মৌলবাদের সংঘর্ষ: ক্রুসেড, জিহাদ এবং আধুনিকতা-১০

মৌলবাদের সংঘর্ষ: ক্রুসেড, জিহাদ এবং আধুনিকতা-১০

এক সন্ত্রাসের সাগর

তারিক আলি

২০০২ সালে যখন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসী তৎপরতা অনেক বিস্তৃত এবং ইসলামি মৌলবাদ বিশ্বজুড়ে আলোচিত বিতর্কিত বিষয় তখন তারিক আলির বই The Clash of Fundamentalisms: Crusades, Jihads and Modernity প্রকাশিত হয়। তারিকের এই বই অনুসন্ধান করেছে ধর্মীয় বিভিন্ন মত-পথ, বিভিন্ন ধরনের মৌলবাদী শক্তি, তার ইতিহাস ও রাজনীতি এবং সর্বোপরি তার ভাষায় ‘সবচেয়ে বড় মৌলবাদী শক্তি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ’-এর সঙ্গে এর সম্পর্ক। সর্বজনকথার জন্য এই বই (প্রকাশক ভার্সো, 2003)-এর ধারাবাহিক অনুবাদ করছেন ফাতেমা বেগম। এবারে দশম পর্ব। এখানে আলোচিত হয়েছে ইরাকে মার্কিন নেতৃত্বে পশ্চিমা আগ্রাসনের প্রথম পর্বের বিভিন্ন দিক। উল্লেখ্য যে, ইরাকে দ্বিতীয় দফা আগ্রাসন ও গণহত্যার আগেই এই গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। 

১৯৮৭ সালের ডিসেম্বর মাসে পশ্চিম তীর এবং গাজায় একটি নতুন ফিলিস্তিনি ইন্তিফাদা শুরু হয়। জায়নবাদের নিশ্চয়তাকে চ্যালেঞ্জ করা এই ইন্তিফাদা ইসরাইলকে অস্থির করে ফেলে । আরব শাসকদের ধারণা ছিল অনেক আগেই এই সংগ্রামের ইতি ঘটেছে। তাই তারাও বিস্মিত হলো। ইন্তিফাদা ইনফিতাহকে চ্যালেঞ্জ করল।  

যথারীতি নিজার কাব্বানিই মানুষের অনুভূতি ধরতে পারলেন জনপ্রিয়তা লাভ করলেন। তিনি ট্রিলজি অব দ্য চিলড্রেন অব স্টোনস-এ ফিলিস্তিনিদেরকে তাদের নিজেদের শক্তির ওপর আস্থা রাখার পরামর্শ দিলেন:

পাথরের সন্তানেরা

আমাদের কাগজপত্র এলোমেলো করেছে

আমাদের জামাকাপড়ে কালি ছিটিয়েছে

পুরোনো গ্রন্থের সরলতাকে উপহাস করেছে…

কী ঘটিয়েছে

পাথরের সন্তানেরা

তারা কি শতবর্ষগুলোর তৃষ্ণার পর আমাদের বৃষ্টি এনেছে?

বহু শতাব্দীর অন্ধকারের পর আমাদের কাছে সূর্য এনেছে,

শত শত পরাজয়ের পর আমাদের আশা নিয়ে এসেছে…

তাদের সম্পর্কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়

হলো যে তারা বিদ্রোহ করেছে

পিতাদের কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে,

যে তারা বাধ্যতার ঘর থেকে পালিয়ে গেছে…

হে গাজার বাচ্চারা

আমাদের সম্প্রচারে কিছু মনে করবে না

আমাদের কথা শুনবে না

আমরা ঠান্ডা হিসাব-নিকাশের মানুষ

যোগ, বিয়োগের

যুদ্ধ কর এবং আমাদের একা ছেড়ে দাও

আমরা মৃত এবং সমাধিচ্যুত

দৃষ্টিহীন অনাথ।

গাজার সন্তানেরা

আমাদের লেখা উল্লেখ করবে না

আমাদেরকে পড়ো না

আমরা তোমাদের মা-বাবা

আমাদের মতো হয়ো না।

আমরা তোমাদের প্রতিমা

আমাদের পূজা করবে না।

হে গাজার পাগল মানুষ,

হাজারো সালাম পাগলকে

রাজনৈতিক যুক্তির যুগ

অনেক আগে অপগত

তাই আমাদের পাগলামি শেখাও।

ইরাকি সরকার প্রচুর আর্থিক সাহায্যসহ ফিলিস্তিনিদের পক্ষে জোর আওয়াজ তুলেছিল। ইসরাইলি তদবিরকারকরা এই ‘পাগলামি’র বিরুদ্ধে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টে  একটি জোরালো প্রচার শুরু করে। তারা সচেতন ছিল যে ফিলিস্তিনিরা যদি নুয়ে পড়তে অস্বীকার করে, তাহলে চিরন্তন গৌরবের স্বপ্ন দেখা একজন  উচ্চাভিলাষী  আরব নেতা তাদের নেতৃত্বদানের ঝুঁকি নিতে পারে । আরাফাত রাষ্ট্রহীন ছিলেন। তাকে ছাড় দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে, কিন্তু বাগদাদে ফিলিস্তিনিদের এই লোক, সে কি সত্যিই তাদের পক্ষের লোক ছিল নাকি কেবলই তার নিজের উচ্চাকাঙ্ক্ষা কাজ করছিল? ইসরাইলি তদবিরের চেষ্টা ফলপ্রসূ  হলো। ওয়াশিংটন নিশ্চিত হয়ে উঠল যে ইরাককে অস্ত্র দ্বারা পুনর্সজ্জিত করলে সে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। এটি অঞ্চলের সূক্ষ্ম  স্থিতাবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। তাই সাদ্দামের ডানা কাটতে হবে। কিন্তু তা কীভাবে?

কুয়েত আক্রমণ একটি স্বর্গ-প্রেরিত সুযোগ বয়ে আনে। কিন্তু তা আসলে কীভাবে হয়েছিল? ১৯২২ সালের ম্যান্ডেটের পর থেকে প্রতিটি ইরাকি সরকার  কুয়েতের কাছে তাদের নিজ অঞ্চল দাবি করছিল। প্রকৃতপক্ষে পূর্ববর্তী দুই হাজার বছর ধরে অঞ্চলটি বাগদাদ থেকে শাসিত হয়েছিল। বাগদাদের সঙ্গে তেল বিরোধে কুয়েতিরা উসকানিমূলক আচরণ করেছে—এ রকম একটি ধারণা ব্যাপকভাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। বা’থ নেতৃত্ব এমন একটি  পরিকল্পনা উপস্থাপন করে যা ইরাকের সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধার এবং চিরস্থায়ীভাবে  কুয়েতের সঙ্গে বিরোধ নিষ্পত্তি করতে পারত। কিন্তু সাদ্দাম হোসেনের ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে সতর্কতার কথা সবাই জানত। আগাম অনুমোদন ছাড়া তিনি খুব কমই কোনো বড় পদক্ষেপ নিয়েছেন। তাই এবারও তিনি তার প্রিয় প্রশ্নটি তুলে ধরলেন: ওয়াশিংটন কী ভাবছে?   

আজ অবধি ঊর্ধ্বতন ইরাকি কর্মকর্তারা জোর দিয়ে বলেন যে মার্কিন রাষ্ট্রদূত এপ্রিল গ্ল্যাস্পির সঙ্গে সাদ্দামের প্রাণঘাতী সাক্ষাৎটি একটি নির্ধারক ব্যাপার ছিল। গ্ল্যাস্পি ইরাকের পরিকল্পনা সম্পর্কে অবহিত  ছিলেন। তিনি এ ব্যাপারে সহানুভূতিশীল ছিলেন, এবং এই পরিকল্পনায় ডি ফ্যাক্টো অনুমোদন দিয়েছিলেন।  ১৯৯০ সালের ২ আগস্ট সাদ্দামের বাহিনীর আক্রমণে খুব সহজেই কুয়েতের পতন ঘটে। ক্ষমতাসীন আল-সাবাহ পরিবার পালিয়ে যায়। বাগদাদ যদি দ্রুত তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে নির্বাচনের ব্যবস্থা করে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করত তবে তা ব্যাপক জনসমর্থন লাভ করতে পারত। কিন্তু গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা তো বিবেচনার মধ্যে ছিল না। অনেক দিন যাবৎ ইরাকের জনগণের জন্য গণতন্ত্র অস্বীকৃত ছিল। তাই কুয়েতিদের তার অনুমতি দেওয়া খুবই বিপজ্জনক বিষয় ধরা হয়েছে। 

তা সত্ত্বেও, সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ইয়েভগেনি প্রিমাকভ, কুয়েত থেকে একতরফা ইরাকি প্রত্যাহারের জন্য  বাগদাদের সঙ্গে একটি চুক্তির জন্য আলোচনা শুরু করেছিলেন। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেই চুক্তি কার্যক্রমে বাধা দেয়। সেই সময়  দুর্বল রাশিয়া কোনো কিছুতেই জোর খাটানোর অবস্থানে ছিল না। উপসাগরীয় যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ওয়াশিংটনের  সাবেক মিত্র সাদ্দাম হোসেন তখন ‘আরব হিটলার’ হিসেবে চিহ্নিত হয়। পাশ্চাত্যের সংবাদমাধ্যমগুলো চুপচাপ  থাকে এবং কুয়েতের পতিত শাসকেরা একটি প্রচারণামূলক আক্রমণের বিষয় হয়ে ওঠে। সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের অপরাধে সাদ্দাম অভিযুক্ত  হলেন। আন্তর্জাতিক আইন এবং জাতিসংঘের সনদ লঙ্ঘন করার অপরাধে  জনসম্মুখে তাকে শাস্তি পেতে হয়েছিল। তিনি বুঝতে পারেননি যে  একমাত্র সাম্রাজ্যিক শক্তি সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের অধিকার রাখে। এই অধিকার অনুকরণে অন্য কাউকে উৎসাহিত করা হয় না। 

উদারপন্থিরা ইরাকের জনগণের প্রকৃত স্বার্থ রক্ষা করার জন্যই উপসাগরীয় যুদ্ধ প্রয়োজন বলে যুক্তি দিতে থাকলেন।  যুদ্ধের পর ওয়াশিংটন সীমিত সময়ের জন্য প্রত্যক্ষ শাসন করার পর বাগদাদে একটি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা  কায়েম হবে। আমাদেরকে বলা হয়েছিল যে সাম্রাজ্যবাদ, ‘ফ্যাসিবাদ’কে পরাজিত করে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করবে।  এবং সে কারণেই যুদ্ধ অগ্রাধিকার পাচ্ছিল। এই ‘মুক্তির প্রকল্প’টি কেবল ওয়াশিংটনের হাতেই নিরাপদ এবং এর আর কোনো বিকল্প ছিল না। যুদ্ধ শেষ হওয়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই এই বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি চুরমার হয়ে যায়। স্পষ্ট হয়ে যায় যে, দামেস্ক এবং কায়রোকে বাদ দিয়ে রিয়াদ ও উপসাগরীয় উপনদীতে ওয়াশিংটন বা তার সাগরেদরা কেউই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী নয়। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা কখনোই ওয়াশিংটনের বিবেচনার বিষয় ছিল না। সবসময় তার বেশি আগ্রহ ছিল ‘ভিয়েতনাম সিন্ড্রোমের অবসান’ করা এবং ইরাকের মেরুদণ্ড ভেঙে মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতার একটি নতুন ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা এবং এভাবে ফিলিস্তিন ও তার  প্রতিবেশীদের সঙ্গে স্থায়ী শান্তিতে সম্মত হওয়ার জন্য ইসরাইলকে রাজি করানো।

সাদ্দামকে উচিত শিক্ষা দেওয়া হয়েছিল। তাকে অপসারণ করা যেতে পারত।  কিন্তু থমাস ফ্রিডম্যানের  উদ্ধৃতিতে ‘লৌহমুষ্টির ইরাকি জান্তা’কে ক্ষমতায় রাখার প্রয়োজন ছিল। তাদের যুক্তি অনুযায়ী, এ ধরনের একটি শাসন ছাড়া, ইরাক একটি লেবাননে পরিণত হতে পারত। জাতিগত এবং সাম্প্রদায়িক প্রতিদ্বন্দ্বিতা দ্বারা দেশটি বিচ্ছিন্নতায় আক্রান্ত হতে পারত। গণতন্ত্রের জন্য কোনো চিন্তাভাবনা ছিল না। ইরানকে একটি ভগ্নি শিয়া প্রজাতন্ত্র দেওয়া যাবে না। সৌদি ও উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলো এবং  তেল  কোম্পানিগুলোও তা সহ্য করতে পারত না। উপসাগরীয় যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে সাদ্দামের জনপ্রিয় অভ্যুত্থান দমন বিষয়ে দৃষ্টি না দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা পরিবর্তে ইরাকের জনগণকে শাস্তি দেওয়ার জন্য একটি নিষ্ঠুর আয়োজন শুরু করে। প্রত্যাশা ছিল, শাস্তি পেয়ে ইরাকের জনগণ তাদের বিদ্যমান সরকারকে উৎখাত করতে উৎসাহিত হবে। কিন্তু এই পশ্চিমা নীতিগুলো তার বিপরীত ফলাফল এনেছিল। 

২০০০ সালের ২৩ মে, ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জিওফ হুনকে হাউস অব কমন্সে ইরাকের ওপর অ্যাংলো-আমেরিকান আক্রমণের ধরন সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলো। তিনি জবাব দেন:

১৯৯২ সালের পহেলা আগস্ট এবং ১৯৯৮ সালের ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে যুক্তরাজ্যের বিমানপ্রতি মাসে গড়ে .০২৫ টন করে দক্ষিণ নো-ফ্লাই জোনে মোট  ২.৫ টন ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছিল। জোটের মোট কত শতাংশের অংশীদার ছিল তা অনুমান করার জন্য এই সময়ের মধ্যেকার জোটের কার্যকলাপের পর্যাপ্ত বিশদ রেকর্ড আমাদের কাছে নেই। ১৯৯৮ সালের ২০  ডিসেম্বর  এবং ১৭ মে-র মধ্যে, যুক্তরাজ্যের বিমান দক্ষিণাঞ্চলীয় নো-ফ্লাই জোনগুলোতে প্রতি মাসে গড়ে ৫ টন হিসাবে মোট ৭৮ টন বোমা ছেড়েছিল । এই পরিসংখ্যান এই সময়ের জন্য জোটের মোট সহযোগিতার প্রায় ২০ শতাংশ প্রতিনিধিত্ব  করে৷

অন্য কথায়, আঠারো মাস ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য ইরাকের ওপর প্রায় ৪০০ টন বোমা এবং ক্ষেপণাস্ত্র বর্ষণ করেছে। টনি ব্লেয়ার তার কনজারভেটিভ পূর্বসূরি জন মেজরের চেয়ে বিশ গুণ বেশি হারে দেশটিতে  মারাত্মক বিস্ফোরক নিক্ষেপ করেছেন। এই বৃদ্ধির ব্যাখ্যা কি? এর তাৎক্ষণিক কারণ দুর্বোধ্য নয়। প্রতিনিধি পরিষদে মিথ্যাচার  এবং ন্যায়বিচারে বাধা দেওয়ার অভিযোগে ক্লিনটনের বিরুদ্ধে ১৯৯৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভোট হওয়ার প্রাক্কালে, ক্লিনটন ইরাকের ওপর একটানা চব্বিশ ঘণ্টা বিমান হামলা অনুমোদন করেন। জাতিসংঘের পরিদর্শনে সহায়তা করতে ব্যর্থতার জন্য বাগদাদের সরকারকে শাস্তি দিতে এই বিমান হামলা চলে বলে বলা হয়, আসলে অনাস্থা ভোট থেকে বাঁচার জন্য। একজন নাৎসি জেনারেলের নামে ‘অপারেশন ডেজার্ট ফক্স’ নামকরণটি যথাযথই হয়েছিল। সেটি  একটানা সত্তর ঘণ্ট ধরে আক্রমণ চালু রেখে একশটি লক্ষ্যবস্তু ধ্বংস করেছিল। 

অন্য কথায়, আঠারো মাস ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য ইরাকের ওপর প্রায় ৪০০ টন বোমা এবং ক্ষেপণাস্ত্র বর্ষণ করেছে। টনি ব্লেয়ার তার কনজারভেটিভ পূর্বসূরি জন মেজরের চেয়ে বিশ গুণ বেশি হারে দেশটিতে  মারাত্মক বিস্ফোরক নিক্ষেপ করেছেন।

আগুনের ঝড় থামে না, চলতে থাকে। ১৯৯৯ সালের আগস্ট মাসে নিউ ইয়র্ক টাইমস রিপোর্ট করেছে:

আমেরিকান যুদ্ধবিমানগুলো কার্যত কোনো প্রকাশ্য আলোচনা ছাড়াই ইরাকে আক্রমণ করছে।  গত আট মাসে, আমেরিকান এবং ব্রিটিশ পাইলটরা ইরাকে ৩৫৯টি লক্ষ্যবস্তুর বিরুদ্ধে ১ হাজার ১০০টিরও বেশি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে।  ডিসেম্বরের চার দিনের ক্ষিপ্র আক্রমণের তুলনায় তিন গুণ বেশি লক্ষ্যবস্তুতে আক্রমণ হয়… অন্য একটি পরিমাপ অনুসারে, ন্যাটোর পাইলটরা একটানা আটাত্তর  দিনের যুদ্ধে যুগোস্লাভিয়ার ওপর দিয়ে যতগুলো  মিশনে উড়েছিল,  পাইলটরা ইরাকে তার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ উড়েছে।

১৯৯৯ সালের অক্টোবরে আমেরিকান কর্মকর্তারা ওয়াল স্ট্রিট জার্নালকে বলছিল যে শিগগিরই তাদের লক্ষ্যমাত্রা শেষ হবে— ‘আমরা শেষ লক্ষ্যবস্তুতে পৌঁছেছি।’ বছরের  শেষ নাগাদ, অ্যাংলো-আমেরিকান বিমানবাহিনী ৬ হাজারেরও বেশি চক্কর দিয়ে ইরাকে ১ হাজার ৮০০টিরও বেশি বোমা ফেলেছিল। ২০০১ সালের প্রথম দিকে ইরাকে বোমাবর্ষণ ভিয়েতনামে মার্কিন আগ্রাসনের চেয়ে দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল৷

এক দশকের বিমান হামলায় ইরাকে যন্ত্রণা যা হয়েছিল তুলনায় স্থল ও সমুদ্র অবরোধ আরও বেশি দুর্ভোগ সৃষ্টি করেছে। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা  সমগ্র  আঞ্চলিক গড়ের চেয়ে ঊর্ধ্বে থাকা জনগণের পুষ্টি, শিক্ষা এবং জনসেবা ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে। ১৯৯০ সালের আগে দেশটির মাথাপিছু গড় আয় তিন হাজার ডলারের বেশি ছিল। আজ তা পাঁচশ ডলারের নিচে, যা ইরাককে পৃথিবীর অন্যতম দরিদ্র সমাজে পরিণত করেছে। পশ্চিমা আগ্রাসন ইরাকের  উচ্চস্তরের  সাক্ষরতা এবং উন্নত স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে। সামাজিক কাঠামো ধ্বংস হয়ে যায়। জনগণ মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত হতে থাকে। এর ভূমি ইউরেনিয়াম-সমৃদ্ধ যুদ্ধাস্ত্র দ্বারা  দূষিত হয়। ২০০১ সালের জাতিসংঘের পরিসংখ্যান অনুসারে, জনসংখ্যার প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষের বিশুদ্ধ পানির নিয়মিত প্রবেশাধিকার নাই এবং ৮০ শতাংশেরও বেশি  বিদ্যালয়ের অনেক মেরামত প্রয়োজন। ১৯৯৭ সালে FAO গণনা করেছিল যে ২৭ শতাংশ ইরাকি দীর্ঘস্থায়ী অপুষ্টিতে ভুগছে এবং ৭০ শতাংশ নারী রক্তাল্পতায় ভুগছে। ইউনিসেফ রিপোর্ট করেছে যে ইরাকের দক্ষিণ ও মধ্য অঞ্চলে যেখানে দেশের জনসংখ্যার ৮৫ শতাংশের বাস, উপসাগরীয় যুদ্ধ-পূর্ব সময়ের তুলনায় সেখানে শিশুমৃত্যুর হার দ্বিগুণ হয়েছে।

১৯৯০ সালের আগে দেশটির মাথাপিছু গড় আয় তিন হাজার ডলারের বেশি ছিল। আজ তা পাঁচশ ডলারের নিচে, যা ইরাককে পৃথিবীর অন্যতম দরিদ্র সমাজে পরিণত করেছে।

পরিকল্পিত অর্থনৈতিক শ্বাসরোধের ফলে মৃতের সম্পূর্ণ নির্ভুল সংখ্যা এখনো হিসাব করা যায় না । সেই কাজটি ইতিহাসবিদদের করতে হবে।  রিচার্ড গারফিল্ড বলেন, সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য  কর্তৃপক্ষের মতে, ‘১৯৯১ সাল থেকে পাঁচ বছরের কম বয়সীদের মধ্যে “অতিরিক্ত মৃত্যুর” একটি রক্ষণশীল অনুমান হবে তিন লাখ।’ অন্যদিকে, ১৯৯৭ সালে ইউনিসেফের প্রতিবেদন বলে যে ‘পাঁচ বছরের কম বয়সী ৪ হাজার ৫০০  জন শিশু প্রতি মাসে ক্ষুধা এবং রোগের কারণে মারা যাচ্ছে’ – সেই গণনায়  পাঁচ লাখ ছোট শিশুর মৃত্যু হিসাব করা হয়। অন্যান্য মৃত্যুর সংখ্যা নির্ণয় করা কঠিন। গারফিল্ড উল্লেখ করেছেন,

‘ইউনিসেফের গণনায় মৃত্যুর হার সমুদ্রে  ভাসন্ত বিরাট তুষারস্তূপের কেবল অগ্রভাগ দেখায়। প্রতি পাঁচজন ইরাকির মধ্যে চারজন তাদের পঞ্চম জন্মদিনের পরে বেঁচে থাকে চরম আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে।‘

১৯৯৭ সালে ইউনিসেফের প্রতিবেদন বলে যে ‘পাঁচ বছরের কম বয়সী ৪ হাজার ৫০০  জন শিশু প্রতি মাসে ক্ষুধা এবং রোগের কারণে মারা যাচ্ছে’ – সেই গণনায়  পাঁচ লাখ ছোট শিশুর মৃত্যু হিসাব করা হয়।

১৯৯৮ সালের শেষের দিকে অর্থনৈতিক অবরোধের প্রতিবাদে  ইরাকের জন্য জাতিসংঘের মানবিক সমন্বয়কারী, একজন আইরিশ, সাবেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ডেনিস  হ্যালিডে পদত্যাগ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে অবরোধের কারণে মোট মৃত্যুর সংখ্যা ১০ লাখের বেশি হতে পারে। তার উত্তরসূরি হ্যান্স ভন স্পোনেক যখন অ্যাংলো-আমেরিকান বিমান হামলায় বেসামরিক হতাহতের ঘটনাগুলো অন্তর্ভুক্ত করে তার  বক্তব্যে তা প্রকাশ  করতে চেষ্টা করেন তখন ক্লিনটন এবং ব্লেয়ার সরকার তার বরখাস্ত দাবি করে। তিনিও পদত্যাগ করেন। ১৯৯৯ সালের শেষের দিকে তিনি ব্যাখ্যা করেন যে, ইরাকের জনগণের প্রতি তার দায়িত্ব ছিল এবং ‘প্রতি মাসেই ইরাকের সামাজিক কাঠামোতে আরও বৃহত্তর ফাটল সৃষ্টি হচ্ছে’। এই ফাটলগুলো ১৯৯৬  সাল থেকে অয়েল-ফর-ফুড নিষেধাজ্ঞার অধীন ছিন্নভিন্ন হয়ে চলেছে। এই  নিষেধাজ্ঞা ইরাককে বছরে চার বিলিয়ন ডলারের পেট্রোলিয়াম রপ্তানির অনুমতি দেয়, যখন ব্যাপকভাবে হ্রাস করা পরিষেবার জন্যও ন্যূনতম সাত বিলিয়ন ডলারের প্রয়োজন ছিল।১০ এক দশক পরে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য ইরাকের টুঁটি চেপে ধরে এমন একটি ফলাফল অর্জন করেছে যা আধুনিক  ইতিহাসে বিরল।  ‘গ্যারফিল্ড’ বলেন, গত দুইশ বছরের ইতিহাসে বিশ লাখের বেশি একটি স্থিতিশীল জনসংখ্যার এমন একটি একটানা বর্ধিত মৃত্যুহারে ইরাক হচ্ছে একমাত্র উদাহরণ।১১ 

১৯৯৮ সালের শেষের দিকে অর্থনৈতিক অবরোধের প্রতিবাদে  ইরাকের জন্য জাতিসংঘের মানবিক সমন্বয়কারী, একজন আইরিশ, সাবেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ডেনিস  হ্যালিডে পদত্যাগ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে অবরোধের কারণে মোট মৃত্যুর সংখ্যা ১০ লাখের বেশি হতে পারে।

একটি পুরো জনগোষ্ঠীকে সমষ্টিগত শাস্তি দেওয়ার জন্য এই প্রতিশোধমূলক হত্যাকাণ্ডের পক্ষে কী যুক্তি দেওয়া হয়? গৃহপালিত মিডিয়ার মাধ্যমে সরকারি তিনটি যুক্তি পুনরাবৃত্তি করা হয়। প্রথমত, সাদ্দাম হোসেন একজন অতৃপ্ত আগ্রাসী, যার কুয়েত দখল ছিল আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন এবং সমগ্র অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি; তাকে উৎখাত না-করা পর্যন্ত কোনো প্রতিবেশী নিরাপদ থাকবে না। দ্বিতীয়ত, তার সরকার মানববিধ্বংসী অস্ত্র মজুত করছিল এবং পারমাণবিক অস্ত্রাগার অর্জন করতে যাচ্ছিল যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য অশ্রুত বিপদ ডেকে আনছিল। তৃতীয়ত, ইরাকে  সাদ্দামের একনায়কত্ব বিরল এক মারাত্মক হিংস্রতা, খারাপ রাজনৈতিক কাঠামোর এক মূর্ত প্রতীক যার অব্যাহত অস্তিত্ব কোনো শালীন সরকার সমর্থন করতে পারে না। এসব কারণে সাদ্দামকে নির্মূল না-করা পর্যন্ত সভ্য বিশ্ব কখনোই বিশ্রাম নিতে পারে না। নিজেদের নাগরিকদের জন্য অনুচিত ঝুঁকি এড়িয়ে তাকে নির্মূল করতে বোমাবর্ষণ এবং অবরোধই একমাত্র উপায়।

এর প্রতিটি যুক্তিই একেবারে ভিত্তিহীন। প্রাক-ঔপনিবেশিক সময়ে প্রায়ই বসরা বা বাগদাদ থেকে নিয়ন্ত্রিত  কুয়েতে ইরাকি দখলদারিত্ব এই অঞ্চল বা বৃহত্তর বিশ্বে কোনো ক্ষোভ তৈরি করেনি।  ইন্দোনেশিয়ার পূর্ব তিমুর দখলকে পশ্চিমারা দুই দশকের উল্লেখযোগ্য সময়ে সাদরে গ্রহণ করেছিল যখন শাসক পরিবার কুয়েতে পালিয়ে যায়।  আরও স্পষ্ট উদাহরণ দেওয়া যাক। জাতিগত হত্যাকাণ্ডের প্রক্রিয়ার ওপর প্রতিষ্ঠিত একটি রাষ্ট্র ইসরাইল, খোদ মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘদিন ধরে ফিলিস্তিনের তুলনামূলক সমান বিভক্তিকরণে জাতিসংঘের বাধ্যতামূলক প্রস্তাবগুলো অমান্য করেছে, বারবার প্রতিবেশী ভূখণ্ডের বিশাল এলাকা দখল করেছে। এই দখল কেবল গাজা স্ট্রিপ, পশ্চিম তীর এবং গোলান হাইটসেই সীমিত নয়, তা দক্ষিণের লেবাননেও সম্প্রসারিত হয়েছিল। এই সম্প্রসারণবাদকে প্রতিহত করা তো  দূরের কথা; মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এর প্রতি সমর্থন, অস্ত্রায়ন এবং অর্থায়ন অব্যাহত রেখেছে। ইউরোপীয় মিত্রদের, বিশেষত ব্রিটেনের কাছ থেকে কোনো আপত্তি আসেনি।  এই প্রক্রিয়ার  সমাপ্তিপর্ব এখন বিশ্ববাসীর কাছে দৃশ্যমান। কারণ, ইসরাইলের খুশিমতো ফিলিস্তিনিদেরকে সংকুচিত কিছু বান্তুস্তানে (দক্ষিন আফ্রিকার বর্ণবাদী বিভাজনের মতো) হ্রাস করার কাজটি ওয়াশিংটনই তদারক করছে। তাই শিক্ষা এমন নয় যে আগ্রাসী আঞ্চলিক সম্প্রসারণ অবশ্যই একটি অপরাধ যার মূল্য দিতে হবে। বরং এটাই  যে, এই কাজ করতে গেলে পশ্চিমের স্বার্থও তাতে থাকতে হবে। ইরাকের কুয়েত দখল করা পশ্চিমাদের স্বার্থে ছিল না।  কারণ তাতে স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতিতে চলা একটি আধুনিক আরব রাষ্ট্রের  নিয়ন্ত্রণে বিশ্বের তেলের ভান্ডারের দুই-পঞ্চমাংশ চলে যাওয়ার হুমকি সৃষ্টি হয়েছিল। কুয়েত, উপসাগর  বা সৌদি আরবের সামন্তপ্রভুদের সঙ্গে পশ্চিমের সেই সমস্যা ছিল না। তাই মরুভূমিতে ঝড় উঠেছিল।    

সম্প্রসারণবাদের জন্যই এত কিছু। ইরাকি অস্ত্র কর্মসূচি থেকে মারাত্মক হুমকির বিষয়টি তেমন কিছু ছিল না। বাগদাদের শাসক তার নিজ দেশের কমিউনিস্টদের চূর্ণ করেছে এবং বিদেশে ইরানি মোল্লাদের সঙ্গে লড়াই করেছে। তাই প্রায় বিশ বছর ধরে এই শাসক ওয়াশিংটন এবং লন্ডনে বন্ধু হিসেবে বিবেচিত ছিল। এই বন্ধুত্বের সময়কালে তার অস্ত্র সমাবেশ নিয়ে পশ্চিমের আশঙ্কা খুব সীমিত ছিল: রাসায়নিক অস্ত্রগুলো ব্যবহার করার ব্যাপারে অভিযোগ  ছিল না, রপ্তানি লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল, এবং প্রশ্নবোধক রপ্তানি চালানগুলো দৃশ্যমান হয়েছিল। ইরাকের পারমাণবিক সক্ষমতার প্রশ্নটিও আশঙ্কামূলক ছিল না। ষাটের দশক থেকে বড় শক্তির একচেটিয়া স্বার্থে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চেয়েছিল পারমাণবিক সক্ষমতা যেন কম রাষ্ট্রে সীমিত থাকে। ইসরাইল, স্বাভাবিকভাবেই, এই ‘অ-প্রসারণ’-এর প্রয়োজনীয়তা থেকে মুক্ত ছিল। সে পশ্চিমের সামান্যতম প্রতিবাদ ছাড়াই কেবল একটি বড় অস্ত্রাগার মজুত করা নয়, তার কর্মসূচি গোপন করার ক্ষেত্রে সক্রিয় সমর্থনও উপভোগ করছে। 

যখনই উপসাগরে ইরাকের সরকার পশ্চিমা স্বার্থের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, তখনই তার পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের সম্ভাবনাটি হঠাৎ করে মার্কিন এজেন্ডায় একটি সর্বনাশা বিপদের মর্যাদায় অবস্থান গ্রহণ করে। আজ এই ভয়ের উৎসের কোনো ছিটেফোঁটা অবশিষ্ট নেই। একদিকে বৃহৎ শক্তিগুলোর পারমাণবিক একচেটিয়া  আধিপত্য যা  সর্বদাই একটি বিভ্রান্তিকর ভান ছিল তা ভারত ও পাকিস্তানের পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনের মাধ্যমে ভেঙে পড়েছে।  ইরানও শিগগিরই তা অনুসরণ করবে তাতে সন্দেহ নেই। অন্যদিকে ইরাকের নিজস্ব পারমাণবিক কর্মসূচি এতটাই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে নির্মূল করা হয়েছে যে এমনকি ইউএনএসকম ইন্সপেক্টর স্কট রিটার — যিনি ইসরাইলি গোয়েন্দাদের সঙ্গে তার সহযোগিতার জন্য গর্বিত ছিলেন এবং ডেজার্ট ফক্সের সূচনাকারী অভিযানগুলো ব্যবস্থা করেছিলেন — তিনি এখন বলছেন যে এর পুনর্গঠনের কোনো সুযোগ নেই, এবং তাই অবরোধ প্রত্যাহার করা উচিত।

সবশেষে দাবি করা হয় যে সাদ্দামের শাসনামলে অভ্যন্তরীণ শত্রুতা এতটাই চরম ছিল যে তার থেকে পরিত্রাণ পেতে  যে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। যেহেতু উপসাগরীয় যুদ্ধ বাগদাদের ওপর মার্চ ছাড়াই শেষ হয়েছে, তাই ওয়াশিংটন এবং লন্ডনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা থেকে বিরত থেকেছে। তবে তারা প্রতিটি অনানুষ্ঠানিক ব্রিফিং এবং অভ্যন্তরীণ ভাষ্য দিয়ে তা প্রকাশ করে। ‘সাদ্দাম একজন আরব হিটলার’, এই আখ্যানবস্তু বামদের একাংশের কাছে সর্বোচ্চ গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। এবং যেহেতু ‘ফ্যাসিবাদ সাম্রাজ্যবাদের চেয়েও খারাপ’, তাই সমস্ত বুদ্ধিমান লোকদের কৌশলগত এয়ার কমান্ডের পেছনে ঐক্যবদ্ধ হওয়া উচিত। যুক্তির এই বাক্যটি আসলে  অবরোধের চূড়ান্ত ঘোষণা দেয়; ক্লিনটনের ভাষায়: ‘সময়ের শেষ না হওয়া পর্যন্ত বা সাদ্দাম যতদিন থাকবে ততদিন নিষেধাজ্ঞা থাকবে।’১২ 

বা’থ শাসন নিঃসন্দেহে নৃশংস অত্যাচারী ছিল। তবে সাদ্দাম মিত্র থাকাকালীন কিন্তু পশ্চিমা মন্ত্রীবর্গ সে ব্যাপারে উদাস ছিল। যেন নিষ্ঠুরতায় অনন্য এটি একটি কল্পকাহিনি মাত্র। তুরস্কে অনেক কুর্দির বসবাস।  তবে সেখানে স্কুলে কুর্দি ভাষা অনুমোদিত নয়। এবং সেনাবাহিনী কুর্দি জনসংখ্যার বিরুদ্ধে যুদ্ধে দুই মিলিয়ন মানুষকে তাদের জন্মভূমি থেকে বাস্তুচ্যুত করেছে। কুর্দি প্রসঙ্গে ইরাকের চেয়ে তুরস্কের ভূমিকা সবসময় খারাপ ছিল। সাদ্দামের অন্যান্য অপরাধ যা-ই হোক না কেন, এ ধরনের সাংস্কৃতিক বিনাশের কোনো চেষ্টা কখনো হয়নি। তবুও ন্যাটোর সদস্য এবং ইইউর প্রার্থী হিসেবে, আঙ্কারার বিরুদ্ধে সামান্যতম ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি, বরঞ্চ দমন প্রক্রিয়ায় তুরস্ক পশ্চিমা সাহায্যের ওপর নির্ভর করতে পেরেছে। ওকালানের অপহরণের সঙ্গে ভানুনুর অপহরণের  সাদৃশ্য তৈরি করে আধুনিকতার দিকে তুরস্কের দায়িত্বশীল অগ্রগতি সম্পর্কে অ্যাংলো-আমেরিকান মিডিয়া খুবই আরামের প্রতিবেদন করে। ডিমোনাতে একটি পূর্ব আক্রমণের পর কে লেক ভ্যানের আশপাশে অপারেশন আরজেন্ট রেসকিউ, বা আদানার ওপর একটি নো-ফ্লাই জোনের পরামর্শ দিয়েছে?  

আন্তর্জাতিকভাবে কুর্দিদের অবস্থা সবচেয়ে বেশি মনোযোগ আকর্ষণ করে থাকলেও, বা’থ নিপীড়ন অবশ্যই ইরাকের আরব জনগোষ্ঠীর ভাগ্যকে রেহাই দেয়নি। কিন্তু এর দক্ষিণ সীমান্তে পশ্চিমা মিত্রের বিষয় কী? হার্ভার্ড মানবাধিকার, বা ওয়েস্টমিনিস্টার নির্বাচন প্রসঙ্গে যা বোঝে তা পালনে সৌদি সাম্রাজ্য কোনো ভানও করে না। নারীর অধিকার সম্পর্কে তো কথাই নেই, সৌদি আরবে যার অবস্থা মধ্যযুগের রাশিয়ার চাইতেও খারাপ। তবুও ওয়াশিংটনে আরব বিশ্বের আর কোনো রাষ্ট্রই ইরাকের চেয়ে বেশি সমালোচিত  হয়নি। হত্যা ও নির্যাতনের ক্ষেত্রে, সাদ্দাম কখনোই সুহার্তোর সমতুল্য ছিল না।  ইন্দোনেশিয়ায় সুহার্তোর গণহত্যা ইরাকের যে কোনো নৃশংসতাকে ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের আর কোনো শাসক পশ্চিমাদের কাছে সুহার্তোর চেয়ে বেশি সমাদৃত ছিল না। সুহার্তোর রক্তাক্ত সূচনা থেকে শুরু করে সেই বছরগুলোতে, যখন সাদ্দামের শাসনকে এমন অপরাধ ঘোষণা করা হয়েছিল যে তার অপসারণ সমগ্র ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের’ একটি নৈতিক বাধ্যতা ছিল, তখন পর্যন্ত এই আদর-যত্ন অব্যাহত ছিল।। ১৯৯৫ সালে, আমেরিকান এবং ব্রিটিশ বিমানশক্তি যখন বাগদাদে অবৈধদের ওপর আঘাত হানছিল, তখন ক্লিনটন এবং গোর জাকার্তা থেকে একজন পুরোনো বন্ধুকে সাদরে  গ্রহণ করছিলেন।১৩

লন্ডন থেকে ব্লেয়ার ইন্দোনেশিয়ার একনায়ক সরকারকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত অস্ত্র পাঠাচ্ছিলেন, এবং সুহার্তোর পতনের ঠিক প্রাক্কালে লন্ডনে ইউরো-এশীয় শীর্ষ সম্মেলনে তিনি তার শাসনকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। সেই তুলনায় বার্মিজ জান্তা সরকারের নিপীড়ন তুলনামূলক কম হলেও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের প্রতি আগ্রহ কম থাকায় তাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

কিন্তু যদি ইরাকে বোমাবর্ষণ এবং অবরোধের জন্য বিন্দুমাত্র যুক্তি গ্রহণযোগ্য না হয়, তবে তাতে কী? অন্য রাষ্ট্রগুলো সমানভাবে সম্প্রসারণবাদী হতে পারে, আরও কার্যকরভাবে পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র  স্থাপনা করতে চাইতে পারে, তাদের ব্যাপক সংখ্যক নাগরিকদের ওপর নিপীড়ন বা  হত্যাকাণ্ড চালাতে  পারে। কিন্তু তাতে কী? এক আঘাতে সব অন্যায়কে নিরাময় করা যায় না। এখানে ন্যায়কার্যের ব্যর্থতা অন্যখানের অন্যায়কে মেরামত  করতে পারে  না। তবে কখনোই সঠিক কাজ না করার চেয়ে অন্তত একবার কি তা করা ভালো নয়? কোনো একক মান না থাকার  চেয়ে বরং দ্বিমুখী মান থাকুক। যখন সৌদি, ইসরাইলি, ইন্দোনেশিয়ান, তুর্কি বা অন্য কোনো বিরূপ বাস্তবতা অস্বীকার করা অসম্ভব হয়ে পড়ে তখন  ক্লিনটন এবং ব্লেয়ার শাসনের অনুগত ফাইফরমাশ খাটা লোকজন, কলামিস্ট এবং দরবারিদের মধ্যে এমনই গোঁড়া কূটতর্ক শোনা যায়। ব্লেয়ারের পররাষ্ট্রবিষয়ক ব্যক্তিগত সহকারী, সাবেক কূটনীতিক রবার্ট কুপার, বেশ খোলামেলাভাবে লিখেছেন, ‘দ্বিমুখী মানের ধারণায় আমাদের অভ্যস্ত হওয়া দরকার।’১৪  

এসব যুক্তির অন্তর্নিহিত বার্তা হলো: আমরা আমাদের শত্রুদের অপরাধের শাস্তি দেব এবং আমাদের বন্ধুদের অপরাধকে পুরস্কৃত করব। এটা কি অন্তত সর্বজনীন দায়মুক্তির চেয়ে পছন্দনীয় নয়? এর উত্তরটি সহজ: এই প্রেক্ষিতে ‘শাস্তি’ অপরাধ কমায় না, বরং তা অপরাধের জন্ম দেয়। উপসাগরীয় এবং বলকান যুদ্ধগুলো একটি বাছাই করা সতর্কতার নৈতিক ফাঁকা চেকের হুবহু উদাহরণ।

যুগোস্লাভিয়ায় কোনো কৌশলগত খনিজ ছিল না বলে দুটি ব্যাপার এক নয়। কিন্তু যদি তাদের উৎস ভিন্ন হয়, তাহলে একটি একক মতাদর্শ উভয়কেই গ্রহণ করে। এ ব্যাপারে কুপারের স্পষ্ট ব্যাখ্যা প্রশংসনীয় ছিল। একদিকে, তিনি দ্বিধাহীন ব্যাখ্যা করেন যে ‘ইরাকের আন্তর্জাতিক আচরণের নিয়ম লঙ্ঘন উপসাগরীয় যুদ্ধের কারণ ছিল না’। তিনি বলেন, অন্যান্য রাষ্ট্র দ্বারা এলাকা সংযুক্তিকরণ যথেষ্ট সহনীয় হতে পারে – যদি তা পশ্চিমের ‘অত্যাবশ্যক তেল সরবরাহ’-এর স্বার্থের ওপর শক্তভাবে আঁকড়ে ধরা থাকে। অন্যদিকে, তিনি যোগ করেন, পশ্চিমের উচিত এ ধরনের সুস্পষ্ট বস্তুগত স্বার্থের ক্ষেত্রে নিজেকে সীমাবদ্ধ না রেখে বরং আরও বিস্তৃত হওয়া। ‘উত্তর-আধুনিক’রাষ্ট্রগুলোর প্রতি তার উপদেশ: ‘হস্তক্ষেপকে প্রাক-আধুনিক জীবনের একটি বাস্তবতা হিসেবে মেনে নিন’, ‘এ ধরনের হস্তক্ষেপে  সমস্যার সমাধান না-ও হতে  পারে, কিন্তু তারা বিবেককে রক্ষা করতে পারে। এবং তাই হস্তক্ষেপ খারাপ হওয়া অবশ্যম্ভাবী নয়।’১৫ ন্যাটোর কসোভো আগ্রাসন নিয়ে আগাম লেখা হয়। সম্পূর্ণ অনুমেয়ভাবে, কসোভোকে ‘বাঁচানোর’ জন্য দৃশ্যমান উপলক্ষ্যের চেয়ে অনেক বেশি মৃত্যু, ধ্বংস এবং স্থায়ী জাতিগত নির্মূলের মাধ্যমে ‘বিবেক’-এর মূল্য নির্ধারিত হয়।  প্রকৃতপক্ষে, শব্দগুচ্ছ নিজেই প্রাণনাশক হলেও যেহেতু ন্যাটোকে কয়েক মাস ধরে বিমান হামলা চালিয়ে যেতে হয়েছিল তাই ‘বিশ্বাসযোগ্যতা’র প্রশ্নে বলকানে পশ্চিমা হস্তক্ষেপের বাস্তবতায় কিছুটা সমন্বয়ের প্রয়োজন ছিল। আনুষ্ঠানিকভাবে সেক্রেটারি-জেনারেলের কথায়, এটি কয়েক ‘ঘণ্টা’র ব্যাপার বলে প্রতিজ্ঞা করা হয়েছিল: ভালোভাবে  বলতে গেলে ‘মান বাঁচানো’র জন্য সমন্বয় প্রয়োজনীয় ছিল।     

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী তার সহযোগীদের কাছে গোপনীয় স্মারকলিপিতে এই বিষয়ের পেছনের মনোভাব গ্রাফিকভাবে প্রকাশ করেছেন— ‘মৌলিক সমস্যাগুলো আপাতদৃষ্টিতে আলাদা মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে সেগুলো সংযুক্ত৷  তারা মোটামুটি “আপনার পক্ষে” বলিষ্ঠতার সঙ্গে একত্রিত করছে এবং ব্রিটেনের পক্ষে দাঁড়িয়েছে।’ ব্লেয়ার আরও  বলেন: ‘প্রতিরক্ষা-বিরোধী অবস্থানে থাকলে নিঃসন্দেহে “ব্রিটেনের পক্ষে দাঁড়ানো” যুক্তিতে জয়ী হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।’ অনুরূপভাবে, ‘আশ্রয় এবং অপরাধ : এগুলো দেশপ্রেমের সঙ্গে সম্পর্কহীন বলে মনে হতে পারে; কিন্তু তার আংশিক কারণ হলো সমস্যাগুলোর বলিষ্ঠতা; আরও আংশিক কারণ যে তারা ব্রিটিশ প্রবৃত্তির গভীরে পৌঁছায়।’ প্রতিকার কী? ‘প্রতিরক্ষা বিষয়ে আমাদের শক্তি সম্পর্কে কসোভোর সন্দেহ দূর করা উচিত ছিল। এবং ‘আমরা রাজনৈতিক আশ্রয় এবং অপরাধের বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছি’।

বলকান যুদ্ধের শরণার্থীরা, এক ধরনের কঠোরতার সুবিধাভোগী, এখন অন্য ধরনের কঠোরতার সুফল উপভোগ করতে পারে: ‘শরণার্থী শিবিরে আমাদের অপসারণগুলো লক্ষণীয় করা দরকার — এ ছাড়াও যদি নিরাপত্তা খরচ সত্যিই কমতে শুরু করে, তবে এটি লক্ষণীয় করা উচিত।’ ব্রিটেনের পিপস্কিক বোম্বারার্ডিয়ারের চিন্তাভাবনা অতুলনীয় নির্দেশের সঙ্গে সমাপ্তি টানে: ‘ব্যক্তিগতভাবে যতটা সম্ভব আমার এর সঙ্গে যুক্ত হওয়া উচিত।১৬ আমরা বিশের দশকে পিয়াজা ডি  ভেনেজিয়াতে থাকতে পারতাম।

কোনো টেকসই সমাধানের আশা ছাড়াই  এটি যে সব ধ্বংসলীলা সৃষ্টি করেছে, তার জন্য ইরাকের পরিণতির তুলনায় বলকান অঞ্চলে হস্তক্ষেপের ফলাফল ম্লান হয়ে গেছে। সেখানে নিরীহ মানুষের ওপর নিশ্চিত গণহত্যা হয়েছে। এ ব্যাপারে নেতাদের অবস্থা দেখা যাক। ক্লিনটন এবং ব্লেয়ার ব্যক্তিগতভাবে তাদের যৌথ ‘বিশ্বাসযোগ্যতা’ বাঁচাতে কয়েক হাজার ছোট শিশুকে নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী।  যদি আমরা পাঁচ বছরের কম বয়সী ৩ লাখ শিশুর একটি রক্ষণশীল পরিসংখ্যান নিই এবং ২ লাখ প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে অকালমৃত্যুর একটি অস্থায়ী  অনুমান যোগ করি, তাহলে আমরা বিগত ত্রৈমাসিক শতাব্দীর বৃহত্তম একটি গণহত্যাতে পৌঁছে যাই। ডেনিস হ্যালিডে মোট সংখ্যাকে অনেক বেশি ধরেন, ১০ লাখ বা তারও বেশি। 

তুলনায় উপসাগরীয় যুদ্ধ ছোটই: তাতে ৫০ হাজার জনের বেশি নিহত হয়নি। ইরান আক্রমণ সাদ্দামের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী অপরাধ ছিল। এর ফলে তার নিজের ২ লাখ মানুষ নিহত হয়। পশ্চিমা সহযোগীরা তা উপভোগ করেছিল। রুয়ান্ডায় গণহত্যা প্রায় ৫ লাখ মানুষকে নিশ্চিহ্ন করেছে। ইরাক অবরোধের ফলে মৃত শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্কদের সংখ্যা একইরকম বলা যায়। আমরা যদি আরও সঠিক রাজনৈতিক জবাবদিহি চাই, তাহলে ১৯৯২ সাল থেকে ক্লিনটনের ক্ষমতাকালে  — মৃতদের নয়-দশমাংশ, এবং — ১৯৯৭ সাল থেকে ব্লেয়ারের  দায়িত্বের অধীন – মৃতদের  দুই-পঞ্চমাংশ হিসাবে ভাগ করা যেতে পারে । যেহেতু আমেরিকা ও ব্রিটেন না থাকলে অবরোধ অনেক আগেই উঠে যেত, সেহেতু অন্য পশ্চিমা নেতাদের  নিন্দনীয় ভূমিকা  বিবেচনার বাইরে রাখা যায়। 

১৯৬৪ সালে, উইলসন সরকার ক্ষমতায় আসার কয়েক মাসের মধ্যে, সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক তাত্ত্বিক রাল্ফ মিলিব্যান্ড ষাটের দশকের প্রজন্মকে সতর্ক করেছিলেন। এই প্রজন্মের অনেকেই তেরো বছরের রক্ষণশীল শাসনের সমাপ্তিতে গর্বিত এবং লেবার পার্টির প্রগতিশীল প্রশাসনের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ সংস্কারের প্রত্যাশা করছিল। কিন্তু ইতোমধ্যেই লেবার পার্টির পররাষ্ট্র নীতি যে ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়েছিল সে ব্যাপারে তারা অসচেতন ছিল।  মিলিব্যান্ড ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, এই সম্পর্ক সম্ভবত শাসনের পুরো অভিজ্ঞতা নির্ধারণ করবে। এক বছরের মধ্যে তিনি সঠিক প্রমাণিত হন। জনসন ১৯৬৫ সালে যখন  ভিয়েতনামে মার্কিন অভিযাত্রী বাহিনী প্রেরণ করলেন, উইলসন এই আক্রমণকে সমর্থন করলেন। এই ঘটনা লেবার পার্টির মধ্যে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক পচন শুরু করেছিল।

এক দশকের অনুর্বর অফিসের পর একটি জঘন্য সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের সঙ্গে দাসত্বমূলক যোগসাজশের ফলে পুরোনো লেবার পার্টির করুণ পরিণতি  অবধারিত  হয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে সংগ্রাম জনসনের  এবং শেষ পর্যন্ত, পরোক্ষভাবে, নিক্সনেরও ইতি টেনেছিল। উইলসন, ক্যালাঘান এবং তাদের  সহকর্মীদের প্রতি ব্রিটেনে মোহভঙ্গ প্রবীণদের এবং  পঁচিশ বছরের কম বয়সী যে কোনো মানুষের ঘৃণা নিশ্চিত করেছিল। 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে সংগ্রাম জনসনের  এবং শেষ পর্যন্ত, পরোক্ষভাবে, নিক্সনেরও ইতি টেনেছিল। উইলসন, ক্যালাঘান এবং তাদের  সহকর্মীদের প্রতি ব্রিটেনে মোহভঙ্গ প্রবীণদের এবং  পঁচিশ বছরের কম বয়সী যে কোনো মানুষের ঘৃণা নিশ্চিত করেছিল।

ইরাক অবরোধ আরেকটি ভিয়েতনাম যুদ্ধের মতো নয়। এর লক্ষ্য, স্কেল এবং রসদ সবই তুলনায় কম। তবে আরেকটি  পার্থক্যও রয়েছে। এবার আমেরিকান বর্বরতাকে ব্রিটেন শুধু কূটনৈতিক ও আদর্শিক সমর্থন দিচ্ছে না, এটি একটি সামরিক কনফেডারেট হিসেবে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছে। পুরাতন লেবার পার্টির লজ্জাজনক রেকর্ড তার উত্তরসূরির জঘন্যতার তুলনায় সামান্যই ছিল।  

১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনার পর, পেন্টাগনের সামরিক পরিকল্পনাকারীরা আবারও সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতা থেকে অপসারণের প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। ইরাকের বিরুদ্ধে নতুন যুদ্ধ শুরু হলে তথাকথিত ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ বিপরীত ফলাফল তৈরি করবে। ক্রোধ এবং হতাশার সংমিশ্রণে আরব বিশ্বে এবং অন্যত্র আরও বেশি সংখ্যক তরুণ মনে করবে যে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের একমাত্র উত্তর হলো ব্যক্তিসন্ত্রাস৷

ফাতেমা বেগম: লেখক শিক্ষক অনুবাদক। ই-মেইল: fatemaorama@gmail.com

তথ্যসূত্র ও পাদটীকা

১।  নিজার কাব্বানি পাবলিকেশন্স, প্রথম প্রকাশনা, বৈরুত, ১৯৮৮।

২। হ্যান্সার্ড। ২৪ মে ২০০০।

৩। স্টিভেন লি মায়ার্স, ‘ইন ইনটেনস বাট লিটল-নোটিসড ফাইট, এলাইস হ্যাভ বোম্বড ইরাক অল ইয়ার’, নিউ ইয়র্ক টাইমস, ১৩ আগস্ট ১৯৯৯। এর জন্য এবং আরও অনেক কিছুর জন্য দেখুন, অ্যান্থনি আর্নভ’স: ইনট্রোডাকশন টু আর্নভ (সম্পাদিত), ইরাক আন্ডার সিজ: দ্য ডেডলি ইমপ্যাক্ট অব স্যাংশনস অ্যান্ড ওয়ার, লন্ডন অ্যান্ড কেমব্রিজ, এমএ, ২০০২, পৃষ্ঠা: ১১-১৩।

৪। পিটার পেলেট, ‘স্যাংশনস, ফুড, নিউট্রিশন অ্যান্ড হেলথ ইন ইরাক,’  ইন ইরাক আন্ডার সিজ, পৃ. ১৮৯।

৫। ইউএন রিপোর্ট অন দ্য কারেন্ট হিউম্যানেটারিয়ান সিচুয়েশন ইন ইরাক, মার্চ ১৯৯৯।

৬। রিচার্ড গারফিল্ড, ‘দি পাবলিক হেলথ ইমপেক্ট অব স্যাংশনস’, মিডল ইস্ট রিপোর্ট, নম্বর-২১৫, সামার ২০০০, পৃ. ১৭. গারফিল্ড কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল ইন্টারন্যাশনাল নার্সিংয়ের অধ্যাপক।

৭। ইউনিসেফ, ‘ইরাক সার্ভে শোস “হিউম্যানেটারিয়ান ইমারজেন্সি”, ১২ আগস্ট ১৯৯৯।

৮। গারফিল্ড, ‘দি পাবলিক হেলথ ইমপেক্ট অব স্যাংশনস’, পৃ. ১৭।

৯। আর্নভ  (সম্পাদিত), ইরাক আন্ডার সিজ, পৃ.  ৪৫, ৬৭।

১০। হারিস গাজদার এবং আতহার হোসেন, ‘ক্রাইসিস অ্যান্ড রেসপনস: এ স্টাডি অব দি ইমপ্যাক্ট অব ইকোনমিক  স্যাংশনস  ইন ইরাক’, এশিয়া রিসার্চ সেন্টার, লন্ডন স্কুল অক ইকোনমিকস, ডিসেম্বর ১৯৯৭।

১১। রিচার্ড গারফিল্ড, ‘চেঞ্জেস ইন হেলথ অ্যান্ড ওয়েল-বিইং ইন ইরাক ডিউরিং দ্য ১৯৯০’, ইন স্যাংশনস অন ইরাক – ব্যাকগ্রাউন্ড, কন্সিকুয়েন্সেস, স্ট্র্যাটেজিস। কেমব্রিজ ২০০০, পৃ. ৩৬।

১২।  বারবারা ক্রসেট , ‘ফর ইরাক, এ ডগ হাউজ উইথ ম্যানি রুমস’, নিউ ইয়র্ক টাইমস, ২৩ নভেম্বর ১৯৯৭।

১৩। সুহার্তো একজন প্রবীণ, সামরিক সমর্থিত ইন্দোনেশিয়ার নেতা এবং একজন মানুষ যিনি প্রতিবাদীদের দমন করার ভালো দক্ষতা রাখেন।   নিউ ইয়র্ক টাইমস প্রতিবেদনে তাকে তারকা আকর্ষণ  বলে।  সুহার্তো যখন শুক্রবার রাষ্ট্রপতির সঙ্গে একটি “ব্যক্তিগত” সফরের জন্য হোয়াইট হাউসে পৌঁছান, তখন কেবিনেট কক্ষে তাকে স্বাগত জানাতে শীর্ষ কর্মকর্তাদের ভিড়  ছিল। ভাইস প্রেসিডেন্ট গোর, সেক্রেটারি অব স্টেট ওয়ারেন ক্রিস্টোফারসহ সেখানে ছিলেন জয়েন্ট চিফস অব স্টাফের চেয়ারম্যান, জেনারেল জন শালিকাশভিলি; বাণিজ্য সচিব রোনাল্ড এইচ ব্রাউন; মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি, মিকি ক্যান্টর; জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা, অ্যান্টনি লেক এবং আরও অনেকে। “কক্ষে একটি খালি চেয়ারও ছিল না,” একজন অংশগ্রহণকারী বলেছিলেন। ” আগে কেউ ইন্দোনেশিয়ানদের সঙ্গে এ রকম আচরণ করত না। তাই বিশ্বে আমাদের অগ্রাধিকারগুলো কীভাবে পরিবর্তিত হয়েছে এই আচরণ সে ব্যাপারে একটি ধারণা দিয়েছিল।” দি নিউ ইয়র্ক টাইমস আরও জানায় যে, এগুলোর প্রকৃতি ও কারণ সম্পর্কে কোনো সন্দেহ নেই। সুহার্তোর নিয়ন্ত্রণে  ছিল, ‘চূড়ান্ত উদীয়মান বাজার: প্রায় ১৩,০০০টি দ্বীপ, ১৯৩ মিলিয়ন জনসংখ্যা এবং একটি অর্থনীতি যা বছরে ৭ শতাংশেরও বেশি হারে বাড়ছে।  দেশটি চরমভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত । সুহার্তোর পরিবার নেতৃস্থানীয় ব্যবসাগুলো পুরো নিয়ন্ত্রণ করতো, সেখানে জাকার্তার অন্য প্রতিযোগীদের টিকে থাকা কঠিন। তবে সুহার্তো ওয়াশিংটনকে খুশি রাখার বিষয়ে সচেতন ছিলেন। তিনি অর্থনীতিকে  বেসরকারিকরণ করেছেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য বাজার  উন্মুক্ত করেছেন এবং ইন্দোনেশিয়ার বৃহত্তম বিদেশি সাহায্যকারী জাপানিদেরকে  দেশে আমদানি করা পণ্যের এক-চতুর্থাংশের বেশি বাজার দখল করা থেকে বিরত রেখেছেন। তাই ক্লিনটন সরকারবিরোধী বিক্ষোভ অব্যাহত থাকা পূর্ব তিমুরে ইন্দোনেশিয়ার দমনমূলক কৌশল সম্পর্কে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ করেন, এবং নভেম্বরের মাঝামাঝি ওসাকায় বার্ষিক এশিয়ান প্যাসিফিক অর্থনৈতিক সহযোগিতার বৈঠকে উন্মুক্ত বাজারের অগ্রগতির জন্য সুহার্তোর সমর্থন পেয়ে ব্যবসায়িক হাত মেলান। প্রায়ই এশিয়ান নীতি নিয়ে কাজ করেন, প্রশাসনের এমন একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, ‘তিনি আমাদের ধরনের লোক।’

-ডেভিড স্যাঙ্গার , ‘রিয়েল পলিটিকস: হোয়াই সুহার্তো ইজ ইন অ্যান্ড ক্যাস্ট্রো ইজ আউট’, নিউ ইয়র্ক টাইমস, ৩১ অক্টোবর ১৯৯৫।

১৪। রবার্ট কুপার, দি পোস্ট-মডার্ন স্টেট অ্যান্ড ওয়ার্ল্ড অর্ডার, লন্ডন ১৯৯৬, পৃ. ৪২।

১৫। পূর্বোক্ত,  পৃ. ৪৪-৫.

১৬। ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বর এবং ২৯ এপ্রিল ২০০০-এর ‘টিবি’ থেকে স্মারকলিপি, ১৬ এবং ২৭ জুলাই ২০০০, টাইমস-এ প্রকাশিত। ‘অপরাধের বিরুদ্ধে আমাদের কঠোর ব্যবস্থাগুলো তুলে ধরতে হবে’, ‘প্রধানমন্ত্রী গভীর আবেগের সঙ্গে পুনর্ব্যক্ত করেছেন। তাৎক্ষণিক কঠিন আঘাত সিস্টেমের মাধ্যমে একটি বার্তা পাঠায় — হয়তো তরুণ অপরাধীদের জন্য ড্রাইভিং লাইসেন্সের জরিমানার মতো৷ তবে এটি অবিলম্বে করা উচিত এবং ব্যক্তিগতভাবে আমার এর সঙ্গে যুক্ত হওয়া উচিত।’ নথিগুলো ব্রিটেনের শাসকের মানসিক আসবাবপত্রের মজুত। তাকে বর্ণনা করা বাক্যাংশটি  আলেকজান্ডার ককবার্নের মূল্যবান উক্তি: কাউন্টারপাঞ্চ, ১৬-৩০ মে ১৯৯৯

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •