

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান স্মৃতিসৌধে। কী প্রহসন- একাত্তরের ঘাতক দালালেরা রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে, সাংগঠনিক উদ্যোগে স্বাধীনতা দিবস পালন করছে!

৩.৪.৮৭

গত ৩০ তারিখ সকালে ঢাকা থেকে রওনা দিয়েছি। পাবনা ও রাজশাহী। বেলা ৩টায় দুলাই পুরান বাজারে নামলাম। মজিবর ভাই ছিলেন। দুজনে ওখান থেকে মাইল দেড়েক ভেতরে হেঁটে ‘সমতা সমিতি’তে গেলাম। অক্সফামের তহবিলে চলে। ১৭ হাজার ভূমিহীনের সংগঠন। প্রাকৃতিক দিক থেকে গ্রামটা সুন্দর। এলাকাতে ঢুকতেই বেশ ক’জন ভূমিহীন ঘিরে ধরলেন, মাটি কাটা কাজের লোক ভেবে। কোন গ্রামে মাটি কাটা হচ্ছে, রেট দিনে ১৫/১৬ টাকা হয়, কোথায় কোন ঠিকাদার ৩দিন কাজ করিয়ে ভেগেছে তাও। অক্সফামের টাকা বিশাল দারিদ্রের মধ্যে আলেয়ার মত। সমতার লোকজনদের সাথে দীর্ঘ আলোচনা করে কাজের পদ্ধতি, এলাকার অবস্থা, সমস্যা ইত্যাদি বোঝার চেষ্টা করলাম।…

সাঁথিয়া হয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছালাম ১ তারিখ বেলা ৩টায়। হাসান ভাই থাকার ফলে এই ক্যাম্পাসে ২০/২৫ জন শিক্ষকের একটা দল দাঁড়িয়ে গেছে যারা প্রগতিশীল চিন্তা চর্চার সাথে জড়িত।.. পরদিন সেমিনার ছিল এনজিওর উপর।

১৩.৪.৮৭

জাহাঙ্গীরনগরে পর পর দুদিন আলোচনা সভা। প্রথম দিন- ‘বিরাষ্ট্রীয়করণ, লুটেরা পুঁজি এবং আমাদের করণীয়’ এবং দ্বিতীয় দিন ‘মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক শক্তির পুনরুত্থান এবং আমাদের করণীয়’। ভর্তি পরীক্ষা।

ভারতের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সুযোগ নিতে চাচ্ছে জামায়াত ও এরশাদ সরকার। এর বিপরীতে বিভিন্ন কর্মসূচি। 

৩.৭.৮৭

সকালে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে গিয়েছিলাম তাদের ব্যাপারে সর্বশেষ তথ্য আনতে। আগেই সন্ধ্যার সঙ্গে কথা হয়েছিল। আজকেই সব তথ্য দেবার কথা ছিল। কিন্তু গিয়ে জানলাম যে, ডা. জাফরুল্লাহর সঙ্গে কথা না হলে হবে না। তাঁর সাথে তখন বসেছিলেন সৈয়দ হাশেমী ও হোসেন জিল্লুর রহমান। আমার জিজ্ঞাসা উত্থাপন করতেই ডা. জাফরুল্লাহ পরিষ্কার ভাবে জানিয়ে দিলেন, তথ্য দেয়া যাবে না। কেন দেয়া যাবে না সেটাও তিনি বলবেন না।

১২.৭.৮৭

সকাল ৬টা থেকে শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ এবং অন্যান্য আরও শ্রমিক কর্মচারী সংগঠনের ডাকে সর্বাত্মক ধর্মঘট শুরু হয়েছে। এখনও চলছে, আগামীকাল সকাল ৬টা পর্যন্ত। পূর্ণ হরতালের মতো। এর মধ্যে সরকার জেলা পরিষদ সামরিকীকরণের বিল আজকেই সংসদে পাশ করলো। সংসদে হট্টগোল হয়েছে কিন্তু পদত্যাগের খবর পাইনি। আওয়ামী লীগ, জামায়াত এবং সিপিবি এখনও আছে সংসদে।                   

১৩.৭.৮৭

আজও দুপুর পর্যন্ত হরতাল গেল। আগামীকালও হরতাল আহবান করা হয়েছে। …সংসদ সদস্যপদ রাখা দরকার পারমিট, ট্যাক্স ফ্রি গাড়ীর জন্য।

২৪.৭.৮৭

খুবই সফল হরতাল হয়েছে গতকাল। ঢাকাসহ সর্বত্র সাধারণ মানুষ পুলিশ ও জাপার সশস্ত্র গুন্ডাদের বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ সৃষ্টি করেছেন তা অসাধারণ। মতিঝিল এলাকায় পুলিশ ও গুন্ডাদের ধাওয়া করার, রাইফেল ভাঙার, তাড়া খেয়ে সশস্ত্র ব্যক্তিদের গাড়ী ফেলে পালানোর একাধিক ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু নিহত হয়েছেন ১১জন। 

জনগণ বারবার নিজেদের বিক্ষোভ অসন্তোষ নিয়ে বেরিয়ে আসছেন। কিন্তু তাদের সংগঠিত শক্তি নেই। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নিজেদের ক্ষমতার জন্য পারস্পরিক সন্দেহ অবিশ্বাস নিয়ে বর্তমান সরকারকে ফেলতে পারার অবস্থাকেও দুর্বল করে দিচ্ছে। এদের এই লক্ষ্য বাস্তবায়ন সামরিক বাহিনীর কোনো না কোনো অংশের অংশীদারীত্ব ছাড়া কিছু নয়। এরা আন্দোলন করছে যে লক্ষ্যে তা জনগণের নয়। অথচ আমাদের এবং আরও দুএকটি সংগঠন বাদে বাকি সব বামপন্থী তাদের কর্মসূচীকেই উর্ধ্বে তুলে রাখছে। 

৩১.৭.৮৭

গত কদিন থেকে প্রবল বর্ষণ হচ্ছে। ১৯টা জেলা ইতিমধ্যেই বন্যা কবলিত। মারাও গেছেন কজন। এরকম পরিস্থিতিতে অসহায় লাগে। প্রায়বছরই এরকমভাবে প্রকৃতির ভয়াবহ শিকার মানুষ, কিছু মুষ্টিমেয় লোকের জন্য- এই রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য।…

১৩.৮.৮৭    

সারাদিন ঢাকায় ওয়ার্কশপ ছিল। সন্ধ্যায় ছিল ১৭টি কৃষক ও ক্ষেতমজুর সংগঠনের যৌথ সভা। ন্যূনতম দাবিদাওয়ার ভিত্তিতে একসঙ্গে কাজ করা বিষয়ক। পরশুদিনও এ বিষয়ে সভা ছিল। আজকের সভায় যুক্ত বিবৃতি চূড়ান্ত হলো। অনেক রাত পর্যন্ত সভা ছিল। সভায় আবদুল মতিন, অমল সেন, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমসহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন।

বন্যা নিয়ে প্রকাশনা, ত্রাণ কর্মসূচী।

১৮.৮.৮৭

বন্যার অবস্থা খুব খারাপ দিকে মোড় নিচ্ছে। ঢাকা আরিচা সড়কের ওপর এখন পানি। মনে হয় আজ রাতে পানি আরও বাড়বে। ঢাকার বাইরে কয়েকটি জেলা বাদে বাকিগুলো বন্যাক্রান্ত। এভাবে চললে কদিনের মধ্যে ঢাকার সঙ্গে সব জেলার সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। অসহায়, শ্রান্ত এবং প্রান্তস্থ মানুষ এই অবস্থা কী করে সামলাবেন? লুটপাটে ফোকলা অর্থনীতির পক্ষে এই ক্ষয়ক্ষতি সামাল দেয়া খুব কঠিন। বন্যার পর কী অবস্থা হবে চিন্তা করতেও ভয় লাগছে। অব্যাহত লুটপাট কীভাবে প্রকৃতির কাছে কোটি কোটি মানুষকে জিম্মি করে রাখে! যে সমস্যার সমাধান সম্ভব তারও সমাধান হয় না।

১৯.৮.৮৭

এরশাদ জাতীয় ছাত্রসমাজ নিষিদ্ধ করলো, কেন তা পরিষ্কার নয়। অনেকরকম সম্ভাবনা আছে। কিন্তু এ নিয়ে রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে তুমুল গন্ডগোল হলো। ৮ দলীয় ছাত্রজোট বিনা প্রস্তুতিতে এদের খোঁচা দিয়ে আক্রান্ত হবার পর গরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও মনোবল ও প্রস্তুতির অভাবে পালিয়েছে। 

২২.৮.৮৭

বন্যা পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে। জিনিষপত্রের দাম হু হু করে বাড়ছে। এক ধরনের অস্থিরতা সর্বক্ষণ মাথার মধ্যে চেপে আছে। এই বন্যা, এরপর কোটি মানুষের প্রান্তস্থ জীবনের পতন, দুর্ভিক্ষ ইত্যাদির মুখোমুখি করে দিচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এখন অনেক ঘুরে ঢাকায় যেতে হয় ৩ ঘন্টায়। পরশু গেলাম ১৭টি কৃষক ও খেতমজুর সংগঠনের সাংবাদিক সম্মেলনে, গতকাল ত্রাণ সামগ্রী সংগ্রহে।

২৭.৮.৮৭

একটানা বর্ষণ হচ্ছে। কিছু ত্রাণ সামগ্রী কিনলাম। ২৪ মণ চাল, ৫ মণ ডাল, ২ মণ লবণ, ম্যাচ। নগদ টাকাও দিতে হবে।

২৮.৮.৮৭

ভোর সাড়ে ৫টায় ঘুম থেকে উঠেছি। রওনা হয়েছি সাড়ে ৬টায়। ফিরেছি রাত প্রায় ১০টায়। শিক্ষক সমিতি থেকে ত্রাণ কাজে গিয়েছিলাম আরিচা থেকে ভেতরে নদী তীরবর্তী ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামগুলোতে। গ্রামগুলো হচ্ছে গঙ্গাদিয়া, চরধুবলিয়া, গোয়ারিয়া, জাফরগঞ্জ, তেওতা। বেশিরভাগই যমুনার ভাঙনের শিকার।

যাদের মধ্যে ত্রাণ সামগ্রী দিলাম, তাদের অবস্থা বলার মত কিছু নাই। বন্যা না হলেও তাদের অবস্থা বলার মত কিছু ছিল না। কোনরকম খুপড়ি ছিল, ঘর নামের প্রহসন। সেগুলোও ভেঙে গেছে। এক জায়গায় নেমে ঘুরে ঘুরে ভাঙা ঘরের মালিকদের কিছু নগদ টাকাও দিলাম। কিন্তু যাদের ঘর ভাঙেনি তাদের অবস্থা ভাল এটা কোনমতেই বলা যাবে না।

সংগঠনের মুখপত্র হিসেবে ‘প্রস্তুতি’ প্রকাশিত হলো। মূল দায়িত্ব নিয়েছে মাহবুব। এর আগে আমাদের সব প্রকাশনা- সংস্কৃতি, সাংস্কৃতিক আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন ছাপা হয়েছে পুরনো প্রযুক্তিতে। সেটাই তখন ব্যবস্থা ছিল। দীর্ঘ সময় নিয়ে অক্ষর বসানো, বড় কাগজে কালিমাখা হয়ে প্রুফ দেখা, পরে ছাপা। এখন এই প্রথম কম্পিউটরে কম্পোজ হয়ে সেখানেই প্রুফ দেখা হলো। পুরনো প্রেসের সাথে যুক্ত মানুষদের জন্য হুমকি। অন্যদিকে নতুন কর্মসংস্থানও তৈরি হচ্ছে।

২১,৯.৮৭

পাবনা, ঈশ্বরদী, পাকশী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

১৮ তারিখ ভোরে আরিচা। তিন ঘন্টার ফেরী। ঘাটে নেমে পাবনার কোস্টার। ছাদ ভরা মানুষ। পাবনায় জেলা সম্মেলনের প্রস্তুতি সভা। পরদিন পাকশীতে রেলওয়ে শ্রমিক সংগঠন বারেকাপের সভা। রাতে ঈশ্বরদী। ভোরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। হাসান ভাই লেখক শিবিরের সভাপতি হতে অবশেষে রাজী হয়েছেন।

১০.১০.৮৭

গণতান্ত্রিক বিপ্লবী জোটের বিক্ষোভ সপ্তাহ শুরু হলো আজ।

১৮.১০.৮৭

১৩ তারিখ কুমারখালী কৃষক ফেডারেশনের সভা। ১৪ তারিখ খুলনায় লেখক শিবিরের সভা। ১৫ ও ১৬ তারিখ কর্মশিবির। ১৭ তারিখ দৌলতপুর কলেজ।

১৯.১০.৮৭

শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ ও টাফের আহবানে ৪৮ ঘন্টা ধর্মঘট শুরু। বকুলদা টাফের অবস্থান নিয়ে পোস্টার নিয়ে সারাদেশ ঘুরেছেন।

২৩.১০.৮৭

অর্থনীতি সমিতি ও জাবি অর্থনীতি বিভাগের যৌথ উদ্যোগে আঞ্চলিক সেমিনার। বিষয়- ‘শিক্ষা সংকট’। 

নভেম্বর ডিসেম্বর ১৯৮৭: গণপ্রতিরোধ

এই দুই মাস জুড়ে প্রায় একটানা হরতাল আর সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে। ৩রা নভেম্বর সরকার বিরোধী আন্দোলন থামানোর জন্য সারাদেশে ব্যাপক গ্রেপ্তার শুরু হয়। আমাদের সংগঠন থেকেও গ্রেপ্তার হয়। প্রথম দিনেই কুষ্টিয়া থেকে সজীব রায়, পাবনা থেকে আবু সাঈদ, জহুরুল হক গ্রেপ্তার হন।

আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধিতে ও সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি ঠেকাতে ৮ তারিখে সরকার ৯ ও ১০ তারিখ রেলওয়ে বন্ধ থাকবে বলে ঘোষণা করে। এর আগেই ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগের সব পথ ফেরী লঞ্চ কোচ সব বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ৯ তারিখ ভোর থেকে ১৪৪ ধারা জারী করা হয়েছে। বরিশালে জেলের মধ্যে হত্যা করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ আবার বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। নতুন বাংলা বা জাতীয় ছাত্র সমাজ বিলুপ্ত ঘোষণা করলেও তারা ঠিকই গুন্ডাবাহিনী হিসেবে কাজ করেছে। জাহাঙ্গীরনগরে মাইক্রোবাস নিয়ে মহাসড়কে গুন্ডামি ডাকাতি সবই করেছে।

ট্রেন, ফেরী, বাস বন্ধ রাখলেও ঢাকায় ১০ই নভেম্বর ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ১৫/২০ হাজার মানুষের সমাবেশ হয়। এদিনই নূর হোসেনসহ ৬ জন নিহত হন, আহত শতাধিক। ১১ ও ১২ তারিখ হরতাল ঘোষণা করা হয়, ১১ তারিখে প্রথমে খালেদা জিয়া ও পরে শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১২ তারিখ নাগাদ সারাদেশে দুজন পুলিশসহ ৬০ জন নিহত হবার খবর পাওয়া যায়। ১৪ ও ১৫ তারিখ আবার হরতাল আহবান করা হয়। জাবি শিক্ষক সমিতি থেকে আমরা ১২ তারিখ প্রতিবাদ সভা ও ১৪ তারিখ শিক্ষকদের মৌন মিছিল এবং গায়েবানা জানাজার আয়োজন করি। ২৩ ও ২৪ আবার হরতাল।

২৬.১১.৮৭

আমাদের ‘প্রস্তুতি’ দ্বিতীয় সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। এই সময়ে এর প্রকাশ খুব কাজে দেবে মনে হয়। আজ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক শিক্ষার্থী কর্মকর্তা কর্মচারী যৌথ সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল হলো। খুব ভালো হয়েছে।

শোনা যাচ্ছে দেশে জরুরী অবস্থা জারী হবে। এর অর্থ হচ্ছে সামরিক বাহিনী এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত এরশাদের পেছনে আছে। বস্তুত আন্দোলনের উপর আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নিয়ন্ত্রণ থাকার কারণে জনগণের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের সম্ভাবনা নাই। যেটা হবে সেটা হচ্ছে আন্দোলন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে সাম্রাজ্যবাদের অনুগ্রহপুষ্ট কাউকে ক্ষমতায় বসানো। এখন পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টাই চলছে। ধরপাকড় বৃদ্ধি পাচ্ছে। এবারের আন্দোলনে লক্ষণীয় দিক হচ্ছে খোদ এরশাদ বামপন্থী শক্তিগুলোর উপর বিষোদগার করছে বেশি।

৩০.১১.৮৭

গত কয়দিন খুব অস্বাভাবিক পরিস্থিতি গেল। ২৭ তারিখ শুক্রবার মিছিল, সভা করে এবং পরদিন সমাবেশের প্রস্তুতি নিয়ে ক্যাম্পাসে ফিরেছি। রাত ১০টায় আকস্মিকভাবে জরুরী অবস্থা জারীর ঘোষণা। সব রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ। কারফিউ রাত ১২ টা থেকে রোববার সকাল পর্যন্ত। এদিকে রোববার থেকে ৩ দিনব্যাপী হরতাল ঘোষণা করা আছে। ছাত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ হলো। আজ আমরা যৌথভাবে ক্যাম্পাসে সভা এবং মিছিল করলাম, জরুরী অবস্থার সব নিষেধাজ্ঞা ভেঙে। ঠিক হলো পরদিনও সভা হবে, বুধবার গায়েবানা জানাজা ও মৌন মিছিল হবে। নির্বিকার রাজনীতি ভীতু শিক্ষকেরাও আজকের মিছিলে ছিলেন।

১.১২.৮৭

ক্যাম্পাসে যৌথ কর্মসূচীর পথে বাধা হয়ে দাঁড়ালো ইসলামী ছাত্র শিবির। ২২ ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ, শিবির গ্রাম থেকে জমায়েত নিয়ে এল। বামপন্থীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা ছড়ানোর শ্লোগান দিতে থাকলো।

৮.১২.৮৭

জাবিতে শিক্ষক সমিতির নির্বাহী পরিষদের সভা করে জরুরী অবস্থা, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ইত্যাদির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে প্রস্তাব নেয়া হলো। বিভিন্ন রকম হুমকির মুখে বেশ কদিন সরে থাকতে হলো।

স্বৈরাচার টিকে থাকলো

১৯৮৭ সালের ১০ই নভেম্বর শ্রমজীবী যুবক  নূর হোসেন খালি বুকে পিঠে শ্লোগান লিখে এরশাদ পতন আন্দোলনের মিছিলে গিয়েছিলেন। লেখা ছিল- ‘স্বৈরাচার নীপাত যাক- গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। তিনি সেখানেই পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছিলেন। এই শ্লোগান আর তার জীবনদান গণঅভ্যুত্থানের পরিস্থিতিকে আরও তীব্র করে তুলেছিল। নভেম্বর মাসেই আন্দোলনের তাপে ১৯৮৬ সালের নির্বাচিত সংসদ থেকে আওয়ামী লীগ, সিপিবি, জামায়াত সহ বিরোধী সকল সদস্য একযোগে পদত্যাগ করায় সংসদ অকার্যকর হয়ে পড়ে। ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে এরশাদ সংসদ ভেঙে দেন। এরপর ৯ই ডিসেম্বর হাসিনা ও খালেদাকে মুক্তি দেয়া হয়। ততদিনে এরশাদ আবার গুছিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু মাস খানেকের মধ্যে আন্দোলনের নানা সমীকরণের ফাঁকে স্বৈরাচার টিকে যাবার রাস্তা খুঁজে নেয়। বোঝা গেল সামরিক বাহিনী এবং দেশি বিদেশি প্রভাবশালী গোষ্ঠী তার উপর সমর্থন তখনও তুলে নেয়নি।

এরপরও আন্দোলনের কর্মসূচি ছিল। ২২- ২৩ ডিসেম্বরেও হরতালের ডাক দেয়া হলো। কিন্তু প্রাণহীন। এদিকে এরশাদ বাহিনীর নতুন প্রাণপ্রাপ্তির পর তাদের প্রস্তুতি শুরু হলো নতুন বছরে একটা ভোটারবিহীন সংসদ নির্বাচনের।  (চলবে)

আনু মুহাম্মদ: সম্পাদক, সর্বজনকথা। ইমেইল: sarbojonkotha@gmail.com 

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •